সিরাতুন নবী (সাঃ) ৫৯ || মদীনার মুশরিক নেতা আব্দুল্লাহ ইবনু উবাইকে মুসলিমদেরকে বের করে দেওয়ার জন্য কুরাইশদের পত্র দান ||






সিরাতুন নবী (সাঃ) ৫৯-তম পর্বের আলোচ্য বিষয়সমূহঃ
  • মদীনার মুশরিক নেতা আব্দুল্লাহ ইবনু উবাইকে কুরাইশদের পত্র দান
  • মুসমানদের জন্য মসজিদুল হারামের দরজা বন্ধ করার ঘোষণা
  • মদীনার মুহাজিরদেরকে কুরাইশদের ধমক


মদীনার মুশরিক নেতা আব্দুল্লাহ ইবনু উবাইকে কুরাইশদের পত্র দান

মক্কার কুরাইশ মুশরিকগণ মুসলিমদের উপর কিরূপ অন্যায় অত্যাচার ও নিপীড়ন নির্যাতনের পাহাড় ভেঙ্গে ছিল এবং যখন তারা মদীনায় হিজরত শুরু করেন তখন তারা তাদের বিরুদ্ধে কী ধরণের বিদ্বেষমূলক ব্যবস্থা অবলম্বন করেছিল তা ইতোপূর্বে বর্ণিত হয়েছে। যার ফলে তাদের ধনমাল ছিনিয়ে নেয়ার এবং সাধারণভাবে তারা হত্যার নির্দেশ প্রদানের যোগ্য হয়ে পড়েছিল। কিন্তু এরপরও তাদের অন্যায় আচরণ ও হঠকারিতামূলক কার্য-কলাপ বন্ধ হল না এবং তারা সে সব থেকে বিরতও থাকল না। পক্ষান্তরে, মুসলিমগণ তাদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে গিয়ে মদীনায় একটা নিরাপদ আশ্রয় লাভ করেছে এবং ধীরে ধীরে সুসংগঠিত ও শক্তি সঞ্চয় করে চলেছে। এটা প্রত্যক্ষ করে তাদের ক্রোধাগ্নি অতি মাত্রায় প্রজ্জ্বলিত হয়ে উঠল। তাই তারা আনসারদের নেতা আব্দুল্লাহ ইবনু উবাইকে প্রকাশ্য হুমকি সহকারে একটি পত্র লিখল যিনি তখন পর্যন্ত খোলাখুলি মুশরিক ছিলেন। তখন মদীনাবাসীগণের মধ্যে এমন এক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল যে, মদীনায় রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর আগমন সংঘটিত না হলে তারা তাকেই মুকুট পরিয়ে তাদের বাদশাহ নির্বাচিত করত। মুশরিকদের এ পত্রের সার সংক্ষেপ ছিল নিম্নরূপ :

তোমরা আমাদের কিছু সংখ্যক বিপথগামী লোককে আশ্রয় দিয়েছ, এজন্য আমরা আল্লাহর নামে শপথ করে বলছি যে, হয় তোমরা তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করে তোমাদের দেশ থেকে তাদেরকে বহিষ্কার করে দেবে, অন্যথায় সদল বলে তোমাদের উপর ভীষণভাবে আক্রমণ পরিচালিত করে তোমাদের যোদ্ধাদের হত্যা এবং মহিলাদের মান হানি করব।’[১]

এ পত্র পাওয়া মাত্রই আব্দুল্লাহ ইবনু উবাই তার ঐ মক্কাবাসী মুশরিক ভাইদের দির্দেশ পালনার্থে উঠে পড়ে লেগে গেল। যেহেতু তার অন্তরে এ বিশ্বাস বদ্ধমূল হয়েছিল যে, মদীনায় রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর আগমনের কারণেই তাকে মদীনার বাদশাহী থেকে বঞ্চিত হতে হয়েছে সেহেতু পূর্ব থেকেই সে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রতি হিংসায় জ্বলে পুড়ে মরছিল। এ কারণে কাল বিলম্ব না করে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বিরুদ্ধে সে তার মুশরিক ভাইদের একত্রিত করে ফেলল।

এ সংবাদ অবগত হয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাদের নিকট আগমন করলেন এবং তাদের সম্বোধন করে বললেন, ‘আমি দেখছি যে, কুরাইশদের হুমকি তোমাদের অন্তরে গভীরভাবে রেখাপাত করেছে। কিন্তু এটা তোমাদের অনুধাবন করা উচিত যে, তোমরা নিজেরাই নিজেদেরকে যে পরিমাণ ক্ষতির মুখে ঠেলে দিতে যাচ্ছ কুরাইশরা কোনক্রমেই তোমাদের সেই পরিমাণ ক্ষতি করতে সক্ষম হবে না। তোমরা কি তোমাদের পুত্র ও ভ্রাতাদের সঙ্গে নিজেরাই যুদ্ধ করতে চাও?’

