হজ্জ সফরের সহজ গাইড (পর্ব-৮)




তাওয়াফুল ইফাদাহ, মিনায় রাত্রিযাপন ও জামরাতে কংকর নিক্ষেপ

১০ যিলহজ তাওয়াফুল ইফাদাহ ও সা‘ঈ করা

  • এ তাওয়াফের অপর নাম তাওয়াফে যিয়ারাহ বা ফরয তাওয়াফ। এটি হজের গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ। তাওয়াফুল ইফাদাহ করা ও সা‘ঈ করা হজের ফরয কাজ। আপনি যদি মিনা থেকে মক্কায় এ তাওয়াফ করতে যান তবে দু’ভাবে যেতে পারেন।
এক: পায়ে হেঁটে জামরাত পার করে প্যডেস্ট্রিয়ান টানেল (সুড়ঙ্গ পথ) রাস্তা দিয়ে।
দুই: মিনায় কিং ফয়সাল ওভারব্রিজ-এর উপর থেকে বা জামরাতের পাশে থেকে কার বা মটরসাইকেল ভাড়া করে। আর আপনি যদি মাথা মুণ্ডন করার পরপরই মক্কায় চলে গিয়ে থাকেন তবে আপনার হোটেল বা ভাড়া বাসা থেকেই এ তাওয়াফ করতে যাবেন।
  • রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ১০ যিলহজ সূর্য মধ্য আকাশে বা সূর্য হেলে যাওয়ার পর এ তাওয়াফ সম্পন্ন করেছিলেন। তবে সেই দিন ফজরের সূর্য উদয়ের পর থেকে এ তাওয়াফের সময় শুরু হয়। আর এ তাওয়াফের সময় উন্মুক্ত। কারও কারও মতে ১২ ই যিলহজ সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত। আবার কারও মতে, ১৩ যিলহজ সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত। অবশ্য সত্যনিষ্ঠ একদল আলেমের মত অনুযায়ী এ তাওয়াফ যিলহজ মাস শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত বা ঐ হিজরী বছর শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত করা যাবে। তবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এ তাওয়াফ করে নেওয়াই উত্তম। যার যার তাওয়াফ তাকে নিজেই করতে হবে। অন্য কাউকে কারো পক্ষ থেকে তাওয়াফ করতে পাঠানো যাবে না। প্রয়োজনে হুইল চেয়ারের আশ্রয় নিয়ে তাওয়াফ ও সা‘ঈ শেষ করতে হবে।
  • যেভাবে উমরাহর সময় তাওয়াফ করেছিলেন ঠিক তেমনি এ তাওয়াফের নিয়ম। শুধু ব্যতিক্রম এই যে, এখন আপনি ইহরামের কাপড় পরা নেই তাই কোনো ইদত্বিবাহ নেই এবং এ তাওয়াফে রমলও নেই। সাধারণ পোশাক পরিধান করে এ তাওয়াফ করবেন। এ তাওয়াফের সময় প্রচুর লোকের চাপ হয়। তাই অবস্থা বুঝে ফাঁকা জায়গা দিয়ে তাওয়াফ শেষ করুন।
  • তাওয়াফ শেষে মাক্বামে ইবরাহীমের পেছনে অথবা মসজিদে হারামের যে কোনো স্থানে দুই রাকাত সালাত পড়ুন। এবার যমযম কুপের পানি পান করুন এবং কিছু পানি আপনার মাথায় ঢালুন। এবার সাফা-মারওয়ায় গিয়ে ঠিক উমরাহর মতো সা‘ঈ করুন। এ সাঈর পর আর চুল কাটতে হবে না।
  • মাসিক স্রাব-গ্রস্ত মহিলাগণ এ তাওয়াফ করার জন্য অপেক্ষা করবেন। স্রাব বন্ধ হলে তাওয়াফে যিয়ারত সেরে নিবেন। এক্ষেত্রে কোনো দম দিতে হবে না। আর যদি পরিস্থিতি এমন হয় যে স্রাব বন্ধ হওয়ার সময় পর্যন্ত কোনো ক্রমেই অপেক্ষা করা যাচ্ছে না ও পরবর্তীতে এসে তাওয়াফ যিয়ারাহ আদায় করে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই, তবে জমহুর ফুকহা ও আরো আলেম-আলেমগণের মত অনুযায়ী ন্যাপকিন দিয়ে ভালোভাবে বেঁধে তাওয়াফ সেরে নেওয়া যাবে।
  • এ তাওয়াফ ও সা‘ঈ শেষ করার পর যৌনসঙ্গমও আপনার জন্য হালাল হয়ে যাবে। একে বলে তাহাল্লুল আল আকবার বা চূড়ান্ত হালাল হওয়া।
১০ জিলহজ তাওয়াফ ও সা‘ঈ শেষ হয়ে যাওয়ার পর যত দ্রুত সম্ভব সন্ধ্যা বা মধ্য রাতের পূর্বেই তাশরীকের রাত্রিযাপনের জন্য মিনায় ফিরে আসুন।

