মা হিসেবে মুসলিম নারীর দায়িত্ব || একজন মুসলিম মায়ের দায়িত্ব ও কর্তব্য
রক্ষণশীল আদর্শ নারীর প্রয়োজন, যে তার দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে জানে এবং তার উপর অর্পিত আমানতকে অনুধাবন করে; যে নিজের পথ দেখতে পায় এবং অন্য কেও পথ দেখাতে পারে ,আর এ ক্ষেত্রে সে সবার আগে যার ওপর পূর্ণ অধিকার রাখে তা হল তার সন্তান । যার প্রতি পরিপূর্ণ দায়িত্ব- কর্তব্য পালন করার পরই আল্লাহ্ চাইলে নিজেকে একজন সার্থক মা হিসেবে নিজেকে দেখতে পাবেন ।
মা হিসেবে মুসলিম নারীর দায়িত্ব
একজন মুসলিম জননীর প্রাথমিক দায়িত্ব হল সন্তানদেরকে কুরআন ও সুন্নাহর শিক্ষা অনুযায়ী চলতে অনুপ্রাণিত করা।
অনারবীয় এলাকায় যে সকল মুসলিম নারী প্রত্যহ সকালে ভক্তিভরে কুরআন তেলাওয়াত করেন তাদের অধিকাংশই তার সামান্যতম অর্থও জানেন না, কিংবা জানার চেষ্টাও করেন না।
ধর্মকর্ম পালনে এবং অশ্লীলতা রোধে মায়ের ভূমিকা
ধর্মীয় ঝোঁক প্রবণ অথচ আধুনিক শিক্ষায় গড়ে ওঠা অনেক মেয়েই কুরআন, হাদীস ও ইসলামী সাহিত্য অধ্যয়ন করে থাকে। কিন্তু এগুলোকে তারা নোবেল নাটকের মতই ভাবে, কিংবা ভাবে কোন বিমূর্ত দর্শন হিসেবে। ইসলাম সম্পর্কিত এই পড়াশুনা তাই তাদেরকে এক মুহূর্তের জন্যও নোংরা ছায়াছবি দর্শন, অশ্লীল সংগীত শ্রবণ ও গানের তালে তালে অংগভংগি প্রদর্শন কিংবা অশালীন দেহ আটা পোশাক পড়ে সামাজিক অনুষ্ঠানাদিতে অংশগ্রহণ থেকে বিরত রাখতে সমর্থ হয় না ।
এক্ষেত্রে মুসলিম মায়েদের কর্তব্য তাদের বেড়ে ওঠা ছেলে মেয়েদেরকে এ কথা বুঝানো যে, স্কুল-কলেজে তাদের অন্যান্য বন্ধু-বান্ধবীরা যা করছে তা আসলে ঠিক নয়। মুসলিম নারী কুরআন-হাদীস পড়বেন এই উদ্দেশ্যে যেন তাদের দৈনন্দিন জীবনে তার শিক্ষা বাস্তবায়িত হয়।
অনেক মুসলমানের ঘরেই দেখা যায়, তাকের ওপরে সুন্দর সিলকের কাপড়ে আবৃত করে কুরআন শরীফ রেখে দেয়া হয়েছে, যেন ময়লা পড়ার জন্যই। অব্যবহৃত এই অসংখ্য কুরআন আর্তি করে বলছে “ওহে মানুষ আমাকে বন্ধন মুক্ত কর, আমাকে পড়, আমাকে অনুসরণ কর।”
যে মায়েরা মহিলা বিষয়ক পত্রিকাদি পড়তে অভ্যস্ত তারা সমাজে দীর্ঘদিন ধরে প্রতিষ্ঠিত নৈতিকতা ও ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রতি তাদের যুব সন্তানদের তীব্র বিদ্রোহাত্মক দৃষ্টিভংগিকেও সহজেই সমর্থন করে বসেন। এমনকি তাদের নির্বোধ, ঘৃণ্য আচরণ ও তুচ্ছ চপলতার প্রতি তীব্র আকর্ষণ এবং গতানুগতিকতার প্রতি সর্বাত্মক অনিহাকেও তারা প্রশ্রয় দিয়ে থাকেন। এই মায়েরা মনে করেন, “নাস্তিকতা ও বস্তুবাদ হচ্ছে যুব কিশোরদের জন্য উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত এক জৈবিক বাস্তবতা। একে তারা একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন হিসেবে গ্রহণ করবেই। সুতরাং তাদেরকে এ সর্বব্যাপী ঝোঁক প্রবণতার ওপর ছেড়ে দেয়াই উচিত।”
