প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর জীবনী [পর্ব- ৪১] || মহানবীর জীবনী ||






[পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ট মহামানব আমাদের প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:)। যাকে আল্লাহ সমস্ত মানুষের জন্য অশেষ রহমত স্বরূপ এই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। যে নবী সারা জীবন উম্মতের জন্য সংগ্রাম করেছেন, কাল রোজ হাশরের মাঠেও যিনি উম্মতের জন্যই পেরেশান থাকবেন; সেই প্রাণপ্রিয় নবীকে আমরা কতটুকু চিনি কতটুকু জানি। প্রিয় নবী (সা:) এর জীবনের পরতে পরতে রয়েছে আমাদের জন্য শিক্ষা ও অনুপ্রেরণা। যার জীবনী পড়লে নিজের অজান্তেই চোখের পানি গড়িয়ে পড়ে। সেই নবীর জীবনী কি আমরা সত্যিই জানি? আসুন, আরেকবার দেখে নেই “প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর জীবনী”। যে জীবনী পড়ে বদলে যেতে পারে আপনার আমার জীবন। আল্লাহ আমাদের সবাইকে প্রাণপ্রিয় নবীর (সা:) উম্মত হিসাবে কবুল করুন। আমিন।।]

খায়বর যুদ্ধ, খায়বর ‍যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল, রাসুলুল্লাহ (সা:) কে বিষ প্রয়োগে হত্যার চেষ্টা

গাযওয়া যী ক্বারাদ

৭ম হিজরীর মুহাররম মাস। হোদায়বিয়া থেকে মদীনায় ফেরার মাসাধিক কাল পরে এটাই ছিল রাসূল (ছাঃ)-এর প্রথম যুদ্ধ, যা খায়বর যুদ্ধে গমনের মাত্র তিনদিন পূর্বে সংঘটিত হয় (বুখারী, ‘গাযওয়া যী ক্বারাদ’ অনুচ্ছেদ-৩৭)। বনু গাত্বফানের ফাযারাহ গোত্রের আব্দুর রহমান আল-ফাযারীর নেতৃত্বে একটি ডাকাত দল মদীনায় এসে রাসূল (ছাঃ)-এর রাখালদের হত্যা করে চারণভূমি থেকে তাঁর উটগুলি লুট করে নিয়ে যায়। দক্ষ তীরন্দায সালামা বিন আকওয়া‘ একাই দৌঁড়ে তাদের পশ্চাদ্ধাবন করে যূ-ক্বারাদ ঝর্ণা পর্যন্ত দীর্ঘ পথ তাড়িয়ে নিয়ে যান। কখনো পাহাড়ের মাথায় উঠে পাথর ছুঁড়ে, কখনো পেছন থেকে তীর ছুঁড়ে তাদেরকে কাবু করে ফেলেন। অবশেষে তারা তাদের সমস্ত উট, অস্ত্রশস্ত্র ও আসবাব-পত্র সমূহ ফেলে পালিয়ে যায়। এ সময় তিনি চিৎকার দিয়ে বলতে থাকেন,أَنَا ابْنُ الأَكْوَعِ، وَالْيَوْمُ يَوْمُ الرُّضَّعِ ‘আমি ইবনুল আকওয়া। আর আজ হল ধ্বংসের দিন’ (বুখারী হা/৪১৯৪)।

ইতিমধ্যে পিছে পিছে রাসূল (ছাঃ) ৫০০ ছাহাবীর এক বাহিনী নিয়ে সন্ধ্যার পরে উপস্থিত হন। ডাকাত দলের নেতা আব্দুর রহমানের নিক্ষিপ্ত বর্শার আঘাতে ছাহাবী আখরাম (أَخرَم) শহীদ হন। পরক্ষণেই আবু ক্বাতাদার বর্শার আঘাতে আব্দুর রহমান নিহত হয়। সালামা বিন আকওয়া‘-এর দুঃসাহস ও বীরত্বের পুরস্কার স্বরূপ আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) তাকে গণীমতের দুই অংশ দান করেন। যার মধ্যে পদাতিকের একাংশ ও অশ্বারোহীর একাংশ। মদীনায় ফেরার সময় সম্মান স্বরূপ নিজের সবচেয়ে দ্রুতগামী ‘আযবা’ (الْعَضْبَاءُ) উটের পিঠে তাকে বসিয়ে নেন’।[1] এই যুদ্ধে মদীনার আমীর ছিলেন আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতূম (রাঃ) এবং পতাকাবাহী ছিলেন মিক্বদাদ বিন ‘আমর (রাঃ)।[2]

[1]. ইবনু হিশাম ২/২৮১; আল-বিদায়াহ ৪/১৫০; বুখারী হা/৪১৯৪; মুসলিম হা/১৮০৬; আল-বিদায়াহ ৪/১৫৩।
[2]. যাদুল মা‘আদ; আর-রাহীক্ব ৩৬২-৬৩ পৃঃ।

খায়বর যুদ্ধ

(৭ম হিজরীর মুহাররম মাস)
কুরায়েশদের সঙ্গে সন্ধিচুক্তির পর সকল ষড়যন্ত্রের মূল ঘাঁটি খায়বরের ইহূদীদের প্রতি এই অভিযান পরিচালিত হয়। হুদায়বিয়ার সন্ধি ও বায়‘আতে রিযওয়ানে উপস্থিত ১৪০০ ছাহাবীকে নিয়ে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) স্বয়ং এই অভিযান পরিচালনা করেন। তিনি কোন মুনাফিককে এ যুদ্ধে নেননি।[1] এই যুদ্ধে মুসলিম পক্ষে ১৬ জন শহীদ এবং ইহূদী পক্ষে ৯৩ জন নিহত হয়। ইহূদীদের বিতাড়িত করার সিদ্ধান্ত হয়। তবে তাদের আবেদন মতে উৎপন্ন ফসলের অর্ধেক ভাগ দেবার শর্তে তাদেরকে সেখানে বসবাস করার সাময়িক অনুমতি দেওয়া হয় (বুখারী হা/৪২৩৫)।

যুদ্ধে বিপুল পরিমাণ গণীমত হস্তগত হয়। যাতে মুসলমানদের অভাব দূর হয়ে যায়। এই সময়ে ফাদাকের ইহূদীদের নিকটে ইসলামের দাওয়াত দিয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মুহাইয়েছাহ বিন মাসঊদকে(مُحَيِّصَةُ بنُ مسعودٍ) প্রেরণ করেন। খায়বর বিজয়ের পর তারা নিজেরা রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে দূত পাঠিয়ে আত্মসমর্পণ করে এবং খায়বরবাসীদের ন্যায় অর্ধেক ফসলে সন্ধিচুক্তি করে। বিনাযুদ্ধে ও স্রেফ রাসূল (ছাঃ)-এর দাওয়াতে বিজিত হওয়ায় ফাদাক ভূমি কেবল রাসূল (ছাঃ)-এর জন্য নির্দিষ্ট করা হয়। বিস্তারিত বিবরণ নিম্নরূপ।-

যিলহাজ্জের মাঝামাঝিতে হোদায়বিয়া থেকে ফিরে মুহাররম মাসের শেষভাগে কোন একদিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) খায়বর অভিমুখে যাত্রা করেন। এ সময় তিনি সেবা‘ বিন উরফুত্বাহ গেফারীকে মদীনার প্রশাসক নিয়োগ করে যান।[2]

মুসলিম শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধরত তিনটি শক্তি- কুরায়েশ, বনু গাত্বফান ও ইহূদী- এগুলির মধ্যে প্রধান শক্তি কুরায়েশদের সাথে হোদায়বিয়ার সন্ধির ফলে বনু গাত্বফান ও বেদুঈন গোত্রগুলি এমনিতেই দুর্বল হয়ে পড়ে। বাকী রইল ইহূদীরা। যারা মদীনা থেকে বিতাড়িত হয়ে খায়বরে গিয়ে বসতি স্থাপন করে এবং সেখান থেকেই মুসলমানদের বিরুদ্ধে সকল প্রকারের ষড়যন্ত্র করে। বরং বলা চলে যে, খায়বর ছিল তখন মুসলমানদের বিরুদ্ধে পরিচালিত সকল চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের কেন্দ্রবিন্দু। তাই এদেরকে দমন করার জন্য এই অভিযান পরিচালিত হয়। এই অভিযানে যাতে কোন মুনাফিক যেতে না পারে, সেজন্য আল্লাহ পূর্বেই আয়াত নাযিল করেন (ফাৎহ ৪৮/১৫)। তাছাড়া এ যুদ্ধে যে মুসলিম বাহিনী বিজয়ী হবে এবং প্রচুর গণীমত লাভ করবে, সে বিষয়ে আগাম ভবিষ্যদ্বাণী নাযিল হয়েছিল (ফাৎহ ৪৮/২০)। ফলে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) কেবলমাত্র ঐ সকল সাথীকে সঙ্গে নিলেন, যারা হোদায়বিয়ার সফরে ‘বায়‘আতুর রিযওয়ানে’ শরীক ছিলেন। যাদের সংখ্যা ছিল প্রায় ১৪০০। এঁদের সাথে কিছু সংখ্যক মহিলা ছাহাবী ছিলেন।[3] যারা আহতদের সেবা-যত্নে নিযুক্ত হন। আল্লাহপাকের এই আগাম হুঁশিয়ারীর কারণ ছিল এই যে, মুনাফিকদের সঙ্গে ইহূদীদের সখ্যতা ছিল বহু পুরাতন। তাই তারা যুদ্ধে গেলে তারা বরং ইহূদীদের স্বার্থেই কাজ করবে, যা মুসলিম বাহিনীর চরম ক্ষতির কারণ হবে।

