সূরা আত-তাকভীর তেলাওয়াত, উচ্চারণ, অনুবাদ ও তাফসীর || কারী শেখ আব্দুল বাসিত || Surah At-Takwir ||

সূরা আত-তাকভীর তেলাওয়াত

কারী শেখ আব্দুল বাসিত

সূরা আত-তাকভীর কোরআন মাজিদের ৮১ নম্বর সূরা। 
এই সূরার মোট আয়াত সংখ্যা ২৯ টি। 
সূরা আত-তাকভীর এর বাংলা অর্থ - অন্ধকারাচ্ছন্ন। 
সূরা আত-তাকভীর মক্কায় অবতীর্ণ হয়েছে।

সূরা আত-তাকভীর আরবী উচ্চারণ

Surah At-Takwir Arabi Uchcharon

১ اِذَا الشَّمۡسُ کُوِّرَتۡ
২ وَ اِذَا النُّجُوۡمُ انۡکَدَرَتۡ
৩ وَ اِذَا الۡجِبَالُ سُیِّرَتۡ
৪ وَ اِذَا الۡعِشَارُ عُطِّلَتۡ
৫ وَ اِذَا الۡوُحُوۡشُ حُشِرَتۡ
৬ وَ اِذَا الۡبِحَارُ سُجِّرَتۡ
৭ وَ اِذَا النُّفُوۡسُ زُوِّجَتۡ
৮ وَ اِذَا الۡمَوۡءٗدَۃُ سُئِلَتۡ
৯ بِاَیِّ ذَنۡۢبٍ قُتِلَتۡ ۚ
১০ وَ اِذَا الصُّحُفُ نُشِرَتۡ
১১ وَ اِذَا السَّمَآءُ کُشِطَتۡ
১২ وَ اِذَا الۡجَحِیۡمُ سُعِّرَتۡ
১৩ وَ اِذَا الۡجَنَّۃُ اُزۡلِفَتۡ
১৪ عَلِمَتۡ نَفۡسٌ مَّاۤ اَحۡضَرَتۡ
১৫ فَلَاۤ اُقۡسِمُ بِالۡخُنَّسِ
১৬ الۡجَوَارِ الۡکُنَّسِ
১৭ وَ الَّیۡلِ اِذَا عَسۡعَسَ
১৮ وَ الصُّبۡحِ اِذَا تَنَفَّسَ
১৯ اِنَّهٗ لَقَوۡلُ رَسُوۡلٍ کَرِیۡمٍ
২০ ذِیۡ قُوَّۃٍ عِنۡدَ ذِی الۡعَرۡشِ مَکِیۡنٍ
২১ مُّطَاعٍ ثَمَّ اَمِیۡنٍ
২২ وَ مَا صَاحِبُکُمۡ بِمَجۡنُوۡنٍ 
২৩ وَ لَقَدۡ رَاٰهُ بِالۡاُفُقِ الۡمُبِیۡنِ
২৪ وَ مَا هُوَ عَلَی الۡغَیۡبِ بِضَنِیۡنٍ 
২৫ وَ مَا هُوَ بِقَوۡلِ شَیۡطٰنٍ رَّجِیۡمٍ
২৬ فَاَیۡنَ تَذۡهَبُوۡنَ
২৭ اِنۡ هُوَ اِلَّا ذِکۡرٌ لِّلۡعٰلَمِیۡنَ 
২৮ لِمَنۡ شَآءَ مِنۡکُمۡ اَنۡ یَّسۡتَقِیۡمَ
২৯ وَ مَا تَشَآءُوۡنَ اِلَّاۤ اَنۡ یَّشَآءَ اللّٰهُ رَبُّ الۡعٰلَمِیۡنَ
সূরা আত-তাকভীর বাংলা উচ্চারণ
Surah At-Takwir Bangla Uchcharon
১) ইযাশশামছুকুওবিরাত।
২) ওয়া ইযাননুজূমুন কাদারাত।
৩) ওয়া ইযাল জিবা-লুছুইয়িরাত।
৪) ওয়া ইযাল ‘ইশা-রু ‘উত্তিলাত।
৫) ওয়া ইযাল উহূশু হুশিরাত।
৬) ওয়া ইযাল বিহা-রু ছুজ্জিরাত।
৭) ওয়া ইযাননুফূছুঝুওবিজাত।
৮) ওয়া ইযাল মাওঊদাতুছুইলাত।
৯) বিআইয়ি যামবিন কুতিলাত।
১০) ওয়া ইযাসসুহুফুনুশিরাত।
১১) ওয়া ইয়াছ ছামাউ কুশিতাত।
১২) ওয়া ইযাল জাহীমুছু‘‘য়িরাত।
১৩) ওয়া ইযাল জান্নাতুউঝলিফাত।
১৪) ‘আলিমাত নাফছুম মাআহদারাত।
১৫) ফালা উকছিমুবিলখুন্নাছ।
১৬) আল জাওয়া-রিল কুন্নাছ।
১৭) ওয়াল্লাইলি ইযা-‘আছ‘আছ।
১৮) ওয়াসসুবহিইযা-তানাফফাছ।
১৯) ইন্নাহূলাকাওলুরাছূলিন কারীম।
২০) যী কুওওয়াতিন ‘ইনদা যিল ‘আরশি মাকীন।
২১) মুতা-‘ইন ছাম্মা আমীন।
২২) ওয়া মা-সা-হিবুকুম বিমাজনূন।
২৩) ওয়া লাকাদ রাআ-হু বিলউফুকিল মুবীন।
২৪) ওয়ামা-হুওয়া ‘আলাল গাইবি বিদানীন।
২৫) ওয়ামা-হুওয়া বিকাওলি শাইতা-নির রাজীম।
২৬) ফাআইনা তাযহাবূন।
২৭) ইন হুওয়া ইল্লা-যিকরুল লিল‘আ-লামীন।
২৮) লিমান শাআ মিনকুম আইঁ ইয়াছতাকীম।
২৯) ওয়ামা-তাশাঊনা ইল্লাআইঁ ইয়াশাআল্লা-হু রাব্বুল ‘আ-লামীন।

