প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর জীবনী [পর্ব-১৮]





মুছ‘আব বিন ওমায়ের-এর ইসলাম গ্রহণ ও মেরাজের ঘটনা


মুছ‘আব বিন ওমায়ের (রাঃ)-এর দাওয়াত

মুছ‘আব ছিলেন মক্কার এক ধনাঢ্য পরিবারের আদরের দুলাল। তিনি যখন ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে বের হতেন, তখন আগে-পিছে গোলামের দল থাকত। দু’শো দিরহামের কম মূল্যের কোন পোষাক তিনি পরতেন না। তিনি ইসলাম গ্রহণ করায় তার গোত্রের লোকেরা তাকে বেঁধে ঘরে আটকে রাখে। পরে তিনি কৌশলে বেরিয়ে হাবশায় হিজরত করেন। অতঃপর সেখান থেকে ফিরে মক্কায় আসেন। তিনি ছিলেন তীক্ষ্ণধী এবং অত্যন্ত বিশ্বস্ত যুবক। বিষয়বস্ত্ত উপস্থাপন ও অন্যকে আকৃষ্ট করার অনন্য সাধারণ গুণাবলী তার মধ্যে ছিল।

১ম আক্বাবাহর বায়‘আত সম্পাদিত হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মুছ‘আবকে তাদের সাথে ইয়াছরিবে প্রেরণ করেন। তিনি সেখানে গিয়ে তরুণ দলনেতা আবু উমামাহ আস‘আদ বিন যুরারাহ (রাঃ)-এর বাড়ীতে অবস্থান করেন এবং উভয়ে মিলে ইয়াছরিবের ঘরে ঘরে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছাতে থাকেন। তাঁকে মুক্বরি (الْمُقْرِئُ) অর্থাৎ পাঠদানকারী বা শিক্ষক বলে সবাই ডাকত। তাঁর দাওয়াতের ফল এই হয়েছিল যে, পরবর্তী হজ্জ মৌসুম আসার আগেই ইয়াছরিবের ঘরে ঘরে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে গিয়েছিল এবং আনছারদের এমন কোন গৃহ ছিল না যার পুরুষ ও মহিলাদের কিছু সংখ্যক মুসলমান হননি। তাঁর প্রচারকালের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনাটি ছিল নিম্নরূপ:-

একদিন আস‘আদ বিন যুরারাহ তাঁকে সাথে নিয়ে বনু আব্দিল আশহাল ও বনু যাফরের(بنو ظَفَر) মহল্লায় গমন করেন ও সেখানে একটি কূয়ার পাশে কয়েকজন মুসলমানকে নিয়ে বসেন। তখনো পর্যন্ত বনু আব্দিল আশহাল গোত্রের দুই নেতা সা‘দ বিন মু‘আয ও উসায়েদ বিন হুযায়ের ইসলাম কবুল করেননি। মুবাল্লিগদের আগমনের খবর জানতে পেরে সা‘দ উসায়েদকে বললেন, আপনি যেয়ে ওদের নিষেধ করুন যেন আমাদের সরল-সিধা মানুষগুলিকে বোকা না বানায়। আস‘আদ আমার খালাতো ভাই না হ’লে আমি নিজেই যেতাম’।

উসায়েদ বর্শা উঁচিয়ে সদর্পে সেখানে গিয়ে বললেন, যদি প্রাণে বাঁচতে চাও, তবে এখুনি পালাও। তোমরা আমাদের বোকা লোকগুলিকে মুসলমান বানাচ্ছো’। মুছ‘আব শান্তভাবে বললেন, আপনি কিছুক্ষণের জন্য বসুন ও কথা শুনুন। যদি পসন্দ না হয়, তখন দেখা যাবে’। উসায়েদ তখন মাটিতে বর্শা গেড়ে বসে পড়লেন। অতঃপর মুছ‘আব তাকে কুরআন থেকে কিছু অংশ পাঠ করে শুনালেন। তারপর তিনি আল্লাহর বড়ত্ব, মহত্ত্ব ও তাঁর ইবাদত ও আনুগত্যের গুরুত্ব সম্পর্কে কিছু কথা বললেন। ইতিমধ্যে উসায়েদ চমকিত হয়ে বলে উঠলেন, مَا أَحْسَنَ هَذَا الْكَلاَمَ وَأَجْمَلَهُ ‘কতই না সুন্দর কথা এগুলি ও কতই না মনোহর’। এরপর তিনি সেখানেই ইসলাম কবুল করলেন।

অতঃপর তিনি সা‘দ বিন মু‘আয-এর নিকটে এসে বললেন, فَواللهِ مَا رَأَيْتُ بِهِمَا بَأْسًا ‘আল্লাহর কসম! আমি তাদের মধ্যে দোষের কিছু দেখিনি’। তবে আমি তাদের নিষেধ করে দিয়েছি এবং তারাও বলেছে, আপনারা যা চান তাই করা হবে’। এ সময় উসায়েদ চাচ্ছিলেন যে, সা‘দ সেখানে যান। তাই তাকে রাগানোর জন্যে বললেন, আমি জানতে পারলাম যে, বনু হারেছাহ্র লোকজন আস‘আদ বিন যুরারাহকে হত্যা করার জন্য বের হয়েছে এজন্য যে, সে আপনার খালাতো ভাই। সা‘দ ক্রুদ্ধ হয়ে তখনই বর্শা হাতে ছুটে গেলেন। যেয়ে দেখেন যে, আস‘আদ ও মুছ‘আব নিশ্চিন্তে বসে আছে। বনু হারেছাহ্র হামলাকারীদের কোন খবর নেই। তখন তিনি বুঝলেন যে, উসায়েদ তার সঙ্গে চালাকি করেছে তাকে এদের কাছে পাঠানোর জন্য। তখন সা‘দ ক্রুদ্ধস্বরে উভয়কে ধমকাতে থাকলেন এবং আস‘আদকে বললেন, তুমি আমার আত্মীয় না হ’লে তোমাদের কোনই ক্ষমতা ছিল না আমার মহল্লায় এসে লোকদের বাজে কথা শুনাবার’। আস‘আদ পূর্বেই সা‘দ ও উসায়েদ-এর বিষয়ে মুছ‘আবকে অবহিত করেছিলেন যে, এরা দু’জন মুসলমান হ’লে এদের গোত্রের সবাই মুসলমান হয়ে যাবে। আস‘আদের ইঙ্গিতে মুছ‘আব অত্যন্ত ধীর ও নম্র ভাষায় সা‘দকে বললেন, আপনি বসুন এবং আমাদের কথা শুনুন! অতঃপর পসন্দ হলে কবুল করবেন, নইলে প্রত্যাখ্যান করবেন’।

