//]]>

Win a Prize

Mohammadia Foundation https://www.mohammadiafoundationbd.com/2022/10/Siratunnabi50.html

সিরাতুন নবী (সাঃ) || (পর্ব-৫০) || হিজরতের উদ্দেশ্যে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর গৃহত্যাগ ||






সিরাতুন নবী (সাঃ) ৫০-তম পর্বের আলোচ্য বিষয়সমূহঃ

কুরাইশ মুশরিকগণ তাদের দুরভিসন্ধি বাস্তবায়নের জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়েও চরমভাবে ব্যর্থ হয়ে গেল। উন্মত্ত জিঘাংসু শত্রু পরিবেষ্টিত রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আলী (রাঃ)-কে বললেন, ‘তুমি আমার এ সবুজ হাযরামী[১] চাদর গায়ে দিয়ে আমার বিছানায় ঘুমিয়ে থাক। তারা তোমার ক্ষতি করতে পারবে না। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এ চাদর গায়ে দিয়েই শুয়ে থাকতেন।[২]

তারপর নবী করীম (ﷺ) গৃহের বাহিরে গমন করলেন এবং মুশরিকদের কাতার ফেড়ে এক মুষ্টি কংকরযুক্ত মাটি নিয়ে তাদের মাথার উপর ছড়িয়ে দিলেন। এর মাধ্যমে আল্লাহ তাদের দৃষ্টি দরে রাখলেন যার ফলে তারা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে আর দেখতে পেল না। এ সময় তিনি এ আয়াত কারীমাটি পাঠ করছিলেন,

‏(‏وَجَعَلْنَا مِن بَيْنِ أَيْدِيْهِمْ سَدًّا وَمِنْ خَلْفِهِمْ سَدًّا فَأَغْشَيْنَاهُمْ فَهُمْ لاَ يُبْصِرُوْنَ‏)‏ ‏[‏يس‏:‏9‏]

‘‘তাদের সামনে আমি একটা (বাধার) প্রাচীর দাঁড় করিয়ে দিয়েছি, আর পেছনে একটা প্রাচীর, উপরন্তু তাদেরকে ঢেকে দিয়েছি; কাজেই তারা দেখতে পায় না।’ (ইয়া সীন ৩৬ : ৯)

এ সময় এমন কোন মুশরিক বাকি ছিল না যার মাথায় তিনি মাটি নিক্ষেপ করেন নি। এরপর তিনি আবূ বাকর (রাঃ)-এর গৃহে গমন করলেন এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকে সঙ্গে নিয়ে ইয়ামান অভিমুখে যাত্রা করলেন। তারপর রাতের অন্ধকার থাকতেই তাঁরা মক্কা থেকে কয়েক মাইল দূরত্বে ‘সাওর’ নামক পর্বত গুহায় গিয়ে পৌঁছলেন।[৩]

এদিকে অবরোধকারীরা রাত ১২ টার অপেক্ষা করছিল। কিন্তু তার আগেই তাদের নিকট তাদের ব্যর্থতা ও অক্ষমতার সংবাদ পৌঁছে গেল। অবস্থা হল এই যে, তাদের নিকট এক আগন্তুক এসে তাদেরকে নবী (সাঃ)-এর দরজায় দাঁড়িয়ে থেকে জিজ্ঞেস করল ‘আপনারা কিসের জন্য অপেক্ষা করছেন? তারা বলল, ‘আমরা মুহাম্মাদ (ﷺ)-কে খতম করার অপেক্ষায় রয়েছি।

সে বলল, ‘উদ্দেশ্য সাধনে তোমরা সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছ। আল্লাহর কসম! কিছুক্ষণ পূর্বে মুহাম্মাদ (ﷺ) তোমাদের সম্মুখ দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছেন। যাওয়ার পূর্বে তিনি তোমাদের মাথার উপর এক মুষ্টি মৃত্তিকা ছড়িয়ে দিয়ে গিয়েছেন।’

