তাফসীরে ইবনে কাসীর - ৩৫ || সূরা বাকারা - ২৫ || সত্যকে মিথ্যা মিথ্যাকে সত্য করা || আমলহীন উপদেশদাতার শাস্তি ||





সত্যকে মিথ্যা মিথ্যাকে সত্য করা এবং আমলহীন ব্যক্তির উপদেশ দেওয়ার পরিণাম


সূরা আল বাকারা ৪২নং আয়াত

وَ لَا تَلۡبِسُوا الۡحَقَّ بِالۡبَاطِلِ وَ تَکۡتُمُوا الۡحَقَّ وَ اَنۡتُمۡ تَعۡلَمُوۡنَ ﴿۴۲

সূরা আল বাকারা ৪২নং আয়াতের অর্থ

৪২। এবং তোমরা সত্যকে মিথ্যার সাথে মিশ্রিত করনা এবং জেনে শুনে সত্য গোপন করনা।

   

সূরা আল বাকারা ৪৩নং আয়াত

وَ اَقِیۡمُوا الصَّلٰوۃَ وَ اٰتُوا الزَّکٰوۃَ وَ ارۡکَعُوۡا مَعَ الرّٰکِعِیۡنَ ﴿۴۳

সূরা আল বাকারা ৪৩নং আয়াতের অর্থ

৪৩। আর তোমরা সালাত প্রতিষ্ঠিত কর ও যাকাত প্রদান কর এবং রুকুকারীদের সাথে রুকু কর ।


সূরা আল বাকারা ৪২-৪৩নং আয়াতের তাফসীর

সত্যকে মিথ্যা মিথ্যাকে সত্য করা

সত্যকে আড়াল করা কিংবা সত্যকে পরিবর্তন করার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা
ইয়াহুদীদেরকে এ বদ অভ্যাসের জন্য তিরস্কার করা হচ্ছে যে, তারা জানা সত্ত্বেও কখনও সত্য ও মিথ্যাকে মিশ্রিত করত, আবার কখনও সত্যকে গোপন করত এবং মিথ্যাকে প্রকাশ করত। তাদেরকে এ কুঅভ্যাস ত্যাগ করতে বলা হচ্ছে এবং উপদেশ দেয়া হচ্ছে যে, তারা যেন সত্যকে প্রকাশ করে ও স্পষ্টভাবে বর্ণনা করে। আর তারা যেন ন্যায় ও অন্যায়, সত্য ও মিথ্যাকে মিশ্রিত না করে, আল্লাহর বান্দাদের মঙ্গল কামনা করে, ইয়াহুদী ও খৃষ্টানদের বিদ'আতকে ইসলামের শিক্ষার সঙ্গে মিশ্রিত না করে। (তাবারী ১/৫৬৯) আর তারা তাদের কিতাবে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে যে ভবিষ্যদ্বাণী পাচ্ছে তা যেন সর্বসাধারণের মধ্যে প্রকাশ করতে কার্পণ্য না করে।

অতঃপর তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হচ্ছে যে, তারা যেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে সালাত আদায় করে, যাকাত প্রদান করে, তাঁর উম্মাতের সাথে রুকু' ও সাজদায় অংশগ্রহণ করতে থাকে, তাদের সাথে মিলেমিশে থাকে এবং তারা নিজেরাও যেন তাঁরই উম্মাত হয়ে যায়। আনুগত্য ও অন্তরঙ্গতাকেও যাকাত বলা হয়।

'রুকূকারীদের সাথে রুকু কর' এর অর্থ এই যে, তারা যেন ভাল কাজে মু'মিনদের সাথে অংশগ্রহণ করে। আর ঐ কাজগুলির মধ্যে সালাতই হল সর্বোত্তম। এ আয়াত দ্বারা অধিকাংশ আলিম জামা'আতের সাথে সালাত ফরজ হওয়ার দলীল গ্রহণ করেছেন। এখানে ইমাম কুরতবী (রহঃ) জামা'আত সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন।

