প্রাত্যহিক জীবনে “আল্লাহ’র স্মরণ” || প্রকাশ্য অপ্রাকাশ্য সব কাজে নিয়ত বিশুদ্ধ থাকা চাই






বিশুদ্ধ নিয়ত


পবিত্র কুরআন মাজিদে মহান আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

وَمَا أُمِرُوا إِلَّا لِيَعْبُدُوا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ حُنَفَاءَ

অর্থ: তাদের তো বিশুদ্ধচিত্তে একনিষ্ঠ হয়ে আল্লাহর ইবাদত করতে আদেশ করা হয়েছিলো।(১)

অন্য এক জায়গায় ইরশাদ করেন-

لَنْ يَنَالَ اللَّهَ لُحُوْمُهَا وَلَا دِمَاؤُهَا وَلَكِنْ يَنَالُهُ التَّقْوَى مِنْكُمْ

অর্থ: (কুরবানীর পশুর) রক্ত ও গোশত কোনটিই আল্লাহর কাছে পৌছে না । কেবল তোমাদের তাকওয়া (আল্লাহর কাছে) তাঁর কাছে পৌঁছে।(২) 

ইবনে আব্বাস (রাঃ) উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, مَعْنَاهُ وَلَكِنْ يَنَالُهُ النَّيَّاتُ অর্থাৎ (বিশুদ্ধ) নিয়তই তাঁর কাছে পৌঁছে।

এ সম্পর্কে সহিহ বুখারি ও মুসলিমে আমিরুল মুমিনিন উমর (রা:) থেকে বর্ণিত আছে-

قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : إِنَّمَا الْأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ، وَإِنَّمَا لِكُلِّ امْرِئٍ مَا نَوَى، فَمَنْ كَانَتْ هِجْرَتُهُ إِلَى اللهِ وَرَسُولِهِ، فَهِجْرَتُهُ إِلَى اللهِ، وَرَسُوْلِهِ، وَمَنْ كَانَتْ هِجْرَتُهُ إِلى دُنْيَا يُصِيبُهَا أَوِ امْرَأَةٍ يَنْكِحُهَا، فَهِجْرَتُهُ إِلَى مَا هَاجَرَ إِلَيْهِ .

অর্থ: রাসুল সাল্লাল্লাহু তাআলা আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, সব কাজ নিয়তের ওপর নির্ভরশীল। প্রত্যেকেই তার নিয়ত অনুসারে প্রতিদান পেয়ে থাকে। যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসুলকে পাওয়ার আশায় হিজরত করবে, তার হিজরত আল্লাহ ও তাঁর রাসুলকে পাওয়ার জন্যই হবে। আর যে দুনিয়া পাওয়ার আশায় কিংবা কোন মহিলাকে বিবাহ করার আশায় হিজরত করে, তার হিজরত সে জন্যই হবে, যে উদ্দেশে সে হিজরত করেছে। (৩)

এই হাদিসটি সহিহ, সবাই এ ব্যাপারে একমত। এর উঁচু মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের ব্যাপারে সবাই সম্মতি জ্ঞাপন করেন। যেসব হাদিসের ওপর ইসলামের ভিত্তি, সেগুলোর মধ্যে এ হাদিসটি অন্যতম। সালফে সালেহিন ও তাদের অনুসারীরা তাদের কিতাবকে এ হাদিসের মাধ্যমে সূচনা করতে পছন্দ করতেন। এই লক্ষ্যে যে, শুরুতেই যেন সবাই নিয়তের পরিশুদ্ধির বিষয়ে মনোযোগী ও যত্নশীল হয়।

ইমাম আবু সাঈদ আবদুর রহমান বিন মাহদি রহ. থেকে বর্ণিত: যে ব্যক্তি কোন কিতাব সঙ্কলন করতে চায়, তাঁর উচিত তিনি যেন এই হাদিস দ্বারা তা শুরু করেন।

ইমাম আবু সুলাইমান খাত্তাবি রহ. বলেন, আমাদের পূর্ববর্তী মাশায়েখরা প্রতিটি কাজ বিশেষ করে দ্বীনী বিষয়াদি শুরু করার আগে এই হাদিসকে বর্ণনা করা মুস্তাহাব মনে করতেন। কারণ, প্রতিটি ক্ষেত্রেই এর ব্যাপক প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

আবদুল্লাহ বিন আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, নিয়ত অনুসারে ব্যক্তির বিষয়কে সংরক্ষণ করা হয় ।

কোন বিজ্ঞ ব্যক্তি বলেন, মানুষ তার নিয়ত অনুসারেই প্রতিদান পেয়ে থাকে। ফুযাইল বিন ইয়ায (রাঃ) থেকে বর্ণিত- মানুষের কারণে আমল ছেড়ে দেয়া হল, রিয়া বা কপটতা। মানুষের জন্য আমল করা হচ্ছে শিরক। আর আল্লাহ তাআলা তোমাকে এদুটো থেকে রক্ষা করার নামই হল এখলাস (৪)

ইমাম হারিস মুহাসিবি রহ. বলেন, সাদিক বা সত্যবাদী বলা হয় তাকে, সৃষ্টিজগতের সবার মন থেকেও তার মর্যাদা বিলীন হয়ে যায় তারপরও সে আন্তরিক বিশুদ্ধতার জন্য এর কোনই পরোয়া করে না। আর মানুষ তার নেকআমল সম্পর্কে বিন্দু পরিমাণ জানুক, এটা সে পছন্দ করে না। আর মানুষ তার বদ আমল জানাকেও সে অপছন্দ করে না।  (৫)

হুজায়ফা মারআশি রহ. থেকে বর্ণিত যে, ইখলাস হল, বান্দার কাছে প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সবধরনের কাজ সমান হয়ে যাওয়া।  (৬)

উস্তায ইমাম আবুল কাসিম কুশাইরি রহ. বলেন-

ইখলাস হল, স্বেচ্ছায় কেবলমাত্র আল্লাহর জন্য ইবাদত করা, অর্থাৎ বান্দার ইবাদতের একমাত্র উদ্দেশ্য হবে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা। এছাড়া পার্থিব অন্য কোন উদ্দেশ্য থাকতে পারবে না। যেমন- সৃষ্টিকে খুশি করা, মানুষের প্রশংসা অর্জন করা, মানুষের ভালোবাসা লাভ করা, অথবা আল্লাহর নৈকট্য অর্জন ব্যতীত অন্য কোন উদ্দেশ্য করা।

