প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর জীবনী [পর্ব- ৪৯] || মহানবীর জীবনী ||





রোমকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা, তাবূক অভিমূখে মুসলিম বাহিনীর রওয়ানা

[পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ট মহামানব আমাদের প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:)। যাকে আল্লাহ সমস্ত মানুষের জন্য অশেষ রহমত স্বরূপ এই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। যে নবী সারা জীবন উম্মতের জন্য সংগ্রাম করেছেন, কাল রোজ হাশরের মাঠেও যিনি উম্মতের জন্যই পেরেশান থাকবেন ইয়া উম্মতি ইয়া উম্মতি বলে বিচলিত হবেন; সেই প্রাণপ্রিয় নবীকে আমরা কতটুকু চিনি, কতটুকু জানি? প্রিয় নবী (সা:) এর জীবনের পরতে পরতে রয়েছে আমাদের জন্য শিক্ষা ও অনুপ্রেরণা। যার জীবনী পড়লে নিজের অজান্তেই চোখের পানি গড়িয়ে পড়ে। সেই নবীর জীবনী কি আমরা সত্যিই জানি? আসুন, আরেকবার দেখে নেই “প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর জীবনী”। যে জীবনী পড়ে বদলে যেতে পারে আপনার আমার জীবন। আমরা এখানে প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর বিশাল কর্মময় জীবনকে ৬৭টি সুবিশাল পর্বে তুলে ধরেছি। আল্লাহ আমাদের সবাইকে প্রাণপ্রিয় নবীর (সা:) উম্মত হিসাবে কবুল করুন। আমিন।।]

হোনায়েন পরবর্তী যুদ্ধসমূহ

সারিইয়া ক্বায়েস বিন সা‘দ

৮ম হিজরীর যুলক্বা‘দাহ মাস। হোনায়েন যুদ্ধ শেষে মদীনায় ফেরার পর রাসূল (ছাঃ) ক্বায়েস বিন সা‘দ বিন ওবাদাহ-এর নেতৃত্বে ৪০০ সৈন্যের একটি দলকে ইয়ামন সীমান্তবর্তী ছুদা অঞ্চলে প্রেরণ করেন। তখন তাদের নেতা যিয়াদ ইবনুল হারেছ ছুদাঈ রাসূল (ছাঃ)-এর দরবারে হাযির হন এবং অনুরোধ করে বলেন, আপনি সৈন্যদলকে ফিরিয়ে নিন। আমি আমার সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে দায়িত্ব নিচ্ছি’। তখন রাসূল (ছাঃ) সেনাদল ফেরত নিলেন।[1]

সারিইয়া উয়ায়না বিন হিছন আল-ফাযারী

৯ম হিজরীর মুহাররম মাস। বনু তামীম গোত্রের লোকেরা অন্য গোত্রের লোকদের জিযিয়া প্রদান না করার জন্য প্ররোচিত করছিল। সেকারণ তাদের বিরুদ্ধে ‘ছাহরা’ (الصَّحْرَاء) এলাকায় ৫০ জন অশ্বারোহীর একটি দল প্রেরিত হয়। বনু তামীম পালিয়ে যায়। তাদের পুরুষ-নারী-শিশু মিলে ৬২ জনকে বন্দী করে মদীনায় আনা হয়। পরদিন তাদের ১০ জন নেতা মদীনায় এসে ইসলাম কবুল করে। ফলে সবাইকে মুক্তি দেওয়া হয়।[2]

সারিইয়া কুত্ববাহ বিন ‘আমের

৯ম হিজরীর ছফর মাস। তুরবার (ةُربة) নিকটবর্তী তাবালা (تَبَالَة) অঞ্চলে খাছ‘আম (خَثْعَم) গোত্রের একটি শাখার বিরুদ্ধে ২০ জনের এই দলটি প্রেরিত হয়। এরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছিল। যুদ্ধে তাদের অনেকে হতাহত হয়। মুসলিম বাহিনী উট, বকরী ও নারী সহ অনেক গণীমত নিয়ে ফিরে আসে। তবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদের ছেড়ে দেন।[3]

সারিইয়া যাহহাক বিন সুফিয়ান কেলাবী

৯ম হিজরীর রবীউল আউয়াল মাস। বনু কেলাব গোত্রকে ইসলামের দাওয়াত দেওয়ার জন্য এই দলটিকে প্রেরণ করা হয়। কিন্তু বনু কেলাব তাতে অস্বীকার করে এবং যুদ্ধে লিপ্ত হয়। ফলে তাদের একজন নিহত হয় (যাদুল মা‘আদ ৩/৪৫০; ইবনু সা‘দ ২/১২৩)।

সারিইয়া আলী ইবনু আবী ত্বালেব

৯ম হিজরীর রবীউল আউয়াল মাস। বিখ্যাত খ্রিষ্টান গোত্র ত্বাঈ (طَيِّئ)-এর ‘ফুল্স’ (الفُلْس) মূর্তিটি ভেঙ্গে ফেলার জন্য ১৫০ জনের এই বাহিনী প্রেরিত হয়। মূর্তি ভাঙ্গার পর দানবীর হাতেম তাঈ-এর পরিবার সহ অনেকে বন্দী হয়ে মদীনায় নীত হন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদেরকে সসম্মানে মুক্তি দেন। হাতেম তাঈ-এর বৃদ্ধা কন্যা সাফফানাহ (سَفَّانَةَ) মুক্তি পেয়ে পলাতক ভাই খ্যাতনামা বিদ্বান ও গোত্রনেতা ‘আদী ইবনে হাতেমকে পাবার জন্য সিরিয়ায় যান। পরে ‘আদী মদীনায় এসে ইসলাম কবুল করেন (যাদুল মা‘আদ ৩/৪৫৩)।

সারিইয়া আলক্বামা বিন মুজাযযিয আল-মুদলেজী

৯ম হিজরীর রবীউল আখের। হাবশার কিছু নৌদস্যু জেদ্দা তীরবর্তী এলাকায় সমবেত হয়ে মক্কায় হামলা করার চক্রান্ত করছে জানতে পেরে ৩০০ জনের এই বাহিনী প্রেরিত হয়। আলক্বামা একদল সাথী নিয়ে সাগরে নেমে যান ও একটি দ্বীপে পৌঁছে যান। এ খবর পেয়ে দস্যুদল দ্রুত পালিয়ে যায়।[4]

অতঃপর পলাতকদের বিরুদ্ধে আব্দুল্লাহ বিন হুযাফাহ সাহমীকে পাঠানো হয়। আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন, তিনি ছিলেন বদরী ছাহাবী এবং তার মধ্যে ঠাট্টা করার মেযাজ ছিল। আমি ছিলাম উক্ত সেনাদলের সদস্য। অতঃপর সেনাদল রাস্তার এক স্থানে অবতরণ করে। সেখানে তারা শরীর গরম করার জন্য একটি অগ্নিকুন্ড তৈরী করে। তখন তিনি তাদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘আমার কথা শোনা ও মান্য করা কি তোমাদের উপর ওয়াজিব নয়? সবাই বলল, হ্যাঁ। তিনি বললেন, আমি তোমাদেরকে কোন বিষয়ে আদেশ দিলে তোমরা কি তা পালন করবে? সকলে বলল, হ্যাঁ। তখন তিনি বললেন, আমি চাই তোমরা এই আগুনে ঝাঁপ দাও। তখন লোকেরা দাঁড়িয়ে গেল। যখন তিনি ধারণা করলেন যে, তারা ঝাঁপ দিবে, তখন তিনি বললেন,أَمْسِكُوا عَلَى أَنْفُسِكُمْ فَإِنَّمَا كُنْتُ أَمْزَحُ مَعَكُمْ ‘তোমরা থাম। আমি তোমাদের সাথে স্রেফ হাসি-ঠাট্টা করতে চেয়েছিলাম মাত্র। পরে ঘটনাটি রাসূল (ছাঃ)-কে জানানো হ’লে তিনি বলেন,مَنْ أَمَرَكُمْ بِمَعْصِيَةٍ فَلاَ تُطِيعُوهُ ‘যে ব্যক্তি তোমাদের কোন পাপকর্মের নির্দেশ দিবে, তোমরা তা মানবে না’।[5]

ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, উক্ত ঘটনা উপলক্ষ্যে সূরা নিসা ৫৯ আয়াতটি নাযিল হয়। যেখানে বলা হয়, ‘তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর এবং আনুগত্য কর রাসূলের ও তোমাদের মধ্যকার আমীরের...’ (নিসা ৪/৫৯; মুসলিম হা/১৮৩৪)।

অনুরূপ একটি ঘটনা আলী (রাঃ)-এর বর্ণনায় এসেছে, যেখানে আমীর হিসাবে বলা হয়েছে, ‘আনছারের জনৈক ব্যক্তি’(رَجُلاً مِنَ الأَنْصَارِ)। তিনি ক্রুদ্ধ হয়ে তার সেনাদলকে আগুনে প্রবেশের নির্দেশ দিয়েছিলেন। তখন একদল তাতে প্রবেশ করার সংকল্প করল। অপর দল একে অপরের দিকে তাকাতে লাগল এবং বলল, আমরা আগুন থেকে বাঁচার জন্য রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকটে এসেছিলাম’। তখন আমীরের রাগ ঠান্ডা হয়ে যায় ও আগুন নিভে যায়। অতঃপর মদীনায় ফিরে এসে ঘটনাটি রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে বলা হলে তিনি বলেন,لَوْ دَخَلُوهَا لَمْ يَزَالُوا فِيهَا إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ ‘যদি তারা আগুনে প্রবেশ করত, তাহলে ক্বিয়ামত পর্যন্ত তারা সেখানেই থাকত’। তিনি আরও বলেন,لاَ طَاعَةَ فِى مَعْصِيَةِ اللهِ إِنَّمَا الطَّاعَةُ فِى الْمَعْرُوفِ ‘আল্লাহর অবাধ্যতায় কোন আনুগত্য নেই। আনুগত্য কেবল ন্যায় কর্মে’।[6] ইমাম নববী বলেন, এটি আব্দুল্লাহ বিন হুযাফাহর ঘটনা নয়। বরং পৃথক ঘটনা (মুসলিম হা/১৮৪০-এর ব্যাখ্যা)।

ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ) বলেন, ‘যদি তারা আগুনে প্রবেশ করত’ এর অর্থ ‘যদি তারা আমীরের নির্দেশ মান্য করার জন্য এটাকে হালাল ভেবে করত, তাহ’লে তারা সেখান থেকে আর কখনো বের হ’তে পারত না’। যারা আগুনে প্রবেশ করেনি, তাদেরকে তিনি উত্তম কথা বলেন ও জানিয়ে দেন যে, আল্লাহর অবাধ্যতায় কারো প্রতি আনুগত্য নেই। আনুগত্য কেবল বৈধ কর্মে’ (ফাৎহুল বারী হা/৪০৮৫-এর ব্যাখ্য)। তিনি বলেন, নিসা ৫৯ আয়াতে বর্ণিত উলুল আমরের অর্থ ‘আমীরের আনুগত্য’ আলেমের আনুগত্য নয়। যা তাদের বিপরীত যারা উক্ত কথা বলে থাকেন। এর উদ্দেশ্য সামাজিক ঐক্য বজায় রাখা। নইলে বহু আনুগত্যের ফলে সমাজে বিভক্তি ও বিশৃংখলা সৃষ্টি হবে’।[7]

উপরোক্ত ঘটনায় আমীরের প্রতি সর্বোচ্চ আনুগত্যের দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। সেই সাথে উক্ত আনুগত্যের সীমা নির্দেশও জানা যায়। এছাড়া ইসলামী জিহাদের চিরন্তন বিধান পাওয়া যায় এই মর্মে যে, আমীরের নির্দেশে আত্মঘাতি হওয়া নিষিদ্ধ।

[1]. যাদুল মা‘আদ ৩/৫৮০; আর-রাহীক্ব ৪৪৬ পৃঃ।
[2]. যাদুল মা‘আদ ৩/৪৪৬; ইবনু সা‘দ ২/১২১-২২।

চরিতকারগণ এই ঘটনাকে ৯ম হিজরীর মুহাররম মাস বললেও মুবারকপুরী এতে ভিন্নমত পোষণ করেছেন। যদিও তিনি পৃথক কোন সাল বা তারিখ উল্লেখ করেননি (আর-রাহীক্ব ৪২৬ পৃঃ টীকা-১)।
[3]. যাদুল মা‘আদ ৩/৪৪৯; ইবনু সা‘দ ২/১২২-২৩।
[4]. যাদুল মা‘আদ ৩/৪৫১; আর-রাহীক্ব ৪২৬ পৃঃ; ফাৎহুল বারী ‘সারিইয়া আব্দুল্লাহ বিন হুযাফাহ ও আলক্বামা বিন মুজাযযিয’ অনুচ্ছেদ, হা/৪০৮৫-এর পূর্বে, ৮/৫৯ পৃঃ।
[5]. ছহীহ ইবনু হিববান হা/৪৫৫৮; আহমাদ হা/১১৬৫৭; ইবনু মাজাহ হা/২৮৬৩; ছহীহাহ হা/২৩২৪।
[6]. মুসলিম হা/১৮৪০; বুখারী হা/৭১৪৫, ৭২৫৭; যাদুল মা‘আদ ৩/৪৫০-৫১।
[7]. ফাৎহুল বারী, ‘আহকাম’ অধ্যায়, আল্লাহর বাণী ‘তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর, রাসূলের আনুগত্য কর এবং তোমাদের মধ্যকার আমীরের আনুগত্য কর’ অনুচ্ছেদ; হা/৬৭১৮-এর ব্যাখ্যা।

তাবূক যুদ্ধ

(৯ম হিজরীর রজব মাস)
মুতার যুদ্ধে রোমকদের বিরুদ্ধে প্রথম অভিযানের ১৩ মাস পর এটি ছিল তাদের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় অভিযান। আর এটিই ছিল রাসূল (ছাঃ)-এর অংশগ্রহণে তাঁর জীবনের শেষ যুদ্ধ।

এই অভিযানে মুসলিম বাহিনীতে সৈন্যসংখ্যা ছিল ৩০,০০০ এবং রোমকদের সৈন্য সংখ্যা ছিল ৪০,০০০-এর বেশী। যাদের মধ্যে লাখাম ও জুযামসহ অন্যান্য আরব খ্রিষ্টান গোত্রসমূহ ছিল। যারা ইতিমধ্যে শামের বালক্বা (بَلْقَاء) পর্যন্ত এসে গিয়েছিল। গত বছরে মুতার যুদ্ধে শোচনীয় পরাজয়ের প্রতিশোধ নেবার জন্য তারা সরাসরি মদীনায় হামলার এই গোপন প্রস্ত্ততি নেয়। তাতে মদীনার সর্বত্র রোমক ভীতির(خَوْفُ غَسَّانَ) সঞ্চার হয়। কিন্তু এতদসত্ত্বেও রাসূল (ছাঃ) তাদের প্রতিরোধে রোমান সীমান্ত অভিমুখে যাত্রা করলে তারা সংবাদ পেয়ে ভীত হয়ে পালিয়ে যায়। রামাযান মাসে মুসলিম বাহিনী বিনা যুদ্ধে জয়ী হয়ে মদীনায় ফিরে আসে। এই অভিযান কালে সূরা তওবার অনেকগুলি আয়াত নাযিল হয়। পঞ্চাশ দিনের এই দীর্ঘ সফরে ৩০ দিন যাতায়াতে এবং ২০ দিন তাবূকে অবস্থানে ব্যয়িত হয়।[1] বিস্তারিত বিবরণ নিম্নরূপ।-

