বিষয় ভিত্তিক আয়াত (পর্ব -৩) || শিরক (আল্লাহ কারো অংশীদারিত্ব থেকে পবিত্র) ||




সুরা আল ইসরা (বনী-ইসরাইল) এ বর্ণিত শিরক সর্ম্পকিত আয়াত


বল, ‘তাঁর সাথে যদি আরো উপাস্য থাকত, যেমন তারা বলে, তবে তারা আরশের অধিপতি পর্যন্ত পৌঁছার পথ তালাশ করত’। আল-বায়ান

বল- তাঁর সঙ্গে যদি আরো ইলাহ থাকত যেমন তারা বলে, তাহলে তারা অবশ্যই আরশের মালিকের নিকট পৌঁছার জন্য পথের সন্ধান করত। তাইসিরুল

বলঃ তাদের কথা মত যদি তাঁর সাথে আরও মা‘বূদ থাকত তাহলে তারা আরশ অধিপতির সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার উপায় অন্বেষন করত। মুজিবুর রহমান

Say, [O Muhammad], "If there had been with Him [other] gods, as they say, then they [each] would have sought to the Owner of the Throne a way." Sahih International


৪২. বলুন, যদি তাঁর সাথে আরও ইলাহ্ থাকত যেমন তারা বলে, তবে তারা ‘আরশ-অধিপতির (নৈকট্য লাভের) উপায় খুঁজে বেড়াত।(১)

১. এ আয়াতের দুটি অর্থ করা হয়ে থাকেঃ

এক. যদি আল্লাহর সাথে আরো অনেক ইলাহ থাকত। তবে তারা আরশের অধিপতির প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত হতো। যেমনিভাবে দুনিয়ার রাজা-বাদশারা করে থাকে। [ফাতহুল কাদীর] এ অর্থটি ইমাম শাওকানী প্রাধান্য দিয়েছেন।

দুই. আয়াতের আরেকটি অর্থ হলো, যদি আল্লাহর সাথে আরও ইলাহ থাকত, তবে তারা তাদের অক্ষমতা জেনে আরশের অধিপতি সত্যিকারের ইলাহ আল্লাহর নৈকট্য লাভের আশায় ব্যস্ত হয়ে পড়ত। [ইবন কাসীর] এ শেষোক্ত অর্থটিই সঠিক। ইমাম ইবন কাসীর। এটিকে প্রাধান্য দিয়েছেন। এটি শায়খুল ইসলাম ইবন তাইমিয়্যা ও ইবনুল কাইয়্যেমও প্রাধান্য দিয়েছেন। [দেখুন, আল-ফাতাওয়া আল-হামাওয়িয়্যাহ; মাজমু ফাতাওয়া: ১৬/১২২-১২৪, ৫৭৭; ইবনুল কাইয়্যেম, আল-জাওয়াবুল কাফী: ২০৩; আস-সাওয়ায়িকুল মুরসালাহ: ২/৪৬২] কারণ প্রথমত, এখানে (إِلَىٰ ذِي الْعَرْشِ) আরশের অধিপতির দিকে বলা হয়েছে عَلٰى ذِي الْعَرْشِ আরশের অধিপতির বিপক্ষে বলা হয়নি। আর আরবী ভাষায় إِلى শব্দটি নৈকট্যের অর্থেই ব্যবহার হয়। যেমন অন্যত্র বলা হয়েছে, (اتَّقُوا اللَّهَ وَابْتَغُوا إِلَيْهِ الْوَسِيلَةَ) [সূরা আল-মায়িদাহঃ ৩৫] পক্ষান্তরে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য عَلٰى শব্দটি ব্যবহার হয়। যেমন অন্যত্র বলা হয়েছে, (فَإِنْ أَطَعْنَكُمْ فَلَا تَبْغُوا عَلَيْهِنَّ سَبِيلًا) [সূরা আন-নিসাঃ ৩৪]

