প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর জীবনী [পর্ব- ৪০] || মহানবীর জীবনী ||




[পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ট মহামানব আমাদের প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:)। যাকে আল্লাহ সমস্ত মানুষের জন্য অশেষ রহমত স্বরূপ এই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। যে নবী সারা জীবন উম্মতের জন্য সংগ্রাম করেছেন, কাল রোজ হাশরের মাঠেও যিনি উম্মতের জন্যই পেরেশান থাকবেন; সেই প্রাণপ্রিয় নবীকে আমরা কতটুকু চিনি কতটুকু জানি। প্রিয় নবী (সা:) এর জীবনের পরতে পরতে রয়েছে আমাদের জন্য শিক্ষা ও অনুপ্রেরণা। যার জীবনী পড়লে নিজের অজান্তেই চোখের পানি গড়িয়ে পড়ে। সেই নবীর জীবনী কি আমরা সত্যিই জানি? আসুন, আরেকবার দেখে নেই “প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর জীবনী”। যে জীবনী পড়ে বদলে যেতে পারে আপনার আমার জীবন। আল্লাহ আমাদের সবাইকে প্রাণপ্রিয় নবীর (সা:) উম্মত হিসাবে কবুল করুন। আমিন।।]

সম্রাট ও বাদশাহদের নিকট ইসলামের দাওয়াত দিয়ে নবী মোহাম্মদের (সা:) পত্র প্রেরণ

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর পুরা জীবনটাই ছিল দাওয়াত ও জিহাদের জীবন। দাওয়াত প্রতিষ্ঠার জন্য জিহাদের প্রয়োজন হয়। মাক্কী জীবন ছিল এককভাবে দাওয়াতী জীবন। মাদানী জীবনে সশস্ত্র জিহাদের অনুমতি পেলেও তার মধ্যে তিনি সবসময় দাওয়াতী কার্যক্রম চালিয়েছেন। বিভিন্ন গোত্রে দাওয়াতী কাফেলা পাঠিয়েছেন। কখনো সফল হয়েছেন, কখনো বিফল হয়েছেন। ৪র্থ হিজরীর ছফর মাসে আযাল ও ক্বারাহ গোত্রে ‘আছেম বিন ছাবিত (রাঃ)-এর নেতৃত্বে ১০ জনের এবং একই সময়ে নাজদের বনু সুলায়েম গোত্রে মুনযির বিন ‘আমের (রাঃ)-এর নেতৃত্বে ৭০ জনের যে তাবলীগী কাফেলা পাঠান, তারা সবাই আমন্ত্রণকারীদের বিশ্বাসঘাতকতার ফলে মর্মান্তিকভাবে শহীদ হয়ে যান। শেষোক্তটি বি’রে মাঊনার ঘটনা হিসাবে পরিচিত (দ্রঃ সারিইয়া ক্রমিক ২৪ ও ২৫)। আবার ৬ষ্ঠ হিজরীর শা‘বান মাসে সিরিয়ার দূমাতুল জান্দালের বনু কালব খ্রিষ্টান গোত্রের নিকটে আব্দুর রহমান বিন ‘আওফ (রাঃ)-এর নেতৃত্বে যে তাবলীগী কাফেলা পাঠানো হয়, তা সফল হয় এবং খ্রিষ্টান গোত্রনেতাসহ সবাই মুসলমান হয়ে যান (দ্রঃ সারিইয়া ক্রমিক ৪৪)। এছাড়া নবী ও ছাহাবীগণ সকলে ব্যক্তিগতভাবে সর্বদা দাওয়াতের দায়িত্ব পালন করতেন। কেননা দাওয়াতই হল ইসলামের রূহ। মাদানী জীবনে মুশরিক-মুনাফিক ও ইহূদীদের অবিরতভাবে চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র ও যুদ্ধবাদী কর্মকান্ডের ফলে ইসলামের সুস্থ দাওয়াত বাধাগ্রস্ত হয় এবং যুদ্ধসমূহ সংঘটিত হয়।

৬ষ্ঠ হিজরীর যুলক্বা‘দাহ মাসে প্রধান প্রতিপক্ষ কুরায়েশদের সাথে হোদায়বিয়ার সন্ধিচুক্তি স্বাক্ষরের ফলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও মুসলমানদের জীবনে অনেকটা স্বস্তি ফিরে আসে। ফলে এ সময়টাকে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) ইসলামের দাওয়াত প্রসারের জন্য একটি মহতী সুযোগ হিসাবে কাজে লাগান। এই সময় তৎকালীন আরব ও পার্শ্ববর্তী রাজা-বাদশা ও গোত্রনেতাদের নিকটে পত্র প্রেরণের মাধ্যমে ইসলামের দাওয়াত প্রসারে তিনি এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেন। পত্র বাহকের হাতে পত্রসমূহ প্রেরিত হয় এবং সে যুগের নিয়ম অনুযায়ী পত্রের শেষে সীলমোহর ব্যবহার করা হয়। রাসূল (ছাঃ)-এর আংটিতে মুদ্রিত সীলমোহরটি ছিল রৌপ্য নির্মিত এবং যাতে ‘মুহাম্মাদ রাসূলুল্লাহ’ (محمد رسول الله) খোদিত ছিল।[1] এতে তিনটি লাইন ছিল। মুহাম্মাদ এক লাইন, রাসূল এক লাইন এবং আল্লাহ এক লাইন’।[2]

