মোবাইল ব্যবহারের ইসলামিক রীতিনীতি || মোবাইল ক্রয়-বিক্রয় এবং মোবাইল সংক্রান্ত ব্যবসা বাণিজ্য






চুরি ও ছিনতাই করা মোবাইল ক্রয় করা নাজায়েয


আজকাল মোবাইল ফোনের ব্যবহার অত্যধিক হারে বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে মোবাইল সেট চুরি ও ছিনতাইয়ের ঘটনা অহরহ ঘটছে। এখন কোনো চোর বা ছিনতাইকারী বা তাদের কোনো লোক যদি এ ধরনের মোবাইল সেট বিক্রি করে তাহলে অন্যের জন্য জেনেশুনে ইচ্ছাকৃতভাবে তা ক্রয় করা জায়েয হবে না। অনুরূপভাবে কারো মোবাইল যদি হারিয়ে যায় এবং অন্য কেউ পেয়ে তা বিক্রি করে তাহলে তাও জেনেশুনে ক্রয় করা জায়েয হবে না। [আপ কা মাসায়েল আউর উন কা হল, খণ্ডঃ ২ পৃষ্ঠাঃ ১১৩]

সাধারণ মোবাইল নামীদামী কোম্পানির নামে বিক্রি নাজায়েয


অনেক সময় দেখা যায়, ব্যবসায়ীরা অধিক মুনাফা লাভের উদ্দেশ্যে সাধারণ ও কমদামী মোবাইল সেট নামীদামী কোম্পানি যেমন নকিয়া, স্যামসং ইত্যাদির লেভেল লাগিয়ে বেশি দামে বিক্রি করে। এভাবে এক কোম্পানির মাল অন্য কোম্পানির লেভেল দিয়ে বিক্রি করা হারাম ও নাজায়েয। কারণ এরদ্বারা মানুষকে ধোকা দেওয়া হয় এবং অন্যায়ভাবে অন্যের মাল হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে। আল্লাহ আমাদেরকে এ থেকে হেফাজত করুন । আমীন। [মুসলিম শরিফ, খণ্ডঃ ২ পৃষ্ঠাঃ ২]

নির্ধারিত সময়ে খরচের শর্তে বোনাস ঘোষণা ও তার হুকুম


বর্তমানে মাঝে মাঝে প্রায় সব কটা মোবাইল কোম্পানি নির্ধারিত পরিমাণ টাকা রিচার্জ করলে এর উপর একটা আকর্ষণীয় বোনাস টক টাইমের অফার দেয়। তবে এক্ষেত্রে তারা অনেক সময় শর্ত জুড়ে দেয় যে, এতদিনের মধ্যে এই বোনাস টকটাইম খরচ করতে হবে। এখন প্রশ্ন হলো, মোবাইল কোম্পানিগুলোর এধরনের বোনাস ঘোষণা করা এবং গ্রাহক কর্তৃক এরূপ বোনাস প্রাপ্তির উদ্দেশ্যে রিচার্জ করার হুকুম কি? আসলে মোবাইল কোম্পানিগুলো গ্রাহককে স্বল্প সময়ে অধিক মোবাইল ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করে বেশি মুনাফা লাভের জন্য এ ধরনের অফার দিয়ে থাকে । এটা মূলত গ্রাহকদেরকে প্রলোভন দেখানো ছাড়া আর কিছুই নয়। যেহেতু মোবাইল কোম্পানিগুলোর শর্ত থাকে, নির্ধারিত মেয়াদের ভিতর বোনাস টকটাইম খরচ করতে হবে, অন্যথায় বোনাসের সুযোগ হারাতে হবে। ফলে গ্রাহকরা বাধ্য হয়ে প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে কথা বলে এই বোনাস টকটাইম শেষ করে। এতে নিঃসন্দেহে গ্রাহকের সময়ের অপচয় ও অর্থের অপব্যয় হয়। এছাড়া অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তা এবং অধিকমাত্রায় কথা বলার খারাবি তো আছেই। ব্যবসার এমন পলিসি শরিয়ত পছন্দ করে না। তাই মোবাইল কোম্পানিগুলোকে এ ধরনের অফার দেওয়া থেকে বিরত থাকা উচিত। হ্যাঁ, বোনাস যদি দিতেই চায় তবে তা খরচের জন্য পর্যাপ্ত সময়ও দিতে হবে। যাতে ব্যবহারকারীরা অপ্রয়োজনীয় খরচে বাধ্য না হয়।

