সিরাতুন নবী (সাঃ) || (পর্ব-২৮) || রাসুলুল্লাহ (সাঃ) কে হত্যা করতে গিয়ে আবু জাহল ভয়ে কম্পমান এবং সূরা কাফিরুন নাজিল ||






রাসুলুল্লাহ (সাঃ) কে হত্যা করতে গিয়ে আবু জাহল ভয়ে কম্পমান এবং সূরা কাফিরুন নাজিল



রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে হত্যা করতে গিয়ে আবূ জাহল ভয়ে কম্পমান

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যখন কুরাইশ নেতৃবৃন্দের নিকট হতে ফিরে আসলেন তখন আবূ জাহল কুরাইশ নেতৃবৃন্দের মধ্যে ঘোষণা দিয়ে বললো, ‘কুরাইশ ভ্রাতৃবৃন্দ। আপনারা সম্যকরূপে অবগত আছেন যে, মুহাম্মাদ (ﷺ) আমাদের ধর্মে কলঙ্ক রটাচ্ছে, আমাদের পূর্বপুরুষের নিন্দা করছে, আমাদের জ্ঞান বুদ্ধিকে খাটো বলে রটনা করছে এবং দেবদেবীগণের অবমাননা করছে। এ সব কারণে আল্লাহ তা’আলার শপথ করে বলছি যে, আমি এক খণ্ড ভারী এবং সহজে উঠানো সম্ভব এমন পাথর নিয়ে বসব এবং মুহাম্মাদ (ﷺ) যখন সিজদায় যাবে তখন সেই পাথর মেরে তার মাথা চূর্ণ করে ফেলব। এখন এ অবস্থায় তোমরা আমাকে এক অসহায় অবস্থায় ছেড়ে দাও, আর না হয় সাহায্য কর। বনু আবদে মানাফ এর পর যা চাই তা করুক’। উপস্থিত লোকেরা বলল, ‘আল্লাহর শপথ! আমরা তোমাকে অসহায় ছেড়ে দিতে পারি না। তুমি যা করার ইচ্ছে করেছ তা করে ফেল।

সকাল হলে আবূ জাহল তার ঘোষণার অনুরূপ একখণ্ড পাথর নিয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর অপেক্ষায় বসে থাকল। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যথা নিয়মে আগমন করলেন এবং সালাতে রত হলেন। কুরাইশগণও সেখানে উপস্থিত হয়ে আবূ জাহলের কথিত কাণ্ড দেখার জন্য অপেক্ষামান রইল। যখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সিজদায় গমন করলেন তখন আবূ জাহল পাথর উঠিয়ে তাঁর দিকে অগ্রসর হল, কিন্তু নিকটে পৌঁছে পরাস্ত সৈনিকের মতো স্ববেগে পশ্চাদপসরণ করল। এ সময় তাকে অত্যন্ত বিবর্ণ এবং ভীত সন্ত্রস্ত দেখাচ্ছিল। তার দু’হাত পাথরের সঙ্গে শক্তভাবে চিমটে লেগে গিয়েছিল। পাথরের গা থেকে হাত ছাড়াতে তাকে যথেষ্ট কষ্ট করতে এবং বেগ পেতে হয়েছিল।

এ দিকে কুরাইশগণের মধ্য থেকে কিছু সংখ্যক লোক দ্রুত তার নিকট এগিয়ে আসে এবং বলতে থাকে, আবূল হাকাম! ব্যাপারটি হল কী? কিছুই যেন বুঝে উঠছি না।

সে বলল, ‘আমি রাত্রিবেলা যা বলেছিলাম তা করার জন্যই এগিয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু যখন তাঁর নিকটে গিয়ে পৌঁছলাম তখন একটি উট আমার সামনে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াল। হায় আল্লাহ! কক্ষনো আমি এমন মস্তক, এমন ঘাড় এবং এমন দাঁতবিশিষ্ট উট দেখি নি। মনে হল সে যেন আমাকে খেয়ে ফেলতে চাচ্ছে।

ইবনে ইসহাক্ব বলেন, আমাকে বলা হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেছেন, ‘উষ্ট্রের রূপ ধারণ করে সেখানে ছিলেন জিবরাঈল (আঃ)। আবূ জাহল যদি আমার নিকট যেত তাহলে তার উপর বিপদ অবতীর্ণ হয়ে যেত।[১]