[1]. ইবনু হিশাম ২/৫১৫-১৬; যাদুল মা‘আদ ৩/৪৬১; আর-রাহীক্ব ৪২০ পৃঃ।

তাবূক যুদ্ধের পটভূমি

ত্বায়েফ থেকে ফেরার কাছাকাছি ছয় মাস পরে ৯ম হিজরীর রজব মাসে প্রচন্ড গ্রীষ্মের মধ্যে এই অভিযান প্রেরিত হয় (ইবনু হিশাম ২/৫১৫-১৬)। তাবূক ছিল মদীনা থেকে ৭৭৮ কি. মি. উত্তরে সঊদী আরবের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে অবস্থিত। তৎকালীন সময়ের অর্ধেক পৃথিবীর একচ্ছত্র অধিপতি রোম সম্রাটের সিরিয় গবর্ণরের বিরুদ্ধে ৮ম হিজরীর জুমাদাল ঊলা মাসে পরিচালিত ‘মুতা’ অভিযানে এক অসম যুদ্ধে রোমকদের পিছু হটার ফলে আরব উপদ্বীপে মুসলিম শক্তির শ্রদ্ধাপূর্ণ প্রভাব বিস্তৃত হয়। তাতে যুগ যুগ ধরে রোমকদের শাসন-শোষণে নিষ্পিষ্ট আরবদের মধ্যে স্বাধীনতার স্বপ্ন জাগরিত হয়। বিশেষ করে আরব ভূখন্ডের সীমান্তবর্তী রোম শাসিত শাম রাজ্যের জন্য তা একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ হিসাবে দেখা দেয়।

এ সময় মদীনার আউস গোত্রের অন্যতম সাবেক নেতা এবং খাযরাজ গোত্রের উপরেও যার যথেষ্ট প্রভাব ছিল, ধর্মগুরু আবু ‘আমের আর-রাহেব ৮ম হিজরীর শেষ দিকে হোনায়েন যুদ্ধের পর সবদিক থেকে নিরাশ হয়ে অবশেষে শামে (সিরিয়া) চলে যান। কেননা এটি তখন ছিল আরব ভূমিতে খ্রিষ্টান শাসনের কেন্দ্রবিন্দু। তিনি সেখানে গিয়ে ‘নাছারা’ হন। অতঃপর রোম সম্রাটকে মদীনা আক্রমণের জন্য প্ররোচনা দিতে থাকেন। এ উদ্দেশ্যে মদীনার মুনাফিকদের সাথে তিনি পুরা যোগাযোগ রাখেন এবং তাদেরকে দিয়ে তিনি মসজিদে ক্বোবার অদূরে ‘মসজিদে যেরার’ নির্মাণ করান। যাতে মসজিদের আড়ালে চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের কেন্দ্র হিসাবে এটাকে ব্যবহার করা যায়। ত্বাবারী যুহরীর বরাতে ‘মুরসাল’ সূত্রে (ত্বাবারী হা/১৭২০০) বর্ণনা করেন যে, বনু ‘আমর বিন ‘আওফ গোত্রে মসজিদে ক্বোবা নির্মিত হ’লে তার প্রতি হিংসাবশে তার ভাই বনু গুন্ম বিন ‘আওফ গোত্রের লোকেরা এই মসজিদ নির্মাণ করে (কুরতুবী হা/৩৪৮৫)।

রোম সম্রাটকে আবু ‘আমের বুঝাতে সক্ষম হন যে, মদীনায় মুহাম্মাদের বিরুদ্ধে তার একটি বিরাট দল রয়েছে। যারা বাহ্যিকভাবে মুহাম্মাদের দলে মিশে আছে। বাইরে থেকে রোমকরা হামলা করলেই তারা ঘুরে দাঁড়াবে এবং রোমকদের সহজ বিজয় লাভ হবে। উল্লেখ্য যে, ওহোদ যুদ্ধে শহীদ এবং ফেরেশতারা যার লাশ গোসল করান, সেই বিখ্যাত ছাহাবী হানযালা ছিলেন এই ফাসেক আবু ‘আমেরের পুত্র। রাসূল (ছাঃ) তাকে ইসলামের দাওয়াত দিলে সে অস্বীকার করে। ফলে রাসূল (ছাঃ) তার নামকরণ করেন আবু ‘আমের আল-ফাসেক্ব’(فَسَمَّاهُ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم الفَاسِقَ)। তিনি তাকে বদদো‘আ করেন, যেন সে মদীনা থেকে দূরে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে নির্জন কোন স্থানে মৃত্যুবরণ করে। পরে তিনি শামের ক্বিন্নাসরীন (قِنَّسْرِين) যেলায় নিঃসঙ্গ অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন।[1]

একদিকে রাজনৈতিক বাস্তবতা অন্যদিকে আবু ‘আমেরের এই প্ররোচনা রোম সম্রাটকে মদীনা হামলায় উৎসাহিত করল। পূর্ণরূপে শক্তি সঞ্চয়ের পূর্বেই উঠতি ইসলামী শক্তিকে অংকুরে বিনাশ করার সংকল্প নিয়ে তারা ব্যাপক যুদ্ধ প্রস্ত্ততি শুরু করে। যাতে রোম সাম্রাজ্য সংলগ্ন আরব এলাকা থেকে ভবিষ্যতে কোনরূপ বিদ্রোহের হুমকি সৃষ্টি না হয়।

রোমকদের উক্ত হুমকি মুকাবিলা করাই ছিল তাবূক অভিযানের প্রত্যক্ষ কারণ। দ্বিতীয় কারণ ছিল তাদের কুফরী আদর্শের হুমকি মুকাবিলা করা। কারণ তারা ছিল ইহূদীদের পরে আরবদের নিকটতম দুশমন শক্তি। আহলে কিতাব হ’লেও তাদের অধিকাংশ ত্রিত্ববাদের কুফরী আক্বীদায় বিশ্বাসী হয়ে গিয়েছিল। তাদেরকে প্রকৃত তাওহীদের দিকে আহবান করা এবং অন্যদেরকে তাদের মন্দ প্রভাব থেকে বাঁচানো এই অভিযানের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ছিল। আর এটাই হ’ল ইসলামী জিহাদের মূল রূহ। যেমন আল্লাহ বলেন,يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا قَاتِلُوا الَّذِينَ يَلُونَكُمْ مِنَ الْكُفَّارِ وَلْيَجِدُوا فِيكُمْ غِلْظَةً وَاعْلَمُوا أَنَّ اللهَ مَعَ الْمُتَّقِينَ ‘হে মুমিনগণ! তোমরা তোমাদের নিকটবর্তী কাফেরদের সাথে যুদ্ধ কর। তারা যেন তোমাদের মধ্যে কঠোরতা অনুভব করে। আর জেনে রেখ যে, আল্লাহ সর্বদা মুত্তাক্বীদের সঙ্গে থাকেন’ (তওবা ৯/১২৩)। যাতে এর মাধ্যমে আরব উপদ্বীপ কাফেরমুক্ত হয় এবং দ্বীন সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর জন্য হয়ে যায়। যেমন আল্লাহ বলেন,وَقَاتِلُوهُمْ حَتَّى لاَ تَكُونَ فِتْنَةٌ وَيَكُونَ الدِّينُ كُلُّهُ لِلَّهِ ‘আর তোমরা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর যতক্ষণ না ফিৎনা (কুফরী) শেষ হয় এবং দ্বীন পূর্ণরূপে আল্লাহর জন্য হয়ে যায়’ (আনফাল ৮/৩৯)।

প্রত্যক্ষ কারণ যেটাই থাক না কেন আল্লাহর ইচ্ছা ছিল সম্ভবতঃ এটাই যে, খন্দক, খায়বর, মুতা ও মক্কা বিজয় শেষে আরবের সমস্ত অঞ্চল থেকে যখন দলে দলে গোত্রনেতারা মদীনায় গিয়ে আত্মসমর্পণ করছে, তখন বাকী শাম ও তৎসন্নিহিত খ্রিষ্টান শাসিত এলাকাগুলি ইসলামী খেলাফতের অধীনস্ত হৌক। আলহামদুলিল্লাহ সেটাই হয়েছিল এবং কোনরূপ রক্তপাত ছাড়াই তাবূক অভিযানে খ্রিষ্টান শাসকরা সন্ধিচুক্তি করতে বাধ্য হয়। অতঃপর খেলাফতে রাশেদাহর সময় সমস্ত আরব উপদ্বীপ কাফেরমুক্ত হয়। ফালিল্লাহিল হাম্দ।