এবার রইল গ্রাহকদের বিষয়টি। এ ব্যাপারে শরিয়তের দৃষ্টিভঙ্গি হলো, যে গ্রাহক এই অফার গ্রহণ করে প্রয়োজনীয় কাজেই খরচ করবে, অপ্রয়োজনীয় কথা বলবে না বা বলতে বাধ্য হবে না তার জন্য এ অফার গ্রহণ করা জায়েয। কিন্তু এ অফার গ্রহণ করার কারণে যদি অপ্রয়োজনীয় কল করতে হয় কিংবা অহেতুক লম্বা আলাপ জুড়তে হয় তাহলে সময় ও অর্থ অপচয়ের গুনাহ হবে । তাই এমন গ্রাহকের জন্য এই অফার বর্জন করা জরুরি। [সহায়তায়, মোবাইল ও সাক্ষাৎঃ আদাব ও মাসায়েল - মুফতি মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক]

সর্বোচ্চ এসএমএসকারীকে পুরস্কার প্রদান


অনেক সময় দেখা যায়, নির্ধারিত মেয়াদের ভিতর সর্বোচ্চ এসএমএসকরীকে কোনো কোনো মোবাইল কোম্পানি পুরস্কৃত করে থাকে। এই পুরস্কার ঐ ব্যক্তির জন্য গ্রহণ করা জায়েয যে প্রয়োজনে এসএমএস করে থাকে। কিন্তু কেউ যদি পুরস্কার লাভের আশায় বিনা প্রয়োজনে এসএমএস করে থাকে এবং পুরস্কারও পেয়ে যায় তাহলে এমন ব্যক্তির জন্য ঐ পুরস্কার গ্রহণ করা ঠিক হবে না। [সূত্রঃ বুহুস ফি কাযায়া ফিকহিয়্যা মুআছারা, ২/২২৯ কারযাবী ২ / ৪২০]

ইনকামিং কলের উপর প্রাপ্ত বোনাস বৈধ


বাংলালিংক, টেলিটক ইত্যাদি কোম্পানি ইনকামিং কলের উপর বোনাস দিয়ে থাকে। গ্রাহকদের জন্য এই বোনাস গ্রহণ করা বৈধ। ইনকামিং কলে রিসিভকারীর যদিও কোনো খরচ হয় না তথাপি বোনাস গ্রহণ করতে কোনো অসুবিধা নেই। কেননা এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মোবাইল কোম্পানি আন্ত:সংযোগ ফী বাবদ অন্য কোম্পানি থেকে বিল পেয়ে থাকে। মূলত সেটির বৃদ্ধির লক্ষ্যেই কোনো কোনো মোবাইল কোম্পানি এমন সুবিধা দিয়ে থাকে। তাছাড়া কোনো কোম্পানি যদি তার গ্রাহকদেরকে কোনো শর্ত বা কারণ ছাড়াই কোনো টকটাইম ফ্রী দেয় তবে সেটিও গ্রহণ করা জায়েয। এটা গ্রাহকদের জন্য বাড়তি সুবিধা বলে বিবেচিত হবে । [সূত্রঃ বুহুস ফি কাযায়া ফিকহিয়্যা মুআছারা, ২/২২৯ ] কারযাবী ২/৪২০]

ডাউনলোড ব্যবসা কি জায়েয


বর্তমানে এমন অনেক ব্যবসায়ী আছেন যারা কম্পিউটারের সাহায্যে মোবাইলের মধ্যে বিভিন্ন প্রকার প্রাণীর ছবি, রিংটোন, মিউজিক, গান, ভিডিও ইত্যাদি ডাউনলোড করেন এবং এ বাবদ কাস্টমারদের থেকে নির্ধারিত হারে টাকা নেন। এই ডাউনলোড ব্যবসা নাজায়েয এবং এ ধরনের ডাউনলোড থেকে উপার্জিত অর্থও হালাল নয়। কারণ এসব জিনিস ডাউনলোড করার দ্বারা নিজের তো গুনাহ হয়ই, উপরন্তু অপরের নিকট গুনাহের উপকরণ সরবরাহ করা হয়। তবে কোনো বৈধ চিত্র, জায়েয রিংটোন, বাজনাবিহীন গজল ইত্যাদি ডাউন লোড করা জায়েয এবং এ থেকে উপার্জিত অর্থও হালাল। [সহিহ বোখারি, খণ্ডঃ ১, পৃষ্ঠাঃ ২৯৮; সহিহ মুসলিম, পৃষ্ঠাঃ ২১৯; শরহে নববী, খণ্ডঃ ২, পৃষ্ঠাঃ ২৯ আল বাহরুর্ রায়েক, খণ্ডঃ ৮, পৃষ্ঠাঃ ১৯; আদ্ দুররুল মুখতার, খণ্ডঃ ৬, পৃষ্ঠাঃ ৫৫]

