প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর জীবনী [পর্ব- ৫১] || মহানবীর জীবনী ||





তাবূক অভিযান থেকে রাসুলুল্লাহ (ছাঃ) এর মদিনায় প্রত্যাবর্তন, নবী কন্যা কুলসুমের মৃত্যু

[পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ট মহামানব আমাদের প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:)। যাকে আল্লাহ সমস্ত মানুষের জন্য অশেষ রহমত স্বরূপ এই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। যে নবী সারা জীবন উম্মতের জন্য সংগ্রাম করেছেন, কাল রোজ হাশরের মাঠেও যিনি উম্মতের জন্যই পেরেশান থাকবেন ইয়া উম্মতি ইয়া উম্মতি বলে বিচলিত হবেন; সেই প্রাণপ্রিয় নবীকে আমরা কতটুকু চিনি, কতটুকু জানি? প্রিয় নবী (সা:) এর জীবনের পরতে পরতে রয়েছে আমাদের জন্য শিক্ষা ও অনুপ্রেরণা। যার জীবনী পড়লে নিজের অজান্তেই চোখের পানি গড়িয়ে পড়ে। সেই নবীর জীবনী কি আমরা সত্যিই জানি? আসুন, আরেকবার দেখে নেই “প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর জীবনী”। যে জীবনী পড়ে বদলে যেতে পারে আপনার আমার জীবন। আমরা এখানে প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর বিশাল কর্মময় জীবনকে ৬৭টি সুবিশাল পর্বে তুলে ধরেছি। আল্লাহ আমাদের সবাইকে প্রাণপ্রিয় নবীর (সা:) উম্মত হিসাবে কবুল করুন। আমিন।।]

তাবূক ছেড়ে মদীনার পথে রাসূল (ছাঃ)

২০ দিন তাবূকে অবস্থানের পর এবং স্থানীয় খ্রিষ্টান ও অন্যান্য গোত্রগুলির সাথে সন্ধিচুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে রোমক বাহিনীর সাথে কোনরূপ সংঘর্ষ ও রক্তক্ষয় ছাড়াই বিজয় সম্পন্ন ও সুসংহত করার পর রাসূল (ছাঃ) মদীনার পথে রওয়ানা হ’লেন।

বিনা রক্তপাতে যুদ্ধ জয়ের পর যখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও তাঁর সাথীগণ সহাস্য বদনে মদীনায় ফিরে চললেন, তখন মুনাফিক নেতা আব্দুল্লাহ ইবনু উবাইয়ের গোপন সাথী যারা ছিল, তারা প্রমাদ গুণলো এবং রাসূল (ছাঃ)-কে পথিমধ্যেই হত্যার পরিকল্পনা করল।

তাবূক থেকে ফেরার পথে রাসূল (ছাঃ)-কে হত্যার চেষ্টা

মদীনায় ফেরার পথে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একটি সংকীর্ণ গিরিসংকট অতিক্রম করছিলেন। এ সময় তাঁর সাথে কেবল ‘আম্মার বিন ইয়াসির ও হুযায়ফা ইবনুল ইয়ামান ছিলেন। ‘আম্মার রাসূল (ছাঃ)-এর উষ্ট্রীর লাগাম ধরে সামনে হাঁটছিলেন এবং হুযায়ফা পিছনে থেকে উষ্ট্রী হাঁকাচিছলেন। মুসলিম বাহিনী তখন পিছনে উপত্যকায় ছিল। ১২ জন মুনাফিক যারা এতক্ষণ সুযোগের অপেক্ষায় ছিল, তারা মুখোশ পরে দ্রুত এগিয়ে এসে ঐ গিরিসংকটে প্রবেশ করল এবং পিছন থেকে অতর্কিতে রাসূল (ছাঃ)-কে হত্যা করতে উদ্যত হ’ল। হঠাৎ পদশব্দে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) পিছন ফিরে তাকান এবং হুযায়ফাকে ওদের ঠেকানোর নির্দেশ দেন। হুযায়ফা তাঁর ঢাল দিয়ে ওদের বাহনগুলির মুখের উপরে আঘাত করতে থাকেন। এতেই আল্লাহর ইচ্ছায় তারা ভীত হয়ে পিছন ফিরে দৌড় দিয়ে দ্রুত সেনাবাহিনীর মধ্যে হারিয়ে যায়।

এভাবেই মুনাফিকরা অন্যান্য সময়ের ন্যায় এবারেও রাসূল (ছাঃ)-এর ক্ষতি সাধনে ব্যর্থ হ’ল। এ বিষয়ে আল্লাহ বলেন,وَهَمُّوْا بِمَا لَمْ يَنَالُوْا ‘তারা চেয়েছিল সেটাই করতে, যা তারা পারেনি’ (তওবাহ ৯/৭৪)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদের সকলের নাম ও তাদের অসদুদ্দেশ্য সম্পর্কে হুযায়ফাকে অবহিত করেন। তবে সেগুলি প্রকাশ করতে নিষেধ করেন। একারণে হুযায়ফাকেصَاحِبُ سِرِّ رَّسُوْلِ اللهِ صلى الله عليه وسلم ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর গোপন রহস্যবিদ’ বলে অভিহিত করা হয়’।[1] ঐ মুনাফিকদের সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,إِنَّ فِىْ أُمَّتِىْ اثْنَا عَشَرَ مُنَافِقًا لاَ يَدْخُلُوْنَ الْجَنَّةَ وَلاَ يَجِدُوْنَ رِيْحَهَا حَتَّى يَلِجَ الْجَمَلُ فِىْ سَمِّ الْخِيَاطِ ‘আমার উম্মতের মধ্যে ১২ জন মুনাফিক রয়েছে, যারা জান্নাতে প্রবেশ করবে না এবং জান্নাতের সুগন্ধিও পাবে না। তাদের জান্নাতে যাওয়া ঐরূপ অসম্ভব, যেরূপ সূঁচের ছিদ্রপথে উটের প্রবেশ অসম্ভব’।[2] ফলে মদীনায় কেউ মারা গেলে ওমর (রাঃ) তার জানাযায় যাওয়ার পূর্বে খোঁজ নিতেন হুযায়ফা যাচ্ছেন কি-না। হুযায়ফা না গেলে তিনি যেতেন না, এই কারণে যে, যদি ঐ মৃত ব্যক্তি ঐ মুনাফিকদের মধ্যকার কেউ হয়।[3]

[1]. তিরমিযী হা/৩৮১১; মিশকাত হা/৬২২৩।
[2]. মুসলিম হা/২৭৭৯; মিশকাত হা/৫৯১৭।
[3]. আল-বিদায়াহ ৫/১৯; আল-ইছাবাহ ক্রমিক ১৬৪৯; মির‘আত ১/১৪০ ‘হুযায়ফার জীবনী’ দ্রষ্টব্য।

মদীনায় উপস্থিতি ও মদীনাবাসীর অভিনন্দন

দূর হ’তে দেখতে পেয়ে খুশীতে রাসূল (ছাঃ) বলে ওঠেন,هَذِهِ طَابَةٌ وَهَذَا أُحُدٌ ‘এই যে মদীনা, এই যে ওহোদ’। جَبَلٌ يُحِبُّنَا وَنُحِبُّهُ ‘এই পাহাড় আমাদের ভালবাসে এবং আমরা একে ভালবাসি’।[1] মদীনার নারী-শিশু ও বালকেরা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বিপুল উৎসাহে রাসূল (ছাঃ) ও তাঁর সেনাবাহিনীকে অভিনন্দন জানান।[2]

উল্লেখ্য যে, এটাই ছিল রাসূল (ছাঃ)-এর জীবনের সর্বশেষ যুদ্ধ। ৫০ দিনের এই সফরে ৩০ দিন যাতায়াতে ও ২০ দিন ছিল তাবূকে অবস্থান (আহমাদ হা/১৪১৭২)। রজব মাসে গমন ও রামাযান মাসে প্রত্যাবর্তন।[3]

[1]. বুখারী হা/৪৪২২; মুসলিম হা/১৩৯২।
[2]. ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, এসময় মদীনার নারী-শিশু ও বালকেরা বেরিয়ে রাসূল (ছাঃ)-কে অভিনন্দন জানিয়ে طَلَعَ الْبَدْرُ عَلَيْنَا + مِنْ ثَنِيَّاتِ الْوَدَاع، وَجَبَ الشُّكْرُ عَلَيْنَا + مَا دَعَا ِللهِ دَاعِ কবিতা পাঠ করেন (যাদুল মা‘আদ ৩/৪৮২; আর-রাহীক্ব ৪৩৬ পৃঃ)।
বায়হাক্বী বলেন, আমাদের বিদ্বানগণ এটিকে মক্কা থেকে মদীনায় হিজরতকালীন সময়ের কথা বলেছেন, তাবূক থেকে ফেরার সময় নয়’ (আল-বিদায়াহ ৫/২৩)। জীবনীকার আলী আল-হালাবী (৯৭৫-১০৪৪ হি.) বলেন, ولا مانع من تعدد ذلك ‘এটি একাধিক বার হওয়ায় কোন বাধা নেই’ (সীরাহ হালাবিইয়াহ ৩/১২৩)। তাছাড়া ‘ছানিয়াহ’ বা টিলা মক্কা ও তাবূক দু’দিকে হওয়াটা অসম্ভব নয়। বস্ত্ততঃ এ ব্যাপারে প্রমাণিত সেটুকুই যা উপরে ছহীহ হাদীছ সমূহে বর্ণিত হয়েছে। বিস্তারিত দ্রষ্টব্য : ‘১ম জুম‘আ আদায় ও ইয়াছরিবে প্রবেশ’ অনুচ্ছেদ, টীকা-৩২২।
[3]. ইবনু হিশাম ২/৫১৫-১৬, ৫৩৭; যাদুল মা‘আদ ৩/৪৯১; আর-রাহীক্ব ৪৩৬ পৃঃ।