 ১০ যিলহজ কাজের ধারাবাহিকতা ভঙ্গ

  • এটি আরেকটি বিতর্কিত বিষয়! হজে যাওয়ার আগে এ সম্পর্কে আপনার জ্ঞান থাকা জরুরি। অনেকে আপনাকে ১০ যিলহজ এর সকল কাজগুলো ধারাবাহিকতা অনুসরণ করার জন্য বলবে, ধারাবাহিকতা ভঙ্গ করলে একটি পশু যবেহ করে দম দিতে বলবে! কিন্তু সহীহ হাদীসের তথ্যসূত্র অনুসারে ধারাবাহিকতা ভঙ্গ হলে কোনো দমের কথা বলা নেই; বরং এতে কোনো ক্ষতি নেই বলা আছে! আল্লাহ তা‘আলা অসীম দয়ালু ও করুণাময়, তাই তিনি তার বান্দাদের ওপর কোনো বিষয় কঠিন করে জোরপূর্বক চাপিয়ে দেন না। আপনি যদি আপনার সাধারণ জ্ঞান ব্যবহার করেন তাহলেই বুঝতে পারবেন কোনটা সঠিক আর কোনটা ভুল।
  • ১০ যিলহজ যদি এমন হয়, আপনার না জানার কারণে হজের কোনো বিধান ধারাবাহিকভাবে সম্পাদন করা হয় নি অথবা কোনো ওজর/জটিলতার কারণে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কোনো বিধান পালন করতে গিয়ে হজের অন্য কোনো বিধান এর ধারাবাহিকতা ভঙ্গ হয়ে যায় তাহলে এতে কোনো সমস্যা নেই। এ জন্য কোনো কাফফারা আদায় করতে হবে না। তবে ইচ্ছাকৃতভাবে ধারাবাহিকতা ভঙ্গ না করা উত্তম। (উদাহরণ: আপনি যদি ব্যাংক বুথ থেকে হাদী টিকেট ক্রয় করেন, আর আপনার কাছে যদি মোবাইল না থাকে তবে আপনি তো জানতে পারবেন না আপনার পশু ১০ যিলহজ কখন যবেহ করা হলো! তবে আপনি কতক্ষণ পর্যন্ত ইহরামের কাপড় পরে থাকবেন!)
  • হজের কার্যক্রমগুলো ধারাবাহিকভাবে করা সুন্নাত: কংকর নিক্ষেপ, হাদী, কসর/হলক্ব, তাওয়াফে ইফাদাহ, সা‘ঈ করা; কিন্তু কেউ যদি ধারাবাহিকতা ভঙ্গ করে কোনটি আগে বা কোনটি পরে করেন কোনো জটিলতার কারণে তাহলে তা করা যাবে। কারণ ইবন আব্বাস থেকে বর্ণিত বেশ কয়েকটি হাদীসে লোকদের বিভিন্ন কাজ আগে পরে হওয়ার কথা শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘কর, কোনো অসুবিধা নেই’’, ‘‘কোনো সমস্যা নেই”।[১]
[১] সহীহ হাদীসের তথ্যসূত্র দেখুন: সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৬২৫, ১৬২৬; ইফা; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৩০৫; মুসনাদে আহমদ; ইবন মাজাহ।

