প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর জীবনী [পর্ব-১৩]





ইসলাম গ্রহণের কারণে ছাহাবীগণের উপর নির্মম অত্যাচার


ছাহাবীগণের উপরে অত্যাচার

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর উপরে মানসিক ও দৈহিক অত্যাচারের কিছু ঘটনা আমরা ইতিপূর্বে জেনেছি। এক্ষণে আমরা তাঁর সাথীদের উপরে অত্যাচারের কিছু নমুনা পেশ করব।-

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন, প্রথম সাতজন ব্যক্তি তাদের ইসলাম প্রকাশ করেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ), আবুবকর, ‘আম্মার ও তার মা সুমাইয়া, ছোহায়েব, বেলাল ও মিক্বদাদ। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে আল্লাহ নিরাপত্তা দেন তাঁর চাচা আবু ত্বালেবের মাধ্যমে, আবুবকরকে নিরাপত্তা দেন তার গোত্রের মাধ্যমে। আর বাকীদের মুশরিকরা পাকড়াও করে। তাদেরকে তারা লোহার পোষাক পরিয়ে প্রচন্ড দাবদাহের মধ্যে ফেলে রাখে। তারা যেভাবে খুশী নির্যাতন করে। কিন্তু বেলালের ব্যাপারটি ছিল ভিন্ন। সে নিজেকে আল্লাহর উপর সঁপে দিয়েছিল। লোকেরা তার পিছনে ছোকরাদের লেলিয়ে দেয়। তারা তাকে মক্কার অলি-গলিতে ঘুরায়। আর সে বলতে থাকে আহাদ, আহাদ’।[১] এখানে সাতজনের মধ্যে সুমাইয়ার স্বামী ইয়াসিরকে ধরা হয়নি। যদিও তিনিও ছিলেন একই সময়ের নির্যাতিত ছাহাবী’ (আল-ইছাবাহ, ‘আম্মার ক্রমিক ৫৭০৮)।

উল্লেখ্য যে, মুসলমানদের উপরে কাফিরদের এই অত্যাচারের কোন ধরাবাঁধা নিয়ম ছিল না কিংবা উঁচু-নীচু ভেদাভেদ ছিল না। তবে স্বাভাবিক নিয়ম অনুযায়ী সচ্ছল ও উঁচু স্তরের লোকদের চাইতে গরীব ও ক্রীতদাস শ্রেণীর মুসলমানদের উপরে অত্যাচার ও নির্যাতনের মাত্রা ছিল অনেক বেশী, যা অবর্ণনীয়। নিম্নে উদাহরণ স্বরূপ জাহেলী যুগে ছাহাবীগণের উপর নির্যাতনের কিছু নমুনা পেশ করা হ’ল।-
[১]. আহমাদ হা/৩৮৩২, সনদ হাসান; বায়হাক্বী সুনান হা/১৭৩৫১; মা শা-‘আ ৩৪ পৃঃ।

বেলাল বিন রাবাহ এর উপর অত্যাচার

যিনি কুরায়েশ নেতা উমাইয়া বিন খালাফের হাবশী ক্রীতদাস ছিলেন। ইসলাম কবুল করার অপরাধে তাকে তার মনিব অবর্ণনীয় নির্যাতন করে। তার গলায় দড়ি বেঁধে গরু-ছাগলের মত ছেলে-ছোকরাদের দিয়ে পাহাড়ে ও প্রান্তরে টেনে-হিঁচড়ে ঘুরানো হত। তাতে তার গলার চামড়া রক্তাক্ত হয়ে যেত। খানাপিনা বন্ধ রেখে তাকে ক্ষুৎ-পিপাসায় কষ্ট দেওয়া হত। কখনো উত্তপ্ত কংকর-বালুর উপরে হাত-পা বেঁধে ফেলে রেখে বুকে পাথর চাপা দেওয়া হত আর বলা হতلاَ تَزَالُ هَكَذَا حَتَّى تَمُوتَ أَوْ تَكْفُرَ بِمُحَمَّدِ وَتَعْبُدَ اللاَّتَ وَالْعُزَّى ‘মুহাম্মাদের দ্বীন পরিত্যাগ এবং লাত-‘উযযার পূজা না করা পর্যন্ত তোকে আমৃত্যু এভাবেই পড়ে থাকতে হবে’। কিন্তু বেলাল শুধুই বলতেন ‘আহাদ’ ‘আহাদ’ (ইবনু হিশাম ১/৩১৭-১৮)। 
একদিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) পাশ দিয়ে যাবার সময় এই দৃশ্য দেখে বললেন أَحَدٌ يُنْجِيكَ ‘আহাদ’ অর্থাৎ ‘আল্লাহ তোমাকে মুক্তি দেবেন’। অতঃপর তিনি এসে আবুবকরকে বললেন, يَا أَبَا بَكْرٍ إِنَّ بِلاَلاً يُعَذَّبُ فِي اللهِ ‘হে আবুবকর। বেলাল আল্লাহর পথে শাস্তি ভোগ করছে’। আবুবকর ইঙ্গিত বুঝলেন। অতঃপর উমাইয়ার দাবী অনুযায়ী নিজের কাফের গোলাম নিসতাস (نِسْطَاسٌ)-এর বিনিময়ে এবং একটি মূল্যবান চাদর ও দশটি উক্বিয়ার (স্বর্ণমুদ্রা) বিনিময়ে তাকে খরীদ করে মুক্ত করে দেন।[১] ওমর (রাঃ) বলেন, أَبُو بَكْرٍ سَيِّدُنَا، وَأَعْتَقَ سَيِّدَنَا، يَعْنِى بِلاَلاً ‘আবুবকর আমাদের নেতা এবং মুক্ত করেছেন আমাদের নেতাকে’। এর দ্বারা তিনি বেলালকে বুঝাতেন।[২] ওমর (রাঃ)-এর এই কথার মধ্যে ইসলামী সাম্যের প্রকৃষ্ট প্রমাণ মেলে। যেখানে মানুষে মানুষে কোন ভেদাভেদ নেই তাক্বওয়া ব্যতীত। বেলাল (রাঃ) ইসলামের প্রথম ও শ্রেষ্ঠ মুওয়াযযিন ছিলেন। তিনি ২০ হিজরী সনে ৬৩ বছর বয়সে দামেষ্কে মৃত্যুবরণ করেন’ (আল-ইছাবাহ ক্রমিক সংখ্যা ৭৭৬)।
[১]. কুরতুবী তাফসীর সূরা লায়েল ১৯-২০ আয়াত; হা/৬৩৫৮ সনদ হাসান; ২০/৭৯-৮০ পৃঃ।
[২]. বুখারী হা/৩৭৫৪; মিশকাত হা/৬২৫০ ‘মর্যাদা সমষ্টি’ অনুচ্ছেদ।

