প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর জীবনী [পর্ব-২১]





হিজরতের প্রাক্কালে আবুবকর (রাঃ) এর পরিবারের অনন্য খিদমত

আবু বকর (রাঃ) ও তাঁর পরিবারের খিদমত

(১) হিজরতের প্রাক্কালে আসমা সফরের মাল-সামান ও খাদ্য-সামগ্রী বাঁধার জন্য রশিতে কম পড়ায় নিজের কোমরবন্দ খুলে তা ছিঁড়ে দু’টুকরা করে এক টুকরা দিয়ে থলির মুখ বাঁধেন ও বাকী টুকরা দিয়ে নিজের কোমরবন্দের কাজ সারেন। এ কারণে তিনি ذَاتُ النِّطَاقَيْنِ বা দুই কোমরবন্দের অধিকারিণী উপাধিতে ভূষিত হন’ (বুখারী হা/২৯৭৯)। উল্লেখ্য যে, আসমা (রাঃ) প্রতি রাতে তাঁদের জন্য খাবার রান্না করে নিয়ে যেতেন (ইবনু হিশাম ১/৪৮৫) বলে যা প্রসিদ্ধ আছে, তা সঠিক নয় (মা শা-‘আ ৭৮ পৃঃ)।

(২) বাসায় রক্ষিত পাঁচ/ছয় হাযার মুদ্রার সবই পিতা আবুবকর যাবার সময় সাথে নিয়ে যান। তাঁরা চলে যাবার পর আসমার বৃদ্ধ ও অন্ধ দাদা আবু ক্বোহাফা এসে আসমাকে বললেন, বেটি! আমি মনে করি, আবুবকর তোমাদের দ্বিগুণ কষ্টে ফেলে গেল। সে নিজে চলে গেল এবং নগদ মুদ্রা সব নিয়ে গেল। একথা শুনে উপস্থিত বুদ্ধি খাটিয়ে আসমা একটা পাথর কাপড়ে জড়িয়ে টাকা রাখার গর্তে রেখে এসে দাদাকে সেখানে নিয়ে গেল এবং দাদার হাত উক্ত গর্তের মধ্যে কাপড়ের গায়ে ধরিয়ে দিয়ে বলল, এই দেখ দাদু! আববা সব মুদ্রা রেখে গেছেন’। অন্ধ দাদু তাতে মহা খুশী হয়ে বললেন, أَمَّا إِذَا تَرَكَ هَذَا فَنَعَمْ ‘যাক! এগুলো ছেড়ে গিয়ে সে খুব ভাল কাজ করেছে’ (হাকেম হা/৪২৬৭ সনদ ছহীহ)। উল্লেখ্য যে, আবুবকর (রাঃ)-এর পিতা আবু ক্বোহাফা ঐ সময় কাফের ছিলেন। পরে তিনি মক্কা বিজয়ের দিন মুসলমান হন।

(৩) তাছাড়া আসমার ছোট বোন আয়েশা আসমার সাথে সকল কাজে সাহায্য করেন। (৪) তাঁর ভাই আব্দুল্লাহ পিতার সাথে রাতে গুহায় কাটাতেন ও ভোর রাতে বাড়ি ফিরে আসতেন। অতঃপর শত্রুপক্ষের খবরাখবর নিয়ে রাতের বেলা পুনরায় গুহায় চলে যেতেন’ (বুখারী হা/৩৯০৫)।

(৫) আবুবকরের মুক্তদাস ‘আমের বিন ফুহায়রা ছওর পর্বতের পার্শ্ববর্তী ময়দানে দিনের বেলা ছাগল চরাতো। তারপর রাতের একাংশ অতিবাহিত হ’লে সে ছাগপাল নিয়ে ছওর পাহাড়ের পাদদেশে চলে আসত এবং রাসূল (ছাঃ) ও আবুবকরকে দুধ পান করাত। তারপর সেখানে অবস্থান করে ভোর হবার আগেই ছাগপাল নিয়ে পুনরায় দূরে চলে যেত’ (বুখারী হা/৩৯০৫)।