দ্বিতীয়ত, এ অর্থের সমর্থনে এ সূরারই ৫৭ নং আয়াত প্রমাণবিহ। সেখানে বলা হয়েছে, তারা যাদেরকে ডাকে তারাই তো তাদের রবের নৈকট্য লাভের উপায় সন্ধান করে যে, তাদের মধ্যে কে কত নিকটতর হতে পারে, তার দয়া প্রত্যাশা করে ও তাঁর শাস্তিকে ভয় করে। নিশ্চয়ই আপনার রবের শাস্তি ভয়াবহ।” এতে করে বুঝা গেল যে, এখানে এ আয়াতের অর্থ হবে এই যে, যদি তারা যেভাবে বলে সেভাবে সেখানে আরো ইলাহ থাকত তবে সে বানানো ইলাহগুলো নিজেদের অক্ষমতা সম্যক বুঝতে পেরে প্রকৃত ইলাহ রাব্বুল আলামীন আল্লাহ তা’আলার প্রতি নৈকট্য লাভের আশায় ধাবিত হতো।

এ অর্থের সমর্থনে তৃতীয় আরেকটি প্রমাণ আমরা পাই এ কথা থেকেও যে কাফেরগণ কখনও এ কথা দাবী করেনি যে, তাদের ইলাহাগণ আল্লাহ্ তা'আলার প্রতিদ্বন্দ্বী বরং তারা সবসময় বলে আসছে যে, “আমরা তো কেবল তাদেরকে আল্লাহর কাছে নৈকট্য লাভে সুপারিশকারী হিসেবেই ইবাদত করে থাকি”। [সূরা আয-যুমারঃ ৩] এখানেও আয়াতে বলা হয়েছে, “যেমনটি তারা বলে”। আর তারা কখনো তাদের মা’বুদাদেরকে আল্লাহর প্রতিদ্বন্দ্বী বলে ঘোষণা করেনি। এ দ্বিতীয় তাফসীরটি প্রখ্যাত তাফসীরবিদ কাতাদা রাহেমাহুল্লাহ থেকে সহীহ সনদে বর্ণিত হয়েছে।

তাফসীরে জাকারিয়া

তিনি পবিত্র মহান এবং তারা যা বলে তা থেকে তিনি অনেক ঊর্ধ্বে। আল-বায়ান

তিনি পবিত্র ও অতি উচ্চ, তারা যা বলে তাত্থেকে অনেক অনেক ঊর্ধ্বে। তাইসিরুল

তিনি পবিত্র, মহিমান্বিত এবং তারা যা বলে তা হতে তিনি বহু উর্ধ্বে। মুজিবুর রহমান

Exalted is He and high above what they say by great sublimity. Sahih International

(৪৩) তিনি পবিত্র, মহিমার্নিত এবং তারা যা বলে, তা হতে তিনি বহু ঊর্ধ্বে। [1]

[1] অর্থাৎ, প্রকৃত ব্যাপার হল এই যে, আল্লাহ সম্পর্কে এই লোকেরা যে বলে, তাঁর শরীক আছে, মহান আল্লাহ এই সমস্ত কথাবার্তা থেকে পাক-পবিত্র ও অনেক ঊর্ধ্বে।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান

বল, ‘তাদেরকে ডাক, আল্লাহ ছাড়া তোমরা যাদেরকে (উপাস্য) মনে কর। তারা তো তোমাদের দুঃখ-দুর্দশা দূর করার ও পরিবর্তন করার ক্ষমতা রাখে না’। আল-বায়ান

বল, ‘তোমরা আল্লাহ ছাড়া যাদেরকে ইলাহ মনে কর তাদেরকে ডাক, (ডাকলেও দেখতে পাবে) তারা তোমাদের দুঃখ-বেদনা দূর করতে বা বদলাতে সক্ষম নয়। তাইসিরুল

বলঃ তোমরা আল্লাহ ছাড়া যাদেরকে মা‘বূদ মনে কর তাদেরকে আহবান কর; করলে দেখবে তোমাদের দুঃখ দৈন্য দূর করার অথবা পরিবর্তন করার শক্তি তাদের নেই। মুজিবুর রহমান

