সাহাবাগণের জীবনকথা-৫৩ || ইকরিমা ইবন আবু জাহল (রা) এর জীবনী






ইকরিমা ইবন আবু জাহল (রাঃ)

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁর সম্পর্কে বলেনঃ “শিগগিরই ইকরিমা কুফর ত্যাগ করে মুমিন হিসেবে তােমাদের কাছে আসছে। তোমরা তার পিতাকে (আবু জাহল) গালি দেবেনা। কারণ মৃতকে গালি দিলে জীবিতদের মনোকষ্টের কারণ হয় এবং মৃতের কাছে তা পৌছেন না।'

ইকরিমার বংশ পরিচয়

নবী মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সাঃ) যখন মক্কায় দ্বীনের দাওয়াত দিতে শুরু করেন তখন ইকরিমার বয়সের তৃতীয় দশকটি শেষ হতে চলেছে। কুরাইশদের মধ্যে বংশের দিক দিয়ে তিনি ছিলেন সর্বাধিক সম্মানিত ও ধনশালী। মক্কার সম্ভ্রান্ত গৃহের সন্তান সা'দ ইবন আবী ওয়াক্কাস, মুসয়াব ইবন উমাইর প্রমুখের মত তারও উচিত ছিল প্রথম স্তরেই ইসলাম গ্রহণ করা। কিন্তু তার পিতার জন্য তা সম্ভব হয়নি। | তার পিতা আবু জাহল ছিল মক্কার সবচেয়ে বড় স্বেচ্ছাচারী, প্রথম যুগের মুশরিকদের নেতা ও কঠোর অত্যাচারী। আল্লাহ তা'আলা তার অত্যাচার-উৎপীড়নের মাধ্যমে মু'মিনদের ঈমান পরীক্ষা করেছেন এবং সে পরীক্ষায় তারা সফলকাম হয়েছেন। তার ধোকার মাধ্যমে বিশ্বাসীদের সত্যতা যাচাই করেছেন এবং তাতে তারা উত্তীর্ণ হয়েছেন।

   

ইসলাম গ্রহণের পূর্বে ইকরিমার কর্মকান্ড


পিতার নেতৃত্বে ইকরিমা মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (সাঃ) শত্রুতায় আত্মনিয়োগ করেন। এ ব্যাপারে তাঁর ভূমিকা ছিল অত্যন্ত কঠোর। তার অত্যাচারে রাসূলুল্লাহর (সাঃ) সাহাবীদের জীবন দুর্বিসহ হয়ে পড়েছিল। ইসলাম ও মুসলমানদের প্রতি তাঁর এ নিষ্ঠুরতা দেখে তাঁর পিতা আবু জাহল পরম আত্মতৃপ্তি অনুভব করতো।

তাঁর পিতা বদরের যুদ্ধে মুশরিকদের নেতৃত্ব দেয়। সে লাত ও উজ্জার নামে শপথ করে যে, মুহাম্মাদের একটা হেনস্তা না করে মক্কায় ফিরবে না। বদরে ঘাঁটি গেড়ে তিন দিন অবস্থান করলাে, উট জবেহ করলাে, মদ পান করে মাতাল হলাে এবং গায়কগায়িকাদের নিয়ে নাচ-গানে মত্ত হলাে। আবু জাহল যখন এ যুদ্ধ পরিচালনা করছিল, ইকরিমা তখন তার ডান হাত- প্রধান সহযােগী। কিন্তু লাত ও উজ্জা এ যুদ্ধে আবু জাহলের ডাকে সাড়া দেয়নি, এ দু,টি উপাস্য মূর্তি তাকে কোন সাহায্য করতে পারেনি। পারা সম্ভবও ছিলাে না।

বদরের ময়দানে আবু জাহল মুখ থুবড়ে পড়ে রইলাে। ইকরিমা নিজ চোখেই দেখলেন কিভাবে মুসলমানদের তীরের ফলা তাঁর পিতার রক্ত পান করছে এবং তিনি নিজ কানেই শুনতে পেলেন তাঁর পিতার মুখের অন্তিম চিৎকার ধ্বনিটি।

