প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর জীবনী [পর্ব- ৪৫] || মহানবীর জীবনী ||




মক্কা বিজয়ের প্রথম ও দ্বিতীয় দিনের ঘটনাসমূহ


[পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ট মহামানব আমাদের প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:)। যাকে আল্লাহ সমস্ত মানুষের জন্য অশেষ রহমত স্বরূপ এই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। যে নবী সারা জীবন উম্মতের জন্য সংগ্রাম করেছেন, কাল রোজ হাশরের মাঠেও যিনি উম্মতের জন্যই পেরেশান থাকবেন ইয়া উম্মতি ইয়া উম্মতি বলে বিচলিত হবেন; সেই প্রাণপ্রিয় নবীকে আমরা কতটুকু চিনি, কতটুকু জানি? প্রিয় নবী (সা:) এর জীবনের পরতে পরতে রয়েছে আমাদের জন্য শিক্ষা ও অনুপ্রেরণা। যার জীবনী পড়লে নিজের অজান্তেই চোখের পানি গড়িয়ে পড়ে। সেই নবীর জীবনী কি আমরা সত্যিই জানি? আসুন, আরেকবার দেখে নেই “প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর জীবনী”। যে জীবনী পড়ে বদলে যেতে পারে আপনার আমার জীবন। আমরা এখানে প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর বিশাল কর্মময় জীবনকে ৬৭টি সুবিশাল পর্বে তুলে ধরেছি। আল্লাহ আমাদের সবাইকে প্রাণপ্রিয় নবীর (সা:) উম্মত হিসাবে কবুল করুন। আমিন।।]

বিজয়ীর বেশে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর মক্কায় প্রবেশ

ক্বাছওয়া উটনীর পিঠে সওয়ার হয়ে আনছার ও মুহাজির পরিবেষ্টিত অবস্থায় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মক্কায় প্রবেশ করেন। এদিন তিনি আল্লাহর প্রতি বিনয়ী ও তাঁর নে‘মতের শুকরিয়া আদায়কারী হিসাবে মক্কায় প্রবেশ করেন। বিজয়ী সেনাপতির ন্যায় অহংকারীভাবে নয়। এ সময় তিনি সওয়ারীর উপরে বসে সূরা ফাৎহ বা তার কিছু অংশ ধীর কণ্ঠে বারবার পাঠ করছিলেন’ (বুখারী হা/৪২৮১, ৫০৪৭)। যুদ্ধের প্রস্ত্ততি থাকার কারণে রাসূল (ছাঃ) এ দিন মুহরিম ছিলেন না। এ সময় তাঁর মাথায় লৌহ শিরস্ত্রাণের উপর কালো পাগড়ী ছিল’।[1]

অতঃপর তিনি মাসজিদুল হারামে প্রবেশ করেন এবং হাতের মাথা বাঁকানো লাঠি দ্বারা হাজারে আসওয়াদ চুম্বন করেন। অতঃপর বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করেন।[2] এ সময় কা‘বাগৃহের ভিতরে ও বাইরে ৩৬০টি মূর্তি ছিল। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হাতের লাঠি দ্বারা এগুলি ভাঙতে থাকেন এবং কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াতটি পড়তে থাকেন।وَقُلْ جَاءَ الْحَقُّ وَزَهَقَ الْبَاطِلُ إِنَّ الْبَاطِلَ كَانَ زَهُوْقًا ‘তুমি বল, হক এসে গেছে, বাতিল দূরীভূত হয়েছে। নিশ্চয়ই বাতিল দূরীভূত হয়েই থাকে’ (বনু ইসরাঈল ১৭/৮১)। তিনি আরও পড়েন,قُلْ جَاءَ الْحَقُّ وَمَا يُبْدِئُ الْبَاطِلُ وَمَا يُعِيْدُ ‘তুমি বল হক এসে গেছে এবং বাতিল আর না শুরু হবে, না ফিরে আসবে’ (সাবা ৩৪/৪৯)। অর্থাৎ সত্যের মুকাবিলায় মিথ্যা এমনভাবে পর্যুদস্ত হয় যে, তা কোন বিষয়ের সূচনা বা পুনরাবৃত্তির যোগ্য থাকে না’ (বুখারী হা/৪২৮৭)।

ইবনু আব্বাস (রাঃ)-এর বর্ণনা অনুযায়ী অতঃপর তিনি ওছমান বিন ত্বালহাকে ডেকে তাকে ভিতর থেকে সমস্ত মূর্তি-প্রতিকৃতি বের করার নির্দেশ দেন। এসময় তিনি তার মধ্যে ইবরাহীম ও ইসমাঈল (আঃ)-এর দু’টি প্রতিকৃতি দেখেন। যাদের হাতে ভাগ্য নির্ধারণী তীর দেখে তিনি বলে ওঠেন,قَاتَلَهُمُ اللهُ لَقَدْ عَلِمُوا مَا اسْتَقْسَمَا بِهَا قَطُّ ‘মুশরিকদের আল্লাহ ধ্বংস করুন। আল্লাহর কসম! তারা জানে যে, তাঁরা কখনোই এ ধরনের ভাগ্যতীর ব্যবহার করেননি’। তিনি বলেন,مَا كانَ إِبْراهِيمُ يَهُودِيًّا وَلا نَصْرانِيًّا، وَلكِنْ كانَ حَنِيفاً مُسْلِماً، وَما كانَ مِنَ الْمُشْرِكِينَ ‘ইবরাহীম কখনো ইহূদী বা নাছারা ছিলেন না। বরং তিনি ছিলেন একনিষ্ঠ মুসলিম। আর তিনি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না’ (আলে ইমরান ৩/৬৭)। ইবনু আববাসের অন্য বর্ণনায় এসেছে যে, সেখানে মারিয়ামের ছবিও ছিল (বুখারী হা/৩৩৫১)। এভাবে সমস্ত ছবি-মূর্তি দূর হওয়ার পর তিনি কা‘বাগৃহে প্রবেশ করেন ও ঘরের চারিদিকে তাকবীর দেন (বুখারী হা/৪২৮৮)।

ইবনু ওমরের বর্ণনায় এসেছে যে, অতঃপর তিনি ভিতরে প্রবেশ করেন ও দরজা বন্ধ করে দেন। এ সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন উসামা, বেলাল এবং ওছমান বিন তালহা (রাঃ)। এরপর তিনি কা‘বার দরজা পিছনে রেখে সম্মুখ দেওয়ালের তিন হাত পিছনে দুই খাম্বার মাঝে দাঁড়িয়ে বাম দিকে এক খাম্বা ও ডান দিকে দুই খাম্বা এবং পিছনে তিন খাম্বা রেখে দু’রাক‘আত ছালাত আদায় করেন। এ সময় কা‘বাগৃহে মোট ছয়টি খাম্বা ছিল’।[3] কোন কোন বিদ্বান একে ‘তাহিইয়াতুল মসজিদ’ দু’রাক‘আত ছালাত বলেছেন।[4]

ঐদিন আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) কা‘বা গৃহের মধ্যে ছালাত আদায় করেছিলেন কি-না, এ নিয়ে বেলাল ও উসামাহর দু’ধরনের বক্তব্য থাকায় বিদ্বানগণ একমত হ’তে পারেননি। বেলাল বলেছেন, ‘পড়েছেন দুই ইয়ামানী খাম্বার মাঝে’ (বুখারী হা/১৫৯৮, ৪২৮৯)। অন্যদিকে উসামা বলেছেন, ‘পড়েননি, বরং ঘরের চারদিকে হেটে তাকবীর দিয়েছেন’ (মুসলিম হা/১৩৩০, ফাৎহ ৩/৫৪৩)। এর সমন্বয় দু’ভাবে হ’তে পারে। ১. বেলালের বর্ণনা হ্যাঁ বোধক (مُثْبِتٌ)। তাছাড়া এ বিষয়ে কোন মতভেদ নেই। অতএব সেটাই অগ্রাধিকারযোগ্য। ২. উসামা বালতি ভরে পানি নিয়ে যখন প্রবেশ করেন, তখন তিনি তাকে (ছালাত শেষে) দাঁড়িয়ে দো‘আ পাঠ ও তাকবীর দিতে দেখেন। উপরন্তু ঘরে ছিল অন্ধকার। অতএব বাহির থেকে ঢুকে ছালাত দেখতে না পাওয়াটা অসম্ভব কিছু নয় (ফাৎহ ৩/৫৪৭)। এটা নিশ্চিত যে, ঐ সময় রাসূল (ছাঃ) ‘মুহরিম’ ছিলেন না (বুখারী হা/৪২৮৬)। অতএব মসজিদ হিসাবে সেখানে ‘তাহিইয়াতুল মাসজিদ’ দু’রাক‘আত নফল ছালাত পড়াটাই স্বাভাবিক। পরবর্তীতে বিদায় হজ্জের সময় তিনি কা‘বার মধ্যে ছালাত আদায় করেননি। বরং বাইরে মাক্বামে ইবরাহীমে দাঁড়িয়ে কা‘বাকে সামনে রেখে ছালাত আদায় করেছেন। কেননা এভাবে আদায়ের নির্দেশ রয়েছে কুরআনে (বাক্বারাহ ২/১২৫)।[5] অতঃপর তিনি দরজা খুলে দেন। এসময় শত শত মানুষ কা‘বাগৃহের সম্মুখে দন্ডায়মান ছিল’ (মুসলিম হা/১৩২৯)। অতঃপর ত্বাওয়াফ শেষে উষ্ট্রীকে বসানোর জায়গা না পেয়ে বাতনে ওয়াদীতে সরিয়ে দেন (ছহীহ ইবনু হিববান হা/৩৮২৮)।