অতঃপর তিনি বসলেন এবং মুছ‘আব তাকে কুরআন থেকে শুনালেন ও তাওহীদের মর্ম বুঝালেন। ফলে কিছুক্ষণের মধ্যেই সা‘দ বিন মু‘আয ইসলাম কবুল করে ধন্য হ’লেন। অতঃপর সেখানেই দু’রাক‘আত নফল ছালাত আদায় করে নিজ গোত্রে এলেন ও সবাইকে ডেকে বললেন, হে বনু আব্দিল আশহাল! كَيْفَ تَعْلَمُونَ أَمْرِي فِيكُمْ؟ তোমরা আমাকে তোমাদের মধ্যে কেমন মনে কর? তারা বলল, اَنْتَ سَيِّدُنَا وَأَفْضَلُنَا رَأْيًا وَأَيْمَنُنَا نَقِيبَةً ‘আপনি আমাদের নেতা, সর্বোত্তম সিদ্ধান্তের অধিকারী ও আমাদের নিশ্চিন্ততম কান্ডারী’। তখন তিনি বললেন, فَإِنَّ كَلاَمَ رِجَالِكُمْ وَنِسَائِكُمْ عَلَيَّ حَرَامٌ حَتّى تُؤْمِنُوا بِاللهِ وَبِرَسُولِهِ ‘তোমাদের নারী ও পুরুষ সকলের সঙ্গে আমার কথা বলা হারাম, যে পর্যন্ত না তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উপরে ঈমান আনবে’। এ কথার প্রতিক্রিয়া এমন হ’ল যে, সন্ধ্যার মধ্যেই সকলে ইসলাম কবুল করল’ (ইবনু হিশাম ১/৪৩৫-৩৭) মাত্র একজন তরুণ ব্যতীত। যার নাম ছিল আমর বিন ছাবিত আল-উছাইরিম (الأُصَيْرِمُ)। ইনি পরে ওহোদ যুদ্ধের দিন ইসলাম কবুল করেই যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন ও শাহাদত বরণ করেন (ইবনু হিশাম ২/৯০)।

ইসরা ও মেরাজ

১৩ নববী বর্ষ
‘ইসরা’ অর্থ নৈশ ভ্রমণ এবং ‘মেরাজ’ অর্থ সিঁড়ি। মক্কার মাসজিদুল হারাম থেকে ফিলিস্তীনের বায়তুল মুক্বাদ্দাস মসজিদ পর্যন্ত বোরাক্বের সাহায্যে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর স্বল্পকালীন নৈশ ভ্রমণকে ‘ইসরা’ (الإِسْرَاء) বলা হয় এবং বায়তুল মুক্বাদ্দাস থেকে ঊর্ধ্বমুখী সিঁড়ির মাধ্যমে মহাকাশের সীমানা পেরিয়ে আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎকে মেরাজ (الْمِعْرَاج) বলা হয়। নববী জীবনে এটি ছিল এক অলৌকিক ও শিক্ষাপ্রদ ঘটনা। যার মাধ্যমে শেষনবীকে পরকালীন জীবনের সবকিছু চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ করানো হয়। এর ফলে তাঁর মধ্যে যেমন বিশ্বাস ও প্রতীতি দৃঢ়তর হয় এবং হৃদয়ে প্রশান্তি জন্মে, তেমনি মুমিন হৃদয়ে পরকালীন মুক্তির জন্য উদগ্র বাসনা জাগ্রত হয়। ভবিষ্যৎ মাদানী জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতসংকুল জিহাদী যিন্দেগীতে যে দৃঢ় বিশ্বাস-এর প্রয়োজন হবে অত্যন্ত বেশী। সেকারণ অদূর ভবিষ্যতে অনুষ্ঠিতব্য হিজরতের পূর্বেই আল্লাহ তাঁর নবীকে মে‘রাজের মাধ্যমে মানসিকভাবে প্রস্ত্তত করে নেন। যাতে তা মাদানী জীবনে ইসলামী বিজয়ে সহায়ক হয়। পবিত্র কুরআনে সূরা বনু ইসরাঈলের ১ম আয়াতে ‘ইসরা’ এবং সূরা নজমের ১৩ থেকে ১৮ পর্যন্ত ৬ আয়াতে মেরাজ সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে। বাকী বিশদ ঘটনাবলী ছহীহ হাদীছ সমূহে বিবৃত হয়েছে। আল্লাহ বলেন, سُبْحَانَ الَّذِيْ أَسْرَى بِعَبْدِهِ لَيْلاً مِّنَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ إِلَى الْمَسْجِدِ الأَقْصَى الَّذِيْ بَارَكْنَا حَوْلَهُ لِنُرِيَهُ مِنْ آيَاتِنَا إِنَّهُ هُوَ السَّمِيْعُ البَصِيْرُ ‘পরম পবিত্র সেই মহান সত্তা, যিনি স্বীয় বান্দাকে রাত্রির একাংশে ভ্রমণ করিয়েছেন (মক্কার) মাসজিদুল হারাম থেকে (ফিলিস্তীনের) মাসজিদুল আক্বছা পর্যন্ত। যার চতুষ্পার্শ্বকে আমরা বরকতময় করেছি। যাতে আমরা তাকে আমাদের কিছু নিদর্শন দেখিয়ে দিতে পারি। নিশ্চয়ই তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা’ (ইসরা ১৭/১)।

উক্ত আয়াতে চারটি বিষয়ে ইঙ্গিত রয়েছে। ১. ইসরা ও মেরাজের পুরা ঘটনাটি রাতের শেষাংশে স্বল্প সময়ে একবার মাত্র সম্পন্ন হয়েছিল, যা ليلاً শব্দের মধ্যে বলা হয়েছে।