আমের বিন ফুহায়রাহ এর উপর অত্যাচার

আবুবকরের মুক্তদাস ছিলেন। হিজরতের রাতে ইনি সার্বিক খিদমতে ছিলেন। বদর ও ওহুদের যুদ্ধে যোগদান করেন। তিনি ৪র্থ হিজরীর ছফর মাসে সংঘটিত বি’রে মাঊনার মর্মান্তিক ঘটনায় ৭০জন শহীদের অন্যতম ছিলেন (ইবনু হিশাম ১/৩১৮)।

উম্মে উবাইস, যিন্নীরাহ, নাহদিয়াহ ও তার মেয়ের উপর অত্যাচার

(৩) উম্মে উবাইস, যিন্নীরাহ, নাহদিয়াহ ও তার মেয়ে এবং বনু মুআম্মাল-এর জনৈকা দাসী মুসলমান হলে তারা সবাই বর্বরতম নির্যাতনের শিকার হন। ইবনু ইসহাক বলেন, যিন্নীরাহকে যখন তিনি মুক্ত করেন, তখন সে অন্ধ ছিল। কুরায়েশরা বলল, লাত-‘উযযার অভিশাপে সে অন্ধ হয়ে গেছে। তখন যিন্নীরাহ বলল, ওরা মিথ্যা বলেছে। আল্লাহর ঘরের কসম![১] লাত-‘উযযা কারু কোন ক্ষতি করতে পারেনা, উপকারও করতে পারেনা’। তখনই আল্লাহ তার দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দেন’।[২]

এভাবে সর্বশেষ বেলালকে নিয়ে হিজরতের পূর্বে মোট ৭জন দাস-দাসীকে আবুবকর মুক্ত করেন (হাকেম হা/৫২৪১ হাদীছ ছহীহ)। এবিষয়ে একদিন তার পিতা আবু কুহাফা তাকে বলেন, বেটা! আমি দেখছি তুমি যত দুর্বল দাস-দাসী মুক্ত করছ। যদি তুমি শক্তিশালী ও সাহসী কিছু লোককে মুক্ত করতে, তাহলে তারা তোমাকে রক্ষা করত এবং তোমার পক্ষে যুদ্ধ করত! জবাবে আবুবকর বলেন, হে পিতা! আমি তো কেবল আল্লাহর জন্যই এগুলি করেছি। অতঃপর তাঁর সম্পর্কে ‘সূরা লায়েল’ নাযিল হয় (ইবনু হিশাম ১/৩১৮-৩১৯)। উল্লেখ্য যে, এসময় আবু কুহাফা ইসলাম কবুল করেননি। মক্কা বিজয়ের দিন তিনি মুসলমান হন  (মুসলিম হা/২১০২ (৭৯)।

এভাবে কুরায়েশ নেতারা মুসলিম দাস-দাসী ও তাদের পরিবারের উপরে সর্বাধিক নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন করত। আবুবকর (রাঃ) এইসব নির্যাতিত দাস-দাসীকে বহু মূল্যের বিনিময়ে তাদের নিষ্ঠুর মনিবদের নিকট থেকে খরীদ করে নিয়ে মুক্ত করে দিতেন।
[১]. আল্লাহর ঘরের কসম করা জায়েয নয়। বরং রববুল কা‘বা (কা‘বার রবের) কসম করা যাবে (আহমাদ হা/২৭১৩৮; নাসাঈ হা/৩৭৭৩; সিলসিলা ছহীহাহ হা/১১৬৬)।
[২]. ইবনু হিশাম ১/৩১৮; আল-ইছাবাহ ক্রমিক ১১২১৬; মুহাক্কিক বলেন, যিন্নীরাহ্র ঘটনাটি বিভিন্ন সূত্রে বর্ণিত হওয়ার কারণে এর সনদ ‘হাসান’ স্তরে উন্নীত হ’তে পারে (তাহকীক ইবনু হিশাম ক্রমিক ৩০৯)।