কল রিসিভের সুবিধা দিয়ে বিনিময় নেওয়া


যাদের মোবাইল নেই বা থাকলেও টিএগুটি ইনকামিং নেই; বিদেশ বা অন্য কোথাও থেকে দোকানীর মোবাইলে তাদের কোনো কল আসলে সে গ্রাহক থেকে কিছু টাকা নিয়ে থাকে। অথচ এ বাবদ দোকানীর এক টাকাও খরচ হয় না। এ টাকা নেওয়া কি দোকানীর জন্য জায়েয? হ্যাঁ, এ টাকা নেওয়া দোকানীর জন্য জায়েয ও বৈধ। কেননা এখানে দোকানীর কোনো খরচ বাহ্যত না দেখা গেলেও তার মোবাইল সেট ও লাইন ব্যবহার হচ্ছে। সেই সাথে তার ব্যয় হচ্ছে সময়ও। তাই সে এগুলোর ন্যায্য বিনিময় নিতেই পারে। এ সেবা ফ্রি দিতে দোকানী বাধ্য নয়। যদি দেয় তবে তা ভিন্ন কথা। [মাসিক আল কাউসার, এপ্রিল ২০০৮ সংখ্যা, পৃষ্ঠাঃ ২২]

কল রিসিভের আগের সময়ের বিল নাজায়েজ


সাধারণত দেখা যায়, ডায়াল করার প্রায় ১০/১৫ সেকেণ্ড বা তারও বেশি সময় পরে অপর প্রান্ত থেকে মোবাইল রিসিভ করা হয় এবং রিসিভ করার পর থেকেই সময় গণনার হিসাব শুরু হয়। কিন্তু কোনো কোনো মোবাইল কোম্পানির বেলায় এর ব্যতিক্রম নিয়মও পরিলক্ষিত হয়। অর্থাৎ এসব মোবাইল কোম্পানির মিনিট গণনার হিসাব রিসিভ করার পর থেকে শুরু না হয়ে ডায়াল করার পর থেকেই শুরু হয়ে যায়। ফলে রিসিভ করার আগে যে সময়টুকু অতিবাহিত হয়, মোবাইল ব্যবসায়ীরা গ্রাহক থেকে তার বিলও আদায় করে। অথচ কল রিসিভের আগের সময়ের বিল নেওয়া জায়েয নয়। কেননা এক্ষেত্রে গ্রাহকের সাথে চুক্তি হলো, কল রিসিভ করার পর থেকে যত মিনিটের কথা হবে তার বিল নিবে । উল্লেখ্য যে, বর্তমানে আমাদের দেশে ডায়াল করার পর থেকেই সময় গণনার এই নিয়মটি শুধুমাত্র সিটিসেল মোবাইল কোম্পানির ক্ষেত্রেই দেখা যায়। ফলে বাড়তি সুবিধা পাওয়ার জন্য অনেক মোবাইল ব্যবসায়ী তাদের দোকানে সিটিসেল সিম ব্যবহার করে থাকেন। তাই সিটিসেল সিম দিয়ে বৈধভাবে ব্যবসা করতে চাইলে হয়তো মোবাইল ব্যবসায়ী নিজেই কল করবেন এবং অপর প্রান্ত থেকে রিসিভ করার পর সঙ্গে সঙ্গে সময় দেখে নিয়ে গ্রাহকের হাতে মোবাইল হস্তান্তর করবেন। অথবা তিনি পৃথক মিনিটমাইণ্ডার রাখবেন যদ্বারা রিসিভ করার সময় থেকে মিনিটের হিসাব করা হবে। অথবা কল ডিউরেশন অপশন থেকেও শেষ কলের মোট সময় জেনে নেওয়া যেতে পারে। [সূরা নিসাঃ ২৯ ] মাসিক আল কাউসার, এপ্রিল ২০০৮ সংখ্যা, পৃষ্ঠাঃ ৪২২]