কাফির মুশরিকদের সমতা ও মধ্যপন্থা অবলম্বনের চেষ্টা

কুরাইশগণ বিভিন্নভাবে চেষ্টা-প্রচেষ্টা, ভীতি প্রদর্শন, হুমকি-ধমকি দিয়েও ব্যর্থ হলো এবং আবূ জাহল যে ন্যাক্কারজনক সংকল্প গ্রহণ করেছিল তা বিফল হলো তখন তারা সমস্যা থেকে উত্তোরণের নতুন কৌশল অবলম্বনের চিন্তা-ভাবনা করলো। তাদের মনে এ ধারণা ছিল না যে, মুহাম্মাদ (ﷺ) সত্য নাবী নয় বরং তাদের অবস্থান সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন, لَفِي شَكٍّ مِنْهُ مُرِيبٍ -তারা বিভ্রান্তিকর সন্দেহে রয়েছে। (সূরাহ শূরা : ১৪ আয়াত)

কাজেই তারা সিদ্ধান্ত নিল যে, দীনের বিষয়ে মুহাম্মাদের সাথে কিছু সমতা আনয়ন এবং মধ্যপন্থা অবলম্বনের। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কে কিছু বিষয় পরিত্যাগ করতে বলার চিন্তাভাবনা করলেন। এতে তারা ধারণা করলো যে, তারা এবার একটা প্রকৃত সিদ্ধান্তে আসতে পেরেছে যদিও রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সত্য বিষয়ের প্রতি আহবান করে থাকেন।

সূরা কাফিরুন নাজিল

ইবনে ইসহাক্ব বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কাবাহ গৃহ ত্বাওয়াফ করছিলেন এমতাবস্থায় আসওয়াদ বিন মুত্তালিব বিন আসাদ বিন আব্দুল উযযা, ওয়ালীদ বিন মুগীরাহ, উমাইয়া বিন খালাফ এবং আস বিন ওয়ায়িল সাহমী তার সামনে উপস্থিত হলেন। এঁরা সকলেই ছিলেন নিজ নিজ গোত্রের প্রধান। তাঁরা বললেন, ‘হে মুহাম্মাদ (ﷺ) এসো। তুমি যে মা’বুদের উপাসনা কর আমরাও সে মা’বুদের উপাসনা করি এবং আমরা যে মা’বুদের উপাসনা করি তোমরাও সে মা’বুদের উপাসনা কর। এরপর দেখা যাবে, যদি তোমাদের মা’বূদ কোন অংশে আমাদের মা’বূদ চেয়ে উন্নত হয় তাহলে আমরা সেই অংশ গ্রহণ করব, আর যদি আমাদের মা’বূদ কোন অংশে তোমার মা’বূদের চেয়ে উন্নত হয় তাহলে সেই অংশ তুমি গ্রহণ করবে। এ প্রেক্ষিতেই আল্লাহ তা’আলা সূরাহ কূল ইয়া আইয়্যুহাল কাফিরুন সম্পূর্ণ অবতীর্ণ করেন। যার মধ্যে জলদগম্ভীর সূরে ঘোষণা করা হয়েছে যে,

قُلْ يَا أَيُّهَا الْكَافِرُونَ لَا أَعْبُدُ مَا تَعْبُدُونَ

‘বল, ‘হে কাফিররা! ২. তোমরা যার ইবাদাত কর, আমি তার ইবাদাত করি না।' (আল-কাফিরূন ১০৯ : ১-২)[২]

আবদ বিন হুমায়েদ ও অন্যান্য হতে একটি বর্ণনা এভাবে রয়েছে যে, মুশরিকগণ প্রস্তাব করল যে, যদি আপনি আমাদের মাবূদকে গ্রহণ করেন তবে আমরাও আপনার আল্লাহর ইবাদত করব।[৩]

ইবনে জারীর এবং তাবারানীর এক বর্ণনায় রয়েছে যে, মুশরিকগণ নাবী কারীম (ﷺ)-এর নিকট প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন যে, যদি তিনি এক বছর যাবৎ তাদের মা’বূদের (প্রভুর) পূজা অৰ্চনা করেন তাহলে তারা নাবী (ﷺ)-এর প্রভু প্রতিপালকের ইবাদত (উপাসনা) করবে।

