প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর জীবনী [পর্ব- ৫৯] || মহানবীর জীবনী ||





রাসুলুল্লাহ (ছাঃ) এর বিদায় হজ্জ ও মদিনায় প্রত্যাবর্তন

[পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ট মহামানব আমাদের প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:)। যাকে আল্লাহ সমস্ত মানুষের জন্য অশেষ রহমত স্বরূপ এই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। যে নবী সারা জীবন উম্মতের জন্য সংগ্রাম করেছেন, কাল রোজ হাশরের মাঠেও যিনি উম্মতের জন্যই পেরেশান থাকবেন ইয়া উম্মতি ইয়া উম্মতি বলে বিচলিত হবেন; সেই প্রাণপ্রিয় নবীকে আমরা কতটুকু চিনি, কতটুকু জানি? প্রিয় নবী (সা:) এর জীবনের পরতে পরতে রয়েছে আমাদের জন্য শিক্ষা ও অনুপ্রেরণা। যার জীবনী পড়লে নিজের অজান্তেই চোখের পানি গড়িয়ে পড়ে। সেই নবীর জীবনী কি আমরা সত্যিই জানি? আসুন, আরেকবার দেখে নেই “প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর জীবনী”। যে জীবনী পড়ে বদলে যেতে পারে আপনার আমার জীবন। আমরা এখানে প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর বিশাল কর্মময় জীবনকে ৬৭টি সুবিশাল পর্বে তুলে ধরেছি। আল্লাহ আমাদের সবাইকে প্রাণপ্রিয় নবীর (সা:) উম্মত হিসাবে কবুল করুন। আমিন।।]

আইয়ামে তাশরীক্বের ১ম দিনের ভাষণ

৪. উম্মুল হুছাইন (রাযিয়াল্লাহু ‘আনহা) বলেন, ‘আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে বিদায় হজ্জ করেছি। অতঃপর জামরায় কংকর নিক্ষেপের পর ফিরে এসে জাদ‘আ (الْجَدْعَاء) উটনীর উপর বসা অবস্থায় তাঁকে বলতে শুনেছি,إِنْ أُمِّرَ عَلَيْكُمْ عَبْدٌ مُجَدَّعٌ أَسْوَدُ يَقُودُكُمْ بِكِتَابِ اللهِ فَاسْمَعُوا لَهُ وَأَطِيعُوا (৮) ‘যদি তোমাদের উপর নাক-কান কাটা কৃষ্ণকায় গোলামও আমীর নিযুক্ত হন, যিনি তোমাদেরকে আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী পরিচালিত করেন, তোমরা তাঁর কথা শোন ও মান্য কর’।[1]
[1]. আহমাদ হা/২২২১৫ সনদ ছহীহ; মুসলিম হা/১২৯৮; মিশকাত হা/৩৬৬২ ‘নেতৃত্ব ও পদমর্যাদা’ অধ্যায়।

সূরা নছর নাযিল

আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ) বলেন, আইয়ামে তাশরীক্বের মধ্যবর্তী দিনে অর্থাৎ ১২ই যিলহাজ্জে মিনায় সূরা নছর নাযিল হয়। অতঃপর তিনি ক্বাছওয়া (القَصْواء) উটনীতে সওয়ার হয়ে জামরায়ে আক্বাবায় গমন করেন। অতঃপর কংকর নিক্ষেপ শেষে ফিরে এসে জনগণের উদ্দেশ্যে তাঁর প্রসিদ্ধ ভাষণটি প্রদান করেন’।[1]

সূরা নছর: إِذَا جَاءَ نَصْرُ اللهِ وَالْفَتْحُ، وَرَأَيْتَ النَّاسَ يَدْخُلُوْنَ فِيْ دِيْنِ اللهِ أَفْوَاجًا، فَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ وَاسْتَغْفِرْهُ إِنَّهُ كَانَ تَوَّابًا ‘যখন এসে গেছে আল্লাহর সাহায্য ও বিজয়’। ‘এবং তুমি লোকদের দলে দলে আল্লাহর দ্বীনের মধ্যে প্রবেশ করতে দেখছ’। ‘তখন তুমি তোমার পালনকর্তার প্রশংসা সহ পবিত্রতা বর্ণনা কর এবং তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর। নিশ্চয়ই তিনি সর্বাধিক তওবা কবুলকারী’ (নাছর ১১০/১-৩)।

আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, এটিই ছিল কুরআনের সর্বশেষ পূর্ণাঙ্গ সূরা’ (মুসলিম হা/৩০২৪ ‘তাফসীর’ অধ্যায়)। তিনি বলেন,إِنَّمَا هُوَ أَجَلُ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَعْلَمَهُ لَهُ ‘এ সূরার মাধ্যমে আল্লাহ তাঁর রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যু ঘনিয়ে আসার কথা জানিয়ে দিয়েছেন’ (বুখারী হা/৪৯৭০)। এজন্য এ সূরাকে সূরা তাওদী‘ (التَّوْدِيع) বা বিদায়ী সূরা বলা হয় (কুরতুবী)।

[1]. বায়হাক্বী ৫/১৫২, হা/৯৪৬৪; আবুদাঊদ হা/১৯৫২ ‘মানাসিক’ অধ্যায় ৭১ অনুচ্ছেদ; আলবানী, সনদ ছহীহ; ‘আওনুল মা‘বূদ হা/১৯৫২-এর ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য।