ভুল নাম্বারে কল চলে গেলে


মোবাইলে যে নাম্বারে ফোন করা হয় সে নাম্বারেই যায়। সঠিক নাম্বারে রিং করার পরও ভুল নাম্বারে চলে যাওয়ার কোনো অবকাশ নেই। তাই ভুল নাম্বারে চলে গেলে বুঝতে হবে নিশ্চয়ই ভুল নাম্বারে ডায়াল করা হয়েছে। এখন এ ভুল দোকানীর যেমন হতে পারে তেমনি গ্রাহকেরও হতে পারে। দোকানীর ভুল এ হতে পারে যে, সে হয়তো নাম্বার টিপার সময় একটির পরিবর্তে অন্যটি টিপেছে। অথবা এমনও হতে পারে যে, গ্রাহকের মুখ থেকে শুনে দোকানী তার খাতায় নম্বর লিখার সময়ই ভুল লিখেছে। ফলে সেখান থেকে দেখে দেখে নম্বর টিপে ডায়াল করার কারণে তা ভুল নাম্বারে চলে গেছে। আর গ্রাহকের ভুল এ হতে পারে যে, সে নাম্বার বলার সময় ভুল বলেছে ।

যাহোক এ ক্ষেত্রে সমাধান হলো, ভুল যার দায় তার। সুতরাং দোকানীর ভুল হলে এই ভুলের ক্ষতি তারই। তাই সে গ্রাহক থেকে এ বাবদ কোনো বিল নিতে পারবে না। তবে ভুল যদি গ্রাহকের হয়ে থাকে তবে তার ক্ষতিপূরণ তাকেই দিতেই হবে। [মাসিক আল কাউসার, এপ্রিল ২০০৮ সংখ্যা, পৃষ্ঠাঃ ২২]

পরবর্তী মিনিটের ১/২ সেকেন্ড হলেও পুরো মিনিটের বিল নেওয়া জায়েয


ফোন দোকানীরা সাধারণত মোবাইল কোম্পানি কর্তৃক ঘোষিত পাস সুবিধা গ্রাহকদেরকে দেয় না। তারা দ্বিতীয় বা তৃতীয় মিনিট শুরু হলেই পুরো মিনিটের বিল নেয়। যেমন কোনো গ্রাহক তার প্রয়োজনীয় কথা শেষ করার পর দেখল, এক মিনিট এক সেকেণ্ড হয়েছে বা দুই মিনিট এক সেকেণ্ড হয়েছে। এমতাবস্থায় দোকানীরা ঐ গ্রাহক থেকে দেড় বা আড়াই মিনিটের বিল না নিয়ে পুরো দুই বা তিন মিনিটের বিল নেয়। পাল্‌স সুবিধা না দিয়ে এভাবে পুরো মিনিটের বিল নেওয়া দোকানীদের জন্য জায়েয। কেননা, ফোন ব্যবসায়ীদের জন্য মোবাইল কোম্পানি কর্তৃক ঘোষিত পাস সুবিধা গ্রাহকদের দেওয়া জরুরি নয়। তবে উত্তম হলো, পাল্স সুবিধা দেওয়া। হ্যাঁ, যদি সে পাল্স সুবিধা দিতে না-ই চায় তাহলে উত্তম হলো, সবার চোখে পড়ে এমন কোনো জায়গায় একটু বড় অক্ষর দিয়ে একথা লিখে রাখা যে, এখানে পরবর্তী মিনিটের এক সেকেণ্ড হলেও পুরো মিনিটের বিল নেওয়া হয়। এরূপ লিখে রাখার ফলে গ্রাহক সময়ের প্রতি খেয়াল রেখে কথা বলবে। তথাপি ১/২ সেকেণ্ড বেশি হয়ে গেলে সেজন্য পুরো মিনিটের বিল দেওয়া-নেওয়া নিয়ে কোনো প্রকার কথা কাটাকাটিও হবে না। [মাসিক আল কাউসার, এপ্রিল ২০০৮ সংখ্যা, পৃষ্ঠাঃ ২২]

মোবাইল কার্ড নির্ধারিত মূল্য থেকে কম-বেশিতে বিক্রয় করা জায়েয হবে কি?


বর্তমানে দেখা যায় কিছু কিছু ব্যবসায়ী নির্ধারিত মূল্য থেকে ২/৪টাকা বেশিতে মোবাইল কার্ড (স্ক্র্যাচকার্ড) বিক্রি করেন। যেমন, ৫০ টাকার কার্ড ৫২ বা ৫৪ টাকায় বিক্রি করেন। আবার কেউ কেউ নির্ধারিত মূল্য থেকে কিছু কমও রাখেন। যেমন ৩০০ টাকার কার্ড ২৯০ টাকায় দিয়ে দেন। প্রশ্ন হলো, এরূপ করা কি জায়েয ? এটা কি সুদ হবে ?