মদীনায় ফেরার পরবর্তী ঘটনাবলী

মুনাফিকদের ওযর কবুল

মদীনায় পৌঁছে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সর্বপ্রথম মসজিদে নববীতে দু’রাক‘আত নফল ছালাত আদায় করেন। অতঃপর সেখানেই লোকজনের সাথে বসে পড়েন। এ সময় ৮০ জনের অধিক লোক এসে তাদের যুদ্ধে গমন না করার পক্ষে নানা ওযর-আপত্তি পেশ করে ক্ষমা চাইতে থাকে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদের ক্ষমা করে দেন ও আনুগত্যের বায়‘আত গ্রহণ করেন এবং তাদের হৃদয়ের গোপন বিষয়সমূহ আল্লাহর উপরে ছেড়ে দেন। তবে এদের ওযর সমূহ যে কপটতাপূর্ণ ছিল, সে বিষয়ে আল্লাহ সূরা তওবার ৯৪-৯৮ আয়াতে বর্ণনা করেছেন এবং রাসূল (ছাঃ) রাযী হ’লেও আল্লাহ যে কখনো তাদের উপরে রাযী হবেন না, সেকথা বলে দেন। যেমন আল্লাহ বলেন,يَحْلِفُوْنَ لَكُمْ لِتَرْضَوْا عَنْهُمْ فَإِنْ تَرْضَوْا عَنْهُمْ فَإِنَّ اللهَ لاَ يَرْضَى عَنِ الْقَوْمِ الْفَاسِقِيْنَ ‘তারা তোমাদের নিকট শপথ করবে যেন তোমরা তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে যাও। যদি তোমরা তাদের প্রতি রাযী হয়ে যাও, তবু আল্লাহ তো ফাসেক কওমের উপর রাযী হন না’ (তওবা ৯/৯৬)। এভাবেই মুনাফিকদের সাথে মুমিনদের পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে যায়। আল্লাহর ভাষায়مَا كَانَ اللهُ لِيَذَرَ الْمُؤْمِنِيْنَ عَلَى مَا أَنْتُمْ عَلَيْهِ حَتَّى يَمِيْزَ الْخَبِيْثَ مِنَ الطَّيِّبِ ‘আল্লাহ মুমিনদেরকে বর্তমান অবস্থায় ছেড়ে দিতে পারেন না, যতক্ষণ না অপবিত্র লোকগুলিকে পবিত্রদের থেকে পৃথক করে দেন’ (আলে ইমরান ৩/১৭৯)। অবশ্য আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই ও তার দলবল উক্ত ৮০ জনের বাইরে ছিল। যাদের সংখ্যা ছিল অনেক বেশী।[1]

পিছনে থাকা তিনজন খাঁটি মুমিনের অবস্থা

আনছারদের তিনজন শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি, যারা স্রেফ সাময়িক বিচ্যুতির কারণে যুদ্ধে গমন থেকে পিছিয়ে ছিলেন, তাঁরা ওযর-আপত্তি না তুলে সরাসরি সত্য কথা বলেন। এঁরা হলেন, ১- হযরত কা‘ব বিন মালেক, যিনি মক্কায় ঐতিহাসিক বায়‘আতে আক্বাবায় অংশগ্রহণকারী ৭৩ জন পুরুষ ছাহাবীর অন্যতম ছিলেন। ২- মুরারাহ বিন রবী‘ এবং ৩- হেলাল বিন উমাইয়া। এরা ইতিহাসে ‘আল-মুখাল্লাফূন’(الْمُخَلَّفُوْنَ) বা ‘পিছিয়ে থাকা ব্যক্তিগণ’ বলে পরিচিত হয়েছেন।

এঁরা সবাই ছিলেন অত্যন্ত মুখলেছ এবং রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে বিভিন্ন জিহাদে অংশগ্রহণকারী ছাহাবী। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাঁদের ওযর কবুল করলেন এবং তাদেরকে পূর্ণ বয়কটের নির্দেশ দিলেন। অতঃপর তাদের তওবা কবুলের বিষয়টি আল্লাহর উপরে ছেড়ে দিলেন। তাদের বিরুদ্ধে বয়কট চল্লিশ দিন অতিবাহিত হয়। এরি মধ্যে তাদের অবস্থা কঠিন আকার ধারণ করল। আপনজন ও বন্ধু-বান্ধব কেউ তাদের দিকে ফিরেও তাকায় না। কথাও বলে না। সালাম দিলেও জবাব দেয় না। মুখ ফিরিয়ে চলে যায়। এই দুর্বিষহ জীবনে দুঃখে-বেদনায় প্রাণ ওষ্ঠাগত হবার উপক্রম হয়। চল্লিশ দিনের মাথায় তাদের প্রতি স্ত্রী থেকে পৃথক থাকার নির্দেশ এল। ফলে তারা স্ব স্ব স্ত্রীদের পিতৃগৃহে পাঠিয়ে দিলেন। যা তাদের অবস্থাকে আরও সংকটাপন্ন করে তুলল। তারা সর্বদা আল্লাহর দরবারে কেঁদে বুক ভাসাতে থাকেন। এই বয়কট চলাকালে হযরত কা‘ব বিন মালেক আরেকটি কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হন। গাসসান অধিপতি তাঁর নিকটে একটি পত্র পাঠিয়ে তাদের তিনজনের প্রতি সহানুভূতি জানান এবং কা‘বকে তাঁর দরবারে আমন্ত্রণ জানান। পত্রে বলা হয় যে, ‘আমরা জানতে পেরেছি, তোমাদের মনিব তোমাদের প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শন করেছেন। আল্লাহ তোমাকে লাঞ্ছনা ও অবমাননার জন্য রাখেননি এবং তোমাকে নষ্ট করতে চান না। তুমি আমাদের কাছে চলে এসো। আমরা তোমার প্রতি খেয়াল রাখব ও যথোপযুক্ত মর্যাদা দেব’। চিঠি পড়েই কা‘ব বলেন, এটাও একটি পরীক্ষা’। তিনি বলেন, এরপর আমি পত্রটা একটা জ্বলন্ত চুলায় নিক্ষেপ করলাম’ (বুখারী হা/৪৪১৮)। অতঃপর ৫০ দিনের মাথায় তাদের খালেছ তওবা কবুল হ’ল এবং নিম্নোক্ত আয়াত নাযিল হ’ল।-

وَعَلَى الثَّلاَثَةِ الَّذِيْنَ خُلِّفُوْا حَتَّى إِذَا ضَاقَتْ عَلَيْهِمُ الْأَرْضُ بِمَا رَحُبَتْ وَضَاقَتْ عَلَيْهِمْ أَنْفُسُهُمْ وَظَنُّوْا أَنْ لاَ مَلْجَأَ مِنَ اللهِ إِلاَّ إِلَيْهِ ثُمَّ تَابَ عَلَيْهِمْ لِيَتُوْبُوْا إِنَّ اللهَ هُوَ التَّوَّابُ الرَّحِيْمُ-

‘এবং আল্লাহ দয়াশীল হন সেই তিন ব্যক্তির উপরে, যারা (জিহাদ থেকে) পিছনে ছিল। তাদের অবস্থা এমন হয়েছিল যে, প্রশস্ত যমীন তাদের উপরে সংকীর্ণ হয়ে পড়েছিল ও তাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল। তারা দৃঢ় বিশ্বাস পোষণ করেছিল যে, আল্লাহ ব্যতীত তাদের অন্য কোন আশ্রয়স্থল নেই। অতঃপর আল্লাহ তদের তওবা কবুল করেন যাতে তারা ফিরে আসে। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বাধিক তওবা কবুলকারী ও অসীম দয়ালু’ (তওবাহ ৯/১১৮)।

তওবা কবুলের উক্ত আয়াত নাযিলের সাথে সাথে মুমিনদের মধ্যে আনন্দের ঢেউ উঠে গেল। সকলে দান-ছাদাক্বায় লিপ্ত হ’ল। এমন আনন্দ তারা জীবনে পায়নি। এটাই ছিল যেন তাদের জীবনের সবচেয়ে সৌভাগ্যময় দিন।

কা‘ব বিন মালিক তার বাড়ীর ছাদে নিঃসঙ্গভাবে দুঃখে-বেদনায় পড়েছিলেন। এমন সময় নিকটবর্তী সালা‘ (سَلْع) পাহাড়ের উপর থেকে একজন আহবানকারীর আওয়ায শোনা গেল-يَا كَعْبَ بْنَ مَالِكٍ أَبْشِرْ ‘হে কা‘ব বিন মালেক! সুসংবাদ গ্রহণ কর’।

