সাহাবাগণের জীবনকথা-৭৬ || শুরাহবীল ইবন হাসানা (রাঃ) -এর জীবনী








নাম শুরাহবীল, কুনিয়াত বা ডাকনাম আবু আবদিল্লাহ বা আবু 'আবদির রহমান। পিতা আবদুল্লাহ ইবনুল মুতা', মাতা হাসানা। তবে আবু 'আমরের মতে হাসানা তাঁর মেয়ের নাম। 

শুরাহবীলের (রাঃ) ইসলাম গ্রহণ ও হিজরাত


শুরাহবীলের (রাঃ) পিতা মারা যাওয়ার পর তাঁর মা হাসানা দ্বিতীয়বার সুফইয়ান আনসারীকে বিয়ে করেন। এ কারণে তিনি পিতার পরিবর্তে মাতার নামের সাথে পরিচিত হন। এই হাসানার বংশ সম্পর্কে মতভেদ আছে। কেউ বলেছেন কিন্দা গোত্রের, কেউ বলেছেন বনী তামীম গোত্রের, আবার অনেকের মতে বনী জুমাহ গোত্রের। তিনি মক্কায় ইসলামের প্রথম পর্বে ইসলাম গ্রহণ করেন এবং পরিবারের অন্যদের সাথে হাবশায় হিজরাত করেন। অতঃপর সেখান থেকে মদীনায় চলে যান। (সীরাতু ইবন হিশাম- ২/৩৬৪, ৩৬৯)।

শুরাহবীল (রাঃ) ইসলামের সূচনা পর্বেই মুসলমান হওয়ার গৌরব অর্জন করেন এবং মক্কা থেকে হাবশাগামী প্রথম কাফিলার সাথে হাবশায় হিজরাত করেন। তারপর হাবশা থেকে সরাসরি মদিনায় আসেন এবং মায়ের দিক দিয়ে সম্পর্কিত বনী খুরাইক গোত্রে বসবাস করতে থাকেন। মদীনায় আসার পর থেকে রাসূলুল্লাহর (সাঃ) ওফাত পর্যন্ত তাঁর জীবনের উল্লেখযোগ্য কোন তথ্য ইতিহাসে পাওয়া যায় না। সম্ভবতঃ রাসূলুল্লাহর (সাঃ) ওফাতের অল্প কিছুদিন আগে তিনি মদীনায় আসেন। ইসলামের খিদমতে তাঁর উল্লেখযোগ্য কর্মজীবন শুরু হয় খলীফা হযরত আবু বকরের (রা) খিলাফত কালে ৷

ইসলামের খেদমতে শুরাহবীলের (রাঃ) যুদ্ধ অভিযান


হিজরী ১২ সনে খলীফা আবু বকর (রাঃ) মুসলিম বাহিনীর শ্রেষ্ঠ চার সৈনিককে কমাণ্ডার হিসেবে নির্বাচন করেন। তাঁরা হলেন: ১. আমর ইবনুল আস, ২- ইয়াযীদ ইবন আবী সুফইয়ান, ৩. আবু “উবাইদা ইবনুল জাররাহ এবং ৪. শুরাহবীল ইবন হাসানা। প্রত্যেকের জন্য সৈনিক বাছাই করলেন এবং কে কোন্ পথে অগ্রসর হবেন তাও বলে দিলেন। বিজয়ের পর কে কোথাকার ওয়ালী হবেন সেটাও নির্ধারণ করে দিলেন। যথাঃ 'আমর ফিলিস্তীনের, ইয়াযীদ দিমাশকের এবং শুরাহবীল জর্দানের। (তারীখুল উম্মাহ আল ইসলামিয়্যাহ-১/১৯০-৯১) অবশ্য কোন কোন বর্ণনায় পাঁচ জন সেনা কমাণ্ডারের নাম এসেছে। উপরে উল্লেখিত চারজনের মধ্যে তিনজন এবং আবু উবাইদার স্থলে খালিদ ইবনুল ওয়ালীদ ও ইয়াজ ইবন গান্‌ আল ফির এর নাম বর্ণিত হয়েছে। (হায়াতুস সাহাবা-৩/৬৮৪, ১/২১৩) ইবনুল বারকী বলেন, খলীফা উমার (রাঃ) শুরাহবীলকে শামের এক চতুর্থাংশের শাসক নিযুক্ত করেন। (আল ইসাবা ২/১৪৩)।

