একজন ইমামের আত্ম কাহিনী || ইমামদেরও পরিবার আছে ||





এযুগেও ইমামদের বেতন নিয়ে কেউ ভাবেন না



১০কোটি টাকার মসজিদের ইমামের হাদিয়া বা বেতন মাত্র আট হাজার টাকা! ইমাম নিয়োগ দেওয়ার জন্য মসজিদে ইন্টারভিউয়ের আয়োজন করা হলো। ইসলামী ফাউন্ডেশন থেকে আলেমদের নিয়ে আসা হলো ইন্টারভিউ নিতে। এই নিয়ে বাজেট হলো মোট ৮০ হাজার টাকা। প্রায় দেড়শ আলেম থেকে বাছাই করে রাখা হলো যোগ্যতাসম্পন্ন একজন আলেমকে।

মাশাল্লাহ তিনি হাফেজ-মাওলানা-মুফতি। পোস্টারে এর আগে অনেক শর্তও জুড়ে দেয়া হয়েছিলো। যার মধ্যে হাফেজ-মাওলানা-মুফতি হওয়া ছিলো অন্যতম শর্ত। সবকিছুই ভালোভাবে সম্পন্ন হলো আলহামদুলিল্লাহ। ইমাম সাহেবের মাসিক হাদিয়া নির্ধারণ করা হলো 'সাত হাজার' টাকা।

এই বেতনেই চলছিলো ইমাম সাহেবের দিন। হঠাৎ একদিন ইমাম সাহেব বললেন, আমাদের একটা মিম্বর লাগবে। যেটায় দাঁড়িয়ে সুন্দর করে খুতবা দেওয়া যায়। মাশাল্লাহ এক সপ্তাহের মধ্যেই দেড়লাখ টাকা বাজেটের মিম্বর চলে আসলো৷ অন্য আরেক জুম্মায় আবার জানানো হলো, মসজিদের মাইকের সমস্যা। এটাও হয়ে আসলো সপ্তাহের ভিতরেই।  এভাবেই প্রতি জুম্মায় বড়ো কোনো বাজেটের ঘোষণা করা হয়, সপ্তাহের ভিতরেই সেটা সম্পন্ন হয়ে যায়।

কিন্তু ইমাম সাহেবের বেতনের কোনো পরিবর্তন নেই। এখনো সেই সাত হাজারই।

এভাবে চলতে চলতে ইমাম সাহেবের বয়স বেড়ে কালো দাড়ি সাদা হলো। পরিবারের সদস্য তিনজন থেকে ১০ জনে পরিণত হলো৷ কিন্তু তাঁর বেতন যেই সেই। তবে হে, অনেকদিন ইমামতি করার ফলে একটু দয়া দেখিয়ে বাড়ানো হলো এক হাজার।

মসজিদও কিছুটা পুরনো হলো৷ এদিকে পাশের মহল্লায় পাঁচকোটি টাকা বাজেটে নতুন তিন গম্বুজের মসজিদ নির্মাণ করা হলো। সেটা দেখে এই মহল্লার মানুষ ওঠে পরে লাগলো ঐ মহল্লার চেয়ে ভাল মসজিদ নির্মানের জন্য। এবার এই মহল্লার মানুষ ১০কোটি টাকার ছয় গম্বুজের মসজিদ নির্মাণের জন্য বাজেট হাতে নিলো । অল্প দিনেই কাজ সম্পন্ন হয়ে সুদর্শন একটি মসজিদ হয়ে গেলো।

ইমাম সাহেব এই এলাকার মুসল্লীগণকে নিয়ে প্রায়ই জুমু’আর বয়ানে গর্ব  করেন। এই এলাকার মানুষ খুবই দানশীল, ধর্মীয় বিষয়ে টাকা খরচ করতে কৃপণতা করেন না। ইমাম সাহেব এই মহল্লার মানুষের সূখ-শান্তির জন্য, পরকালীন মুক্তির জন্য প্রাণ খুলে দোয়া করেন সব সময়। ইমাম সাহেব এই মহল্লার মানুষের সুখ-শান্তি, ইমান-আমল আর ধর্মীয়- নৈতিকতা শিক্ষার ব্যাপারে যতটা আন্তরিক, মহল্লার মানুষকে ইমাম সাহেবের ব্যাপারে ততটা আন্তরিক কখনোই দেখা যায়নি।

