বিষয় ভিত্তিক আয়াত (পর্ব -১৫) || আল কুরআনে মানব সৃষ্টির রহস্য ||


মানব সৃষ্টির রহস্য

আল্লাহ মানুষকে কেন সৃষ্টি করেছেন? তিনি কিভাবে মানুষকে সৃষ্টি করেছেন? মানব সৃষ্টির পিছনে কি তার রহস্য? পবিত্র কুরআন পাকে কমপক্ষে ৮২টি আয়াতে আল্লাহ পাক তাঁর শ্রেষ্ট সৃষ্টি মানব সৃষ্টির রহস্য উম্মোচন করেছেন। আমরা ধারাবাহিকভাবে “মানব সৃষ্টির রহস্য” নিয়ে এখানে প্রতিটি আয়াতের বাংলা ও ইংরেজি অর্থ এবং এর ব্যাখ্যা বা তাফসীর নিয়ে আলোচনা করবো। আশা করি, সবার ভাল লাগবে ইন শা আল্লাহ।

সূরা আল মুমিনুন, আয়াতঃ ১২-১৬

২৩:১২ وَ لَقَدۡ خَلَقۡنَا الۡاِنۡسَانَ مِنۡ سُلٰلَۃٍ مِّنۡ طِیۡنٍ
২৩:১৩ ثُمَّ جَعَلۡنٰهُ نُطۡفَۃً فِیۡ قَرَارٍ مَّکِیۡنٍ
২৩:১৪ ثُمَّ خَلَقۡنَا النُّطۡفَۃَ عَلَقَۃً فَخَلَقۡنَا الۡعَلَقَۃَ مُضۡغَۃً فَخَلَقۡنَا الۡمُضۡغَۃَ عِظٰمًا فَکَسَوۡنَا الۡعِظٰمَ لَحۡمًا ٭ ثُمَّ اَنۡشَاۡنٰهُ خَلۡقًا اٰخَرَ ؕ فَتَبٰرَکَ اللّٰهُ اَحۡسَنُ الۡخٰلِقِیۡنَ 
২৩:১৫ ثُمَّ اِنَّکُمۡ بَعۡدَ ذٰلِکَ لَمَیِّتُوۡنَ
২৩:১৬ ثُمَّ اِنَّکُمۡ یَوۡمَ الۡقِیٰمَۃِ تُبۡعَثُوۡنَ

সূরা আল মুমিনুন আয়াতঃ ১২-১৬ এর বাংলা অনুবাদ

১২. আর অবশ্যই আমি মানুষকে মাটির নির্যাস থেকে সৃষ্টি করেছি। 
১৩. তারপর আমি তাকে শুক্ররূপে সংরক্ষিত আধারে স্থাপন করেছি। 
১৪. তারপর শুক্রকে আমি ‘আলাকায় পরিণত করি। তারপর ‘আলাকাকে গোশতপিন্ডে পরিণত করি। তারপর গোশতপিন্ডকে হাড়ে পরিণত করি। তারপর হাড়কে গোশ্ত দিয়ে আবৃত করি। অতঃপর তাকে অন্য এক সৃষ্টিরূপে গড়ে তুলি। অতএব সর্বোত্তম স্রষ্টা আল্লাহ কত বরকতময়!
১৫. এরপর অবশ্যই তোমরা মরবে। 
১৬ তারপর কিয়ামতের দিন অবশ্যই তোমরা পুনরুত্থিত হবে।
আল-বায়ান

12. And certainly did We create man from an extract of clay. 
13. Then We placed him as a sperm-drop in a firm lodging.
14. Then We made the sperm-drop into a clinging clot, and We made the clot into a lump [of flesh], and We made [from] the lump, bones, and We covered the bones with flesh; then We developed him into another creation. So blessed is Allah, the best of creators. 
15. Then indeed, after that you are to die.
16. Then indeed you, on the Day of Resurrection, will be resurrected.
Sahih International

