মা’আরেফুল কোরআন-১৪ || সূরা আল-বাকারাহ, আয়াতঃ ২৫-২৭ || বাকারাহ ২৫-২৭ আয়াতের অর্থ ও তাফসীর ||






بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ

سورة البقرة

সূরা আল-বাকারাহ আয়াতঃ ২৫-২৭

কোরআনের অকাট্যতায় রিসালতের প্রমাণ

بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ
 وَ بَشِّرِ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ عَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ اَنَّ لَهُمۡ جَنّٰتٍ تَجۡرِیۡ مِنۡ تَحۡتِهَا الۡاَنۡهٰرُ ؕ کُلَّمَا رُزِقُوۡا مِنۡهَا مِنۡ ثَمَرَۃٍ رِّزۡقًا ۙ قَالُوۡا هٰذَا الَّذِیۡ رُزِقۡنَا مِنۡ قَبۡلُ ۙ وَ اُتُوۡا بِهٖ مُتَشَابِهًا ؕ وَ لَهُمۡ فِیۡهَاۤ اَزۡوَاجٌ مُّطَهَّرَۃٌ ٭ۙ وَّ هُمۡ فِیۡهَا خٰلِدُوۡنَ ﴿۲۵
اِنَّ اللّٰهَ لَا یَسۡتَحۡیٖۤ اَنۡ یَّضۡرِبَ مَثَلًا مَّا بَعُوۡضَۃً فَمَا فَوۡقَهَا ؕ فَاَمَّا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا فَیَعۡلَمُوۡنَ اَنَّهُ الۡحَقُّ مِنۡ رَّبِّهِمۡ ۚ وَ اَمَّا الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا فَیَقُوۡلُوۡنَ مَا ذَاۤ اَرَادَ اللّٰهُ بِهٰذَا مَثَلًا ۘ یُضِلُّ بِهٖ کَثِیۡرًا ۙ وَّ یَهۡدِیۡ بِهٖ کَثِیۡرًا ؕ وَ مَا یُضِلُّ بِهٖۤ اِلَّا الۡفٰسِقِیۡنَ ﴿ۙ۲۶
 الَّذِیۡنَ یَنۡقُضُوۡنَ عَهۡدَ اللّٰهِ مِنۡۢ بَعۡدِ مِیۡثَاقِهٖ ۪ وَ یَقۡطَعُوۡنَ مَاۤ اَمَرَ اللّٰهُ بِهٖۤ اَنۡ یُّوۡصَلَ وَ یُفۡسِدُوۡنَ فِی الۡاَرۡضِ ؕ اُولٰٓئِکَ هُمُ الۡخٰسِرُوۡنَ ﴿۲۷

সূরা আল-বাকারাহ, ২৫-২৭নং আয়াতের অর্থ

(২৫) আর হে নবী! যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকাজসমূহ করেছে, আপনি তাদেরকে এমন বেহেশতের সুসংবাদ দিন, যার পাদদেশে নহরসমূহ প্রবহমান থাকবে। যখনই তারা খাবার হিসেবে কোন ফল প্রাপ্ত হবে, তখনই তারা বলবে, এতো অবিকল সে ফলই যা আমরা ইতিপূর্বেও লাভ করেছিলাম। বস্তুত তাদেরকে একই প্রকৃতির ফল প্রদান করা হবে। এবং সেখানে তাদের জন্য শুদ্ধচারিণী রমণীকুল থাকবে। আর সেখানে তারা অনন্তকাল অবস্থান করবে। (২৬) আল্লাহ্ পাক নিঃসন্দেহে মশা বা তদূর্ধ্ব বস্তু দ্বারা উপমা পেশ করতে লজ্জাবোধ করেন না। বস্তুত যারা মু'মিন তারা নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করে যে, তাদের পালনকর্তা কর্তৃক উপস্থাপিত এ উপমা সম্পূর্ণ নির্ভুল ও সঠিক। আর যারা কাফির তারা বলে, এরূপ উপমা উপস্থাপনে আল্লাহ্র মতলবই বা কি ছিল। এর দ্বারা আল্লাহ্ তা'আলা অনেককে বিপথগামী করেন। আবার অনেককে সঠিক পথও প্রদর্শন করেন। তিনি অনুরূপ উপমা দ্বারা অসৎ ব্যক্তিবর্গ ভিন্ন কাকেও বিপথগামী করেন না। (২৭) (বিপথগামী ওরাই যারা আল্লাহর সঙ্গে অঙ্গীকারাবদ্ধ হওয়ার পর তা ভঙ্গ করে এবং আল্লাহ্ পাক যা অবিচ্ছিন্ন রাখতে নির্দেশ দিয়েছেন, তা ছিন্ন করে, আর পৃথিবীর বুকে অশান্তি সৃষ্টি করে। ওরা যথার্থই ক্ষতিগ্রস্ত।