সূরা আল বাকারা ৪৪নং আয়াত

 اَتَاۡمُرُوۡنَ النَّاسَ بِالۡبِرِّ وَ تَنۡسَوۡنَ اَنۡفُسَکُمۡ وَ اَنۡتُمۡ تَتۡلُوۡنَ الۡکِتٰبَ ؕ اَفَلَا تَعۡقِلُوۡنَ ﴿۴۴

সূরা আল বাকারা ৪৪নং আয়াতের অর্থ

৪৪। তোমরা লোকদেরকে কি সৎ কাজে আদেশ করছ এবং তোমাদের নিজেদের সম্বন্ধে বিস্মৃত হচ্ছ? অথচ তোমরা গ্রন্থ পাঠ কর; তাহলে কি তোমরা হৃদয়ঙ্গম করছনা?

   

সূরা আল বাকারা ৪৪নং আয়াতের তাফসীর

উপদেশ দেওয়ার আগে নিজে আমল কর

অন্যকে উপদেশ দিয়ে নিজে তা না করার জন্য তিরস্কার
আল্লাহ তা'আলা লোকদেরকে আচরণের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন যে, যারা ভাল কাজের আদেশ করেন তাদের উচিত প্রথমেই নিজেরা তা বাস্তবায়ন করে উদাহরণ সৃষ্টি করা। (তাবারী ২/৮) মুহাম্মাদ ইব্‌ন ইসহাক (রহঃ) ইবন আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, এর ভাবার্থ হল 'অথচ তোমরা নিজেরা তা কার্যকর করতে ভুলে যাও'। কিতাবীদেরকে লক্ষ্য করে বলা হচ্ছে, যারা অন্যকে ভাল কাজের আদেশ করে থাকে, অথচ নিজেরা তা পালন করেনা। তাদের জন্য কঠিন শাস্তি রয়েছে, এটা জানা সত্ত্বেও যে কিতাবীরা এ কাজ করছে এটা বড়ই বিস্ময়কর ব্যাপারই বটে। তাই তাদেরকে উপদেশ দেয়া হচ্ছে যে, তারা অপরকে যেমন আল্লাহভীতি ও পবিত্রতার কথা শিক্ষা দিচ্ছে, তাদের নিজেদেরও তার উপর আমল করা উচিত। অপরকে সালাত-সিয়ামের নির্দেশ দেয়া, অথচ নিজে পালন না করা বড়ই লজ্জার কথা। জনগণকে বলার পূর্বে মানুষের উচিত নিজে আমলকারী হওয়া। অর্থ এও হচ্ছে যে, তারা অন্যদেরকে তো তাদের কিতাবকে অস্বীকার করতে নিষেধ করছে অথচ আল্লাহর নাবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অস্বীকার করে নিজেরাই তাদের কিতাবকে অস্বীকার করছে। ভাবার্থ এও হতে পারে যে, তারা অন্যদেরকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে বলছে, অথচ ইহলৌকিক ভয়ের কারণে তারা নিজেরাই ইসলাম কবূল করছেনা।

আমল ও উপদেশের মধ্যে একটি সূক্ষ্ম পার্থক্য

এখানে এটা স্মরণ রাখতে হবে যে, ভালো কাজের নির্দেশ দেয়ার জন্য আহলে কিতাবদেরকে তিরস্কার করা হয়নি, বরং তারা নিজেরা পালন না করার জন্য তিরস্কৃত হয়েছে। ভালো কথা বলা তো ভালোই, বরং এটা তো ওয়াজিব, কিন্তু সাথে সাথে মানুষের নিজেরও তার প্রতি ‘আমল করা উচিত। যেমন শু‘আইব (আঃ) বলেছেনঃ

