প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর জীবনী [পর্ব- ৩৯] || মহানবীর জীবনী ||




বনু মুছত্বালিক্ব পরবর্তী যুদ্ধসমূহ এবং হোদায়বিয়ার সন্ধি


[পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ট মহামানব আমাদের প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:)। যাকে আল্লাহ সমস্ত মানুষের জন্য অশেষ রহমত স্বরূপ এই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। যে নবী সারা জীবন উম্মতের জন্য সংগ্রাম করেছেন, কাল রোজ হাশরের মাঠেও যিনি উম্মতের জন্যই পেরেশান থাকবেন; সেই প্রাণপ্রিয় নবীকে আমরা কতটুকু চিনি কতটুকু জানি। প্রিয় নবী (সা:) এর জীবনের পরতে পরতে রয়েছে আমাদের জন্য শিক্ষা ও অনুপ্রেরণা। যার জীবনী পড়লে নিজের অজান্তেই চোখের পানি গড়িয়ে পড়ে। সেই নবীর জীবনী কি আমরা সত্যিই জানি? আসুন, আরেকবার দেখে নেই “প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর জীবনী”। যে জীবনী পড়ে বদলে যেতে পারে আপনার আমার জীবন। আল্লাহ আমাদের সবাইকে প্রাণপ্রিয় নবীর (সা:) উম্মত হিসাবে কবুল করুন। আমিন।।]

বনু মুছত্বালিক্ব পরবর্তী যুদ্ধ সমূহ

সারিইয়া আব্দুর রহমান বিন ‘আওফ

৬ষ্ঠ হিজরীর শা‘বান মাস। ‘দূমাতুল জান্দাল’(دُومةُ الْجَنْدل) এলাকায় বনু কলব খ্রিষ্টান গোত্রের বিরুদ্ধে এটি প্রেরিত হয় এবং সহজ বিজয় অর্জিত হয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিজ হাতে আব্দুর রহমানের মাথায় পাগড়ী বেঁধে দেন ও যুদ্ধে উত্তম পন্থা অবলম্বনের উপদেশ দেন। তিনি এখানে তিনদিন অবস্থান করে সবাইকে ইসলামের দাওয়াত দেন। ফলে খ্রিষ্টান গোত্রনেতাসহ সকলে মুসলমান হয়ে যায়।[1]

সারিইয়া আলী ইবনু আবী ত্বালিব

৬ষ্ঠ হিজরীর শা‘বান মাস। ২০০ জনের একটি সেনাদল নিয়ে আলী (রাঃ) খায়বরের ফাদাক অঞ্চলে বনু সা‘দ বিন বকর গোত্রের বিরুদ্ধে প্রেরিত হন, যারা ইহূদীদের সাহায্যার্থে প্রস্তুতি নিচ্ছিল। বনু সা‘দ পালিয়ে যায়। তাদের ফেলে যাওয়া ৫০০ উট ও ২০০০ ছাগল মুসলিম বাহিনীর হস্তগত হয়।[2]

সারিইয়া আবুবকর ছিদ্দীক

৬ষ্ঠ হিজরীর রামাযান মাস। ওয়াদিল ক্বোরা এলাকার বনু ফাযারাহ গোত্রের একটি শাখার নেত্রী উম্মে ক্বিরফা (أم قِرْفَة) ৩০ জন সশস্ত্র অশ্বারোহীকে প্রস্তুত করছিল। এ কথা জানতে পেরে হযরত আবুবকর অথবা যায়েদ বিন হারেছাহ (রাঃ)-এর নেতৃত্বে সেখানে একটি বাহিনী প্রেরিত হয়। উক্ত ৩০ জনের সবাই নিহত হয় এবং দলনেত্রীর কন্যা অন্যতম সেরা আরব সুন্দরীকে (مِنْ أَحْسَنِ الْعَرَبِ) দাসী হিসাবে মক্কায় পাঠিয়ে তার বিনিময়ে সেখান থেকে কয়েকজন মুসলিম বন্দীকে মুক্ত করা হয়।[3] কেউ এটিকে ৭ম হিজরীর ঘটনা বলেছেন’ (আর-রাহীক্ব পৃঃ ৩৩৫, টীকা-১)।

সারিইয়া কুরয বিন জাবের আল-ফিহরী

৬ষ্ঠ হিজরীর শাওয়াল মাস। উরাইনা গোত্রের প্রতি তিনি ২০ জন অশ্বারোহী সহ প্রেরিত হন। দলনেতা কুরয ছিলেন সেই কুরায়েশ নেতা, যিনি ২য় হিজরীর রবীউল আউয়াল মাসে সর্বপ্রথম মদীনার উপকণ্ঠে হামলা চালিয়ে বহু গবাদিপশু লুট করে নিয়ে যান এবং রাসূল (ছাঃ) স্বয়ং যার পশ্চাদ্ধাবন করে বদরের উপকণ্ঠে সাফওয়ান পর্যন্ত পৌঁছে যান (দ্রঃ গাযওয়া সাফওয়ান ক্রমিক সংখ্যা-৬)। পরে তিনি ইসলাম কবুল করেন এবং মক্কা বিজয়ের দিন শহীদ হন।

অত্র অভিযানের কারণ ছিল এই যে, ওক্ল ও উরাইনা(عُكْل وعُرَيْنة) গোত্রের আটজন লোক ইসলাম কবুল করে মদীনায় বসবাস করতে থাকে। কিন্তু তারা অসুস্থ হয়ে পড়ে। তখন তাদেরকে কিছু দূরে ছাদাক্বার উটসমূহের চারণক্ষেত্রে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে তাদেরকে উটের দুধ ও পেশাব পান করতে বলা হয়। এতে তারা দ্রুত সুস্থতা লাভ করে। কিন্তু একদিন তারা রাসূল (ছাঃ)-এর রাখালদের হত্যা করে উটগুলো সব নিজেদের এলাকায় খেদিয়ে নিয়ে যায় এবং পুনরায় কাফির হয়ে যায়। ফলে তাদের বিরুদ্ধে এই অভিযান প্রেরিত হয়।[4]

সেনাদল তাদের গ্রেফতার করেন এবং হাত-পা কেটে ও উত্তপ্ত লোহা দিয়ে চোখ অন্ধ করে ঘটনাস্থলের নিকটবর্তী ‘হাররাহ’ (حرَّة) নামক পাথুরে স্থানে ছেড়ে দেন। ফলে সেখানেই তারা মরে পড়ে থাকে’ (বুখারী হা/২৩৩, ১৫০১)।

ক্বাতাদাহ ইবনু সীরীন থেকে বর্ণনা করেন যে, এটি ছিল ‘দন্ডবিধিসমূহ’ নাযিল হওয়ার পূর্বেকার ঘটনা। উক্ত হাদীছের রাবী হযরত আনাস (রাঃ) বলেন, এরপর থেকে রাসূল (ছাঃ) ‘অঙ্গহানি নিষিদ্ধ করেন’(ثُمَّ نَهَى عَنِ الْمُثْلَةِ)।[5] আর এটি ছিল সূরা মায়েদাহ ৪৫ আয়াত নাযিলের অনুসরণে। ইমাম বুখারী (রহঃ) এদিকেই ঝুঁকেছেন (বুখারী, ফাৎহুল বারী হা/২৩৩-এর আলোচনা দ্রষ্টব্য)।

সারিইয়া ‘আমর বিন উমাইয়া যামরী

৬ষ্ঠ হিজরীর শাওয়াল মাস। সালামাহ বিন আবু সালামাহ সহ দুইজনের এই ক্ষুদ্র দলটি মক্কায় প্রেরিত হয় আবু সুফিয়ানকে গোপনে হত্যা করার জন্য। কেননা তিনি ইতিপূর্বে একজন বেদুঈনকে মদীনায় পাঠিয়েছিলেন রাসূল (ছাঃ)-কে হত্যা করার জন্য। কিন্তু কারু কোন অভিযানই সফল হয়নি।[6]

সারিইয়া আবু ওবায়দাহ ইবনুল জাররাহ

৬ষ্ঠ হিজরীর যুলক্বা‘দাহ মাস। এটাই ছিল হোদায়বিয়া সন্ধির পূর্ব পর্যন্ত কুরায়েশ কাফেলা সমূহের বিরুদ্ধে মুসলমানদের সর্বশেষ অভিযান। আবু ওবায়দাহ (রাঃ)-এর নেতৃত্বে ৩০০ অশ্বারোহীর এ দলটি প্রেরিত হয় একটি কুরায়েশ বাণিজ্য কাফেলা আটকানোর জন্য। অভিযানে কোন ফল হয়নি। কিন্তু সেনাদল দারুণ অন্নকষ্টে পতিত হন। ফলে তাদের গাছের ছাল-পাতা খেয়ে জীবন ধারণ করতে হয়। সেকারণ এই অভিযানجَيْشُ الْخَبَط বা ‘ছাল-পাতার অভিযান’ নামে আখ্যায়িত হয়। এই সময় সমুদ্র হ’তে একটি বিশালাকারের মাছ কিনারে নিক্ষিপ্ত হয়। যাকে আম্বর (الْعَنْبَرُ) বলা হয়। বাংলাতে যা ‘তিমি মাছ’ বলে পরিচিত। এই মাছ তারা ১৫ দিন যাবৎ ভক্ষণ করেন। এই মাছ এত বড় ছিল যে, সেনাপতির হুকুমে তার দলের মধ্যকার সবচেয়ে দীর্ঘকায় ব্যক্তিটি সবচেয়ে উঁচু উটটির পিঠে বসে মাছের একটি কাঁটার ঘেরের মধ্য দিয়ে অনায়াসে চলে যায়। বিশেষভাবে সংরক্ষণ করে উক্ত মাছের কিছু অংশ মদীনায় আনা হয় এবং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে ‘হাদিয়া’ প্রদান করা হয়। তিনি বলেন,هُوَ رِزْقٌ أَخْرَجَهُ اللهُ لَكُمْ ‘এটি রূযী, যা আল্লাহ তোমাদের জন্য (সাগর থেকে) বের করে দিয়েছিলেন’।[7]

স্থানটি বর্তমানে বদর থেকে জেদ্দা অভিমুখে ২৫ কি. মি. যাওয়ার পর ডানদিকে ১০ কি. মি. দূরে আর-রাইস (الرَّايِس) নামে পরিচিত। যা লোহিত সাগরের তীরে অবস্থিত ছোট্ট শহর। মুসলিম পর্যটকরা এখানে এসে সমুদ্রের মাছ কিনে তা ভেজে নিয়ে সাগরপাড়ে বসে খেয়ে থাকেন বরকতময় বিগত স্মৃতি ধারণ করে।

[1]. যাদুল মা‘আদ ৩/২৫৪; ইবনু হিশাম ২/৬৩১; আর-রাহীক্ব ৩৩৪ পৃঃ।
[2]. যাদুল মা‘আদ ৩/২৪৯; ইবনু সা‘দ ২/৬৯; আর-রাহীক্ব ৩৩৪ পৃঃ।
[3]. যাদুল মা‘আদ ৩/৩১৮; ইবনু সা‘দ ৪/২২০; আর-রাহীক্ব ৩৩৪ পৃঃ; মুসলিম হা/১৭৫৫ (৪৬)।

মুবারকপুরী কোনরূপ সূত্র ছাড়াই এখানে রাসূল (ছাঃ)-কে গোপন হত্যার ষড়যন্ত্রের কথা বর্ণনা করেছেন (আর-রাহীক্ব ৩৩৪ পৃঃ)। ইবনু হিশামসহ অন্য কোন জীবনীকার এটি বর্ণনা করেননি বা কোন হাদীছেও এরূপ কথা বর্ণিত হয়নি।

[4]. যাদুল মা‘আদ ৩/২৫৪; ইবনু সা‘দ ২/৭১।
[5]. আবু দাঊদ হা/৪৩৬৮ ‘দন্ডবিধিসমূহ’ অধ্যায় ৩ অনুচ্ছেদ ।
[6]. ইবনু হিশাম ২/৬৩৩; আর-রাহীক্ব ৩৩৫ পৃঃ।
[7]. যাদুল মা‘আদ ৩/৩৪৪; ইবনু সা‘দ ৩/৩১৩-১৪; বুখারী হা/৪৩৬১; মুসলিম হা/১৯৩৫; মিশকাত হা/৪১১৪ ‘শিকার ও যবহ’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-২।

