আল কুরআনে মানব সৃষ্টির রহস্য-



মানব সৃষ্টির রহস্য-৭

আল্লাহ মানুষকে কেন সৃষ্টি করেছেন? তিনি কিভাবে মানুষকে সৃষ্টি করেছেন? মানব সৃষ্টির পিছনে কি তার রহস্য? পবিত্র কুরআন পাকে কমপক্ষে ৮২টি আয়াতে আল্লাহ পাক তাঁর শ্রেষ্ট সৃষ্টি মানব সৃষ্টির রহস্য উম্মোচন করেছেন। আমরা ধারাবাহিকভাবেমানব সৃষ্টির রহস্যনিয়ে এখানে প্রতিটি আয়াতের বাংলা ইংরেজি অর্থ এবং এর ব্যাখ্যা বা তাফসীর নিয়ে আলোচনা করবো। জ্ঞানীদের জন্য এসব আয়াতে রয়েছে আল্লাহ পাকের নির্দশন ইন শা আল্লাহ।

২৬. আর অবশ্যই আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি শুকনো ঠনঠনে, কালচে কাদামাটি থেকে। 
২৭. আর ইতঃপূর্বে জিনকে সৃষ্টি করেছি উত্তপ্ত অগ্নিশিখা থেকে। 
২৮. আর স্মরণ কর, যখন তোমার রব ফেরেশতাদের বললেন, ‘আমি একজন মানুষ সৃষ্টি করতে যাচ্ছি শুকনো ঠনঠনে কালচে মাটি থেকে’।
২৯. ‘অতএব যখন আমি তাকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দেব এবং তার মধ্যে আমার রূহ ফুঁকে দেব, তখন তোমরা তার জন্য সিজদাবনত হও’। 
৩০. অতঃপর, ফেরেশতারা সকলেই সিজদা করল।
৩১. ইবলীস ছাড়া। সে সিজদাকারীদের সঙ্গী হতে অস্বীকার করল।
৩২. তিনি বললেন, ‘হে ইবলীস, তোমার কী হল যে, তুমি সিজদাকারীদের সঙ্গী হলে না’?
৩৩. সে বলল, ‘আমি তো এমন নই যে, একজন মানুষকে আমি সিজদা করব, যাকে আপনি সৃষ্টি করেছেন শুকনো ঠনঠনে কালচে মাটি থেকে’। 
৩৪. তিনি বললেন, ‘তাহলে তুমি এখান থেকে বেরিয়ে যাও, তুমি বিতাড়িত’। 
৩৫. ‘আর নিশ্চয় কিয়ামত দিবস পর্যন্ত তোমার উপর লা‘নত’। 
৩৬. সে বলল, ‘হে আমার রব, তাহলে আমাকে অবকাশ দিন সে দিন পর্যন্ত, যেদিন তাদেরকে পুনরুজ্জীবিত করা হবে’।
৩৭. তিনি বললেন, ‘তুমি নিশ্চয় অবকাশপ্রাপ্তদের একজন’।
৩৮. ‘নির্ধারিত সময়ের দিন পর্যন্ত’। 
৩৯. সে বলল, ‘হে আমার রব, যেহেতু আপনি আমাকে পথভ্রষ্ট করেছেন, তাই যমীনে আমি তাদের জন্য (পাপকে) শোভিত করব এবং নিশ্চয় তাদের সকলকে পথভ্রষ্ট করব’। 
৪০. তাদের মধ্য থেকে আপনার একান্ত বান্দাগণ ছাড়া।
৪১. তিনি বললেন, ‘এটা আমার দিকে আনয়নকারী সরল পথ’।
৪২. ‘নিশ্চয় আমার বান্দাদের উপর তোমার কোন ক্ষমতা নেই, তবে পথভ্রষ্টরা ছাড়া যারা তোমাকে অনুসরণ করেছে’।
আল-বায়ান

