সাহাবাগণের জীবনকথা-৪১ || হযরত মুসয়াব ইবন উমাইর (রাঃ) এর জীবনী || মুসয়াব (রা)






মুসয়াব ইবন উমাইর (রা)

হযরত মুসয়াব ছিলেন প্রখর মেধাবী, উলার ও প্রাঞ্জলভাষী বাগ্মী। যে দ্রুততার সাথে ইয়াসরিবে (মদীনা) ইসলাম প্রসার লাভ করেছিল তাতেই তার এসব গুণের প্রমাণ পাওয়া যায়। তার শাহাদাত পর্যন্ত যতটুকু কুরআন নাযিল হয়েছিল, তিনি মুখস্থ করেছিলেন। মদীনায় সর্বপ্রথম তিনিই জুময়ার নামায কায়েম করেন।



মুসয়াব (রা) এর নাম ও বংশ পরিচয়

নাম মুসাব, কুনিয়াত আবু মুহাম্মদ। ইসলাম গ্রহণের পর লকব হয় মুসয়াব আলখায়ের। পিতা 'উমাইর এবং মাতা খুনাস বিনতু মালিক। পিতা-মাতার পরম আদরে ঐশ্বর্যের মধ্যে লালিত মক্কার অন্যতম সুদর্শন যুবক ছিলেন তিনি। 

মুসয়াব (রা) ছিলেন অত্যন্ত সুদর্শন

মা সম্পদশালী হওয়ার কারণে অত্যন্ত ভােগ বিলাসের মধ্যে তাকে প্রতিপালন করেন। তখনকার যুগে মক্কার যত রকমের চমকার পােশাক ও উক্তৃষ্ট খুশবু পাওয়া যেত সবই তিনি ব্যবহার করতেন। রাসূলুল্লাহর (সা) সামনে কোনভাবে তার প্রসংগ উঠলে বলতেনঃ 'মক্কায় মুসয়াবের চেয়ে সুদর্শন এবং উৎকৃষ্ট পােশাকধারী আর কেউ ছিল না।' (তাবাকতি) ঐতিহাসিকরা বলেছেনঃ 'তিনি ছিলেন মক্কার সর্বোৎকৃষ্ট সুগন্ধি ব্যবহারকারী।


সৌন্দৰ্য, সুরুচি ও সৎ স্বভাবের সাথে সাথে আল্লাহ তাআলা তার অন্তরটি দারুণ স্বচ্ছ করে তৈরী করেছিলেন। তাওহীদের একটি মাত্র ঝলকেই তিনি শিরকের প্রতি বিতৃষ্ণ হয়ে ওঠেন এবং হযরত রাসূলে পাকের দরবারে হাজির হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। এ সেই সময়ের কথা যখন রাসূল (সা) হযরত আরকামের বাড়ীতে অবস্থান করে ইসলামের দাওয়াত দিয়ে চলেছিলেন এবং মুসলমানদের সামনে মক্কার মাটি সংকীর্ণ হয়ে উঠেছিলাে।

মুসয়াব (রা) এর ইসলাম গ্রহণ

মক্কার অলিতে-গলিতে, কুরাইশদের আগুড়ায়, পরামর্শ সভায় তখন একই আলােচনা মুহাম্মদ আল আমীন ও তার নতুন দ্বীন আল ইসলাম । কুরাইশদের এই আদুরে দুলাল এসব আলোচনা অত্যন্ত মনােযোগ সহকারে শুনতেন। অল্প বয়স্ক হওয়া সত্বেও তিনি হতেন কুরাইশদের সকল বৈঠক ও মজলিসের শােভা ও মধ্যমণি। তাদের প্রতিটি বৈঠকে সবার কাম্য হতাে তাঁর উপস্থিতি। তীক্ষ মেধা, প্রখর বুদ্ধিমত্তা ও ব্যক্তিত্ব ছিল তাঁর চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য। আর এ বৈশিষ্ট্য তার হৃদয়ের সকল দ্বার, সকল অর্গল উন্মুক্ত করে দেয়।'