সূরা আল-বাকারাহ, ২৫-২৭নং আয়াতের তফসীরের সার-সংক্ষেপ

আর আপনি সেসব লোককে যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকাজসমূহ সম্পাদন করেছে, এ সুসংবাদ দিয়ে দিন যে, তাদের জন্য নিঃসন্দেহে এমন বেহেশত রয়েছে, যার তলদেশে নহরসমূহ প্রবাহিত থাকবে। সেখানে যতবারই তাদেরকে কোন ফলজাত খাবার প্রদান করা হবে, ততবারই তারা এগুলো পূর্বপ্রাপ্ত ফলের অনুরূপ বলে মন্তব্য করবে। বস্তুত প্রতিবারেই তাদেরকে একই ধরনের ফল দেওয়া হবে এবং বেহেশতে তাদের স্ত্রীগণ সম্পূর্ণ নিষ্কলুষ ও পূত-পবিত্র হবে। আর সেখানে তারা অনন্তকাল বসবাস করতে থাকবে। প্রতিবার একই ধরনের ফলপ্রাপ্তি পরিপূর্ণ স্বাদ ও তৃপ্তি লাভে সহায়ক। (প্রতিবার অভিন্ন আকৃতিবিশিষ্ট ফল দেখে তারা মনে করবে, এতো প্রথমবারে প্রাপ্ত ফল ছাড়া অন্য কিছুই নয়। কিন্তু স্বাদে ও গন্ধে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ধরনের হবে বলে অত্যন্ত আনন্দদায়ক ও তৃপ্তিবর্ধক বলে প্রতিপন্ন হবে। )
আয়াতের পূর্বাপর সম্পর্ক ঃ পূর্ববর্তী আয়াতে ছিল কোরআন করীমের প্রতি অবিশ্বাসীদের শান্তির বর্ণনা। আলোচ্য আয়াতে কোরআন পাকের অনুসরণকারীদের জন্য বেহেশতে সংরক্ষিত বিস্ময়কর ও অভিনব ফলমূল ও অনিন্দ্যসুন্দরী স্বর্গীয় অপ্সরীদের সুসংবাদ প্রদান করা হয়েছে ।
কোরআন পাক যে আল্লাহর বাণী সে সম্পর্কে এ আপত্তি উত্থাপন করে কোন কোন বিরুদ্ধবাদী বলেছিল যে, এতে বিভিন্ন উপমা প্রদান প্রসঙ্গে মশা-মাছি প্রভৃতি তুচ্ছ ও নগণ্য বস্তুর অবতারণা করা হয়েছে। যদি এটি সত্য সত্যই আল্লাহ্র বাণী হতো, তবে এতে এরূপ নিকৃষ্ট বস্তুর উল্লেখ থাকত না। (এর উত্তরে বলা হয়েছে যে,) হ্যাঁ! যথার্থই আল্লাহ্ পাক মশা বা ততোধিক নগণ্য বস্তুর দ্বারাও উপমা প্রদান করতে লজ্জাবোধ করেন না। সুতরাং যারা ঈমান এনেছে (যাই হোক না কেন) তারা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস পোষণ করে যে, তাদের পালনকর্তা কর্তৃক উপস্থাপিত উপমাগুলো অত্যন্ত স্থানোপযোগী ও সম্পূর্ণ যুক্তিযুক্ত। বাকি কাফিরদের কথা-বন্ধুত সর্বাবস্থায়ই তারা বলতে থাকবে যে, এরূপ তৃচ্ছ উপমা দ্বারা আল্লাহ্ পাক কি উদ্দেশ্য সাধন করতে চান ? এরূপ উপমা দ্বারা আল্লাহ্ পাক অনেককে পথভ্রষ্ট করেন। আবার এরই মাধ্যমে অনেককে হেদায়েত প্রদান করেন। এতদ্বারা নিছক অবাধ্যজন ব্যতীত অন্য কাকেও পথচ্যুত করেন না। যারা আল্লাহ্ পাকের সাথে দৃঢ়ভাবে কৃত অঙ্গীকার ভঙ্গ করে (অর্থাৎ আযল দিবসের অঙ্গীকার, যার মাধ্যমে প্রত্যেকের আত্মাই আল্লাহ্ পাককে স্বীয় রব বা পালনকর্তা বলে স্বীকার করে নিয়েছিল) এবং আল্লাহ্ পাক যেসব সম্পর্ক অটুট রাখতে নির্দেশ দিয়েছেন সেগুলো ছিন্ন করে (শরীয়ত অনুমোদিত সম্পর্কই এর অন্তর্ভুক্ত। চাই তা আল্লাহ্ ও মানুষের মধ্যে বিরাজমান সম্পর্কই হোক; অথবা আত্মীয়-স্বজন বা সমগ্র মুসলমান অথবা বিশ্বমানবের মধ্যে অবস্থিত পারস্পরিক সম্পর্কই হোক) এবং ভূপৃষ্ঠে কলহ সৃষ্টি করে। (কুফর, আল্লাহ্ পাকের অস্তিত্বে অবিশ্বাস পোষণ ও অংশীদার নিরূপণ অশান্তি তো বটেই, তা ছাড়া তা কুফরেরই অবশ্যম্ভাবী ফল। অত্যাচার, অবিচারও এ অশান্তির অন্তর্ভুক্ত।) ফলত এরাই পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্ত। (ইহলৌকিক শান্তি ও স্বাচ্ছন্দ্য এবং পারলৌকিক সুখ ভোগের উপকরণ—সবই এদের নাগালের বাইরে। কারণ, হিংসুকের পার্থিব জীবন সর্বদা নানাবিধ তিক্ততা ও প্রতিকূলতায় পরিপূর্ণ থাকে।) 