মুবারকপুরী বলেন, চরিতকারগণ এটিকে ৮ম হিজরীর রজব মাসের ঘটনা বলে থাকেন। কিন্তু পূর্বাপর সম্পর্ক (السِّيَاق) বিবেচনায় দেখা যায় যে, এটি হোদায়বিয়ার পূর্বের ঘটনা। কেননা ৬ষ্ঠ হিজরীর যুলক্বা‘দাহ মাসে হোদায়বিয়ার সন্ধি হওয়ার পরে কুরায়েশ কাফেলার উপর হামলা করার জন্য আর কোন মুসলিম বাহিনী প্রেরিত হয়নি’ (আর-রাহীক্ব ৩২৪ পৃঃ)।
 হোদায়বিয়ার সন্ধি (صلح الحديبية) (৬ষ্ঠ হিজরীর যুলক্বা‘দাহ মাস)
হোদায়বিয়ার সন্ধিকে ‘গাযওয়া’ বা যুদ্ধ(غزوة الحديبية) বলা হয় এ কারণে যে, কুরায়েশরা রাসূল (ছাঃ)-কে এখানে ওমরার জন্য মক্কায় প্রবেশে বাধা দিয়েছিল’ (সীরাহ ছহীহাহ ২/৪৩৪)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ১লা যুলক্বা‘দাহ সোমবার স্ত্রী উম্মে সালামাহ সহ ১৪০০ (মতান্তরে ১৫০০) সাথী নিয়ে ওমরাহর উদ্দেশ্যে মদীনা হ’তে মক্কা অভিমুখে রওয়ানা হন। এই সময় কোষবদ্ধ তরবারি ব্যতীত তাদের সাথে অন্য কোন অস্ত্র ছিল না। কিন্তু মক্কার অদূরে হোদায়বিয়া নামক স্থানে পৌঁছলে তাঁরা কুরায়েশ নেতাদের বাধার সম্মুখীন হন। অবশেষে তাদের সঙ্গে দশ বছরের জন্য শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ফলে চুক্তির শর্তানুযায়ী তিনি মদীনায় ফিরে আসেন এবং পরের বছর ওমরা করেন। বিস্তারিত নিম্নরূপ।-

‘হোদায়বিয়া’ (الْحُدَيْبِيَة) একটি কূয়ার নাম। যা মক্কা থেকে উত্তর-পশ্চিমে ২২ কি.মি. দূরে অবস্থিত। এটি বর্তমানে ‘শুমাইসী’ (الشُمَيْسِى) নামে পরিচিত। এখানে হোদায়বিয়ার বাগিচাসমূহ এবং ‘রিযওয়ান মসজিদ’(مسجد الرِضْوَان) অবস্থিত।

খন্দকের যুদ্ধে ভূমিধস বিজয়ের পরেও কুরায়েশদের শত্রুতা থেকে রাসূল (ছাঃ) নিশ্চিন্ত ছিলেন না। সেকারণ অধিক সংখ্যক ছাহাবী নিয়ে তিনি ওমরায় এসেছিলেন এবং সাথে অস্ত্রও ছিল। ফলে যুদ্ধ হবে মনে করে দুর্বলচেতা ও বেদুঈন মুসলমানরা বিভিন্ন অজুহাত দিয়ে সরে পড়ে। এ বিষয়ে আল্লাহ বলেন,

سَيَقُولُ لَكَ الْمُخَلَّفُونَ مِنَ الْأَعْرَابِ شَغَلَتْنَا أَمْوَالُنَا وَأَهْلُونَا فَاسْتَغْفِرْ لَنَا يَقُولُونَ بِأَلْسِنَتِهِمْ مَا لَيْسَ فِي قُلُوبِهِمْ قُلْ فَمَنْ يَمْلِكُ لَكُمْ مِنَ اللهِ شَيْئًا إِنْ أَرَادَ بِكُمْ ضَرًّا أَوْ أَرَادَ بِكُمْ نَفْعًا بَلْ كَانَ اللهُ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرًا- بَلْ ظَنَنْتُمْ أَنْ لَنْ يَنْقَلِبَ الرَّسُولُ وَالْمُؤْمِنُونَ إِلَى أَهْلِيهِمْ أَبَدًا وَزُيِّنَ ذَلِكَ فِي قُلُوبِكُمْ وَظَنَنْتُمْ ظَنَّ السَّوْءِ وَكُنْتُمْ قَوْمًا بُورًا- (الفتح 11-12)-

‘পিছনে পড়ে থাকা বেদুঈনরা সত্বর তোমাকে বলবে, আমাদের মাল-সম্পদ ও পরিবার আমাদেরকে ব্যস্ত রেখেছিল। অতএব আপনি আমাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন। তারা মুখে একথা বলবে, যা তাদের অন্তরে নেই। বল, আল্লাহ তোমাদের কোন ক্ষতি বা উপকার করতে চাইলে কে তাকে বিরত রাখতে পারে? বরং তোমরা যা কিছু কর সবই আল্লাহ খবর রাখেন’। ‘বরং তোমরা ধারণা করেছিলে যে, রাসূল ও মুমিনগণ তাদের পরিবারের কাছে আর কখনই ফিরে আসতে পারবে না এবং এই ধারণা তোমাদের অন্তরগুলিকে সুশোভিত করে রেখেছিল। আর তোমরা মন্দ ধারণা করেছিলে। বস্ত্ততঃ তোমরা ছিলে ধ্বংসমুখী এক সম্প্রদায়’ (ফাৎহ ৪৮/১১-১২)। এখানে বেদুঈন (الْأَعْرَابُ) বলতে মদীনার জুহাইনা ও মুযাইনা গোত্র দ্বয়কে বুঝানো হয়েছে (তাফসীর ত্বাবারী)।

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে এক রাতে স্বপ্ন দেখানো হ’ল যে, তিনি স্বীয় ছাহাবীদের সাথে নিয়ে মাসজিদুল হারামে প্রবেশ করছেন এবং ওমরাহ করছেন। যেমন আল্লাহ বলেন,لَقَدْ صَدَقَ اللهُ رَسُولَهُ الرُّؤْيَا بِالْحَقِّ لَتَدْخُلُنَّ الْمَسْجِدَ الْحَرَامَ إِنْ شَاءَ اللهُ آمِنِينَ مُحَلِّقِينَ رُءُوسَكُمْ وَمُقَصِّرِينَ لاَ تَخَافُونَ فَعَلِمَ مَا لَمْ تَعْلَمُوا فَجَعَلَ مِنْ دُونِ ذَلِكَ فَتْحًا قَرِيبًا ‘আল্লাহ তাঁর রাসূলকে সত্য স্বপ্ন দেখিয়েছেন। আল্লাহ চাহেন তো তোমরা অবশ্যই মাসজিদুল হারামে প্রবেশ করবে নিরাপদে মস্তক মুন্ডিত অবস্থায় এবং কেশ কর্তিত অবস্থায়। এমনভাবে যে, তোমরা কাউকে ভয় করবে না। অতঃপর তিনি জানেন, যা তোমরা জানো না। অতঃপর তিনি তোমাদেরকে একটি নিকটবর্তী বিজয় দান করবেন’ (ফাৎহ ৪৮/২৭)। অর্থাৎ তোমাদেরকে মক্কায় প্রবেশ না করিয়ে হোদায়বিয়া থেকে ফেরৎ আনার মধ্যে তোমাদের জন্য কি কল্যাণ নিহিত থাকবে, তা তোমরা জানো না। অতঃপর সেই প্রত্যাবর্তনের বিনিময়ে তোমাদেরকে তিনি দান করবেন একটি ‘নিকটবর্তী বিজয়’। অর্থাৎ হোদায়বিয়ার সন্ধি। অতঃপর সেখান থেকে ফিরেই হবে খায়বর বিজয় ও বিপুল গণীমত লাভ।

এ স্বপ্ন দেখার পরে তিনি ওমরাহ করার সিদ্ধান্ত নেন এবং ছাহাবীদের প্রস্ত্তত হ’তে বলেন। ইতিপূর্বে খন্দক যুদ্ধে বিজয় লাভের পর সমগ্র আরবে মুসলিম শক্তিকে অপ্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি হিসাবে গণ্য করা হ’তে থাকে। তাই রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কিছুটা স্বস্তির মধ্যে ছিলেন।

ওমরার উদ্দেশ্যে রওয়ানা

৬ষ্ঠ হিজরীর ১লা যুলক্বা‘দাহ সোমবার তিনি ১৪০০ (মতান্তরে ১৫০০) সাথী নিয়ে মদীনা হ’তে রওয়ানা হন (বুখারী হা/৪১৫৩)। লটারিতে এবার তাঁর সফরসঙ্গী হন উম্মুল মুমেনীন হযরত উম্মে সালামাহ (রাঃ)। ওমরাহর সফরে নিয়মানুযায়ী কোষবদ্ধ তরবারি এবং মুসাফিরের হালকা অস্ত্র ব্যতীত অন্য কোন অস্ত্র তাঁদের নিকটে রইল না। অতঃপর মদীনা থেকে অনতিদূরে যুল-হুলায়ফা পৌঁছে তাঁরা ওমরাহর ইহরাম বাঁধেন। অতঃপর ৭০টি উটের গলায় হার পরালেন এবং উটের পিঠের কুঁজের উপরে সামান্য কেটে রক্তপাত করে কুরবানীর জন্য চিহ্নিত করলেন। আবু ক্বাতাদাহ আনছারী (রাঃ)-সহ অনেক ছাহাবী মুহরিম ছিলেন না। মুসলমানদের মিত্র বনু খোযা‘আ গোত্রের বিশর বিন সুফিয়ান আল-কা‘বী(بِشْرُ بْنُ سُفْيَانَ الْكَعْبِيُّ) কে গোয়েন্দা হিসাবে রাসূল (ছাঃ) আগেই মক্কায় পাঠিয়েছিলেন কুরায়েশদের গতিবিধি জানার জন্য। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) মক্কা থেকে ৮০ কি. মি. দূরে ‘ওসফান’ (عُسفان) পৌঁছলে উক্ত গোয়েন্দা এসে রাসূল (ছাঃ)-কে খবর দেন যে, কুরায়েশরা ওমরাহতে বাধা দেওয়ার জন্য যুদ্ধের প্রস্ত্ততি নিয়েছে। এজন্য তারা তাদের মিত্র বেদুঈন গোত্র সমূহকে সংঘবদ্ধ করেছে। তারা আপনার সফরের কথা শুনেছে এবং যুদ্ধ সাজে সজ্জিত অবস্থায় যু-তুওয়া(ذو طُوَي)তে পৌঁছে গেছে। তারা আল্লাহর নামে কসম করেছে যে, আপনি কখনোই মক্কায় প্রবেশ করতে পারবেন না। অন্যদিকে খালেদ বিন অলীদ তার অশ্বারোহী বাহিনী নিয়ে মক্কা থেকে ৬৪ কি. মি. দূরে কুরাউল গামীমে পৌঁছে গেছে। তখন রাসূল (ছাঃ) বললেন,

يَا وَيْحَ قُرَيْشٍ لَقَدْ أَكَلَتْهُمُ الْحَرْبُ مَاذَا عَلَيْهِمْ لَوْ خَلَّوْا بَيْنِى وَبَيْنَ سَائِرِ النَّاسِ فَإِنْ أَصَابُونِى كَانَ الَّذِى أَرَادُوا وَإِنْ أَظْهَرَنِى اللهُ عَلَيْهِمْ دَخَلُوا فِى الإِسْلاَمِ وَهُمْ وَافِرُونَ وَإِنْ لَمْ يَفْعَلُوا قَاتَلُوا وَبِهِمْ قُوَّةٌ فَمَاذَا تَظُنُّ قُرَيْشٌ وَاللهِ لاَ أَزَالُ أُجَاهِدُهُمْ عَلَى الَّذِى بَعَثَنِى اللهُ لَهُ حَتَّى يُظْهِرَهُ اللهُ أَوْ تَنْفَرِدَ هَذِهِ السَّالِفَةُ- رواه احمد-

‘হায় দুর্ভোগ কুরায়েশদের জন্য! যুদ্ধ তাদের খেয়ে ফেলেছে। যদি তারা আমার ও অন্যদের মধ্য থেকে সরে দাঁড়াত, তাহ’লে তাদের কি সমস্যা ছিল? যদি তারা আমার ক্ষতি সাধন করতে পারে, তবে সেটি তাদের আশানুরূপ হবে। আর যদি আল্লাহ আমাকে তাদের উপর বিজয়ী করেন, তাহ’লে তারা ইসলামে প্রবেশ করবে পুরোপুরি লাভবান অবস্থায়। আর যদি ইসলাম কবুল না করে, তাহ’লে তারা যুদ্ধ চালিয়ে যাবে যতক্ষণ তাদের শক্তি থাকবে। সুতরাং কুরায়েশরা কী ধারণা করে? আল্লাহর কসম! আমি তাদের বিরুদ্ধে সেই দ্বীনের উপর যুদ্ধ চালিয়ে যাব, যার জন্য আল্লাহ আমাকে পাঠিয়েছেন। যতক্ষণ না আল্লাহ তাকে বিজয়ী করেন অথবা এই ক্ষুদ্র দল নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়’।[1] রাসূল (ছাঃ)-এর উক্ত বক্তব্যে তাঁর শান্তিবাদী নীতি ফুটে উঠে।

[1]. আহমাদ হা/১৮৯৩০; আলবানী, ফিক্বহুস সীরাহ ৩১৮ পৃঃ, সনদ ছহীহ।

ওমরা নাকি আক্রমণ পরামর্শ বৈঠক

উক্ত গোয়েন্দা রিপোর্ট পাওয়ার পর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ছাহাবায়ে কেরামের সাথে পরামর্শ বৈঠকে বসলেন এবং বললেন,أَشِيرُوا أَيُّهَا النَّاسُ عَلَىَّ ‘হে লোকেরা! তোমরা আমাকে পরামর্শ দাও!’ অতঃপর তিনি তাদের নিকট দু’টি বিষয়ে মতামত চাইলেন। এক- কুরাইশের সাহায্যকারী গোত্রগুলির উপরে হামলা চালিয়ে তাদেরকে পরাভূত করা। অথবা দুই- আমরা ওমরাহ পালনের উদ্দেশ্যে যাত্রা অব্যাহত রাখব এবং পথে কেউ বাধা দিলে মুকাবিলা করব। আবুবকর (রাঃ) শেষোক্ত প্রস্তাবের পক্ষে মত প্রকাশ করলেন। অতঃপর তিনি বললেন,امْضُوا عَلَى اسْمِ اللهِ ‘তোমরা আল্লাহর নামে যাত্রা কর’ (বুখারী হা/৪১৭৮-৭৯)। অতঃপর মক্কা অভিমুখে যাত্রা শুরু হ’ল।

