মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু মহীয়সী ইন্দিরা গান্ধি



(কারও পক্ষে বা বিপক্ষে নয়, বাংলাদেশের ঔতিহাসিক ও দুষ্প্রাপ্য ছবি, ভিডিও, বক্তব্য ও তথ্য এখানে তুলে ধরা হবে।)


মহীয়সী ইন্দিরা গান্ধি 

মহীয়সী ইন্দিরা গান্ধি ভারতবর্ষের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী, ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম নারী রাজনীতিক, ভারতের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী ও মহান মুক্তিযুদ্ধ সহ বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু । কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভালোবেসে তাঁর নাম দিয়েছিলেন ‘প্রিয়দর্শিনী’ ৷ তিনি দেখতে যতটা প্রিয়দর্শিনী ছিলেন, ততটাই প্রিয়দর্শিনী ছিলেন রাজনৈতিক জীবনে ৷ তিনি শুধু এই উপমহাদেশেরই নন বরং গোটা বিশ্বের অগ্রগণ্য রাজনীতিবিদদের একজন ।

ইন্দিরা প্রিয়দর্শিনী গান্ধি’র জন্ম ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের ১৯শে নভেম্বর, ভারতের বিখ্যাত নেহেরু পরিবারে । পিতা বিখ্যাত পণ্ডিত ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু আর মাতা কমলা দেবী । তিনি লেখাপড়া করেছেন বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে ৷ ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে ভারতের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হন ইন্দিরা গান্ধি । তাঁর বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনে আসা বহু রাজনৈতিক সংকট মোকাবিলা করেছেন দক্ষ হাতে । ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সর্বাত্মক সহযোগিতা দিয়ে সত্যিকারের বন্ধুর পরিচয় দেন তিনি



১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ২৫শে মার্চের কালরাতে পাক হানাদার বাহিনী ঘুমন্ত নিরীহ বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে । সেদিন রাতে পিলখানা, রাজারবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে একযোগে হামলা করে নির্বিচারে মানুষ হত্যা করে । এ সংবাদ দ্রুত দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়লে প্রাণের ভয়ে বহু মানুষ সীমান্ত দিয়ে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ঢুকে পড়ে । নিরীহ আশ্রয়হীন প্রায় দুই কোটি মানুষদের জন্য সীমান্ত খুলে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে শরণার্থী শিবিরের দায়িত্ব নেন যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু মহীয়সী ইন্দিরা গান্ধি ৷

২৫শে মার্চের পাক হানাদার বাহিনী বাঙালি জাতির উপর ঝাপিয়ে পড়লে অনেক দেশই এটাকে বাংলাদেশের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের যুদ্ধ বলে মন্তব্য করেছে । এ সময় ইন্দিরা গান্ধি’র বিশ্ব মিডিয়ায় দেয়া বক্তব্য ছিল তাৎপর্যপূর্ণ । পাকিস্তান তখন স্বাধীন রাষ্ট্র হওয়ায় এর ভেতরে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের করা যুদ্ধকে বাকি সব দেশ গৃহযুদ্ধ হিসেবেই দেখতে চেয়েছে । শুরু থেকে কিছু আন্তর্জাতিক মিডিয়া ও রাষ্ট্রপ্রধানরাও সেভাবেই বিশ্লেষণ করছিলেন । কিন্তু ইন্দিরা গান্ধি ততদিনে পূর্ব পাকিস্তান নয়, ‘পূর্ব বাংলা’ বলে সম্বোধন করছিলেন ।


২৫ মার্চ ঢাকায় গণহত্যার পর ২৭ মার্চ ভারতের লোকসভায় ভাষণ দিয়ে করণীয় তুলে ধরেন তিনি। ৩১ মার্চ বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধে সর্বাত্মক সহযোগিতার প্রস্তাব লোকসভায় উত্থাপন করলে সর্বসম্মতিক্রমে পাস হয় । পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ’র সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদকে সাক্ষাৎকার দেন ইন্দিরা গান্ধি । ৭ই এপ্রিল তাজউদ্দীন আহমদ’র সঙ্গে বৈঠকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের জন্য আশ্রয় ও রাজনৈতিক কাজ পরিচালনার সুযোগসহ সার্বিক সাহায্য করার আশ্বাস পুনঃব্যক্ত করেন । সেই সাথে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠনের পরামর্শ ও পরিকল্পনা দেন তাজউদ্দীন আহমদকে ৷