সূরা আল-বাকারাহ, ২৫-২৭নং আয়াতের আনুষঙ্গিক জ্ঞাতব্য বিষয়

জান্নাতবাসীদেরকে একই আকৃতিবিশিষ্ট বিভিন্ন ফলমূল পরিবেশনের উদ্দেশ্য হবে পরিতৃপ্তি ও আনন্দ সঞ্চার। কোন কোন ভাষ্যকারের মতে ফলসমূহ পরস্পর সাদৃশ্যপূর্ণ হওয়ার অর্থ বেহেশতের ফলাদি আকৃতিগতভাবে ইহজগতে প্রাপ্ত ফলের অনুরূপই হবে, সেগুলো যখন জান্নাতবাসীদের মাঝে পরিবেশন করা হবে, তখন তারা বলে উঠবে, অনুরূপ ফল তো আমরা দুনিয়াতেও পেতাম। কিন্তু স্বাদ ও গন্ধ হবে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের। দুনিয়ার ফলের সঙ্গে তার কোন তুলনাই চলবে না, শুধু নামের মিল থাকবে।

জান্নাতে পুত-পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন স্ত্রী লাভের অর্থ, তারা হবে পার্থিব যাবতীয় বাহ্যিক ও গঠনগত ত্রুটি-বিচ্যুতি ও চরিত্রগত কলুষতা থেকে সম্পূর্ণযুক্ত এবং প্রস্রাব-পায়খানা, রজঃস্রাব, প্রসবোত্তর স্রাব প্রভৃতি যাবতীয় ঘৃণ্য বন্ধু থেকে একেবারে ঊর্ধ্বে। অনুরূপভাবে নীতিভ্রষ্টতা, চরিত্রহীনতা, অবাধ্যতা, প্রভৃতি আভ্যন্তরীণ ত্রুটি ও কদর্যতার লেশমাত্রও তাদের মধ্যে পাওয়া যাবে না।

পরিবেশে বলা হয়েছে যে, জান্নাতের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও ভোগ-বিলাসের উপকরণসমূহকে যেন দুনিয়ার পতনশীল ও ক্ষীয়মান উপকরণসমূহের ন্যায় মনে না করা হয়, যাতে যে কোন মুহূর্তে বিলুপ্তি ও ধ্বংসপ্রাপ্তির আশঙ্কা থাকে এবং জান্নাতবাসীরা অনন্তকাল সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের এই অফুরন্ত উপকরণসমূহ ভোগ করত বিমল আনন্দস্ফূর্তি ও চরম তৃপ্তি লাভ করতে থাকবেন।