[1]. কুরতুবী হা/৩৪৮৫, ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা তওবা ১০৭-০৮ আয়াত; আর-রাহীক্ব ২৫৮ পৃঃ; ইবনু হিশাম ২/৬৭; সনদ ‘মুরসাল’ (তাহকীক ইবনু হিশাম ক্রমিক ১০৯৫)।

মদীনায় রোমক ভীতি

রোম সম্রাটের ব্যাপক যুদ্ধ প্রস্ত্ততির খবর মদীনায় পৌঁছে গেলে মুসলমানদের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই ভীতির সঞ্চার হয়। বিশেষ করে মুনাফিকদের অতিমাত্রায় অপপ্রচারের ফলে সাধারণ ও দুর্বলমনা মুসলমানদের রাতের ঘুম হারাম হয়ে যায়।

রোমকভীতি মুসলমানদের মধ্যে কেমন প্রভাব বিস্তার করেছিল, নিম্নের ঘটনা দ্বারা কিছুটা বুঝা যায়।-

ওমর ফারূক (রাঃ) বলেন, আমার একজন আনছার বন্ধু ছিলেন। যখন আমি রাসূল (ছাঃ)-এর দরবারে হাযির না থাকতাম, তখন তিনি আমার নিকটে সংবাদাদি পৌঁছে দিতেন। আর তিনি যখন উপস্থিত না থাকতেন, তখন আমি তার নিকটে তা পৌঁছে দিতাম। তাঁরা উভয়ে প্রতিবেশী ছিলেন এবং মদীনার পূর্বদিকে উচ্চভূমিতে(عَوَالِي الْمَدِينَةِ) বসবাস করতেন। তারা পালাক্রমে রাসূল (ছাঃ)-এর দরবারে উপস্থিত থাকতেন। তিনি বলেন, আমরা সবাই গাসসানী সম্রাটকে ভয় করতাম। কেননা আমাদের বলা হয়েছিল যে, সত্বর তারা আমাদের উপরে হামলা করবে। ফলে আমাদের অন্তরগুলি সর্বদা তাদের ভয়ে ভীত থাকত।

একদিন রাতে হঠাৎ আমার ঐ আনছার বন্ধু দরজা ধাক্কাতে ধাক্কাতে বললেন, افْتَحِ، افْتَحْ দরজা খুলুন, দরজা খুলুন! আমি ভয়ে বলে উঠলাম, جَاءَ الْغَسَّانِىُّ؟ ‘গাসসানী এসে গেছে কি?’ তিনি বললেন, না, বরং তার চেয়ে কঠিন। আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) তার স্ত্রীদের থেকে পৃথক হয়ে গেছেন’।[1] অর্থাৎ তিনি স্ত্রীদের সঙ্গে ‘ঈলা’ (الإِيلاَء) করেছেন। ৯ম হিজরীর প্রথমভাগের এই সময় স্ত্রীদের উপরে অসন্তুষ্ট হয়ে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) তাদের থেকে পৃথক থাকার শপথ নেন এবং একমাসের জন্য ‘ঈলা’ করেন। অতঃপর তাদের থেকে পৃথক হয়ে একটি নির্জন কক্ষে অবস্থান করেন। কিন্তু ছাহাবায়ে কেরাম বিষয়টি বুঝতে না পেরে একে তালাক ভেবেছিলেন। অবশ্য ঈলার মেয়াদ চার মাস অতিক্রম করলে তখন তালাকের প্রশ্ন চলে আসে।

ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ)-এর উপরোক্ত ভয় থেকে সহজে অনুমান করা চলে যে, ঐ সময় রোমকভীতি মুসলমানদের কিভাবে গ্রাস করেছিল।

[1]. বুখারী হা/৪৯১৩; মুসলিম হা/১৪৭৯।

রোমকদের আগমনের খবর

এইরূপ ভীতিকর অবস্থার মধ্যে শাম থেকে মদীনায় আগত তৈল ব্যবসায়ী নাবাত্বী দলের মাধ্যমে সংবাদ পাওয়া গেল যে, রোম সম্রাট হেরাক্লিয়াস তার একজন বিখ্যাত সেনাপতির অধীনে ৪০,০০০ সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী প্রস্ত্তত করেছেন। যার মধ্যে লাখাম, জুযাম প্রভৃতি খ্রিষ্টান গোত্রগুলি সহ অন্যান্য আরব মিত্র গোত্রসমূহ রয়েছে। তাদের অগ্রবর্তী বাহিনীটি মদীনা অভিমুখে ইতিমধ্যে সিরিয়ার বালক্বা (الْبَلْقَاء) নগরীতে পৌঁছে গেছে।[1]

খবরটি এমন সময় পৌঁছল, যখন ছিল গ্রীষ্মকাল এবং ফল পাকার মৌসুম। মানুষের মধ্যে ছিল ক্ষুধা ও দারিদ্রে্যর তীব্র কষাঘাত। রাস্তা ছিল বহু দূরের এবং অতীব ক্লেশকর।

[1]. ইবনু সা‘দ ২/১২৫; যাদুল মা‘আদ ৩/৪৬২।

নাজাশীর মৃত্যু ও গায়েবানা জানাযা আদায়

সুহায়লী বলেন, হাবশার বাদশাহ আছহামা নাজাশী(الأصحمة النجاشي) ৯ম হিজরীর রজব মাসে মৃত্যুবরণ করেন। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) ছাহাবীগণকে নিয়ে বাক্বী‘ গারক্বাদের মুছাল্লায় গিয়ে তার গায়েবানা জানাযা আদায় করেন।[1] নাজাশী মুসলমান ছিলেন এবং রাসূল (ছাঃ) ও মুসলমানদের একান্ত হিতাকাংখী ও নিঃস্বার্থ সাহায্যকারী ছিলেন। জাবের (রাঃ) বলেন, তার মৃত্যুর দিন রাসূল (ছাঃ) সবাইকে অবহিত করে বলেন,مَاتَ الْيَوْمَ رَجُلٌ صَالِحٌ، فَقُوْمُوْا فَصَلُّوْا عَلَى أَخِيْكُمْ أَصْحَمَةَ ‘আজ একজন সৎ ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করেছেন। অতএব তোমরা দাঁড়িয়ে যাও এবং তোমাদের ভাই আছহামার জন্য জানাযার ছালাত আদায় কর’ (বুখারী হা/৩৮৭৭)। হুযায়ফা বিন আসীদ আল-গিফারী (রাঃ) হ’তে অন্য বর্ণনায় এসেছে যে, তিনি বলেন,صَلُّوْا عَلَى أَخٍ لَّكُمْ مَاتَ بِغَيْرِ أَرْضِكُمْ ‘তোমরা তোমাদের একজন ভাইয়ের জানাযা পড়। যিনি তোমাদের দেশ ব্যতীত অন্য দেশে মৃত্যুবরণ করেছেন’।[2]

[1]. আর-রউযুল উনুফ ২/১১৯; ইবনু হিশাম ১/৩৪১ টীকা-৪; মুবারকপুরী বলেছেন যে, আছহামা নাজাশীর মৃত্যু তাবূক যুদ্ধের পর রজব মাসে হয়েছে (আর-রাহীক্ব ৩৫২ পৃঃ)। কিন্তু তিনি একথাও বলেছেন যে, রাসূল (ছাঃ)-এর তাবূক যুদ্ধে গমন ৯ম হিজরীর রজব মাসে এবং মদীনায় প্রত্যাবর্তন রামাযান মাসে (পৃঃ ৪৩৬)। অতএব তাঁর বক্তব্যের মধ্যে বৈপরীত্য রয়েছে।
[2]. আহমাদ হা/১৬১৯২; ইবনু মাজাহ হা/১৫৩৭, সনদ ছহীহ।

রোমকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রার ঘোষণা

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) চিন্তা করলেন যে, আরব এলাকায় রোমকদের প্রবেশ করার আগেই তাদেরকে তাদের সীমানার মধ্যেই আটকে দিতে হবে। যাতে আরব ও মুসলিম এলাকা অহেতুক ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। অন্য সময় রাসূলুললাহ (ছাঃ) ‘তাওরিয়া’ (التَّوْرِيَة) করেন। অর্থাৎ একদিকে যাওয়ার কথা বলে অন্যদিকে যেতেন। কিন্তু এবার তিনি সরাসরি ঘোষণা করলেন যে, রোমকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যেতে হবে। অতঃপর এ ব্যাপারে তিনি সবাইকে জোরালোভাবে উৎসাহিত করতে থাকেন। যাতে ভীতি ঝেড়ে ফেলে সবাই যুদ্ধের জন্য জোরে-শোরে প্রস্তুতি নিতে পারে। দেখা গেল যে, কেবল মুনাফিকরা ব্যতীত সবাই যুদ্ধে যাওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠলো। মক্কাবাসীদের নিকটে ও অন্যান্য আরব গোত্রগুলির নিকটে খবর পাঠানো হল। একই সময়ে সূরা তওবার অনেকগুলি আয়াত নাযিল হল মুনাফিকদের যুদ্ধভীতির বিরুদ্ধে ও মিথ্যা ওযর-আপত্তির বিরুদ্ধে। এতদ্ব্যতীত জিহাদের ফযীলত এবং এতদুদ্দেশ্যে দান-ছাদাক্বার ফযীলত সম্পর্কে অনেকগুলি আয়াত নাযিল হয়। এতে মুসলমানদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া পড়ে যায়। গ্রীষ্মের খরতাপ, ফসল কাটার মৌসুম, দীর্ঘ সফরের কষ্ট সবকিছু ভুলে গিয়ে তাদের মধ্যে শুরু হয় জিহাদে গমন করার ও জিহাদ ফান্ডে দান করার প্রতিযোগিতা।

এই বাহিনীকে ‘জায়শুল উসরাহ’ (جَيْشُ الْعُسْرَةِ) অর্থাৎ ‘ক্লেশকর যুদ্ধের সেনাবাহিনী’ বলে অভিহিত করা হয়। এসময় মুনাফিকরা মসজিদে ক্বোবার অনতিদূরে একটি মসজিদ নির্মাণ করে এবং সেখানে গিয়ে ছালাত আদায়ের জন্য রাসূল (ছাঃ)-কে দাওয়াত দেয়। রাসূল (ছাঃ) তাবূক যুদ্ধ থেকে ফিরে এসে সেখানে যাবেন বলে কথা দেন। ইতিহাসে এটি ‘মসজিদে যেরার’(مَسْجِدُ الضِّرَار) বা ‘অনিষ্টকারী মসজিদ’ নামে পরিচিত’ (ইবনু হিশাম ১/৫২২; তওবা ৯/১০৭)।

জিহাদে গমনের নির্দেশ প্রচারিত হওয়ার পর মুসলমানদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া পড়ে যায়। সকলে স্বতঃস্ফূর্তভাবে জিহাদের প্রস্তুতি শুরু করে দেয়। যাদের বাহন ছিল না, তারা ছুটে আসেন রাসূল (ছাঃ)-এর কাছে বাহনের জন্য। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সবাইকে বাহনের ব্যবস্থা করতে পারলেন না। ফলে যারা বাহন পেলেন না, তারা জিহাদে যেতে না পারার দুঃখে কেঁদে বুক ভাসান। ইতিহাসে এরা ‘আল-বাক্কাঊন’ (ক্রন্দনকারীগণ) নামে খ্যাত।[1]

[1]. যাদুল মা‘আদ ৩/৪৬২। প্রসিদ্ধ আছে যে, আবু যার গিফারীর জন্য উট পেতে দেরী হয়। তখন তিনি সরঞ্জামাদি পিঠে নিয়ে পায়ে হেঁটে চলতে থাকেন। অতঃপর এক স্থানে রাসূল (ছাঃ) অবতরণ করলে লোকেরা বলল, হে আল্লাহর রাসূল! ঐ ব্যক্তি একাকী হেঁটে আসছে। রাসূল (ছাঃ) বললেন, দেখ ওটা আবু যার। অতঃপর লোকেরা ভালোভাবে দেখে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহর কসম ঐ ব্যক্তি আবু যার। তখন রাসূল (ছাঃ) বললেন, আল্লাহ আবু যারের উপরে রহম করুন! সে একাকী হাঁটে। একাকী মরবে ও একাকী পুনরুত্থিত হবে’ (যাদুল মা‘আদ ৩/৪৬৭; ইবনু হিশাম ২/৫২৪)। বর্ণনাটি যঈফ (মা শা-‘আ ২১৭ পৃঃ)।

জিহাদ ফান্ডে দানের প্রতিযোগিতা

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَنْ جَهَّزَ جَيْشَ الْعُسْرَةِ فَلَهُ الْجَنَّةُ ‘যে ব্যক্তি জায়শুল উসরাহর প্রস্ত্ততিতে দান করবে, তার জন্য জান্নাত’ (বুখারী হা/২৭৭৮)। উক্ত হাদীছ শোনার পর মুসলমানদের মধ্যে দানের প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়।

(১) ওমর (রাঃ) বলেন, (তাবূক যুদ্ধের সময়) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সবাইকে ছাদাক্বার নির্দেশ দিলেন। তখন আমার নিকটে পর্যাপ্ত সম্পদ ছিল। আমি মনে মনে বললাম, দানের প্রতিযোগিতায় আজ আমি আবুবকরের উপরে জিতে যাব। তিনি বলেন, অতঃপর আমি আমার সমস্ত মালের অর্ধেক নিয়ে রাসূল (ছাঃ)-এর খিদমতে হাযির হ’লাম। তিনি বললেন, পরিবারের জন্য কি পরিমাণ রেখে এসেছ? আমি বললাম, অনুরূপ পরিমাণ। এ সময় (২) আবুবকর (রাঃ) তাঁর সমস্ত মাল-সম্পদ নিয়ে হাযির হ’লেন। রাসূল (ছাঃ) বললেন, হে আবুবকর! তোমার পরিবারের জন্য কি পরিমাণ রেখে এসেছ? তিনি বললেন,أَبْقَيْتُ لَهُمُ اللهَ وَرَسُولَهُ ‘তাদের জন্য আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে রেখে এসেছি’। ওমর বলেন, তখন আমি মনে মনে বললাম, আর আমি কখনোই তাঁর উপরে জিততে পারব না’।[1] এতে বুঝা যায় যে, দু’জনের মধ্যে ওমর (রাঃ) প্রথম ছাদাক্বা নিয়ে আসেন।

(৩) ওছমান গণী (রাঃ) ১০০০ স্বর্ণমুদ্রা নিয়ে আসেন। স্বর্ণমুদ্রাগুলি যখন রাসূল (ছাঃ)-এর কোলের উপরে তিনি ঢেলে দেন, তখন রাসূল (ছাঃ) সেগুলি উল্টে-পাল্টে বলতে থাকেন,مَا ضَرَّ ابْنَ عَفَّانَ مَا عَمِلَ بَعْدَ الْيَوْمِ، يُرَدِّدُهَا مِرَاراً ‘আজকের দিনের পর কোন আমলই ইবনু ‘আফফানের (অর্থাৎ ওছমানের) কোন ক্ষতিসাধন করবে না’। কথাটি তিনি কয়েকবার বলেন’।[2] এই বিপুল দানের জন্য তাঁকেمُجْهِزُ جَيْشِ الْعُسْرَةِ অর্থাৎ ‘তাবূক যুদ্ধের রসদ যোগানদাতা’ বলা হয়।[3]