তিনি শুনতে পেলেন, রাসূল (সা) ও তার প্রতি বিশ্বাসীরা কুরাইশদের সকল অর্থহীন কাজ ও তাদের যুলুম অত্যাচার থেকে দূরে থেকে সেই সাফা পাহাড়ের পাদদেশে আল আরকাম ইবন আবিল আরকামের বাড়ীতে সমবেত হন। সব দ্বিধা সব দ্বন্দ্ব ঝেড়ে ফেলে একদিন সন্ধ্যায় তিনি হাজির হলেন দারুল আরকামে। রাসূল (সা) সেই দিনগুলিতে সেখানে তার সাথীদের সংগে মিলিত হতেন, তাদেরকে কুরআন শিক্ষা দিতেন এবং তাদের সাথে নামায আদায় করতেন।

মুসয়াব ইবন উমাইর দারুল আরকামে বসতে না বসতেই কুরআনের আয়াত নাযিল হলাে। রাসূলের (সা) যবান থেকে সে আয়াত বের হয়ে তা যেন সকল শ্রোতার কর্ণকুহরে ও হৃদয়ের গভীরে প্রবেশ করতে লাগলাে। সেই বরকতময় সন্ধ্যায় ইবন "উমাইরও হয়ে গেলেন এক বিশ্বাসী অন্তঃকরণের অধিকারী। খুশী ও আনন্দে তিনি হয়ে পড়েন আত্মহারা। রাসূল (সা) তার একটি পবিত্র হাত বাড়িয়ে দিলেন মুসয়াবের বুকের ওপর। দারুণ এক প্রশান্তিতে বিভাের হয়ে পড়েন মুসয়াব । মুহূর্তে তিনি তাঁর বয়সের তুলনায় বহুগুণ বেশী হিকমত ও জ্ঞান লাভ করলেন এবং এমন দৃঢ়তা অর্জন করলেন যে হাজারো বিপদ মুসীবত তাকে আর কোনদিন বিন্দুমাত্র টলাতে পারেনি।

মুসয়বের মা খুনাস বিনতু মালিক ছিলেন এক প্রচণ্ড ব্যক্তিত্বের অধিকারিণী। মুসয়াব তাকে যমের মত ভয় করতেন। তিনি ইসলাম গ্রহণের পর ধরাপৃষ্ঠে একমাত্র তার মা ছাড়া আর কারাে ভয় পেতেন না। কুরাইশ ও তাদের দেব-দেবীসহ সকল শক্তি তাঁর কাছে তুচ্ছ মনে হলাে। কিন্তু মায়ের ভয় তিনি দূর করতে পারলেন না। তাই সিদ্ধান্ত নিলেন আল্লাহর চূড়ান্ত ফায়সালা না হওয়া পর্যন্ত ইসলাম গ্রহণের সংবাদটি চেপে যাওয়ার। দারুল আরকামে যাতায়াত চলতে লাগলাে। রাসলল্লাহর (সা) মজলিসে বসতে লাগলেন। কিন্তু তার মা কিছুই জানতে পেলেন না।


একদিন গোপনে তিনি দারুল আরকামে প্রবেশ করছেন, উসমান ইবন তালহা তা দেখে ফেললাে। আরেক দিন তিনি মুহাম্মদের (সা) মত নামায পড়ছেন, সেদিনও তা উসমানের চোখে পড়ে যায়। বাতাসের আগে খবরটি মক্কার অলিতে গলিতে ছড়িয়ে পড়লাে। তার মায়ের কানেও খবরটি পৌছে গেল।

মুসয়াবের (রাঃ) হাবশায় হিজরত

মুসয়াবকে তার মা, গোত্রের লােকজন ও মক্কার নেতৃবৃন্দের সামনে কাঠগড়ায় দাঁড় করানাে হলাে। তিনি অত্যন্ত স্থির বিশ্বাস ও প্রশান্ত চিত্তে তাদেরকে পাঠ করে শুনাতে লাগলেন কুরআনের সেই মহাবাণী যার ওপর তিনি ঈমান এনেছেন। মা তার গালে থাপ্পড় মেরে চুপ করিয়ে দিতে চাইলেন। বকাঝকা, মারপিট চললাে। তারপর তাকে ঘরে বন্দি করে রাখা হলো।
তিনি বন্দী অবস্থায় কাটাতে লাগলেন। রাত্রিদিন চব্বিশ ঘন্টা তাঁকে পাহারা দেয়া হয়। এর মধ্যে তিনি খবর পেলেন, তাঁরই মত কিছু মুমিন মুসলমান হাবশায় হিজরত করছেন। তিনি মায়ের চোখে ধুলাে দিয়ে সেই দলটির সাথে হাবশায় চলে গেলেন।