১১ যিলহজ মিনায় রাত্রিযাপন ও জামরাতে কংকর নিক্ষেপ

  • রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যোহরের সালাত মসজিদুল হারামে আদায় করে, তাওয়াফে যিয়ারত শেষে মিনায় ফিরে এসেছেন ও তাশরীকের রাত্রিগুলো মিনায় অবস্থান করেছেন। মিনায় তাশরীকের রাত্রীযাপন গুরুত্বপূর্ণ একটি আমল। বিভিন্ন মতাদর্শের বেশিরভাগ আলেম ও উলামা মিনায় তাশরীকের রাত্রীযাপন করাকে অত্যাবশ্যকীয় হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন।[১]
  • আপনি যদি ১০ যিলহজ দিনের বেলায় তাওয়াফে ইফাদাহ না করে থাকেন তবে উত্তম হবে এ তাশরীকের রাতটি মিনায় অবস্থান করে পরদিন সকালে মক্কায় গিয়ে ফরয তাওয়াফ সম্পন্ন করা। আবার আপনি যদি মক্কায় গিয়ে তাওয়াফ শেষ করে সন্ধা বা মধ্যরাতের আগে মিনায় ফিরে আসতে পারেন তবেও কোনো সমস্যা নেই। মিনায় রাতের অর্ধেকের বেশি সময় অবস্থান করা সহ রাত্রিযাপন করা বাঞ্চনীয়। আপনার শক্তি-সামর্থ, যাতায়াত পরিস্থিতি ও দলের লোকদের সাথে আলোচনা করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিন।
  • আপনি যদি আগের দিন ফরয তাওয়াফ না করে থাকেন তবে ১১ যিলহজ দিনের বেলায় মক্কায় গিয়ে তাওয়াফ শেষে মাক্বামে ইবরাহীমের পেছনে অথবা মসজিদে হারামের যে কোনো স্থানে দুই রাকাত সালাত পড়ুন, যমযমের পানি পান করুন এবং সা‘ঈ করে আবার মিনায় ফিরে আসুন।
  • এবার মিনায় দুপুরের সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলে যাওয়ার পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত তিনটি জামরাহে গিয়ে কংকর নিক্ষেপ করুন, এটি কংকর নিক্ষেপের উত্তম সময়। এতে মোট ২১টি কংকর লাগবে (প্রতিটির জন্য ৭টি করে)। অবশ্য দুপুরের সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলে যাওয়ার পর থেকে সুবহে সাদিক হওয়ার আগ পর্যন্ত কংকর নিক্ষেপ করা যেতে পারে। কংকর নিক্ষেপের সময় জামরার ধারাবাহিকতা রক্ষা করা অত্যাবশ্যকীয়।[২]
  • প্রথমে জামরাতুল সুগরার (ছোট জামরাহ) মুখোমুখি হয়ে কা‘বা আপনার বামে, মিনা ডানে রেখে অথবা যে কোনো ভাবে দাঁড়িয়ে ডান হাত উচু করে আলাদা আলাদাভাবে ৭টি কংকর একে একে নিক্ষেপ করুন এবং প্রতিবার নিক্ষেপের সময় বলুন: اَللهُ أَكْبَر ‘‘আল্লাহু আকবার’’ ‘‘আল্লাহ মহান’’।
  • প্রথম জামরাহতে কংকর নিক্ষেপের পর একটু সামনে এগিয়ে গিয়ে কিবলার দিকে মুখ করে (ছোট জামরাহকে ডানে রেখে) দুই হাত উঠিয়ে আপনার ইচ্ছা অনুযায়ী দীর্ঘক্ষণ দো‘আ করুন। এরপর পরবর্তী মধ্যম জামরাহের দিকে এগিয়ে যান।
  • এবার জামরাতুল উস্তার (মধ্যম জামরাহ) মুখোমুখি হয়ে কা‘বা আপনার বামে, মিনা ডানে রেখে অথবা যে কোনোভাবে দাঁড়িয়ে ডান হাত উঁচু করে আলাদা আলাদাভাবে ৭টি কংকর একে একে নিক্ষেপ করুন এবং জামরাতুল সুগরার মতো করে প্রতিবার ‘আল্লাহু আকবার’ বলুন।