কুরাইশ নেতা আবু জাহলের মৃতদেহটি বদরে ফেলে রেখে ইকরিমা মক্কায় ফিরে এলেন। শোচনীয় পরাজয় তাকে পিতার লাশটি দাফনের সুযােগ পর্যন্ত দেয়নি। মুসলমানরা বদরে নিহত অন্যান্য মুশরিক সৈন্যদের সাথে তার লাশটিও ‘কালীব' নামক কূপে নিক্ষেপ করে মাটি চাপা দেয়। এভাবেই এ অহঙ্কারী অত্যাচারী কুরাইশ নেতার দর্প চূর্ণ হয়। এ দিন থেকেই ইসলামের সাথে ইকরিমার আচরণ নতুনরূপে আত্মপ্রকাশ করে। 

উহুদের যুদ্ধে মুসলিমদের বিরুদ্ধে ইকরিমার বিজয়


এ যাবত তিনি পিতার মান-মর্যাদা রক্ষার্থে ইসলামের সাথে দুশমনী করে এসেছেন। আর এখন তিনি প্রতিজ্ঞা করলেন পিতার রক্তের প্রতিশােধ গ্রহণের। বদরে অন্য যারা পিতৃহারা হয়েছিল, তিনি তাদের সাথে সম্মিলিতভাবে মুহাম্মদের (সাঃ) বিরুদ্ধে মুশরিকদের অন্তরে শক্রতার আগুন জ্বালিয়ে দিতে শুরু করলেন এবং তাদেরকে বদরে নিহতদের রক্তের প্রতিশােধ গ্রহণের জন্য উৎসাহিত করতে লাগলেন। এভাবেই উহুদের যুদ্ধটি সংগঠিত হয়।

ইকরিমা ইবন আবু জাহল উহুদের দিকে যাত্রা করলেন। সংগে তার স্ত্রী উম্মু হাকীমও বদরে স্বামী, ভ্রাতা ও পুত্রহারা নারীদের সাথে চললেন। উদ্দেশ্য, তারা সেখানে যুদ্ধরত সৈনিকদের পশ্চাতে অবস্থান করে বাদ্য বাজাবেন, কুরাইশদেরকে যুদ্ধে উৎসাহ দেবেন এবং পলায়ন উদ্যত সৈনিকদেরকে সাহস ও শক্তি যােগাবেন। 

কুরাইশরা তাদের অশ্বারােহী সৈনিকদের ডান দিকে খালিদ বিন ওয়ালিদ ও বাম দিকে ইকরিমা ইবন আবু জাহলকে নিয়োগ করলাে। সেদিন তারা দু'জন সাহসিকতা ও রণকৌশলের চরম পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছিলেন। তারা মুহাম্মদ (সাঃ) ও তার সাথীদের হাত থেকে বিজয়ের গৌরব ছিনিয়ে এনে কুরাইশদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। তাই সেদিনকার কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ান বলতে পেরেছিলেন? 'এটা বদরের দিনের। প্রতিশােধ।'

খন্দকের যুদ্ধে ইকরিমার পলায়ন

এরপর এলাে খন্দকের যুদ্ধ। মুশরিক সৈন্যরা কয়েকদিন যাবত মীনা অবরােধ করে রেখেছে। ইকরিমার ধৈর্যের বাঁধ ভেংগে যাচ্ছে, তিনি তিক্ত-বিরক্ত হয়ে উঠছেন। অবশেষে তিনি দেখতে পেলেন খন্দকের এক স্থানে সংকীর্ণ একটা পথ। তার মধ্য দিয়ে অতি কষ্টে তিনি তার ঘােড়াটি ঢুকিয়ে দিলেন এবং খন্দক পার হয়ে গেলেন। তাঁকে অনুসরণ করে খন্দক পার হলাে আরাে কিছু মুশরিক সৈনিক। মুসলিম সৈনিকরা তাদেরকে তাড়া করেন। ইকরিমা তার অন্য সংগীদের সাথে পালিয়ে গিয়ে প্রাণ বাঁচান, কিন্তু তার একজন সংগী আমর ইবনু আবদে উদ্দ আল-আমিরী মুসলিম সৈনিকদের হাতে প্রাণ হারায়।