খালেদের অপকৌশল

কিছুদূর অগ্রসর হ’তেই জানা গেল যে, মক্কার মহা সড়কে ‘কোরাউল গামীম’(كُرَاعُ الْغَمِيمِ) নামক স্থানে খালেদ বিন অলীদ ২০০ অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে প্রস্ত্তত হয়ে আছেন মুসলিম কাফেলার উপরে হামলা করার জন্য। যেখান থেকে উভয় দল পরস্পরকে দেখতে পাচ্ছিল। দূর থেকে মুসলমানদের যোহরের ছালাত আদায়ের দৃশ্য অবলোকন করে তারা উপলব্ধি করে যে, মুসলমানেরা ছালাত আদায় কালে দুনিয়া ভুলে যায় ও আখেরাতের চিন্তায় ব্যাকুল হয়ে পড়ে। তারা ভাবল, এই সুযোগে মুসলিম কাফেলার উপরে হামলা চালিয়ে তাদেরকে নিশ্চিহ্ন করা যাবে। আল্লাহ পাক তাদের এ চক্রান্ত নস্যাৎ করে দেবার জন্য তাঁর রাসূল-এর উপর এ সময় ছালাতুল খাওফের বিধান নাযিল করলেন (নিসা ৪/১০১-১০২)। ফলে আছরের ছালাতের সময় একদল যখন ছালাত আদায় করলেন, অপরদল তখন সতর্ক পাহারায় রইলেন (আবুদাঊদ হা/১২৩৬, সনদ ছহীহ)। এতে খালেদের পরিকল্পনা ভন্ডুল হয়ে গেল।

হোদায়বিয়ায় অবতরণ ও পানির সংকট

মিসওয়ার বিন মাখরামাহ (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) যুদ্ধ এড়ানোর জন্য মহাসড়ক ছেড়ে ডান দিকে পাহাড়ী পথ ধরে অগ্রসর হ’তে থাকেন এবং মক্কার নিম্নাঞ্চলে হোদায়বিয়ার শেষ প্রান্তে একটি ঝর্ণার নিকটে গিয়ে অবতরণ করেন। ঐ সময় রাসূল (ছাঃ)-এর উষ্ট্রী ‘ক্বাছওয়া’ বসে পড়ে। লোকেরা বলল, ক্বাছওয়া নাখোশ হয়েছে(خَلَأَتِ الْقَصْوَاءُ)। উত্তরে রাসূল (ছাঃ) বললেন,مَا خَلَأَتِ الْقَصْوَاءُ وَمَا ذَاكَ لَهَا بِخُلُقٍ وَلَكِنْ حَبَسَهَا حَابِسُ الْفِيلِ ‘ক্বাছওয়া নাখোশ হয়নি, আর এটা তার চরিত্রে নেই। কিন্তু তাকে আটকে দিয়েছেন সেই সত্তা যিনি (আবরাহার) হস্তীকে (কা‘বায় হামলা করা থেকে) আটকিয়েছিলেন’। তৃষ্ণার্ত সাথীদের পানির সমস্যা সমাধানে উক্ত ঝর্ণা অতি অল্প সময়ের মধ্যেই ব্যর্থ হয়ে গেল। ফলে সবাই রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে পানির আবেদন করল। তখন তিনি নিজের শরাধার থেকে একটি তীর বের করে তাদের হাতে দিলেন এবং সেটাকে ঝর্ণায় নিক্ষেপ করার জন্য বললেন। ‘অতঃপর আল্লাহর কসম! ঝর্ণায় অতক্ষণ পর্যন্ত পানি জোশ মারতে থাকল, যতক্ষণ না তারা পরিতৃপ্ত হ’লেন এবং সেখান থেকে (মদীনায়) ফিরে গেলেন’।[1] জাবের ও বারা বিন আযেব (রাঃ)-এর বর্ণনায় এসেছে, তিনি একটি পানির পাত্র চাইলেন। অতঃপর তা থেকে ওযূ করলেন। অতঃপর অবশিষ্ট পানি কূয়ায় ফেলতে বললেন। অতঃপর সেখান থেকে ঝর্ণাধারার ন্যায় পানি প্রবাহিত হ’তে থাকল’।[2] বস্ত্ততঃ এটি ছিল রাসূল (ছাঃ)-এর অন্যতম মু‘জেযা।

[1]. বুখারী হা/২৭৩২; মিশকাত হা/৪০৪২ ‘জিহাদ’ অধ্যায়-১৯, ‘সন্ধি’ অনুচ্ছেদ-৯; ইবনু কাছীর হাদীছটি সূরা ফাৎহ ২৬ আয়াত ও সূরা ফীল-এর তাফসীরে উদ্ধৃত করেছেন।
[2]. বুখারী হা/৩৫৭৬, ৪১৫০; মিশকাত হা/৫৮৮২-৮৩ ‘ফাযায়েল ও শামায়েল’ অধ্যায়-২৯, ‘মু‘জিযা সমূহ’ অনুচ্ছেদ-৭।

ওমরাহর বিষয়ে মধ্যস্থতা বৈঠক

হোদায়বিয়ায় অবতরণের কিছু পরে মুসলমানদের মিত্র বনু খোযা‘আহর নেতা বুদাইল বিন অরক্বা(بُدَيلُ بنُ وَرْقَاءَ) কিছু লোক সহ উপস্থিত হ’লেন। তিনি এসে খবর দিলেন যে, কুরায়েশ নেতা কা‘ব ও ‘আমের বিন লুওয়াই সৈন্য-সামন্ত এমনকি নারী-শিশু নিয়ে হোদায়বিয়ার পর্যাপ্ত পানিপূর্ণ ঝর্ণার ধারে শিবির স্থাপন করেছে, আপনাদের বাধা দেওয়ার জন্য ও প্রয়োজনে যুদ্ধ করার জন্য। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, তুমি তাদেরকে গিয়ে বল যে,إِنَّا لَمْ نَجِئْ لِقِتَالِ أَحَدٍ، وَلَكِنَّا جِئْنَا مُعْتَمِرِينَ ‘আমরা কারু সঙ্গে যুদ্ধ করতে আসিনি। বরং আমরা এসেছি কেবল ওমরাহ করার জন্য’। তিনি বললেন, কুরায়েশরা ইতিপূর্বে যুদ্ধ করেছে এবং তারা পর্যুদস্ত হয়েছে। তারা চাইলে আমি তাদের জন্য একটা সময় বেঁধে দেব, সে সময়ে তারা সরে দাঁড়াবে (এবং আমরা ওমরাহ করে নেব)। এরপরেও তারা যদি না মানে এবং কেবল যুদ্ধই তাদের কাম্য হয়, তাহ’লে যার হাতে আমার জীবন তার কসম করে বলছি, আমি অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে এই দ্বীনের জন্য যুদ্ধ করব যতক্ষণ না আমার আত্মা বিচ্ছিন্ন হয় অথবা আল্লাহ স্বীয় দ্বীনের ব্যাপারে একটা ফায়ছালা করে দেন’।

অতঃপর বুদাইল কুরায়েশ নেতাদের কাছে গেলেন। তরুণরা তার কোন কথা শুনতে চাইল না। জ্ঞানীরা শুনতে চাইলেন। তখন তিনি রাসূল (ছাঃ)-এর বক্তব্য যথাযথভাবে বিবৃত করলেন।

ফলে সেখানে উপস্থিত উরওয়া বিন মাসঊদ ছাক্বাফী বলে উঠলেন, আমাকে একবার তার কাছে যেতে দাও’। অতঃপর নেতাদের অনুমতি নিয়ে তিনি রাসূল (ছাঃ)-এর দরবারে উপস্থিত হ’লেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে সেসব কথাই বললেন, যা তিনি ইতিপূর্বে বুদাইলকে বলেছিলেন। জবাবে উরওয়া বললেন, ‘হে মুহাম্মাদ! যদি তুমি নিজ সম্প্রদায়কে নিশ্চিহ্ন করে দাও, তবে ইতিপূর্বে কোন আরব এরূপ করেনি। আর যদি বিপরীতটা হয়, (অর্থাৎ তুমি পরাজিত হও) তবে আল্লাহর কসম! তোমার পাশে এমন কিছু নিকৃষ্ট লোককে দেখছি, যারা তোমার থেকে পালিয়ে যাবে অথবা ছেড়ে যাবে’। তার এ মন্তব্য শুনে ঠান্ডা মেযাজের মানুষ আবুবকর (রাঃ) রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে বলে উঠলেন,امْصُصْ بَظْرَ اللاَّتِ، أَنَحْنُ نَفِرُّ عَنْهُ وَنَدَعُهُ؟ ‘লাতের গুপ্তাঙ্গের ঝুলন্ত চর্ম চুষতে থাক! আমরা রাসূলকে রেখে পালিয়ে যাব ও তাঁকে ছেড়ে যাব’?

এরপর উরওয়া রাসূল (ছাঃ)-এর সঙ্গে কথাবার্তা চালিয়ে যেতে থাকেন। কথার ফাঁকে ফাঁকে তিনি বারবার রাসূল (ছাঃ)-এর দাড়িতে হাত দিচ্ছিলেন। ওদিকে পাশে দাঁড়ানো মুগীরা বিন শো‘বা (রাঃ) নিজ তরবারির বাঁটে হাত দিচ্ছিলেন ও উরওয়াকে ধমক দিয়ে বলছিলেন,أَخِّرْ يَدَكَ عَنْ لِحْيَةِ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ‘তোমার হাতকে রাসূল (ছাঃ)-এর দাড়ি থেকে দূরে রাখ’। এভাবে উরওয়া রাসূল (ছাঃ)-এর প্রতি ছাহাবীগণের ভালাবাসার নমুনা সমূহ প্রত্যক্ষ করলেন। উল্লেখ্য যে, মুগীরা ছিলেন উরওয়ার ভাতিজা।

আলোচনা শেষে উরওয়া কুরায়েশদের নিকটে ফিরে গিয়ে বললেন,أَىْ قَوْمِ، وَاللهِ لَقَدْ وَفَدْتُ عَلَى الْمُلُوكِ، وَوَفَدْتُ عَلَى قَيْصَرَ وَكِسْرَى وَالنَّجَاشِىِّ وَاللهِ إِنْ رَأَيْتُ مَلِكًا قَطُّ يُعَظِّمُهُ أَصْحَابُهُ مَا يُعَظِّمُ أَصْحَابُ مُحَمَّدٍ مُحَمَّدًا‘হে আমার কওম! আল্লাহর কসম! আমি ক্বায়ছার, কিসরা, নাজাশী প্রমুখ সম্রাটদের দরবারে প্রতিনিধি হিসাবে গিয়েছি। কিন্তু কোন সম্রাট-এর প্রতি তার সহচরদের এমন সম্মান করতে দেখিনি, যেমনটি দেখেছি মুহাম্মাদের প্রতি তার সাথীদের সম্মান করতে’। অতঃপর তিনি রাসূল (ছাঃ)-এর ছাহাবীদের সম্মান প্রদর্শনের এবং ভক্তি-শ্রদ্ধার কতগুলি উদাহরণ পেশ করে বলেন, আল্লাহর কসম! তারা তাঁর থুথু হাতে ধরে মুখে ও গায়ে মেখে নেয়। তার ওযূর ব্যবহৃত পানি ধরার জন্য প্রতিযোগিতা করে। তার নির্দেশ পালনের জন্য সদা প্রস্ত্তত থাকে। তাঁর সাথে কথা বলার সময় সকলের কণ্ঠস্বর নীচু হয়ে যায়। অধিক সম্মান প্রদর্শনের কারণে তাঁর প্রতি কেউ পূর্ণভাবে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে না’। তিনি বললেন,وَإِنَّهُ قَدْ عَرَضَ عَلَيْكُمْ خُطَّةَ رُشْدٍ، فَاقْبَلُوهَا ‘এই লোকটি (মুহাম্মাদ) তোমাদের নিকটে একটা ভাল প্রস্তাব পাঠিয়েছেন। তোমরা সেটা কবুল করে নাও’ (বুখারী হা/২৭৩১)।