এসময় আবুবকর (রাঃ) তাঁর বৃদ্ধ ও অন্ধ পিতা আবু কুহাফাকে নিয়ে আসেন। তাকে দেখে রাসূল (ছাঃ) বললেন, কেন তুমি তাকে বাড়ীতে রেখে এলে না? আমিই তাঁর কাছে যেতাম। আবুবকর (রাঃ) বললেন, আপনি যাওয়ার চাইতে তাঁরই আসার হক বেশী। অতঃপর তিনি পিতাকে সামনে বসিয়ে দিলেন। তখন রাসূল (ছাঃ) তাঁর বুকে হাত রেখে বললেন, ইসলাম কবুল করুন! নিরাপদ থাকুন’। তিনি ইসলাম কবুল করলেন।[6]

[1]. বুখারী হা/৪২৮৬, মুসলিম হা/১৩৫৮ (৪৫১)।
[2]. আবুদাঊদ হা/১৮৭৮। প্রসিদ্ধ আছে যে, এসময় মক্কার একজন দুঃসাহসী পুরুষ ‘ফাযালাহ বিন ওমায়ের’ (فَضالة بن عُمَير) রাসূল (ছাঃ)-কে হত্যার উদ্দেশ্যে ত্বাওয়াফের সময় তাঁর কাছাকাছি হয় এবং তাঁকে হত্যার উদ্যোগ নেয়। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হেসে উঠে বলেন, কি মতলব হে ফাযালাহ! সে বলল, কিছু না। আমি আল্লাহর যিকির করছিলাম। তখন রাসূল (ছাঃ) তার বুকে হাত রেখে বলেন, আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাও। এতে তার হৃদয় শীতল হয়ে যায়। ফাযালাহ বলেন, এটি আমার নিকটে দুনিয়ার সবচেয়ে প্রিয়তর ছিল’। এরপর সে মুসলমান হয়ে যায় (ইবনু হিশাম ২/৪১৭; আর-রাহীক্ব ৪০৭ পৃঃ; যাদুল মা‘আদ ৩/৩৬৩)। ঘটনাটি বিশুদ্ধভাবে প্রমাণিত নয় (মা শা-‘আ ১৯২ পৃঃ; আলবানী, দিফা‘ ‘আনিল হাদীছ, পৃঃ ১/৩৩, সনদ যঈফ)।
[3]. মুসলিম হা/১৩২৯; বুখারী হা/৫০৫।
[4]. ফাৎহুল বারী ৩/৫৪৪, হা/১৫৯৮-এর আলোচনা ‘হজ্জ’ অধ্যায়-২৫, অনুচ্ছেদ-৫১।
[5]. বিস্তারিত দ্রঃ ফাৎহুল বারী ৩/৫৪৫, ৫৪৭, হা/১৫৯৮ ও ১৬০১-এর ব্যাখ্যা, ‘হজ্জ’ অধ্যায়, ৫১ ও ৫৪ অনুচ্ছেদ।
[6]. ইবনু হিশাম ২/৪০৬।

রাসূল (ছাঃ)-এর হাজূনে অবতরণ

এদিন তিনি তাঁর নিজ পিতৃগৃহে অবতরণ করেননি। বরং তাঁর জন্য হাজূনে (حَجُون) প্রস্ত্ততকৃত তাঁবুতে অবতরণ করেন।[1] এই স্থানেই কুরায়েশগণ বনু হাশেম ও মুসলমানদের সাথে বয়কটচুক্তি করেছিল, যা তিন বছর স্থায়ী হয়। উসামা বিন যায়েদ তাঁকে জিজ্ঞেস করেন, বাড়িতে প্রবেশ করবেন কি? জবাবে রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘আক্বীল আমাদের জন্য কোন ঘর-বাড়ি ছেড়ে গেছেন কি?[2] অর্থাৎ ‘আক্বীল ও তার বড় ভাই ত্বালিব, যারা তখন কাফের ছিলেন। বদর যুদ্ধের বছর কাফের অবস্থায় ত্বালিবের মৃত্যুর পর ‘আক্বীল তাদের বাড়ি-ঘর সব বেঁচে দিয়েছিলেন। আর আলী ও জা‘ফর ইসলামের কারণে আবু ত্বালিবের অংশীদার হননি। এর দ্বারা তিনি বুঝাতে চেয়েছিলেন যে, মুসলিম কোন কাফিরের উত্তরাধিকারী হয় না।[3]

[1]. সীরাহ ছহীহাহ ২/৪৮২; মুসনাদ আবু ইয়া‘লা হা/৫৯৫৪; বুখারী হা/৩৫৭; মুসলিম হা/৩৩৬ (৮২)।
[2]. মুসলিম হা/১৩৫১; বুখারী হা/১৫৮৮।
[3]. ফাৎহুল বারী হা/১৫৮৮-এর আলোচনা দ্রষ্টব্য। উল্লেখ্য যে, ২য় হিজরীতে বদর যুদ্ধ থেকে ফিরে সেই বছর কাফের অবস্থায় ত্বালিবের মৃত্যু হ’লে আক্বীল সব সম্পত্তির মালিক হন। পরে তিনি সবকিছু বেঁচে দেন। আক্বীল ৮ম হিজরীতে মক্কা বিজয়ের বছর মুসলমান হন। কেউ বলেছেন, ৬ষ্ঠ হিজরীতে হোদায়বিয়ার সন্ধির পর। তিনি ৮ম হিজরীর প্রথম দিকে মদীনায় হিজরত করেন। পরে মুতার যুদ্ধে যোগদান করেন। তিনি কুরায়েশদের চারজন প্রসিদ্ধ বিবাদ মীমাংসাকারী ব্যক্তির অন্যতম ছিলেন। বংশবিদ্যা বিষয়ে অভিজ্ঞ ছিলেন। তিনি (১০১ বছরের) দীর্ঘ বয়সে ইয়াযীদ বিন মু‘আবিয়ার শাসনকালের (৬০-৬৪ হি.) প্রথম দিকে মৃত্যুবরণ করেন (আল-ইছাবাহ, ‘আক্বীল ক্রমিক ৫৬৩২)।

মক্কা বিজয়ের পর ১ম দিনের ভাষণ

মক্কা বিজয়ের দু’দিনে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একাধিক ভাষণ দিয়েছেন। পূর্বাপর সম্পর্ক বিবেচনায় ভাষণগুলিকে ১ম দিনের ও ২য় দিনের ভাষণ হিসাবে ভাগ করা হয়েছে।

১ম দিন তিনি কা‘বাগৃহের দরজায় দাঁড়িয়ে কুরায়েশদের উদ্দেশ্যে সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেন।-

(১) হামদ ও ছানা শেষে তিনি বলেন,اللهُ أَكْبَرُ، اللهُ أَكْبَرُ، اللهُ أَكْبَرُ، لآ إلَه إلاَّ اللهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيْكَ لَهُ صَدَقَ وَعْدَهُ وَنَصَرَ عَبْدَهُ وَهَزَمَ الْأَحْزَابَ وَحْدَهُ ‘আল্লাহ সবার চেয়ে বড়, আল্লাহ সবার চেয়ে বড়, আল্লাহ সবার চেয়ে বড়। আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। যিনি এক, যাঁর কোন শরীক নেই। তিনি তাঁর ওয়াদা সত্যে পরিণত করেছেন। তাঁর বান্দাকে সাহায্য করেছেন এবং সেনাদল সমূহকে একাই পরাভূত করেছেন’। (২) أَلاَ كُلُّ مَأْثُرَةٍ أَوْ مَالٍ أَوْ دَمٍ فَهُوَ تَحْتَ قَدَمَيَّ هَاتَيْنِ إِلاَّ سِدَانَةَ الْبَيْتِ وَسِقَايَةَ الْحَاجِّ ‘শুনে রাখ, সম্মান ও সম্পদের সকল অহংকার এবং রক্তারক্তি আমার এই পদতলে পিষ্ট হ’ল। কেবলমাত্র বায়তুল্লাহর চাবি সংরক্ষণ ও হাজীদের পানি পান করানোর সম্মানটুকু ছাড়া (অর্থাৎ এ দু’টি দায়িত্ব তোমাদের জন্য বহাল রইল)। (৩)أَلاَ وَقَتْلُ الْخَطَإِ شِبْهُ الْعَمْدِ السَّوْطُ وَالْعَصَا، فَفِيهِ الدِّيَةُ مُغَلَّظَةً مِائَةٌ مِنَ الْإِبِلِ أَرْبَعُونَ مِنْهَا فِي بُطُونِهَا أَوْلاَدُهَا ‘ভুলক্রমে হত্যা যা লাঠিসোটা দ্বারা হয়ে থাকে, তা ইচ্ছাকৃত হত্যার সমতুল্য। তাকে পূর্ণ রক্তমূল্য দিতে হবে একশ’টি উট। যার মধ্যে ৪০টি হবে গর্ভবতী’।[1]

(৪) অতঃপর বলেন,يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّ اللهَ قَدْ أَذْهَبَ عَنْكُمْ عُبِّيَّةَ الْجَاهِلِيَّةِ وَفَخْرَهَا بِالْآبَاءِ، فَالنَّاسُ رَجُلاَنِ : مُؤْمِنٌ تَقِيٌّ وَفَاجِرٌ شَقِيٌّ، أَنْتُمْ بَنُوْ آدَمَ وَآدَمُ مِنْ تُرَابٍ ‘হে জনগণ! আল্লাহ তোমাদের থেকে জাহেলিয়াতের অংশ ও পূর্ব পুরুষের অহংকার দূরীভূত করে দিয়েছেন। মানুষ দু’প্রকারের : মুমিন আল্লাহভীরু অথবা পাপাচারী হতভাগা। তোমরা আদম সন্তান। আর আদম ছিলেন মাটির তৈরী’ (আর মাটির কোন অহংকার নেই)। অতঃপর তিনি নিম্নোক্ত আয়াতটি পাঠ করলেন,يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّا خَلَقْنَاكُمْ مِنْ ذَكَرٍ وَأُنْثَى وَجَعَلْنَاكُمْ شُعُوبًا وَقَبَائِلَ لِتَعَارَفُوْا إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللهِ أَتْقَاكُمْ إِنَّ اللهَ عَلِيْمٌ خَبِيْرٌ ‘হে মানবজাতি! আমরা তোমাদেরকে একজন পুরুষ ও একজন নারী হ’তে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে বিভিন্ন সম্প্রদায় ও গোত্রে বিভক্ত করেছি যাতে তোমরা পরস্পরে পরিচিত হ’তে পার। নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে আল্লাহর নিকটে সবচেয়ে সম্মানিত সেই ব্যক্তি, যিনি তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে আল্লাহভীরু। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞ এবং তিনি সবকিছুর খবর রাখেন’ (হুজুরাত ৪৯/১৩)।[2]