সাহল বিন আবদুল্লাহ তুসতারি রহ. বলেন-
জ্ঞানী ব্যক্তিরা ইখলাসের পরিচয় দিতে গিয়ে বলেন, বান্দার প্রকাশ্য- অপ্রকাশ্য প্রতিটি উঠাবসা একমাত্র আল্লাহর জন্য হওয়া। নিজের আত্মা, কুপ্রবৃত্তি ও দুনিয়া হাসিলের কোন সংমিশ্রণ না থাকা।  (৭)

উস্তায আবু আলি দাক্কাক রহ. থেকে বর্ণিত—
ইখলাস হল, সৃষ্টিকে লক্ষ করে চলা হতে বেঁচে থাকা। আর ‘সিদক' বলা হয়, নিজের ভালো কাজ দেখা হতে নিজেকে দূরে রাখা। (কেননা নিজের ভালো কাজ দেখলে এটাকে নিজের কৃতিত্ব মনে করবে। এটা আত্মগর্ব ও অহঙ্কার সৃষ্টি করবে।) অতএব, কপটতা মুক্ত ব্যক্তিই হলেন প্রকৃত মুখলিস। আর যার কোন আত্মগর্ব নেই, তিনিই হলেন সাদিক তথা সত্যবাদী।

যুনুন মিশরি রহ. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ইখলাসের তিনটি নিদর্শন-

১. সাধারণ মানুষের প্রশংসা ও নিন্দা সমান হয়ে যাওয়া ।
২. নেককাজ করার সময় নিজের এই নেককাজ দেখতে ভুলে যাওয়া । (যেমন, কোন নেককাজ করার সময় এটা না ভাবা যে আমি খুব ভালো করছি।) আর
৩. কেয়ামতে নেককাজের সওয়াব তথা প্রতিদানের দাবিদার না হওয়া।

ইমাম কুশাইরি রহ. বলেন- সিদকের সর্বনিম্ন স্তর হল, ব্যক্তির প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য অর্থাৎ সর্বাবস্থা সমান হয়ে যাওয়া।

সাহাল আত-তাসতুরী রহ. বলেন- যে নিজেকে বা অন্যকে তোষামোদ করে চলে, সে কখনও সত্যবাদিতার ঘ্রাণ পায় না ।

এছাড়াও এ ব্যাপারে অসংখ্য উক্তি রয়েছে, আমলকারীর জন্য এখানে যতটুকু উল্লেখ করেছি তাই যথেষ্ট।

ফযিলতের আমল একবার হলেও করা


কোন আমলের ফাযায়েল সম্পর্কে জানলে উচিত হল, সেটি আমল করা; যদি জীবনে অন্তত একবারও হয়। যাতে সে এর আমলকারীদের দলভুক্ত হয়ে যায়। সেটি একেবারেই আমল না করা সমীচীন নয়, বরং যথাসম্ভব সেটি আমল করা। হাদিস শরিফে ইরশাদ হচ্ছে-

إِذَا أَمَرْتُكُمْ بِأَمْرٍ فَأْتُوْا مِنْهُ مَا اسْتَطَعْتُمْ.

অর্থ: যখন আমি তোমাদের কোন বিষয়ের আদেশ দেই, তখন তোমরা তা সাধ্যানুযায়ী পালন করো।  (৮)

ফজিলত বিষয়ক দুর্বল হাদিসের ওপর আমল 


উলামা, ফুকাহা ও মুহাদ্দিসিনে কেরামের মতে ফাযায়েল ও উৎসাহমূলক বিষয়ে দুর্বল হাদিসের ওপর আমল করা জায়েয আছে। এমনকি, আমল করাই উত্তম। যতক্ষণ না ঐ হাদিস মাওজু (জাল) পর্যায়ের না হবে। পক্ষান্তরে আহকামের ক্ষেত্রে যেমন- হালাল, হারাম, ক্রয়-বিক্রয়, বিবাহ- শাদি, তালাক ইত্যাদি বিষয়ে কেবল সহিহ বা হাসান হাদিসের ওপরই আমল করতে হবে। তবে হ্যাঁ, যদি কোন সতর্কতামূলক বিষয় হয়, যেমন- বিবাহ-শাদী বা বেচাকেনা সংক্রান্ত কোন বিষয়ের অপছন্দনীয়তার ক্ষেত্রে দুর্বল হাদিস আসে, তাহলে মুস্তাহাব হল তা থেকে বেঁচে থাকা চাই । তবে এটা ওয়াজিব নয়। বিষয়টি এ কিতাবে এজন্য বর্ণনা করেছি যে, এই কিতাবে সহিহ, হাসান ও যাঈফ (দুর্বল) হাদিসও বর্ণিত হয়েছে। যাতে পাঠকবৃন্দ এ বিষয়ে শুরুতেই অবগত হতে পারেন ।

জিকিরের মজলিসে বসা


জিকির করা যেমন মুস্তাহাব, তেমনিভাবে জিকিরের মজলিসে বসাও মুস্তাহাব। এ ব্যাপারে দলিল-প্রমাণ সুস্পষ্ট। এগুলো যথাস্থানে আলোচনা করা হবে। এ ব্যাপারে আবদুল্লাহ বিন উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদিসই যথেষ্ট। তিনি বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

إِذَا مَرَرْتُمْ بِرِيَاضِ الْجَنَّةِ فَارْتَعُوْا قَالُوا: يَا رَسُوْلَ اللهِ وَمَا رِيَاضُ الْجَنَّةِ؟ قَالَ: حِلَقُ الذِّكْرِ قَالَ: إِنَّ لِلَّهِ سَيَّارَةً مِنَ الْمَلَائِكَةِ يَطْلُبُوْنَ حِلَقَ الذِّكْرِ فَإِذَا أَتَوْا عَلَيْهِمْ حَقُوْا بِهِمْ.

