হজ্জ সফরের সহজ গাইড (পর্ব-৭)




মুযদালিফায় অবস্থান, জামরাত ও শয়তানকে কংকর নিক্ষেপ



(হজ, উমরা ও যিয়ারতের উদ্দেশ্যে সৌদি আরব যারা ভ্রমন করেন তাদের জন্য এটি অতি জরুরী একটি হজ গাইড)

আরাফার কিছু ভুলত্রুটি ও বিদ‘আত

  • আরাফার সীমানার বাইরে অথবা মসজিদে নামিরার সেই অংশে বসা, যা আরাফার সীমার বাইরে অবস্থিত। এছাড়া তাড়াতাড়ি সূর্যাস্তের পূর্বে মুযদালিফার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হওয়া।
  • সূর্যাস্তের আগেই আরাফা ত্যাগ করা, যারা এ কাজ করবে তাদের অবশ্যই আবার সূর্যাস্তের আগেই আরাফায় ফিরে আসতে হবে অথবা কাফফারাস্বরূপ একটি (দম) পশু যবেহ করতে হবে।
  • আরাফার পাহাড়ে আরোহণ করা, বা পাহাড়ের চূড়ায় আরোহনের জন্য ধাক্কাধাক্কি করা এবং সেখানে পাহাড়ের গায়ে হাত ঘষা ও সিজদা দিয়ে দো‘আ করা।
  • দুআ করার সময় জাবালে আরাফা পাহাড়ের দিকে মুখ করে হাত উঠিয়ে দো‘আ করা।
  • জাবালে আরাফা পাহাড়ের উপরস্থ ডোমে স্পর্শ করা, যা আদমের ডোম নামে পরিচিত এবং এখানে সালাত পড়া ও ডোম তাওয়াফ করা।
  • মসজিদে নামিরাতে খুৎবা শেষ করার আগেই যোহর ও আসরের আযান দেওয়া এবং সালাত পড়া।
  • যোহরের সালাতের পর ওয়াজ, দো‘আ ও মিলাদ করে দীর্ঘ সময় পর আসরের সালাত পড়া।
  • অনেকের ধারণা জুমু‘আর দিনে আরাফায় দাঁড়ানো ৭২টি হজযাত্রার সমান। এটির কোনো প্রমাণ নেই।
  • আরাফায় সন্ধ্যায় আরাফা পাহাড়ের উপর আগুন অথবা মোমবাতি জ্বালানো।
অনেকে দলবদ্ধ হয়ে মিলাদ পড়েন, বিনামূল্যের খাবার অনুসন্ধান করেন এবং ঈদের দিনের মতো কোলাকুলি মুসাফাহ করেন।