কা‘ব বলেন, এ সংবাদ শুনেই আমি সিজদায় পড়ে যাই। অতঃপর দৌড়ে রাসূল (ছাঃ)-এর দরবারে চলে যাই। বন্ধু-বান্ধব চারদিক থেকে ছুটে এসে অভিনন্দন জানাতে থাকে। সারা মদীনায় আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হাস্যোজ্জ্বল মুখে আমাকে বলেন,أَبْشِرْ بِخَيْرِ يَوْمٍ مَرَّ عَلَيْكَ مُنْذُ وَلَدَتْكَ أُمُّكَ ‘সুসংবাদ গ্রহণ কর! জন্মের পর থেকে এমন আনন্দের দিন তোমার জীবনে আর কখনো আসেনি’। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! এ (ক্ষমা) আপনার পক্ষ থেকে, না আল্লাহর পক্ষ থেকে? তিনি বললেন, আল্লাহর পক্ষ থেকে। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! এর শুকরিয়া স্বরূপ আমি আমার সম্পদ থেকে আল্লাহর রাহে ছাদাক্বা করতে চাই। রাসূল (ছাঃ) বললেন, কিছু অংশ রেখে দাও। সেটা তোমার জন্য উত্তম হবে। আমি বললাম, খায়বরের গণীমতের অংশ আমি রেখে দিয়েছি। অতঃপর আমি বললাম, সত্য কথা বলার জন্য আল্লাহ আমাকে নাজাত দিয়েছেন। অতএব আমার তওবা এই যে, যতদিন বেঁচে থাকব কখনই সত্য ছাড়া বলবো না। আল্লাহর কসম! রাসূল (ছাঃ)-এর সামনে সত্য বলার আগ পর্যন্ত মুসলমানদের মধ্যে সত্য কথা বলার জন্য আমার মত পরীক্ষা কাউকে দিতে হয়েছে বলে আমি জানতে পারিনি’।[2]

সত্যিকারের অপারগদের জন্য সুসংবাদ

মদীনায় এমন বহু মুমিন ছিলেন, যারা মনের দিক দিয়ে সর্বক্ষণ রাসূল (ছাঃ)-এর সাথী ছিলেন, কিন্তু শারীরিক দুর্বলতা, আর্থিক অপারগতা, বাহনের অপ্রাপ্যতা বা অনিবার্য কোন কারণবশতঃ যুদ্ধে যেতে পারেননি। তাদের এই অক্ষমতার জন্য তারা যেমন দুঃখিত ও লজ্জিত ছিলেন, তেমনি ভীত ছিলেন এজন্য যে, আল্লাহ তাদের ক্ষমা করবেন কি-না। আল্লাহ তাদের অন্তরের খবর রাখেন। তাই তাদের ক্ষমার সুসংবাদ দিয়ে আয়াত নাযিল হ’ল-

لَقَدْ تَابَ اللهُ عَلَى النَّبِيِّ وَالْمُهَاجِرِينَ وَالْأَنْصَارِ الَّذِينَ اتَّبَعُوهُ فِي سَاعَةِ الْعُسْرَةِ مِنْ بَعْدِ مَا كَادَ يَزِيغُ قُلُوبُ فَرِيقٍ مِنْهُمْ ثُمَّ تَابَ عَلَيْهِمْ إِنَّهُ بِهِمْ رَؤُوفٌ رَحِيمٌ-

‘অবশ্যই আল্লাহ দয়াশীল হয়েছেন নবীর প্রতি এবং মুহাজির ও আনছারদের প্রতি, যারা দুঃসময়ে তার অনুসারী হয়েছিল, তাদের এক দলের অন্তর টলে যাওয়ার উপক্রম হওয়ার পর। অতঃপর তিনি তাদের প্রতি দয়াপরবশ হ’লেন। নিশ্চয়ই তিনি তাদের প্রতি স্নেহশীল ও করুণাময় (তওবাহ ৯/১১৭)। আরও নাযিল হয়,-

لَيْسَ عَلَى الضُّعَفَاءِ وَلاَ عَلَى الْمَرْضَى وَلاَ عَلَى الَّذِيْنَ لاَ يَجِدُوْنَ مَا يُنْفِقُوْنَ حَرَجٌ إِذَا نَصَحُوْا لِلَّهِ وَرَسُوْلِهِ مَا عَلَى الْمُحْسِنِيْنَ مِنْ سَبِيْلٍ وَاللهُ غَفُوْرٌ رَحِيْمٌ-

‘কোন অভিযোগ নেই ঐসব লোকদের প্রতি, যারা দুর্বল, রোগী এবং (যুদ্ধের সফরে) ব্যয়ভার বহনে অক্ষম, যখন তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল-এর প্রতি আন্তরিক নিষ্ঠা পোষণ করে। সদাচারী লোকদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নেই। আর আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়াবান’ (তওবাহ ৯/৯১)।

মদীনার কাছাকাছি পৌঁছে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) এইসব লোকদের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেছিলেন,إِنَّ بِالْمَدِينَةِ أَقْوَامًا مَا سِرْتُمْ مَسِيرًا وَلاَ قَطَعْتُمْ وَادِيًا إِلاَّ كَانُوا مَعَكُمْ قَالُوا يَا رَسُولَ اللهِ وَهُمْ بِالْمَدِينَةِ قَالَ وَهُمْ بِالْمَدِينَةِ ، حَبَسَهُمُ الْعُذْرُ ‘মদীনায় এমন কিছু লোক রয়েছে, তোমরা যেখানেই সফর করেছ, বা যে উপত্যকা অতিক্রম করেছ, তারা সর্বদা তোমাদের সঙ্গে থেকেছে। ছাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! তারা মদীনায় থেকেও আমাদের সঙ্গে ছিল? রাসূল (ছাঃ) বললেন, হ্যাঁ তারা মদীনায় থেকেও তোমাদের সঙ্গে ছিল। ওযর তাদেরকে আটকে রেখেছিল’(حَبَسَهُمُ الْعُذْرُ)।[3]

মুনাফিকদের প্রতি কঠোর হওয়ার নির্দেশ

তাবূক যুদ্ধের সময় মুনাফিকরা যে ন্যাক্কারজনক ভূমিকা পালন করেছিল, তা ছিল ক্ষমার অযোগ্য। বিশেষ করে বহিঃশক্তি রোমক বাহিনীকে মদীনা আক্রমণের আহবান জানানো ও তার জন্য ষড়যন্ত্রের আখড়া হিসাবে ক্বোবায় ‘মসজিদে যেরার’ নির্মাণ ছিল রীতিমত রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক অপরাধ। এ প্রেক্ষিতে এদের অপতৎপরতা যাতে আর বৃদ্ধি পেতে না পারে এবং রাসূল (ছাঃ)-এর উদারতাকে তারা দুর্বলতা না ভাবে, সেকারণ আল্লাহ স্বীয় রাসূলকে তাদের ব্যাপারে কঠোর হবার নির্দেশ দিয়ে বলেন,يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ جَاهِدِ الْكُفَّارَ وَالْمُنَافِقِيْنَ وَاغْلُظْ عَلَيْهِمْ وَمَأْوَاهُمْ جَهَنَّمُ وَبِئْسَ الْمَصِيْرُ ‘হে নবী! কাফের ও মুনাফিকদের বিরুদ্ধে জিহাদ কর ও তাদের প্রতি কঠোর হও। তাদের ঠিকানা হ’ল জাহান্নাম এবং সেটি কতই না মন্দ ঠিকানা’ (তওবাহ ৯/৭৩)। এখানে মুনাফিকদের সাথে জিহাদের অর্থ ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, মৌখিক কঠোরতার জিহাদ (ইবনু কাছীর)। কেননা আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) কখনোই তাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ করেননি বা তাদেরকে হত্যা করেননি।

মসজিদে যেরার ধ্বংস

রোমকদের কেন্দ্রভূমি সিরিয়া থেকে ষড়যন্ত্রকারী আবু ‘আমের আর-রাহেব-এর পত্র মোতাবেক মদীনার ১২ জন মুনাফিক ক্বোবা মসজিদের অদূরে একটি মসজিদ নির্মাণ করে (কুরতুবী, তাফসীর সূরা তওবা ১০৭)। এটা তাদের চক্রান্ত ও অস্ত্র সংগ্রহের কেন্দ্র হলেও সাধারণ মুসলমানদের ধোঁকা দেওয়ার জন্য তারা এটাকে ‘মসজিদ’ নাম দেয় এবং রাসূল (ছাঃ)-কে সেখানে গিয়ে ছালাত আদায়ের জন্য দাওয়াত দেয়। অজুহাত হিসাবে তারা বলেছিল যে, এটি তারা নির্মাণ করছে দুর্বলদের জন্য এবং অসুস্থদের জন্য, যারা শীতের রাতে কষ্ট করে দূরের মসজিদে যেতে পারে না তাদের জন্য। তারা বলে, আমরা চাই যে, আপনি সেখানে ছালাত আদায় করুন এবং আমাদের জন্য বরকতের দো‘আ করুন’। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সরল মনে তাদের দাওয়াত কবুল করেন এবং তাবূক যুদ্ধ থেকে ফিরে এসে সেখানে যাবেন বলে ওয়াদা করেন। কিন্তু তাবূক থেকে ফেরার সময় এক ঘণ্টার পথ বাকী থাকতে তিনি যখন মদীনার নিকটবর্তী যু-আওয়ান(ذُو أَوَان) নামক স্থানে অবতরণ করেন, তখন তাঁর নিকটে মুনাফিকদের ঐ ষড়যন্ত্র ফাঁস করে দিয়ে নিম্নোক্ত আয়াত নাযিল হয়,