অর্থ: যখন তোমরা জান্নাতের বাগানের কাছ দিয়ে যাবে, তখন তোমরা বাগানের ফল খাবে। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ, জান্নাতের বাগান কী? তিনি বললেন, জিকিরের মজলিস। আল্লাহর পক্ষ থেকে এক দল ফেরেশতা জমিনে বিচরণ করে জিকিরের মজলিস খুঁজতে থাকে। ফেরেশতারা যখন জিকিরকারীদের কাছে আসেন তখন তাদেরকে বেষ্টন করে রাখেন।  (৯)

মুআবিয়া (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেন-

إِنَّ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ خَرَجَ عَلَى حَلْقَةٍ مِنْ أَصْحَابِهِ، فَقَالَ: مَا أَجْلَسَكُمْ ؟ قَالُوا : جَلَسْنَا نَذْكُرُ اللهَ وَنَحْمَدُهُ عَلَى مَا هَدَانَا لِلْإِسْلَامِ، وَمَنَّ بِهِ عَلَيْنَا. قَالَ : اللهِ، مَا أَجْلَسَكُمْ إِلَّا ذَاكَ ؟ قَالُوا : وَاللَّهِ، مَا أَجْلَسَنَا إِلَّا ذَاكَ. قَالَ : أَمَا إِنِّي لَمْ أَسْتَحْلِفْكُمْ تُهمَةٌ لَكُمْ، وَلَكِنَّهُ أَتَانِي جِبْرِيلُ فَأَخْبَرَنِي أَنَّ اللهَ عَزَّ وَجَلَّ يُبَاهِي بِكُمُ الْمَلَائِكَةَ.

অর্থ: একবার রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সাহাবিদের একটি মজলিসে গমন করে বললেন, তোমরা এখানে কেন বসেছো? তাঁরা বললেন, আমরা বসেছি আল্লাহর জিকির এবং তাঁর প্রশংসা করতে। কারণ, তিনি আমাদের ইসলামের পথে এনছেন; ইসলামের মাধ্যমে আমাদের প্রতি বড় অনুগ্রহ করেছেন। তিনি বললেন, আল্লাহর কসম, তোমরা কি শুধু এ উদ্দেশ্যেই বসেছো? তাঁরা উত্তর দিলেন, হ্যাঁ, আল্লাহর কসম, আমরা কেবল এ উদ্দেশ্যেই বসেছি। তিনি বললেন, আমি তোমাদেরকে দোষী ভেবে শপথ দিয়ে জিজ্ঞাসা করিনি (বরং তোমাদেরকে এক মহা সুসংবাদ কোনানোর জন্য কসম করে বিষয়টির প্রতি গুরুত্বারোপ করেছি।) মাত্র জিবরিল আমার কাছে এসে জানিয়েছেন যে, তোমাদের নিয়ে আল্লাহ তাআলা ফেরেশতাদের সাথে গর্ব করছেন। (১০)

মুসলিম শরিফে আবু সাঈদ খুদরি এবং আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তারা উভয়ে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে উপস্থিত ছিলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-

لا يَقْعُدُ قَوْمُ يَذْكُرُوْنَ اللهَ عَزَّ وَجَلَّ إِلَّا حَفَّتْهُمُ الْمَلَائِكَةُ، وَغَشِيَتْهُمُ الرَّحْمَةُ، وَنَزَلَتْ عَلَيْهِم السَّكِينَةُ، وَذَكَرَهُمُ اللهُ فِيْمَنْ عِنْدَهُ.

অর্থ: যারা বসে বসে আল্লাহর জিকির করে, ফেরেশতারা তাদের বেষ্টন করে নেয়। আল্লাহর রহমত তাদের ঢেকে নেয়। তাদের ওপর শান্তি বর্ষিত হয়। আল্লাহ তাআলা তাঁর কাছের ফেরেশতাদের সঙ্গে জিকিরকারীদের বিষয়ে আলোচনা করেন। (১১)

জিকির হবে যবানে ও অন্তরে


জিকির মুখে হতে পারে। আবার অন্তরেও হতে পারে। তবে একই সাথে উভয়টির মাধ্যমে জিকিরই শ্রেষ্ঠ। যদি একটি দিয়ে করতে হয়, তবে অন্তর দিয়ে করাই উত্তম। অবশ্য লোকেরা কী মনে করবে, এজন্য অন্তরের সঙ্গে মুখের জিকিরকে ছেড়ে দেয়া ঠিক না; বরং উভয়টি দিয়েই জিকির করবে। উদ্দেশ্য থাকবে আল্লাহর সন্তুষ্টি।

আগেই আমরা ফুযাইল রহ. থেকে বর্ণনা করে এসেছি যে, মানুষের কারণে আমল ছেড়ে দেয়ার নাম রিয়া বা কপটতা ।

মানুষের সমালোচনা ও কথাবার্তার পরোয়া করলে, তাদের অবান্তর ধ্যান- ধারণা থেকে বাঁচতে চাইলে অধিকাংশ ভালো ও কল্যাণের পথ বন্ধ হয়ে যাবে। দ্বীনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও মহান বিষয়ে অবহেলা করে নিজের ক্ষতি ডেকে আনতে হবে। এটি আরেফিন ও আল্লাহওয়ালাদের পথ নয় । সহিহ বুখারি ও মুসলিমে হজরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে-

وَلَا تَجْهَرْ بِصَلَاتِكَ وَلَا تُخَافِتْ بِهَا أُنْزِلَتْ فِي الدُّعَاءِ.

অর্থ: তোমরা নামাজে আওয়াজ একেবারে উঁচু করো না। আবার বেশি নিচুও করো না (১২) এই আয়াতটি দুআর ব্যাপারে নাযিল হয়েছে। (১৩)

জিকিরের ফযিলত


জিকিরের ফজিলত কেবল সুবহানাল্লাহ, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহু আকবার বা এজাতীয় বিষয়ের মাঝে সীমাবদ্ধ নয়; বরং আল্লাহর সকল আনুগত্যকারী ব্যক্তি আল্লাহর জিকিরকারী। হজরত সাঈদ বিন যুবায়ের রহ. সহ অন্যান্য উলামায়ে কেরাম এমনটিই বলেছেন। হজরত আতা রহ. বলেন, জিকিরের মজলিস অর্থ হল, হারাম-হালালের আলোচনা, কীভাবে ক্রয়-বিক্রয় করা হবে, নামাজ কেমন করে আদায় করা হবে, রোজা রাখার সঠিক পদ্ধতি কী, বিবাহের পদ্ধতি ও তালাক প্রদানের নিয়ম, হজ্জের সঠিক নিয়ম কী? ইত্যাদি বিষয়ের মজলিস। (১৪)

বেশি বেশি আল্লাহর জিকির করা


আল্লাহ তাআলা বলেন-

إِنَّ الْمُسْلِمِينَ وَالْمُسْلِمَاتِ وَالْمُؤْمِنِينَ وَالْمُؤْمِنَاتِ وَالْقَانِتِينَ وَالْقَانِتَاتِ وَالصَّادِقِينَ وَالصَّادِقَاتِ وَالصَّابِرِينَ وَالصَّابِرَاتِ وَالْخَاشِعِينَ وَالْخَاشِعَاتِ وَالْمُتَصَدِّقِينَ وَالْمُتَصَدَّقَاتِ وَالصَّائِمِينَ وَالصَّائِمَاتِ وَالْحَافِظِينَ فُرُوجَهُمْ وَالْحَافِظَاتِ وَالذَّاكِرِينَ اللَّهَ كَثِيرًا وَالذَّاكِرَاتِ.

