প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর জীবনী [পর্ব- ৪৪] || মহানবীর জীবনী ||




মক্কা বিজয়ের ঘটনাবহুল অভিযাত্রা

[পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ট মহামানব আমাদের প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:)। যাকে আল্লাহ সমস্ত মানুষের জন্য অশেষ রহমত স্বরূপ এই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। যে নবী সারা জীবন উম্মতের জন্য সংগ্রাম করেছেন, কাল রোজ হাশরের মাঠেও যিনি উম্মতের জন্যই পেরেশান থাকবেন ইয়া উম্মতি ইয়া উম্মতি বলে বিচলিত হবেন; সেই প্রাণপ্রিয় নবীকে আমরা কতটুকু চিনি, কতটুকু জানি? প্রিয় নবী (সা:) এর জীবনের পরতে পরতে রয়েছে আমাদের জন্য শিক্ষা ও অনুপ্রেরণা। যার জীবনী পড়লে নিজের অজান্তেই চোখের পানি গড়িয়ে পড়ে। সেই নবীর জীবনী কি আমরা সত্যিই জানি? আসুন, আরেকবার দেখে নেই “প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর জীবনী”। যে জীবনী পড়ে বদলে যেতে পারে আপনার আমার জীবন। আমরা এখানে প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর বিশাল কর্মময় জীবনকে ৬৭টি সুবিশাল পর্বে তুলে ধরেছি। আল্লাহ আমাদের সবাইকে প্রাণপ্রিয় নবীর (সা:) উম্মত হিসাবে কবুল করুন। আমিন।।]

বনু খোযা‘আহ গোত্রের পরিচয়

বনু খোযা‘আহ গোত্রের সাথে বনু হাশেমের মৈত্রীচুক্তি আব্দুল মুত্ত্বালিবের যুগ হতেই চলে আসছিল। কুরায়েশ বংশের প্রবাদ প্রতীম নেতা কুছাই বিন কিলাবের স্ত্রী অর্থাৎ ‘আব্দে মানাফের মা ছিলেন খোযা‘আহ গোত্রের মহিলা। সে হিসাবে বনু হাশেমকে তারা তাদের সন্তান মনে করত। তারও পূর্বের ঘটনা এই যে, বনু খোযা‘আহ ছিল এক সময় বায়তুল্লাহর তত্ত্বাবধায়ক ও মক্কার শাসকগোত্র। তাদের সর্বশেষ নেতা ‘হুলাইল’(حُلَيْل) তার কন্যা হুবাই (حُبَيّ) বা হুববা (حُبَّى)-কে কুছাই বিন কিলাবের সাথে বিবাহ দেন এবং বিয়ের সময় বায়তুল্লাহর মুতাওয়াল্লীর দায়িত্ব কন্যাকে অর্পণ করেন। সাথে সাথে আবু গুবশান(أبو غُبْشَان) কে কন্যার উকিল নিয়োগ করেন। হুলাইলের মৃত্যুর পর আবু গুবশান এক মশক শরাবের বিনিময়ে তার উকিলের দায়িত্ব কুছাইকে অর্পণ করেন। এভাবে কুছাই বিন কিলাব তার স্ত্রীর উকিল হিসাবে বায়তুল্লাহর তত্ত্বাবধায়ক নিযুক্ত হন। তাছাড়া বনু খোযা‘আহ ধারণা করত যে, তাদের নেতা হুলাইল তার জামাতা কুছাইকে পরবর্তী নেতা হিসাবে অছিয়ত করে গেছেন। অতঃপর কুছাই তার মেধা ও দূরদর্শিতার বদৌলতে বিভক্ত কুরায়েশ বংশকে ঐক্যবদ্ধ করেন এবং তার অবিসংবাদিত নেতা হিসাবে বরিত হন (ইবনু হিশাম ১/১১৭-১৮)।

উপরোক্ত বিষয়গুলি বিবেচনা করে বনু খোযা‘আহ সর্বদা বনু হাশেমের মিত্র হিসাবে থাকত। মুসলমান না হওয়া সত্ত্বেও কেবল বনু হাশেমের সন্তান হিসাবে তারা সর্বদা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর পক্ষে অবস্থান নিত।

বনু খোযা‘আহর আবেদনে রাসূল (ছাঃ)-এর সাড়া

এরপর বনু খোযা‘আহর আরেকটি প্রতিনিধিদল নিয়ে বুদাইল বিন অরক্বা আল-খোযাঈ(بُدَيْلُ بنُ وَرْقَاءَ الْخُزَاعِيُّ) আগমন করেন এবং তাদের গোত্রের কারা কারা নিহত হয়েছে ও কুরায়েশরা কিভাবে বনু বকরকে সাহায্য করেছে, তার পূর্ণ বিবরণ পেশ করেন। রাসূল (ছাঃ) তাদের আবেদনে সাড়া দেন। অতঃপর তারা মক্কায় ফিরে যান।[1]

[1]. আর-রাহীক্ব ৩৯৫ পৃঃ; ইবনু হিশাম ২/৩৯৪-৯৬; যাদুল মা‘আদ ৩/৩৪৯।

এখানে নিম্নোক্ত বিষয়গুলি প্রসিদ্ধ আছে। যেমন, (১) কুরায়েশদের চুক্তিভঙ্গের খবর পৌঁছবার তিন দিন আগেই আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) স্ত্রী আয়েশাকে সফরের জন্য প্রস্ত্ততি গ্রহণের আদেশ দেন- যা কেউ জানত না। পিতা আবুবকর (রাঃ) কন্যা আয়েশাকে জিজ্ঞেস করলেন, يَابُنَيَّةُ، مَا هَذَا الْجِهَازُ؟ ‘হে কন্যা! এসব কিসের প্রস্ত্ততি? কন্যা জবাব দিলেন وَاللهِ مَا أَدْرِيْ ‘আল্লাহর কসম! আমি জানি না’। আবু বকর (রাঃ) বললেন, এখন তো রোমকদের সঙ্গে যুদ্ধের সময় নয়। তাহ’লে রাসূল (ছাঃ) কোন দিকের এরাদা করেছেন? আয়েশা (রাঃ) আবার বললেন, وَاللهِ لاَ عِلْمَ لِيْ ‘আল্লাহর কসম! এ বিষয়ে আমার কিছুই জানা নেই’। দেখা গেল যে, তৃতীয় দিন ‘আমর ইবনু সালেম আল-খোযাঈ ৪০ জন সঙ্গী নিয়ে হাযির হ’লেন। তখন লোকেরা চুক্তিভঙ্গের খবর জানতে পারল’ (ত্বাবারাণী কাবীর হা/১০৫২; ঐ, ছগীর হা/৯৬৮; ইবনু হিশাম ২/৩৯৭; যাদুল মা‘আদ ৩/৩৫১; আর-রাহীক্ব ৩৯৭ পৃঃ)। বর্ণনাটি যঈফ (আর-রাহীক্ব, তা‘লীক্ব ১৭১ পৃঃ)।

(২) ‘আমর বিন সালেম-এর মর্মস্পর্শী কবিতা শোনার পর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলে ওঠেন, نُصِرْتَ يَا عَمْرَو بْنَ سَالِمٍ ‘তুমি সাহায্যপ্রাপ্ত হয়েছ হে ‘আমর ইবনু সালেম’! (সীরাহ ছহীহাহ ২/৪৭৩, সনদ যঈফ)। এমন সময় আসমানে একটি মেঘখন্ডের আবির্ভাব হয়। তা দেখে রাসূল (ছাঃ) বলে ওঠেন, إنَّ هَذِهِ السَّحَابَةَ لَتَسْتَهِلُّ بِنَصْرِ بَنِيْ كَعْبٍ ‘এই মেঘমালা বনু কা‘বের সাহায্যের শুভ সংবাদে চমকাচ্ছে’ (আর-রাহীক্ব ৩৯৫ পৃঃ)। বর্ণনাটি যঈফ (ঐ, তা‘লীক্ব ১৬৯-৭০ পৃঃ)।