এইভাবে দেখা যায় যে, আবুবকর (রাঃ)-এর পুরো পরিবার হিজরতের প্রস্তুতিকালে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। উল্লেখ্য যে, ছাহাবীগণের মধ্যে একমাত্র আবুবকর (রাঃ) এই বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ছিলেন যে, তাঁর চার পুরুষ মুসলমান ও ছাহাবী ছিলেন। অর্থাৎ তিনি, তাঁর পিতা-মাতা, তাঁর সন্তানগণ এবং তাদের সন্তানগণ। তন্মধ্যে সবচেয়ে খ্যাতনামা ছিলেন তাঁর কন্যা আসমার পুত্র ও আয়েশার পালিত পুত্র হযরত আব্দুল্লাহ বিন যুবায়ের (১-৭৩ হিঃ)। যিনি ছিলেন হিজরতের পরপরই ক্বোবায় জন্মগ্রহণকারী প্রথম মুহাজির সন্তান। তাঁর সহোদর ছোট ভাই উরওয়া বিন যুবায়ের (২৩-৯৪ হিঃ) ছিলেন রাসূল চরিত বর্ণনায় শ্রেষ্ঠ ও বিশ্বস্ত রাবী এবং মদীনার শ্রেষ্ঠ ফক্বীহ সপ্তকের অন্যতম (সৈয়ূত্বী, ত্বাবাক্বাতুল হুফফায ক্রমিক ৪৯)।

আল্লাহ বলেন,رَبِّ أَوْزِعْنِيْ أَنْ أَشْكُرَ نِعْمَتَكَ الَّتِيْ أَنْعَمْتَ عَلَيَّ وَعَلَى وَالِدَيَّ وَأَنْ أَعْمَلَ صَالِحًا تَرْضَاهُ وَأَصْلِحْ لِيْ فِيْ ذُرِّيَّتِيْ إِنِّيْ تُبْتُ إِلَيْكَ وَإِنِّيْ مِنَ الْمُسْلِمِيْنَ ‘হে আমার পালনকর্তা! আমাকে ও আমার পিতা-মাতাকে যে নে‘মত তুমি দান করেছ, তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার শক্তি আমাকে দাও! আর আমি যেন এমন সৎকর্ম করতে পারি, যা তুমি পসন্দ কর এবং আমার জন্য আমার সন্তানদের মধ্যে তুমি কল্যাণ দান কর। আমি তোমার দিকে ফিরে গেলাম এবং আমি তোমার একান্ত আজ্ঞাবহদের অন্তর্ভুক্ত’ (আহক্বাফ ৪৬/১৫)।

আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, উক্ত দো‘আটি আবুবকর ছিদ্দীক (রাঃ) করেছিলেন, যখন তিনি ৪০ বছর বয়সে উপনীত হন। ফলে তিনিই ছিলেন একমাত্র ব্যক্তি, যার সকল সন্তান ও পিতা-মাতা ইসলাম কবুল করেছিলেন’ (কুরতুবী)। উল্লেখ্য যে, হযরত আবুবকর (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর চাইতে বয়সে দু’বছরের ছোট ছিলেন।

ছওর গুহা থেকে ইয়াছরিব যাত্রা

অনেক খোঁজাখুজির পর ব্যর্থ হয়ে কাফেররা একপ্রকার রণে ভঙ্গ দিয়েছিল। আব্দুল্লাহর মাধ্যমে সব খবর জানতে পেরে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এবার ইয়াছরিব যাত্রার নির্দেশ দিলেন।