১০ যিলহজ মুযদালিফার রাত

  • এ রাতের মূল কাজ হলো মুযদালিফায় গমন করে মাগরিব ও এশার সালাত একসাথে পরপর কসর করে আদায় করা ও মুযদালিফায় ঘুমিয়ে রাত্রি যাপন করা এবং ফজরের সালাতের পর মিনা তথা জামরাতুল আকা‘বাহ’য় কংকর নিক্ষেপের উদ্দেশ্যে গমন করা।
  • মুযদালিফায় অবস্থান সাদামাটা জীবন যাপন, গৃহহীনতা ও অভাবের প্রতীক। মুযদালিফা এলাকা হারামের সীমার ভিতরে অবস্থিত। আরাফার সীমানা শেষ হলেই মুযদালিফা শুরু হয় না। আরাফা থেকে ৬ কি.মি. অতিক্রম করার পর আসে মুযদালিফা। মুযদালিফার পর কিছু অংশ ওয়াদি আল-মুহাসসির উপত্যকা এলাকা তারপর মিনা সীমানা শুরু। বর্তমানে মিনায় জায়গা সংকুলান না হওয়ায় মুযদালিফার একাংশ মিনা হিসাবে ব্যবহৃত হয়।
  • আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে বলেন, ‘‘তোমরা যখন আরাফার ময়দান থেকে ফিরে আসবে তখন মাশআরুল হারামের (মুযদালিফায়) কাছে এসে আল্লাহকে স্মরণ করবে, যেমনি করে আল্লাহ তোমাদের পথ বলে দিয়েছেন, তেমনি করে তাঁকে স্মরণ করবে, নিশ্চয় তোমরা পথভ্রষ্টদের দলে শামিল ছিলে”।[১]
  • রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুযদালিফায় অবস্থানের ফযীলত সম্পর্কে বলেছেন, ‘‘আল্লাহ তা‘আলা এ দিনে তোমাদের ওপর অনুকম্পা করেছেন, অতঃপর তিনি গুনাহগারদেরকে সৎকাজকারীদের কাছে সোপর্দ করেছেন। আর সৎকাজকারীরা যা চেয়েছে তা তিনি দিয়েছেন”।[২]
  • আরাফার ময়দানে সূর্যাস্তের পর মাগরিবের সালাত না পড়েই মুযদালিফার উদ্দেশ্যে আরাফা ত্যাগ করুন। সূর্যাস্তের পূর্বে আরাফা ত্যাগ করবেন না, করলেই দম দিতে হবে। ধীরে-সুস্থে শান্ত ভাবে যাত্রা শুরু করুন, বাসে আগে উঠার জন্য ধাক্কাধাক্কি করবেন না। রাস্তায় যেতে যেতে তালবিয়াহ পাঠ অব্যাহত রাখুন। আরাফা থেকে সকল বাস প্রায় একই সময়ে মুযদালিফার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। তাই রাস্তায় প্রচুর যানজটের সৃষ্টি হয়। তাই মুযদালিফায় বাসে যাওয়ার চেয়ে ছোট গ্রুপ করে পায়ে হেঁটে যাওয়াই ভালো, কারণ এতে আপনি খুব দ্রুতই মুযদালিফায় পৌঁছাতে পারবেন। সবসময় দলবদ্ধ হয়ে থাকার চেষ্টা করুন। এখানে দলছাড়া ও হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি। মুযদালিফায় পায়ে হেঁটে যাওয়ার জন্য আলাদা একমুখী রাস্তা আছে, এ রাস্তায় কোনো গাড়ি চলাচল করে না। তবে রাস্তা চেনা না থাকলে ও হারিয়ে যাওয়ার ভয় থাকলে বাসে যাওয়াই উত্তম।
  • মুযদালিফা সীমানার ভিতরে প্রবেশের পর বাস কোনো একটি সুবিধাজনক ফাঁকা জায়গায় দাঁড়াবে। মুযদালিফায় যখনই পৌছাবেন তখন প্রথম কাজ হলো মাগরিব ও এশার সালাত কসর করে পরপর আদায় করা। যদি একত্রে জামা‘আত করে পড়েন তবে প্রথমে একবার আযান ও তারপর এক ইকামাতের পর মাগরিবের তিন রাকাত ফরয সালাত এবং তার পরপরই ইকামাত দিয়ে এশার দুই রাকাত ফরয সালাত আদায় করবেন। এ দুই সালাতের মাঝখানে অন্য কোনো সালাত বা তাসবিহ পড়বেন না, শুধু এশার ফরয সালাতের পর বিতর সালাত পড়বেন।[৩]
  • মুযদালিফায় পৌছার পর যদি এশার সালাতের ওয়াক্ত না হয় তবে অপেক্ষা করতে হবে। আবার আপনি যদি প্রচণ্ড যানজটের কারণে মধ্যরাতের আগে মুযদালিফায় পৌঁছতে না পারেন, তাহলে পথিমধ্যে কোথাও যাত্রাবিরতি করে মাগরিব ও এশার সালাত পড়ে নিবেন।
  • সালাত আদায়ের পর আর কোনো কাজ নেই। এবার আপনি শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুযদালিফায় সুবহে সাদিক পর্যন্ত শুয়ে ঘুমিয়ে আরাম করেছেন। যেহেতু ১০ যিলহজ হাজীদের অনেক পরিশ্রম করতে হবে তাই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুযদালিফার রাতে বিশ্রাম করেছেন।
  • রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুযদালিফা থেকে মিনা যাওয়ার সময় সাতটি কংকর নিয়েছিলেন তা স্পষ্ট। অবশ্য মুযদালিফা থেকে কংকর নেওয়ায় কোনো সমস্যা নেই তবে উচিত হবে এটাকে জরুরী মনে না করা ও মুযদালিফার কংকরের বিশেষ গুণ আছে এমন ধারণা পোষণ না করা। পরবর্তীতে মিনা থেকে বা হারামের সীমানার ভিতরে যে কোনো স্থান থেকে কংকর সংগ্রহ করতে পারেন।
  • আপনি ইচ্ছা করলে এখান থেকে জামরায় পরবর্তী তিন দিন কংকর নিক্ষেপের জন্য (২১ ৩=৬৩) কংকর সংগ্রহ করতে পারেন। সব কংকরই এখান থেকে নেওয়া বিধান মনে করা যাবে না, কারণ মিনা থেকেও কংকর সংগ্রহের সময় ও সুযোগ পাওয়া যায়। তবে মিনার চেয়ে মুযদালিফায় কংকর সহজলভ্য বেশি।
  • কংকর নিক্ষেপের জন্য সংগৃহিত পাথরের আকার চনা বুটের দানা বা শিমের বিচির মতো হবে। বেশি বড় আকারের কংকর নেওয়া মাকরূহ। কংকর মুছার বা ধোয়ার কোনো নিয়ম হাদীসে কোথাও নেই। কিছু অতিরিক্ত কংকর নিবেন কারণ অনেক সময় কংকর হাত থেকে পড়ে হারিয়ে যায়। কংকরগুলো একটি ছোট ব্যাগ অথবা প্লাস্টিকের বোতলে সংরক্ষণ করে রাখুন। আবার আপনি যদি মুযদালিফা বা মিনা থেকে কংকর সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হন তাহলে অন্য কারো কাছ থেকেও কংকর নিতে পারেন। এতে কোনো সমস্যা নেই। এভাবে সবাই এতো কংকর এখান থেকে নিলে একদিন মুযদালিফার সব কংকর হয়তো শেষ হয়ে যেতে পারে বলে আপনার মনে যদি ধারণা জাগে তবে আপনাকে আশ্বস্ত করতে চাই, ইনশা-আল্লাহ এমনটি হবে না কখনো!
  • মুযদালিফা ও মিনার মধ্যবর্তী একটি জায়গার নাম ওয়াদী মুহাসসার। এটা মুযদালিফার অংশ নয়। তাই এখানে অবস্থান করা যাবে না। এ মুহাসসার এলাকায় আবরাহা রাজার হাতির বাহিনীকে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি কংকর নিক্ষেপ করে নাস্তানাবুদ করেছিল। ইতোপূর্বে এ কথাটি বলা হয়েছিল যে, বর্তমানে মুযদালিফার একাংশ মিনা হিসাবে ব্যবহার করা হয় হজযাত্রী সংকুলান না হওয়ার কারণে। তাই ঐ জায়গাটুকু মিনা হিসাবে ব্যবহৃত হলেও যেহেতু মৌলিক অর্থে মিনায় পরিনত হয় নি, তাই ঐ অংশে তাবুতে রাত্রিযাপন করলে মুযদালিফার রাত্রিযাপন হয়ে যাবে। ওয়াদী মুহাসসারেও এখন অবশ্য তাবু বিছিয়ে মিনা হিসাবে ব্যবহৃত হয়।
  • মুযদালিফায় রাত্রি যাপন করা ওয়াজিব
  • বৃদ্ধ ও দূর্বল পুরুষ-নারী, শিশু ও অসুস্থ ব্যক্তিগণ ওজর বা কারণ সাপেক্ষে মধ্যরাতের চাঁদ ডুবে যাওয়ার পর মুযদালিফা ত্যাগ করে মিনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হতে পারেন। অসুস্থ্য ও দুর্বলদের সাহায্যার্থে তাদের সাথে অভিভাবকরাও যেতে পারবেন। ওজর ছাড়া মুযদালিফা ত্যাগ করে মিনায় যাওয়া ঠিক হবে না। চলে গেলে দম দিতে হবে।[৪]
  • মুযদালিফায় সুবহে সাদিকে ঘুম থেকে উঠে একটু আগেভাগে আউয়াল ওয়াক্তেই ফজরের সালাত আদায় করে নিবেন। ফজরের সময় দুই রাকাত সুন্নাত ও দুই রাকাত ফরয সালাত আদায় করবেন। এবার মুযদালিফায় উকুফ করবেন, দো‘আ-যিকর করবেন ঠিক যেমন আল্লাহ করতে বলেছেন সূরা আল-বাকারা: ২:১৯৮ এবং সূরা-আল আ‘রাফ, ৭:২০৫ আয়াতে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুযদালিফায় ‘কুযাহ’ পাহাড়ের পাদদেশে উকুফ করেছেন। এ স্থানটি বর্তমানে আল মাশার-আল হারাম মসজিদের সন্মুখভাগে অবস্থিত। এ মসজিদটি মুযদালিফার ৫নং রোডের পাশে অবস্থিত এবং ১২ হাজার মুসল্লী ধারন ক্ষমতা রাখে। কিন্তু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘আমি এখানে উকুফ (অবস্থান) করলাম তবে মুযদালিফার পুরোটাই উকুফের স্থান”।[৫]
  • এবার কিবলার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে দুই হাত উঠিয়ে দো‘আ-যিকির, তাসবিহ করতে থাকুন, আল্লাহর প্রশংসা করুন: ‘‘আলহামদুলিল্লাহ’’- ‘‘সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য’’।
  • তাকবীরের মাধ্যমে আল্লাহর মহত্ব ঘোষণা করুন: ‘‘আল্লাহু আকবার’’- ‘‘আল্লাহ মহান’’।
  • কালেমা পাঠের মাধ্যমে আল্লাহর একত্ববাদ ঘোষণা করুন: ‘‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’’ -‘‘আল্লাহ ছাড়া সত্যিকার কোনো ইলাহ নেই’’।
এই দো‘আ-যিকিরগুলো বারবার পাঠ করতে থাকুন এবং যতক্ষণ না পূর্ব আকাশ ফর্সা হওয়া দৃশ্যমান হয় ততক্ষণ এ দো‘আগুলো পাঠ করতে থাকুন, আপনার পছন্দ মতো অন্য দো‘আও পাঠ করতে পারেন। অতঃপর সূর্যোদয়ের আগেই মিনার উদ্দেশ্যে রওনা হবেন।[৬]