(৪) আববাস বিন আব্দুল মুত্ত্বালিব বহু মাল-সামান নিয়ে আসেন। (৫) এতদ্ব্যতীত ত্বালহা, সা‘দ বিন ওবাদাহ, মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহ প্রমুখ প্রচুর মাল-সম্পদ দান করেন। এভাবে এক মুদ, দুই মুদ করে কম-বেশী দানের স্রোত চলতে থাকে। মহিলাগণ তাদের গলার হার, হাতের চুড়ি, পায়ের অলংকার, কানের রিং, আংটি ইত্যাদি যার যা গহনা ও অলংকার ছিল, সবই রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে পাঠিয়ে দেন। কেউ সামান্যতম কৃপণতা করেননি (সীরাহ হালাবিইয়াহ ৩/১০০; আর-রাহীক্ব ৪৩৩ পৃঃ)। আছেম বিন ‘আদী ১০০ অসাক্ব অর্থাৎ হিজাযী ছা‘ হিসাবে প্রায় ১৪,৩৫৯ কেজি খেজুর জমা দেন (ইবনু হিশাম ২/৫৫১)। এ সময় উমাইরাহ বিনতে সুহায়েল বিন রাফে‘ দুই ছা‘ খেজুর, আবু খায়ছামা আনছারী এক ছা‘ এবং আবু ‘আক্বীল হাছহাছ অথবা হাবহাব আনছারী (রাঃ) অর্ধ ছা‘ বা অর্ধ থলি (نِصْفُ صُبْرَةٍ) খেজুর নিয়ে আসেন’ (কুরতুবী)। আবু ‘আক্বীল বলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমি সারা রাত দুই ছা‘ খেজুরের বিনিময়ে অন্যের ক্ষেতে পানি সেচেছি। সেখান থেকে এক ছা‘ পরিবারের জন্য রেখে এসেছি এবং এক ছা‘ এখানে এনেছি’ (আল-ইছাবাহ ক্রমিক ১০২৬০)। তখন রাসূল (ছাঃ) নির্দেশ দিলেন তার ঐ খেজুরগুলি ছাদাক্বার স্তূপের উপর ছড়িয়ে দিতে। অতঃপর তার জন্য দো‘আ করলেন, بَارَكَ اللهُ فِيمَا أَعْطَيْتَ وَفِيمَا أَمْسَكْتَ ‘আল্লাহ তাতে বরকত দিন যা তুমি দান করেছ এবং যা তুমি (পরিবারের জন্য) রেখে দিয়েছ’। তখন কিছু লোক এতে হাসাহাসি করে বলল, নিশ্চয় আল্লাহ ও তাঁর রাসূল এসব দান থেকে অমুখাপেক্ষী’ (ত্বাবারী হা/১৭০১২; কুরতুবী, ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা তওবা ৭৯ আয়াত, সনদ যঈফ)।

সবশেষে আব্দুর রহমান বিন ‘আওফ (রাঃ) এসে বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! ছাদাক্বা দানকারী আর কেউ বাকী আছে কি? রাসূল (ছাঃ) বললেন, না। তখন তিনি তার মোট সম্পদের অর্ধেক ৪০০০ দিরহাম বা ১০০ উক্বিয়া স্বর্ণমুদ্রা দান করেন। এ সময় ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব বলেন, তুমি কি পাগল? তিনি বললেন, আমি পাগল নই। অতঃপর বলেন, আমার মোট ৮০০০ দিরহামের মাল রয়েছে। তন্মধ্যে ৪০০০ দিরহাম রেখেছি আমার পরিবারের জন্য এবং বাকী ৪০০০ দিরহাম আমি আমার প্রতিপালককে ঋণ দিলাম। তখন রাসূল (ছাঃ) খুশী হয়ে বললেন,بَارَكَ اللهُ فِيمَا أَعْطَيْتَ وَفِيمَا أَمْسَكْتَ ‘আল্লাহ তাতে বরকত দিন যা তুমি দান করেছ এবং যা তুমি রেখে দিয়েছ’। এ সময় এক ছা‘ বা অর্ধ ছা‘ করে যারা দান করেন, সকলের উদ্দেশ্যে তিনি একই দো‘আ করেন। তখন মুনাফিকরা বলল, আল্লাহর কসম! এটি স্রেফ ‘রিয়া’ ও শ্রুতি মাত্র। কেননা আল্লাহ এসব দান থেকে অমুখাপেক্ষী’ (ত্বাবারী হা/১৭০০৪, ১৭০১৭; ইবনু কাছীর, তাফসীর তওবা ৭৯ আয়াত, সনদ যঈফ)।

আবু মাসঊদ আনছারী (রাঃ) বলেন, আমাদেরকে ছাদাক্বার আদেশ দেওয়া হ’ল। তখন আমরা সবাই তা বহন করে নিয়ে গেলাম। এ সময় আবু ‘আক্বীল অর্ধ ছা‘ ছাদাক্বা নিয়ে এলেন। অন্য একজন তার চাইতে কিছু বেশী নিয়ে এল। তখন মুনাফিকরা বলল, নিশ্চয় আল্লাহ এইসব ছাদাক্বা থেকে অমুখাপেক্ষী। তারা বলল, এরা এগুলি করছে লোক দেখানোর জন্য। তখন সূরা তওবা ৭৯ আয়াতটি নাযিল হয়’ (বুখারী হা/৪৬৬৮)।[4]

উক্ত আয়াতে আল্লাহ বলেন, الَّذِينَ يَلْمِزُونَ الْمُطَّوِّعِينَ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ فِي الصَّدَقَاتِ وَالَّذِينَ لاَ يَجِدُونَ إِلاَّ جُهْدَهُمْ فَيَسْخَرُونَ مِنْهُمْ سَخِرَ اللهُ مِنْهُمْ وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ ‘যারা স্বেচ্ছায় ছাদাক্বা দানকারী মুমিনদের প্রতি বিদ্রূপ করে এবং যাদের স্বীয় পরিশ্রমলব্ধ বস্ত্ত ছাড়া কিছুই নেই তাদেরকে উপহাস করে, আল্লাহ তাদেরকে লাঞ্ছিত করেন এবং তাদের জন্য রয়েছে মর্মন্তুদ শাস্তি’ (তওবা ৯/৭৯)।

