আয়াতুল কুরসীর বিস্ময়কর অন্ত্যমিল

আয়াতুল কুরসীর ভিতরে এত বিস্ময়!


আয়াতুল কুরসী সম্পর্কে এতদিন শুধু এটুকুই জানতাম যে, এটা তিলাওয়াত করলে এত এত নেকি হয়। ফেরেস্তারা প্রটেক্ট করে ইত্যাদি। কিন্তু এটার মাঝে যে এত মিরাকল, এত বিস্ময় লুকিয়ে আছে জানতাম না। ওস্তাদ নুমান আলি খানের কাছেই জানলাম কতো বিস্ময়ই না ধারন করছে আল কুরআনের সূরা বাকারা'র এই অংশটুকু। আপনাদের সাথে শেয়ার করছি। অনেকেই হয়তো জানেন সেটা। যারা জানেন না, তাদের জন্য।

আয়াতুল কুরসী'তে মোট বাক্য আছে নয়টি। মিরাকলটা বুঝার আগে কিছু হিন্টস দরকার, এতে সেটা বুঝতে অনেক সহজ হবে। মিরাকলটা হলো, এই নয় বাক্যের প্রত্যেকটি অন্যটির সাথে ভাবে, অলঙ্কারে, অর্থে হুবহু মিলে যাবে। কিন্তু মিলবিন্যাসটা হবে উল্টোদিক থেকে।

অর্থাৎ ১ নং বাক্যের সাথে একদম শেষ বাক্য।অর্থাৎ, ১ এর সাথে মিলবে ৯।
প্রথম দিক থেকে দ্বিতীয় ও শেষের দিক থেকে দ্বিতীয় অর্থাৎ ২ এর সাথে মিলবে ৮।
প্রথম দিক থেকে তৃতীয় ও শেষের দিক থেকে তৃতীয় অর্থাৎ ৩ এর সাথে মিলবে ৭।
প্রথম দিক থেকে চতূর্থ ও শেষের দিক থেকে চতূর্থ অর্থাৎ ৪ এর সাথে মিলবে ৬।
কিন্তু ৫ নং বাক্যে থাকবে একা। এটির সাথে কোন বাক্যের ম্যাচ হবেনা। আর, এটিও অন্যতম একটা বিস্ময়।
এবার সরাসরি আয়াতুল কুরসীতে চলে যাওয়া যাক। আমরা উপরে উল্লিখিত সিকোয়েন্স অনুযায়ী মিরাকলটা দেখবো। (১-৯) (২-৮) (৩-৭) (৪-৬) এভাবে। আয়াতুল কুরসীর প্রথম বাক্য হলো-
'আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন উপাস্য নেই, তিনি চিরঞ্জীব(হাইয়্যুল) ,চিরস্থায়ী(কাইয়্যুম) ।' খেয়াল করুন, উল্লিখিত বাক্যে আল্লাহর দুটি গুণ/অবস্থা/নাম(সিফাত) এর উল্লেখ আছে। একদম শেষ বাক্যে চলে যাই। শেষ বাক্য অর্থাৎ ৯ নং বাক্যটি হলো- ' তিনিই সর্বোচ্চ (আলিয়্যুল) এবং সর্বাপেক্ষা মহান (আজীম)।' দুই বাক্যেই আল্লাহর সিফাতের বর্ণনা,এবং দুটিতে আল্লাহর দুটি করে সিফাতের উল্লেখ আছে। (১ এর সাথে ৯ এর এটাই হলো সিকোয়েন্স)

দুই নম্বর বাক্যে যাওয়ার আগে একটা বিষয় জানা জরুরি। তা হলো- ঘুম আর তন্দ্রার মধ্যকার পার্থক্য। ইংরেজি, বাংলা ইত্যাদি ভাষায় 'ঘুম' আর 'তন্দ্রা' র জন্য আলাদা অর্থ নেই। এসব ভাষায় ঘুম মানে যা বোঝায়, তন্দ্রা মানেও তা বোঝা হয়। কিন্তু আরবিতে সেরকম না। ঘুম মানে- যখন আমরা একদম মৃত্যুর মত হয়ে যাই। কিছুর খেয়ালে থাকিনা। কিছুই বুঝিনা, কিছুই শুনিনা। আর তন্দ্রা হলো- ঘুমের প্রাথমিক পর্যায়। যেটাকে আমরা অন্যভাবে 'ঝিমুনি' বলি। তন্দ্রা কিন্তু ঘুম নয়, ঘুমের প্রাইমারি ষ্টেপ। আরবিতে ঘুমকে বলে- নাঊম। আর তন্দ্রা/ঝিমুনিকে বলে- 'সীনা'।