[১] সূরা আল-বাকারা: ২:১৯৮
[২] ইবন মাজাহ, হাদীস নং ৩০২৩
[৩] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২২৫৬; সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৫৬০
[৪] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৫৬৪
[৫] সহীহ মুসলিম (২/৮৯৩)
[৬] আবু দাউদ

মুযদালিফা সম্পর্কিত কিছু তথ্য

  • হজের অন্যতম কঠিন ও কষ্টকর কাজ শুরু হয় এখান থেকে। সূর্যাস্তের পর আরাফাহ থেকে মুযদালিফার উদ্দেশ্যে বাস ছাড়ে। কিন্তু রাস্তায় ভারী যানজটের কারণে বাস তেমন একটা এগুতে পারে না। অনেক সময় যানজটের কারণে বাসের সংখ্যা কমিয়ে দেওয়া হয়, এতে পরিবহন সঙ্কটে যাত্রীরা বাসের ভেতর দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ক্লান্ত ও অসুস্থ্য হয়ে পড়েন। আপনার এজেন্সিকে পর্যাপ্ত পরিবহণের ব্যবস্থা রাখার জন্য সতর্ক করে দেবেন যাতে সব যাত্রী বাসে আসন পায়, কাউকে যেন দাঁড়িয়ে থাকতে না হয়।
  • ভারী যানজটের কারণে অনেকে বাস ছেড়ে দিয়ে হাঁটতে শুরু করেন, কারণ তাদের ধারণা এভাবে যানজটে বসে থাকলে মুযদালিফায় পৌঁছতে পারবেন না বা মুযদালিফায় রাত্রি যাপন করতে পারবেন না। আপনিও যদি এ অবস্থায় পড়েন তবে বাস ছাড়বেন কি ছাড়বেন না এ সিদ্ধান্তে আসা কঠিন। কারণ যদি বাস একবার ছেড়ে দেন তাহলে পায়ে হেঁটেই আপনাকে মিনা অথবা পরবর্তীতে জামরায় পৌঁছতে হতে পারে। এক্ষেত্রে দলনেতা অথবা অভিজ্ঞ ব্যক্তির পরামর্শ নিন।
  • আরাফা থেকে মুযদালিফার দূরত্ব ৬/৭ কি.মি. হলেও কিছু গাড়ি ফজরের আগে মুযদালিফা পৌঁছাতে পারে না। কিছু লোক মুযদালিফা এসে গেছে ধারণা করে অন্যদের দেখাদেখি মাঝপথে মাগরিব-এশা পড়ে রাত্রি যাপন করে। অবশেষে ফজর বাদ মুযদালিফার সীমানায় এসে সাইনবোর্ড দেখে তাদের ভুল বুঝতে পেরে আক্ষেপ করে। এভাবে হজের একটি গুরুত্বপূর্ণ ওয়াজিব ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যায় অনেক হাজীর।
  • মুযদালিফায় কোনো তাবু নেই। আপনার বাস এখানে পৌঁছার পর পার্কিং এলাকায় পার্ক করবে অথবা রাস্তার পাশে রেখে দেবে। আপনি চাইলে বাসের মধ্যে অথবা বাইরে খোলা আকাশের নিচে একটু সমতল ভূমিতে ম্যাট বিছিয়ে শুয়ে ঘুমাতে পারেন। আপনি দেখবেন অনেকে রাস্তার পাশে, কেউ পাহাড়ের ঢালে ঘুমিয়ে আছে। এখানে টয়লেটের সংখ্যা খুবই কম তাই এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।
  • আপনি এখানে রাতের বেলায় খাবার ও পানি কেনার জন্য দোকান পাবেন না। এ কারণে কিছু খাবার ও পানীয় মজুদ রাখলে ভালো হয়। ফজরের সালাত আদায় করার জন্য প্রয়োজনে মাটি দিয়ে তায়াম্মুম করে নেবেন।