(৫) তিনি বললেন,لاَ يُقْتَلُ قُرَشِىٌّ صَبْرًا بَعْدَ هَذَا الْيَوْمِ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ ‘আজকের দিনের পর কোন কুরায়শীকে আর যুদ্ধাবস্থা ব্যতীত হত্যা করা হবে না’ (মুসলিম হা/১৭৮২)। অর্থাৎ তারা এদিন সবাই মুসলমান হবে এবং কেউ মুরতাদ হবে না। আর অন্যায়ভাবে তাদের কাউকে হত্যা করা হবে না (ঐ, শরহ নববী)। অতঃপর তিনি বলেন,أَقُوْلُ هَذَا وَاسْتَغْفَرُ اللهَ لِيْ وَلَكُمْ ‘আমি এগুলি বললাম। অতঃপর আমি আল্লাহর নিকট আমার জন্য ও তোমাদের জন্য ক্ষমা চাচ্ছি’ (ছহীহ ইবনু হিববান হা/৩৮২৮)।

(৬) ভাষণ শেষে তিনি সমবেত কুরায়েশদের উদ্দেশ্যে বলেন,يَا مَعْشَرَ قُرَيْشٍ مَا تَرَوْنَ أَنِّي فَاعِلٌ بِكُمْ؟ ‘হে কুরায়েশগণ! আমি তোমাদের সাথে কিরূপ আচরণ করব বলে তোমরা আশা কর’? সবাই বলে উঠল,خَيْرًا، أَخٌ كَرِيمٌ وَابْنُ أَخٍ كَرِيمٍ ‘উত্তম আচরণ। আপনি দয়ালু ভাই ও দয়ালু ভাইয়ের পুত্র’। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন,فَإِنّي أَقُولُ لَكُمْ كَمَا قَالَ يُوسُفُ لِإِخْوَتِهِ لاَ تَثْرِيبَ عَلَيْكُمُ الْيَوْمَ اذْهَبُوا فَأَنْتُمُ الطُّلَقَاءُ ‘শোন! আমি তোমাদের সেকথাই বলছি, যেকথা ইউসুফ তার ভাইদের বলেছিলেন, ‘তোমাদের প্রতি আজ আর কোন অভিযোগ নেই’ (ইউসুফ ১২/৯২)। যাও তোমরা সবাই মুক্ত’।[3] বর্ণনাটির সনদ ‘মুরসাল’ বা যঈফ।[4] কিন্তু মতন (Text) মশহূর এবং এর মর্ম (Meaning) সঠিক। কারণ ঐ দিন কাউকে বন্দী করা হয়নি বা গণীমত সংগ্রহ করা হয়নি। বরং সবাই মুক্ত ছিল এবং উপস্থিত সবাই বায়‘আত গ্রহণ করে ইসলাম কবুল করেছিল।

উক্ত প্রসঙ্গে উবাই বিন কা‘ব (রাঃ) বলেন, ‘ওহোদের দিন আনছারদের ৬৪ জন ও মুহাজিরদের ৬ জন শহীদ হন। তখন রাসূল (ছাঃ)-এর সাথীগণ বলেন, ‘যদি আমাদের নিকট মুশরিকদের সঙ্গে এইরূপ কোন দিন আসে, তাহ’লে আমরা অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে দ্বিগুণ প্রতিশোধ নেব। অতঃপর যখন মক্কা বিজয়ের দিন এল, তখন একজন অজ্ঞাত ব্যক্তি বলে উঠল,لاَ قُرَيْشَ بَعْدَ الْيَوْمِ، فَنَادَى مُنَادِي رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَمِنَ الْأَسْوَدُ وَالْأَبْيَضُ إِلاَّ فُلاَنًا وَفُلاَنًا، نَاسًا سَمَّاهُمْ ‘আজকের দিনের পর আর কোন কুরায়েশ নেই’। তখন রাসূল (ছাঃ)-এর একজন ঘোষক উচ্চৈঃস্বরে বললেন, কালো-সাদা সকলে নিরাপত্তা পাবে, অমুক অমুক ব্যতীত, যাদের নাম তিনি বললেন। এ সময় আল্লাহ নাযিল করেন,وَإِنْ عَاقَبْتُمْ فَعَاقِبُوا بِمِثْلِ مَا عُوقِبْتُمْ بِهِ وَلَئِنْ صَبَرْتُمْ لَهُوَ خَيْرٌ لِلصَّابِرِينَ ‘যদি তোমরা প্রতিশোধ গ্রহণ কর, তবে ঐ পরিমাণ প্রতিশোধ গ্রহণ করবে, যে পরিমাণ তোমাদেরকে কষ্ট দেওয়া হয়েছে। আর যদি তোমরা ছবর কর, তাহ’লে সেটাই ছবরকারীদের জন্য উত্তম হবে’ (নাহল ১৬/১২৬)। তখন রাসূল (ছাঃ) বললেন,نَصْبِرُ وَلاَ نُعَاقِبُ ‘আমরা ছবর করব, প্রতিশোধ নেব না’ (আহমাদ হা/২১২৬৭, সনদ হাসান)।

সেমতে ছবর করা হয়, ঘোষিত মাত্র কয়েকজনকে হত্যা করা হয়। বস্ত্ততঃ এদিন কিছু সময়ের জন্য রক্তপাত হালাল করা হ’লেও ২য় দিনের ভাষণে তা চিরকালের জন্য হারাম ঘোষণা করা হয়।

[1]. আবুদাঊদ হা/৪৫৪৭, সনদ হাসান; ছহীহ ইবনু হিববান হা/৩৮২৮, সনদ ছহীহ।
[2]. তিরমিযী হা/৩২৭০; আবু দাউদ হা/৫১১৬; ঐ, মিশকাত হা/৪৮৯৯; ছহীহাহ হা/২৭০০।
[3]. ইবনু হিশাম ২/৪১২; যাদুল মা‘আদ ৩/৩৬০; আর-রাহীক্ব ৪০৫ পৃঃ; আল-বিদায়াহ ৪/৩০১।
[4]. হাদীছ যঈফ, তাহকীক ইবনু হিশাম, ক্রমিক ১৬৮১; যঈফাহ হা/১১৬৩; মা শা-‘আ ১৯০ পৃঃ।

মক্কা বিজয়ের ১ম দিনের ঘটনাসমূহ

কালো খেযাব নিষিদ্ধ

এদিন আবুবকর (রাঃ) স্বীয় পিতা আবু কুহাফাকে ইসলাম কবুলের জন্য নিয়ে এলে তাঁর মাথার চুল ও দাড়ি কাশফুলের মত সাদা দেখে রাসূল (ছাঃ) বলেন,غَيِّرُوا هَذَا بِشَىْءٍ وَاجْتَنِبُوا السَّوَادَ ‘তোমরা এঁর চুলগুলি কালো ব্যতীত অন্য কোন রং দিয়ে পরিবর্তন করে দাও’।[1] ইবনু আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,يَكُونُ قَوْمٌ يَخْضِبُونَ فِى آخِرِ الزَّمَانِ بِالسَّوَادِ كَحَوَاصِلِ الْحَمَامِ لاَ يَرِيحُونَ رَائِحَةَ الْجَنَّةِ ‘শেষ যামানায় একদল লোকের আবির্ভাব হবে, যারা কালো রং-এর খেযাব লাগাবে কবুতরের বুকের ঠোসার কালো পাখনা সমূহের ন্যায়। এরা জান্নাতের সুগন্ধিও পাবে না’।[2]

কা‘বাগৃহের চাবি হস্তান্তর

জাহেলী যুগ থেকেই বনু হাশেমের উপর এবং সে হিসাবে ইসলামী যুগের প্রাক্কালে হযরত আববাস-এর উপরে হাজীদের পানি পান করানোর এবং ওছমান বিন ত্বালহার উপর কা‘বার চাবি সংরক্ষণের দায়িত্ব ছিল। ওছমান বিন ত্বালহা ৭ম হিজরীর প্রথম দিকে মদীনায় গিয়ে ইসলাম কবুল করেন’। মক্কা বিজয়ের পর রাসূল (ছাঃ) তার নিকটেই পুনরায় চাবি হস্তান্তর করেন (ইবনু হিশাম ২/৪১২)।[3] যা আজও অব্যাহত আছে। যাদের ১০৮তম বংশধর শায়খ আব্দুল কাদের আশ-শায়বী ৭৫ বছর বয়সে গত ২৩শে অক্টোবর’২০১৪-তে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর পরে এখন দায়িত্বে আছেন শায়বী পরিবারের সবচেয়ে প্রবীণ ব্যক্তি ড. ছালেহ বিন ত্বোয়াহা আশ-শায়বী।[4]