وَ مَاۤ اُرِیْدُ اَنْ اُخَالِفَكُمْ اِلٰى مَاۤ اَنْهٰىكُمْ عَنْهُ١ؕ اِنْ اُرِیْدُ اِلَّا الْاِصْلَاحَ مَا اسْتَطَعْتُ١ؕ وَ مَا تَوْفِیْقِیْۤ اِلَّا بِاللّٰهِ١ؕ عَلَیْهِ تَوَكَّلْتُ وَ اِلَیْهِ اُنِیْبُ

আর আমি এটা চাই না যে, আমি তোমাদের বিপরীত সেই সব কাজ করি যা হতে তোমাদেরকে নিষেধ করছি; আমি তো সংশোধন করে দিতে চাচ্ছি, যে পর্যন্ত আমার সাধ্যে হয়, আর আমার যা কিছু প্রচেষ্টা তা শুধু মহান আল্লাহরই সাহায্যে হয়ে থাকে; আমি তাঁরই ওপর ভরসা রাখি এবং তাঁরই দিকে প্রত্যাবর্তন করি। (১১ নং সূরাহ্ হুদ, আয়াত নং ৮৮) সুতরাং ভালো কাজ করতে বলা ওয়াজিব এবং নিজে করাও ওয়াজিব। একটি না করলে অন্যটিও ব্যর্থ হয়ে যাবে তা নয়। পূর্ববর্তী ও পরবর্তী ‘আলিমদের অভিমত এটাই। যদিও কতকগুলো লোকের অভিমত এই যে, যারা নিজেরা খারাপ কাজ করে তারা যেন অপরকে ভালো কাজের কথা না বলে। কিন্তু এটা সঠিক কথা নয়।

আমলহীন উপদেশদাতার শাস্তি

মুসনাদ আহমাদে আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : 'মিরাজের রাতে আমি দেখেছি যে, কতকগুলো লোকের ওষ্ঠ আগুনের কাঁচি দ্বারা কাটা হচ্ছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম যে, এরা কারা? তখন আমাকে বলা হল যে, এরা আপনার উম্মাতের বক্তা, উপদেশ দাতা ও আলেম। এরা মানুষকে ভাল কথা শিক্ষা দিত কিন্তু নিজে আমল করতনা, জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও বুঝতনা।' অন্য হাদীসে আছে যে, তাদের জিহ্বা ও ওষ্ঠ উভয়ই কাটা হচ্ছিল। হাদীসটি বিশুদ্ধ। ইব্‌ন হিব্বান (রহঃ), আদী ইবন আবী হাতিম (রহঃ), ইব্‌ন মিরদুওয়াই (রহঃ) প্রমুখ মনীষীদের লিখিত কিতাবের মধ্যে এটা বিদ্যমান আছে।

আবূ অ'য়েল (রহঃ) বলেন যে, একদা উসামাকে (রাঃ) বলা হয় : 'আপনি উসমানকে (রাঃ) কেন কিছু বলেননা? তিনি উত্তরে বলেন : 'আপনাদেরকে শুনিয়ে বললেই কি শুধু বলা হবে? আমি তো গোপনে তাঁকে সব সময়েই বলে আসছি। কিন্তু আমি কোন কথা ছড়াতে চাইনা। আল্লাহর শপথ! আমি কোন লোককে সর্বোত্তম বলবনা, যদিও সে আমার খুব নিকটেরও হয়। কেননা আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছিঃ

কিয়ামাতের দিন একটি লোককে আনা হবে এবং তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। তার নাড়ীভুঁড়ি বেরিয়ে আসবে এবং সে তার চারদিকে ঘুরতে থাকবে । অন্যান্য জাহান্নামবাসীরা তাকে জিজ্ঞেস করবে : 'জনাব আপনি তো আমাদেরকে ভাল কাজের আদেশ করতেন এবং মন্দ কাজ হতে নিষেধ করতেন, আপনার এ অবস্থা কেন?' সে বলবে : 'আফসোস! আমি তোমাদেরকে বলতাম, কিন্তু নিজে আমল করতামনা। আমি তোমাদেরকে বিরত রাখতাম কিন্তু নিজে বিরত থাকতামনা । (ফাতহুল বারী ৬/৩৮১, মুসলিম ৪/২২৯১, আহমাদ ৫/২০৫)