এটা সম্পূর্ণ একটি প্রতারণাপূর্ণ কথা। এর কোন যৌক্তিকতাই থাকতে পারে না। বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রে তথাকথিত প্রগতিবাদীদের প্রচার প্রচারণাই তাদেরকে এ নৈরাশ্যের মধ্যে ফেলে দিয়েছে।
গণমাধ্যমগুলো ধর্মহীনতার প্রচারক
গণ মাধ্যমগুলোতে আমাদের সন্তানেরা যা শোনে ও দেখে এবং তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে তারা যা শেখে, তাদের গৃহে আচরিত কিংবা শিখানো মূল্যবোধের সাথে তার কোন মিল না থাকায় স্বাভাবিকভাবেই তারা প্রতিবাদী হয়ে উঠে। তারা ধর্মহীনতা ও অশ্লীলতার দিকে এগিয়ে যায়। এসব গণমাধ্যম যদি পাশ্চাত্য জীবন-পদ্ধতি শিক্ষা না দিয়ে ইসলামী জীবন ধারার শিক্ষা দিতো তাহলে এই যুবক-যুবতীরা চিন্তা-বিশ্বাস এবং অনুভূতি ও আচরণে সম্পূর্ণ বিপরীত হতে পারতো। এই অত্যাবশ্যকীয় পরিবর্তন সাধনে শিক্ষিত মায়েরাই কেবল তাদের সন্তানদের ওপর পরম কার্যকরী প্রভাব খাটাতে মুখ্য ভূমিকা রাখতে পারেন ।
পর্দা সম্পর্কিত ইসলামী শিক্ষার দাবীই হচ্ছে মহিলাগণ ব্যক্তিত্ব ও সম্মানের সাথে একাকিত্বে বাস করবেন। নিতান্ত প্রয়োজনে আত্মীয়-স্বজন ও পুরুষ বন্ধু- বান্ধবের সাথে সাক্ষাতের জন্য বের হওয়া ছাড়া অধিকাংশ সময় তারা নিজ গৃহে অবস্থান করবেন। একজন মা তার বেড়ে ওঠা সন্তানদের সামনে তার ব্যক্তি জীবনে অনুশীলিত কার্যাদির দ্বারাই সুন্দর উদাহরণ উপস্থাপন করতে পারেন। যে জননী সর্বদা তার ঘর-কন্যার কাজে নিজেকে সাচ্ছন্দ রাখেন, রান্না-বান্না, তদারকী ও শিশুদের পরিচর্যায় ব্যাপৃত থাকেন, নিয়মিত নামায পড়েন, কুরআন অধ্যয়ন ও অন্যান্য ইবাদাত বন্দেগীর কাজে ব্যস্ত থাকেন, তিনিই তার পরিবারে এমন একটি অনুকুল ইসলামী পরিবেশ সৃষ্টি করতে সক্ষম, যার দ্বারা তার শিশু সন্তানেরা গভীরভাবে প্রভাবিত হবে এবং বয়ঃবৃদ্ধির সাথে সাথে সে যখন বাইরের পরিবেশে মিশবে তখন অবাঞ্ছিত আচরণ দ্বারা আকৃষ্ট হবে না। এ জন্য খুব অল্প বয়স থেকে শিশুদের ইসলামী শিক্ষা প্রদান করা উচিত। হাদীস থেকে আমরা জানতে পারি যে, রসূল (সাঃ) এর সাহাবা-ই-কেরাম (রাঃ) এর সন্তানগণ এমনকি নেংটা থাকাকালীন বয়সেও কুরআন আবৃত্তি করতে পারতেন।
সন্তানের শিক্ষা দানে মায়ের ভূমিকা
