সাহাবাগণের জীবনকথা-৪৪ || সালমান আল-ফারেসীর (রা) || সালমান আল-ফারেসীর (রা) ইসলাম গ্রহণের কাহিনী





সালমান আল-ফারেসী (রা) 


সালমান আল ফারেসী নবী মুহম্মদের একজন বিখ্যাত সাহাবী। মুহাম্মাদ তাকে সালমান আল খায়র নাম প্রদান করেন। ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার পূর্বে তার নাম ছিল মাবিহ ইবনে বুজখ্‌শান। তিনি বর্তমান ইরানের ইস্পাহান নামক স্থানে জায়্য নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ছিলেন একজন জরাথ্রুস্টবাদী। ইসলাম গ্রহণের পূর্বে সালমান খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহণ করেন। খন্দকের যুদ্ধকালীন সময়ে তার পরামর্শে মুসলমান গণ পরিখা খনন করেন। ধর্মীয় জ্ঞানে তার ছিল অগাধ পাণ্ডিত্য। তিনি এ ব্যাপারে গভীর রাত পর্যন্ত মুহাম্মাদের সাথে আলোচনায় মগ্ন থাকতেন। তার নিকট হতে ৬০ টি এর মতো হাদিস বর্ণিত হয়েছে। তার সন্তানদের মধ্যে এক পুত্র এবং তিনজন কন্যা সন্তানের কথা জানা যায়।


সালমান আল-ফারেসীর (রা) ইসলাম গ্রহণের চমৎকার কাহিনী

রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, সালমান নবী পরিবারেরই একজন।'
এটি একজন সত্য-সন্ধানী ও আল্লাহকে পাওয়ার অভিলাষী এক ব্যক্তির জীবন কথা। তিনি হযরত সালমান আল-ফারেসী। সালমান আল-ফারেসীর যবানেই তাঁর সেই সত্য প্রাপ্তির চমকপ্রদ বর্ণনা রয়েছে। তিনি বলেনঃ
আমি তখন পারস্যের ইসফাহান অঞ্চলের একজন পারসী নওজোয়ান। আমার গ্রামটির নাম ‘জায়্যান। বাবা ছিলেন গ্রামের দাহকান-সর্দার। সর্বাধিক ধনবান ও উচ্চ মর্যাদার অধিকারী। জন্মের পর থেকেই আমি ছিলাম তার কাছে আল্লাহর সৃষ্টিজগতের মধ্যে সবচে বেশী প্রিয়। আমার বয়স বাড়ার সাথে সাথে আমার প্রতি তার স্নেহ ও ভালবাসাও বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে কোন অমঙ্গলের আশংকায় তিনি আমাকে মেয়েদের মত ঘরে আবদ্ধ করে রাখেন।
আমার বাবা-মার মাজুসী ধর্মে আমি কঠোর সাধনা শুরু করলাম এবং আমাদের উপাস্য আগুনের তত্ত্বাবধায়কের পদটি খুব তাড়াতাড়ি অর্জন করলাম। রাতদিন চব্বিশ ঘন্টা উপাসনার সেই আগুন জ্বালিয়ে রাখার দায়িত্বটি আমার ওপর অর্পিত হয়।


আমার বাবা ছিলেন বিরাট ভূ-সম্পত্তির মালিক। তিনি নিজেই তা দেখাশুনা করতেন। তাতে আমাদের প্রচুর শস্য উৎপন্ন হতো। একদিন কোন কারণবশত তিনি বাড়িতে আটকে গেলেন, গ্রামের খামারটি দেখাশুনার জন্য যেতে পারলেন না। আমাকে ডেকে তিনি বললেনঃ

‘বেটা, তুমি তাে দেখতেই পাচ্ছে, বিশেষ কারণে আজ আমি খামারে যেতে পারছিনা। আজ বরং তুমি একটু সেখানে যাও এবং আমার তরফ থেকে সেখানকার কাজকর্ম তদারক কর।'

আমি খামারের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। পথে খৃষ্টানদের একটি গীর্জার পাশ দিয়ে যাবার সময় তাদের কিছু কথার আওয়াজ আমার কানে ভেসে এলাে। তারা তখন প্রার্থনা করছিলাে। এ আওয়াজই আমাকে সচেতন করে তােলে।

