প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর জীবনী [পর্ব-১৪]




ইসলামের বিজয়ের ভবিষ্যদ্বাণী এবং সেই বিজয় রোধ করতে কাফেরদের চেষ্টা


ইসলামের বিজয়ের ভবিষ্যদ্বাণী

ছাহাবায়ে কেরামের মধ্যে বিশেষ করে দুর্বলদের উপরে কাফের নেতাদের পক্ষ হতে যখন অবর্ণনীয় নির্যাতনসমূহ করা হচ্ছিল। তখন একদিন অন্যতম নির্যাতিত ছাহাবী খাববাব ইবনুল আরাত এসে রাসূল (ছাঃ)-কে কাফেরদের বিরুদ্ধে বদদো‘আ করার আহবান জানান। রাসূল (ছাঃ) তখন কাবাগৃহের ছায়ায় চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে ছিলেন।[১] খাববাবের কথা শুনে তিনি উঠে বসেন এবং রাগতস্বরে বলেন, যা ইতিপূর্বে (১৩তম পর্বে) বলা হয়েছে।

মদীনায় হিজরতের পরেও ৯ম হিজরীর রবীউল আউয়াল মাসে ইসলাম কবুল করতে আসা খ্রিষ্টান নেতা ‘আদী বিন হাতেমকে তিনি একই ধরনের জবাব দিয়ে বলেছিলেন, يَا عَدِىُّ هَلْ رَأَيْتَ الْحِيرَةَ؟ قُلْتُ لَمْ أَرَهَا وَقَدْ أُنْبِئْتُ عَنْهَا. قَالَ فَإِنْ طَالَتْ بِكَ حَيَاةٌ لَتَرَيَنَّ الظَّعِينَةَ تَرْتَحِلُ مِنَ الْحِيرَةِ حَتَّى تَطُوفَ بِالْكَعْبَةِ، لاَ تَخَافُ أَحَدًا إِلاَّ اللهَ، ‘হে ‘আদী! তুমি কি (ইরাকের) হীরা নগরী চেন? তিনি বললেন, আমি দেখিনি। তবে তার সম্পর্কে শুনেছি। রাসূল (ছাঃ) বললেন, যদি তোমার হায়াত দীর্ঘ হয়, তাহলে তুমি দেখবে, একজন হাওদানশীন মহিলা একাকী সেখান থেকে গিয়ে কাবাগৃহ তাওয়াফ করে ফিরে আসবে। অথচ সে কাউকে ভয় পাবে না আল্লাহ ব্যতীত’। ‘আদী বলেন, আমি পর্দানশীন মহিলাকে হীরা নগরী থেকে একাকী সফর করে কাবাগৃহ তাওয়াফ করে ফিরে আসতে দেখেছি। সে আল্লাহ ব্যতীত কাউকে ভয় করেনি। আমি পারস্য সম্রাট কিসরার অর্থ ভান্ডার বিজয়ে শরীক হয়েছি। এরপর যদি তোমাদের হায়াত দীর্ঘ হয়, তাহলে তোমরা অবশ্যই বাস্তবে দেখতে পাবে, যা নবী আবুল ক্বাসেম (ছাঃ) ভবিষ্যদ্বাণী করে গিয়েছেন যে, তোমরা অঞ্জলী ভরা অর্থ নিয়ে বের হবে। অথচ তা দান করার মত কোন গ্রহিতা খুঁজে পাবে না’।[২]
[১]. বুখারী হা/৩৬১২; মিশকাত হা/৫৮৫৮।
[২]. বুখারী হা/৩৫৯৫; আহমাদ হা/১৮২৮৬; মিশকাত হা/৫৮৫৭, ‘নবুঅতের নিদর্শনসমূহ’ অনুচ্ছেদ।

আরক্বামের গৃহে প্রচার কেন্দ্র

মুসলমানগণ পাহাড়ের পাদদেশে ও বিভিন্ন গোপন স্থানে মিলিত হয়ে জামআতের সাথে ছালাত আদায় করতেন এবং দ্বীনের তালীম নিতেন। একদিন কতিপয় মুশরিক এটা দেখে ফেলে এবং মুসলমানদের অশ্রাব্য ভাষায় গালি দিতে দিতে তাদের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তখন হযরত সা‘দ বিন আবু ওয়াকক্বাছ (রাঃ) তাদের একজনকে উটের চোয়ালের শুকনো হাড্ডি দিয়ে মেরে রক্তাক্ত করেন। ফলে তারা পালিয়ে যায়। এটিই ছিল ইসলামের জন্য প্রথম রক্ত প্রবাহিত করার ঘটনা’। চতুর্থ নববী বর্ষে এটি ঘটেছিল।[১]

এই ঘটনার পরে ৫ম নববী বর্ষে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) আরক্বাম বিন আবুল আরক্বাম আল-মাখযূমীর বাড়িটিকে প্রশিক্ষণ ও প্রচার কেন্দ্র হিসাবে বেছে নেন। বাড়িটি ছিল ছাফা পাহাড়ের উপরে। যা ছিল অপেক্ষাকৃত নিরাপদ এবং মুশরিকদের দৃষ্টির আড়ালে।[২] কাফের নেতাদের সম্মেলনস্থল ‘দারুন নাদওয়া’ থেকে এটা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন স্থানে। যদিও আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) নিজে সর্বদা প্রকাশ্যে ছালাত আদায় করতেন।

[১]. ইবনু হিশাম ১/২৬২-৬৩; আল-বিদায়াহ ৩/৩৭; আর-রাহীক্ব ৯১ পৃঃ; আল-ইছাবাহ, সা‘দ বিন আবু ওয়াক্কাছ ক্রমিক ৩১৯৬। ইবনু হিশামে বলা হয়েছে যে, তিনি হামলাকারী কাফেরকে لَحْيِ بَعِيرٍ দ্বারা আঘাত করেন। ভাষ্যকার সুহায়লী তার ব্যাখ্যা করেছেন, اللحى: الْعظم الّذي على الْفَخْذ ‘রানের উপরে উরুস্তম্ভের হাড্ডি’ (ইবনু হিশাম ১/২৬৩ টীকা-৪)। কিন্তু এই ব্যাখ্যা সঠিক নয়। বরং সঠিক অর্থ হবে যা সীরাহ হালাবিইয়াহ-তে করা হয়েছে,لحى بعير: أي العظم الذي تنبت عليه الأسنان অর্থাৎ চোয়ালের হাড্ডি। যাতে দাঁত সমূহ উদ্গত হয়’ (সীরাহ হালাবিইয়াহ ১/৪৮৩)।
[২]. ইবনু হিশাম ১/২৫৩ টীকা-১; আল-বিদায়াহ ৫/৩৪১; আর-রাহীক্ব ৯২ পৃঃ।

শিক্ষণীয় বিষয়সমূহ
(১) তাওহীদ, রিসালাত ও আখেরাতের উপরে বিশ্বাস দৃঢ় থাকার কারণেই ছাহাবায়ে কেরাম লোমহর্ষক নির্যাতনসমূহ বরণ করে নিতে সমর্থ হয়েছিলেন। অথচ নির্যাতনকারীরাও এসবে বিশ্বাসী ছিল বলে দাবী করত। প্রকৃত অর্থে তারা ছিল কপট বিশ্বাসী অথবা শিথিল বিশ্বাসী। এ যুগেও ঐরূপ মুসলমানেরা দৃঢ় বিশ্বাসী খাঁটি মুসলমানদেরকে ক্ষেত্র বিশেষে অনুরূপ নির্যাতন করে থাকে।
(২) প্রকৃত ও দৃঢ় বিশ্বাসীদের সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমেই সমাজ বিপ্লব সাধিত হয়। কপট, শিথিল বিশ্বাসী ও সুবিধাবাদীদের মাধ্যমে নয়। তাদের দুনিয়াবী জৌলুস যতই থাক না কেন।
(৩) বিশ্বাস ও কর্মের পরিবর্তন ব্যতীত সমাজের কাংখিত পরিবর্তন সম্ভব নয়।
(৪) শুধু নেতা নয়, সাথে সাথে কর্মীদের নিঃস্বার্থ ত্যাগ ও কুরবানীর মাধ্যমেই একটি মহতী আদর্শ প্রতিষ্ঠা লাভ করে থাকে।
(৫) যুলুম প্রতিরোধের বৈধ কোন পথ খোলা না থাকলে দৃঢ়ভাবে ধৈর্য ধারণ করে আল্লাহর রহমত কামনা করাই হ’ল মুক্তির একমাত্র পথ।

হাবশায় হিজরত

১ম হিজরত

রজব ৫ম নববী বর্ষ):
চতুর্থ নববী বর্ষের মাঝামাঝি থেকে মুসলমানদের উপরে যে নির্যাতন শুরু হয় ৫ম নববী বর্ষের মাঝামাঝি নাগাদ তা চরম আকার ধারণ করে। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এই মযলূম মুসলমানদের রক্ষার জন্য উপায় খুঁজতে থাকেন। তিনি আগে থেকেই পার্শ্ববর্তী হাবশার ন্যায়নিষ্ঠ খ্রিষ্টান রাজা আছহামা নাজাশী (أَصْحَمَةُ النَّجَاشِىُّ)-র সুনাম শুনে আসছিলেন যে, তার রাজ্যে মানুষ সুখে-শান্তিতে বসবাস করে। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সবাইকে স্বাধীনভাবে তাদের ধর্ম পালন করতে দেওয়া হয়। অতএব তিনি সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে প্রয়োজনীয় পরামর্শ শেষে হাবশায় হিজরতের নির্দেশ দানের সিদ্ধান্ত নেন। সেমতে নবুঅতের পঞ্চম বর্ষের রজব মাসে হযরত ওছমান (রাঃ)-এর নেতৃত্বে ১২ জন পুরুষ ও ৪ জন মহিলার প্রথম দলটি রাতের অন্ধকারে অতি সঙ্গোপনে হাবশার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে যায়। এই দলে রাসূল (ছাঃ)-এর কন্যা ‘রুক্বাইয়া’ ছিলেন।[১] ভাগ্যক্রমে ঐ সময় লোহিত সাগরের বন্দর শো‘আইবাহ(ميناء شعيبة) তে দু’টো ব্যবসায়ী জাহায নোঙর করা ছিল। ফলে তারা খুব সহজে তাতে সওয়ার হয়ে হাবশায় পৌঁছে যান। কুরায়েশ নেতারা পরে জানতে পেরে দ্রুত পিছু নিয়ে বন্দর পর্যন্ত গমন করে। কিন্তু তারা নাগাল পায়নি।[২]

[১]. ইবনুল ক্বাইয়িম, যাদুল মা‘আদ তাহকীক : শু‘আইব ও আব্দুল কাদের আরনাঊত্ব (বৈরূত : মুওয়াসসাতুর রিসালাহ ২৯তম মুদ্রণ ১৪১৬/১৯৯৬) ৩/২১ পৃঃ। মুবারকপুরী এখানে রাসূল (ছাঃ) থেকে একটি বর্ণনা এনেছেন, إِنَّهُمَا أَوَّلُ بَيْتٍ هَاجَرَ فِي سَبِيْلِ اللهِ بَعْدَ إبراهيمَ ولوطٍ عليهما السلام ‘তারা দু’জন ছিলেন ইবরাহীম ও লূত (আঃ)-এর পরে আল্লাহর রাস্তায় প্রথম হিজরতকারী পরিবার’ (ইবনু ‘আসাকির, তারীখু দিমাশক্ব ৩৯/২১, আর-রাহীক্ব ৯৩ পৃঃ)। এর সনদ মুনকার ও ‘খুবই দুর্বল’ (আবু ইসহাক্ব আল-হুওয়াইনী, আন-নাফেলাহ ফিল আহাদীছিয যঈফাহ ওয়াল বাত্বেলাহ হা/৩৩, ১/৫৮ পৃঃ)।
[২]. আর-রাহীক্ব ৯৩ পৃঃ; যাদুল মা‘আদ ১/৯৫।