শিশুরা যখন কথা বলতে শিখে তখনই তাকে কালিমা শিক্ষা দেয়া উচিত এবং বিসমিল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহু আকবার, ইনশাআল্লাহ, মাশাআল্লাহ প্রভৃতি ইসলামী ভাবাবেগপূর্ণ কথামালাও শিক্ষা দেয়া প্রয়োজন শিশু যখনই দাঁড়াতে ও হাঁটতে শিখে তখনই মায়ের অনুকরণে তাকে নামাযের মহড়া করতে অনুপ্রাণিত করা উচিত। শিশুর বয়স যখন সাত বছর হবে তখন মায়েদের উচিত তাদেরকে নামায পড়তে চাপ দেয়া এবং দশ বছর বয়সেও নামায না পড়লে শিশুদের শাস্তি দেয়া প্রয়োজন। এভাবে শিক্ষা দিলেই শিশুরা বুকদার হওয়ার অনেক আগে থেকেই স্রষ্টা ও মানুষের প্রতি দায়িত্ব পালনে অভ্যস্ত হয়ে উঠবে।
বয়স ও মেধা অনুসারে এ সকল কর্তব্য পালনের গুরুত্ব সম্পর্কে শিশুদেরকে সহজ-সরল ও পরিষ্কার ব্যাখ্যা এর উচিত এ ক্ষেত্রে মায়েদের কর্তব্য শিশুদেরকে অতীত ও বর্তমানের মুসলিম মহৎ ব্যক্তিত্বের রোমাঞ্চকর জীবন ও কর্ম সম্পর্কে পরিচিত করে তোলা এবং তাদের নিজেদের জীবনে ঐ সকল মূল্যবোধ মেনে চলার তীব্র আকাংখা সৃষ্টি করা। শিশুরা যখন একটু বড় হয়ে ওঠে এবং নিজেরা ইচ্ছা করে বই পুস্তক পড়তে পারে তখন বাসগৃহের পরিবেশে এমন সব ইসলামী বই পুস্তক রাখা প্রয়োজন যা শিশুদেরকে পড়তে আকৃষ্ট করে।
যে সব ছেলেমেয়ে বেশ বড় হয়েছে কিংবা যৌবনে অবতীর্ণ হয়েছে তাদেরকে প্রেক্ষাগৃহের নোংরা ছায়াছবি ও রেডিও-টিভির অর্থহীন প্রোগ্রামগুলো কেবল দেখতে নিষেধ করলেই চলবে না বরং সেগুলোর খারাপ দিকটা তাদেরকে ব্যাখ্যা করে বুঝাতে হবে। ঘরে যদি রেডিও অথবা টেলিভিশন সেট থাকে তবে মায়েদের উচিত তার কুরআন তিলাওয়াত, সংবাদ বুলেটিন, ভাল কবিতা আবৃত্তি ও স্বাস্থ্য শিক্ষা প্রোগ্রামগুলো ছাড়া অন্য সব প্রোগ্রাম শোনা থেকে সন্তানদেরকে সম্পূর্ণ বিরত রাখা। কোন অবস্থাতেই শিশুদেরকে পপ সঙ্গীত শুনতে দেয়া উচিত নয়। কারণ শিশু চরিত্রের ওপর এর চেয়ে খারাপ নৈতিক প্রভাব ফেলার মত আর কোন প্রোগ্রামই নেই। যদি শিশু কখনো প্রতিবেশীর রেডিও-টিভি থেকে শুনে এ সকল খারাপ গান গাইতে শুরু করে তবে মায়েদের উচিত তাদেরকে চুপ থাকতে বাধ্য করা এবং এসব নোংরা গান গাইতে লজ্জাবোধ থাকা উচিত বলে ধিক্কার দেয়া।
মুসলিম মায়েদের কোন অবস্থাতেই তাদের সন্তানদেরকে খৃস্টান মিশনারী স্কুলে বা আশ্রমে লেখাপড়ার উদ্দেশ্যে পাঠাতে সম্মত হওয়া উচিত নয় । কারণ সেগুলোতে ছেলেমেয়েরা খৃস্টধর্ম ও সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত হবেই। এমনকি সরকারি স্কুলগুলোতেও নৈতিক শিক্ষার জন্য তেমন ভাল ফল আশা করা যায় না।
তাই এ ক্ষেত্রে সামর্থ থাকলে গৃহ শিক্ষকের মাধ্যমে কিংবা অসমর্থ হলে মসজিদে পাঠিয়ে ছেলেমেয়েদেরকে আরবী ভাষা, কুরআন ও হাদীসের শিক্ষা প্রদানের সাহায্যে বস্তুবাদী শিক্ষার প্রতিপূরণ করা যেতে পারে। পারলে মা নিজেও তার সন্তানদেরকে এ ধরনের শিক্ষা দিতে পারেন।
