নবজাতক ও শিশুদের ক্ষেত্রে পালনীয় সুন্নাতসমূহ


নবজাতক ও শিশুদের ক্ষেত্রে পালনীয় সুন্নাতসমূহ

[”সুন্নাতী জিন্দেগী”র এই বিভাগে আমরা একজন মানব সন্তানের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত অর্থাৎ একজন মানব সন্তানের ব্যাক্তিগত, পারিবারিক, সাংসারিক, সামাজিক ক্রিয়াকর্ম, সম্পর্ক ও লেনদেন এবং রাস্ট্রীয় বিষয়ে যাবতীয় সুন্নাহ সমূহ নিয়ে আলোচনা করবো ইন শা আল্লাহ। আশাকরি, বিপুল সংখ্যক মুসলিম ভাই বোন এ থেকে উপকৃত হবেন। আল্লাহ পাক আমাদের জীবনে চলার পথে সকল ক্ষেত্রে হুজুরে পাক (সা:) এর সকল সুন্নাহ সমূহ মেনে চলার তৌফিক দান করুন, আমিন। আজ আমরা নবজাতক ও শিশুদের ক্ষেত্রে পালনীয় সুন্নাহ সমূহ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো, ইন শা আল্লাহ।]

শিশুর জন্মের পরপর নবজাতকের জন্য পালনীয় সুন্নাতসমূহ

নবজাতকের কানে আযান ও ইকামত দেওয়া সুন্নত

সন্তান জন্মগ্রহণ করলে চাই সে ছেলে হোক বা মেয়ে হোক তাকে পরিস্কার করার পরে তার ডান কানে আযান ও বাম কানে ইকামত দেওয়া সুন্নত। (আবু দাউদ শরীফ, ২/৬৯৬, হাদিস নং-৪৪৪১, তিরমিযী শরীফ, ২/২৭৮, হাদীস নং-১৪৩৬, মেরকাত-৭/৭৫, রদ্দুর মুহতার-২/৫০, আহসানুল ফাতওয়া-২/২৭৬)

 নবজাতকের কানে আযান ইকামত দেওয়ার সুন্নাতী পদ্ধতি

নবজাতকের ডান কানে আযান ও বাম কানে ইকামত দেওয়া সুন্নত। যিনি আযান দিবেন তিনি পশ্চিম দিকে মুখ করে দাঁড়াবেন। তিনি নিজে শিশুটিকে কোলে নিবেন অথবা অন্য কেউ শিমুকে কোলে নিয়ে তার সামনে মুখোমুখি হয়ে দাঁড়াবেন। কিংবা আযান দাতার সামনে খাট বা টেবিলের উপর নবজাতক শিশুটিকে শুইয়ে রাখবেন। প্রথমে শিশুকে দক্ষিণ শিয়র করে শুইয়ে কিবলামূখি করে রেখে আযান দিতে হবে। যাতে শিশুর ডান কানে আযানের শব্দ ঢুকে। এরপর শিশুকে উত্তর শিয়র করে শুইয়ে কিবলামূখি করে রেখে ইকামত দিতে হবে। যাতে করে শিশুর বাম কানে ইকামতের শব্দ ঢুকে।

 নবজাতকের তাহনীক করা সুন্নাত

জন্মের পরপরই শিশুর মুখে অতি অল্প পরিমাণে মিষ্টিজাতীয় কিছু দেওয়াকে তাহনীক বলে। তাহনীক করতে হয় কোন বুযুর্গ ব্যক্তির দ্বারা। খেজুর অথবা খেজুর না থাকলে মধু অথবা মিষ্টি জাতীয় কোন দ্রব্য চিবিয়ে মুখ থেকে কিছু অংশ লালাসহকারে বের করে তা শিশুর মুখে দিয়ে শিশুর জন্য দোয়া করাই হচ্ছে তাহনীক। এরূপ তাহনীক করা সুন্নাত। (বুখারী শরীফ, হাদিস নং-৩৬১৯, ৫০৪৭ ও ৫২৭৪)