দীর্ঘদিন ঘরে আবদ্ধ থাকার কারণে খৃষ্টান অথবা অন্য কোন ধর্মাবলম্বীদের সম্পর্কে আমার কোন জ্ঞানই ছিল না। তাদের কথার আওয়াজ শুনে তারা কি করছে তা দেখার জন্য আমি গীর্জার অভ্যন্তরে প্রবেশ করলাম। গভীরভাবে তাদেরকে আমি নিরীক্ষণ করলাম। তাদের প্রার্থনা পদ্ধতি আমার খুবই ভালাে লাগলাে এবং আমি তাদের ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়লাম। মনে মনে বললাম আমরা যে ধর্মের অনুসারী তা থেকে এ ধর্ম অতি উত্তম । আমি খামারে না গিয়ে সে দিনটি তাদের সাথেই কাটিয়ে দিলাম। তাদেরকে জিজ্ঞেস করলাম ? - এ ধর্মের মূল উৎস কোথায়? - শামে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলাে। আমি বাড়িতে ফিরে আসলাম। 


সারাদিন আমি কি কি করেছি, বাবা তা আমাকে জিজ্ঞেস করতে লাগলেন।
বললাম 'বাবা কিছু লােকের পাশ দিয়ে অতিক্রম করার সময় দেখতে পেলাম তারা তাদের উপাসনালয়ে প্রার্থনা করছে। তাদের ধর্মের যেসব ক্রিয়াকাণ্ড আমি প্রত্যক্ষ করেছি তা আমার খুবই ভালাে লেগেছে। বেলা ডােবা পর্যন্ত আমি তাদের সাথেই কাটিয়ে দিয়েছি। আমার কথা শুনে বাবা শংকিত হয়ে পড়লেন। তিনি বললেনঃ

বেটা, সে ধর্মে কোন কল্যাণ নেই, তােমার ও তােমার পিতৃপুরুষের ধর্ম তা থেকেও উত্তম।' বললাম, 'আল্লাহর শপথ, কখনাে তা নয়। তাদের ধর্ম আমাদের ধর্ম থেকেও উত্তম।'

আমার কথা শুনে বাবা ভীত হয়ে পড়লেন এবং আমি আমার ধর্ম ত্যাগ করতে পারি বলে তিনি আশংকা করলেন। তাই আমার পায়ে বেড়ী লাগিয়ে ঘরে বন্দী করে রাখলেন।

আমি সুযােগের প্রতীক্ষায় ছিলাম। কিছুদিনের মধ্যেই সে সুযোগ এসে গেল। গােপনে খৃষ্টানদের কাছে এই বলে সংবাদ পাঠালাম যে, শাম অভিমুখী কোন কাফিলা তাদের কাছে এলে তারা যেন আমাকে খবর দেয়।


কিছুদিনের মধ্যেই শাম অভিমুখী একটি কাফিলা তাদের কাছে এলাে। তারা আমাকে সংবাদ দিল। আমি আমার বন্দীদশা থেকে পালিয়ে গোপনে তাদের সাথে বেরিয়ে পড়লাম । তারা আমাকে শামে পৌছে দিল। শামে পৌঁছে আমি জিজ্ঞেস করলাম। - এ ধর্মের সর্বোত্তম ও সবচেয়ে বেশী জ্ঞানী ব্যক্তি কে? তারা বললােঃ  বিশপ, গীর্জার পুরােহিত।

আমি তার কাছে গেলাম। বললাম আমি খৃষ্টধর্মের প্রতি অকৃিষ্ট হয়েছি। আমার ইচ্ছে, আপনার সাহচর্যে থেকে আপনার খিদমত করা, আপনার নিকট থেকে শিক্ষালাভ ও আপনার সাথে প্রার্থনা করা। তিনি বললেনঃ ভেতরে এসো।

আমি ভেতরে ঢুকে তার কাছে গেলাম এবং তার খিদমত শুরু করে দিলাম। কিছুদিন যেতে না যেতেই আমি বুঝতে পারলাম লােকটি অসৎ। কারণ সে তার সংগী সাথীদেরকে দান-খয়রাতের নির্দেশ দেয়, সওয়াব লাভের প্রতি উৎসাহ প্রদান করে; কিন্তু যখন তারা আল্লাহর রাস্তায় খরচ করার জন্য তার হাতে কিছু তুলে দেয়, তখন সে নিজেই তা আত্মসাত করে এবং নিজের জন্য পুঞ্জিভূত করে রাখে। গরীব মিসকীনদের সে কিছুই দেয় না। এভাবে সে সাত কলস স্বর্ণ পুঞ্জিভূত করে।