قُلْ أَفَغَيْرَ اللَّهِ تَأْمُرُونِّي أَعْبُدُ أَيُّهَا الْجَاهِلُونَ

“বল, ওহে অজ্ঞরা! তোমরা কি আমাকে আল্লাহ ছাড়া অন্যের ইবাদত করার আদেশ করছ?” (যুমার : ৬৪ আয়াত) আল্লাহ তা’আলা তাদের এহেন হাস্যকর কথার এমন স্পষ্ট ও দৃঢ় জবাব দেওয়ার পরও মুশরিকরা বিরত হলো না বরং আরো অধিক হারে এ ব্যাপারে প্রচেষ্টা করতে থাকল। এমনকি তারা এ দাবি করলো যে, মুহাম্মাদ যা নিয়ে এসেছে তার কিছু অংশ যেন পরিবর্তন করে। তারা বললো, ائْتِ بِقُرْآنٍ غَيْرِ هَٰذَا أَوْ بَدِّلْهُ

তারা বলে, ‘এটা বাদে অন্য আরেকটা কুরআন আন কিংবা ওটাকে বদলাও’। (সূরাহ ইউনুস : ১৫ আয়াত)

আল্লাহ তা’আলা নিম্নোক্ত আয়াত অবতীর্ণ করে তাদের দাবিকে প্রত্যাখ্যান করেন,

قُلْ مَا يَكُونُ لِي أَنْ أُبَدِّلَهُ مِنْ تِلْقَاءِ نَفْسِي إِنْ أَتَّبِعُ إِلَّا مَا يُوحَىٰ إِلَيَّ إِنِّي أَخَافُ إِنْ عَصَيْتُ رَبِّي عَذَابَ يَوْمٍ عَظِيمٍ

আল্লাহ তা’আলা আরো বলেন, বল, “আমার নিজের ইচ্ছেমত ওটা বদলানো আমার কাজ নয়, আমার কাছে যা ওয়াহী করা হয় আমি কেবল সেটারই অনুসরণ করে থাকি। আমি আমার প্রতিপালকের অবাধ্যতা করলে এক অতি বড় বিভীষিকার দিনে আমি শাস্তির ভয় করি”। (সূরাহ ইউনুস : ১৫ আয়াত)

আর এরকম কাজের মহাদুর্ভোগ সম্পর্কে সতর্ক করে আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন,

وَإِنْ كَادُوا لَيَفْتِنُونَكَ عَنِ الَّذِي أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ لِتَفْتَرِيَ عَلَيْنَا غَيْرَهُ وَإِذًا لَاتَّخَذُوكَ خَلِيلًا وَلَوْلَا أَنْ ثَبَّتْنَاكَ لَقَدْ كِدْتَ تَرْكَنُ إِلَيْهِمْ شَيْئًا قَلِيلًا إِذًا لَأَذَقْنَاكَ ضِعْفَ الْحَيَاةِ وَضِعْفَ الْمَمَاتِ ثُمَّ لَا تَجِدُ لَكَ عَلَيْنَا نَصِيرًا

“আমি তোমার প্রতি যে ওয়াহী করেছি তাথেকে তোমাকে পদস্থলিত করার জন্য তারা চেষ্টার কোন ত্রুটি করেনি যাতে তুমি আমার সম্বন্ধে তার (অর্থাৎ নাযিলকৃত ওয়াহীর) বিপরীতে মিথ্যা রচনা কর, তাহলে তারা তোমাকে অবশ্যই বন্ধু বানিয়ে নিত। - আমি তোমাকে দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত না রাখলে তুমি তাদের দিকে কিছু না কিছু ঝুঁকেই পড়তে। - তুমি তা করলে আমি তোমাকে এ দুনিয়ায় দ্বিগুণ আর পরকালেও দ্বিগুণ আযাবের স্বাদ আস্বাদন করাতাম। সে অবস্থায় তুমি তোমার জন্য আমার বিরুদ্ধে কোন সাহায্যকারী পেতে না।” (সূরাহ বানী ইসরাঈল : ৭৩-৭৪ আয়াত)

তথ্যসূত্রঃ
[১] ইবনে হিলমা ১ম খণ্ড ২৯৮-২৯৯ পৃঃ।
[২] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ৩৬২পৃঃ
[৩] ফাতহুল ক্বাদীর, ইমাম শাওকানী, ৫ম খণ্ড ৫০৮ পৃঃ।




*********************************************
সাইটটি ভিজিট করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আর্টিকেলটি ভাল লাগলে সত্য ও ন্যয়ের পথে অন্য ভাইনদেরকে দাওয়াতের নিয়তে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন। মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে এবং দীন ও মানবতার সেবায় অংশ নিতে OUR ACTION PLAN বাটনে ক্লিক করুন।



এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url