ওয়াক্বেদী, ত্বাবারী প্রমুখ জীবনীকারগণের হিসাব মতে হোদায়বিয়া থেকে ফিরেই ৬ষ্ঠ হিজরীর যিলহজ্জ মাসে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আরবের ভিতরে ও বাইরে বিভিন্ন রাজা-বাদশাহদের নিকট ইসলামের দাওয়াত দিয়ে পত্রসমূহ প্রেরণ করেন। ইবনু সা‘দ ও ইবনুল ক্বাইয়িমের মতে ৭ম হিজরীর মুহাররম মাসের একই তারিখে ছয় জন পত্র বাহককে পত্রসহ প্রেরণ করা হয়।[3] উভয় তারিখের মধ্যে সমন্বয় করে ইবনু হাজার বলেন, কোন কোন পত্র যিলহাজ্জের শেষ দিকে পাঠানো হয়েছে, যা ৭ম হিজরীর মুহাররমে প্রাপকের নিকট পৌঁছেছে। যেমন হেরাক্লিয়াসের নিকটে প্রেরিত চিঠি (সীরাহ ছহীহাহ ২/৪৫৫)। এতদ্ব্যতীত যাকে যেখানে পাঠানো হয়েছিল, তাদের প্রত্যেকে সেখানকার ভাষায় কথা বলতে পারতেন’ (ইবনু সা‘দ ১/১৯৮)।

উল্লেখ্য যে, হেরাক্বলের নিকট লিখিত একটি মাত্র চিঠি ব্যতীত অন্য কোন পত্র সনদে ও মতনে হুবহু ছহীহ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত নয়। তবে পত্রসমূহ যে পাঠানো হয়েছিল, তা ছহীহ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত। যেমন আনাস (রাঃ) বলেন, كَتَبَ إِلَى كِسْرَى وَإِلَى قَيْصَرَ وَإِلَى النَّجَاشِىِّ وَإِلَى كُلِّ جَبَّارٍ يَدْعُوهُمْ إِلَى اللهِ تَعَالَى وَلَيْسَ بِالنَّجَاشِىِّ الَّذِى صَلَّى عَلَيْهِ النَّبِىُّ– صلى الله عليه وسلم ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) পত্র লেখেন কিসরা, ক্বায়ছার, নাজাশী এবং অন্যান্য সকল সম্রাটের নিকটে। তিনি তাদেরকে আল্লাহর দিকে আহবান করেন। তবে ঐ নাজাশী নন, যার মৃত্যুর পরে রাসূল (ছাঃ) তার গায়েবানা জানাযা পড়েছিলেন (কারণ তিনি ইসলাম কবুল করেছিলেন)’ (মুসলিম হা/১৭৭৪)। অন্য বর্ণনায় দূমাতুল জান্দাল-এর খ্রিষ্টান শাসক উকায়দির-এর নিকটে পত্র লেখার বিষয়টি প্রমাণিত হয়’ (আহমাদ হা/১২৩৭৮, হাদীছ ছহীহ)।

তবে হুবহু প্রমাণিত না হলেও হেরাক্বলের নিকট প্রেরিত পত্রের নমুনায় অন্যান্য পত্রগুলি লিখিত হওয়ায় তা ঐতিহাসিকভাবে মূল্যায়নযোগ্য। যদিও তা আক্বীদা ও শরী‘আত বিষয়ে দলীল হিসাবে গ্রহণযোগ্য নয়’ (সীরাহ ছহীহাহ ২/৪৫৯)।