তার এ চারিত্রিক অধঃপতন দেখে আমি তাকে ভীষণ ঘৃণা করতাম। কিছু দিনের মধ্যেই লােকটি মারা গেল। এলাকার খৃষ্টান সম্প্রদায় তাকে দাফনের জন্য সমবেত হলাে। তাদেরকে আমি বললামঃ তােমাদের এ বন্ধুটি খুবই অসৎ প্রকৃতির লােক ছিল। তােমাদের সে দান খয়রাতের নির্দেশ দিত এবং সেজন্য তােমাদেরকে অনুপ্রাণিত করতাে। কিন্তু তােমরা যখন তা তার হাতে তুলে দিতে সে সবই আত্মসাত করতাে। গরীব-মিসকীনদের কিছুই দিত না।

তারা জিজ্ঞেস করলােঃ তুমি তা কেমন করে জানলে?

বললামঃ তােমাদেরকে আমি তার পুঞ্জিভূত সম্পদের গােপন ভাণ্ডার দেখাচ্ছি। তারা বললােঃ ঠিক আছে, তাই দেখাও।

আমি তাদেরকে গোপন ভাণ্ডারটি দেখিয়ে দিলে তারা সেখান থেকে সাত কলস সােনা-চান্দি উদ্ধার করে। এ দেখে তারা বললােঃ

- আল্লাহর কসম আমরা তাকে দাফন করবো না। তাকে তারা গুলিতে লটকিয়ে পাথর মেরে তার দেহ জর্জরিত করে দিল। কিছুদিন যেতে না যেতেই তারা অন্য এক ব্যক্তিকে তার স্থলাভিষিক্ত করলাে। আমি তারও সাহচর্য গ্রহণ করলাম। এ লােকটি অপেক্ষা দুনিয়ার প্রতি অধিক উদাসীন, আখিরাতের। প্রতি অধিক অনুরাগী ও রাতদিন ইবাদতের প্রতি বেশী নিষ্ঠাবান কোন লােক আমি এর আগে আর দেখিনি। আমি তাঁকে অত্যাধিক ভালােবাসতাম। একটা দীর্ঘ সময় তার সাথে আমি কাটালাম। যখন তার মরণ সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলাে, আমি তাকে বললাম- জনাব, আপনার মৃত্যুর পর কার সাহচর্যে কাটাবার উপদেশ দিচ্ছেন আমাকে বললেনঃ বেটা আমি যে সত্যকে আঁকড়ে রেখেছিলাম, এখানে সে সত্যের ধারক আর কাউকে আমি জানিনা। তবে মাওসেলে এক ব্যক্তি আছেন, নাম তার অমুক, তিনি এ সত্যের এক বিন্দুও পরিবর্তন বা পরিবর্ধন করেননি। তুমি তার সাহচর্য অবলম্বন করাে।


আমার সে বন্ধুটির মৃত্যুর পর মাওসেলে গিয়ে তাঁর বর্ণিত লােকটিকে আমি খুঁজে বের করি। আমি তাকে আমার সব কথা খুলে বলি। একথাও তাকে আমি বলি যে, অমুক ব্যক্তি তার অন্তিম সময়ে আমাকে আপনার সাহচর্য অবলম্বনের কথা বলে গেছেন। আর তিনি আমাকে একথাও বলে গেছেন যে, তিনি যে সত্যের ওপর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন, আপনি সে সত্যকেই গভীরভাবে আঁকড়ে ধরে রেখেছেন। আমার কথা শুনে তিনি বললেনঃ তুমি আমার কাছে থাক।

আমি তার কাছে থেকে গেলাম। তার চালচলন আমার ভালােই লাগলাে। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তিনি মারা গেলেন। তার মরণ সময় নিকটবর্তী হলে আমি তাকে বললাম?