নবজাতকের সুন্দর ও অর্থবোধক নামরাখা সুন্নাত

বাচ্চার বয়স যখন সাতদিন হবে অর্থাৎ যে বারে জন্মগ্রহন করবে পরের সপ্তাহে ঠিক আগেরবারে, যেমন বাচ্চাটি শনিবারে জন্মগ্রহণ করলে পরের শুক্রবারে তার সুন্দর নাম রাখা সুন্নাত। সর্বোত্তম নাম হল- আব্দুল্লাহ ও আব্দুর রহমান। এরপরে নবী রাসুলগণের নাম, বুযুর্গগণের নাম ইত্যাদি মিলিয়ে ভাল অর্থবহ নাম রাখা সুন্নাত। (তিরমিযী শরীফ, হাদিস নং-২৭৫৯, আবু দাউদ শরীফ, হাদিস নং-৪২৯৮)

খারাপ নাম রেখে থাকলে তা পরিবর্তন করাও সুন্নাত

খারাপ নাম বা খারাপ অর্থবহ নাম রেখে থাকলে তা পরিবর্তন করে ভাল অর্থবহ নাম রাখা সুন্নাত।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা:) বলেন, হযরত ওমর (রা:) এর একটি মেয়ের নাম ছিল আ’সিয়া (যার অর্থ অবাধ্যকারিনী) রাসুলুল্লাহ (সা:) তার নাম রাখলেন “জামিলা” (যার অর্থ সুন্দরী)। (মুসলিম শরীফ, হাদিস নং-৩৯৮৮)
হযরত আবু হুরায়রা (রা:) বলেন, হযরত যায়নাব (রা:) এর নাম ছিল “বার্ রতু”। রাসুলুল্লাহ (সা:) তার নাম পরিবর্তন করে ‘যায়নাব’ রাখলেন। (মুসলিম শরীফ, হাদিস নং- ৩৯৯০)

খারাপ নামের একটি শিক্ষনীয় ঘটনা

সাহাবী হযরত ইয়াহ ইবনে সাঈদ (রা:) বর্ণনা করেন, একবার এক লোক হযরত ওমর (রা:) এর কাছে আসলো। হযরত ওমর (রা:) তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার নাম কি? সে বলল, ‘আমার নাম “জামরাহ” (যার অর্থ জ্বলন্ত কয়লা)।’ তিনি আবার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি কার সন্তান?’ সে বলল, ‘ আমি শিহাব (অর্থ অগ্নীস্ফুলিঙ্গ) এর সন্তান।’ হযরত ওমর (রা:) আবার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি কোন গোত্রের লোক?’ সে বলল, ‘আমি হুরাকা (অর্থ প্রজ্বলন) গোত্রের লোক।’ তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি কোথায় থাকো।’ সে বলল, ‘আমি হাররাতুন্নার (অর্থ আগুনের উত্তাপ) নামক জায়গায় থাকি।’ তিনি আবার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি কোন এলাকায় থাক, তোমার এলাকার নামি কি?’ সে বলল, ‘আমি যাতু লাজা (অর্থাৎ জ্বলন্ত আগুনওয়ালা) নামক এলাকায় থাকি।’ হযরত ওমর (রা:) তার সব কথা শুনে বললেন, ‘যাও, তুমি গিয়ে দেখবে তোমার গোত্রের সবকিছু জ্বলে ছাই হয়ে গেছে।’ (মুয়াত্তা মালেক, হাদীস নং-১৫৪১, বাবু মা ইয়াকরহু মিনাল আসমা)