মুযদালিফায় প্রচলিত ভুলত্রুটি ও বিদ‘আত

  • মুযদালিফার উদ্দেশ্যে আরাফা ত্যাগ করার সময় তাড়াহুড়া করা।
  • মুযদালিফায় রাত কাটানোর জন্য গোসল করা।
  • মুযদালিফাকে পবিত্র এলাকা গণ্য করে পায়ে হেঁটে এলাকায় প্রবেশ করা।
  • মুযদালিফায় পৌঁছার পর এ দো‘আ করা সুন্নাত মনে করা, (হে আল্লাহ এ মুযদালিফা, এখানে একত্রে অনেক ভাষা এসেছে..।)
  • দুই সালাতের মাঝে মাগরিবের সুন্নাত সালাত পড়া ও এশার পর সুন্নাত পড়া।
  • মুযদালিফায় পৌঁছে মাগরিব ও এশার সালাত পড়ার আগে কংকর নিক্ষেপের কংকর সংগ্রহ করা।
  • কংকর শুধু মুযদালিফা থেকে সংগ্রহ করতে হবে এ ধারণা পোষণ করা।
  • মুযদালিফায় জাগ্রত অবস্থায় রাত কাটানো।
  • পুরো রাত যাপন করা ছাড়াই কিছুক্ষণ অবস্থান করে মুযদালিফায় থেকে বের হয়ে যাওয়া।
  • ‘আল মাশার আল হারাম’ পৌঁছার পর এ দো‘আ পাঠ করা নিয়ম মনে করা, (হে আল্লাহ আমি এ রাতের মাধ্যমে আপনার কাছে প্রার্থনা করছি..।)
  • মুযদালিফা থেকে কংকর নিক্ষেপের জন্য ৭টি কংকর নেওয়া এবং বাকি সব কংকর ওয়াদী মুহাসসারের পাশ থেকে নেওয়া রীতি মনে করা।

