সিরাতুন নবী (সাঃ) || (পর্ব-৪২) || আক্বাবাহর দ্বিতীয় শপথে মদিনায় হিজরতের পরিকল্পনা ||





আক্বাবাহর দ্বিতীয় শপথ

নবুওয়াতের ত্রয়োদশ বর্ষে হজ্বের মৌসুমে (জুন, ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে) মদিনার সত্তর জনেরও অধিক মুসলিম ফরজ হজ্ব পালনের উদ্দেশ্যে মক্কায় আগমন করেন। তাঁরা নিজ সম্প্রদায়ের মুশরিক হজ্বযাত্রীগণের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। ইয়াসরিবের মধ্যে কিংবা মক্কার পথে ছিলেন এমন এক পর্যায়ে, তারা পরস্পর পরস্পরের মধ্যে বলাবলি করতে থাকলেন, ‘আমরা কতদিন আর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে এভাবে মক্কার পাহাড় সমূহের মধ্যে চক্কর ও ঠোক্কর খেতে ভীত-সন্ত্রস্ত অবস্থায় ফেলে রাখব?’

এ মুসলিমগণ যখন মক্কায় পৌঁছলেন তখন গোপনে নবী করীম (ﷺ)-এর সঙ্গে যোগাযোগ আরম্ভ করলেন এবং শেষ পর্যন্ত সর্বসম্মতিক্রমে এ কথার উপর সিদ্ধান্ত গৃহীত হল যে, আইয়ামে তাশরীকের[১] মধ্য দিবসে (১২ই জিলহজ্জ তারীখে) উভয় দল মিনায় জামরাই উলা, অর্থাৎ জামরাই আক্বাবাহর নিকটে যে সুড়ঙ্গ রয়েছে সেখানে একত্রিত হবেন এবং সে সমাবেশ গোপনে রাতের অন্ধকারে অনুষ্ঠিত হবে। এ ঐতিহাসিক সমাবেশ কিভাবে ইসলাম ও মূর্তিপূজার মধ্যে চলমান সংঘর্ষের মোড় পালটিয়ে দেয় তা একজন আনসার সাহাবীর নিকট থেকে প্রাপ্ত বিবরণ সূত্রে জানা যায়।

কা‘ব বিন মালিক (রাঃ) বলেছেন, ‘আমরা হজ্জের জন্য বের হলাম। আইয়াম তাশরীকের মধ্যবর্তী দিবাগত রাত্রে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সঙ্গে সাক্ষাতের সিদ্ধান্ত গৃহীত হল এবং শেষ পর্যন্ত নির্ধারিত সময় উপস্থিত হল। আমাদের সঙ্গে আমাদের অন্যতম প্রভাবশালী নেতা আব্দুল্লাহ বিন হারামও উপস্থিত ছিলেন (যিনি ইসলাম গ্রহণ করেন নি)। মুশরিকগণের মধ্যে একমাত্র তাঁকেই আমরা সঙ্গে নিয়েছিলাম। আমাদের সঙ্গে আগত অন্যান্য মুশরিকদের থেকে আমাদের কাজকর্ম ও কথাবার্তা গোপন রাখছিলাম। কিন্তু আব্দুল্লাহ বিন হারামের সঙ্গে আমাদের কথোপকথন ঠিকভাবেই চলছিল। আমরা তাকে বললাম, ‘হে আবূ জাবির! আপনি আমাদের একজন প্রভাবশালী এবং উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন নেতা। আপনার প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা ও ভালবাসার সূত্রে আমরা আপনাকে বর্তমান অবস্থা থেকে বের করে আনতে চাচ্ছি যাতে করে আপনি জাহান্নামের ভয়াবহ অগ্নিকুন্ডের ইন্ধন হয়ে না যান। এর পর তাঁকে আমরা ইসলামের দাওয়াত দিলাম এবং বললাম যে, ‘আজ ‘আক্বাবাহয় রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সঙ্গে আমাদের সাক্ষাতের কথাবার্তা আছে’’, তিনি ইসলাম গ্রহণ করলেন এবং আমাদের সাথে ‘আক্বাবাহয় গমন করলেন। তারপর তিনি আমাদের নেতা নির্বাচিত হলেন।

আক্বাবাহর দ্বিতীয় শপথে অংশগ্রহণকারীগণ

কা‘ব (রাঃ) ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দিতে গিয়ে বলেছেন, ‘আমরা এ রাতেও যথারীতি নিজ নিজ সম্প্রদায়ের সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়লাম। কিন্তু যখন রাত্রের তৃতীয় অংশ অতিবাহিত হল তখন আমরা নিজ নিজ তাঁবু থেকে বের হয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য নির্ধারিত স্থানে গেলাম যেমনটি পাখি নিজ বাসা থেকে নিজেকে জড়োসড়ো করে বের হয়। শেষ পর্যন্ত আমরা সকলে গিয়ে ‘আক্বাবাহয় একত্রিত হলাম। আমরা সংখ্যায় ছিলাম মোট পঁচাত্তর জন। তেহাত্তর জন্য পুরুষ এবং দু’জন মহিলা। মহিলা দু’জনের একজন ছিলেন উম্মু আম্মারা নাসীবা বিনতে কা‘ব। তিনি কাবিলা বনু মাযেন বিন নাজ্জারের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিলেন। দ্বিতীয় জন ছিলেন উম্মু মানী আসমা বিনতে ‘আমর। তিনি বনু সালামাহ গোত্রের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিলেন।