উপদেশ দেওয়ার বিষয়ে একটি ঘটনা

একটি ঘটনার বর্ণনা
ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) বলেন, ‘এক স্থানে তো আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেনঃ তোমরা জনগণকে ভালো কাজের আদেশ করছো, আর নিজেদের সম্বন্ধে বেখবর রয়েছো। ইবরাহীম নাখ‘ঈ (রহঃ) বলেনঃ তিনটি সূরার আয়াতের কারণে আমি লোকদেরকে উপদেশ দেয়ার ব্যাপারে দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ি। তা হলো আলোচ্য এ আয়াতটি এবং নিম্নের দু’টি আয়াতসমূহ। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেনঃ

یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا لِمَ تَقُوْلُوْنَ مَا لَا تَفْعَلُوْنَ۝۲ كَبُرَ مَقْتًا عِنْدَ اللّٰهِ اَنْ تَقُوْلُوْا مَا لَا تَفْعَلُوْنَ

হে মু’মিনগণ! তোমরা যা করো না তা তোমরা কেন বলো? তোমরা যা করো না তোমাদের তা বলা মহান আল্লাহর দৃষ্টিতে অতিশয় অসন্তোষজনক। (৬১ নং সূরাহ্ সাফ, আয়াত নং ২-৩। তাফসীর কুরতুবী ১/৩৬৭) মহান আল্লাহর নিকট এটা খুব অসন্তষ্টির কারণ যে, তোমরা যা বলবে তা নিজেরা করবে না।’ অন্য আয়াতে শু’আইব (আঃ)-এর কথা, যেমন মহান আল্লাহ বলেনঃ

وَ مَاۤ اُرِیْدُ اَنْ اُخَالِفَكُمْ اِلٰى مَاۤ اَنْهٰىكُمْ عَنْهُ١ؕ اِنْ اُرِیْدُ اِلَّا الْاِصْلَاحَ مَا اسْتَطَعْتُ١ؕ وَ مَا تَوْفِیْقِیْۤ اِلَّا بِاللّٰهِ١ؕ عَلَیْهِ تَوَكَّلْتُ وَ اِلَیْهِ اُنِیْبُ

আর আমি এটা চাইনা যে, আমি তোমাদের বিপরীত সেই সব কাজ করি যা হতে তোমাদেরকে নিষেধ করছি; আমি তো সংশোধন করে দিতে চাচ্ছি, যে পর্যন্ত আমার সাধ্যে হয়, আর আমার যা কিছু প্রচেষ্টা তা শুধু মহান আল্লাহরই সাহায্যে হয়ে থাকে; আমি তাঁরই ওপর ভরসা রাখি এবং তাঁরই দিকে প্রত্যাবর্তন করি। (১১ নং সূরাহ্ হুদ, আয়াত নং ৮৮)

আচ্ছা বলতো ! তুমি কি এই তিনটি আয়াত হতে নির্ভয় হয়ে রয়েছো? সে বলেঃ ‘না।’ তিনি বলেনঃ ‘তুমি স্বীয় নাফ্স হতেই আরম্ভ করো।’






******************************************
Thank you for visiting the site. If you like the article, share it on social media to invite other Vines to the path of truth and justice. Click on OUR ACTION PLAN button to know about activities, goals and objectives of Mohammadia Foundation and to participate in the service of religion and humanity.
Almost all articles on this website are written in Bengali. But you can also read it in your language if you want. Click the “ভাষা বেছে নিন” button at the bottom of the website to read in your own language.



এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url