ছহীহ বুখারীতে বর্ণিত উক্ত হাদীছের ব্যাখ্যায় ভাষ্যকার আহমাদ ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ) বলেন যে, উরওয়ার উপস্থিতিতে ছাহাবীগণ ভক্তির এই বাড়াবাড়ি প্রদর্শন করেছিলেন, তাকে বাস্তবে একথা বুঝিয়ে দেবার জন্য যে, যারা তাদের নেতার ভালোবাসায় এতদূর করতে পারে ও এতবড় সম্মান ও ভক্তি দেখাতে পারে, তাদের সম্পর্কে উরওয়া কিভাবে ধারণা করতে পারেন যে, কুরায়েশদের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত হলে তারা রাসূলকে ছেড়ে পালিয়ে যাবে ও তাঁকে শত্রুদের হাতে সমর্পণ করবে? বরং বিভিন্ন গোত্রীয় যুদ্ধে স্রেফ গোত্রীয় স্বার্থের চাইতে তারা আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) ও তাঁর দ্বীনের প্রতি সাহায্যের ক্ষেত্রে সবচাইতে অগ্রণী ও আপোষহীন। ইবনু হাজার বলেন, এই ঘটনায় বুঝা যায় যে, বৈধ উদ্দেশ্য হাছিলের জন্য যেকোন বৈধ পন্থা অবলম্বন করা যায়’।[1] বস্ত্ততঃ এই ধরনের বাড়াবাড়ি আচরণের ঘটনা অন্য সময়ে দেখা যায়নি।

উরওয়া বিন মাসঊদ-এর রিপোর্ট পাওয়ার পর সেখানে উপস্থিত কুরায়েশ মিত্র বনু কেনানা গোত্রের বেদুঈন নেতা হুলাইস বিন আলক্বামা(حُلَيسُ بنُ عَلْقَمةَ) বললেন, আমাকে একবার যেতে দিন! অতঃপর নেতাদের অনুমতি নিয়ে তিনি গেলেন। দূর থেকে তাকে দেখে রাসূল (ছাঃ) মন্তব্য করলেন,هُوَ مِنْ قَوْمٍ يُعَظِّمُونَ الْبُدْنَ ‘এ ব্যক্তি এমন একটি গোত্রের, যারা কুরবানীর পশুকে সম্মান করে’। অতএব তোমরা পশুগুলিকে দাঁড় করিয়ে দাও। কাছে এলে লোকটি কুরবানীর পশুসমূহ দেখে খুশীতে বলে উঠলো,سُبْحَانَ اللهِ مَا يَنْبَغِي لِهَؤُلاَءِ أَنْ يُصَدُّوا عَنِ الْبَيْتِ ‘সুবহানাল্লাহ! এইসব লোককে আল্লাহর ঘর থেকে বিরত রাখা উচিত নয়’। কথা বলেই লোকটি ফিরে গেল এবং কুরায়েশদের নিকটে তার উত্তম মতামত পেশ করল’ (বুখারী হা/২৭৩১)। কিন্তু নেতারা বললেন,اجْلِسْ فَإِنَّمَا أَنْتَ أَعْرَابِىٌّ لاَ عِلْمَ لَكَ ‘তুমি বস! তুমি একজন বেদুঈন মাত্র। তোমার কোন জ্ঞান নেই’ (আহমাদ হা/১৮৯৩০, সনদ হাসান)।

এরপর নেতারা মিকরায বিন হাফছ(مِكْرَزُ بنُ حَفْصٍ) কে পাঠালেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে দূর থেকে দেখেই মন্তব্য করলেন,هَذَا مِكْرَزٌ وَهْوَ رَجُلٌ فَاجِرٌ ‘লোকটি মিকরায। সে একজন দুষ্টু লোক’। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) তাকে সেসব কথাই বললেন, যা ইতিপূর্বে বুদাইল ও তার সাথীদের বলেছিলেন।

মিকরায কথা বলছেন। এমতাবস্থায় সুহায়েল বিন আমর(سُهَيلُ بنُ عَمْرو) এসে উপস্থিত হন। তাকে দেখে রাসূল (ছাঃ) মন্তব্য করলেন,قَدْ سَهَّلَ اللهُ لَكُمْ أَمْرَكُمْ ‘নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের বিষয়টি সহজ করে দিবেন’।[2] অতঃপর সুহায়েল ও রাসূল (ছাঃ)-এর মধ্যে দীর্ঘ সময় ধরে আলোচনা হয়। অবশেষে তাঁরা একটি আপোষ প্রস্তাবে সম্মত হন। যা ‘হোদায়বিয়ার সন্ধি’ নামে পরিচিত।

[1]. ফাৎহুল বারী ৫/৪০২, হা/২৭৩১-৩৩-এর ব্যাখ্যা, ‘শর্ত সমূহ’ অধ্যায়-৫৪, ‘যুদ্ধকারীদের সাথে সন্ধি ও শর্ত সমূহ’ অনুচ্ছেদ-১৫।
[2]. বুখারী হা/২৭৩১; ছহীহ ইবনু হিববান হা/৪৮৭২।

হোদায়বিয়ার সন্ধি ও তার দফা সমূহ

১। মুহাম্মাদ এ বছর মক্কায় প্রবেশ না করেই সঙ্গী-সাথীসহ মদীনায় ফিরে যাবেন। আগামী বছর ওমরাহ করবেন এবং মক্কায় তিনদিন অবস্থান করবেন। সঙ্গে সফরের প্রয়োজনীয় অস্ত্র থাকবে এবং তরবারি কোষবদ্ধ থাকবে। কুরায়েশরা তাদের প্রতি কোনরূপ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে না’। এই শর্তের ব্যাপারে রাসূল (ছাঃ) আপত্তি জানালে সুহায়েল বলেন, যাতে আরবরা একথা বলার সুযোগ না পায় যে, মুসলমানেরা আমাদের উপরে যবরদস্তি প্রবেশ করেছে। বরং ওটা আগামী বছর’। অতঃপর তিনি মেনে নেন’ (বুখারী হা/৩১৮৪; ২৭৩১)।

২। কুরায়েশদের কোন লোক পালিয়ে মুহাম্মাদের দলে যোগ দিলে তাকে ফেরৎ দিতে হবে। পক্ষান্তরে মুসলমানদের কেউ কুরায়েশদের নিকটে গেলে তাকে ফেরৎ দেওয়া হবে না’।[1]

৩। দু’পক্ষের মধ্যে আগামী ১০ বছর যাবৎ যুদ্ধ বন্ধ থাকবে। এই সময় লোকেরা নিরাপদ থাকবে। কেউ কারু উপরে হস্তক্ষেপ করবে না’।[2]

৪। যারা মুহাম্মাদের সাথে চুক্তিবদ্ধ হবে, তারা তার দলে এবং যারা কুরায়েশদের সাথে চুক্তিবদ্ধ হবে, তারা তাদের দলে গণ্য হবে। এমতাবস্থায় তাদের কারু উপরে অত্যাচার করা হ’লে সেটা সংশ্লিষ্ট দলের উপরে অত্যাচার বলে ধরে নেয়া হবে’ (আহমাদ হা/১৮৯৩০)।

উপরোক্ত দফাগুলিতে একমত হওয়ার পর আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) হযরত আলীকে ডাকলেন। অতঃপর তাকে লেখার নির্দেশ দিয়ে বললেন, লিখ- ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম’। সুহায়েল বলল, ‘রহমান’ কি আমরা জানি না। বরং লিখুন- ‘বিসমিকা আল্লাহুম্মা’। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আলীকে তাই-ই লিখতে বললেন। অতঃপর লিখতে বললেন-هَذَا مَا قَاضَى عَلَيْهِ مُحَمَّدٌ رَسُولُ اللهِ ‘এগুলি হ’ল সেইসব বিষয় যার উপরে আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ সন্ধি করেছেন’। সোহায়েল বাধা দিয়ে বলল,لَوْ عَلِمْنَا أَنَّكَ رَسُولُ اللهِ لَمْ نَمْنَعْكَ وَلَبَايَعْنَاكَ ‘যদি আমরা জানতাম যে, আপনি আল্লাহর রাসূল, তাহ’লে আমরা আপনাকে আল্লাহর ঘর হ’তে বিরত রাখতাম না এবং অবশ্যই আমরা আপনার হাতে বায়‘আত করতাম’। অতএব লিখুন ‘মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ’। জবাবে রাসূল (ছাঃ) বললেন,أَنَا وَاللهِ مُحَمَّدُ بْنُ عَبْدِ اللهِ وَأَنَا وَاللهِ رَسُولُ اللهِ ‘আমি অবশ্যই আব্দুল্লাহর পুত্র মুহাম্মাদ এবং আমি অবশ্যই আল্লাহর রাসূল’ (বুখারী হা/৩১৮৪)। অন্য বর্ণনায় এসেছে,وَإِنْ كَذَّبْتُمُونِى ‘যদিও তোমরা আমাকে মিথ্যা সাব্যস্ত করে থাক’ (বুখারী হা/২৭৩১)। অতঃপর তিনি আলীকে বললেন ‘রাসূলুল্লাহ’ শব্দ মুছে ‘মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ’ লিখতে। কিন্তু আলী বললেন,وَاللهِ لاَ أَمْحَاهُ أَبَدًا ‘কসম আল্লাহর! কখনোই আমি তা মুছবো না’। রাসূল (ছাঃ) বললেন, فَأَرِنِيْهِ ‘তাহ’লে আমাকে স্থানটি দেখিয়ে দাও’। আলী বলেন, অতঃপর আমি তাঁকে দেখিয়ে দিলাম। তখন তিনি নিজ হাতে ওটা মুছে দিলেন’ (বুখারী হা/৩১৮৪)। অতঃপর তিনি বললেন,اكْتُبْ مِنْ مُحَمَّدِ بْنِ عَبْدِ اللهِ ‘লেখ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ’।[3] এভাবে চুক্তিনামা লিখন সম্পন্ন হ’ল।

চুক্তি সম্পাদনের পর বনু খোযা‘আহ রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে এবং বনু বকর কুরায়েশদের সাথে অঙ্গীকারাবদ্ধ হ’ল’ (আহমাদ হা/১৮৯৩০, সনদ হাসান)। অবশ্য বনু খোযা‘আহ আব্দুল মুত্ত্বালিবের সময় থেকেই বনু হাশেমের মিত্র ছিল, যা বংশ পরম্পরায় চলে আসছিল।

[1]. বুখারী হা/২৭৩১-৩২; আহমাদ হা/১৮৯৩০।
[2]. আহমাদ হা/১৮৯৩০; আবুদাঊদ হা/২৭৬৬; মিশকাত হা/৪০৪৬।
[3]. মুসলিম হা/১৭৮৪; বুখারী হা/২৭৩১।

হোদায়বিয়ার অন্যান্য খবর

১. কুরায়েশ তরুণদের অপকৌশল(مكيدة شباب قريش) : বুদাইল, উরওয়া ও হুলাইস-এর রিপোর্ট কাছাকাছি প্রায় একই রূপ হওয়ায় এবং সকলে রাসূল (ছাঃ)-এর দেওয়া প্রস্তাব মেনে নেওয়ার জন্য অনুরোধ করায় কুরায়েশ নেতৃবৃন্দ আপোষ করার প্রতি ঝুঁকে পড়েন। কিন্তু তরুণরা এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। তারা নিজেরা গোপনে পৃথকভাবে এক কৌশল প্রস্ত্তত করে যে, রাতের অন্ধকারে তারা মুসলিম শিবিরে অতর্কিতে প্রবেশ করে এমন হৈ চৈ লাগিয়ে দেবে, যাতে উভয়পক্ষে যুদ্ধ বেধে যায় । পরিকল্পনা মোতাবেক ৭০ কিংবা ৮০ জন যুবক ‘তানঈম’ পাহাড় থেকে নেমে সোজা মুসলিম শিবিরে ঢোকার চেষ্টা করে। কিন্তু প্রহরীদের নেতা মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহর হাতে সবাই গ্রেফতার হয়ে যায়। পরে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) সন্ধির প্রতি আগ্রহের কারণে(رَغْبَةً فيِ الصُّلْح) সবাইকে ক্ষমা করেন ও মুক্ত করে দেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন,وَهُوَ الَّذِي كَفَّ أَيْدِيَهُمْ عَنْكُمْ وَأَيْدِيَكُمْ عَنْهُمْ بِبَطْنِ مَكَّةَ مِنْ بَعْدِ أَنْ أَظْفَرَكُمْ عَلَيْهِمْ وَكَانَ اللهُ بِمَا تَعْمَلُونَ بَصِيرًا ‘তিনিই মক্কা শহরে তাদের হাত তোমাদের থেকে এবং তোমাদের হাত তাদের থেকে নিবৃত্ত করেছেন তাদের উপর তোমাদের বিজয়ী করার পর। বস্ত্ততঃ তোমরা যা কিছু কর আল্লাহ সবই দেখেন’ (ফাৎহ ৪৮/২৪)।

২. আপোষ চেষ্টায় মক্কায় প্রতিনিধি প্রেরণ(إرسال المندوب إلى مكة للمصالحة) : অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কুরায়েশদের নিকটে এমন একজন দূত প্রেরণের চিন্তা করলেন, যিনি তাদের নিকটে গিয়ে বর্তমান সফরের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে জোরালোভাবে বক্তব্য উপস্থাপন করতে পারেন এবং অহেতুক যুদ্ধ এড়িয়ে যেতে পারেন। এজন্য তিনি প্রথমে খারাশ বিন উমাইয়া আল-খুযাঈকে পাঠান। কিন্তু কুরায়েশরা তাকে হত্যা করতে উদ্যত হয়। যদি না বেদুঈনরা বাধা দিত (আহমাদ হা/১৮৯৩০)। অতঃপর ওমর (রাঃ)-কে নির্বাচন করলেন। কিন্তু তিনি বললেন যে, মক্কায় বনু ‘আদী গোত্রের একজন লোকও নেই যে আমার সাহায্যে এগিয়ে আসবে যদি আমি আক্রান্ত হই’। তাছাড়া আমার প্রতি তাদের আক্রোশ আপনি জানেন। তার চাইতে আপনি এমন একজনকে পাঠান, যিনি আমার চাইতে তাদের নিকট অধিক সম্মানিত। আপনি ওছমানকে প্রেরণ করুন। কেননা সেখানে তার গোত্রীয় লোকজন রয়েছে। তিনি আপনার বার্তা তাদের নিকটে ভালভাবে পৌঁছাতে পারবেন’।