وَالَّذِينَ اتَّخَذُوْا مَسْجِدًا ضِرَارًا وَكُفْرًا وَتَفْرِيْقًا بَيْنَ الْمُؤْمِنِيْنَ وَإِرْصَادًا لِمَنْ حَارَبَ اللهَ وَرَسُولَهُ مِنْ قَبْلُ وَلَيَحْلِفُنَّ إِنْ أَرَدْنَا إِلاَّ الْحُسْنَى وَاللهُ يَشْهَدُ إِنَّهُمْ لَكَاذِبُونَ- لاَ تَقُمْ فِيْهِ أَبَدًا لَمَسْجِدٌ أُسِّسَ عَلَى التَّقْوَى مِنْ أَوَّلِ يَوْمٍ أَحَقُّ أَنْ تَقُومَ فِيْهِ فِيْهِ رِجَالٌ يُحِبُّونَ أَنْ يَتَطَهَّرُوا وَاللهُ يُحِبُّ الْمُطَّهِّرِيْنَ-

‘আর যারা মসজিদ তৈরী করেছে ক্ষতি সাধনের জন্য, কুফরী করার জন্য ও মুমিনদের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টির জন্য এবং আল্লাহ ও তার রাসূল-এর বিরুদ্ধে পূর্ব থেকেই যুদ্ধকারীদের ঘাঁটি করার জন্য, তারা অবশ্যই শপথ করে বলবে যে, আমরা সদুদ্দেশ্যেই এটা করেছি। অথচ আল্লাহ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, ওরা অবশ্যই মিথ্যাবাদী’। ‘তুমি কখনোই উক্ত মসজিদে দন্ডায়মান হবে না। যে মসজিদ প্রথম দিন থেকে তাক্বওয়ার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে, সেটাই তোমার (ছালাতের জন্য) দাঁড়াবার যথাযোগ্য স্থান। সেখানে এমন সব লোক রয়েছে, যারা উত্তমরূপে পরিশুদ্ধ হওয়াকে ভালবাসে। বস্তুতঃ আল্লাহ পবিত্রতা অর্জনকারীদের ভালবাসেন’ (তওবাহ ৯/১০৭-০৮)।

প্রকৃত ঘটনা অবহিত হয়ে মদীনায় উপস্থিত হওয়ার পর আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) প্রাথমিক কাজকর্ম সেরে মালেক বিন দুখশুম, মা‘আন বিন ‘আদী, ‘আমের বিন সাকান এবং ওহোদ যুদ্ধে হামযা (রাঃ)-এর হত্যাকারী ওয়াহশী বিন হারবকে নির্দেশ দিলেন মসজিদ নামক উক্ত ষড়যন্ত্রের ঘাঁটিকে গুঁড়িয়ে ও পুড়িয়ে নিশ্চিহ্ন করে আসার জন্য।[4] তারা সঙ্গে সঙ্গে গিয়ে উক্ত গৃহটি সমূলে উৎপাটিত করে পুড়িয়ে নিশ্চিহ্ন করে দেন। মসজিদে ক্বোবা থেকে অনতিদূরে উক্ত অভিশপ্ত স্থানটি আজও বিরান পড়ে আছে। এই সময় সূরা তওবায় মুনাফিকদের মুখোশ উন্মোচন করে অনেকগুলি আয়াত নাযিল হয়। ফলে তারা সমাজে চিহ্নিত হয়ে যায় এবং একেবারেই কোনঠাসা হয়ে পড়ে।[5]

অতঃপর মাত্র তিন মাসের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ আরও কতগুলি ঘটনা ঘটে। যেমন-

লে‘আন-এর ঘটনা

স্বামী যদি স্ত্রীর প্রতি ব্যভিচারের অপবাদ দেয়, আর তার কোন সাক্ষী না থাকে, সে অবস্থায় যে পদ্ধতির মাধ্যমে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটানো হয়, তাকে লে‘আন বলা হয়। পদ্ধতি এই যে, স্বামী ও স্ত্রী উভয়ে আদালতে বিচারকের সম্মুখে দাঁড়াবে। অতঃপর স্বামী আল্লাহর কসম করে চারবার বলবে যে, সে অবশ্যই সত্যবাদী এবং পঞ্চমবার বলবে, যদি সে মিথ্যাবাদী হয়, তবে তার উপরে আল্লাহর লা‘নত বর্ষিত হৌক (নূর ২৪/৬-৭)। আর ‘স্ত্রীর শাস্তি রহিত হয়ে যাবে যদি সে আল্লাহর কসম করে চারবার বলে যে, তার স্বামী অবশ্যই মিথ্যাবাদী এবং পঞ্চমবারে বলে, যদি তার স্বামী সত্যবাদী হয়, তবে তার উপর আল্লাহর গযব নেমে আসুক’ (নূর ২৪/৮-৯)। হেলাল বিন উমাইয়া এবং ‘উওয়াইমির ‘আজলানীর ঘটনার প্রেক্ষিতে উক্ত আয়াতগুলি নাযিল হয়। অতঃপর আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) তাদের স্বামী-স্ত্রীকে ডেকে এনে মসজিদের মধ্যে লে‘আন করান। উভয় পক্ষে পাঁচটি করে সাক্ষ্য পূর্ণ হয়ে লে‘আন সমাপ্ত হ’লে ‘উওয়াইমের বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! এখন যদি আমি তাকে স্ত্রীরূপে রাখি, তাহ’লে আমি মিথ্যা অপবাদ দানকারী হয়ে যাব। অতএব আমি তাকে তালাক দিলাম’। হেলাল বিন উমাইয়ার ঘটনায় রাসূল (ছাঃ) লে‘আনের পর স্বামী ও স্ত্রীকে বিচ্ছিন্ন করে দেন এবং বলেন যে, স্ত্রীর গর্ভের সন্তান স্ত্রীর বলে কথিত হবে- পিতার সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত হবে না। তবে সন্তানটিকে ধিকৃত করা যাবে না। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,الْمُتَلاَعِنَانِ إِذَا تَفَرَّقَا لاَ يَجْتَمِعَانِ أَبَدًا ‘লে‘আনকারীদ্বয় পৃথক হ’লে তারা কখনোই আর একত্রিত হ’তে পারবে না’।[6] বিচারক বিবাহ বিচ্ছিন্ন করে দেবার পর ইদ্দত পূর্ণ করে উক্ত স্ত্রী অন্যত্র বিবাহ করতে পারবে। এভাবে লে‘আনের মাধ্যমে সে দুনিয়ার শাস্তি থেকে বাঁচলেও আখেরাতের শাস্তি বেড়ে যাবে।

গামেদী মহিলার ব্যভিচারের শাস্তি

গামেদী মহিলার(امرأة غامدية) ব্যভিচারের শাস্তি দানের বিখ্যাত ঘটনাটি এ সময়ে সংঘটিত হয়। উক্ত মহিলা ইতিপূর্বে নিজে এসে ব্যভিচারের স্বীকৃতি দেয় ও গর্ভধারণের কথা বলে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে সন্তান প্রসবের পর আসতে বলেন। অতঃপর ভূমিষ্ট সন্তান কোলে নিয়ে এলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে দুধ ছাড়ানোর পর বাচ্চা শক্ত খাবার খেতে শিখলে পরে আসতে বলেন। অতঃপর বাচ্চার হাতে রুটিসহ এলে এবং রাসূল (ছাঃ)-এর আহবানে জনৈক আনছার ছাহাবী ঐ বাচ্চার লালন-পালনের দায়িত্ব গ্রহণ করলে তাকে ব্যভিচারের শাস্তি স্বরূপ প্রস্তরাঘাতে হত্যা করা হয়।

প্রস্তরাঘাতে ফেটে যাওয়া মাথার রক্তের ছিটা খালেদ বিন অলীদের মুখে এসে লাগলে তিনি গালি দিয়ে কিছু মন্তব্য করেন। তাতে রাসূল (ছাঃ) তাকে ধমক দিয়ে বলেন,مَهْلاً يَا خَالِدُ فَوَالَّذِى نَفْسِى بِيَدِهِ لَقَدْ تَابَتْ تَوْبَةً لَوْ تَابَهَا صَاحِبُ مَكْسٍ لَغُفِرَ لَهُ ‘থাম হে খালেদ! যার হাতে আমার জীবন তার কসম করে বলছি, এই মহিলা এমন তওবা করেছে, যদি রাজস্ব আদায়ে খেয়ানতকারী ব্যক্তিও এমন তওবা করত, তাহ’লে তাকেও ক্ষমা করা হ’ত’। অন্য বর্ণনায় এসেছে, অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তার জানাযা পড়েন। তখন ওমর (রাঃ) বলেন, ‘হে আল্লাহর নবী! আপনি তার জানাযা পড়লেন? অথচ সে যেনা করেছে? জবাবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন,لَقَدْ تَابَتْ تَوْبَةً لَوْ قُسِّمَتْ بَيْنَ سَبْعِيْنَ مِنْ أَهْلِ الْمَدِيْنَةِ لَوَسِعَتْهُمْ، وَهَلْ وَجَدْتَ تَوْبَةً أَفْضَلَ مِنْ أَنْ جَادَتْ بِنَفْسِهَا للهِ تَعَالَى؟ ‘এ মহিলা এমন তওবা করেছে যে, তা সত্তর জন মদীনাবাসীর মধ্যে বণ্টন করে দিলেও যথেষ্ট হয়ে যেত। তুমি কি এর চাইতে উত্তম কোন তওবা পাবে, যে ব্যক্তি স্রেফ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছে?’[7] বস্ত্ততঃ পরকালের কঠিন শাস্তি হ’তে বাঁচার জন্য দুনিয়ায় প্রাণদন্ডের মত কঠোরতম শাস্তি স্বেচ্ছায় বরণ করার এ আকুতি পৃথিবীর কোন সমাজব্যবস্থায় পাওয়া যাবে কি?