হেরাক্বলের চিঠির শেষে সূরা আলে ইমরানের ৬৪ আয়াতটি উল্লেখিত থাকায় বিদ্বানগণ সন্দেহে পতিত হয়েছেন। কেননা তাঁদের ধারণায় উক্ত আয়াত ৯ম হিজরীতে নাজরানের খ্রিষ্টান প্রতিনিধি দলের মদীনায় আগমনের সময় নাযিল হয়। ইবনু ইসহাক এটি বিনা সনদে বর্ণনা করেছেন। যা বিশুদ্ধভাবে প্রমাণিত নয়।[4] বরং তাফসীরে ত্বাবারীর বর্ণনা (হা/৭১৯১), যার সনদ ক্বাতাদাহ (৬১-১১৮ হিঃ) পর্যন্ত ‘হাসান’ হিসাবে প্রমাণিত। সেখানে বলা হয়েছে যে, উক্ত আয়াত মদীনার ইহূদীদের বহিষ্কারের পূর্বে নাযিল হয়েছে। আর ইহূদীদের বহিষ্কার চূড়ান্ত হয় ৫ম হিজরীর শেষে খন্দক যুদ্ধের পর। আর হেরাক্বলের নিকট পত্র প্রেরিত হয় ৬ষ্ঠ হিজরীর শেষে হোদায়বিয়া সন্ধির পর (সীরাহ ছহীহাহ ২/৪৫৬-৫৭)। অতএব পত্রে উক্ত আয়াত লেখায় কোন সমস্যা নেই।

উল্লেখ্য যে, প্রত্যেক চিঠি ‘বিসমিল্লাহ’ দিয়ে শুরু করার মাধ্যমে যেমন আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ঘোষণা করা হয়েছে, তেমনি বাদশাহদেরকে তাদের সর্বোচ্চ সম্মানজনক পদবী উল্লেখ করার মাধ্যমে সম্মানিত করা হয়েছে। সাথে সাথে তাদেরকে ইসলামের প্রতি ও পরকালীন পুরস্কার লাভের প্রতি উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে।

এক্ষণে যে সকল সম্রাট ও শাসকের নিকট পত্র প্রেরণ করা হয়েছিল, সেই ৬ জন বিখ্যাত পত্রবাহক ও শাসকগণ হ’লেন, দেহিইয়া বিন খলীফা কালবীকে রোম সম্রাট ক্বায়ছারের নিকটে, আব্দুল্লাহ বিন হুযাফাহ সাহমীকে পারস্য সম্রাট কিসরা-র নিকটে, হাত্বেব বিন আবু বালতা‘আহ লাখমীকে মিসর রাজ মুক্বাউক্বিস-এর নিকটে, সালীত্ব বিন ‘আমর আল-‘আমেরীকে ইয়ামামার শাসক হাওযাহ বিন ‘আলী হানাফীর নিকটে, শুজা‘ বিন ওয়াহাব আল-আসাদীকে বালক্বা (দামেশক্ব)-এর শাসক হারেছ বিন আবু শিমর আল-গাসসানীর নিকটে এবং বাহরায়নের শাসক মুনযির বিন সাওয়া-র নিকটে (সীরাহ ছহীহাহ ২/৪৫৪; যাদুল মা‘আদ ১/১১৬, ১১৯)।

এতদ্ব্যতীত মৃত্যুর আগ পর্যন্ত রাসূল (ছাঃ) আরও কয়েকজন পত্র বাহককে বিভিন্ন শাসকের নিকট প্রেরণ করেন’ (যাদুল মা‘আদ ১/১১৯-২০)। নিম্নে পত্রগুলি উল্লেখ করা হ’ল।-

[1]. বুখারী হা/৫৮৭২-৭৩ ‘আংটি খোদাই’ অনুচ্ছেদ।
রাবী আনাস ও ইবনু ওমর (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যুর পরে উক্ত আংটি হযরত আবুবকর, পরে ওমর এবং তার পরে ওছমান (রাঃ) ব্যবহার করেন। কিন্তু তাঁর খেলাফতের শেষ দিকে এক সময় আংটিটি ‘আরীস’ (بِئْرُ أَرِيسَ) কূয়ায় পড়ে যায়’ (বুখারী হা/৫৮৬৬, ৫৮৭৩)। ইবনু হাজার বলেন, ওছমান (রাঃ)-এর খেলাফতের ৬ বছর পর একদিন তাঁর হাত থেকে আংটিটি ‘আরীস’ কূয়ায় পড়ে যায়। যা তিনদিন ধরে খুঁজে এমনকি কূয়ার পানি সব সেঁচে ফেলেও আর পাওয়া যায়নি। অনেকে এই ঘটনায় বরকত বঞ্চিত হওয়ার কথা বলেছেন। কেননা এরপর থেকে ওছমান (রাঃ)-এর খেলাফতের বাকী অর্ধাংশ বিশৃংখলার মধ্য দিয়ে কাটে। যেমন আংটি হারানোর ফলে সোলায়মান (আঃ)-এর রাজত্ব চলে গিয়েছিল’ (ফাৎহুল বারী হা/৫৮৭৮-এর আলোচনা দ্রঃ)।

[2]. বুখারী হা/৩১০৬, ৫৮৭৮; মিশকাত হা/৪৩৮৬।
ইবনু হাজার বলেন, উক্ত বিষয়ে হাদীছসমূহে স্পষ্ট কোন ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। তবে কোন কোন বিদ্বান বলেছেন, লেখার নকশা ছিল, নীচে মুহাম্মাদ, তার উপরে রাসূল এবং তার উপরে আল্লাহ’ (ফাৎহুল বারী হা/৫৮৭৮-এর আলোচনা; সীরাহ হালাবিইয়াহ ৩/২৮১)।