আইয়ামে তাশরীক্বের ২য় দিনের ভাষণ

৫. জাবের বিন আব্দুল্লাহ (রাঃ) বলেন,

عَنْ جَابِرِ بْنِ عَبْدِ اللهِ قَالَ: خَطَبَنَا رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي وَسَطِ أَيَّامِ التَّشْرِيقِ خُطْبَةَ الْوَدَاعِ، فَقَالَ: يَا أَيُّهَا النَّاسُ، إِنَّ رَبَّكُمْ وَاحِدٌ، وَإِنَّ أَبَاكُمْ وَاحِدٌ، أَلاَ لاَ فَضْلَ لِعَرَبِيٍّ عَلَى عَجَمِيٍّ، وَلاَ لِعَجَمِيٍّ عَلَى عَرَبِيٍّ، وَلاَ لِأَحْمَرَ عَلَى أَسْوَدَ، وَلاَ أَسْوَدَ عَلَى أَحْمَرَ، إِلاَّ بِالتَّقْوَى، إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللهِ أَتْقَاكُمْ، أَلاَ هَلْ بَلَّغْتُ؟ قَالُوا: بَلَى يَا رَسُولَ اللهِ، قَالَ: فَلْيُبَلِّغِ الشَّاهِدُ الْغَائِبَ- رواه البيهقى فى الشُّعَب و رواه أحمد-

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাদেরকে আইয়ামে তাশরীক্বের মধ্যবর্তী দিনে আমাদের উদ্দেশ্যে বিদায়ী ভাষণ দিয়ে বলেন, (৯) ‘হে জনগণ! নিশ্চয় তোমাদের পালনকর্তা মাত্র একজন। তোমাদের পিতাও মাত্র একজন। (১০) মনে রেখ! আরবের জন্য অনারবের উপর, অনারবের জন্য আরবের উপর, লালের জন্য কালোর উপর এবং কালোর জন্য লালের উপর কোনরূপ প্রাধান্য নেই আল্লাহভীরুতা ব্যতীত’। (১১) নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে আল্লাহর নিকট সর্বাধিক সম্মানিত সেই ব্যক্তি, যে তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক আল্লাহভীরু। তিনি বলেন, (১২) আমি কি তোমাদের নিকট পৌঁছে দিলাম? লোকেরা বলল, হ্যাঁ, হে আল্লাহর রাসূল! তিনি বললেন, অতএব উপস্থিতগণ যেন অনুপস্থিতদের নিকট পৌঁছে দেয়’।[1]

৬. আব্দুল্লাহ বিন ওমর (রাঃ) বলেন, এদিন রাসূল (ছাঃ) হামদ ও ছানার পর ‘দাজ্জাল’ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেন। অতঃপর বলেন,

مَا بَعَثَ اللهُ مِنْ نَبِيٍّ إِلاَّ قَدْ أَنْذَرَهُ أُمَّتَهُ، لَقَدْ أَنْذَرَهُ نُوحٌ وَالنَّبِيُّونَ مِنْ بَعْدِهِ، وَإِنَّهُ يَخْرُجُ فِيكُمْ، وَمَا خَفِيَ عَلَيْكُمْ مِنْ شَأْنِهِ، فَلاَ يَخْفَى عَلَيْكُمْ إِنَّهُ أَعْوَرُ عَيْنِ الْيُمْنَى كَأَنَّهَا عِنَبَةٌ طَافِيَةٌ ثُمَّ قَالَ: وَيْلَكُمْ أَوْ وَيْحَكُمْ انْظُرُوا لاَ تَرْجِعُوا بَعْدِي كُفَّارًا يَضْرِبُ بَعْضُكُمْ رِقَابَ بَعْضٍ-

(১৩) ‘আল্লাহ এমন কোন নবী প্রেরণ করেননি, যিনি তার উম্মতকে এ বিষয়ে সতর্ক করেননি। নূহ এবং তাঁর পরবর্তী নবীগণ তাদের স্ব স্ব উম্মতকে এ বিষয়ে সতর্ক করেছেন। সে তোমাদের মধ্যে বহির্গত হবে। তার অবস্থা তোমাদের নিকট গোপন থাকবে না। তার ডান চোখ হবে কানা, ফোলা আঙ্গুরের মত’...। অতঃপর তিনি বলেন, (১৪) তোমরা সাবধান থেকো। আমার পরে তোমরা একে অপরের গর্দান মেরে যেন পুনরায় কাফের হয়ে যেয়ো না’।[2] এর অর্থ খুনোখুনি মহাপাপে লিপ্ত হয়ো না। যা সবচেয়ে বড় পাপ। এর অর্থ প্রকৃত কাফের নয়। যা ইসলাম থেকে বের করে দেয়। যেমন অন্য হাদীছে এসেছে,سِبَابُ الْمُسْلِمِ فُسُوقٌ، وَقِتَالُهُ كُفْرٌ ‘মুসলিমকে গালি দেওয়া ফাসেক্বী এবং তাকে হত্যা করা কুফরী’ (বুখারী হা/৪৮)। দুর্ভাগ্য মুসলমানেরা রাসূল (ছাঃ)-এর এ নির্দেশ মানেনি।

৭. আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, বিদায় হজ্জের ভাষণে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,

يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنِّي قَدْ تَرَكْتُ فِيكُمْ مَا إِنِ اعْتَصَمْتُمْ بِهِ فَلَنْ تَضِلُّوا أَبَدًا كِتَابَ اللهِ وَسُنَّةَ نَبِيِّهِ-

(১৫) ‘হে জনগণ! আমি তোমাদের নিকট এমন বস্তু রেখে যাচ্ছি, যা মযবুতভাবে ধারণ করলে তোমরা কখনই পথভ্রষ্ট হবে না। আল্লাহর কিতাব ও তাঁর নবীর সুন্নাহ’ (হাকেম হা/৩১৮, হাদীছ ছহীহ)।

মালেক বিন আনাস (রহঃ) বলেন, তার নিকটে হাদীছ পৌঁছেছে যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,