নবী করীম (ﷺ)-এর এ কথা শ্রবণ করে তারা বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে।[২] কাজেই, আব্দুল্লাহ ইবনু উবাইকে তার প্রতিহিংসাজনিত যুদ্ধের সংকল্প থেকে তখনকার মতো বিরত থাকতে হয়। কারণ, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কথায় তার সঙ্গী সাথীদের যুদ্ধ স্পৃহা স্তিমিত হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু তা সত্ত্বেও কুরাইশদের সঙ্গে তার গোপন যোগাযোগ চলতে থাকে। কারণ, মুসলিম ও কাফিরদের মধ্যে বিবাদ বিসম্বাদ বাধিয়ে দেয়ার কোন সুযোগ হাতছাড়া করার ইচ্ছা তার আদৌ ছিল না। তাছাড়া ইহুদীদের সঙ্গেও সে যোগাযোগ রাখতে থাকে যাতে প্রয়োজন হলে তাদের কাছ থেকেও সাহায্য লাভ সম্ভব হয়। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সময়োচিত ও বিজ্ঞোচিত ব্যবস্থাপনার ফলে ঝগড়া বিবাদের প্রজ্জ্বলিত অগ্নিশিখা ক্রমান্বয়ে প্রশমিত হতে থাকে।[৩]


মুসমানদের জন্য মসজিদুল হারামের দরজা বন্ধ করার ঘোষণা

এরপর সা‘দ ইবনু মু’আয (রাঃ) উমরাহ করার উদ্দেশ্যে মক্কায় আগমন করেন এবং উমাইয়া ইবনু খালফের অতিথি হন। তিনি উমাইয়াকে সম্বোধন করে বলেন, ‘আমার জন্য এমন এক সময়ের ব্যবস্থা করে দাও যখন আমি নির্জনে বায়তুল্লাহর ত্বাওয়াফ করতে পারি। সেই মোতাবেক উমাইয়া খরতপ্ত দুপুরে তাকে নিয়ে পথে বের হলে পথে আবূ জাহলের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়ে যায়। সে উমাইয়াকে সম্বোধন করে বলে, ‘হে আবূ সাফওয়ান, তোমার সঙ্গে ঐ লোকটি কে?’

উত্তরে উমাইয়া বলল, ‘এ হচ্ছে সা‘দ (রাঃ)।’

আবূ জাহল তখন সা‘দ (রাঃ)-কে লক্ষ্য করে বলল, ‘আমি দেখছি যে, তুমি বড় নিরাপদে ত্বাওয়াফ করতে বের হয়েছ, অথচ তোমরা বেদ্বীনদেরকে আশ্রয় দিয়েছ এবং তাদেরকে সাহায্য করারও সিদ্ধান্ত নিয়েছ। আল্লাহর কসম! যদি তুমি আবূ সাফওয়ানের সঙ্গে না থাকতে তবে নিরাপদে ফিরে যেতে পারতে না।

তার একথা শুনে সা‘দ (রাঃ) উচ্চ কণ্ঠে বললেন, ‘দেখো আল্লাহর কসম! যদি তুমি আমার একাজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি কর তবে তোমার এমন কাজে আমি প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াব যা তোমাদের জন্য হবে অত্যন্ত ভয়াবহ এবং তা হবে মদীনার পাশ দিয়ে চলে যাওয়া বাণিজ্য পথটি।[৪]


মদীনার মুহাজিরদেরকে কুরাইশদের ধমক

কুরাইশ মুশরিকগণ মদীনার মুহাজিরদেরকে ধমকের সূরে বলে পাঠাল, ‘মক্কা হতে তোমরা নিরাপদে মদীনায় পালিয়ে যেতে পেরেছ বলে অহংকারে ফেটে পড় না যেন। এটুকু জেনে রেখ যে, মদীনায় চড়াও হয়েই তোমাদের ধ্বংস করে ফেলার ক্ষমতা আমাদের রয়েছে।[৫]

তাদের এ ধমক শুধু যে কথাবার্তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল তা নয়, বরং এ ব্যাপারে তারা গোপনে গোপনে তৎপরও ছিল। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাদের এ ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের কথা এমন এক গুরুত্বপূর্ণ সূত্র থেকে অবগত হয়েছিলেন যে, তিনি সতর্কতা অবলম্বন না করে পারেন নি। নিরাপত্তার খাতিরে হয় জাগ্রত অবস্থায় তিনি রাত্রি যাপন করতেন, নতুবা সাহাবীদের প্রহরাধীনে ঘুমোতেন। যেমনটি সহীহুল বুখারী এবং সহীহুল মুসলিম শরীফে ‘আয়িশাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেছেন, ‘মদীনায় আগমনের পর একদা রাত্রি বেলায় রাসূলুল্লাহ (ﷺ) জাগ্রত অবস্থায় ছিলেন এবং আকাঙ্ক্ষা পোষণ করছিলেন যে, আজ রাত্রে যদি তাঁর সাহাবীদের মধ্যে থেকে কোন ব্যক্তি এখানে এসে পাহারা দিতেন (তাহলে কতই না ভাল হতো)।

