সুদের নৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক কুফল || দারিদ্রতা ও সব ধরণের অশান্তির মূলে আছে সুদ
সুদের নৈতিক ও সামাজিক কুফল
সুদ সমাজ শোষণের সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম
একদল লোক বিনাশ্রমে অন্যের উপার্জনে ভাগ বসায় সুদের সাহায্যেই। ঋণগ্রহীতা যে কারণে টাকা ঋণ নেয় সে কাজে তার লাভ হোক বা না হোক তাকে সুদের অর্থ দিতেই হবে। এর ফলে অনেক সময় ঋণ গ্রহীতাকে স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ বিক্রি করে হ’লেও সুদসহ আসল টাকা পরিশোধ করতে হয়। পরিণামে সে আরও দরিদ্র হয়। সমাজে শ্রেণীবৈষম্য আরও বৃদ্ধি পায়। বস্ত্ততঃ সুদ গ্রহীতারা সমাজের পরগাছা। এরা অন্যের উপার্জন ও সম্পদে ভাগ বসিয়ে জীবনযাপন করে। উপরন্তু বিনাশ্রমে অর্থ লাভের ফলে সমাজের প্রত্যক্ষ অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে এদের কোন অবদান থাকে না।
সুদ মানুষকে স্বার্থপর ও কৃপণ বানায়
অর্থলিপ্সা, কার্পণ্য ও স্বার্থপরতা সুদখোরদের কতিপয় চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। বিনাশ্রমে উপার্জনের আকাঙ্খা ও অর্থলিপ্সা হ’তেই সূদ প্রথার জন্ম। সুদের মাধ্যমে নিশ্চিত ও নির্ধারিত আয় প্রাপ্তির লোভ সুদখোরদের বিচার-বিবেচনা, আবেগ-অনুভূতি এমনকি বিবেককে পর্যন্ত নিঃসাড় করে দেয়। সুদখোরদের মধ্যে লোভ ও স্বার্থপরতা ক্রমে ক্রমে এতদূর প্রসার লাভ করে, তাদের আচার-আচরণের এতখানি পরিবর্তন ঘটে যে, তারা হয়ে ওঠে সমাজের পরিহাসের পাত্র। তাদের প্রবাদতুল্য লোভ, পরের সম্পদ ও বিত্ত গ্রাসের প্রবণতা গল্প-কাহিনীর খোরাক হয়ে ওঠে। ইতিপূর্বে সেসব উদাহরণ তুলে ধরা হয়েছে। যারা সুদ দিতে সক্ষম তাদের জন্য মহাজন ও সুদী ব্যাংকগুলো এগিয়ে আসে ঋণের পসরা নিয়ে। কিন্তু যারা সুদ দিতে অপারগ তাদের পক্ষে ঋণ পাওয়া তো দূরের কথা, অনেক সময়ে মৌখিক সহানুভূতিটুকু পাওয়াও হয়ে ওঠে না।
সুদ শ্রমবিমুখতা ও অলসতা সৃষ্টি করে
সুদভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ব্যাংকে অর্থ জমা রাখলে কোন পরিশ্রম ও ঝুঁকি ছাড়াই সুদের মাধ্যমে নির্ধারিত হারে অর্থ পাওয়া যায়। এই ব্যবস্থা যোগ্যতাসম্পন্ন, প্রতিভাবান ও কর্মঠ লোককেও অকর্মণ্য ও অলস বানিয়ে দেয়। ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্প-কারখানা স্থাপন অর্থাৎ উৎপাদনধর্মী কাজে যে চিন্তা-ভাবনা, পরিকল্পনা, পরিশ্রম ও ঝুঁকি গ্রহণের দরকার সুদভিত্তিক সঞ্চয়কারীরা তা আর করে না। বরং ব্যাংকে সঞ্চিত অর্থ হ’তে বিনাশ্রমে নির্দিষ্ট ও নির্ধারিত হারে আয় পেয়ে তারা পরিতৃপ্ত থাকে। ধীরে ধীরে আলস্য তাদের গ্রাস করে। এভাবে সুদের কারণেই