১লা রবীউল আউয়াল মোতাবেক ৬২২ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ই সেপ্টেম্বর সোমবার প্রত্যুষে তাঁরা ছওর গিরিগুহা ছেড়ে মক্কার নিম্নভূমি দিয়ে ইয়াছরিব অভিমুখে রওয়ানা হন। একটি উটে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও আবুবকর (রাঃ) এবং অন্যটিতে মুক্তদাস ‘আমের বিন ফুহাইরা ও বনু দীল (الدِّيلِ) গোত্রের পথপ্রদর্শক (প্রসিদ্ধ মতে) আব্দুল্লাহ বিন উরাইক্বিত লায়ছী সওয়ার হয়, যে তখন কাফের ছিল।[1]

আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, মক্কা থেকে বের হওয়ার সময় আবুবকর (রাঃ) দুঃখ করে বলেছিলেন, أَخْرَجُوْا نَبِيَّهُمْ لَيَهْلِكُنَّ ‘তারা তাদের নবীকে বের করে দিল। এখন অবশ্যই তারা ধ্বংস হবে’। অতঃপর সূরা হজ্জ-এর ৩৯ আয়াতটি নাযিল হয়, أُذِنَ لِلَّذِينَ يُقَاتَلُونَ بِأَنَّهُمْ ظُلِمُوا وَإِنَّ اللهَ عَلَى نَصْرِهِمْ لَقَدِيرٌ- الَّذِيْنَ أُخْرِجُوا مِنْ دِيَارِهِمْ بِغَيْرِ حَقٍّ إِلاَّ أَنْ يَقُولُوا رَبُّنَا اللهُ وَلَوْلاَ دَفْعُ اللهِ النَّاسَ بَعْضَهُمْ بِبَعْضٍ لَهُدِّمَتْ صَوَامِعُ وَبِيَعٌ وَصَلَوَاتٌ وَمَسَاجِدُ يُذْكَرُ فِيْهَا اسْمُ اللهِ كَثِيْرًا وَلَيَنْصُرَنَّ اللهُ مَنْ يَنْصُرُهُ إِنَّ اللهَ لَقَوِيٌّ عَزِيْزٌ ‘যুদ্ধের অনুমতি দেওয়া হ’ল তাদেরকে, যারা আক্রান্ত হয়েছে। কারণ তাদের প্রতি যুলুম করা হয়েছে। বস্তুতঃ আল্লাহ তাদেরকে (যুদ্ধ ছাড়াই) সাহায্য করতে অবশ্যই সক্ষম’ (৩৯)। ‘যাদেরকে তাদের ঘর-বাড়ি থেকে অন্যায়ভাবে বের করে দেওয়া হয়েছে শুধুমাত্র এ কারণে যে, তারা বলে আমাদের পালনকর্তা ‘আল্লাহ’। যদি আল্লাহ মানবজাতির একদলকে অন্য দল দ্বারা প্রতিহত না করতেন, তাহলে নাছারাদের বিশেষ উপাসনালয়, সাধারণ উপাসনালয়, ইহূদীদের উপাসনালয় ও মুসলমানদের মসজিদসমূহ, যে সকল স্থানে আল্লাহর নাম অধিকহারে স্মরণ করা হয়, সবই ধ্বংস হয়ে যেত। আর নিশ্চয়ই আল্লাহ মহাশক্তিমান ও পরাক্রমশালী’ (হজ্জ ২২/৩৯-৪০)।[2] বস্তুতঃ এটাই ছিল যুদ্ধের অনুমতি দিয়ে নাযিল হওয়া প্রথম আয়াত।

[1]. ফাৎহুল বারী হা/৩৯০৫-এর আলোচনা দ্রষ্টব্য।
[2]. তিরমিযী হা/৩১৭১; নাসাঈ হা/৩০৮৫; আহমাদ হা/১৮৬৫; হাকেম হা/২৩৭৬।