আলোচ্য আয়াতে মু'মিনদের জান্নাতের সুসংবাদ লাভের জন্য ঈমানের সাথে সাথে সৎকাজেরও শর্ত আরোপ করা হয়েছে। তাই সৎকর্মহীন ঈমান মানুষকে এ সুসংবাদের অধিকারী করতে পারে না। যদিও কেবল ঈমানই স্থায়ী দোযখবাস হতে অব্যাহতি প্রদান করতে পারে। সুতরাং মু'মিন মত পাপীই হোক, কোন না কোন সময় দোষখ থেকে মুক্তি লাভ করে জান্নাতে প্রবেশ করবে। কিন্তু সৎকাজ ভিন্ন কেউ দোযখের শাস্তি থেকে সম্পূর্ণ অব্যাহতি লাভের অধিকারী হতে পারবে না। (রুহুল বয়ান)

কয়েক আয়াত পূর্বে দাবি করা হয়েছে যে, কোরআন করীমে কোন প্রকার সন্দেহের অবকাশ নেই। এ যে আল্লাহর বাণী এ সম্পর্কে কেউ যদি বিন্দুমাত্র সন্দেহ পোষণ করে, তবে তাকে কোরআনের ক্ষুদ্রতম সূরার অনুরূপ একটি সূরা প্রণয়ন করে পেশ করতে আহবান করা হয়েছে। আলোচ্য আয়াতসমূহে কোরআন অবিশ্বাসীদের এক অমূলক সন্দেহ বর্ণনাপূর্বক তা অপনোদন করা হয়েছে। সন্দেহটি এই যে, কোরআন শরীফে মশা-মাছির ন্যায় তুচ্ছ বস্তুর আলোচনাও স্থান লাভ করেছে। বস্তুত এটা মহান আল্লাহ্ ও তাঁর পবিত্র কালামের মর্যাদার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। এ গ্রন্থ প্রকৃতই যদি আল্লাহর বাণী হতো, তবে এরূপ নিকৃষ্ট ও তুচ্ছ বস্তুর আলোচনা স্থান পেত না। কারণ, কোন মহান সত্তা এ ধরনের নগণ্য বন্ধুর আলোচনা করতে লজ্জা ও অপমান বোধ করেন।

প্রত্যুত্তরে বলা হয়েছে যে, কোন তুচ্ছ ও নগণ্য বস্তুর উপমা অনুরূপ নগণ্য বন্ধুর মাধ্যমে দেয়াই অধিকতর যুক্তিযুক্ত ও বিবেকসম্মত। এতদুদ্দেশ্যে কোন ঘৃণ্য ও নগণ্য বস্তুর উল্লেখ সম্ভ্রম ও আত্মমর্যাদাবোধের মোটেও পরিপন্থী নয়। এ কারণেই আল্লাহ্ পাক এ ধরনের বস্তুসমূহের উল্লেখে মোটেও লজ্জাবোধ করেন না। সাথে সাথে এও ব্যক্ত করে দেয়া হয়েছে যে, এ ধরনের নির্বুদ্ধিতামূলক সন্দেহের উদ্রেক শুধু তাদের মনেই হতে পারে, যাদের মন-মস্তিষ্ক অবিরাম আল্লাহদ্রোহিতার ফলে সম্পূর্ণভাবে বুদ্ধি-বিবেচনা ও অনুধাবনশক্তি বিবর্জিত হয়ে পড়েছে। মু'মিনদের মন-মস্তিষ্কে এ ধরনের অবাস্তব সন্দেহের উদ্রেক কখনো হতে পারে না।