যাদের হাতে অঢেল বিত্ত রয়েছে তাদের শ্রম, মেধা, দক্ষতা ও যোগ্যতার ফসল হ’তে সমাজ বঞ্চিত হয়। সৃষ্টি হয় শ্রমবিমুখতা ও অলসতা। এদেশের সাহি’ত্যে এর ভুরি ভুরি নজীর মিলবে। বাংলাদেশে বিদ্যমান সুদী ব্যবস্থায় কেউ ব্যাংকে দশ লাখ টাকা মেয়াদী জমা রেখে কোন রকম শ্রম, ঝুঁকি বা দুশ্চিন্তা ছাড়াই ঘরে বসে প্রতি মাসে ন্যূনতম দশ হাযার টাকা পেতে পারে।
সুদ সামাজিক প্রয়োজনীয় খাতে বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করে
সকল অর্থনৈতিক কর্মকান্ড, তা উৎপাদনমুখীই হোক আর সেবামূলকই হোক, একই হারে মুনাফা হয় না। কোন কোন ক্ষেত্রে মুনাফার হার সুদের হারের চেয়ে বেশী, কোথাও সমান, আবার কোথাও বা কম। সাধারণভাবে বিলাস সামগ্রী ও সমাজের জন্যে অকল্যাণকর খাতে উৎপাদন ও ব্যবসায়ে মুনাফার হার হয়ে থাকে সর্বোচ্চ। প্রসাধনী ও বিলাস সামগ্রী, সৌখিন দ্রব্য, মদ ও নেশার বস্ত্ত এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। পক্ষান্তরে সমাজের জন্য অত্যাবশ্যকীয় ও কল্যাণকর দ্রব্যসামগ্রী ও সেবার ক্ষেত্রে মুনাফার হার প্রায়শঃই খুব কম হয়ে থাকে। এমনকি তা প্রদেয় সুদের হারের চেয়েও কম হ’তে পারে। ফলে সূদভিত্তিক অর্থনীতিতে যেখানে মুনাফার হার সুদের হারের চেয়ে বেশী সেখানেই বিনিয়োগ হয় সর্বাধিক। অপরদিকে যেসব অত্যাবশ্যকীয় খাতে মুনাফার হার সুদের হারের সমান বা কম সেখানে কোন বিনিয়োগকারী এগিয়ে আসতে আগ্রহী হয় না। কারণ গৃহীত ঋণের সুদ প্রদানের পর উদ্যোক্তার আর কিছু অবশিষ্ট থাকবে না। পরিণামে সামাজিকভাবে কাম্য সেবা ও দ্রব্য সামগ্রীর উৎপাদন ও সরবরাহে সংকোচন ঘটে অনিবার্যভাবেই। অথচ সমাজের বৃহত্তর স্বার্থে এই খাতে বিনিয়োগ সবচেয়ে যরূরী। যদি অর্থনীতিতে সুদ না থাকতো তাহ’লে বিনিয়োগকারীরা (এবং মূলধনের যোগানদারেরাও) প্রাপ্তব্য মুনাফাতেই (তার হার যত কমই হোক না কেন) পুঁজি বিনিয়োগে দ্বিধা করতো না। ফলে সমাজের অপরিহার্য ও কল্যাণকর খাতের সম্প্রসারণ ও কর্মোদ্যোগের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা সম্ভব হ’ত।
সুদ নৈতিক অবক্ষয়ের অন্যতম কারণ
সুদভিত্তিক অর্থনীতিতে নিশ্চিত আয়ের অর্থাৎ অবধারিতভাবে সুদ প্রাপ্তির লোভে অনৈতিক ও অনৈসলামী কাজে মূলধন বিনিয়োজিত হয়। উদাহরণস্বরূপ মদের ব্যবসা, ফটকাবাজারী, মজুতদারী, অনৈতিক ও কুরুচিপূর্ণ গান-বাজনা, সিনেমা, এমনকি পর্ণোগ্রাফির মতো বিষয়ে পুঁজি বিনিয়োগ করা হয়ে থাকে। এসব কাজে যেহেতু মুনাফা অর্জিত হয় তুলনামূলকভাবে অনেক বেশী হারে, সেহেতু প্রদেয় সুদ পরিশোধের পরও বিস্তর মুনাফা থেকে যায় উদ্যোক্তার হাতে। তাই তার পক্ষে চড়া হারেও সুদ পরিশোধ করা আদৌ কঠিন নয়। এই পথ ধরে সমাজে অনৈতিক ও অসামাজিক কাজের প্রসার ঘটে সহজেই। পরিণামে লক্ষ লক্ষ যুবক-যুবতী ও কিশোর-কিশোরীর সহজাত বোধ-বিশ্বাসে চিড় ধরে। ধীরে ধীরে তাদের ঈমানী চেতনার বিলুপ্তি ঘটতে শুরু করে। ক্রমেই মূল্যবোধের ক্ষয় হয় এবং প্রায় অলক্ষ্যেই সমাজে নৈতিক অধঃপতন গভীরভাবে শিকড় গেড়ে বসে। সমাজের অবক্ষয় তথা ধ্বংস হয়ে ওঠে অবশ্যম্ভাবী ও অপ্রতিরোধ্য। বস্ত্ততই মুনাফার হার তুলনামূলকভাবে কম হওয়ার কারণে সমাজ হিতকর ও কল্যাণধর্মী প্রকল্পে বিনিয়োগের জন্যে পুঁজি সংগ্রহ করা বর্তমান সময়ে অতীব দুরূহ কাজ।
সুদ সমাজে ঘৃণা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করে
সুদখোর মহাজন ও পুঁজিপতিরা তাদের প্রদত্ত ঋণের বিনিময়ে হাযার হাযার লোকের কঠোর শ্রমের ফসলে অন্যায্য ভাগ বসায়। শুধু তাই নয়, অনুৎপাদনশীল কাজের জন্য গৃহীত ঋণের বিপরীতে যেহেতু কোন বাড়তি আয়ের সুযোগ নেই সেহেতু এই ঋণ পরিশোধ করতে ঋণগ্রহীতাদের সহায়-সম্পত্তির উপরেও চাপ পড়ে অনিবার্যভাবেই। এমনকি ঋণের দায়ে অনেকের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ক্রোক হয়, পিতৃপুরুষের ভিটেমাটি ওঠে নিলামে। মানুষের আপদকালে দাবীকৃত বাড়তি এই অর্থ অর্থাৎ সুদ তাই স্বভাবতই ঋণ গ্রহীতাদের সংক্ষুব্ধ করে তোলে। মানুষ তাদেরকে বিপদের দিনে দাতা মনে করার পরিবর্তে রক্তচোষা ভ্যাম্পায়ারই মনে করে। এরা হয়ে ওঠে সমাজে ঘৃণার পাত্র।
অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, ইসলামী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বিদ্যমান না থাকায় বাইতুল মাল হ’তে সাহায্য বা করযে হাসানা পাওয়ার কোন সুযোগ না থাকায় সুদভিত্তিক ঋণ নিতে বাধ্য হয় সমস্যাগ্রস্ত অসহায় নারী-পুরুষ। উপরন্তু সুদখোররা গরীব ও অসহায় কৃষকদের জমি-জিরাত ঋণের দায়ে দখল করে, ফসলের সুদ খেয়ে খেয়ে ধীরে ধীরে ফুলে ফেঁপে ওঠে, হয়ে ওঠে বিপুল সম্পদের মালিক। কখনও কখনও এমনও দেখা যায়, গৃহস্থ চাষী, ক্ষুদে খামারের মালিক সুদখোর মহাজনের ঐ জমিতে বর্গাচাষ করতে বাধ্য হচ্ছে একদিন যে জমির মালিক ছিল সে নিজেই। স্বভাবতই তখন তার মনে সৃষ্টি হয় বিদ্বেষ ও অসূয়ার যার পরিণাম ফল মোটেই শুভ নয়।
সুদের কারণেই দরিদ্র আরও দরিদ্র এবং ধনী আরো ধনী হয়
সুদের পরিণামে সামাজিক শ্রেণীবৈষম্য বেড়েই চলে। দরিদ্র অভাবগ্রস্ত মানুষ প্রয়োজনের সময়ে সাহায্যের কোন দরজা খোলা না পেয়ে উপায়ান্তর না দেখে ঋণ নিতে বাধ্য হয়। সেই ঋণ উৎপাদনশীল ও অনুৎপাদনশীল উভয় প্রকার কাজেই ব্যবহৃত হয়ে থাকে। বিশেষ করে অনুৎপাদনশীল কাজে ঋণের অর্থ ব্যবহারের ফলে তার ঋণ পরিশোধের ক্ষমতাই লোপ পায়। পুঁজিবাদী সমাজে করযে হাসানার কোন সুযোগ না থাকায় অনুৎপাদনী খাতে ঋণ তো দূরের কথা, উৎপাদনী খাতেও বিনা সুদে ঋণ মেলে না। বোঝার উপর শাকের অাঁটির মতো তাকে সুদ পরিশোধ করতে হয়। এর ফলে সে তার শেষ সম্বল যা থাকে তাই বিক্রি করে উত্তমর্ণের ঋণ শুধরে থাকে। এই বাড়তি অর্থ পেয়ে উত্তমর্ণ আরো ধনী হয়। অধমর্ণ হয় আরও দরিদ্র। বৃদ্ধি পেতে থাকে সামাজিক শ্রেণীবৈষম্য।