সূরা আত-তাকভীর বাংলা অনুবাদ

Surah At-Takwir Bangla Onubad

১. যখন সূর্যকে গুটিয়ে নেয়া হবে। 
২. আর নক্ষত্ররাজি যখন পতিত হবে। 
৩. আর পর্বতগুলোকে যখন সঞ্চালিত করা হবে।
৪. আর যখন দশমাসের গর্ভবতী উষ্ট্রীগুলো উপেক্ষিত হবে।
৫. আর যখন বন্য পশুগুলোকে একত্র করা হবে। 
৬. আর যখন সমুদ্রগুলোকে অগ্নিউত্তাল করা হবে।
৭. আর যখন আত্মাগুলোকে (সমগোত্রীয়দের সাথে) মিলিয়ে দেয়া হবে।
৮. আর যখন জীবন্ত কবরস্থ কন্যাকে জিজ্ঞাসা করা হবে।
৯. কী অপরাধে তাকে হত্যা করা হয়েছে? 
১০. আর যখন আমলনামাগুলো প্রকাশ করে দেয়া হবে।
১১. আর যখন আসমানকে আবরণ মুক্ত করা হবে।
১২. আর জাহান্নামকে যখন প্রজ্জ্বলিত করা হবে।
১৩. আর জান্নাতকে যখন নিকটবর্তী করা হবে।
১৪. তখন প্রত্যেক ব্যক্তিই জানতে পারবে সে কী উপস্থিত করেছে!
১৫. আমি কসম করছি পশ্চাদপসারী নক্ষত্রের।
১৬. যা চলমান, অদৃশ্য। 
১৭. আর কসম রাতের, যখন তা বিদায় নেয়। 
১৮. আর কসম প্রভাতের, যখন তা আগমন করে। 
১৯. নিশ্চয় এ কুরআন সম্মানিত রাসূলের* আনিত বাণী।
২০. যে শক্তিশালী, আরশের মালিকের নিকট মর্যাদাসম্পন্ন।
২১. মান্যবর, সেখানে সে বিশ্বস্ত। 
২২. আর তোমাদের সাথী* পাগল নয়। 
২৩. আর সে* তাকে** সুস্পষ্ট দিগন্তে দেখেছে।
২৪. আর সে তো গায়েব সম্পর্কে কৃপণ নয়।
২৫. আর তা কোন অভিশপ্ত শয়তানের উক্তি নয়। 
২৬. সুতরাং তোমরা কোথায় যাচ্ছ?
২৭. এটাতো সৃষ্টিকুলের জন্য উপদেশমাত্র।
২৮. যে তোমাদের মধ্যে সরল পথে চলতে চায়, তার জন্য।
২৯. আর তোমরা ইচ্ছা করতে পার না, যদি না সৃষ্টিকুলের রব আল্লাহ ইচ্ছা করেন। 