১২. আর অবশ্যই আমরা মানুষকে সৃষ্টি করেছি মাটির উপাদান থেকে(১),

(১) سلالة শব্দের অর্থ সারাংশ এবং طين অর্থ আদ্ৰ মাটি। [কুরতুবী] অর্থ এই যে, পৃথিবীর মাটির বিশেষ অংশ বের করে তা দ্বারা মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে। [দেখুন, কুরতুবী] মানব সৃষ্টির সূচনা আদম আলাইহিস সালাম থেকে এবং তার সৃষ্টি মাটির সারাংশ থেকে হয়েছে। তাই প্রথম সৃষ্টিকে মাটির সাথে সম্বন্ধযুক্ত করা হয়েছে। এরপর এক মানুষের শুক্র অন্য মানুষের সৃষ্টির কারণ হয়েছে। পরবর্তী আয়াতে (ثُمَّ جَعَلْنَاهُ نُطْفَةً) “তারপর আমরা তাকে করে দিয়েছি বীৰ্য” বলে এ কথাই বৰ্ণনা করা হয়েছে। উদ্দেশ্য এই যে, প্রাথমিক সৃষ্টি মাটি দ্বারা হয়েছে, এরপর আদম সন্তানদের সৃষ্টিধারা এই মাটির সূক্ষ্ম অংশ অর্থাৎ শুক্র দ্বারা চালু করা হয়েছে। অধিকাংশ তফসীরবিদগণ আয়াতের এ তফসীরই লিখেছেন। [দেখুন, কুরতুবী] মুজাহিদ বলেন, এখানে (سُلَالَةٍ مِنْ طِينٍ) বলে মানুষের শুক্রই বোঝানো হয়েছে। তখন অর্থ হবে, পরিষ্কার নিংড়ানো পানি হতে তৈরী করেছি। ইবন আব্বাস থেকেও এ অর্থ বর্ণিত আছে। ইবন কাসীর]

১৩. তারপর আমরা তাকে শুক্রবিন্দুরূপে স্থাপন করি এক নিরাপদ ভাণ্ডারে;

১৪. পরে আমরা শুক্রবিন্দুকে পরিণত করি আলাকা-তে, অতঃপর ‘আলাকা-কে পরিণত করি গোশতপিণ্ডে, অতঃপর গোশতপিণ্ডকে পরিণত করি অস্থিতে; অতঃপর অস্থিকে ঢেকে দেই গোশত দিয়ে; তারপর তাকে গড়ে তুলি অন্য এক সৃষ্টিরূপে।(১) অতএব (দেখে নিন) সর্বোত্তম স্রষ্টা(২) আল্লাহ কত বরকতময়!(৩)

(১) আলোচ্য আয়াতসমূহে মানব সৃষ্টির সাতটি স্তর উল্লেখ করা হয়েছে। সর্বপ্রথম স্তর মৃত্তিকার সারাংশ, দ্বিতীয় বীর্য, তৃতীয় জমাট রক্ত, চতুর্থ মাংসপিণ্ড, পঞ্চম অস্থি-পিঞ্জর, ষষ্ঠ অস্থিকে মাংস দ্বারা আবৃতকরণ ও সপ্তম সৃষ্টিটির পূর্ণত্ব অর্থাৎ রূহ সঞ্চারকরণ। আল্লাহ্ তা'আলা কুরআনে এ শেষোক্ত স্তরকে এক বিশেষ ও স্বতন্ত্র ভঙ্গিতে বর্ণনা করে বলেছেনঃ “তারপর আমরা তাকে এক বিশেষ ধরনের সৃষ্টি দান করেছি।” এই বিশেষ বর্ণনার কারণ এই যে, প্রথমোক্ত ছয় স্তরে সে পূর্ণত্ব লাভ করেনি। শেষ স্তরে এসে সে সম্পূর্ণ এক মানুষে পরিণত হয়েছে। এ কথাই বিভিন্ন তাফসীরকারকগণ বলেছেন। তারা বলেন, এ স্তরে এসে তার মধ্যে আল্লাহ তা'আলা রূহ সঞ্চার করিয়েছেন। [দেখুন, ইবন কাসীর] কোন কোন মুফাস্‌সির বলেন, “তারপর আমরা তাকে এক বিশেষ ধরনের সৃষ্টি দান করেছি।” এর অর্থ তাকে এক স্তর থেকে অন্য স্তরে নিয়ে গেছি। প্রথমে শিশু, তারপর ছোট, তারপর কৈশোর, তারপর যুবক, তারপর পূর্ণবয়স্ক, তারপর বৃদ্ধ, তারপর অতি বয়স্ক। বস্তুত দুটি অর্থের মধ্যে বিরোধ নেই। কারণ, রূহ ফুঁকে দেয়ার পর এসবই সংঘটিত হয়। [ইবন কাসীর]