26. And We did certainly create man out of clay from an altered black mud. 
27. And the jinn We created before from scorching fire. 
28. And [mention, O Muhammad], when your Lord said to the angels, "I will create a human being out of clay from an altered black mud. 
29. And when I have proportioned him and breathed into him of My [created] soul, then fall down to him in prostration."
30. So the angels prostrated - all of them entirely, 
 31. Except Iblees, he refused to be with those who prostrated.
32. [Allah] said, O Iblees, what is [the matter] with you that you are not with those who prostrate?"
33. He said, "Never would I prostrate to a human whom You created out of clay from an altered black mud."
34. [Allah] said, "Then get out of it, for indeed, you are expelled. 
35. And indeed, upon you is the curse until the Day of Recompense."
36. He said, "My Lord, then reprieve me until the Day they are resurrected." 
37. [Allah] said, "So indeed, you are of those reprieved 
38. Until the Day of the time well-known."
39. [Iblees] said, "My Lord, because You have put me in error, I will surely make [disobedience] attractive to them on earth, and I will mislead them all
40. Except, among them, Your chosen servants." 
41. [Allah] said, "This is a path [of return] to Me [that is] straight.
42. Indeed, My servants - no authority will you have over them, except those who follow you of the deviators. 
Sahih International

২৬. আর অবশ্যই আমরা মানুষ সৃষ্টি করেছি গন্ধযুক্ত কাদার শুষ্ক ঠনঠনে কালচে মাটি হতে,(১)

(১) মানুষের আদি উৎস সম্পর্কে কুরআন বলছে, সরাসরি মৃত্তিকার উপাদান থেকে তার সৃষ্টিকর্ম শুরু হয়। (صَلْصَالٍ مِنْ حَمَإٍ مَسْنُونٍ) “শুকনো কালো ঠনঠনে পচা মাটি” শব্দাবলীর মাধ্যমে একথা ব্যক্ত করা হয়েছে। حمأ বলতে আরবী ভাষায় এমন ধরনের কালো কাদা মাটিকে বুঝায় যার মধ্যে দুর্গন্ধ সৃষ্টি হয়ে গেছে, যাকে আমরা নিজেদের ভাষায় পংক বা পাঁক বলে থাকি অথবা অন্য কথায় বলা যায়, যা মাটির গোলা বা মন্ড হয়ে গেছে। [সা'দী] مَسْنُون শব্দের দুই অর্থ হয়। একটি অর্থ, পরিবর্তিত, অর্থাৎ এমন পচা, যার মধ্যে পচন ধরার ফলে চকচকে ও তেলতেলে ভাব সৃষ্টি হয়ে গেছে। [সা'দী] আর দ্বিতীয় অর্থ, চিত্রিত। অর্থাৎ যা একটি নির্দিষ্ট আকৃতি ও কাঠামোতে রুপান্তরিত হয়েছে। [ফাতহুল কাদীর] صَلْصَال বলা হয় এমন পচা কাদাকে যা শুকিয়ে যাওয়ার পর ঠনঠন করে বাজে। [এর জন্য আরও দেখুন, বাগভী; কুরতুবী ইবন কাসীর] এ শব্দাবলী থেকে পরিষ্কার জানা যাচ্ছে যে, গাজানো কাদা মাটির গোলা বা মন্ড থেকে প্রথমে প্রথম মানুষকে বানানো হয় এবং তা তৈরী হবার পর যখন শুকিয়ে যায় তখন তার মধ্যে প্রাণ ফুঁকে দেয়া হয়।

২৭. আর এর আগে আমরা সৃষ্টি করেছি জিনদেরকে অতি উষ্ণ(১) নির্ধুম আগুন থেকে।

(১) سموم বলা হয় গরম বাতাসকে। [বাগভী] আর আগুনকে সামুমের সাথে সংযুক্ত করার ফলে এর অর্থ হয় আগুনের প্রখর উত্তাপ। [সা’দী] কুরআনের যেসব জায়গায় জিনকে আগুন থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে এ আয়াত থেকে তার সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা হয়ে যায়।

২৮. আর স্মরণ করুন, যখন আপনার রব ফেরেশতাদেরকে বললেন, নিশ্চয় আমি গন্ধযুক্ত কাদার শুষ্ক ঠনঠনে কালচে মাটি হতে মানুষ সৃষ্টি করতে যাচ্ছি; 

২৯. অতঃপর যখন আমি তাকে সুঠাম করব এবং তাতে আমার পক্ষ থেকে রূহ সঞ্চার করব(১) তখন তোমরা তার প্রতি সিজদাবনত হয়ো,(২)