সিরিয়া অভিযানে বসরার যুদ্ধে শুরাহবীল ছিলেন একজন কমান্ডিং অফিসার। যুদ্ধ শুরুর পূর্বে তাঁর ও প্রতিপক্ষের নেতা 'রোমানাস-এর মধ্যে মত বিনিময় হয়। কিন্তু তাতে কোন ফল না হওয়ায় তিনি সৈন্য সুসংগঠিত করে সম্মুখে অগ্রসর হচ্ছেন এমন সময় হযরত খালিদ এসে উপস্থিত হলেন। খালিদ প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং তারই নেতৃত্বে প্রতিপক্ষ জিযিয়া দানে সম্মত হয় (ফুতূহুল বুলদান - ১১১ )।

বসরার পর রোমানরা আজনা দাইনে সমবেত হয়। খালিদ তাদের প্রতিহত করার জন্য অগ্রসর হন। কিছুদুর যাওয়ার পর শুরাহবীলও তাঁর সাথে যোগ দেন। উভয়ে সম্মিলিতভাবে রোমান বাহিনীর মুখোমুখি হন এবং এক ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর মুসলিম বাহিনী বিজয় লাভ করে। দিমাশ্ক অভিযানে তিনি পদাতিক বাহিনীর কমাণ্ডার এবং অবরোধের সময় একটি ফটক প্রহরার দায়িত্বে ছিলেন। বিজয়ের সমাপ্তি পর্যন্ত তিনি এ দায়িত্ব পালন করেন।

দিমাশ্ক বিজয়ের পর মুসলিম বাহিনী ‘ফাহল'-এর পথে ‘বীসান’-এর দিকে অগ্রসর হয়। প্লাবনের কারণে পথিমধ্যে 'ফাহল'-এ তাদের যাত্রাবিরতি করতে হয়। এ বাহিনীর সাথেও শুরাহবীল ছিলেন। তারই সতর্কতায় মুসলিম বাহিনী এক মারাত্মক বিপদ থেকে রক্ষা পায়। মূলতঃ রোমানরা সমুদ্রের একটি বাঁধ ভেঙ্গে দিয়ে 'ফাহল' ও বীসান'- '-এর মধ্যবর্তী অঞ্চলে প্লাবনের সৃষ্টি করে। মুসলিম বাহিনী যাত্রাবিরতি করে ফাহল-এ শিবির স্থাপন করে। এই নাজুক পরিস্থিতিতে শূরাহবীল সারা রাত জেগে শিবির পাহারা দিতেন যাতে রোমানরা অতর্কিত আক্রমণ করতে না পারে। সত্যি সত্যিই রোমানরা একদিন হঠাৎ পেছন দিক থেকে আক্রমণ করে বসে কিন্তু শুরাহবীলের দূরদর্শিতা ও সতর্কতার ফলে রোমানরা পরাজিত হয়।

ফাহল-এর পর শুরাহবীল ও 'আমর ইবনুল 'আস ‘বীসান'-এর দিকে অগ্রসর হন। বীসান-এর অগ্নিবাসীরা ফাহল-এর পরিণাম প্রত্যক্ষ করেছিল। তারা সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ না হয়ে কিল্লার দরজা বন্ধ করে দেয়। শুরাহবীল বীসান পৌঁছেই কিল্লা অবরোধ করেন। দীর্ঘদিন এ অবরোধ চলতে থাকে ৷ একদিন কতিপয় লোক কিল্লা থেকে বের হয়ে আক্রমণ চালানোর চেষ্টা করলে তাদের হত্যা করা হয়। অবশেষে তারা দিমাশকের শর্তাবলীতে সন্ধি করে। এরপর 'তিবরিয়া'-এর অধিবাসীরা শুরাহবীলের নিকট প্রতিনিধি পাঠিয়ে চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। অতঃপর হযরত শুরাহবীল জর্দান এলাকা ও এর আশেপাশের সকল শহর প্রায় বিনা বাধায় ও বিনা রক্তপাতে ইসলামী শাসনের অধীনে আনেন ৷

ইয়ারমুক অভিযানে মুসলিম বাহিনী সিরিয়ার সকল অঞ্চল থেকে গুটিয়ে ইয়ারমুকে সমবেত হয়। হযরত শুরাহবীলও আসেন। তিনি ও ইয়াযীদ ইবন আবী সুফইয়ান একই স্থানে অবস্থান গ্রহণ করেন। খালিদ ছিলেন এ অভিযানের সিপাহসালার বা প্রধান সেনাপতি। তিনি গোটা সেনাবাহিনীকে সম্পূর্ণ নতুন পদ্ধতিতে ছত্রিশটি ভাগে বিভক্ত করেন এবং প্রতিটি ভাগকে একজন অফিসারের অধীনে ন্যস্ত করেন। ডান ও বাম ভাগের দায়িত্ব অর্পিত হয় হযরত 'আমর ইবনুল 'আস ও শুরাহবীল ইবন হাসানার ওপর। এ যুদ্ধে রোমানদের প্রথম আঘাতেই মুসলিম বাহিনীর অবস্থা যখন টলটলায়মান এবং অনেকে ময়দান থেকে ভেগে যায় তখনও শুরাহবীল অটল। এ যুদ্ধে তিনি জীবন বাজি রেখে লড়েন।