১৭ই এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠন হলে বিশ্বব্যাপী পাকিস্তানিদের গণহত্যার বিষয়টি তুলে ধরেন তিনি । পাকিস্তানি হত্যাযজ্ঞ বাড়তে থাকায় ভারতে শরণার্থীও বাড়তে থাকে। এ প্রসঙ্গ টেনে তিনি পাকিস্তানকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ভারতের পক্ষে চুপ করে থাকা সম্ভব নয় । মে মাসে বেলগ্রেডের বিশ্বশান্তি কংগ্রেসে ভারতীয় প্রতিনিধিরা ইন্দিরা গান্ধি’র বাণী পাঠ করেন । বাণীতে বাংলাদেশের প্রতি সমর্থন প্রসঙ্গে প্রায় ৮০টি দেশের প্রতিনিধি করতালি দিয়ে একাত্মতা ঘোষণা করেন । ৮ই আগস্ট বিশ্বের সব রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানের কাছে ভারত সরকারের পাঠানো এক বার্তায় শেখ মুজিবুর রহমান’র জীবন রক্ষায় ও তাঁর মুক্তির দাবিতে ইয়াহিয়া খানের ওপর চাপ সৃষ্টির আহ্বান জানান ।


শরতের শুরুতে ইন্দিরা গান্ধি বাংলাদেশের পক্ষে আক্রমণাত্মক কূটনৈতিক সফরে পশ্চিমা বিশ্বে যান এবং যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সকে পক্ষে আনতে সমর্থ হন । এই দুই রাষ্ট্র নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য এবং মার্কিন বলয়ের, কিন্তু বাংলাদেশ প্রশ্নে এরা ভারতকে সমর্থন দেয় । ওই সময় ইন্দিরা গান্ধি’র বিরাট কূটনৈতিক বিজয় ছিল ৯ই আগস্ট সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ২০ বছর মেয়াদি ‘বন্ধুত্ব ও সহযোগিতা চুক্তি’ । যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এটা ছিল একটি বড় আঘাত । এর ফলে ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষে চীনের অংশগ্রহণের সম্ভাবনা কমে যায় । চীন তখন পাকিস্তানকে নৈতিক সমর্থন বা সামান্য সামরিক সাহায্য দিলেও ভারত সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ ঘটায়নি । ইন্দিরা গান্ধি ওয়াশিংটন সফর করেন । কিন্তু প্রেসিডেন্ট নিক্সন তাকে ততটা আমলে নেননি । হোয়াইট হাউসের ‘রোজ গর্ডেনে’ বসেই ইন্দিরা গান্ধি প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছিলেন যে, আমেরিকা না চাইলেও বাংলাদেশ স্বাধীন হবে ।

ইন্দিরা গান্ধি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে সমর্থন দিতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করে জনমত সৃষ্টি করেন । তার ডাকে সারা দিয়ে অনেকেই এগিয়ে আসেন । বিশ্বব্যাপী তিনি মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে সোচ্চার ছিলেন । একাত্তরের সেপ্টেম্বরে নিজের বক্তব্য থেকে খুব সচেতনভাবে পূর্ব বাংলা শব্দটি বাদ দিয়ে ‘বাংলাদেশ’ উচ্চারণ করেন । ২৪শে অক্টোবর বাংলাদেশ পরিস্থিতি ও শরণার্থী সমস্যা সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে সর্বশেষ অবস্থা জানানোর উদ্দেশে ১৯ দিনের বিশ্ব সফরে বের হন তিনি । ২৫শে অক্টোবর ব্রাসেলসে তিনি বাংলাদেশের জনগণের গণতন্ত্র রক্ষার সংগ্রামে বিশ্ব বিবেককে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান । ২৮শে অক্টোবর ভিয়েনাতেও তিনি বাংলাদেশ পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেন ।

৩১শে অক্টোবর ব্রিটেন সফর করে প্রধানমন্ত্রী অ্যাওয়ার্ড হিথকে বাংলাদেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে ধারণা দেন । লন্ডনে তিনি বলেছিলেন- “শরণার্থী সমস্যা ছোট করে দেখার উপায় নেই । বাংলাদেশের সমস্যা শুধু শরণার্থী সমস্যা নয়, বরং এর চেয়ে অনেক গভীর । ভারতের জন্য শরণার্থী সমস্যা শুধু অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক নয় বরং এটা ভারতের নিরাপত্তা ও অখণ্ডতার জন্য বিরাট হুমকি । শরণার্থীদের ওপর যে বর্বরোচিত নির্যাতন হচ্ছে বিশ্ব তা জানে না, কিন্তু প্রতিদিন শরণার্থীরা ভারতে আসছে । মানুষ আমাকে জিজ্ঞাসা করছে, কতদিন এই ভার আমরা বহন করতে পারব? আমি বলছি, সেই সময় পেরিয়ে গেছে । আমরা আগ্নেয়গিরির ওপর বসে আছি, জানি না কখন সেটা উদগীরণ শুরু করবে? আমরা সংযত, কিন্তু কতটা সংযত থাকব বিষয়টি নির্ভর করছে, সীমান্তে কী ঘটছে এর ওপর । আমরা মনে করি বিশ্ব সম্প্রদায়ের দায়িত্ব এর সমাধান খুঁজে বের করা । সবচেয়ে ভালো হয় এবং সেটা মানবিক, তাহলো এর রাজনৈতিক সমাধান বা বাংলাদেশে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা ৷”