২. ঘটনাটি জাগ্রত অবস্থায় সশরীরে ঘটেছিল, যা بِعَبْدِهِ শব্দের মাধ্যমে বলা হয়েছে। কেননা রূহ ও দেহের সমন্বিত সত্তাকে ‘আব্দ’ বা দাস বলা হয়। ঘুমের মধ্যে স্বপ্নযোগে বা রূহানী কোন ব্যাপার হ’লে কেউ একে অবিশ্বাস করত না এবং কুরআনে তাঁকে ‘আব্দ’ না বলে হয়তবা ‘রূহ’ (بِرُوْحِ عَبْدِهِ) বলা হ’ত। এখানে عَبْدُهُ ‘তাঁর দাস’ বলে রাসূল (ছাঃ)-কে সর্বোচ্চ মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। কেননা আল্লাহর দাস হওয়ার মধ্যেই মানুষের সর্বোচ্চ সম্মান নিহিত রয়েছে। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, هِىَ رُؤْيَا عَيْنٍ أُرِيَهَا رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم ‘এটি ছিল প্রত্যক্ষ দর্শন, যা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে দেখানো হয়েছিল’ (বুখারী হা/৪৭১৬)।

উল্লেখ্য যে, মক্কা থেকে বায়তুল মুক্বাদ্দাস পর্যন্ত ঘোড়া বা উটে যাতায়াতে দু’মাসের পথ। যা এক রাতেই ভ্রমণ করে মি‘রাজ থেকে ফিরে এসে সকাল বেলা যখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) লোকদের কাছে উক্ত ঘটনা বর্ণনা করলেন, তখন সবাই একে মিথ্যা ও বানোয়াট বলে উড়িয়ে দিল এবং তাঁকে বিভিন্নভাবে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করতে লাগল। অবশেষে যারা ইতিপূর্বে বায়তুল মুক্বাদ্দাস ভ্রমণ করেছেন, এমন কিছু অভিজ্ঞ লোক তাঁকে বিভিন্ন প্রশ্নের মাধ্যমে পরীক্ষা করেন। সব প্রশ্নের যথাযথ জবাব পেয়ে তারা চুপ হ’ল বটে। কিন্তু তাদের অবিশ্বাসী অন্তর প্রশান্ত হয়নি। পক্ষান্তরে হযরত আবুবকর (রাঃ) একথা শোনামাত্র বিশ্বাস স্থাপন করেন এবং বলেন, نَعَمْ، إِنِّي لَأُصَدِّقُهُ فِيْمَا هُوَ أَبْعَدُ مِنْ ذَلِكَ، أُصَدِّقُهُ بِخَبَرِ السَّمَاءِ فِي غَدْوَةِ أَوْ رَوْحَةِ. فَلِذَلِكَ سُمِّيَ أَبُو بَكْرٍ الصِّدِّيقَ ‘আমি তাকে এর চাইতে অনেক বড় বিষয়ে সত্য বলে জানি। আমি সকালে ও সন্ধ্যায় তার নিকটে আগত আসমানী খবরসমূহকে সত্য বলে বিশ্বাস করে থাকি’। এ দিন থেকেই তিনি ‘ছিদ্দীক্ব’ (صِدِّيْق) বা সর্বাধিক সত্যবাদী নামে অভিহিত হ’তে থাকেন’।[1]

এটি অত্যন্ত বড় আশ্চর্যজনক ঘটনা ছিল। সেকারণ শুরুতে سُبْحَانَ বিস্ময়সূচক শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। স্বপ্নের ব্যাপার হ’লে তো এটা মোটেই আশ্চর্যজনক হ’ত না এবং একদল দুর্বল ঈমানদার ইসলাম ত্যাগ করে চলে যেত না। এজন্যই আল্লাহ এটাকে ‘মানুষের জন্য ফিৎনা বা পরীক্ষা স্বরূপ’ (فِتْنَةً لِلنَّاسِ) বলেছেন (ইসরা ১৭/৬০)। অর্থাৎ উক্ত ঘটনায় নও মুসলিমদের মুরতাদ হয়ে যাবার ফিৎনা। যেমন অনেকে হয়েছিল।[2]

৩. বায়তুল মুক্বাদ্দাস-এর আশপাশ ভূমি অর্থাৎ ফিলিস্তীন সহ পুরা সিরিয়া অঞ্চল বরকতময় এলাকা, যা بَارَكْنَا حَوْلَهُ বাক্যাংশের মাধ্যমে বলা হয়েছে। এখানে আধ্যাত্মিক বরকত হ’ল এই যে, হযরত ইবরাহীম, ইসহাক, ইয়াকূব, মূসা, দাঊদ, সুলায়মান, ইলিয়াস, যাকারিয়া, ইয়াহ্ইয়া ও ঈসা (আঃ) সহ বনু ইস্রাঈলের হাযার হাযার নবীর আবাসভূমি হ’ল এই এলাকা। আর দুনিয়াবী বরকত এই যে, শাম এলাকার মাটি মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যে সবচেয়ে উর্বর ও সুজলা-সুফলা। এতদ্ব্যতীত এ অঞ্চলের অন্যান্য বরকত সম্পর্কে বহু হাদীছ বর্ণিত হয়েছে।[3]