নবীকন্যা উম্মে কুলছূমের মৃত্যু

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর কন্যা উম্মে কুলছূম এসময় নিঃসন্তান অবস্থায় মারা যান। আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) তার মৃত্যুতে গভীরভাবে শোকাভিভূত হন। জামাতা ওছমান গণীকে তিনি বলেন, ‘আমার আর কোন মেয়ে থাকলে তাকেও আমি তোমার সাথে বিবাহ দিতাম’ (আল-বিদায়াহ ৫/৩০৯)।

উল্লেখ্য যে, রাসূল (ছাঃ)-এর দ্বিতীয়া কন্যা এবং ওছমান (রাঃ)-এর প্রথমা স্ত্রী রুক্বাইয়া মাত্র ২১ বছর বয়সে ২য় হিজরীর রামাযান মাসে বদরের যুদ্ধের সুসংবাদ মদীনায় পৌঁছার দিন মারা যান। অতঃপর ৩য় হিজরীতে ওছমানের সাথে উম্মে কুলছূমের বিবাহ হয়। ৯ম হিজরীতে তার মৃত্যুর পরে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এতই ব্যথিত হন যে, তিনি কবরের পাশে বসে পড়েন। এ সময় তাঁর গন্ড বেয়ে অবিরলধারে অশ্রুবন্যা বয়ে যাচ্ছিল।[8]

ইবনে উবাইয়ের মৃত্যু

এ সময় মুনাফিক নেতা আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের মৃত্যু হয়। তার ছেলে আব্দুল্লাহ, যিনি উত্তম ছাহাবী ছিলেন, তার দাবী অনুযায়ী তার কাফন পরানোর জন্য রাসূল (ছাঃ) নিজের ব্যবহৃত জামা তাকে প্রদান করেন ও জানাযা পড়তে সম্মত হন। অতঃপর তিনি জানাযায় গমনের জন্য উঠে দাঁড়ালে ওমর (রাঃ) তাঁর কাপড় টেনে ধরে বলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আপনি তার জানাযার ছালাত আদায় করবেন, অথচ আল্লাহ কি আপনাকে মুনাফিকদের জানাযা পড়তে নিষেধ করেন নি? তখন মুচকি হেসে রাসূল (ছাঃ) বললেন, ‘সরে যাও হে ওমর! আমাকে এ ব্যাপারে এখতিয়ার দেওয়া হয়েছে। যদি আমি জানতাম ৭০ বারের অধিক মাগফেরাত কামনা (তওবা ৯/৮০) করলে তাকে ক্ষমা করা হবে, তাহ’লে আমি তার চেয়ে অধিকবার ক্ষমা চাইতাম। ওমর বললেন, সে তো মুনাফিক! অতঃপর রাসূল (ছাঃ) তার জানাযার ছালাত আদায় করলেন এবং ফিরে এলেন। এর কিছু পরেই মুনাফিকদের জানাযায় অংশগ্রহণের উপরে চূড়ান্ত নিষেধাজ্ঞা জারী করে নিম্নোক্ত আয়াত নাযিল হয়,

وَلاَ تُصَلِّ عَلَى أَحَدٍ مِّنْهُمْ مَاتَ أَبَدًا وَلاَ تَقُمْ عَلَى قَبْرِهِ إِنَّهُمْ كَفَرُوْا بِاللهِ وَرَسُوْلِهِ وَمَاتُوْا وَهُمْ فَاسِقُوْنَ ‘তাদের মধ্যে কারু মৃত্যু হ’লে কখনোই তার জানাযা পড়বে না এবং তার কবরে দাঁড়াবে না। তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি কুফরী করেছে (অর্থাৎ তাঁর বিধানকে প্রত্যাখ্যান করেছে)। আর তারা মৃত্যুবরণ করেছে পাপাচারী অবস্থায়’ (তওবা ৯/৮৪)। আরও নাযিল হয়,سَوَاءٌ عَلَيْهِمْ أَسْتَغْفَرْتَ لَهُمْ أَمْ لَمْ تَسْتَغْفِرْ لَهُمْ لَنْ يَغْفِرَ اللهُ لَهُمْ إِنَّ اللهَ لاَ يَهْدِي الْقَوْمَ الْفَاسِقِينَ ‘তুমি তাদের জন্য ক্ষমা চাও বা না চাও, দু’টিই তাদের জন্য সমান। আল্লাহ কখনোই তাদের ক্ষমা করবেন না। নিশ্চয়ই আল্লাহ ফাসেক সম্প্রদায়কে সুপথ প্রদর্শন করেন না’ (মুনাফিকূন ৬৩/৬)। এরপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আর কোন মুনাফিকের জানাযা পড়েননি।[9]

ওমর (রাঃ)-এর এরূপ বলার কারণ, ইতিপূর্বে আয়াত নাযিল হয়েছিল যে,مَا كَانَ لِلنَّبِيِّ وَالَّذِينَ آمَنُوا أَنْ يَسْتَغْفِرُوا لِلْمُشْرِكِينَ ‘নবী বা কোন মুমিনের জন্য উচিত নয় যে, তারা মুশরিকদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুক’ (তওবা ৯/১১৩)। উক্ত আয়াত মক্কায় নাযিল হয়েছিল আবু ত্বালিবের মৃত্যুর সময়। সম্ভবতঃ তার উপরে ভিত্তি করেই ওমর (রাঃ) এরূপ কথা বলে থাকবেন (কুরতুবী, তাফসীর সূরা তওবা ৮৪ আয়াত)।

আব্দুল্লাহ বিন উবাইয়ের সাথে রাসূল (ছাঃ)-এর এরূপ সদাচরণের কারণ তিনি নিজেই উল্লেখ করেছেন। যেমন তিনি বলেন, আমার জামা তাকে আল্লাহর আযাব থেকে বাঁচাতে পারবে না। তবে আমি একাজটি এজন্য করেছি, আমার আশা যে, এর ফলে তার গোত্রের বহু লোক মুসলমান হয়ে যাবে’। ইবনু ইসহাক তার মাগাযীতে এবং কোন কোন তাফসীর গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূল (ছাঃ)-এর এই সদাচরণ দেখে ইবনু উবাইয়ের খাযরাজ গোত্রের এক হাযার লোক মুসলমান হয়ে যায়।[10]

এর আরও কারণ থাকতে পারে। জাবের (রাঃ) বর্ণিত হাদীছে এসেছে যে, বদরের যুদ্ধে বন্দী রাসূল (ছাঃ)-এর চাচা আববাস-এর জন্য একটি জামার প্রয়োজন হ’লে কারু জামা তার গায়ে হয়নি। আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের দেওয়া জামাটিই আববাসের গায়ের জন্য উপযুক্ত হয়’। সেদিনের সেই দানের প্রতিদান হিসাবে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) নিজের জামা তাকে দিয়ে দেন। ইবনু উয়ায়না বলেন, রাসূল (ছাঃ)-এর প্রতি আব্দুল্লাহ বিন উবাইয়ের এটি সৌজন্য ছিল, তাই তিনি তার প্রতিদান দিতে চেয়েছিলেন।[11]

আবুবকরের হজ্জ; বিধি-বিধান সমূহ জারী

হজ্জের বিধি-বিধান জারী করার উদ্দেশ্যে ৯ম হিজরীতে হজ্জের মৌসুমে আবুবকর (রাঃ)-কে ‘আমীরুল হাজ্জ’ হিসাবে মক্কায় পাঠানো হয়। তাদের রওয়ানা হবার পরপরই সূরা তওবাহর প্রথম দিকের আয়াতগুলি নাযিল হয়। যাতে মুশরিকদের সঙ্গে সম্পাদিত ইতিপূর্বেকার সকল চুক্তি বাতিলের নির্দেশ দেওয়া হয়। ফলে সে যুগের নিয়মানুযায়ী রাসূল (ছাঃ)-এর রক্ত সম্পর্কীয় হিসাবে হযরত আলীকে পুনরায় পাঠানো হয়। কেননা পরিবার বহির্ভূত কোন ব্যক্তির মাধ্যমে চুক্তি বাতিলের ঘোষণা সে যুগে স্বীকৃত ছিল না বা কার্যকর হ’ত না। আরাজ (الْعَرْج) অথবা যাজনান (الضَجْنَان) উপত্যকায় গিয়ে আলী (রাঃ) হযরত আবুবকর (রাঃ)-এর কাফেলার সাথে মিলিত হন। তখন আবুবকর (রাঃ) তাকে জিজ্ঞেস করেন,أَمِيْرٌ أَوْ مَأْمُوْرٌ ‘আমীর হিসাবে এসেছেন না মামূর হিসাবে?’ আলী (রাঃ) বললেন,لاَ بَلْ مَأْمُوْرٌ ‘না। বরং মা’মূর হিসাবে’।