অতঃপর এর অন্য এক তাৎপর্য বিশ্লেষণ করে বলা হয়েছে যে, অনুরূপ উপমার মাধ্যমে মানুষের এক পরীক্ষাও হয়ে যায় এসব দৃষ্টান্ত দূরদর্শী চিন্তাশীলদের জন্য যোগায় হেদায়েতের উপকরণ। আর চিন্তাশক্তি বিবর্জিত দুর্বিনীতদের পক্ষে অধিকতর পথভ্রষ্টতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। পরিশেষে এ কথাও ব্যক্ত করা হয়েছে যে, মহান কোরআনে বর্ণিত এসব উপমার দ্বারা এমন উদ্ধত ও অবাধ্যজনই বিপথগামী হয়, যারা আল্লাহ্ পাকের সাথে কৃত অঙ্গীকার ভঙ্গ করে এবং যেসব সম্পর্ক আল্লাহ্ পাক অক্ষুণ্ণ রাখতে নির্দেশ দিয়েছেন, তারা তা ছিন্ন করে। যার পরিণামস্বরূপ ধরার বুকে অশান্তি বিস্তার লাভ করে ।

 بَعُوۡضَۃً فَمَا فَوۡقَهَا এর অর্থ মশা বা ততোধিক। এখানে অধিক বলে নিকৃষ্টতায় অধিক বুঝানো হয়েছে।

 یُضِلُّ بِهٖ کَثِیۡرًا ۙ وَّ یَهۡدِیۡ بِهٖ کَثِیۡرًا কোরআন পাক এবং এতে বর্ণিত উপমাসমূহের মাধ্যমে মানবকূলের হেদায়েতপ্রাপ্তি তো সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ব্যাপার, কিন্তু অনেককে বিপথগামী করার অর্থ কোরআন একদিকে যেমন তার প্রতি বিশ্বাসস্থাপনকারী ও তার অনুসারীদের জন্য হেদায়েতের মাধ্যম, অপরদিকে তার বিরুদ্ধাচারী ও অবিশ্বাসীদের জন্য পথচ্যুতির কারণও বটে। 
 فِسق - وَ مَا یُضِلُّ بِهٖۤ اِلَّا الۡفٰسِقِیۡنَ  এর শাব্দিক অর্থ বের হয়ে যাওয়া । শরীয়তের পরিভাষায় আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের গণ্ডি থেকে বের হয়ে যাওয়াকে  فِسق বলা হয়। আর আল্লাহ্র আনুগত্যের গণ্ডি থেকে বের হয়ে যাওয়া মহান স্রষ্টার অস্তিত্বে অবিশ্বাস পোষণের কারণেও হতে পারে, আচার-আচরণ ও কর্মগত অবাধ্যতার কারণেও হতে পারে। এজন্য  فِسق শব্দটি ‎كافِر এর স্থলেও ব্যবহৃত হয়ে থাকে। কোরআনের অধিকাংশ জায়গায় فٰسِقِیۡنَ শব্দ کٰفِرِیۡنَ অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে। পাপী মু'মিনদেরকেও فِسق (ফাসিক) বলে সম্বোধন করা হয়। ফিকাহ শাস্ত্রবিদগণের পরিভাষায় সাধারণত ফাসিক فِسق শব্দটি এ অর্থেই ব্যবহৃত হয়ে থাকে। তাঁদের পরিভাষায় ফাসিককে (فِسق) কাফির (‎كافِر)- এর সমার্থবোধক শব্দ হিসেবে দাঁড় করানো হয়েছে। যে ব্যক্তি কবীরা গুনাহে লিপ্ত হওয়ার পর তা থেকে তওবা করে না, বা অবিরাম সগীরা গুনাহে লিপ্ত থাকার ফলে সেটি তার অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়, সে ব্যক্তি ফিকাহ শাস্ত্রবিদগণের পরিভাষায় ফাসিক বলে পরিগণিত। আর যে ব্যক্তি এ ধরনের পাপ ও গর্হিত কাজ ঔদ্ধত্য সহকারে প্রকাশ্যভাবে করতে থাকে, সে ফাজির বলে আখ্যায়িত।

সুতরাং আয়াতের অর্থ দাঁড়ালো এই যে, কোরআন পাকে বর্ণিত এসব দৃষ্টান্তের মাধ্যমে অনেকেই সঠিক পথপ্রাপ্ত হয়, আবার অনেকের ভাগ্যে জোটে পথচ্যুতি। বিপথগামী শুধু সেসব লোকই হয়, যারা আল্লাহ্র প্রতি আনুগত্যের আওতা অতিক্রম করে। পক্ষান্তরে যাদের অন্তরে সামান্যতম আল্লাহভীতিও রয়েছে, তারা তা থেকে হেদায়েতই লাভ করে থাকেন ।

الَّذِينَ يَنْقُضُونَ عَهْدَ اللهِ مِنْ بَعْدِ مِیۡثَاقِهٖ .