আমরা ঐ অবস্থাতেই ছিলাম এমন সময় অকস্মাৎ অস্ত্রের ঝনাঝনানি আমাদের কর্ণগোচর হল। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) প্রশ্ন করলেন, ‘কে’? উত্তরে শ্রুত হল ‘আমি সা‘দ ইবনু আবী অক্কাস’ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) জিজ্ঞেস করলেন, ‘এ গভীর রাত্রে তোমার এখানে আগমনের কারণ কী’? জবাবে তিনি বললেন, ‘আপনার সম্পর্কে আমার মনে বিপদের আশঙ্কা উদ্রেক হওয়ায় আপনাকে পাহারা দেয়ার উদ্দেশ্যে এসেছি।’ তার একথা শুনে তিনি তার জন্য দু‘আ করলেন এবং ঘুমিয়ে পড়লেন।[৬]

এটা স্মরণ রাখার বিষয় যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে পাহারা দেয়ার ব্যাপারটি শুধু কয়েকটি রাত্রির জন্য নির্দিষ্ট ছিল না, বরং এটা ছিল পর্যায়ক্রমিক এবং স্থায়ী ব্যবস্থা। ‘আয়িশাহ (রাঃ) হতে যেমনটি বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেছেন যে, রাত্রিকালে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে পাহারা দেয়া হতো। তারপর নিম্নের আয়াতটি অবতীর্ণ হয়ঃ

‏(‏وَاللهُ يَعْصِمُكَ مِنَ النَّاسِ‏)‏ ‏[‏المائدة‏:‏ 67‏]‏،

‘‘(হে রসূল!) মানুষ হতে আল্লাহ্ই তোমাকে রক্ষা করবেন।’ (আল-মায়িদাহ ৫ : ৬৭)

তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কুববা (ঘর বিশেষ) থেকে মাথা বের করে বললেন,

‏‏(‏يَا أَيُّهَا النَّاسُ، اِنْصَرِفُوْا عَنِّيْ فَقَدْ عَصَمَنِيْ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ‏)‏‏

‘‘হে জনমন্ডলী! তোমরা ফিরে যাও। মহামহিমান্বিত প্রভূ পরওয়ার দেগার আল্লাহ আমাকে নিরাপত্তা দান করেছেন।’’[৭]

আরব মুশরিকদের শত্রুতাজনিত এ বিপদ শুধুমাত্র রাসূলুল্লাহ (ﷺ) পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং তা মুসলিম সমাজের সকল সদস্য পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। যেমনটি উবাই ইবনু কা‘ব (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেছেন যে, যখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও তাঁর সাহাবীগণ (রাঃ) মদীনা আগমন করেন এবং আনসারগণ তাদের আশ্রয় দান করেন, তখন আরব মুশরিকগণ তাঁদেরকে একই কামান দ্বারা আক্রমণ করে। তাই না তাঁরা অস্ত্র ছাড়া রাত্রি যাপন করতেন, না অস্ত্র ছাড়া সকাল বেলা নিদ্রা থেকে জাগ্রত হতেন।

তথ্যসূত্রঃ
[১] সুনানে আবূ দাউদ, বাবু খাবারিন নাযীর।
[২] সুনানে আবূ দাউদ, বাবু খাবারিন নাযীর।
[৩] এ সম্পর্কে সহীহুল বুখারীর ২য় খন্ড ৬৫৫, ৬৫৬, ৯১৬ ও ৯২৪ পৃঃ।
[৪] সহীহুল বুখারী ২য় খন্ড, কিতাবুল মাগাযী ৫৬৩ পৃঃ।
[৫] রহমাতুল্লিল আলামীন প্রথম খন্ড ১১৬ পৃঃ।
[৬] সহীহুল মুসলিম শরীফ ২য় খন্ড, বাবু ফাযালি সা‘দ ইবনু আবী ওয়াক্কাস (রাঃ) ২৮০ পৃঃ এবং সহীহুল বুখারী বাবুল হারাসাতে ফিল গাযভে ফী সাবীলিল্লাহ ১ম খন্ড ৪০৪ পৃঃ।
[৭] জামীউত তিরমিযী, আবওয়াবুত তাফসীর ২য় খন্ড ১৩ পৃঃ।




******************************************
>>> Welcome, You are now on Mohammadia Foundation's Website. Please stay & Tune with us>>>

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url