عَنْ مَالِكٍ أَنَّهُ بَلَغَهُ أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ تَرَكْتُ فِيكُمْ أَمْرَيْنِ لَنْ تَضِلُّوا مَا تَمَسَّكْتُمْ بِهِمَا كِتَابَ اللهِ وَسُنَّةَ نَبِيِّهِ- رَواهُ فِي الْمُوَطَّأِ-

‘আমি তোমাদের মাঝে দু’টি বস্ত্ত রেখে যাচ্ছি। যতদিন তোমরা তা মযবুতভাবে আঁকড়ে থাকবে, ততদিন তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না। আল্লাহর কিতাব ও তাঁর নবীর সুন্নাহ’।[3]

এভাবে আরাফাতের ময়দানে ৬টি হাদীছে ১৬টি বিষয় এবং কুরবানীর দিন ও মিনার প্রথম দু’দিন সহ তিনদিনে উপরে বর্ণিত ৭টি হাদীছে ১৫টি বিষয় সহ সর্বমোট ১৩টি হাদীছে ৩১টি বিষয় বর্ণিত হয়েছে। যার প্রতিটি মানব জীবনে চিরন্তন দিক নির্দেশনা মূলক। যা মেনে চলা মানব জাতির জন্য একান্ত আবশ্যক।

[1]. বায়হাক্বী -শো‘আব হা/৫১৩৭; আহমাদ হা/২৩৫৩৬; ছহীহাহ হা/২৭০০।
[2]. আবু ইয়া‘লা হা/৫৫৮৬, সনদ ছহীহ; বুখারী, ফাৎহুল বারী হা/৪৪০২।
[3]. মুওয়াত্ত্বা হা/৩৩৩৮, তাহকীক : মুহাম্মাদ মুছত্বফা আল-আ‘যামী; মিশকাত হা/১৮৬, তাহকীক আলবানী, সনদ হাসান ; যুরক্বানী, শরহ মুওয়াত্ত্বা ক্রমিক ১৬১৪; মির‘আত হা/১৮৬-এর ব্যাখ্যা।

বিদায়ী ত্বাওয়াফ এবং মদীনায় রওয়ানা

১৩ই যিলহাজ্জ মঙ্গলবার কংকর মেরে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মিনা থেকে রওয়ানা হন। অতঃপর মিনা ও মক্কার মধ্যবর্তী তাঁর অবস্থানস্থল আবত্বাহ (الْأَبْطَحِ) গিয়ে অবতরণ করেন। যা বনু কেনানার প্রশস্ত মুহাছ্ছাব উপত্যকায় (الْمُحَصَّب) অবস্থিত। অতঃপর সেখানে তিনি সবাইকে নিয়ে যোহর, আছর, মাগরিব ও এশার ছালাত আদায় করেন। অতঃপর কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে তিনি কা‘বা অভিমুখে রওয়ানা হন ও বিদায়ী ত্বাওয়াফ শেষ করেন’।[1] মুহাছ্ছাব পাঁচটি নামে পরিচিত : খায়েফ, মুহাছ্ছাব, আবত্বাহ, হাছবা ও বাত্বহা’ (মির‘আত হা/২৬৮৮-এর আলোচনা)।

উল্লেখ্য যে, মুহাছ্ছাব হ’ল সেই উপত্যকার নাম, যেখানে বসে বনু কিনানাহ ও বনু কুরায়েশ বয়কট চুক্তি করেছিল এই মর্মে যে, যতক্ষণ না বনু হাশেম ও বনু মুত্ত্বালিব মুহাম্মাদকে তাদের হাতে তুলে দিবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের সাথে ওঠা-বসা, বিয়ে-শাদী ও ব্যবসা-বাণিজ্য সবই নিষিদ্ধ থাকবে’।[2] ইতিহাসে এটি সর্বাত্মক বয়কট চুক্তি (الْمُقَاطَعَةُ الْعَامَّةُ) নামে পরিচিত। যা তিন বছর স্থায়ী হয় (দ্রঃ সংশ্লিষ্ট অনুচ্ছেদ)।

[1]. বুখারী হা/১৭৫৬; মিশকাত হা/২৬৬৪।
[2]. বুখারী হা/১৫৯০; মুসলিম হা/১৩১৪।

আয়েশা (রাঃ)-এর ওমরাহ

মিনা থেকে ফিরে মুহাছ্ছাবে অবতরণের পর আয়েশা (রাঃ) রাসূল (ছাঃ)-কে বলেন, সবাই হজ্জ ও ওমরার নেকী নিয়ে ফিরবে, আর আমি কেবল হজ্জের নেকী নিয়ে ফিরব? তখন রাসূল (ছাঃ) আমাকে আমার ভাই আব্দুর রহমানের সাথে হারামের বাইরে তান‘ঈম পাঠিয়ে দিলেন। অতঃপর সেখান থেকে ওমরার ইহরাম বেঁধে এসে আমি ওমরাহ সম্পন্ন করি’। অতঃপর আমরা মুহাছ্ছাবে ফিরে আসি।[1] এসময় রাসূল (ছাঃ) বললেন, তোমরা কাজ শেষ করেছ? আমরা বললাম, হ্যাঁ। তখন তিনি সবাইকে রওয়ানা হওয়ার নির্দেশ দেন এবং ফজরের ছালাতের আগেই সকলে কা‘বায় গিয়ে বিদায়ী ত্বাওয়াফ সম্পন্ন করেন। অতঃপর সকলে মদীনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা করেন’।[2] তবে উম্মে সালামাহ (রাঃ)-এর বর্ণনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, হারামে ফজরের ছালাত আদায় করেই তাঁরা বেরিয়ে যান’।[3] উল্লেখ্য যে, ঋতুবতী হওয়ার কারণে আয়েশা (রাঃ) ওমরাহ করতে পারেননি। পাক হওয়ার পর মদীনায় ফেরার প্রাক্কালে সেটি আদায় করেন’।[4]