অতঃপর রাসূল (ছাঃ) ওছমানকে ডাকলেন এবং তাকে কুরায়েশ নেতাদের কাছে পাঠালেন এই বলে যে,أَنَّا لَمْ نَأْتِ لِقِتَالٍ وَإِنَّمَا جِئْنَا عُمَّارًا ‘আমরা লড়াই করতে আসিনি বরং আমরা এসেছি ওমরাহকারী হিসাবে’। তিনি তাদেরকে ইসলামের প্রতি দাওয়াত দিতে বললেন। এছাড়াও মক্কার গোপন মুমিন নর-নারীদের কাছে সত্বর বিজয়ের সুসংবাদ শুনাতে বললেন এবং বলতে বললেন যে, আললাহ শীঘ্র তাঁর দ্বীনকে মক্কায় বিজয়ী করবেন। তখন আর কাউকে তার ঈমান লুকিয়ে রাখার প্রয়োজন হবে না’।

আদেশ পাওয়ার পর ওছমান (রাঃ) মক্কাভিমুখে রওয়ানা হ’লেন। বালদাহ (بَلْدَح) নামক স্থানে পৌঁছলে কুরায়েশদের কিছু লোক তাঁকে জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাচ্ছেন? জবাবে তিনি বললেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাকে অমুক অমুক কাজে পাঠিয়েছেন। তারা বলল,قَدْ سَمِعْنَا مَا تَقُولُ ‘আমরা শুনেছি যা আপনি বলবেন’। এ সময় আবান বিন সাঈদ ইবনুল ‘আছ এসে তাঁকে স্বাগত জানিয়ে নিজ ঘোড়ায় বসিয়ে নিলেন। অতঃপর মক্কায় উপস্থিত হয়ে ওছমান (রাঃ) রাসূল (ছাঃ)-এর নির্দেশ মোতাবেক নেতৃবৃন্দের কাছে বার্তা পৌঁছে দিলেন ও তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দিলেন। বার্তা পৌঁছানোর কাজ শেষ হ’লে নেতারা তাঁকে বায়তুল্লাহ তাওয়াফ করার অনুরোধ জানালেন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর পূর্বে তিনি তাওয়াফ করতে অস্বীকার করলেন।[1]

ওছমান হত্যার ধারণা ও বায়‘আতুর রিযওয়ান

মক্কায় কাজ মিটাতে বেশ দেরী হয়ে যায়। তাতে মুসলমানরা ধারণা করেন যে, মক্কাবাসীরা ওছমানকে হত্যা করেছে। তখন রাসূল (ছাঃ) ‘সামুরাহ’ বৃক্ষের(شَجَرَةُ السَّمُرَةِ) নীচে সবাইকে বায়‘আতের জন্য আহবান করলেন। যেখানে সবাই ওছমান হত্যার প্রতিশোধ না নেয়া পর্যন্ত ফিরে যাবে না বলে আল্লাহর নামে প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করেন। ইতিহাসে এটাই বায়‘আতুর রিযওয়ান(بَيْعَةُ الرِّضْوَانِ) বলে পরিচিত। এদিন বায়‘আত করার জন্য প্রথমে এগিয়ে আসেন আবু সিনান আব্দুল্লাহ বিন ওয়াহাব আল-আসাদী’ (মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ হা/৩৩১৭৫)। অতঃপর সকলে বায়‘আত করেন একজন ব্যতীত। যার নাম জাদ বিন ক্বায়েস আনছারী(جَدُّ بنُ قَيْسٍ)। সে মুনাফিক ছিল। এদিন বায়‘আতকারীদের উদ্দেশ্যে রাসূল (ছাঃ) বলেন,أَنْتُمُ الْيَوْمَ خَيْرُ أَهْلِ الأَرْضِ ‘আজ তোমরা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষ’ (বুখারী হা/৪১৫৪)। বায়‘আত শেষ হওয়ার পরপরই ওছমান (রাঃ) ফিরে আসেন।

বায়‘আতের বিবরণ দিতে গিয়ে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ) বলেন,فَلَوْ كَانَ أَحَدٌ أَعَزَّ بِبَطْنِ مَكَّةَ مِنْ عُثْمَانَ لَبَعَثَهُ مَكَانَهُ ‘যদি মক্কার জনপদে ওছমানের চাইতে উত্তম কেউ থাকতেন, তাহ’লে রাসূল (ছাঃ) তাকেই কুরায়েশদের নিকট পাঠাতেন’। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) ওছমানকে মক্কায় পাঠান। তিনি চলে যাওয়ার পর বায়‘আতুর রিযওয়ান অনুষ্ঠিত হয়। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) তাঁর ডান হাত দেখিয়ে বলেন,هَذِهِ يَدُ عُثْمَانَ ‘এটি ওছমানের হাত’। অতঃপর সেটি দিয়ে অন্য হাতে মারেন এবং বলেন,هَذِهِ لِعُثْمَانَ ‘এটি ওছমানের জন্য’ (বুখারী হা/৩৬৯৮)। এরপর যথারীতি বায়‘আত অনুষ্ঠিত হয়।

উল্লেখ্য যে, বায়‘আত অনুষ্ঠান শেষে ‘ওছমান ফিরে এলেন। অতঃপর তিনি রাসূল (ছাঃ)-এর হাতে বায়‘আত করলেন’(جاءَ عثمانُ فبايعَهُ) বলে যে কথা মুবারকপুরী লিখেছেন (আর-রাহীক্ব ৩৪১-৪২ পৃঃ), তা দলীল বিহীন এবং এটি কোন জীবনীকার লেখেননি। বরং বাস্তব কথা এই যে, ওছমানের পক্ষে রাসূল (ছাঃ) নিজেই স্বীয় ডান হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন ও তার উপরেই বায়‘আত নিয়েছিলেন। অতএব পুনরায় এসে তাঁর বায়‘আত গ্রহণের কোন প্রয়োজন ছিল না। তবে নিঃসন্দেহে এই বায়‘আতের ফযীলতে তিনি অংশীদার ছিলেন। তাছাড়া ওছমানের নিজ হাতে বায়‘আত করার চাইতে তাঁর পক্ষে রাসূল (ছাঃ)-এর হাতে বায়‘আত করা নিঃসন্দেহে অধিক উত্তম ছিল।

উক্ত বিষয়ে জাবের বিন আব্দুল্লাহ (রাঃ) বলেন, এদিন আমরা চৌদ্দশ’ ব্যক্তি ছিলাম। আমরা সবাই বায়‘আত করেছিলাম। কেবল জাদ বিন ক্বায়েস আনছারী বায়‘আত করেনি। সে তার উটের পেটের নীচে লুকিয়ে ছিল। তিনি বলেন, আমরা মৃত্যুর উপরে বায়‘আত করিনি। বরং বায়‘আত করেছিলাম যেন আমরা পালিয়ে না যাই। এ সময় ওমর (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর হাত ধরে রেখেছিলেন’।[2]

মা‘ক্বিল বিন ইয়াসার (রাঃ) বলেন, ‘আমি গাছের ডাল উঁচু করে ধরে রেখেছিলাম’ (মুসলিম হা/১৮৫৮)। এদিন দক্ষ তীরন্দায সালামাহ ইবনুল আকওয়া‘ শুরুতে, মাঝে এবং শেষে মোট তিনবার বায়‘আত করেন’।[3] সালামাহ বলেন, এদিন আমরা মৃত্যুর উপরে বায়‘আত করি’ (মুসলিম হা/১৮৬০)। নাফে‘কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ‘তাঁরা মৃত্যুর উপর বায়‘আত করেননি। বরং ছবরের উপর বায়‘আত করেছিলেন’ (বুখারী হা/২৯৫৮)। এ বিষয়ে হাফেয ইবনু হাজার বলেন, মৃত্যুর উপরে বায়‘আতের অর্থ হ’ল, মৃত্যু হয়ে গেলেও যেন পালিয়ে না যাই। এটা নয় যে, অবশ্যই মৃত্যুবরণ করতে হবে। ছবরের অর্থ হ’ল, দৃঢ় থাকা এবং পালিয়ে না যাওয়া। তাতে বন্দীত্ব বা মৃত্যু যেটাই আসুক না কেন’।[4]

উপরের হাদীছগুলি সহ অন্য কোন ছহীহ হাদীছে বায়‘আতুর রিযওয়ান-এর কারণ কি ছিল সে বিষয়ে স্পষ্ট কিছু বলা হয়নি। যদিও বিভিন্ন সীরাত গ্রন্থে ওছমান হত্যার খবর শোনার পরে রাসূল (ছাঃ) সবার নিকট থেকে এই বায়‘আত গ্রহণ করেন বলে বর্ণিত হয়েছে। যা বিশুদ্ধভাবে প্রমাণিত নয়।[5] বরং শত্রুপক্ষের সম্ভাব্য হামলার বিরুদ্ধে আল্লাহর নামে দৃঢ় অঙ্গীকার গ্রহণের জন্য রাসূল (ছাঃ) মুসলমানদের কাছ থেকে এই বায়‘আত নিয়েছিলেন। বস্ত্ততঃ ওছমান (রাঃ) প্রদত্ত প্রস্তাবনার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও জবাব প্রদানের জন্য কুরায়েশ নেতাদের শলা-পরামর্শ কিছুটা দীর্ঘায়িত হয়। এতে তাঁর প্রত্যাবর্তন বিলম্বিত হয়। এভাবে যখন বায়‘আত সম্পন্ন হয়ে গেল, তখন ওছমান (রাঃ) এসে হাযির হন। এ ঘটনাই বায়‘আতুর রিযওয়ান(بَيْعَةُ الرِّضْوَانِ) বা সন্তুষ্টির বায়‘আত নামে খ্যাত। কেননা আল্লাহ পাক মুসলমানদের এই স্বতঃস্ফূর্ত বায়‘আত গ্রহণে অত্যন্ত সন্তুষ্ট হয়েছিলেন।

ফযীলত(فضيلة البيعة) : এই বায়‘আতে আল্লাহ খুশী হয়ে সাথে সাথে নিম্নোক্ত আয়াত নাযিল করেন-لَقَدْ رَضِيَ اللهُ عَنِ الْمُؤْمِنِيْنَ إِذْ يُبَايِعُوْنَكَ تَحْتَ الشَّجَرَةِ فَعَلِمَ مَا فِيْ قُلُوْبِهِمْ فَأَنْزَلَ السَّكِيْنَةَ عَلَيْهِمْ وَأَثَابَهُمْ فَتْحاً قَرِيْباً ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ সন্তুষ্ট হয়েছেন মুমিনদের উপরে যখন তারা বায়‘আত করছিল তোমার নিকটে বৃক্ষের নীচে। আল্লাহ অবগত ছিলেন যা তাদের অন্তরে ছিল। অতঃপর তিনি তাদের উপরে বিশেষ প্রশান্তি নাযিল করলেন এবং তাদেরকে আসন্ন বিজয় পুরস্কার দিলেন’ (ফাৎহ ৪৮/১৮)। এছাড়াও আল্লাহ বলেন,إِنَّ الَّذِيْنَ يُبَايِعُوْنَكَ إِنَّمَا يُبَايِعُوْنَ اللهَ يَدُ اللهِ فَوْقَ أَيْدِيْهِمْ فَمَن نَّكَثَ فَإِنَّمَا يَنْكُثُ عَلَى نَفْسِهِ وَمَنْ أَوْفَى بِمَا عَاهَدَ عَلَيْهُ اللهَ فَسَيُؤْتِيْهِ أَجْراً عَظِيْماً ‘নিশ্চয়ই যারা তোমার নিকটে বায়‘আত করেছে, তারা তো আল্লাহর নিকটেই বায়‘আত করেছে। আল্লাহর হাত তাদের হাতের উপর রয়েছে। অতঃপর যে ব্যক্তি বায়‘আত ভঙ্গ করে, সে তার নিজের ক্ষতির জন্যই সেটা করে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে কৃত অঙ্গীকার পূর্ণ করে, সত্বর আল্লাহ তাকে মহা পুরস্কারে ভূষিত করবেন’ (ফাৎহ ৪৮/১০)।

এই বায়‘আতের পরকালীন গুরুত্ব সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,لاَ يَدْخُلُ النَّارَ إِنْ شَاءَ اللهُ مِنْ أَصْحَابِ الشَّجَرَةِ أَحَدٌ الَّذِينَ بَايَعُوا تَحْتَهَا ‘আল্লাহ চাহেন তো বৃক্ষতলে বায়‘আতকারীদের কোন ব্যক্তি জাহান্নামে প্রবেশ করবে না’ (মুসলিম হা/২৪৯৬)। তিনি বলেন,كُلُّكُمْ مَغْفُورٌ لَهُ إِلاَّ صَاحِبَ الْجَمَلِ الأَحْمَرِ ‘তোমরা প্রত্যেকে ক্ষমাপ্রাপ্ত লাল উটওয়ালা ব্যতীত’ (মুসলিম হা/২৭৮০ (১২)। ইমাম নববী বলেন, কাযী আয়ায বলেন, ‘লাল উটওয়ালা’ বলে জাদ বিন ক্বায়েস মুনাফিককে বুঝানো হয়েছে (শরহ মুসলিম)। ফলে এই বায়‘আতে অংশগ্রহণকারীগণের অবস্থা বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের ন্যায় হয়ে গেছে। তাঁরা সবাই হ’লেন স্ব স্ব জীবদ্দশায় জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত (ফালিল্লাহিল হাম্দ)।