মক্কা বিজয়ের দিন ইকরিমার পলায়ন

মক্কা বিজয়ের দিন কুরাইশরা বুঝতে পারলো মুহাম্মাদ (সাঃ) ও তাঁর সাথীদের বাধা দেওয়া কোনভাবেই সম্ভব হবে না। তারা মুসলমানদের পথ ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। মুহাম্মাদ (সাঃ) ঘােষণা করলেন। মক্কাবাসীদের যারা মুসলিম সৈনিকদের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হবে, কেবল তাদের সাথেই যুদ্ধ করা হবে। তাছাড়া অন্য সকলকে ক্ষমা করা হবে।

ইকরিমা ইবনে আবু জাহল এবং আরাে একদল সৈনিক কুরাইশদের সিদ্ধান্ত অমান্য করে মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রতিরােধ খাড়া করেন। খালিদ ইবনে ওয়ালিদের নেতৃত্বে মুসলিম সৈনিকদের ছােট্ট একটি দল তাদের এ প্রতিরােধ ব্যুহ তছনছ করে দেয়। তারা তাদের অনেককে হত্যা করে এবং অনেকে পালিয়ে গিয়ে প্রাণ বাঁচায়। এ পলায়নকারীদের মধ্যে ইকরিমা ইবন আবু জাহলও ছিলেন।

মুসলমানদের মক্কা বিজয়ের পর ইকরিমা ইবন আবু জাহল কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লেন। তিনি এই প্রথম বারের মত তার শক্তি মদমত্ততা থেকে সম্বিত ফিরে পেলেন। তিনি বুঝতে পারলেন মক্কা আর তার জন্যে নিরাপদ নয়। এদিকে রাসূল (সাঃ) মক্কাবাসীদের সকলের অতীত আচরণ ক্ষমা করে দেন। তবে তিনি কয়েকজনের নাম উচ্চারণ করে তাদেরকে এ ক্ষমার আওতা থেকে ব্যতিক্রম ঘােষণা করেন। কাবার গিলাফের নীচে পাওয়া গেলেও তিনি তাদেরকে হত্যার নির্দেশ দেন। হত্যার নির্দেশপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের তালিকার শীর্ষস্থানে ইকরিমার নামটি। তিনি কোন উপায়ান্তর না দেখে গোপনে মক্কা থেকে বের হয়ে ইয়ামিনের দিকে যাত্রা করেন।