অতঃপর হজ্জের বিধি-বিধানসমূহ জারী করার ব্যাপারে আবুবকর (রাঃ) তাঁর দায়িত্ব পালন করলেন। এরপর কুরবানীর দিন হযরত আলী (রাঃ) কংকর নিক্ষেপের স্থান জামরার নিকটে দাঁড়িয়ে রাসূল (ছাঃ)-এর পক্ষে সূরা তওবাহর প্রথম দিককার সংশ্লিষ্ট আয়াতগুলি পড়ে শুনান এবং পূর্বের সকল চুক্তি বাতিলের ঘোষণা দেন। তিনি চুক্তিবদ্ধ ও চুক্তিবিহীন সকলের জন্য চার মাসের সময়সীমা বেঁধে দেন। যাতে এই সময়ের মধ্যে মুশরিকরা চুক্তিতে বর্ণিত বিষয়সমূহ নিষ্পত্তি করে ফেলে। তবে যেসব মুশরিক অঙ্গীকার পালনে কোন ত্রুটি করেনি বা মুসলমানদের বিরুদ্ধে কাউকে সাহায্য করেনি, তাদের চুক্তিনামা পূর্বনির্ধারিত সময় পর্যন্ত বলবৎ রাখা হয়। অতঃপর আবুবকর (রাঃ) একদল লোক পাঠিয়ে ঘোষণা জারী করেন যে,لاَ يَطُوْفُ بِالْبَيْتِ عُرْيَانٌ وَلاَ يَحُجُّ مُشْرِكٌ ‘এখন থেকে আর কোন মুশরিক কা‘বাগৃহে হজ্জ করতে পারবে না এবং কোন ব্যক্তি নগ্ন অবস্থায় কা‘বাগৃহ ত্বাওয়াফ করতে পারবে না’।[12] এর ফলে মূর্তিপূজা চিরকালের জন্য নিষিদ্ধ হ’ল। মূলতঃ ৯ম হিজরীর এই হজ্জ ছিল পরবর্তী বছর রাসূল (ছাঃ)-এর বিদায় হজ্জের প্রাথমিক পর্ব। যাতে ঐ সময় মুশরিকমুক্ত অবস্থায় হজ্জ সম্পন্ন করা যায় এবং মুসলমানদের উদ্দেশ্যে বিদায়ী ভাষণ দেওয়া যায়।

উল্লেখ্য যে, সূরা তওবাহর মোট ১২৯টি আয়াতের মধ্যে অনেকগুলি আয়াত তাবূক যুদ্ধে রওয়ানার প্রাক্কালে, মধ্যে ও ফিরে আসার পর নাযিল হয়’ (আর-রাহীক্ব ৪৩৮-৩৯ পৃঃ)।

[1]. ফাৎহুল বারী ৮/১১৯; আর-রাহীক্ব পৃঃ ৪৩৭, টীকা-১।
[2]. এ বিষয়ে কা‘ব বিন মালেক (রাঃ) বর্ণিত বিস্তারিত বর্ণনা দেখুন বুখারী হা/৪৪১৮; মুসলিম হা/২৭৬৯। মানছূরপুরী এখানে প্রথমে সমস্ত সম্পদ, পরে দুই তৃতীয়াংশ, পরে অর্ধেক এবং শেষে এক তৃতীয়াংশ সম্পদ ছাদাক্বা দানের কথা বলেছেন (রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ১/১৪৫)। কথাটি ভুল। বস্ত্ততঃ সেটি ছিল বদরী ছাহাবী সা‘দ বিন খাওলা (রাঃ)-এর ঘটনা। যিনি বিদায় হজ্জের সময় মক্কায় অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং সেখানেই মাত্র একটি কন্যা সন্তান রেখে মৃত্যুবরণ করেন (আল-ইছাবাহ, সা‘দ বিন খাওলা ক্রমিক ৩১৪৭)। বুখারী ও মুসলিমে তাঁর নাম সা‘দ বিন আবু ওয়াকক্বাছ লেখা হয়েছে (আল-ইছাবাহ, ঐ)। ইবনু হাজার বলেন, ظَاهِرُهُ أَنَّهُ مِنْ قَوْلِ سَعْدِ بْنِ أَبِي وَقَّاصٍ وَيَحْتَمِلُ أَنْ يَكُونَ مِنْ قَوْلِ مَنْ دُونَهُ وَاللهُ أَعْلَمُ ‘প্রকাশ্য মতন অনুযায়ী এটি সা‘দ বিন আবু ওয়াকক্বাছ-এর কথা। তবে এটি তিনি ব্যতীত অন্যের কথা হ’তে পারে। আল্লাহ সর্বাধিক অবগত (ফাৎহুল বারী হা/২৭৪৪-এর আলোচনা)। সা‘দ বিন খাওলা কর্তৃক এক তৃতীয়াংশ সম্পদ ছাদাক্বা দানের বিষয়ে বর্ণিত হাদীছ দ্রষ্টব্য বুখারী হা/১২৯৫; মুসলিম হা/১৬২৮ (৫)। উল্লেখ্য যে, সা‘দ বিন আবু ওয়াকক্বাছ (রাঃ) ৫৫ হিজরীতে মদীনায় মৃত্যুবরণ করেন এবং বাক্বী‘ গোরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয় (আল-ইস্তী‘আব; আল-ইছাবাহ ক্রমিক ৩১৯৬)।
[3]. বুখারী হা/৪৪২৩; মিশকাত হা/৩৮১৫; ইবনু মাজাহ হা/২৭৬৫।
[4]. কুরতুবী, তাফসীর সূরা তওবা ১০৭ আয়াত; ইবনু হিশাম ২/৫৩০; যাদুল মা‘আদ ৩/৪৮১।
[5]. ১২ জন ব্যক্তির মাধ্যমে মসজিদে যেরার তৈরী এবং সেখানে ছালাত আদায়ের জন্য রাসূল (ছাঃ)-কে আমন্ত্রণের উক্ত ঘটনাটি ইবনু ইসহাক বিনা সনদে বর্ণনা করেছেন (ইবনু হিশাম ২/৫২৯)। যে সম্পর্কে ইবনু কাছীর, আলবানী প্রমুখ বিদ্বানগণ বলেন, বর্ণনাটি ‘মুরসাল’ বা যঈফ। আলবানী বলেন, সীরাতের কিতাবসমূহে ঘটনাটি খুবই প্রসিদ্ধ। কিন্তু আমি এর কোন বিশুদ্ধ সনদ খুঁজে পাইনি (ইরওয়া হা/১৫৩১, ৫/৩৭০ পৃঃ)। তাছাড়া উক্ত ঘটনায় আবু ‘আমের আল-ফাসেক্ব-এর জড়িত থাকার বিষয়টি অনিশ্চিত। কেননা রাসূল (ছাঃ) যখন মদীনায় হিজরত করে আসেন তখন সে মদীনা থেকে মক্কায় চলে যায়। অতঃপর যখন মক্কা বিজিত হয়, তখন সে ত্বায়েফে চলে যায়। অতঃপর যখন ত্বায়েফবাসীরা ইসলাম কবুল করে তখন সে বেরিয়ে শামে চলে যায় এবং সেখানেই বিচ্ছিন্ন ও নিঃসঙ্গ অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে’ (যাদুল মা‘আদ ৩/৪৮০; মা শা-‘আ ২১৯-২০ পৃঃ)। তবে মুনাফিকদের জন্য কোন ষড়যন্ত্রই অসম্ভব নয়। শয়তান ওদের পথ বাৎলিয়ে দেয়। আর মসজিদ আগুনে নিশ্চিহ্ন হওয়ার ঘটনাটি সঠিক। যেমন জাবের বিন আব্দুল্লাহ আনছারী (রাঃ) বলেন, আমি মসজিদে যেরারকে জ্বলন্ত অবস্থায় দেখেছি’। রাবী বলেন, আমি পূর্বতন অনেক ছাহাবীকে বলতে শুনেছি যে, তাঁরা উক্ত দৃশ্য দেখেছেন’ (হাকেম হা/৮৭৬৩, সনদ ছহীহ)। এক্ষণে এ আগুন আল্লাহর পক্ষ থেকেও হ’তে পারে’ (মা শা-‘আ ২২১ পৃঃ)। কেননা কারা আগুন দিয়েছিল, তার কোন নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া যায় না।
[6]. দারাকুৎনী হা/৩৬৬৪ ‘বিবাহ’ অধ্যায়, সিলসিলা ছহীহাহ হা/২৪৬৫।
[7]. মুসলিম হা/১৬৯৫-৯৬; মিশকাত হা/৩৫৬২।
[8]. বুখারী হা/১৩২০; মিশকাত হা/১৭১৫; মির‘আত হা/১৭২৯-এর আলোচনা, ৫/৪৫০-৫১।
[9]. বুখারী হা/১২৬৯, ৪৬৭০-৭২, ৫৭৯৬।
[10]. কুরতুবী, তাফসীর সূরা তওবা ৮৪ আয়াত, ৮/২০২; তাফসীর ত্বাবারী হা/১৭০৫৮, সনদ ‘মুরসাল’।
[11]. বুখারী হা/৩০০৮ ‘জিহাদ’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-১৪২।
[12]. বুখারী হা/৪৬৫৬ ও ফাৎহুল বারী, সংশ্লিষ্ট অনুচ্ছেদ; যাদুল মা‘আদ ৩/৫১৯।

তাবূক যুদ্ধের গুরুত্ব

(১) এই যুদ্ধে বিশ্বশক্তি রোমকবাহিনীর যুদ্ধ ছাড়াই পিছু হটে যাওয়ায় মুসলিম শক্তির প্রভাব আরব ও আরব এলাকার বাইরে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে।

(২) রোমকদের কেন্দ্রবিন্দু সিরিয়া ও তার আশপাশের সকল খ্রিষ্টান শাসক ও গোত্রীয় নেতৃবৃন্দ মুসলিম শক্তির সাথে স্বেচ্ছায় সন্ধিচুক্তি স্বাক্ষর করে। ফলে আরব এলাকা বহিঃশক্তির হামলা থেকে নিরাপদ হয়।