উল্লেখ্য যে, নাফে‘ বলেন, ওমর (রাঃ)-এর কাছে খবর পৌছলো এই মর্মে যে, লোকেরা ঐ গাছের নিকট গিয়ে ছালাত আদায় করছে। তখন তিনি তাদেরকে খুবই ধমকালেন এবং গাছটি কেটে ফেলার নির্দেশ দিলেন’।[6] ইবনু ওমর (রাঃ) বলেন, যখন আমরা পরের বছর পুনরায় গেলাম (ক্বাযা ওমরাহ আদায়ের জন্য), তখন আমাদের দু’জন ব্যক্তিও গাছের নীচে জমা হয়নি। যেখানে আমরা বায়‘আত করেছিলাম। আর এটি ছিল আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমত’ (বুখারী, ফৎহুল বারী হা/২৯৫৮-এর ব্যাখ্যা)। এর অর্থ, গাছটির অবস্থান গোপন থাকায় মানুষ সেখানে কোনরূপ পূজা করার সুযোগ পায়নি। যাতে তারা ঐ গাছটিকে কোনরূপ উপকার বা ক্ষতি করার ক্ষমতা রাখে বলে বিশ্বাসী না হয়’ (ঐ)।

৪. আবু জান্দালের আগমন(قدوم أبى جندل) : সন্ধিপত্র লেখার কাজ চলছে এরি মধ্যে সোহায়েল-পুত্র আবু জান্দাল(أَبُو جَنْدَل) শিকল পরা অবস্থায় পা হেঁচড়াতে হেঁচড়াতে এসে মুসলিম শিবিরে ঢুকে পড়ল। তাকে দেখে সোহায়েল বলে ওঠেন, এই আবু জান্দালই হল প্রথম ব্যক্তি যে বিষয়ে আমরা চুক্তি করেছি যে, আপনি তাকে ফেরৎ দিবেন। (কেননা সে অভিভাবকের অনুমতি ছাড়াই পালিয়ে আপনার দলে চলে এসেছে)। রাসূল (ছাঃ) বললেন, এখনও তো চুক্তি লিখন কাজ শেষ হয়নি? সোহায়েল বললেন, আল্লাহর কসম! তাহলে চুক্তির ব্যাপারে আমি আর কোন কথাই বলব না’। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, অন্ততঃ আমার খাতিরে তুমি ওকে ছেড়ে দাও’। সোহায়েল বললেন, আপনার খাতিরেও আমি তাকে ছাড়ব না। রাসূল (ছাঃ) বললেন,بَلَى فَافْعَلْ ‘হ্যাঁ এটুকু তুমি কর’। তিনি বললেন,مَا أَنَا بِفَاعِلٍ ‘না আমি তা করব না’। অতঃপর সোহায়েল আবু জান্দালের মুখে চপেটাঘাত করে তার গলার কাপড় ধরে টানতে টানতে মুশরিকদের নিকটে নিয়ে চললেন। আবু জান্দাল তখন অসহায়ভাবে চিৎকার দিয়ে বলতে লাগল ‘হে মুসলিমগণ! আমি কি মুশরিকদের কাছে ফিরে যাব? ওরা আমাকে দ্বীনের ব্যাপারে ফিৎনায় নিক্ষেপ করবে’। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন,يَا أَبَا جَنْدَلٍ، اصْبِرْ وَاحْتَسِبْ ‘হে আবু জান্দাল! ধৈর্য ধর এবং ছওয়াবের আশা কর। আল্লাহ তোমার ও তোমার সাথী দুর্বলদের জন্য মুক্তির পথ খুলে দেবেন। আমরা কুরায়েশদের সঙ্গে সন্ধি করেছি। তারা ও আমরা পরস্পরে আল্লাহর নামে চুক্তিবদ্ধ হয়েছি। যা আমরা ভঙ্গ করতে পারি না’।[7]

৫. মুহাজির মহিলাদের ফেরৎ দানে অস্বীকৃতি(إنكار رد النساء المهاجرات) : এই সময় মক্কা হ’তে বেশ কিছু মুমিন মহিলা আগমন করলেন, যারা মদীনায় হিজরত করতে চান। তাদের অভিভাবকগণ তাদের ফেরৎ নিতে এলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদের ফেরৎ দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেন, সন্ধিচুক্তিতে পুরুষ মুহাজিরের কথা বলা আছে, মহিলাদের কথা নেই। কেননা চুক্তির ভাষ্য হ’ল এই যে,وَعَلَى أَنَّهُ لاَ يَأْتِيْكَ مِنَّا رَجُلٌ وَإِنْ كَانَ عَلَى دِيْنِكَ إِلاَّ رَدَدْتَهُ إِلَيْنَا ‘আমাদের মধ্যকার কোন পুরুষ(رَجُلٌُ) যদি আপনার নিকটে আসে, সে আপনার দ্বীনের উপরে হ’লেও তাকে আপনি ফেরৎ দিবেন’ (বুখারী হা/২৭৩২)। এখানে মহিলাদের বিষয়ে কিছুই বলা হয়নি। একই সময়ে ঐ ধরণের মহিলা মুহাজিরদের সম্পর্কে সূরা মুমতাহিনা ১০ আয়াতটি নাযিল হয়। যাতে বলা হয় যে, এইসব মুহাজির মহিলাগণকে পরীক্ষা করো। পরীক্ষায় সত্যিকারের মুমিন প্রমাণিত হ’লে তাদেরকে কাফেরদের নিকটে ফেরৎ দিয়ো না। কেননা কাফেরগণ তাদের জন্য হালাল নয়। অতঃপর ঐসব মহিলাদেরকে যথাযথভাবে মোহর দানের মাধ্যমে মুমিনদের সাথে বিবাহের নির্দেশ দেওয়া হয় এবং তাদের কাছ থেকে বায়‘আত গ্রহণের আদেশ দেওয়া হয় (মুমতাহিনা ৬০/১২)। উক্ত আয়াত নাযিলের ফলে হযরত ওমর (রাঃ) মক্কায় তাঁর দু’জন মুশরিক স্ত্রীকে তালাক দিয়ে দেন। যারা পরে একজন মু‘আবিয়ার সাথে, অন্যজন আবু জাহম বিন হুযায়ফাহ অথবা তার পরে ছাফওয়ান বিন উমাইয়ার সাথে বিবাহিতা হন।[8]

৬. ওমরাহ থেকে হালাল হ’লেন সবাই(يتحللون جميعا من العمرة) : চুক্তি সম্পাদনের পর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সবাইকে হালাল হওয়ার জন্য স্ব স্ব পশু কুরবানী করতে বললেন। তিনি পরপর তিনবার একথা বললেন। কিন্তু কেউ সাড়া দিল না। তখন রাসূল (ছাঃ) উম্মে সালামাহর কাছে গিয়ে বিষয়টি বললেন। তিনি পরামর্শ দিলেন যে, আপনি এটা চাইলে ‘সোজা বেরিয়ে যান ও কাউকে কিছু না বলে নিজের উটটি নহর করুন। অতঃপর নাপিত ডেকে নিজের মাথা মুন্ডন করুন’। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাই করলেন। তখন সবাই উঠে দাঁড়ালো ও স্ব স্ব কুরবানী সম্পন্ন করল। অতঃপর কেউ মাথা মুন্ডন করল, কেউ চুল ছাঁটলো’ (বুখারী হা/২৭৩২)। সবাই এত দুঃখিত ছিল যে, যেন পরস্পরকে হত্যা করবে। সেই সময় তাঁরা প্রতি সাত জনে একটি গরু অথবা একটি উট নহর করেন। আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) আবু জাহলের হৃষ্টপুষ্ট নামকরা উটটি নহর করেন (যা বদরযুদ্ধে গণীমত হিসাবে হস্তগত হয়েছিল), যার নাকে রূপার নোলক ছিল। উদ্দেশ্য, যাতে মক্কার মুশরিকরা মনোকষ্টে ভোগে। এই সময় রাসূল (ছাঃ) মাথা মুন্ডনকারীদের জন্য তিনবার ও চুল ছাঁটাইকারীদের জন্য একবার করে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। এই সফরে এহরাম অবস্থায় অসুখ বা কষ্টের কারণে মাথা মুন্ডনকারীর জন্য ফিদইয়ার বিধান নাযিল হয়। যা কা‘ব বিন উজরাহর(كَعْبُ بنُ عُجْرَةَ) মাথায় প্রচন্ড উকুনের কারণে নাযিল হয়েছিল। হজ্জ ও ওমরাহর কোন ওয়াজিব তরক করলে ‘ফিদইয়া’ ওয়াজিব হয়। এজন্য একটি বকরী কুরবানী দিবে অথবা ৬ জন মিসকীনকে তিন ছা‘ খাদ্য দিবে অথবা তিনটি ছিয়াম পালন করবে’।[9]

৭. সন্ধির ব্যাপারে মুসলমানদের বিষণ্ণতা ও রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে ওমর (রাঃ)-এর বিতর্ক (غم المسلمين من الصلح ومكالمة عمر مع الرسول صـ) : হোদায়বিয়ার সন্ধিচুক্তির দু’টি বিষয় মুসলিম কাফেলার অন্তরে দারুণভাবে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল, যা তাদের হৃদয়কে দুঃখে ও বেদনায় ভারাক্রান্ত করে ফেলেছিল। (ক) রওয়ানা হবার সময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছিলেন যে, আমরা বায়তুল্লাহ গমন করব ও তাওয়াফ করব। অথচ এখন তিনি তা না করেই ফিরে যাচ্ছেন। (খ) তিনি আল্লাহর রাসূল এবং তিনি সত্যের উপরে আছেন। উপরন্তু আল্লাহ তাঁর দ্বীনকে বিজয়ী করার ওয়াদা দিয়েছেন। তাহ’লে কুরায়েশদের চাপে তিনি কেন ওমরাহ না করেই ফিরে যাওয়ার মত হীন শর্তে সন্ধি করলেন।

বলা বাহুল্য উসায়েদ বিন হুযায়ের, সা‘দ বিন উবাদাহ, সাহল বিন হুনাইফ এবং অন্যান্য সকলের অনুভূতির মুখপাত্র স্বরূপ ওমর ফারূক (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকটে উপস্থিত হয়ে নিম্নোক্ত বাদানুবাদ করেন। ওমর বলেন, হে আল্লাহর রাসূল!أَلَسْنَا عَلَى الْحَقِّ وَهُم عَلَى الْبَاطِلِ ‘আমরা কি হক-এর উপরে নই? এবং তারা বাতিলের উপরে? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, হ্যাঁ। ওমর বললেন,أَلَيْسَ قَتْلاَنَا فِي الْجَنَّةِ وَقَتْلاَهُمْ فِي النَّارِ؟ ‘আমাদের নিহতেরা কি জান্নাতে নয়? এবং তাদের নিহতেরা জাহান্নামে? রাসূল (ছাঃ) বললেন, হ্যাঁ। ওমর বললেন, তাহ’লে কেন আমরা দ্বীনের ব্যাপারে ছাড় দেব এবং ফিরে যাব? অথচ আল্লাহ পাক এখনো আমাদের ও তাদের মাঝে কোনরূপ ফায়ছালা করেননি? জবাবে রাসূল (ছাঃ) বললেন,يَا ابْنَ الْخَطَّابِ، إِنِّى رَسُولُ اللهِ، وَلَنْ يُضَيِّعَنِى اللهُ أَبَدًا ‘হে ইবনুল খাত্ত্বাব! আমি আল্লাহর রাসূল। কখনোই আল্লাহ আমাকে ধ্বংস করবেন না’।[10] অন্য বর্ণনায় এসেছে তিনি বলেন,إِنِّي رَسُولُ اللهِ، وَلَسْتُ أَعْصِي رَبِّي، وَهُوَ نَاصِرِيْ ‘আমি আল্লাহর রাসূল। আমি আমার প্রতিপালকের অবাধ্যতা করি না। তিনিই আমার সাহায্যকারী’। তখন ওমর বললেন,أَوَ لَيْسَ كُنْتَ تُحَدِّثُنَا أَنَّا سَنَأْتِي الْبَيْتَ، فَنَطُوفُ بِهِ؟ ‘আপনি কি আমাদের বলেননি যে, সত্বর আমরা আল্লাহর ঘরে গমন করব ও তাওয়াফ করব’? জবাবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, হ্যাঁ। তবে আমি কি তোমাকে বলেছিলাম যে, আমরা এবছরই সেটা করব’? ওমর বললেন, না’। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন,فَإِنَّكَ تَأْتِيْهِ، فَتَطُوفُ بِهِ ‘তাহ’লে অবশ্যই তুমি আল্লাহর ঘরে আসবে ও তাওয়াফ করবে’।[11]