১০ যিলহজ বড় জামরায় কংকর নিক্ষেপ করা

  • ১০ই জিলহজের দিনটি হজের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ দিনটিকে হজের বড় দিন হিসাবে উল্লেখ করেছেন। এ দিনে ৪টি কাজ সম্পাদন করতে হবে; প্রথমত বড় জামরায় কংকর নিক্ষেপ করা (রমি করা), দ্বিতীয়ত হাদী বা পশু জবেহ করা, তৃতীয়ত কসর/হলক্ব করা, চতুর্থত তাওয়াফুল ইফাদাহ করা ও সা‘ঈ করা।[১]
  • জামরাত এলাকা দিয়ে ইবরাহীম আলাইহিস সালাম ইসমাঈল আলাইহিস সালামকে যবেহ করতে নিয়ে যাচ্ছিলেন ও শয়তান তাঁকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছিল এবং তিনি শয়তানকে কংকর নিক্ষেপ করেছিলেন। জামরাতে শয়তান বাঁধা আছে বলে যে কেউ কেউ ধারণা করে তা মোটেই ঠিক নয়। আবার অনেকে জামরাতকে বড় শয়তান, ছোট শয়তান নামে ডাকে যা সঠিক নয়। জামারাত এলাকা মিনার সীমানার মধ্যে পড়ে। কংকর নিক্ষেপ বা রামি করা আল্লাহর নিদর্শনসমূহে‎র অন্যতম। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘বায়তুল্লাহ তাওয়াফ, সাফা মারওয়া সা‘ঈ ও জামরাতে কংকর নিক্ষেপ আল্লাহর যিকির কায়েমের উদ্দেশ্যে।’’ হাদীসে আরও এসেছে ‘‘আর তোমার কংকর নিক্ষেপ, সে তো তোমার জন্য সঞ্চিত করে রাখা হয়”।[২]
  • সূর্যোদয়ের আগেই তালবিয়াহ পাঠরত অবস্থায় মিনার উদ্দেশ্যে মুযদালিফা ত্যাগ করুন। এসময়ও রাস্তায় প্রচুর গাড়ির ভীড় হয়। অনেক সময় রাস্তায় অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়ে যাওয়ার কারণে বাস আর মিনায় ঢ়ুকতে দেওয়া হয় না। তাই এখান থেকে ১০-১৫কি:মি: হাঁটার মন-মানসিকতা রাখুন। আসলে এখান থেকে মিনা হয়ে জামরাতে হেঁটে যাওয়াই উত্তম। তবে সবসময় দলবদ্ধ হয়ে থাকুন, কারণ এখানে অনেক লোক হারিয়ে দলছাড়া হয়ে যায়। যখন মুহাসসার উপত্যকা পার হবেন তখন একটু তাড়াতাড়ি যাওয়ার চেষ্টা করুন তবে শান্ত ও সুস্থিরভাবে চলুন-কারণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমনটাই করেছেন। আর আপনি যদি বাসে থাকেন, তবে বাস তার নিজস্ব গতিতেই যাবে। জামরাত যাওয়ার পথে যদি আপনার মিনার তাবু সামনে এসে যায় তবে তাবুতে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে ও কিছু খাওয়া দাওয়া করে তারপর জামরাতের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। তালবিয়াহ বেশি বেশি করে পাঠ করা অব্যাহত রাখুন, কারণ তালবিয়াহ পাঠ এর সময় শেষ হয়ে আসছে। এসময় দলনেতা একটি পতাকা নিয়ে সকলকে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেলে উত্তম হয়।[৩]
  • রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সূর্য উঠার ১-২ ঘন্টার মধ্যে কংকর মেরেছিলেন। সে হিসাবে সূর্য পশ্চিমে ঢলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত কংকর নিক্ষেপ করা সুন্নাত। অবশ্য সূর্য উঠা থেকে শুরু করে ১১ যিলহজ সুবহে সাদিক পর্যন্ত কংকর মারা জায়েয। বর্তমানে যেহেতু ৩০ লক্ষাধিক হাজীর সুন্নাত সময়ের মধ্যে কংকর মারা দুঃসাধ্য ও অনেকের পক্ষে কষ্টকর তাই একটু দেরী করে ও খবর নিয়ে কম ভিড়ের সময়ে কংকর নিক্ষেপ করতে যাওয়া উত্তম।[৪]
  • নারী, বালক, অসুস্থ্য ও বৃদ্ধরা যারা মুযদালিফা থেকে মধ্যরাতে মিনায় চলে এসেছেন তারা ১০ তারিখ সূর্য উঠার আগেই কংকর নিক্ষেপ করতে পারেন। তবে এ সময়ে রাস্তায় বিপরীতমুখী প্রচণ্ড ভীড় থাকার কারণে তাদের আবার জামরাত থেকে মিনায় ফিরে আসা কঠিন ব্যাপার হয়ে যায়। সাধারণত দেখা যায় বিকেল বেলায় বা রাতে জামরাত ফাঁকা থাকে। এ সময়ে নারী, বালক, অসুস্থ্য ও বৃদ্ধদের কংকর নিক্ষেপ করা সহজ হয়।[৫]
  • অসুস্থ্য ও বৃদ্ধ নারী-পুরুষ, শিশু-বালকদের পক্ষ থেকে অন্য যে কেউ তার প্রতিনিধি হিসাবে রমি করতে পারবেন। এক্ষেত্রে প্রতিনিধি ব্যক্তি সেই বছর হজ আদায়কারী হতে হবে এবং প্রথমে তার নিজের কংকর নিক্ষেপ করবেন ও তারপর অন্যের কংকর নিক্ষেপ করবেন। আজকাল অনেককে দেখা যায়; বিশেষ করে নারীরা ক্ষীণ শারিরীক দুর্বলতা ও অসুস্থতার অজুহাতে রমি করতে না গিয়ে অন্যকে নিযুক্ত করেন ও তাবুতে ঘুমিয়ে সময় পার করেন। এমনটি করা অনুচিত। নিজের কংকর নিজে মারা উত্তম। একেবারে চলতে অপারগ বা ওখানে গেলে পরে আরও অসুস্থ্য হওয়ার সম্ভাবনা আছে বা জামরাতে প্রচণ্ড লোকের ভীড়-এমন গুরুতর ওজর ছাড়া সকলেরই জামরাতে যাওয়া উচিত।
  • এবার পায়ে হেঁটে জামরাত এলাকায় যান। হাঁটতে হাঁটতে তালবিয়াহ পাঠ করতে থাকুন। বর্তমানে কংকর নিক্ষেপের সুবিধা উন্নত করা হয়েছে। এখন আপনি এখানে নিচতলা/দ্বিতীয় তলা/তৃতীয় তলা/চতুর্থ তলা থেকেও কংকর নিক্ষেপ করতে পারবেন।
  • জামরাতের যে কোনো এক ফ্লোরে লিফট অথবা এস্কেলেটরে উঠে এরপর পায়ে হেঁটে বড় জামরাহর কাছে আসুন। আপনি যেহেতু মিনার খাইফ মসজিদের দিক থেকে জামরাতে ঢুকেছেন সেহেতু পথে আপনি প্রথমে ছোট জামরাহ (জামরাতুল সুগরা) ও তারপর মধ্যম জামরাহ (জামরাতুল উস্তা) অতিক্রম করবেন এবং অতঃপর সবশেষে পৌঁছাবেন বড় জামরাহর (জামরাতুল ‘আকাবাহর) কাছে। সোজাসুজি বড় জামরাহর দিকে কংকর মারতে না গিয়ে চারদিকে খানিকটা ঘোরা ফেরা করে ভিড় কম এমন একটি জায়গা খুঁজে বের করুন। বড় জামরার কাছে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে তালবিয়াহ পাঠ বন্ধ করে দেবেন। তালবিয়াহ পাঠ এখানেই শেষ।
  • যদি সম্ভব হয় জামরাকে সামনে রেখে কা‘বাকে বামে ও মিনাকে ডানে রেখে অথবা যে কোনোভাবে সুবিধামত দাঁড়িয়ে ডান হাত উচু করে আলাদা আলাদাভাবে ৭টি কংকর একে একে নিক্ষেপ করুন এবং প্রতিবার নিক্ষেপের শুরুতে বলুন: اَللهُ أَكْبَرُ ‘‘আল্লাহু আকবার’’ ‘‘আল্লাহ মহান’’।
  • জামরার হাউজ বা বেসিনে বুক লাগিয়ে অথবা ২-৩ মিটার দূরত্ব থেকে জামরায় রমি করুন। কংকরগুলো যেন জামরার দেওয়ালে আঘাত করে অথবা জামরার বেসিনের মধ্যে পড়ে সেটা নিশ্চিত করুন। যদি কোনো কংকর বেসিনের মধ্যে না পড়ে তবে তার পরিবর্তে আবার একটি কংকর নিক্ষেপ করুন। সে কারণে সঙ্গে অতিরিক্ত কংকর নিয়ে নেবেন। কংকর যদি জামরার দেওয়ালে লেগে বা বেসিনের মধ্য থেকে ছিটকে বাইরে পরে যায় তাতে সমস্যা নেই। কংকর আংগুল দিয়ে যে কোনভাবে ধরে নিক্ষেপ করা যাবে। এজন্য নির্দিষ্ট কোনো নিয়ম নেই। নিজের কংকর নিক্ষেপ হয়ে গেলে ঠিক একই নিয়মে অন্যের কংকর নিক্ষেপ করতে পারেন। খুশু-খুজুর সাথে কংকর নিক্ষেপ করুন।
  • বড় জামরাহে কংকর নিক্ষেপ করা ওয়াজিব।
  • কংকর নিক্ষেপ শেষে তাকবীরে তাশরিক পড়া শুরু করুন এবং ১৩ যিলহজ আসরের সালাত পর্যন্ত চলবে এ তাকবীর। প্রতি ফরয সালাতের পর উচ্চস্বরে এ তাকবীর পড়ুন।
اَلله أَكْبَرُ، اَللهُ أَكْبَرُ، لاَ إِلهَ إِلَّا اللهُ وَاللهُ أَكْبَرُ، اَللهُ أَكْبَرُ وَلِلّٰهِ الْحَمْدُ

‘‘আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, ওয়ালিল্লাহিল হামদ’’।

‘‘আল্লাহ মহান, আল্লাহ মহান, আল্লাহ ছাড়া সত্যিকার কোনো ইলাহ নেই, আল্লাহ মহান, আল্লাহ মহান। সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য’’।

  • রমি করা শেষে এখানে দাঁড়িয়ে দো‘আ করার কোনো নিয়ম হাদীসে পাওয়া যায় না। জামরাহ থেকে বের হয়ে এস্কেলেটর বা লিফট দিয়ে মক্কার দিকে নেমে পড়ুন। এবার হাদী বা পশু জবাই এর জন্য মু‘আইসম বা অন্য কোনো স্থান যেখানে আপনি আগে থেকেই নির্ধারণ করেছেন সেখানে চলে যাবেন।
আর যদি ব্যাংকে টাকা দিয়ে থাকেন, তাহলে আর আপনার কোনো করণীয় নেই। আপনি মাথা মুণ্ডিয়ে কিংবা চুল ছোট করে হালাল হয়ে যাবেন।