গারানীক্ব কাহিনী

রামাযান ৫ম নববী বর্ষ)
এটি একটি ভিত্তিহীন ও বানোয়াট কাহিনী। যদিও প্রাচ্যবিদ ফুইক, মূর, ওয়াট প্রমুখদের কাছে এটি একটি লোভনীয় কাহিনী। ঘটনা এই যে, একদিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কা‘বা চত্বরে সরবে সূরা নাজম পাঠ করেন। সূরার শেষে তিনি সিজদা করেন। তখন উপস্থিত মুসলিম-মুশরিক সবাই সিজদায় পড়ে যায়। ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন, এটিই ছিল প্রথম সূরা যাতে সিজদা করা হয় (অর্থাৎ সিজদায়ে তেলাওয়াত)। আমি দেখলাম যে, একজন ব্যক্তি এক মুষ্টি মাটি নিয়ে তাতে সিজদা করল এবং বলল, আমার জন্য এটুকুই যথেষ্ট। আমি তাকে পরে কাফের অবস্থায় (বদর যুদ্ধে) নিহত হতে দেখেছি। ঐ ব্যক্তি হল উমাইয়া বিন খালাফ।[১] কাফিরদের সিজদা করার উক্ত ঘটনা সত্য এবং এটি ছিল নিঃসন্দেহে সূরা নাজমের অশ্রুতপূর্ব আসমানী খবর ও অনন্য সাধারণ ভাষালংকারের অপূর্ব দ্যোতনার বাস্তব ফলশ্রুতি। ভাষাগর্বী নেতারা যার সামনে অবচেতনভাবে মুহ্যমান হয়ে পড়ে ও নবীর সাথে সাথে নিজেরাও সিজদায় পড়ে যায়। কারণ উক্ত সূরার শেষ আয়াতটি ছিল, فَاسْجُدُوْا لِلَّهِ وَاعْبُدُوْا ‘অতএব তোমরা আল্লাহর জন্য সিজদা কর ও তাঁর ইবাদত কর’ (নাজম ৫৩/৬২)।

উক্ত ঘটনায় কাফের নেতারা নিজেদের মুখরক্ষার জন্য গারানীক্ব কাহিনী ছড়িয়ে দেয়। আর তা হল এই যে, সূরার ১৯ ও ২০ আয়াতে বর্ণিত, أَفَرَأَيْتُمُ اللاَّتَ وَالْعُزَّى- وَمَنَاةَ الثَّالِثَةَ الْأُخْرَى ‘তোমরা কি ভেবে দেখেছ ‘লাত’ ও ‘উযযা’ সম্বন্ধে’? ‘এবং তৃতীয় আরেকটি ‘মানাত’ সম্বন্ধে?’ উক্ত আয়াতদ্বয়ের পরে তারা জুড়ে দেয়, تِلْكَ الْغَرَانِيقُ الْعُلَى + وَإِنَّ شَفَاعَتَهُنَّ لَتُرْتَجَى ‘ঐগুলি হ’ল মহান শ্বেত-শুভ্র উপাস্য। আর তাদের সুফারিশ অবশ্যই কাম্য’। এই বাক্যটি প্রচার করে তারা বলে, ইতিপূর্বে মুহাম্মাদ কখনো আমাদের উপাস্যদের ভাল বলেনি, আজ বলেছে। সেকারণ তারা খুশী হয়ে তাঁর সাথে সিজদায় পড়ে যায়’।[২]

الْغَرَانِيقُ একবচনে غُرْنوق، غِرْنيق، غُرَانِق অর্থ ‘বক জাতীয় এক ধরনের পানিতে চরা সাদা পাখি’। ফর্সা সুন্দর যুবককে شَابٌّ غُرَانِقٌ বলা হয়। কাফেরদের ধারণা ছিল যে, সাদা পোষাকধারী মানুষের বেশ ধরে কোন জিন বা ফেরেশতা এসে মুহাম্মাদকে কুরআনের আয়াত নাযিল করত (কুরতুবী) এবং তাঁকে তাঁর পিতৃধর্ম থেকে বিচ্যুত করত। ফেরেশতাদেরকে তারা আল্লাহর কন্যা বলত ও তাদের উপাস্য মানত (ইসরা ১৭/৪০)।

কথাটি হাবশায় হিজরতকারীদের কানে পৌঁছে যায়। ফলে তাদের ধারণা হয় যে, মুশরিকদের সাথে আপোষ হয়ে গেছে। এখন থেকে মুসলমানরা মক্কায় নিরাপদে বসবাস করতে পারবে। এই ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে ওছমান বিন মাযঊন (রাঃ) সহ অনেকে মক্কায় ফিরে আসেন।

অথচ মূল কারণ ছিল ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব-এর ইসলাম কবুলের ঘটনা এবং তার ফলে মুসলমানদের প্রকাশ্যে কা‘বায় ছালাত আদায়ের খবর। এতেই হাবশার মুহাজির মুসলমানেরা ধারণা করেছিল যে, মক্কা এখন নিরাপদ হয়ে গেছে’।[৩]

উল্লেখ্য যে, উচ্চ অলংকার সমৃদ্ধ কোন বক্তব্য বা কবিতা শুনে তার প্রতি সম্মানের সিজদা করা জাহেলী যুগে ও ইসলামী যুগে আরবদের রীতি ছিল। যেমন বিখ্যাত উমাইয়া কবি ফারাযদাক্ব (৩৮-১১০ হি.) জাহেলী কবি লাবীদ বিন রাবী‘আহ্র (মৃ. ৪১ হি.) দীর্ঘ কবিতা মু‘আল্লাক্বার ৮ম লাইনটি পড়ে সিজদায় পড়ে গিয়েছিলেন। লোকেরা জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেছিলেন, أَنْتُمْ تَعْلَمُوْنَ سَجْدَةَ الْقُرْآنِ وَأَنَا أَعْلَمُ سَجْدَةَ الشِّعْرِ ‘তোমরা কুরআনের সিজদা জানো। আর আমি কবিতার সিজদা ভাল করে জানি’। লাইনটি ছিল, وَجَلاَ السُّيُوْلُ عَنِ الطُّلُوْلِ كَأَنَّهَا + زُبُرٌ تُجِدُّ مُتُوْنَهَا اَقْلاَمُهَا অর্থ ‘বন্যাস্রোত প্রেয়সীর পরিত্যক্ত ভিটার চিহ্নসমূহ প্রকাশ করে দিয়েছে। যেন সেগুলি বইয়ের পৃষ্ঠা। কলমসমূহ যার হরফগুলিকে নতুন করে দিয়েছে’।[৪]

[১]. আর-রাহীক্ব ৯৩ পৃঃ; বুখারী হা/৪৮৬৩; মুসলিম হা/৫৭৬; মিশকাত হা/১০৩৭। বুখারী হা/১০৭১ (মিশকাত হা/১০২৩)-এ ‘জিন ও ইনসান সবাই সিজদা করে’ বলা হয়েছে। যার রাবী হলেন ইবনু আববাস (জন্ম : ১১ নববী বর্ষ এবং মৃ. ৬৮ হি.)। কিন্তু ইবনু মাসঊদ (মৃ. ৩২ হি.) বর্ণিত বুখারী (হা/৪৮৬৩) এবং মুসলিম (হা/৫৭৬) বর্ণিত হাদীছে কেবল ‘সেখানে উপস্থিত মুস©র্লম ও মুশরিকদের’ কথা এসেছে। দু’টি হাদীছের মধ্যে ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বর্ণিত হাদীছ অধিকতর গ্রহণযোগ্য। কেননা তিনি ছিলেন ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী।
[২]. কুরতুবী, ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা হজ্জ ৫২ আয়াত।
[৩]. বিস্তারিত আলোচনা দ্রষ্টব্য : ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা হাজ্জ ৫২ আয়াত দীর্ঘ টীকা ও ব্যাখ্যাসহ; সীরাহ ছহীহাহ ১/১৭১; মা শা-‘আ পৃঃ ৬১-৬২।
[৪]. আবুল ফারজ ইস্ফাহানী, আল-আগানী (বৈরূত : ২য় সংস্করণ, সাল বিহীন) ১৫/৩৬০ পৃঃ।

কবি লাবীদ বিন রাবী‘আহ আল-‘আমেরী বীরত্বে ও দানশীলতায় আরবের প্রসিদ্ধ হাওয়াযেন গোত্রে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি আরবী কাব্যে নক্ষত্র তুল্য বিবেচিত হ’তেন। ১১৬ বছর বয়সে তিনি ইসলাম কবুল করেন এবং ৪১ হিজরীতে আমীর মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর শাসনামলে ১৪৫ অথবা ১৫৭ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট তার শ্রেষ্ঠ কবিতা ছিল أَلاَ كُلُّ شَيْءٍ مَا خَلاَ اللهَ بَاطِلُ। উমাইয়া কবি ফারাযদাক্ব তাঁর কবিতাংশ পাঠে সিজদায় পড়ে যান। কুরআন পাঠের পর তিনি কাব্য রচনা পরিত্যাগ করেন। কথিত আছে যে, কবিদের উপর ইসলামের প্রভাব যাচাই করার জন্য ওমর ফারূক (রাঃ) তাদের নিকট থেকে নতুন কবিতা আহবান করেন। তখন লাবীদ সূরা বাক্বারাহ্র কয়েকটি আয়াত লিখে পাঠান এবং তার নীচে তিনি লেখেন, هذه الشمس قد اطفأت قناديل الشاعرية مطلقا ‘এই সূর্য কাব্য রচনার বাতিসমূহ একেবারেই নিভিয়ে দিয়েছে’। তবে অনেকে ধারণা করেন যে, ইসলাম কবুলের পর তিনি মাত্র এক লাইন কবিতা বলেছিলেন।- الحمد لله الذى إذلم يأتنى أجلى + حتى لبست من الإسلام سربلا- ‘যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহর জন্য যে, মৃত্যু আমার নিকটে আসেনি। যতক্ষণ না আমি ইসলামের পোষাক পরিধান করেছি’। এজন্যেই তাঁকে জাহেলী কবি বলা হয়। যদিও তিনি ইসলাম কবুলের পর বহুদিন বেঁচে ছিলেন। তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়, আরবদের শ্রেষ্ঠ কবি কে? তিনি বলেন, ‘পথভ্রষ্ট রাজা’ (الملك الضليل) ইমরাউল ক্বায়েস। তারপর কে? তিনি বলেন, বনু বকরের নিহত বালক তুরফাহ। অতঃপর কে? তিনি বলেন, এই লাঠিধারী ব্যক্তি। অর্থাৎ তিনি নিজে’। তিনি নিজের দীর্ঘ জীবন সম্পর্কে বলেন, ولقد ستمت من الحياة وطولها + وسؤال هذا الناس كيف لبيد؟ ‘আমি বীতশ্রদ্ধ হয়ে গেছি জীবন ও তার দীর্ঘতার ব্যাপারে এবং মানুষের এই প্রশ্ন থেকে যে, লাবীদ কেমন ছিল’? =মাওলানা মুহিউদ্দীন, ঢাকা, সাব‘আ মু‘আল্লাক্বাত আরবী-উর্দূ (ঢাকা, এমদাদিয়া লাইব্রেরী, তাবি) ১৩৬ পৃঃ; আহমাদ হাসান আয-যাইয়াত, তারীখুল আদাবিল ‘আরাবী (২৪তম সংস্করণ) ৬৮-৬৯ পৃঃ।