মুছ‘আব বিন উমায়ের এর উপর অত্যাচার

ইনি ছিলেন মক্কার শ্রেষ্ঠ তরুণদের অন্যতম। তিনি অত্যন্ত বিলাস-ব্যসনে মানুষ হন। রাসূল (ছাঃ) যখন দারুল আরক্বামে দ্বীনের দাওয়াত দিতেন, তখন তিনি ইসলাম কবুল করেন। কিন্তু মা ও গোত্রের লোকদের ভয়ে তা প্রকাশ করেননি। পরে ওছমান বিন ত্বালহার মাধ্যমে খবরটি প্রকাশ হয়ে পড়ে। তখন তার গোত্রের লোকেরা তাকে হাত-পা বেঁধে তার ঘরের মধ্যে আটকে রাখে। এক সময় তিনি কৌশলে পালিয়ে যান ও হাবশায় হিজরত করেন। পরে সেখান থেকে ফিরে রাসূল (ছাঃ)-এর নির্দেশে মদীনায় প্রেরিত হন। তিনিই ছিলেন মদীনায় প্রেরিত ইসলামের প্রথম দাঈ। প্রধানতঃ তাঁরই প্রচেষ্টায় মদীনার আউস ও খাযরাজ নেতারা ইসলাম কবুল করেন। যা হিজরতের পটভূমি তৈরী করে। ওহুদের যুদ্ধে তিনি ইসলামী বাহিনীর পতাকাবাহী ছিলেন। অতঃপর শহীদ হন (আল-ইছাবাহ ক্রমিক সংখ্যা ৮০০৮)।

ইয়াসির পরিবারের উপর নির্মম অত্যাচার

ইয়ামন থেকে মক্কায় হিজরতকারী এই পরিবার মক্কার বনু মাখযূমের সাথে চুক্তিবদ্ধ মিত্র (حَلِيفٌ) ছিল। পরিবার প্রধান ইয়াসির বিন মালিক এবং তার স্ত্রী সুমাইয়া ও পুত্র ‘আম্মার সকলে মুসলমান হন। ফলে তাদের উপরে যে ধরনের অমানুষিক নির্যাতন করা হয়েছিল, ইতিহাসে তার তুলনা বিরল। বনু মাখযূম নেতা আবু জাহেলের নির্দেশে তাদেরকে খোলা ময়দানে নিয়ে উত্তপ্ত বালুকার উপরে শুইয়ে রেখে প্রতিদিন নানাভাবে নির্যাতন করা হত। একদিন চলার পথে তাদের শাস্তির দৃশ্য দেখে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদের উদ্দেশ্যে বলেন, صَبْرًا آلَ يَاسِر فَإِنَّ مَوْعِدَكُمُ الْجَنَّةُ ‘ধৈর্য ধর হে ইয়াসির পরিবার! তোমাদের ঠিকানা হল জান্নাত’। অবশেষে ইয়াসিরকে কঠিন নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা করা হয়।[১]

অতঃপর পাষাণহৃদয় আবু জাহেল নিজ হাতে ইয়াসিরের বৃদ্ধা স্ত্রী সুমাইয়ার গুপ্তাঙ্গে বর্শা বিদ্ধ করে তাকে হত্যা করে। তিনিই ছিলেন ইসলামে প্রথম মহিলা শহীদ।[২] অতঃপর তাদের পুত্র ‘আম্মারের উপরে শুরু হয় নির্যাতনের পালা। তাকেও বেলালের ন্যায় কঠিন নির্যাতন করা হয় যতক্ষণ না সে রাসূল (ছাঃ)-কে গালি দিতে রাযী হয়। অবশেষে বাধ্য হয়ে তিনি তাদের কথা মেনে নেন। পরে মুক্তি পেয়েই তিনি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর দরবারে গিয়ে সব ঘটনা খুলে বলেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে জিজ্ঞেস করেন كََيْفَ تَجِدُ قَلْبَكَ؟ ‘ঐ সময় তোমার অন্তর কিরূপ ছিল’? তিনি বললেন, مُطْمَئِنًّا بِالْإِيْمَانِ ‘ঈমানের উপর অবিচল’। রাসূল (ছাঃ) বললেন إِنْ عَادُوا فَعُدْ ‘যদি ওরা আবার বলতে বলে, তাহলে তুমি আবার বল’। তখন নিম্নোক্ত আয়াত নাযিল হয়,[3] مَنْ كَفَرَ بِاللهِ مِنْ بَعْدِ إِيمَانِهِ إِلاَّ مَنْ أُكْرِهَ وَقَلْبُهُ مُطْمَئِنٌّ بِالْإِيمَانِ وَلَكِنْ مَنْ شَرَحَ بِالْكُفْرِ صَدْرًا فَعَلَيْهِمْ غَضَبٌ مِنَ اللهِ وَلَهُمْ عَذَابٌ عَظِيمٌ ‘ঈমান আনার পরে যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে কুফরী করে, তাদের জন্য রয়েছে আল্লাহর ক্রোধ এবং কঠিন শাস্তি। কিন্তু যাকে বাধ্য করা হয়, অথচ তার অন্তর বিশ্বাসে অটল থাকে (তার কোন চিন্তা নেই)’ (নাহল ১৬/১০৬)। ইবনু কাছীর বলেন, সকল বিদ্বান এ বিষয়ে একমত যে, কুফরীতে বাধ্য করা হলে বাধ্যকারীর কথামত কাজ করা জায়েয (ইবনু কাছীর)। একমাত্র বেলাল ছিলেন, যিনি তাদের কথা মত কাজ করতেন না, বরং কেবলি বলতেন আহাদ, আহাদ।

পরে হযরত আবুবকর (রাঃ) ‘আম্মার বিন ইয়াসিরকে তার মনিবের কাছ থেকে খরীদ করে মুক্ত করে দেন। ‘আম্মার ঐ সময় আবুবকর (রাঃ)-এর প্রশংসায় যে কবিতা বলেন, তার শুরু ছিল নিম্নরূপ :

جَزَى اللهُ خَيْرًا عَنْ بَلاَلٍ وَصَحْبِهِ + عَتِيْقًا وَأَخْزَى فَاكِهًا وَأَبَا جَهْلِ

‘আল্লাহ উত্তম পুরস্কার দান করুন আবুবকর (রাঃ)-কে বেলাল ও তার সাথীদের পক্ষ হতে এবং লাঞ্ছিত করুন আবু ফাকীহাহ (উমাইয়া বিন খালাফ) ও আবু জাহেলকে’।[৪]