হ্যাঁ, এভাবে কম-বেশিতে মোবাইল কার্ড বিক্রি করা জায়েয। তাছাড়া এটা সুদও নয়। কেননা মোবাইল কার্ডের গায়ে যে মূল্য লিখা থাকে সেটা মূলত একটি নির্ধারিত পরিমাণ আউটগোয়িং সেবা তথা টেলিযোগাযোগ সুবিধার প্রতিনিধিত্ব করে। অন্যান্য সেবার মত এটিও একটি সেবা যা বিক্রয়যোগ্য। সুতরাং কার্ডের গায়ের দাম যেহেতু টাকা নয় তাই তা কম বেশিতে বিক্রি করা সুদও নয়।

তবে এখানে একটি লক্ষণীয় বিষয় হলো, কোনো কোম্পানি থেকে কোনো পণ্য বা সেবার মূল্য নির্ধারিত করে দিলে ঐ নির্ধারিত মূল্যেই বিক্রি করা উচিত। কম-বেশি করা ঠিক নয়। কেননা এতে বাজারে বিরূপ প্রভাব পড়ে এবং বাজারের স্বাভাবিক গতি ব্যাহত হয়। [ফাতহুল কাদীর, খণ্ডঃ ৬, পৃষ্ঠাঃ ১৫৯- তাকমিলাতু ফাতহিল মুলহিম, খণ্ডঃ ১, পৃষ্ঠাঃ ৪০০)

শরিয়তের দৃষ্টিতে ভুল ব্যালেন্স


কোনো কোনো সময় দেখা যায়, ভুল কমাণ্ড দেওয়ার কারণে বা কম্পিউটারের ত্রুটিজনিত অন্য কোনো কারণে কারো কারো মোবাইলে ভুল ব্যালেন্স দৃষ্টিগোচর হয়। যেমন, ব্যালেন্সে টাকা কম থাকা সত্ত্বেও বেশি দেখায় কিংবা ব্যালেন্সে টাকা না থাকলে ব্যালেন্স উঠে থাকে। কোনো কোনো সময় তো এমনও হয় যে, ব্যালেন্সে কোনো টাকা দেখা যায় না ঠিকই, কিন্তু অন্যের কাছে কল যায় এবং দীর্ঘক্ষণ কথাও বলা যায়।

উপরে বর্ণিত সুযোগ গ্রহণ করা কারো জন্য জায়েয নয়। অর্থাৎ নিজের জমা টাকার বেশি খরচ করা কিংবা ব্যালেন্সে কোনো টাকা না থাকা সত্ত্বেও মোবাইল ব্যবহার করে টাকা খরচ করা জায়েয নয়। কেউ যদি এরূপ করে থাকে তাহলে তাকে কাস্টমার কেয়ারে ফোন করে কিংবা সরাসরি হাজির হয়ে একথা অবহিত করতে হবে। বলতে হবে, আমি এত মিনিট অতিরিক্ত কথা বলেছি। এর বিল পরিশোধের জন্য আমার করণীয় কি বলে দিন। অতঃপর তারা যেভাবে বলবে সেভাবে টাকা পরিশোধ করতে হবে। আর এই টাকা পরিশোধের মাধ্যমেই দায় মুক্ত হওয়া যাবে। মনে রাখতে হবে, যেহেতু কোম্পানির কাছে ব্যবহৃত কলের টাকা পৌঁছানো সম্ভব তাই এই টাকা সদকা করে দেওয়া যথেষ্ট নয়। [আল বাহরুর রায়েক, খণ্ডঃ ৮, পৃষ্ঠাঃ ১০৯ খুলাসাতুল ফাতাওয়া, খণ্ডঃ ৪, পৃষ্ঠাঃ ২৭২ আব্দুররুল মুখতার, খণ্ডঃ ৬, পৃষ্ঠাঃ ১৭৯]

নির্ধারিত বিলের চেয়ে বেশি বিল করা


কল করা কিংবা যে কোনো সেবা প্রদানের জন্য মোবাইল কোম্পানি থেকে যে পরিমাণ চার্জ ঘোষণা করা হয় সে পরিমাণ চার্জই করতে হবে। এর বেশি করতে পারবে না। কোনো কোম্পানির জন্য ঘোষিত চার্জের চেয়ে বেশি চার্জ করা বা পোস্ট-পেইডে বেশি বিল করা জায়েয নয়। বেশি চার্জ করলে কাস্টমার কেয়ারে জানাতে হবে। কোম্পানি কর্তৃপক্ষ এ ভুল জানতে পারলে তা অবশ্যই শোধরে নিতে হবে। যদি শোধরে না নেয় অর্থাৎ কোনো না কোনোভাবে যদি গ্রাহককে তার অতিরিক্ত চার্জ পরিমাণ সেবা প্রদান না করে তাহলে মোবাইল কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে এবং এজন্য তারা গুনাহগার হবে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন,