মেরাজে পরজগতের অলৌকিক নিদর্শনসমূহ দর্শন

৪. আল্লাহ তাঁর শেষনবীকে পরজগতের অলৌকিক নিদর্শন সমূহের কিছু অংশ স্বচক্ষে দেখিয়ে দেন। যা لِنُرِيَهُ مِنْ آيَاتِنَا বাক্যাংশের মাধ্যমে বলা হয়েছে। উক্ত নিদর্শন সমূহের মধ্যে ছিল যা ছহীহ হাদীছসমূহে বর্ণিত হয়েছে, যেমন (১) মক্কা থেকে বোরাকে সওয়ার হওয়ার পূর্বে সীনা চাক করা এবং তা যমযম পানি দিয়ে ধুয়ে সেখানে নূর দিয়ে ভরে দেওয়া। অতঃপর বায়তুল মুক্বাদ্দাস গিয়ে সেখান থেকে ঊর্ধ্বারোহণের পূর্বে তাঁকে দুধ ও মদ পরিবেশন করা। কিন্তু রাসূল (ছাঃ) দুধ গ্রহণ করেন। তখন জিব্রীল বলেন, أَصَبْتَ الْفِطْرَةَ ‘আপনি স্বভাবধর্ম প্রাপ্ত হয়েছেন’। (২) তিনি প্রথম আসমানে আদম, দ্বিতীয় আসমানে ইয়াহইয়া ও ঈসা, তৃতীয় আসমানে ইউসুফ, চতুর্থ আসমানে ইদরীস, পঞ্চম আসমানে হারূণ, ষষ্ঠ আসমানে মূসা এবং সপ্তম আসমানে ইবরাহীম (‘আলাইহিমুস সালাম)-এর সাথে সাক্ষাৎ করেন। তবে আদম ও ইবরাহীম (আঃ) ব্যতীত অন্যদের আসমানের ব্যাপারে বর্ণনাগত ভিন্নতা রয়েছে। (৩) তিনি ফেরেশতাদের কলম দিয়ে লেখার খসখস আওয়ায শোনেন। (৪) ছয়শো ডানাবিশিষ্ট জিব্রীলকে তার নিজস্ব রূপে নিকট থেকে দেখেন। (৫) সিদরাতুল মুনতাহার কুলগাছ দেখেন। যার পাতাগুলি হাতির কানের মত বড় বড়। (৬) সপ্তম আসমানে বায়তুল মা‘মূর মসজিদ দেখেন। যেখানে প্রতিদিন সত্তুর হাযার ফেরেশতা ছালাত আদায় করে। কিন্তু পুনরায় আর সুযোগ পায় না। (৭) হাউয কাওছার, জান্নাত ও জাহান্নাম দেখেন। তিনি জান্নাতের নে‘মতরাজি ও জাহান্নামের কঠিন শাস্তিসমূহ প্রত্যক্ষ করেন। (৮) তাঁকে তাঁর জন্য নির্ধারিত সুফারিশের স্থান ‘মাক্বামে মাহমূদ’ দেখানো হয়। (৯) সিদরাতুল মুনতাহায় পৌঁছলে চারদিকে আচ্ছন্ন হয়ে যায়। এরি মধ্যে আল্লাহ তাঁর সাথে সরাসরি অহি-র মাধ্যমে কথা বলেন। অতঃপর তাঁর উম্মতের জন্য প্রথমে পঞ্চাশ ওয়াক্ত ছালাত ফরয করা হয়। পরে মূসার পরামর্শক্রমে তাঁর বারবার যাতায়াত ও উপর্যুপরি অনুরোধে কমিয়ে পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত ফরয করা হয়। যা পঞ্চাশ ওয়াক্তের নেকীর সমান। (১০) তিনি সরাসরি আল্লাহকে দেখেননি, তাঁর নূর দেখেছিলেন। (১১) অতঃপর তিনি নেমে আসেন এবং বায়তুল মুক্বাদ্দাস মসজিদে নবীগণের ছালাতে ইমামতি করেন। অতঃপর বোরাকে চড়ে রাত্রি কিছু বাকী থাকতেই মক্কায় মাসজিদুল হারামে ফিরে আসেন (তাফসীর ইবনু কাছীর)।[4] পুরা ঘটনাটিই ঘটে অত্যন্ত দ্রুত সময়ের মধ্যে। যা ছিল মানবীয় জ্ঞানের বহির্ভূত। অথচ বাস্তব সত্য। যা মক্কার মুশরিক ও শত্রুনেতাদের দ্বারা সত্যায়িত।

উল্লেখ্য যে, অন্যান্য নবীদেরকেও আল্লাহ তাঁর কিছু কিছু নিদর্শন দেখিয়েছেন। তবে সেগুলি সব দুনিয়াতেই দেখানো হয়েছিল। যেমন ইবরাহীম (আঃ) চারটি পাখি যবহ ও টুকরা টুকরা করে মিশ্রিত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলি চারটি পাহাড়ে রেখে এসে বিসমিল্লাহ বলে ডাক দিতেই তাদের স্ব স্ব দেহে পুনর্জীবিত হওয়া, অতঃপর তাঁর কাছে চলে আসা (বাক্বারাহ ২/২৬০); তাঁর জন্য নমরূদের অগ্নিকুন্ড শান্তিময় স্থানে পরিণত হওয়া (আম্বিয়া ২১/৬৮-৭০); কেন‘আন থেকে মিসর যাওয়ার পথে অপহৃত স্ত্রী সারাহ-এর উপরে যালেম বাদশাহ্র হাত-পা অবশ হয়ে যাওয়া (বুখারী হা/২২১৭; আহমাদ হা/৯২৩০) ইত্যাদি অলৌকিক ঘটনাবলী। অন্যদিকে মূসা (আঃ)-এর আল্লাহর সাথে পবিত্র তুবা উপত্যকায় কথোপকথন ও তূর পাহাড়ে তাঁর জ্যোতি প্রদর্শন (আ‘রাফ ৭/১৪৩), অলৌকিক লাঠির মাধ্যমে নদী বিভক্ত হওয়া ও ফেরাঊন বাহিনী ডুবে মরা (শো‘আরা ২৬/৬৩-৬৬), নিজ গোত্রের ৭০ জন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির এলাহী গযবে মৃত্যুবরণ ও পরক্ষণেই মূসা (ছাঃ)-এর দো‘আয় ও আল্লাহর হুকুমে পুনরায় জীবিত হওয়া (বাক্বারাহ ২/৫৫-৫৬) ইত্যাদি ঘটনাবলী।

ইবরাহীম (আঃ)-কে দেখানোর উদ্দেশ্য সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, وَكَذَلِكَ نُرِيْ إِبْرَاهِيْمَ مَلَكُوْتَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَلِيَكُوْنَ مِنَ الْمُوْقِنِيْنَ ‘আর এভাবেই আমরা ইবরাহীমকে আসমান ও যমীনের রাজত্ব প্রদর্শন করেছি। যাতে সে দৃঢ়বিশ্বাসীদের অন্তর্ভুক্ত হয়’ (আন‘আম ৬/৭৫)। অনুরূপভাবে মূসা (আঃ)-কে দেখানোর উদ্দেশ্য সম্পর্কে তিনি বলেন, لِنُرِيَكَ مِنْ آيَاتِنَا الْكُبْرَى ‘যাতে আমরা তোমাকে আমাদের বড় বড় কিছু নিদর্শন দেখাতে পারি’ (ত্বোয়াহা ২০/২৩)। সবশেষে শেষনবী (ছাঃ)-কে সপ্তাকাশের উপরে নিজের কাছে ডেকে নিয়ে আল্লাহ তাঁকে পরজগতের অনেক কিছু প্রত্যক্ষ করালেন এবং বললেন, لِنُرِيَهُ مِنْ آيَاتِنَا ‘এটা এজন্য, যাতে আমরা তাকে আমাদের কিছু নিদর্শন প্রত্যক্ষ করাই’ (ইসরা ১৭/১)।