এর দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, মক্কাবাসীগণ হারাম এলাকার বাইরে যাবেন ও সেখান থেকে ওমরাহর ইহরাম বেঁধে আসবেন। এজন্য সবচেয়ে নিকটবর্তী হ’ল ৬ কি.মি. উত্তরে তান‘ঈম এলাকা। এটাই হ’ল জমহূর বিদ্বানগণের মত। মুহেববুদ্দীন ত্বাবারী বলেন, ওমরাহর জন্য মক্কাকে মীক্বাত গণ্য করেছেন, এমন কোন বিদ্বান সম্পর্কে আমি অবগত নই’।[5]

এভাবে হজ্জের সকল বিধি-বিধান পালন করার পর ১৪ই যিলহাজ্জ বুধবার হারামে ফজরের ছালাত আদায়ের পর রাসূল (ছাঃ) তাঁর ছাহাবীগণকে নিয়ে মদীনা অভিমুখে রওয়ানা হয়ে যান (যাদুল মা‘আদ ২/২৭৫)।

[1]. আহমাদ হা/২৬১৯৭, ১৪৯৮৫; বুখারী হা/৩১৯; মুসলিম হা/১২১১ (১১২); মিশকাত হা/২৫৫৬।
[2]. বুখারী হা/১৭৮৮; মুসলিম হা/১২১১ (১২৩); আবুদাঊদ হা/২০০৫; মিশকাত হা/২৬৬৭ হাদীছ ছহীহ।
[3]. বুখারী হা/১৬১৯; মুসলিম হা/১২৭৬; যাদুল মা‘আদ ২/২৭৫।
[4]. বুখারী হা/৩১৯; মুসলিম হা/১২১১; মিশকাত হা/২৫৫৬।
[5]. ফাৎহুল বারী হা/১৫২৪-এর আলোচনা দ্রষ্টব্য; সুবুলুস সালাম হা/৬৭৫-এর ব্যাখ্যা, যা গ্রহণযোগ্য নয় (২/৩৮৪-৮৫); মাসিক আত-তাহরীক, রাজশাহী, ১৭/৮ সংখ্যা, মে’১৪ প্রশ্নোত্তর ১/২৪১ দ্রষ্টব্য।

বহিরাগত হাজীগণ যারা ওমরাহ করে মক্কায় অবস্থান করেন, তাদের মধ্যে বারবার মক্কার বাইরে গিয়ে তানঈম অর্থাৎ মসজিদে আয়েশা থেকে ইহরাম বেঁধে এসে ভিন্ন ভিন্ন নামে বারবার ওমরাহ করা একটি বিদ‘আতী প্রথা মাত্র। আর এক সফরে একটির বেশী ওমরাহ করা যায় না। যেমন আব্দুর রহমান ওমরাহ করেননি (যাদুল মা‘আদ ২/৯০)। কেননা তিনি ওমরাহ করেছিলেন। কিন্তু আয়েশা ওমরাহ করেন। কেননা তিনি ইতিপূর্বে ওমরাহ করেননি।
 খুম কূয়ার নিকটে ভাষণ (خطبة غدير خمّ)
পথে রাবেগের নিকটবর্তী খুম কূয়ার নিকট পৌঁছে বুরাইদা আসলামী (রাঃ) রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে হযরত আলী (রাঃ) সম্পর্কে কিছু অভিযোগ পেশ করেন। যা ইয়ামনে গণীমত বণ্টন সংক্রান্ত বিষয়ে ছিল। এতে রাসূল (ছাঃ)-এর চেহারা পরিবর্তন হয়ে যায়। অতঃপর তিনি বলেন,يَا بُرَيْدَةُ، أَلَسْتُ أَوْلَى بِالْمُؤْمِنِينَ مِنْ أَنْفُسِهِمْ؟ ‘হে বুরাইদা! আমি কি মুমিনদের নিকট তাদের নিজের চাইতে অধিক ঘনিষ্টতর নই? বুরাইদা বললেন, হ্যাঁ। তখন রাসূল (ছাঃ) বলেন, مَنْ كُنْتُ مَوْلاَهُ فَعَلِىٌّ مَوْلاَهُ ‘আমি যার বন্ধু, আলী তার বন্ধু’।[1]

[1]. আহমাদ হা/২২৯৯৫; তিরমিযী হা/৩৭১৩; মিশকাত হা/৬০৮২; ছহীহাহ হা/১৭৫০।

মানছূরপুরী এখানে কোনরূপ সূত্র উল্লেখ ছাড়াই লিখেছেন যে, এই ভাষণ শ্রবণের পরে হযরত ওমর (রাঃ) আলী (রাঃ)-কে অভিনন্দন জানান এবং বুরাইদা (রাঃ) তার ভুল বুঝতে পেরে লজ্জিত হন। তিনি সারা জীবন হযরত আলীর প্রতি মহববত ও আনুগত্য বজায় রাখেন। অবশেষে তিনি ‘উটের যুদ্ধে’ নিহত হন (রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ১/২৪৩)। অথচ বুরাইদা আসলামী (রাঃ)-এর জীবনীতে এসবের কিছুই পাওয়া যায় না। তিনি ইয়াযীদ বিন মু‘আবিয়ার খিলাফতকালে (৬০-৬৪ হিঃ) যুদ্ধের উদ্দেশ্যে খোরাসান গমন করেন। অতঃপর সেখানেই মারভ নগরীতে মৃত্যুবরণ করেন (আল-ইছাবাহ ক্রমিক ৬৩২; আল-ইস্তী‘আব)।