সূরা আত-তাকভীর তাফসীর

Surah At-Takwir Tafseer

১. সূর্যকে যখন নিষ্প্রোভ করা হবে(১),
(১) আরবী ভাষায় তাকভীর মানে হচ্ছে গুটিয়ে নেয়া। মাথায় পাগড়ী বঁধার জন্য ‘তাকভীরুল ইমামাহ’ বলা হয়ে থাকে। কারণ ইমাম তথা পাগড়ী লম্বা কাপড়ের হয়ে থাকে এবং মাথার চারদিকে তা জড়িয়ে নিতে হয়। এই সাদৃশ্য ও সম্পর্কের কারণে সূর্য থেকে যে আলোক রশ্মি বিছুরিত হয়ে সমগ্র সৌরজগতে ছড়িয়ে পড়ে তাকে পাগড়ীর সাথে তুলনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, কিয়ামতের দিন এই সূর্যকে গুটিয়ে নেয়া হবে। অর্থাৎ তার আলোক বিচ্ছুরণ বন্ধ হয়ে যাবে। তাছাড়া كُوِّرَتْ এর অপর অর্থ নিক্ষেপ করাও হয়ে থাকে। হাদীসে এসেছে, “চাঁদ ও সূর্যকে কিয়ামতের দিন পেচিয়ে রাখা হবে।” [বুখারী: ৩২০০] [ইবন কাসীর]

২. আর যখন নক্ষত্ররাজি খসে পড়বে(১),
(১) অর্থাৎ যে বাঁধনের কারণে তারা নিজেদের কক্ষপথে ও নিজেদের জায়গায় বাধা আছে তা খুলে যাবে এবং সমস্ত গ্ৰহ-তারকা বিশ্ব-জাহানের চারদিকে ছড়িয়ে পড়বে। এ ছাড়াও তারা শুধু ছড়িয়েই পড়বে না। বরং এই সঙ্গে আলোহীন হয়ে অন্ধকারও হয়ে যাবে। [সা’দী]

৩. আর পর্বতসমূহকে যখন চলমান করা হবে(১),
(১) পাহাড়সমূহকে কয়েকটি পর্যায়ে চলমান করা হবে। প্রথমে তা বিক্ষিপ্ত বালুরাশির মত হবে, তারপর তা ধূনিত পশমের মত হবে, সবশেষে তা উৎক্ষিপ্ত ধূলিকণা হয়ে যাবে এবং তার জায়গায় আর অবস্থিত থাকবে না। [সা’দী]
৪. আর যখন পূর্ণগর্ভা মাদী উট উপেক্ষিত হবে(১),
(১) আরবদেরকে কিয়ামতের ভায়াবহ অবস্থা বুঝাবার জন্য এটি ছিল একটি চমৎকার বর্ণনা পদ্ধতি। কেননা কুরআন আরবদেরই সম্বোধন করা হয়েছে। আরবদের কাছে গর্ভবতী মাদী উট, যার প্রসবের সময় অতি নিকটে, তার চাইতে বেশী মূল্যবান আর কোন সম্পদই ছিল না। এ সময় তার হেফাজত ও দেখাশুনার জন্য সবচেয়ে বেশী যত্ন নেয়া হতো। এই ধরনের উষ্ট্রীদের থেকে লোকদের গাফেল হয়ে যাওয়ার মানে এই দাঁড়ায় যে, তখন নিশ্চয়ই এমন কোন কঠিন বিপদ লোকদের ওপর এসে পড়বে যার ফলে তাদের নিজেদের এই সবচেয়ে প্রিয় সম্পদ সংরক্ষণের কথা তাদের খেয়ালই থাকবে না। [ইবন কাসীর, সা’দী]