তারা বলল, ‘আল্লাহর কসম! আমরা তো তাকে দেখিনি। এ বলে তারা মাথা ঝাড়তে ঝাড়তে দাঁড়িয়ে পড়ল। এরপর দারুণ হতাশা ও ক্রোধের সঙ্গে তারা দরজার ফাঁক-ফোকর দিয়ে গৃহের মধ্যে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে থাকল। চাদর জড়ানো অবস্থায় শায়িত আলী (রাঃ) দৃষ্টি গোচর হলে তারা বলতে লাগল, ‘আল্লাহর কসম! এই তো মুহাম্মাদ (ﷺ) শুয়ে আছে।’ তিনি শুয়ে আছেন এ ভ্রান্ত বিশ্বাস নিয়েই তারা সেখানে সকালের জন্য অপেক্ষা করতে থাকল। এ দিকে যখন সকাল হল এবং আলী (রাঃ) বিছানা ছেড়ে উঠলেন তখন তারা বুঝতে পারল যে, সত্যি সত্যিই মুহাম্মাদ (ﷺ)-নেই। তারা অত্যন্ত ক্রদ্ধ এবং বিক্ষুব্ধ কণ্ঠে আলী (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করল, ‘মুহাম্মাদ (ﷺ) কোথায়’’? হযরত আলী (রাঃ) বললেন, ‘‘আমি জানিনা।’’


গৃহ থেকে সওর গুহা পর্যন্ত

রাসূলুল্লাহ ২৭শে সফর চতুর্দশ নবুওয়াত সাল মোতাবেক ১২/১৩ই সেপ্টেম্বর, ৬২২[৪] খ্রিষ্টাব্দ মধ্যরাতের সামান্য কিছু সময় পর নিজ গৃহ থেকে বাহির হয়ে জান-মালের ব্যাপারে সর্বাধিক নির্ভরযোগ্য সঙ্গী আবূ বকর (রাঃ)-এর গৃহে গমন করেছিলেন এবং সেখান থেকে পিছনের একটি জানালা দিয়ে বাহির হয়ে দুজনই পথ বেয়ে অগ্রসর হতে থাকেন যাতে রাতের অন্ধকার থাকতেই তারা মক্কা নগরীর বাহিরে চলে যেতে সক্ষম হন। কারণ, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) জানতেন যে, কুরাইশগণ তাঁকে দেখতে না পেলে সর্বশক্তি দিয়ে তার সন্ধানে লেগে পড়বে এবং সর্বপ্রথম যে রাস্তায় দৃষ্টি দেবে তা হচ্ছে মদীনার কর্মব্যস্ত রাস্তা যা উত্তর দিকে গেছে। এ জন্য তাঁরা সেই পথে যেতে থাকলেন যে পথটি ছিল সেই পথের সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী। অর্থাৎ ইয়ামান যাওয়ার পথ যা মক্কার দক্ষিণে দিকে অবস্থিত ছিল। এ পথ ধরে পাঁচ মাইল দূরত্ব অতিক্রম করে সুপ্রসিদ্ধ সওর পর্বতের পাদদেশে গিয়ে পৌঁছলেন। এ পর্বতটি ছিল খুব উঁচু, পর্বত শীর্ষে আরোহণের পথ ছিল আঁকা-বাঁকা ও পাক জড়ানো। আরোহণের ব্যাপারটিও ছিল অত্যন্ত আয়াস-সাধ্য। এ পর্বত গাত্রের এখানে-সেখানে ছিল প্রচুর ধারালো পাথর যা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পদযুগলকে ক্ষত-কিক্ষত করে ফেলেছিল। বলা হয়েছে যে, তিনি পদচিহ্ন গোপন করার জন্য আঙ্গুলের উপর ভর দিয়ে চলছিলেন। এ জন্য তাঁর পা জখম হয়েছিল। যাহোক, আবূ বাকর (রাঃ)-এর সহায়তায় তিনি পর্বতের শৃঙ্গদেশে অবস্থিত গুহার পাশে গিয়ে পৌঁছলেন। এ গুহাটিই ইতিহাসে ‘গারে সওর বা সওর গুহা’ নামে পরিচিত।[৫]