  • দ্বিতীয় জামরাহে কংকর নিক্ষেপের পর আবারো একটু সামনে এগিয়ে গিয়ে কিবলার দিকে মুখ করে (মধ্যম জামরাহকে ডানে রেখে) দুই হাত উঠিয়ে আপনার ইচ্ছা অনুযায়ী দীর্ঘক্ষণ দো‘আ করুন। এরপর পরবর্তী বড় জামরাহের দিকে এগিয়ে যান।
  • এবার জামরাতুল ‘আকাবার (বড় জামরাহ) মুখোমুখি হয়ে কা‘বা আপনার বামে, মিনা ডানে রেখে অথবা যে কোনোভাবে দাঁড়িয়ে ডান হাত উচু করে আলাদা আলাদাভাবে ৭টি কংকর একে একে নিক্ষেপ করুন এবং বিগত দুই জামরাহের মতো করে প্রতিবার ‘আল্লাহু আকবার’ বলুন।
  • তৃতীয় জামরায় কংকর নিক্ষেপ শেষ করে আর কোনো দো‘আ না করেই জামরাত বিল্ডিং ত্যাগ করুন এবং মিনার তাবুতে ফিরে যান।[৩]
  • মিনায় অবস্থান করে সালাত আদায় করা, কুরআন তিলাওয়াত, তসবিহ তাহলিল, দো‘আ, যিকির ও ইসতেগফার করা বাঞ্ছণীয়। তাই তাবুর মধ্যে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে অথবা গল্পগুজব ও ঘুরাঘুরি না করে মিনার সময়গুলোকে কাজে লাগানো উত্তম। মিনায় সালাত আদায়ের নিয়ম ৮ই যিলহজের মতো করে হবে। মিনায় এ তাশরীকের রাতগুলো যাপন করা ওয়াজিব।
  • অসুস্থ্য ও দুর্বল লোকেরা সূর্যাস্তের পর থেকে সুবহে সাদিক হওয়ার আগ পর্যন্ত কংকর নিক্ষেপ করতে পারবেন অথবা তার পক্ষ থেকে অন্য একজনকে কংকর নিক্ষেপ করার জন্য নিয়োগও করতে পারবেন।
সতর্কতা: আজকাল কিছু কিছু হজ এজেন্সির নেতাদের দেখা যায় তারা ১১ তারিখের মধ্য রাতের পর হাজীদের নিয়ে মিনা ত্যাগ করে চলে যান। রাতের বাকি অংশ মক্কায় যাপন করে পরদিন যোহরের পর মক্কা থেকে এসে কংকর নিক্ষেপ করেন ও আবার মক্কায় চলে যান। এরূপ করা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শের বিপরীত। বিশেষ অসুবিধায় না পড়লে এরূপ করা উচিৎ নয়। আর মিনায় রাত ও দিন উভয়টাই যাপন করা উচিত। কেননা মিনায় রাত্রিযাপন যদি ওয়াজিবের পর্যায়ে পড়ে থাকে তবে দিন যাপন করা সুন্নাত, এতে কোনো সন্দেহ নেই। সর্বোপরি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দিন ও রাত উভয়টাই মিনায় যাপন করেছেন।
  • এমন পরিস্থিতিতে পড়লে আপনি কি করবেন? আপনি যদি তাকওয়া অবলম্বনকারী হন ও বিশেষ কোনো ওজর না থাকে তবে দল থেকে আলাদা হয়ে যান ও মিনায় অবস্থান করুন। আপনি অন্যদের বিষয়টি বুঝাতে পারেন তবে এনিয়ে দ্বন্দে যাবেন না। আপনি নিশ্চয় এ কয় দিনে পথ-ঘাট বুঝে যাবেন আর হাতে যদি মোবাইল ফোন ও কিছু রিয়াল থাকে তাহলে কোনো সমস্যাই নেই। হজ যখন করতেই এসেছেন তবে এ শেষ পর্যায়ে একটু কষ্ট করে ওয়াজিব ও সুন্নাতগুলো পালন করে যান। অবশ্য আপনি হজে যাওয়ার পূর্বে আপনার এজেন্সির লোকদের সাথে এ বিষয়টি নিয়ে হালকাভাবে আলোচনা করে তাদের মনোভাবটাও বুঝে ফেলতে পারেন!
[১] আবু দাউদ, হাদীস নং ১৬৮৩
[২] মুসনাদে আহমদ, সহীহ মুসলিম
[৩] ইবন মাজাহ