(২) خالق এর আসল অর্থ নুতনভাবে কোন সাবেক নমুনা ছাড়া কোন কিছু সৃষ্টি করা যা আল্লাহ্ তা'আলারই বিশেষ গুণ। এই অর্থের দিক দিয়ে خالق একমাত্র আল্লাহ তা'আলা-ই। কিন্তু মাঝে মাঝে خلق ও تخليق শব্দ কারিগরীর অর্থেও ব্যবহার করা হয়। কারিগরীর স্বরূপ এর বেশী কিছু নয় যে, আল্লাহ তা’আলা স্বীয় কুদরাত দ্বারা এই বিশ্বে যেসব উপকরণ ও উপাদান সৃষ্টি করে রেখেছেন, সেগুলোকে জোড়াতালি দিয়ে পরস্পরে মিশ্রণ করে এক নতুন জিনিস তৈরী করা। একাজ কারও কারও দ্বারা হওয়া সম্ভব। তখন এর অর্থ হবে, উদ্ভাবন করা, আকৃতি প্রদান করা, গঠন করা ইত্যাদি।

এ অর্থেই কুরআনের অন্যত্র ইবরাহীম আলাইহিস সালামের মুখে এসেছে, (إِنَّمَا تَعْبُدُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ أَوْثَانًا وَتَخْلُقُونَ إِفْكًا) “তোমরা তো আল্লাহ্‌ ছাড়া শুধু মূর্তিপূজা করছ এবং মিথ্যা উদ্ভাবন করছ।” [সূরা আল-আনকাবূতঃ ১৭] অনুরূপভাবে ঈসা আলাইহিস সালামও বলেছেনঃ (أَنِّي أَخْلُقُ لَكُمْ مِنَ الطِّينِ كَهَيْئَةِ الطَّيْرِ فَأَنْفُخُ فِيهِ فَيَكُونُ طَيْرًا بِإِذْنِ اللَّهِ) ‘আমি তোমাদের জন্য কর্দম দ্বারা একটি পাখিসদৃশ আকৃতি গঠন করব; তারপর ওটাতে আমি ফুঁ দেব; ফলে আল্লাহর হুকুমে ওটা পাখি হয়ে যাবে।’ [সূরা আলে ইমরানঃ ৪৯] তাছাড়া আল্লাহ্ তা'আলা নিজেও ঈসা আলাইহিস সালামকে তার উপর কৃত নেয়ামতসমূহ স্মরণ করিয়ে দিতে বলেনঃ (وَإِذْ تَخْلُقُ مِنَ الطِّينِ كَهَيْئَةِ الطَّيْرِ بِإِذْنِي فَتَنْفُخُ فِيهَا فَتَكُونُ طَيْرًا بِإِذْنِي) “আপনি কাদামাটি দিয়ে আমার অনুমতিক্রমে পাখির মত আকৃতি গঠন করতেন এবং ওটাতে ফুক দিতেন, ফলে আমার অনুমতিক্রমে ওটা পাখি হয়ে যেত।” [সূরা আল মায়েদাহঃ ১১০] এসব ক্ষেত্রে خلق শব্দ কারিগরীর অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে সৃষ্টির অর্থে নয়। [দেখুন, বাগভী; কুরতুবী]

(৩) মূলে تبارك শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এর এক অর্থ তিনি প্রশংসা ও সম্মানের অধিকারী। অথবা এর অর্থ, তাঁর কল্যাণ ও বরকত বৃদ্ধি পেয়েছে। [ফাতহুল কাদীর]

১৫. এরপর তোমরা নিশ্চয় মরবে,

১৬. তারপর কেয়ামতের দিন নিশ্চয় তোমাদেরকে উত্থিত করা হবে।(১)