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَأْكُلُوا أَمْوَالَكُمْ بَيْنَكُمْ بِالْبَاطِل إلَّا أَن تَكُونَ تِجَارَةٌ عَنْ تَرَاضٍ مِنْكُمُ (۲۹)
النساء :٢٩

হে ঈমানদারগণ! তোমরা পরস্পর সম্মতিক্রমে যে ব্যবসা কর তা ব্যতীত অন্যকোনো উপায়ে অন্যায়ভাবে অন্যের মাল আত্মসাৎ করো না। [সূরা নিসাঃ ২৯]

মোবাইলে ইন্টারনেট সার্চ করা


ইন্টারনেট হলো বিশ্বব্যাপী কম্পিউটার নেটওয়ার্কিং-এর বিস্তৃত পদ্ধতি। ইন্টারনেটের সুবাদে সমস্ত বিশ্বের কম্পিউটারগুলো এক অভিন্ন সুতোয় গাঁথা হয়ে গেছে। কম্পিউটারের কী বোর্ডে আঙুলের সামান্য স্পর্শেই বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে তথ্য ছুটে যাচ্ছে অন্য প্রান্তে। আবার অন্য প্রান্ত থেকে তথ্য আসছে এ প্রান্তে। ইন্টারনেটের কাজের পরিধির যেমন কোনো শেষ নেই, তেমনি এর বৈশিষ্ট্যেরও সিমানা নির্ধারিত নেই। তাই ইন্টারনেট কী করছে এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া তো সহজ কিন্তু ইন্টারনেট কী করছে না এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সহজ নয়। কারণ ইন্টারনেট কম্পিউটার সংক্রান্ত সবকিছুই করছে নিমেষের মধ্যে। মোটকথা, ইন্টারনেট হলো তথ্যের এক বিশাল জগত। এখানে যেমন নাজায়েয বস্তু এবং দুনিয়ার সকল অশ্লীল জিনিস আছে তেমনি ভালো ও দীনি বিষয়ে জানারও অনেক কিছু আছে। তাই ইন্টারনেটের উপর ব্যাপকভাবে কোনো হুকুম আরোপ করা যাবে না। বরং এর হুকুম হবে ব্যবহারকারী হিসেবে। ব্যবহারকারী যদি এ থেকে নাজায়েয ও অবৈধ জিনিস সার্চ করে- চাই তা কম্পিউটারের মাধ্যমে হউক বা মোবাইলের মাধ্যমে হউক— তবে তা গুনাহ হবে। আর ব্যবহারকারী যদি বৈধ ও জায়েয বস্তু সার্চ করে তবে তা জায়েয হবে। [বুহুস ফী কাযায়া ফিকহিয়্যাহ মুআসারা, খণ্ডঃ ১, পৃষ্ঠাঃ ৩৫৯; রদ্দুল মুহতার, খণ্ডঃ ৬, পৃষ্ঠাঃ ৩৫০]

মেমোরী কার্ড ও ডাটা ক্যাবল ক্রয়-বিক্রয়


যেহেতু মেমোরী কার্ড এবং ডাটা ক্যাবলের ব্যবহার ক্ষেত্র নাজায়েয হওয়া সুনির্দিষ্ট নয় তাই এগুলোর ক্রয়-বিক্রয়ও নাজায়েয নয়। কেননা, নিয়ম হলো কোনো জিনিসের ব্যবহার ক্ষেত্র নাজায়েয হওয়া সুনির্দিষ্ট না হলে তা ক্রয়-বিক্রয়ও নাজায়েয হয় না। মেমোরী কার্ডে কোরআন কারিমের তিলাওয়াত, হামদ, নাত, গজল, প্রাকৃতিক দৃশ্য, প্রাণহীন বস্তুর ছবি ইত্যাদি সংরক্ষণ করা যেতে পারে। আর ডাটা ক্যাবলের মাধ্যমে কম্পিউটার থেকে এ ধরনের জায়েয বস্তু সরবরাহ করা যেতে পারে। এ হলো মেমোরী কার্ড ও ডাটা ক্যাবল ব্যবহারের বৈধ ক্ষেত্র। আবার এ দুটি বস্তুর সাহায্যে গান, ছবি ইত্যাদি নাজায়েয জিনিসও সংরক্ষণ করা যায়। আর এ হলো এগুলো ব্যবহারের অবৈধ ক্ষেত্র। মোটকথা এ দুটি বস্তু জায়েয কাজেও ব্যবহার করা সম্ভব বিধায় মৌলিকভাবে এগুলোর ক্রয়-বিক্রয়ও নাজায়েয নয়। তবে একথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, নাজায়েয কিছু আদান প্রদান বা সংরক্ষণের জন্য এসব বস্তুর ব্যবহার সম্পূর্ণরূপে নাজায়েয। [জাওয়াহিরুল ফিকহ্, খণ্ড: ২, পৃষ্ঠা : ৪৪৬ বুহুস ফী কাযায়া ফিকহিয়্যাহ, খণ্ডঃ ১, পৃষ্ঠাঃ ৩৫৯; রদ্দুল মুহতার, খণ্ডঃ ৬, পৃষ্ঠাঃ ৩৯১] 