[1]. আর-রাহীক্ব ৩৬৫ পৃঃ।

ওয়াক্বেদী এখানে সনদ বিহীনভাবে একটি ঘটনা বর্ণনা করেছেন। যা নিম্নরূপ :

রাসূল (ছাঃ) যখন সবাইকে খায়বর গমনের জন্য প্রস্ত্ততি নিতে বললেন, তখন হোদায়বিয়া থেকে বিভিন্ন অজুহাতে পিছিয়ে পড়া লোকেরা এসে বলল, আমরা আপনার সাথে যুদ্ধে যাব। তখন রাসূল (ছাঃ) একজন ঘোষককে দিয়ে ঘোষণা প্রদান করলেন যে,لاَ يَخْرُجَنَّ مَعَنَا إلاَّ رَاغِبٌ فِي الْجِهَادِ، فَأَمَّا الْغَنِيمَةُ فَلاَ- ‘আমাদের সঙ্গে জিহাদে অংশগ্রহণে আগ্রহীগণই কেবল বের হবে। অতঃপর তারা গণীমত পাবে না’। এই ঘোষণা শোনার পর তারা আর বের হয়নি (ওয়াক্বেদী, মাগাযী ২/৬৩৪; সীরাহ হালাবিইয়াহ ৩/৪৫)।

[2]. হাকেম হা/৪৩৩৭; ছহীহ ইবনু হিববান হা/৪৮৫১; আর-রাহীক্ব ৩৬৫ পৃঃ; যাদুল মা‘আদ ৩/২৮১।
ইবনু ইসহাক নুমায়লাহ বিন আব্দুল্লাহ লায়ছীর কথা বলেছেন (ইবনু হিশাম ২/৩২৮)। কিন্তু উরফুত্বাই অধিক সঠিক (ফাৎহুল বারী ‘খায়বর যুদ্ধ’ অনুচ্ছেদ; আর-রাহীক্ব ৩৬৫ পৃঃ)।
[3]. ইবনু হিশাম ও ত্বাবারী সংখ্যা নির্ধারণ করেননি (ইবনু হিশাম ২/৩৪২; তারীখ ত্বাবারী ৩/১৭)। মানছূরপুরী সূত্রহীনভাবে ২০ জন মহিলা ছাহাবী লিখেছেন, যারা সেবা করার জন্য এসেছিলেন (রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ১/২১৯)।

খায়বর অভিযানে মুনাফিকদের অপতৎপরতা

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর খায়বর অভিযানের গোপন খবর মুনাফিক নেতা আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই আগেভাগেই ইহূদীদের জানিয়ে দিয়ে তাদের কাছে পত্র পাঠায়। তাতে তাদেরকে যুদ্ধের জন্য প্ররোচিত করা হয় এবং একথাও বলা হয় যে, ‘তোমরা অবশ্যই জিতবে। কেননা মুহাম্মাদের লোকসংখ্যা অতীব নগণ্য এবং তারা প্রায় রিক্তহস্ত’। খয়বরের ইহূদীরা এই খবর পেয়ে তাদের মিত্র বনু গাত্বফানের নিকটে সাহায্য চেয়ে লোক পাঠায়। তাদেরকে বলা হয় যে, মুসলমানদের বিরুদ্ধে জয়লাভ করলে খায়বরের মোট উৎপন্ন ফসলের অর্ধেক তাদেরকে দেওয়া হবে’। উক্ত লোভনীয় প্রস্তাব পেয়ে বনু গাত্বফানের লোকেরা পূর্ণ প্রস্ত্ততি নিয়ে খায়বর অভিমুখে রওয়ানা হয়। কিছু দূর গিয়েই তারা পিছন দিকে শোরগোল শুনে ভাবল, হয়তবা মুসলিম বাহিনী তাদের সন্তানাদি ও পশুপালের উপরে হামলা চালিয়েছে। ফলে তারা খায়বরের চিন্তা বাদ দিয়ে স্ব স্ব গৃহ অভিমুখে প্রত্যাবর্তন করল। বলা বাহুল্য, এটা ছিল আল্লাহর অদৃশ্য সাহায্য। এর দ্বারা একথাও বুঝা যায় যে, মুসলমানদের ব্যাপারে তারা দারুণ ভীত ছিল। কেননা ইতিপূর্বে তারা খন্দকের যুদ্ধে পরাজিত হয়ে ফিরে এসেছে। এরপর সম্প্রতি কুরায়েশরা মুসলমানদের সঙ্গে হোদায়বিয়ায় সন্ধিচুক্তি করেছে। তাতে মুসলিম ভীতি সর্বত্র আরও ব্যাপকতা লাভ করে।

খায়বরের পথে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)

যুদ্ধ কৌশল বিবেচনা করে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) উত্তর দিকে সিরিয়ার পথ ধরে খায়বর অভিমুখে যাত্রা করলেন। যাতে বনু গাত্বফানের পক্ষ থেকে ইহূদীদের সাহায্য প্রাপ্তির পথ বন্ধ করা যায় এবং ইহূদীরাও এপথে পালিয়ে যাবার সুযোগ না পায়।

খায়বর অভিযানে পথিমধ্যের ঘটনাবলী

১. ‘আমের ইবনুল আকওয়ার কবিতা পাঠ (إنشاد عامر بن الأكوع) : সালামা ইবনুল আকওয়া‘ (سَلَمَةُ بنُ الْأَكْوَع) বলেন, খায়বরের পথে আমরা রাতের বেলা পথ চলছিলাম। ইতিমধ্যে জনৈক ব্যক্তি (আমার চাচা) ‘আমের ইবনুল আকওয়া‘(عَامِرُ بنُ الْأَكْوَع) কে বলল,يَا عَامِرُ أَلاَ تُسْمِعُنَا مِنْ هُنَيْهَاتِكَ؟ ‘হে ‘আমের! তুমি কি আমাদেরকে তোমার অসাধারণ কাব্য-কথা কিছু শুনাবে না? ‘আমের ছিলেন একজন উঁচুদরের কবি। একথা শুনে তিনি নিজের বাহন থেকে নামলেন ও নিজ কওমের জন্য প্রার্থনামূলক কবিতা বলা শুরু করলেন।-

اللَّهُمَّ لَوْلاَ أَنْتَ مَا اهْتَدَيْنَا * وَلاَ تَصَدَّقْنَا وَلاَ صَلَّيْنَا
فَاغْفِرْ فِدَاءً لَكَ مَا أَبْقَيْنَا * وَثَبِّتِ الأَقْدَامَ إِنْ لاَقَيْنَا
وَأَلْقِيَنْ سَكِينَةً عَلَيْنَا * إِنَّا إِذَا صِيْحَ بِنَا أَبَيْنَا
وَبِالصِّيَاحِ عَوَّلُوْا عَلَيْنَا

‘হে আল্লাহ! যদি তুমি অনুগ্রহ না করতে, তাহলে আমরা হেদায়াত পেতাম না। ছাদাক্বা করতাম না, ছালাতও আদায় করতাম না’। ‘আমরা তোমার জন্য উৎসর্গীত। অতএব তুমি আমাদের ক্ষমা কর যেসব পাপ আমরা অবশিষ্ট রেখেছি (অর্থাৎ যা থেকে তওবা করিনি)। তুমি আমাদের পাগুলিকে দৃঢ় রেখো যদি আমরা যুদ্ধের মুকাবিলা করি’। ‘আমাদের উপরে তুমি প্রশান্তি নাযিল কর। আমাদেরকে যখন ভয় দেখানো হয়, তখন আমরা তা প্রত্যাখ্যান করি’। ‘বস্তুতঃ ভয়ের সময় লোকেরা আমাদের উপর ভরসা করে থাকে’ (বুখারী হা/৪১৯৬)।

ইবনু হাজার বলেন, ‘উৎসর্গীত’ কথাটি বান্দার জন্য হয়, আল্লাহর জন্য নয়। তবে এখানে প্রকাশ্য অর্থ উদ্দেশ্য নয়। বরং এর দ্বারা ‘আল্লাহর জন্য আমাদের যাবতীয় সম্মান ও ভালবাসা উৎসর্গীত’ বুঝানো হয়েছে (ফাৎহুল বারী হা/৪১৯৬-এর আলোচনা)।