(১) এ থেকে জানা যায়, মানুষের মধ্যে যে রূহ ফুকে দেয়া হয় অর্থাৎ প্রাণ সঞ্চার করা হয় তা মূলতঃ আল্লাহর সৃষ্টিকৃত রুহ বা নির্দেশ বিশেষ। এ সম্পর্কটি সম্মানের জন্য করা হয়েছে। নতুবা আল্লাহর কোন অংশ সৃষ্টির কারো কাছে নেই। [ফাতহুল কাদীর] মূলত: সৃষ্টির মধ্যে যেসব গুণের সন্ধান পাওয়া যায় তার প্রত্যেকটিরই উৎস ও উৎপত্তিস্থল আল্লাহরই কোন না কোন গুণ। যেমন হাদীসে বলা হয়েছেঃ “মহান আল্লাহ রহমতকে একশো ভাগে বিভক্ত করেছেন। তারপর এর মধ্য থেকে ৯৯ টি অংশ নিজের কাছে রেখে দিয়েছেন এবং মাত্র একটি অংশ পৃথিবীতে অবতীর্ণ করেছেন। এই একটি মাত্র অংশের বরকতেই সমুদয় সৃষ্টি পরস্পরের প্রতি অনুগ্রহশীল হয়। এমনকি যদি একটি প্রাণী তার নিজের সন্তান যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় এ জন্য তার ওপর থেকে নিজের নখর উঠিয়ে নেয় তাহলে এটিও আসলে এ রহমত গুণের প্রভাবেরই ফলশ্রুতি।” [বুখারী ৬০০০, মুসলিমঃ ২৭৫২]

(২) এ সিজদা কোন ইবাদতের সিজদা ছিল না বরং সম্মানসূচক ছিল। [বাগভী; ফাতহুল কাদীর] যেমনটি আমাদের সালামের বেলায় হয়ে থাকে। যার প্রকৃত স্বরূপ কেমন ছিল তা আমরা জানি না। [আল-মানার]

৩০. অতঃপর ফেরেশতাগণ সবাই একত্রে সিজদা করল,

৩১. ইবলীস ছাড়া, সে সিজদাকারীদের অন্তর্ভুক্ত হতে অস্বীকার করল।

৩২. আল্লাহ বললেন, হে ইবলীস! তোমার কি হল যে, তুমি সিজদাকারীদের অন্তর্ভুক্ত হলে না? 

৩৩. সে বলল, আপনি গন্ধযুক্ত কাদার শুষ্ক ঠনঠনে কালচে মাটি হতে যে মানুষ সৃষ্টি করেছেন আমি তাকে সিজদা করার করার নই।

৩৪. তিনি বললেন, তবে তুমি এখান থেকে বের হয়ে যাও, কারণ নিশ্চয় তুমি বিতাড়িত; 

৩৫. আর নিশ্চয় প্রতিদান দিবস পর্যন্ত তোমার প্রতি রইল লা'নত।

৩৬. সে বলল, হে আমার রব! যেদিন তাদের পুনরুত্থান করা হবে সেদিন পর্যন্ত আমাকে অবকাশ দিন।

৩৭. তিনি বললেন, নিশ্চয় তুমি অবকাশপ্রাপ্তদের একজন,

৩৮. সুনির্দিষ্ট সময় আসার দিন পর্যন্ত।

৩৯. সে বলল, হে আমার রব! আপনি যে আমাকে বিপথগামী করলেন সে জন্য অবশ্যই আমি যমীনে মানুষের কাছে পাপকাজকে শোভন করে তুলব এবং অবশ্যই আমি তাদের সবাইকে বিপথগামী করব।(১)