পণ্যসামগ্রীর দোকান থেকে প্রাপ্ত ছাড় গ্রহণ করা জায়েয


আজকাল দেখা যায়, কোনো কোনো পণ্যসামগ্রীর দোকানে গ্রামীণ বা বাংলালিংক সিম ব্যবহারকারীদের জন্য পুরো মূল্যের উপর ডিসকাউন্ট দেওয়া হয়। যেমন, 'পেগাসাস সুজ কোম্পানির শোরুম থেকে কোনো জুতো ক্রয় করলে গ্রামীণ সিম ব্যবহারকারীদের জন্য পুরো মূল্যের উপর ১০% ‘থ্যাংকইউ ডিসকাউন্ট' দেয়। তা এভাবে যে, ক্রেতা দোকান থেকে নির্দিষ্ট নাম্বারে ম্যাসেজ পাঠালে কোম্পানি থেকে একটি ফিরতি ম্যাসেজ আসে। সেই ম্যাসেজ দোকানীকে দেখালে সে ১০% মূল্য ছাড় দেয়। এভাবে ৫০০ টাকার জুতো ৪৫০ টাকায় পাওয়া যায়। আর ১০০০ টাকার জুতো পাওয়া যায় ৯০০ টাকায়। শরিয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে এই ছাড় গ্রহণ করতে কোনো অসুবিধা নেই। এই ছাড় গ্রহণ করা জায়েয। এটি সুদ নয়। ক্রেতার জন্য এই মূল্যছাড় বিক্রেতার পক্ষ থেকে দেওয়া হচ্ছে বলে ধর্তব্য হবে। আর বিক্রেতার জন্য স্বেচ্ছায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে নির্ধারিত মূল্য হতে কিছু ছাড় দেওয়া শুধু জায়েযই নয়, পছন্দনীয়ও বটে। [মাসিক আল কাউসার, জুলাই, ২০০৮ সংখ্যা, পৃষ্ঠাঃ ৮]

বোনাস টকটাইম ব্যবহার


মোবাইল কোম্পানিগুলো বিভিন্ন সময় বিভিন্ন উপায়ে গ্রাহকদেরকে বোনাস টকটাইম দিয়ে থাকে। যেমন, ২৯৯ টাকা দিয়ে একটি একটেল সিম কিনলে ৩০০ টাকার বোনাস টকটাইম দেওয়া হয়। এমনিভাবে বাংলালিংক বা ওয়ারিদ সিম কিনলে সমমূল্যের বোনাস টকটাইম দেওয়া হয়। বিভিন্ন সময়ে মোবাইল কোম্পানিগুলোর দেওয়া এই বোনাস টকটাইম ব্যবহার করা জায়েয। কেননা এটা মূলত এক ধরনের মূল্য হ্রাসের ঘোষণা। এখানে সিম ও ঘোষিত বোনাস উভয়টি বিক্রিত পণ্য।

অনুরূপভাবে মাঝে মধ্যে কোনো কোনো কোম্পানি নির্দিষ্ট পরিমাণ রিচার্জের উপরেও নির্দিষ্ট পরিমাণ বোনাস টকটাইম দিয়ে থাকে। কেউ কেউ আবার স্ক্র্যাচকার্ড কিনলেও বোনাস টকটাইম দেয়। এই বোনাস টকটাইমও ব্যবহার করা বৈধ। এতেও সুদের কিছু নেই। ৩০০ টাকার ক্র্যাচকার্ডের উপর ১০% টকটাইমসহ ব্যালেন্সে ৩৩০ টাকা জমা হয়। এখানে একথা বলার সুযোগ নেই যে, ৩০০ টাকার পরিবর্তে ৩৩০ টাকা নেওয়া হচ্ছে। বরং এখানে যা হচ্ছে তা হলো, ৩০০ টাকার পরিবর্তে ৩৩০ টাকা সমমূল্যের টকটাইম ক্রয় করা হচ্ছে। যাতে সুদ কিংবা নাজায়েজের কিছু নেই।