এইজন্যে ফজরের সালাতে মুয়াজ্জিন বলে- 'আচ্ছালতু খাইরুম মিনানাঊম'।ঘুম হতে সালাত উত্তম। মুয়াজ্জিন কিন্তু বলেনা- 'আচ্ছালাতু খাইরুম মিনাসসীনা'।

যাইহোক, আমরা বাক্যটি দেখি। বাক্যটির অর্থ হলো- 'তাঁকে তন্দ্রাও স্পর্শ করতে পারে না এবং নিদ্রাও নয়।' এটি হচ্ছে ২ নং বাক্য। এবার শেষ থেকে ৮ নং বাক্যটি দেখি। (কারন সিকোয়েন্স অনুযায়ী ২ এর সাথে ৮ এর মিলবিন্যাসের কথা বলেছি)। ৮ নং বাক্যটি হচ্ছে- 'আকাশ এবং জমিন নিয়ন্ত্রন করা  আল্লাহর জন্য কঠিন নয় (তিনি তাতে ক্লান্ত হন না)।'

খেয়াল করুন, ২ নং বাক্যে বলা হয়েছে- ঘুম আর তন্দ্রা আল্লাহকে স্পর্শ করেনা। আমাদের কখন ঘুম বা তন্দ্রা/ঝিমুনি আসে? যখন আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়ি। ৮ নং বাক্যেও আল্লাহ বলেছেন একইরকম কথা। 'আকাশ এবং জমিন নিয়ন্ত্রনে তিনি ক্লান্ত হন না'- কারন (২ নং বাক্যেই তিনি বলে এসেছেন, ঘুম এবং তন্দ্রা তাকে স্পর্শ করতে পারেনা।) ২ নং বাক্যের সাথে ৮ নং বাক্যের এই হলো অসাধারন মিল।

৩ নং বাক্যে যাওয়ার আগে আপনাকে আরো একটি বিষয়ে ক্লিয়ার হতে হবে। সেটি হচ্ছে- 'মালিক' দুই রকমের। একটি হচ্ছে ক্ষুদ্র জিনিসের মালিক, একটি বড় জিনিসের মালিক। একটির ব্যবহার ক্ষুদ্রার্থে, অন্যটি বৃহদার্থে। যেমন, আপনার হাতে একটি কলম থাকলে আপনি বলেন,- আমি এই কলমের মালিক। কিন্তু আপনি বলেন না যে,- আমি এই কলমের রাজা। কারন, কলম শব্দের মালিকানার সাথে 'রাজা' শব্দ ম্যাচ হয়না। রাজা শব্দটি ম্যাচ হয় বিশাল রাজত্ব বুঝাতে, যার ব্যাপ্তি বিশাল। 
এবার ৩ নং বাক্যটি দেখুন। বাক্যটি হলো- 'আসমান ও যমীনে (ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র)  যা কিছু রয়েছে, সবই তাঁর।' এবার ৭ নং বাক্যে কি আছে দেখুন। সেটি হলো- 'তাঁর সিংহাসন সমস্ত আসমান ও যমীনকে পরিবেষ্টিত করে আছে।'
এখানে লক্ষ্যনীয় ব্যাপার, ৩ নং বাক্যের বিষয় আর ৭ নং বাক্যের বিষয় একই। তা হলো- আল্লাহর মালিকানা। ৩ নং বাক্যে তিনি আসমান আর জমিনের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জিনিসের মালিকানা যে তার, সেটা ঘোষণা করেছেন, আর ৭ নং বাক্যে এতদমধ্যে, ক্ষুদ্র-বিশাল যা কিছু আছে, সব কিছুই যে তার, সেটার ঘোষণা। ৩ আর ৭ এর মধ্যে এটাই হলো আশ্চর্য রকম মিল।

এবার ৪ নম্বর বাক্যে যাওয়া যাক। এখানে বলা হচ্ছে- 'কে আছ এমন, যে সুপারিশ করবে তাঁর কাছে তাঁর অনুমতি ছাড়া?' খেয়াল করুন, আল্লাহ প্রশ্ন ছুড়ছেন, কে আছ এমন কিয়ামতের দিন সুপারিশ করার মতো আল্লাহর কাছে? এর ঠিক পরেই আল্লাহ একটা 'কিন্তু (but) লাগিয়ে বলছেন- 'আল্লাহর অনুমতি ছাড়া'। অর্থাৎ, কেউই সেদিন আল্লাহর কাছে সুপারিশ করতে পারবেনা।শুধু সেই-ই পারবে, যাকে তিনি পারমিশান দিবেন।
এবার শেষ থেকে ৬ নং বাক্যে যাই। সেখানে আল্লাহ বলছেন- 'তাঁর জ্ঞান সম্পর্কে তারা কোন কিছুই জানেনা কিন্তু ততটুকু (তারা জানতে পারে) যতটুকু তিনি ইচ্ছা করেন।' দেখুন, ৪ নম্বর বাক্যে বলা হলো- সেদিন কেউ সুপারিশ করতে পারবেনা, শুধু সে ব্যতীত যাকে তিনি পারমিশান দিবেন। 
প্রথমে বলেছেন কারো ক্ষমতা নেই সুপারিশের যতক্ষন না তিনি অনুমতি দিচ্ছেন। ৬ নম্বর বাক্যে বলছেন, - তার জ্ঞান সম্পর্কে কেউই জানেনা, যতক্ষন না তিনি ইচ্ছামাফিক কাউকে জানাচ্ছেন। দুটি বাক্যেই দুটি করে Clause ব্যবহৃত হয়েছে। এটিই হলো ৪ আর ৬ মধ্যে চমৎকার মিলবিন্যাস।