[১] আবু দাউদ, হাদীস নং ১৯৪৫
[২] আবু দাউদ-১৬১২; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৩৪৮
[৩] আবু দাউদ, দারেমী
[৪] সুনান নাসাঈ, হাদীস নং ৩০১৩
[৫] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১২৯০

জামরাত সম্পর্কিত কিছু তথ্য

  • ইতোপূর্বে কয়েক বছর আগেও জামরাতে অনেক লোক পদদলিত হয়ে মারা যেত। সে কারণে অনেকে জামরাতে যেতে ভয় করত। কিন্তু বর্তমানে কংকর নিক্ষেপের নিরাপদ ও সহজ ব্যবস্থা করা হয়েছে।
  • জামরাতে কংকর নিক্ষেপের সকল রাস্তা একমুখি। আপনি যদি মিনা থেকে জামরাতে আসেন তাহলে আপনি ভিতরে প্রবেশের জন্য বেশ কয়েকটি গেট পাবেন। এস্কেলেটরে করে আপনি সহজে উপরে আরোহন করতে পারবেন। কংকর নিক্ষেপের পর আপনাকে জামরাতের অন্য দিকে নামিয়ে দেওয়া হবে, অর্থাৎ মক্কার দিকে।
  • জামরাতে অনেক নিরাপত্তাকর্মী ও হজযাত্রী ব্যবস্থাপনার লোক দেখতে পাবেন। বড় ব্যাগ মাথায় বা কাঁধে নিয়ে জামরাতে যাবেন না, তাহলে নিরাপত্তাকর্মীরা আপনাকে আটকিয়ে দেবে এবং আপনাকে ভেতরে নাও যেতে দিতে পারে। তবে ছোট হাত ব্যাগ বা কাঁধ ব্যাগ থাকলে সমস্যা নেই।
  • জামরাত বিল্ডিংয়ের ভিতর দিয়ে যাওয়ার পথে আপনি বিশাল আকারের অনেকগুলো এয়ারকুলার ফ্যান দেখতে পাবেন, হজযাত্রীদের শীতল বাতাস প্রদানের জন্য এখানে ফ্যানের ব্যবস্থা করা আছে। জামরাতের চারপাশে অনেক কংকর ও প্লাস্টিকের বোতল পড়ে থাকতে দেখবেন। অনেক লোকই এখানে এসে হারিয়ে যান, তাই আপনি সবসময় আপনার দলের সঙ্গেই থাকুন। দলনেতার হাতে ছোট পতাকা থাকলে ভালো হয়।
একটি বিষয় মনে রাখবেন, প্রতিদিন কংকর নিক্ষেপের জন্য আপনাকে মিনা থেকে হেঁটে জামরাতে আসতে হবে, আবার হেঁটেই জামরাত থেকে মিনার তাবুতে ফিরে যেতে হবে। তাই হাঁটার প্রস্তুতি রাখুন। তবে আপনি দেখবেন যাদের শাটল ট্রেনের টিকিট কাটা আছে তারা মিনা থেকে ট্রেনে জামরাতের একেবারে কাছে এসে কংকর নিক্ষেপ করতে পারেন। কিছু সৌদি ভিআইপি অতিথি হজযাত্রীকে কংকর নিক্ষেপের করার জন্য হেলিকপ্টারে করে জামরাত ভবনের ছাদে অবতরণ করতে দেখবেন।

কংকর নিক্ষেপের সময় প্রচলিত ভুলত্রুটি ও বিদ‘আত

  • কংকর নিক্ষেপের জন্য গোসল বা অযু করা।
  • কংকর নিক্ষেপের আগে কংকর ধুয়ে নেওয়া।
  • একসাথে ২/৩টি বা ৭টি কংকর একত্রে নিক্ষেপ করা।
  • তাকবীরের স্থলে সুবহানাল্লাহ বা অন্য কোনো যিকির করা। তাকবীরের সাথে কোনো কিছু যোগ করে বলা।
  • অনেকের ধারণা তারা আসল শয়তানের গায়ে কংকর নিক্ষেপ করছেন, এজন্য তারা খুব রাগান্বিত হয়ে ওই জামরাহগুলোকে অপমান ও গালাগালি করেন।
  • জামরাতে বড় কংকর অথবা স্যান্ডেল বা কাঠের খন্ড নিক্ষেপ-এ ধরনের কাজ করা বাড়াবাড়ি, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন কাজ করতে নিষেধ করেছেন।
  • কংকর কাছ থেকে মারার জন্য ঠেলাঠেলি বা ধাক্কাধাক্কি করা।
  • কংকর নিক্ষেপের জন্য নির্দিষ্ট পন্থা: অনেকের বক্তব্য: ডানহাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি তর্জনির কেন্দ্রের ওপর রেখে (চিমটি করে লবণ নেওয়ার মতো করে) এবং কংকরটি তার বৃদ্ধাঙ্গুলির পিছনের দিকে রেখে নিক্ষেপ করতে হবে।
  • আবার অনেকে বলেন: তর্জনী বাঁকা করে বৃত্তের মতো বানিয়ে বৃদ্ধাগুলির জোড়া-সন্ধিতে লাগিয়ে দিতে হবে, দেখতে অনেকটা ১০-এর মতো হবে।
  • কংকর নিক্ষেপের জন্য দাঁড়ানোর স্থান নির্ধারণ করা অথবা জামরাহ ও ব্যক্তির মাঝে অন্তত পাঁচ হাত দূরত্ব থাকতে হবে এমন ধারণা পোষণ করা।