(১) অর্থাৎ যেভাবে তুমি এ নগণ্য ও হীন সৃষ্টিকে সিজদা করার হুকুম দিয়ে আমাকে আপনার হুকুম অমান্য করতে বাধ্য করেছে ঠিক তেমনিভাবে এ মানুষদের জন্য আমি দুনিয়াকে এমন চিত্তাকর্ষক ও মনোমুগ্ধকর জিনিসে পরিণত করে দেবো যার ফলে তারা সবাই এর দ্বারা প্রতারিত হয়ে আপনার নাফরমানী করতে থাকবে, আখেরাতের জবাবদিহির কথা ভুলে যাবে। অথবা আয়াতের অর্থ, নাফরমানকে তাদের কাছে এমন চিত্তাকর্ষক করে তুলব যে, তারা আপনার নির্দেশ ভুলে যাবে। [ফাতহুল কাদীর] ইবলীসের এ ঘোষণা কুরআনের অন্যান্য স্থানেও এসেছে। [যেমন, সূরা আল-আরাফঃ ১৬–১৭, সূরা আন-নিসাঃ ১১৮, সূরা আল-ইসরাঃ ১৬২] শয়তান তার এ সমস্ত দাবীকে অনেকটাই সত্যে পরিণত করে দেখিয়েছে। আল্লাহ বলেনঃ “তাদের সম্বন্ধে ইবলীস তার ধারণা সত্য প্রমাণ করল, ফলে তাদের মধ্যে একটি মু'মিন দল ছাড়া সবাই তার অনুসরণ করল।” [সূরা সাবাঃ ২০]

৪০. তবে তাদের মধ্যে আপনার একনিষ্ঠ বান্দাগণ ছাড়া।(১)

(১) এ বাক্যের দু'টি অর্থ হতে পারে। একটি অর্থ, তোমার জোর খাটবে শুধুমাত্র এমন বিপথগামীদের ওপর যারা তোমাকে অনুসরণ করবে। আমার সত্যিকার বান্দাদের উপর তোমার কোন জোর খাটবে না। আর দ্বিতীয় অর্থটি হচ্ছে, যারা ইখলাসের সাথে ইবাদাত করবে, অন্য কোন দিকে তাকাবে না, তাদের উপর তোমার কোন প্রভাব কাজ করবে না। [ফাতহুল কাদীর]

৪১. আল্লাহ বললেন, এটাই আমার কাছে পৌছার সরল পথ।

৪২. বিভ্রান্তদের মধ্যে যে তোমার অনুসরণ করবে সে ছাড়া আমার বান্দাদের উপর তোমার কোনই ক্ষমতা থাকবে না।(১);

(১) এ আয়াত থেকে জানা যায় যে, আল্লাহ্ তা'আলার মনোনীত বান্দাদের উপর শয়তানী কারসাজির প্রভাব পড়ে না। কিন্তু বর্ণিত আদমের কাহিনীতে একথাও উল্লেখ করা হয়েছে যে, আদম ও হাওয়ার উপর শয়তানের চক্রান্ত সফল হয়েছে। এমনিভাবে সাহাবায়ে কেরাম সম্পর্কে কুরআন বলেঃ (إِنَّمَا اسْتَزَلَّهُمُ الشَّيْطَانُ بِبَعْضِ مَا كَسَبُوا) [সূরা আলে ইমরানঃ ১৫৫] এ থেকে জানা যায়া যে, সাহাবায়ে কেরামের উপরও শয়তানের ধোঁকা এক্ষেত্রে কার্যকর হয়েছে। তাই আলোচ্য আয়াতে আল্লাহর বিশেষ বান্দাদের উপর শয়তানের আধিপত্য বিস্তৃত না হওয়ার অর্থ এই যে, তাদের মন-মস্তিস্ক ও জ্ঞান-বুদ্ধির উপর শয়তানের এমন আধিপত্য বিস্তৃত হয় না যে, তারা তাদের নিজ ভ্রান্তি কোন সময় বুঝতেই পারেন না; ফলে তওবা করার শক্তি হয় না কিংবা কোন ক্ষমার অযোগ্য গোনাহ করে ফেলেন। উল্লেখিত ঘটনাবলী এ তথ্যের পরিপন্থী নয়। কারণ, আদম ও হাওয়া তওবা করেছিলেন এবং তা মাফ করা হয়েছিল। [দেখুন, ফাতহুল কাদীর]

তাফসীরে জাকারিয়া
===================================
===================================



সাইটটি ভিজিট করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আরও বেশি মানুষের কাছে ইসলামের জ্ঞান পৌঁছে দিতে শেয়ার ও কমেন্ট করুন।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url