১২ যিলহজ মিনায় রাত্রিযাপন ও জামরাতে কংকর নিক্ষেপ

  • যদি এখনও তাওয়াফে ইফাদাহ না করে থাকেন, তাহলে ১২ যিলহজ দিনের বেলায় মক্কায় গিয়ে তাওয়াফ করুন। তাওয়াফ শেষে মাক্বামে ইবরাহীমের পেছনে অথবা মসজিদে হারামের যে কোনো স্থানে দুই রাকাত সালাত পড়ুন, যমযমের পানি পান করুন এবং সা‘ঈ করে মিনায় ফিরে আসুন।
  • ঠিক ১১ জিলহজের মতো করে একই নিয়মে দুপুরের সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলে যাওয়ার পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত তিনটি জামরাতে গিয়ে কংকর নিক্ষেপ শেষ করুন।[১]
  • সাধারণত ১২ তারিখ প্রথম ওয়াক্তে কংকর মারার প্রচণ্ড ভীড় থাকে। তাই একটু দেরী করে বিকালের দিকে গেলে ভালো হয়। আবার ১২ তারিখই কংকর নিক্ষেপের পর্ব শেষ করা যায়, তবে যুক্তিযুক্ত কারণ সাপেক্ষে। আপনি যদি কোনো বিশেষ কারণে; যেমন: সম্পদ নষ্ট হওয়ার ভয় থাকলে, জীবনের নিরাপত্তার অভাব বোধ করলে, গুরুতর শারিরীক অসুস্থতার অবনতি, রোগীর সেবার জন্য সাথে থাকা, চাকরী হারানোর ভয় ইত্যাদি বিশেষ কারণে আজ কংকর নিক্ষেপ করে সূর্যাস্তের পূর্বেই মক্কায় ফিরে যেতে চান তবে আপনি যেতে পারবেন। এতে কোনো ক্ষতি নেই।
  • আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে বলেন, ‘‘যদি কেউ তাড়াতাড়ি করে দুই দিনে চলে আসে তবে তার কোনো পাপ নেই। আর যদি কেউ বিলম্ব করে তবে তারও কোনো পাপ নেই, এটা তার জন্য; যে তাকওয়া অবলম্বন করে”।[২]
  • আপনি যদি ১২ তারিখই কংকর নিক্ষেপের পর্ব শেষ করতে চান তবে অবশ্যই সূর্যাস্তের পূর্বেই মিনা এলাকা ত্যাগ করতে হবে। মিনায় সূর্যাস্ত হয়ে গেলে আর মিনা ত্যাগ করবেন না, বরং রাতে মিনায় অবস্থান করে পরবর্তী দিন একই নিয়মে তিনটি জামরাতে কংকর নিক্ষেপ করে তারপর মিনা ত্যাগ করবেন। তবে কোনো বৈধ কারণ ছাড়া মিনা ত্যাগ না করাই উত্তম। কংকর নিক্ষেপের জন্য মিনায় ১৩ তারিখ পর্যন্ত অর্থাৎ তিনদিন অবস্থান করা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাত।
  • মক্কার উদ্দেশ্যে মিনা ত্যাগ করার পর হজের সর্বশেষ ও চূড়ান্ত কাজ হলো বিদায়ী তাওয়াফ করা। দেশে ফেরা বা মদীনা গমনের আগে এ তাওয়াফ করবেন। এর মাঝে যে কয়দিন মক্কায় থাকবেন সে কয়দিন নফল তাওয়াফ, জামআতে সালাত, তাহাজ্জুদ সালাত, দো‘আ ও যিকিরে মশগুল থাকবেন।
  • সতর্কতা: আজকাল কিছু কিছু হজ এজেন্সির নেতাদের দেখা যায় তারা ১২ তারিখে কংকর নিক্ষেপের পর হাজীদের নিয়ে মিনা ত্যাগ করে চলে যান। তারা কুরআনের ঐ আয়াত পেশ করে অথবা দলের কয়েকজন লোকের অসুস্থতার অজুহাত দেখিয়ে, সবাই দুর্বল ও ক্লান্ত হয়ে গেছে, আশেপাশে অন্যান্যরা সবাই চলে যাচ্ছে, তাবুতে আর খাবার পাওয়া যাবে না ইত্যাদি বলে সবাইকে নিয়ে মক্কায় চলে যেতে চায়। তাদের উদ্দেশ্য হলো তাদের কষ্ট লাঘব করা। সর্টকাটে হজ শেষ করানো। ওজর থাকতে পারে কারো ব্যক্তিগত, সে অনুযায়ী তার জন্য ব্যবস্থা নিতে হবে। তাই বলে সকলকে ওজরের আওতায় ফেলে এমন কাজ করা অনুচিত। দুই দিন মিনায় অবস্থান করে মিনা ত্যাগ করার অনুমতি আছে তবে যুক্তিযুক্ত কারণ সাপেক্ষে।
এমন পরিস্থিতিতে পড়লে আপনি কি করবেন? আবার ঐ একই কথা বলবো। আপনি যদি তাকওয়া অবলম্বনকারী হন ও বিশেষ কোনো ওজর না থাকে তবে দল থেকে আলাদা হয়ে যান ও মিনায় অবস্থান করুন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাত অনুসরণ করুন ও তিন দিন মিনায় অবস্থান করে জামরায় কংকর নিক্ষেপ করে তারপর মক্কায় ফিরে যান।
[১] মুসনাদে আহমদ, সহীহ মুসলিম
[২] সূরা আল-বাকারা: ২:২০৩