গারানীক্ব ঘটনা পর্যালোচনা

উক্ত গারানীক্ব কাহিনী পুরাপুরি মিথ্যা ও বানোয়াট। এর মাধ্যমে রাসূল (ছাঃ)-এর উপরে মিথ্যা তোহমত চাপানো হয়েছে মাত্র। কেননা আল্লাহর ‘অহি’ ব্যতীত তিনি কুরআনের কোন কিছুই বর্ণনা করেননি (নাজম ৫৩/৩-৪)। ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় এরূপ মিথ্যা বর্ণনা থেকে তিনি সর্বদা নিরাপদ ও মা‘ছূম (হামীম সাজদাহ ৪১/৪১)। অতএব উক্ত বিষয়ে তাঁর নামে প্রচলিত কাহিনী পবিত্র কুরআন ও ইসলামের তাওহীদী আক্বীদার বিরোধী হওয়ায় পরিত্যক্ত। ছহীহ হাদীছ সমূহে এসবের কোনই ভিত্তি নেই।

দ্বিতীয় বিষয়টি এই যে, মুবারকপুরীর বক্তব্য অনুযায়ী ৫ম হিজরীর রামাযান মাসে (আর-রাহীক্ব ৯৩ পৃঃ) এই ঘটনা কিভাবে সম্ভব? অথচ পঠিত সূরা নাজম ১৩-১৮ আয়াতে মে‘রাজের ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। যা হিজরতের কিছুদিন পূর্বে ১৩ নববী বর্ষে সংঘটিত হয় বলে সর্বাধিক বিশুদ্ধ মতে প্রমাণিত।

বস্ত্ততঃ শয়তানের এ ধোঁকাবাজি মক্কা ও মদীনায় সর্বদা চালু ছিল। যেমন মাদানী সূরা হাজ্জ-এর ৫২ আয়াতে আল্লাহ বলেন, وَمَا أَرْسَلْنَا مِنْ قَبْلِكَ مِنْ رَسُوْلٍ وَلاَ نَبِيٍّ إِلاَّ إِذَا تَمَنَّ أَلْقَى الشَّيْطَانُ فِي أُمْنِيَّتِهِ فَيَنْسَخُ اللهُ مَا يُلْقِي الشَّيْطَانُ ثُمَّ يُحْكِمُ اللهُ آيَاتِهِ وَاللهُ عَلِيْمٌ حَكِيْمٌ ‘আমরা তোমার পূর্বে যেসব রাসূল ও নবী প্রেরণ করেছি, তারা যখনই লোকদের নিকট আল্লাহর পক্ষ হ’তে কিছু পাঠ করেছে, তখনই শয়তান তার পাঠে নতুন কিছু নিক্ষেপ করেছে। অতঃপর শয়তান যা নিক্ষেপ করে আল্লাহ তা বিদূরিত করেন। অতঃপর আল্লাহ তার আয়াতসমূহকে প্রতিষ্ঠিত করেন। বস্ত্ততঃ আল্লাহ সর্বজ্ঞ ও প্রজ্ঞাময়’ (হাজ্জ ২২/৫২)।

অনেক মুফাসসির গারানীক্ব কাহিনীকে সূরা হজ্জ ৫২ আয়াতের শানে নুযূল হিসাবে বর্ণনা করেছেন, যা ঠিক নয়। কেননা উক্ত কাহিনী ছিল মক্কার এবং অত্র আয়াত নাযিল হয়েছে মদীনায়। জিন শয়তান সরাসরি অথবা তাদের দোসর মানুষ শয়তান এগুলি করে থাকে। তারা সর্বদা ইলাহী বিধানের বিরুদ্ধে তাদের চাকচিক্যময় কথার মাধ্যমে সন্দেহবাদ আরোপ করে ও মানুষকে আল্লাহর দাসত্ব থেকে বের করে শয়তানের তথা নিজেদের দাসত্বে ফিরিয়ে নেয়। এ বিষয়ে আল্লাহ স্বীয় রাসূলকে মক্কাতেই সাবধান করেছেন। যেমন মাক্কী সূরা আন‘আমের ১১২ আয়াতে আল্লাহ বলেন, وَكَذَلِكَ جَعَلْنَا لِكُلِّ نَبِيٍّ عَدُوًّا شَيَاطِيْنَ الْإِنْسِ وَالْجِنِّ يُوْحِي بَعْضُهُمْ إِلَى بَعْضٍ زُخْرُفَ الْقَوْلِ غُرُوْرًا وَلَوْ شَاءَ رَبُّكَ مَا فَعَلُوْهُ فَذَرْهُمْ وَمَا يَفْتَرُوْنَ ‘এভাবে আমরা প্রত্যেক নবীর জন্য মানুষ ও জিনের মধ্য থেকে বহু শয়তানকে শত্রুরূপে নিযুক্ত করেছি। তারা প্রতারণার উদ্দেশ্যে একে অপরকে চাকচিক্যপূর্ণ কথা দ্বারা প্ররোচনা দেয়। যদি তোমার প্রভু চাইতেন, তাহ’লে তারা এটা করতে পারতো না। অতএব তুমি ওদেরকে ও ওদের মিথ্যা অপবাদসমূহকে ছেড়ে চল’ (আন‘আম ৬/১১২)। আজও ইসলামের সত্যিকারের খাদেমদেরকে উক্ত নীতি মেনে চলতে হবে এবং বাতিল হ’তে দূরে থেকে দ্বীনী দায়িত্ব পালন করে যেতে হবে। কেননা বাতিলের সঙ্গে মিশে থেকে বা আপোষ করে কখনো হক পালন বা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।[১]

[১]. প্রাচ্যবিদ স্টেনলি লেনপুল (১৮৫৪-১৯৩১) তাঁর গ্রন্থে উক্ত কাহিনী বর্ণনা শেষে মন্তব্য করেন, What wonder that a momentary thought crossed his mind to end the conflict by making a slight concession to the bigotry of his enemies ‘অর্থাৎ শত্রুপক্ষের সাথে সংঘর্ষ নিবৃত্ত করার উদ্দেশ্যে তাদের গোঁড়ামীর প্রতি কিছুটা রেয়াত দেওয়ার চিন্তা যদি সাময়িকভাবে তাঁর মনে এসেও থাকে তাতে বিস্ময়ের কি আছে’? অধিকন্তু তিনি বলেছেন, এটি সদুদ্দেশ্যে করা হয়েছিল। আর এটি ছিল মুহাম্মাদের জীবনের একমাত্র পদস্খলন’। তিনি বলেন, মুহাম্মাদ যদি জীবনে একবার মাত্র insincere বা কপট হয়ে থাকেন; আর কে-ই বা তা হন না; ... তারপর তিনি এজন্য যথেষ্ট অনুতাপ করেছিলেন’ (The Spirit of Islam P. 32)। আকরম খাঁ (১৮৬৮-১৯৬৮) বলেন, (শী‘আ লেখক) মি. আমীর আলী (১৮৪৯-১৯২৮) নিজের সমর্থনের জন্য একথাগুলি যে কিভাবে উদ্ধৃত করলেন, তা আমরা ভেবে পাই না। তিনি উক্ত বক্তব্যটি কোনরূপ প্রতিবাদ ছাড়াই তাঁর বইয়ে উল্লেখ করায় অধিক ক্ষতি হয়েছে বলে আমাদের বিশ্বাস’। এমনকি (হানাফী লেখক) শিবলী নোমানী (১৮৫৭-১৯১৪) তাঁর ‘সীরাতুন্নবী’ (১/১৭৬-৭৭ পৃঃ)-এর মধ্যে উক্ত বিষয়টি ‘হয়ে থাকবে’ ‘করে থাকবে’ ‘প্রকৃত কথা এই যে’ ইত্যাকারভাবে সংক্ষেপে আলোচনাটির পরিসমাপ্তি ঘটিয়েছেন’ (মোহাম্মদ আকরম খাঁ, মোস্তফা চরিত ৩৭৮-৭৯ পৃঃ)। বিস্ময়ের ব্যাপার এই যে, খ্রিষ্টান লেখকের ইচ্ছাকৃত প্রগলভতার প্রতিবাদ না করে শী‘আ ও হানাফী লেখকদ্বয় কিভাবে দুর্বল হয়ে গেলেন? এগুলির মাধ্যমে মূল সত্যকে আড়াল করা হয়েছে মাত্র। ধন্যবাদ মাওলানা আকরম খাঁ-কে বৃটিশ শাসনামলে তাদের বিরুদ্ধে এই ধরনের সাহসী লেখনীর জন্য।-লেখক।

ওছমান বিন মাযঊন (রাঃ)-এর ঘটনা

গারানীক্ব কাহিনীর সাথে যুক্ত হল অত্র ঘটনা। ইবনু ইসহাক বলেন, মক্কাবাসীদের ইসলাম কবুলের খবর শুনে হাবশার মুহাজিরগণের অনেকে মক্কায় ফিরে আসেন। যাদের সংখ্যা ছিল ৩৩ জন। তাদের মধ্যে ছিলেন ওছমান বিন মাযঊন ও তার সাথীগণ। তারা সাগর পার হয়ে এসেই মিথ্যা খবর সম্পর্কে জানতে পারেন। তখন তাদের অনেকে ফিরে যান ও অনেকে গা ঢাকা দেন। কেউবা মক্কার কোন কোন নেতার আশ্রয়ে থাকেন। এমনিভাবে ওছমান বিন মাযঊন থাকেন ধনাঢ্য নেতা অলীদ বিন মুগীরাহর আশ্রয়ে। কিন্তু যখন তিনি দেখেন যে, অন্য মুসলমানেরা নির্যাতিত হচ্ছে। অথচ তিনি নিরাপদে আছেন, তখন তিনি উক্ত আশ্রয় পরিত্যাগ করেন এবং বলেন, আল্লাহর কসম! একজন মুশরিকের আশ্রয়ে আমার দিবারাত্রি শান্তির সাথে অতিবাহিত হচ্ছে, অথচ আমার সাথী দ্বীনী ভাইয়েরা আল্লাহর পথে নানাবিধ নির্যাতন ভোগ করছে। যা আমার ভোগ করতে হচ্ছে না। এটা আমার জন্য অত্যন্ত বড় ধরনের ত্রুটি। অতঃপর তিনি কুরায়েশদের মজলিসে গিয়ে বসেন, যেখানে কবি লাবীদ বিন রাবী‘আহ নিজের কবিতা পাঠ করছিলেন। এক পর্যায়ে লাবীদ বলেন, أَلاَ كُلُّ شَيْءٍ مَا خَلاَ اللهَ بَاطِلُ ‘মনে রেখ আল্লাহ ব্যতীত সকল বস্ত্ত মিথ্যা’। ওছমান বললেন, আপনি সত্য বলেছেন। অতঃপর লাবীদ বললেন, وَكُلُّ نَعِيمٍ لاَ مَحَالَةَ زَائِلُ ‘আর প্রত্যেক নেয়ামত অবশ্যই বিদূরিত হবে’।[১] ওছমান বললেন, আপনি মিথ্যা বলেছেন। نَعِيمُ الْجَنَّةِ لاَ يَزُولُ ‘জান্নাতের নে‘মতরাজি নিঃশেষিত হবে না’। লাবীদ বললেন, হে কুরায়েশগণ! আল্লাহর কসম! এ ব্যক্তি সর্বদা তোমাদের সাথী (কবি)-কে কষ্ট দিতে থাকবে। কখন এ লোক তোমাদের মাঝে এসেছে? উত্তরে জনৈক ব্যক্তি বলল, إنَّ هَذَا سَفِيهٌ فِي سُفَهَاءَ مَعَهُ، قَدْ فَارَقُوا دِينَنَا، فَلاَ تَجِدَنَّ فِي نَفْسِكَ مِنْ قَوْلِهِ ‘লোকটি তার সাথী বেওকুফদের মধ্যকার একজন বেওকুফ। ওরা আমাদের দ্বীন থেকে পৃথক হয়ে গেছে। অতএব আপনি ওদের কথায় কিছু মনে নিবেন না’। কিন্তু ওছমান উক্ত কথার প্রতিবাদ করলেন। ফলে পরিবেশ উত্তপ্ত হয়ে গেল। তখন ঐ লোকটি উঠে তার চোখে থাপপড় মেরে আহত করে দিল। পাশে বসে অলীদ সবকিছু দেখছিলেন। তিনি তাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, হে ভাতিজা! তোমার চোখটা অবশ্যই সুন্দর ছিল এবং তুমি একটা নিরাপদ আশ্রয়ে ছিলে। জবাবে ওছমান বললেন, بَلْ وَاللهِ إنَّ عَيْنِي الصَّحِيحَةَ لَفَقِيرَةٌ إلَى مِثْلِ مَا أَصَابَ أُخْتَهَا فِي اللهِ ‘বরং আমার সুস্থ চোখটি তার সাথী চোখটির ন্যায় আল্লাহর রাস্তায় আহত হবার অপেক্ষায় রয়েছে’।[২]