রাসুলুল্লাহর (ছাঃ) মদীনায় প্রত্যাবর্তন

মক্কা থেকে দীর্ঘ সফর শেষে যুল-হুলায়ফাতে পৌঁছে রাত্রি যাপন করেন এবং পরদিন দিনের বেলায় তিনি মদীনায় প্রবেশ করেন। এ সময় খুশীতে তিনি তিনবার তাকবীর ধ্বনি করেন ও দো‘আ পাঠ করেন।لا إلَه إلا اللهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيكَ لَهُ لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ وَهُوَ عَلَى كُلّ شَيْءٍ قَدِيرٌ آيِبُونَ تَائِبُونَ عَابِدُونَ سَاجِدُونَ لِرَبّنَا حَامِدُونَ صَدَقَ اللهُ وَعْدَهُ وَنَصَرَ عَبْدَهُ وَهَزَمَ الْأَحْزَابَ وَحْدَهُ ‘আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। তিনি এক। তাঁর কোন শরীক নেই। তাঁরই জন্য সমস্ত রাজত্ব ও তাঁরই জন্য সমস্ত প্রশংসা এবং তিনিই সকল বস্ত্তর উপরে ক্ষমতাবান। আমরা সফর হ’তে প্রত্যাবর্তন করছি তওবাকারী হিসাবে, ইবাদতকারী হিসাবে, সিজদাকারী হিসাবে এবং আমাদের প্রভুর জন্য প্রশংসাকারী হিসাবে। আল্লাহ সত্যে পরিণত করেছেন তাঁর প্রতিশ্রুতিকে, জয়ী করেছেন তাঁর বান্দা (মুহাম্মাদ)-কে এবং পরাজিত করেছেন একাই সম্মিলিত (কুফরী) শক্তিকে’।[1]

এই হজ্জ ছিল রাসূল (ছাঃ)-এর জীবনের সর্বশেষ হজ্জ। সেকারণ একে ‘বিদায় হজ্জ’ বা ‘হাজ্জাতুল অদা‘(حَجَّةُ الْوَدَاعِ) বা ‘হাজ্জাতুল বিদা‘(حَجَّةُ الْوِدَاعِ) বলা হয় (মিরক্বাত হা/১৯৫১-এর ব্যাখ্যা)। এই সময় তিনি উম্মতের উদ্দেশ্যে সর্বশেষ উপদেশবাণী প্রদান করেন বিধায় একে ‘হাজ্জাতুল বালাগ’(حَجَّةُ الْبَلاَغِ) বলা হয়। সেই সাথে ইসলামী জীবনে রাসূল (ছাঃ)-এর একমাত্র হজ্জ হওয়ার কারণে এবং মানবজাতির জন্য ‘ইসলামকে একমাত্র দ্বীন’ হিসাবে আল্লাহর পক্ষ হ’তে মনোনীত হওয়ার কারণে ও ইসলামের পূর্ণাঙ্গতার সনদ নাযিল হওয়ার কারণে একে ‘হাজ্জাতুল ইসলাম’(حَجَّةُ الْإِسْلاَمِ) বলা হয় (আল-বিদায়াহ ৫/১০৯)।

[1]. যাদুল মা‘আদ ২/২৭৫-৭৬; বুখারী হা/১৭৯৭; মুসলিম হা/১৩৪৪ (৪২৮); মিশকাত হা/২৪২৫।

বিদায় হজ্জের মোট সফরকাল

২৪শে যুলক্বা‘দাহ শনিবার বাদ যোহর মদীনা থেকে রওয়ানা হন ও যুল-হুলায়ফাতে গিয়ে ক্বছরের সাথে আছর পড়েন এবং সেখানে রাত্রি যাপন করেন। ৩রা যিলহাজ্জ শনিবার সন্ধ্যার প্রাক্কালে মক্কার নিকটবর্তী ‘যূ-তুওয়া’(ذُو طُوَى) তে অবতরণ করেন ও সেখানে রাত্রি যাপন করেন। পরদিন ৪ঠা যিলহজ্জ রবিবার ৯ দিনের মাথায় মক্কায় পৌঁছেন।[1] অতঃপর ৯ই যিলহজ্জ শুক্রবার পবিত্র হজ্জ অনুষ্ঠিত হয়। তিনি মক্কায় মোট ১০ দিন অবস্থান করেন (বুখারী হা/১০৮১)। ১৪ই যিলহজ্জ বুধবার ফজর ছালাত শেষে মদীনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। অতঃপর সপ্তাহকাল সফর শেষে যুল-হুলায়ফাতে পৌঁছে রাত্রি যাপন করেন ও পরদিন মদীনায় পৌঁছেন (যাদুল মা‘আদ ২/২৭৫)। এভাবে গড়ে ৯ + ১০ + ৮ = ২৭ দিন সফরে অতিবাহিত হয়।

[1]. ইবনু সা‘দ বলেন, মদীনা থেকে রওয়ানা দেন যুলক্বা’দাহ মাসের পাঁচদিন বাকী থাকতে (অর্থাৎ ২৫শে যুলক্বা‘দাহ) শনিবার। অতঃপর মক্কার ৮ মাইল দূরবর্তী সারিফ (السَّرِف) নামক স্থানে সোমবার অবতরণ করেন এবং সেখানে রাত্রি যাপন করেন। পরদিন (মঙ্গলবার) তিনি মক্কায় প্রবেশ করেন (ইবনু সা‘দ ২/১৩১)। এতে মদীনা থেকে মক্কায় প্রবেশ পর্যন্ত মোট সফরকাল হয় ১১ দিন। সঠিক খবর আল্লাহ ভাল জানেন।

নবী জীবনের শেষ অধ্যায়

হজ্জ থেকে ফিরে যিলহজ্জের বাকী দিনগুলিসহ ১১ হিজরীর মুহাররম ও ছফর পুরা দু’মাস রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মদীনায় অবস্থান করেন।