১৩ যিলহজ মিনায় রাত্রিযাপন ও জামরাতে কংকর নিক্ষেপ

  • ১১ ও ১২ জিলহজের মতো করে একই নিয়মে দুপুরের সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলে যাওয়ার পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত তিনটি জামরাতে গিয়ে কংকর নিক্ষেপ শেষ করুন। শেষ দিনে লক্ষ্য করবেন লোকের ভীড় অনেক কমে গেছে। এ দিন আসরের সালাতের পর থেকে তাকবীরে তাশরীক পড়া শেষ।[১]
  • এরপর মিনা ছেড়ে মক্কায় চলে আসুন। আল্লাহ তা‘আলা আপনাকে পরিপূর্ণভাবে হজ শেষ করার তাওফীক দিয়েছেন সেজন্য তাঁর দরবারে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করুন। যদিও শেষ একটি কাজ ‘তাওয়াফুল বিদা’ করা বাকি আছে। এ দিন আসরের সালাতের পর থেকে তাকবীরে তাশরিক পড়া শেষ হয়ে যাবে। সৌদি মু‘আল্লিম সাধারণত কখনো গাড়ি দিয়ে থাকে আবার দেয়ও না এ শেষ দিনে মালপত্র সহ আসার জন্য। আপনারা কয়েকজনে মিলে গাড়ি ভাড়া করে অথবা পায়ে হেঁটেই মক্কায় পৌছে যেতে পারেন।
  • এবার যতদিন আপনি মক্কায় থাকবেন, প্রতি ওয়াক্ত সালাত জামাআতের সাথে মসজিদে হারামে গিয়ে আদায় করার চেষ্টা করুন; কারণ মসজিদে হারামে সালাত পড়া আর অন্য সাধারণ মসজিদের সালাতের চেয়ে ১ লক্ষ গুণ শ্রেয়। যে কয়দিন মক্কায় থাকবেন সে কয়দিন নফল তাওয়াফ, মসজিদে জামআতে সালাত, দো‘আ ও যিকরে মশগুল থাকবেন।
  • যতবার ইচ্ছে নফল তাওয়াফ করুন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কা‘বার ইয়েমেনী কর্নার ও কালো পাথরের বিষয়ে বলেছেন, ‘‘যে এ দুটি স্পর্শ করে এবং তাওয়াফ সম্পন্ন করেন আল্লাহ তার নামে একটি ভালো কাজের সওয়াব লিখে দেন এবং একটি গুনাহ মুছে দেন, তার জন্য একটি অতিরিক্ত মর্যাদা লিখে দেন এবং যে বারবার এটা করবে সে যেন একটি গোলাম মুক্ত করে দিল’’।
  • হজের সর্বশেষ ও চূড়ান্ত কাজ হলো বিদায়ী তাওয়াফ করা। দেশে ফেরা বা মদীনা গমনের আগে সর্বশেষ কাজ হিসাবে এ তাওয়াফ করবেন।
  • সতর্কতা: আজকাল অনেকে নিয়ম মোতাবেক হজেররপ্রতিটি কাজ সম্পাদন করার পরও কেউ কেউ এরূপ সন্দেহ পোষণ করতে থাকেন যে, কে জানে কোথাও কোনো ভুল হলো কি না! কিছু হজ এজেন্সির নেতাদেরও দেখা যায় তারা হাজী সাহেবদের উৎসাহিত করেন যে কোনো ভুলত্রুটি হয়ে থাকতে পারে তাই একটা দমে-খাতা দিয়ে দিন, শতভাগ বিশুদ্ধ হয়ে যাবে আপনার হজ!
এরূপ করাটা মারাত্মক অন্যায়। কেননা আপনি হজ সহীহ শুদ্ধ ভাবে পালন করা সত্ত্বেও নিজ ইচ্ছায় হজকে সন্দেহযুক্ত করছেন। আপনার যদি কোনো বিষয় নিয়ে সত্যি সন্দেহ হয় তবে একজন বিজ্ঞ আলেমকে আপনার হজের সমস্যার কথা বলে শুনান। তিনি যদি দম দিতে বলেন তবেই দম দিন। অন্যথায় নয়। শুধু আন্দাজের ওপর ভিত্তি করে দমে-খাতা দেওয়ার কোনো বিধান ইসলামে নেই। তবে হাঁ, আপনি চাইলে নফল পশু জবাই সাদকা হিসাবে করতে পারেন। আর দম দিতে চাইলে কাউকে বিশ্বাস করে হাতে রিয়াল দিয়ে ছেড়ে দিবেন না। ব্যাংক এর বুথে গিয়ে দম টিকিট কিনে দিন অথবা হালাকা (পশুর হাট এলাকা) গিয়ে নিজে দম দিয়ে আসুন।
[১] মুসনাদে আহমদ, সহীহ মুসলিম