‘আম্মার রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে সকল যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলতেন, যে ব্যক্তি ‘আম্মারের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে আল্লাহ তার প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করেন’। খালিদ বিন অলীদ (রাঃ) বলেন, এই হাদীছ শোনার পর থেকে আমি সর্বদা তাকে ভালোবাসতাম’।[৫] আবুবকর (রাঃ)-এর খেলাফতকালে ভন্ডনবীদের বিরুদ্ধে ইয়ামামাহর যুদ্ধে তার কান বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ওমর (রাঃ) তাকে কূফার গভর্ণর নিযুক্ত করেন। রাসূল (ছাঃ) ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে, تَقْتُلُهُ الْفِئَةُ الْبَاغِيَةُ ‘তাকে বিদ্রোহী দল হত্যা করবে’ (বুখারী হা/৪৪৭)। ৩৭ হিজরীতে ছিফফীনের যুদ্ধে তিনি আলী (রাঃ)-এর পক্ষে যোগদান করেন এবং শহীদ হন। এসময় তাঁর বয়স ছিল ৯৩ বছর। আলী (রাঃ) তাঁকে গোসল ও কাফন না দিয়েই দাফন করেন।[৬]
[১]. ইবনু হিশাম ১/৩১৯-২০; হাকেম হা/৫৬৪৬; আলবানী, ফিক্বহুস সীরাহ ১০৩ পৃঃ, সনদ ছহীহ; ত্বাবারাণী আওসাত্ব হা/৩৮৪৬; আল-ইছাবাহ, ইয়াসির ‘আনাসী ক্রমিক ৯২১৪; আল-ইস্তী‘আব ক্রমিক ২৮২২।
[২]. আল-ইছাবাহ, সুমাইয়া, ক্রমিক ১১৩৩৬।
[৩]. হাকেম হা/৩৩৬২, ২/৩৫৭ পৃঃ সনদ ছহীহ; কুরতুবী হা/৩৯৫৫; বায়হাক্বী হা/১৭৩৫০, ৮/২০৮-০৯ পৃঃ; ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা নাহল ১০৬ আয়াত।
[৪]. আবু নু‘আইম, হিলইয়াতুল আউলিয়া ১/১৪৮; তানতাভী, তাফসীর সূরা লায়েল ১৯-২০ আয়াত, ১৩/২০৪ পৃঃ।
[৫]. হাকেম হা/৫৬৭৪; ছহীহুল জামে‘ হা/৬৩৮৬।
[৬]. আল-ইছাবাহ, ‘আম্মার ক্রমিক ৫৭০৮; আল-ইস্তী‘আব ক্রমিক ১৮৬৩।

আবু জাহলের অভ্যাস

আবু জাহলের অভ্যাস ছিল এই যে,
(ক) যখন কোন অভিজাত বংশের লোক ইসলাম কবুল করতেন, তখন সে গিয়ে তাকে গালি-গালাজ করত ও তার ধন-সম্পদের ক্ষতি সাধন করবে বলে হুমকি দিত। নিজ আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে গরীব ও দুর্বল কেউ মুসলমান হয়েছে জানতে পারলে তাকে ধরে নির্দয়ভাবে পিটাতো এবং অন্যকে মারার জন্য প্ররোচিত করত। কোন ব্যবসায়ী ইসলাম কবুল করলে তাকে গিয়ে ধমক দিয়ে বলত, তোমার ব্যবসা বন্ধ করে দেব এবং তোমার মাল-সম্পদ ধ্বংস করে দেব’ (ইবনু হিশাম ১/৩২০)। এইভাবে সম্মানিত ব্যক্তিকে ইসলাম কবুলের অপরাধে অসম্মানিত করা মক্কার নেতাদের নিয়মিত অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। আজকের সভ্য যুগেও যা চলছে বরং আরও জোরে-শোরে।

(খ) পবিত্র কুরআনে عَلَيْهَا تِسْعَةَ عَشَرَ ‘জাহান্নামের প্রহরী হল ১৯জন ফেরেশতা’ (মুদ্দাছছির ৭৪/৩০) নাযিল হলে আবু জাহেল অহংকার বশে তার লোকদের বলে, ‘হে কুরায়েশ যুবকেরা! তোমাদের ১০জনে কি জাহান্নামের ১জন ফেরেশতাকে কাবু করতে পারবে না? (ইবনু কাছীর)। কেননা মুহাম্মাদ বলে, এরা তোমাদেরকে জাহান্নামে আটকে রেখে নির্যাতন করবে। অথচ তোমরা হলে সংখ্যায় ও শক্তিতে অনেক বেশী। তোমরা তাদের একশ’ জনের সমান’ (ইবনু হিশাম ১/৩১৩)। আবু জাহল অত্র আয়াতের ব্যাখ্যা বুঝেনি। অথবা বুঝেও দল ঠিক রাখার জন্য আসল কথা বলেনি। সেকারণ পরবর্তী আয়াতেই আল্লাহ বলে দিয়েছেন যে,

وَمَا جَعَلْنَا أَصْحَابَ النَّارِ إِلاَّ مَلاَئِكَةً وَمَا جَعَلْنَا عِدَّتَهُمْ إِلاَّ فِتْنَةً لِلَّذِيْنَ كَفَرُوْا لِيَسْتَيْقِنَ الَّذِيْنَ أُوْتُوْا الْكِتَابَ وَيَزْدَادَ الَّذِيْنَ آمَنُوْا إِيْمَانًا وَلاَ يَرْتَابَ الَّذِيْنَ أُوْتُوْا الْكِتَابَ وَالْمُؤْمِنُوْنَ وَلِيَقُوْلَ الَّذِيْنَ فِي قُلُوْبِهِمْ مَرَضٌ وَالْكَافِرُوْنَ مَاذَا أَرَادَ اللهُ بِهَذَا مَثَلاً- (مدثر ৩১)-