বিদায় হজ্জের সময় আরাফাতের ময়দানে ইসলাম পরিপূর্ণ হওয়ার বিখ্যাত আয়াতটি (মায়েদাহ ৫/৩) নাযিল হয়। যা ছিল রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যুর ৮১ দিন পূর্বের ঘটনা। ইবনু ওমর (রাঃ) বলেন, অতঃপর আইয়ামে তাশরীক্বের মধ্যবর্তী দিনে মিনায় ‘সূরা নছর’ নাযিল হয়। মৃত্যুর ৫০দিন পূর্বে নাযিল হয় কালালাহর বিখ্যাত আয়াতটি (নিসা ৪/১৭৬)। অতঃপর মৃত্যুর ৩৫ দিন পূর্বে নাযিল হয় সূরা তওবার সর্বশেষ দু’টি আয়াত-

لَقَدْ جَاءَكُمْ رَسُوْلٌ مِّنْ أَنْفُسِكُمْ عَزِيْزٌ عَلَيْهِ مَا عَنِتُّمْ حَرِيْصٌ عَلَيْكُمْ بِالْمُؤْمِنِيْنَ رَؤُوْفٌ رَّحِيْمٌ، فَإِن تَوَلَّوْاْ فَقُلْ حَسْبِيَ اللهُ لاَ إِلَـهَ إِلاَّ هُوَ عَلَيْهِ تَوَكَّلْتُ وَهُوَ رَبُّ الْعَرْشِ الْعَظِيْمِ-

‘নিশ্চয় তোমাদের কাছে এসেছেন তোমাদের মধ্য থেকেই একজন রাসূল, তোমাদের দুঃখ-কষ্ট যার উপরে কষ্টদায়ক। তিনি তোমাদের মঙ্গলকামী, মুমিনদের প্রতি স্নেহশীল ও দয়ালু’। ‘এসত্ত্বেও যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে বলে দাও যে, আমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। তিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। তাঁর উপরেই আমি ভরসা করি। তিনি মহান আরশের অধিপতি’ (তওবা ৯/১২৮-১২৯)। অতঃপর মৃত্যুর ২১ দিন মতান্তরে ৭ দিন পূর্বে নাযিল হয় কুরআনের সর্বশেষ আয়াতটি-

وَاتَّقُواْ يَوْماً تُرْجَعُوْنَ فِيْهِ إِلَى اللهِ ثُمَّ تُوَفَّى كُلُّ نَفْسٍ مَّا كَسَبَتْ وَهُمْ لاَ يُظْلَمُوْنَ-

‘আর তোমরা ভয় কর সেই দিনকে, যেদিন তোমরা পুনরায় ফিরে যাবে আল্লাহর কাছে। অতঃপর প্রত্যেকেই তার কর্মফল পুরোপুরি পাবে। আর তাদের প্রতি কোনরূপ অবিচার করা হবে না’ (বাক্বারাহ ২/২৮১; কুরতুবী, তাফসীর সূরা নছর)।

রাসুলুল্লাহর (ছাঃ) বিদায়ের পূর্বলক্ষণ সমূহ

মূলতঃ সূরা নছর নাযিলের পরেই আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বুঝতে পারেন যে, সত্বর তাঁকে আখেরাতে পাড়ি দিতে হবে। তখন থেকেই যেন তার অদৃশ্য প্রস্ত্ততি শুরু হয়ে যায়। যেমন-

(১) আয়েশা (রাঃ) বলেন, সূরা নছর নাযিল হওয়ার পর থেকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এমন কোন ছালাত আদায় করেননি, যেখানে রুকূ ও সিজদায় নিম্নের দো‘আটি পাঠ করতেন না।سُبْحَانَكَ اللَّهُمَّ رَبَّنَا وَبِحَمْدِكَ اللَّهُمَّ اغْفِرْلِىْ ‘মহাপবিত্র তুমি হে আল্লাহ! আমাদের পালনকর্তা! তোমার জন্যই সকল প্রশংসা। হে আল্লাহ! তুমি আমাকে ক্ষমা কর’।[1]

ইমাম কুরতুবী বলেন,وقيل: الاستغفارُ تَعَبُّدٌ يَجِبُ إتْيَانَهُ، لاَ لِلْمَغْفِرَةِ، بَلْ تَعَبُّدًا ‘ক্ষমা প্রার্থনা হ’ল দাসত্ব প্রকাশ করা, যা আল্লাহর নিকটে পেশ করা ওয়াজিব। এটি ক্ষমার জন্য নয় বরং অধিক দাসত্ব প্রকাশের জন্য’ (কুরতুবী, তাফসীর সূরা নছর)।[2]

(২) অন্যান্য বছর রামাযানের শেষে দশদিন ই‘তিকাফে থাকলেও ১০ম হিজরীর রামাযানে তিনি ২০ দিন ই‘তিকাফে থাকেন।[3]

(৩) অন্যান্য বছর জিব্রীল (আঃ) রামাযানে একবার সমস্ত কুরআন পেশ করলেও এ বছর সেটা দু’বার করেন। এর কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি প্রিয় কন্যা ফাতেমাকে বলেন, আমার মৃত্যু খুব নিকটে মনে হচ্ছে’।[4]

(৪) ১০ম হিজরীতে বিদায় হজ্জের ভাষণের শুরুতেই তিনি বলেছিলেন, ‘আল্লাহর কসম! আমি জানি না এ বছরের পর এই স্থানে তোমাদের সঙ্গে আর মিলিত হ’তে পারব কি-না’ (নাসাঈ হা/৩০৬২)।