অর্থ: নিশ্চয় মুসলিম পুরুষ ও নারী, মুমিন পুরুষ ও নারী, অনুগত পুরুষ ও নারী, সত্যবাদী পুরুষ ও নারী, ধৈর্যশীল পুরুষ ও নারী, বিনয়ী পুরুষ ও নারী, দানশীল পুরুষ ও নারী, রোজাদার পুরুষ ও নারী, যৌনাঙ্গ হেফাযতকারী পুরুষ ও নারী, আল্লাহকে অধিক স্মরণকারী পুরুষ ও নারীদের জন্য (আল্লাহ তাআলা বিশাল ক্ষমা ও মহাপ্রতিদান রেখে দিয়েছেন)। (১৫)

মুসলিম শরিফে হজরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার মক্কার জুমদান পর্বত দিয়ে হাঁটছিলেন। তখন তিনি বলেন,

سِيرُوا هَذَا جُمْدَانُ سَبَقَ الْمُفَرِّدُوْنَ قَالُوا: وَمَا الْمُفَرِّدُوْنَ؟ يَا رَسُوْلَ اللهِ قَالَ: الذَّاكِرُوْنَ اللهَ كَثِيرًا وَالذَّاكِرَاتُ

অর্থ: তোমরা এই জুমদান পর্বতে ভ্রমণ করো। মুফাররিদগণ অগ্রগামী হয়েছে। মুফাররিদ কারা? নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তর দিলেন, মুফাররিদ হল, বেশি বেশি আল্লাহর জিকিরকারী পুরুষ ও নারী। (১৬)

আজকার জাতীয় কিতাবের লেখকের জন্য উক্ত আয়াতের উদ্দেশ্যের প্রতি গুরুত্বারোপ করা চাই। এ আয়াতের উদ্দেশ্য কী- এ ব্যাপারে উলামায়ে কেরামের মাঝে মতবিরোধ রয়েছে।

আবুল হাসান ওয়াহিদি রহ. হতে বর্ণিত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, এদ্বারা উদ্দেশ্য হল, যারা নামাজের পরে জিকির করে, সকাল-বিকাল জিকির করে, বিছানায় ঘুমাতে গিয়ে জিকির করে, ঘুম থেকে উঠার সময় জিকির করে, সকাল-বিকাল যখনই ঘর থেকে বের হয় তখনই জিকির করে । এই সময়গুলোর যেসব দুআ আছে সেগুলো পড়ে।)

মুজাহিদ রহ. বলেন, ঐ সময় পর্যন্ত কোন লোক বেশি বেশি আল্লাহর জিকিরকারী পুরুষ ও নারী বলে গণ্য হবে না, যতক্ষণ না সে বসে, দাঁড়িয়ে ও শুয়ে তথা সর্বাবস্থায় আল্লাহর জিকির করবে।

আতা রহ. বলেন, যে ব্যক্তি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ সমস্ত হকসহ আদায় করে, সে আল্লাহর বাণী: অধিক পরিমাণে জিকিরকারী নারী-পুরুষ- এর মধ্যে গণ্য হবে।

হজরত আবু সাঈদ খুদরি (রাঃ) থেকে বর্ণিত রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-

إِذَا أَيْقَظَ الرَّجُلُ أَهْلَهُ مِنَ اللَّيْلِ فَصَلَّيَا، أَوْ صَلَّى رَكْعَتَيْنِ جَمِيعًا، كُتِبَا فِي الذَّاكِرِينَ وَالذَّاكِرَاتِ.

অর্থ: স্বামী যদি তার স্ত্রীকে রাতে নামাজ পড়ার জন্য জাগ্রত করে এরপর উভয়ে অথবা স্বামী একা দুই রাকাত নামাজ আদায় করে তাহলে তাদের উভয়ের নাম অধিক পরিমাণে আল্লাহর জিকিরকারী পুরুষ ও মহিলাদের মধ্যে লেখা হয়ে যায়। (১৭)

শাইখ ইবনুস সালাহ রাহিমাহুল্লাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিলো যে, কী পরিমাণ জিকির করলে বেশি বেশি জিকিরকারী হিসেবে গণ্য হবে? উত্তরে বলেছিলেন, হাদিসে বর্ণিত সকাল-সন্ধ্যার দুআ নিয়মিত পড়লে এবং বিভিন্ন সময় বর্ণিত দুআসমূহ পাঠ করলে সে বেশি বেশি জিকিরকারীদের অন্তর্ভুক্ত হবে।

অজু না থাকলেও জিকির করা যায়


উলামায়ে কেরাম এব্যাপারে একমত যে, মুখে ও অন্তরে যে কেউ জিকির করতে পারবে। অজু-গোসল না থাকা অবস্থায় ও মহিলারা ঋতুস্রাব ও প্রসূতি অবস্থায়ও জিকির করতে পারবে। এসময়ে সুবহানাল্লাহ, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহু আকবার ও দুরুদ পাঠ ইত্যাদি জিকির করতে পারবে। অবশ্য গোসল ফরজ, ঋতুস্রাব ও প্রসূতি অবস্থায় কুরআন তিলাওয়াত করা নিষেধ। চাই তা অল্প হোক বা বেশি হোক। তবে তারা উচ্চারণ না করে মনে মনে পড়তে পারবে। অনুরূপভাবে কুরআনের কপিতে তাকিয়ে তাকিয়ে এবং মনে মনে আওড়ানো যাবে।

তবে গোসল ফরজ, ঋতুস্রাব ও প্রসূতি অবস্থায় কুরআনের আয়াত দুআ হিসেবে পড়তে পারবে। যেমন বিপদের সম্মুখীন হলে 'ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিঊন' পড়তে পারবে। 

এছাড়া কোন বাহনে আরোহণ করার সময় এ দুআ পড়তে পারবে-

سُبْحَنَ الَّذِي سَخَّرَ لَنَا هَذَا وَمَا كُنَّا لَهُ مُقْرِنِيْنَ.