৮ রাক‘আত নফল ছালাত আদায়

মক্কা বিজয় সম্পন্ন হওয়ার পর দুপুরের কিছু পূর্বে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ‘হাজূনে’ তাঁর অবস্থান স্থলে গমন করেন ও গোসল সারেন। এ সময় ফাতেমা (রাঃ) তাঁকে পর্দা করেন। গোসলের সময় আলী (রাঃ)-এর বোন উম্মে হানী (যিনি ঐ দিন ইসলাম কবুল করেন), সেখানে যান ও অনুমতি প্রার্থনা করেন। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) এক কাপড়ে ৮ রাক‘আত নফল ছালাত আদায় করেন। তিনি বলেন, এটি ছিল ‘ছালাতুয যুহা’।[5] অতঃপর তিনি উম্মে হানীর সাথে কথা বলেন। ঐ সময় উম্মে হানীর গৃহে তার দু’জন দেবর হারেছ বিন হিশাম ও আব্দুল্লাহ বিন আবু রাবী‘আহ আশ্রিত ছিল। আলী (রাঃ) তাদের হত্যা করতে চেয়েছিলেন। উম্মে হানী তাদের জন্য রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে আশ্রয় চাইলে তিনি তাদের আশ্রয় দেন।[6] ইবনু কাছীর বলেন, এটি ছিল বিজয়োত্তর শুকরিয়ার ছালাত, যা তিনি দুই দুই রাক‘আত করে পড়েছিলেন। পরে এটাই রীতি হয়ে যায়। যেমন সা‘দ ইবনু আবী ওয়াকক্বাছ মাদায়েন বিজয়ের দিন এটা পড়েন।[7]

কা‘বার ছাদে আযানের ধ্বনি

যোহরের ওয়াক্ত সমাগত। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বেলালকে নির্দেশ দিলেন কা‘বার ছাদে দাঁড়িয়ে আযান দিতে। শুরু হ’ল বেলালের মনোহারিণী কণ্ঠের গুরুগম্ভীর আযান ধ্বনি। শিরকী জাহেলিয়াত খান খান হয়ে ভেঙ্গে পড়লো তাওহীদ ও রিসালাতের গগনভেদী আওয়াযে। মক্কার পাহাড়ে ও উপত্যকায় সে আওয়ায ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়ে চলে গেল দূরে বহু দূরে। ছবি ও মূর্তিহীন কা‘বা পুনরায় ইবরাহীমী যুগের আসল চেহারা ফিরে পেল। বেলালী কণ্ঠের এ আযান ধ্বনি যেন তাই খোদ কা‘বারই কণ্ঠস্বর। মুমিনের হৃদয়ে তা এনে দিল এক অনাবিল আনন্দের অব্যক্ত মূর্চ্ছনা, এক অনুপম আবেগেয় বাঙ্ময় অনুভূতি। আড়াই হাযার বছর পূর্বে নির্মিত ইবরাহীম ও ইসমাঈলের স্মৃতিধন্য কা‘বার পাদদেশে মাক্বামে ইবরাহীমে দাঁড়িয়ে ছালাতের ইমামতি করবেন ইসমাঈল-সন্তান মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)। মক্কার অলিতে-গলিতে শুরু হ’ল এক অনির্বচনীয় আনন্দের ফল্গুধারা। দলে দলে মুমিন নর-নারী ছুটলো কা‘বার পানে। সে দৃশ্য কেবল মনের চোখেই দেখা যায়। লিখে প্রকাশ করা যায় না। কেবল হৃদয় দিয়ে অনুভব করা যায়, মুখে বলা যায় না। কিন্তু শয়তান কখনই তার স্বভাব ছাড়ে না।[8]

যাদের রক্ত মূল্যহীন ঘোষণা করা হয়

মক্কা বিজয়ের দিন আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বড় বড় পাপীদের মধ্যে ৯ জনের রক্ত মূল্যহীন ঘোষণা করেন এবং কঠোর নির্দেশ জারী করেন যে, এরা যদি কা‘বার গেলাফের নীচেও আশ্রয় নেয়, তথাপি তাদের হত্যা করা হবে। এই নয় জন ছিল- (১) আব্দুল্লাহ বিন সা‘দ বিন আবু সারাহ। ইনি ওছমান গণী (রাঃ)-এর দুধ ভাই ছিলেন। পরে মুসলমান হন এবং রাসূল (ছাঃ)-এর ‘অহি’ লেখক হন। পরে ‘মুরতাদ’ হয়ে কুরায়েশদের কাছে ফিরে যায়। (২) আব্দুল্লাহ বিন খাত্বাল। এ ব্যক্তি মুসলমান হওয়ার পর রাসূল (ছাঃ) তাকে যাকাত সংগ্রহের জন্য প্রেরণ করেন। সেখানে তিনি তার মুসলিম গোলামকে হত্যা করেন। অতঃপর ‘মুরতাদ’ হয়ে মুশরিকদের সাথে মিশে যায়। সে কা‘বাগৃহের গেলাফ ধরে ঝুলছিল (যাদুল মা‘আদ ৩/৩৯০)। জনৈক ছাহাবী এখবর দিলে রাসূল (ছাঃ) তাকে হত্যার নির্দেশ দেন। (৩-৪) আব্দুল্লাহ বিন খাত্বালের দুই দাসী। যারা রাসূল (ছাঃ)-কে ব্যঙ্গ করে গান গাইত (৫) হুওয়াইরিছ বিন নুক্বাইয বিন ওয়াহাব (حُوَيرث بن نُقَيذ)। সে মক্কায় রাসূল (ছাঃ)-কে কঠিনভাবে কষ্ট দিত। এ ব্যক্তি মক্কা থেকে মদীনায় প্রেরণের সময় রাসূল-কন্যা হযরত ফাতেমা ও উম্মে কুলছূমকে তীর মেরে উটের পিঠ থেকে ফেলে দিয়েছিল’। (৬) মিক্বইয়াস বিন হুবাবাহ (مِقْيَس بن حُبابة)। এ ব্যক্তি ইতিপূর্বে মুসলমান হয়ে জনৈক আনছার ছাহাবীকে হত্যা করে ‘মুরতাদ’ হয়ে মুশরিকদের সঙ্গে মিলিত হয়েছিল। (৭) সারাহ- যে আব্দুল মুত্ত্বালিবের সন্তানদের কারু দাসী ছিল। ধারণা করা হয় যে, এই দাসীই মদীনা থেকে গোপনে হাতেব বিন আবু বালতা‘আহর পত্র বহন করেছিল (ইবনু হিশাম ২/৩৯৮)। (৮) ইকরিমা বিন আবু জাহল (ইবনু হিশাম ২/৪০৯-১০)। (৯) হাববার ইবনুল আসওয়াদ (هَبَّار بن الأَسوَد)। এ ব্যক্তি রাসূল (ছাঃ)-এর গর্ভবতী কন্যা যয়নবকে হিজরতের সময় তার হাওদায় বর্শা নিক্ষেপ করেছিল। যাতে আহত হয়ে তিনি উটের পিঠ থেকে নীচে পাথরের উপরে পতিত হন এবং তাঁর গর্ভপাত হয়ে যায় (ইবনু হিশাম ১/৬৫৪)।

উপরের ৯ জনের মধ্যে যে ৪ জনকে হত্যা করা হয়, তারা হ’ল- (১) আব্দুল্লাহ বিন খাত্বাল। তাকে হত্যা করেন সাঈদ বিন হুরায়েছ আল-মাখযূমী এবং আবু বারযাহ আসলামী। (২) মিক্বইয়াস বিন হুবাবাহ। তার কওমের নুমায়লা বিন আব্দুল্লাহ তাকে হত্যা করেন। (৩) ইবনু খাত্বালের দুই দাসীর মধ্যে একজন। (৪) হুওয়াইরিছ বিন নুক্বাইয বিন ওয়াহাব। আলী (রাঃ) তাকে হত্যা করেন।

অতঃপর বাকী ৫ জন যাদের ক্ষমা করা হয় তারা হ’লেন : (১) আব্দুল্লাহ বিন আবু সারাহ। মক্কা বিজয়ের দিন হযরত ওছমান (রাঃ) তাকে সাথে নিয়ে রাসূল (ছাঃ)-এর দরবারে এসে আশ্রয় প্রার্থনা করেন। ফলে তাকে ক্ষমা করা হয়। পরে আমৃত্যু তার ইসলাম খুবই ভাল ছিল। (২) ইকরিমা বিন আবু জাহল। তার স্ত্রী এসে আশ্রয় প্রার্থনা করলে তাকে আশ্রয় দেওয়া হয়। পরে ইয়ামনের পথে পলায়নরত অবস্থায় তার স্ত্রী গিয়ে তাকে নিয়ে আসেন। পরবর্তীতে তার ইসলাম খুবই ভাল ছিল। (৩) হাববার ইবনুল আসওয়াদ। মক্কা বিজয়ের দিন এই ব্যক্তি পালিয়ে যায়। পরে মুসলমান হন এবং তার ইসলাম সুন্দর ছিল। (৪) ইবনু খাত্বালের দুই গায়িকা দাসীর মধ্যে একজনের জন্য আশ্রয় চাওয়া হয়। অতঃপর সে ইসলাম কবুল করে। (৫) সারাহর জন্যও আশ্রয় প্রার্থনা করা হয় এবং সেও ইসলাম কবুল করে।[9]

উল্লেখ্য যে, ইবনু হাজার বিভিন্ন সূত্রে ৮ জন পুরুষ ও ৬ জন নারী সহ মোট ১৪ জনের কথা বলেছেন। কিন্তু তাঁর বর্ণিত তালিকা মতে পুরুষের সংখ্যা হয় ৯ জন এবং নারীর সংখ্যা ৪ জন সহ মোট ১৩ জন। যাদের মধ্যে ইতিপূর্বে বর্ণিত ৬ জন পুরুষ ছাড়াও বাকী ৩ জন হ’লেন, (ক) হারেছ বিন ত্বালাত্বেল আল-খুযাঈ (حارثُ بنُ طَلاطِلَ الْخُزاعِيُّ)। যাকে আলী (রাঃ) হত্যা করেন। (খ) হামযাহ (রাঃ)-এর হত্যাকারী ওয়াহ্শী বিন হারব, যিনি পরে মদীনায় গিয়ে ইসলাম কবুল করেন। (গ) রাসূল (ছাঃ)-কে ব্যঙ্গকারী বিখ্যাত কবি কা‘ব বিন যুহায়ের, যিনি পরে মদীনায় গিয়ে ইসলাম কবুল করেন। অতঃপর ১ জন নারী হ’লেন, (ঘ) আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দ বিনতে ওৎবা। যিনি মক্কা বিজয়ের দিন মুসলমান হন।[10]