[1]. তিরমিযী হা/৩৬৭৫; আবুদাঊদ হা/১৬৭৮; মিশকাত হা/৬০২১, সনদ হাসান। অত্র হাদীছে তাবূক যুদ্ধের উল্লেখ নেই। কিন্তু পূর্বাপর সম্পর্ক বিবেচনায় ঘটনাটি তাবূক যুদ্ধের সাথে সংশ্লিষ্ট বলে দৃঢ় প্রতীতি জন্মে। মাক্বরেযী (মৃ. ৮৪৫ হি.) ও মুবারকপুরী সূত্রবিহীনভাবে লিখেছেন যে, আবুবকর (রাঃ) প্রথম দানের সূচনা করেন এবং এর পরিমাণ ছিল ৪০০০ দিরহাম (মাক্বরেযী, ইমতা‘উল আসমা ২/৪৭; আর-রাহীক্ব ৪৩৩)।
[2]. আহমাদ হা/২০৬৪৯; তিরমিযী হা/৩৭০১; মিশকাত হা/৬০৬৪। তিরমিযীর বর্ণনায় এসেছে, مَرَّتَيْنِ (দুই বার)।
এখানে প্রসিদ্ধ আছে যে, তিনি স্বর্ণমুদ্রা ছাড়াও ৯০০ উট, গদি ও পালানসহ ১০০ ঘোড়া (রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ১/১৩৬; আর-রাহীক্ব ৪৩৩ পৃঃ) এবং ২০০ উক্বিয়া রৌপ্য মুদ্রা দান করেন (আর-রাহীক্ব ৪৩৩ পৃঃ)। তবে এগুলির সনদ দুর্বলতা থেকে মুক্ত নয় (সীরাহ ছহীহাহ ২/৫২৫)।
[3]. মুহাম্মাদ বিন ওমর আল-হাযরামী ওরফে বাহরাক্ব (মৃ. ৯৩০ হি.), হাদায়েকুল আনওয়ার ওয়া মাত্বালি‘উল আসরার ফী সীরাতিন নবীইল মুখতার (জেদ্দা : দারুল মানহাজ, ১ম সংস্করণ ১৪১৯ হি.) ৩৭২ পৃঃ।
[4]. এখানে প্রসিদ্ধ আছে যে, আবু খায়ছামা মালেক বিন ক্বায়েস আনছারী, যিনি তাবূক যুদ্ধের তহবিলে এক ছা‘ খেজুর দান করেন এবং মুনাফিকরা সেজন্য তাকে বিদ্রুপ করে, রাসূল (ছাঃ)-এর কাফেলা তাবূকের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যাওয়ার পর তিনি নিজ বাড়ীতে প্রবেশ করেন। সেখানে গিয়ে তার দু’জন স্ত্রীকে তার জন্য ঠান্ডা পানি ও খাদ্য সমূহ প্রস্ত্ততরত অবস্থায় দেখতে পান। এসব দেখে তিনি বলে ওঠেন, আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) এখন প্রচন্ড দাবদাহের মধ্যে রাস্তা চলছেন। আর আবু খায়ছামা শীতল ছায়ার নীচে উপাদেয় খাদ্য ও সুন্দরী স্ত্রী নিয়ে তার মাল-সম্পদের মধ্যে অবস্থান করছে? এটা কখনই ইনছাফ নয়। অতঃপর তিনি স্ত্রীদের উদ্দেশ্যে বললেন, আমি কখনই তোমাদের কারু কক্ষে প্রবেশ করব না, যতক্ষণ না আমি রাসূল (ছাঃ)-এর সঙ্গে মিলিত হব। অতএব তোমরা আমার জন্য পাথেয় প্রস্ত্তত করে দাও। অতঃপর তিনি তার বাহনে উঠে রওয়ানা হ’লেন। পথিমধ্যে উমায়ের বিন ওয়াহাব আল-জুমাহীর সঙ্গে দেখা হ’লে তিনি বলেন, আমার কিছু পাপ রয়েছে। অতএব তুমি আমাকে পিছনে ফেলে যেয়োনা, যতক্ষণ না আমি রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে পৌঁছে যাই। অতঃপর তিনি আগে আগে চললেন। অবশেষে রাসূল (ছাঃ)-এর কাছাকাছি দূরত্বে পৌঁছে গেলে লোকেরা বলল, একজন সওয়ারী এগিয়ে আসছে। রাসূল (ছাঃ) বললেন, ওটি আবু খায়ছামা। লোকেরা বলল, আল্লাহর কসম! সে আবু খায়ছামা। অতঃপর তিনি সওয়ারী থেকে নেমে রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে এসে সালাম করলেন এবং তার বিষয়টি বর্ণনা করলেন। তখন রাসূল (ছাঃ) তার কল্যাণের জন্য দো‘আ করলেন’ (ইবনু হিশাম ২/৫২০-২১; যাদুল মা‘আদ ৩/৪৬৪)।
ঘটনাটি ইবনু ইসহাক বিনা সনদে বর্ণনা করেছেন। এটি ‘মুরসাল’ (তাহকীক ইবনু হিশাম, ক্রমিক ১৮৭০)।

তাবূক যুদ্ধে মুনাফিকদের অবস্থান

তাবূক যুদ্ধে মুনাফিকদের অবস্থান ছিল খুবই জঘন্য। যাতে মুসলিম বাহিনী মদীনা থেকে বের না হয় এবং রোমকদের হামলার পথ সুগম হয়, সেজন্য তাদের চেষ্টার অন্ত ছিল না। সেকারণ তাদের ও দুর্বল ঈমানদারদের লক্ষ্য করে সূরা তওবা ৩৮ থেকে ১১০ পর্যন্ত পরপর ৭২টি আয়াত নাযিল হয়। তাতে মুমিনদের ঈমান বৃদ্ধি পায় ও মুনাফিকদের বিষয়ে তারা অধিক সজাগ হয়।

মুনাফিকরা নিজেরা তো দান করেনি। উপরন্তু এই দানকে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করেছিল (তওবা ৯/৭৯)। তাদের ঠাট্টা যেন এরূপ ছিল যে, বিশ্বশক্তি রোমক বাহিনীকে এরা দু’চারটি খেজুর দিয়ে পরাস্ত করতে চায়। কিংবা দু’চারটা খেজুর দিয়েই এরা রোম সাম্রাজ্য জয়ের দিবা স্বপ্ন দেখছে।

আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের নেতৃত্বে মুনাফিকরা নানা অজুহাতে জিহাদ থেকে পিছিয়ে থাকে। উপরন্তু তারা গোপনে মুমিনদের বলতে থাকে যে, মুহাম্মাদ ও তার সাথীরা কেউ আর মদীনায় ফিরতে পারবেনা। রোম সম্রাট ওদের বন্দী করে বিভিন্ন দেশে পাঠিয়ে দিবেন। তারা বলে,لاَ تَنْفِرُوا فِي الْحَرِّ ‘তোমরা এই গরমে বের হয়োনা’ (তওবা ৯/৮১)। তাদের প্ররোচনায় কেউ কেউ গিয়ে মিথ্যা অজুহাত দেখিয়ে রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট থেকে জিহাদে না যাওয়ার অনুমতি প্রার্থনা করে’ (তওবা ৯/৪৩)। এ সময় মদীনার বেদুঈনদের মুনাফেকী ও অবাধ্যতা ছিল খুবই বেশী’ (তওবা ৯/৯৭)।[1] মদীনার শহর এলাকা ছেড়ে পার্শ্ববর্তী বস্তী এলাকাতেও মুনাফেকী ছড়িয়ে পড়ে। যাদেরকে রাসূল (ছাঃ) জানতেন না। কিন্তু আল্লাহ জানতেন’ (তওবা ৯/১০১)। আল্লাহ পাক এসব মুনাফিকদের ওযর কবুল করতে এবং তাদের কথা বিশ্বাস করতে রাসূল (ছাঃ)-কে নিষেধ করেন’ (তওবা ৯/৯৪)। এমনকি কুরআন তাদেরকে ‘অপবিত্র’ (رِجْسٌ) বলে আখ্যায়িত করে’ (তওবা ৯/৯৫)।

এভাবে মুমিন ও মুনাফিকদের মধ্যে আমলে ও আচরণে বিভক্তি রেখা সৃষ্টি হয়। ক্বোবায় মুনাফিকদের তৈরী ‘মসজিদে যেরারে’ রাসূল (ছাঃ)-কে ছালাত আদায়ে নিষেধ করা হয়’ (তওবা ৯/১০৭-০৮)। তাবূক যুদ্ধ থেকে ফিরে মুনাফিক নেতা আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই-এর জানাযায় শরীক হওয়ার পর থেকে সকল মুনাফিকের জানাযায় শরীক হওয়ার ব্যাপারে স্থায়ী নিষেধাজ্ঞা জারী করা হয়’ (তওবা ৯/৮৪)। তাবূক যুদ্ধে মুনাফিকদের বৃহদাংশ যোগদান করেনি। দু’চার জন যারা গিয়েছিল, তারা গিয়েছিল স্রেফ ষড়যন্ত্র করার জন্য। এমনকি ফেরার পথে তাদের মধ্যে ১২ জন রাসূল (ছাঃ)-কে এক পাহাড়ী সরু পথে হত্যার চেষ্টা করে (আল-বিদায়াহ ৫/১৯)।

তাছাড়া ঐ সময় ছিল ফল পাকার মৌসুম। যে কারণে মদীনা থেকে বের হওয়া তখন ছিল বড়ই কষ্টকর বিষয়।