প্রত্যেক মায়ের উচিত বাচ্চাদের স্কুল পাঠ্য সমস্ত টেক্স বই ভালভাবে পড়ে দেখা। এগুলোতে যেসব বিষয় অসত্য, ভুল ও ক্ষতিকারক তা বাচ্চাদেরকে ধরিয়ে দেয়া এবং নিঃসন্দেহ প্রমাণে সেগুলোর অসত্যতা বুঝিয়ে দেয়া ।
বাসগৃহে রক্ষণাবেক্ষনে মায়ের ভূমিকা
মুসলিম মায়েদের উচিত তার সাধ্যের সীমার মধ্যেই বাসগৃহকে আকর্ষণীয় করে তোলা। এ দেশের প্রায় সকল গৃহই, এমনকি মধ্যবিত্তের ঘরবাড়ীও অনেক ক্ষেত্রে অপরিচ্ছন্ন ও নোংরা। অনেক মহিলাই মেঝেতে, বিশেষ করে উঠোন ও রান্না ঘরে ময়লা আবর্জনা ছড়িয়ে রাখেন। তাদের এ একটা খারাপ অভ্যাস যে, তারা ময়লার মধ্যে থাকবেন তবুও নিজ হাতে তা পরিষ্কার করবেন না। ইসলামী শিক্ষা মেয়েদেরকে অবশ্যই পরিচ্ছন্নতা ও নিরমানুবর্তিতা শিখায়। নিজেদের হাতে ঘরদোর ঝাড়ু দিতে কিংব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করতে মুসলিম নারীকে কখনোই লজ্জাবোধ করা উচিত নয় এবং চাকর-চাকরানীদের ওপরও সব সময় এ ব্যাপারে নির্ভরশীল হওয়া ঠিক নয়। যদি সম্পদশালী হন তবে সর্বদা জাঁক-জমক ও অপচয় এড়িয়ে চলতে হবে এবং পশ্চিমা ধাঁচের সোফা, ড্রেসিং টেবিল, খেলোগয়না ইত্যাদি ব্যয় বহুল গৃহসামগ্রী পরিহার করতে হবে। কুরআন ও হাদীসের বাণী সম্বলিত কারুকার্যপূর্ণ ক্যালিগ্রাফী দিয়ে ঘরের দেয়াল সজ্জিত করা যেতে পারে। এতে একদিকে যেমন ঘর সাজানো হবে অন্যদিকে তা সবাইকে স্মরণ করিয়ে দেবে যে, এটা একটি মুসলিম বাসগৃহ। ইসলামী শিক্ষার সাথে সাংঘর্ষিক ধরনের ছবি, পারিবারিক কিংবা বন্ধু-বান্ধবের একক ও গ্রুপ ফটোগ্রাফ ইত্যাদি কিছুতেই ফ্রেমে আটকিয়ে ঘরে টাঙিয়ে রাখা ঠিক নয় ।
ইসলামী শিক্ষা একজন বালিকাকে গৃহকর্মের জন্য অন্তত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার মূল্যনীতি, প্রাথমিক চিকিৎসা এবং মজাদায়ক হলে খানা তৈরির পদ্ধতি শেখায়। অনেক মুসলিম নারীই খাদ্যের পরিপুষ্টি জ্ঞান সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ। তাই প্রয়োজনীয় ও উপযোগী প্রচুর খাদ্য হাতের কাছে থাকতেও তারা তাদের বাচ্চাদেরকে তা খাওয়াতে জানেন না ।
একজন অশিক্ষিত ও উদাসীন মুসলিম নর কিছুতেই কি প্রভাব যা দিবারাত্র তার সন্তানকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে তা প্রতিহত করতে পারেন না। শুধুমাত্র একজন শিক্ষিত, চতুর ও অত্যন্ত আগ্রহশীল মুসলিম নারী মা-ই পারেন বর্তমান প্রতিকুল পরিবেশের সামনে সাহসের সাথে মুখোমুখি হতে।
>>> Welcome, You are now on Mohammadia Foundation's Website. Please stay & Tune with us>>>
মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url