বলা হয়ে থাকে যে, ওছমান বিন মাযঊনই প্রথম ছাহাবী, যিনি মদীনায় মৃত্যুবরণ করেন এবং বাক্বী‘ গোরস্থানে সমাহিত হন। কথাটি কোন নির্ভরযোগ্য সূত্রে বর্ণিত নয়। বরং এর ভিত্তি হল ওয়াক্বেদীর বর্ণনা, যা মাতরূক বা পরিত্যক্ত’।[৩]

[১]. লাইনের দ্বিতীয় অংশটি লাবীদের নয় বলে অনেকে মত প্রকাশ করেন (দীওয়ানে লাবীদ; সিলসিলা যঈফাহ হা/৬৫০০; প্রথমাংশটি ‘ছহীহ’ বুখারী হা/৩৮৪১; মুসলিম হা/২২৫৬; মিশকাত হা/৪৭৮৬)।
[২]. ইবনু হিশাম ১/৩৬৪-৭১; বায়হাক্বী, দালায়েলুন নবুঅত ২/২৯১; সনদ ‘মুরসাল’; মা শা-‘আ ৬৩ পৃঃ।
[৩]. আলবানী, সিলসিলা ছহীহাহ হা/৩০৬০-এর আলোচনা দ্রঃ; মা শা-‘আ ৬৪ পৃঃ।

হাবশায় ২য় হিজরত

সম্ভবতঃ যুলক্বা‘দাহ ৫ম নববী বর্ষ)
হাবশার বাদশাহ কর্তৃক সদাচরণের খবর শুনে কুরায়েশ নেতারা মুসলমানদের উপরে যুলুমের মাত্রা বাড়িয়ে দিল এবং কেউ যাতে আর হাবশায় যেতে না পারে, সেদিকে কড়া নযর রাখতে লাগল। কারণ এর ফলে তাদের দুটি ক্ষতি ছিল। এক- বিদেশের মাটিতে কুরায়েশ নেতাদের যুলুমের খবর পৌঁছে গেলে তাদের ভাবমূর্তি নষ্ট হবে। দুই- সেখানে গিয়ে মুসলমানেরা সংঘবদ্ধ হয়ে শক্তি সঞ্চয় করার সুযোগ পাবে। কিন্তু তাদের অত্যাচারের মাত্রা বৃদ্ধি এবং কড়া নযরদারী সত্ত্বেও জা‘ফর বিন আবু ত্বালিব-এর নেতৃত্বে ৮২ বা ৮৩ জন পুরুষ এবং ১৮ বা ১৯জন মহিলা দ্বিতীয়বারের মত হাবশায় হিজরত করতে সমর্থ হন। এই দলে ‘আম্মার বিন ইয়াসির (রাঃ) ছিলেন কি-না সন্দেহ আছে’।[১]

তাফসীরবিদগণের আলোচনায় আরেকটি বিষয় প্রতিভাত হয় যে, ৫ম নববী বর্ষে মুহাজিরগণের দ্বিতীয় যে দলটি হাবশায় হিজরত করেন, তাদের সাথে হযরত জা‘ফর বিন আবু তালেব সম্ভবতঃ দু’বছর হাবশায় অবস্থান করেন। তিনি নাজাশী ও তাঁর সভাসদমন্ডলী এবং পোপ-পাদ্রী-বিশপসহ রাজ্যের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের নিকটে ইসলামের দাওয়াত পেশ করেন। এ সময় নাজাশীর দরবারে জা‘ফরের দেওয়া ভাষণ নাজাশী ও তার সভাসদগণের অন্তর কেড়ে নেয়। ইসলামের সত্যতা ও শেষনবীর উপরে তাদের বিশ্বাস তখনই বদ্ধমূল হয়ে যায়। অতঃপর হাবশার মুহাজিরগণ যখন মদীনায় যাওয়ার সংকল্প করেন, তখন সম্রাট নাজাশী তাদের সাথে ৭০ জনের একটি ওলামা প্রতিনিধি দল মদীনায় প্রেরণ করেন। যাদের মধ্যে ৬২ জন ছিলেন আবিসিনীয় এবং ৮ জন ছিলেন সিরীয়। এরা ছিলেন খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের সেরা ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব। সংসার বিরাগী দরবেশ সূলভ পোষাকে এই প্রতিনিধিদলটি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর দরবারে পৌঁছলে তিনি তাদেরকে সূরা ইয়াসীন পাঠ করে শুনান। এ সময় তাদের দু’চোখ বেয়ে অবিরল ধারে অশ্রু প্রবাহিত হতে থাকে। তারা বলে ওঠেন ইনজীলের বাণীর সাথে কুরআনের বাণীর কি অদ্ভূত মিল! অতঃপর তারা সবাই অত্যন্ত শ্রদ্ধাভরে রাসূল (ছাঃ)-এর হাতে বায়আত করে ইসলাম কবুল করেন।

প্রতিনিধি দলটির প্রত্যাবর্তনের পর সম্রাট নাজাশী প্রকাশ্যে ইসলাম কবুলের ঘোষণা দেন। যদিও প্রথম থেকেই তিনি শেষ নবীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। কিন্তু ধর্মনেতাদের ভয়ে প্রকাশ করেননি। অতঃপর তিনি একটি পত্র লিখে স্বীয় পুত্রের নেতৃত্বে আরেকটি প্রতিনিধি দল মদীনায় পাঠান। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ জাহাযটি পথিমধ্যে ডুবে গেলে আরোহী সকলের মর্মান্তিক সলিল সমাধি ঘটে।

উক্ত খ্রিষ্টান প্রতিনিধিদলের মদীনায় গমন ও ইসলাম গ্রহণের প্রতি ইঙ্গিত করেই সূরা মায়েদাহ ৮২ হ’তে ৮৫ চারটি আয়াত নাযিল হয়।[২]

[১]. আর-রাহীক্ব ৯৪ পৃঃ; ইবনু হিশাম ১/৩৩০; আল-ইছাবাহ, ‘আম্মার, ক্রমিক ৫৭০৮।
[২]. আলোচনা দ্রষ্টব্য : কুরতুবী, ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা মায়েদাহ ৮২-৮৫ আয়াত; ক্বাছাছ ৫২-৫৪ আয়াত।

নাজাশীর দরবারে কুরায়েশ প্রতিনিধি দল

৬ষ্ঠ নববী বর্ষের শেষে
হাবশায় গিয়ে যাতে মুসলমানগণ শান্তিতে থাকতে না পারে, সেজন্য কুরায়েশ নেতারা তাদেরকে ফিরিয়ে আনার ষড়যন্ত্র করল। এ উদ্দেশ্য সফল করার জন্য তারা কুশাগ্রবুদ্ধি কুটনীতিবিদ আমর ইবনুল ‘আছ এবং আব্দুল্লাহ ইবনু আবী রাবী‘আহকে দায়িত্ব দিল। এ দু’জন পরে মুসলমান হন। ১ম জন ৭ম হিজরীর প্রথম দিকে এবং ২য় জন ৮ম হিজরীতে মক্কা বিজয়ের পর। আব্দুল্লাহ ছিলেন আবু জাহলের বৈপিত্রেয় সহোদর ভাই। নাম ছিল বুহায়রা (بُحَيرى)। ইসলাম গ্রহণের পর আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) তার নাম রাখেন ‘আব্দুল্লাহ’ (ইবনু হিশাম ১/৩৩৩, টীকা-১)।

তারা মহামূল্য উপঢৌকনাদি নিয়ে হাবশা যাত্রা করেন এবং সেখানে গিয়ে প্রথমে খ্রিষ্টানদের নেতৃস্থানীয় ধর্মনেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। তাদের ক্ষুরধার যুক্তি এবং মূল্যবান উপঢৌকনাদিতে ভুলে দরবারের পাদ্রী নেতারা একমত হয়ে যান। পরের দিন আমর ইবনুল ‘আছ উপঢৌকনাদি নিয়ে বাদশাহ নাজাশীর দরবারে উপস্থিত হলেন। অতঃপর তারা বললেন, হে বাদশাহ! আপনার দেশে আমাদের কিছু অজ্ঞ-মূর্খ ছেলে-ছোকরা পালিয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছে। যারা তাদের কওমের দ্বীন পরিত্যাগ করেছে এবং তারা আপনাদের ধর্মেও প্রবেশ করেনি। তারা এমন এক নতুন দ্বীন নিয়ে এসেছে, যা আমরা কখনো শুনিনি বা আপনিও জানেন না। আমাদের কওমের নেতৃবৃন্দ আমাদেরকে আপনার নিকটে পাঠিয়েছেন, যাতে আপনি তাদেরকে তাদের সম্প্রদায়ের কাছে ফেরৎ পাঠান’। তাদের কথা শেষ হ’লে উপস্থিত পাদ্রীনেতাগণ কুরায়েশ দূতদ্বয়ের সমর্থনে মুহাজিরগণকে তাদের হাতে সোপর্দ করার জন্য বাদশাহকে অনুরোধ করেন। তখন বাদশাহ রাগতঃ স্বরে বলেন, আল্লাহর কসম! এটা কখনোই হতে পারে না। তারা আমার দেশে এসেছে এবং অন্যদের চাইতে আমাকে পসন্দ করেছে। অতএব তাদের বক্তব্য না শুনে কোনরূপ সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না। ফলে তাঁর নির্দেশক্রমে জা‘ফর বিন আবু তালিবের নেতৃত্বে মুসলিম প্রতিনিধি দল বাদশাহর দরবারে উপস্থিত হয়ে তাঁকে সালাম দিলেন। কিন্তু সিজদা করলেন না। বাদশাহ তাদের জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা প্রথানুযায়ী আমাকে সিজদা করলে না কেন? যেমন ইতিপূর্বে তোমাদের কওমের প্রতিনিধিদ্বয় এসে করেছে? বাদশাহ আরও বললেন, বাপ-দাদার ধর্ম ত্যাগ করে এমনকি আমাদের ধর্ম গ্রহণ না করে নতুন যে ধর্মে তোমরা দীক্ষা নিয়েছ, সেটা কী, আমাকে শোনাও!’