একদিন মুসলমানদের একটি দল রাসূলুল্লাহর (সা) পাশে বসে আছেন। এমন সময় পাশ দিয়ে তারা মুসয়াবকে যেতে দেখলেন। তাকে দেখেই বৈঠকে উপস্থিত সকলের মধ্যে ভাবান্তর সৃষ্টি হলাে। তাদের দৃষ্টি নত হয়ে গেল। কারাে কারাে চোখে পানি এসে গেল। কারণ, মুসয়াবের গায়ে 'তখন শত তালি দেওয়া জীর্ণ শীর্ণ একটি চামড়ার টুকরাে। তাতে মারাত্মক দারিদ্রের ছাপ সুস্পষ্ট। তাদের সকলের মনে তখন তার ইসলাম পূর্ব জীবনের ছবি ভেসে উঠলো। তখনকার পরিচ্ছদ হতাে বাগিচার ফুলের মত কোমল চিত্তাকর্ষক ও সুগন্ধিময়। এ দৃশ্য দেখে একটু মুচকি হেসে রাসূল (সা) বললেন মক্কায় আমি এ মুসয়াবকে দেখেছি। তার চেয়ে পিতামাতার বেশী আদরের আর কোন যুবক মক্কায় ছিল না। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের মুহাব্বতে সবকিছু সে ত্যাগ করেছে। | কিছুদিন হাবশায় থাকার পর তিনি মক্কায় ফিরে এলেন। তারপর রাসূলুল্লাহর (সা) নির্দেশে আরেকটি দলকে সংগে করে হাবশায় চলে যান। কিন্তু মুসয়াব উপলব্ধি করেছিলেন, তিনি মক্কায়, হাবশায় যেখানেই থাকুন না কেন, জীবন তার নতুন-রূপ ধারণ করেছে। তার একমাত্র অনুকরণীয় আদর্শ ব্যক্তি মুহাম্মাদ (সা) এবং একমাত্র কাম্য মহাপ্রভু আল্লাহর সন্তুষ্টি।


তার মা নতুন দ্বীন থেকে ফিরাতে ব্যর্থ হয়ে তাঁকে সবকিছু দেওয়া বন্ধ করে দিল। যে ব্যক্তি তাদের দেব-দেবীকে ছেড়ে দিয়েছে, তাদের গালাগাল করে, তা সে নিজের পেটের ছেলেই হোকনা কেন, তাকে সে কোন মতেই খেতে পরতে দিতে পারে না।

মুসয়াব হাবশা থেকে ফিরে আসার পর তার মা আবারাে তাকে বন্দী করতে চাইলাে। তিনি মায়ের মুখের ওপর কসম খেয়ে বললেনঃ যদি তুমি এমনটি কর এবং যারা তােমার এ কাজে সাহায্য করবে তোমাদের সবাইকে আমি হত্যা করবাে। মা তার এই বেয়াড়া ছেলেকে জানতাে। তাই কাঁদতে কাঁদতে তাঁকে বিদায় দিল, আর তিনিও মাকে কাঁদতে কাঁদতে বিদায় দিলেন।

ইসলামের জন্য মুসয়াব (রা) চরম দারিদ্রতাকে বরণ করলেন

বিদায় মুহূর্তে মা যেমন কুফরীর ওপর ছেলেও তেমনি ঈমানের ওপর অটল। প্রাণপ্রিয় ছেলেকে বাড়ী থেকে তাড়িয়ে বের করে দিতে দিতে মা বলছে ! তােমার যেখানে খুশী যাও। আমাকে আর মা বলে ডেক না। ছেলে একটু মায়ের দিকে এগিয়ে বললেনঃ মা আমি আপনাকে ভালাে কথা বলছি, আপনার প্রতি আমার দারুণ মমতা রয়েছে। আপনি একবার একটু বলুন, আশহাদু আন-লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসূলুহ।' মা উত্তেজিত হয়ে নক্ষত্ররাজির নামে কসম খেয়ে বললেনঃ আমি তােমার দ্বীন গ্রহণ করবাে না। তােমার দ্বীন গ্রহণ করলে আমার মতামত ও বুদ্ধি বিবেক দুর্বল বলে মনে করা হবে।' এভাবে কুরাইশদের সেই চরম আদুরে ও বিলাসী যুবক মুসয়াব বাড়ী থেকে বিতাড়িত হয়ে পথে বেরিয়ে পড়লেন। এখন তিনি মােটা শতচ্ছিন্ন তালিযুক্ত পােশাক পরেন। একদিন খাবার জুটলে অন্যদিন অভূক্ত কাটান। কিন্তু বিশ্বাসের আলােয় আলােকিত তার অন্তরটি।