(৫) পরদিন মিনায় কুরবানীর দিনের ভাষণে জামরা আক্বাবায়ে কুবরায় তিনি বলেন, ‘আমার নিকট থেকে তোমরা হজ্জ ও কুরবানীর(خُذُوا عَنِّى مَنَاسِكَكُمْ) নিয়ম-কানূনগুলি শিখে নাও। কারণ এ বছরের পর হয়তবা আমার পক্ষে আর হজ্জ করা সম্ভব হবে না।[5]

(৬) মৃত্যু সন্নিকটে বুঝতে পেরে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একদিন ওহোদ প্রান্তে ‘শোহাদা কবরস্থানে’ গমন করেন এবং তাদের জন্য এমনভাবে দো‘আ করেন যেন তিনি জীবিত ও মৃত সকলের নিকট থেকে চির বিদায় গ্রহণ করছেন। রাবী ওক্ববা বিন ‘আমের (রাঃ) বলেন, আট বছর পরে রাসূল (ছাঃ) এই যিয়ারত করেন মৃতদের নিকট থেকে জীবিতদের বিদায় গ্রহণকারীর ন্যায়(كَالْمُوَدِّعِ لِلأَحْيَاءِ وَالأَمْوَاتِ)।[6]

(৭) শোহাদা কবরস্থান যিয়ারত শেষে মদীনায় ফিরে তিনি মসজিদে নববীর মিম্বরে বসে সমবেত জনগণের উদ্দেশ্যে বলেন,

إِنِّى فَرَطٌ لَكُمْ، وَأَنَا شَهِيدٌ عَلَيْكُمْ، إنَّ مَوْعِدَكُمُ الْحَوْضُ وَإِنِّىْ وَاللهِ لأَنْظُرُ إِلَى حَوْضِى الآنَ، وَإِنِّىْ أُعْطِيْتُ مَفَاتِيْحَ خَزَائِنِ الأَرْضِ، أَوْ مَفَاتِيْحَ الأَرْضِ، وَإِنِّىْ وَاللهِ مَا أَخَافُ عَلَيْكُمْ أَنْ تُشْرِكُوْا بَعْدِى، وَلَكِنِّى أَخَافُ عَلَيْكُمْ أَنْ تَنَافَسُوْا فِيْهَا وزاد بعضهم: فَتَقْتَتَلُوْا فَتُهْلِكُوْا كَمَا هَلَكَ مَنْ كَانَ قَبلَكُمْ

‘আমি তোমাদের আগেই চলে যাচ্ছি এবং আমি তোমাদের উপরে সাক্ষ্য দানকারী হব। তোমাদের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হবে হাউয কাওছারে। আমি এখুনি আমার ‘হাউয কাওছার’ দেখতে পাচ্ছি। আমাকে পৃথিবীর সম্পদরাজির চাবিসমূহ প্রদান করা হয়েছে। আল্লাহর কসম! আমার এ ভয় নেই যে, আমার পরে তোমরা শিরকে লিপ্ত হবে। কিন্তু আমার আশংকা হয় যে, তোমরা দুনিয়া অর্জনে পরস্পরে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হবে’। অন্য বর্ণনায় এসেছে, অতঃপর তোমরা পরস্পরে লড়াই করবে এবং ধ্বংস হয়ে যাবে, যেমন তোমাদের পূর্বের লোকেরা ধ্বংস হয়ে গেছে’।[7]

[1]. বুখারী হা/৭৯৪, মুসলিম/৪৮৪; মিশকাত হা/৮৭১; কুরতুবী হা/৬৫০৭।
[2]. উক্ত আয়াতের তাফসীরে অনেক মুফাসসির রাসূল (ছাঃ)-কে তাঁর রিসালাতের দায়িত্ব পালনে ‘ভুল-ত্রুটি ও কমতি করার’ কারণে আল্লাহ ক্ষমা চাইতে বলেছেন মর্মে তাফসীর করেছেন। যা ঠিক নয়। কেননা এটি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের আক্বীদা বিরোধী। নিঃসন্দেহে রিসালাতের দায়িত্ব পালনে রাসূল (ছাঃ) কোনরূপ কমতি করেননি এবং ইসলাম পরিপূর্ণতা লাভ করেছে (মায়েদাহ ৫/৩)। তাছাড়া বিদ্বানগণ এ বিষয়ে একমত যে, সকল নবীই নিষ্পাপ ছিলেন। আর শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) নবী হওয়ার আগে ও পরে যাবতীয় কুফরী থেকে এবং অহী প্রাপ্তির পরে কবীরা গোনাহের সংকল্প থেকেও নিষ্পাপ ছিলেন। আল্লাহ তাঁর আগে-পিছের সকল গোনাহ মাফ করে দিয়েছেন (বুখারী হা/৭৪১০)। তাই তিনি ছিলেন আল্লাহর মনোনীত নিষ্পাপ রাসূল (ড. আকরাম যিয়া উমারী, সীরাহ নববিইয়াহ ছহীহাহ ১/১১৪-১৭)। আর নবুঅতের দায়িত্ব পালনে ভুল-ত্রুটি ও কমতি করার প্রশ্নই উঠে না। কেননা আল্লাহ স্বীয় রাসূলকে এ বিষয়ে বিশেষভাবে নির্দেশ দিয়ে বলেন, فَاسْتَقِمْ كَمَا أُمِرْتَ وَمَنْ تَابَ مَعَكَ وَلاَ تَطْغَوْا إِنَّهُ بِمَا تَعْمَلُوْنَ بَصِيْرٌ- ‘তোমাকে যেভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, সেভাবে দৃঢ় থাক এবং যারা তোমার সঙ্গে তওবা করেছে তারাও। (কোন অবস্থায়) সীমালংঘন করো না। নিশ্চয়ই তিনি সবকিছু দেখেন যা তোমরা করো’ (হূদ ১১/১১২)। অতএব তাঁর পক্ষ থেকে রিসালাতের দায়িত্ব পালনে ‘ভুল-ত্রুটি হওয়া এবং তাতে কমতি করার’ কোন অবকাশ ছিল না।