জা‘ফর বিন আবু ত্বালিব বললেন, হে বাদশাহ! আমাদের ধর্মের নাম ‘ইসলাম’। আমরা স্রেফ আল্লাহর ইবাদত করি এবং তাঁর সাথে কাউকে শরীক করি না। বাদশাহ বললেন, কে তোমাদের এসব কথা শিখিয়েছেন? জা‘ফর বললেন, আমাদের মধ্যেরই একজন ব্যক্তি। ইতিপূর্বে আমরা মূর্তিপূজা ও অশ্লীলতা এবং অন্যায় ও অত্যাচারে আকণ্ঠ নিমজ্জিত ছিলাম। আমরা শক্তিশালীরা দুর্বলদের শোষণ করতাম। এমতাবস্থায় আল্লাহ মেহেরবানী করে আমাদের মধ্যে তাঁর শেষ নবীকে প্রেরণ করেছেন। তাঁর নাম ‘মুহাম্মাদ’। তিনি আমাদের চোখের সামনে বড় হয়েছেন। তাঁর বংশ মর্যাদা, সততা, ন্যায়পরায়ণতা, আমানতদারী, সংযমশীলতা, পরোপকারিতা প্রভৃতি গুণাবলী আমরা জানি। নবুঅত লাভের পর তিনি আমাদেরকে তাওহীদের দাওয়াত দিয়েছেন এবং মূর্তিপূজা পরিত্যাগ করে সর্বাবস্থায় এক আল্লাহর ইবাদত করার আহবান জানিয়েছেন। সাথে সাথে যাবতীয় অন্যায়-অপকর্ম হতে তওবা করে সৎকর্মশীল হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। আমরা তাঁর উপর বিশ্বাস স্থাপন করেছি এবং এক আল্লাহর ইবাদত করছি ও হালাল-হারাম মেনে চলছি। এতে আমাদের কওমের নেতারা আমাদের উপর ক্রুদ্ধ হয়েছেন এবং আমাদের উপর প্রচন্ড নির্যাতন চালিয়েছেন। সেকারণ বাধ্য হয়ে আমরা সবকিছু ফেলে আপনার রাজ্যে আশ্রয় নিয়েছি আপনার সুশাসনের খবর শুনে। আমরা অন্যস্থান বাদ দিয়ে আপনাকে পছন্দ করেছি এবং আপনার এখানেই আমরা থাকতে চাই। আশা করি আমরা আপনার নিকটে অত্যাচারিত হব না’।

অতঃপর জাফর বললেন, হে বাদশাহ! অভিবাদন সম্পর্কে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) আমাদের জানিয়েছেন যে, জান্নাতবাসীদের পরস্পরে অভিবাদন হল ‘সালাম’ এবং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাদেরকে পরস্পরে ‘সালাম’ করার নির্দেশ দিয়েছেন’।

বাদশাহ বললেন, ঈসা ও তাঁর দ্বীন সম্পর্কে তোমরা কি বলতে চাও?

উত্তরে জা‘ফর বিন আবু ত্বালিব সূরা মারিয়ামের শুরু থেকে ৩৬ পর্যন্ত আয়াতগুলি পাঠ করে শুনান। যেখানে হযরত যাকারিয়া ও ইয়াহইয়া (আঃ)-এর বিবরণ, মারিয়ামের প্রতিপালন, ঈসার জন্মগ্রহণ ও লালন-পালন, মাতৃক্রোড়ে কথোপকথন ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা রয়েছে। বাদশাহ ছিলেন অত্যন্ত ধার্মিক এবং তাওরাত-ইনজীলে পন্ডিত ব্যক্তি। কুরআনের অপূর্ব বাকভঙ্গি, শব্দশৈলী ও ভাষালংকার এবং ঘটনার সারবত্তা উপলব্ধি করে বাদশাহ অঝোর নয়নে কাঁদতে থাকলেন। সাথে উপস্থিত পাদ্রীগণও কাঁদতে লাগলেন। তাদের চোখের পানিতে তাদের হাতে ধরা ধর্মগ্রন্থগুলি ভিজে গেল। অতঃপর নাজাশী বলে উঠলেন,  إنَّ هَذَا وَالَّذِي جَاءَ بِهِ عِيسَى لَيَخْرُجُ مِنْ مِشْكَاةٍ وَاحِدَةٍ ‘নিশ্চয়ই এই কালাম এবং ঈসার নিকটে যা নাযিল হয়েছিল দু’টি একই আলোর উৎস থেকে নির্গত’। বলেই তিনি কুরায়েশ দূতদ্বয়ের দিকে ফিরে বললেন, انْطَلِقَا فَلاَ وَاللهِ لاَ أُسْلِمَهُمْ ‘তোমরা চলে যাও! আল্লাহর কসম! আমি কখনোই এদেরকে তোমাদের হাতে তুলে দেব না’।

আমর ইবনুল ‘আছ এবং আব্দুল্লাহ ইবনু আবী রাবী‘আহ দরবার থেকে বেরিয়ে গেলেন। আমর বললেন, কালকে এসে এমন কিছু কথা বাদশাহকে শুনাবো, যাতে এদের মূলোৎপাটন হয়ে যাবে এবং এরা ধ্বংস হবে। একথা শুনে আব্দুল্লাহ বললেন, না, না এমন নিষ্ঠুর কিছু করবেন না। ওরা আমাদের স্বগোত্রীয় এবং নিকটাত্মীয়। কিন্তু আমর ওসব কথায় কর্ণপাত করলেন না।

পরের দিন বাদশাহর দরবারে এসে তিনি বললেন, أَيُّهَا الْمَلِكُ إِنَّهُمْ يَقُولُونَ فِى عِيسَى ابْنِ مَرْيَمَ قَوْلاً عَظِيماً ‘হে সম্রাট! এরা ঈসা ইবনে মারিয়াম সম্পর্কে ভয়ংকর সব কথা বলে থাকে’। একথা শুনে বাদশাহ মুসলমানদের ডাকালেন। মুসলমানেরা একটু চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়লেন। কেননা নাছারারা ঈসাকে উপাস্য মানে। কিন্তু মুসলমানরা তাকে ‘আল্লাহর বান্দা’ (عَبْدُ الله) বলে থাকে। যাই হোক কোনরূপ দ্বৈততার আশ্রয় না নিয়ে তারা সত্য বলার ব্যাপারে মনস্থির করলেন। অতঃপর আল্লাহর উপর ভরসা করে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে সত্য প্রকাশ করে দিয়ে জা‘ফর বিন আবু ত্বালিব বললেন, هُوَ عَبْدُ اللهِ وَرَسُولُهُ وَرُوحُهُ وَكَلِمَتُهُ أَلْقَاهَا إلَى مَرْيَمَ الْعَذْرَاءِ الْبَتُولِ ولم يَمَسُّها بَشَرٌ ‘তিনি ছিলেন আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল। তিনি ছিলেন আল্লাহ প্রেরিত রূহ এবং তাঁর নির্দেশ। যা তিনি মহীয়সী কুমারী মাতা মারিয়ামের উপরে ফুঁকে দিয়েছিলেন। কোন পুরুষ লোক তাকে স্পর্শ করেনি’। তখন নাজাশী মাটি থেকে একটা কাঠের টুকরা উঠিয়ে নিয়ে বললেন, وَاللهِ مَا عَدَا عِيسَى بن مَرْيَمَ مَا قُلْتَ هَذَا الْعُودَ ‘আল্লাহর কসম! তুমি যা বলেছ, ঈসা ইবনে মারিয়াম তার চাইতে এই কাষ্ঠখন্ড পরিমাণও বেশী ছিলেন না’। তিনি জাফর ও তার সাথীদের উদ্দেশ্যে বললেন, اذْهَبُوا فَأَنْتُمْ سُيُومٌ بِأَرْضِى- وَالسُّيُومُ الآمِنُونَ، مَنْ سَبَّكُمْ غَرِمَ (ثلاث مرات). مَا أُحِبُّ أَنَّ لِيْ دَبَرًا مِنْ ذَهَبٍ وَأَنِّي آذَيْتُ رَجُلاً مِنْكُمْ ‘যাও! তোমরা আমার দেশে সম্পূর্ণ নিরাপদ। যে ব্যক্তি তোমাদের গালি দিবে, তার জরিমানা হবে (৩বার)। তোমাদের কাউকে কষ্ট দেওয়ার বিনিময়ে যদি কেউ আমাকে স্বর্ণের পাহাড় এনে দেয়, আমি তা পছন্দ করব না’। অতঃপর তিনি কুরায়েশ দূতদ্বয়ের প্রদত্ত উপঢৌকনাদি ফেরৎ দানের নির্দেশ দিলেন।

ঘটনার বর্ণনাদানকারিণী প্রত্যক্ষ সাক্ষী হযরত উম্মে সালামাহ (রাঃ) (পরবর্তীকালে উম্মুল মুমেনীন) বলেন, فَخَرَجَا مِنْ عِنْدِهِ مَقْبُوحَيْنِ ...وَأَقَمْنَا عِنْدَهُ بِخَيْرِ دَارٍ، مَعَ خَيْرِ جَارٍ ‘অতঃপর ঐ দু’জন ব্যক্তি চরম বেইযযতির সাথে দরবার থেকে বেরিয়ে গেল... এবং আমরা উত্তম প্রতিবেশীর সাথে উত্তম গৃহবাসীরূপে বসবাস করতে থাকলাম’।[১] ফালিল্লাহিল হাম্দ।

আবু মূসা আশ‘আরী (রাঃ) বলেন, তারা শেষনবীর আবির্ভাবের খবর শুনে ৫০-এর অধিক লোক নিয়ে ইসলাম গ্রহণের উদ্দেশ্যে ইয়ামন থেকে নৌকায় মদীনা রওয়ানা হন। কিন্তু ঝড়ে তাদের নৌকা হাবশায় গিয়ে নোঙর করে। ফলে তারা সেখানে অবতরণ করেন এবং জাফর ও তার সাথীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে তারা সেখানেই থেকে যান। পরে জাফরের সাথে তারা ৭ম হিজরীতে খায়বরে এসে রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট হাযির হন। রাবী আবু বুরদাহ বলেন, قال وأبو مُوسَى شَهِدَ مَا جَرَى بَيْنَ جَعْفَرٍ وَبَيْنَ النَّجَاشِيِّ ‘আবু মূসা আশ‘আরী জা‘ফর ও নাজাশীর মধ্যকার আলোচনার সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন’।[২]