‘আমরা ফেরেশতাদের এই সংখ্যা নির্ধারণ করেছি কাফেরদের পরীক্ষা করার জন্য। যাতে কিতাবীরা (রাসূলের সত্যতার ব্যাপারে) দৃঢ় বিশ্বাসী হয়, মুমিনদের ঈমান বৃদ্ধি পায় এবং কিতাবীগণ ও মুমিনগণ সন্দেহ পোষণ না করে। আর যাতে যাদের অন্তরে ব্যাধি আছে (মুনাফিকরা) ও কাফেররা বলে যে, এর (এই সংখ্যা) দ্বারা আল্লাহ কি বুঝাতে চেয়েছেন’? (মুদ্দাছছির ৭৪/৩১)। বর্তমান যুগেও অনেকে আবু জাহলের মত ঊনিশ-এর ব্যাখ্যায় বহু মনগড়া বিষয় উদঘাটন করে ফিৎনায় পড়েছে।[১]
[১]. লেখক প্রণীত তাফসীরুল কুরআন ৩০তম পারা (রাজশাহী, ২য় সংস্করণ : মে ২০১৩ খ্রিঃ) ১৭-১৮ পৃঃ।

আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ

উরওয়া বিন যুবায়ের স্বীয় পিতা যুবায়ের ইবনুল ‘আওয়াম (রাঃ) হ’তে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন যে, আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ (রাঃ) ছিলেন প্রথম ব্যক্তি, যিনি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর পরে মক্কায় কাফেরদের সম্মুখে প্রথম প্রকাশ্যে কুরআন পাঠ করেন। তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূলের ছাহাবীগণ একদিন একত্রিত হয়ে বললেন, আল্লাহর কসম! কুরায়েশরা কখনো প্রকাশ্যে কুরআন শুনেনি। অতএব কে আছে যে তাদেরকে কুরআন শুনাতে পারে? তখন আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ বললেন, আমি। এতে সবাই বলল, আমরা তোমার ব্যাপারে ভয় পাচ্ছি। বরং আমরা এমন একজন ব্যক্তিকে চাচ্ছি, যাদের গোত্র আছে। যারা তাকে রক্ষা করবে। তখন তিনি বললেন, আমাকে ছাড়ুন! আল্লাহ আমাকে রক্ষা করবেন। অতঃপর ইবনু মাসঊদ পরদিন সকালে কিছু বেলা উঠার পর কুরায়েশদের ভরা মজলিসে এসে দাঁড়ান। অতঃপর উচ্চ কণ্ঠে ‘বিসমিল্লাহ’ বলে সূরা রহমান পড়তে শুরু করেন। তখন তারা বলে উঠল,  مَاذَا قَالَ ابْنُ أُمِّ عَبْدٍ؟ ‘গোলামের মায়ের বেটা কি বলছে’? তাদের কেউ বলল, সে মুহাম্মাদ যা নিয়ে এসেছে, তার কিছু পাঠ করছে। তখন সবাই তার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল এবং তার মুখে মারতে শুরু করল। এভাবে প্রহৃত হয়ে ইবনু মাসঊদ তার সাথীদের নিকটে ফিরে এলেন। তখন সাথীরা তাকে বললেন, তোমার ব্যাপারে আমরা এটাই ভয় করেছিলাম। ইবনু মাসঊদ বললেন, আল্লাহর শত্রুরা এখন আমার কাছে সহজ হয়ে গেছে। যদি আপনারা চান কাল সকালে আবার গিয়ে আমি তাদের কুরআন শুনাব। সাথীরা বললেন, না। যথেষ্ট হয়েছে। তারা যা পছন্দ করেনা তুমি তাদেরকে তাই শুনিয়েছ’।[১] উল্লেখ্য যে, ইবনু মাসঊদ (রাঃ) মক্কায় ওক্ববা বিন আবু মু‘আইত্বের বকরীর রাখাল ছিলেন (আল-বিদায়াহ ৬/১০২)।
[১]. ইবনু হিশাম ১/৩১৪-১৫; আছার ছহীহ (তাহকীক ইবনু হিশাম ক্রমিক ৩০৩)।

খাববাব ইবনুল আরাত

বনু খোযা‘আহ গোত্রের জনৈকা মহিলা উম্মে আনমার-এর গোলাম ছিলেন। তিনি ষষ্ঠ মুসলমান ছিলেন এবং দুর্বলদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তিনি ছিলেন প্রথম ইসলাম প্রকাশকারী এবং আললাহর পথে কঠিন নির্যাতন ভোগকারী’ (আল-ইছাবাহ ক্রমিক ২২১২)। মুসলমান হওয়ার অপরাধে মুশরিক নেতারা তার উপরে লোমহর্ষক নির্যাতন চালায়। নানাবিধ অত্যাচারের মধ্যে সবচাইতে মর্মান্তিক ছিল এই যে, তাকে জ্বলন্ত লোহার উপরে চিৎ করে শুইয়ে বুকের উপরে পাথর চাপা দেওয়া হয়েছিল। ফলে পিঠের চামড়া ও গোশত গলে লোহার আগুন নিভে গিয়েছিল। বারবার নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে তিনি একদিন রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে গমন করেন। তখন তিনি কা‘বা চত্বরে চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়েছিলেন। তিনি রাসূল (ছাঃ)-কে কাফেরদের বিরুদ্ধে বদ দো‘আ করার জন্য আকুলভাবে দাবী করেন। তখন উঠে রাগতঃস্বরে রাসূল (ছাঃ) তাকে দ্বীনের জন্য বিগত উম্মতগণের কঠিন নির্যাতন ভোগের কথা স্মরণ করিয়ে দেন এবং বলেন,