এভাবে মেরাজের মাধ্যমে আল্লাহ শেষনবীর মধ্যে ‘আয়নুল ইয়াক্বীন’ অর্থাৎ প্রত্যক্ষ দর্শনলব্ধ দৃঢ় বিশ্বাস সৃষ্টি করেন। যা অন্য কোন নবীর বেলায় করেননি। নিঃসন্দেহে এটি ছিল তাঁর শ্রেষ্ঠত্বের অন্যতম দলীল। সেই সাথে এটি ছিল বিশ্বাসীদের জন্য একটি বড় পরীক্ষা। যেমন আল্লাহ বলেন,

وَمَا جَعَلْنَا الرُّؤْيَا الَّتِي أَرَيْنَاكَ إِلاَّ فِتْنَةً لِلنَّاسِ وَالشَّجَرَةَ الْمَلْعُونَةَ فِي الْقُرْآنِ وَنُخَوِّفُهُمْ فَمَا يَزِيدُهُمْ إِلاَّ طُغْيَانًا كَبِيرًا-(الإسراء 60)-

‘...আর আমরা তোমাকে (মে‘রাজের রাতে) যে দৃশ্য দেখিয়েছি এবং কুরআনে বর্ণিত যে অভিশপ্ত (যাক্কুম) বৃক্ষ দেখিয়েছি, তা ছিল কেবল মানুষের (ঈমান) পরীক্ষার জন্য। আমরা তাদের ভীতি প্রদর্শন করি। অতঃপর এটা তাদের বড় ধরনের অবাধ্যতাই কেবল বৃদ্ধি করে’ (ইসরা ১৭/৬০)।

[1]. হাকেম হা/৪৪০৭, ৩/৬২; ছহীহাহ হা/৩০৬; ইবনু ইসহাক বলেন, এ সময় রাসূল (ছাঃ) তাকে ‘ছিদ্দীক্ব’ বলে অভিহিত করেন।-قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لِأَبِي بَكْرٍ: وَأَنْتَ يَا أَبَا بَكْرٍ الصِّدِّيقُ، فَيَوْمَئِذٍ سَمَّاهُ الصِّدِّيقَ (ইবনু হিশাম ১/৩৯৯)। হাদীছ ছহীহ, সনদ ‘মুরসাল’ (তাহকীক ইবনু হিশাম ক্রমিক ৩৯২)।
[2]. ইবনু হিশাম ১/৩৯৮; হাকেম হা/৪৪০৭, ৩/৬২; ছহীহাহ হা/৩০৬।
[3]. দ্রঃ মিশকাত ‘মানাক্বিব’ অধ্যায়-৩০ ‘ইয়ামন, শাম ও ওয়ায়েস ক্বারনীর বর্ণনা’ অনুচ্ছেদ-১৩।
[4]. বুখারী হা/৩৮৮৭; মুসলিম হা/১৬৪, ১৭৮; মিশকাত হা/৫৮৬২-৬৬।

মেরাজের তারিখ

এ সম্পর্কে বিদ্বানগণের মধ্যে ছয় প্রকার মতভেদ পরিদৃষ্ট হয়। যথা- (১) ১ নববী বর্ষেই মে‘রাজ সংঘটিত হয়েছিল (২) ৫ নববী বর্ষে (৩) ১০ নববী বর্ষের ২৭শে রজব তারিখে (৪) ১২ নববী বর্ষের রামাযান মাসে (৫) ১৩ নববী বর্ষের মুহাররম মাসে (৬) ১৩ নববী বর্ষের রবীউল আউয়াল মাসে (আর-রাহীক্ব ১৩৭ পৃঃ)।

উপরোক্ত ছয়টি মতামতের মধ্যে প্রথম চারটি গ্রহণযোগ্য নয়। যদিও তৃতীয় মতটিই উপমহাদেশে প্রচলিত আছে। কারণ, এ ব্যাপারে সকল বিদ্বান একমত যে, উম্মুল মুমেনীন হযরত খাদীজাতুল কুবরা (রাযিয়াল্লাহু ‘আনহা) পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত ফরয হওয়ার পূর্বেই মৃত্যুবরণ করেছিলেন। এটাও সকল বিদ্বান কর্তৃক স্বীকৃত যে, তাঁর মৃত্যু হয়েছিল ১০ নববী বর্ষের রামাযান মাসে। অতএব মি‘রাজ সংঘটিত হয়েছিল তাঁর মৃত্যুর পরে একথা একপ্রকার নিশ্চিতভাবেই বলা চলে। এক্ষণে শেষের তিনটি মতামতের মধ্যে কোনটিতেই নিশ্চিত হবার উপায় নেই। তবে সূরা ইসরার শুরুতে মে‘রাজ সম্পর্কিত বর্ণনার পরপরই বনু ইস্রাঈলের অধঃপতন সম্পর্কিত বর্ণনায় প্রতীয়মান হয় যে, ঈমানী বিশ্বে বনু ইস্রাঈলের দীর্ঘ নেতৃত্বের অবসান এবং মুহাম্মাদী নেতৃত্বের উত্থান ঘটতে যাচ্ছে। অর্থাৎ হিজরতের প্রাক্কালে মাক্কী জীবনের শেষপ্রান্তে মি‘রাজ সংঘটিত হয়েছিল। যা ১৩ নববী বর্ষের যেকোন এক রাতে হয়েছিল বলে একপ্রকার নিশ্চিতভাবে বলা যায়। অতঃপর হিজরত শুরু হয়েছিল ১৪ নববী বর্ষের ২৭শে ছফর বৃহস্পতিবার।

মে‘রাজের সঠিক তারিখ উম্মতের নিকটে অস্পষ্ট রাখার তাৎপর্য সম্ভবতঃ এই যে, তারা যেন ধ্বংসপ্রাপ্ত বিগত উম্মতগুলির ন্যায় অনুষ্ঠানসর্বস্ব না হয়ে পড়ে। বরং মে‘রাজের তাৎপর্য অনুধাবন করে আখেরাতে জবাবদিহিতার ব্যাপারে নিশ্চিত বিশ্বাস রাখে। অতঃপর মে‘রাজের অমূল্য তোহ্ফা পাঁচ ওয়াক্ত ছালাতের মাধ্যমে গভীর অধ্যাত্ম চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সর্বদা আল্লাহর আনুগত্যের মাধ্যমে দুনিয়াবী জীবন পরিচালনা করে।