শুরাহবীলের (রাঃ) জীবন-যাপন

হযরত শুরাহবীলের সারাটি জীবন হাবশা প্রবাসে এবং পরবর্তীতে জিহাদের ময়দানে অতিবাহিত হলেও রাসুলুল্লাহ্র (সা) হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে কোন অংশে পিছিয়ে নন। তিনি বেশ কিছু হাদীস বর্ণনা করেছেন।

শিফা বিনতু 'আবদিল্লাহ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহর (সা) কাছে গেলাম কিছু সাদকা চাওয়ার উদ্দেশ্যে। কিন্তু তিনি সাদকা দানে অক্ষমতা প্রকাশ করলেন, আর আমিও চাপাচাপি করতে লাগলাম। ইতিমধ্যে নামাযের সময় হয়ে এলো। আমি রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট থেকে বের হয়ে আমার মেয়ের ঘরে গেলাম। শুরাহবীল ইবন হাসানার স্ত্রী আমার মেয়ে। আমি শুরাহবীলকে ঘরেই পেলাম। আমি তাকে বললাম, নামাযের সময় হয়েছে, আর তুমি ঘরে বসে আছ? আমি তিরস্কার করতে লাগলাম। তখন সে বললো, আমাকে তিরস্কার করবেন না। আমার একখানা মাত্র কাপড়, সেটাও রাসূলুল্লাহ (সা) ধার নিয়েছেন। আমি বললাম, আমার মা-বাবা কুরবান হোক! আজ সারাদিন আমি রাসূলুল্লাহর (সা) সংগে ঝগড়া করছি, অথচ তাঁর এ করুণ অবস্থা আমি মোটেও বুঝতে পারিনি। শুরাহবীল বলেন, 'রাসূলুল্লাহর (সা) একখানা মাত্র কাপড়, আমরা তাতে তালি লাগিয়ে দিয়েছি।' (হায়াতুস সাহাবা- ১/৩২৬)।

হযরত শুরাহবীলের (রাঃ) ইনতিকাল

হিজরী ১৮ সনে মুসলিম বাহিনী সিরিয়া অভিযানে লিপ্ত। এ সময় ইরাক, সিরিয়া ও মিসরে মহামারি আকারে প্লেগ দেখা দেয়। 'আমর ইবনুল 'আস বললেন, 'এই প্লেগ হচ্ছে আল্লাহর আযাব । সুতরাং তোমরা বিভিন্ন উপত্যকা ও গিরিপথে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়।' একথা শুনে শুরাহবীল ভীষণ রেগে গেলেন। তিনি বললেন, 'আমর ঠিক কথা বলেনি। আমি যখন রাসূলুল্লাহর সংগী তখনও 'আমর তার পরিবারের উটের চেয়েও পথভ্রষ্ট। নিশ্চয় এ প্লেগ তোমাদের নবীদের দু'আ রবের রহমত এবং তোমাদের পূর্ববর্তী বহু সত্যনিষ্ঠ লোক এতে মৃত্যুবরণ করেছেন। (হায়াতুস সাহাবা-২/৫৮১) তিনি ছিলেন একান্তভাবে আল্লাহ-নির্ভর ব্যক্তি। তাই রোগের ভয়ে স্থান ত্যাগ করা সমীচীন মনে করেননি। তিনি স্থান ত্যাগ করলেন না। বর্ণিত আছে হযরত মু'য়াজ ইবন জাবাল, আবু উবাইদাহ, শূরাহবীল ইবন হাসানা ও আবু মালিক আল-আশয়ারী (রা) একই দিন প্লেগে আক্রান্ত হন। (হায়াতুস সাহাবা- ২/৫৮২) 'আমওয়াসের এই প্লেগে অনেকের সাথে হযরত শুরাহবীল ইবন হাসানা ৬৭ বছর বয়সে ইনতিকাল করেন। অবশ্য ইবন ইউনূস বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) শুরাহবীলকে মিসর পাঠান এবং সেখানেই তিনি মারা যান। (আল ইসাবা-২/১৪৩) ইবন ইউনূসের মতটি বিভিন্ন কারণে গ্রহণযোগ্য নয় বলে মনে হয় ।




**************************************
>>> Welcome, You are now on Mohammadia Foundation's Website. Please stay & Tune with us>>>


এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url