(১) পূর্ববর্তী ১২-১৪ নং আয়াতে সৃষ্টির প্রাথমিক স্তর উল্লেখ করা হয়েছিল, এখন ১৫ ও ১৬ আয়াতে তার শেষ পরিণতির কথা বলা হয়েছে। বলা হচ্ছেঃ তোমরা সবাই এ জগতে আসা ও বসবাস করার পর মৃত্যুর সম্মুখীন হবে। কেউ এর কবল থেকে রক্ষা পাবে না। মৃত্যুর পর আবার কেয়ামতের দিন তোমাদেরকে জীবিত করে পুনরুখিত করা হবে, যাতে তোমাদের ক্রিয়াকর্মের ভাল কিংবা মন্দের হিসাবান্তে তোমাদেরকে আসল ঠিকানা জান্নাত অথবা জাহান্নামে পৌছে দেয়া হয়। [দেখুন: ইবন কাসীর] এ হচ্ছে মানুষের শেষ পরিণতি।
তাফসীরে জাকারিয়া

সূরা ত্ব-হা, আয়াতঃ ৫৫

২০:৫৫ مِنۡهَا خَلَقۡنٰکُمۡ وَ فِیۡهَا نُعِیۡدُکُمۡ وَ مِنۡهَا نُخۡرِجُکُمۡ تَارَۃً اُخۡرٰی

সূরা ত্ব-হা আয়াতঃ ৫৫এর বাংলা অনুবাদ

৫৫. মাটি থেকেই আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি, মাটিতেই আমি তোমাদেরকে ফিরিয়ে নেব এবং মাটি থেকেই তোমাদেরকে পুনরায় বের করে আনব। 
আল-বায়ান

55. From the earth We created you, and into it We will return you, and from it We will extract you another time. 
Sahih International

৫৫. আমরা মাটি থেকে(১) তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি, তাতেই তোমাদেরকে ফিরিয়ে দেব এবং তা থেকেই পুনর্বার তোমাদেরকে বের করব।(২)

(১) منها শব্দের সর্বনাম দ্বারা মাটি বোঝানো হয়েছে। অর্থ এই যে, আমি তোমাদেরকে মাটি দ্বারা সৃষ্টি করেছি। কারণ মানুষের মূল এবং সবার পিতা হলেন আদম ‘আলাইহিস সালাম তিনি মাটি থেকে সৃষ্টি হয়েছেন। [ইবন কাসীর]

(২) অর্থাৎ প্রত্যেক ব্যক্তিকে অনিবাৰ্যভাবে তিনটি পর্যায় অতিক্রম করতে হবে। একটি পর্যায় হচ্ছে, বর্তমান জগতে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত, দ্বিতীয় পর্যয়টি মৃত্যু থেকে কেয়ামত পর্যন্ত এবং তৃতীয়টি হচ্ছে কিয়ামতের দিন পুনর্বার জীবিত হবার পরের পর্যায়। এই আয়াতের দৃষ্টিতে এ তিনটি পর্যায়ই অতিক্রান্ত হবে এ যমীনের উপর। যমীন থেকে তাদের শুরু। তারপর মৃত্যুর পর যমীনেই তাদের ঠাঁই। আর যখন সময় হবে তখন এখান থেকেই তাদেরকে পুনরুত্থান ঘটানো হবে। [ইবন কাসীর] আল্লাহ বলেন, “যেদিন তিনি তোমাদেরকে ডাকবেন এবং তোমরা তার প্রশংসার সাথে তার ডাকে সাড়া দেবে এবং তোমরা মনে করবে, তোমরা অল্পকালই অবস্থান করেছিলো।” [সূরা আল-ইসরা: ৫২]

আলোচ্য আয়াতটি অন্য একটি আয়াতের মত, যেখানে বলা হয়েছে, “তিনি বললেন, সেখানেই তোমরা জীবন যাপন করবে এবং সেখানেই তোমরা মারা যাবে। আর সেখান থেকেই তোমাদেরকে বের করা হবে।” [সূরা আল-আ’রাফ: ২৫]
তাফসীরে জাকারিয়া


***********************************************
>>> Welcome, You are now on Mohammadia Foundation's Website. Please stay & Tune with us>>>

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url