৫. আর যখন বন্য পশুগুলো একত্র করা হবে,
৬. আর যখন সাগরকে অগ্নি-উত্তাল করা হবে(১),
(১) এর কয়েকটি অর্থ রয়েছে। একটি অর্থ হল অগ্নিসংযোগ করা ও প্রজ্জ্বলিত করা। কেউ কেউ বলেন, সমুদ্রগুলোকে স্ফীত করা হবে। কেউ কেউ এর অর্থ নিয়েছেন, পানি পূর্ণ করা হবে। অন্য কেউ অর্থ নিয়েছেন মিশ্রিত করা অর্থাৎ সমস্ত সমুদ্র এক করে দেয়া হবে, ফলে লবনাক্ত ও সুমিষ্ট পানি একাকার হয়ে যাবে। হাসান ও কাতাদাহ রাহিমাহুমাল্লাহ বলেন, এর অর্থ তার পানিসমূহ নিঃশেষ হয়ে যাবে। ফলে তাতে এক ফোটা পানিও থাকবে না। [কুরতুবী]

৭. আর যখন আত্মাগুলোকে সমগোত্রীয়দের সাথে মিলিয়ে দেয়া হবে(১),
(১) এর অর্থ হচ্ছে, যখন মানুষকে জোড়া জোড়া করা হবে। অর্থাৎ মানুষের আমল অনুসারে তাদের শ্রেণীবিভাগ করা হবে। যখন হাশরে সমবেত লোকদেরকে বিভিন্ন দলে দলবদ্ধ করে দেয়া হবে। এই দলবদ্ধকরণ ঈমান ও কর্মের দিক দিয়ে করা হবে। কাফের এক জায়গায় ও মুমিন এক জায়গায়। কাফের এবং মুমিনের মধ্যেও কর্ম এবং অভ্যাসের পার্থক্য থাকে। এদিকে দিয়ে কাফেরদেরও বিভিন্ন প্রকার দল হবে আর মুমিনদেরও বিশ্বাস এবং কর্মের ভিত্তিতে দল হবে। যারা ভাল হোক মন্দ হোক একই প্রকার কর্ম করবে তাদেরকে এক জায়গায় জড়ো করা হবে।

উদাহরণত ইহুদীরা ইহুদীদের সাথে, নাসারারা নাসারাদের সাথে, মুনাফিকরা মুনাফিকদের সাথে এক জায়গায় সমবেত হবে। মূলত হাশরে লোকদের তিনটি প্রধান দল হবে- (১) পূর্ববর্তী সৎকর্মী লোকদের (২) আসহাবুল ইয়ামীনের এবং (৩) আসহাবুশ শিমালের দল। প্রথমোক্ত দুই দল মুক্তি পাবে এবং তৃতীয় দলটি হবে কাফের পাপাচারীদের। তারা মুক্তি পাবে না। [তাবারী, কুরতুবী] এ আয়াতের আরেকটি অর্থও হতে পারে। আর তা হল, “যখন আত্মাকে দেহের সাথে পুনঃমিলিত করা হবে। কেয়ামতের সময়ে সকলকে জীবিত করার জন্য প্রথমে দেহকে পুনরায় সৃষ্টি করা হবে। অতঃপর আত্মাকে দেহের সাথে সংযোজন করা হবে। [কুরতুবী, ইবন কাসীর] এ আয়াত এবং এর পূর্ববর্তী আয়াত থেকে কিয়ামতের দ্বিতীয় অংশের আলোচনা শুরু হচ্ছে।
৮. আর যখন জীবন্ত সমাধিস্থ কন্যাকে(১) জিজ্ঞেস করা হবে,
(১) الْمَوْءُودَةُ শব্দের অর্থ জীবন্ত প্রোথিত কন্যা। জাহেলিয়াত যুগের কোন কোন আরব গোত্র কন্যা সন্তানকে লজ্জাকর মনে করত এবং জীবন্তই মাটিতে প্রোথিত করে দিত। [ইবন কাসীর, কুরতুবী] পরবর্তীতে ইসলাম এই কুপ্রথার মূলোৎপাটন করে।