(৩) সন্ধিচুক্তি ভঙ্গের পর করণীয় সম্পর্কে আলোচনার জন্য রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ছাহাবায়ে কেরামকে নিয়ে বৈঠকে বসেন। এক সময় আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বলে ওঠেন, كَأَنّكُمْ بِأَبِيْ سُفْيَانَ قَدْ جَاءَكُمْ لِيَشُدَّ الْعَقْدَ وَيَزِيْدَ فِي الْمُدَّةِ ‘আমি যেন তোমাদেরকে আবু সুফিয়ানের সাথে দেখছি যে, সে মদীনায় আসছে তোমাদের কাছে চুক্তি পাকাপোক্ত করার জন্য এবং মেয়াদ বাড়ানোর জন্য’ (আর রাহীক্ব ৩৯৬ পৃঃ; ইবনু হিশাম ২/৩৯৫; যাদুল মা‘আদ ৩/৩৪৯)। বর্ণনাটির সনদ ‘মুরসাল’ (তাহকীক ইবনু হিশাম ক্রমিক ১৬৫৬)।

(৪) দূরদর্শী আবু সুফিয়ান সন্ধিচুক্তি নবায়নের জন্য দ্রুত মদীনায় আসেন এবং তার কন্যা উম্মুল মুমিনীন উম্মে হাবীবাহর গৃহে গমন করেন। এসময় তিনি বিছানায় বসতে উদ্যত হ’লে কন্যা দ্রুত সেটি গুটিয়ে নিয়ে বলেন, هَذَا فِرَاشُ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَأَنْتَ رَجُلٌ مُشْرِكٌ نَجَسٌ ‘এটি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর বিছানা। এখানে আপনার বসার অধিকার নেই। কেননা আপনি অপবিত্র মুশরিক’। অতঃপর আবু সুফিয়ান বেরিয়ে জামাতা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর কাছে গেলেন ও সব কথা বললেন। কিন্তু রাসূল (ছাঃ) কোন কথা বললেন না। নিরাশ হয়ে তিনি আবুবকর (রাঃ)-এর কাছে গেলেন। অতঃপর ওমর-এর নিকটে অতঃপর আলী ও ফাতেমার নিকটে গেলেন। এমনকি হাসান-এর দোহাই দিয়ে বললেন, তোমাদের পুত্র আগামী দিনে নেতা হবে। তার দোহাই দিয়ে বলছি, তোমরা রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে গিয়ে আমার বিষয়ে অনুরোধ কর। কিন্তু সবাই অপারগতা প্রকাশ করলেন। অবশেষে আবু সুফিয়ান মসজিদে নববীতে গিয়ে দাঁড়ালেন ও লোকদের উদ্দেশ্যে বললেন, أَيُّهَا النَّاسُ إنِّيْ قَدْ أَجَرْتُ بَيْنَ النَّاسِ ‘হে লোকসকল! আমি সকলের মাঝে আশ্রয় প্রার্থনার ঘোষণা দিচ্ছি’। অতঃপর বেরিয়ে উটে সওয়ার হয়ে মক্কার পথে রওয়ানা হয়ে যান। আবু সুফিয়ান মক্কায় এসে নেতাদের নিকটে সব কথা পেশ করেন এবং তাদের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার জবাবে বলেন, وَاللهِ مَا وَجَدْتُّ غَيْرَ ذَلِكَ ‘আল্লাহর কসম! এছাড়া আমি আর কোন পথ খুঁজে পাইনি’ (ইবনু হিশাম ২/৩৯৬-৯৭; আর-রাহীক্ব ৩৯৫-৯৭ পৃঃ)। উক্ত বর্ণনাগুলি সনদবিহীন ও ‘মুরসাল’ (মা শা-‘আ ১৮৮ পৃঃ)।

বরং এ বিষয়ে সঠিক কথা এটাই যে, মক্কা বিজয়ের অভিযানের বিষয়টি একেবারেই গোপন ছিল এবং হঠাৎ করেই রাসূল (ছাঃ) এ অভিযানে যাত্রা করেন। কোনদিকে যাবেন সেটাও সাথীরা জানতেন না। অতঃপর যখন রাসূল (ছাঃ) মক্কার উপকণ্ঠে উপনীত হন এবং কুরায়েশদের কাছে এ খবর পৌছে যায়, তখন আবু সুফিয়ান বিন হারব, হাকীম বিন হেযাম, বুদায়েল বিন অরক্বা প্রমুখ নেতাগণ রাতের অন্ধকারে খবর সংগ্রহ করতে বের হন। এসময় রাসূল (ছাঃ)-এর পাহারাদারগণ তাদেরকে ধরে ফেলেন। .... ‘অতঃপর আবু সুফিয়ান ইসলাম কবুল করেন’ (বুখারী হা/৪২৮০)।

(৫) অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সবাইকে মক্কা গমনের জন্য প্রস্ত্ততি গ্রহণের নির্দেশ দিলেন এবং আল্লাহর নিকটে দো‘আ করলেন-اللَّهُمَّ خُذِ الْعُيُوْنَ وَالْأَخْبَارَ عَنْ قُرَيْشٍ حَتَّى نَبْغَتَهَا فِيْ بِلاَدِهَا ‘হে আল্লাহ! তুমি কুরায়েশদের নিকটে গোয়েন্দা রিপোর্ট এবং এই অভিযানের খবর পৌঁছানোর পথ সমূহ বন্ধ করে দাও। যাতে ওদের অজান্তেই আমরা তাদের শহরে হঠাৎ উপস্থিত হ’তে পারি’ (আর-রাহীক্ব ৩৯৭ পৃঃ; আলবানী, ফিক্বহুস সীরাহ ৩৭৫ পৃঃ, সনদ যঈফ)।
 রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর প্রস্ত্ততি (استعداد الرسول صـ للغزوة)
অতঃপর বাহ্যিক কৌশল হিসাবে তিনি আবু ক্বাতাদাহ হারেছ বিন রিব্‘ঈ(أَبُو قَتَادَةَ الْحَارِث بن رِبْعِي) এর নেতৃত্বে ৮ সদস্যের একটি দলকে ১লা রামাযান তারিখে ‘ইযাম’(بَطْن إِضَم) উপত্যকার দিকে রওয়ানা করে দেন। যাতে শত্রুরা ভাবে যে, অভিযান ঐদিকেই পরিচালিত হবে। পরে তারা গিয়ে পথিমধ্যে রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে মিলিত হন।[1]

[1]. ওয়াক্বেদী, কিতাবুল মাগাযী, ‘মক্কা বিজয়ের যুদ্ধ’ অনুচ্ছেদ, ২/৩২৩; আর-রাহীক্ব ৩৯৭ পৃঃ।

মক্কা অভিযান পরিকল্পনা ফাঁসের ব্যর্থ চেষ্টা ও চিঠি উদ্ধার

বদর যুদ্ধের নিবেদিতপ্রাণ ছাহাবী এবং রাসূল (ছাঃ)-এর দান্দান মুবারক শহীদকারী উৎবা বিন আবু ওয়াকক্বাছের হত্যাকারী (ইয়ামন প্রত্যাগত-কুরতুবী) প্রসিদ্ধ বীর হাতেব বিন আবু বালতা‘আহ (রাঃ) রাসূল (ছাঃ)-এর আসন্ন মক্কা অভিযানের খবর দিয়ে একটি পত্র লিখে একজন মহিলার মাধ্যমে গোপনে মক্কায় প্রেরণ করেন। অহি-র মাধ্যমে অবগত হয়ে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) আলী, যুবায়ের ও মিক্বদাদ (রাঃ)-কে দ্রুত পশ্চাদ্ধাবনের নির্দেশ দিয়ে বলেন, তোমরা ‘খাখ’(رَوْضَةُ خَاخ) নামক বাগিচায় গিয়ে একজন হাওদানশীন মহিলাকে পাবে, যার কাছে কুরায়েশদের নিকটে লিখিত একটি পত্র রয়েছে’। তারা অতি দ্রুত পিছু নিয়ে ১২ মাইল দূরে ঠিক সেখানে গিয়েই মহিলাকে পেলেন ও তাকে পত্রের কথা জিজ্ঞেস করলেন। মহিলা অস্বীকার করলে তার হাওদা তল্লাশি করা হল। কিন্তু না পেয়ে আলী (রাঃ) তাকে বললেন, مَا كَذَبَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، لَتُخْرِجِنَّ الْكِتَابَ أَوْ لَنُجَرِّدَنَّكِ ‘আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) মিথ্যা বলেননি। আল্লাহর কসম! অবশ্যই তুমি চিঠিটি বের করে দিবে। নইলে অবশ্যই আমরা তোমাকে উলঙ্গ করব’। তখন মহিলা ভয়ে তার মাথার খোঁপা থেকে চিঠিটা বের করে দিল। পত্রখানা নিয়ে তারা মদীনায় ফিরে এলেন।