- জনাব, আপনি দেখতেই পাচ্ছেন, আল্লাহর ফায়সালা আপনার কাছে এসে গেছে। আর আমার ব্যাপারটি তাে আপনি অবগত আছেন। এখন আমাকে কার কাছে যাওয়ার উপদেশ দিচ্ছেন?
বললেনঃ বেটা, আমরা যে জিনিসের ওপর ছিলাম, তার ওপর অটল আছে এমন কাউকে তাে আমি জানিনা। তবে নাসসিবীনে' অমুক নামে এক ব্যক্তি আছেন, তুমি তার সাথে মিলতে পার।

তাকে কবর দেওয়ার পর আমি নাসসিবীনের সেই লােকটির সাথে সাক্ষাত করলাম এবং আমার সমস্ত কাহিনী তাকে খুলে বললাম। তিনি আমাকে তার কাছে থেকে যেতে বললেন। আমি থেকে গেলাম। এ ব্যক্তিকেও পূর্ববর্তী দু'বন্ধুর মত নিষ্কলুষ চরিত্রের দেখতে পেলাম। আল্লাহর কি মহিমা, অল্পদিনের মধ্যে তিনিও মারা গেলেন। অন্তিম সময়ে তাকে আমি বললাম আমার সম্পর্কে আপনি মােটামুটি সব কথা জানেন। এখন আমাকে কার কাছে যেতে বলেন?

তিনি বললেনঃ অমুক নামে ‘আম্মুরিয়াতে এক লােক আছেন, তুমি তারই সুহবত অবলম্বন করবে। এছাড়া আমাদের এ সত্যের ওপর অবশিষ্ট আর কাউকে তাে আমি জানিনা। তার কাছে উপস্থিত হয়ে আমি আমার সব কথা বললাম।


আমার কথা শুনে তিনি বললেনঃ আমার কাছে থাক। আল্লাহর কসম, তার কাছে থেকে আমি দেখতে পেলাম তিনি তার পূর্ববর্তী সংগীদের মত একই মত ও পথের অনুসারী। তার কাছে থাকাকালেই আমি অনেকগুলি গরু ও ছাগলের অধিকারী হয়েছিলাম।

কিছুদিনের মধ্যেই তার পূর্ববর্তী সংগীদের যে পরিণতি দেখেছিলাম, সেই একই পরিণতি তার ভাগ্যে আমি দেখতে পেলাম। তার জীবনের অন্তিম সময়ে আমি তাকে বললামঃ আমার অবস্থা তাে আপনি ভালােই জানেন। এখন আমাকে কি করতে বলেন, কার কাছে যেতে পরামর্শ দেন?

বললেনঃ বৎস! আমরা যে সত্যকে ধরে রেখেছিলাম, সে সত্যের ওপর ভূ-পৃষ্ঠে অন্য কোন ব্যক্তি অবশিষ্ট আছে বলে আমার জানা নেই। তবে, অদূর ভবিষ্যতে আরব দেশে একজন নবী আবির্ভূত হবেন। তিনি ইবরাহীমের দ্বীন নতুনভাবে নিয়ে আসবেন। তিনি তার জন্মভূমি থেকে বিতাড়িত হয়ে বড় বড় কালাে পাথরের যমীনের মাঝখানে খেজুর উদ্যানবিশিষ্ট ভূমির দিকে হিজরাত করবেন। দিবালোকের ন্যায় সুস্পষ্ট কিছু নিদর্শনও তার থাকবে। তিনি হাদিয়ার জিনিস তাে খাবেন; কিন্তু সাদকার জিনিস খাবেন না। তাঁর দু'কাঁধের মাঝখানে নবুওয়াতের মােহর থাকবে। তুমি পারলে সে দেশে যাও।

এরপর তিনি মারা গেলেন। আমি আরাে কিছুদিন আম্মুরিয়াতে কাটালাম। একদিন সেখানে ‘কালব’ গােত্রের কিছু আরব ব্যবসায়ী এলাে। আমি তাদেরকে বললামঃ আপনারা যদি আমাকে সংগে করে আরব দেশে নিয়ে যান, বিনিময়ে আমি আপনাদেরকে আমার এ গরু ছাগলগুলি দিয়ে দেব। তারা বললেন ঠিক আছে, আমরা তোমাকে সংগে করে নিয়ে যাব।