অতঃপর ওমর (রাঃ) রাগতঃভাবে বেরিয়ে আবুবকর (রাঃ)-এর কাছে গেলেন ও একইরূপ অভিযোগ করলেন। তিনিও তাকে রাসূল (ছাঃ)-এর ন্যায় জবাব দিলেন এবং বললেন,إِنَّهُ رَسُولُ اللهِ، وَلَنْ يُضَيِّعَهُ اللهُ أَبَدًا ‘নিশ্চয়ই তিনি আল্লাহর রাসূল এবং কখনোই আল্লাহ তাঁকে ধ্বংস করবেন না’।[12] তিনি আরও বলেন,أَيُّهَا الرَّجُلُ إِنَّهُ رَسُولُ اللهِ، وَلَيْسَ يَعْصِي رَبَّهُ، وَهُوَ نَاصِرُهُ، فَاسْتَمْسِكْ بِغَرْزِهِ، حَتَّى تَمُوتَ، فَوَاللهِ إِنَّهُ عَلَى الْحَقِّ ‘হে ব্যক্তি! নিশ্চয়ই তিনি আল্লাহর রাসূল। তিনি তাঁর প্রতিপালকের অবাধ্যতা করেন না। তিনিই তাঁকে সাহায্যকারী। অতএব তুমি আমৃত্যু তাঁর রাস্তা দৃঢ়ভাবে অাঁকড়ে থাক। আল্লাহর কসম! তিনি অবশ্যই হক-এর উপরে আছেন’ (ছহীহ ইবনু হিববান হা/৪৮৭২, সনদ ছহীহ)। এর মাধ্যমে আবুবকর (রাঃ)-এর ঈমানী দৃঢ়তা ও অবিচল আনুগত্যের প্রমাণ পাওয়া যায়।

ফাৎহুম মুবীন

ফেরার পথে মক্কা থেকে মদীনার পথে ৪২ মাইল (৬৪ কি. মি.) দূরে কোরাউল গামীম(كُرَاعُ الْغَمِيمِ) পৌঁছলে সূরা ফাৎহ-এর প্রথম দিকের আয়াতগুলি নাযিল হয় (ফাৎহুল বারী হা/৪১৫২-এর আলোচনা দ্রষ্টব্য)। যেখানে বলা হয়,إِنَّا فَتَحْنَا لَكَ فَتْحًا مُبِينًا- لِيَغْفِرَ لَكَ اللهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِكَ وَمَا تَأَخَّرَ وَيُتِمَّ نِعْمَتَهُ عَلَيْكَ وَيَهْدِيَكَ صِرَاطًا مُسْتَقِيمًا- وَيَنْصُرَكَ اللهُ نَصْرًا عَزِيزًا ‘আমরা তোমাকে স্পষ্ট বিজয় দান করেছি’। ‘যাতে আল্লাহ তোমার অতীত ও ভবিষ্যৎ ত্রুটিসমূহ ক্ষমা করে দেন এবং তোমার প্রতি তাঁর নে‘মত পূর্ণ করেন ও তোমাকে সরল পথে পরিচালিত করেন’। ‘আর তোমাকে দান করেন বলিষ্ঠ সাহায্য’ (ফাৎহ ৪৮/১-৩)। রাসূল (ছাঃ) ওমরের কাছে লোক পাঠিয়ে আয়াতটি শুনিয়ে দিলেন। তখন ওমর এসে বললেন,يَا رَسُوْلَ اللهِ، أَوَ فَتْحٌ هُوَ؟ ‘হে আল্লাহর রাসূল! এটা কি বিজয় হ’ল’? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, হ্যাঁ। তখন তিনি খুশী হ’লেন ও ফিরে গেলেন’ (মুসলিম হা/১৭৮৫ (৯৪)।

ওমর (রাঃ) তার ঐদিনের বাড়াবাড়ির কারণে দারুণভাবে লজ্জিত হন। তিনি বলেন,

مَا زِلْتُ أَصُومُ وَأَتَصَدَّقُ وَأُصَلِّى وَأَعْتِقُ مِنَ الَّذِى صَنَعْتُ مَخَافَةَ كَلاَمِى الَّذِى تَكَلَّمْتُ بِهِ يَوْمَئِذٍ حَتَّى رَجَوْتُ أَنْ يَكُونَ خَيْراً

‘আমি এজন্য অনেক সৎকর্ম করেছি। সর্বদা ছাদাক্বা করেছি, ছিয়াম রেখেছি, নফল ছালাত আদায় করেছি, দাস-দাসী মুক্ত করেছি- শুধু ঐদিন ঐকথাগুলি বলার গোনাহর ভয়ে। এখন আমি মঙ্গলের আশা করছি’ (আহমাদ হা/১৮৯৩০)।

এভাবে ৪৫২ কিঃ মিঃ দূর থেকে ইহরাম বেঁধে এসে মাত্র ২২ কিঃ মিঃ দূরে থাকতে ফিরে যেতে হ’ল। অথচ কা‘বাগৃহ এমন একটি স্থান যেখানে পিতৃহন্তা আশ্রয় নিলেও তাকে নিরাপত্তা দেওয়া হয়। কিন্তু আড়াই হাযার বছর থেকে চলে আসা এই রেওয়াজ রাসূল (ছাঃ) ও তাঁর সাথী মুসলমানদের জন্য ভঙ্গ করা হ’ল এবং তাঁদেরকে কা‘বাগৃহ যেয়ারতে বাধা দেওয়া হ’ল। শান্তির বৃহত্তর স্বার্থে রাসূল (ছাঃ) তা মেনে নিলেন। যদিও সাথীরা প্রায় সবাই তাতে নারায ছিলেন। এর মধ্যে নেতৃত্বের দৃঢ়তা ও তার প্রতি কর্মীদের অটুট আনুগত্যের অনন্য দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়।

হোদায়বিয়া চুক্তির প্রতিক্রিয়া

চুক্তি শেষে রাসূল (ছাঃ) যখন মদীনায় ফিরে আসেন, তখন আবু বাছীর নামে কুরায়েশের একজন ব্যক্তি মুসলিম হয়ে মদীনায় আসেন। তখন কুরায়েশরা তাকে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য দু’জন লোক পাঠায়। তারা এসে এই চুক্তির দোহাই দিয়ে তাকে ফেরৎ চায়। তখন রাসূল (ছাঃ) আবু বাছীরকে তাদের হাতে অর্পণ করেন। অতঃপর তারা তাকে নিয়ে বের হয়ে যায় এবং যুল হুলায়ফাতে অবতরণ করে খেজুর খেতে থাকে। এমন সময় আবু বাছীর তাদের একজনকে বললেন, আল্লাহর কসম! তোমার তরবারীটা কতই না সুন্দর! তাতে লোকটি খুশী হয়ে তরবারী টান দিয়ে বের করে বলল, অবশ্যই আল্লাহর কসম এটি খুবই সুন্দর। আমি এটি বার বার পরীক্ষা করেছি। আবু বাছীর বললেন, আমাকে দাও তো আমি একটু দেখি। তখন সে তাকে তরবারীটি দিল। হাতে পেয়েই আবু বাছীর তাকে হত্যা করে ফেলল। এ দৃশ্য দেখে দ্বিতীয় জন ভয়ে দৌড় দিয়ে মদীনায় পৌঁছে গেল এবং মসজিদে প্রবেশ করল। অতঃপর রাসূল (ছাঃ)-কে বলল, আল্লাহর কসম আমার সাথী নিহত হয়েছে। এমন সময় আবু বাছীর পিছে পিছে এসে বলল, হে আল্লাহর নবী! আপনি অবশ্যই আপনার চুক্তি পালন করেছেন। আপনি আমাকে তাদের নিকটে ফেরৎ দিয়েছেন। অতঃপর আল্লাহ আমাকে তাদের থেকে নাজাত দিয়েছেন। তখন রাসূল (ছাঃ) বললেন,وَيْلُ أُمِّهِ مِسْعَرَ حَرْبٍ، لَوْ كَانَ لَهُ أَحَدٌ ‘দুর্ভোগ তার মায়ের জন্য! সে যুদ্ধের অগ্নি উদ্দীপক। যদি আজ তাকে সাহায্য করার কেউ থাকত!’।[13] এখানে বাক্যের প্রথম অংশটি বিস্ময়সূচক। অর্থাৎ তার মা কত বড়ই না বীর সন্তানের জন্মদাত্রী। বাক্যের শেষাংশে তার অভিভাবকদের প্রতি শ্লেষ ব্যক্ত হয়েছে। হায়! যদি তারা তার ইচ্ছা অনুযায়ী কাজ করার ব্যাপারে তাকে সাহায্য করত!

একথার মাধ্যমে আবু বাছীর যখন বুঝলেন যে, তাকে ফেরৎ দেওয়া হবে, তখন তিনি শামের সায়ফুল বাহরের দিকে চলে গেলেন। ওদিকে মক্কা থেকে আবু জান্দাল এসে তার সাথে মিলিত হলেন। এমনিভাবে কুরায়েশ থেকে যখনই কোন ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করতেন, তখনই তিনি বের হয়ে এসে আবু বাছীরের সাথে ‘ঈছ’ নামক স্থানে মিলিত হতেন। ফলে সেখানে একটি বড় দল গড়ে ওঠে। যখনই তাদের সামনে কোন কুরায়েশ কাফেলা আসত, তখনই তার উপরে তারা হামলা করত। পরবর্তীতে রাসূল (ছাঃ)-এর জামাতা আবুল ‘আছ বিন রবী‘-এর ব্যবসায়ী কাফেলা তাদের দ্বারা আক্রান্ত হয়। তখন তার বিষয়ে রাসূল (ছাঃ)-এর বক্তব্য জানতে পেরে তারা উক্ত কাফেলার সবকিছু ছেড়ে দেয় (যাদুল মা‘আদ ৩/২৬৩-৬৪)।

[1]. আহমাদ হা/১৮৯৩০; যাদুল মা‘আদ ৩/২৫৯; ইবনু হিশাম ২/৩১৫-১৬।
[2]. মুসলিম হা/১৮৫৬ (৬৯); বুখারী হা/৪১৫৪; মিশকাত হা/৬২১৯।
[3]. মুসলিম হা/১৮০৭; ইবনু হিশাম ২/৩১৫-১৬।
[4]. ফাৎহুল বারী হা/২৯৫৭-৫৮-এর আলোচনা দ্রঃ।
[5]. আর-রাহীক্ব ৩৪১ পৃঃ, (ঐ, তা‘লীক্ব ১৬৪ পৃঃ)।

প্রসিদ্ধ আছে যে, ওছমান হত্যার গুজবই ছিল এর একমাত্র কারণ। তিনি নিহত হয়েছেন, এ খবর পৌঁছার পর রাসূল (ছাঃ) বলেন, لاَ نَبْرَحُ حَتَّى نُنَاجِزَ الْقَوْمَ ‘আমরা যাব না যতক্ষণ না ওদের সঙ্গে যুদ্ধ করব’ (ইবনু হিশাম ২/৩১৫; তারীখ ত্বাবারী ২/৬৩২; আল-বিদায়াহ ৪/১৬৭; আর-রাহীক্ব ৩৪১ পৃঃ)। বর্ণনাটির সনদ ‘মুরসাল’ বা যঈফ (মা শা-‘আ ১৭৭ পৃঃ)। অন্য আর একটি কারণ হিসাবে বলা হয়েছে, কুরায়েশ প্রতিনিধি সুহায়েল বিন ‘আমর ও অন্যদের সাথে রাসূল (ছাঃ)-এর সন্ধি আলোচনার এক পর্যায়ে দু’পক্ষের কোন একজন ব্যক্তি অপর পক্ষের উদ্দেশ্যে তীর ছুঁড়ে মারেন। তখন উভয় পক্ষে গোলমাল ও হৈ চৈ শুরু হয়ে যায়। এমতাবস্থায় মুসলিম পক্ষ সুহায়েল বিন ‘আমরসহ মক্কার প্রতিনিধি দলকে এবং অন্যদিকে মক্কার নেতারা ওছমানকে আটকিয়ে রাখে। তখন রাসূল (ছাঃ) মুসলমানদেরকে বায়‘আতের আহবান জানান’ (বায়হাক্বী, দালায়েলুন নবুঅত হা/১৪৬৭)। হাদীছটি ‘যঈফ’ (আর-রাহীক্ব, তা‘লীক্ব ১৬৪ পৃঃ; মা শা-‘আ ১৭৬-৭৮ পৃঃ)।

[6]. ত্বাবাক্বাত ইবনু সা‘দ, সনদ ছহীহ; ফাৎহুল বারী হা/৪১৬৫-এর আলোচনা।
[7]. আহমাদ হা/১৮৯৩০, সনদ হাসান; ইবনু হিশাম ২/৩১৮।
[8]. বুখারী হা/২৭৩৩; ফাৎহুল বারী হা/৫২৮৬-এর আলোচনা।
[9]. বুখারী হা/১৮১৫; মুসলিম হা/১২০১; মিশকাত হা/২৬৮৮। দ্রঃ লেখক প্রণীত ‘হজ্জ ও ওমরাহ’ বই (৪র্থ সংস্করণ, ২০১৩ খৃ.) ৩৮-৩৯ পৃঃ।
[10]. বুখারী হা/৩১৮২; মুসলিম হা/১৭৮৫ (৯৪)।
[11]. ছহীহ ইবনু হিববান হা/৪৮৭২, হাদীছ ছহীহ।
[12]. বুখারী হা/৩১৮২; মুসলিম হা/১৭৮৫ (৯৪)।
[13]. যাদুল মা‘আদ ৩/২৬৩-৬৪; বুখারী হা/২৭৩১; মিশকাত হা/৪০৪২।