হিজরতকালের কিছু ঘটনা

আবুবকর (রাঃ)-এর তাওরিয়া অবলম্বন

যাত্রাবস্থায় আবুবকর (রাঃ) সর্বদা সওয়ারীতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর পিছনে বসতেন। কেননা আবুবকরের মধ্যে বার্ধক্যের নিদর্শন প্রকাশ পেয়েছিল। কিন্তু রাসূল (ছাঃ)-এর চেহারা-ছূরতে তখনো চাকচিক্য বজায় ছিল। তাই রাস্তায় লোকেরা কিছু জিজ্ঞেস করলে মুরববী ভেবে আবুবকরকেই করতো। সামনের লোকটির পরিচয় জানতে চাইলে তিনি বলতেন,هَذَا الرَّجُلُ يَهْدِينِى السَّبِيلَ ‘এ ব্যক্তি আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন’ (বুখারী হা/৩৯১১)। এর দ্বারা তিনি হেদায়াতের পথ বুঝাতেন। কিন্তু লোকেরা ভাবত রাস্তা দেখানো কোন লোক হবে। এর মাধ্যমে তিনি রাসূল (ছাঃ)-এর পরিচয় গোপন করতেন। আরবী অলংকার শাস্ত্রে এই দ্ব্যর্থবোধক বক্তব্যকে ‘তাওরিয়া’ (التوْرِيَة) বলা হয়। যাতে একদিকে সত্য বলা হয়। অন্যদিকে শ্রোতাকেও বুঝানো যায়।

উম্মে মা‘বাদের দুর্বল বকরী দোহন

খোযা‘আহ গোত্রের খ্যাতনাম্নী অতিথিপরায়ণ মহিলা উম্মে মা‘বাদের তাঁবুর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে জিজ্ঞেস করলেন, পানাহারের কিছু আছে কি? ঐ মহিলার অভ্যাস ছিল তাঁবুর বাইরে বসে থাকতেন মেহমানের অপেক্ষায়। মেহমান পেলে তাকে কিছু না খাইয়ে ছাড়তেন না। কিন্তু এইদিন এমন হয়েছিল যে, বাড়ীতে পানাহারের মত কিছুই ছিল না। ঐ সময়টা ছিল ব্যাপক দুর্ভিক্ষের সময়। বকরীগুলো সব মাঠে নিয়ে গেছেন স্বামী আবু মা‘বাদ। একটা কৃশ দুর্বল বকরী যে মাঠে যাওয়ার মত শক্তি হারিয়ে ফেলেছিল, সেটা তাঁবুর এক কোণে বাঁধা ছিল। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সেটাকে দোহন করার অনুমতি চাইলেন। উম্মে মা‘বাদ বললেন, ওর পালানে কিছু থাকলে তো আমিই আপনাদের দোহন করে দিতাম। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বকরীটির বাঁটে ‘বিসমিল্লাহ’ বলে হাত রাখলেন ও বরকতের দো‘আ করলেন। সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহর ইচ্ছায় বকরীটির পালান দুধে পূর্ণ হয়ে গেল। তারপর তিনি দোহন করতে থাকলেন। তাতে দ্রুত পাত্র পূর্ণ হয়ে গেল। প্রথমে বাড়ীওয়ালী উম্মে মা‘বাদকে পান করালেন। তারপর সাথীদের এবং সবশেষে তিনি নিজে পান করলেন। এরপরে এক পাত্র পূর্ণ করে উম্মে মা‘বাদের কাছে রেখে তাঁরা পুনরায় যাত্রা করলেন।

অল্পক্ষণ পরেই আবু মা‘বাদ বাড়ীতে ফিরে সব ঘটনা শুনে অবাক বিস্ময়ে বলে উঠলেন- وَاللهِ هَذَا صَاحِبُ قُرَيْشٍ ... لَقَدْ هَمَمْتُ أَنْ أَصْحَبَهُ وَلَأَفْعَلَنَّ إِنْ وَجَدْتُ إِلَى ذَلِكَ سَبِيْلاً ‘আল্লাহর কসম! ইনিই কুরায়েশদের সেই মহান ব্যক্তি হবেন। যার সম্পর্কে লোকেরা নানা কথা বলে থাকে। আমার দৃঢ় ইচ্ছা আমি তাঁর সাহচর্য লাভ করি এবং সুযোগ পেলে আমি তা অবশ্যই করব’।

আসমা বিনতে আবু বকর বলেন, আমরা জানতাম না রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কোন পথে ইয়াছরিব গমন করেছেন। কিন্তু দেখা গেল যে, হঠাৎ মক্কার নিম্নভূমি থেকে জনৈক অদৃশ্য ব্যক্তি একটি কবিতা পাঠ করতে করতে এল এবং মানুষ তার পিছে পিছে চলছিল। তারা সবাই তার কবিতা শুনছিল। কিন্তু তাকে কেউ দেখতে পাচ্ছিল না। এভাবে কবিতা বলতে বলতে মক্কার উচ্চভূমি দিয়ে আওয়াযটি বেরিয়ে চলে গেল। আর বারবার শোনা যাচ্ছিল لاَ تَحْزَنْ إِنَّ اللهَ مَعَنَا ‘চিন্তিত হয়ো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন’। সেই সাথে পঠিত পাঁচ লাইন কবিতা শুনে আমরা বুঝেছিলাম যে, তিনি উম্মে মা‘বাদের তাঁবুতে অবতরণ করে ঐ পথ ধরে ইয়াছরিব গিয়েছেন। উক্ত বার্তায় কয়েক লাইন কবিতার প্রথম দু’টি লাইন ছিল নিম্নরূপ।-

جَزَى اللهُ رَبُّ الْعَرْشِ خَيْرَ جَزَائِهِ + رَفِيقَيْنِ حَلاَّ خَيْمَتَيْ أُمِّ مَعْبَدٍ
هُمَا نَزَلاَ بِالْبِرِّ وَارْتَحَلاَ بِه + وَأَفْلَحَ مَنْ أَمْسَى رَفِيقَ مُحَمَّدِ

‘আরশের মালিক আল্লাহ তার সর্বোত্তম বদলা দান করেছেন তাঁর দুই বন্ধুকে, যারা উম্মে মা‘বাদের দুই তাঁবুতে অবতরণ করেছেন’।

‘তারা কল্যাণের সাথে অবতরণ করেছেন এবং কল্যাণের সাথে গমন করেছেন। তিনি সফলকাম হয়েছেন যিনি মুহাম্মাদের বন্ধু হয়েছেন’।[1] মূলতঃ আবুবকর পরিবারকে দুশ্চিন্তামুক্ত করার জন্য এটি ছিল আল্লাহর পক্ষ থেকে এলাহী বেতার বার্তা স্বরূপ। উম্মে মা‘বাদের তাঁবুতে অবতরণের ঘটনাটি ছিল সফরের দ্বিতীয় দিনের (আর-রাহীক্ব ১৭০ পৃঃ)।