উপরের হিসাব মতে নিহতদের মোট সংখ্যা দাঁড়ায় ৫ জন। (১) আব্দুল্লাহ বিন খাত্বাল (২) মিক্বইয়াস বিন হুবাবাহ (৩) হুওয়াইরিছ বিন নুক্বাইয বিন ওয়াহাব (৪) হারেছ বিন ত্বালাত্বেল আল-খুযাঈ এবং একজন নারী- (৫) ইবনু খাত্বালের দুই গায়িকা দাসীর মধ্যে একজন।

ক্ষমাপ্রাপ্তদের মোট সংখ্যা দাঁড়ায় ৮ জন। তন্মধ্যে পুরুষ ৫ জন। (১) আব্দুল্লাহ বিন আবু সারাহ (২) ইকরিমা বিন আবু জাহল (৩) হাববার ইবনুল আসওয়াদ (৪) ওয়াহশী বিন হারব ও (৫) কা‘ব বিন যুহায়ের এবং নারী ৩ জন।- (৬) ইবনু খাত্বালের দুই গায়িকা দাসীর মধ্যে একজন (৭) দাসী সারাহ (৮) আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দ বিনতে ওৎবা।

উল্লেখ্য যে, রক্ত প্রবাহিত করা স্রেফ মক্কা বিজয়ের দিন কয়েক ঘণ্টার (سَاعَةً مِنْ نَهَارٍ) জন্য হালাল করা হয়েছিল। পরবর্তীতে চিরকালের জন্য হারাম করা হয় (বুখারী হা/২৪৩৪)।

এদিকে মক্কার অন্যতম নেতা ছাফওয়ান বিন উমাইয়ার রক্ত বৃথা সাব্যস্ত করা না হ’লেও তিনি পালিয়ে যান। ওমায়ের বিন ওয়াহাব আল-জুমাহী তার জন্য আশ্রয় প্রার্থনা করলে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) তা মনযূর করেন এবং তাকে আশ্রয় দানের প্রতীক স্বরূপ নিজের পাগড়ী প্রদান করেন। যে পাগড়ী পরে তিনি বিজয়ের দিন মক্কায় প্রবেশ করেছিলেন। অতঃপর ওমায়ের যখন ছাফওয়ানের নিকটে পৌঁছেন, তখন তিনি জেদ্দা হ’তে ইয়ামন যাওয়ার জন্য জাহাযে ওঠার প্রস্ত্ততি নিচ্ছিলেন। ওমায়ের তাকে ফিরিয়ে আনেন। তিনি এসে রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট দু’মাস সময়ের আবেদন করেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে চার মাস সময় দেন। অতঃপর ছাফওয়ান ইসলাম কবুল করেন। তার স্ত্রী পূর্বেই ইসলাম কবুল করেছিলেন। ফলে তাদের মধ্যে বিবাহ বহাল রাখা হয়।[11] ছাফওয়ান মুশরিক অবস্থায় রাসূল (ছাঃ)-এর পক্ষে হোনায়েন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।

[1]. মুসলিম হা/২১০২ (৭৯); মিশকাত হা/৪৪২৪।
[2]. আবুদাঊদ হা/৪২১২; নাসাঈ হা/৫০৭৫; মিশকাত হা/৪৪৫২ ‘পোষাক’ অধ্যায়, ‘চিরুনী করা’ অনুচ্ছেদ।
[3]. আর-রাহীক্ব ৩৪৭-৪৮, ৪০৫ পৃঃ। এখানে প্রসিদ্ধ আছে যে, ভাষণ শেষে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) মাসজিদুল হারামে বসে পড়লেন। এমন সময় চাবি হাতে নিয়ে হযরত আলী (রাঃ) এসে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! ‘আমাদেরকে হাজীদের পানি পান করানোর দায়িত্বের সাথে সাথে কা‘বাগৃহের চাবি সংরক্ষণের দায়িত্বটাও অর্পণ করুন’। অন্য বর্ণনায় এসেছে যে, এই দাবীটি চাচা আববাস (রাঃ) করেছিলেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, ‘ওছমান বিন ত্বালহা কোথায়? অতঃপর তিনি এলে তাকে বললেন, هَاكَ مِفْتَاحَكَ يَا عُثْمَانُ الْيَوْمَ يَوْمُ بِرّ وَوَفَاءٍ ‘হে ওছমান! এই নাও তোমার চাবি। আজ হ’ল সদাচরণ ও ওয়াদা পূরণের দিন’ (ইবনু হিশাম ২/৪১২; আর-রাহীক্ব ৪০৫ পৃঃ)। এর সনদ ‘মুরসাল’ বা যঈফ (আলবানী, যঈফাহ হা/১১৬৩)। উল্লেখ্য যে, ওছমান-এর পিতা ত্বালহা ও চাচা ওছমান বিন আবু ত্বালহা আল-‘আবদারী আল-হাজাবী ওহোদের যুদ্ধে নিহত হন (আল-ইছাবাহ, ওছমান বিন ত্বালহা ক্রমিক ৫৪৪৪)।
অন্য এক বর্ণনায় এসেছে যে, আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) একথাও বলেন, خُذُوهَا خَالِدَةً تَالِدَةً لاَ يَنْزِعُهَا مِنْكُمْ إلاَّ ظَالِمٌ ‘তোমরা এটা গ্রহণ কর চিরদিনের জন্য। তোমাদের কাছ থেকে কেউ এটা ছিনিয়ে নেবে না যালেম ব্যতীত। হে ওছমান! আল্লাহ তাঁর গৃহের জন্য তোমাদেরকে আমানতদার করেছেন। ‘অতএব এই গৃহ থেকে ন্যায়সঙ্গত ভাবে যা তোমাদের কাছে আসবে, তা তোমরা ভক্ষণ করবে’ (ফাৎহুল বারী হা/৪২৮৯-এর আলোচনা; যাদুল মা‘আদ ৩/৩৬০; আর-রাহীক্ব ৪০৫ পৃঃ)। বর্ণনাটি বিশুদ্ধ সনদে প্রমাণিত নয়’ (মা শা-‘আ ১৯২ পৃঃ)। কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত। যা আজও অব্যাহত আছে।
[4]. মাসিক আত-তাহরীক, রাজশাহী, ডিসেম্বর’১৪, ১৮তম বর্ষ ৩য় সংখ্যা ৪৬ পৃঃ।
[5]. বুখারী হা/৩৫৭; মুসলিম হা/৩৩৬ (৮২)।
প্রসিদ্ধ আছে যে, এদিন রাসূল (ছাঃ) উম্মে হানীর গৃহে প্রবেশ করেন ও সেখানে গোসল করে ৮ রাক‘আত ছালাত আদায় করেন (আর-রাহীক্ব ৪০৬ পৃঃ)। কথা সঠিক নয়। বরং সঠিক সেটাই যা উপরে ছহীহ হাদীছে বর্ণিত হয়েছে।
[6]. হাকেম হা/৫২১০; আহমাদ হা/২৬৯৩৬, সনদ ছহীহ।
[7]. ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা নছর, ৮/৪৮২।
[8]. এখানে প্রসিদ্ধ আছে যে, সদ্য ইসলাম গ্রহণকারী কুরায়েশ নেতা আবু সুফিয়ান বিন হারব এবং তার সাথী মুশরিক নেতা আত্তাব বিন আসীদ ও হারেছ বিন হেশাম- যারা তখন কা‘বার চত্বরে বসেছিলেন, এ আযান তাদের হৃদয়ে কোন রেখাপাত করেনি। জাহেলী যুগের কৌলিন্যের অহংকার তখনও তাদেরকে তাড়া করে ফিরছিল। তাদের অন্যতম নেতা উমাইয়া বিন খালাফের সাবেক ক্রীতদাস ও তার হাতে সে সময় মর্মান্তিকভাবে নির্যাতিত নিগ্রো যুবক বেলাল আজ মহাপবিত্র কা‘বার ছাদে উঠে দাঁড়িয়েছে, এটা তাদের কাছে ছিল নিতান্ত অসহনীয় বিষয়। কথায় কথায় আল্লাহর নাম নিলেও লাত ও ‘উয্যার এই সেবকদের নিকটে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহর আযান ধ্বনি অত্যন্ত অপছন্দনীয় ঠেকলো। তাই আত্তাব বলে উঠলেন, (পিতা) আসীদকে আল্লাহ সম্মানিত করেছেন যে, তিনি এটা শুনেননি, যা তাঁকে ক্রুদ্ধ করত’। হারেছ বললেন, আল্লাহর কসম! যদি আমি জানতে পারি যে, ইনি সত্য, তাহ’লে অবশ্যই আমি তাঁর অনুসারী হয়ে যাব’। আবু সুফিয়ান বললেন, আল্লাহর কসম! আমি কিছুই বলব না। কেননা যদি আমি কিছু বলি তাহ’লে এই কংকরগুলিও আমার সম্পর্কে খবর পৌঁছে দিবে’। এমন সময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সেখানে উপস্থিত হ’লেন এবং বললেন, এইমাত্র তোমরা যেসব কথা বলছিলে, তা আমাকে জানানো হয়েছে। অতঃপর তিনি সব বলে দিলেন। তখন হারেছ ও আত্তাব বলে উঠলেন,نَشْهَدُ أَنَّكَ رَسُوْلُ اللهِ ‘আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনি আল্লাহর রাসূল’! আল্লাহর কসম! আমাদের নিকটে এমন কেউ ছিল না যে, সে গিয়ে আপনাকে বলে দিবে’ (ইবনু হিশাম ২/৪১৩)। বর্ণনাটির সনদ যঈফ (তাহকীক ইবনু হিশাম ক্রমিক ১৬৮৫)।
[9]. যাদুল মা‘আদ ৩/৩৬২; ইবনু হিশাম ২/৪১০; নাসাঈ হা/৪০৬৭, সনদ ছহীহ; মুওয়াত্ত্বা হা/২০০৩; মিশকাত হা/৩১৮০; সনদ ‘মুরসাল’। উল্লেখ্য যে, অন্য বর্ণনায় আব্দুল ‘উযযা বিন খাত্বাল (عبد الْعُزَّى بنُ خَطَلٍ), মাক্বীস বিন ছুবাবাহ (مَقِيسُ بن صُبَابَةَ) এবং হারেছ বিন নুফায়েল বিন ওয়াহাব (حارثُ بنُ نُفَيْل بنِ وَهْب) বলা হয়েছে (যাদুল মা‘আদ ৩/৩৬২)।
প্রসিদ্ধ আছে যে, এইদিন ইকরিমা বিন আবু জাহল রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে ইসলাম কবুল করার জন্য এলে তিনি তাকে দাঁড়িয়ে স্বাগত জানিয়ে বলেন, مَرْحَبًا بِالرَّاكِبِ الْمُهَاجِرِ‘মুহাজির আরোহীর প্রতি অভিনন্দন’ (তিরমিযী হা/২৭৩৫; মিশকাত হা/৪৬৮৪; হাদীছটি যঈফ)। এখানে মুহাজির অর্থ কুফরী থেকে ইসলামের দিকে হিজরতকারী (মিরক্বাত)।
[10]. ফাৎহুল বারী হা/৪২৮০-এর আলোচনা; আর-রাহীক্ব ৪০৬-০৭ পৃঃ।
[11]. ইবনু হিশাম ২/৪১৮; মুওয়াত্ত্বা হা/২০০৩; মিশকাত হা/৩১৮০। বর্ণনাটির সনদ ‘মুরসাল’ বা যঈফ। তার নিকট থেকে হোনায়েন যুদ্ধের সময় বর্মসমূহ ধার নেওয়া বিষয়ে বর্ণিত হাদীছগুলির বিশুদ্ধতার ব্যাপারে বিদ্বানগণ মতভেদ করেছেন। বায়হাক্বী বলেন, বিষয়টির বর্ণনা ‘মুরসাল’। কিন্তু তার বহু ‘শাওয়াহেদ’ বা সমার্থক বর্ণনা রয়েছে’। বিভিন্ন সূত্রে বর্ণিত হওয়ার কারণে আলবানী বর্ণনাটিকে ‘হাসান’ বলেছেন’ (সিলসিলা ছহীহাহ হা/৬৩১-এর আলোচনা; ইরওয়া হা/১৫১৩, ৫/৩৪৪-৪৬; মা শা-‘আ ১৯৬-৯৮)।