হোদায়বিয়া সন্ধির গুরুত্ব

(১) হোদায়বিয়ার সন্ধি ছিল ইসলামের ইতিহাসে একটি মোড় পরিবর্তনকারী ঘটনা এবং নিঃসন্দেহে তা ছিল মুসলমানদের জন্য স্পষ্ট বিজয়। কারণ ইতিপূর্বে কুরায়েশরা আরব উপদ্বীপের অধিবাসীদের ধর্মীয় ও পার্থিব নেতৃত্বের একচ্ছত্র অধিকারী বলে সর্বদা গর্ব অনুভব করত। আর সেকারণে মদীনায় প্রতিষ্ঠিত ইসলামী শক্তিকে তারা আমলেই নিত না। কিন্তু হোদায়বিয়ার সন্ধির ফলে তারা এই প্রথম রাসূল (ছাঃ)-এর নেতৃত্বে মদীনার ইসলামী শক্তিকে তাদের প্রতিপক্ষ হিসাবে স্বীকৃতি দিল। চুক্তির তৃতীয় ধারাটির মাধ্যমে একথাটি স্পষ্টভাবেই স্বীকার করা হয়েছে।

(২) আগামী দশ বছরের জন্য ‘যুদ্ধ নয়’ চুক্তিটাই ছিল প্রকৃত অর্থে মুসলিম শক্তির জন্য ‘স্পষ্ট বিজয়’(فَتْحٌ مُبِينٌ)। কেননা সর্বদা যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করলে কোন আদর্শই যথার্থভাবে সমাজে প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। এই চুক্তির ফলে কাফিরদের সাথে যোগাযোগ সহজ হয় এবং তাদের মধ্যে দ্বীনের দাওয়াতের পথ খুলে যায়। এতে ইসলাম দ্রুত বিস্তার লাভ করে। অতএব নির্বিঘ্ন প্রচারের সুযোগ লাভের স্বার্থে এবছর ওমরাহ না করে ফিরে যাবার মত অবমাননাকর শর্ত মেনে নিয়ে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) যে রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও শান্তিপ্রিয়তার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন, বিশ্ব ইতিহাসে তার তুলনা বিরল। এতে ফল হ’ল এই যে, পরের বছর ক্বাযা ওমরাহ করার সময় ২০০০ এবং তার দু’বছর পর মক্কা বিজয়ের সময় ১০,০০০ মুসলমান রাসূল (ছাঃ)-এর সাথী হন।

(৩) যুদ্ধই যে সবকিছুর সমাধান নয়, বরং আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে শান্তি স্থাপন করা সম্ভব, এ সন্ধি তার বাস্তব প্রমাণ। আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) শক্তিশালী অবস্থানে থেকেও এবং কুরায়েশদের শত উসকানি সত্ত্বেও তিনি সর্বদা যুদ্ধ এড়াতে চেয়েছেন। তিনি নিজেই অগ্রণী হয়ে ওছমান (রাঃ)-কে কুরায়েশ নেতাদের কাছে দূত হিসাবে পাঠিয়েছেন। এর দ্বারা ইসলাম যে শান্তির ধর্ম এবং তিনি যে বিশ্ব মানবতার জন্য শান্তির দূত(رَحْمَةٌ لِّلْعَالَمِيْن) হিসাবে আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত হয়েছেন (আম্বিয়া ২১/১০৭), তিনি সেটারই স্বাক্ষর রেখেছেন। কেননা মুসলমান তার জীবন ও সম্পদ সবকিছুর বিনিময়ে দুনিয়াতে স্রেফ আল্লাহর খেলাফত ও তাঁর বিধানাবলীর প্রতিষ্ঠা দেখতে চায়। গণীমত লাভ বা বাদশাহী করা তাদের জীবনের লক্ষ্য নয়। এদিকে ইঙ্গিত করেই মহাকবি ইকবাল বলেন,

شہادت ہے مطلوب ومقصود مؤمن
نہ مال غنيمت نہ كشور كشائي

‘মুমিনের লক্ষ্য হ’ল শাহাদাত লাভ। গণীমত বা বাদশাহী লাভ করা নয়’।[1]

(৪) প্রথম দফাটি মুসলিম পক্ষের জন্য অবমাননাকর মনে হ’লেও এতে পরের বছর নিরাপদে ওমরাহ করার গ্যারান্টি ছিল। এর মাধ্যমে রাসূল (ছাঃ)-এর স্বপ্ন স্বার্থক হবার সুযোগ সৃষ্টি হয়।

(৫) হোদায়বিয়ার সন্ধির চার দফা চুক্তির মধ্যে কুরায়েশগণ মুসলমানদের তিনটি বিষয়ে সুযোগ দানের বিনিময়ে নিজেরা মাত্র একটি সুযোগ লাভ করে। মুসলমানদের তিনটি সুযোগ হ’ল : পরের বছর ওমরাহ করার নিশ্চয়তা, আগামী দশ বছর যুদ্ধ না করা এবং সাধারণ আরব গোত্রগুলিকে মুসলিম পক্ষে যোগদানের সুযোগ প্রদান করা। পক্ষান্তরে কুরায়েশরা সুযোগ লাভ করেছিল কেবল চতুর্থ দফার মাধ্যমে। যাতে বলা হয়েছে যে, তাদের কেউ পালিয়ে গিয়ে মুসলিম পক্ষে যোগ দিলে তাকে ফিরিয়ে দেওয়া হবে। এটা ছিল নিতান্তই গুরুত্বহীন। কেননা এভাবে প্রকাশ্যে যারা হিজরত করে, জীবনের ঝুঁকি নিয়েই তারা এটা করে। আবু জান্দাল, আবু বাছীর, সুহায়েল বিন আমর প্রমুখের ঈমানী জাযবাকে এই চুক্তি দিয়ে আটকে রাখা যায়নি। তারা সিরিয়ার নিকটবর্তী সমুদ্রোপকূলে ঈছ (العِيْص) পাহাড়ী এলাকায় গিয়ে অন্যান্য মুসলমানদের নিয়ে দল গঠন করে ও কুরায়েশদের বাণিজ্য কাফেলার জন্য কঠিন হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। এক বছরের মধ্যে সেখানে প্রায় তিনশ মুসলমান জমা হয়ে যায়। ফলে এই ধারাটি অবশেষে কুরায়েশদের বিপক্ষে চলে যায় এবং তারা মদীনায় গিয়ে উক্ত ধারা বাতিলের আবেদন জানায় (সীরাহ ছহীহাহ ২/৪৫১)। এভাবে কার্যতঃ চুক্তির ৪র্থ ধারাটি বাতিল গণ্য হয়।

পরের বছর অর্থাৎ ৭ম হিজরীর প্রথম দিকে ওছমান বিন ত্বালহা, খালেদ বিন অলীদ ও আমর ইবনুল ‘আছ-এর মত সেরা ব্যক্তিগণ মদীনায় গিয়ে ইসলাম কবুল করেন।[2] এছাড়াও গোপনে ঈমান আনয়নকারীর সংখ্যা ছিল অগণিত। যারা মক্কা বিজয়ের পরে নিজেদের প্রকাশ করেন। ফলে দেখা যাচ্ছে যে, ফলাফলের বিচারে পুরা চুক্তিটাই মুসলমানদের পক্ষে চলে গেছে। এর মাধ্যমে রাসূল (ছাঃ)-এর গভীর দূরদৃষ্টির পরিচয় ফুটে ওঠে। হোদায়বিয়ার সন্ধি তাই নিঃসন্দেহে ছিল ‘ফাৎহুম মুবীন’ বা স্পষ্ট বিজয়। যা শুরুতে ওমরের মত দূরদর্শী ছাহাবীরও বুঝতে ভুল হয়েছিল।

[1]. আর-রাহীকুল মাখতূম (উর্দূ) ৫৬০ পৃঃ। প্রকাশকের বক্তব্য মতে উর্দূ সংস্করণটি লেখকের নিজহাতে অনূদিত ও সম্পাদিত হয়েছে (প্রকাশক : মাকতাবা সালাফিইয়াহ, শীশমহল রোড, লাহোর ৩য় সংস্করণ ১৪০৯ হি./১৯৮৮ খৃ.)। কবিতাটি আরবী সংস্করণে নেই।
[2]. আর-রাহীক্ব ৩৪৭-৪৮ পৃঃ।

প্রসিদ্ধ আছে যে, এঁদের দেখে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) খুশী হয়ে বলেছিলেন, هَذِهِ مَكَّةُ قَدْ أَلْقَتْ إلَيْكُمْ أَفْلاَذَ كَبِدِهَا ‘মক্কা তার কলিজার টুকরাগুলোকে আমাদের কাছে সমর্পণ করেছে’ (আর-রাহীক্ব ৩৪৮ পৃঃ; সীরাহ হালাবিইয়াহ ৩/৮৮)। বক্তব্যটি সনদ বিহীন।

হোদায়বিয়া সন্ধির শিক্ষণীয় বিষয়সমূহ

(১) যুদ্ধ নয়, শান্তি প্রতিষ্ঠাই ইসলামের মূল উদ্দেশ্য। এজন্য কিছু ছাড় দিয়ে হলেও সর্বদা সন্ধির পথে চলাই হ’ল ইসলামের নীতি।

(২) আমীর হবেন শান্তিবাদী এবং সবার চাইতে অধিক জ্ঞানী ও দূরদৃষ্টি সম্পন্ন।

(৩) আমীরের কোন সিদ্ধান্ত কর্মীদের মনঃপুত না হ’লে ছবর করতে হবে এবং তা মেনে নিতে হবে।

(৪) সর্বদা আমীরের সিদ্ধান্তই হবে চূড়ান্ত। পরামর্শ আবশ্যিক হলেও যৌথ নেতৃত্ব বলে ইসলামে কিছু নেই।

(৫) মহিলারা পুরুষের উপরে নেতৃত্ব না দিলেও রাজনৈতিক ও সামাজিক সকল ব্যাপারে তাদের উত্তম পরামর্শ অবশ্যই গ্রহণীয়। হোদায়বিয়া সন্ধির পর রাসূল (ছাঃ) স্ত্রী উম্মে সালামাহর একক পরামর্শ গ্রহণ করেন, যা খুবই ফলপ্রসু প্রমাণিত হয়।

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও তাঁর সাথীগণ হোদায়বিয়াতে ২০ দিন অবস্থান করেন। অতঃপর মদীনায় ফিরে যান। যাতায়াতসহ সর্বমোট দেড় মাস তাঁরা এই সফরে অতিবাহিত করেন (সীরাহ ছহীহাহ ২/৪৪৭)।

বলা আবশ্যক যে, হোদায়বিয়ার সন্ধিচুক্তি ১৭ কিংবা ১৮ মাস অব্যাহত ছিল। অতঃপর কুরায়েশরা তা ভঙ্গ করে। ফলে সেটি মক্কা বিজয়ের প্রত্যক্ষ কারণ হিসাবে গণ্য হয়।



প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর ৬৭ পর্বের জীবনীর সকল পর্ব এখান থেকে পড়ুন-

পর্ব-০১   পর্ব-০২   পর্ব-০৩   পর্ব-০৪   পর্ব-০৫   পর্ব-০৬   পর্ব-০৭   পর্ব-০৮   পর্ব-০৯   পর্ব-১০   পর্ব-১১   পর্ব-১২   পর্ব-১৩   পর্ব-১৪   পর্ব-১৫   পর্ব-১৬   পর্ব-১৭   পর্ব-১৮   পর্ব-১৯   পর্ব-২০   পর্ব-২১   পর্ব-২২   পর্ব-২৩   পর্ব-২৪   পর্ব-২৫   পর্ব-২৬   পর্ব-২৭   পর্ব-২৮   পর্ব-২৯   পর্ব-৩০    পর্ব-৩১   পর্ব-৩২   পর্ব-৩৩   পর্ব-৩৪   পর্ব-৩৫   পর্ব-৩৬   পর্ব-৩৭   পর্ব-৩৮   পর্ব-৩৯   পর্ব-৪০   পর্ব-৪১   পর্ব-৪২   পর্ব-৪৩   পর্ব-৪৪   পর্ব-৪৫   পর্ব-৪৬(১ম) পর্ব-৪৬(২য়)    পর্ব-৪৭   পর্ব-৪৮   পর্ব-৪৯   পর্ব-৫০   পর্ব-৫১   পর্ব-৫২   পর্ব-৫৩   পর্ব-৫৪   পর্ব-৫৫   পর্ব-৫৬   পর্ব-৫৭   পর্ব-৫৮   পর্ব-৫৯   পর্ব-৬০   পর্ব-৬১   পর্ব-৬২   পর্ব-৬৩   পর্ব-৬৪   পর্ব-৬৫   পর্ব-৬৬   পর্ব-৬৭  




******************************************
>>> Welcome, You are now on Mohammadia Foundation's Website. Please stay & Tune with us>>>



এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url