আমি তাদেরকে গরু-ছাগলগুলি দিয়ে দিলাম। তারা আমাকে সংগে নিয়ে চললেন। যখন আমরা মদীনা ও শামের মধ্যবর্তী ‘ওয়াদী আল-কুরা' নামক স্থানে পৌঁছলাম, তখন তারা আমার সংগে বিশ্বাসঘাতকতা করে এক ইহুদীর কাছে আমাকে বিক্রি করে দিল। আমি তার দাসত্ব শুরু করে দিলাম। অল্পদিনের মধ্যেই বনী কুরাইজা গােত্রের তার এক চাচাতাে ভাই আমাকে খরীদ করে এবং আমাকে ইয়াসরিবে' (মদীনা) নিয়ে আসে। এখানে আমি আম্মুরিয়ার বন্ধুটির বর্ণিত সেই খেজুর গাছ দেখতে পেলাম এবং তিনি স্থানটির যে বর্ণনা দিয়েছিলেন, সে অনুযায়ী শহরটিকে চিনতে পারলাম। এখানে আমি আমার মনিবের সাথে কাটাতে লাগলাম।

নবী (সা) তখন মক্কায় দ্বীনের দাওয়াত দিচ্ছিলেন। কিন্তু দাস হিসাবে সব সময় কাজে ব্যস্ত থাকায় তার সম্পর্কে কোন কথা বা আলােচনা আমার কানে পৌঁছেনি। কিছুদিনের মধ্যে রাসূল (সা) মক্কা থেকে হিজরত করে ইয়াসরিবে এলেন। আমি তখন একটি খেজুর গাছের মাথায় উঠে কি যেন কাজ করছিলাম, আমার মনিব, গাছের নীচেই বসে ছিলো। এমন সময় তার এক ভাতিজা এসে তাকে বললােঃ


আল্লাহ বনী কায়লাকে (আউস ও খাজরাজ গোত্র) ধ্বংস করুন। কসম খােদার, তারা এখন কুবাতে মক্কা থেকে আজই আগত এক ব্যক্তির কাছে সমবেত হয়েছে, যে কিনা নিজেকে নবী বলে মনে করে।

তার কথাগুলি আমার কানে যেতেই আমার গায়ে যেন জ্বর এসে গেল। আমি ভীষণভাবে কাঁপতে শুরু করলাম। আমার ভয় হলাে, গাছের নীচে বসা আমার মনিবের ঘাড়ের ওপর ধপাস করে পড়ে না যাই। তাড়াতাড়ি আমি গাছ থেকে নেমে এলাম এবং সেই লােকটিকে বললামঃ

- তুমি কি বললে? কথাগুলি আমার কাছে আবার বলো তো।
আমার কথা শুনে আমার মনিব রেগে ফেটে পড়লাে এবং আমার গালে সজোরে এক থাপ্পড় বসিয়ে দিয়ে বললাে।

- এর সাথে তােমার সম্পর্ক কি? যাও, তুমি যা করছিলে তাই কর।

রাসুলের (সাঃ) নবুওয়তি যাচাই

সেদিন সন্ধ্যায় আমার সংগৃহীত খেজুর থেকে কিছু খেজুর নিয়ে রাসূল (সা) যেখানে অবস্থান করছিলেন সেদিকে রওয়ানা হলাম। রাসূলের (সা) নিকট পৌছে তাকে বললামঃ

- আমি শুনেছি আপনি একজন পুণ্যবান ব্যক্তি। আপনার কিছু সহায়-সম্বলহীন সঙ্গীসাথী আছেন। এ সামান্য কিছু জিনিস সদকার উদ্দেশ্যে আমার কাছে জমা ছিল, আমি দেখলাম অন্যদের তুলনায় আপনারাই এগুলি পাওয়ার অধিক উপযুক্ত। এ কথা বলে খেজুরগুলি তাঁর দিকে এগিয়ে দিলাম। তিনি সঙ্গীদের বললেনঃ তােমরা খাও। কিন্তু তিনি নিজের হাতটি গুটিয়ে নিলেন, কিছুই খেলেন না। মনে মনে আমি বললাম এ হলাে একটি।


সেদিন আমি ফিরে এলাম । আমি আবারও কিছু খেজুর জমা করতে লাগলাম । রাসূল (সা) কুবা থেকে মদীনায় এলেন। আমি একদিন খেজুরগুলি নিয়ে তার কাছে গিয়ে বললামঃ 'আমি দেখেছি, আপনি সদকার জিনিস খাননা। তাই এবার কিছু হাদিয়া নিয়ে এসেছি, আপনাকে দেয়ার উদ্দেশ্যে।' এবার তিনি নিজে খেলেন এবং সঙ্গীদের আহ্বান জানালেন তারাও তার সাথে খেলেন। আমি মনে মনে বললামঃ এ হলাে দ্বিতীয়টি।