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, مَنْ هَذَا السَّائِقُ؟ ‘এই চালকটি কে’? লোকেরা বলল, ‘আমের ইবনুল আকওয়া‘। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, يَرْحَمُهُ اللهُ ‘আল্লাহ তার উপরে রহম করুন’। তখন একজন ব্যক্তি বলে উঠল, وَجَبَتْ يَا نَبِىَّ اللهِ، لَوْلاَ أَمْتَعْتَنَا بِهِ ‘হে আল্লাহর নবী! তার উপরে তো শাহাদাত ওয়াজিব হয়ে গেল। যদি আপনি তার দ্বারা আমাদের উপকৃত হওয়ার সুযোগ করে দিতেন’![1] অর্থাৎ যদি তার হায়াত বৃদ্ধির জন্য আপনি দো‘আ করতেন’। কেননা ছাহাবায়ে কেরাম জানতেন যে, যুদ্ধের সময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কারু জন্য ‘রহমত ও মাগফেরাত’-এর দো‘আ করলে তিনি শাহাদাত লাভ করতেন। আর খায়বর যুদ্ধে সেটাই বাস্তবে দেখা গেছে ‘আমের ইবনুল আকওয়া‘-র শাহাদাতের মধ্য দিয়ে। এর দ্বারা যেন এই ভ্রান্ত আক্বীদা সৃষ্টি না হয় যে, রাসূল (ছাঃ) গায়েব জানতেন। কেননা গায়েবের চাবিকাঠি আল্লাহর হাতে। তিনি ব্যতীত তা কেউই জানে না’ (আন‘আম ৬/৫৯)। বরং এটি তাঁর উপর ‘অহি’ করা হয়ে থাকতে পারে। কেননা ‘অহি’ ব্যতীত কোন কথা তিনি বলেন না’ (নাজম ৫৩/৩-৪)।

২. জোরে তাকবীর ধ্বনি করার উপর নিষেধাজ্ঞা (نهى عن التكبير بأعلى الصوت) : পথিমধ্যে একটি উপত্যকা অতিক্রম করার সময় ছাহাবীগণ জোরে জোরে তাকবীর দিতে থাকেন (আল্লাহু আকবর, আল্লাহু আকবর, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ)। তখন রাসূল (ছাঃ) বললেন,ارْبَعُوا عَلَى أَنْفُسِكُمْ ‘তোমরা নরম কণ্ঠে বল’। কেননা إِنَّكُمْ لاَ تَدْعُونَ أَصَمَّ وَلاَ غَائِبًا إِنَّكُمْ تَدْعُونَ سَمِيعًا قَرِيبًا ‘তোমরা কোন বধির বা অনুপস্থিত সত্তাকে ডাকছ না। বরং তোমরা ডাকছ একজন সদা শ্রবণকারী ও সদা নিকটবর্তী এক সত্তাকে’।[2] এর অর্থ এটা নয় যে, আদৌ উচ্চৈঃস্বরে তাকবীর দেওয়া যাবে না। বরং প্রয়োজন বোধে অবশ্যই তা করা যাবে। যেমন তালবিয়াহ, লা হাওলা অলা কুওয়াতা.., ইন্না লিল্লাহ ইত্যাদি সরবে পাঠ করা। যেগুলি অন্যান্য হাদীছ সমূহ দ্বারা প্রমাণিত।[3] অবশ্য এখানে যুদ্ধের কোন কৌশল থাকতে পারে।

৩. কেবল ছাতু খেলেন সবাই(أكلهم السويق فقط) : খায়বরের সন্নিকটে ‘ছাহবা’ (الصَّهْبَاء) নামক স্থানে অবতরণ করে রাসূল (ছাঃ) আছরের ছালাত আদায় করেন। অতঃপর তিনি খাবার চাইলেন। কিন্তু কেবল কিছু ছাতু পাওয়া গেল। তিনি তাই মাখাতে বললেন। অতঃপর তিনি খেলেন ও ছাহাবায়ে কেরাম খেলেন। অতঃপর শুধুমাত্র কুলি করে একই ওযূতে মাগরিব পড়লেন। অতঃপর এশা পড়লেন।[4] এটা নিঃসন্দেহে রাসূল (ছাঃ)-এর একটি মু‘জেযা। যেমনটি ঘটেছিল ইতিপূর্বে খন্দকের যুদ্ধে পেটে পাথর বাঁধা ক্ষুধার্ত নবী ও তাঁর ছাহাবীগণের খাদ্যের ব্যাপারে।

[1]. বুখারী হা/৪১৯৬; মুসলিম হা/১৮০২। এখানে مَا أَبْقَيْنَا, مَا اتَّقَيْنَا, مَا اقْتَفَيْنَا, مَا لَقِينَا শব্দ সমূহ ব্যবহৃত হয়েছে’ (বদরুদ্দীন ‘আয়নী (মৃ. ৮৫৫ হি.), ‘উমদাতুল ক্বারী শরহ ছহীহুল বুখারী (বৈরূত : তাবি) হা/৪১৯৫-এর আলোচনা, ১৭/২৩৫। সবগুলির অর্থ কাছাকাছি মর্মের।
[2]. বুখারী হা/৪২০৫; মুসলিম হা/২৭০৪; মিশকাত হা/২৩০৩।
[3]. মুসলিম শরহ নববী হা/২৭০৪-এর অনুচ্ছেদ ও আলোচনা।
[4]. বুখারী হা/২১৫; ইবনু কাছীর, সীরাহ নববিইয়াহ (বৈরূত : ১৩৯৫ হি./১৯৭৬ খৃ.) ৩/৩৪৬; ওয়াক্বেদী, মাগাযী ২/৬৩৯।

খায়বরে উপস্থিতি

রাসূল (ছাঃ)-এর নীতি ছিল কোথাও যুদ্ধের জন্য গেলে আগের দিন রাতে গিয়ে সেখানে অবস্থান নিতেন। অতঃপর সকালে হামলা করতেন। খায়বরের ক্ষেত্রেও তাই করলেন। তবে শিবিরের স্থান নির্বাচনের ব্যাপারে তিনি পূর্ব সিদ্ধান্ত বাতিল করে অভিজ্ঞ যুদ্ধবিশারদ আনছার ছাহাবী হুবাব ইবনুল মুনযির(حُبَابُ بنُ الْمُنذِر) এর পরামর্শকে অগ্রাধিকার দিয়ে খায়বরের এত নিকটে গিয়ে শিবির সন্নিবেশ করলেন, যেখান থেকে শহর পরিষ্কার দেখা যায়। সেখানে পৌঁছে তিনি সবাইকে বললেন, তোমরা থাম। অতঃপর তিনি আল্লাহর নিকট নিম্নোক্তভাবে আকুল প্রার্থনা করলেন।-

اللَّهُمَّ رَبَّ السَّمَاوَاتِ السَّبْعِ وَمَا أَظْلَلْنَ، وَرَبَّ الْأَرَضِينَ السَّبْعِ وَمَا أَقْلَلْنَ، وَرَبَّ الرِّيَاحِ وَمَا ذَرَيْنَ، وَرَبَّ الشَّيَاطِينِ وَمَا أَضْلَلْنَ، نَسْأَلُكَ خَيْرَ هَذِهِ الْقَرْيَةِ وَخَيْرَ أَهْلِهَا، وَنَعُوذُ بِكَ مِنْ شَرِّهَا وَشَرِّ أَهْلِهَا وَشَرِّ مَا فِيهَا-

‘হে আল্লাহ! তুমি সপ্ত আকাশ ও যেসবের উপরে এর ছায়া রয়েছে তার প্রভু। সপ্ত যমীন ও যা কিছু সে বহন করছে তার প্রভু। ঝঞ্ঝা-বায়ু এবং যা কিছু তা উড়িয়ে নেয়, তার প্রভু। শয়তান সমূহ ও যাদেরকে তারা পথভ্রষ্ট করেছে তাদের প্রভু। আমরা তোমার নিকটে এই জনপদের কল্যাণ, এর বাসিন্দাদের কল্যাণ ও এর মধ্যে যা কিছু আছে সবকিছুর কল্যাণ প্রার্থনা করছি। আমরা তোমার নিকটে আশ্রয় প্রার্থনা করছি এই জনপদের অনিষ্টতা হ’তে, এর বাসিন্দাদের অনিষ্টতা হ’তে এবং এর মধ্যে যা কিছু আছে, সবকিছুর অনিষ্টতা হ’তে’।[1] অতঃপর সৈন্যদের উদ্দেশ্যে বললেন,أَقْدِمُوا بِسْمِ اللهِ ‘আগে বাড়ো, আল্লাহর নামে’। অতঃপর খায়বরের সীমানায় প্রবেশ করে শিবির সন্নিবেশ করলেন।[2]

[1]. ছহীহ ইবনু হিববান হা/২৭০৯; আলবানী, ফিক্বহুস সীরাহ পৃঃ ৩৪০, সনদ হাসান।
[2]. ত্বাবারাণী; হায়ছামী, মাজমাউয যাওয়ায়েদ হা/১৭১১৭; ইবনু হিশাম ২/৩২৯, হাদীছ ছহীহ সনদ ‘মুরসাল’ (তাহকীক ইবনু হিশাম ক্রমিক ১৫৪৫)।