ইকরিমা (রাঃ) এর ইসলাম গ্রহণের কাহিনী

এদিকে ইকরিমার স্ত্রী উম্মু হাকীম ও হিন্দা বিনতু উত্তবা গেলেন রাসূলুল্লাহর (সাঃ) কাছে। তাদের সাথে গেলেন আরাে অনেক মহিলা। উদ্দেশ্য তাদের, রাসূলুল্লাহর (সাঃ) হাতে বাইয়াত হওয়া। তারা যখন রাসুলুল্লাহর (সা) কাছে পৌছলেন, তখন তার কাছে বসা ছিলেন তার দু' স্ত্রী, কন্যা ফাতিমা ও বনী আবদুল মুত্তালিবের আরাে বহু মহিলা। মাথা ও মুখ ঢাকা অবস্থায় হিন্দা কথা বললেন রাসূলুল্লাহর (সাঃ) সাথে। হিন্দা ছিলেন আবু সুফিয়ানের স্ত্রী ও আমীর মুয়াবিয়ার মা। উহুদের যুদ্ধে হযরত হামযার (রাঃ) কলিজা চিবিয়েছিলেন ইনিই। তাই মক্কা বিজয়ের দিনে লজ্জা ও অনুশোচনায় মাথা ও মুখ ঢেকে তিনি রাসূলুল্লাহর (সাঃ) দরবারে উপস্থিত হন। ইয়া রাসূলাল্লাহ, সেই আল্লাহর প্রশংসা, যিনি তাঁর মনােনীত দ্বীনকে বিজয়ী করেছেন। আপনার ও আমার মাঝে যে আত্মীয়তার সম্পর্ক রয়েছে সে সূত্রে আমি আপনার নিকট ভালাে ব্যবহার আশা করি। এখন আমি একজন ঈমানদার ও বিশ্বাসী নারী এ কথা বলেই তিনি তার অবগুণ্ঠন খুলে পরিচয় দেন “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমি হিন্দা বিনতু উতবা'। রাসূল (সাঃ) বললেন, ‘খােশ আমদেদ।' হিন্দা বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ, আল্লাহর কসম, হেয় ও অপমানিত করার জন্য আপনার বাড়ী থেকে আমার নিকট অধিক প্রিয় বাড়ী ধরাপৃষ্ঠে এর আগে আর ছিলনা। আর এখন আপনার বাড়ী থেকে অধিক সম্মানিত বাড়ী আমার নিকট দ্বিতীয়টি নেই। 

রাসূল (সাঃ) বললেন : আরাে অনেক বেশী।

এরপর ইকরিমার স্ত্রী উম্মু হাকীম উঠে দাঁড়িয়ে ইসলাম গ্রহণের স্বীকৃতি দিলেন। তারপর বললেনঃ ইয়া রাসুলাল্লাহ, আপনি ইকরিমাকে হত্যা করতে পারেন, এ ভয়ে সে ইয়ামনের দিকে পালিয়ে গেছে। আপনি তাকে নিরাপত্তা দিন আল্লাহ আপনাকে নিরাপত্তা দেবেন। 

রাসূল (সা) বললেন, 'সে নিরাপদ।

সেই মুহূর্তে উম্মু হাকীম তার স্বামী ইকরিমার সন্ধানে বের হলেন। সংগে নিলেন তার এক রূমী ক্রীতদাস। তারা দু'জন রাস্তায় চলছেন। পথিমধ্যে দাসিটির মনে তাঁর মনিবের প্রতি অসৎ কামনা দেখা দিল। সে চাইলাে তাকে ভােগ করতে, আর তিনি নানা রকম টালবাহানা করে সময় কাটাতে লাগলেন। এভাবে তারা একটি আরব গােত্রে পৌছলেন। সেখানে উম্মু হাকীম তাঁদের সাহায্য কামনা করলেন। তারা তাকে সাহায্যের আশ্বাস দিল। তিনি তাঁর দাসিটিকে তাদের জিম্মায় রেখে একাকী পথে বের হলেন। অবশেষে তিনি তিহামা অঞ্চলে সমুদ্র উপকূলে ইকরিমার দেখা পেলেন। সেখানে তিনি এক মাঝির সাথে কথা বলছেন তাঁকে পার করে দেওয়ার জন্য, আর মাঝি তাকে বলছেনঃ

= 'সত্যবাদী হও' 
ইকরিমা তাকে বললেন, - কিভাবে আমি সত্যবাদী হবে? 
মাঝি বললেন, - “তুমি বলাে, আশহাদু আন লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ।' 
- “আমি তাে শুধু এ কারণেই পালিয়েছি। তাদের দু'জনের এ কথােপকথনের মাঝখানেই উম্মু হাকীম উপস্থিত হলেন। তিনি তাঁর স্বামীকে লক্ষ্য করে বললেনঃ

“হে আমার চাচাতাে ভাই, আমি সর্বোত্তম, সর্বশ্রেষ্ঠ ও পবিত্রতম ব্যক্তির নিকট থেকে আসছি। আমি তার কাছে তোমার জন্য আমান চেয়েছি। তিনি তােমার আমান মঞ্জুর করেছেন। সুতরাং এরপরও তুমি নিজেকে ধংস করোনা।

এ কথা শুনে ইকরিমা জিজ্ঞেস করলেন? 
- “তুমি নিজেই তার সাথে কথা বলেছো?' 