আর বাকি রইলো- ৫।
১ এর সাথে ৯ গেলো। ২ এর সাথে ৮। ৩ এর সাথে ৭। ৪ এর সাথে ৬।
৫ রয়ে গেলো একা। মোষ্ট সারপ্রাইজিং ম্যাটার ইজ, এই ৫ নং বাক্যে এমন কিছু বলা হয়েছে, যার সম্পর্কে ১-৪ বা ৬-৯ কোথাও কিছু বলা হয়নি। পুরো ৯ বাক্যের মধ্যের বাক্য হচ্ছে এই ৫ নম্বর বাক্যটি।আর, ১-৪ এবং ৬-৯ বাক্যগুলোর মধ্যে অসাধারন এক সামঞ্জস্য নিয়ে বলা হয়েছে এই বাক্যে। বাক্যটি হলো- 'দৃষ্টির সামনে কিংবা পিছনে যা কিছু রয়েছে সে সবই তিনি জানেন।'
খেয়াল করুন, বাক্যটি এমন এক জায়গায় (৫ নম্বরে), যার আগের বাক্য আর পরের বাক্যে আল্লাহ তার রাজত্ব, ক্ষমতা, গুণ, সিফাত, সৃষ্টির কথা বলেছেন।

তিনি বাক্যটি একদম মাঝখানে দিলেন, আর বলছেন  'এর সামনে পেছনে যা আছে তার সবই আমি জানি।' এরকম করে কোন সাহিত্যিক, কোন কবি কি বলতে পারবেন?

শুরুর প্রথম বাক্যের সাথে শেষের শেষ বাক্যের মিল। শুরুর দ্বিতীয় বাক্যের সাথে শেষের দ্বিতীয় বাক্যের মিল। শুরুর তৃতীয় বাক্যের সাথে শেষের তৃতীয় বাক্য। শুরুর চতুর্থ বাক্যের সাথে শেষের চতুর্থ বাক্য।
আর, তার মাঝখানে এমন একটি বাক্য যা সমন্বয় করছে আগে পরের সবকিছু? সুবাহান আল্লাহ ওয়া বিহামদিহি! কুরআনের এমন ভাষা শৈলি, এমন বর্ণনা ভঙ্গি, এমন চমৎকার উপস্থাপন।
এইজন্যেই আল্লাহ সুবাহান ওয়া'তালা  বার বার চ্যালেঞ্জ করেছেন- 'তোমরা (অবিশ্বাসীরা) যদি পারো অন্তত এর মতো (কুরআনের মত) একটি আয়াত লিখে আনো।' সেই কুরআনকে বাদ দিয়ে আমরা হিন্দি গান, সিরিয়াল, পপ গান, মুভি ধরেছি।
ভাষা, সাহিত্য, বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ কুরআনকে স্থান দিয়েছি ড্রয়ারে। কাপড় পেছানো অবস্থায়। কতোই না অবহেলিত ভাবে ফেলে রেখেছি।

এই জন্যে মি. গ্লাডষ্টোন ব্রিটিশ পার্লামেন্টে কুরআন হাতে নিয়ে বলেছিলেন,- 'যতদিন এই কুরআন মুসলমানদের হাতে থাকবে (তারা এটা বুঝবে, এটা নিয়ে ভাববে, আমল করবে), ততদিন তাদেরকে আমরা আমাদের দাসে পরিণত করতে পারবোনা।'
আজ আমরা কোরআন নিয়ে ভাবিনা, চিন্তা করিনা, বুঝতে চাইনা। তাই আমরা দিন দিন পশ্চিমা দাসে পরিণত হচ্ছি।

এবার আসুন ওস্তাদ নুমান আলীর লেকচারটা শুনি:




****************************************
>>> Welcome, You are now on Mohammadia Foundation's Website. Please stay & Tune with us>>>

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url