সুরাক্বা বিন মালেকের পশ্চাদ্ধাবন

বনু মুদলিজ গোত্রের নেতা সুরাক্বা বিন মালেক বিন জু‘শুম আল-মুদলেজী জনৈক ব্যক্তির কাছে মুহাম্মাদ গমনের সংবাদ শুনে পুরস্কারের লোভে দ্রুতগামী ঘোড়া ও তীর-ধনুক নিয়ে রাসূল (ছাঃ)-এর পিছে ধাওয়া করল। কিন্তু কাছে যেতেই ঘোড়ার পা দেবে গিয়ে সে চলন্ত ঘোড়া থেকে ছিটকে পড়ল। তখন তীর ছুঁড়তে গিয়ে তার পছন্দনীয় তীরটি খুঁজে পেল না। ইতিমধ্যে মুহাম্মাদী কাফেলা অনেক দূরে চলে গেল। সে পুনরায় ঘোড়া ছুটালো। কিন্তু এবারও একই অবস্থা হল। কাছে পৌঁছতেই ঘোড়ার পা পেট পর্যন্ত মাটিতে এমনভাবে দেবে গেল যে, তা আর উঠাতে পারে না। আবার সে তীর বের করার চেষ্টা করল। কিন্তু আগের মতই ব্যর্থ হল। তার পছন্দনীয় তীরটি খুঁজে পেল না। তখনই তার মনে ভয় উপস্থিত হল এবং এ বিশ্বাস দৃঢ় হল যে, মুহাম্মাদকে নাগালে পাওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। সে তখন রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে নিরাপত্তা প্রার্থনা করল। এ আহবান শুনে মুহাম্মাদী কাফেলা থেমে গেল। সে কাছে গিয়ে রাসূল (ছাঃ)-কে কিছু খাদ্য-সামগ্রী ও আসবাবপত্র দিতে চাইল। রাসূল (ছাঃ) কিছুই গ্রহণ করলেন না। সুরাক্বা বলল, আমাকে একটি ‘নিরাপত্তা নামা’(كِتَابُ أَمْنٍ) লিখে দিন। তখন রাসূল (ছাঃ)-এর হুকুমে ‘আমের বিন ফুহায়রা একটি চামড়ার উপরে তা লিখে তার দিকে নিক্ষেপ করলেন। অতঃপর রওয়ানা হলেন।[2] লাভ হল এই যে, ফেরার পথে সুরাক্বা অন্যান্যদের ফিরিয়ে নিয়ে গেল, যারা রাসূল (ছাঃ)-এর পিছু নিয়েছিল। এভাবে দিনের প্রথম ভাগে যে ছিল রক্ত পিপাসু দুশমন, দিনের শেষভাগে সেই হল দেহরক্ষী বন্ধু।

বারা বিন ‘আযেব (রাঃ) স্বীয় পিতা হতে বর্ণনা করেন, একদিন আমি আবুবকরকে জিজ্ঞেস করলাম, হিজরতের রাতে আপনারা কিভাবে সফর করেছিলেন, আমাকে একটু বলুন। তখন তিনি বললেন, আমরা সারা রাত চলে পরদিন দুপুরে জনমানবহীন রাস্তার পাশে একটা লম্বা ও বড় পাথরের ছায়ায় রাসূল (ছাঃ)-কে শুইয়ে দিলাম। অতঃপর আমি চারিদিকে দেখতে লাগলাম। এমন সময় একটি মেষপাল আসতে দেখলাম। আমি মেষপালককে বললে সে দুগ্ধ দোহন করে দিল। অতঃপর আমরা উভয়ে দুধ পান করে তৃপ্ত হলাম। অতঃপর সূর্য ঢলে পড়লে আমরা রওয়ানা হলাম। ইতিমধ্যে দূর থেকে দেখলাম সুরাক্বা বিন মালেক আমাদের পিছু নিয়েছে। তখন আমি ব্যস্ত হয়ে পড়লে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, لاَ تَحْزَنْ إِنَّ اللهَ مَعَنَا ‘চিন্তিত হয়ো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন’। অতঃপর কাছে আসতেই তার ঘোড়া পেট পর্যন্ত শক্ত মাটিতে দেবে গেল। সে বলল, আমি দেখলাম তোমরা আমার বিরুদ্ধে বদ দোআ করেছ। এক্ষণে আমার জন্য দোআ কর। আমি তোমাদের পক্ষে শত্রুদের ফিরিয়ে নিয়ে যাব। তখন রাসূল (ছাঃ) তার জন্য দোআ করলেন এবং সে মুক্তি পেল। অতঃপর সে ফিরে যাওয়ার পথে পিছু ধাওয়াকারী লোকদের বলতে থাকে যে, ‘আমি তাকে খুঁজে ব্যর্থ হয়েছি। অতএব তোমরাও ফিরে চল। এভাবে সে সবাইকে ফিরিয়ে নিয়ে যায়।[3] এতে বুঝা যায় যে, উক্ত সান্ত্বনা বাক্যটি কেবল ছওর গিরিগুহায় নয়, অন্যত্র সংকট কালেও তিনি বলেছেন। ছওর গুহা থেকে রওয়ানা হওয়ার তৃতীয় দিনে ঘটনাটি ঘটেছিল।