তবে উল্লেখিত মাসআলায় একথাটি খুব ভালো করে মনে রাখতে হবে যে, বোনাস পাওয়ার আশায় অপ্রয়োজনীয় কল করা কিংবা প্রয়োজন ছাড়া কল করে সময়ের অপচয় করা কোনো অবস্থাতেই জায়েয হবে না। [হেদায়া, খণ্ডঃ ৩, পৃষ্ঠাঃ ৭৫; রদ্দুল মুহতার, খণ্ডঃ ৫, পৃষ্ঠাঃ ১৮-১৯; ফাতহুল কাদীর, খণ্ডঃ ৬, পৃষ্ঠাঃ ১৪২]

মোবাইল কোম্পানির বোনাস অফার


মোবাইল কোম্পানিগুলো বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রকার বোনাস অফার দিয়ে থাকে। যেমন, সর্বাধিক এসএমএস করলে বা এই পরিমাণ টাকা খরচ করলে গোল্ডেন কয়েন পাওয়া যাবে বা সিঙ্গাপুর ভ্রমণ করা যাবে ইত্যাদি। এক্ষেত্রে শরিয়তের দৃষ্টিভঙ্গি হলো, কোনো কোম্পানি বোনাস অফার দিয়ে যদি বাস্তবিকই তা দিয়ে থাকে তাহলে গ্রাহকের জন্য তা নেওয়া জায়েয। কেননা এ বোনাসটি মূলত কোম্পানির পক্ষ থেকে উপহার স্বরূপ। অবশ্য যদি কোনো কোম্পানি মানুষকে শুধু লোভ দেখানোর জন্য বড় বড় অফার দেয় এবং বাস্তবে তা না দেয় কিংবা নানা কৌশল করে তা এড়িয়ে যায়, তাহলে তা হবে ধোঁকা ও প্রতারণার শামিল। এক হাদিসে নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যারা ধোঁকা দেয় তারা আমার দলভুক্ত নয় ।

স্টেশনে মোবাইল চার্জ করা


যদি কোনো ব্যক্তি কাউকে বিদায় দেওয়ার জন্য কিংবা অন্য কোনো উদ্দেশ্যে এয়ারপোর্ট, রেলস্টেশন, বাসস্টেশন ইত্যাদি স্থানে যায় এবং সেখানে তার মোবাইল চার্জ দেওয়ার প্রয়োজন দেখা দেয় তাহলে তার জন্য ঐ স্টেশনের বিদ্যুৎ দ্বারা মোবাইল চার্জ দেওয়াতে কোনো অসুবিধা নেই। কেননা স্টেশনে যেসব চার্জ-পয়েন্ট থাকে, তা থেকে উপকৃত হওয়ার সাধারণ অনুমতি সকলের জন্যেই থাকে। [দুররুল মুখতার, খণ্ডঃ ১০, পৃষ্ঠাঃ ১৩]

মোবাইল কি ফ্যাশন


ফ্যাশন হলো সময়ের রঙিন রূপ। তাই সময় বদলানোর সাথে সাথে ফ্যাশনও বদলায়। আজকাল অনেকে মোবাইল ব্যবহার করে ফ্যাশন হিসেবে। যারা এরূপ করে তারা নিজেরাও জানে যে, তাদের মোবাইলের কোনো প্রয়োজন নেই। তবু তাদের মনের একান্ত বাসনা, হাতে একটি সুন্দর মোবাইল শোভা পাক! তাই তারা দামী দামী মোবাইল সেট হাতে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। যেগুলোর মূল্য পাঁচ হাজার থেকে পঁচিশ হাজার টাকা। অথচ বাস্তব সত্য হলো, গোটা মাসে তারা ১০ টাকার কাজের কথাও বলে না! মনে রাখবেন, এভাবে মানুষকে দেখানোর জন্য এবং নিজের বড়ত্ব জাহের করার জন্য কোনো পয়সা খরচ করা জায়েয নেই। মুমিনের জান-মালের মালিক মহা পরাক্রমশালী আল্লাহ। সুতরাং এগুলোকে তার মর্জি মোতাবেক ব্যবহার করতে হবে । তবেই তিনি খুশি হবেন, রাজি হবেন এবং এর বিনিময়ে আমাদেরকে দান করবেন অফুরন্ত নেয়ামতের স্থান- জান্নাত। আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর রাজি-খুশির উদ্দেশ্যে যাবতীয় কাজ সম্পাদন করার তাওফিক দান করুন। আমীন




****************************************
>>> Welcome, You are now on Mohammadia Foundation's Website. Please stay & Tune with us>>>

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url