মক্কা বিজয়ের ২য় দিনের ভাষণ

(১) আব্দুল্লাহ বিন যুবায়ের (রাঃ)-এর বিরুদ্ধে ইয়াযীদ বিন মু‘আবিয়া কর্তৃক নিযুক্ত মদীনার গবর্ণর ‘আমর বিন সাঈদ ইবনুল ‘আছ যখন মক্কায় অভিযানের জন্য সৈন্য প্রেরণ করেন, তখন তাকে উদ্দেশ্য করে বিখ্যাত ছাহাবী আবু শুরাইহ (রাঃ) বলেন, ‘হে আমীর! আপনি কি আমাকে সেই ভাষণটি বলার অনুমতি দিবেন, যা আমি নিজ কানে শুনেছি ও নিজ অন্তরে উপলব্ধি করেছি এবং নিজ দুই চোখে দেখেছি, যখন তিনি কথাগুলি বলছিলেন মক্কা বিজয়ের দ্বিতীয় দিনে?

حَمِدَ اللهَ وَأَثْنَى عَلَيْهِ ثُمَّ قَالَ : إِنَّ مَكَّةَ حَرَّمَهَا اللهُ وَلَمْ يُحَرِّمْهَا النَّاسُ، فَلاَ يَحِلُّ لاِمْرِئٍ يُؤْمِنُ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ أَنْ يَسْفِكَ بِهَا دَمًا، وَلاَ يَعْضِدَ بِهَا شَجَرَةً، فَإِنْ أَحَدٌ تَرَخَّصَ لِقِتَالِ رَسُولِ اللهِ- صلى الله عليه وسلم : فِيهَا فَقُولُوا إِنَّ اللهَ قَدْ أَذِنَ لِرَسُولِهِ، وَلَمْ يَأْذَنْ لَكُمْ. وَإِنَّمَا أَذِنَ لِى فِيهَا سَاعَةً مِنْ نَهَارٍ، ثُمَّ عَادَتْ حُرْمَتُهَا الْيَوْمَ كَحُرْمَتِهَا بِالأَمْسِ، وَلْيُبَلِّغِ الشَّاهِدُ الْغَائِبَ- رواه البخارىُّ-

হামদ ও ছানার পরে তিনি বলেন, ‘নিশ্চয়ই মক্কাকে আললাহ হারাম করেছেন। অথচ লোকেরা এটিকে হারাম করেনি। অতঃপর যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখেরাতে বিশ্বাস করে তার জন্য এখানে রক্তপাত ও বৃক্ষ কর্তন হালাল নয়। যদি কেউ আল্লাহর রাসূলের রক্তপাতের দোহাই দিয়ে এটাকে হালাল করতে চায়, তাহ’লে তোমরা বলো, নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর রাসূলকে অনুমতি দিয়েছিলেন। কিন্তু তোমাদেরকে তিনি অনুমতি দেননি। আর তিনি তো আমাকে অনুমতি দিয়েছিলেন কেবল দিনের কিছু সময়ের জন্য। অতঃপর আজ তার সম্মান ফিরে এসেছে, যে সম্মান ছিল গতকাল। সুতরাং তোমাদের উপস্থিতগণ যেন অনুপস্থিতগণের নিকট পৌঁছে দেয়’ (বুখারী হা/১০৪)। উল্লেখ্য যে, উক্ত যুদ্ধে কা‘বাগৃহে রক্তপাত হয় এবং আব্দুল্লাহ বিন যুবায়ের (রাঃ) ৭৩ বছর বয়সে মর্মান্তিকভাবে শহীদ হন (ঐ, ফাৎহুল বারী)।

(২) আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন,

لَمَّا فَتَحَ اللهُ عَلَى رَسُولِهِ- صلى الله عليه وسلم- مَكَّةَ قَامَ فِى النَّاسِ، فَحَمِدَ اللهَ وَأَثْنَى عَلَيْهِ ثُمَّ قَالَ : إِنَّ اللهَ حَبَسَ عَنْ مَكَّةَ الْفِيلَ وَسَلَّطَ عَلَيْهَا رَسُولَهُ وَالْمُؤْمِنِينَ، فَإِنَّهَا لاَ تَحِلُّ لأَحَدٍ كَانَ قَبْلِى، وَإِنَّهَا أُحِلَّتْ لِى سَاعَةً مِنْ نَهَارٍ وَإِنَّهَا لاَ تَحِلُّ لأَحَدٍ بَعْدِى، فَلاَ يُنَفَّرُ صَيْدُهَا وَلاَ يُخْتَلَى شَوْكُهَا وَلاَ تَحِلُّ سَاقِطَتُهَا إِلاَّ لِمُنْشِدٍ، وَمَنْ قُتِلَ لَهُ قَتِيلٌ فَهْوَ بِخَيْرِ النَّظَرَيْنِ، إِمَّا أَنْ يُفْدَى وَإِمَّا أَنْ يُقِيدَ. فَقَالَ الْعَبَّاسُ إِلاَّ الإِذْخِرَ، فَإِنَّا نَجْعَلُهُ لِقُبُورِنَا وَبُيُوتِنَا. فَقَالَ رَسُولُ اللهِ- صلى الله عليه وسلم : إِلاَّ الإِذْخِرَ، فَقَامَ أَبُو شَاهٍ- رَجُلٌ مِنْ أَهْلِ الْيَمَنِ- فَقَالَ اكْتُبُوا لِى يَا رَسُولَ اللهِ، فَقَالَ رَسُولُ اللهِ- صلى الله عليه وسلم : اكْتُبُوا لأَبِى شَاهٍ- رواه البخارىُّ-