৪ঠা নভেম্বর আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের সঙ্গে ১২৫ মিনিট বৈঠক করেন । এরপর তিনি ফ্রান্সে যান । ফরাসি প্রেসিডেন্টের দেওয়া ভোজসভায় তিনি বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যার চিত্র তুলে ধরেন । তিনি প্যারিস থেকে জার্মানি এসে চ্যান্সেলর উইলি ব্রান্টের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা করেন । নভেম্বর জুড়ে তিনি বাংলাদেশ প্রসঙ্গে বিশ্বনেতাদের কাছে ভারতের সমর্থনের কথা প্রচার করেন ।

৩০শে নভেম্বর রাজ্যসভায় ভাষণে বাংলাদেশ থেকে সব পাকিস্তানি সেনা ফিরিয়ে এনে বাঙালিদের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার আহ্বান জানান । ৩রা ডিসেম্বর রাত ১২টা ২০ মিনিটে ভারতবাসীর উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন । ভাষণের মূল বিষয় ছিল বাংলাদেশ প্রসঙ্গ । তিনি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সর্বশক্তি দিয়ে মোকাবিলা করার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন । আর ডিসেম্বরের ৬ তারিখ লোকসভার ভাষণে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার কথা ঘোষণা করেন । সেদিনই স্বাধীন স্বার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে প্রথম স্বীকৃতি প্রদান করে ভারত ৷

ইন্দিরা গান্ধি’র সরকার মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে নানাভাবে সহায়তা করলেও ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী এই যুদ্ধে সরাসরি জড়িয়ে পড়ে । ৩রা ডিসেম্বর পাকিস্তান অকস্মাৎ ভারতীয় বিমান ঘাঁটিতে আক্রমণ চালালে ইন্দিরা গান্ধি’র নির্দেশে ভারত পাল্টা আঘাত হানে । শুরু হয় আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ । তিনটি ভারতীয় কর্পস তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধ করে, সঙ্গে প্রায় তিন ব্রিগেড মুক্তিবাহিনী । ভারতীয় বিমান বাহিনী এক সপ্তাহের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের আকাশ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে । পশ্চিমেও প্রায় একই অবস্থা ৷ উপায়ন্তর না দেখে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত মিত্রবাহিনীর কাছে ৯৩ হাজার সৈন্য নিয়ে ১৬ই ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ করে পাকিস্তান সেনাবাহিনী । মহান মুক্তিযুদ্ধে মিত্রবাহিনীর ১ হাজার ১৬১ ভারতীয় সেনা শহিদ হয়েছিলেন ।

মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং বাংলাদেশ গঠনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা ইন্দিরা গান্ধি’র ৷ তিনি মুক্তিযুদ্ধের একজন সহমর্মী, সহযোগী, বন্ধু, প্রতিবেশী এবং সর্বোপরি একজন অভিভাবক হয়ে পাশে দাঁড়িয়েছেন ৷ ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে নিজ শাসনকালে শিখদের পবিত্র ধর্মাশালা স্বর্ণ মন্দিরে ভারতীয় সেনা হানা দেয়ার খেসারতে সে বছরই ৩১শে অক্টোবর নিজ দেহরক্ষী শিখদের হাতে নির্মমভাবে হত্যার শিকার হন তিনি ৷

আজ এই মহীয়সীর প্রয়াণদিবসে জানাই অন্তর্লীন শ্রদ্ধাঞ্জলি, সশ্রদ্ধ সম্মান ও স্যালুট ৷


******************************
সাইটটি ভিজিট করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আর্টিকেলটি ভাল লাগলে সত্য ও ন্যয়ের পথে অন্য ভাইনদেরকে দাওয়াতের নিয়তে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন। মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে এবং দীন ও মানবতার সেবায় অংশ নিতে OUR ACTION PLAN বাটনে ক্লিক করুন।


এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url