৯. কী অপরাধে তাকে হত্যা করা হয়েছিল?(১)
(১) কোনো কোনো মুফাস্‌সির বলেন, এই আয়াতের বর্ণনাভঙ্গীতে মারাত্মক ধরনের ক্রোধের প্রকাশ দেখা যায়। যে পিতা বা মাতা তাদের মেয়েকে জীবিত পুঁতে ফেলেছে আল্লাহর কাছে তারা এত বেশী ঘৃণিত হবে যে, তাদেরকে সম্বোধন করে একথা জিজ্ঞেস করা হবে না, তোমরা এই নিষ্পাপ শিশুটিকে হত্যা করেছিলে কোন অপরাধে? বরং তাদের দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে ছোট্ট নিরপরাধ মেয়েকে জিজ্ঞেস করা হবে, তোমাকে কোন অপরাধে মেরে ফেলা হয়েছিল? [ইবন কাসীর]

১০. আর যখন আমলনামাগুলো উন্মোচিত করা হবে,
১১. আর যখন আসমানের আবরণ অপসারিত করা হবে(১),
(১) كشطت এর আভিধানিক অর্থ জন্তুর চামড়া খসানো। [কুরতুবী] এর অর্থ অপসারণ করা, সরিয়ে নেয়া। এ হিসেবে আয়াতের অর্থ এই যে, যখন মাথার উপর ছাদের ন্যায় বিস্তৃত এই আকাশকে অপসারিত করা হবে। [মুয়াসসার, সা’দী]

১২. আর যখন জাহান্নামকে ভীষণভাবে প্ৰজ্বলিত করা হবে,
১৩. আর যখন জান্নাত নিকটবর্তী করা হবে
১৪. তখন প্রত্যেক ব্যক্তিই জানবে সে কি উপস্থিত করেছে।(১)
(১) অর্থাৎ কেয়ামতের উপরোক্ত পরিস্থিতিতে প্ৰত্যেকই জেনে নিবে সে কি নিয়ে এসেছে। অর্থাৎ সৎকর্ম কিংবা অসৎকর্ম সব তার দৃষ্টির সামনে এসে যাবে। [মুয়াস্‌সার]

১৫. সুতরাং আমি শপথ করছি পশ্চাদপসরণকারী নক্ষত্রের,
১৬. যা চলমান, অপসৃয়মাণ,
১৭. শপথ রাতের যখন তা শেষ হয়(১),
(১) عَسْعَسَ শব্দটির দুটি অর্থ হতে পারে। একটি উপরে আছে, তা হচ্ছে বিদায় নেয়া, শেষ হওয়া। অপর অর্থ হল আগমন করা, প্রবেশ করা। তখন আয়াতটির অর্থ হয়, শপথ রাতের, যখন তা আগমন করে। [ইবন কাসীর]
১৮. শপথ প্ৰভাতের যখন তার আবির্ভাব হয়,
১৯. নিশ্চয়ই এ কুরআন সম্মানিত রাসূলের আনীত বাণী(১)
(১) এখানে সম্মানিত বাণীবাহক (رَسُولٍ كَرِيمٍ) বলতে অহী আনার কাজে লিপ্ত ফেরেশতা জিবরীল আলাইহিস সালামকে বোঝানো হয়েছে। পরবর্তী আয়াতে এ-কথাটি আরো সুস্পষ্ট করে বলা হয়েছে। নবী-রাসূলগণের মতো ফেরেশতাগণের বেলায়ও রাসূল শব্দ ব্যবহৃত হয়। উল্লেখিত সবগুলো বিশেষণ জিবরীল আলাইহিস সালাম এর জন্যে বিনা দ্বিধায় প্রযোজ্য। তিনি যে শক্তিশালী, তা অন্যত্রও বলা হয়েছে, (عَلَّمَهُ شَدِيدُ الْقُوَىٰ) “তাঁকে শিক্ষা দান করে শক্তিশালী” [সূরা আন-নাজম: ৫]। তিনি যে আরাশ ও আকাশবাসী ফেরেশতাগণের মান্যবর তা মিরাজের হাদীস দ্বারা প্ৰমাণিত আছে; তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সাথে নিয়ে আকাশে পৌছলে তাঁর আদেশে ফেরেশতারা আকাশের দরজাসমূহ খুলে দেয়। তিনি যে أمين তথা বিশ্বাসভাজন তা বর্ণনার অপেক্ষা রাখে না; আল্লাহ্ তা'আলা নিজেই তার আমানত বা বিশ্বস্ততার ঘোষণা দিয়েছেন, তাকে অহীর আমানত দিয়েছেন। [ইবন কাসীর, কুরতুবী]

