প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর জীবনী [পর্ব-১৭]





তায়েফ থেকে প্রত্যাবর্তন এবং আয়েশা (রা:)এর সাথে বিবাহ বন্ধন

জিনদের ইসলাম গ্রহণ

১০ম নববী বর্ষে ত্বায়েফ সফর থেকে ফেরার পথে
ত্বায়েফ থেকে ফেরার পথে জিনেরা কুরআন শুনে ইসলাম কবুল করে। জিনেরা দু’বার রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট আসে। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, ১০ম নববী বর্ষে ত্বায়েফ সফর থেকে ফেরার পথে তিনি ওকায বাজারের দিকে যাত্রাকালে নাখলা উপত্যকায় ফজরের ছালাতে কুরআন পাঠ করছিলেন। তখন জিনেরা সেই কুরআন শুনে ইসলাম কবুল করল এবং তাদের জাতির কাছে ফিরে এসে বলল, হে আমাদের জাতি! إِنَّا سَمِعْنَا قُرْآنًا عَجَبًا يَهْدِى إِلَى الرُّشْدِ فَآمَنَّا بِهِ، وَلَنْ نُشْرِكَ بِرَبِّنَا أَحَدًا ‘আমরা এক বিস্ময়কর কুরআন শুনেছি, যা সঠিক পথ প্রদর্শন করে। ফলে আমরা তাতে বিশ্বাস স্থাপন করেছি। আমরা কখনো আমাদের পালনকর্তার সাথে কাউকে শরীক করব না’ (জিন ৭২/১-২)।[1]

দ্বিতীয় বারের বিষয়ে ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন, ‘আমরা সবাই মক্কার বাইরে রাত্রিকালে রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে ছিলাম। কিন্তু এক সময় তিনি হারিয়ে গেলেন। আমরা ভয় পেলাম তাঁকে জিনে উড়িয়ে নিয়ে গেল, নাকি কেউ অপহরণ করল। আমরা চারদিকে খুঁজতে থাকলাম। কিন্তু না পেয়ে গভীর দুশ্চিন্তায় রাত কাটালাম। রাতটি ছিল আমাদের জন্য খুবই ‘মন্দ রাত্রি’ (شَرُّ لَيْلَة)। সকালে তাঁকে আমরা হেরা পাহাড়ের দিক থেকে আসতে দেখলাম। অতঃপর তিনি আমাদের বললেন, জিনদের একজন প্রতিনিধি আমাকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল। আমি গিয়ে তাদেরকে কুরআন শুনালাম’। অতঃপর তিনি আমাদেরকে সাথে করে নিয়ে গেলেন এবং জিনদের নমুনা ও তাদের আগুনের চিহ্নসমূহ দেখালেন। অতঃপর বললেন, তোমরা শুকনা হাড্ডি ও গোবর ইস্তিঞ্জাকালে ব্যবহার করো না। এগুলি তোমাদের ভাই জিনদের খাদ্য’ (মুসলিম হা/৪৫০)। উল্লেখ্য যে, ইবনু মাসঊদ কর্তৃক আবুদাঊদে বর্ণিত হাদীছে কয়লার কথাও বলা হয়েছে (আবুদাঊদ হা/৩৯)।

ত্বায়েফ সফরের ঘটনাবলীতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হৃদয়ে প্রশান্তি অনুভব করলেন এবং সব দুঃখ-কষ্ট ভুলে গিয়ে পুনরায় পথ চলতে শুরু করলেন। অতঃপর ‘নাখলা’ উপত্যকায় পৌঁছে সেখানকার জনপদে কয়েকদিন অবস্থান করলেন। এখানেই জিনদের প্রথম ইসলাম গ্রহণের ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটে। যা সূরা আহক্বাফ ২৯, ৩০ ও ৩১ আয়াতে এবং সূরা জিন ১-১৫ আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। তবে জিনদের কুরআন শ্রবণ ও ইসলাম গ্রহণের কথা তিনি তখনই জানতে পারেননি। বরং পরে সূরা জিন নাযিলের পর জানতে পারেন। অতঃপর সূরা আহক্বাফ ৩২ আয়াত নাযিল করে আল্লাহ তাকে নিশ্চিত করেছিলেন যে, কোন শক্তিই তার দাওয়াতকে বন্ধ করতে পারবে না। যেখানে আল্লাহ বলেন, وَمَن لاَّ يُجِبْ دَاعِيَ اللهِ فَلَيْسَ بِمُعْجِزٍ فِي الْأَرْضِ وَلَيْسَ لَهُ مِنْ دُوْنِهِ أَوْلِيَاءَ أُوْلَئِكَ فِيْ ضَلاَلٍ مُّبِيْنٍ ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে আহবানকারীর ডাকে সাড়া দেয় না, সে ব্যক্তি এ পৃথিবীতে আল্লাহকে পরাজিত করতে পারবে না এবং আল্লাহ ব্যতীত সে কাউকে সাহায্যকারীও পাবে না। বস্ত্ততঃ তারাই হ’ল স্পষ্ট ভ্রান্তির মধ্যে নিপতিত’ (আহক্বাফ ৪৬/৩২)। এতে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) মনের মধ্যে আরও শক্তি অনুভব করেন।

নাখলা উপত্যকায় ফজরের ছালাতে রাসূল (ছাঃ)-এর কুরআন পাঠ শুনে নাছীবাইন (نصيبين) এলাকার নেতৃস্থানীয় জিনদের ৭ বা ৯জনের অনুসন্ধানী দলটি তাদের সম্প্রদায়ের নিকটে গিয়ে যে রিপোর্ট দেয়, সেখানে বক্তব্যের শুরুতে তারা কুরআনের অলৌকিকত্বের কথা বলে। যেমন إِنَّا سَمِعْنَا قُرْآناً عَجَباً- يَهْدِيْ إِلَى الرُّشْدِ فَآمَنَّا بِهِ وَلَن نُّشْرِكَ بِرَبِّنَا أَحَداً ‘আমরা বিস্ময়কর কুরআন শুনেছি’। ‘যা সঠিক পথ প্রদর্শন করে। অতঃপর আমরা তার উপরে ঈমান এনেছি এবং আমরা আমাদের পালনকর্তার সাথে কাউকে কখনোই শরীক করব না’ (জিন ৭২/১-২)। অতঃপর তারা বলে, وَأَنَّا ظَنَنَّا أَنْ لَّنْ نُّعْجِزَ اللهَ فِي الْأَرْضِ وَلَن نُّعْجِزَهُ هَرَبًا ‘আমরা নিশ্চিত যে, পৃথিবীতে আমরা আল্লাহকে পরাজিত করতে পারব না এবং তাঁর থেকে পালিয়েও বাঁচতে পারব না’ (জিন ৭২/১২)। সুহায়লী তাফসীরবিদগণের বরাতে বলেন, এই জিনগুলি ইহূদী ছিল। অতঃপর মুসলমান হয়’। এদের বক্তব্য এসেছে সূরা আহক্বাফ ২৯, ৩০ ও ৩১ আয়াতে’।[2]

উপরোক্ত ঘটনায় প্রমাণিত হয় যে, শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) জিন ও ইনসানের নবী ছিলেন। বরং তিনি সকল সৃষ্ট জীবের নবী ছিলেন। যেমন তিনি বলেন, وَأُرْسِلْتُ إِلَى الْخَلْقِ كَافَّةً، وَخُتِمَ بِيَ النَّبِيُّوْنَ ‘আমি সকল সৃষ্ট জীবের প্রতি প্রেরিত হয়েছি এবং আমাকে দিয়ে নবীদের সিলসিলা সমাপ্ত করা হয়েছে’।[3] অন্য হাদীছে সূরা সাবা ২৮ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, فَأَرْسَلَهُ إِلَى الْجِنِّ وَالْإِنْسِ ‘অতঃপর আল্লাহ তাকে জিন ও ইনসানের প্রতি প্রেরণ করেছেন’।[4]

[1]. ইবনু হিশাম ১/৪২১-২২; বুখারী ফাৎহসহ হা/৪৯২১; মুসলিম হা/৪৪৯।
[2]. কুরতুবী, তাফসীর সূরা আহক্বাফ ২৯, হা/৫৫০৪-০৫; ইবনু কাছীর, তাফসীর উক্ত আয়াত; মুসলিম হা/৪৪৯; ইবনু হিশাম ১/৪২২; আর-রউযুল উনুফ ১/৩৫৪।
[3]. মুসলিম হা/৫২৩; মিশকাত হা/৫৭৪৮ ‘ফাযায়েল ও শামায়েল’ অধ্যায় ১ অনুচ্ছেদ।
[4]. দারেমী হা/৪৬; মিশকাত হা/৫৭৭৩ সনদ ছহীহ ‘ফাযায়েল ও শামায়েল’ অধ্যায় ১ অনুচ্ছেদ।