মদীনার এই সার্বিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে আল্লাহপাক আয়াত নাযিল করে বলেন,يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنَّمَا الْمُشْرِكُونَ نَجَسٌ فَلاَ يَقْرَبُوا الْمَسْجِدَ الْحَرَامَ بَعْدَ عَامِهِمْ هَذَا وَإِنْ خِفْتُمْ عَيْلَةً فَسَوْفَ يُغْنِيكُمُ اللهُ مِنْ فَضْلِهِ إِنْ شَاءَ إِنَّ اللهَ عَلِيمٌ حَكِيمٌ ‘হে মুমিনগণ! মুশরিকগণ (শিরকী আক্বীদার কারণে) নাপাক বৈ কিছুই নয়। অতএব তারা যেন এ বছরের পর মাসজিদুল হারামের নিকটবর্তী না হয়। (ব্যবসা-বাণিজ্য তাদের হাতে থাকার কারণে) তোমরা যদি দারিদ্রে্যর ভয় কর, তবে সত্বর আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তোমাদেরকে অভাবমুক্ত করে দিবেন যদি তিনি চান। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞ ও প্রজ্ঞাময়’ (তওবা ৯/২৮)। যারা অজুহাত দিয়ে পিছিয়ে থাকার অনুমতি চেয়েছিল, তাদের প্রতি ইঙ্গিত করে আল্লাহ বলেন,لَوْ كَانَ عَرَضًا قَرِيبًا وَسَفَرًا قَاصِدًا لَاتَّبَعُوكَ وَلَكِنْ بَعُدَتْ عَلَيْهِمُ الشُّقَّةُ وَسَيَحْلِفُونَ بِاللهِ لَوِ اسْتَطَعْنَا لَخَرَجْنَا مَعَكُمْ يُهْلِكُونَ أَنْفُسَهُمْ وَاللهُ يَعْلَمُ إِنَّهُمْ لَكَاذِبُونَ ‘যদি গণীমত নিকটবর্তী হ’ত এবং সফর কাছাকাছি হ’ত, তাহ’লে ওরা অবশ্যই তোমার অনুগামী হ’ত। কিন্তু তাদের নিকট (শাম পর্যন্ত) সফরটাই দীর্ঘ মনে হয়েছে। তাই সত্বর ওরা আল্লাহর নামে শপথ করে বলবে, সাধ্যে কুলালে অবশ্যই আমরা তোমাদের সাথে বের হ’তাম। এভাবে (শপথ করে) তারা নিজেরা নিজেদের ধ্বংস করে। অথচ আল্লাহ জানেন যে ওরা অবশ্যই মিথ্যাবাদী’ (তওবা ৯/৪২)। অতঃপর দৃঢ় বিশ্বাসী মুমিনদের প্রতি আহবান জানিয়ে আল্লাহ বলেন,انْفِرُوا خِفَافًا وَثِقَالاً وَجَاهِدُوا بِأَمْوَالِكُمْ وَأَنْفُسِكُمْ فِي سَبِيلِ اللهِ ذَلِكُمْ خَيْرٌ لَكُمْ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُونَ ‘তোমরা বেরিয়ে পড় অল্প সংখ্যায় হও বা অধিক সংখ্যায় হও এবং জিহাদ কর আল্লাহর পথে তোমাদের মাল দ্বারা ও জান দ্বারা। এটাই তোমাদের জন্য উত্তম যদি তোমরা জানতে’ (তওবা ৯/৪১)। আল্লাহর এই আহবানে সাড়া দিয়ে ঈমানদারগণ দলে দলে জিহাদের উদ্দেশ্যে রাসূল (ছাঃ)-এর চারপাশে জমা হয়ে যায়। মুজাহিদ বলেন, আয়াতগুলি সবই তাবূক যুদ্ধের ঘটনায় নাযিল হয়েছিল’ (সীরাহ ছহীহাহ ২/৫২৮)।

[1]. প্রসিদ্ধ আছে যে, বনু সালামাহ গোত্রের জাদ বিন ক্বায়েসকে রাসূল (ছাঃ) জিহাদে যাওয়ার আহবান জানালে সে বলল, রোমক নারীরা খুবই সুন্দর। ওদের দেখে আমি ফিৎনায় পড়ে যাওয়ার আশংকা করি। অতএব হে আল্লাহর রাসূল! আপনি আমাকে ফিৎনায় ফেলবেন না। এ কথা শুনে রাসূল (ছাঃ) মুখ ফিরিয়ে নিলেন। এ বিষয়ে তওবা ৪৯ আয়াতটি নাযিল হয়। যেখানে আল্লাহ বলেন, وَمِنْهُمْ مَنْ يَقُولُ ائْذَنْ لِي وَلاَ تَفْتِنِّي ‘আর তাদের মধ্যেকার কেউ বলে, আমাকে (যুদ্ধ থেকে) অব্যাহতি দিন এবং আমাকে ফিৎনায় ফেলবেন না’ (তওবা ৯/৪৯; যাদুল মা‘আদ ৩/৪৬১)। বর্ণনাটি যঈফ ( মা শা-‘আ ২১৩-১৭ পৃঃ)। উল্লেখ্য যে, এই ব্যক্তি একাই মাত্র হোদায়বিয়াতে বায়‘আতুর রিযওয়ানে অংশ নেয়নি।

তাবূকের পথে মুসলিম বাহিনী

৯ম হিজরীর রজব মাসের এক বৃহস্পতিবারে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) ৩০,০০০ সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী নিয়ে তাবূকের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হ’লেন। এটাই ছিল তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় সেনা অভিযান। এই সময় তিনি মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামাহ আনছারীকে মতান্তরে সিবা‘ বিন উরফুত্বাহ আল-গিফারীকে মদীনার প্রশাসক নিযুক্ত করেন এবং হযরত আলীকে তাঁর পরিবারের দেখাশুনার দায়িত্ব দিয়ে যান। কিন্তু মুনাফিকরা তাকে সম্ভবতঃ ভীতু, কাপুরুষ ইত্যাদি বলে ঠাট্টা করায় ক্রুদ্ধ হয়ে তিনি পুনরায় গিয়ে পথিমধ্যে সেনাদলে যোগ দেন। তখন সেনাদল দু’তিন মনযিল অতিক্রম করে গেছে। আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) তাকে কাছে ডেকে সস্নেহে বলেন,أَلاَ تَرْضَى أَنْ تَكُوْنَ مِنِّيْ بِمَنْزِلَةِ هَارُوْنَ مِنْ مُوْسَى؟ إلاَّ أَنَّهُ لاَ نَبِيَّ بَعْدِيْ ‘তুমি কি এতে সন্তুষ্ট নও যে, তুমি আমার নিকটে অনুরূপ হও যেমন হারূণ ছিলেন মূসার নিকটে? তবে পার্থক্য এই যে, আমার পরে আর কোন নবী নেই’ (বুখারী হা/৪৪১৬)। একথা শুনে আলী (রাঃ) খুশী মনে মদীনায় ফিরে গেলেন।



প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর ৬৭ পর্বের জীবনীর সকল পর্ব এখান থেকে পড়ুন-

পর্ব-০১   পর্ব-০২   পর্ব-০৩   পর্ব-০৪   পর্ব-০৫   পর্ব-০৬   পর্ব-০৭   পর্ব-০৮   পর্ব-০৯   পর্ব-১০   পর্ব-১১   পর্ব-১২   পর্ব-১৩   পর্ব-১৪   পর্ব-১৫   পর্ব-১৬   পর্ব-১৭   পর্ব-১৮   পর্ব-১৯   পর্ব-২০   পর্ব-২১   পর্ব-২২   পর্ব-২৩   পর্ব-২৪   পর্ব-২৫   পর্ব-২৬   পর্ব-২৭   পর্ব-২৮   পর্ব-২৯   পর্ব-৩০    পর্ব-৩১   পর্ব-৩২   পর্ব-৩৩   পর্ব-৩৪   পর্ব-৩৫   পর্ব-৩৬   পর্ব-৩৭   পর্ব-৩৮   পর্ব-৩৯   পর্ব-৪০   পর্ব-৪১   পর্ব-৪২   পর্ব-৪৩   পর্ব-৪৪   পর্ব-৪৫   পর্ব-৪৬(১ম) পর্ব-৪৬(২য়)    পর্ব-৪৭   পর্ব-৪৮   পর্ব-৪৯   পর্ব-৫০   পর্ব-৫১   পর্ব-৫২   পর্ব-৫৩   পর্ব-৫৪   পর্ব-৫৫   পর্ব-৫৬   পর্ব-৫৭   পর্ব-৫৮   পর্ব-৫৯   পর্ব-৬০   পর্ব-৬১   পর্ব-৬২   পর্ব-৬৩   পর্ব-৬৪   পর্ব-৬৫   পর্ব-৬৬   পর্ব-৬৭  




******************************************
>>> Welcome, You are now on Mohammadia Foundation's Website. Please stay & Tune with us>>>


এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url