সওর পর্বতের গুহায় তিন দিন তিন রাত্রি

গুহার নিকট উপস্থিত হয়ে আবূ বাকর (রাঃ) বললেন, ‘আল্লাহর ওয়াস্তে আপনি এখন গুহায় প্রবেশ করবেন না। প্রথমে আমি প্রবেশ করে দেখি এখানে অসুবিধাজনক কোন কিছু আছে কিনা। যদি তেমন কিছু থাকে তাহলে প্রথমে তা আমার সম্মুখীন হবে এবং এর ফলে আপনাকে প্রাথমিক অসুবিধার সম্মুখীন হতে হবে না। এ কথা বলার পর আবূ বাকর (রাঃ) গর্তের ভিতরে প্রবেশ করলেন এবং প্রথমে গর্তটি পরিষ্কার করে নিলেন। গর্তের এক পাশে কিছু ছিদ্র ছিল। নিজের কাপড় টুকরো টুকরো করে তিনি ছিদ্রপথের মুখগুলো বন্ধ করে দিলেন। কিন্তু কাপড়ের টুকরোর ঘাটতির কারণে দুটো ছিদ্র মুখ বন্ধ করা সম্ভব হল না। আবূ বাকর (রাঃ) ছিদ্র দুটোর মুখে নিজ পদদ্বয় স্থাপন করার পর ভিতরে আগমনের জন্য রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট আরয করলেন। তিনি ভিতরে প্রবেশ করে আবূ বাকর (রাঃ)-এর উরুতে মাথা রেখে শুয়ে পড়লেন এবং কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়লেন।

এদিকে আবূ বাকর (রাঃ)-এর পায়ে ছিদ্র মধ্যস্থিত স্বর্প কিংবা বিচ্ছু কোন কিছুতে দংশন করল। তিনি বিষে কাতর হয়ে উঠলেন অথচ নড়াচড়া করলেন না এ ভয়ে যে, এর ফলে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ঘুম ভেঙ্গে যেতে পারে। এদিকে বিষের তীব্রতায় তাঁর চক্ষু যুগল থেকে অশ্রু ঝরতে থাকল এবং সেই আশ্রু বিন্দু ঝরে পড়ল রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মুখমন্ডলের উপর। এর ফলে তাঁর ঘুম ভেঙ্গে গেলে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘আবূ বাকর (রাঃ)! তোমার কী হয়েছে?’’

তিনি আরয করলেন, ‘আমার মাতা-পিতা আপনার জন্য কুরবান হউক, গর্তের ছিদ্র পথে কোন কিছু আমার পায়ে কামড় দিয়েছে। এ কথা শ্রবণের পর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নিজের মুখ থেকে কিছুটা লালা নিয়ে সেই ক্ষতস্থানে লাগিয়ে দিলেন। ফলে আবূ বাকর (রাঃ)-এর দংশন জনিত বিষব্যথা দূরীভূত হল।[৬] এ পর্বত গুহায় তাঁরা উভয়ে একাদিক্রমে তিন রাত্রি (শুক্র, শনি ও রবিবার রাত্রি) অবস্থান করলেন।[৭] আবূ বাকর (রাঃ)-এর পুত্র আব্দুল্লাহও ঐ সময় একই সঙ্গে সেখানে রাত্রি যাপন করতেন। ‘আয়িশাহ (রাঃ)-এর বর্ণনাতে তিনি ছিলেন একজন কর্মঠ, বুদ্ধিমান ও ধীশক্তিসম্পন্ন যুবক। সকলের অগোচরে রাত গভীর হলে তিনি সেখানে যেতেন এবং সাহরী সময়ের পূর্বেই মক্কায় ফিরে এসে মক্কাবাসীগণের সঙ্গে মিলিত হতেন। এতে মনে হতো যেন তিনি মক্কাতেই রাত্রি যাপন করেছেন। গুহায় আত্মগোপনকারীগণের বিরুদ্ধে মুশরিকগণ যে সকল ষড়যন্ত্র করত তা অত্যন্ত সঙ্গোপনে তিনি তাঁদের নিকট পৌঁছিয়ে দিতেন।