তখন হাতেবকে ডেকে রাসূল (ছাঃ) কারণ জিজ্ঞেস করলেন। জবাবে তিনি বললেন,يَا رَسُولَ اللهِ، لاَ تَعْجَلْ عَلَىَّ، مَا بِىْ إِلاَّ أَنْ أَكُوْنَ مُؤْمِنًا بِاللهِ وَرَسُولِهِ، وَمَا غَيَّرْتُ وَلاَ بَدَّلْتُ ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমার ব্যাপারে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিবেন না। আল্লাহর কসম! আমি অবশ্যই আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উপরে বিশ্বাসী। আমার মধ্যে কোনরূপ পরিবর্তন আসেনি বা আমি আমার দ্বীন বদল করিনি’। তবে ব্যাপারটি হল এই যে, আমি কুরায়েশদের গোত্রভুক্ত নই। বরং একজন চুক্তিবদ্ধ মিত্র (حَلِيف) মাত্র। তাদের মধ্যে রয়েছে আমার পরিবার ও সন্তান-সন্ততি। তাদের সাথে আমার কোন আত্মীয়তা নেই, যারা তাদের হেফাযত করবে। অথচ আপনার সাথে যেসকল মুহাজির আছেন, তাদের সেখানে আত্মীয়-স্বজন আছে, যারা তাদের পরিবারকে নিরাপত্তা দিতে পারে। এজন্য আমি চেয়েছিলাম যে, তাদের প্রতি কিছুটা সহানুভূতি দেখাই, যাতে তারা আমার পরিবারকে নিরাপত্তা দেয়। وَلَمْ أَفْعَلْهُ ارْتِدَادًا عَنْ دِينِى، وَلاَ رِضًا بِالْكُفْرِ بَعْدَ الإِسْلاَمِ ‘আমি এটা আমার দ্বীন থেকে ‘মুরতাদ’ হয়ে করিনি বা ইসলামের পরে কুফরীতে খুশী হয়ে করিনি’। রাসূল (ছাঃ) বললেন, صَدَقَ فَلاَ تَقُولُوا لَهُ إِلاَّ خَيْرًا ‘সে সত্য বলেছে। অতএব তোমরা তার সম্পর্কে ভালো ব্যতীত কিছু বলো না’।

তখন ওমর (রাঃ) বলে উঠলেন, إِنَّهُ قَدْ خَانَ اللهَ وَرَسُولَهُ وَالْمُؤْمِنِينَ فَدَعْنِى فَلْأَضْرِبَ عُنُقَهُ ‘সে আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং মুমিনদের সাথে খেয়ানত করেছে। আমাকে ছেড়ে দিন আমি এর গর্দান উড়িয়ে দেই’ (বুখারী হা/৩৯৮৩)। অন্য বর্ণনায় এসেছে,دَعْنِى أَضْرِبْ عُنُقَ هَذَا الْمُنَافِقِ আমাকে ছেড়ে দিন এই মুনাফিকটার গর্দান উড়িয়ে দেই’ (বুখারী হা/৩০০৭)। জবাবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, إِنَّهُ قَدْ شَهِدَ بَدْرًا ‘সে বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল’। তোমার কি জানা নেই হে ওমর! আহলে বদর সম্পর্কে আল্লাহ বলেছেন (হাদীছে কুদসী),اِعْمَلُوْا مَا شِئْتُمْ فَقَدْ غَفَرْتُ لَكُمْ ‘তোমরা যা খুশী করো, আমি তোমাদের ক্ষমা করে দিয়েছি’। একথা শুনে ওমরের দু’চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে গেল এবং তিনি বললেন, ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসূল অধিক জ্ঞাত’।

অতঃপর আয়াত নাযিল হ’ল,يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لاَ تَتَّخِذُوا عَدُوِّي وَعَدُوَّكُمْ أَوْلِيَاءَ تُلْقُونَ إِلَيْهِمْ بِالْمَوَدَّةِ وَقَدْ كَفَرُوا بِمَا جَاءَكُمْ مِنَ الْحَقِّ يُخْرِجُونَ الرَّسُولَ وَإِيَّاكُمْ أَنْ تُؤْمِنُوا بِاللَّهِ رَبِّكُمْ إِنْ كُنْتُمْ خَرَجْتُمْ جِهَادًا فِي سَبِيلِي وَابْتِغَاءَ مَرْضَاتِي تُسِرُّونَ إِلَيْهِمْ بِالْمَوَدَّةِ وَأَنَا أَعْلَمُ بِمَا أَخْفَيْتُمْ وَمَا أَعْلَنْتُمْ وَمَنْ يَفْعَلْهُ مِنْكُمْ فَقَدْ ضَلَّ سَوَاءَ السَّبِيلِ ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আমার শত্রু ও তোমাদের শত্রুকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। তোমরা তাদের সাথে বন্ধুত্ব করছ, অথচ তারা তোমাদের নিকট যে সত্য এসেছে, তার সাথে কুফরী করেছে। তারা রাসূলকে ও তোমাদেরকে বহিষ্কার করেছে এই কারণে যে, তোমরা তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহর উপরে ঈমান এনেছ। যদি তোমরা আমার সন্তুষ্টি লাভের জন্য আমার রাস্তায় জিহাদের উদ্দেশ্যে বের হয়ে থাক, তাহলে তোমরা তাদের সাথে গোপনে বন্ধুত্ব করো না। কেননা তোমরা যা গোপন কর এবং যা প্রকাশ কর, তা আমি ভালভাবে অবগত। যে ব্যক্তি তোমাদের মধ্যে এ কাজ করবে, সে সরল পথ থেকে বিচ্যুত হবে’ (মুমতাহিনা ৬০/১)।[1]

[1]. বুখারী হা/৩৯৮৩, ৪২৭৪ ‘মাগাযী’ অধ্যায়, ‘বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের মর্যাদা’ অনুচ্ছেদ ৯ এবং অনুচ্ছেদ ৪৬।

রাসুলুল্লাহ (সা:) এর মু‘জেযা ও বিধানসমূহ

গোপনে পত্র প্রেরণের তথ্য উদঘাটনের ফলে অত্র ঘটনায় রাসূল (ছাঃ)-এর মু‘জিযা প্রকাশিত হয়েছে। এর দ্বারা এই বিধানও জানা গেছে যে, প্রয়োজনে গুপ্তচরের লজ্জাস্থান নগ্ন করা যাবে। তাছাড়া এই বিধানও জারী হয়েছে যে, কবীরা গুনাহগার মুমিন ব্যক্তি কর্মগত কুফরী করলেও সে বিশ্বাসগতভাবে কাফের হয় না। যেমন এক্ষেত্রে হাতেব (রাঃ) কাফের হননি।