আল্লাহ ইচ্ছা করলে মক্কা থেকেই সরাসরি মেরাজ করাতে পারতেন। কিন্তু মক্কা থেকে বায়তুল মুক্বাদ্দাস নিয়ে এসে সেখান থেকে মেরাজ করানোর মধ্যে এ বিষয়ে ইঙ্গিত রয়েছে যে, ইবরাহীমী দাওয়াতের দু’টি প্রধান কেন্দ্র কা‘বা ও বায়তুল মুক্বাদ্দাস দুই স্থানের কর্তৃত্ব ও দায়িত্ব এখন থেকে শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) ও তাঁর উম্মতের উপরেই ন্যস্ত করা হবে। যা ওমর (রাঃ)-এর খেলাফতকালে ১৫ হিজরী সনে সম্পন্ন হয় এবং যা এখনো অব্যাহত রয়েছে। যদিও পাশ্চাত্য বিশ্ব মধ্যপ্রাচ্যে তাদের সামরিক ঘাঁটি হিসাবে ব্যবহারের জন্য বাহির থেকে ইহূদীদের এনে ফিলিস্তীনের একাংশ থেকে সেখানকার স্থায়ী বাসিন্দা মুসলমানদের বের করে দিয়েছে এবং সেখানে ইহূদীদের যবরদস্তি বসিয়ে দিয়ে তাকে ‘ইস্রাঈল রাষ্ট্র’ নাম দিয়েছে ১৯৪৮ সালে। নিঃসন্দেহে এটি একটি অস্থায়ী বিষয়। যার সত্বর অবসান হবে ইনশাআল্লাহ।

অতএব ইসলামী দাওয়াতের প্রথম পর্যায় মাক্কী জীবনের শেষপ্রান্তে এসে ইয়াছরিবে হিজরতের প্রাক্কালে মে‘রাজ হয়েছিল বলা চলে। অর্থাৎ দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ নববী বর্ষের যিলহাজ্জ মাসে অনুষ্ঠিত ১ম ও ২য় বায়‘আত অনুষ্ঠানের মধ্যবর্তী কোন এক রজনীতে মেরাজ সংঘটিত হয়েছিল বলে প্রতীয়মান হয়। তবে আল্লাহ সর্বাধিক অবগত।

অতএব মে‘রাজ ছিল ইসলামী বিজয়ের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত এবং মাদানী জীবনের নব অধ্যায়ের সূচক ঘটনা।

৩য় বায়‘আত, বায়‘আতে কুবরা

যিলহাজ্জ ১৩ নববী বর্ষ: ৭৫জনের ইসলাম গ্রহণ
দ্বাদশ নববী বর্ষের যিলহাজ্জ মাসে অনুষ্ঠিত আক্বাবাহ্র ২য় বায়‘আতে অংশগ্রহণকারী ১২ জন মুসলমানের সাথে পরের বছর যিলহাজ্জ মাসে (জুন ৬২২ খৃঃ) অনুষ্ঠিত আক্বাবাহর ৩য় বায়‘আতে ৭৩ জন পুরুষ ও ২ জন মহিলাসহ মোট ৭৫ জন ইয়াছরিববাসী হজ্জে এসে বায়‘আত গ্রহণ করেন। এটিই ইসলামের ইতিহাসে বায়‘আতে কুবরা (الْبَيْعَةُ الْكُبْرَى) বা বড় বায়‘আত নামে খ্যাত। যা ছিল রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর মাদানী জীবনের ভিত্তি স্বরূপ এবং আগামীতে ঘটিতব্য ইসলামী সমাজ বিপ্লবের সূচনাকারী। এই সময় মুছ‘আব বিন ওমায়ের (রাঃ) মক্কায় ফিরে আসেন এবং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকটে ইয়াছরিবে দাওয়াতের অবস্থা ও গোত্র সমূহের ইসলাম কবুলের সুসংবাদ প্রদান করেন। যা রাসূল (ছাঃ)-কে হিজরতে উদ্বুদ্ধ করে।

মূলতঃ আক্বাবাহর বায়‘আত তিন বছরে তিনবার অনুষ্ঠিত হয়। ১১ নববী বর্ষে আস‘আদ বিন যুরারাহ্র নেতৃত্বে ৬ জন ইয়াছরিববাসীর প্রথম ইসলাম কবুলের বায়‘আত। ১২ নববী বর্ষে ১২ জনের দ্বিতীয় বায়‘আত এবং ১৩ নববী বর্ষে ৭৩+২=৭৫ জনের তৃতীয় ও সর্ববৃহৎ বায়‘আত- যার মাত্র ৭৫ দিনের মাথায় ১৪ নববী বর্ষের ২৭শে ছফর বৃহস্পতিবার মক্কা হ’তে ইয়াছরিবের উদ্দেশ্যে রাসূল (ছাঃ)-এর হিজরতের সূচনা হয়।

বিবরণ : ১২ই যিলহজ্জ দিবাগত রাতের এক তৃতীয়াংশ অতিক্রান্ত হ’লে নিজ নিজ সম্প্রদায়ের লোকদের গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন থাকা অবস্থায় পূর্বোক্ত ৭৫ জন ইয়াছরেবী হাজী রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাক্ষাতের জন্য বের হন এবং পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী আক্বাবাহ্র সুড়ঙ্গ পথে অতি সঙ্গোপনে হাযির হন। অল্পক্ষণের মধ্যেই রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) স্বীয় চাচা আববাসকে সাথে নিয়ে উপস্থিত হন, যিনি তখনও প্রকাশ্যে মুসলমান হননি। তবে তিনি কখনও রাসূল (ছাঃ)-কে একা ছাড়তেন না।

কুশলাদি বিনিময়ের পর প্রথমে আববাস কথা শুরু করেন। তিনি বলেন, মুহাম্মাদ আমাদের মাঝে কিভাবে আছেন তোমরা জানো। তাকে আমরা আমাদের কওমের শত্রুতা থেকে নিরাপদে রেখেছি এবং তিনি ইযযতের সাথে তার শহরে বসবাস করছেন। এক্ষণে তিনি তোমাদের ওখানে হিজরত করতে ইচ্ছুক। এ অবস্থায় তোমরা তার পূর্ণ যিম্মাদারীর অঙ্গীকার করলে আমাদের আপত্তি নেই। কিন্তু যদি এমনটি হয় যে, তোমরা তাকে নিয়ে গেলে, অতঃপর বিপদ মুহূর্তে তাকে পরিত্যাগ করলে, তাহ’লে তোমরা তাকে নিয়ে যেয়ো না। তিনি আমাদের মধ্যে সসম্মানেই আছেন’।