মূলতঃ রিসালাতের দায়িত্ব পালনকে সাধারণ মানুষের দায়িত্ব পালনের সাথে তুলনা করাটাই হ’ল মারাত্মক ভ্রান্তি। আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করুন! বস্ত্ততঃ অন্যান্য নবীগণ ও শেষনবী (ছাঃ)-এর ‘ক্ষমা প্রার্থনা’ অর্থ আল্লাহর নিকট নিজেদের হীনতা প্রকাশ করা। নবুঅতের দায়িত্ব পালনে ভুল-ত্রুটি বা কমতি করার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা নয়।

[3]. বুখারী হা/৪৯৯৮; মিশকাত হা/২০৯৯।
[4]. বুখারী হা/৬২৮৫; মুসলিম হা/২৪৫০; মিশকাত হা/৬১২৯।
[5]. নাসাঈ হা/৩০৬২; মুসলিম হা/১২৯৭ (৩১০); মিশকাত হা/২৬১৮।
[6]. বুখারী হা/৪০৪২; মুসলিম হা/২২৯৬; মিশকাত হা/৫৯৫৮। হাদীছের বর্ণনায় ৮ বছর বলা হ’লেও মূলতঃ তা ছিল সোয়া ৭ বছরের কম (ফাৎহুল বারী হা/১৩৪৪-এর আলোচনা)। কেননা ওহোদ যুদ্ধ হয়েছিল ৩য় হিজরীর ৭ই শাওয়াল এবং রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যু হয়েছিল ১১ হিজরীর ১লা রবীউল আউয়াল। আর মৃত্যুর কিছুদিন আগে তিনি উক্ত যিয়ারতে গিয়েছিলেন।

(১) মুবারকপুরী ১১ হিজরীর ছফর মাসের প্রথম দিকে উক্ত যিয়ারত হয়েছিল বলেছেন (আর-রাহীক্ব ৪৬৪ পৃঃ)। অথচ এর কোন প্রমাণ নেই। এ বিষয়ে ইবনু কাছীর বলেন, كَانَ فِيْ مَرْضِ مَوْتِهِ هَذَا ‘এটি হয়েছিল তাঁর মৃত্যু রোগের সময়ে’ (আল-বিদায়াহ ৬/১৮৯)। সীরাহ হালাবিইয়ার লেখক বলেন, حِيْنَ عَلِمَ قُرْبَ أَجَلِهِ ‘যখন তিনি তাঁর মৃত্যু আসন্ন বুঝতে পারলেন’ (সীরাহ হালাবিইয়াহ ২/৩৩৮)।

(২) এখানে মুবারকপুরী আরও বলেন যে, রাসূল (ছাঃ) একদিন মধ্যরাতে বাক্বী‘ গোরস্থানে গমন করেন। অতঃপর তাদেরকে সালাম দেন ও তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন। সবশেষে তিনি তাদেরকে সুসংবাদ দিয়ে বলেন, إِنَّا بِكُمْ لَلاَحِقُونَ ‘আমরা অবশ্যই তোমাদের সাথে সত্বর মিলিত হব’ (আর-রাহীক্ব ৪৬৪ পৃঃ)। বর্ণনাটি ‘যঈফ’ (যঈফাহ হা/৬৪৪৭; আর-রাহীক্ব, তা‘লীক্ব পৃঃ ১৮২)।

[7]. বুখারী ফাৎহুল বারী হা/৪০৪২-এর আলোচনা; মুসলিম হা/২২৯৬; মিশকাত হা/৫৯৫৮।



প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর ৬৭ পর্বের জীবনীর সকল পর্ব এখান থেকে পড়ুন-

পর্ব-০১   পর্ব-০২   পর্ব-০৩   পর্ব-০৪   পর্ব-০৫   পর্ব-০৬   পর্ব-০৭   পর্ব-০৮   পর্ব-০৯   পর্ব-১০   পর্ব-১১   পর্ব-১২   পর্ব-১৩   পর্ব-১৪   পর্ব-১৫   পর্ব-১৬   পর্ব-১৭   পর্ব-১৮   পর্ব-১৯   পর্ব-২০   পর্ব-২১   পর্ব-২২   পর্ব-২৩   পর্ব-২৪   পর্ব-২৫   পর্ব-২৬   পর্ব-২৭   পর্ব-২৮   পর্ব-২৯   পর্ব-৩০    পর্ব-৩১   পর্ব-৩২   পর্ব-৩৩   পর্ব-৩৪   পর্ব-৩৫   পর্ব-৩৬   পর্ব-৩৭   পর্ব-৩৮   পর্ব-৩৯   পর্ব-৪০   পর্ব-৪১   পর্ব-৪২   পর্ব-৪৩   পর্ব-৪৪   পর্ব-৪৫   পর্ব-৪৬(১ম) পর্ব-৪৬(২য়)    পর্ব-৪৭   পর্ব-৪৮   পর্ব-৪৯   পর্ব-৫০   পর্ব-৫১   পর্ব-৫২   পর্ব-৫৩   পর্ব-৫৪   পর্ব-৫৫   পর্ব-৫৬   পর্ব-৫৭   পর্ব-৫৮   পর্ব-৫৯   পর্ব-৬০   পর্ব-৬১   পর্ব-৬২   পর্ব-৬৩   পর্ব-৬৪   পর্ব-৬৫   পর্ব-৬৬   পর্ব-৬৭  



******************************************
>>> Welcome, You are now on Mohammadia Foundation's Website. Please stay & Tune with us>>>


এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url