জগৎসমূহের প্রতিপালক আল্লাহর পরিচয়-৬
আল্লাহ কে? আল্লাহর পরিচয় কি? আল্লাহ কেমন? আল্লাহ এই পৃথিবী কেন তৈরী করেছেন? আল্লাহ কিভাবে এই দুনিয়া সৃষ্টি করেছেন? আল্লাহ আমাদেরকে কেন সৃষ্টি করেছেন? আল্লাহ আমাদেরকে কেন সৃষ্টি করেছেন? আল্লাহ আমাদেরকে কিভাবে লালন পালন করছেন? আল্লাহ কোথায় থাকেন? আল্লাহর গুণাবলী কেমন? আল্লাহর ক্ষমতা বা শক্তি কেমন? আল্লাহ ছাড়া আরও কোন ইলাহ আছে কি?
এসব প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা নিজে পবিত্র কুরআনে বিশদভাবে তাঁর পরিচয় তুলেছেন। কমপক্ষে ১৩১টি আয়াতে আল্লাহ তায়ালা নিজের পরিচয় তুলে ধরেছেন।আমরা ধারাবাহিকভাবে সেসব আয়াতের অর্থ ও তাফসীর নিয়ে আলোচনা করবো।এসব আয়াতে বিশ্বাসীদর জন্য রয়েছে নিদর্শন।
১৯. আর আসমানসমূহ ও যমীনে যারা আছে তারা তাঁরই; আর তাঁর সান্নিধ্যে যারা আছে(১) তারা অহংকার-বশে তার ইবাদাত করা হতে বিমুখ হয় না এবং বিরক্তি বোধ করে না।(২)
(১) যারা তাঁর সান্নিধ্যে আছে তারা হলেন ফিরিশতারা। আরব মুশরিকরা সেসব ফেরেশতাদেরকে আল্লাহর সন্তান অথবা প্রভুত্ব কর্তৃত্বে শামিল মনে করে মাঝুদ বানিয়ে রেখেছিল। [কুরতুবী] এখানে তাদের ধারণা খণ্ডন করা হচ্ছে।
(২) অন্য আয়াতেও এসেছে, “মসীহ আল্লাহর বান্দা হওয়াকে কখনো হেয় মনে করেন না, এবং ঘনিষ্ঠ ফেরেশতাগণও করে না। আর কেউ তার ইবাদাতকে হেয় জ্ঞান করলে এবং অহংকার করলে তিনি অচিরেই তাদের সবাইকে তার কাছে একত্ৰ করবেন।” [সূরা আন-নিসা: ১৭২]
২০. তারা দিন-রাত তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে, তারা ক্লান্তও হয় না।(১)
(১) আয়াতের শেষে বলা হয়েছে যে, ফেরেশতাদের ইবাদাতে কোন অন্তরায় নেই। তারা ইবাদতে অহংকারও করে না যে, ইবাদাতকে পদমর্যাদার খেলাফ মনে করবে এবং ইবাদাতে কোন সময় ক্লান্তও হয় না। আয়াতে এ বিষয়বস্তুকেই পূর্ণতা দান করে বলা হয়েছে যে, ফেরেশতারা রাত দিন তসবীহ পাঠ করে এবং কোন সময় অলসতা করেন না। যাজ্জাজ বলেন, আমাদের নিঃশ্বাস নিতে যেমন কোন কাজ বাধা হয় না, তেমনি তাদের তাসবীহ পাঠ করতে কোন কাজ বাধা হয় না। [দেখুন, কুরতুবী; ইবন কাসীর; ফাতহুল কাদীর]
আল্লাহ ছাড়া অন্য মাবুদের কোন ক্ষমতা আছে কি?