তারপর অন্য একদিন আমি রাসূলুল্লাহর (সা) কাছে গেলাম। তিনি তখন বাকী আলগারকাদ' গােরস্থানে তার এক সঙ্গীকে দাফন করছিলেন। আমি দেখলাম, তিনি গায়ে ‘শমলা' (এক ধরনের টিলা পােশাক) জড়িয়ে বসে আছেন। আমি তাঁকে সালাম দিলাম। তারপর আমি তার পেছনের দিকে দৃষ্টি ঘােরাতে লাগলাম। আমি খুঁজতে লাগলাম, আমার সেই আসুরিয়ার বন্ধুটির বর্ণিত নবুওয়াতের মােহরটি।


রাসূল (সা) আমাকে তার পিঠের দিকে ঘন ঘন তাকাতে দেখে আমার উদ্দেশ্য বুঝতে পারলেন। তিনি তার পিঠের চাদরটি সরিয়ে নিলেন এবং আমি মােহরটি স্পষ্ট দেখতে পেলাম। আমি তখন পরিষ্কারভাবে তাঁকে চিনতে পারলাম এবং হুমড়ি খেয়ে পড়ে তাঁকে চুমুতে চুমুতে ভরে দিলাম ও কেঁদে চোখের পানিতে বুক ভাসালাম। আমার এ অবস্থা দেখে রাসূল (সা) জিজ্ঞেস করলেনঃ

- তোমার খবর কি?
আমি সব কাহিনী খুলে বললাম। তিনি আশ্চর্য হয়ে গেলেন এবং আমার মুখ দিয়েই এ কাহিনীটি তাঁর সংগীদের শোনাতে চাইলেন। আমি তাঁদেরকেও শোনালাম। তাঁরা অবাক হয়ে গেলেন, খুবই আনন্দিত হলেন।

সালমান ফারেসীর (রাঃ) দাসত্ব থেকে মুক্তি

দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ থাকার কারণে সালমান (রা) রাসূলুল্লাহর (সা) সাথে বদর ও উহুদের যুদ্ধে অংশ নিতে পারেননি। ফলে তিনি খুবই মর্মজ্বালা ভোগ করতে থাকেন। সালমান বলেন: 'একদিন রাসূল (সা) আমাকে ডেকে বললেনঃ তুমি তোমার মনিবের সাথে মুকাতাবা (চুক্তি) কর। আমি চুক্তি করলাম, তাকে আমি তিন শ' খেজুরের চারা লাগিয়ে দেব এবং সেই সাথে চল্লিশ 'উকিয়া স্বর্ণও দেব। আর বিনিময়ে আমি মুক্তি লাভ করবো। আমি রাসূলুল্লাহকে (সা) এ চুক্তির কথা অবহিত করলাম। তিনি সাহাবীদেরকে ডেকে বললেন: তোমরা তোমাদের এ ভাইকে সাহায্য কর। তারা প্রত্যেকেই আমাকে পাঁচ, দশ, বিশ, ত্রিশটি করে যে যা পারলেন চারা দিলেন । এভাবে আমার তিনশ' চারা সংগ্রহ হয়ে গেল। তারপর আমি রাসূলের (সা) নির্দেশে গর্ত খুড়লাম । তিনি নিজেই একদিন আমার সাথে সেখানে গেলেন। আমি তাঁর হাতে একটি করে চারা তুলে দিলাম, আর তিনি সেটা রোপন করলেন। আল্লাহর কসম, তাঁর একটি চারাও মারা যায়নি। (ঐতিহাসিকরা বলছেন, সালামান (রা) একটি মাত্র চারা রোপন করেছিলেন, আর সেটাই মারা যায়। বাকী সবগুলিই রাসুল (সা) রোপন করেছিলেন এবং সবগুলিই বেঁচে যায়।) এভাবে আমি আমার চুক্তির একাংশ পূরণ করলাম, বাকী থাকলো অর্থ । 


একদিন রাসূল (সা) আমাকে ডেকে মুরগীর ডিমের মত দেখতে স্বর্ণজাতীয় কিছু পদার্থ আমার হাতে দিয়ে বললেন, যাও, তোমার চুক্তি মুতাবিক পরিশোধ কর। আমি বললাম, এতে কি তা পরিশোধ হবে? তিনি বললেন : 'ধর, আল্লাহ এতেই পরিশোধ করবেন।' আল্লাহর কসম, আমরা ওজন করে দেখলাম তাতে চল্লিশ উকিয়াই আছে। এভাবে সালমান (রা) তার চুক্তি পূরণ করে মুক্তিলাভ করেন। 