ত্বায়েফ থেকে মক্কায় প্রত্যাবর্তন

ক্বারনুল মানাযিলে মালাকুল জিবালের আগমন ও তার বক্তব্যে রাসূল (ছাঃ)-এর মন থেকে ত্বায়েফের সকল দুঃখ-বেদনা মুছে যায়। তিনি পুনরায় মক্কায় ফিরে গিয়ে পূর্ণোদ্যমে দাওয়াতের কাজ শুরু করার সংকল্প করলেন। তখন যায়েদ বিন হারেছাহ (রাঃ) বললেন, كَيْفَ تَدْخُلُ عَلَيْهِمْ وَقَدْ أَخْرَجُوك؟ ‘যে মক্কাবাসীরা আপনাকে বের করে দিয়েছে, সেখানে আপনি কিভাবে প্রবেশ করবেন? জওয়াবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, يَا زَيْدُ إنَّ اللهَ جَاعِلٌ لِمَا تَرَى فَرْجًا وَمَخْرَجًا وَإِنَّ اللهَ نَاصِرٌ دِينَهُ وَمُظْهِرٌ نَبِيَّهُ ‘হে যায়েদ! তুমি যে অবস্থা দেখছ, নিশ্চয়ই আল্লাহ এ থেকে পরিত্রাণের একটা পথ বের করে দেবেন এবং নিশ্চয়ই আল্লাহ তার দ্বীনকে সাহায্য করবেন ও তার নবীকে বিজয়ী করবেন’।[1]

কুরায়েশদের নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে ত্বায়েফের ছাক্বীফ গোত্রের নিকটে সাহায্য প্রার্থনা ও সেখানে দাওয়াতের নতুন কেন্দ্র স্থাপনের আশা নিয়ে রাসূল (ছাঃ) এ সফর করেছিলেন। কিন্তু তারা সে দাওয়াত কবুল করেনি। বরং সেখান থেকে চরম নির্যাতিত হয়ে তাঁকে ফিরতে হয়।

ত্বায়েফের দিনকে সর্বাধিক দুঃখময় দিন বলার কারণ সম্ভবতঃ এই ছিল যে, ওহোদের ঘটনায় দান্দান মুবারক শহীদ হ’লেও সেদিন তাঁর সাথী মুজাহিদ ছিলেন অনেক, যারা তাঁর দাওয়াত চালিয়ে নিতে পারতেন। কিন্তু ওহোদের ঘটনার প্রায় ছয় বছর পূর্বে ত্বায়েফের সেই মর্মান্তিক ঘটনার দিন তাঁর সাথী কেউ ছিল না যায়েদ বিন হারেছাহ ব্যতীত। অতএব ত্বায়েফের ঘটনা ওহোদের ঘটনার চাইতে নিঃসন্দেহে অধিক কষ্টদায়ক ও অধিক হৃদয় বিদারক ছিল।

অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নাখলা উপত্যকা হ’তে মক্কাভিমুখে রওয়ানা করে হেরা গুহার পাদদেশে পৌঁছে মক্কায় প্রবেশের জন্য কিছু হিতাকাংখীর নিকটে খবর পাঠালেন। কিন্তু কেউ ঝুঁকি নিতে চায়নি। অবশেষে মুত্ব‘ইম বিন ‘আদী রাযী হন এবং তার সম্মতিক্রমে যায়েদ বিন হারেছাহকে নিয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মক্কায় এসে মাসজিদুল হারামে প্রবেশ করেন ও হাজারে আসওয়াদ চুম্বন করেন। অতঃপর দু’রাক‘আত ছালাত আদায় করেন। এ সময় মুত্ব‘ইম ও তার পুত্র এবং কওমের লোকেরা সশস্ত্র অবস্থায় তাঁকে পাহারা দেন এবং পরে তাঁকে বাড়ীতে পৌঁছে দেন। আবু জাহল মুত্ব‘ইমকে প্রশ্ন করেন أمجير أو تَابِعٌ؟ ‘আশ্রয়দাতা না অনুসারী’? মুত্ব‘ইম জবাবে বলেন, بَلْ مُجِيرٌ ‘বরং আশ্রয়দাতা’। তখন আবু জাহল বলেন, قَدْ أَجَرْنَا مَنْ أَجَرْتَ ‘আমরাও তাকে আশ্রয় দিলাম, যাকে তুমি আশ্রয় দিয়েছ’। মূলতঃ এটি ছিল বংশীয় টান মাত্র। এভাবে মাসাধিককালের কষ্টকর সফর শেষে ১০ম নববী বর্ষের যুলক্বা‘দাহ মোতাবেক ৬১৯ খৃষ্টাব্দের জুলাই মাসের প্রথম দিকে তিনি মক্কায় ফিরে এলেন’।[2]

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মুত্ব‘ইম বিন ‘আদীর এই সৌজন্যের কথা কখনো ভুলেননি। এই ঘটনার প্রায় পাঁচ বছর পর সংঘটিত বদরের যুদ্ধে বন্দী কাফেরদের মুক্তির ব্যাপারে তিনি বলেন, لَوْ كَانَ الْمُطْعِمُ بْنُ عَدِىٍّ حَيًّا، ثُمَّ كَلَّمَنِى فِى هَؤُلاَءِ النَّتْنَى، لَتَرَكْتُهُمْ لَهُ ‘যদি মুত্ব‘ইম বিন ‘আদী বেঁচে থাকত এবং এইসব দুর্গন্ধময় মানুষগুলোর জন্য সুফারিশ করত, তাহ’লে তার খাতিরে আমি এদের সবাইকে ছেড়ে দিতাম’।[3] মুত্ব‘ইম বিন ‘আদী ৯০-এর অধিক বয়সে বদর যুদ্ধের পূর্বে মক্কায় মৃত্যুবরণ করেন (সিয়ারু আ‘লাম ৩/৯৮)।

[1]. আর-রাহীক্ব ১২৮ পৃঃ; যাদুল মা‘আদ ৩/৩০; ইবনু সা‘দ ১/১৬৫।
[2]. আর-রাহীক্ব ১২৯-৩০ পৃঃ; যাদুল মা‘আদ ৩/৩০; আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ৩/১৩৭।
[3]. বুখারী হা/৩১৩৯; মিশকাত হা/৩৯৬৫; ‘জিহাদ’ অধ্যায় ‘বন্দীদের হুকুম’ অনুচ্ছেদ-৫।

ত্বায়েফ সফরের ফলাফল

(১) ত্বায়েফের এই সফরের ফলে মক্কার বাইরে প্রথম ইসলামের দাওয়াত প্রসারিত হয়।

(২) প্রায় ৬০ মাইলের এই দীর্ঘ পথে যাতায়াতকালে পথিমধ্যেকার জনপদ সমূহে দাওয়াত পৌঁছানো হয়। এতে নেতারা দাওয়াত কবুল না করলেও গরীব ও মযলূম জনগোষ্ঠীর মধ্যে সাড়া জাগে। ত্বায়েফের আঙ্গুর বাগিচার মালিকের ক্রীতদাস ‘আদ্দাস-এর ব্যাকুল অভিব্যক্তি ভবিষ্যৎ সমাজ বিপ্লবের অন্তর্দাহ ছিল বৈ কি!

(৩) এই সফরে কোন বাহ্যিক ফলাফল দেখা না গেলেও মালাকুল জিবাল-এর আগমন এবং সফর শেষে মুত্ব‘ইম বিন ‘আদীর সহযোগিতায় নির্বিঘ্নে মক্কায় প্রবেশ ও সেখানে নিরাপদ অবস্থানের ফলে রাসূল (ছাঃ)-এর মধ্যে এ বিশ্বাস দৃঢ়তর হয় যে, আল্লাহ তাঁর এই দাওয়াতকে অবশ্যই বিজয়ী করবেন। ফলে তিনি দ্বিগুণ উৎসাহ লাভ করেন।
অতএব রাসূল (ছাঃ)-এর এ সফর ব্যর্থ হয়নি। বরং ভবিষ্যৎ বিজয়ের পথ সুগম করে।

শিক্ষণীয় বিষয়সমূহ
(১) যতবড় বিপদ আসুক তাতে ধৈর্য ধারণ করা এবং বাস্তবতার মুকাবিলা করা সংস্কারকের প্রধান কর্তব্য। কাছাকাছি সময়ে আবু তালেব ও খাদীজাকে পরপর হারিয়ে হত-বিহবল রাসূলকে স্বীয় কর্তব্যে অবিচল থাকার মধ্যে আমরা সেই শিক্ষা পাই।