উচ্চারণ: সুবহানাল্লাজি সাখখারা লানা হাজা, ওয়া মা কুন্না লাহু মুকরিনিন।

অর্থ: পবিত্র তিনি, যিনি এদেরকে আমাদের বশীভূত করে দিয়েছেন। অথচ আমরা এদেরকে বশীভূত করতে সক্ষম ছিলাম না । 

দুআর মধ্যে পড়তে পারবে-

ربَّنَا آتِنَا فِي الدُّنْيَا حَسَنَةً وَفِي الْآخِرَةِ حَسَنَةً وَقِنَا عَذَابَ النَّارِ.

উচ্চারণ: রাব্বানা আতিনা ফিদ্দুনয়া হাসানাতান, ওয়াফিল আখিরাতি হাসানাতান, ওয়া কিনা আজাবান্নার।

অর্থ: হে পরওয়ারদিগার, আমাদেরকে দুনিয়াতেও কল্যাণ দান কর এবং আমাদেরকে দোযখের আযাব থেকে রক্ষা কর।

ঋতুস্রাব ও প্রসূতি অবস্থায় তিলাওয়াতের উদ্দেশ্য না করে বিসমিল্লাহ এবং আলহামদুলিল্লাহ বলতে পারবে। এগুলো জিকিরের উদ্দেশ্যে বা কোন উদ্দেশ্য ছাড়াই বলতে পারবে; তিলাওয়াতের উদ্দেশ্যে না করে যে কোন উদ্দেশ্যে বলতে পারবে, গুনাহ হবে না।

কুরআনের যেসব আয়াতের তিলাওয়াত রহিত হয়ে গেছে যেমন-

الشَّيْخُ وَالشَّيْخَةُ إِذَا زَنَيَا فَارْجُمُوْهَا.

অর্থ: বিবাহিত পুরুষ এবং বিবাহিতা নারী যখন যিনা করবে, তাদেরকে পাপথরাঘাত করে হত্যা কর। 

এগুলোও পড়তে পারবে।

যদি কাউকে বলে- خُذِ الْكِتَابَ بِقُوَّةٍ  (কিতাবটি মজবুতের সাথে ধরো)
অথবা বলে اُدْخُلُوْهَا بِسَلَامٍ آمِنِيْنَ (তাতে শান্তি ও নিরাপত্তার সাথে প্রবেশ করো।) বা এজাতীয় আয়াত বলে, তবে কুরআন তিলাওয়াতের ইচ্ছা না থাকে, তাহলে জায়েয আছে।

যদি পানি না থাকায় তায়াম্মুম করে, তাহলে তার জন্যও তিলাওয়াত করা বৈধ হবে। এমনকি, এরপর যদি পুনরায় সে নাপাক হয় তাহলে তার জন্য তিলাওয়াত করা নিষিদ্ধ হবে না। তায়াম্মুম চাই সফরে হোক বা মুকিম অবস্থায় পানি না পাওয়ার কারণে হোক, কোন পার্থক্য নেই। পুনরায় নাপাক হওয়ার পরও সে কুরআন তিলাওয়াত করতে পারবে। কেউ কেউ বলেন, যদি মুকিম অবস্থায় হয় তাহলে উক্ত তায়াম্মুম দ্বারা নামাজের কিরাত পড়তে পারবে। কিন্তু নামাজের বাইরে কুরআন তিলাওয়াত করতে পারবে না। তবে বিশুদ্ধ মত হল, নামাজের বাইরেও তিলাওয়াত করতে পারবে। কেননা তায়াম্মুম গোসলের স্থলাভিষিক্ত।

গোসল ফরজ হয়েছে এমন ব্যক্তি তায়াম্মুম করার পর পানি দেখতে পেলে পানি ব্যবহার করা আবশ্যক। গোসর না করা পর্যন্ত তিলাওয়াতসহ তায়াম্মুমের আগে তার ওপর যা যা হারাম ছিলো সবই হারাম হয়ে যাবে।

তায়াম্মুম করার পর যদি নামাজ ও তিলাওয়াত করে। এরপর যদি আবার অন্য কোন নাপাকের জন্য তায়াম্মুম করে, তাহলে তার ওপর তিলাওয়াত করা হারাম হবে না। এটাই বিশুদ্ধ ও গ্রহণযোগ্য মাজহাব। তবে হারাম হওয়ার কথাও কেউ কেউ বলেছেন। অবশ্য সেটা খুব দুর্বল।

আর যদি গোসল ফরজ হয়েছে এমন ব্যক্তি পানি বা মাটি না পায়, তাহলে ওয়াক্তের সম্মান রক্ষার্থে ঐ অবস্থায়ই নামাজ আদায় করবে। তবে নামাজের বাহিরে সে তিলাওয়াত করতে পারবে না। আর সুরা ফাতেহার চেয়ে বেশি যা পড়বে তাও হবে হারাম ।

আর ফাতেহা পড়া যাবে কিনা? এ ব্যাপারে দুই ধরনের বক্তব্য বর্ণিত আছে। বিশুদ্ধ মত হল, এটা হারাম হবে না; বরং পাঠ করাই ওয়াজিব। কেননা এটা ছাড়া নামাজ আদায় হবে না। নামাজ পড়া যেহেতু প্রয়োজনের কারণে জায়েয তেমনিভাবে সুরা ফাতেহার তিলাওয়াতও জায়েয।

দ্বিতীয় মত হল, সুরা ফাতেহা তিলাওয়াত করাও হারাম হবে। তবে এক্ষেত্রে কুরআন ছাড়া অন্য কোন দুআ পড়বে। যেমন কোন ব্যক্তি কুরআন তিলাওয়াত করতেই পারে না, তার মতো ।

এই বিষয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট বিধায় এখানে এই কয়েকটি মাসয়ালা আলোচনা করা হল। এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা ফিকহের কিতাবাদিতে রয়েছে। আল্লাহ তাআলা ভালো জানেন।