আমরা সকলে সুড়ঙ্গে একত্রিত হয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। শেষ পর্যন্ত সে আকাঙ্ক্ষিত মুহূর্ত এসে পড়ল এবং তিনি তশরীফ আনয়ন করলেন। সঙ্গে ছিলেন তার চাচা আব্বাস বিন আব্দুল মুত্তালিব। যদিও তিনি তখনো নিজ সম্প্রদায়ের ধর্মের উপরই প্রতিষ্ঠিত ছিলেন তবুও তিনি এটা চাচ্ছিলেন যে, আপন ভ্রাতুষ্পুত্রের সমস্যায় উপস্থিত থাকেন যাতে তাঁর পূর্ণ ইত্বমিনান হাসিল হয়ে যায়। তিনিই সর্বপ্রথম কথা বলা আরম্ভ করেন।[২]


আক্বাবাহর দ্বিতীয় শপথের আলোচনা

সভার প্রাথমিক কাজকর্ম সম্পন্ন হলে ধর্মীয় ও সামরিক সাহায্যকল্পে সন্ধি ও চুক্তির পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা তৈরির জন্য কথোপকথন আরম্ভ হল। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর চাচা আব্বাস (রাঃ) সর্বপ্রথম মুখ খুললেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল তাদের সম্পাদিত চুক্তির ফলে তাদের উপর যে দায়িত্ব কর্তব্য আরোপিত হয়েছে এবং পরিণামে যে নাজুক অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে তা ব্যাখ্যা করা।

কাজেই তিনি বললেন, ‘হে খাযরাজের লোকজন! (আরববাসীগণের নিকট আনসারদের মধ্যে দু’গোত্রের অর্থাৎ খাযরাজ এবং আউস, খাযরাজ নামেই পরিচিত ছিল) আমাদের মধ্যে মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর মর্যাদা ও অবস্থান সম্পর্কে তোমরা সকলেই ওয়াকেফহাল রয়েছ। ধর্মের ব্যাপারে আমরা যে মনোভাব পোষণ করি আমাদের সম্প্রদায়ের লোকজনও একই মনোভাব পোষণ করে। আমরা তাঁকে তাঁর বিরুদ্ধবাদীদের অনিষ্ট থেকে হেফাজত করে রেখেছি। তিনি এখন আপন আবাসস্থানে নিজ সম্প্রদায়ের মধ্যে মানসম্মান, শক্তি সামর্থ্য এবং হেফাজতের সঙ্গেই রয়েছেন। কিন্তু এখন তিনি তোমাদের সেখানে গিয়ে তোমাদের সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য সংকল্পবদ্ধ। এ অবস্থায় যদি এমনটি হয় যে, তোমরা তাঁর কাজকর্মে সাহায্য সহযোগিতা প্রদান করবে এবং তাঁর বিরুদ্ধবাদীদের অনিষ্ট থেকে তাঁকে রক্ষা করার জন্য সচেষ্ট থাকবে তাহলে সব ঠিক আছে, আপত্তির কোন কিছু নেই। তোমরা জিম্মাদারীর যে গুরুভার গ্রহণ করতে যাচ্ছ আশা করি তার গুরুত্ব সম্পর্কে তোমাদের সুস্পষ্ট ধারণা রয়েছে। কিন্তু এমনটি যদি হয় যে, তোমরা তাঁকে নিয়ে গিয়ে আলাদা হয়ে যাবে কিংবা প্রয়োজনে তোমরা তাঁর কোন উপকারে আসবে না তাহলে তাঁকে এখনি ছেড়ে দাও। কেননা, তিনি নিজ আবাসিক নগরীতে আপন সম্প্রদায়ের মধ্যে মান-সম্মান ও হেফাজতের সঙ্গেই রয়েছেন।

কা‘ব (রাঃ) বলেছেন যে, ‘আব্বাস (রাঃ)-কে বললাম, ‘আমরা আপনার কথা শুনেছি।’ তারপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে লক্ষ্য করে বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আপনি কথাবার্তা বলুন এবং নিজের জন্য ও নিজ প্রভূর জন্য যে সন্ধি ও চুক্তি করতে পছন্দ করেন তা করুন’’।[৩]

কা‘ব (রাঃ)-এর উত্তর থেকে এটা সহজেই অনুধাবন করা যায় যে, এ বিরাট জিম্মাদারী বহন করা এবং এর অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ও বিপজ্জনক পরিণতির ব্যাপারে আনসারগণের দৃঢ় সংকল্প, বাহাদুরী, ঈমান, উদ্যম ও খুলুসিয়াত কোন পর্যায়ের ছিল।

এর পর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কথাবার্তা বললেন। তিনি (ﷺ) প্রথমে কুরআন শরীফ থেকে কিছু অংশ তিলাওয়াত করলেন, আল্লাহর দ্বীনের দাওয়াত পেশ করলেন এবং ইসলামের প্রতি অনুরাগ সৃষ্টি করলেন। এরপর আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করলেন।

তথ্যসূত্রঃ
[১] যুল হিজ্জাহ মাসের ১১, ১২, ও ১৩ তারীখের আ্ইয়ামে তাশরীক বলা হয়।
[২] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ৪৪০ ও ৪৪১ পৃঃ।
[৩] ইবনে হিশাম ১/ ৪৪২ পৃঃ।




******************************************
>>> Welcome, You are now on Mohammadia Foundation's Website. Please stay & Tune with us>>>


এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url