(২) ইসলামের প্রসার ও নিরাপত্তার জন্য তাওহীদকে অক্ষুণ্ণ রেখে সম্ভাব্য সকল দুনিয়াবী উৎসের সন্ধান করা ও তার সাহায্য নেওয়া সিদ্ধ। ত্বায়েফবাসীদের নিকটে সাহায্যের জন্য গমনের মধ্যে সে বিষয়ে নির্দেশনা রয়েছে।

(৩) কঠিন বিপদে অসহায় অবস্থায় কেবলমাত্র আল্লাহর নিকটেই সাহায্য চাইতে হবে- এ বিষয়ে শিক্ষা রয়েছে তায়েফ থেকে ফেরার পথে রাসূল (ছাঃ)-এর সেই প্রসিদ্ধ দো‘আর মধ্যে।

(৪) বিরোধী পক্ষকে সবংশে নির্মূল করে দেবার মত শক্তি হাতে পেলেও তাদের ভবিষ্যৎ বংশধরগণের হেদায়াতের আশায় সংস্কারক ব্যক্তি তা থেকে বিরত থাকেন। মালাকুল জিবালের আবেদনে সাড়া না দিয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সেই উদারতার দৃষ্টান্ত দেখিয়েছেন। যদিও ব্যক্তিগতভাবে কোন দুশমনকে ধ্বংসের অভিশাপ দেওয়া যাবে। যেমন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) উৎবা-শায়বা-আবু জাহল প্রমুখকে দিয়েছিলেন এবং তা আল্লাহর পক্ষ হ’তে কার্যকর হয়েছিল।

(৫) আল্লাহর পথে সংস্কারকদের জন্য আল্লাহর গায়েবী মদদ হয়, তার বাস্তব প্রমাণ রাসূল (ছাঃ)-এর জীবনে দেখা গেছে তায়েফ থেকে ফেরার পথে ক্বারনুল মানাযিল নামক স্থানে ফেরেশতা অবতরণের মাধ্যমে এবং মক্কায় প্রবেশকালে মুত্ব‘ইম বিন ‘আদীর সহযোগিতার মাধ্যমে।

(৬) দুনিয়াবী জৌলুস যে মানুষকে অহংকারী করে ও হেদায়াত থেকে বঞ্চিত রাখে, তায়েফের নেতাদের উদ্ধত আচরণ এবং রাসূল (ছাঃ)-এর দীনহীন অবস্থার প্রতি কটাক্ষ করা, অতঃপর তাঁর পিছনে ছোকরাদের লেলিয়ে দেবার ঘটনার মধ্যে তার প্রমাণ মেলে।

হজ্জের মৌসুমে পুনরায় দাওয়াত

মাসাধিক কাল ত্বায়েফ সফর শেষে দশম নববী বর্ষের যুলক্বা‘দাহ মাসে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মক্কায় ফিরে আসেন। এখান থেকে মুহাররম মাসের শেষ পর্যন্ত একটানা তিনটি হারাম মাসের সুবর্ণ সুযোগকে তিনি পুরোপুরি কাজে লাগান এবং হজ্জে আগত দূরদেশী কাফেলা সমূহের তাঁবুতে গিয়ে গিয়ে তাওহীদের দাওয়াত দিতে থাকেন। যদিও কেউ তাঁর দাওয়াতে সাড়া দেয়নি।

বহিরাগতদের ইসলাম গ্রহণ

১১ নববী বর্ষ
এই বছর ভিন দেশের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ওমরাহ করার জন্য বা অন্য কোন উদ্দেশ্যে মক্কায় আসেন এবং শেষনবী আবির্ভাবের সংবাদ শুনে রাসূল (ছাঃ)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। যারা এ সময় ইসলাম কবুল করে ধন্য হন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন, ইয়াছরিবের আউস গোত্রের বিখ্যাত কবি ও উচ্চ সামাজিক মর্যাদার অধিকারী ও ‘কামিল’ লকবধারী সুওয়াইদ বিন ছামেত, একই গোত্রের ইয়াস বিন মু‘আয, ইয়াছরিবের বিখ্যাত ‘গেফার’ গোত্রের আবু যার গেফারী, ইয়ামনের যেমাদ আযদী প্রমুখ নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ’।[1] এই সকল ব্যক্তির মাধ্যমে তাদের স্ব স্ব এলাকায় ইসলামের বাণী দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং পরবর্তীতে দলে দলে লোক ইসলাম কবুল করে।

সুওয়াইদ বিন ছামেত এর ইসলাম গ্রহণ

১১ নববী বর্ষে ওমরার উদ্দেশ্যে মক্কায় আসেন এবং ইসলাম কবুল করেন। কিন্তু ফিরে যাওয়ার অব্যবহিত পরেই তিনি নিহত হন। সেকারণ তাঁর ইসলাম গ্রহণ সম্পর্কে কেউ কেউ সন্দেহ পোষণ করলেও ইবনু হাজার বলেন, যদি তাদের বক্তব্য সঠিক হ’ত, তবে তাঁকে ছাহাবীদের মধ্যে গণ্য করা হ’ত না (আল-ইছাবাহ, ক্রমিক ৩৮২২)।

ইয়াস বিন মু‘আয এর ইসলাম গ্রহণ

ইনি আবুল জালীস আনাস বিন রাফে‘ এবং বনু আব্দিল আশহালের কতিপয় যুবকের সাথে মক্কায় আসেন। আউস গোত্রের এ দলটি আগমনের উদ্দেশ্য ছিল খাযরাজ গোত্রের বিরুদ্ধে কুরায়েশদের মিত্রতা ও সহায়তা লাভ করা। তাদের আগমনের খবর পেয়ে রাসূল (ছাঃ) তাদের নিকট গিয়ে বললেন, আপনারা যে উদ্দেশ্যে এসেছেন তার চাইতে উত্তম বস্ত্ত গ্রহণ করবেন কি? তারা বলল, সেটা কি? তিনি বললেন, আমি আল্লাহর রাসূল। আল্লাহ তা‘আলা আমাকে তার বান্দাদের নিকটে এ উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেছেন যে, আমি যেন তাদেরকে দাওয়াত দেই এ মর্মে যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর এবং তার সাথে কাউকে শরীক করো না। তিনি আমার উপর কিতাব অবতীর্ণ করেছেন। অতঃপর তিনি তাদের নিকট ইসলাম সম্পর্কে আলোচনা করলেন এবং কুরআন তেলাওয়াত করে শুনালেন’। এসময় যুবক ইয়াস বিন মু‘আয বলে উঠলেন, হে আমার সাথীরা! আল্লাহর কসম আমরা যে উদ্দেশ্যে এসেছি এটাতো তার চেয়ে অনেক উত্তম। তখন আনাস বিন রাফে‘ এক মুষ্টি কংকর নিয়ে ইয়াসের মুখে মারল। তারপর রাসূল (ছাঃ) উঠে গেলেন এবং তারা ইয়াছরিবে ফিরে গেল। এর কিছুদিন পর ইয়াস মৃত্যুবরণ করেন। রাবী বলেন, মৃত্যুর সময় তিনি তাসবীহ, তাহলীল, তাকবীর ও তাহমীদে রত ছিলেন। সেকারণ ইসলামের উপর তার মৃত্যু হয়েছিল বলে অনেকে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন’ (আহমাদ হা/২৩৬৬৮, সনদ হাসান)।

আবূ যর গিফারী এর ইসলাম গ্রহণ

তাঁর ইসলাম কবুলের ঘটনা তাঁর যবানীতেই জানা যায়। তিনি বলেন, আমরা জানতে পারলাম যে, মক্কায় এক ব্যক্তি নিজেকে নবী বলে দাবী করছেন। আমি আমার ভাইকে বললাম, তুমি মক্কায় গিয়ে ঐ ব্যক্তির সাথে কথা বলে বিস্তারিত খোঁজ-খবর নিয়ে এস। সে রওয়ানা হয়ে গেল এবং মক্কায় তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ফিরে আসল। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, কি খবর নিয়ে এলে? সে বলল, আল্লাহর কসম! আমি এমন একজন ব্যক্তিকে দেখেছি যিনি সৎকাজের আদেশ দেন এবং অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করেন। আমি বললাম, তোমার খবরে আমি সন্তুষ্ট হ’তে পারলাম না। অতঃপর আমি একটি ছড়ি ও এক থলি খাবার নিয়ে মক্কায় রওয়ানা হ’লাম। কিন্তু সেখানে গিয়ে আমি তাকে চিনতেও পারলাম না বা কারু কাছে তার কথা জিজ্ঞেস করাও সমীচীন মনে করলাম না। তাই আমি যমযমের পানি পান করে মসজিদে থাকতে লাগলাম।