[১]. ইবনু হিশাম ১/৩৩৩-৩৮; আহমাদ হা/১৭৪০; যাদুল মা‘আদ ৩/২৬; আলবানী, ফিক্বহুস সীরাহ পৃঃ ১১৫, সনদ ছহীহ।
প্রাচ্যবিদ মার্গোলিয়থ (১৮৫৮-১৯৪০) নাজাশীর ইসলাম কবুল করায় খুবই অস্বস্তি বোধ করেছেন। ফলে ঘটনাটি সরাসরি অস্বীকার করতে না পেরে তাঁর লিখিত নবী জীবনী (১৫৮ পৃঃ)-তে অন্যতম জীবনীকার নোলডেক (১৮৩৬-১৯৩০)-এর দোহাই দিয়ে এই সংশয় ব্যক্ত করেছেন যে, আরব ও আবিসিনীয়গণ যে পরস্পরের কথা বুঝতে পারত, তার কোন প্রমাণ নেই’ (মোস্তফা চরিত ৩৬১ পৃঃ)। অর্থাৎ তিনি ইঙ্গিতে ঘটনাটি অস্বীকার করতে চেয়েছেন। এটাই হ’ল তথাকথিত বস্ত্তনিষ্ঠ (!) ইতিহাসের নমুনা।
[২]. আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ৩/৬৪-৭২; বুখারী হা/৩১৩৬; মুসলিম হা/২৫০২; আবুদাঊদ হা/২৭২৫; মিশকাত হা/৪০১০।

শিক্ষণীয় বিষয়সমূহ
(১) আল্লাহ অনেক সময় শক্তিশালী অন্য কোন ব্যক্তিকে সত্যসেবীদের সহায়তার জন্য দাঁড় করিয়ে দেন। হাবশার খ্রিষ্টান বাদশা তার বাস্তব প্রমাণ।

(২) কুরআন যে নিঃসন্দেহে আল্লাহর কালাম এবং তার শব্দশৈলী ও ভাষালংকার যে অবিশ্বাসীদের হৃদয়কেও ছিন্ন করে, কা‘বা চত্বরে সূরা নাজম পাঠ শেষে রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে সাথে কাফেরদের সিজদায় পড়ে যাওয়া তার অন্যতম প্রমাণ।

(৩) মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে কুরআনী সত্য প্রকাশ করায় যে আল্লাহর রহমত নেমে আসে, নাজাশীর সম্মুখে জাফর বিন আবু তালিবের ঈসা (আঃ) সম্পর্কিত সত্যভাষণ তার জাজ্বল্যমান প্রমাণ বহন করে।

(৪) রাজনৈতিক সুবিধাভোগী ও দরবারী আলেমরা যে ঘুষখোর ও দুনিয়াপূজারী হয়, নাজাশী দরবারের পোপ-পাদ্রীরা তার অন্যতম উদাহরণ।

(৫) মিথ্যাচার যে অবশেষে ব্যর্থ হয়, কুরায়েশ দূত আমর ইবনুল ‘আছের কূটনীতির ব্যর্থতা তার বাস্তব প্রমাণ।

আবু তালিবের নিকটে কুরায়েশ নেতাদের আগমন

৬ষ্ঠ নববী বর্ষের মাঝামাঝি)
ইসলামের দাওয়াত বন্ধ করার জন্য নিবর্তনমূলক সবরকম চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় অবশেষে কুরায়েশদের ১০জন নেতা একত্রে আবু তালিবের কাছে এলেন। এই দলে ছিলেন ওৎবা ও শায়বাহ বিন রাবী‘আহ, আবু সুফিয়ান ছাখর ইবনু হারব, আবুল বাখতারী ‘আছ বিন হিশাম, আসওয়াদ বিন মুত্ত্বালিব, আবু জাহল আমর ইবনু হেশাম (যিনি ‘আবুল হাকাম’ উপনামে পরিচিত ছিলেন), অলীদ বিন মুগীরাহ, নুবাইহ ও মুনাবিবহ বিন হাজ্জাজ ও ‘আছ বিন ওয়ায়েল এবং আরও কয়েকজন যারা তাদের সঙ্গে ছিলেন। তারা এসে বললেন, يَا أَبَا طَالِبٍ! إنَّ ابْنَ أَخِيكَ قَدْ سَبَّ آلِهَتَنَا، وَعَابَ دِينَنَا، وَسَفَّهُ أَحْلاَمَنَا، وَضَلَّلَ آبَاءَنَا ‘হে আবু তালেব! আপনার ভাতিজা আমাদের উপাস্যদের গালি দিয়েছে, আমাদের দ্বীনকে দোষারোপ করেছে, আমাদের জ্ঞানীদের বোকা ঠাউরেছে এবং আমাদের বাপ-দাদাদের পথভ্রষ্ট মনে করেছে’। এক্ষণে হয় আপনি তাকে বিরত রাখুন। নতুবা আমাদের ও তার মাঝ থেকে আপনি সরে দাঁড়ান। কেননা আপনিও আমাদের ন্যায় তার আদর্শের বিরোধী। সেকারণ আমরা আপনাকে তার ব্যাপারে যথেষ্ট মনে করি’। ধৈর্য্যের সঙ্গে তাদের কথা শুনে আবু তালেব তাদেরকে নম্র ভাষায় বুঝিয়ে বিদায় করলেন (ইবনু হিশাম ১/২৬৪-৬৫)।

নাজাশীর দরবারে দ্বিতীয়বার

প্রথমবারের কিছু পরে
মুসলমানদের সংখ্যা ক্রমে বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং নির্যাতনের ভয়ে সকলে পার্শ্ববতী খ্রিষ্টান রাজ্য হাবশায় গিয়ে আশ্রয় নেওয়ায় নেতারা প্রমাদ গুণলেন। অতঃপর বিদেশে তাদের ভাবমূর্তি রক্ষার জন্য এবং হিজরতকারীদের ফিরিয়ে আনার জন্য আমর ইবনুল ‘আছ ও আবু জাহলের বৈপিত্রেয় সহোদর ভাই আব্দুল্লাহ ইবনু আবী রাবী‘আহকে নাজাশীর দরবারে প্রেরণ করেন। কিন্তু তারা নিরাশ হয়ে ফিরে আসেন। তখন তারা সিদ্ধান্ত নিলেন যে, শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে মুহাম্মাদের দাওয়াত একেবারেই বন্ধ করে দিতে হবে অথবা তাকে হত্যা করে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে হবে। কিন্তু মুহাম্মাদের বিরুদ্ধে যেকোন কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার পথে সবচাইতে বড় বাধা হ’লেন তার চাচা বর্ষীয়ান ও সর্বজন শ্রদ্ধেয় গোত্রনেতা আবু ত্বালিব। ফলে নেতারা পুনরায় আবু তালেবের কাছে এলেন এবং বললেন, আমাদের মধ্যে বয়সে, সম্মানে ও পদমর্যাদায় আপনি বিশেষ স্থানের অধিকারী। আমরা চেয়েছিলাম যে, আপনি আপনার ভাতিজাকে বিরত রাখবেন। কিন্তু আপনি তাকে বিরত রাখেননি। আল্লাহর কসম! আমরা আর এ ব্যক্তির ব্যাপারে ধৈর্য রাখতে পারছি না। কেননা এ ব্যক্তি আমাদের বাপ-দাদাদের গালি দিচ্ছে, আমাদের জ্ঞানীদের বোকা বলছে, আমাদের উপাস্যদের দোষারোপ করছে’। এক্ষণে হয় আপনি তাকে বিরত রাখুন, নয়তো আমরা তাকে ও আপনাকে এ ব্যাপারে একই পর্যায়ে নামাবো। যতক্ষণ না আমাদের দু’পক্ষের একটি পক্ষ ধ্বংস হয়’। অন্য বর্ণনায় এসেছে, الَّذِي قَدْ خَالَفَ دِينَكَ وَدِينَ آبَائِكَ، وَفَرَّقَ جَمَاعَةَ قَوْمِكَ، وَسَفَّهُ أَحْلاَمَهُمْ، فَنَقْتُلَهُ ‘সে আপনার ও আপনার বাপ-দাদাদের দ্বীনের বিরোধিতা করেছে, আপনার সম্প্রদায়ের ঐক্যকে বিভক্ত করেছে এবং তাদের জ্ঞানীদের বোকা বলেছে। অতএব আমরা তাকে হত্যা করব’ (ইবনু হিশাম ১/২৬৭)।

গোত্রনেতাদের এই চূড়ান্ত হুমকি শুনে আবু তালেব দুশ্চিন্তায় পড়লেন। অতঃপর রাসূল (ছাঃ)-কে ডেকে এনে বললেন, يَا ابْنَ أَخِي إنّ قَوْمَك قَدْ جَاءُوْنِي فَقَالُوا لِي كَذَا وَكَذَا ... وَلاَ تُحَمِّلْنِي مِنَ الْأَمْرِ مَا لاَ أُطِيْقُ ‘হে ভাতিজা! তোমার বংশের নেতারা আমার কাছে এসেছিলেন এবং তারা এই এই কথা বলেছেন।... অতএব তুমি আমার উপরে এমন বোঝা চাপিয়ো না, যা বহন করার ক্ষমতা আমার নেই’। চাচার এই কথা শুনে তিনি তাকে ছেড়ে যাচ্ছেন ধারণা করে সাময়িকভাবে বিহবল নবী আল্লাহর উপরে গভীর আস্থা রেখে বলে উঠলেন, يَا عَمِّ، وَاللهِ لَوْ وَضَعُوا الشَّمْسَ فِي يَمِينِي، وَالْقَمَرَ فِي يَسَارِي عَلَى أَنْ أَتْرُكَ هَذَا الْأَمْرَ حَتَّى يُظْهِرَهُ اللهُ، أَوْ أَهْلِكَ فِيْهِ، مَا تَرَكْتُه ‘হে চাচাজী! যদি তারা আমার ডান হাতে সূর্য এবং বাম হাতে চন্দ্র এনে দেয় তাওহীদের এই দাওয়াত বন্ধ করার বিনিময়ে, আমি তা কখনোই পরিত্যাগ করব না। যতক্ষণ না আল্লাহ এই দাওয়াতকে বিজয়ী করেন অথবা আমি তাতে ধ্বংস হয়ে যাই’ বলেই তিনি অশ্রুভরা নয়নে চলে যেতে উদ্যত হলেন। পরম স্নেহের ভাতিজার এই অসহায় দৃশ্য দেখে বয়োবৃদ্ধ চাচা তাকে পিছন থেকে ডাকলেন। তিনি তার দিকে মুখ তুলে তাকাতেই চাচা বলে উঠলেন, إِذْهَبْ يَا بْنَ أَخِي، فَقُلْ مَا أَحْبَبْتَ، فَوَاللهِ لاَ أُسْلِمُكَ لِشَيْءٍ أَبَدًا ‘যাও ভাতিজা! তুমি যা খুশী প্রচার কর। আল্লাহর কসম! কোন কিছুর বিনিময়ে আমি তোমাকে ওদের হাতে তুলে দেব না’।[১] এ সময় তিনি পাঁচ লাইন কবিতার মাধ্যমে স্বীয় দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। যেমন,

وَاللهِ لَنْ يَصِلُوا إِلَيْكَ بِجَمْعِهِمْ * حَتَّى أُوَسَّدَ فِي التُّرَابِ دَفِينَا
فَامْضِيْ لِأَمْرِكَ مَا عَلَيْكَ غَضَاضَةٌ * أَبْشِرْ وَقَرَّ بِذَاكَ مِنْكَ عُيُونَا