খায়বরের বিবরণ

মদীনা হতে প্রায় ১৭০ কি. মি. উত্তর-পূর্বে অবস্থিত খায়বর একটি বড় শহরের নাম। শহরটি অনেকগুলি দুর্গবেষ্টিত এবং চাষাবাদ যোগ্য কৃষিজমি সমৃদ্ধ। খায়বরের জনবসতি দু’টি অঞ্চলে বিভক্ত। প্রথম অঞ্চলটিতে ৫টি দুর্গ এবং দ্বিতীয় অঞ্চলটিতে ৩টি দুর্গ ছিল। প্রথম অঞ্চলটি দু’ভাগে বিভক্ত। এক ভাগের নাম ‘নাত্বাত’ (نَطَاةُ)। এ ভাগে ছিল সবচেয়ে বড় না‘এম (نَاعِمٌ)-সহ তিনটি দুর্গ এবং আরেক ভাগের নাম ‘শিক্ব’ (الشِّقُّ)। এভাগে ছিল বাকী দু’টি দুর্গ। অন্য অঞ্চলটির নাম ‘কাতীবাহ’ (الكَتِيبَةُ)। এ অঞ্চলে ছিল প্রসিদ্ধ ‘ক্বামূছ’(حِصْنُ الْقَمُوصِ) দুর্গসহ মোট ৩টি দুর্গ। দুই অঞ্চলের বড় বড় ৮টি দুর্গ ছাড়াও ছোট-বড় আরও কিছু দুর্গ ও কেল্লা ছিল। তবে সেগুলি শক্তি ও নিরাপত্তার দিক দিয়ে উপরোক্ত দুর্গগুলির সমপর্যায়ের ছিল না। খায়বরের যুদ্ধ মূলতঃ প্রথম অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ ছিল। দ্বিতীয় অঞ্চলের দুর্গ তিনটি বিনা যুদ্ধে আত্মসমর্পণ করে।

খায়বর যুদ্ধ শুরু ও না‘এম দুর্গ জয়

৮টি দুর্গের মধ্যে সেরা ছিল না‘এম দুর্গ। যা ইহূদী বীর ‘মারহাব’ (مَرْحَب)-এর নেতৃত্বাধীন ছিল। যাকে এক হাযার বীরের সমকক্ষ বলা হত। কৌশলগত দিক দিয়ে এটার স্থান ছিল সবার উপরে। সেজন্য রাসূল (ছাঃ) প্রথমেই এটাকে জয় করার দিকে মনোযোগ দেন।

রাতের বেলা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন,لأُعْطِيَنَّ الرَّايَةَ غَدًا رَجُلاً يُفْتَحُ عَلَى يَدَيْهِ، يُحِبُّ اللهَ وَرَسُولَهُ، وَيُحِبُّهُ اللهُ وَرَسُولُهُ ‘কাল সকালে আমি এমন একজনের হাতে পতাকা দেব, যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে ভালবাসে এবং যাকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ভালবাসেন’। সকালে সবাই রাসূল (ছাঃ)-এর দরবারে হাযির হলেন। নেতৃস্থানীয় প্রত্যেকের ধারণা পতাকা তার হাতে আসবে। এমন সময় রাসূল (ছাঃ) বললেন,أَيْنَ عَلِىُّ بْنُ أَبِى طَالِبٍ؟ ‘আলী ইবনু আবী ত্বালেব কোথায়’? সবাই বলল, চোখের অসুখের কারণে তিনি পিছনে পড়েছেন। রাসূল (ছাঃ) বললেন,فَأَرْسِلُوا إِلَيْهِ فَأْتُونِى بِهِ ‘তার কাছে লোক পাঠাও এবং তাকে আমার কাছে নিয়ে এসো’। অতঃপর তাকে আনা হল। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিজ মুখের লালা তার চোখে লাগিয়ে দিলেন এবং তার জন্য সুস্থতার দো‘আ করলেন। ফলে তিনি এমনভাবে সুস্থ হলেন যেন ইতিপূর্বে তার চোখে কোন অসুখ ছিল না। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) তার হাতে পতাকা দিয়ে বললেন,اُنْفُذْ عَلَى رِسْلِكَ حَتَّى تَنْزِلَ بِسَاحَتِهِمْ ‘ধীরে-সুস্থে এগিয়ে যাও, যতক্ষণ না তাদের এলাকায় অবতরণ কর’। অতঃপর তাদেরকে ইসলামের প্রতি দাওয়াত দাও এবং জানিয়ে দাও আল্লাহর হক হিসাবে তাদের উপরে কি কি বিষয় ওয়াজিব রয়েছে। فَوَاللهِ لَأَن يَّهْدِيَ اللهُ بِكَ رَجُلاً وَاحِدًا خَيْرٌ لَّكَ مِنْ حُمْرِ النَّعَمِ ‘আল্লাহর কসম! যদি আল্লাহ তোমার দ্বারা একজন লোককেও হেদায়াত দান করেন, তবে সেটি তোমার জন্য মূল্যবান লাল উটের (কুরবানীর) চাইতে উত্তম হবে’।[1] যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে রাসূল (ছাঃ)-এর এই বক্তব্যের মাধ্যমে তাঁর শান্তিবাদী নীতি ফুটে ওঠে।

অতঃপর আলী (রাঃ) সেনাদল নিয়ে ‘না‘এম’ (نَاعِمٌ) দুর্গের সম্মুখে উপস্থিত হলেন ও দুর্গবাসীদের প্রথমে ইসলামের দাওয়াত দিলেন। ইহূদীরা এই দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করল এবং তাদের নেতা ‘মারহাব’ দর্পভরে কবিতা বলে এগিয়ে এসে দ্বন্দ্বযুদ্ধের আহবান জানালো। মারহাবের দর্পিত আহবানে সাড়া দিয়ে পাল্টা কবিতা বলে ‘আমের ইবনুল আকওয়া‘ ঝাঁপিয়ে পড়লেন। কিন্তু তাঁর তরবারি আকারে ছোট থাকায় তার আঘাত মারহাবের পায়ের গোছায় না লেগে উল্টা নিজের হাঁটুতে এসে লাগে। যাতে তিনি আহত হন ও পরে মৃত্যুবরণ করেন। নিজের আঘাতে শহীদ হওয়ায় আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বলেন যে, তিনি দ্বিগুণ ছওয়াবের অধিকারী হবেন।[2]

এরপর মারহাব পুনরায় গর্বভরে কবিতা আওড়াতে থাকে ও মুসলিম বাহিনীর প্রতি দ্বন্দ্বযুদ্ধের আহবান জানাতে থাকে। তখন সেনাপতি আলী (রাঃ) তার দর্প চূর্ণ করার জন্য নিজেই এগিয়ে গেলেন এবং গর্বভরে কবিতা বলে সিংহের মত ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে এক আঘাতেই শেষ করে দিলেন। এভাবে তাঁর হাতেই মূলতঃ না‘এম দুর্গ জয় হয়ে গেল।

হযরত আলী (রাঃ) তাঁর পঠিত উক্ত কবিতায় নিজের সম্পর্কে বলেন,

أَنَا الَّذِى سَمَّتْنِى أُمِّى حَيْدَرَهْ + كَلَيْثِ غَابَاتٍ كَرِيهِ الْمَنْظَرَهْ
أُوفِيهِم بِالصَّاعِ كَيْلَ السَّنْدَرَهْ

‘আমি সেই ব্যক্তি আমার মা যার নাম রেখেছিলেন হায়দার (বাঘ)। তাই বনের বাঘের মত ভয়ংকর আমি’। ‘আমি তাদেরকে অতি দ্রুত অধিক সংখ্যায় হত্যা করব’।[3] একারণে হযরত আলীকে ‘আলী হায়দার’ বলা হয়।

‘মারহাব’ নিহত হওয়ার পরে তার ভাই ‘ইয়াসের’ (يَاسِر) এগিয়ে আসে। সে যুবায়ের (রাঃ)-এর হাতে নিহত হয়। তারপর উভয়পক্ষে কিছুক্ষণ যুদ্ধ চলে। তাদের নেতৃস্থানীয় ইহূদীদের অনেকে নিহত হয়। ফলে যুদ্ধ দ্রুত শেষ হয়ে যায় এবং না‘এম দুর্গ বিজয় সমাপ্ত হয়।[4]

[1]. বুখারী হা/৩৭০১, ৪২১০ ‘ছাহাবীগণের ফাযায়েল’ ও ‘মাগাযী’ অধ্যায় ‘আলীর মর্যাদা’ ও ‘খায়বর যুদ্ধ’ অনুচ্ছেদ; ইবনু হিশাম ২/৩৩৪।
[2]. বুখারী হা/৩৮৭৫, ৫৬৮২, ৬৩৮৩; মুসলিম হা/৩৩৮৩।
[3]. মুসলিম হা/১৮০৭। ‘সানদারাহ’ একটি প্রশস্ত পরিমাপের নাম যা দিয়ে অধিক পরিমাণ বস্তু দ্রুত পরিমাপ করা যায় (মুসলিম, শরহ নববী)।

