তারাবীহ’র জন্য হাফেয নিয়োগের শর্তাবলী || তারাবীহ নামাযের ইমামতের বিনিময় গ্রহণ

সুন্নাত তরীকায় তারাবীহ’র জন্য হাফেয নিয়োগ
১. হাফেয সাহেব ও তারাবীহ কর্তৃপক্ষ পরিষ্কার ভাবে তারাবীহ্ নামাযের বিনিময় লেন-দেন না করার ব্যাপারে একমত হতে হবে।
২. তারাবীহতে খতমের সময় টাকা-পয়সা বা অন্য কোন প্রকার হাদিয়া, সম্মিলিত কালেকশনের কিংবা মসজিদ ফান্ডের টাকা ইত্যাদি কোন অবস্থাতেই হাফেয সাহেবকে দেয়া যাবে না, আর হাফেয সাহেবও নিবেন না। কেননা এটা শরীআতের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ নাজায়িয ও গুনাহের কাজ।
৩. হাফেয সাহেবকে দ্রুত পড়তে বাধ্য করা যাবে না, কেননা এভাবে কুরআন তিলাওয়াতে গুনাহ্ হয়। হাফেয সাহেব তারাবীতে হৃদর অর্থাৎ, সহীহ্ শুদ্ধ করে মধ্যম গতিতে পড়বেন। তারাবীহতে লুকমা দেয়া হলে হাফেয সাহেব তা গ্রহণ করবেন, লুকমা গ্রহণে নামাযের কোন ক্ষতি হয় না।
৪. প্রতি চার রাকাআতের শেষে 'সুবহানাল্লাহিল মুলকি' পড়া অথবা সম্মিলিত মুনাজাত করা হাদীসে প্রমাণিত নেই, এর জন্য হাফেয সাহেবকে হুকুম করা যাবে না। বরং সে সময় যে কোন দু'আ বা যিকির করা যেতে পারে। তেমনি ভাবে “আল্লাহুম্মা ইন্না নাম আহুকাল জান্নাহ্' তারাবীহ নামায শেষে গুরুত্ব সহকারে পড়া হয়, অথচ এভাবে পড়াও হাদীসে প্রমাণিত নেই। সুতরাং এর জন্যও হাফেয সাহেবদেরকে হুকুম করা যাবে না।
৫. তারাবীহ্ নামাযের মাঝে হাফেয ইমাম বদল যে কোন চার রাকাআতের পরে হওয়া উত্তম। দশ রাকাআতের মাথায় না করা চাই।
৬. হাফেয সাহেবদের মাধমে তাহাজ্জুদের জামাআত বা কিয়ামুল লাইল এর জামাআত (তিন জনের বেশী মুসল্লী দ্বারা) চালু করা যাবে না। কারণ এটা না জায়িয ।
৭. হাফেয সাহেবদের মাধ্যমে প্রতিদিন স্বল্প সময়ের জন্য সুন্নাতের তালীম ও নামাযের আমলী মশকের ব্যবস্থা করা বাঞ্ছনীয়।
৮. হাফেয সাহেবদের রমযানের খানার ইন্তেযাম করা কর্তৃপক্ষের দায়িত্বে থাকবে।
৯. প্রতিদিন যাতায়াত করলে তার খরচ এবং তারাবীহ্ খতম শেষে হাফেয সাহেব নিজ বাড়িতে পৌঁছার খরচ কর্তৃপক্ষকে বহন করতে হবে।
১০. খতমের সময় ছাড়া অন্য কোন সময় কেউ যদি নিজ উদ্যোগে হাফেয সাহেবের মুহাব্বতে ব্যক্তিগত ভাবে হাদিয়া পেশ করেন তাহলে শরিআতে তার অনুমতি আছে এবং এটা আলেম-উলামা ও তালেবে ইলমদের খেদমতের অন্তর্ভুক্ত, যার প্রতি আল্লাহ্ তা'আলা কুরআনে কারীমের তৃতীয় পারায় সূরা বাকারায় ২৭৩ নং আয়াতে উৎসাহিত করেছেন। তবে এটা সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত ব্যাপার, কেউ করতে চাইলে করতে পারেন।
তারাবীহ নামাযের ইমামতের বিনিময় গ্রহণ
তারাবীহ নামাযের ইমামতের বিনিময় গ্রহণের শরয়ী বিধানঃ