তিনি বললেনঃ 
- “হা, আমিই তার সাথে কথা বলেছি, এবং তিনি তোমাকে আমান দিয়েছেন' এভাবে বার বার তিনি তাকে আমানের কথা শুনাতে লাগলেন ও তাকে আশ্বাস দিতে লাগলেন। অবশেষে আশ্বস্ত হয়ে তিনি স্ত্রীর সাথে ফিরে চললেন।

পথে চলতে চলতে উম্ম হাকীম তার দসিটির কাণ্ড-কারখানার কথা স্বামীকে খুলে বললেন। ফেরার পথে ইসলাম গ্রহণের পূর্বেই ইকরিমা দাসটিকে হত্যা করেন।

পথিমধ্যে তারা এক বাড়ীতে রাত্রি যাপন করেন। ইকরিমা চাইলেন একান্তে তার স্ত্রীর সাথে মিলিত হতে। কিন্তু স্ত্রী কঠোরভাবে প্রত্যাখ্যান করে বলেন,

- ‘আমি একজন মুসলিম নারী এবং আপনি এখনও একজন মুশরিক। স্ত্রীর কথা শুনে ইকরিমা অবাক হয়ে গেলেন। তিনি বললেনঃ

- 'তোমার ও আমার মিলনের মাঝখানে যে ব্যাপারটি অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে তা তাে। খুব বিরাট ব্যাপার ।!'

এভাবে ইকরিমা যখন মক্কার নিকটবর্তী হলেন, তখন রাসূল (সাঃ) তার সাহাবীদের বললেন ! খুব শিগগিরই ইকরিমা কুফর ত্যাগ করে মুমিন হিসেবে তােমাদের কাছে আসছে। তােমরা তার পিতাকে গালি দেবে না। কারণ মৃতকে গালি দিলে তা জীবিতদের মনে কষ্টের কারণ হয় এবং মৃতের কাছে তা পৌঁছে না।'

কিছুক্ষণের মধ্যেই ইকরিমা তার স্ত্রীসহ রাসূলুল্লাহর (সা) কাছে উপস্থিত হলেন। রাসূল (সাঃ) তাকে দেখেই আনন্দে উঠে দাঁড়ালেন এবং চাদর গায়ে না জড়িয়েই তার দিকে এগিয়ে গেলেন। তারপর রাসূল (সাঃ) বসলেন। ইকরিমা তার সামনে দাঁড়িয়ে বলেন।

- "ইয়া মুহাম্মাদ, উম্মু হাকীম আমাকে বলেছে, আপনি আমাকে আমান দিয়েছেন।'

নবী (সাঃ) বললেন, 'সে সত্যই বলেছে। তুমি নিরাপদ।' ইকরিমা কললেন, মুহম্মদ, আপনি কিসের দাওয়াত দিয়ে থাকেন? রাসূল (সাঃ) বললেন, 'আমি তোমাকে দাওয়াত দিচ্ছি তুমি সাক্ষ্য দেবে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন মাবুদ নেই এবং আমি আল্লাহর বান্দাহ ও তাঁর রাসূল। তারপর তুমি নামায কায়েম করবে, যাকাত দান করবে। এভাবে তিনি ইসলামের সবগুলি আরকান বর্ণনা করলেন।

ইকরিমা বললেন, 'আল্লাহর কসম, আপনি একমাত্র সত্যের দিকেই দাওয়াত দিচ্ছেন এবং কল্যাণের নির্দেশ দিচ্ছেন। তারপর তিনি বলতে লাগলেনঃ