প্রসিদ্ধ আছে যে, এদিন আলী (রাঃ) দুর্গের একটি দরজা উপড়ে ফেলে সেটাকে হাতের ঢাল বানিয়ে যুদ্ধ করেন। অবশেষে যখন আল্লাহ তাকে বিজয় দান করেন, তখন তিনি সেটা ছুঁড়ে ফেলে দেন। রাবী আবু রাফে‘ বলেন, পরে আমরা আটজনে মিলেও সেটা নাড়াতে পারিনি (ইবনু হিশাম ২/৩৩৫; তারীখ ত্বাবারী ৩/১৩)। বর্ণনাটির সনদ মুনক্বাতি‘ বা ‘ছিন্নসূত্র’ (মা শা-‘আ ১৮০ পৃঃ)। আলী (রাঃ)-এর মর্যাদা প্রমাণের জন্য অসংখ্য ছহীহ হাদীছ রয়েছে। অতএব এরূপ যঈফ বর্ণনার আশ্রয় নেওয়া আদৌ সমীচীন নয়।

[4]. ইবনু হিশাম ২/৩৩৪।

প্রসিদ্ধ আছে যে, হযরত যুবায়ের (রাঃ) যখন ময়দানে অবতরণ করেন, তখন তার মা রাসূল (ছাঃ)-এর ফুফু হযরত ছাফিয়া (রাঃ) বলে ওঠেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমার ছেলে কি নিহত হবে? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, না। بَلْ ابْنُكَ يَقْتُلُهُ إنْ شَاءَ اللهُ ‘বরং আপনার ছেলে তার প্রতিপক্ষকে হত্যা করবে ইনশাআল্লাহ’। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেটা বাস্তবায়িত হয়’ (ইবনু হিশাম ২/৩৩৪; যাদুল মা‘আদ ৩/২৮৭; আর-রাহীক্ব ৩৭০ পৃঃ)। বক্তব্যটির সনদ ‘যঈফ’ (আর-রাহীক্ব, তা‘লীক্ব ১৬৫ পৃঃ)।

খায়বরের অন্যান্য দুর্গ জয়

না‘এম দুর্গ জয়ের পর দ্বিতীয় প্রধান দুর্গ ছা‘ব বিন মু‘আয(حِصْنُ الصَّعْب بن مُعَاذ) দুর্গটি বিজিত হয় হযরত হুবাব ইবনুল মুনযির (রাঃ)-এর নেতৃত্বে তিনদিন অবরোধের পর। এই দুর্গটি ছিল খাদ্যসম্ভারে পূর্ণ। আর এই সময় মুসলিম সেনাদলে দারুণ খাদ্য সংকট চলছিল। তখন এ দুর্গটি জয়ের জন্য আল্লাহর নিকটে রাসূল (ছাঃ) বিশেষ দো‘আ করেন[1] এবং সেদিনই সন্ধ্যার পূর্বে দুর্গ জয় সম্পন্ন হয়। এ সময় ক্ষুধার তাড়নায় মুসলিম সেনাদলের কেউ কেউ গাধা যবহ করে তার গোশত রান্না শুরু করে দেয়। এ খবর শুনে রাসূল (ছাঃ) গৃহপালিত গাধার গোশত খাওয়া নিষিদ্ধ করে দেন’ (বুখারী হা/৫৪৯৭)। এই দুর্গ থেকে সেই আমলের প্রচলিত কিছু ট্যাংক ও কামান (মিনজানীক্ব ও দাববাবাহ) হস্তগত হয়। যা দুর্গ দুয়ার ভাঙ্গা এবং পাহাড়ের চূড়া বা উচ্চ ভূমিতে আগুনের গোলা নিক্ষেপের কাজে ব্যবহৃত হ’ত। পরবর্তী যুদ্ধগুলিতে যা খুবই কার্যকর প্রমাণিত হয়। যেমন অত্যন্ত মযবুত ‘নেযার’ (نِزَار) দুর্গটি জয় করার সময় আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) উক্ত ট্যাংক ও কামানের গোলা নিক্ষেপ করে সহজ বিজয় অর্জন করেন। ইসলামের ইতিহাসে এটিই ছিল যুদ্ধে কামান ব্যবহারের প্রথম ঘটনা। নাত্বাত ও শিক্ব অঞ্চলে ৫টি দুর্গের পতনের পর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কাতীবাহ অঞ্চলে গমন করেন ও তাদেরকে অবরোধ করেন। পরে তাদের উপরে কামানের গোলা নিক্ষেপের হুমকি দিলে ১৪দিন পর তারা বেরিয়ে এসে আত্মসমর্পণ করে ও সন্ধির প্রস্তাব দেয়। অতঃপর সন্ধিচুক্তির মাধ্যমে ‘কাতীবাহ’ অঞ্চলের তিনটি দুর্গ বিজিত হয়। এভাবে খায়বর বিজয় সম্পন্ন হয়।

[1]. এখানে নিম্নোক্ত দো‘আটি প্রসিদ্ধ আছে,

اللَّهُمَّ إنَّكَ قَدْ عَرَفْتُ حَالَهُمْ وَأَنْ لَيْسَتْ بِهِمْ قُوَّةٌ، وَأَنْ لَيْسَ بِيَدِي شَيْءٌ أُعْطِيهِمْ إيَّاهُ، فَافْتَحْ عَلَيْهِمْ أَعْظَمَ حُصُونِهَا عَنْهُمْ غَنَاءً، وَأَكْثَرَهَا طَعَامًا وَوَدَكًا-

‘হে আল্লাহ! তাদের (আমার সৈন্যদের) অবস্থা তুমি ভালোভাবে জান। তাদের সহায়-সম্পদ কিছুই নেই। আর আমার নিকটেও এমন কিছু নেই, যা আমি তাদেরকে দিতে পারি। অতএব তুমি ইহূদীদের সবচেয়ে বড় দুর্গটির উপর তাদেরকে বিজয়ী কর। যা তাদের জন্য যথেষ্ট হয়ে যায় এবং সেখান থেকে তাদের অধিক খাদ্য ও চর্বি হস্তগত হয়’ (ইবনু হিশাম ২/৩৩২; আর-রাহীক্ব ৩৭১ পৃঃ, সনদ মু‘যাল বা যঈফ, ঐ তা‘লীক্ব ১৬৫-৬৬ পৃঃ; আলবানী, ফিক্বহুস সীরাহ ৩৪৪ পৃঃ)।

খায়বরে সন্ধির আলোচনা

‘কাতীবাহ’ অঞ্চলের বিখ্যাত ‘ক্বামূছ’(حِصْن الْقَمُوص) দুর্গের অধিপতি মদীনা হ’তে ইতিপূর্বে বিতাড়িত বনু নাযীর গোত্রের নেতা আবুল হুক্বাইক্ব-এর দুই ছেলে সন্ধির বিষয়ে আলোচনার জন্য রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে আসেন। আলোচনায় স্থির হয় যে, দুর্গের মধ্যে যারা আছে, তাদের সবাইকে মুক্তি দেওয়া হবে। তাদের সোনা-রূপাসহ অন্যান্য সকল সম্পদ মুসলিম বাহিনীর অধিকারভুক্ত হবে। ইহূদীরা সপরিবারে দুর্গ ত্যাগ করে চলে যাবে। সুনানে আবুদাঊদের বর্ণনায় এসেছে যে, নিজ নিজ বাহনের উপরে যতটুকু মালামাল নেওয়া সম্ভব ততটুক নেওয়ার অনুমতি তাদেরকে দেওয়া হয়। কেউ কিছু লুকালে সে ব্যাপারে কোন দায়িত্ব বা কোন চুক্তি থাকবে না। কিন্তু আবুল হুক্বাইক্বের ছেলেরা সন্ধিচুক্তি ভঙ্গ করে অনেক মাল লুকিয়ে ফেলে। জিজ্ঞেস করা হ’ল أَيْنَ مَسْكُ حُيَىِّ بْنِ أَخْطَبَ؟ ‘হুয়াই বিন আখত্বাব-এর মশকটি কোথায়? ইতিপূর্বে মদীনা থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার সময় হুয়াই বিন আখত্বাব চামড়ার মশক ভরে যে সোনা-দানা ও অলংকারাদি নিয়ে এসেছিল, সেই মশকটার কথা এখানে বলা হয়েছে। এতদ্ব্যতীত কেনানা বিন আবুল হুক্বাইক্বের নিকটে বনু নাযীরের যে মূল্যবান সম্পদরাজি গচ্ছিত ছিল, সেগুলি সে জনশূন্য একটি স্থানে মাটির নীচে পুঁতে রেখেছিল। জিজ্ঞেস করা হ’লে তারা বলল যে, যুদ্ধ ও অন্যান্য কাজে খরচ হয়ে গেছে। অতঃপর সেগুলি পাওয়া গেল। তখন সন্ধি ভঙ্গের অপরাধে ইবনু আবিল হুক্বাইক্বকে হত্যা করা হ’ল এবং তার পরিবার ও অন্যান্যদের বন্দী করা হ’ল। অতঃপর তাদের সবাইকে খায়বর থেকে বিতাড়িত করতে চাইলে তারা অর্ধেক ফসল দানের বিনিময়ে সন্ধিচুক্তি করে...।[1]