ইসলামের সেবায় সালমান ফারেসী (রা)


গোলামী থেকে মুক্ত হয়ে হযরত সালমান (রা) মুসলমানদের সাথে বসবাস করতে থাকেন। তখন তাঁর কোন ঘড়-বাড়ী ছিল না। রাসূল (সা) অন্যান্য মুহাজিরদের মত প্রখ্যাত আনসারী সাহাবী আবু দারদার (রা) সাথে তাঁর মুওয়াখাত বা ভ্রাতৃ-সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে দেন। গোলামীর কারণে হযরত সালমান (রা) বদর ও উহুদ যুদ্ধে শরীক হতে পারেননি। গোলামী থেকে মুক্ত হওয়ার পর খন্দকের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ যুদ্ধে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে পূর্ববর্তী দু'টি যুদ্ধে অনুপস্থিতির ক্ষতি পুষিয়ে নেন। সারা আরবের বিভিন্ন গোত্র কুরাইশদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে মদীনা আক্রমণের প্রস্তুতি নেয়। খবর পেয়ে রাসূল (সা) সাহাবীদের সাথে পরামর্শ করেন। অনেকে অনেক রকম পরামর্শ দেন। হযরত সালমান বলেন, পারস্যে পরিখা খনন করে নগরের হিফাজত করা হয়। মদীনার অরক্ষিত দিকে পরিখা খনন করে নগরীর হিফাজত করা সমীচীন। এ পরামর্শ রাসূলুল্লাহর (সা) মনঃপূত হয়। মদীনার পশ্চিম ও উত্তর-পশ্চিম দিকে সুদীর্ঘ পরিখা খনন করে বিশাল কুরাইশ বাহিনীর আক্রমণ সহজে প্রতিরােধ করা হয়। রাসূল (সা) নিজেও এই পরিখা বা খন্দক খননের কাজে অংশগ্রহণ করেন। কুরাইশ বাহিনী মদীনার উপকণ্ঠে এসে এ অপূর্ব রণ-কৌশল দেখে স্তম্ভিত হয়ে যায়। ২১/২২ দিন মদীনা অবরােধ করে বসে থাকার পর শেষে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। খন্দকের পর যত যুদ্ধ হয়েছে তার প্রত্যেকটিতে হযরত সালমান অংশগ্রহণ করেছেন। রাসূলুল্লাহর (সা) ইনতিকালের পর হযরত সালমান বেশ কিছুদিন মদীনায় অবস্থান করেন। সম্ভবতঃ হযরত আবু বকরের (রা) খিলাফতের শেষ অথবা হযরত উমারের খিলাফতের প্রথম দিকে তিনি ইরাকে এবং তার দ্বীনী ভাই আবু দারদার (রা) সাথে সিরিয়ায় বসতি স্থাপন করেন। তিনি হযরত উমারের যুগে ইরান বিজয়ে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। মুসলিম মুজাহিদদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বিভিন্ন ফ্রন্টে যুদ্ধ করেন। জালুলু বিজয়েও তিনি অংশগ্রহণ করেন। হযরত উমর (রা) তাকে মাদায়েনের ওয়ালী নিযুক্ত করেন। হযরত উসমানের খিলাফতকালে তিনি ইনতিকাল করেন।