বাংলাদেশে একশ্রেণীর ধনী যে আরও ধনী হচ্ছে তার অন্যতম প্রধান কারণ সুদভিত্তিক ব্যাংক ও বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠানসমূহের ঋণ দানের নীতি ও কৌশল। যোগ্যতা ও আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও দরিদ্র বা মধ্যবিত্ত উদ্যোক্তারা প্রয়োজনীয় জামানত দিতে না পারার কারণে সুদী ব্যাংকগুলো হ’তে ঋণ পায় না, অথচ বিত্তশালী ব্যবসায়ী বা শিল্প উদ্যোক্তারা সহজেই ঋণ পায়। ব্যাংক হাযার হাযার লোকের নিকট থেকে আমানত সংগ্রহ করে থাকে, কিন্তু ঐ অর্থ ঋণ আকারে পায় মুষ্টিমেয় বিত্তশালীরাই। এ থেকে উপার্জিত বিপুল মুনাফা তাদের হাতেই রয়ে যায়। ফলে সঞ্চয়কারী হাযার হাযার লোক তাদের অর্থের প্রাপ্য উচিত আয় থেকে বঞ্চিত হয়। বিত্তশালী উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীরা ব্যাংক ও বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠানসমূহকে যে সুদ পরিশোধ করে তা জনগণের কাছ থেকে সেবা ও দ্রব্যের মূল্যের সাথেই তুলে নেয়। ফলে ব্যাংকের দায় পরিশোধ করেও তাদের মুনাফার কোন কমতি হয় না, পরিণামে ধনীরা আরও ধনী হয়, গরীবরা হয় আরও গরীব। সমাজহিতৈষীরা তাই যতই ‘গরীবী হঠাও’ বলে চিৎকার করুক সুদের মতো এই দৃঢ়মূল, সুকৌশলী ও সর্বব্যাপী শোষণ প্রক্রিয়া বহাল থাকা অবস্থায় দারিদ্র্য দূরীকরণের কোন প্রেসক্রিপশনই কার্যকর হবে না।
সুদের অর্থনৈতিক কুফল
সুদভিত্তিত অর্থব্যবস্থা শোষণের হাতিয়ার। বর্তমানে অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও সামাজিক অস্থিরতার মূলে আছে সুদের কুপ্রভাব। ইসলামে সুদভিত্তিক অর্থব্যবস্থা নিষিদ্ধ। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘হে মুমিনরা, তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সুদের বকেয়া যা আছে তা ছেড়ে দাও, যদি তোমরা মুমিন হও।
’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২৭৮)
সুদের অর্থনৈতিক কুফলগুলো নিম্নরূপ
ধনী-গরিব বৈষম্য: সুদের কারণে সমাজের দরিদ্র শ্রেণি আরো দরিদ্র ও ধনী আরো ধনী হয়। পরিণামে সামাজিক শ্রেণিগত বৈষম্য বেড়েই চলে। দরিদ্র অভাবগ্রস্ত মানুষ সাহায্যের আর কোনো দরজা খোলা না পেয়ে উপায়ান্তর না দেখে ঋণ নিতে বাধ্য হয়। সুদি অর্থনীতিতে পুঁজিপতি ও ব্যাংকাররা অধিক সুদ পাবে—এ লক্ষ্য সামনে রেখে ঋণ দিয়ে থাকে।