একদিন সন্ধ্যায় আলী (রাঃ) আমার নিকট দিয়ে গমনকালে আমার দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, মনে হয় লোকটি বিদেশী। আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি বললেন, আমার সঙ্গে আমার বাড়িতে চলুন। তখন আমি তার সাথে তার বাড়িতে চললাম। পথে তিনি আমাকে কোন কিছু জিজ্ঞেস করেননি। আমিও ইচ্ছা করে কিছু বলিনি। অতঃপর তাঁর বাড়িতে রাত্রি যাপন করে ভোরবেলায় আবার মসজিদে এলাম ঐ ব্যক্তির খোঁজ নেওয়ার জন্য। কিন্তু ওখানে এমন কোন লোক ছিল না যে ঐ ব্যক্তি সম্পর্কে কিছু বলবে। তিনি বলেন, ঐদিনও আলী (রাঃ) আমার নিকট দিয়ে চলার সময় বললেন, এখনো কি লোকটি তার গন্তব্যস্থল ঠিক করতে পারেনি? আমি বললাম, না। তিনি বললেন, আমার সঙ্গে চলুন। পথিমধ্যে তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, বলুন তো আপনার উদ্দেশ্য কি? কিজন্য এ শহরে এসেছেন? আমি বললাম, যদি আপনি আমার বিষয়টি গোপন রাখার আশ্বাস দেন, তাহ’লে তা আপনাকে বলতে পারি। তিনি বললেন, নিশ্চয়ই আমি গোপন রাখব। আমি বললাম, আমরা জানতে পেরেছি যে, এখানে একজন ব্যক্তির আবির্ভাব হয়েছে যিনি নিজেকে নবী বলে দাবী করেন। আমি তাঁর সঙ্গে কথা বলার জন্য আমার ভাইকে পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু সে ফিরে গিয়ে আমাকে সন্তোষজনক কিছু বলতে পারেনি। তাই নিজে দেখা করার ইচ্ছা নিয়ে এখানে এসেছি। আলী (রাঃ) বললেন, আপনি সঠিক পথপ্রদর্শক পেয়েছেন। আমি এখনই তাঁর কাছে যাওয়ার জন্য রওয়ানা হচ্ছি। আপনি আমাকে অনুসরণ করুন এবং আমি যে গৃহে প্রবেশ করব আপনিও সে গৃহে প্রবেশ করবেন। রাস্তায় যদি আপনার জন্য বিপজ্জনক কোন লোক দেখতে পাই, তাহ’লে আমি জুতা ঠিক করার অজুহাতে দেয়ালের পার্শ্বে সরে দাঁড়াব, যেন আমি জুতা ঠিক করছি। আর আপনি চলতেই থাকবেন। অতঃপর আলী (রাঃ) পথ চলতে শুরু করলেন। আমিও তাঁর অনুসরণ করে চলতে লাগলাম। তিনি নবী (ছাঃ)-এর নিকট প্রবেশ করলে আমিও তাঁর পিছে পিছে প্রবেশ করলাম। আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বললাম, আমার নিকট ইসলাম পেশ করুন। তিনি পেশ করলেন। ফলে আমি তৎক্ষণাৎ ইসলাম কবুল করলাম।

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, হে আবূ যর! এখনকার মত তোমার ইসলাম গোপন রেখে দেশে ফিরে যাও। অতঃপর যখন আমাদের বিজয়ের খবর জানতে পারবে তখন এসো। আমি বললাম, যে আল্লাহ আপনাকে সত্য সহ প্রেরণ করেছেন তাঁর শপথ করে বলছি, আমি কাফির-মুশরিকদের সামনে উচ্চৈঃস্বরে তাওহীদের বাণী ঘোষণা করব’।

রাবী ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, এ কথা বলে তিনি মাসজিদুল হারামে গমন করলেন। কুরাইশের লোকজন সেখানে উপস্থিত ছিল। তিনি বললেন, হে কুরায়েশগণ! আমি নিশ্চিতভাবে সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোন মা‘বূদ নেই এবং আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল’। এ কথা শুনেই কুরায়েশরা বলে উঠল, ধর এই ‘ছাবেঈ’ (ধর্মত্যাগী)-টাকে। তারা আমার দিকে তেড়ে এল এবং আমাকে এমন নির্দয়ভাবে প্রহার করতে লাগল, যেন আমি মরে যাই। তখন আববাস (রাঃ) আমার নিকট পৌঁছে আমাকে ঘিরে রাখলেন এবং কুরায়েশদের উদ্দেশ্যে বললেন, তোমাদের ধ্বংস হৌক! তোমরা গিফার গোত্রের লোককে হত্যা করতে উদ্যত হয়েছ? অথচ তোমাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের কাফেলা গিফার গোত্রের নিকট দিয়ে যাতায়াত করে থাকে? এ কথা শুনে তারা আমার থেকে সটকে পড়ল। পরদিন ভোরে কা‘বাগৃহে উপস্থিত হয়ে আগের দিনের মতই আমি আমার ইসলাম গ্রহণের কথা ঘোষণা দিলাম। কুরায়েশরা গতকালের মত আজও আমাকে মারধর করল। এ দিনও আববাস (রাঃ) এসে আমাকে রক্ষা করলেন এবং কুরায়েশদের উদ্দেশ্যে গতকালের মত বক্তব্য রাখলেন। রাবী ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, এটাই ছিল আবূ যর গেফারী (রাঃ)-এর ইসলাম গ্রহণের প্রথম ঘটনা’।[2] পরবর্তীতে বদর ও ওহোদ যুদ্ধ শেষে তিনি রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট আগমন করেন এবং মদীনায় থেকে যান (ইবনু সা‘দ ৪/১৬৮)। তিনি আছহাবে ছুফফাহ্র অন্তর্ভুক্ত হন (সীরাহ ছহীহাহ ১/২৬০)।

যেমাদ আযদী এর ইসলাম গ্রহণ

ইয়ামনের অধিবাসী যেমাদ আযদী ছিলেন ঝাড়-ফুঁকের মাধ্যমে জিন ছাড়ানো চিকিৎসক। মক্কাবাসীদের নিকট সবকিছু শুনে তিনি রাসূল (ছাঃ)-কে জিনে ধরা রোগী মনে করে তাঁর কাছে আসেন এবং বলেন, يَا مُحَمَّدُ إِنِّى أَرْقِى مِنْ هَذِهِ الرِّيحِ وَإِنَّ اللهَ يَشْفِى عَلَى يَدِى مَنْ شَاءَ فَهَلْ لَكَ؟ ‘হে মুহাম্মাদ! আমি এই ঝাড়-ফুঁকের মাধ্যমে চিকিৎসা করে থাকি। আল্লাহ আমার হাতে যাকে ইচ্ছা আরোগ্য দান করে থাকেন। অতএব আপনার কোন প্রয়োজন আছে কি?’ জবাবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে শুনিয়ে দেন খুৎবাতুল হাজতের সেই অমৃত বাণী সমূহ- যা প্রতিটি খুৎবা ও বক্তৃতার সূচনায় আবৃত্তি করা পরবর্তীতে সুন্নাতে পরিণত হয়। বক্তব্যটি ছিল নিম্নরূপ:

إِنَّ الْحَمْدَ لِلَّهِ نَحْمَدُهُ وَنَسْتَعِينُهُ مَنْ يَهْدِهِ اللهُ فَلاَ مُضِلَّ لَهُ وَمَنْ يُضْلِلْ فَلاَ هَادِىَ لَهُ وَأَشْهَدُ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيكَ لَهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ، أَمَّا بَعْدُ:

‘নিশ্চয়ই সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য। আমরা তাঁর প্রশংসা করি ও তাঁর নিকটে সাহায্য প্রার্থনা করি। আল্লাহ যাকে হেদায়াত দান করেন, তাকে পথভ্রষ্টকারী কেউ নেই। আর তিনি যাকে পথভ্রষ্ট করেন, তাকে হেদায়াতকারী কেউ নেই। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। তিনি এক তাঁর কোন শরীক নেই এবং মুহাম্মাদ তাঁর বান্দা ও তাঁর রাসূল’।