ইসলামের প্রথম দূত

হজ্জের সময় মদীনা থেকে কতিপয় লােক মক্কায় এসে রাসুলুল্লাহর (সা) সাথে গােপনে আকাবায় সাক্ষাৎ করলাে এবং তার ওপর ঈমান এনে বাইয়াত করলাে। তারা মদীনায় ফিরে গেল। তাদেরকে দ্বীনের তালীম দেওয়ার এবং অন্যদের কাছে দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছানাের উদ্দেশ্যে, এবং মদীনাকে হিজরাতের জন্য প্রস্তুত করার লক্ষ্যে রাসূল (সা) মুসয়াবকে দূত হিসাবে মদীনা পাঠালেন। এভাবে মুসয়াব হলেন ইসলামের ইতিহাসে প্রথম দূত


মক্কায় তখন মুসয়াবের চেয়েও বয়সে ও মর্যাদায় বড় অনেক সাহাবী ছিলেন। তা সত্বেও এ গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য রাসূল তাকেই নির্বাচন করেন। মুসয়াব তার খােদাপ্রদত্ত বুদ্ধি, মেধা ও মহৎ চরিত্রের সাহায্যে অত্যন্ত আমানতদারীর সাথে এ কঠিন দায়িত্ব পালন করেন। কঠোর সাধনা, নিষ্ঠা ও মহত্বের সাহায্যে তিনি মদীনাবাসীদের হৃদয়ের সাথে সংলাপ করেন। ফলে দলে দলে তারা আল্লাহর দ্বীনে প্রবেশ করে।

মুসয়াব মদীনায় এলেন। এর আগে মদীনার মাত্র বারাে জন লােক আকাবায় এসে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু তিনি মদীনায় আসার পর কয়েক মাস যেতে না যেতেই বহু মানুষ তার দাওয়াতে সাড়া দিয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। পরবর্তী হজ্জ মওসুমে মদীনাবাসী মুসলমানদের বাহাত্তর জনের একটি প্রতিনিধিদল তাদের ধর্মীয় শিক্ষক ও নবীর দূত মুসয়াবের সাথে মক্কায় এলাে এবং আকাবায় আবার রাসূলুল্লাহর (সা) সাথে মিলিত হলাে।

মুসয়াব তার দায়িত্ব এবং সে দায়িত্বের সীমা সঠিকভাবে উপলব্ধি করেছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন, তিনি আল্লাহর দিকে আহ্বানকারী এবং আল্লাহর এমন এক দ্বীনের সুসংবাদ দানকারী যা মানবসমাজকে হিদায়াত ও সরল সােজা পথের দিকে আহ্বান জানায়। তার ওপর এ দ্বীনের দাওয়াত পৌছিয়ে দেওয়া ছাড়া আর কোন দায়িত্ব নেই।

মুসয়াব মদীনায় পৌঁছে আসয়াদ ইবন যারারার অতিথি হলেন। তারা দু'জন মদীনার বিভিন্ন গােত্রে, বিভিন্ন বাড়ীতে এবং সমাবেশে এক আল্লাহর দিকে মানুষকে দাওয়াত দিতে লাগলেন। নানারকম বাঁধার সম্মুখীন হলেন। কিন্তু বুদ্ধি, প্রজ্ঞা ও ধৈর্যের সাথে সব বাধা তারা অতিক্রম করলেন।