মক্কার পথে মুসলিম বাহিনীর রওয়ানা

৮ম হিজরীর ৭ই রামাযান শুক্রবার ১০,০০০ সাথী নিয়ে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) মক্কা অভিমুখে রওয়ানা হন। এই সময় মদীনার প্রশাসক নিযুক্ত করে যান আবু রুহুম কুলছূম আল-গেফারী-কে (হাকেম হা/৬৫১৭)। মুহাজির ও আনছারদের সকলেই অত্র অভিযানে যোগদান করেন। এতদ্ব্যতীত মদীনার আশপাশের নওমুসলিম গোত্রসমূহ যেমন আসলাম, গেফার, মুযায়না, জোহায়না, বনু সোলায়েম, আশজা‘ প্রভৃতি গোত্র সমূহ এই সাথে গমন করে। এদের মধ্যে মুযায়না গোত্রের এক হাযার ও বনু সুলায়েম-এর এক হাযার সৈন্য ছিল’ (সীরাহ ছহীহাহ ২/৪৭৪)। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, এদিন রাসূল (ছাঃ) ছিয়াম অবস্থায় ছিলেন। সাথীগণের কেউ ছায়েম ছিলেন, কেউ ছিলেন না। অতঃপর মক্কা থেকে ৪২ মাইল দূরে কুরাউল গামীম পৌঁছে তিনি এক পাত্র পানি চাইলেন এবং তা উঁচু করে সবাইকে দেখিয়ে পান করে দিনের বেলায় ছিয়াম ভঙ্গ করলেন’... (মুসলিম হা/১১১৩-১৪)। স্থানটি ছিল আমাজ ও ওসফানের মধ্যবর্তী কুদাইদ নামক স্থানে(كَانَ بِالْكُدَيْدِ، بَيْنَ عُسْفَانَ وَأَمَجٍ)।[1] কুদাইদ ছিল মক্কা থেকে ৪২ মাইল দূরে একটি ঝর্ণাধারার নাম(الكديد عين جارية على اثنين وأربعين ميلا من مكة)।[2]

[1]. ইবনু হিশাম ২/৪০০।
[2]. মুসলিম, শরহ নববী হা/১১১৩-এর ব্যাখ্যা।

মক্কার পথিমধ্যের ঘটনাবলী

আববাস-এর সাথে সাক্ষাৎ

মদীনা থেকে মক্কার পথে ১৮৭ কি. মি. দূরে জুহফা (الْجُحْفَة) বা তার কিছু পরে পৌঁছে রাসূল (ছাঃ)-এর প্রিয় চাচা আববাস বিন আব্দুল মুত্ত্বালিবের সাথে সাক্ষাৎ হয়। যিনি পরিবার-পরিজনসহ মুসলমান হয়ে মদীনার পথে হিজরতে বের হয়েছিলেন। যদিও আববাস খায়বর বিজয়ের পূর্বেই ইসলাম কবুল করেছিলেন। উল্লেখ্য যে, আববাস ছিলেন রাসূল (ছাঃ)-এর বিশ্বস্ত চাচা। যিনি কুরায়েশদের খবরাখবর গোপনে তাঁকে সরবরাহ করতেন এবং আবু তালেবের পরে তিনিই ছিলেন মক্কায় দুর্বল মুসলমানদের প্রধান আশ্রয়স্থল।

চাচাতো ও ফুফাতো ভাইয়ের সাথে সাক্ষাৎ

মদীনা থেকে দক্ষিণে মক্কার পথে ২৫০ কি. মি. দূরে আবওয়া (الْأَبْوَاء), যেখানে রাসূল (ছাঃ)-এর মা আমেনার কবর রয়েছে- সেখানে রাসূল (ছাঃ)-এর চাচাতো ভাই ও দুধ ভাই আবু সুফিয়ান মুগীরাহ ইবনুল হারেছ বিন আব্দুল মুত্ত্বালিব এবং ফুফাতো ভাই আব্দুল্লাহ বিন আবু উমাইয়া বিন মুগীরাহর সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। শেষোক্ত ব্যক্তি উম্মুল মুমিনীন উম্মে সালামার বিমাতা ভাই ছিলেন। তাদের সম্পর্কে উম্মে সালামা অনুরোধ করলে রাসূল (ছাঃ) বলেন, তাদের কাছে আমার কোন প্রয়োজন নেই’। চাচাতো ভাই মক্কায় আমার সম্মান বিনষ্ট করেছে এবং ফুফাতো ভাই মক্কায় আমার সম্পর্কে নানারূপ কুৎসা রটনা করেছে’। অতঃপর এ খবর জানতে পেরে তারা বলে উঠলেন, আল্লাহর কসম! হয় আল্লাহর রাসূল আমাদেরকে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের অনুমতি দিবেন, না হয় আমরা আমাদের সন্তানাদি নিয়ে একদিকে চলে যাব। অতঃপর ক্ষুধায়-তৃষ্ণায় মারা যাব’। একথা শুনে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর অন্তর নরম হল এবং তাদেরকে অনুমতি দিলেন’ (অতঃপর তারা ইসলাম কবুল করলেন)।[1]

অন্যদিকে হযরত আলী (রাঃ) আবু সুফিয়ান মুগীরাহ ইবনুল হারেছকে শিখিয়ে দিলেন যে, তুমি রাসূল (ছাঃ)-এর সম্মুখে গিয়ে সেই কথাগুলি বল, যা ইউসুফের ভাইয়েরা তাঁকে বলেছিলেন- تَاللهِ لَقَدْ آثَرَكَ اللهُ عَلَيْنَا وَإِنْ كُنَّا لَخَاطِئِيْنَ ‘আল্লাহর কসম! আল্লাহ আপনাকে আমাদের উপরে প্রাধান্য দিয়েছেন এবং আমরা অবশ্যই অপরাধী ছিলাম’ (ইউসুফ ১২/৯১)। আবু সুফিয়ান ইবনুল হারেছ তাই করলেন। আর সাথে সাথে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) সেই জবাবই দিলেন, যা ইউসুফ (আঃ) তার ভাইদের দিয়েছিলেন- لاَ تَثْرَيْبَ عَلَيْكُمُ الْيَوْمَ يَغْفِرُ اللهُ لَكُمْ وَهُوَ أَرْحَمُ الرَّاحِمِيْنَ ‘আজ তোমাদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নেই। আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করুন। তিনি হলেন দয়ালুদের সেরা দয়ালু’ (ইউসুফ ১২/৯২)।

আবু সুফিয়ান ইবনুল হারেছ ছিলেন আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি এবং রাসূল (ছাঃ)-এর বড় চাচা হারেছ-এর পুত্র। তিনিও হালীমা সা‘দিয়াহর দুধ পান করেছিলেন। সেকারণে রাসূল (ছাঃ) ছিলেন তার দুধ ভাই। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) তাকে ক্ষমা করে দিলে খুশীতে তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে নয় লাইনের একটি কবিতা পাঠ করেন। যার মধ্যে ৩য় লাইনে তিনি বলেন,

هَدَاني هادٍ غيرُ نفسي ودَلَّني * على الله مَنْ طَرَّدتُ كُلَّ مُطَرَّدٍ

‘আমার নফস ব্যতীত অন্য একজন পথপ্রদর্শক আমাকে পথ দেখিয়েছেন এবং আমাকে আল্লাহর পথের সন্ধান দিয়েছেন, যাকে সকল প্রকারের তিরষ্কারের মাধ্যমে আমি তাড়িয়ে দিতাম’। একথা শুনে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তার বুকে থাবা মেরে বললেন, হ্যাঁ।أَنْتَ طَرَّدْتَنِيْ كُلَّ مُطَرَّدٍ ‘তুমিই তো আমাকে সর্বদা তাড়িয়ে দিতে’।[2]

ইসলাম গ্রহণের পর থেকে তিনি কখনো লজ্জায় রাসূল (ছাঃ)-এর সামনে মাথা উঁচু করে কথা বলতেন না। মক্কা বিজয়ের মাত্র ১৯ দিন পরে হোনায়েনের যুদ্ধে যে কয়জন ছাহাবী রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে দৃঢ়ভাবে অবস্থান নিয়েছিলেন, তিনি ছিলেন তাদের অন্যতম। তিনি কোনমতেই রাসূল (ছাঃ)-এর উটের লাগাম ছাড়েননি। তাঁর ছেলে জা‘ফর হোনায়েন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। দুই ছেলে জা‘ফর ও আব্দুল্লাহ ছাহাবী ছিলেন। রাসূল (ছাঃ) তাকে খুবই ভালবাসতেন এবং বলতেন,أَرْجُو أَنْ يَكُوْنَ خَلَفًا مِنْ حَمْزَةَ ‘আশা করি তিনি হামযাহর স্থলাভিষিক্ত হবেন’। তিনি তার জন্য জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছিলেন। তিনি হোদায়বিয়ার সন্ধির প্রাক্কালে বায়‘আতুর রিযওয়ানে উপস্থিত ছিলেন। রাসূল (ছাঃ)-এর ওফাতের পর তিনি যে ১০ লাইনের শোকগাথা পাঠ করেন, তা ছিল অতীব মর্মস্পর্শী ও হৃদয় বিদারক। ১৫ অথবা ২০ হিজরীতে তিনি ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুকালে তিনি বলেন,لاَ تَبْكُوْا عَلَيَّ فَوَاللهِ مَا نَطَقْتُ بِخَطِيئَةٍ مُنْذُ أَسْلَمْتُ ‘আমার জন্য তোমরা কেঁদো না। আল্লাহর কসম! ইসলাম গ্রহণের পর হ’তে আমি কোন গোনাহের কথা বলিনি’।[3]