(৩) শুধু অপ্রতিদ্বন্দ্বী সামরিক শক্তি হিসাবে নয়, সর্বোচ্চ মানবাধিকার নিশ্চিতকারী বাহিনী হিসাবে মুসলমানদের সুনাম-সুখ্যাতি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। ফলে দলে দলে খ্রিষ্টানরা মুসলমান হয়ে যায়। যা খেলাফতে রাশেদাহর সময় বিশ্বব্যাপী মুসলিম বিজয়ে সহায়ক হয়।

তাবূক যুদ্ধ থেকে প্রাপ্ত বিধানসমূহ

(১) এ যুদ্ধে রাসূল (ছাঃ) আব্দুর রহমান বিন ‘আওফের পিছনে ফজরের ছালাত এক রাক‘আত আদায় করেন। পরে বাকী রাক‘আত শেষে সালাম ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, তোমরা সঠিক কাজ করেছ। ছালাত যথাসময়ে আদায় করতে হয়’ (মুসলিম হা/২৭৪ (১০৫)। এর দ্বারা অনুত্তমের পিছনে উত্তমের ছালাত জায়েয প্রমাণিত হয়। তাছাড়া জামা‘আতের জন্য সময় নির্ধারণ করা ও তা সকলের জন্য মেনে চলা আবশ্যিক প্রমাণিত হয়।

(২) ফেরার পথে মু‘আয বিন জাবাল (রাঃ) রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট এমন আমলের কথা জানতে চান, যা তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে ও জাহান্নাম থেকে দূরে রাখবে। জবাবে রাসূল (ছাঃ) বলেন, প্রধান বিষয় হ’ল ইসলাম কবুল করা। কেননা যে ইসলাম কবুল করে, সে জাহান্নাম থেকে নিরাপদ হয়। এর স্তম্ভ হ’ল ছালাত এবং চূড়া হ’ল জিহাদ’ (আহমাদ হা/২২১২১)।

(৩) এ যুদ্ধে রাসূল (ছাঃ)-কে মুছল্লীর সুৎরা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হ’লে তিনি বলেন, এটি হাওদার পিছনের অংশের ন্যায় উঁচু(مِثْلُ مُؤْخِرَةِ الرَّحْلِ)। নাসাঈ হা/৭৪৬।

(৪) এ সফরে যোহর-আছর, মাগরিব-এশা জমা ও ক্বছর করা হয়’ (মুসলিম হা/৭০৫ (৫১)।

(৫) তাবূক যাওয়ার পথে ওয়াদীল ক্বোরার একটি বাগিচা থেকে অনুমানের ভিত্তিতে খেজুর খরীদ করা হয়। যার দ্বারা অনুমান ভিত্তিক ব্যবসা জায়েয প্রমাণিত হয়’ (ফাৎহুল বারী হা/১৪৮১-এর আলোচনা)।

(৬) তাবূকের একটি বাড়ি থেকে চামড়ার পাত্রে রাখা পানি চাওয়া হয়। এ সময় মৃত প্রাণীর চামড়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হ’লে রাসূল (ছাঃ) বলেন,دِبَاغُهَا طُهُورُهَا ‘এর দাবাগত করাই হ’ল এর পবিত্রতা’ (আবুদাঊদ হা/৪১২৫)।

(৭) জনৈক ব্যক্তি মারামারির সময় অন্যের হাত কামড়ে ধরলে জোরে টান দেওয়ার কারণে তার সম্মুখের উপর-নীচ দু’টি দাঁত ছিটকে বেরিয়ে আসে। রাসূল (ছাঃ) তার জন্য ক্বিছাছ বাতিল করে দেন’।[1] কারণ সে ইচ্ছাকৃতভাবে তার দাঁত উপড়ে ফেলেনি।

(৮) এ যুদ্ধে তিন দিনের অধিক সময় কোন মুমিন ব্যক্তির সাথে দ্বীনী কারণে বয়কট সিদ্ধ করা হয়। যা যুদ্ধ থেকে পিছিয়ে থাকা তিন জন মুখলেছ ছাহাবীর ক্ষেত্রে ৫০ দিনের বয়কট দ্বারা প্রমাণিত হয়’।[2]

(৯) এ যুদ্ধে তাবূকে ২০ দিন অবস্থানকালে এবং সেখানে যাওয়া ও প্রত্যাবর্তনকালে পূরা সময়টা ছালাতে জমা ও ক্বছর করা হয়।[3] এতে বুঝা যায় যে, সফরে ক্বছরের জন্য ১৯ দিন সময়কাল নির্ধারিত নয়। যেটি ইবনু আববাস (রাঃ) বলেছেন (বুখারী হা/৪২৯৮)।

[1]. বুখারী হা/২৯৭৩; মুসলিম হা/১৬৭৩ (২১)।
[2]. বুখারী হা/৪৪১৮; মুসলিম হা/২৭৬৯।
[3]. মুসলিম হা/৭০৫ (৫১); আবুদাঊদ হা/১২০৮; তিরমিযী হা/৫৫৩; মিশকাত হা/১৩৪৪ ‘সফরের ছালাত’ অনুচ্ছেদ।

তাবূক যুদ্ধে শিক্ষণীয় বিষয়সমূহ

(১) সর্বত্র ছড়িয়ে পড়া রোমকভীতিকে অগ্রাহ্য করে এবং কঠিন দুর্ভিক্ষ ও দৈন্যদশার মধ্যেও গ্রীষ্মের প্রচন্ড দাবদাহ উপেক্ষা করে দীর্ঘ ও ক্লেশকর অভিযানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার মধ্যে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-এর অদম্য সাহস ও বিপুল দূরদৃষ্টির পরিচয় পাওয়া যায়। যা প্রতি যুগে ইসলামী আমীরদের জন্য অত্যন্ত শিক্ষণীয় বিষয়।

(২) মুনাফিকরাই যে ইসলামী শাসনের সবচেয়ে বড় দুশমন, তাবূকের যুদ্ধে তার স্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে। এমনকি মসজিদ-এর আড়ালে যে তারা ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত ও আত্মঘাতি কাজ করতে পারে, তারও প্রমাণ তারা রেখেছে। রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে এধরনের মুনাফেকী তৎপরতার মধ্যে পরবর্তী যুগের ইসলামী নেতাদের জন্য হুঁশিয়ারী সংকেত লুকিয়ে রয়েছে।

(৩) জীবন ও সম্পদ সবকিছুর চেয়ে ঈমানের হেফাযতের জন্য আমীরের আদেশ পালনে নিবেদিতপ্রাণ হওয়া যে সর্বাধিক যরূরী, তার সর্বোত্তম পরাকাষ্ঠা দেখা গেছে তাবূক যুদ্ধে গমনকারী শাহাদাত পাগল মুজাহিদগণের মধ্যে এবং বাহন সংকট ও অন্যান্য কারণে যেতে ব্যর্থ হওয়া ক্রন্দনশীল মুমিনদের মধ্যে। ইসলামী বিজয়ের জন্য সর্বযুগে এরূপ নিবেদিতপ্রাণ নেতা-কর্মী অবশ্যই যরূরী।

তাবূক পরবর্তী যুদ্ধসমূহ

সারিইয়া খালেদ বিন অলীদ

৯ম হিজরীর রজব মাস। বিনা যুদ্ধে বিজয় শেষে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাবূকে অবস্থানকালেই পার্শ্ববর্তী দূমাতুল জান্দালের(دُومَةُ الْجَنْدَلِ) খ্রিষ্টান নেতা উকায়দিরের (أُكَيْدِر) বিরুদ্ধে খালেদকে প্রেরণ করেন। খালেদ বিন অলীদ তাকে বন্দী করে রাসূল (ছাঃ)-এর দরবারে আনেন এবং তার সাথে সন্ধিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।[1]

সারিইয়া উসামাহ বিন যায়েদ বিন হারেছাহ

১১ হিজরীর রবীউল আউয়াল মাস। রাসূল (ছাঃ) তাঁর মৃত্যুর দু’দিন পূর্বে শনিবার ওসামা বিন যায়েদের নেতৃত্বে শামের দিকে সর্বশেষ সেনাদল প্রেরণ করেন এবং নিজ হাতে যুদ্ধের পতাকা বেঁধে তার হাতে তুলে দেন। অতঃপর তাকে ফিলিস্তীনের তুখূম, বালক্বা, দারূম প্রভৃতি এলাকা ঘোড়ার পায়ে পিষ্ট করার নির্দেশ দেন। এই দলে প্রথম যুগের মুহাজিরগণ ওসামার সাথে যোগ দেন। এটাই ছিল রাসূল (ছাঃ) প্রেরিত সর্বশেষ সেনাদল (ইবনু হিশাম ২/৬৪১-৪২)।

মুহাজির ও আনছারদের জ্যেষ্ঠ ছাহাবীদের উপরে (১৮ বছরের) তরুণ ওসামাকে নেতৃত্ব প্রদান করায় কেউ কেউ এর সমালোচনা করেন। তখন রাসূল (ছাঃ) অসুখের কষ্টের মধ্যেও মাথায় কাপড় বেঁধে বেরিয়ে আসেন ও মেম্বরে বসে হামদ ও ছানার পরে (ইবনু হিশাম ২/৬৫০) লোকদের উদ্দেশ্যে বলেন,