যেমাদ কথাগুলি শুনে গদগদ চিত্তে রাসূল (ছাঃ)-কে বারবার কথাগুলি বলতে অনুরোধ করেন। ফলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কথাগুলি তিনবার বলেন। অতঃপর যেমাদ বলে উঠলেন, لَقَدْ سَمِعْتُ قَوْلَ الْكَهَنَةِ وَقَوْلَ السَّحَرَةِ وَقَوْلَ الشُّعَرَاءِ فَمَا سَمِعْتُ مِثْلَ كَلِمَاتِكَ هَؤُلاَءِ وَلَقَدْ بَلَغْنَ نَاعُوسَ الْبَحْرِ هَاتِ يَدَكَ أُبَايِعْكَ عَلَى الإِسْلاَمِ فَبَايَعَهُ ‘আমি জ্যোতিষীদের, জাদুকরদের ও কবিদের কথা শুনেছি। কিন্তু আপনার উক্ত কথাগুলির মত কারুর কাছে শুনিনি। এগুলি সমুদ্রের গভীরে পৌঁছে গেছে। আপনি হাত বাড়িয়ে দিন! আমি আপনার নিকটে ইসলামের উপরে বায়‘আত করব’। অতঃপর তিনি বায়‘আত করেন।[3]

[1]. আর-রাহীক্ব ১৩১-৩৪ পৃঃ। এসময় দাউস গোত্রের নেতা ও কবি তুফায়েল বিন ‘আমর দাউসী ইসলাম গ্রহণের ঘটনাটি প্রসিদ্ধ রয়েছে (ইবনু হিশাম ১/৩৮২-৮৫, আর-রাহীক্ব ১৩১ পৃঃ)। বর্ণনাটি যঈফ (ঐ, তা‘লীক্ব ৯৩ পৃঃ)।
[2]. বুখারী হা/৩৫২২ ‘মানাক্বিব’ অধ্যায়, ‘আবূ যর গিফারীর ইসলাম গ্রহণের কাহিনী’ অনুচ্ছেদ-১১; মুসলিম হা/২৪৭৩-৭৪।
[3]. মুসলিম হা/৮৬৮; মিশকাত হা/৫৮৬০ ‘নবুঅতের নিদর্শন সমূহ’ অনুচ্ছেদ। নববী বলেন, মুসলিম ব্যতীত অন্যান্য হাদীছ গ্রন্থে نَاعُوسَ الْبَحْرِ এর বদলে قَامُوسُ البحر এসেছে (ঐ, শরহ নববী)। অর্থ একই।

(১) এখানে ইবনু ইসহাক বিনা সনদে আর একটি ঘটনা বর্ণনা করেছেন যে, হাবশায় ইসলামের খবর পৌঁছার পর সেখান থেকে ২০জন বা তার কিছু কম সংখ্যক খ্রিষ্টান মক্কায় আসেন। তারা এসে রাসূল (ছাঃ)-কে মাসজিদুল হারামে পেয়ে যান। অতঃপর তারা তাঁর সঙ্গে কথা বলেন ও বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন করেন। এ সময় কুরায়েশ-এর একদল লোক কা‘বাগৃহের চারপাশে ছিল। খ্রিষ্টান প্রতিনিধি দলটি যখন রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট থেকে তাওহীদের দাওয়াত পেল এবং কুরআন শুনল, তখন তাদের চোখ দিয়ে অবিরল ধারে অশ্রু প্রবাহিত হ’ল। অতঃপর তারা ঈমান আনল ও ইসলাম কবুল করল। অতঃপর তারা যখন বেরিয়ে এল তখন আবু জাহল তার দলবল নিয়ে তাদের পথ রোধ করল এবং বলল, خَيَّبَكُمْ اللهُ ‘আল্লাহ তোমাদেরকে নিরাশ করুন!’ তোমাদের লোকেরা তোমাদেরকে পাঠিয়েছে এই লোকটির খবরাখবর নিয়ে তাদেরকে জানানোর জন্য। অথচ তোমরা তোমাদের দ্বীন পরিত্যাগ করলে এবং এই ব্যক্তির উপরে বিশ্বাস স্থাপন করলে। তোমাদের চাইতে কোন আহাম্মক কাফেলা আমরা দেখিনি’(مَا نَعْلَمُ رَكْبًا أَحْمَقَ مِنْكُمْ)। জবাবে তারা বললেন, আপনাদের উপরে সালাম। আমরা আপনাদেরকে জাহিল বলছি না। আমাদের বিষয়টি আমাদের এবং আপনাদের বিষয়টি আপনাদের। আমরা আমাদের কোন কল্যাণ লাভ থেকে বিরত হব না’ (ইবনু হিশাম ১/৩৯১-৯২)। খবরটি যঈফ (তাহকীক ইবনু হিশাম ক্রমিক ৩৭৬)।

(২) ইবনু ইসহাক এখানে আর একটি ঘটনা বর্ণনা করেছেন যা খুবই প্রসিদ্ধ। যেমন রুকানাহ বিন ‘আব্দে ইয়াযীদ বিন হাশেম বিন আব্দুল মুত্ত্বালিব ছিলেন মক্কার একজন প্রসিদ্ধ বীর, যাকে কেউ কখনো কুস্তিতে হারাতে পারত না। একদিন মক্কার কোন গলিপথে নিরিবিলি সাক্ষাৎ হ’লে রাসূল (ছাঃ) তাকে ইসলামের দাওয়াত দেন এবং বলেন, আমি যদি তোমাকে হারাতে পারি, তাহ’লে কি তুমি ঈমান আনবে? তিনি বলেন, হ্যাঁ। অতঃপর তিনি তাকে দু’বার হারিয়ে দেন। পরে রাসূল (ছাঃ) তাকে বলেন, এর চাইতে বিস্ময়কর বস্ত্ত আমি তোমাকে দেখাতে পারি, যদি তুমি আল্লাহকে ভয় কর এবং আমার আনুগত্য কর। অতঃপর তিনি নিকটবর্তী একটি বৃক্ষকে আহবান করলেন। তখন বৃক্ষটি তাঁর নিকটে এল। অতঃপর তাঁর হুকুমে বৃক্ষটি তার আগের স্থানে ফিরে গেল। এটি দেখে রুকানাহ তার কওমের কাছে ফিরে গিয়ে বলল, হে বনু ‘আব্দে মানাফ! তোমাদের এই লোকটির মাধ্যমে তোমরা সারা বিশ্ববাসীকে জাদু করতে পারবে। আল্লাহর কসম! এই ব্যক্তির চাইতে বড় জাদুকর আমি কাউকে দেখিনি’ (ইবনু হিশাম ১/৩৯০-৯১)। বর্ণনাটির সনদ যঈফ (তাহকীক ইবনু হিশাম ক্রমিক ৩৭৫)।

হযরত আয়েশা (রাঃ)-এর সাথে বিবাহ

একাদশ নববী বর্ষের শাওয়াল মাসে অর্থাৎ হযরত সওদা বিনতে যাম‘আর সাথে বিয়ের ঠিক এক বছরের মাথায় ওছমান বিন মায‘ঊন (রাঃ)-এর স্ত্রী খাওলা বিনতে হাকীম (রাঃ)-এর প্রস্তাবক্রমে হযরত আবুবকরের নাবালিকা কন্যা আয়েশাকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বিবাহ করেন।[1] বিয়ের তিন বছর পরে সাবালিকা হ’লে নয় বছর বয়সে মদীনায় ১ম হিজরী সনের শাওয়াল মাসে তিনি নবীগৃহে গমন করেন।[2]

[1]. আহমাদ হা/২৫৮১০; হাকেম হা/২৭০৪, সনদ হাসান।
[2]. বুখারী হা/৩৮৯৬, মুসলিম হা/১৪২২, মিশকাত হা/৩১২৯।

আয়েশা (রা:) বয়স সংক্রান্ত সংশয় নিরসন
আয়েশা (রাঃ) এর বিবাহের সময়কার বয়স নিয়ে কেউ কেউ সন্দেহ প্রকাশ করে বলেছেন, ‘আরব দেশের ইতিহাসে ও সাহিত্যে এরূপ কোন ঘটনার কথা জানা যায় না। আরব দেশের কোন মেয়েই নয় বছর বয়সে সাবালিকা হয় না। সুতরাং নবীজী সম্বন্ধে এরূপ বলা মানে তাঁর চরিত্র হনন করা’। বস্তুতঃ তাঁদের এই দাবী অনৈতিহাসিক ও অযৌক্তিক বটে। কেননা এটাই স্বাভাবিক যে, গ্রীষ্ম প্রধান দেশের মেয়েরা শীত প্রধান দেশের তুলনায় আগেই সাবালিকা হয়। তারা রাবী হিশাম বিন উরওয়া বিন যুবায়ের সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। উরওয়া ছিলেন আয়েশা (রাঃ)-এর বোন আসমা (রাঃ)-এর পুত্র এবং খ্যাতনামা ছাহাবী আব্দুল্লাহ বিন যুবায়ের (রাঃ)-এর ছোট ভাই। খালা হওয়ার সুবাদে আয়েশা (রাঃ) সম্পর্কিত বহু বর্ণনা আমরা তাঁর মাধ্যমে পেয়েছি। অত্র বর্ণনায় সন্দেহ প্রকাশ করলে তাঁর অন্যান্য বর্ণনাও বাদ দিতে হবে। অথচ ইমাম বুখারী সহ কোন মুহাদ্দিছই এরূপ বলেননি। বরং উক্ত বিষয়ে ইমাম বুখারী বর্ণিত হাদীছটির ব্যাখ্যায় ইবনু হাজার আসক্বালানী বলেন, খাদীজার মৃত্যুর পর রাসূল (ছাঃ) আয়েশাকে বিবাহ করেন। যখন তাঁর বয়স ছিল ৬ বছর। অতঃপর তাঁর সাথে বাসর যাপন করেন মদীনায় আসার পর। যখন তাঁর বয়স ছিল ৯ বছর। আর এই বর্ণনায় কোনরূপ সন্দেহ নেই (وَهَذَا السِّيَاقُ لاَ إِشْكَالَ فِيهِ)।[1] অতএব কষ্ট কল্পনা বাদ দিয়ে ছহীহ হাদীছ সমূহের উপরে বিশ্বাস রাখাই মুমিনের কর্তব্য।