আববাসের বক্তব্যের পর প্রতিনিধি দলের মধ্য থেকে কা‘ব বিন মালেক বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা আববাসের কথা শুনেছি। এক্ষণে تَكَلَّمْ يَا رَسُولَ اللهِ فَخُذْ لِنَفْسِكَ وَلِرَبِّكَ مَا أَحْبَبْتَ ‘আপনি কথা বলুন এবং আপনার নিজের জন্য ও নিজ প্রভুর জন্য যে চুক্তি আপনি ইচ্ছা করেন, তা করে নিন’। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) প্রথমে কুরআন থেকে কিছু আয়াত তেলাওয়াত করেন। অতঃপর তাদেরকে ইসলাম কবুলের আহবান জানান। অতঃপর তিনি বলেন,أُبَايِعُكُمْ عَلَى أَنْ تَمْنَعُونِى مِمَّا تَمْنَعُونَ مِنْهُ نِسَاءَكُمْ وَأَبْنَاءَكُمْ ‘আমি তোমাদের বায়‘আত নেব এ বিষয়ের উপর যে, তোমরা আমাকে হেফাযত করবে ঐসব বিষয় থেকে, যেসব বিষয় থেকে তোমরা তোমাদের নারী ও সন্তানদেরকে হেফাযত করে থাক’। সাথে সাথে বারা বিন মা‘রূর রাসূল (ছাঃ)-এর হাত ধরে বললেন, نَعَمْ وَالَّذِي بَعَثَكَ بِالْحَقِّ لَنَمْنَعَنَّكَ مِمَّا نَمْنَعُ مِنْهُ أُزُرَنَا ‘হ্যাঁ! ঐ সত্তার কসম যিনি আপনাকে সত্য সহ প্রেরণ করেছেন, অবশ্যই আমরা আপনাকে হেফাযত করব ঐসব বিষয় থেকে, যা থেকে আমরা আমাদের মা-বোনদের হেফাযত করে থাকি’।[1] এ সময় আবুল হায়ছাম ইবনুত তাইয়েহান বলে উঠলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের সঙ্গে ইহূদীদের সন্ধিচুক্তি রয়েছে। আমরা তা ছিন্ন করছি। কিন্তু এমন তো হবে না যে, আমরা এরূপ করে ফেলি। তারপর আল্লাহ যখন আপনাকে জয়যুক্ত করবেন, তখন আপনি আবার আপনার সম্প্রদায়ের কাছে ফিরে আসবেন ও আমাদের পরিত্যাগ করবেন’?

জবাবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মুচকি হেসে বললেন, بَلْ الدَّمَ الدَّمَ، وَالْهَدْمَ الْهَدْمَ، أَنَا مِنْكُمْ وَأَنْتُمْ مِنِّي، أُحَارِبُ مَنْ حَارَبْتُمْ، وَأُسَالِمُ مَنْ سَالَمْتُمْ ‘না! বরং তোমাদের রক্ত আমার রক্ত, তোমাদের ইযযত আমার ইযযত। আমি তোমাদের থেকে এবং তোমরা আমার থেকে। তোমরা যাদের সঙ্গে যুদ্ধ করবে, আমিও তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করব। তোমরা যাদের সঙ্গে সন্ধি করবে, আমিও তাদের সঙ্গে সন্ধি করব’।[2] এরপর সবাই যখন বায়‘আত গ্রহণের জন্য এগিয়ে এল, তখন আববাস বিন ওবাদাহ বিন নাযালাহ (যিনি গত বছর বায়‘আত করেছিলেন,) সকলের উদ্দেশ্যে বিশেষ করে নিজের গোত্র খাযরাজদের উদ্দেশ্যে বললেন, هَلْ تَدْرُونَ عَلاَمَ تُبَايِعُونَ هَذَا الرَّجُلَ؟ ‘তোমরা কি জানো কোন কথার উপরে তোমরা এই মানুষটির নিকটে বায়‘আত করছ? সবাই বলল, হ্যাঁ। তিনি বললেন, তোমরা লাল ও কালো (আযাদ ও গোলাম) মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ব্যাপারে তাঁর নিকটে বায়‘আত করতে যাচ্ছ। যদি তোমাদের এরূপ ধারণা থাকে যে, যখন তোমাদের সকল সম্পদ নিঃশেষ হয়ে যাবে এবং তোমাদের সম্ভ্রান্ত লোকদের হত্যা করা হবে, তখন তোমরা তাঁর সঙ্গ ছেড়ে যাবে, তাহ’লে এখনই ছেড়ে যাও। কেননা তাঁকে নিয়ে যাওয়ার পরে যদি তোমরা তাঁকে পরিত্যাগ কর, তাহ’লে ইহকাল ও পরকালে চরম লজ্জার বিষয় হবে। আর যদি তোমাদের ইচ্ছা থাকে যে, তোমাদের মাল-সম্পদের ধ্বংস ও সম্ভ্রান্ত লোকদের হত্যা সত্ত্বেও এ চুক্তি অক্ষুণ্ণ রাখবে, যার প্রতি তোমরা তাঁকে আহবান করছ, তাহ’লে অবশ্যই তা সম্পাদন করবে। কেননা আল্লাহর কসম! এতেই তোমাদের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক জীবনের জন্য মঙ্গল নিহিত রয়েছে’ (ইবনু হিশাম ১/৪৪৬)।