ইসলাম গ্রহণের পর হযরত সালমানের জীবনের বেশীর ভাগ সময় অতিবাহিত হয় রাসূলুল্লাহর (সা) সুহবতে। এ কারণে তিনি ইলম ও মারেফাতে বিশেষ পারদর্শিতা লাভ করেন। হযরত আলীকে (রা) তার ইলম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে বলেনঃ 'সালমান ইলম ও হিকমতের ক্ষেত্রে লুকমান হাকীমের সমতুল্য।' অন্য একটি বর্ণনা মতে তিনি বলেনঃ “ইলমে আউয়াল ও ইলমে আখের সকল ইলমের আলিম ছিলেন তিনি। ইলমে আখের অর্থ কুরআনের ইলম। আরবে তার কোন আত্মীয় ও খান্দান ছিল না, তাই রাসূল (সা) কে আহলে বাইতের সদস্য বলে ঘােষণা করেন। হযরত মুয়াজ বিন জাবাল, যিনি ছিলেন একজন বিশিষ্ট আলিম ও মুজতাহিদ সাহাৰী, বলেনঃ চার ব্যক্তি থেকে ইলম হাসিল করবে। সেই চারজনের একজন সালমান। হযরত সালমান থেকে ষাটটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে। তার মধ্যে তিনটি মুত্তাফাক আলাইহি, একটি মুসলিম ও তিনটি বুখারী এককভাবে বর্ণনা করেছেন। আবু সাঈদ খুদরী, আবুত তুফাইল, ইবন আব্বাস, আউস বিন মালিকইবন আজযা (রা) প্রমুখ বিশিষ্ট সাহাবী তার ছাত্র ছিলেন।

সালমানের (রা) জীবন যাপন

হযরত সালমান সেইসব বিশিষ্ট সাহাবীদের অন্তর্ভুক্ত যারা রাসূলুল্লাহর (সা) বিশেষ নৈকট্য লাভের সৌভাগ্য অর্জন করেন। হযরত আয়িশা (রা) বলেনঃ রাসূল (সা) যেদিন রাতে সালমানের সাথে নিবৃতে আলােচনা করতে বসতেন, আমরা তাঁর স্ত্রীরা ধারণা করতাম সালমান হয়তো আজ আমাদের রাতের সান্নিধ্যটুকু কেড়ে নেবে।'


মুহুদ ও তাকওয়ার তিনি ছিলেন বাস্তব নমুনা। ক্ষণিকের মুসাফির হিসেবে তিনি জীবন যাপন করেছেন। জীবনে কোন বাড়ী তৈরী করেননি। কোথাও কোন প্রাচীর বা গাছের ছায়া পেলে সেখানেই শুয়ে যেতেন। এক ব্যক্তি তার কাছে ইজাযত চাইলাে, তাকে একটি ঘর বানিয়ে দেওয়ার। তিনি নিষেধ করলেন। বার বার পীড়াপীড়িতে শেষে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কেমন ঘর বানাবে? লােকটি বললােঃ এত ছােট যে, দাঁড়ালে মাথায় চাল বেঁধে যাবে এবং শুইয়ে পড়লে দেয়ালে পা ঠেকে যাবে। এ কথায় তিনি রাজী হলেন। তার জন্য একটি ঝুপড়ি ঘর তৈরী করা হয়। হযরত হাসান (রা) বলেনঃ 'সালমান যখন পাঁচ হাজার দিরহাম ভাতা পেতেন, তিরিশ হাজার লােকের উপর প্রভুত্ব করতেন তখনও তার একটি মাত্র ‘আবা’ ছিল। তার মধ্যে ভরে তিনি কাঠ সংগ্রহ করতেন। ঘুমানাের সময় আবাটির এক পাশ গায়ে দিতেন এবং অন্য পাশ বিছাতেন।'

হযরত সালমানের (রা) অন্তিম সময়

হযরত সালমান (রা) যখন অন্তিম রোগ শয্যায়, হযরত সা'দ বিন আবী ওয়াক্কাস (রা) তাকে দেখতে যান। সালমান (রা) কাঁদতে শুরু করলেন। সা'দ বললেনঃ আবু আবদিল্লাহ, কাঁদছেন কেন? রাসূল (সা) তো আপনার প্রতি সন্তুষ্ট অবস্থায় দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন। হাউজে কাওসারের নিকট তার সাথে আপনি মিলিত হবেন। বললেনঃ আমি মরণ ভয়ে কাঁদছিনে। কান্নার কারণ হচ্ছে, রাসূল (সা) আমাদের নিকট থেকে অঙ্গীকার নিয়েছিলেন, আমাদের সাজ-সরসরন্জাম যেন একজন মুসাফিরের সাজ-সরঞ্জাম থেকে বেশী না হয়। অথচ আমার কাছে এতগুলি জিনিসপত্র জমা হয়ে গেছে। সা'দ বলেনঃ সেই জিনিসগুলি একটি বড় পিয়ালা, তামার একটি থালা ও একটি পানির পাত্র ছাড়া আর কিছু নয়।



**************************************
>>> Welcome, You are now on Mohammadia Foundation's Website. Please stay & Tune with us>>>


এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url