যুবায়ের ইবনুল ‘আওয়ামের সাথে সাক্ষাৎ

পরবর্তী পর্যায়ে ছাহাবী যুবায়ের ইবনুল ‘আওয়ামের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়, যিনি মুসলমানদের একটি বাণিজ্য কাফেলা নিয়ে সিরিয়া থেকে ইয়াছরিব ফিরছিলেন। ইনি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও আবুবকর (রাঃ)-কে এক সেট করে সাদা কাপড় প্রদান করেন (বুখারী হা/৩৯০৬)। যুবায়ের ছিলেন হযরত আবুবকর (রাঃ)-এর বড় জামাতা ও আসমা (রাঃ)-এর স্বামী এবং ‘আশারায়ে মুবাশ্শারাহর অন্যতম মহান ব্যক্তিত্ব। তিনি ছিলেন মহাবীর ছাহাবী ও আয়েশা (রাঃ)-এর পালিতপুত্র আব্দুল্লাহ বিন যুবায়েরের স্বনামধন্য পিতা।

[1]. যাদুল মা‘আদ ৩/৫১-৫২; হাকেম হা/৪২৭৪, ৩/৯-১০ পৃঃ, হাকেম ছহীহ বলেছেন এবং যাহাবী তা সমর্থন করেছেন; হাকেমে ১৬ লাইনের কবিতা এসেছে। দ্বিতীয় লাইন থেকে কিছু শাব্দিক পরিবর্তন আছে। মিশকাত হা/৫৯৪৩ ‘ফাযায়েল’ অধ্যায় ‘মু‘জেযা সমূহ’ অনুচ্ছেদ; ফিক্বহুস সীরাহ ১৬৮ পৃঃ, আলবানী ‘হাসান’ বলেছেন; সীরাহ ছহীহাহ ১/২১২-১৫।
[2]. বুখারী হা/৩৯০৬ ‘আনছারদের মর্যাদা’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ ৪৫; ইবনু হিশাম ১/৪৮৯-৯০।
[3]. বুখারী হা/৩৬১৫; মুসলিম হা/২০০৯; মিশকাত হা/৫৮৬৯ ‘ফাযায়েল’ অধ্যায় ‘মু‘জেযা সমূহ’ অনুচ্ছেদ। 

সুরাক্বা বিন মালেক সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ’র ভবিষ্যৎবাণী

(ক) এখানে প্রসিদ্ধ আছে যে, সুরাক্বা বিন মালেক যখন তার রাবেগ এলাকায় ফিরে যাচ্ছিল, তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে লক্ষ্য করে বলেন, তোমার অবস্থা তখন কেমন হবে, যখন তোমার হাতে কিসরার মূল্যবান কংকন পরানো হবে? এ বক্তব্যটির সনদ মুরসাল বা যঈফ (মা শা-‘আ ৮৫ পৃঃ)। বস্ত্ততঃ হোনায়েন যুদ্ধের পরে জি‘ইর্রানাতে এসে সুরাক্বাহ মুসলমান হন (ইবনু হিশাম ১/৪৯০)। অতঃপর ওমর (রাঃ)-এর খেলাফতকালে ১৫ হিজরীতে যখন মাদায়েন বিজিত হয় এবং পারস্য সম্রাট কিসরার রাজমুকুট ও অমূল্য রত্নাদি তাঁর সম্মুখে হাযির করা হয়, তখন তিনি সুরাক্বাকে ডাকেন ও তার হাতে কিসরার কংকন পরিয়ে দেন। এ সময় ওমরের যবান দিয়ে বেরিয়ে যায়- الْحَمْدُ ِللهِ سِوَارَىْ كِسْرَى بْنِ هُرْمُزَ فِى يَدِ سُرَاقَةَ بْنِ مَالِكِ بْنِ جُعْشُمٍ أَعْرَابِىٌّ مِنْ بَنِى مُدْلِجٍ- ‘আল্লাহর জন্য সকল প্রশংসা! আজ সম্রাট কিসরার কংকন বেদুইন সুরাক্বার হাতে শোভা পাচ্ছে’। এ বক্তব্যটির সনদ ‘মুরসাল’ বা যঈফ (মা শা-‘আ ৮৫ পৃঃ)। উক্ত বিষয়ে ছহীহ বর্ণনা সেটাই যা উপরে বর্ণিত হয়েছে।