তাওয়াফুল বিদা বা বিদায়ী তাওয়াফ

  • তাওয়াফুল বিদা হজের ওয়াজিব। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিদায়ী তাওয়াফ আদায় করেছেন এবং বলেছেন, ‘‘বায়তুল্লাহর সাথে শেষ সাক্ষাত না করে তোমাদের কেউ যেন না যায়।’’ অন্য এক বর্ণনা অনুসারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইবন আববাস রাদিয়াল্লাহু আনহু কে বলেন, লোকদেরকে বলো, তাদের শেষ কর্ম যেন হয় বায়তুল্লাহর সাথে সাক্ষাত, তবে তিনি মাসিক স্রাবগ্রস্ত নারীর জন্য ছাড় দিয়েছেন।[১]
  • হজ শেষে আপনি যদি মক্কায় অবস্থান করেন তবে এ তাওয়াফ আপনি মক্কা ছাড়ার আগ মুহূর্তে করবেন। মনে রাখবেন এটাই হবে মক্কায় আপনার শেষ কাজ। এ তাওয়াফের পর কোনো সময় ক্ষেপনকারী কাজ করা যাবে না। যেমন, ঘুমানো যাবে না। ওজর ছাড়া বেশি সময় পার করলে আবারও এ তাওয়াফ করতে হবে। এ তাওয়াফের পর সা‘ঈ নেই। এ তাওয়াফ সাধারণ নফল তাওয়াফের মত; অর্থাৎ কোনো রমল নেই তবে তাওয়াফ শেষে দু’রাকাত সালাত আদায় করুন। তাওয়াফ শেষে যমযম এর পানি পান করে বাহির হন। অনেকে মসজিদ থেকে বের হওয়ার সময় সম্মানপ্রদর্শন করে পশ্চাৎমুখী হয়ে বের হন যার কোনো ভিত্তি নেই।
  • কোন নারী যদি তাওয়াফে ইফাদাহ করার পর ঋতুবর্তী হয়ে থাকেন এবং তাওয়াফে বিদার জন্য অপেক্ষা করতে না পারেন তাহলে তিনি চলে যেতে পারেন। এ ক্ষেত্রে কোনো কাফফারার বা দম দেওয়ার দরকার হবে না।
  • এ তাওয়াফের মাধ্যমে আপনার হজে তামাত্তু সম্পন্ন হলো।
[১] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৩৫০, ২৩৫১

হজে ক্বিরান

(হজে ক্বিরান যারা করবেন) 
৮ জিলহজের আগে

মীকাতের বাহির থেকে আগত ব্যক্তিগণ মীকাত থেকেই ইহরাম করবেন, (মক্কার অধিবাসীরা তাদের বাসস্থান থেকে করবেন) তালবিয়া পাঠ করতে থাকবেন এবং একইসঙ্গে হজ ও উমরাহর নিয়ত করবেন।

‘‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা উমরাতান ওয়া হাজ্জান’’।
তাওয়াফুল কুদুম করতে পারেন। এটা বাধ্যতামুলক নয়, সুন্নাত।
তাওয়াফুল কুদুমের সঙ্গে সা‘ঈও করতে পারেন। তবে কেউ যদি সা‘ঈ না করেই হজের জন্য যান তাহলে তাকে তাওয়াফুল ইফাদার পরে অবশ্যই সা‘ঈ করতে হবে।