Say, "Invoke those you have claimed [as gods] besides Him, for they do not possess the [ability for] removal of adversity from you or [for its] transfer [to someone else]." Sahih International


৫৬. বলুন, “তোমরা আল্লাহ ছাড়া যাদেরকে ইলাহ মনে কর তাদেরকে ডাক, অতঃপর দেখবে যে, তোমাদের দুঃখ-দৈন্য দূর করার বা পরিবর্তন করার শক্তি তাদের নেই।(১)

১. এ থেকে পরিষ্কার জানা যায়, কেবল গায়রুল্লাহকে (আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন সত্তা) সিজদা করাই শির্ক নয় বরং আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন সত্তার কাছে দোআ চাওয়া বা তাকে সাহায্য করার জন্য ডাকাও শির্ক। দো'আ ও সাহায্য চাওয়া ইবাদতেরই অন্তর্ভুক্ত। কাজেই গায়রুল্লাহর কাছে প্রার্থনাকারী একজন মূর্তি পূজকের সমান অপরাধী। তাছাড়া এ থেকে একথাও জানা যায় যে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ কোন আপদ-বিপদ থেকে বাঁচাতে পারে না এবং কোন খারাপ অবস্থাকে ভাল অবস্থায় পরিবর্তিত করে দিতেও পারে না। আল্লাহ ছাড়া অন্য যে কোন সত্তা সম্পর্কে এ ধরনের বিশ্বাস রাখা ভ্ৰষ্টতা ছাড়া আর কিছুই নয়।

তাফসীরে জাকারিয়া


আর বল, ‘সমস্ত প্রশংসা আল্লাহরই, যিনি কোন সন্তান গ্রহণ করেননি, রাজত্বে তাঁর কোন শরীক নেই এবং অপমান থেকে বাঁচতে তাঁর কোন অভিভাবকের দরকার নেই।’ সুতরাং তুমি পূর্ণরূপে তাঁর বড়ত্ব ঘোষণা কর। 
আল-বায়ান

বল, ‘সকল প্রশংসাই আল্লাহর যিনি সন্তান গ্রহণ করেন না, যাঁর শাসন-কর্তৃত্বে কোন অংশীদার নেই, দুর্দশাগ্রস্ত হওয়া থেকে বাঁচার জন্য যাঁর কোন অভিভাবকের প্রয়োজন হয় না। অতএব পূর্ণ শ্রেষ্ঠত্বে তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা কর। তাইসিরুল

বলঃ প্রশংসা আল্লাহরই যিনি সন্তান গ্রহণ করেননি, তাঁর সার্বভৌমত্বে কোন অংশী নেই এবং তিনি দুর্দশাগ্রস্ত হননা যে কারণে তাঁর অভিভাবকের প্রয়োজন হতে পারে; সুতরাং স্বসম্ভ্রমে তাঁর মাহাত্ম্য ঘোষণা কর। 
মুজিবুর রহমান
And say, "Praise to Allah, who has not taken a son and has had no partner in [His] dominion and has no [need of a] protector out of weakness; and glorify Him with [great] glorification." 
Sahih International

১১১. বলুন, প্রশংসা আল্লাহরই যিনি কোন সন্তান গ্রহণ করেননি(১), তাঁর সার্বভৌমত্ত্বে কোন অংশীদার নেই(২) এবং দুর্দশাগ্ৰস্ততা থেকে বাঁচতে তাঁর অভিভাবকের প্রয়োজন নেই।(৩) আর আপনি সসম্রামে তার মাহাত্য ঘোষণা করুন।