আর কুরআনকে “বাণীবাহকের বাণী” বলার অর্থ এই নয় যে, এটি ঐ সং ফেরেশতার নিজের কথা। বরং “বাণীবাহকের বাণী” শব্দ দুটিই একথা প্ৰকাশ করছে যে, এটি সেই সত্তার বাণী যিনি তাকে বাণীবাহক করে পাঠিয়েছেন। সূরা ‘আল হাক্কার ৪০ আয়াতে এভাবে কুরআনকে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বাণী বলা হয়েছে। সেখানেও এর অর্থ এই নয় যে, এটি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিজের রচনা। বরং একে “রাসূলে করীমের” বাণী বলে একথা সুস্পষ্ট করা হয়েছে যে, আল্লাহর রাসূল হিসেবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এটি পেশ করছেন, মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ হিসেবে নয়। উভয় স্থানে বাণীকে ফেরেশতা ও মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে সম্পর্কিত করার কারণ হচ্ছে এই যে, আল্লাহর বাণী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনে বাণীবহনকারী ফেরেশতার মুখ থেকে এবং লোকদের সামনে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুখ থেকে উচ্চারিত হচ্ছিল। [বাদায়িউত তাফসীর]
২০. যে সামৰ্থ্যশালী, আরশের মালিকের কাছে মর্যাদা সম্পন্ন,
২১. সে মান্য সেখানে, বিশ্বাসভাজন।(১)
(১) অর্থাৎ এই কুরআন একজন সম্মানিত দূতের আনীত কালাম। তিনি শক্তিশালী, আরশের অধিপতির কাছে মর্যাদাশীল। তিনি ফেরেশতাদের নিকট মান্য। সমস্ত ফেরেশতা তাকে মান্য করে। তিনি আল্লাহর বিশ্বাসভাজন; পয়গাম আনা নেয়ার কাজে তার তরফ থেকে বিশ্বাসভঙ্গ ও কম বেশী করার সম্ভাবনা নেই। নিজের পক্ষ থেকে তিনি কোন কথা আল্লাহর অহীর সাথে মিশিয়ে দেবেন না। বরং তিনি এমন পর্যায়ের আমানতদার যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে যা কিছু বলা হয় সেগুলো তিনি হুবহু পৌছিয়ে দেন। [মুয়াস্‌সার, সাদী]

২২. আর তোমাদের সাথী উন্মাদ নন(১),
(১) এখানে সাথী বলতে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বুঝানো হয়েছে। যারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে উন্মাদ বলত এতে তাদেরকে জওয়াব দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ তোমাদের এ ধারণা ঠিক নয় যে, কুরআনে যা কিছু বর্ণনা করা হচ্ছে এগুলো কোন পাগলের প্রলাপ বা শয়তানের বক্তব্য। [কুরতুবী]