‘যখন আল্লাহ তাঁর রাসূলকে মক্কা বিজয় দান করলেন, তখন তিনি লোকদের মধ্যে দাঁড়িয়ে গেলেন। অতঃপর হাম্দ ও ছানা শেষে বলেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ মক্কা থেকে হস্তীওয়ালাদের প্রতিরোধ করেছিলেন এবং তার উপরে তিনি তাঁর রাসূল ও মুমিনদের বিজয়ী করেছেন। আমার পূর্বে কারু জন্য এখানে রক্তপাত হালাল ছিল না। দিনের কিছু সময়ের জন্য কেবল আমার জন্য হালাল করা হয়। আর তা আমার পরে কারু জন্য হালাল হবে না। অতএব এখানকার কোন শিকার কেউ তাড়াবে না। এখানকার কোন কাঁটা কেউ উঠাবে না। কোন হারানো বস্ত্ত কেউ কুড়াবে না। তবে উক্ত বিষয়ে প্রচারকারী ব্যতীত। যদি কেউ হত্যা করে, তবে তার উত্তরাধিকারীদের জন্য দু’টি এখতিয়ার থাকবে। তারা চাইলে হত্যার বদলে হত্যা করবে অথবা রক্তমূল্য গ্রহণ করবে। এ সময় আববাস (রাঃ) বললেন, ‘ইযখির’ (الْإِذْخِر) ঘাস ব্যতীত। কেননা এটি আমরা ব্যবহার করে থাকি আমাদের বাড়ী-ঘরের জন্য এবং কবরের জন্য। তখন রাসূল (ছাঃ) বললেন, ‘ইযখির’ ব্যতীত। এসময় ‘আবু শাহ’ নামক জনৈক ইয়ামনবাসী উঠে দাঁড়িয়ে বলল, اُكْتُبْ لِى يَا رَسُوْلَ اللهِ ‘হে আল্লাহর রাসূল’! কথাগুলি আমাকে লিখে দিন। তখন রাসূল (ছাঃ) বললেন,اُكْتُبُوْا لِأَبِىْ شَاهٍ ‘তোমরা আবু শাহকে কথাগুলি লিখে দাও’।[1] রাসূল (ছাঃ)-এর এই নির্দেশের মধ্যে তাঁর জীবদ্দশায় হাদীছ সংকলনের দলীল পাওয়া যায়।

একই রাবী কর্তৃক অন্য বর্ণনায় এসেছে যে, এই দিন রাসূল (ছাঃ)-এর মিত্র বনু খোযা‘আহ গোত্রের লোকেরা বনু লাইছ(بَنُو لَيْث) গোত্রের জনৈক ব্যক্তিকে হত্যা করে জাহেলিয়াতের সময় তাদের এক ব্যক্তিকে হত্যার বদলা নেয়। একথা জানতে পেরে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) জনগণের উদ্দেশ্যে উক্ত কথা বলেন (বুখারী হা/১১২)।

আবু হুরায়রা ও আবু শুরাইহ উভয় রাবী কর্তৃক আরও বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূল (ছাঃ) বলেন,يَا مَعْشَرَ خُزَاعَةَ وَارْفَعُو أَيْدِيَكُمْ عَنِ الْقَتْلِ فَقَدْ كَثُرَ إِنْ يَّقَعَ ‘হে বনু খোযা‘আহ! হত্যা করা থেকে নিবৃত্ত হও। কেননা হত্যাকান্ড সংঘটিত হ’লে এর সংখ্যা বেড়ে যাবে’ (বুখারী হা/১১২; আহমাদ হা/১৬৪২৪)। তিনি বলেন,فَمَنْقُتِلَ بَعْدَ مَقَامِيْ هَذَا فَأَهْلُهُ بِخَيْرِ النَّظَرَيْنِ إِنْ شَاءُوْا فَدَمُ قَاتِلِهِ وَإِنْ شَاءُوْا فَعَقْلُهُ ‘অতএব এর পরে যদি কেউ হত্যা করে, তবে তার উত্তরাধিকারীদের জন্য দু’টি এখতিয়ার থাকবে। তারা চাইলে হত্যার বদলে হত্যা করবে অথবা রক্তমূল্য গ্রহণ করবে’ (আহমাদ হা/১৬৪২৪)।

(৩) এদিনের ভাষণে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিকাহে মুৎ‘আহ চিরকালের জন্য হারাম করে জনগণের উদ্দেশ্যে বলেন,

يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنِّى قَدْ كُنْتُ أَذِنْتُ لَكُمْ فِى الاِسْتِمْتَاعِ مِنَ النِّسَاءِ وَإِنَّ اللهَ قَدْ حَرَّمَ ذَلِكَ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ فَمَنْ كَانَ عِنْدَهُ مِنْهُنَّ شَىْءٌ فَلْيُخَلِّ سَبِيلَهُ وَلاَ تَأْخُذُوا مِمَّا آتَيْتُمُوهُنَّ شَيْئًا ‘হে জনগণ! আমি তোমাদের জন্য নিকাহে মুৎ‘আহ বা সাময়িকভাবে ঠিকা বিবাহের অনুমতি দিয়েছিলাম। এক্ষণে আল্লাহ এটি ক্বিয়ামত পর্যন্ত নিষিদ্ধ করেছেন। অতএব যে ব্যক্তির নিকট এই ধরনের কোন মহিলা আছে, তাকে ছেড়ে দাও। তাকে যা কিছু সম্পদ তোমরা দিয়েছ, সেখান থেকে কিছুই নিয়োনা’ (মুসলিম হা/১৪০৬ (২১)।

ভাষ্যকার ইমাম নববী বলেন, অত্র হাদীছ দ্বারা বিগত সাময়িক হুকুম সমূহ রহিত করা হয়েছে। যেমন কবর যিয়ারত প্রথমে নারীদের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। পরে তা রহিত করা হয় এবং যিয়ারতের অনুমতি দেওয়া হয়। অত্র হাদীছের মাধ্যমে নিকাহে মুৎ‘আহকে ক্বিয়ামত পর্যন্ত নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে’ (ঐ, শরহ নববী)।

[1]. বুখারী হা/২৪৩৪; মুসলিম হা/১৩৫৫ প্রভৃতি; ইবনু হিশাম ২/৪১৫ ।

ছাফা পাহাড়ের শীর্ষে দাঁড়িয়ে রাসূল (ছাঃ)-এর দো‘আ

মক্কা বিজয় সমাপ্ত হওয়ায় আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) দ্বিতীয় দিন ছাফা পাহাড়ের শীর্ষে ওঠেন এবং কা‘বার দিকে ফিরে দু’হাত তুলে আল্লাহর প্রশংসা করেন। অতঃপর ইচ্ছা মত প্রাণভরে যা খুশী দো‘আ করতে থাকেন’ (মুসলিম হা/১৭৮০)।

আনছারদের সন্দেহ

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন দু’হাত উঠিয়ে প্রার্থনায় রত ছিলেন, তখন আনছারগণ আপোষে বলাবলি করতে থাকেন, হয়তবা আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) মক্কাতেই থেকে যাবেন। আর মদীনায় ফিরে যাবেন না। কেননা মক্কা তাঁর শহর, তাঁর দেশ ও তাঁর জন্মভূমি(بَلَدُهُ وَوَطَنُهُ وَمَوْلِدُهُ)। দো‘আ থেকে ফারেগ হয়ে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) আনছারদের ডেকে বলেন, তোমরা কি বলছিলে? তারা বললেন, তেমন কিছু নয়। কিন্তু রাসূল (ছাঃ)-এর পীড়াপীড়িতে অবশেষে তারা সব বললেন। তখন জবাবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদেরকে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়ে দিলেন,مَعَاذَ اللهِ الْمَحْيَا مَحْيَاكُمْ وَالْمَمَاتُ مَمَاتُكُمْ ‘আল্লাহর আশ্রয় চাই। আমার জীবন তোমাদের সাথে ও আমার মরণ তোমাদের সাথে’।[1]

[1]. ইবনু হিশাম ২/৪১৬; আলবানী, ফিক্বহুস সীরাহ, ৩৯৯ পৃঃ, সনদ ছহীহ।

মক্কার জনগণের নিকট থেকে বায়‘আত গ্রহণ

মক্কা বিজয়ের দ্বিতীয় দিন হাযার হাযার লোক ছাফা পাহাড়ের পাদদেশে জমা হ’তে থাকে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-এর হাতে ইসলামের বায়‘আত নেবার জন্য। রাসূল (ছাঃ) ছাফা পাহাড়ের শীর্ষে দাঁড়িয়ে প্রার্থনা শেষে উপবেশন করলেন এবং ওমর (রাঃ) তাঁর নীচে বসলেন জনগণের বায়‘আত নেবার জন্য’।[1] আসওয়াদ বিন খালাফ (রাঃ) বলেন, আমি ঐ দিন রাসূল (ছাঃ)-কে ছোট-বড় নারী-পুরুষ সকলের নিকট থেকে বায়‘আত নিতে দেখেছি ইসলাম ও কালেমা শাহাদাতের উপরে’।[2]

মক্কা বিজয়ের দিন ইসলাম, ঈমান ও জিহাদের উপরে বায়‘আত গ্রহণ করা হয়। হিজরতের উপরে নয়। কেননা রাসূল (ছাঃ) ঐ দিন বলেন,لاَ هِجْرَةَ بَعْدَ الْفَتْحِ وَلَكِنْ جِهَادٌ وَنِيَّةٌ، وَإِذَا اسْتُنْفِرْتُمْ فَانْفِرُوا ‘মক্কা বিজয়ের পর কোন হিজরত নেই। তবে জিহাদ ও জিহাদের নিয়ত বাকী রইল। যখন তোমাদেরকে আমীরের পক্ষ থেকে জিহাদে বের হ’তে বলা হবে, তখন তোমরা বের হবে’।[3] কারণ মক্কা এখন দারুল ইসলামে পরিণত হয়েছে। ইবনু ওমর (রাঃ) বলেন, মক্কা বিজয়ের পর হিজরতের নির্দেশ রহিত হয়েছে। কিন্তু দারুল কুফর থেকে হিজরত রহিত হয় নি। অতএব মুসলমানদের উপরে হিজরত ওয়াজিব হবে, যখন তার দ্বীন পালনে বাধা সৃষ্টি হবে’ (ফাৎহুল বারী হা/৩৯০০-এর ব্যাখ্যা)।