তারাবীহ এর নামাযে ইমামতের বিনিময় আদান-প্রদান না-জায়িয হওয়া নির্ভরযোগ্য সকল ফিকাহবিদদের সর্বসম্মত মত। অতীতের কোন ফক্বীহ্ এ ব্যাপারে দ্বিমত করেননি। এতদসত্বেও বর্তমানে কেউ কেউ নিজস্ব মতকে শরীআতের মত ও ফিকাহবিদদের মত হিসাবে প্রচার করে তারাবীহ এর উজরতকে বৈধ বলার প্রয়াস চালাচ্ছেন। এ প্রেক্ষিতে সমকালীন বিশিষ্ট মুফতিয়ানে কিরামের ফাতাওয়া নিম্নে তুলে ধরা হলঃ
ফাতাওয়া বিভাগ, জামি'আ রাহমানিয়া, ঢাকা।
ইবাদত বন্দেগী হিসাবে আমরা যা পালন করে থাকি, সাধারণত তা তিন প্রকারঃ
(ক) মাকাসিদ তথা খালেস ও মূল ইবাদাত, যেমন নামায, রোযা, হজ, সাওয়াবের উদ্দেশ্যে কুরআন তিলাওয়াত, যিকির আযকার ও দু'আ দুরূদ ইত্যাদি।
(খ) ওয়াসাইল তথা সহায়ক ইবাদাতঃ - যেমন ইমামত, ইকামত, দীনী শিক্ষাদান ও ওয়াজ নসীহত ইত্যাদি।
(গ) রুক্বইয়াত তথা বালা মুসীবত থেকে পরিত্রাণ, রোগ মুক্তি, ব্যবসায় উন্নতি এ জাতীয় দুনিয়াবি কোন উদ্দেশ্যে বৈধ দু'আ, খতম, ঝাড় ফুঁক, তাবীয-কবয ইত্যাদি।
প্রথম প্রকার তথা মাকাসিদ জাতীয় ইবাদত করে বিনিময় নেয়া-দেয়া সম্পূর্ণ ও সর্বসম্মতভাবে হারাম। এ ব্যাপারে কোন কালেও কোন মাযহাবের কোন নির্ভরযোগ্য আলেম ফক্বীহ দ্বিমত পোষণ করেননি। পক্ষান্তরে তৃতীয় প্রকার আমলের বিনিময় গ্রহণ করা সম্পূর্ণ হালাল। শুরু থেকে অদ্যাবধি এ ব্যাপারে কোন মাযহাবের নির্ভরযোগ্য কোন মুজতাহিদ ফক্বীহ দ্বিমত পোষণ করেননি। (রদ্দুল মুহতার ৬ষ্ঠ খণ্ড, ৫৫,৫৮ পৃষ্ঠা, আল মুদওয়ানাতুল কুবরা ৩য় খণ্ড; ৪৩১ পৃষ্ঠা, ফাতওয়া রশীদিয়া-৪১৭ পৃষ্ঠা।)
আর দ্বিতীয় প্রকার তথা আযান, ইমামত, কুরআন-হাদীস তথা দীনী তালীযম এ জাতীয় পর্যায়ের ইবাদাতের বিনিময় গ্রহণ ও প্রদান অন্যান্য মাযহাবে জায়িয থাকলেও হানাফী মাযহাবের পূর্ববর্তী উলামায়ে কিরামের মতে নাজায়িয়। কিন্তু উলামায়ে মুতাআখখিরীন (পরবর্তী যুগের আলেমগণ) শরীআতের বিশেষ উসূল তথা মূলনীতির ভিত্তিতে বিশেষ কতক ইবাদাতের বিনিময় গ্রহণ ও প্রদানকে বৈধ বলেছেন। সে উসূল হলো এ শ্রেণীর যে সকল ইবাদাত ফরয ওয়াজিব ও সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ এবং শি’আরে ইসলামের অন্তর্ভুক্ত অথবা দীনের স্থায়িত্ব তার উপর নির্ভরশীল বিধায় বিনিময়ের আদান-প্রদান বৈধ না হলে এ যুগে এসকল ইবাদত কায়েম রাখা সম্ভব হবে না, তাই দীনের স্থায়িত্বের প্রয়োজনেই তা জায়িয। ফিকাহবিদগণ সে সকল ইবাদতকে চিহ্নিতও করেছেন আর তা হলোঃ ফরয ওয়াজিব নামাযের ইমামতি, আযান-ইকামত, দীনি শিক্ষাদান ইত্যাদি। (সূত্রঃ রদ্দুল মুহতার-৬ : ৬৯০, ৬৯১ পৃষ্ঠা। ইমদাদুল ফাতাওয়া ১ম খণ্ড ৪৭৬ পৃষ্ঠা ইমাদদুল মুফতীন ৩১৩ পৃষ্ঠা, ইমদাদুল আহকাম- ৩য় খণ্ড ৫২৭ পৃষ্ঠা)