একদিন তিনি কিছু লােককে দাওয়াত দিচ্ছেন। হঠাৎ বনী আবদিল আশহালের নেতা উসাইদ ইবন হুদাইর সশস্ত্র অবস্থায় দারুণ উত্তেজিতভাবে উপস্থিত হল। তার ভীষণ রাগ সেই ব্যক্তিটির ওপর যে কিনা মুহাম্মাদের দূত হিসাবে এখানে এসেছে এবং মানুষকে তাদের পৈত্রিক ধর্ম ত্যাগ করতে উৎসাহিত করছে। সে তাদের উপাস্য দেব-দেবীকে গালাগালও করছে। উসাইদের এ রণমূর্তি দেখে মুসয়াবের পাশে বসা মুসলমানরা ভয় পেয়ে গেলেন। কিন্তু না, মুসয়াব ভয় পেলেন না, সহাস্যে উসাইলকে স্বাগতম জানালেন। হাসতে হাসতে তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। উসাইদ তখন তাঁকে ও আসয়াদ ইবন যারারাকে লক্ষ্য করে বলছে- তোমরা আমাদের গোত্র এলাকায় এসে এভাবে আমাদের দুর্বল লােকদের বােকা বানাচ্ছো কেন? যদি তােমাদের মরার সখ না থাকে তাহলে আমাদের এলাকা থেকে বেরিয়ে যাও।

হাসতে হাসতে মুসয়াব তাকে বললেনঃ আপনি কি একটু বসে আমার কথা শুনবেন ? আমার কথা শুনুন। ভালো লাগে মানবেন, ভালাে না লাগলে অর্মিরা চলে যাব।


উসাইদ ছিল একজন বুদ্ধিমান লােক। মুসয়াবের কথা তার মনে লাগলাে। এ তো বুদ্ধিমানের কথা। শুনতে আপত্তি কিসের! সে অস্ত্র ফেলে মাটিতে বসে কান লাগিয়ে মুসয়াবের কথা শুনতে লাগলাে। | মুসয়াব পবিত্র কুরআনের আয়াত তিলাওয়াত করে নবী মুহাম্মদ (সা) যে দ্বীন নিয়ে এসেছেন তার ব্যাখ্যা করছেন, আর এদিকে উসাইদের মুখমণ্ডল একটু একটু করে হাস্যোজ্জ্বল হয়ে উঠছে। মুসয়াব তার বক্তব্য এখনও শেষ করতে পারেননি, এর মধ্যে উসাইদ ও তার সংগী লােকটি বলে বসলাে : এ তো খুব চমৎকার ও সত্য কথা। তােমাদের দ্বীনে প্রবেশ করতে গেলে কি করতে হয়? মুসয়াব বললেন : শরীর ও পােশাক পবিত্র করে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ' এই সাক্ষ্য দিতে হয়।

উসাইল উঠে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর যখন ফিরে এল তখন তার মাথার চুল থেকে টপ টপ করে পানি পড়ছে। দাড়িয়ে তিনি ঘােষণা করেন, 'আশহাদু আন্ লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসূলুহ। এ খবর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লাে, সাদ ইবন মুয়াজ ও সাদ ইবন উবাদা ছুটে এলেন মুসয়াবের নিকট। তারা উভয়ে ইসলাম গ্রহণ করলেন। এসব নেতৃবৃন্দের ইসলাম গ্রহণের পর সাধারণ মদীনাবাসী বলাবলি করতে লাগলাে, আমরা পেছনে পড়ে থাকবাে কেন। চল যাই মুসয়াবের কাছে ইসলাম গ্রহণ করি।

মুসয়াব (রা) এর জিহাদ

এভাবে আল্লাহর রাসূলের প্রথম দুত এমনভাবে সফল হলেন যে, তার কোন তুলনা ইতিহাসে নেই। সময় দ্রুত গতিতে বয়ে চললো। রাসূলুল্লাহ (সা) ও তাঁর সংগী সাথীরা মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করে এসেছেন। হিংসায় কুরাইশরা জ্বলতে লাগলাে। মদীনা থেকেও তাদেরকে সমূলে উৎপাটিত করার ষড়যন্ত্র করলো। বদরে তারা এমন শিক্ষাই পেল যে, তাদের হিংসা প্রতিশােধস্পৃহায় রূপান্তরিত হলো। তারা আবার উহুদে মুসলমানদের মুখােমুখি হলাে। যুদ্ধ শুরুর পূর্বে রাসূল (সা) মুসলিম বাহিনীর মাঝখানে সবার মুখের দিকে তাকাচ্ছেন। চিন্তা করছেন করি হাতে আজ ইসলামের ঝাণ্ডাটি দেওয়া যায়। গভীরভাবে নিরীক্ষণ করলেন। তারপর মুসয়বিকে ডাকলেন তাঁরই হাতে ঝাণ্ডাটি তুলে দিলেন।


তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। কুরাইশ বাহিনী পরাজয়ের মুখােমুখি। এমন সময় মুসলিম তীরন্দাজ বাহিনী রাসূলুল্লাহর (সা) নির্দেশ ভুলে গিয়ে নিজেদের অবস্থান থেকে সরে কুরাইশদের পিছু ধাওয়া করলাে। কিন্তু তাদের এ কাজ মুসলিম বাহিনীর সুনিশ্চিত বিজয় নস্যাৎ করে দিয়ে পরাজয় বয়ে নিয়ে এলাে। মুসলিম তীরন্দা বাহিনীর ছেড়ে যাওয়া গিরিপথ দিয়ে কুরাইশ বাহিনী অকস্মাৎ ঢুকে পড়ে পেছন দিক থেকে মুসলিম বাহিনীকে আক্রমণ করে বসলাে। মুসলিম বাহিনী বিশৃঙ্খল হয়ে পড়লাে। এই সুযােগে কুরাইশ বাহিনী তাদের সর্বশক্তি নিয়ােগ করে রাসুলুল্লাহকে (সা) ঘিরে ফেললাে।

মুসয়াব (রা) এর শাহাদাত

মুসয়াব ইবন উমাইর বিপদের ভয়াবহতা উপলব্ধি করলেন। যতটুকু সম্ভব তিনি ঝান্ডা উচু করে ধরলেন, গলা ফাটিয়ে নেকড়ের মত হুঙ্কার ছাড়তে এবং জোরে জোরে তাকবীর দিতে লাগলেন। আর সেইসাথে লম্ফ ঝম্ফ মেরে আস্ফালন দেখতে লাগলেন। তার উদ্দেশ্য হলো শত্রুদের দৃষ্টি রাসল্লাহ (সা) থেকে ফিরিয়ে নিজের প্রতি নিবদ্ধ করা। এভাবে সেদিন তিনি নিজের একটি মাত্র সত্তাকে একটি বাহিনীতে পরিণত করেন। অত্যন্ত আমানতদারীর সাথে একহাতে ঝাণ্ডা উচু করে ধরেন এবং অন্য হাতে প্রচণ্ড বেগে তরবারি চালাতে থাকেন। শত্রুবাহিনী তার দিকে ঝুঁকে পড়ে এবং তার দেহের ওপর দিয়ে তারা রাসুলুল্লাহর (সা) কাছে পৌছার চেষ্টা করে। হযরত মুসয়াবের অন্তিম অবস্থা সম্পর্কে ইবন সাদ বর্ণনা করে, “উহুদের দিনে মুসয়াব ইবন উমাইর ঝান্ডা বহন করেন। মুসলমানরা যখন বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে মুসয়াব তখন অটল হয়ে রুখে দাঁড়ান। অশ্বারােহী ইবন কামীয়া তার দিকে এগিয়ে এসে তরবারির এক আঘাতে তার ডান হাতটি বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। মুসয়াব তখন বলে ওঠেন। 'ওয়ামা মুহাম্মাদুন ইল্লা রাসূল, কাদ খালাত মিন কাবলিহির কসূল মুহাম্মাদ একজন রাসুল ছাড়া আর কিছু নন। তার পূর্বে আরাে বহু রাসূল অতিবাহিত হয়েছেন।' মুসয়াব বাম হাতে ঝাণ্ডাটি তুলে ধরেন। তরবারির অন্য একটি আঘাতে তার বাম হাতটিও বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়। আবারাে তিনি 'ওয়ামা মুহাম্মাদুন ইল্লা রাসূল” এ কথাটি বলতে বলতে ঝাণ্ডার ওপর ঝুঁকে পড়ে দুই বাহু দ্বারা সেটি তুলে ধরেন। তারপর তার প্রতি বর্শা নিক্ষেপ করা হয়। পতাকাসহ তিনি মাটিতে ঢলে পড়েন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। হযরত মুসয়াব শাহাদাতের পূর্বে যে বাক্যটি বার বার উচ্চারণ করছিলেন তখনও কিন্তু সেটি কুরআনের আয়াত হিসেবে নাযিল হয়নি। উহুদের এ ঘটনার পরই ‘ওয়ামা মুহাম্মাদুন ইল্লা রাসূল,...' এ আয়াতটি নিয়ে হযরত জিবরীল (আ) উপস্থিত হন।"