আববাস বিন ওবাদাহর এই ওজস্বিনী ভাষণ শোনার পর সকলে সমবেত কণ্ঠে বলে উঠল, قَالُوا: فَإِنَّا نَأْخُذُهُ عَلَى مُصِيبَةِ الْأَمْوَالِ، وَقَتْلِ الْأَشْرَافِ، فَمَا لَنَا بِذَلِكَ يَا رَسُولَ اللهِ إنْ نَحْنُ وَفَّيْنَا (بِذَلِكَ)؟ قَالَ: الْجَنَّةُ. قَالُوا: اُبْسُطْ يَدَكَ، فَبَسَطَ يَدَهُ، فَبَايَعُوهُ ‘আমরা তাঁকে গ্রহণ করছি আমাদের মাল-সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি ও সম্ভ্রান্ত লোকদের হত্যার বিনিময়ে। কিন্তু যদি আমরা এই প্রতিজ্ঞা পূর্ণ করি, তবে এর বদলায় আমাদের কি পুরস্কার রয়েছে হে আল্লাহর রাসূল! তিনি বললেন, জান্নাত। তারা বলল, হাত বাড়িয়ে দিন। অতঃপর তিনি হাত বাড়িয়ে দিলেন এবং তারা সবাই তাঁর হাতে বায়‘আত করল’ (ইবনু হিশাম ১/৪৪৬)। অন্য বর্ণনায় এসেছে, رَبِحَ الْبَيْعُ لا نُقِيلُ ولا نَسْتقيلُ ‘ব্যবসা চুক্তি লাভজনক হয়েছে। আমরা কখনো তা রহিত করব না বা রহিত করার আবেদন করব না’।[3]

হযরত জাবের (রাঃ) বর্ণিত অন্য রেওয়ায়াতে এসেছে যে, লোকেরা বলে উঠল, فَوَاللهِ لاَ نَذَرُ هَذِهِ الْبَيْعَةَ وَلاَ نَسْتَقِيلُهَا ‘আল্লাহর কসম! আমরা এই বায়‘আত পরিত্যাগ করব না এবং রহিত করার আবেদন করব না’।[4] একই রাবী কর্তৃক অন্য বর্ণনায় এসেছে, فَوَاللهِ لاَ نَدَعُ هَذِهِ الْبَيْعَةَ أَبَداً وَلاَ نَسْلُبُهَا أَبَداً ‘আল্লাহর কসম! আমরা কখনোই এই বায়‘আত পরিত্যাগ করব না এবং তা বাতিল করব না’ (আহমাদ হা/১৪৪৯৬, সনদ ছহীহ)।

এ সময় দলনেতা এবং কাফেলার সর্বকনিষ্ঠ সদস্য আস‘আদ বিন যুরারাহ পূর্বের বক্তার ন্যায় কথা বললেন এবং পূর্বের ন্যায় সকলে পুনরায় প্রতিজ্ঞা ব্যক্ত করলেন। অতঃপর তিনিই প্রথম বায়‘আত করলেন। এরপর একের পর এক সকলে রাসূল (ছাঃ)-এর হাতে হাত রেখে অঙ্গীকার গ্রহণের মাধ্যমে সাধারণ বায়‘আত অনুষ্ঠিত হয়।

আববাস উক্ত আনছার প্রতিনিধি দলের প্রতি ভালভাবে লক্ষ্য করে দেখেন এবং বলেন যে, ‘এরা সবাই তরুণ বয়সের। এদেরকে আমি চিনিনা’। এতে প্রমাণিত হয় যে, উক্ত দলে যুবকদের আধিক্য ছিল। প্রতিনিধি দলের মহিলা দু’জনের বায়‘আত হয় মৌখিক অঙ্গীকারের মাধ্যমে। সৌভাগ্যবতী এই মহিলা দু’জন হ’লেন বনু মাযেন গোত্রের উম্মে ‘উমারাহ নুসাইবা বিনতে কা‘ব(أُمُّ عُمَارَةَ نُسَيْبَةُ بِنْتُ كَعْبٍ) এবং বনু সালামাহ গোত্রের উম্মে মানী‘ আসমা বিনতে ‘আমর(أُمُّ مَنِيْعٍ أَسْمَاء بِنْتُ عَمْرٍو)।[5] উবাদাহ বিন ছামেত (রাঃ) এই বায়‘আতকে ‘বায়‘আতুল হারব’ বা যুদ্ধের বায়‘আত বলে অভিহিত করেন।[6] কা‘ব বিন মালেকের বর্ণনায় এসেছে যে, প্রথম বায়‘আত করেন বারা বিন মা‘রূর। বনু আব্দিল আশহাল বলতো প্রথম বায়‘আতকারী ছিলেন তাদের গোত্রের আবুল হায়ছাম মালেক ইবনুত তাইয়েহান।[7] অবশ্য বনু নাজ্জার ধারণা করত যে, তাদের গোত্রের আস‘আদই প্রথম বায়‘আত করেন’ (ইবনু হিশাম ১/৪৪৭)। আর দলনেতা ও প্রথম দাঈ হিসাবে এটাই স্বাভাবিক। তবে আবেগের বসে কেউ আগে বায়‘আত করলে সেটাও অসম্ভব নয়।

[1]. আরবরা মহিলাদের উপনাম إزار অর্থাৎ তহবন্দ বলে থাকে। إزار এর বহুবচন হ’ল أُزُر (ইবনু হিশাম ১/৪৪২ টীকা-২)।
[2]. ইবনু হিশাম ১/৪৪২-৪৪৩; ইবনু কুতায়বা বলেন, আরবরা কোন সন্ধি চুক্তি করার সময় বলত,دَمِى دَمُكَ وَهَدْمِى هَدْمُكَ (يعنى الْحُرْمَة) ‘আমার রক্ত তোমার রক্ত, আমার ইযযত তোমার ইযযত’ (ঐ, টীকা -৬)।
[3]. ইবনু কাছীর, কুরতুবী হা/৩৪৯৪; তাফসীর সূরা তওবা ১১১ আয়াত; ইবনু জারীর হা/১৭২৮৪; সনদ ‘মুরসাল’।
[4]. আহমাদ হা/১৪৬৯৪ সনদ ছহীহ; হাকেম হা/৪২৫১, ২/৬২৪-২৫; আর-রাহীক্ব ১৫০ পৃঃ; ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা তওবাহ ১১১ আয়াত।
[5]. ইবনু হিশাম ১/৪৬৬-৬৭; আহমাদ হা/১৫৮৩৬; আর-রাহীক্ব ১৪৮ পৃঃ।
[6]. ইবনু হিশাম ১/৪৫৪; আহমাদ হা/২২৭৫২।
[7]. ইবনু হিশাম ১/৪৪৭; আহমাদ হা/১৫৮৩৬।




***********************************
সাইটটি ভিজিট করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আর্টিকেলটি ভাল লাগলে সত্য ও ন্যয়ের পথে অন্য ভাইনদেরকে দাওয়াতের নিয়তে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন। মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে এবং দীন ও মানবতার সেবায় অংশ নিতে OUR ACTION PLAN বাটনে ক্লিক করুন।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url