[1]. আবুদাঊদ হা/৩০০৬, সনদ হাসান।

প্রসিদ্ধ আছে যে, কেনানা বিন আবুল হুক্বাইক্বকে জিজ্ঞেস করা হ’লে সে উক্ত বিষয়ে অজ্ঞতা প্রকাশ করে। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কেনানাকে বললেন, أَرَأَيْتُ إنْ وَجَدْنَاهُ عِنْدَكَ، أَأَقْتُلُكَ؟ قَالَ: نَعَمْ ‘উক্ত সম্পদ যদি আমরা তোমার নিকট থেকে বের করতে পারি, তাহ’লে তোমাকে হত্যা করব কি? সে বলল, হ্যাঁ। ইতিমধ্যে কেনানাহর জনৈক চাচাতো ভাই স্থানটির সন্ধান দেয় এবং গচ্ছিত মালের কিছু অংশ পাওয়া যায়। অতঃপর বাকী মালামাল সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে সে আগের মতই অজ্ঞতার ভান করে। তখন তাকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হযরত যুবায়ের (রাঃ)-এর হাতে সমর্পণ করে বলেন, عَذِّبْهُ حَتَّى تَسْتَأْصِلَ مَا عِنْدَهُ ‘একে শাস্তি দিতে থাক, যতক্ষণ না তার নিকটে যা আছে, তা সব বের করে নিতে পার’। হযরত যুবায়ের (রাঃ) তার বুকে চকমকি পাথর দিয়ে আঘাত করতে থাকেন (يَقْدَحُ بِزَنْدٍ فِي صَدْرِهِ)। তাতে সে মৃত্যুর কাছাকাছি পৌঁছে যায় (حَتَّى أَشْرَفَ عَلَى نَفْسِهِ)। অতঃপর তাকে মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহর হাতে অর্পণ করা হ’ল। তিনি তাকে তার ভাই মাহমূদ বিন মাসলামাহকে হত্যার বদলা স্বরূপ হত্যা করেন’ (ইবনু হিশাম ২/৩৩৭; আর-রাহীক্ব ৩৭৪ পৃঃ)। বর্ণনাটির সনদ মু‘যাল বা যঈফ (আর-রাহীক্ব, তা‘লীক্ব ১৬৬ পৃঃ)।

ছাফিইয়াহর সাথে রাসূল (ছাঃ)-এর বিবাহ

কেনানাহ বিন আবুল হুক্বাইক্বের নব বিবাহিতা স্ত্রী ছাফিয়া বিনতে হুয়াই বিন আখত্বাব বন্দী হন। দাসী হিসাবে প্রথমে তাকে দেহিইয়া কালবীকে দেয়া হয়। পরক্ষণেই নেতৃকন্যা হিসাবে তাকে রাসূল (ছাঃ)-এর ভাগে দেওয়া হয়। রাসূল (ছাঃ) তাকে ইসলামের দাওয়াত দিলে তিনি ইসলাম কবুল করেন। অতঃপর তাকে মুক্ত করে তিনি তাকে বিবাহের মাধ্যমে স্ত্রীর মর্যাদা দান করেন। এই মুক্তি দানকেই তার মোহরানা হিসাবে গণ্য করা হয়। অতঃপর মদীনায় ফেরার পথে ‘ছাহবা’ (الصَّهْبَاء) নামক স্থানে পৌঁছে ‘ছাফিয়া’ হালাল হলে তার সঙ্গে সেখানে তিনদিন বাসর যাপন করেন’ (বুখারী হা/৪২১১)। আনাস (রাঃ)-এর মা উম্মে সুলায়েম তাকে সাজ-সজ্জা করে রাসূল (ছাঃ)-এর কাছে পাঠান। এই সময় তার মুখে (অন্য বর্ণনায় দু’চোখে) সবুজ দাগ দেখে রাসূল (ছাঃ) তাকে এর কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনার খায়বর আগমনের পূর্বে আমি একরাতে স্বপ্ন দেখি যে, চাঁদ কক্ষচ্যুত হয়ে আমার কোলে পড়ল। একথা কেনানাকে বললে সে আমার গালে জোরে থাপ্পড় মারে, আর বলে যে, أَتُرِيْدِيْنَ مَلِكَ يَثْرِبَ؟ ‘তুমি কি ইয়াছরিবের বাদশাহকে চাও? তিনি বলেন, আমার নিকটে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর চাইতে নিকৃষ্ট ব্যক্তি কেউ ছিলেন না। কারণ তিনি আমার পিতা ও স্বামীকে হত্যা করেছেন। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) আমার নিকটে বারবার ওযর পেশ করেন এবং বলেন, হে ছাফিইয়াহ! তোমার পিতা আমার বিরুদ্ধে আরবদের জমা করেছিলেন। তাছাড়া অমুক অমুক কাজ করেছিলেন। অবশেষে আমার অন্তর থেকে তার উপরে বিদ্বেষ দূরীভূত হয়ে যায়’।[1]

[1]. ছহীহ ইবনু হিববান হা/৫১৯৯; ত্বাবারাণী, ছহীহাহ হা/২৭৯৩; ইবনু হিশাম ২/৩৩৬।

রাসূল (ছাঃ)-কে বিষ প্রয়োগে হত্যার চেষ্টা

খায়বর বিজয়ের পর রাসূল (ছাঃ) যখন একটু নিশ্চিন্ত হলেন, তখন বিতাড়িত বনু নাযীর গোত্রের অন্যতম নেতা ও কোষাধ্যক্ষ সাল্লাম বিন মিশকামের স্ত্রী যয়নব বিনতুল হারেছ তাকে বকরীর ভূনা রান হাদিয়া পাঠায়। সে আগেই জেনে নিয়েছিল যে, রাসূল (ছাঃ) রানের গোশত পছন্দ করেন। এজন্য উক্ত মহিলা উক্ত রানে ভালভাবে বিষ মাখিয়ে দিয়েছিল। রাসূল (ছাঃ) গোশতের কিছু অংশ চিবিয়ে ফেলে দেন, গিলেননি। অতঃপর বলেন, إنَّ هَذَا الْعَظْمَ لَيُخْبِرُنِي أَنَّهُ مَسْمُومٌ ‘এই হাড্ডি আমাকে বলছে যে, সে বিষ মিশ্রিত’। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তখন উক্ত মহিলাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলে সে কৈফিয়ত দিয়ে বলল, এর দ্বারা আমার উদ্দেশ্য ছিল এই যে, إنْ كَانَ مَلِكًا اسْتَرَحْتُ مِنْهُ، وَإِنْ كَانَ نَبِيًّا فَسَيُخْبَرُ ‘যদি এই ব্যক্তি বাদশাহ হন, তাহলে আমরা তার থেকে নিষ্কৃতি পাব। আর যদি নবী হন, তাহলে তাঁকে বিষয়টি জানিয়ে দেওয়া হবে’। অন্য বর্ণনায় এসেছে, أَرَدْنَا إِنْ كُنْتَ كَاذِبًا نَسْتَرِيحُ وَإِنْ كُنْتَ نَبِيًّا لَمْ يَضُرَّكَ ‘আমরা চেয়েছিলাম যদি আপনি মিথ্যাবাদী হন, তাহলে আমরা নিষ্কৃতি পাব। আর যদি আপনি নবী হন, তাহলে এ বিষ আপনার কোন ক্ষতি করবে না’।[1] তখন রাসূল (ছাঃ) তাকে ক্ষমা করে দেন। কিন্তু সাথী বিশর বিন বারা বিন মা‘রূর এক টুকরা চিবিয়ে খেয়ে ফেলেছিলেন। যাতে তিনি মারা যান। ফলে তার বদলা স্বরূপ ঐ মহিলাকে হত্যা করা হয়।[2]

[1]. বুখারী হা/৩১৬৯; আহমাদ হা/৩৫৪৭, ২৭৮৫।
[2]. ইবনু হিশাম ২/৩৩৭; ফিক্বহুস সীরাহ ৩৪৭ পৃঃ, সনদ ছহীহ; হাকেম হা/৪৯৬৭।

খায়বর যুদ্ধে উভয় পক্ষে নিহতের সংখ্যা

এই যুদ্ধে বিভিন্ন সময়ের সংঘর্ষে সর্বমোট শহীদ মুসলমানের সংখ্যা ছিল ১৬ জন। তন্মধ্যে ৪ জন কুরায়েশ, ১ জন আশজা‘ গোত্রের, ১ জন আসলাম গোত্রের, ১ জন খায়বরবাসী ও বাকী ৯ জন ছিলেন আনছার। তবে ১৬ জনের স্থলে ১৮, ১৯, ২৩ মর্মে মতভেদ রয়েছে। ইহূদী পক্ষে মোট ৯৩ জন নিহত হয় (আর-রাহীক্ব ৩৭৭ পৃঃ)।