এদিকে আবূ বাকর (রাঃ)-এর গোলাম ‘আমির বিন ফুহাইরা পর্বতের ময়দানে ছাগল চরাত এবং যখন রাত্রির এক অংশ অতিবাহিত হয়ে যেত তখন সে ছাগল নিয়ে গারে সওরের নিকটে যেত এবং আত্মগোপনকারী নবী (ﷺ) এবং তাঁর সাহাবীকে (রাঃ) দুগ্ধ পান করাত। আবার প্রভাত হওয়ার প্রাক্কালে সে ছাগলের পাল নিয়ে দূরে চলে যেত। পরপর তিন রাত্রেই সে এরূপ করল।[৮] অধিকন্তু, আব্দুল্লাহ বিন আবূ বকরের গমনাগমন পথে তাঁর পদ চিহ্নগুলো যাতে মিশে যায় তার জন্য ‘আমির বিন ফুহাইরা সেই পথে ছাগল খেদিয়ে নিয়ে যেত।[৯]


তথ্যসূত্রঃ
[১] হাযমারাউতের (দক্ষিণ ইয়েমেনের) তৈরি চাদরকে হাযরামী চাদর বলা হয়।
[২] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ৪৮২-৪৮৩ পৃঃ।
[৩] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ৪৮৩ পৃঃ। যা’দুল মা’আদ ২য় খন্ড ৫২ পৃঃ।
[৪] রাহমাতুল্লিল আলামীন ১ম খন্ড ৯৫ পৃঃ। সফরের এ মাস চতুর্দশ নবুওয়াত বর্ষের ঐ সময় হবে যখন বৎসর আরম্ভ হবে মুহারম মাসে। আর যদি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যে মাসে নবুওয়াত প্রাপ্ত হয়েছিলেন সে মাস থেকে বৎসর গণনা করা হয়ে থাকে তাহলে তা ছিল নবুওয়াত ত্রয়োদশ বর্ষের সফর মাসে। সাধারণ ইতিহাসবিদগণ প্রথম হিসাবটি গ্রহণ করেছেন। আর যাঁরা দ্বিতীয়টি গ্রহণ করেছেন, তাঁরা ঘটনার ক্রমধারায় ভুল করেছেন। আমি মুহাররম থেকে বছরের শুরু ধরেছি।
[৫] রহমাতুল্লিল আলামীন ১ম খন্ড ৯৫ পৃঃ। শাইখ আবদুল্লাহ মুখাতসারুস ১৬৭ পৃঃ।
[৬] উমার বিন খাত্তাব থেকে ইমাম রাযীন একথা বর্ণনা করেছেন। এ রেওয়ায়েতে এটা আছে যে, মৃত্যুর প্রান্তকালে এ বিষ তাঁর দেহে প্রতিক্রিয়া করল এবং এটাই ছিল তাঁর মৃত্যুর প্রত্যক্ষ কারণ, মিশকাত ২য় খন্ড ৫৫৬ পৃঃ। বাবু মানাকেবে আবূ বকর দ্রঃ।
[৭] ফাতহুল বারী ৭ম খন্ড ৩৩৬ পৃঃ।
[৮] সহীহুল বুখারী ১ম খন্ড ৫৫৩-৫৫৪ পৃঃ।
[৯] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ৪৮৬ পৃঃ।





*********************************************
সাইটটি ভিজিট করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আর্টিকেলটি ভাল লাগলে সত্য ও ন্যয়ের পথে অন্য ভাইনদেরকে দাওয়াতের নিয়তে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন। মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে এবং দীন ও মানবতার সেবায় অংশ নিতে OUR ACTION PLAN বাটনে ক্লিক করুন।




অন্যদের সাথে শেয়ার করুন

0 Comments

দয়া করে নীতিমালা মেনে মন্তব্য করুন ??

CLICK n WIN

নটিফিকেশন ও নোটিশ এরিয়া