ফুফাতো ভাই আব্দুল্লাহ বিন আবু উমাইয়া, যিনি রাসূল (ছাঃ)-এর ফুফু আতেকার পুত্র ছিলেন। ইনিই আবু ত্বালিবের মৃত্যুর সময় তাকে তার পিতৃধর্মের উপরে মৃত্যুর জন্য অন্যতম প্ররোচনা দানকারী ছিলেন। ইনিই সেই ব্যক্তি যিনি রাসূল (ছাঃ)-কে বলেছিলেন, আমরা কখনোই তোমার উপরে ঈমান আনবো না, যতক্ষণ না তুমি আমাদের জন্য ভূমি থেকে ঝর্ণাধারা প্রবাহিত করে দিবে’ (ইসরা ১৭/৯০)। অতঃপর আল্লাহ তাকে হেদায়াত দান করেন এবং মক্কা বিজয়ের প্রাক্কালে তিনি ও আবু সুফিয়ান ইবনুল হারেছ ইসলাম কবুলের উদ্দেশ্যে মদীনায় হিজরত করেন। পথিমধ্যে রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে সাক্ষাৎ হয় এবং ইসলাম কবুল করেন।

প্রথম দিকে ইসলামের ঘোর দুশমন থাকলেও ইসলাম গ্রহণের পর সর্বক্ষণ রাসূল (ছাঃ)-এর সহযোগী ছিলেন। তিনি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে মক্কা বিজয়, হোনায়েন যুদ্ধ ও ত্বায়েফ যুদ্ধে যোগদান করেন এবং ত্বায়েফে শত্রুপক্ষের তীরের আঘাতে শাহাদাত বরণ করেন।[4]

মার্রুয যাহরানে অবতরণ

মক্কায় প্রবেশের আগের রাতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মক্কা থেকে ৩০ কি.মি. পূর্বে মার্রুয যাহরান(مَرُّ الظَّهْرَانِ) উপত্যকায় অবতরণ করেন এবং প্রত্যেককে পৃথক পৃথকভাবে আগুন জ্বালাতে বলেন। তাতে সমগ্র উপত্যকা দশ হাযার অগ্নিপিন্ডের এক বিশাল আলোক নগরীতে পরিণত হয়। ওমর ইবনুল খাত্ত্বাবকে তিনি পাহারাদার বাহিনীর প্রধান নিয়োগ করেন।

মক্কাবাসীদের উপরে আসন্ন বিপদ অাঁচ করে হযরত আববাস (রাঃ) অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তিনি মনেপ্রাণে চাচ্ছিলেন যে, উপযুক্ত কোন লোক পেলে তিনি তাকে দিয়ে খবর পাঠাবেন যে, রাসূল (ছাঃ)-এর মক্কায় প্রবেশের পূর্বেই যেন কুরায়েশ নেতারা অনতিবিলম্বে এসে রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে আত্মসমর্পণ করে। অতঃপর তিনি রাসূল (ছাঃ)-এর সাদা খচ্চরের উপরে সওয়ার হয়ে রাতের অাঁধারে বেরিয়ে পড়েন।

আবু সুফিয়ান গ্রেফতার

ভীত ও শংকিত কুরায়েশ নেতা আবু সুফিয়ান, হাকীম বিন হেযাম ও বনু খোযা‘আহ নেতা বুদাইল বিন ওয়ারক্বা মুসলমানদের খবর জানার জন্য রাত্রিতে ময়দানে বের হয়ে এসেছিলেন। তারা হঠাৎ গভীর রাতে দিগন্তব্যাপী আগুনের শিখা দেখে হতচকিত হয়ে পড়েন ও একে অপরে নানারূপ আশংকার কথা বলাবলি করতে থাকেন। এমন সময় হযরত আববাস (রাঃ) তাদের কণ্ঠস্বর চিনতে পারেন ও কাছে এসে বলেন, কি দেখছ, এগুলি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সেনাবাহিনীর জ্বালানো আগুন। একথা শুনে ভীত কম্পিত আবু সুফিয়ান বলে উঠলেন, فَمَا الْحِيْلَةُ فِدَاك أَبِيْ وَأُمِّيْ ‘তোমার জন্য আমার পিতা-মাতা উৎসর্গীত হৌন- এখন বাঁচার উপায় কি? আববাস (রাঃ) বললেন, وَاللهِ لَئِنْ ظَفِرَ بِكَ لَيَضْرِبَنَّ عُنُقَكَ ‘আল্লাহর কসম! তোমাকে পেয়ে গেলে তিনি অবশ্যই তোমার গর্দান উড়িয়ে দেবেন’। অতএব এখুনি আমার খচ্চরের পিছনে উঠে বস এবং চলো রাসূল (ছাঃ)-এর কাছে গিয়ে আমি তোমার জন্য আশ্রয় প্রার্থনা করছি’। কোনরূপ দ্বিরুক্তি না করে আবু সুফিয়ান খচ্চরের পিছনে উঠে বসলেন এবং তার সাথী দু’জন ফিরে গেলেন।

রাসূল (ছাঃ)-এর তাঁবুতে পৌঁছার আগ পর্যন্ত সকলে রাসূল (ছাঃ)-এর সাদা খচ্চর ও তাঁর চাচা আববাসকে দেখে সসম্মানে পথ ছেড়ে দিয়েছে। ওমরের নিকটে পৌঁছলে তিনি উঠে কাছে এলেন এবং পিছনে আবু সুফিয়ানকে দেখেই বলে উঠলেন, أَبُو سُفْيَانَ عَدُوُّ اللهِ ‘আবু সুফিয়ান, আল্লাহর দুশমন! আলহামদুলিল্লাহ কোনরূপ চুক্তি ও অঙ্গীকার ছাড়াই আল্লাহ তোমাকে আমাদের নাগালের মধ্যে এনে দিয়েছেন’। বলেই তিনি রাসূল (ছাঃ)-এর তাঁবুর দিকে চললেন। আববাস (রাঃ) বলেন, আমিও দ্রুত খচ্চর হাঁকিয়ে দিলাম এবং তার আগেই রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে পৌঁছে গেলাম। অতঃপর তাঁর সম্মুখে বসে গেলাম। ইতিমধ্যে ওমর এসে পৌঁছলেন এবং বললেন, يَا رَسُوْلَ اللهِ هَذَا أَبُوْ سُفْيَانَ فَدَعْنِيْ أَضْرِبْ عُنُقَهُ ‘হে আল্লাহর রাসূল! এই সেই আবু সুফিয়ান! আমাকে হুকুম দিন ওর গর্দান উড়িয়ে দেই’। আববাস (রাঃ) তখন রাসূল (ছাঃ)-কে বললেন, يَا رَسُوْلَ اللهِ، إنِّيْ قَدْ أَجَرْتُهُ ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমি তাকে আশ্রয় দিয়েছি’। অতঃপর আমি রাসূল (ছাঃ)-এর কাছে উঠে গিয়ে কানে কানে বললাম, وَاللهِ لاَ يُنَاجِيْهِ اللَّيْلَةَ أَحَدٌ دُوْنِيْ ‘আল্লাহর কসম! আমি ছাড়া অন্য কেউ আজ রাতে আপনার সাথে গোপনে কথা বলবে না’। এরপর ওমর ও আববাসের মধ্যে কিছু বাক্য বিনিময় হয়। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, হে আববাস! এঁকে আপনার তাঁবুতে নিয়ে যান। সকালে ওঁকে নিয়ে আমার কাছে আসুন’।