১০ যিলহজ হাদী

  • আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য তামাত্তু ও কিরান হজ আদায়কারীরা যে উট, গরু, ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা ইত্যাদি পশু বাধ্যতামূলকভাবে জবেহ করে থাকেন তাকে হাদী বলা হয়। অনেকে বলে থাকেন এটা হজের কুরবানি, কিন্তু আসলে হজের ক্ষেত্রে এর নাম হলো হাদী। কুরবানি, হাদী ও দম এগুলোর মধ্যে কিছু পার্থক্য রয়েছে। কুরবানীর উপলক্ষ্য হলো ঈদ, হাদীর উপলক্ষ্য হজ আর দমের উপলক্ষ্য হলো কাফফারা আদায়। কুরবানী পৃথিবীর যে কোনো জায়গায় করা যায়। হাদী শুধুমাত্র হারাম এলাকা তথা মক্কা, মিনা ও মুযদালিফায় করা যাবে। দম হারামের সীমানার ভিতর আদায় করতে হবে। হাদী ও কুরবানীর গোস্ত নিজে খাওয়া যাবে কিন্তু দম এর গোস্ত নিজে খাওয়া যাবে না। যারা হজের সময় হাদী করছেন তারা যেহেতু মুসাফির তাই তাদের আর সেই বছর কুরবানী করা জরুরী নয়, তবে চাইলে করতে পারেন। ১০ যিলহজ সূর্যোদয় থেকে শুরু করে ১৩ যিলহজ সূর্যাস্ত পর্যন্ত হাদী করা যায়। হজে তামাত্তু ও হজে ক্বীরান হজকারীদের ওপর হাদী প্রদান করা ওয়াজিব।
  • হারাম এলাকা তথা মিনা, মুযদালিফা ও মক্কার যে কোনো অংশে পশু যবেহ করা যাবে, কারণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আমি এখানে যবেহ করেছি এবং মিনার সকল স্থানই যবেহ করার জায়গা, সকল পাহাড়ে ও গিরিপথের কাছে।
  • হাদীর পশু পুরুষ অথবা স্ত্রী দুটিই হতে পারে। প্রাণীর বয়স প্রকার: কমপক্ষে দুম্বা- ছয় মাস, ভেড়া- এক বছর, ছাগল- এক বছর, গরু- দু’বছর ও উট- পাঁচ বছর। প্রাণী একচোখ ওয়ালা, অসুস্থ, খোঁড়া পা ওয়ালা, খুবই দুর্বল হওয়া যাবে না।[১]
  • উট ও গরু হলে একটা পশু সর্বোচ্চ সাত জনে বা এর কম সংখ্যায় (জোড় বা বিজোড়) অংশ নিতে পারবেন। আর ভেড়া বা ছাগল হলে একজনের জন্য একটা পশু যবেহ করতে হবে। যবেহ করা পশুর গোশত চাইলে নিজে খাওয়া যাবে এবং সাথে করে দেশেও নিয়ে আসা যাবে, যেমনটা করেছেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। যবেহ করা পশুর গোশত গরীব ও মিসকীন লোকদের বেশি পরিমাণে বিতরণ করা বাঞ্চণীয়।
  • কেউ হাদী করতে না পারলে এর পরিবর্তে তিনি হজের পরবর্তী তিন দিন এবং দেশে ফিরে ৭ দিন (ধারাবাহিকভাবে অথবা ভেঙ্গে ভেঙ্গে) সাওম রাখবেন। মক্কাবাসীদের হাদী করা ওয়াজিব নয়, এমনকি সাওমও রাখতে হবে না।[২]
  • হাদী তিন পদ্ধতিতে আদায় করতে পারেন। প্রথমত, ব্যাংকের মাধ্যমে হাদী যবেহ করার ব্যবস্থা করা। দ্বিতীয়ত, আপনার হজ এজেন্সির মাধ্যমে। তৃতীয়ত, নিজে হাট থেকে হাদী কিনে করা যায়। মিনায় তাবু এলাকায় কোথাও হাদী যবাই করা দেখতে পাবেন না। হাদী করার জন্য নির্ধারিত আলাদা জায়গা আছে মু‘আইসিম নামক এলাকায় যা মিনার সীমানার ভিতর অবস্থিত।
  • ব্যাংকের মাধ্যমে হাদী করা সবচেয়ে বিশ্বস্ত পন্থা। হজের পূর্বে আল-রাজী ব্যাংক বা অন্য কোনো ব্যাংক এর বুথে হাদীর জন্য ৪৫০-৫০০ রিয়াল জমা দিয়ে রশিদ বা টিকিট সংগ্রহ করুন। সাধারণত ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ১০ যিলহজ সকাল ১০টা থেকে হাদী জবেহ করা শুরু করেন এবং যারা মোবাইল নং দেন তাদের এস.এম.এস এর মাধ্যমে হাদী সম্পন্ন করা নিশ্চিত করেন। মক্কা ও মদীনায় অনেক হাদীর টাকা জমা দেওয়ার ছোট ছোট ব্যাংক বুথ দেখতে পাবেন। হজের একটু আগেভাগেই টিকেট ক্রয় করা উত্তম, নইলে পরে হাদী টিকেট পাওয়া যায় না।
  • আপনারা কয়েকজনে আপনার হজ এজেন্সির নেতাকে হাদীর টাকা দিয়ে দিতে পারেন। আপনার হজ এজেন্সি নেতা তিনি মিনায় হাট থেকে হাদী ক্রয় করে জবেহ করার ব্যবস্থা করতে পারেন। আবার আপনি নিজে মিনায় হাটে গিয়ে পশু ক্রয় করে জবেহ করতে পারেন। এমন করলে আপনি কিছু গোস্ত খাওয়ার জন্য নিয়ে আসতে পারেন। তবে সাধারণ হাজীদের পক্ষে হাটে যাওয়া সম্ভব নয়, তাই প্রথম দুইটির যে কোনো একটি পদ্ধতি অনুসরণ করুন।
  • নিজ হাতে যবেহ করা সুন্নাত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হজে ৬৩টি উট জবেহ করেছিলেন। যবেহ করার সময় প্রাণীর মুখ থাকবে দক্ষিণ দিকে এবং পশুকে বাম দিকে কাত করে শোয়াতে হবে ও এর পা গুলো ডান দিকে অতঃপর কিবলামুখি হয়ে ছুরি চালাতে হবে।[৩]
  • যবেহ করার সময় এ দো‘আ পাঠ করুন:
بِسْمِ اللهِ وَاللهُ أَكْبَرُ، اَللهم مِنْكَ وَلَكَ، اَللهم تَقَبَّلْ مِنِّي.ْ

‘‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবর, আল্লাহুম্মা মিনকা ওয়ালাকা আল্লাহুম্মা তাক্বাব্বাল মিন্নী’’।

‘‘আল্লাহর নামে, আল্লাহ মহান।হে আল্লাহ! এ প্রাণী আপনার পক্ষ থেকে এবং এর মালিক আপনি। হে আল্লাহ! আমার এটি আপনি কবুল করুন’’।