কোন বিষয়ে দু'ব্যক্তির পারস্পরিক অঙ্গীকারের ভিত্তিতে কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়াকে আহদ (عَهۡدَ) বলা হয় । এ চুক্তি বা অঙ্গীকারকে যখন শপথের মাধ্যমে অধিকতর দৃঢ় করা হয়, তখন তাকে বলা হয় মীসাক میثاق । 

এ আয়াতে পূর্ববর্তী আয়াতের বিষয়বস্তুর বিশ্লেষণ এবং কোরআনের প্রতি অবিশ্বাসীদের করুণ পরিণতির বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। কোরআনের বর্ণিত উপমাসমূহের যৌক্তিকতা প্রসঙ্গে মুনাফিকরা যে আপত্তি উত্থাপন করেছে, তার ফলে যারা আল্লাহ্র প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন ও তাঁর নির্দেশ অনুসরণে পরান্মুখ কেবল তারাই দ্বিবিধ কারণে বিপথগামী হবে।

প্রথম কারণ-এ বিরুদ্ধাচারিগণ সৃষ্টির আদিলগ্নে আল্লাহ্ পাকের সাথে সমগ্র মানব কর্তৃক কৃত অঙ্গীকার ভঙ্গ করেছে। মানব জাতি এ জগতে আবির্ভূত হওয়ার পূর্বে মহান স্রষ্টা তাদের আত্মাগুলোকে একত্র করে সবার সামনে প্রশ্ন রেখেছিলেন যে, “আমি কি তোমাদের পালনকর্তা নই ?” প্রত্যুত্তরে অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে সবাই সমস্বরে স্বীকার করেছিল, “হ্যাঁ-মহান আল্লাহই আমাদের পালনকর্তা।”- আমরা যেন তাঁর আনুগত্যের সীমা একবিন্দুও লঙ্ঘন না করি, এই ছিল এ অঙ্গীকারের অবশ্যম্ভাবী দাবি।

মানব জাতিকে তাদের এ অঙ্গীকারের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া এবং তার বাস্তবায়ন পদ্ধতির সবিস্তার বিশ্লেষণ করার উদ্দেশ্যেই আল্লাহ্ পাকের পক্ষ থেকে যুগে যুগে পবিত্র আসমানী গ্রন্থসহ মহান নবী ও রাসূলগণের আবির্ভার ঘটেছে। যে ব্যক্তি এ অঙ্গীকার ভঙ্গ করে ফেলেছে, সে যে কোন পয়গম্বর বা আসমানী গ্রন্থের দ্বারা উপকৃত হবে, এ আশা কিভাবে করা যায় ?

দ্বিতীয় কারণ তারা সেসব সম্পর্কই ছিন্ন করেছে, যেগুলো আল্লাহ পাক অটুট রাখতে নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ্ পাক পিতা-মাতা ও অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন, নানাবিধ কাজ-কর্মের অংশীদার, গোটা মুসলিম জাতি বা বিশ্বমানবের সঙ্গে মানুষের যত প্রকার সম্পর্কের কথা বলেছেন, সেসবই আলোচ্য সম্পর্কের অন্তর্ভুক্ত। এসব সম্পর্ক যথার্থভাবে বজায় রাখার নামই ইসলাম। এক্ষেত্রে সামান্যতম অমনোযোগিতা ও অসাবধানতার দরুন বিশ্বময় অশান্তি ছড়িয়ে পড়ে। এজন্য বাক্যের শেষাংশে বলা হয়েছে।  وَ یُفۡسِدُوۡنَ فِی الۡاَرۡضِ অর্থাৎ, "এরা ধরার বুকে অশান্তি ঘটায়।” সবশেষে এদের করুণ পরিণতি বর্ণনা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, "এরাই সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত।”