পক্ষান্তরে এ দ্বিতীয় প্রকারের যে সকল ইবাদাত ফরয ওয়াজিব নয় এবং শি’আরে ইসলামের অন্তর্ভুক্ত নয়, দীনের স্থায়িত্বও তার উপর নির্ভরশীল নয় যেমনঃ তারাবীহ্ এবং সওয়াব রেসানীর উদ্দেশ্যে কুরআন খতম করা। এ সকল ইবাদাতের বিনিময় গ্রহণ ও বিনিময় প্রদানকে কোন আলেম জায়িয বলেননি বরং নির্ভরযোগ্য সকল ফিকাহবিদ লেনদেনকে হারাম বলেছেন। (ফাতওয়া রশীদিয়া ৩২৪পৃঃ, ইমদাদুল ফাতাওয়া ১ম খণ্ড ৪৮৪ পৃষ্ঠা, ইমদাদুল মুফতীন ৩১৫ পৃষ্ঠা, ইমদাদুল আহকাম ৩য় খণ্ড ৫১৭ পৃষ্ঠা। আসাদুল ফাতওয়া ৩য় খণ্ড ৫১৪ পৃষ্ঠা, ফাতাওয়া মাহদিয়া ৮ম খণ্ড ২৪৭ পৃষ্ঠা, ফাতওয়া দারুল উলুম ৪র্থ খন্ড ২৭৩ পৃষ্ঠা।)
সম্প্রতি দৈনিক ইনকিলাবের ইসলামী জীবন পাতায় একটি প্রশ্নের জবাবে দু,জন আলেম তারাবীহের বিনিময়ের ক্ষেত্রে ভিন্ন মত ব্যক্ত করেছেন। তন্মধ্যে একজন আলেম তার বর্ণনার এক পর্যায়ে লিখেছেন যুগের সকল ইমাম মুজতাহিদ ঐক্যবদ্ধভাবে রায় দিয়েছেন যে “পবিত্র কুরআন সুন্নাহ হেফাজত তথা তালীমে ইলমে দীন, ওয়াজ নসীহত, আযান ইকামত এক কথায় যাবতীয় ধর্মীয় আমলগুলোর উপর হাদিয়া বা উজরত যে কোন নামে দেয়া নেয়ায় কোন দোষ নেই, বরং উচিত।” এ উক্তির শেষ বাক্যে তিনি ইবাদাতের সব শ্রেণীকে একাকার করে ফেলেছেন। যার মর্ম দাঁড়ায় যে অন্যের জন্য নামায পড়ে, রোযা রেখে বিনিময় গ্রহণ করা যাবে বলে যুগের সকল ইমাম মুজতাহিদ ও আলেম ঐক্যবদ্ধ রায় দিয়েছেন। এমন কথা কোন মূর্খ বা দীনের ব্যাপারে স্পষ্ট খেয়ানতকারী ছাড়া কেউ বলতে পারে না। তিনি প্রমাণ করতে গিয়ে যে সকল কিতাবের বরাত দিয়েছেন, সেগুলোতে এ জাতীয় ফতোয়ার কোন উল্লেখ নেই। আর তারাবীহের বিনিময় আদান-প্রদান বৈধতার কথা থাকার তো প্রশ্নই আসেনা। আর অপর আলেম পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের আযান ইকামতের উপর কিয়াস করে তারাবীহে ইমামতকেও জরুরিয়াতে দীনের অন্তর্ভুক্ত করেছেন এবং এর বিনিময়কে জায়িয বলেছেন। অথচ তারাবীহের নামায একদিকে সুন্নাতে মুআক্কাদাহ অপরদিকে জামা'আত সহকারে খতম তারাবীহের পরিবর্তে সূরা তারাবীহ পড়ার অবকাশও রয়েছে। (রদ্দুল মুহতার ২য় খণ্ড; ৪৫পৃঃ রদ্দুল মুহতার ২য় খণ্ড ৪৭ পৃঃ)
পক্ষান্তরে পাঁচ ওয়াক্তের জামাআত মুসাফির ও মাযূর লোক ছাড়া সকল সাবালক পুরুষের জন্য বিশেষ ওযর না থাকলে মসজিদে গিয়ে আদায় করা ওয়াজিব। তাহলে উভয়টা এক রকম কি করে হলো। এ ছাড়া হাফেযপণ নিজ নিজ হিফয ঠিক রাখার তাগিদেই তারাবীহ পড়ানোর সুযোগ খুঁজতে থাকেন। এমতাবস্থায় বিনিময় না দিলে হাফেয পাওয়া যাবে না, বা খুব কম পাওয়া যাবে এ ধারনা তাঁর মধ্যে কি করে জন্ম হলো। তদুপুরি জনাব মুফতি সাহেব তারাবীর বিনিময় বৈধতায় নিজ মত উল্লেখ করার পর এ ব্যাপারে উলামায়ে মুতাআখখিরীনদের ফাতাওয়া নিম্নরূপ বলে যে বরাত দিয়েছেন তাতে সকলেই সর্বসম্মতভাবে এর বিনিময় লেন-দেনকে সম্পূর্ণ হারাম বলেছেন। তাঁরা পরিস্কার ভাবে বলেছেন তারাবীহের নামায সুন্নাত আর এর বিনিময় লেন-দেন হারাম । তাই সুন্নাত কায়েমের জন্য হারাম কাজের অনুমতি নেই। (ইমদাদুল ফাতওয়া ১ম খন্ড ৪৮৪ পৃষ্ঠা ইমদাদুল মুফতীন ৩১৫ পৃষ্ঠা)