সতর্কতা: হজের সময় কিছু অসাধু লোক মিনার তাবুতে এসে হাদী করানোর নামে ভূয়া রশিদ দিয়ে টাকা নিয়ে প্রতারণা করে। হাদী যবেহ না করেই ফোন করে জানিয়ে দেন হাদী হয়ে গেছে! তাই ব্যাংক ছাড়া কারো হাতে এমনি টাকা দিবেন না। আবার কিছু হজ এজেন্সির নেতারাও একই প্রতারণা করেন। তাই আপনার দলের কয়েকজন লোক এজেন্সি নেতার সাথে সরেজমিনে গিয়ে হাদী ক্রয় করা ও যবেহ প্রত্যক্ষ করে অন্যান্য সহযাত্রীদের ফোন করে অবহিত করতে পারেন। হাদী শেষে মিনা অথবা মক্কার পথে রওনা হউন এবং পথিমধ্যে কসর/হলক্ব সেরে ফেলুন।

[১] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৯৯৭, ১৯৯৮
[২] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১২২৮; ইবন খুযাইমা, হাদীস নং ২৮৫৭
[৩] ইবন মাজাহ

১০ যিলহজ কসর

(হলক্ব করা)
  • হাদী করার পর মাথার সকল অংশ থেকে সমানভাবে চুল ছেঁটে ফেলাকে কসর আর সম্পূর্ণ মাথা মুড়িয়ে বা মুণ্ডন করাকে হলক্ব বলা হয়। তবে মুণ্ডন করাই উত্তম। কুরআনে মাথা মুণ্ডন করার কথা আগে এসেছে আর ছোট করার কথা পরে এসেছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সমস্ত মাথা মুণ্ডন করেছিলেন।
  • যারা মাথা মুণ্ডন করেছিলেন তাদের জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রহমত ও মাগফিরাতের দো‘আ করেছেন তিনবার। আর যারা চুল ছোট করেছিলেন তাদের জন্য দো‘আ করেছেন একবার। আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে বলেন, ‘‘তোমাদের কেউ মাথা মুণ্ডন করবে ও কেউ কেউ চুল ছোট করবে।’’ হাদীসে এসেছে, ‘‘আর তোমরা মাথা মুণ্ডন কর, এতে প্রত্যেক চুলের বিনিময়ে একটি ছাওয়াব ও একটি গুনাহের ক্ষমা রয়েছে”।[১]
  • রাস্তায় দেখবেন অনেকে হাতে ইলেকট্রিক রেজার বা ট্রিমার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হজের এই সময়ে চুল কাটাতে ২০-৫০ রিয়াল পর্যন্ত দাবি করবে তারা। দু’মিনিটে আপনার মাথার পুরো চুল ফেলে দিবে। নাপিতকে ডান দিক থেকে চুল কাটা শুরু করতে বলুন। কারণ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে এমনটি করেছেন। নিজেদের কাছে রেজার বা ক্ষুর থাকলে আপনারা একে অপরের চুল ফেলে দিতে পারেন। এক্ষেত্রে যে ব্যক্তি কারো চুল ফেলবেন তার চুল আগে ফেলা থাকা জরুরী নয়।[২]
  • মহিলারা তাদের মাথার সমগ্র চুলের অগ্রভাগ হতে তর্জনী আঙ্গুলের এক-তৃতীয়াংশ পরিমাণ কাটবেন (প্রায় এক ইঞ্চি)। নারীদের জন্য হলক নেই। নারীদের মাথা মুণ্ডন করা হারাম।[৩]
  • এবার আপনি আপনার ইহরামের কাপড় খুলে ফেলুন, গোসল করে সাধারণ কাপড় পড়ুন। ইহরাম থেকে হালাল হওয়া হজের ওয়াজিব কাজ। একে বলে তাহাল্লুল আল আসগার বা প্রাথমিক হালাল। এখন আপনার ওপর থেকে যৌন সঙ্গম ছাড়া ইহরামের সকল নিষেধাজ্ঞা উঠে গেল। আপনি এখন দেহে সুগন্ধীও ব্যবহার করতে পারেন।[৪]
  • হালাল হওয়ার পর আপনি ইচ্ছা করলে ১০ যিলহজ মক্কায় গিয়ে তাওয়াফে ইফাদাহ ও সা‘ঈ করে সন্ধ্যা বা মধ্য রাতের আগেই মিনায় চলে আসুন। আর যদি ঐ দিন বেশি ক্লান্ত হয়ে পড়েন তবে রাতটি মিনায় অবস্থান করতে পারেন এবং ১১/১২ যিলহজ দিনের বেলায় কোনো এক সময় মক্কায় গিয়ে তাওয়াফ করতে পারেন। তাকবীরে তাশরিক পাঠ অব্যাহত রাখুন।
[১] সূরা আল-ফাতাহ, ৪৮:২৭; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৩৪৮
[২] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২২৯৮
[৩] তিরমিযী (৩/২৫৭)
[৪] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২০৪২

হাদী ও কসর/হলক্ব করার ক্ষেত্রে প্রচলিত ভুলত্রুটি ও বিদ‘আত

  • হাদী না করে এর সমপরিমাণ অর্থ সেবামূলক খাতে দান করে দেওয়া।
  • মাথার চুল ছাঁটানোর ক্ষেত্রে বাম দিক দিয়ে শুরু করা।
  • মাথার কিছু অংশ মুণ্ডানো এবং আর কিছু অংশ কসর করা।
  • মাথা মুড়ানোর সময় কিবলার দিকে মুখ করে বসা নিয়ম মনে করা।
  • কিছু লোক একে অন্যের চুল অথবা নিজেই কাচি দিয়ে মাথার বিভিন্ন অংশ থেকে চুল কেটে বক্সে সংরক্ষণ করে রাখে।
কৃতজ্ঞতা: মুহাম্মাদ মোশফিকুর রহমান এর লেখা
হজ সফরে সহজ গাইড’ নাম পুস্তক থেকে হুবহু কপি করা হয়েছে।



******************************
সাইটটি ভিজিট করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আর্টিকেলটি ভাল লাগলে সত্য ও ন্যয়ের পথে অন্য ভাইনদেরকে দাওয়াতের নিয়তে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন। মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে এবং দীন ও মানবতার সেবায় অংশ নিতে OUR ACTION PLAN বাটনে ক্লিক করুন।


এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url