- এ দাওয়াতের পূর্বেই আপনি ছিলেন আমাদের মধ্যে সবচেয়ে সত্যবাদী এবং সবচেয়ে সৎকর্মশীল।' তারপর একথা বলতে বলতে তিনি হাত বাড়িয়ে দেন এবং বলেন, 'আশহাদু আন লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আশহাদু আন্নাকা আবদুহু ওয়া রাসূলুহু। একথার পর তিনি বলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমি বলতে পারি, এমন কিছু ভাল কথা আমাকে শিখিয়ে দিন।

রাসূল (সাঃ) বললেন, “তুমি বলাে, আশহাদু আন লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসুলুহু।

রাসুল (সাঃ) বললেন, “তুমি বলাে, উশহিদুল্লাহ ওয়া উশহিদু মনি হাদারা আন্নি মুসলিমুন মুজাহিদুন মুহাজিরুন- আল্লাহ ও উপস্থিত সকলকে সাক্ষী রেখে আমি বলছি, আমি একজন মুসলিম, মুজাহিদ ও মুহাজির।”

ইকরিমা তা-ই বললেন। এ সময় রাসূল (সাঃ) তাকে বললেন, “অন্য কাউকে আমি দিচ্ছি, এমন কোন কিছু আজ যদি আমার কাছে চাও, আমি তােমাকে দেব।'

ইকরিমা বললেন, 'আমি আপনার কাছে চাচ্ছি, যত শক্রতা আমি আপনার সাথে করেছি, যত যুদ্ধে আমি আপনার মুখােমুখি হয়েছি এবং আপনার সামনে অথবা পশ্চাতে যত কথাই আমি আপনার বিরুদ্ধে বলেছি- সবকিছুর জন্য আপনি আল্লাহর কাছে আমার মাগফিরাত কামনা করুন।' তক্ষুণি রাসূল (সাঃ) তাঁর জন্য দু'আ করলেনঃ হে আল্লাহ, যত শত্রুতাই সে আমার সাথে করেছে, তােমার নুরকে নিভিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে যুদ্ধের ময়দানে উপস্থিত হতে যত পথই সে ভ্রমণ করেছে, সবকিছুই তাকে ক্ষমা করে দাও। আমার সামনে বা অগোচরে আমার মানহানিকর যত কথাই সে বলেছে, তা-ও তুমি ক্ষমা করে দাও।'

ইসলামের খেদমতে হযরত ইকরিমা (রাঃ)

আনন্দে ইকরিমার মুখমণ্ডল উজ্জ্বল হয়ে উঠলাে। তিনি বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ, আল্লাহর কসম! আল্লাহর রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির জন্য যতকিছু আমি ব্যয় করেছি তার দ্বিগুণ আমি আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করবাে এবং আল্লাহর রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে যত যুদ্ধ আমি করেছি, তার দ্বিগুণ যুদ্ধ আমি আল্লাহর রাস্তায় করবাে।'

এ দিন থেকেই তিনি দাওয়াতের মিছিলে প্রবেশ করলেন। তিনি হলেন যুদ্ধের ময়দানে দুঃসাহসী অশ্বারােহী, মসজিদে সর্বাধিক ইবাদতকারী, রাত্রি জাগরণকারী ও আল্লাহর কিতাব পাঠকারী। পবিত্র কুরআন মুখের ওপর রেখে তিনি বলতেনঃ 'কিতাবু রাব্বি কালামু রাব্বি - আমার রবের কিতাব, আমার প্রভুর কালাম।' একথা বলতেন, আর আকুল হয়ে কাঁদতেন।

রাসূলুল্লাহর (সাঃ) কাছে ইকরিমা যে অঙ্গীকার করেছিলেন, তিনি অক্ষরে অক্ষরে তা পালন করেন। তার ইসলাম গ্রহণের পর মুসলমানরা যত যুদ্ধই করেছে, তার প্রত্যেকটিতে তিনি অংশ নেন এবং যত অভিযানেই তারা বের হয়েছে তিনি থাকেন তার পুরোভাগে।