আর তৎপূর্ববর্তীগণ সম্ভবত তারাবীহ এর বিনিময় নেয়ার কল্পনা করেননি। যার কারণে তাদের কিতাবাদীতে এতদসংক্রান্ত কোন আলোচনাই পাওয়া যায় না। তাছাড়া আলোচ্য মুফতী সাহেব তাঁর বর্ণনায় এক পর্যায়ে লিখেছেন, 'তারাবীহের নামাযের ইমামতি অন্য নামাযের ইমামতি হতে পৃথক নহে।' (হেদায়া প্রথম খণ্ড ৭৮ পৃষ্ঠা)
এটা পত্রিকার ছাপার ভুল না হয়ে থাকলে ইলমী বিষয়ে চরম খেয়ানত বিবেচিত হবে। কেননা হেদায়া গ্রন্থে কোথাও তারাবীহের জামাআতের ইমামতীকে অন্য নামাযের ইমামতীর ন্যায় বলা হয়নি, এটা নিছক মুফতী সাহেবের নিজস্ব উক্তি, যার রেফারেন্স কোন ফাতাওয়ার কিতাবে নেই।
সারকথা, ঢালাওভাবে সকল ধর্মীয় আমলের বিনিময় আদান-প্রদানের কথা যেমন ঠিক নয়, তেমনিভাবে পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের আযান-ইমামত যেমন জরুরত, তারাবীহের ইমামও ঠিক সে রকম জরুরত সে কথাও কোথাও নেই। বরং আকাবির সাহাবাগণ তো তারাবীহ নামায নিজ নিজ বাড়িতে পড়তেন। এ কারণে বর্তমান ও নিকট অতীতের সকল নির্ভরযোগ্য ফাতাওয়া অনুযায়ী তারাবীহ্-এর ইমামতী করে বিনিময় দেয়া ও নেয়া বৈধ নয়। আর হাদিয়ার সাথে তারাবীহ্ এর ইমামতের কোন সম্পৃক্ততা নেই। কাজেই হাদিয়ার প্রশ্ন এখানে অবান্তর। খতমের সময় ব্যতীত অন্য সময় যদি হাফেজ সাহেবের মুহাব্বতে ব্যক্তিগতভাবে কেউ হাদিয়া পেশ করেন তাহলে এটা সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিষ এবং তা শরীআতেও অনুমোদিত। (ফাতাওয়া রশীদিয়া ৩২৫ পৃষ্ঠা, ইমদাদুল মুফতীন ৩১৪ পৃষ্ঠা, ফাইজুল বারী ৩য় খন্ড, ১৮১ পৃষ্ঠা)
সুতরাং হাফেজদের নিজেদের হারাম রিযিক থেকে পরহেজ করা ফরয এবং মুসল্লীদেরও উচিত ক্বারী, হাফেজ আলেমদেরকে সহীহ্ পন্থায় হাদিয়া পেশ করা। আল্লাহ্ তা'আলা আমাদের সকলকে সঠিক বুঝ দান করুন। আমীন।
***************************************
Thank you for visiting the site. If you like the article, share it on social media to invite other Vines to the path of truth and justice. Click on OUR ACTION PLAN button to know about activities, goals and objectives of Mohammadia Foundation and to participate in the service of religion and humanity.
Almost all articles on this website are written in Bengali. But you can also read it in your language if you want. Click the “ভাষা বেছে নিন” button at the bottom of the website to read in your own language.