২৩. তিনি তো তাকে স্পষ্ট দিগন্তে দেখেছেন(১),
(১) অর্থাৎ মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিবরীল আলাইহিস সালামকে প্রকাশ্য দিগন্তে, মূল আকৃতিতে দেখেছেন। অন্যত্র বলা হয়েছে, (فَاسْتَوَىٰ ٭ وَهُوَ بِالْأُفُقِ الْأَعْلَىٰ) “সে নিজ আকৃতিতে স্থির হয়েছিল, তখন সে ঊর্ধ্বদিগন্তে” [সূরা আন-নাজম: ৬–৭] [ইবন কাসীর] এই দেখার কথা বলার উদ্দেশ্য এই যে, তিনি ওহী নিয়ে আগমনকারী জিবরীল আলাইহিস সালাম এর সাথে পরিচিত ছিলেন। তাকে আসল আকার আকৃতিতেও দেখেছিলেন। তাই এই ওহীতে কোনরূপ সন্দেহ সংশয়ের অবকাশ নেই।
২৪. তিনি গায়েবী বিষয় সম্পর্কে কৃপণ নয়।(১)
(১) অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তোমাদের কাছ থেকে কোন কথা গোপন রাখেন না। গায়েব থেকে তার কাছে যে-সব তথ্য বা অহী আসে তা সবই তিনি একটুও কমবেশী না করে তোমাদের কাছে বর্ণনা করেন। [সা’দী]

২৫. আর এটা কোন অভিশপ্ত শয়তানের বাক্য নয়।
২৬. কাজেই তোমরা কোথায় যাচ্ছ?!
২৭. এ তো শুধু সৃষ্টিকুলের জন্য উপদেশ,
২৮. তোমাদের মধ্যে যে সরল পথে চলতে চায়, তার জন্য।(১)
(১) অন্য কথায় বলা যায়, এ বাণীটি তো সারা দুনিয়ার মানুষের জন্য উপদেশ একথা ঠিক, কিন্তু এর থেকে ফায়দা একমাত্র সেই ব্যক্তি হাসিল করতে পারে যে নিজে সত্যসরল পথে চলতে চায়। এ উপদেশ থেকে উপকৃত হবার জন্য মানুষের সত্য-সন্ধানী ও সত্য প্রিয় হওয়া প্ৰথম শর্ত। [বাদায়িউত তাফসীর]

২৯. আর তোমরা ইচ্ছে করতে পার না, যদি না সৃষ্টিকুলের রব আল্লাহ ইচ্ছে করেন।(১)
(১) অর্থাৎ তোমরা সরল পথে চলতে চাইলে এবং আল্লাহর দ্বীনের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকতে চাইলেই থাকতে পারবে না। যতক্ষণ আল্লাহ ইচ্ছা না করবেন। সুতরাং তাঁর কাছেই তাওফীক কামনা করো। তবে এটা সত্য যে, কেউ যদি আল্লাহর পথে চলতে ইচ্ছে করে তবে আল্লাহ্ও তাকে সেদিকে চলতে সহযোগিতা করেন। মূলত আল্লাহর ইচ্ছা হওয়ার পরই বান্দার সে পথে চলার তাওফীক হয়। বান্দার ইচ্ছা আল্লাহর ইচ্ছা অনুসারেই হয়। তবে যদি ভাল কাজ হয় তাতে আল্লাহর সস্তুষ্টি থাকে, এটাকে বলা হয় ‘আল্লাহর শরীয়তগত ইচ্ছা’। পক্ষান্তরে খারাপ কাজ হলে আল্লাহর ইচ্ছায় সংঘটিত হলেও তাতে তাঁর সন্তুষ্টি থাকে না। এটাকে বলা হয় ‘আল্লাহর প্রাকৃতিক ইচ্ছা’। এ দু' ধরনের ইচ্ছার মধ্যে পার্থক্য না করার কারণে অতীতে ও বর্তমানে অনেক দল ও ফেরকার উদ্ভব ঘটেছে। [দেখুন: ইবন তাইমিয়্যাহ, আল-ইস্তেকামাহ: ১/৪৩৩; মিনহাজুস সুন্নাহ: ৩/১৬৪]
তাফসীরে জাকারিয়া


********************
সাইটটি ভিজিট করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে এবং দীন ও মানবতার সেবায় অংশ নিতে OUR ACTION PLAN বাটনে ক্লিক করুন।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url