খায়বরের ভূমি ইহূদীদের হাতে প্রত্যর্পণ ও সন্ধি

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ইহূদীদেরকে মদীনার ন্যায় খায়বর হ’তেও নির্মূল করতে চেয়েছিলেন এবং সেমতে কাতীবাহর ইহূদীরা সবকিছু ফেলে চলে যেতে রাযীও হয়েছিল। কিন্তু ইহূদী নেতারা এক পর্যায়ে রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে আবেদন করল যে, আমাদের এখানে থাকতে দেওয়া হৌক, আমরা এখানকার জমি-জমা দেখাশুনা ও চাষাবাদ করব ও আপনাদেরকে ফসলের অর্ধেক ভাগ দেব। এখানকার মাটি সম্পর্কে আমাদের অভিজ্ঞতা আপনাদের চেয়ে বেশী রয়েছে’। আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) তাদের এ প্রস্তাব বিবেচনা করলেন এবং উৎপন্ন ফসলের অর্ধাংশ প্রদানের শর্তে রাযী হ’লেন। সেই সাথে বলে দিলেন যতদিন তিনি চাইবেন, কেবল ততদিনই এ চুক্তি বহাল থাকবে। প্রয়োজনবোধে যেকোন সময় এ চুক্তি তিনি বাতিল করে দিবেন। অতঃপর উৎপাদনের পরিমাণ নির্ধারণের জন্য তিনি আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহাকে দায়িত্ব দেন।

খায়বরের গণীমত বণ্টন

খায়বরের যুদ্ধে ভূমি সহ বিপুল পরিমাণ গণীমত হস্তগত হয়। যার অর্ধেক ভবিষ্যৎ প্রয়োজনের জন্য রেখে দিয়ে বাকী অর্ধেক ১৮০০ ভাগে ভাগ করা হয়। হোদায়বিয়ার ১৪০০ সাথীর মধ্যে উপস্থিত ও অনুপস্থিত সকলের জন্য অংশ নির্ধারিত ছিল। এদের মধ্যে ২০০ জন ছিলেন অশ্বারোহী। প্রত্যেক পদাতিকের জন্য একভাগ ও অশ্বারোহীর জন্য ঘোড়ার দু’ভাগ সহ তিন ভাগ। এক্ষণে ১২০০ পদাতিকের জন্য ১২০০ ভাগ এবং ২০০ অশ্বারোহীর জন্য ৬০০ ভাগ, সর্বমোট ১৮০০ ভাগে গণীমত বণ্টন করা হয়। উক্ত হিসাবে আল্লাহর রাসূলও একটি ভাগ পান।[1] মহিলাদের জন্য গণীমতের অংশ দেওয়া হয়নি। তবে ‘ফাই’ থেকে তাদের দেওয়া হয় (তারীখ ত্বাবারী ৩/১৭)।

[1]. যাদুল মা‘আদ ৩/২৯১-৯৩; আর-রাহীক্ব ৩৭৪-৭৫ পৃঃ।

ফাদাকের খেজুর বাগান

এই সময় ফাদাক (فَدَك)-এর খেজুর বাগান রাসূল (ছাঃ)-এর জন্য ‘খাছ’ হিসাবে বণ্টিত হয়। কেননা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন প্রথম খায়বরে উপস্থিত হন, তখন তিনি ফাদাকের ইহূদীদের কাছে ইসলামের দাওয়াত দেবার জন্য মুহাইয়েছাহ বিন মাসঊদ (রাঃ)-কে পাঠান। কিন্তু তারা বিলম্ব করে। অতঃপর যখন খায়বর বিজিত হল, তখন তারা ভীত হয়ে পড়ল এবং রাসূল (ছাঃ)-এর কাছে দূত পাঠালো এই মর্মে যে, খায়বরবাসীদের সঙ্গে ফসলের অর্ধাংশ দেবার শর্তে যেরূপ সন্ধি করা হয়েছে, তারাও অনুরূপ সন্ধিতে আগ্রহী। তাদের এ প্রস্তাব কবুল করা হয় এবং ফাদাকের ভূমি রাসূল (ছাঃ)-এর জন্য নির্দিষ্ট করা হয়। কেননা এই ভূমি জয় করতে কোনরূপ যুদ্ধের প্রয়োজন হয়নি। কেবলমাত্র রাসূল (ছাঃ)-এর দাওয়াতের মাধ্যমে তা বিজিত হয়েছিল (ইবনু হিশাম ২/৩৩৭, ৩৫৩)।

উল্লেখ্য যে, এই ফাদাকের খেজুর বাগানের উত্তরাধিকার প্রশ্নেই রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যুর পরে খলীফা আবুবকরের সঙ্গে হযরত ফাতেমা ও আলী (রাঃ)-এর বিরোধ হয়। হাদীছটি ছিল,إنَّا مَعْشَرُ الأنبياءِ لاَ نُورَثُ مَا تَرَكْنَاهُ صَدَقَةٌ ‘আমরা নবীরা আমাদের সম্পদের উত্তরাধিকারী কেউ হয় না। যা কিছু আমরা ছেড়ে যাই, সবই ছাদাক্বা হয়ে যায়’।[1] তিনি বলেন,إِنَّ الأَنْبِيَاءَ لَمْ يُوَرِّثُوا دِينَارًا وَلاَ دِرْهَمًا إِنَّمَا وَرَّثُوا الْعِلْمَ فَمَنْ أَخَذَ بِهِ أَخَذَ بِحَظٍّ وَافِرٍ ‘নবীগণ কোন দীনার বা দিরহাম রেখে যান না। তাঁরা রেখে যান কেবল ইল্ম। অতএব যে ব্যক্তি তা গ্রহণ করেছে, সে পূর্ণ অংশ গ্রহণ করেছে’।[2] বলা বাহুল্য যে, শী‘আরা এখনো উক্ত ফাদাকের সম্পত্তির দাবীতে অটল। তারা খলীফা আবুবকর ও ওমর (রাঃ)-কে দায়ী করে থাকে। অথচ পরে আলী (রাঃ) নিজে খলীফা হয়েও ঐ সম্পত্তি দাবী করেননি।

এভাবে খায়বর যুদ্ধে বিপুল গণীমত লাভ হয়। যে বিষয়ে আল্লাহ হোদায়বিয়া থেকে ফেরার পথে আয়াত নাযিল করে বলেছিলেন,وَمَغَانِمَ كَثِيرَةً يَأْخُذُونَهَا وَكَانَ اللهُ عَزِيزًا حَكِيمًا- وَعَدَكُمُ اللهُ مَغَانِمَ كَثِيرَةً تَأْخُذُونَهَا فَعَجَّلَ لَكُمْ هَذِهِ وَكَفَّ أَيْدِيَ النَّاسِ عَنْكُمْ وَلِتَكُونَ آيَةً لِلْمُؤْمِنِينَ وَيَهْدِيَكُمْ صِرَاطًا مُسْتَقِيمًا ‘আর তিনি তাদের বিপুল পরিমাণ গণীমত লাভের ওয়াদা দিচ্ছেন, যা তারা লাভ করবে। বস্ত্ততঃ আল্লাহ মহা পরাক্রান্ত ও প্রজ্ঞাময়’। ‘আল্লাহ তোমাদেরকে বিপুল পরিমাণ গণীমতের ওয়াদা দিচ্ছেন, যা তোমরা লাভ করবে। তিনি তোমাদের জন্য এটি ত্বরান্বিত করবেন এবং তোমাদের থেকে লোকদের প্রতিরোধ করবেন। যাতে এটা মুমিনদের জন্য নিদর্শন হয় এবং তিনি তোমাদেরকে সরল পথ প্রদর্শন করেন’ (ফাৎহ ৪৮/১৯-২০)।

[1]. নাসাঈ হা/৪১৪৮; সুনানুল কুবরা হা/৬৩০৯; কানযুল ‘উম্মাল হা/৩৫৬০০; বুখারী হা/৬৭২৭; মুসলিম হা/১৭৫৮; মিশকাত হা/৫৯৬৭।
[2]. তিরমিযী হা/২৬৮২; আহমাদ হা/২১৭৬৩; আবুদাঊদ হা/৩৬৪১; ইবনু মাজাহ হা/২২৩; মিশকাত হা/২১২।

খায়বর যুদ্ধের পর মুসলমানদের সচ্ছলতা লাভ

মা আয়েশা (রাঃ) বলেন, খায়বর যুদ্ধে বিজয় লাভের পর আমরা বলতে লাগলাম,الآنَ نَشْبَعُ مِنَ التَّمْرِ ‘এখন আমরা খেজুর খেয়ে তৃপ্ত হ’তে পারব’ (বুখারী হা/৪২৪২)। খায়বর থেকে মদীনায় ফিরে মুহাজিরগণ আনছারগণকে তাদের দেওয়া খেজুর গাছগুলি ফেরৎ দেন। কেননা তখন তাদের জন্য খায়বরে খেজুর গাছের ব্যবস্থা হয়ে গিয়েছিল’ (মুসলিম হা/১৭৭১)।