উপমার ক্ষেত্রে কোন তুচ্ছ ও নগণ্য বস্তুর উল্লেখ দূষণীয় নয়

انَّ اللهَ لا يَسْتَحْى আয়াত দ্বারা প্রমাণ করা হয়েছে যে, কোন প্রয়োজনীয় বিষয়ের বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে কোন নিকৃষ্ট, নগণ্য ও ঘৃণ্য বস্তুর উল্লেখ কোন ত্রুটি বা অপরাধ নয় কিংবা বক্তার মহান মর্যাদার পরিপন্থীও নয় । কোরআন, হাদীস এবং প্রথম যুগের উলামায়ে কিরাম ও প্রখ্যাত ইসলাম বিশেষজ্ঞগণের বাণী ও রচনাবলীতে এ ধরনের বহু উপমার সন্ধান মেলে, যা সাধারণভাবে একেবারেই তুচ্ছ ও নগণ্য বলে মনে হয়। কোরআন-হাদীস এসব তথাকথিত লজ্জা ও সম্ভ্রমের তোয়াক্কা না করে প্রকৃত উদ্দেশ্যের প্রতি লক্ষ্য রেখে এরূপ উপমা বর্জন মোটেও বাঞ্ছনীয় বলে মনে করেনি ।

یَنۡقُضُوۡنَ عَهۡدَ اللّٰهِ (আল্লাহর সঙ্গে কৃত অঙ্গীকার ভঙ্গ করে—) এতে প্রমাণিত হয় যে, কোন অঙ্গীকার ভঙ্গ করা বা চুক্তি লঙ্ঘন করা জঘন্য অপরাধ। এর পরিণতিতে সে যাবতীয় পুণ্য থেকে বঞ্চিতও হয়ে যেতে পারে।

সম্পর্ক সংশ্লিষ্ট শরীয়তী বিধান মেনে চলা ওয়াজিব এবং তা লঙ্ঘন করা মারাত্মক অপরাধ وَيَقْطَعُونَ مَا أَمَرَ اللَّهُ بِهِ أَنْ يُوصَلَ  (এবং আল্লাহ্ পাক যে সব সম্পর্ক অটুট রাখতে বলেছেন, তারা তা ছিন্ন করে।) এতে বোঝা যায়, যে সব সম্পর্ক শরীয়ত অক্ষুণ্ণ রাখতে বলেছে, তা বজায় রাখা একান্ত আবশ্যক এবং তা ছিন্ন করা সম্পূর্ণ হারাম। গভীরভাবে চিন্তা করলে বোঝা যাবে যে, একজন মানুষের প্রতি আল্লাহ্র এবং অন্যান্য মানুষ তথা সমগ্র সৃষ্টিকুলের অধিকার ও প্রাপ্য আদায় করার নির্ধারিত পদ্ধতি ও তৎসংশ্লিষ্ট সীমা ও বাঁধনের সমষ্টির নামই দীন বা ধর্ম। বিশ্বের শান্তি ও অশান্তি এসব সম্পর্ক যথাযথভাবে বজায় রাখা বা না রাখার ওপরই নির্ভরশীল। না, وَ یُفۡسِدُوۡنَ فِی الۡاَرۡضِ (তারা ভূপৃষ্ঠে অশান্তির সৃষ্টি করে) বাক্যাংশের মাধ্যমে উল্লিখিত সম্পর্ক ক্ষুণ্ণ করাকেই বিশ্বশান্তি বিঘ্নিত হওয়ার একমাত্র কারণ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। বস্তুত এ হলো যাবতীয় অশান্তি ও কলহের মূল কারণ ।
اُولٰٓئِکَ هُمُ الۡخٰسِرُوۡنَ (তারাই প্রকৃত প্রস্তাবে ক্ষতিগ্রস্ত।) এ বাক্যের মাধ্যমে যারা উল্লিখিত নির্দেশাবলী অমান্য করবে তাদেরকে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এতে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, পরকালের ক্ষতিই প্রকৃত ক্ষতি। সে তুলনায় পার্থিব ক্ষতি উল্লেখযোগ্য কোন বিষয়ই নয়।




******************************************
Thank you for visiting the site. If you like the article, share it on social media to invite other Vines to the path of truth and justice. Click on OUR ACTION PLAN button to know about activities, goals and objectives of Mohammadia Foundation and to participate in the service of religion and humanity. 

Almost all articles on this website are written in Bengali. But you can also read it in your language if you want. Click the “ভাষা বেছে নিন” button at the bottom of the website to read in your own language.



এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url