[1]. বিস্তারিত দ্রঃ ফাৎহুল বারী হা/৩৮৯৬-এর আলোচনা।

আক্বাবাহর বায়‘আত

১ম বায়‘আত, যিলহাজ্জ ১১ নববী বর্ষ
৬জন ইয়াছরেবী যুবকের ইসলাম গ্রহণ-
একাদশ নববী বর্ষের হজ্জের মওসুম (জুলাই ৬২০ খ্রিঃ)। দিনের বেলায় আবু লাহাব ও অন্যান্যদের পিছু লাগা ও পদে পদে অপদস্থ হবার ভয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) রাত্রির গভীরে দাওয়াতে বের হওয়ার মনস্থ করেন। সেমতে তিনি একরাতে আবুবকর ও আলীকে সাথে নিয়ে বহিরাগত বিভিন্ন হজ্জ কাফেলার লোকদের সঙ্গে তাদের তাঁবুতে বা বাইরে সাক্ষাৎ করে তাদেরকে তাওহীদের দাওয়াত দিতে থাকেন। এমন সময় তাঁরা মিনার আক্বাবাহ গিরিসংকটের আলো-অাঁধারীর মধ্যে কিছু লোকের কথাবার্তা শুনে তাদের দিকে এগিয়ে গেলেন। জিজ্ঞাসায় জানতে পারলেন যে, তারা ইয়াছরিব থেকে হজ্জে এসেছেন এবং তারা ইহূদীদের মিত্র খাযরাজ গোত্রের লোক। তারা ছিলেন সংখ্যায় ছয়জন এবং সকলেই ছিলেন তরতাযা তরুণ। তারা ছিলেন ইয়াছরিবের জ্ঞানী ও নেতৃস্থানীয় যুবকদের শীর্ষস্থানীয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদের মধ্যে বসে পড়লেন। অতঃপর তাওহীদের দাওয়াত দিলেন এবং কুরআনের কিছু আয়াত তেলাওয়াত করে শুনালেন। তারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করল। তারা ইতিপূর্বে ইহূদীদের নিকটে শুনেছিল যে, সত্বর আখেরী নবীর আবির্ভাব ঘটবে। তারা বলত, ... যামানা নিকটবর্তী হয়েছে। এখন একজন নবী আগমন করবেন, যার সাথে আমরা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব ‘আদ ও ইরাম জাতির ন্যায়’ (অর্থাৎ তোমাদের নিশ্চিহ্ন করে ফেলব)। তারা এভাবেই আমাদের হুমকি দিত।[1] ফলে ইনিই যে সেই নবী, এ ব্যাপারে তারা নিশ্চিত হয়ে তখনই ইসলাম কবুল করল।

অতঃপর তারা বলল, দু’বছর পূর্বে সমাপ্ত বু‘আছ যুদ্ধের ফলে ইয়াছরিববাসীগণ পর্যুদস্ত হয়ে গেছে। পারস্পরিক হানাহানি ও শত্রুতার ফলে তাদের সমাজে এখন অশান্তির আগুন জ্বলছে। অতএব এ অবস্থায় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যদি ইয়াছরিবে হিজরত করেন, তবে তাঁর আহবানে সেখানে শান্তি স্থাপিত হ’তে পারে এবং আউস ও খাযরাজ উভয় দল তাঁর নেতৃত্ব মেনে নিতে পারে। ফলে তাঁর চাইতে অধিকতর সম্মানিত ব্যক্তি সেখানে আর কেউ হবে না। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদের দাওয়াত শুনলেন এবং তাদেরকে ফিরে গিয়ে ইয়াছরিবের ঘরে ঘরে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছাতে বললেন (যাতে হিজরতের পরিবেশ সৃষ্টি হয়)।

উপরোক্ত সৌভাগ্যবান ৬ জন খাযরাজী যুবনেতা ছিলেন- আব্দুল মুত্ত্বালিবের মাতুল গোষ্ঠী বনু নাজ্জার গোত্রের আস‘আদ বিন যুরারাহ (أَسْعَدُ بْنُ زُرَارَةَ)। ইনি ছিলেন কনিষ্ঠতম। কিন্তু ইনিই ছিলেন তাদের নেতা।[2] (২) একই গোত্রের ‘আওফ বিন হারেছ বিন রেফা‘আহ (عَوْفُ بْنُ الْحَارِثِ بْنِ رِفَاعَةَ) (৩) বনু যুরায়েক্ব গোত্রের রাফে‘ বিন মালেক বিন আজলান (رَافِعُ بْنُ مَالِكِ بْنِ الْعَجْلاَنِ) (৪) বনু সালামাহ গোত্রের কুৎবা বিন ‘আমের বিন হাদীদাহ (قُطْبَةُ بْنُ عَامِرِ بْنِ حَدِيدَةَ) (৫) বনু হারাম গোত্রের ওক্ববা বিন ‘আমের বিন নাবী (عُقْبَةُ بْنُ عَامِرِ بْنِ نَابِيْ) (৬) বনু ওবায়েদ বিন গানাম গোত্রের জাবির বিন আব্দুল্লাহ বিন রিআব (جَابِرُ بْنُ عَبْدِ اللهِ ابْن رِئَابِ) (রাযিয়াল্লাহু ‘আনহুম)।[3]

উক্ত ৬ জন তরুণের দাওয়াতই মদীনায় হিজরতের বীজ বপন করে। যা মাত্র তিন বছরের মাথায় গিয়ে বাস্তব ফল দান করে। এটি স্রেফ ইসলাম কবুলের সাধারণ বায়‘আত ছিল। এতে কোন শর্ত বা কোন বিশেষ নির্দেশনা ছিলনা বিধায় জীবনীকারগণ এটিকে বায়‘আত হিসাবে গণনা করেননি। যদিও এটাই ছিল প্রথম বায়‘আত এবং পরবর্তী দু’টি বায়‘আতের ভিত্তি।

২য় বায়‘আত, যিলহাজ্জ ১২ নববী বর্ষ
১২ জনের ইসলাম গ্রহণ
গত বছর হজ্জের মওসুমে ইসলাম কবুলকারী ৬ জন যুবকের প্রচারের ফলে পরের বছর নতুন সাত জনকে নিয়ে মোট ১২ জন ব্যক্তি হজ্জে আসেন। গতবারের জাবের বিন আব্দুল্লাহ এবার আসেননি। দ্বাদশ নববী বর্ষের যিলহজ্জ মাসের (মোতাবেক জুলাই ৬২১ খৃঃ) এক গভীর রাতে মিনার পূর্ব নির্ধারিত আক্বাবাহ নামক স্থানে তারা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে সাক্ষাৎ করেন। এই স্থানটিকে এখন জামরায়ে আক্বাবাহ বা বড় জামরাহ বলা হয়। মিনার পশ্চিম দিকের এই সংকীর্ণ পাহাড়ী পথ দিয়ে মক্কা থেকে মিনায় যাতায়াত করতে হ’ত। এই সংকীর্ণ সুড়ঙ্গ পথকেই ‘আক্বাবাহ’ বলা হয়। এখানেই আইয়ামে তাশরীক্বের এক গভীর রাতে আলো-অাঁধারীর মধ্যে আক্বাবাহ্র অত্র বায়‘আত অনুষ্ঠিত হয়, যা ছিল পরবর্তী পর্যায়ে মাদানী জীবনে ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের বীজ বপন সমতুল্য। এই বায়‘আত ছিল মহিলাদের বায়‘আতের ন্যায়। যা তাদের উপর যুদ্ধ ফরয হওয়ার পূর্বে সম্পন্ন হয়েছিল (ইবনু হিশাম ১/৪৩১)।