জিকিরকারীর হালত


জিকিরকারীকে সর্বোত্তম হালতে থাকা চাই। কিবলামুখী হয়ে বসবে; স্থির- শান্ত বিনয়াবনত ও অবনত মস্তকে বসবে। এ হালত ছাড়া ভিন্ন হালতে বসলেও মাকরুহ হবে না; জায়েজ আছে তবে কোন কারণ ছাড়া ভিন্ন হালতে বসলে অনুত্তম হবে। ভিন্ন হালত মাকরুহ না হওয়ার দলিল হল, এই আয়াত-

إِنَّ فِي خَلْقِ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَاخْتِلَافِ اللَّيْلِ وَالنَّهَارِ لَآيَاتٍ لِأُولِي الْأَلْبَابِ الَّذِينَ يَذْكُرُونَ اللَّهَ قِيَامًا وَقُعُودًا وَعَلَى جُنُوبِهِمْ وَيَتَفَكَّرُوْنَ فِي خَلْقِ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ.

অর্থ: নিশ্চয় নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের সৃষ্টিতে এবং দিবস-রজনীর পরিবর্তনের মধ্যে বোধসম্পন্ন লোকদের জন্য অনেক নিদর্শন রয়েছে। যারা দাঁড়িয়ে, বসে ও শুয়ে আল্লাহর জিকির করে এবং আকাশ ও যমীন সৃষ্টির বিষয়ে চিন্তা- গবেষণা করে। (১৮)

সহিহ বুখারি ও মুসলিমে হজরত আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত-

كَانَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَتَّكِيُّ فِي حِجْرِي وَأَنَا حَائِضُ، فَيَقْرَأُ

অর্থ: আমি ঋতুবতী থাকাবস্থায়ও রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার কোলে হেলান দিয়ে বসে কুরআন তিলাওয়াত করতেন। (১৯) 

হজরত আয়েশা (রাঃ) থেকে আরো বর্ণিত আছে-
.
إِنِّي لَأَقْرَأُ حِزْيِي وَأَنَا مُضْطَجِعَةُ عَلَى السَّرِيرِ .

অর্থ: আমি খাটের ওপর শুয়ে আমার অযিফা পাঠ করতাম।

জিকিরের স্থান যেমন হবে


জিকিরের স্থানটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও ভেজালমুক্ত থাকা চাই। কেননা এতে জিকির ও জিকিরকৃত সত্তা মহান আল্লাহ তাআলার প্রতি বিশেষ সম্মান প্রদর্শন করা হয়ে থাকে। একারণেই মসজিদ ও সম্মানীত স্থানে জিকিরের প্রশংসা করা হয়েছে। আবু মাইসারা রহ. বলেন, পবিত্র স্থান ব্যতীত জিকির করা যাবে না।

জিকির করার সময় মুখও পরিষ্কার হওয়া চাই। কোন দুর্গন্ধ থাকলে মিসওয়াক করে নিতে হবে। আর কোন ধরনের নাপাকি থাকলে পানি দিয়ে ধুয়ে নেয়া চাই। এরপরও যদি না ধুয়ে জিকির করে, তাহলে তা মাকরুহ হবে; কিন্তু এ অবস্থায় জিকির করা হারাম হবে না। মুখে নাপাকি নিয়ে কুরআন তিলাওয়াত করা মাকরুহ। হারাম হওয়া না হওয়ার ব্যাপারে মতভেদ আছে; তবে বিশুদ্ধ মত হল হারাম হবে না ।

জিকির মাকরুহ কখন


শরিয়ত কর্তৃক মাকরুহ সময় ছাড়া অন্য সবসময় জিকির করা খুবই উত্তম কাজ। সামনের আলোচনা ছাড়া এখানে কিছু মুহূর্তের কথা বলা হল। যেমন জিকির করা মাকরুহঃ

* পেশাব-পায়খানা করার সময়।
* সহবাস করার সময় ।
* খতিব সাহেবের খুতবা শ্রবণকারীর জন্য খুতবা চলার সময়।
* নামাজে দাঁড়ানো অবস্থায়; বরং এসময় তিলাওয়াতে মশগুল থাকবে ।
* তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় ।

তবে রাস্তায় চলমান অবস্থায় এবং গোসলখানায় থাকাকালে জিকির করা মাকরুহ হবে না।

জিকিরের হাকিকত


জিকিরের মূল উদ্দেশ্য হল, মনের উপস্থিতি। তাই এ উদ্দেশ্য অর্জনে সচেষ্ট থাকা চাই। যা জিকির করছে সে বিষয়ে পূর্ণ মনোযোগী হওয়া। অর্থ অনুধাবনের চেষ্টা করা। যিকিরে চিন্তা করা উদ্দিষ্ট যেমন কেরাতে চিন্তা করা উদ্দিষ্ট। কারণ, উভয়টির উদ্দেশ্য এক। এজন্য প্রণীধানযোগ্য মাজহাব হল-

لآ اِلَهَ اِلّا اللّهُ (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ) এর মধ্যকার لآ (লা) কে টেনে পড়া, কারণ, এতে চিন্তা করার বেশি সময় পাওয়া যায়। এ ব্যাপারে সালাফে সালেহিন ও পরবর্তী ইমামগণের বক্তব্য প্রসিদ্ধ আছে ।


নির্দিষ্ট সময়ে জিকির ছুটে গেলে করণীয়


যার রাতদিনের কোন সময়ে অযিফা পাঠের আমল আছে অথবা নামাজের পর, কিংবা অন্যান্য সময় অযিফা পাঠের আমল আছে যদি কোন কারণে তা ছুটে যায়, তাহলে সুযোগ হওয়া মাত্রই তা পাঠ করে নেবে এ ব্যাপারে কোন অলসতা করবে না। কারণ, এব্যাপারে যত্নবান হলে সামনে আর ছুটবে না । আর যদি অলসতা করা হয় তাহলে সামনেও ছুটে যাবে।
সহিহ মুসলিমে হজরত উমর বিন খাত্তাব (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

مَنْ نَامَ عَنْ حِزْبِهِ، أَوْ عَنْ شَيْءٍ مِنْهُ، فَقَرَأَهُ فِيمَا بَيْنَ صَلَاةِ الْفَجْرِ، وَصَلَاةِ الظهر، كُتِبَ لَهُ كَأَنَّمَا قَرَأَهُ مِنَ اللَّيْلِ.