জা‘ফর, আবু মূসা আশ‘আরী ও আবু হুরায়রা-র আগমন

এসময় জা‘ফর, আবু মূসা আশ‘আরী ও আবু হুরায়রা (রাঃ) খায়বরে আগমন করেন। ফলে উক্ত গণীমতে তাদেরকেও শরীক করা হয়। আবু হুরায়রা (রাঃ) মুসলমান হয়ে মদীনায় যান। অতঃপর সেখান থেকে খায়বর আসেন (আল-ইছাবাহ, আবু হুরায়রা ক্রমিক ১০৬৭৪)। তখন যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে। উক্ত গণীমতে জা‘ফর বিন আবু ত্বালিব ও আবু মূসা আশ‘আরীসহ হাবশা হ’তে সদ্য আগত ছাহাবীগণকেও শরীক করা হয়। যাদের সংখ্যা ছিল ১৬ জন। ‘আমর বিন উমাইয়া যামরীকে পূর্বেই আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বাদশাহ নাজাশীর দরবারে পাঠিয়েছিলেন এদেরকে মদীনায় নিয়ে আসার জন্য। রাসূল (ছাঃ) এই সময় জা‘ফরকে পেয়ে এত খুশী হয়েছিলেন যে, তিনি উঠে তাকে আলিঙ্গন করলেন এবং বললেন,وَاللهِ مَا أَدْرِي بِأَيِّهِمَا أَفْرَحُ، بِفَتْحِ خَيْبَرَ أَمْ بِقُدُومِ جَعْفَرٍ؟ ‘আল্লাহর কসম! আমি জানি না কোনটাতে আমি বেশী খুশী হয়েছি। খায়বর বিজয়ে না জা‘ফরের আগমনে’?[1] এসময় বাদশাহ নাজাশী জা‘ফরের মাধ্যমে বহুমূল্য উপঢৌকনাদি সহ ভাতিজা যূ-মিখমারকে(ذُو مِخْمَرٍ) রাসূল (ছাঃ)-এর খিদমতের জন্য পাঠিয়েছিলেন (আল-বিদায়াহ ৩/৭৮)।

উল্লেখ্য যে, রাসূল (ছাঃ)-এর আবির্ভাবের খবর শুনে আবু মূসা আশ‘আরী ইয়ামন হ’তে তার গোত্রের ৫০-এর অধিক লোক নিয়ে মদীনার উদ্দেশ্যে হিজরত করেন। কিন্তু পথিমধ্যে তাদের নৌকা পথ হারিয়ে তাদেরকে নাজাশীর দেশে নামিয়ে দেয়। আর সেখানেই জা‘ফর (রাঃ)-এর সাথে তাদের সাক্ষাৎ হয়ে যায়। ফলে তারা তাদের সঙ্গেই সেখানে অবস্থান করেন ও পরে সেখান থেকে খায়বরে আসেন ও রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে সাক্ষাৎ করেন।[2]

[1]. শারহুস সুন্নাহ, মিশকাত হা/৪৬৮৭; ছহীহাহ হা/২৬৫৭; ফিক্বহুস সীরাহ ৩৪৭ পৃঃ; সনদ হাসান। উল্লেখ্য যে, এ সময় রাসূল (ছাঃ) তার ‘কপালে চুমু খান’ বলে যে বর্ণনা এসেছে, তা ‘মুরসাল’ ও যঈফ (হাকেম হা/৪৯৪১, আহমাদ হা/২১৯১২)।
[2]. আল-ইছাবাহ ক্রমিক ৪৯০১; বুখারী হা/৩১৩৬; মুসলিম হা/২৫০২।

বেদুঈনের ঈমান

শাদ্দাদ বিন হাদ (রাঃ) বলেন, জনৈক বেদুঈন মুসলমান হ’লে খায়বরের যুদ্ধের গণীমতের অংশ তাকেও দেয়া হয়। সে দুম্বা চরাত। গণীমতের মাল নিয়ে সে রাসূল (ছাঃ)-এর দরবারে উপস্থিত হ’ল এবং বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমি তো এজন্য আপনার সাথী হইনি। আমি তো এসেছিলাম এজন্য যাতে আমার কণ্ঠনালীতে একটা তীর লাগে। আর আমি শহীদ হয়ে জান্নাতে প্রবেশ করি’। রাসূল (ছাঃ) বললেন, যদি তুমি সত্য হও, তাহ’লে আল্লাহ তোমার আকাংখা পূর্ণ করবেন। এরপর সে যুদ্ধে গমন করল এবং কণ্ঠনালীতে তীর লেগে সে শহীদ হয়ে গেল। তার লাশের পাশ দিয়ে যাবার সময় রাসূল (ছাঃ) তাকে চিনতে পেরে বলেন, এ ব্যক্তি কি সেই-ই? লোকেরা বলল, হ্যাঁ। তখন রাসূল (ছাঃ) বললেন, আল্লাহর সঙ্গে তার কারবার সত্য ছিল। আল্লাহ তার আকাংখা পূর্ণ করেছেন। অতঃপর তিনি স্বীয় জুববা দিয়ে তার কাফন পরান ও জানাযা করেন। তার জন্য তিনি দো‘আ করেন, হে আল্লাহ! এটি তোমার বান্দা। বেরিয়েছিল তোমার রাস্তায় মুহাজির হিসাবে। অতঃপর শহীদ হয়ে গেছে। আমি তার সাক্ষী’।[1]

একই ঘটনা জাবের বিন আব্দুল্লাহ বলেন, আমরা রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে খায়বর যুদ্ধে ছিলাম। অতঃপর একটি ছোট সেনাদল বেরিয়ে যায়। তারা একজন মেষচারককে ধরে আনে। সে রাসূল (ছাঃ)-কে এসে বলে যে, আমি আপনার উপর ঈমান এনেছি এবং যুদ্ধ করে শহীদ হ’তে চাই। কিন্তু আমার এই মেষপালের উপায় কি হবে? এগুলি আমার নিকট অন্যের আমানত। জবাবে রাসূল (ছাঃ) বললেন, তুমি এগুলি স্ব স্ব মনিবের বাড়ীর উদ্দেশ্যে হাঁকিয়ে দাও’। সে তাই করল। রাসূল (ছাঃ) তাদের সম্মুখ দিকে একমুষ্টি মাটি ছুঁড়ে মারলেন। অতঃপর প্রত্যেকটি দুম্বা স্ব স্ব মালিকের বাড়ীতে পৌঁছে গেলে সে ফিরে এল এবং যুদ্ধে যোগদান করল। অতঃপর সে একটি তীর বিদ্ধ হয়ে শহীদ হয়ে গেল। অথচ ঐ ব্যক্তি আল্লাহর জন্য কখনো একটি সিজদাও করেনি’(وَلَمْ يُصَلِّ لِلَّهِ سَجْدَةً قَطُّ)।[2]

[1]. বায়হাক্বী হা/৭০৬৫; হাকেম হা/৬৫২৭; নাসাঈ হা/১৯৫৩, সনদ ছহীহ; আলবানী, আহকামুল জানায়েয ১/৬১।
[2]. হাকেম হা/২৬০৯। হাকেম ‘ছহীহ’ বলেছেন। কিন্তু যাহাবী একজন রাবী শুরাহবীল বিন সা‘দকে ‘মিথ্যায় অপবাদগ্রস্ত’ বলেছেন; বায়হাক্বী হা/১৮২০৫, ৯/১৪৩ পৃঃ সনদ ‘মুরসাল’।



প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর ৬৭ পর্বের জীবনীর সকল পর্ব এখান থেকে পড়ুন-

পর্ব-০১   পর্ব-০২   পর্ব-০৩   পর্ব-০৪   পর্ব-০৫   পর্ব-০৬   পর্ব-০৭   পর্ব-০৮   পর্ব-০৯   পর্ব-১০   পর্ব-১১   পর্ব-১২   পর্ব-১৩   পর্ব-১৪   পর্ব-১৫   পর্ব-১৬   পর্ব-১৭   পর্ব-১৮   পর্ব-১৯   পর্ব-২০   পর্ব-২১   পর্ব-২২   পর্ব-২৩   পর্ব-২৪   পর্ব-২৫   পর্ব-২৬   পর্ব-২৭   পর্ব-২৮   পর্ব-২৯   পর্ব-৩০    পর্ব-৩১   পর্ব-৩২   পর্ব-৩৩   পর্ব-৩৪   পর্ব-৩৫   পর্ব-৩৬   পর্ব-৩৭   পর্ব-৩৮   পর্ব-৩৯   পর্ব-৪০   পর্ব-৪১   পর্ব-৪২   পর্ব-৪৩   পর্ব-৪৪   পর্ব-৪৫   পর্ব-৪৬(১ম) পর্ব-৪৬(২য়)    পর্ব-৪৭   পর্ব-৪৮   পর্ব-৪৯   পর্ব-৫০   পর্ব-৫১   পর্ব-৫২   পর্ব-৫৩   পর্ব-৫৪   পর্ব-৫৫   পর্ব-৫৬   পর্ব-৫৭   পর্ব-৫৮   পর্ব-৫৯   পর্ব-৬০   পর্ব-৬১   পর্ব-৬২   পর্ব-৬৩   পর্ব-৬৪   পর্ব-৬৫   পর্ব-৬৬   পর্ব-৬৭  



**************************************
>>> Welcome, You are now on Mohammadia Foundation's Website. Please stay & Tune with us>>>


এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url