এই বায়‘আতে গত বছরের পাঁচজন ছাড়াও এ বছর নতুন যে সাতজন উপস্থিত ছিলেন, তাঁরা হ’লেনঃ (১) বনু নাজ্জার গোত্রের মু‘আয বিন হারেছ বিন রিফা‘আহ (مُعَاذُ بْنُ الْحَارِثِ ابْنِ رِفَاعَةَ) (২) বনু যুরায়েক্ব গোত্রের যাকওয়ান ইবনু ‘আব্দে ক্বায়েস (ذَكْوَانُ بْنُ عَبْدِ قَيْسِ) (৩) বনু গানাম গোত্রের ‘উবাদাহ বিন ছামেত (عُبَادَةُ بْنُ الصَّامِتِ) (৪) বনু গানামের মিত্র গোত্রের ইয়াযীদ বিন ছা‘লাবাহ (يَزِيدُ بْنُ ثَعْلَبَةَ) (৫) বনু সালেম গোত্রের আববাস বিন ওবাদাহ বিন নাযালাহ (عَبَّاسُ بْنُ عُبَادَةَ بْنِ نَضَلَةَ) (৬) বনু ‘আব্দিল আশহাল গোত্রের আবুল হায়ছাম মালেক ইবনুত তাইয়েহান (أَبُو الْهَيْثَمِ مَالِكُ بْنُ التَّيِّهَانِ) (৭) বনু ‘আমর বিন ‘আওফ গোত্রের ‘ওয়ায়েম বিন সা‘এদাহ (عُوَيْمُ بْنُ سَاعِدَةَ)। শেষোক্ত দু’জন ছিলেন আউস বংশের এবং বাকীগণ ছিলেন খাযরাজ বংশের। তন্মধ্যে ১ম ব্যক্তি ছিলেন রাসূল (ছাঃ)-এর দাদার মাতুল গোষ্ঠী বনু নাজ্জারের অন্তর্ভুক্ত’ (ইবনু হিশাম ১/৪৩৩)।

২য় বায়‘আত অনুষ্ঠান
অত্র বায়‘আতে অংশগ্রহণকারী ছাহাবী ‘উবাদাহ বিন ছামেত (রাঃ) বলেন,

أَنَّ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ : تَعَالَوْا بَايِعُونِى عَلَى أَنْ لاَ تُشْرِكُوا بِاللهِ شَيْئًا وَلاَ تَسْرِقُوا وَلاَ تَزْنُوا وَلاَ تَقْتُلُوا أَوْلاَدَكُمْ وَلاَ تَأْتُونَ بِبُهْتَانٍ تَفْتَرُونَهُ بَيْنَ أَيْدِيكُمْ وَأَرْجُلِكُمْ وَلاَ تَعْصُونِى فِى مَعْرُوفٍ، فَمَنْ وَفَى مِنْكُمْ فَأَجْرُهُ عَلَى اللهِ، وَمَنْ أَصَابَ مِنْ ذَلِكَ شَيْئًا فَعُوقِبَ بِهِ فِى الدُّنْيَا فَهُوَ لَهُ كَفَّارَةٌ، وَمَنْ أَصَابَ مِنْ ذَلِكَ شَيْئًا فَسَتَرَهُ اللهُ فَأَمْرُهُ إِلَى اللهِ، إِنْ شَاءَ عَاقَبَهُ وَإِنْ شَاءَ عَفَا عَنْهُ، قَالَ فَبَايَعْنَاهُ عَلَى ذَلِكَ، متفق عليه-

‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাদের বললেন যে, তোমরা এসো আমার নিকটে বায়‘আত কর এই মর্মে যে, (১) তোমরা আল্লাহর সঙ্গে কোন কিছুকে শরীক করবে না (২) চুরি করবে না (৩) যেনা করবে না (৪) নিজেদের সন্তানদের হত্যা করবে না (৫) কাউকে মনগড়া অপবাদ দিবে না (৬) সঙ্গত বিষয়ে আমার অবাধ্যতা করবে না। তোমাদের মধ্যে যারা এগুলি পূর্ণ করবে, আল্লাহর নিকটে তার জন্য পুরস্কার রয়েছে। আর যদি কেউ এগুলির কোনটি করে এবং দুনিয়াতে তার শাস্তি হয়ে যায়, তাহ’লে সেটি তার জন্য কাফফারা হবে। পক্ষান্তরে যদি কেউ এগুলির কোনটি করে, অতঃপর আল্লাহ তা গোপন রাখেন, তবে তার ব্যাপারটি আল্লাহর উপরেই ন্যস্ত থাকবে। চাইলে তিনি বদলা নিবেন, চাইলে তিনি ক্ষমা করবেন’। রাবী ‘উবাদাহ বিন ছামেত বলেন, অতঃপর আমরা উক্ত কথাগুলির উপরে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট বায়‘আত করলাম’।[4] ইতিহাসে এটাই আক্বাবার প্রথম বায়‘আত বা ‘আক্বাবায়ে ঊলা হিসাবে পরিচিত। যদিও প্রকৃত প্রস্তাবে এটি ছিল ২য় বায়‘আত।

[1]. ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা বাক্বারাহ ৮৯ আয়াত, সনদ হাসান; সীরাহ ছহীহাহ, সনদ হাসান ১/১২২ পৃঃ; ইবনু হিশাম ১/২১১; সনদ যঈফ, তাহকীক ইবনু হিশাম ক্রমিক ২০৮।
[2]. ইবনু হিশাম ১/৫০৭-০৮।

১১ নববী বর্ষের হজ্জের মওসুমে (জুলাই ৬২০ খৃঃ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর হাতে সর্বপ্রথম বায়‘আতকারী ৬ জন যুবকের কনিষ্ঠতম নেতা, যার নেতৃত্বে মদীনায় সর্বপ্রথম ইসলাম প্রচারিত হয় এবং পরবর্তী দু’বছরে ৭৩ জন পুরুষ ও ২ জন নারী মক্কায় এসে বায়‘আত করেন। অতঃপর ১৪ নববী বর্ষের রবীউল আউয়াল মাসে (সেপ্টেম্বর ৬২২) হিজরত সংঘটিত হয় এবং ৬ মাস পরে ১ম হিজরী সনের শাওয়াল মাসে অল্প বয়সে তাঁর মৃত্যু হয় ও বাক্বী‘ গোরস্থানে ১ম ছাহাবী হিসাবে কবরস্থ হন। মুহাজিরগণ বলেন, ওছমান বিন মায‘ঊন (রাঃ) ছিলেন প্রথম মৃত্যুবরণকারী’ (আল-ইস্তী‘আব; আল-ইছাবাহ, ক্রমিক ১১১)।

সুহায়লী বলেন, আউস গোত্রের কুলছূম বিন হিদাম সর্বপ্রথম মারা যান। তার কয়েকদিন পরেই আস‘আদ বিন যুরারাহ মৃত্যুবরণ করেন। উল্লেখ্য যে, রাসূল (ছাঃ) মদীনায় হিজরত করে প্রথম ক্বোবাতে কুলছূম বিন হিদামের বাড়িতে অবস্থান করেন। তিনি ছিলেন অতি বৃদ্ধ এবং তিনিই ছিলেন হিজরতের পর অল্প দিনের মধ্যে সর্বপ্রথম মৃত্যুবরণকারী ছাহাবী (ইবনু হিশাম ১/৪৯৩-টীকা ১)। আল্লাহ সর্বাধিক অবগত।

[3]. ইবনু হিশাম ১/৪২৯-৩২; আর-রাহীক্ব ১৩৫ পৃঃ। জাবের বিন আব্দুল্লাহ বিন রিআব আনছারদের মধ্যে প্রথম ইসলাম কবুল করেন। ইনি বদর, ওহোদ, খন্দকসহ রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে সকল যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ইনি বিখ্যাত ছাহাবী জাবের বিন আব্দুল্লাহ বিন ‘আমর আনছারী (রাযিয়াল্লাহু ‘আনহুমা) নন (ইবনু হিশাম ১/৪৩০- টীকা ৭)।
[4]. বুখারী হা/১৮, ৩৮৯২; মুসলিম হা/১৭০৯; মিশকাত হা/১৮; ইবনু হিশাম ১/৪৩৪।