এরপর ৮ যিলহজ পর্যন্ত ইহরাম অবস্থায় থাকতে হবে এবং ইহরামের সকল বিধি-নিষেধ মেনে চলতে হবে।

৮ যিলহজ
যেহেতু আপনি ইহরাম অবস্থায়ই আছেন, তাই মিনায় চলে যাবেন এবং হজে তামাত্তুর সকল বিধান পালন করবেন, তবে আপনাকে নতুন করে হজের নিয়ত করতে হবে না, কারণ ইহরাম করার সময় আপনি হজের নিয়ত করেছেন।

৯ যিলহজ
হজে তামাত্তুর মতো সকল বিধান পালন করুন।

১০ যিলহজ
হজে তামাত্তুর মতোই সকল বিধান পালন করবেন, তবে কিছু বিষয় লক্ষ্য করতে হবে।

তাওয়াফুল কুদুমের পর সা‘ঈ করে না থাকলে তাওয়াফে ইফাদার পরে করতে হবে। তবে কেউ যদি তাওয়াফে কুদুমের সময় সা‘ঈ করে থাকেন তাহলে তার আর করতে হবে না। এতে কোনো ক্ষতি নেই।

১১, ১২ ও ১৩ যিলহজ
হজে তামাত্তুর মতো সকল বিধান পালন করুন। বিদায় তাওয়াফের ক্ষেত্রে হজে তামাত্তুর একই নিয়ম প্রযোজ্য।

হজে ইফরাদ

(হজে ইফরাদ যারা করবেন) 
৮ জিলহজের আগে
মীকাতের বাহির থেকে আগত ব্যক্তিগণ মীকাত থেকেই ইহরাম করবেন, (মক্কার অধিবাসীরা তাদের বাসস্থান থেকে করবেন) তালবিয়া পাঠ করতে থাকবেন এবং শুধুমাত্র হজের নিয়ত করবেন।
‘‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা হাজ্জান’’।

তাওয়াফুল কুদুম করতে পারেন। এটা বাধ্যতামুলক নয়, সুন্নাত।
তাওয়াফুল কুদুমের সঙ্গে সা‘ঈও করতে পারেন। তবে কেউ যদি সা‘ঈ না করেই হজের জন্য যান তাহলে তাকে তাওয়াফুল ইফাদার পরে অবশ্যই সা‘ঈ করতে হবে।

এরপর ৮ যিলহজ পর্যন্ত ইহরাম অবস্থায় থাকতে হবে এবং ইহরামের সকল বিধি-নিষেধ মেনে চলতে হবে।

৮ যিলহজ
যেহেতু আপনি ইহরাম অবস্থায়ই আছেন, তাই মিনায় চলে যাবেন এবং হজে তামাত্তুর সকল বিধান পালন করবেন, তবে আপনাকে নতুন করে হজের নিয়ত করতে হবে না, কারণ মীকাতে ইহরাম করার সময় আপনি হজের নিয়ত করেছেন।

৯ যিলহজ
হজে তামাত্তুর মতো সকল বিধান পালন করুন।

১০ যিলহজ
হজে তামাত্তুর মতোই সকল বিধান পালন করবেন, তবে কিছু বিষয় লক্ষ্য করতে হবে।
কোনো হাদী প্রদান করতে হবে না।

তাওয়াফুল কুদুমের পর সা‘ঈ করে না থাকলে তাওয়াফে ইফাদার পরে করতে হবে। তবে কেউ যদি তাওয়াফে কুদুমের সময় সা‘ঈ করে থাকেন তাহলে তার আর করতে হবে না।

১১, ১২ ও ১৩ যিলহজ
হজে তামাত্তুর মতো সকল বিধান পালন করুন। বিদায়ী তাওয়াফের ক্ষেত্রে হজে তামাত্তুর একই নিয়ম প্রযোজ্য।

কৃতজ্ঞতা: মুহাম্মাদ মোশফিকুর রহমান এর লেখা
হজ সফরে সহজ গাইড’ নাম পুস্তক থেকে হুবহু কপি করা হয়েছে।


*********************************
সাইটটি ভিজিট করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আর্টিকেলটি ভাল লাগলে সত্য ও ন্যয়ের পথে অন্য ভাইনদেরকে দাওয়াতের নিয়তে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন। মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে এবং দীন ও মানবতার সেবায় অংশ নিতে OUR ACTION PLAN বাটনে ক্লিক করুন।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url