আবু সুফিয়ানের ইসলাম গ্রহণ

সকালে তাঁর নিকটে গেলে তিনি আবু সুফিয়ানকে বললেন,وَيْحَكَ يَا أَبَا سُفْيَانَ أَلَمْ يَأْنِ لَكَ أَنْ تَعْلَمَ أَنْ لاَ إلَهَ إلاَّ اللهُ؟ ‘তোমার জন্য দুঃখ হে আবু সুফিয়ান! আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই, একথা উপলব্ধি করার সময় কি তোমার এখনো আসেনি’? আবু সুফিয়ান বললেন,بِأَبِيْ أَنْتَ وَأُمِّيْ مَا أَحْلَمَك وَأَكْرَمَك وَأَوْصَلَك لَقَدْ ظَنَنْتُ أَنْ لَوْ كَانَ مَعَ اللهِ إلَهٌ غَيْرُهُ لَقَدْ أَغْنَى شَيْئًا بَعْدُ ‘আমার পিতা-মাতা আপনার জন্য উৎসর্গীত হউন! আপনি কতইনা সহনশীল, কতই না সম্মানিত ও কতই না আত্মীয়তা রক্ষাকারী। আমি বুঝতে পেরেছি যে, যদি আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোন উপাস্য থাকত, তাহলে এতদিন তা আমার কিছু কাজে আসত’। তখন রাসূল (ছাঃ) বললেন,وَيْحَكَ يَا أَبَا سُفْيَانَ أَلَمْ يَأْنِ لَكَ أَنْ تَعْلَمَ أَنّيْ رَسُوْلُ اللهِ؟ ‘তোমার জন্য দুঃখ হে আবু সুফিয়ান! আমি যে আল্লাহর রাসূল একথা উপলব্ধি করার সময় কি তোমার এখনো আসেনি’? আবু সুফিয়ান বললেন, আপনার জন্য আমার পিতা-মাতা উৎসর্গীত হৌন! আপনি কতই না সহনশীল, কতই না সম্মানিত এবং কতই না আত্মীয়তা রক্ষাকারী। أَمَّا هَذِهِ فَإِنَّ فِي النَّفْسِ حَتَّى الْآنَ مِنْهَا شَيْئًا ‘কেবল এই ব্যাপারটিতে আমার মনের মধ্যে এখনো কিছুটা সংশয় রয়েছে’। সঙ্গে সঙ্গে ধমকের সুরে আববাস (রাঃ) তাকে বললেন, وَيْحَكَ أَسْلِمْ وَاشْهَدْ أَنْ لآ إلَهَ إلاَّ اللهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُوْلُ اللهِ قَبْلَ أَنْ تُضْرَبَ عُنُقُكَ ‘তোমার ধ্বংস হৌক! গর্দান যাওয়ার পূর্বে ইসলাম কবুল কর এবং সাক্ষ্য দাও যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই এবং মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল’। সঙ্গে সঙ্গে আবু সুফিয়ান কালেমায়ে শাহাদাত পাঠের মাধ্যমে ইসলাম কবুল করলেন।

অতঃপর হযরত আববাস (রাঃ) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল!إنَّ أَبَا سُفْيَانَ رَجُلٌ يُحِبُّ الْفَخْرَ فَاجْعَلْ لَهُ شَيْئًا ‘আবু সুফিয়ান গৌরব প্রিয় মানুষ। অতএব এ ব্যাপারে তাকে কিছু প্রদান করুন’। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন,نَعَم مَنْ دَخَلَ دَارَ أَبِيْ سُفْيَانَ فَهُوَ آمِنٌ وَمَنْ أَغْلَقَ عَلَيْهِ بَابَهُ فَهُوَ آمِنٌ وَمَنْ أَلْقَى السَّلاَحَ فَهُوَ آمِنٌ وَمَنْ دَخَلَ الْمَسْجِدَ الْحَرَامَ فَهُوَ آمِنٌ ‘বেশ, যে ব্যক্তি আবু সুফিয়ানের গৃহে প্রবেশ করবে, সে নিরাপদ থাকবে। যে ব্যক্তি তার ঘরের দরজা বন্ধ রাখবে, সে নিরাপদ থাকবে। যে ব্যক্তি অস্ত্র ফেলে দিবে, সে নিরাপদ থাকবে এবং যে ব্যক্তি মাসজিদুল হারামে প্রবেশ করবে, সে নিরাপদ থাকবে’।[5]

[1]. হাকেম হা/৪৩৫৯; ত্বাবারাণী কাবীর হা/৭২৬৪; সিলসিলা ছহীহাহ হা/৩৩৪১; ইবনু হিশাম ২/৪০০, সনদ ছহীহ; ঐ তাহকীক ক্রমিক ১৬৬৪। উল্লেখ্য যে, হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) এখানে উম্মে সালামা (রাঃ)-এর কথা উদ্ধৃত করেছেন যে, তিনি রাসূল (ছাঃ)-কে বলেন, এটি হওয়া উচিৎ নয় যে, আপনার চাচাতো ভাই, ফুফাতো ভাই ও শ্বশুরকুলের লোকেরা আপনার নিকট সবচেয়ে হতভাগ্য হবে (أَشْقَى النَّاسِ بِكَ) (যাদুল মা‘আদ ৩/৩৫২, আর-রাহীক্ব ৩৯৯ পৃঃ)। কথাটি ওয়াক্বেদী (২/৮১০) সূত্রবিহীনভাবে বর্ণনা করেছেন।
[2]. হাকেম হা/৪৩৫৯; আলবানী, ফিক্বহুস সীরাহ ৩৭৬ পৃঃ, সনদ হাসান।
[3]. যাদুল মা‘আদ ৩/৩৫২-৩৫৩; আল-ইছাবাহ, আবু সুফিয়ান ইবনুল হারেছ ক্রমিক ১০০২২।
[4]. আল-ইছাবাহ, আব্দুল্লাহ বিন আবু উমাইয়া ক্রমিক ৪৫৪৬।
[5]. ইবনু হিশাম ২/৪০৩; সিলসিলা ছহীহাহ হা/৩৩৪১; মুসলিম হা/১৭৮০; আবুদাঊদ হা/৩০২১; মিশকাত হা/৬২১০।

মুসলিম বাহিনীর মার্রুয যাহরান ত্যাগ

১৭ই রামাযান সোমবার সকালে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) মার্রুয যাহরান ত্যাগ করে মক্কায় প্রবেশের জন্য যাত্রা শুরু করলেন।[1] তিনি আববাসকে বললেন যে, আপনি আবু সুফিয়ানকে নিয়ে উপত্যকা থেকে বের হওয়ার মুখে সংকীর্ণ পথের পার্শ্বে পাহাড়ের উপরে দাঁড়িয়ে থাকবেন। যাতে সে মুসলিম বাহিনীর সংখ্যা ও শক্তি স্বচক্ষে দেখতে পারে। আববাস (রাঃ) তাই-ই করলেন। এরপর যখনই স্ব স্ব পতাকা সহ এক একটি গোত্র ঐ পথ অতিক্রম করে, তখনই আবু সুফিয়ান আববাসের নিকটে ঐ গোত্রের পরিচয় জিজ্ঞেস করেন। যেমন আসলাম, গেফার, জোহায়না, মুযায়না, বনু সোলায়েম ও অন্যান্য গোত্র সমূহ। কিন্তু আবু সুফিয়ান ঐসব লোকদের তেমন মূল্যায়ন না করে বলেন, এদের সাথে আমার কি সম্পর্ক? এরপরে যখন আনছার ও মুহাজির পরিবেষ্টিত হয়ে লোহার বর্ম পরিহিত অবস্থায় জাঁকজমকপূর্ণ পরিবেশে একটি বিরাট দলকে আসতে দেখলেন তখন আবু সুফিয়ান বলে উঠলেন, সুবহানাল্লাহ হে আববাস এরা কারা? আববাস (রাঃ) বললেন, মুহাজির ও আনছার বেষ্টিত হয়ে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) আসছেন’। আবু সুফিয়ান বিস্ময় ভরা কণ্ঠে বললেন,مَا لِأَحَدٍ بِهَؤُلاَءِ قِبَلٌ وَلاَ طَاقَةٌ ‘কারু পক্ষে এদের মুকাবিলার ক্ষমতা বা শক্তি হবে না’। অতঃপর বললেন,واللهِ يَا أَبَا الْفَضْلِ لَقَدْ أَصْبَحَ مُلْكُ ابْنِ أَخِيكَ الْيَوْمَ عَظِيمًا ‘আল্লাহর কসম, হে আবুল ফযল! তোমার ভাতিজার সাম্রাজ্য তো আজ অনেক বড় হয়ে গেছে’। আববাস (রাঃ) বললেন,يَا أَبَا سُفْيَانَ إنَّهَا النُّبُوَّةُ ‘হে আবু সুফিয়ান, এটা (রাজত্ব নয় বরং) নবুঅত’। আবু সুফিয়ান বললেন,نَعَمْ إِذَنْ ‘হ্যাঁ, তাহ’লে তাই’।[2]