 ভাল নাম রাখার সুফল

ইসলামী নাম রাখার এই সুন্নাতের উপর আমল না করলে অনেক সময় সন্তানের আখলাক চরিত্রের উপর নামের প্রভাব পড়ে। তাই ভাল অর্থবোধক নাম রাখা জরুরী। দু:থজনক কিষয় হল, বর্তমানে আমাদের দেশে নাম রাখার বিষয়ে সুন্নাত তরীকার খেয়াল রাখা হয় না। বরং বিধর্মীদের অনুসরণ করা হয়। যার কারণে অনেক সময় মানুষের নাম শুনলে বুঝা যায় না যে, এটা কি মানুষের নাম নাকি কোন পণ্য বা জিনিসের নাম! যেমন- অনিক, তীব্বত, ঝর্ণা, বন্যা, রবি, ইত্যাদি। আবার নাম শুনে মানষের নাম বুঝা গেলেও সেটা ছেলে না মেয়ে তা বুঝা যায় না। অথচ হাদিস শরীফে বর্ণিত আছে, হযরত আবু হুরায়রা (রা:) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা:) বলেছেন, কিয়ামতের দিন তোমার নাম ও তোমার পিতার নাম ধরে তোমাকে ডাকা হবে। সুতরাং তোমরা ভাল নাম রাখো।’ (আবু দাউদ শরীফ, হাদীস নং- ৪২৯৭, মুসনাদে আহমদ, হাদীস নং-২০৭০৪)

নবজাতকের আকীকা করা সুন্নাত

সন্তান জন্মের সপ্তম দিন সন্তানের আকীকা করা  ‍সুন্নাত। সন্তান ছেলে হলে দুটি ছাগল এবং সন্তান মেয়ে হলে একটি ছাগল দিয়ে আকীকা করা সুন্নাত। সপ্তম দিন সম্ভব না হলে ১৪তম দিনে বা ২১তম দিনে আকীকা করা যায়। তাও সম্ভব না হলে সামর্থ্য অনুযায়ী পরবর্তি যেকোন সময়ে আকীকা কার যাবে। তবে যে বারে সন্তানের জন্ম হয়েছে, আকীকা সব সময় সেই বারের আগের বার দিনে দিবে। তাহলে কোন না কোন সপ্তাহের সপ্তম দিন ধরা হবে। অর্থাৎ সন্তান যদি কোন এক শনিবারে জন্মগ্রহণ করে থাকে তাহলে পরবর্তী সময়ে আকীকার জন্য শুক্রবারকে বেছে নিলে সুন্নাত আদায় হয়ে যাবে। (আবু দাউদ শরীফ, হাদীস নং-২৪৫৫, নাসায়ী, হাদীস নং-৪১৪৯)

আকীকা না করার পরিণতি

আকীকার সুন্নাত পালন করলে শিশু বিভিন্ন রোগ-শোক ও বালা-মুসিবত থেকে নিরাপদ থাকে। তাই আকীকার সুন্নাত পালন না করলে এগুলো থেকে নিরাপদ নাও থাকতে পারে।

নবজাতকের চুলের ওজনে রূপা সদকা করা সুন্নত

নবজাতক জন্মের সপ্তম দিনে বাচ্চার মাথা মুড়িয়ে (শুকনা) চুলের ওজন বরাবর রূপা সদকা করা সুন্নত।

বাচ্চাদেরকে কালিমা শিক্ষা দেওয়া

ছোট বাচ্চা যখন একটু একটু কথা বলতে শিখবে তখন তাকে প্রথমে ঈমানের কালিমাগুলো শিক্ষা দিতে হবে। যেমন, সর্ব প্রথমে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলতে শিখানো। (ইবনে সুন্নী, হিসনে হাসীন)
 
* বাচ্চার বয়স সাত বছর হলে নামাজ ও ইসলামের প্রয়োজনীয় বিষয়াদী শিক্ষা দেওয়া সুন্নাত। এবং নামাজের হুকুম দেওয়া জরুরী। (আবু দাউদ শরীফ, হাদীস নং- ৪১৮)
* সাত বছর বয়সে কোন হাক্কানী অঅলেমের কাছে সন্তানকে বাইয়াত করানো সুন্নাত। (মুসলিম শরীফ, হাদীস নং-৩৯৯৮)
* দশ বছর বয়সে নামাজের আদেশ দেওয়া এবং প্রয়োজনে নামাজের জন্য শাস্তি দেওয়া জরুরী। যাতে সন্তান নামাজের পাবন্দী করতে শিখে। (আবু দাউদ শরীফ, হাদীস নং-৪১৮)
* দশ বছর বয়সে সন্তানের বিছানা আলাদা করে দেওয়া সুন্নাত। (আবু দাউদ শরীফ, হাদীস নং- ৪১৮)