‘আল্লাহর কসম! তারা কখনোই তাদের সম্মিলিত শক্তি নিয়েও তোমার কাছে পৌঁছতে পারবে না। যতক্ষণ পর্যন্ত না আমি মাটিতে সমাহিত হব’। ‘অতএব তুমি তোমার কাজ চালিয়ে যাও। তোমার উপরে কোন বাধা আসবে না। তুমি খুশী হও এবং এর ফলে তোমার থেকে চক্ষুসমূহ শীতল হৌক’ (আল-বিদায়াহ ৩/৪২)। এর দ্বারা বুঝা যায় যে, আল্লাহ স্বীয় রাসূলকে তাঁর চাচার মাধ্যমে শত্রুদের হাত থেকে হেফাযত করেন। আল্লাহর এই বিধান সকল যুগের নিষ্ঠাবান মুমিনের জন্য সর্বদা কার্যকর।
[১]. ইবনু হিশাম ১/২৬৫-৬৬।

(১) প্রসিদ্ধ এ বর্ণনাটির সনদ যঈফ (তাহকীক ইবনু হিশাম ক্রমিক ২৬৬; যঈফাহ হা/৯০৯)। তবে উক্ত মর্মের অন্য বর্ণনাটি ‘হাসান’। যেখানে বলা হয়েছে, রাসূল (ছাঃ) আকাশের দিকে চোখ উঠিয়ে চাচাদের উদ্দেশ্যে বললেন,أَتَرَوْنَ هَذِهِ الشَّمْسَ؟ قَالُوا: نَعَمْ، قَالَ: مَا أَنَا بَأَقْدَرِ عَلَى أَنْ أَدَعَ لَكُمْ ذَلِكَ أَنْ تَشتعِلُوا لِي مِنْهَا بِشُعْلَةٍ، فَقَالَ أَبُو طَالِبٍ: مَا كَذَبَنَا ابْنُ أَخِي فَارْجِعُوا- ‘আপনারা কি এই সূর্যকে দেখছেন? তারা বললেন, হ্যাঁ। তিনি বললেন, আমি আপনাদের কারণে আমার দাওয়াত পরিত্যাগ করব না, যতক্ষণ না আপনারা ঐ সূর্য থেকে আমার জন্য একটা স্ফুলিঙ্গ এনে দিবেন’। তখন আবু ত্বালিব বললেন, আমার ভাতিজা কখনোই আমাদেরকে মিথ্যা বলে না। অতএব তোমরা ফিরে যাও’ (হাকেম হা/৬৪৬৭); ছহীহাহ হা/৯২; মা শা-‘আ ৩০ পৃঃ।

(২) ইবনু ইসহাক এখানে নেতাদের তৃতীয় আরেকটি প্রতিনিধি দলের আগমনের কথা বলেছেন। যা রীতিমত বিস্ময়কর ও অবিশ্বাস্য। তিনি সূত্রবিহীনভাবে লিখেছেন যে, নেতারা মক্কার ধনীশ্রেষ্ঠ ও অন্যতম নেতা অলীদ বিন মুগীরাহ্র পুত্র উমারাহ বিন অলীদ (عُمارة)-কে সাথে নিয়ে গেলেন এবং আবু ত্বালিবকে বললেন, হে আবু ত্বালিব! এই ছেলেটি হ’ল কুরায়েশদের সবচেয়ে সুন্দর ও ধীমান যুবক। আপনি একে পুত্ররূপে গ্রহণ করুন এবং মুহাম্মাদকে আমাদের হাতে সোপর্দ করুন’ (ইবনু হিশাম ১/২৬৬-৬৭; আর-রাহীক্ব ৯৭-৯৮ পৃঃ)। বর্ণনাটির সনদ ‘মুরসাল’ বা যঈফ’ (মা শা-‘আ ৩২ পৃঃ)। নিঃসন্দেহে এটি অবাস্তবও বটে।

রাসূল (ছাঃ)-কে দেওয়া আপোষ প্রস্তাবসমূহ

যিলহজ্জ ৬ষ্ঠ নববী বর্ষ
কঠোর সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে কুরায়েশ নেতারা রাসূল (ছাঃ)-কে আপোষ প্রস্তাবের ফাঁদে আটকানোর চিন্তা করেন। সে মোতাবেক তারা মক্কার অন্যতম নেতা ওৎবা বিন রাবী‘আহকে সরাসরি রাসূল (ছাঃ)-এর কাছে কয়েকটি প্রস্তাব দিয়ে পাঠান।

(১) একদিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কা‘বা চত্বরে একাকী বসেছিলেন। তখন কুরায়েশ নেতাদের অনুমতি নিয়ে ওৎবা তাঁর কাছে গিয়ে বসলেন এবং বললেন, হে ভাতিজা! তুমি আমাদের গোত্রের মধ্যে কেমন সম্মান ও উচ্চ মর্যাদায় আছ, তা তুমি ভালভাবেই জান। وَإِنَّكَ قَدْ أَتَيْتَ قَوْمَكَ بِأَمْرِ عَظِيمٍ فَرَّقْتَ بِهِ جَمَاعَتَهُمْ وَسَفَّهْتَ بِهِ أَحْلاَمَهُمْ وَعِبْتَ بِهِ آلِهَتَهُمْ وَدِينَهُمْ وَكَفَّرْتَ بِهِ مَنْ مَضَى مِنْ آبَائِهِمْ ‘কিন্তু তুমি তোমার সম্প্রদায়ের নিকটে একটি ভয়ানক বিষয় নিয়ে এসেছ। তুমি তাদের জামা‘আতকে বিভক্ত করেছ। তাদের জ্ঞানীদের বোকা বলেছ। তাদের উপাস্যদের ও তাদের দ্বীনকে তুমি মন্দ বলেছ। এই দ্বীনের উপর মৃত্যুবরণকারী তাদের বাপ-দাদাদের তুমি কাফের বলেছ’। অতএব আমি তোমার নিকটে কয়েকটি বিষয় পেশ করছি। এগুলি তুমি ভেবে দেখ, আশা করি তুমি সেগুলির কিছু হ’লেও মেনে নিবে। জওয়াবে রাসূল (ছাঃ) বললেন, বলুন! হে আবু অলীদ, আমি শুনব। তখন তিনি বললেন, হে ভাতিজা! তোমার এই নতুন দ্বীন প্রচারের উদ্দেশ্য যদি সম্পদ উপার্জন হয়, তাহ’লে তুমি বললে আমরা তোমাকে সেরা ধনী বানিয়ে দেব। আর যদি তোমার উদ্দেশ্য নেতৃত্ব লাভ হয়, তাহ’লে আমরা তোমাকে আমাদের নেতা বানিয়ে দেব। আর যদি আরবের বাদশাহ হ’তে চাও, তাহ’লে আমরা তোমাকে বাদশাহ বানিয়ে দেব। আর যদি মনে কর, তোমার মাথার জন্য জিনের চিকিৎসা প্রয়োজন, তাহ’লে আমরাই তা আরোগ্যের জন্য সেরা চিকিৎসককে এনে তোমার চিকিৎসার ব্যবস্থা করব এবং সব খরচ আমরাই বহন করব’। অন্য বর্ণনায় এসেছে, এমনকি নেতারা এ প্রস্তাবও দিয়েছিল যে, তুমি নারীদের মধ্যে যাকে চাও, তার সাথে তোমাকে বিয়ের ব্যবস্থা করে দিব। আমাদের একটাই মাত্র দাবী, তুমি তোমার ঐ নতুন দ্বীনের দাওয়াত পরিত্যাগ কর’।[১]

জবাবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে ৫৪ আয়াত বিশিষ্ট সূরা হা-মীম সাজদাহ পাঠ করে শুনাতে লাগলেন। শুনতে শুনতে ওৎবা মন্ত্রমুগ্ধের মত হয়ে গেলেন। এক বর্ণনায় এসেছে, যখন রাসূল (ছাঃ) ১৩তম আয়াত পাঠ করলেন, তখন ওৎবা রাসূল (ছাঃ)-এর মুখের উপরে হাত চেপে গযব নাযিলের ভয়ে বলে উঠলেন, أَنْشُدُكَ اللهَ وَالرَّحِمَ আল্লাহর দোহাই! তুমি তোমার বংশধরগণের উপরে দয়া কর’। অতঃপর ৩৮তম আয়াতের পর রাসূল (ছাঃ) সিজদা করলেন এবং উঠে বললেন, قَدْ سَمِعْتَ يَا أَبَا الْوَلِيدِ مَا سَمِعْتَ فَأَنْت وَذَاكَ ‘আবুল অলীদ আপনি তো সবকিছু শুনলেন। এখন আপনার যা বিবেচনা হয় করুন’। এরপর ওৎবা উঠে গেলেন।

কুরায়েশ নেতারা সাগ্রহে ওৎবার কাছে জমা হ’লে তিনি বললেন, নেতারা শুনুন! আমি মুহাম্মাদের মুখ থেকে এমন বাণী শুনে এসেছি, যেরূপ বাণী আমি কখনো শুনিনি। যা কোন কবিতা নয় বা জাদুমন্ত্র নয়। সে এক অলৌকিক বাণী। আপনারা আমার কথা শুনুন! মুহাম্মাদকে বাধা দিবেন না। তাকে তার পথে ছেড়ে দিন’। লোকেরা হতবাক হয়ে বলে উঠলো سَحَرَكَ وَاللهِ يَا أَبَا الْوَلِيدِ بِلِسَانِهِ ‘আল্লাহর কসম হে আবুল অলীদ! মুহাম্মাদ তার কথা দিয়ে আপনাকে জাদু করে ফেলেছে’।[২]

(২) একদিন যখন রাসূল (ছাঃ) কা‘বাগৃহ ত্বাওয়াফ করছিলেন, তখন আসওয়াদ বিন আব্দুল মুত্ত্বালিব, অলীদ বিন মুগীরাহ, উমাইয়া বিন খালাফ, ‘আছ বিন ওয়ায়েল প্রমুখ মক্কার বিশিষ্ট নেতৃবর্গ এসে সরাসরি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে প্রস্তাব দেন,يَا مُحَمَّدُ، هَلُمَّ فَلْنَعْبُدْ مَا تَعْبُدُ، وَتَعْبُدُ مَا نَعْبُدُ، فَنَشْتَرِكُ نَحْنُ وَأَنْتَ فِي الْأَمْرِ ‘হে মুহাম্মাদ! এসো আমরা ইবাদত করি, যার তুমি ইবাদত কর এবং তুমি ইবাদত কর, যার আমরা ইবাদত করি। তাতে আমরা ও তুমি আমাদের উপাসনার কাজে পরস্পরে অংশীদার হব’। তখন আল্লাহ সূরা কাফেরূন নাযিল করেন।[৩] যাতে কাফেরদের সঙ্গে পুরাপুরি বিচ্ছিন্নতা ঘোষণা করা হয়।

[১]. ইবনু হিশাম ১/২৯৩-৯৪, সনদ ‘মুরসাল’ হাদীছ ‘হাসান’ (ঐ, তাহকীক ক্রমিক ২৮৩); ইবনু জারীর, তাফসীর সূরা কাফেরূন, ৩০/২১৪; ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা ফুছছিলাত/হা-মীম সাজদাহ ৪-৫ আয়াত।
[৩]. ইবনু হিশাম ১/২৯৪; ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা ফুছছিলাত/হা-মীম সাজদাহ ৫ আয়াত; ফিক্বহুস সীরাহ পৃঃ ১০৭; সনদ হাসান।
[৩]. ইবনু হিশাম ১/৩৬২ ‘সূরা কাফেরূন নাযিলের কারণ’; আলবানী, ছহীহুস সীরাহ ২০১-২০২ পৃঃ।