كَانَ الرَّجُلُ فِيمَنْ قَبْلَكُمْ يُحْفَرُ لَهُ فِى الأَرْضِ فَيُجْعَلُ فِيهِ، فَيُجَاءُ بِالْمِنْشَارِ، فَيُوضَعُ عَلَى رَأْسِهِ فَيُشَقُّ بِاثْنَتَيْنِ، وَمَا يَصُدُّهُ ذَلِكَ عَنْ دِينِهِ، وَيُمْشَطُ بِأَمْشَاطِ الْحَدِيدِ، مَا دُونَ لَحْمِهِ مِنْ عَظْمٍ أَوْ عَصَبٍ، وَمَا يَصُدُّهُ ذَلِكَ عَنْ دِينِهِ، وَاللهِ لَيُتِمَّنَّ هَذَا الأَمْرَ حَتَّى يَسِيرَ الرَّاكِبُ مِنْ صَنْعَاءَ إِلَى حَضْرَمَوْتَ، لاَ يَخَافُ إِلاَّ اللهَ أَوِ الذِّئْبَ عَلَى غَنَمِهِ، وَلَكِنَّكُمْ تَسْتَعْجِلُوْنَ

‘তোমাদের পূর্বেকার জাতিসমূহের লোকদের দ্বীনের কারণে গর্ত খোঁড়া হয়েছে। অতঃপর তাতে নিক্ষেপ করে তাদের মাথার মাঝখানে করাত রেখে দেহকে দ্বিখন্ডিত করা হয়েছে। তথাপি তাদেরকে তাদের দ্বীন থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। লোহার চিরুনী দিয়ে গোশত ও শিরাসমূহ হাড্ডি থেকে পৃথক করে ফেলা হয়েছে। তথাপি এগুলি তাদেরকে তাদের দ্বীন থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। আল্লাহর কসম! অবশ্যই তিনি এই ইসলামী শাসনকে এমনভাবে পূর্ণতা দান করবেন যে, একজন আরোহী (ইয়ামনের রাজধানী) ছান‘আ থেকে হাযরামাউত পর্যন্ত একাকী ভ্রমণ করবে। অথচ সে আল্লাহ ব্যতীত কাউকে ভয় করবে না। অথবা তার ছাগপালের উপরে নেকড়ের ভয় করবে। কিন্তু তোমরা বড়ই ব্যস্ততা দেখাচ্ছ’।[১] এ হাদীছ শোনার পরে তার ঈমান আরও বৃদ্ধি পায়।

খাববাব কর্মকারের কাজ করতেন। তিনি কুরাইশ নেতা ‘আছ বিন ওয়ায়েল-এর জন্য একটি তরবারী তৈরী করে দেন। পরে তার মূল্য নিতে গেলে ‘আছ বলেন, আমি তোমাকে মূল্য দিব না, যতক্ষণ না তুমি মুহাম্মাদের সাথে কুফরী করবে। জবাবে খাববাব বললেন, বরং যতক্ষণ না আপনি মরবেন ও পুনরুত্থিত হবেন’। ‘আছ তাকে বিদ্রুপ করে বললেন, ‘ঠিক আছে ক্বিয়ামতের দিনেও আমার নিকটে মাল-সম্পদ ও সন্তানাদি থাকবে, সেখানে তোমার পাওনা পরিশোধ করে দিব’। তখন নাযিল হয়, أَفَرَأَيْتَ الَّذِي كَفَرَ بِآيَاتِنَا وَقَالَ لَأُوتَيَنَّ مَالاً وَوَلَدًا- أَطَّلَعَ الْغَيْبَ أَمِ اتَّخَذَ عِنْدَ الرَّحْمَنِ عَهْدًا ‘তুমি কি দেখেছ ঐ ব্যক্তিকে, যে আমার আয়াতসমূহ প্রত্যাখান করে এবং বলে, আমাকে অবশ্যই ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি দেওয়া হবে’। ‘সে কি অদৃশ্য জ্ঞান সম্পর্কে অবহিত হয়েছে, না-কি দয়াময়ের নিকট থেকে সে কোন প্রতিশ্রুতি লাভ করেছে?’ (মারিয়াম ১৯/৭৭-৭৮)।[2]

এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, তারা মুসলমানদের কেবল দৈহিক নির্যাতনই করেনি, বরং জাহেলী যুগের বিখ্যাত হিলফুল ফুযূল-এর চুক্তিনামাও তারা ভঙ্গ করেছিল, যা ছিল কুরাইশদের চিরাচরিত রীতির বিরোধী। কেননা মুসলমানদের ক্ষেত্রে তারা সকল প্রকার যুলুমকে সিদ্ধ মনে করত। আব্দুল্লাহ বিন ওমর (রাঃ) বলেন, মুসলমানের সংখ্যা যখন কম ছিল, তখন তারা দ্বীনের কারণে ফিৎনায় পতিত হত। হয় তাদেরকে হত্যা করা হত, নয় তাদেরকে চরমভাবে নির্যাতন করা হত। অবশেষে মুসলমানের সংখ্যা বৃদ্ধি পেল, তখন আর ফিৎনা রইল না’ (বুখারী হা/৪৬৫০)।

ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) একদিন খাববাবকে ডেকে বলেন, তোমার উপরে নির্যাতনের কাহিনী আমাকে একটু শুনাও। তখন তিনি নিজের পিঠ দেখিয়ে বললেন, হে আমীরুল মুমিনীন! আমার পিঠ দেখুন। আমাকে জ্বলন্ত লোহার গনগনে আগুনের উপরে চাপা দিয়ে রাখা হত। আমার পিঠের গোশত গলে উক্ত আগুন নিভে যেত’। তখন ওমর (রাঃ) বলেন, এরূপ দৃশ্য আমি ইতিপূর্বে কখনো দেখিনি’। তিনি খারেজীদের বিরুদ্ধে নাহরাওয়ানের যুদ্ধে এবং পরে ছিফফীনের যুদ্ধে আলী (রাঃ)-এর পক্ষে ছিলেন। তিনি রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে বদর-ওহুদসহ সকল যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।