৭০ জন সাথীসহ বুরাইদা আসলামীর ইসলাম গ্রহণ

(খ) আরও প্রসিদ্ধ আছে যে, পথিমধ্যে বুরাইদা আসলামীর কাফেলার সাথে রাসূল (ছাঃ)-এর সাক্ষাৎ হয়। বুরাইদা ছিলেন একজন বীরপুরুষ ও নিজ সম্প্রদায়ের নেতা। তিনি মক্কাবাসীদের ঘোষিত পুরস্কারের লোভে মুহাম্মাদের মাথা নেওয়ার জন্য অনুসন্ধানে ছিলেন। কিন্তু শিকার হাতে পেয়ে তিনিই ফের শিকারে পরিণত হলেন। রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে কিছু কথাবার্তাতেই তার মনে দারুণ রেখাপাত করে এবং সেখানেই ৭০ জন সাথী সহ তিনি ইসলাম কবুল করেন। অতঃপর মাথার পাগড়ী খুলে বর্শার মাথায় বেঁধে তাকে ঝান্ডা বানিয়ে ঘোষণা প্রচার করতে করতে চললেন, قَدْ جَاءَ مَلِكُ الْأَمْنِ وَالسَّلاَمِ، لَيَمْلَأُ الدُّنْيَا عَدْلاً وَقِسْطًا ‘শান্তি ও নিরাপত্তার বাদশাহ আগমন করেছেন। দুনিয়া এখন ইনছাফ ও ন্যায়বিচারে পূর্ণ হয়ে যাবে’ (রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ১/৯০ পৃঃ; আর-রাহীক্ব ১৭০ পৃঃ)। ঘটনাটির সনদ অত্যন্ত দুর্বল (ঐ, তা‘লীক্ব ১১৩-১১৬; আলবানী, সিলসিলা যঈফাহ হা/৫৪৫০)। এছাড়া মানছূরপুরী রাসূল (ছাঃ)-এর মু‘জেযা অধ্যায়ে বর্ণিত ২১টি ঘটনার মধ্যেও এটি আনেননি (রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ৩/১৩৮-৬২ পৃঃ)।

উল্লেখ্য যে, বুরাইদা আসলামী মক্কার বনু সাহম গোত্রের লোক ছিলেন। তিনি হিজরতকালে রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট ৭০ অথবা ৮০জন সাথী সহ ইসলাম কবুল করেন। বদর অথবা ওহোদ যুদ্ধের পরে মদীনায় আগমন করেন। এরপর থেকে রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে প্রায় ১৬টি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তিনি হোদায়বিয়ার সফরে বায়‘আতুর রিযওয়ানে শরীক ছিলেন। তিনি প্রথমে মদীনা ও পরে বছরার অধিবাসী ছিলেন। অতঃপর ইয়াযীদ বিন মু‘আবিয়ার খিলাফতকালে (৬০-৬৪ হিঃ) যুদ্ধের উদ্দেশ্যে খোরাসান গমন করেন। অতঃপর সেখানে মারভ নগরীতে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর পুত্র সেখানেই থেকে যান (আল-ইছাবাহ ক্রমিক ৬৩২; আল-ইস্তী‘আব)।




***********************************
সাইটটি ভিজিট করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আর্টিকেলটি ভাল লাগলে সত্য ও ন্যয়ের পথে অন্য ভাইনদেরকে দাওয়াতের নিয়তে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন। মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে এবং দীন ও মানবতার সেবায় অংশ নিতে OUR ACTION PLAN বাটনে ক্লিক করুন।


এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url