অর্থ: যে ব্যক্তি তার রাতের অযিফা (তথা কুরআনের নির্দিষ্ট অংশ) অথবা অন্যান্য অযিফা পড়তে ভুলে যায়, এরপর সে এটা ফজর ও যুহরের মাঝামাঝি সময়ে পড়ে নেয়, তাহলে সে যেন তা রাতেই পড়েছে। (২০)

জিকির বন্ধ করে পুনরায় শুরু করা 


জিকিরের সময় যেসব অবস্থার সম্মুখীন হলে জিকির বন্ধ করে দেয়া চাই এবং অবস্থা চলে গেলে আবার জিকির শুরু করবে। অবস্থাগুলো নিম্নরূপঃ

১. সালাম দিলে সালামের জবাব দিয়ে পরে আবার জিকির করবে। 
২. জিকিরকারীর পাশে কেউ হাঁচি দিয়ে আলহামদুলিল্লাহ বললে, তার জবাব দিয়ে পরে আবার জিকির করবে।
৩. খতিব সাহেবের খুতবা শুনলে জিকির বন্ধ করবে, পরে আবার জিকির করবে।
৪. মুআজ্জিনের আজান শুনলে তার সাথে সাথে আজান ইকামতের জবাব দিবে।
৫. কোন নিষিদ্ধ কাজ হতে দেখলে, তা দূর করতে জিকির বন্ধ করবে। অনুরূপভাবে ভালো কাজের সুযোগ এলে। কাউকে উপদেশ দেয়ার সুযোগ এলে । কারো নসিহত কোনার ব্যবস্থা হলে তা করবে। এরপর যিকিরে মাশগুল হবে।
৬. তন্দ্রাভাব বা এজাতীয় কিছু হলে জিকির বন্ধ করে দিবে ইত্যাদি ।

নিজের কানে জিকিরের আওয়াজ শুনতে হবে 


শরিয়ত অনুমোদিত যে কোনো জিকির-নামাজের ভেতরে, বাইরে; ওয়াজিব, মুস্তাহাব-সকল জিকির তখনই জিকির বলে গণ্য হবে যখন ব্যক্তি নিজের কানে শুনতে পাবে, যদি তার শ্রবণশক্তি সুস্থ থাকে এবং কোন কিছু অন্তরায় সৃষ্টি না করে। এরচে কম আওয়াজে হলে সেটি জিকির বলে গণ্য হবে না । 

দৈনন্দিনের আমলের কিতাব ও বক্ষ্যমাণ কিতাবের উৎসগ্রন্থ 

দিবা-রাত্রীর আমল সংক্রান্ত অনেক মূল্যবান কিতাব আমাদের পূর্বসূরীরা লিখে গেছেন। সেগুলোতে তারা মুত্তাসিল (অবিচ্ছিন্ন সূত্রে বর্ণিত) হাদিস বর্ণনা করেছেন। এমনকি একটি হাদিস অনেক সনদে বর্ণনা করেছেন। এর মধ্যে অন্যতম হল ইমাম নাসাঈ রহ. এর " আমালুল ইয়াওমি ওয়াল লাইলাতি"।

তবে এর চেয়ে সুন্দর, মূল্যবান ও উপকারী কিতাব হল, ইবনুস সুন্নি রহ. এর "আমালুল ইয়াওমি ওয়াল লাইলাতি"।

ইমাম নববি বলেন, আমি ইবনুস সুন্নি রহ. এর পুরো কিতাবটি পড়েছি শায়খ আবুল বাকা' খালেদ রহ. এর কাছে। তিনি পড়েছেন আল্লামা আবুল ইয়ুমন হাসান আল কিন্দি রহ. এর কাছে। তিনি পড়েছেন ইমাম আবুল হাসান সাদ আনসারি রহ. এর কাছে। তিনি পড়েছেন ইমাম আবু মুহাম্মদ আবদুর রহমান দাওনি রহ. এর কাছে। তিনি পড়েছেন কাজি আবু নাছর দিনাওরি রহ. এর কাছে। তিনি পড়েছেন স্বয়ং লেখক শায়খ আবু বকর আহমদ বিন মুহাম্মদ বিন ইসহাক আস সুন্নি রহ. এর কাছে ।

আমি এখানে এই সনদটি উল্লেখ করেছি। কারণ, আমি ইবনুস সুন্নির কিতাব থেকে অনেক কিছুই নকল করব। তাই আমি কিতাবের শুরুতেই সনদটি উল্লেখ করেছি। এ পদ্ধতিটি মুহাদ্দিসিনে কেরামের নিকট স্বীকৃত। এখানে বিশেষভাবে এ কিতাবের সনদ উল্লেখ করার কারণ হল, ইবনুস সুন্নির কিতাবটি উক্ত বিষয়ে সবচেয়ে সন্নিবেশিত। অন্যথায় এ কিতাবে যা কিছুই আমি উল্লেখ করব সবকিছুই সহিহ সনদের মধ্যমে ধারাবাহিকভাবে আমি শুনেছি, আলহামদুলিল্লাহ। তবে কিছু বিরল ও দুর্লভ বিষয় আছে যেগুলো আমি ধারাবাহিক সনদে শুনিনি ।

এই কিতাবে আমি ইসলামের মৌলিক পাঁচ কিতাব - সহিহ বুখারি, সহিহ মুসলিম, সুনানে আবু দাউদ, সুনানে তিরমিজি এবং সুনানে নাসাঈ থেকে নকল করব।

এছাড়াও মুসনাদ ও সুনানের কিতাবাদি থেকে হাদিস বর্ণনা করব, যেমন- মুয়াত্তা মালিক, মুসনাদে ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বাল ও মুসনাদে আবু আওয়ানা, সুনানে ইবনে মাজাহ, দারাকুতনি, বায়হাকি ইত্যাদি প্রসিদ্ধ কিতাবসমূহ। তা ছাড়া জুয (হাদিসের বিষয়ভিত্তিক গ্রন্থ) থেকেও হাদিস বর্ণনা করব যা পাঠক অচিরেই দেখতে পাবেন। আর এখানে যা কিছু উল্লেখ করব, তা লেখক পর্যন্ত মুত্তাসিল সনদেই বর্ণনা করব। ইনশাআল্লাহ ।