সন্তানের খাতনা করানো সুন্নাত

ছেলে সন্তানের বয়স ৬/৭ বা ৮/৯ হলেই সন্তানকে খাতনা করানো সুন্নাত। এটা খুবই জরুরী সুন্নাত। কারণ, এই বিষয়টি সমস্ত নবী রাসুলগণের সুন্নাত ছিল। হযরত আম্মার ইবনে ইয়াসির (রা:) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা:) বলেছেন, ‘দশটি কাজ নবী-রাসুলগণের সুন্নাত। (১) মেসওয়াক করা, (২) অজুতে কুলি করা, (৩) নাকে পানি দিয়ে পরিস্কার করা, (৪) নখ কাটা, (৫) মোচ বা গোঁফ ছোট রাখা, (৬) দাড়ি লম্বা করা, (৭) বগলের নীচের লোম পরিস্কার করা, (৮) নাভীর নীচের লোম পরিস্কার করা, (৯) খাতনা করা এবং (১০) পেশাব পায়খানার পর পানি দিয়ে পরিস্কার করা। (ইবনে মাজা শরীফ, হাদীস নং-২৯০, মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-১৭৬০৬)

মেয়ে সন্তান লালন পালনের ফজিলত

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা:) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা:) বলেছেন, যার একটি মেয়ে জন্মগ্রহণ করলো আর সে তার মেয়েকে কষ্ট দিল না, অপমানিত করলো না, তার ছেলেকে মেয়ের উপর প্রাধান্য দিল না, আল্লাহ তা’লা তাকে ঐ মেয়ের উসিলায় জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। (আবু দাউদ শরীফ, হাদীস নং-৪৪৮০, মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-১৮৫৬, শুয়াবুল ঈমান, হাদীস নং-৮৪৪২)

শিশুদেরকে মুহব্বত করার সুন্নাত তরীকা

১। রাসুলুল্লাহ (সা:) শিশুদেরকে দেখামাত্র আসসালামু আ’লাইকুম বলে সালাম দিতেন। (বুখারী শরীফ)
২। শিশুরা তার কাছে আসলে তাদেরকে কোলে তুলে নিতেন এবং আদর করে মাথায় হাত বুলাতেন। (বুখারী শরীফ০
৩। কখনও খেজুর বা কখনও টাটকা ফল বা অন্যকিছু সামান্য হলেও খাওয়াতেন বা উপহার দিতেন।
৪। একাধিক শিশু একত্রিত হলে তাদেরকে এক কাতারে দাঁড় করিয়ে রাসুলুল্লাহ (সা:) দূর হতে দুই বাহু প্রসারিত করে বলতেন, তোমরা সকলে দৌড়ে আমার কাছে আসো। যে সবার আগে আসবে আমি তাকে এটা বা ওটা দিব। এরপর শিশুরা সবাই দৌঁড়ে তাঁর কাছে আসতো। কেউ তাঁর পেটের উপর কেউ তাঁর বুকের উপর এসে পড়ে যেত। আর রাসুলুল্লাহ (সা:) তাদের বুকে জড়িয়ে ধরতেন ও আদর করতেন (খাসায়েসে নববী)। আর কখনও শুয়া অবস্থায় শিশুদেরকে তাঁর পায়ের উপর আবার কখনও তাঁর বুকের উপর বসিয়ে দিতেন। (উস ওয়ায়ে রাসুল)।
একারণেই শিশুরা রাসুলুল্লাহ (সা:) কে খুব ভালবাসতো। যেখানেই শিশুরা রাসুলুল্লাহ (সা:)কে পেতো, তারা দৌঁড়ে তাঁর কাছে চলে আসতো।

No matter what language you are a reader of, you can choose your language from over a hundred languages at the bottom right of our web site. May Allah help us.



********************
সাইটটি ভিজিট করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে এবং দীন ও মানবতার সেবায় অংশ নিতে OUR ACTION PLAN বাটনে ক্লিক করুন।



এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url