[1]. মানছূরপুরী ৮ম হিজরীর ২০শে রামাযান বলেছেন (রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ১/১১৮, ২/৩৬৮)। যা ৬৩০ খ্রিষ্টাব্দের ১১ই জানুয়ারী বৃহস্পতিবার হয়। মুবারকপুরী ৮ম হিজরীর ১৭ই রামাযান মঙ্গলবার বলেছেন (আর-রাহীক্ব ৪০১ পৃঃ)। আধুনিক গণনায় ১৭ই রামাযান সোমবার হয়। আলোচনা দ্রষ্টব্য : ‘মক্কা বিজয়’ অধ্যায়, টীকা-৭৩২-৩৩।
[2]. ইবনু হিশাম ২/৪০৪; আলবানী, ফিক্বহুস সীরাহ পৃঃ ৩৭৮, হায়ছামী, মাজমা‘উয যাওয়ায়েদ, সনদ ছহীহ।

সা‘দের পতাকা তার পুত্রের নিকট হস্তান্তর

এ সময় একটি ঘটনা ঘটে যায়। আনছারদের পতাকা ছিল খাযরাজ নেতা সা‘দ বিন ওবাদাহ (রাঃ)-এর হাতে। তিনি ইতিপূর্বে ঐ স্থান অতিক্রম করার সময় আবু সুফিয়ানকে শুনিয়ে বলেন, الْيَوْمَ يَوْمُ الْمَلْحَمَةِ، الْيَوْمَ تُسْتَحَلُّ الْكَعْبَةُ ‘আজ হ’ল মারপিটের দিন। আজ কা‘বাকে হালাল করা হবে’। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) ঐ স্থান অতিক্রম করার সময় আবু সুফিয়ান বলে উঠলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কি শুনেছেন সা‘দ কি বলেছে? জিজ্ঞেস করলেন কি বলেছে? তখন তাকে উক্ত কথা বলা হ’ল। তখন রাসূল (ছাঃ) বললেন,كَذَبَ سَعْدٌ، وَلَكِنْ هَذَا يَوْمٌ يُعَظِّمُ اللهُ فِيهِ الْكَعْبَةَ ‘সা‘দ মিথ্যা বলেছে। বরং আজ হ’ল সেই দিন যেদিন আল্লাহ তা‘আলা কা‘বাকে সম্মানিত করবেন’ (বুখারী হা/৪২৮০)। তখন হযরত ওছমান ও আব্দুর রহমান ইবনু ‘আওফ রাসূল (ছাঃ)-কে বললেন, আমরা সা‘দের ব্যাপারে নিশ্চিন্ত নই। হয়ত সে কুরায়েশদের মারপিট শুরু করে দেবে’। একথা শুনে তিনি একজনকে পাঠিয়ে সা‘দের নিকট থেকে পতাকা নিয়ে তার পুত্র ক্বায়েসকে দিলেন। যাতে সে বুঝতে পারে যে, পতাকা তার হাত থেকে বাইরে যায়নি। তবে কেউ কেউ বলেন, পতাকাটি যুবায়ের (রাঃ)-কে প্রদান করা হয় (যাদুল মা‘আদ ৩/৩৫৬)।

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর অতিক্রম করে যাওয়ার পর হযরত আববাস (রাঃ) আবু সুফিয়ানকে বললেন, النَّجَاءُ إلَى قَوْمِكَ ‘তোমার কওমের দিকে দৌড়াও’। আবু সুফিয়ান অতি দ্রুত মক্কায় গিয়ে উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করলেন,يَا مَعْشَرَ قُرَيْشٍ هَذَا مُحَمَّدٌ قَدْ جَاءَكُمْ فِيْمَا لاَ قِبَلَ لَكُمْ بِهِ فَمَنْ دَخَلَ دَارَ أَبِيْ سُفْيَانَ فَهُوَ آمِنٌ- ‘হে কুরায়েশগণ! মুহাম্মাদ এসে গেছেন, যার মুকাবিলা করার ক্ষমতা তোমাদের নেই। অতএব যে ব্যক্তি আবু সুফিয়ানের গৃহে প্রবেশ করবে, সে নিরাপদ থাকবে’। এ ঘোষণা শুনে তার স্ত্রী হিন্দা এসে তার মোচ ধরে বলে ওঠেন, এই চর্বিওয়ালা শক্ত মাংসধারী মশকটাকে তোমরা মেরে ফেল। এরূপ দুঃসংবাদ দানকারীর মন্দ হৌক’! আবু সুফিয়ান বললেন, তোমরা সাবধান হও! এই মহিলা যেন তোমাদের ধোঁকায় না ফেলে। লোকেরা বলল, হে আবু সুফিয়ান! আপনার গৃহে কয়জনের স্থান হবে? তিনি বললেন, مَنْ أَغْلَقَ بَابَهُ فَهُوَ آمِنٌ وَمَنْ دَخَلَ الْمَسْجِدَ فَهُوَ آمِنٌ ‘যে ব্যক্তি তার নিজের ঘরের দরজা বন্ধ রাখবে, সে নিরাপদ থাকবে এবং যে ব্যক্তি মাসজিদুল হারামে প্রবেশ করবে, সেও নিরাপদ থাকবে’ (ছহীহাহ হা/৩৩৪১)। একথা শোনার পর লোকেরা স্ব স্ব গৃহ এবং বায়তুল্লাহর দিকে দৌঁড়াতে শুরু করল। কিন্তু কিছু সংখ্যক নির্বোধ লোক ইকরিমা বিন আবু জাহল, ছাফওয়ান বিন উমাইয়া, সোহায়েল বিন আমর প্রমুখের নেতৃত্বে মক্কার ‘খান্দামা’ (الْخَنْدَمَة) পাহাড়ের কাছে গিয়ে জমা হ’ল মুসলিম বাহিনীকে বাধা দেওয়ার জন্য। এদের মধ্যে কুরায়েশ মিত্র বনু বকরের জনৈক বীর হিমাস বিন ক্বায়েস (حِمَاسُ بنُ قَيْس) ছিল। যে ব্যক্তি মুসলমানদের মুকাবিলার জন্য ধারালো অস্ত্র শান দিয়েছিল এবং মুসলমানদের ধরে এনে তার স্ত্রীর গোলাম বানাবার অহংকার প্রদর্শন করে স্ত্রীর সামনে কবিতা পাঠ করেছিল’।[1]

[1]. যাদুল মা‘আদ ৩/৩৫৬-৫৭, ইবনু হিশাম ২/৪০৭, আর-রাহীক্ব ৪০৩ পৃঃ।

খান্দামায় মুকাবিলা ও হতাহতের ঘটনা

মুসলিম বাহিনী খান্দামায় পৌঁছার পর ডান বাহুর সেনাপতি খালেদ বিন অলীদের সাথে তাদের মুকাবিলা হয়। তাতে ১২ জন নিহত হওয়ার পর তাদের মধ্যে পালানোর হিড়িক পড়ে যায়। কিন্তু এই সময় খালেদ বাহিনীর দু’জন শহীদ হন, যারা দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন। তারা হ’লেন হুবাইশ বিন খালেদ বিন রাবী‘আহ এবং কুরয বিন জাবের আল-ফিহরী। হুবাইশ ছিলেন খ্যাতনামা মহিলা উম্মে মা‘বাদের ভাই। কুরয আল-ফিহরী ছিলেন প্রথম মদীনার উপকণ্ঠে হামলাকারী। যিনি অনেকগুলি গবাদিপশু লুট করে নিয়ে আসেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বদরের কাছাকাছি সাফওয়ান উপত্যকা পর্যন্ত তাকে ধাওয়া করেও ব্যর্থ হন’।[1]