ইকরামে অনন্য ইতিহাস

ইয়ারমুকের যুদ্ধে গ্রীষ্মের দুপুরে পিপাসিত ব্যক্তি যেমন ঠাণ্ডা পানির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তেমনি তিনি শত্রুপক্ষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। যুদ্ধের কোন এক পর্যায়ে মুসলমানদের ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি হলাে, তিনি তখন ঘোড়া থেকে নেমে তরবারি কোষ-মুক্ত করেন এবং রোমান বাহিনীর অভ্যন্তরভাগে ঢুকে পড়েন। অবস্থা বেগতিক দেখে খালিদ ইবনুল ওয়ালিদ তাঁর দিকে ছুটে যান এবং বলেন, “ইকরিমা এমনটি করোনা। তােমার হত্যা মুসলমানদের জন্য বিপজ্জনক হবে।'

জবাবে তিনি বললেনঃ

‘খালিদ আমাকে ছেড়ে দাও। রাসূলের (সাঃ) ওপর ঈমান আনার ব্যাপারে তুমি আমার থেকে অগ্রগামী। আমার পিতা ও আমি ছিলাম রাসুলুল্লাহর (সাঃ) সবচেয়ে বড় শত্রু। আমাকে আমার অতীতের কাফফারা আদায় করতে দাও। অনেক যুদ্ধেই আমি রাসূলাহর (সাঃ) বিরুদ্ধে লড়েছি। আর আজ আমি রােমান বাহিনীর ভয়ে পালিয়ে যাব। এ আমার পক্ষে সম্ভব নয়।' একথা বলে তিনি মুসলমানদের কাছে আবেদন জানলেন, মৃত্যুর ওপর বাইয়াত করতে চায় কে?’ তার এ আহ্বানে সাড়া দিলেন তাঁর চাচা হারিস ইবন হিশাম, দিরার ইবনুল আওয়ার ও আরাে চার শ' মুসলিম সৈনিক। তারা খালিদ ইবন ওয়ালিদের তাঁবুর সম্মুখভাগ থেকেই তুমুল লড়াই চালিয়ে ইয়ারমুকের ময়দানে বিরাট বিজয় ও সম্মান বয়ে এনেছিলেন। এই ইয়ারমুকের ময়দানেই হারিস ইবন হিশাম, আইয়াশ ইবন আবী রাবিয়া ও ইকরিমা ইবন আবু জাহলকে ক্ষত বিক্ষত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা গেল। পিপাসায় কাতর হারিস ইবনে হিশাম পানি চাইলেন। যখন তাকে পানি দেয়া হলাে, ইকরিমা তখন তার দিকে তাকালেন। এ দেখে তিনি বললেন, ইকরিমাকে দাও।' পানির গ্লাসটি যখন ইকরিমার কাছে নিয়ে যাওয়া হলাে তখন আয়য়াশ তার দিকে তাকালেন। তা দেখে ইকরিমা বললেন, 'আয়য়াশকে দাও।' আয়য়াশের কাছে পানির গ্লাসটি নিয়ে যাওয়া হলে দেখা গেল, তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। তারপর গ্লাসটি হাতে নিয়ে একে একে তার অপর দুই সাথীর কাছে গিয়ে দেখা গেল তারাও তারই পথের পথিক হয়েছেন। এভাবেই হযরত ইকরিমা (রাঃ) ইকরামের (ইকরামুল মুসলিমিন) যে অনন্য ইতিহাস গড়ে গেছেন তা শত সহস্র বছর ধরে মুসলিমদের প্রেরণা জুগিয়ে আসছে। আল্লাহ তা'আলা তাঁদের সকলের প্রতি রাজী ও খুশী থাকুন। আমীন।



**************************************
>>> Welcome, You are now on Mohammadia Foundation's Website. Please stay & Tune with us>>>


এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url