সে ঋণ উৎপাদনী ও অনুৎপাদনী দুই ধরনের কাজে ব্যবহৃত হয়। আর অনুৎপাদনশীল কাজে ঋণের অর্থ ব্যবহারের ফলে ঋণ পরিশোধের ক্ষমতা লোপ পায়। বোঝার ওপর শাকের আঁটির মতো সুদ পরিশোধ করতে হয়। এতে সুদখোর ধনীরা আরো ধনী হয়।
সুদ বেকারত্ব বৃদ্ধি করে: সুদি অর্থায়ন ও বিনিয়োগ ব্যবস্থার অনিবার্য ফল হিসেবে আশাঙ্কাজনক হারে বেকারত্ব বৃদ্ধি পায়। এ অবস্থায় পুঁজির মালিক বা ব্যাংক উৎপাদনের কোনো ঝুঁকি বহন করে না এবং সব ঝুঁকি কার্যত উদ্যোক্তার ঘাড়ে চাপে। ফলে নতুন উদ্যোক্তরা শিল্প-কারখানা প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসে না। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে তাল রেখে শিল্প প্রতিষ্ঠা করতে না পারায় বেকারত্বের হার বৃদ্ধি পায়। পাশাপাশি বিরাজমান শিল্পের মধ্যে অনেকগুলো সুদের অত্যাচার সইতে পারে না।
এতে বেকারত্ব আরো বেড়ে যায়। সুদি অর্থনীতিতে পুঁজির প্রান্তিক দক্ষতা যেখানে প্রচলিত সুদের হারের সমান হয়, বিনিয়োগ সেখানে থেমে যায়। ফলে দেশে বিনিয়োগ হলে যে পরিমাণ শ্রমিক কাজ পেত তারা বেকার থেকে যায়। তাই সুদ বেকারত্ব সৃষ্টি করে শ্রমিকদের আয়হীন করে রাখে। সুদ মজুরি বৃদ্ধির অন্যতম প্রতিবন্ধক।
সুদ সঞ্চয় বাড়ায় না: কেইনসের মতে, উচ্চতর সুদের হার প্রকৃত সঞ্চয়কে অবশ্যই কমিয়ে দেয়। কারণ মোট সঞ্চয় নিয়ন্ত্রিত হয় মোট বিনিয়োগ দ্বারা, সুদের হার বাড়লে বিনিয়োগ হ্রাস পায়। সুদ বৃদ্ধি পেলে তা অবশ্যই আয় কমিয়ে দেবে। এতে বিনিয়োগ যতটা কমবে, সঞ্চয় ততটা হ্রাস পাবে। সুদের কারণে বিভিন্ন উৎপাদন ও আয়-হ্রাস পায়। অনেকে দেউলিয়া হয় আর বহু লোক কর্মহারা ও বেকার হয়ে পড়ে। ফলে সঞ্চয় ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়।
সুদ বিনিয়োগ কমিয়ে দেয়: সুদের হার বেড়ে গেলে বিনিয়োগকারীরা ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করাকে কম লাভজনক মনে করে এবং ঋণ কম নেয়। ফলে বিনিয়োগ কমে যায়। বিশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ লর্ড কেইনসের মতে, বিনিয়োগ নির্ধারিত হয় সুদের হার ও মূলধনের প্রান্তিক দক্ষতার পারস্পরিক সম্পর্কের মাধ্যমে। তাঁর মতে, সুদের হার মূলধনের প্রান্তিক দক্ষতার সমান হলে কাম্য বিনিয়োগ হবে। সুদের হার কমলে বিনিয়োগ বাড়ে। এভাবে সুদের হার কমে শূন্য হলে বিনিয়োগ সর্বাধিক হবে। সুতরাং সুদভিত্তিক অর্থনীতিতে বিনিয়োগ কম হয়। বিশেষ করে সুদ ক্ষুদ্র বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করে। সুদ উৎপাদনে বাধা সৃষ্টি করে। সুদের হার উৎপাদনকে সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছতে দেয় না।