২১. এরা যমীন থেকে যেগুলোকে মা’বুদ হিসেবে গ্রহণ করেছে সেগুলো কি মৃতকে জীবিত করতে সক্ষম?(১)
(১) ‘ইনশার’ মানে হচ্ছে, কোন পড়ে থাকা প্রাণহীন বস্তুকে তুলে দাঁড় করিয়ে দেয়া। [কুরতুবী] এতে আয়াতের অর্থ দাঁড়ায়, যেসব সত্তাকে তারা ইলাহ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে রেখেছে এবং যাদেরকে নিজেদের মাবুদ বানিয়ে নিয়েছে তাদের মধ্যে কি এমন কেউ আছে যে, নিষ্প্রাণ বস্তুর বুকে প্ৰাণ সঞ্চার করতে পারে? যদি এক আল্লাহ ছাড়া আর কারো মধ্যে এ শক্তি না থেকে থাকে আর আরবের মুশরিকরা নিজেরাই একথা স্বীকার করতো যে, এ শক্তি কারো মধ্যে নেই তাহলে তারা তাদেরকে ইলাহ্ ও মাবুদ বলে মেনে নিচ্ছে কেন? [দেখুন, কুরতুবী; ইবন কাসীর; ফাতহুল কাদীর]
আল্লাহ ছাড়া আরও ইলাহ থাকলে কি হতো?
২২. যদি এতদুভয়ের (আসমান ও যমীনের) মধ্যে আল্লাহ ব্যতীত আরো অনেক ইলাহ থাকত, তাহলে উভয়ই বিশৃংখল হত।(১) অতএব, তারা যা বর্ণনা করে তা থেকে আরশের অধিপতি আল্লাহ কতই না পবিত্ৰ।
(১) এটা তাওহীদের প্রমাণ, যা সাধারণ অভ্যাসের উপর ভিত্তিশীল এবং যুক্তিসঙ্গত প্রমাণের দিকেও ইঙ্গিতবহ। অভ্যাসগত প্রমাণের ভিত্তি এই যে, পৃথিবী ও আকাশে দুই ইলাহ থাকলে উভয়ই সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী হবে। এমতাবস্থায় উভয়ের নির্দেশাবলী পৃথিবী ও আকাশে পূর্ণরূপে কার্যকরী হওয়া উচিত। অভ্যাসগতভাবে এটা অসম্ভব যে, একজন যে নির্দেশ দেবে, অন্যজনও সেই নির্দেশ দেবে, একজন যা পছন্দ করবে, অন্যজনও তাই পছন্দ করবে। তাই উভয়ের মধ্যে মাঝে মাঝে মতবিরোধ ও নির্দেশ বিরোধ হওয়া অবশ্যম্ভাবী। যখন দুই ইলাহর নির্দেশাবলী পৃথিবী ও আকাশে বিভিন্নরূপ হবে, তখন এর ফলশ্রুতি পৃথিবী ও আকাশের ধ্বংস ছাড়া আর কি হবে। এক ইলাহ চাইবে যে এখন দিন হোক, অপর ইলাহ চাইবে এখন রাত্রি হোক। একজন চাইবে বৃষ্টি হোক, অপরজন চাইবে বৃষ্টি না হোক।
এমতাবস্থায় উভয়ের পরস্পর বিরোধী নির্দেশ কিরূপে প্রযোজ্য হবে? যদি একজন পরাভূত হয়ে যায়, তবে সে সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী ও ইলাহ্ থাকতে পারবে না। যদি প্রশ্ন করা হয় যে, উভয় ইলাহ পরস্পরে পরামর্শ করে নির্দেশ জারি করলে তাতে অসুবিধা কি? তার উত্তর হলো এই যে, যদি উভয়ই পরামর্শের অধীন হয় এবং একজন অন্যজনের পরামর্শ ছাড়া কোন কাজ করতে না পারে, তবে এতে জরুরী হয়ে যায় যে, তাদের কেউ সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী নয় এবং কেউ স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। বলাবাহুল্য, স্বয়ংসম্পূর্ণ না হয়ে ইলাহ হওয়া যায় না। সম্ভবতঃ পরবর্তী আয়াতেও এদিকে ইশারা পাওয়া যায় যে, যে ব্যক্তি কোন আইনের অধীন, যার ক্রিয়াকর্ম ধরপাকড় যোগ্য, সে ইলাহ হতে পারে না। ইলাহ তিনিই হবেন, যিনি কারও অধীন নয়, যাকে জিজ্ঞাসা করার অধিকার কারও নেই। পরামর্শের অধীন দুই ইলাহ থাকলে প্ৰত্যেকেই অপরিহার্যরূপে অপরকে জিজ্ঞাসা করার ও পরামর্শ বর্জনের কারণে ধরপাকড় করার অধিকারী হবে। এটা ইলাহ হওয়ার পদমৰ্যদার নিশ্চিত পরিপন্থী। [দেখুন, সা’দী]
এটি একটি সরল ও সোজা যুক্তি আবার গভীর তাৎপর্যপূর্ণও। এটি এত সহজ সরল কথা যে, একজন মরুচারী বেদুঈন, সরল গ্রামবাসী এবং মোটা বুদ্ধির অধিকারী সাধারণ মানুষও একথা বুঝতে পারে। এ আয়াতটি অন্য আয়াতের মত, যেখানে বলা হয়েছে, “আল্লাহ কোন সন্তান গ্রহণ করেননি এবং তাঁর সাথে অন্য কোন ইলাহও নেই; যদি থাকত তবে প্রত্যেক ইলাহ স্বীয় সৃষ্টি নিয়ে পৃথক হয়ে যেত এবং একে অন্যের উপর প্রাধান্য বিস্তার করত। তারা যে গুণে তাকে গুণান্বিত করে তা থেকে আল্লাহ কত পবিত্র- মহান!” [সূরা আল-মুমিনুন: ৯১] [ইবন কাসীর]
তবে লক্ষণীয় যে, আয়াতে এটা বলা হয়নি যে, যদি আসমান ও যমীনে আল্লাহ ব্যতীত আরো অনেক ইলাহ থাকত, তাহলে উভয়ই ধ্বংস হয়ে যেত। বরং বলা হয়েছে যে, ‘বিশৃংখল হত' বা ফাসাদ হয়ে যেত। আর সেটাই প্রমাণ করে যে, এখানে তাওহীদুল উলুহিয়্যাহর ব্যত্যয় ঘটলে কিভাবে দুনিয়াতে ফাসাদ হয় সেটাই বোঝানো উদ্দেশ্য। কারণ, আল্লাহ ছাড়া অন্য মাবুদের ইবাদত করলে সেখানেই ফাসাদ অনিবাৰ্য। কিন্তু যদি দুই ইলাহ থাকত, তবে দুনিয়া ধ্বংস হয়ে যেত। এ বিষয়টি প্রমাণ করে যে, আয়াতটি যেভাবে তাওহীদুর রবুবিয়্যাহ বা প্রভুত্বে একত্ববাদের প্রমাণ, সাথে সাথে সেটি তাওহীদুল উলুহিয়্যাহ বা ইবাদাতের ক্ষেত্রে একত্ববাদেরও প্রমাণ। তবে এর দ্বারা তাওহীদুল উলুহিয়্যাহ বা ইবাদাতে একত্ববাদের প্রয়োজনীয়তাই বেশী প্রমাণিত হচ্ছে। [বিস্তারিত দেখুন, ইবন তাইমিয়্যাহ, ইকতিদায়ুস সিরাতিল মুস্তাকীম ২/৩৮৭: আন-নুবুওয়াত: ১/৩৭৬; ইবনুল কাইয়্যেম, মিফতাহু দারিস সা’আদাহ: ১/২০৬, ২/১১, ১২২; তরীকুল হিজরাতাইন ৫৭, ১২৫; আল-জাওয়াবুল কাফী ২০৩]
২৩. তিনি যা করেন সে বিষয়ে তিনি জিজ্ঞাসিত হবেন না; বরং তাদেরকেই জিজ্ঞাসা করা হবে।
তাফসীরে জাকারিয়া
মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url