এসময় বনু বকরের সেই স্বঘোষিত মহাবীর হিমাস বিন ক্বায়েস ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌঁড়ে এসে স্ত্রীকে বলে ‘শীঘ্র দরজা বন্ধ কর’। স্ত্রী ঠাট্টা করে বলেন, কোথায় গেল তোমার সেই বীরত্ব? ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সে সাড়ে তিন লাইন কবিতা বলল, যা ছিল খুবই সারগর্ভ ও অলংকারপূর্ণ। ‘কবিতা হ’ল আরবদের রেজিষ্টার’(الشِّعرُ دِيوانُ العَرَبِ)। এর মধ্যেই তাদের ইতিহাস ও ঘটনাবলীর রেকর্ড থাকে। সেই সাথে পাওয়া যায় তাদের অনন্য প্রতিভার স্বাক্ষর। যেমন ঐ ভীতিপূর্ণ অবস্থায় আদৌ কবিখ্যাতি নেই এমন একজন সাধারণ আরব ঐ সময়ের অবস্থা বর্ণনা করে স্বতঃস্ফূর্তভাবে যে চমৎকার কবিতা পাঠ করেছিল, তার তুলনা বিরল। কবিতাটিতে সে স্ত্রীর নিকটে পালিয়ে আসার কৈফিয়ত দিয়ে বলছে,

إنَّكِ لَوْ شَهِدْتِ يَوْمَ الْخَنْدَمَهْ + إذْ فَرَّ صَفْوَانُ وَفَرَّ عِكْرِمَهْ
وَأَبُو يَزِيدَ قَائِمٌ كَالْمُوتَمَهْ + وَاسْتَقْبَلَتْهُمْ بِالسُّيُوفِ الْمُسْلِمَهْ
يَقْطَعْنَ كُلَّ سَاعِدٍ وَجُمْجُمَهْ + ضَرْبًا فَلاَ يُسْمَعُ إلاَّ غَمْغَمَهْ
لَهُمْ نَهِيتٌ خَلْفَنَا وَهَمْهَمَهْ + لَمْ تَنْطِقِي فِي اللَّوْمِ أَدْنَى كَلِمَهْ

(১) ‘যদি তুমি খান্দামায় যুদ্ধের অবস্থা স্বচক্ষে দেখতে, যখন ছাফওয়ান ও ইকরিমা উর্ধ্বশ্বাসে পালাচ্ছিলেন’। (২) ‘কুরাইশের খতীব আবু ইয়াযীদ বহু ইয়াতীম সন্তান নিয়ে বিপর্যস্ত বিধবা মহিলার মত দাঁড়িয়েছিল। আর খান্দামা পাহাড় তাদেরকে উন্মুক্ত তরবারিসমূহ নিয়ে অভ্যর্থনা জানাচ্ছিল’। (৩) ‘যেগুলি হাতের বাজু ও মাথার খুলিসমূহ তীব্র আঘাতে কচুকাটা করছিল। তখন কিছুই শোনা যাচ্ছিল না কেবল তাদের গুমগাম শব্দ ছাড়া’। (৪) ‘আমাদের পিছনে তখন কেবলই ছিল তাদের তর্জন-গর্জন ও হুমহাম শব্দ। এমতাবস্থায় তুমি আমাকে তিরষ্কারের কোন কথাই বলতে পারতে না’।[2]

অতঃপর ডান বাহুর সেনাপতি খালেদ বিন অলীদ (রাঃ) আসলাম, সুলাইম, গেফার, মুযায়না, জুহায়না প্রভৃতি আরব গোত্র সমূহকে নিয়ে মক্কার নিম্নভূমি দিয়ে ছাফা পাহাড়ে উপনীত হন। অন্যদিকে বামবাহুর সেনাপতি যুবায়ের ইবনুল ‘আওয়াম (রাঃ) মক্কার উপরিভাগ দিয়ে প্রবেশ করে হাজূন (حَجُون) নামক স্থানে অবতরণ করেন। অতঃপর সেখানে তিনি রাসূল (ছাঃ)-এর জন্য তাঁবু প্রস্ত্তত করেন এবং রাসূল (ছাঃ)-এর পতাকা গেড়ে দেন। যে স্থানটিতে এখন ‘বিজয় মসজিদ’(مسجد الفتح) অবস্থিত। একইভাবে আবু ওবায়দাহ ইবনুল জাররাহ (রাঃ) পদাতিক বাহিনী নিয়ে বাত্বনে ওয়াদীর পথ ধরে মক্কায় উপস্থিত হন। অতঃপর সবশেষে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সেখানে পৌঁছে যান (আর-রাহীক্ব ৪০৩-০৪ পৃঃ)।[3]

[1]. আল-ইছাবাহ, হুবাইশ বিন খালেদ ক্রমিক ১৬০৯; কুরয বিন জাবের আল-ফিহরী ক্রমিক ৭৩৯৯; গাযওয়া সাফওয়ান ক্রমিক ৬।
[2]. যাদুল মা‘আদ ৩/৩৫৭, ইবনু হিশাম ২/৪০৮; ঐ, তাহকীক ক্রমিক ১৬৭৩, সনদ ‘মুরসাল’।
[3]. এখানে প্রসিদ্ধ আছে যে, মক্কার নিম্নভূমি ‘যূ-তুওয়া’ (ذُو طُوَى) পৌঁছলে বিজয়ের স্পষ্ট লক্ষণ দেখে রাসূল (ছাঃ) আল্লাহ প্রদত্ত বিজয়ের এই মহা সম্মান লাভে অত্যন্ত বিনীত হয়ে পড়েন এবং স্বীয় লাল চাদরের এক প্রান্ত ধরে হাওদার মাঝখানে মাথা নীচু করে দেন। যা তাঁর দাড়ি স্পর্শ করে’ (ইবনু হিশাম ২/৪০৫; আর-রাহীক্ব ৪০৩ পৃঃ)। বর্ণনাটির সনদ ‘যঈফ’ (আর-রাহীক্ব, তা‘লীক্ব ১৭২ পৃঃ)।



প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর ৬৭ পর্বের জীবনীর সকল পর্ব এখান থেকে পড়ুন-

পর্ব-০১   পর্ব-০২   পর্ব-০৩   পর্ব-০৪   পর্ব-০৫   পর্ব-০৬   পর্ব-০৭   পর্ব-০৮   পর্ব-০৯   পর্ব-১০   পর্ব-১১   পর্ব-১২   পর্ব-১৩   পর্ব-১৪   পর্ব-১৫   পর্ব-১৬   পর্ব-১৭   পর্ব-১৮   পর্ব-১৯   পর্ব-২০   পর্ব-২১   পর্ব-২২   পর্ব-২৩   পর্ব-২৪   পর্ব-২৫   পর্ব-২৬   পর্ব-২৭   পর্ব-২৮   পর্ব-২৯   পর্ব-৩০    পর্ব-৩১   পর্ব-৩২   পর্ব-৩৩   পর্ব-৩৪   পর্ব-৩৫   পর্ব-৩৬   পর্ব-৩৭   পর্ব-৩৮   পর্ব-৩৯   পর্ব-৪০   পর্ব-৪১   পর্ব-৪২   পর্ব-৪৩   পর্ব-৪৪   পর্ব-৪৫   পর্ব-৪৬(১ম) পর্ব-৪৬(২য়)    পর্ব-৪৭   পর্ব-৪৮   পর্ব-৪৯   পর্ব-৫০   পর্ব-৫১   পর্ব-৫২   পর্ব-৫৩   পর্ব-৫৪   পর্ব-৫৫   পর্ব-৫৬   পর্ব-৫৭   পর্ব-৫৮   পর্ব-৫৯   পর্ব-৬০   পর্ব-৬১   পর্ব-৬২   পর্ব-৬৩   পর্ব-৬৪   পর্ব-৬৫   পর্ব-৬৬   পর্ব-৬৭  





******************************************
>>> Welcome, You are now on Mohammadia Foundation's Website. Please stay & Tune with us>>>



এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url