তৃতীয়বার আবু তালিবের নিকট আগমন

১০ম নববী বর্ষ
হুমকি, লোভনীয় প্রস্তাব ও বয়কট কোনটাতে কাজ না হওয়ায় এবং ইতিমধ্যে আবু তালিবের স্বাস্থ্যহানির খবর শুনে মক্কার নেতারা তৃতীয়বার তাঁর সাথে সাক্ষাতের সিদ্ধান্ত নেন। সেমতে আবু জাহল, আবু সুফিয়ান, উমাইয়া বিন খালাফ, ওৎবা ও শায়বা বিন রাবী‘আহ সহ প্রায় ২৫ জন নেতা আবু তালেবের কাছে আসেন এবং বলেন, হে আবু তালেব! আপনি যে মর্যাদার আসনে আছেন, তা আপনি জানেন। আপনার বর্তমান অবস্থাও আপনি বুঝতে পারছেন। আমরা আপনার জীবনাশংকা করছি। এমতাবস্থায় আপনি ভালভাবে জানেন যা আমাদের ও আপনার ভাতিজার মধ্যে বিদ্যমান রয়েছে। এক্ষণে আপনি তাকে ডাকুন এবং উভয় পক্ষে অঙ্গীকার নিন যে, সে আমাদের ও আমাদের দ্বীন থেকে বিরত থাকবে এবং আমরাও তার থেকে বিরত থাকব। তখন আবু তালেব রাসূল (ছাঃ)-কে ডাকালেন। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) তাদের সম্মুখে এসে বললেন, نَعَمْ كَلِمَةٌ وَاحِدَةٌ تُعْطُونِيهَا تَمْلِكُونَ بِهَا الْعَرَبَ، وَتَدِينُ لَكُمْ بِهَا الْعَجَمُ ‘হ্যাঁ, একটি কালেমার ওয়াদা আপনারা আমাকে দিন। তাতে আপনারা আরবের বাদশাহী পাবেন এবং অনারবরা আপনাদের অনুগত হবে’। আবু জাহেল খুশী হয়ে বলে উঠল, তোমার পিতার কসম, এমন হলে একটা কেন দশটা কালেমা পাঠ করতে রাযী আছি। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, تَقُولُونَ: لاَ إلَهَ إلاَّ اللهُ، وَتَخْلَعُونَ مَا تَعْبُدُوْنَ مِنْ دُوْنِهِ- ‘আপনারা বলুন, ‘আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই’। আর তাঁকে ছাড়া অন্য যাদের পূজা করেন, সব পরিত্যাগ করুন’।

তখন তারা দু’হাতে তালি বাজিয়ে বলে উঠলো أَتُرِيدُ يَا مُحَمَّدُ أَنْ تَجْعَلَ الْآلِهَةَ إلَهًا وَاحِدًا، إنَّ أَمْرَكَ لَعَجَبٌ! ‘হে মুহাম্মাদ! সব উপাস্য বাদ দিয়ে তুমি একজন উপাস্য চাও? নিশ্চয়ই তোমার এ বিষয়টি বড়ই বিস্ময়কর!’ এরপর তারা পরস্পরে বলল, وَاللهِ مَا هَذَا الرَّجُلُ بِمُعْطِيْكُمْ شَيْئًا مِمَّا تُرِيدُوْنَ ‘আল্লাহর কসম! এই ব্যক্তি তোমাদের কিছুই দিবে না, যা তোমরা চাচ্ছ। অতএব فَانْطَلِقُوا وَامْضُوا عَلَى دِينِ آبَائِكُمْ، حَتَّى يَحْكُمَ اللهُ بَيْنَكُمْ وَبَيْنَهُ- ‘চলো! তোমরা তোমাদের বাপ-দাদার ধর্মের উপরে চলতে থাক, যতক্ষণ না আল্লাহ তোমাদের ও তার মধ্যে একটা ফায়ছালা করে দেন’। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ সূরা ছোয়াদের ১ হতে ৭ আয়াতগুলি নাযিল করেন।-

ص، وَالْقُرْآنِ ذِي الذِّكْرِ- بَلِ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا فِيْ عِزَّةٍ وَّشِقَاقٍ- كَمْ أَهْلَكْنَا مِنْ قَبْلِهِم مِّنْ قَرْنٍ فَنَادَوْا وَلاَتَ حِيْنَ مَنَاصٍ- وَعَجِبُوْا أَنْ جَاءَهُمْ مُّنْذِرٌ مِّنْهُمْ وَقَالَ الْكَافِرُوْنَ هَذَا سَاحِرٌ كَذَّابٌ- أَجَعَلَ الْآلِهَةَ إِلَهاً وَاحِداً إِنَّ هَذَا لَشَيْءٌ عُجَابٌ- وَانْطَلَقَ الْمَلاَ مِنْهُمْ أَنِ امْشُوْا وَاصْبِرُوْا عَلَى آلِهَتِكُمْ إِنَّ هَذَا لَشَيْءٌ يُرَادُ- مَا سَمِعْنَا بِهَذَا فِيْ الْمِلَّةِ الْآخِرَةِ إِنْ هَذَا إِلاَّ اخْتِلاَقٌ- (ص 1-7)-

(১) ছোয়াদ- শপথ উপদেশপূর্ণ কুরআনের (২) বরং কাফেররা অহমিকা ও হঠকারিতায় লিপ্ত (৩) তাদের পূর্বেকার কত জনগোষ্ঠীকে আমরা ধ্বংস করেছি। তারা আর্তনাদ করেছে। কিন্তু বাঁচার কোন উপায় তাদের ছিল না (৪) তারা বিস্ময়বোধ করে যে, তাদের কাছে তাদেরই মধ্য থেকে একজন সতর্ককারী আগমন করেছেন। আর কাফেররা বলে এতো একজন জাদুকর ও মহা মিথ্যাবাদী (৫) সে কি বহু উপাস্যের বদলে একজন উপাস্যকে সাব্যস্ত করে? নিশ্চয়ই এটা এক বিস্ময়কর ব্যাপার (৬) তাদের নেতারা একথা বলে চলে যায় যে, তোমরা তোমাদের উপাস্যদের পূজায় অবিচল থাকো। নিশ্চয়ই (মুহাম্মাদের) এ বক্তব্য কোন বিশেষ উদ্দেশ্য প্রণোদিত (৭) আমরা তো পূর্বেকার ধর্মে এরূপ কোন কথা শুনিনি। এটা মনগড়া উক্তি বৈ কিছু নয়’ (ছোয়াদ ৩৮/১-৭)।[১]

[১]. ইবনু হিশাম ১/৪১৭-১৮; তিরমিযী হা/৩২৩২, তাফসীর অধ্যায় সূরা ছোয়াদ; হাকেম হা/৩৬১৭, ২/৪৩২ পৃঃ, সনদ ছহীহ।
 সর্বশেষ মৃত্যুকালে আগমন (المرة الأخيرة রজব ১০ম নববী বর্ষ)
চতুর্থ ও শেষবার নেতারা এসেছিলেন আবু তালিবের মৃত্যুকালে, যেন তিনি তাওহীদের কালেমা পাঠ না করেন ও বাপ-দাদার ধর্মে তথা শিরকের উপর মৃত্যুবরণ করেন, সেটা নিশ্চিত করার জন্য। বস্ত্ততঃ একাজে তারা সফল হয়েছিলেন। রাসূল (ছাঃ)-এর শত আকুতি উপেক্ষা করে সেদিন আবু তালেব আবু জাহ্লের কথায় সায় দিয়ে শিরকের উপর মৃত্যুবরণ করেন। যথাস্থানে তার আলোচনা আসবে ইনশাআল্লাহ (দ্রঃ ১৮০ পৃঃ)।

শিক্ষণীয় বিষয়সমূহ
(১) দুনিয়াপূজারী নেতারা নির্লোভ সংস্কারকদের নিজেদের মত করে ভাবতে চায়। তারা একে ক্ষমতা ও নেতৃত্ব হাছিলের আন্দোলন বলে ধারণা করে। যেমন তারা রাসূল (ছাঃ)-এর দাওয়াত সম্পর্কে মন্তব্য করেছিল- ‘নিশ্চয়ই মুহাম্মাদের এ দাওয়াত বিশেষ কোন উদ্দেশ্য প্রণোদিত’ (ছোয়াদ ৩৮/৬)। আর সেকারণ তারা লোভনীয় প্রস্তাব সমূহের ডালি নিয়ে সংস্কারকের সম্মুখে হাযির হয়। যাতে তার ফাঁদে পড়ে সংস্কার কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায় অথবা তাতে ভাটা পড়ে। শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর জীবনে যেমনটি ঘটেছে, তাঁর সনিষ্ঠ অনুসারী সংস্কারকদের জীবনেও যুগে যুগে তেমনটি ঘটবে এবং এটাই স্বাভাবিক।

(২) বাতিলপন্থী নেতারা হক-এর দাওয়াতের যথার্থতা স্বীকার করে। তারা কুরআনকে সত্য কিতাব হিসাবে মানে। কিন্তু দুনিয়াবী স্বার্থ তাদেরকে অন্ধ করে রাখে। যেমন বিশেষভাবে ওৎবা বিন রাবী‘আহ্র ক্ষেত্রে দেখা গেছে।

(৩) কায়েমী স্বার্থবাদী নেতারা সংস্কারকের বিরুদ্ধে প্রধানতঃ ২টি অভিযোগ দাঁড় করিয়ে থাকে। এক- পিতৃধর্ম ও রেওয়াজের বিরোধিতা এবং দুই- সমাজে বিভক্তি সৃষ্টি করা। যেমন কুরায়েশ নেতারা এসে আবু তালেবের নিকটে রাসূল (ছাঃ)-এর বিরুদ্ধে উক্ত অভিযোগগুলি করেছিল।

(৪) নির্ভেজাল তাওহীদ বিশ্বাসের মাধ্যমে দুনিয়া জয় করা সম্ভব, তার ভবিষ্যদ্বাণী উচ্চারিত হয়েছিল রাসূল (ছাঃ)-এর পবিত্র যবানে আবু জাহলদের সম্মুখে ১০ম নববী বর্ষের মাঝামাঝি সময়ে এবং তার সফল বাস্তবায়ন ঘটেছিল তার ১১ বছর পরে ৮ম হিজরীর ১৭ই রামাযান মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে। অতঃপর খলীফাদের যুগে আরব-আজমের সর্বত্র ইসলামী খেলাফতের একচ্ছত্র বিজয় সাধনের মাধ্যমে।

(৫) তাওহীদের কালেমা চির বিজয়ী শক্তি। যা কখনোই পরাজিত হয় না। প্রয়োজন কেবল দক্ষ ও সাহসী নেতা এবং আনুগত্যশীল সাহসী অনুসারী দল।



******************************
সাইটটি ভিজিট করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আর্টিকেলটি ভাল লাগলে সত্য ও ন্যয়ের পথে অন্য ভাইনদেরকে দাওয়াতের নিয়তে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন। মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে এবং দীন ও মানবতার সেবায় অংশ নিতে OUR ACTION PLAN বাটনে ক্লিক করুন।


এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url