শান শওকতওয়ালা মসজিদ হয়েছে কিন্তু ইমাম সাহেবের থাকার রুম এখনো সেই প্রশ্রাবখানার নিচেই আছে। স্টিলের জানালা মরিচা ধরে কিছুটা ভেঙ্গে পড়ে আছে। হার্ড বোর্ড দিয়ে কোনোমতে আটকে রেখেছেন তুফান থেকে বাঁচতে।

মসজিদে একেকটা ঝাঁড়বাতি লাগানো হলো একলাখ টাকা করে। কিন্তু ইমাম সাহেবের রুমে ২৫ টাকার সেকেলে বাল্ব এখনো নিভু নিভু করছে।

মসজিদে কয়েকটা এসি লাগানো হয়েছে। এসি গুলোর দামও একেকটার অনেক। কিন্তু ইমাম সাহেবে রুমে ২০ বছরের পুরনো জেনারেল কোম্পানির জঙ ধরা ফ্যানটা এখনো ঘেনর-ঘেনর করে ঘুরছে।

মসজিদের প্রশ্রাবখানার ফ্লোরও মোজাইক করা। কিন্তু ইমাম সাহেবের রুমে ইট বিছানো ফ্লোরের উপর ত্রিপল বিছানো, সেখান থেকে প্রায়ই বিভিন্ন কীট পতঙ্গ বেড়িয়ে আসে।

এভাবেই আটহাজার টাকার বেতনে শেষ হলো ইমাম সাহেবের জীবন৷ মসজিদ কমিটি তাঁর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করলো। শত ব্যস্ততার কারণে অনেকেই জানাযায়ও অংশ নিতে পারলো না। এদিকে আবারও মসজিদে ইমাম নিয়োগের ঘোষণা করা হলো। আর সকলে ভুলে গেলো সদ্য পরলোকগত ইমাম সাহেবের কথা।

যেই ইমাম সাহেব তাদের বাপ-দাদার দাফন করলো, জানাজা পড়ালো, প্রতি ওয়াক্ত নামাজের পর জিন্দা-মুর্দাদের জন্য দু'আ করলো, কবরবাসীদের মাগফিরাত কামনা করলো,  সেই ইমামের পরিবারের জন্য তারা কিছুই করতে পারলো না। তাঁর পরিবার কেমন আছে, সেই খোঁজ নেওয়ার জন্যও কাউকে পাওয়া গেলো না।

আলেম-ওলামাদেরকে আমরা অনেকেই ভালবাসি। কিন্তু বিশেষ বিশেষ সময়ে সেই ভালবাসাটুকুও থাকে না। আমরা প্রায়ই বুঝে না বুঝে তাদের বিরোধীতাও করে বসি কখনও কখনও। আট দশ হাজার টাকা হাদিয়া দেই, কখনও কখনও সেটা  নিয়েও বৈধতার প্রশ্ন তুলি। আহা রে মুসলিম!

দিনশেষে তারাও মানুষ!  সমাজের অবহেলিত একদল মানুষ! তাদেরও পরিবার আছে, স্ত্রী-সন্তান আছে, মা বাবা ভাই বোন আছে, খুব সামান্য সেই হাদিয়া নিয়েই তারা বেঁচে থাকেন। আমাদের অনেকেই দেশে কিংবা দেশের বাইরে বেড়াতে যান, সপ্তাহান্তে পরিবার নিয়ে দামী কোন হোটেলে খেতে যান কিন্তু আমাদের ইমাম সাহেব মসজিদের পাশের ছোট চা স্টলটিতেও কখনও যেতে পারেন না। অসংখ্য স্বপ্ন তাঁর কখনও পুরণ হয় না। হয়তো আমরা লোক দেখানো সম্মান তাদেরকে দেখাই, কিন্তু সত্যিকারের ভালবাসা তাদেরকে কখনোই দেখাই না। এ জাতি প্রকৃত অর্থে কখনও ইমামদের সম্মান দিতে জানেনি! মহান আল্লাহ যেন সমস্ত মৃত এবং জীবিত ইমামদের পরিপূর্ণ জাযা দান করেন, আল্লাহ যেন আলেম ওলামাগণের যোগ্য সম্মান রাস্ট্রীয়ভাবে কায়েম করেন,  আমিন।



***************************
সাইটটি ভিজিট করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আর্টিকেলটি ভাল লাগলে সত্য ও ন্যয়ের পথে অন্য ভাইনদেরকে দাওয়াতের নিয়তে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন। মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে এবং দীন ও মানবতার সেবায় অংশ নিতে OUR ACTION PLAN বাটনে ক্লিক করুন।



এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url