যুদ্ধ শেষে হযরত মুসয়াবের লাশটি খুঁজে পাওয়া গেল। রক্ত ও ধুলােবালিতে একাকার তার চেহারা। লাশের কাছে দাড়িয়ে রাসূল (সা) অঝোরে কেঁদে ফেললেন। হযরত খাব্বাব ইবনুল আরাত বলেনঃ “আমরা আল্লাহর রাস্তায় আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে রাসূলুল্লাহর (সা) সাথে হিজরত করেছিলাম। আমাদের এ কাজের প্রতিদান দেওয়া আল্লাহর দায়িত্ব। আমাদের মধ্যে যারা তাদের এ কাজের প্রতিদান মােটেও না নিয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছে তাদের একজন মুসয়াব ইবন উমাইর

উহুদে তিনি শাহাদাত বরণ করলেন। তাঁকে কাফন দেওয়ার জন্য একপ্রস্থ ঢাদর ছাড়া আর কোন কাপড় পাওয়া গেল না। তা দিয়ে তার মাথা ঢকিলে পা এবং পা ঢাকলে মাথা বেরিয়ে যাচ্ছিল। শেষমেষ রাসূল (সা) আমাদের বললেনঃ  চাদর দিয়ে মাথার দিক দিয়ে যতটুকু ঢাকা যায় ঢেকে দাও, বাকী পায়ের দিকে ইখীর' ঘাস দাও। রাসূল (সা) মুসয়াৰের লাশের পাশে দাঁড়িয়ে পাঠ করলেন মিনাল মু'মিনীনা মিজানুল সাদাকু আহাদুল্লাহ আলাইহি... মুমিনদের এমন কিছু লােক আছে যারা আল্লাহর সাথে অঙ্গীকার সত্যে পরিণত করেছে। তারপর তার কানের চাদরটির প্রতি তাকিয়ে বলেন : আমি তোমাকে মক্কায় দেখেছি। সেখানে তোমার চেয়ে কোমল চাদর এবং সুন্দর যুলফী আর কারাে ছিল না। আর আজ তুমি এখানে এই চাদরে ধুলি মলিন অবস্থায় পড়ে আছেন। তিনি আরাে বলেনঃ 'আল্লাহর রাসূল সাক্ষ্য দিচ্ছে, কিয়ামতের দিন তোমরা সবাই আল্লাহর কাছে সাক্ষাদানকারী হবে। তারপর সংগীদের দিকে ফিরে তিনি বলেন : “হে জনমণ্ডলী, তোমরা তাদের ঘেরাও কর, তাদের কাছে এস, তাদের পর সালাম পেশ কর। যার হাতে আমার জীবন সেই সত্তার শপথ, কিয়ামত পর্যন্ত যে কেউ তাদের ওপর সালাম পেশ করবে তারা সেই সালামের জওয়াব দেবে।'

মদিনায় সর্বপ্রথম জুমআর নামাজ আদায়

হযরত মুসয়াবের ভাই আবুর রাওম ইবন উমাইর, আমের ইবন রাবীয়া এবং সুয়াইত ইবন সাদ তাকে কবরে নামিয়ে দাফন কাজ সম্পন্ন করেন। 


হযরত মুসয়াব ছিলেন প্রখর মেধাবী, উলার ও প্রাঞ্জলভাষী বাগ্মী। যে দ্রুততার সাথে ইয়াসরিবে (মদীনা) ইসলাম প্রসার লাভ করেছিল তাতেই তার এসব গুণের প্রমাণ পাওয়া যায়। তার শাহাদাত পর্যন্ত যতটুকু কুরআন নাযিল হয়েছিল, তিনি মুখস্থ করেছিলেন। মদীনায় সর্বপ্রথম তিনিই জুময়ার নামায কায়েম করেন। মদীনায় মুসলমানদের সংখ্যা যখন একটু বেড়ে গেল তিনি রাসূলুল্লাহর (সা) অনুমতি নিয়ে হযরত সাদ ইবন খুযাইমার (রা) বাড়ীতে জুময়ার নামাযের সূচনা করেন। তিনিই ইমামতি করেন। নামাযের পর একটি ছাগল যবেহ করে মুসল্লীদের আপ্যায়ন করা হয়। (তাবাকাত)



**************************************
>>> Welcome, You are now on Mohammadia Foundation's Website. Please stay & Tune with us>>>


এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url