[1]. ইবনু হিশাম ২/৪১৬; আর-রাহীক্ব ৪০৮ পৃঃ; ফিক্বহুস সীরাহ, ৩৯৯ পৃঃ সনদ ছহীহ।
প্রসিদ্ধ আছে যে, এই সময় রাসূল (ছাঃ) সকলের নিকট থেকে বায়‘আত নেন সাধ্যমত শ্রবণ ও আনুগত্যের উপরে’ (عَلَى السَّمْعِ وَالطَّاعَةِ لِلَّهِ وَلِرَسُولِهِ- فِيمَا اسْتَطَاعُوا)। ইবনু জারীর এটি বিনা সনদে অথবা ক্বাতাদাহ থেকে ‘মুরসাল’ সূত্রে বর্ণনা করেছেন। ফলে বর্ণনাটি যঈফ (আলবানী, ফিক্বহুস সীরাহ ৩৮৬ পৃঃ; আর-রাহীক্ব ৪০৮ পৃঃ; ঐ, তা‘লীক্ব ১৭৫ পৃঃ)। তবে বায়‘আতের ঘটনাটি বিশুদ্ধভাবে প্রমাণিত (মুসলিম হা/১৮৬৩ (৮৪)।
[2]. আহমাদ হা/১৫৪৬৯, সনদ হাসান; হাকেম হা/৫২৮৩, যাহাবী চুপ থেকেছেন।
[3]. বুখারী হা/২৮২৫; মুসলিম হা/১৩৫৩।

মক্কার মহিলাদের বায়‘আত

পুরুষের বায়‘আত শেষ হ’লে মহিলাদের বায়‘আত শুরু হয় (আল-বিদায়াহ ৪/৩১৯)। এসময় আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দ বিনতে উৎবাহ উপস্থিত হন। তিনি রাসূল (ছাঃ)-কে উদ্দেশ্য করে বলেন,يَا رَسُولَ اللهِ مَا كَانَ مِمَّا عَلَى ظَهْرِ الأَرْضِ أَهْلُ خِبَاءٍ أَحَبَّ إِلَىَّ أَنْ يَذِلُّوا مِنْ أَهْلِ خِبَائِكَ- ثُمَّ مَا أَصْبَحَ الْيَوْمَ أَهْلُ خِبَاءٍ أَحَبَّ إِلَىَّ مِنْ أَنْ يَعِزُّوا مِنْ أَهْلِ خِبَائِكَ ‘হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহর কসম! আপনার পরিবারের চাইতে অন্য কোন পরিবারের ব্যাপারে আমি আকাংখা করতাম না যে, তারা লাঞ্ছিত হৌক। কিন্তু এখন যমীনের বুকে আপনার পরিবারের ব্যাপারেই আমি সবচেয়ে বেশী আকাংখী যে, তারা সম্মানিত হৌন। তখন রাসূল (ছাঃ) বললেন, সেই সত্তার কসম! যার হাতে আমার জীবন, (তুমি যা বলছ) সেটাই ঠিক। অতঃপর হিন্দা বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আবূ সুফিয়ান কৃপণ স্বভাবের মানুষ। আমি যদি তার বিনা অনুমতিতে তার পরিবার-পরিজনের জন্য তার সম্পদ থেকে খরচ করি, এতে কি আমার কোন দোষ হবে? রাসূল (ছাঃ) বললেন, ন্যায়নিষ্ঠার সাথে ব্যয় করলে কোন দোষ নেই।[1]

[1]. বুখারী হা/৩৮২৫, ৫৩৫৯; মুসলিম হা/১৭১৪।

এখানে প্রসিদ্ধ আছে যে, বায়‘আত গ্রহণের এক পর্যায়ে আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দ বিনতে উৎবাহ ছদ্মবেশে উপস্থিত হন। যাতে রাসূল (ছাঃ) তাকে চিনতে না পারেন। অতঃপর বায়‘আতের জন্য রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মহিলাদের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘তোমরা আল্লাহর সাথে কোন কিছুকে শরীক করো না। ‘তোমরা চুরি করবে না’। একথা শুনে হিন্দা বলে উঠলেন, আবু সুফিয়ান একজন কৃপণ লোক। আমি যদি তার মাল থেকে কিছু নেই, তাহ’লে? সেখানে উপস্থিত আবু সুফিয়ান বললেন, তুমি যা নিবে, সব তোমার জন্য হালাল হবে’। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে চিনতে পেরে হেসে উঠে বললেন, ‘তাহ’লে তুমি হিন্দা’? তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, হে আল্লাহর নবী! পিছনে যা ঘটে গেছে সেজন্য আমাকে ক্ষমা করে দিন’। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে ক্ষমা করে দিলেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, ‘তারা যেন ব্যভিচার না করে’। হিন্দা বলে উঠলেন, أَوَ تَزْنِي الْحُرَّةُ؟ ‘কোন স্বাধীনা নারী কি যেনা করে’? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, ‘তারা যেন নিজ সন্তানদের হত্যা না করে’। হিন্দা বললেন, ‘আমরা শৈশবে তাদের লালন-পালন করেছি, আপনারা যৌবনে তাদের হত্যা করেছেন। এখন এ বিষয়ে আপনারা ও তারাই ভাল জানেন’। উল্লেখ্য যে, তার পুত্র হানযালা বিন আবু সুফিয়ান বদরের যুদ্ধে মুসলমানদের হাতে নিহত হয়েছিল। হিন্দার একথা শুনে ওমর (রাঃ) হেসে চিৎ হয়ে পড়ে গেলেন এবং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মৃদু হাসলেন। রাসূল (ছাঃ) বললেন, ‘তারা যেন কাউকে মিথ্যা অপবাদ না দেয়’। হিন্দা বললেন, আল্লাহর কসম! অপবাদ অত্যন্ত জঘন্য কাজ (لأمر قبيح)। আপনি আমাদেরকে বাস্তবিকই সুপথ ও উত্তম চরিত্রের নির্দেশনা প্রদান করেছেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, ‘তারা কোন সৎকর্মে রাসূল (ছাঃ)-এর অবাধ্য হবে না’। হিন্দা বললেন, আল্লাহর কসম! আপনার অবাধ্য হব এরূপ মনোভাব নিয়ে আমরা মজলিসে বসিনি’। অতঃপর হিন্দা বাড়ী ফিরে গিয়ে নিজ হাতে বাড়ীতে রক্ষিত মূর্তিটি ভেঙ্গে ফেলেন এবং বলেন, ‘আমরা তোর ব্যাপারে এতদিন ধোঁকার মধ্যে ছিলাম’ (আর-রাহীক্ব ৪০৯ পৃঃ; ওয়াক্বেদী, মাগাযী ২/৮৭১; ত্বাবারী ৩/৬১-৬৩)। বর্ণনাটি যঈফ (মুসনাদে আবী ইয়া‘লা হা/৪৭৫৪, সনদ যঈফ)।

মক্কায় অবস্থান ও কার্যসমূহ

মক্কা বিজয়ের পর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সেখানে ঊনিশ দিন অবস্থান করেন। এ সময়ের মধ্যে তিনি সর্বদা মানুষকে তাক্বওয়ার উপদেশ দেন এবং হেদায়াতের রাস্তাসমূহ বাৎলিয়ে দিতে থাকেন। আবু উসায়েদ আল-খোযাঈকে দিয়ে হারাম শরীফের নতুন সীমানা স্তম্ভসমূহ খাড়া করেন। ইসলামের প্রচারের জন্য এবং মূর্তিসমূহ ভেঙ্গে ফেলার জন্য চারদিকে ছোট ছোট সেনাদল প্রেরণ করেন। এছাড়া ঘোষকের মাধ্যমে মক্কার অলিতে-গলিতে প্রচার করে দেন যে,مَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ فَلاَ يَدَعْ فِيْ بَيْتِهِ صَنَمًا إِلاَّ كَسَرَهُ ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখেরাতের উপরে বিশ্বাস রাখে, সে যেন তার বাড়ীতে রক্ষিত মূর্তি ভেঙ্গে ফেলে’।[1]

[1]. ইবনু সা‘দ, ত্বাবাক্বাতুল কুবরা ২/১০৪; আর-রাহীক্ব ৪০৯ পৃঃ; যাদুল মা‘আদ ৩/৩৬৪।



প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর ৬৭ পর্বের জীবনীর সকল পর্ব এখান থেকে পড়ুন-

পর্ব-০১   পর্ব-০২   পর্ব-০৩   পর্ব-০৪   পর্ব-০৫   পর্ব-০৬   পর্ব-০৭   পর্ব-০৮   পর্ব-০৯   পর্ব-১০   পর্ব-১১   পর্ব-১২   পর্ব-১৩   পর্ব-১৪   পর্ব-১৫   পর্ব-১৬   পর্ব-১৭   পর্ব-১৮   পর্ব-১৯   পর্ব-২০   পর্ব-২১   পর্ব-২২   পর্ব-২৩   পর্ব-২৪   পর্ব-২৫   পর্ব-২৬   পর্ব-২৭   পর্ব-২৮   পর্ব-২৯   পর্ব-৩০    পর্ব-৩১   পর্ব-৩২   পর্ব-৩৩   পর্ব-৩৪   পর্ব-৩৫   পর্ব-৩৬   পর্ব-৩৭   পর্ব-৩৮   পর্ব-৩৯   পর্ব-৪০   পর্ব-৪১   পর্ব-৪২   পর্ব-৪৩   পর্ব-৪৪   পর্ব-৪৫   পর্ব-৪৬(১ম) পর্ব-৪৬(২য়)    পর্ব-৪৭   পর্ব-৪৮   পর্ব-৪৯   পর্ব-৫০   পর্ব-৫১   পর্ব-৫২   পর্ব-৫৩   পর্ব-৫৪   পর্ব-৫৫   পর্ব-৫৬   পর্ব-৫৭   পর্ব-৫৮   পর্ব-৫৯   পর্ব-৬০   পর্ব-৬১   পর্ব-৬২   পর্ব-৬৩   পর্ব-৬৪   পর্ব-৬৫   পর্ব-৬৬   পর্ব-৬৭  




******************************************
>>> Welcome, You are now on Mohammadia Foundation's Website. Please stay & Tune with us>>>

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url