(১) এখানে প্রত্যক্ষভাবে রাসূলকে নির্দেশ দেয়া হলেও নির্দেশটি সমস্ত উম্মতের জন্যও প্রযোজ্য। সবাইকে তাওহীদের ঘোষণা দেয়ার নির্দেশ দেয়া হচ্ছে। আল্লাহর একত্ববাদ প্রতিষ্ঠা করার আদেশ করা হয়েছে। পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন স্থানে তাওহীদের এ অংশের নির্দেশ সম্বলিত আয়াতসমূহ এসেছে। [যেমন, সূরা ইখলাস, সূরা আল জিনঃ ৩, সূরা আল-মু'মিনূনঃ ৯১, সূরা আল-আনআমঃ ১০১, সূরা আল-বাকারাহ ১১৬, সূরা ইউনুসঃ ৬৮, সূরা আল-কাহফঃ ৪, সূরা মারইয়ামঃ ৮৮–৯২, সূরা আল আম্বিয়াঃ ২৬, সূরা আল-ফুরকানঃ ২]

এ সমস্ত আয়াতে যে সত্যটি তুলে ধরা হয়েছে তা হলো, দয়াময় আল্লাহর জন্য সন্তান গ্ৰহণ অসম্ভব। সন্তান তো তারাই আশা করে যারা তাদের অবর্তমানে তাদের কাজকারবার দেখাশুনা, তাদের নাম টিকিয়ে রাখা, তাদের চাহিদা পূরণ, তাদের কর্মকাণ্ডে সাহায্য-সহযোগিতার প্রয়োজন পড়ে। মহান আল্লাহ্ তা'আলা এ সমস্ত কিছু থেকে সম্পূর্ণ পবিত্র। তিনি সর্বদা আছেন ও থাকবেন। তার কোন অভাব নেই। সবাই তাঁর মুখাপেক্ষী।  সুতরাং আল্লাহর কোন সন্তান হতে পারে না। এতে ইয়াহুদী ও নাসারাদের দাবীর রদ করা হয়েছে। [দেখুন, ফাতহুল কাদীর] 

(২) এখানে আরও যে সমস্ত কারণে মানুষ তাওহীদ থেকে বিচ্যুত হয় তা হচ্ছে, কোন কোন মানুষ মনে করে থাকে যে, যদি তার সন্তান নাও থাকে তার রাজত্বে ও রাবুবিয়াতে অন্য কেউ শরীক আছে। সুতরাং তাদেরকেও সন্তুষ্ট করা উচিত। যেমন, মাজুস সম্প্রদায় মনে করে থাকে। তারা দু’জন ইলাহ নির্ধারণ করে থাকে। [ফাতহুল কাদীর] অনুরূপভাবে হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যেও অনেকে এ ধরনের বিশ্বাস করে থাকে।

(৩) এখানে সে সমস্ত মুশরিকদের কথা বলা হয়েছে যারা বিভিন্ন দেবতা ও জ্ঞানী গুণী মহামানবদের সম্পর্কে বিশ্বাস করতো যে, আল্লাহ নিজের সার্বভৌম কর্তৃত্বের বিভিন্ন বিভাগ এবং নিজের রাজত্বের বিভিন্ন এলাকা তাদের ব্যবস্থাপনায় দিয়ে দিয়েছেন। এখানে তাদের এ বিশ্বাসের বিরুদ্ধে প্রমাণ পেশ করা হয়েছে যে, আল্লাহ এমন নন যে, তিনি কোন কাজ করতে গিয়ে অপর কাজ করতে অপারগ হয়ে পড়েন।

সুতরাং তার সহকারী কেন লাগবে? সুতরাং তাদের যে বিশ্বাস ছিল, আল্লাহ নিজে তাঁর সার্বভৌম কর্তৃত্বের বোঝা বহন করতে অক্ষম, তাই তিনি নিজের জন্য কোন সাহায্যকারী ও নির্ভর তালাশ করে বেড়াচ্ছেন। এটা একান্ত ভ্ৰান্ত ধারণা ও বিশ্বাস। তাই বলা হয়েছে, আল্লাহ অক্ষম নন। তাঁর কোন ডেপুটি, সহকারী ও সাহায্যকারীর প্রয়োজন নেই। [দেখুন, ইবন কাসীর]

তাফসীরে জাকারিয়া


এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url