আলী (রাঃ) ৩৭ হিজরীতে ছিফফীন যুদ্ধে রওয়ানার পর ৬৩ বছর বয়সে খাববাব (রাঃ) মৃত্যুবরণ করেন। যুদ্ধ থেকে ফেরার পথে আলী (রাঃ) তাঁর কবর যিয়ারত করেন। অতঃপর বলেন, رَحِمَ اللهُ خَبَّابًا، لَقَدْ أَسْلَمَ رَاغِبًا، وَهَاجَرَ طَائِعًا، وَعَاشَ مُجَاهِدًا، وَابْتُلِيَ فِي جِسْمِهِ أَحْوَالاً، وَلَنْ يُضَيِّعَ اللهُ أَجْرَهُ ‘আল্লাহ রহম করুন খাববাবের উপর, তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন আগ্রহের সাথে, হিজরত করেছিলেন আনুগত্যের সাথে, জীবন যাপন করেছেন মুজাহিদ হিসাবে, নির্যাতিত হয়েছেন দৈহিকভাবে বিভিন্ন অবস্থায়। অতএব কখনোই আল্লাহ তার পুরস্কার বিনষ্ট করবেন না’। সম্ভবতঃ যৌবনকালে লোহার আগুনে পিঠ পুড়িয়ে দেওয়ার যন্ত্রণাদায়ক ঘা থেকে পরবর্তীতে তিনি কঠিন রোগে আক্রান্ত হন। যে কারণে মাঝে-মধ্যে বলতেন, মৃত্যু কামনা নিষিদ্ধ না হ’লে আমি সেটাই কামনা করতাম।[৩]

ওমর ও ওছমান (রাঃ)-এর আমলে যখন মুসলমানদের সম্পদ বৃদ্ধি পায়, তখন অগ্রবর্তী মুহাজির হিসাবে খাববাব (রাঃ)-এর জন্য বড় অংকের রাষ্ট্রীয় ভাতা নির্ধারণ করা হয়। যাতে তিনি বহু সম্পদের অধিকারী হন এবং কূফাতে বাড়ি করেন। এসময় তিনি একটি কক্ষে অর্থ জমা রাখতেন। যা তার সাথীদের জানিয়ে দিতেন। অতঃপর অভাবগ্রস্তরা সেখানে যেত এবং প্রয়োজনমত নিয়ে নিত। তিনি বলতেন,  وَلَقَدْ رَأَيْتُنِي مَعَ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، مَا أَمْلِكُ دِينَارًا وَلا دِرْهَمًا وَإِنَّ فِي نَاحِيَةِ بَيْتِي فِي تَابُوتِي لأَرْبَعِينَ أَلْفٍ وَافٍ وَلَقَدْ خَشِيتُ أَنْ تَكُونَ قَدْ عُجِّلَتْ لَنَا طَيِّبَاتُنَا فِي حَيَاتِنَا الدُّنْيَا ‘আমি যখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সঙ্গে ছিলাম, তখন আমি একটি দীনার বা দিরহামেরও মালিক ছিলাম না। আর এখন আমার সিন্দুকের কোণায় চল্লিশ হাযার দীনার জমা আছে। আমি ভয় পাচ্ছি আল্লাহ আমার সকল নেক আমলের ছওয়াব আমার জীবদ্দশায় আমার ঘরেই দিয়ে দেন কি-না!’। মৃত্যুর সময় তাকে পরিচর্যাকারী জনৈক সাথী বললেন,  أَبْشِرْ يَا أَبَا عَبْدِ اللهِ، فَإِنَّكَ مُلاَقٍ إِخْوَانَكَ غَدًا ‘হে আবু আব্দুল্লাহ! সুসংবাদ গ্রহণ করুন। কেননা কালই আপনি আপনার সাথীদের সঙ্গে মিলিত হবেন’। জবাবে তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলেন,  ذَكَّرتموني أقواماً، وإخواناً مَضَوْا بِأُجُورهم كُلِّهَا لَمْ يَنالُوا مِنَ الدُّنيا شَيْئًا ‘তোমরা আমাকে এমন ভাইদের কথা স্মরণ করিয়ে দিলে, যারা তাদের সম্পূর্ণ নেকী নিয়ে বিদায় হয়ে গেছেন। দুনিয়ার কিছুই তারা পাননি’। আর আমরা তাঁদের পরে বেঁচে আছি। অবশেষে দুনিয়ার অনেক কিছু পেয়েছি। অথচ তাঁদের জন্য আমরা মাটি ব্যতীত কিছুই পাইনি। এসময় তিনি তার বাড়ি এবং বাড়ির সম্পদ রাখার কক্ষের দিকে ইঙ্গিত করেন। তিনি বলেন, মদীনায় প্রথম দাঈ ও ওহোদ যুদ্ধের পতাকাবাহী মুছ‘আব বিন উমায়ের শহীদ হওয়ার পর কিছুই ছেড়ে যায়নি একটি চাদর ব্যতীত। অতঃপর তিনি তার কাফনের দিকে তাকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলেন, রাসূল (ছাঃ)-এর চাচা হামযার জন্য এতটুকু কাফনও জুটেনি। মাথা ঢাকলে পা ঢাকেনি। পা ঢাকলে মাথা ঢাকেনি। অতঃপর সেখানে ইযখির ঘাস দিয়ে ঢাকা হয়েছিল’।[৪]
[১]. বুখারী হা/৩৬১২, ৬৯৪৩; মিশকাত হা/৫৮৫৮ ‘ফাযায়েল ও শামায়েল’ অধ্যায়।
[২]. ইবনু হিশাম ১/৩৫৭; আহমাদ হা/২১১০৫, ২১১১২; সনদ ছহীহ -আরনাঊত্ব।
[৩]. ত্বাবারাণী কাবীর হা/৩৬১৮; মাজমা‘উয যাওয়ায়েদ হা/১৫৬৩২; আল-ইছাবাহ, খাববাব ক্রমিক ২২১২।
[৪]. ইবনু সা‘দ, ত্বাবাক্বাতুল কুবরা ৩/১২২-২৩; সীরাহ ছহীহাহ ২/৩৮৪।