বায়‘আতের গুরুত্ব

(১) বায়‘আতে বর্ণিত ছয়টি বিষয়ের প্রতিটি ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এগুলি শুধু সেযুগেই নয়, বরং সর্বযুগেই গুরুত্বপূর্ণ। বর্ণিত বিষয়গুলি সমাজে ব্যাপ্তি লাভ করলে সমাজে শান্তি ও শৃংখলা বিনষ্ট হয়। জাহেলী আরবে এগুলি বিনষ্ট হয়েছিল বলেই আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) এ বিষয়গুলি গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করেন। আজকালকের কথিত সভ্য দুনিয়ায় এগুলি প্রকট আকারে বিদ্যমান। আধুনিক কলাকৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে যা ক্রমেই বিস্তৃত হয়ে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ছে। অতএব দুনিয়াপূজারী সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা আখেরাতমুখী করার ব্যাপারে যতক্ষণ পর্যন্ত সমাজনেতা ও রাষ্ট্রনেতাগণ আল্লাহর নামে অঙ্গীকারাবদ্ধ না হবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত সমাজে ও রাষ্ট্রে কাংখিত শান্তি ও স্থিতি ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে না।

(২) বায়‘আত (الْبَيْعَةُ) অর্থ অঙ্গীকার। ছাহেবে মির‘আত ওবায়দুল্লাহ মুবারকপুরী (রহঃ) বলেন,

سُمِّيَتِ الْمُعَاهَدَةُ عَلَى الإسلامِ بِالْمُبَايَعَةِ تَشْبيهاً لِّنَيْلِ الثَّوَابِ فِيْ مُقَابَلَةِ الطَّاعَةِ بِعَقْدِ الْبَيْعِ الَّذِي هُوَ مُقَابَلَةُ مَالٍ، كَأَنَّهُ بَاعَ مَا عِنْدَهُ مِنْ صَاحِبِهِ وَأَعْطَاهُ خَالِصَةَ نَفْسِهِ وَطَاعَتِهِ كَمَا فِيْ قَوْلِهِ تَعَالَى: (إِنَّ اللهَ اشْتَرَى مِنَ الْمُؤْمِنِينَ) الآية

‘ইসলামের উপরে কৃত অঙ্গীকারকে বায়‘আত এজন্য বলা হয়েছে যে, ব্যবসায়িক চুক্তির বিপরীতে যেমন সম্পদ লাভ হয়, আমীরের নিকটে বায়‘আতের মাধ্যমে আনুগত্যের বিপরীতে তেমনি পুণ্য লাভ হয়। সে যেন আমীরের নিকটে তার খালেছ হৃদয় ও আনুগত্য বিক্রয় করে দেয়। যেমন আল্লাহ বলেন,إِنَّ اللهَ اشْتَرَى مِنَ الْمُؤْمِنِينَ أَنْفُسَهُمْ وَأَمْوَالَهُمْ بِأَنَّ لَهُمُ الْجَنَّةَ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ মুমিনদের জান ও মাল খরীদ করে নিয়েছেন জান্নাতের বিনিময়ে...’ (তাওবাহ ৯/১১১)।[1]

দুনিয়াবী সমাজ ব্যবস্থায় পরস্পরের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস সৃষ্টির জন্য শপথ ও অঙ্গীকার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মুসলিম-অমুসলিম সব সমাজেই এটি রয়েছে। লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের ভিন্নতা এবং কার্যের ধরণ অনুযায়ী অঙ্গীকারের ধরণ ও ভাষা পরিবর্তিত হয়। ইসলামী জীবন ও সমাজ গঠনের লক্ষ্যে নেতা ও কর্মীর মধ্যে আল্লাহর নামে অঙ্গীকার করতে হয়। ইসলামী পরিভাষায় যাকে বায়‘আত বলা হয়। এর একমাত্র লক্ষ্য থাকে ইসলামী বিধান মেনে নিজের জীবন, পরিবার ও সমাজ গঠনের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা এবং আখেরাতে জান্নাত লাভ করা। যার মধ্যে কোন দুনিয়াবী স্বার্থ থাকে না। যিনি যত বেশী আল্লাহর বিধান মেনে চলবেন, তিনি তত বেশী নেকী উপার্জন করবেন। সেকারণ ইসলামী ইমারত ও বায়‘আত এবং অন্যান্য নেতৃত্ব ও শপথ গ্রহণের মধ্যে আলো ও অন্ধকারের পার্থক্য রয়েছে। তাই ইসলামের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে ইমারত ও বায়‘আতের গুরুত্ব সর্বাধিক।

নবীগণ এ তরীকাতেই সমাজ সংস্কারের কাজ করেছেন। শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) মাক্কী ও মাদানী জীবনে একই তরীকা অবলম্বন করেছেন। সর্বদা উক্ত নীতি অব্যাহত থাকবে, যদি না তাওহীদী সমাজ গঠনের মহান লক্ষ্যে যোগ্য ও বিশ্বস্ত কোন আমীর ও মামূর পরস্পরে আল্লাহর নামে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন। যদিও সেখানে দৃঢ় বিশ্বাসী, কপট বিশ্বাসী, শিথিল বিশ্বাসী ও সুবিধাবাদী এমনকি বায়‘আত ভঙ্গকারীরাও থাকবে। যেভাবে নবীযুগে বায়‘আতকারীদের মধ্যেও ছিল। কিন্তু তাই বলে নীতির পরিবর্তন হবে না।

রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক উভয় ক্ষেত্রে এটি যরূরী। রাসূল (ছাঃ) মাক্কী জীবনে সামাজিক এবং মাদানী জীবনে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় উভয় ক্ষেত্রে আমীর ছিলেন। রাষ্ট্রীয় আমীর ইসলামের দন্ডবিধি সমূহ জারী করবেন। কিন্তু সামাজিক বা সাংগঠনিক আমীর সেটা করবেন না। তবে উপদেশ ও অনুশাসন জারি রাখবেন। যার মাধ্যমে ইসলামের বিধিনিষেধ সমূহ সামাজিক জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভ করবে। সর্বোপরি জামা‘আতবদ্ধ জীবন যাপনের ইসলামী নির্দেশ বাস্তবায়নের মাধ্যমে আল্লাহর রহমত লাভ করা সম্ভব হবে। অতএব অমুসলিম বা ফাসেক মুসলিম উভয় সরকারের শাসনামলে মুমিনের কর্তব্য হ’ল, (১) শাসকের প্রতি অনুগত থাকা এবং ইসলামী আমীরের অধীনে জামা‘আতবদ্ধভাবে দেশে ইসলামী বিধান ও নিজেদের বৈধ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ইসলামী পন্থায় সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো। (২) বিভিন্ন উপায়ে সরকারকে নছীহত করা। (৩) সরকারের হেদায়াতের জন্য দো‘আ করা এবং পরিশেষে যালেম সরকারের বিরুদ্ধে আল্লাহর নিকটে কুনূতে নাযেলাহ পাঠ করা।

মোটকথা দেশে ইসলামী খেলাফত থাক বা না থাক, সমাজ পরিচালনায় ইসলামী আমীর থাকতেই হবে। নইলে ফাসেক নেতৃত্বে সমাজ বিপর্যস্ত হবে। যা আল্লাহর কাম্য নয়। এ কারণেই রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মারা গেল, অথচ তার গর্দানে আমীরের বায়‘আত নেই, সে জাহেলী (পথভ্রষ্ট) হালতে মৃত্যুবরণ করল। ক্বিয়ামতের দিন তার (মুক্তির জন্য) কোন দলীল (ওযর) থাকবে না’ (মুসলিম হা/১৮৫১)।

[1]. ওবায়দুল্লাহ মুবারকপুরী (১৩২২-১৪১৪ হিঃ/১৯০৪-১৯৯৪ খৃঃ), মির‘আতুল মাফাতীহ শরহ মিশকাতুল মাছাবীহ (বেনারস, ভারত : ৪র্থ সংস্করণ ১৪১৯/১৯৯৮ খৃঃ) হা/১৮-এর ব্যাখ্যা ১/৭৫ পৃঃ ‘ঈমান’ অধ্যায়।

ইয়াছরিবে মুবাল্লিগ প্রেরণ

বায়‘আতকারী নওমুসলিমদের অনুরোধে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) একজন উদ্যমী ও ধীশক্তিসম্পন্ন যুবককে ইয়াছরিবে পাঠালেন শিক্ষক ও প্রচারক হিসাবে। যার নাম ছিল মুছ‘আব বিন ওমায়ের বিন হাশেম (রাঃ)। তিনিই ছিলেন ইসলামের ইতিহাসে প্রথম দাঈ।




************************************
সাইটটি ভিজিট করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আর্টিকেলটি ভাল লাগলে সত্য ও ন্যয়ের পথে অন্য ভাইনদেরকে দাওয়াতের নিয়তে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন। মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে এবং দীন ও মানবতার সেবায় অংশ নিতে OUR ACTION PLAN বাটনে ক্লিক করুন।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url