قَدْ بَلَغَنِى أَنَّكُمْ قُلْتُمْ فِى أُسَامَةَ وَإِنَّهُ أَحَبُّ النَّاسِ إِلَىَّ، إِنْ تَطْعُنُوا فِى إِمَارَتِهِ فَقَدْ كُنْتُمْ تَطْعُنُونَ فِى إِمَارَةِ أَبِيهِ مِنْ قَبْلُ. وَايْمُ اللهِ، إِنْ كَانَ لَخَلِيقًا لِلإِمَارَةِ، وَإِنْ كَانَ لَمِنْ أَحَبِّ النَّاسِ إِلَىَّ، وَإِنَّ هَذَا لَمِنْ أَحَبِّ النَّاسِ إِلَىَّ بَعْدَه

‘আমার কাছে খবর পৌঁছেছে যে, তোমরা ওসামার ব্যাপারে মন্তব্য করেছ। অথচ সে আমার নিকট সবচেয়ে প্রিয়। যদি তোমরা তার নেতৃত্বের সমালোচনা করে থাক, তবে তার পিতার নেতৃত্বের ব্যাপারেও তোমরা ইতিপূর্বে (মুতার যুদ্ধের সময়) সমালোচনা করেছিলে। অথচ আল্লাহর কসম! সে যোগ্য ছিল। সে আমার নিকটে সবচেয়ে প্রিয় ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত ছিল। তার পরে তার এই পুত্র আমার নিকটে সবচেয়ে প্রিয় ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত’।[2]

অতঃপর তিনি মেম্বর থেকে নেমে আসেন এবং লোকেরা দ্রুত প্রস্তুতি শুরু করে। অতঃপর ওসামা তার সেনাদল নিয়ে বেরিয়ে যান এবং ৪/৫ কি. মি. দূরে ‘জুরুফ’ (الْجُرْف) নামক স্থানে অবতরণ করেন। ইতিমধ্যে লোকেরা তার কাছে গিয়ে রাসূল (ছাঃ)-এর মরণাপন্ন অবস্থার খবর দেয়। তখন সকলে অপেক্ষায় থাকেন আল্লাহর ফায়ছালা কি হয় তা দেখার জন্য’ (ইবনু হিশাম ২/৬৫০)।

উসামা বিন যায়েদ বলেন, রাসূল (ছাঃ)-এর চরম অবস্থার খবর শুনে আমি এবং আমার সাথে অন্যেরা মদীনায় ছুটে আসি। অতঃপর আমি রাসূল (ছাঃ)-এর কক্ষে প্রবেশ করি। যখন সবাই চুপ ছিল। কেউ কথা বলছে না।

فَجَعَلَ يَرْفَعُ يَدَهُ إلَى السَّمَاءِ ثُمَّ يَضَعُهَا عَلَيَّ، فَأَعْرِفُ أَنَّهُ يَدْعُو لِي

‘অতঃপর রাসূল (ছাঃ) তার একটি হাত আকাশের দিকে উঁচু করলেন। অতঃপর সেটি আমার গায়ের উপর রাখলেন। তাতে আমি বুঝলাম, তিনি আমার জন্য দো‘আ করছেন’।[3]

মূলতঃ রোম সম্রাটের অহংকার চূর্ণ করা এবং সিরিয়ার বালক্বা ও ফিলিস্তীন অঞ্চল অশ্বারোহীদের দ্বারা পদদলিত করে রোমকদের ভীত করাই ছিল এ অভিযানের উদ্দেশ্য।

তাছাড়া উসামাকে সেনাপতি করার অন্যতম কারণ এটাও হতে পারে যে, প্রায় সোয়া দু’বছর পূর্বে মুতায় রোমকদের বিরুদ্ধে প্রথম যুদ্ধে সেনাপতি ছিলেন তার পিতা এবং তিনি সেখানেই শহীদ হয়েছিলেন। তাই পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার স্বাভাবিক স্পৃহাকে এর মাধ্যমে আল্লাহর পথে পরিচালিত করা হয়। যেজন্য তাকে রওয়ানা করার সময় তিনি শামের তুখূম, বালক্বা, দারূম প্রভৃতি এলাকা ঘোড়ার পায়ে পিষ্ট করার নির্দেশ দেন। যেখানে মুতার যুদ্ধ হয়েছিল এবং তার পিতাসহ তিনজন সেনাপতি শহীদ হয়েছিলেন।

উল্লেখ্য যে, সারিইয়া উসামা বিন যায়েদ সম্পর্কে ওয়াক্বেদীর সূত্রে বিভিন্ন সীরাত গ্রন্থে যেসব বর্ণনা এসেছে, তার কোনটাই বিশুদ্ধভাবে প্রমাণিত নয়। এ বিষয়ে বুখারী হা/৪৪৬৮-৬৯-এর ব্যাখ্যায় ফাৎহুল বারীতে যেসব বক্তব্য উদ্ধৃত হয়েছে, তার অধিকাংশ বিশুদ্ধতার মানে উন্নীত নয়।

[1]. যাদুল মা‘আদ ৩/৪৭১; আবুদাঊদ হা/৩০৩৭; মিশকাত হা/৪০৩৮।
[2]. বুখারী হা/৩৭৩০, ৪৪৬৮-৬৯; ইবনু ওমর (রাঃ) হ’তে। এখানে বর্ণিত হয়েছে যে, এ সময় রাসূল (ছাঃ) সকলের উদ্দেশ্যে বলেন, أَنْفِذُوا بَعْثَ أُسَامَةَ لَعَنَ اللهُ مَنْ تَخَلَّفَ عَنْهُ. وَكَرَّرَ ذَلِكَ- ‘তোমরা ওসামার বাহিনীকে চালু করে দাও। আল্লাহ ঐ ব্যক্তির উপর লা‘নত করুন, যে ব্যক্তি তার থেকে পিছিয়ে থাকবে। এ কথা তিনি বার বার বলতে থাকেন’। হাদীছটি ‘মুনকার’ বা যঈফ (সিলসিলা যঈফাহ হা/৪৯৭২)।
[3]. ইবনু হিশাম ২/৬৫১; আলবানী, ফিক্বহুস সীরাহ ৪৬৪ পৃঃ সনদ ‘ছহীহ’।

 মন্তব্য
উপরে বর্ণিত যুদ্ধ ও অভিযান সমূহের হিসাব অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে যে, মাদানী জীবনের ১০ বছরের মধ্যে ৭৮১ দিনের অধিক অর্থাৎ দু’বছরের বেশী সময় রাসূল (ছাঃ) যুদ্ধের ময়দানে অতিবাহিত করেছেন। এই অবস্থার মধ্যেই ইসলামের বহু বিধি-বিধান জারী হয়েছে। হিজরতের পর রবীউল আউয়াল থেকে শা‘বান পর্যন্ত মাস ছ’য়েক কিছুটা স্বস্তিতে থাকার পর রামাযান থেকে যুদ্ধাভিযান সমূহ শুরু হয়। যা মৃত্যুর দু’দিন আগ পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। এতে বুঝা যায় যে, ইসলামের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার পথ সর্বদা বাধা সংকুল ছিল এবং কখনোই কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। সত্য ও মিথ্যার এ দ্বন্দ্বে সর্বদা আল্লাহর গায়েবী মদদে সত্য জয়লাভ করেছে। বস্ত্তগত শক্তি অপর্যাপ্ত হওয়া সত্ত্বেও সর্বদা ঈমানী শক্তির জোরেই মুসলমান আল্লাহর সাহায্য লাভ করেছে। আর আল্লাহর বিধান অমান্য করে কখনোই তাঁর সাহায্য লাভ করা যায় না। চরমপন্থী ও শৈথিল্যবাদী সকলের জন্য এর মধ্যে শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে।



প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর ৬৭ পর্বের জীবনীর সকল পর্ব এখান থেকে পড়ুন-

পর্ব-০১   পর্ব-০২   পর্ব-০৩   পর্ব-০৪   পর্ব-০৫   পর্ব-০৬   পর্ব-০৭   পর্ব-০৮   পর্ব-০৯   পর্ব-১০   পর্ব-১১   পর্ব-১২   পর্ব-১৩   পর্ব-১৪   পর্ব-১৫   পর্ব-১৬   পর্ব-১৭   পর্ব-১৮   পর্ব-১৯   পর্ব-২০   পর্ব-২১   পর্ব-২২   পর্ব-২৩   পর্ব-২৪   পর্ব-২৫   পর্ব-২৬   পর্ব-২৭   পর্ব-২৮   পর্ব-২৯   পর্ব-৩০    পর্ব-৩১   পর্ব-৩২   পর্ব-৩৩   পর্ব-৩৪   পর্ব-৩৫   পর্ব-৩৬   পর্ব-৩৭   পর্ব-৩৮   পর্ব-৩৯   পর্ব-৪০   পর্ব-৪১   পর্ব-৪২   পর্ব-৪৩   পর্ব-৪৪   পর্ব-৪৫   পর্ব-৪৬(১ম) পর্ব-৪৬(২য়)    পর্ব-৪৭   পর্ব-৪৮   পর্ব-৪৯   পর্ব-৫০   পর্ব-৫১   পর্ব-৫২   পর্ব-৫৩   পর্ব-৫৪   পর্ব-৫৫   পর্ব-৫৬   পর্ব-৫৭   পর্ব-৫৮   পর্ব-৫৯   পর্ব-৬০   পর্ব-৬১   পর্ব-৬২   পর্ব-৬৩   পর্ব-৬৪   পর্ব-৬৫   পর্ব-৬৬   পর্ব-৬৭  




******************************************
>>> Welcome, You are now on Mohammadia Foundation's Website. Please stay & Tune with us>>>

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url