সুদি অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ কম হয়। ব্যাংকার ও পুঁজিপতিরা বেশি পুঁজি দীর্ঘকাল ধরে আটক রাখতে আগ্রহী নয় বলে বড় বড় ব্যয়বহুল শিল্প কারখানায় বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হয়। আবার বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ঋণ সুদের ভিত্তিতে নেওয়া হলে প্রতিবছর বিরাট অঙ্কের সুদের বোঝা বহন করতে হয়। ফলে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ কমে যায়।
সুদি ব্যবস্থা সাধারণত অস্থির ও অনিশ্চিত। অত্যধিক ঝুঁকি থাকার কারণে বিনিয়োগকারীরা সুদি ঋণের ভিত্তিতে ব্যয়বহুল শিল্প কারখানায় বিনিয়োগ করতে অনীহা প্রদর্শন করে।
সুদের কারণে বরাদ্দ দক্ষতাপূর্ণ হয় না: সুদ পুঁজির দক্ষতাপূর্ণ বরাদ্দে বাধা সৃষ্টি করে। সুদি ব্যাংকগুলো ঋণ বরাদ্দের ক্ষেত্রে কারবারের দক্ষতা, উৎপাদনশীলতা ও লাভজনীনতার চেয়ে সুদসহ আসল ফেরত পাওয়ার নিশ্চয়তার ওপরই বেশি গুরুত্ব আরোপ করে থাকে। সুদি ব্যাংকাররা সুদ ফেরত পাওয়ার নিশ্চয়তা তথা যথার্থ সিকিউরিটি, মর্টগেজ পেলেই ঋণ বরাদ্দ ও মঞ্জুর করে।
সুদ ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস করে: সুদি অর্থনীতি মুদ্রাস্ফীতি সৃষ্টি করে বলে দ্রব্যমূল্য স্তর অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। বিশ্বে বারবার মন্দা ও মহামন্দার মূল কারণ হলো সুদ। কেইনস তাই সুদপ্রথা বিলুপ্ত করে শূন্য সুদের হার চালু করার প্রস্তাব করেছেন। কেইনসের এই প্রস্তাব কেউ আমলে নেয়নি। ১৯৯৭-৯৮ সালের এশীয় আর্থিক সংকটে এ অঞ্চল ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ১৯৯৭ সালের জুলাই মাসে থাইল্যান্ডের মুদ্রা থাই বাথ-এর মূল্য পতনের মাধ্যমে বিপর্যয়ের সূচনা হয় এবং এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। বিপর্যয়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া ও থাইল্যান্ড। হংকং, মালয়েশিয়া, লাওস ও ফিলিপাইনও বেশ ক্ষতির সম্মুখীন হয় ২০০৭-২০১০ সালে আবারও মন্দা সৃষ্টি হয়। এ মন্দা হচ্ছে সুদেরই পরিণতি।
পরিশেষে সুদ মানুষকে প্রকৃত অর্থনৈতিক কার্যকলাপ থেকে ফিরিয়ে রাখে। এতে তার কর্মক্ষমতা হ্রাস পায়। এটা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও প্রচেষ্টার লক্ষ্য ঘুরিয়ে দেয়। ফলে প্রকৃত পণ্যসামগ্রী ও সেবা জোগানের পরিবর্তে অর্থ দিয়ে অর্থ লাভ করার লক্ষ্যে যাবতীয় প্রচেষ্টা পরিচালিত হয়।
💖💝Thanks for being with Mohammadia Foundation. Pls Stay with us always💝💖
মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url