উল্লেখ্য যে, ছাহাবীগণের উপর নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে ইবনু ইসহাক সাঈদ বিন জুবায়ের হতে বর্ণনা করেন যে, আমি আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ)-কে বললাম, মুশরিকরা কি ছাহাবীগণকে দ্বীন ত্যাগ করার শর্তে শাস্তি দিত? জবাবে তিনি বললেন, হ্যাঁ, আল্লাহর কসম! যখন তারা মুসলমানদের কাউকে মারপিট করত, তাদেরকে ক্ষুধার্ত রাখত ও পিপাসায় কাতর করে ফেলত এবং অবশেষে অবস্থা এমন হত যে, তারা উঠে বসার ক্ষমতা রাখত না। তখন তাদের বলা হত, আল্লাহকে ছেড়ে লাত-‘উযযাকে উপাস্য ধর। তারা না বললে আরও কঠিনভাবে অত্যাচার করা হত। ফলে তারা বলতেন, হ্যাঁ। এমনকি গোবরের বড় কালো পোকা তাদের কারু সামনে এনে বলা হত এই পোকা কি তোমার উপাস্য? কঠিন কষ্টের কারণে তিনি বলতেন, হ্যাঁ’ (ইবনু হিশাম ১/৩২০; ফাৎহুল বারী হা/৩৮৫৬-এর আলোচনা)। এ বক্তব্য যঈফ (মা শা-‘আ ৩৪ পৃঃ)। বরং সঠিক সেটাই যা ইবনু মাসঊদ (রাঃ) কর্তৃক ইতিপূর্বে বর্ণিত হয়েছে (আহমাদ হা/৩৮৩২)।

দুর্বল ছাহাবীদের প্রতি নির্দেশনা

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মদীনায় গিয়ে মক্কার দুর্বল ছাহাবীদের জন্য দো‘আ করতে থাকেন এবং তাদেরকে নির্দেশ দেন, যেন তারা ছবর করে’ (নিসা ৪/৭৭)। তারা যেন শক্তির বিপরীতে শক্তি প্রদর্শন না করে ও শত্রুতার বিপরীতে শত্রুতা না করে। যাতে তারা বেঁচে থাকে এবং ভবিষ্যতে দ্বীনের শক্তি বৃদ্ধি করতে পারে। অবশেষে আল্লাহ মক্কা বিজয় দান করেন এবং সবাইকে নিরাপদ ও নিশ্চিন্ত করেন (সীরাহ ছহীহাহ ১/১৫৮)।

নির্যাতিত মুহাজির মুসলমানদের সুসংবাদ দিয়ে আল্লাহ বলেন,

فَاسْتَجَابَ لَهُمْ رَبُّهُمْ أَنِّي لاَ أُضِيعُ عَمَلَ عَامِلٍ مِنْكُمْ مِنْ ذَكَرٍ أَوْ أُنْثَى بَعْضُكُمْ مِنْ بَعْضٍ فَالَّذِينَ هَاجَرُوا وَأُخْرِجُوا مِنْ دِيَارِهِمْ وَأُوذُوا فِي سَبِيلِي وَقَاتَلُوا وَقُتِلُوا لَأُكَفِّرَنَّ عَنْهُمْ سَيِّئَاتِهِمْ وَلَأُدْخِلَنَّهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ ثَوَابًا مِنْ عِنْدِ اللهِ وَاللهُ عِنْدَهُ حُسْنُ الثَّوَابِ- (آل عمران 195)-

‘অতঃপর তাদের প্রতিপালক তাদের দো‘আ কবুল করলেন এই মর্মে যে, পুরুষ হৌক বা নারী হৌক আমি তোমাদের কোন কর্মীর কর্মফল বিনষ্ট করব না। তোমরা পরস্পরে এক (অতএব কর্মফল প্রাপ্তিতে সবাই সমান)। অতঃপর যারা হিজরত করেছে ও নিজ বাড়ী থেকে বহিষ্কৃত হয়েছে এবং আমার রাস্তায় নির্যাতিত হয়েছে। যারা লড়াই করেছে ও নিহত হয়েছে, অবশ্যই আমি তাদের দোষ-ত্রুটিসমূহ মার্জনা করব এবং অবশ্যই আমি তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করাবো, যার তলদেশ দিয়ে নদীসমূহ প্রবাহিত। এটি আল্লাহর নিকট হতে প্রতিদান। বস্তুতঃ আল্লাহর নিকটেই রয়েছে সর্বোত্তম পুরস্কার’ (আলে ইমরান ৩/১৯৫)।




**********************************
সাইটটি ভিজিট করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আর্টিকেলটি ভাল লাগলে সত্য ও ন্যয়ের পথে অন্য ভাইনদেরকে দাওয়াতের নিয়তে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন। মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে এবং দীন ও মানবতার সেবায় অংশ নিতে OUR ACTION PLAN বাটনে ক্লিক করুন।


এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url