হাদিস গ্রন্থের উদ্ধৃতি প্রদান করা হয়েছে


আমি এই কিতাবে যেসব হাদিস উল্লেখ করব সেসব হাদিসের গ্রন্থের উদ্ধৃতি দেবো। যেসব হাদিস বুখারি, মুসলিমের উভয়টি বা যে কোন একটিতে আছে আমি সেগুলোকে কিতাবদ্বয়ের সাথে শুধু সম্পৃক্ত করব, হুকুম বয়ান করব না। কারণ, কিতাবদ্বয়ের সাথে সম্পৃক্ত করার মাধ্যমেই উদ্দেশ্য হাসিল হয়ে যাবে। কারণ, সহিহ বুখারি ও মুসলিমে বর্ণিত সকল হাদিসই সহিহ।

অন্যান্য কিতাবের হাদিসের ক্ষেত্রে সেগুলোকে আমি সুনান, মুসনাদ ইত্যাদি কিতাবের সম্পৃক্ত করব; সাথে সাথে বেশিরভাগ স্থানে হাদিসটির সহিহ, হাসান ও যাঈফ হওয়ার বিষয়টি স্পষ্ট করে দেবো, যদি সেটি যাঈফ হয়ে থাকে। তবে কখনো কখনো সহিহ, হাসান ও যাঈফ কোনটিই উল্লেখ করব না ।

আমি সুনানে আবু দাউদের অনেক হাদিস নকল করব। ইমাম আবু দাউদ রহ. বলেন- ‘আমি এই কিতাবে যা উল্লেখ করেছি, তা সহিহ অথবা এর কাছাকাছি। আর কোন হাদিস বেশি দুর্বল হলে সে বিষয়টি আমি স্পষ্ট করে দিয়েছি। আর যেসব হাদিসের ব্যাপারে কিছু বলা হয়নি, সেগুলো আমলযোগ্য। এবং কিছু হাদিস কিছু হাদিসের তুলনায় বেশি সহিহ।

আবু দাউদ রহ.-এর এই কথায় বিরাট ফায়দা আছে। তা হল, ইমাম আবু দাউদ রহ. তার সুনানে যেসব হাদিস বর্ণনা করেছেন এবং যেসব হাদিসের দুর্বলতার ব্যাপারে তিনি কিছু বলেননি, সেসব হাদিস তার মতে সহিহ অথবা হাসান। উভয় প্রকার হাদিস দ্বারা আহকামের ক্ষেত্রেই দলিল দেয়া যায়। অতএব, ফাযায়েলের ক্ষেত্রে তো অবশ্যই দলিল দেয়া যাবে।

অতএব, যখন এই কিতাবে আবু দাউদ রহ. থেকে বর্ণিত কোন হাদিস দেখা যাবে, আর সে হাদিসের দুর্বলতার ব্যাপারে কোন কথা নেই, তাহলে বুঝতে হবে এই হাদিস তার মতে যাঈফ বা দুর্বল নয়। আল্লাহ পাক ভালো জানেন ।

এরপর জিকিরের ফযিলত প্রসঙ্গে হাদিস দিয়ে কিতাব শুরু করাকে আমার কাছে ভালো মনে হয়েছে। এতে আমি এমন কিছু বিষয় উপস্থাপন করব, যা সামনের আলোচনার ভূমিকা হবে। এরপর কিতাবের মূল অধ্যায়গুলো উল্লেখ করব। আর ইস্তিগফারের অধ্যায় দিয়ে কিতাবটি শেষ করব। যেন আমাদের মৃত্যু ইস্তিগফারের মাধ্যমে হয়। আল্লাহই একমাত্র তাওফিকদাতা, তাঁর ওপরই ভরসা করি, তাঁর কাছেই সবকিছু অর্পণ করছি।

তথ্যসূত্রঃ
১. সুরা বাইয়িনাহ: আয়াত: ০৫।
২. সুরা হজ্জ: আয়াত: ৩৭ ।
৩. সহিহ বুখারি: ১৯০৭, সুনানে আবু দাউদ: ২২০১, সুনানে তিরমিজি: ১৬৪৭।
৪. আর-রিসালাতুল কুশাইরিয়া: ১৬৩। 
৫. আর-রিসালাতুল কুশাইরিয়া: ১৬৩। 
৬. শুআবুল ঈমান লিল-বায়হাকি : ৬৮৭৮।
৭. আর-রিসালাতুল কুশাইরিয়া: ১৬২।
৮. সহিহ বুখারি: ৭২৮৮, সহিহ মুসলিম: ১৩৩৭, সুনানে তিরমিজি: ২৬৮১, সুনানে নাসাঈ ৫/১১০, সুনানে ইবনে মাজাহ: ২।
৯. হিলইয়াতুল আউলিয়া: ৬/৩৫৪, আবু নুআইম আসফাহানি ।
১০. সহিহ মুসলিম: ২৭০১, সুনানে তিরমিজি: ৩৩৭৬, সুনানে নাসাঈ ৮/২৪৯ । 
১১. সহিহ মুসলিম: ২৭০০, সুনানে তিরমিজি: ৩৫৮৭।
১২. সুরা বনি ইসরাইল: ১১০ ।
১৩. সহিহ বুখারি: ৪৭২৩, সহিহ মুসলিম: ৪৪৭।
১৪. আল-ওয়াসিত ফি তাফসিরিল কুরআনিল মাজিদ: ১/২৩৪।
১৫. সুরা আহযাব: ৩৫।
১৬. সহিহ মুসলিম: ২৬৭৬, সুনানে তিরমিজি: ৩৫৯০।
১৭. সুনানে আবু দাউদ: ১৩০৯, সুনানে ইবনে মাজাহঃ ১৩৩৫।
১৮. সুরা আলে ইমরান: ১৮৯-১৯০।
১৯. সহিহ বুখারি: ২৯৭, সহিহ মুসলিম: ৩০১, সুনানে আবু দাউদ: ২৬০, সুনানে নাসাঈ ১/১৯১, সুনানে ইবনে মাজাহ: ৬৩৪।
২০. সহিহ মুসলিম: ৭৪৭, সুনানে আবু দাউদ: ১৩১৩, সুনানে তিরমিজি: ৫৮১, মুয়াত্তা মালেক ১/২০০, সুনানে ইবনে মাজাহ: ১৩৪৩।



****************************************
>>> Welcome, You are now on Mohammadia Foundation's Website. Please stay & Tune with us>>>

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url