[3]. ইবনু সা‘দ ১/১৯৮; যাদুল মা‘আদ ১/১১৬, ১১৯।
[4]. ইবনু হিশাম ১/৫৫৩, ৫৭৬; ঐ, তাহকীক ক্রমিক ৬৩৩, সনদ যঈফ; ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা আলে ইমরান ৬৪ আয়াত।

রোম সম্রাট ক্বায়ছার হেরাক্লিয়াসের নিকটে পত্র

৬ষ্ঠ হিজরীর যিলহজ্জ বা ৭ম হিজরীর মুহাররম মাসে এটি পাঠানো হয়। রোম সাম্রাজ্যের পূর্ব অংশের শাসক কনষ্ট্যান্টিনোপলের বিখ্যাত খ্রিষ্টান সম্রাট হেরাক্বল এ সময় যেরুযালেমে অবস্থান করছিলেন।[1] পত্রবাহক দেহিয়া বিন খালীফা কালবী ওরফে দেহিয়াতুল কালবী (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নির্দেশ মতে পত্রটি শামের বুছরা (بُصْرَى) প্রদেশের শাসনকর্তার নিকটে হস্তান্তর করেন এবং তিনি সেটা রোম সম্রাটকে পৌঁছে দেন’ (বুখারী হা/৭)। পত্রটি ছিল নিম্নরূপ :

بِسْمِ اللهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيْمِ، مِنْ مُحَمَّدٍ عَبْدِ اللهِ وَرَسُوْلِهِ إِلَى هِرَقْلَ عَظِيْمِ الرُّومِ. سَلاَمٌ عَلَى مَنِ اتَّبَعَ الْهُدَى، أَسْلِمْ تَسْلَمْ ، يُؤْتِكَ اللهُ أَجْرَكَ مَرَّتَيْنِ، فَإِنْ تَوَلَّيْتَ فَإِنَّ عَلَيْكَ إِثْمَ الأَرِيسِيِّينَ- يَا أَهْلَ الْكِتَابِ تَعَالَوْا إِلَى كَلِمَةٍ سَوَاءٍ بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمْ أَنْ لاَ نَعْبُدَ إِلاَّ اللهَ وَلاَ نُشْرِكَ بِهِ شَيْئًا وَلاَ يَتَّخِذَ بَعْضُنَا بَعْضًا أَرْبَابًا مِنْ دُونِ اللهِ فَإِنْ تَوَلَّوْا فَقُولُوا اشْهَدُوا بِأَنَّا مُسْلِمُونَ-

‘পরম করুণাময় অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে (শুরু করছি)। আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল মুহাম্মাদ-এর পক্ষ হতে রোম সম্রাট হেরাক্বল-এর প্রতি। শান্তি বর্ষিত হৌক ঐ ব্যক্তির উপরে যিনি হেদায়াতের অনুসরণ করেন। ইসলাম কবুল করুন! নিরাপদ থাকুন। ইসলাম কবুল করুন। আল্লাহ আপনাকে দ্বিগুণ পুরস্কার দান করবেন। যদি মুখ ফিরিয়ে নেন, তাহলে আপনার উপরে প্রজাবৃন্দের পাপ বর্তাবে। (আল্লাহ বলেন,) তুমি বল, হে আহলে কিতাবগণ! এসো! একটি কথায় আমরা একমত হই, যা আমাদের ও তোমাদের মাঝে সমান। আর তা এই যে, আমরা অন্য কারু ইবাদত করব না আল্লাহ ব্যতীত এবং তাঁর সাথে কাউকে শরীক করব না। আর আল্লাহকে ছেড়ে আমরা কেউ কাউকে ‘প্রতিপালক’ হিসাবে গ্রহণ করব না। এরপর যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে তোমরা বল, তোমরা সাক্ষী থাক যে, আমরা ‘মুসলিম’ (আলে ইমরান ৩/৬৪; বুখারী হা/৭)।

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) বলেন, আবু সুফিয়ান ইবনু হারব (যখন তিনি মুসলিম ছিলেন) তাকে খবর দিয়েছেন এই মর্মে যে, যখন তার ও মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর মধ্যে সন্ধি চলছিল, সে সময় আমরা কুরায়েশের একটি দলসহ ব্যবসা উপলক্ষ্যে শামে ছিলাম। হেরাক্বল তখন ঈলিয়া (যেরুযালেম) ছিলেন। তিনি আমাকে তাঁর দরবারে আমন্ত্রণ করেন। সে সময় রোমকদের বড় বড় নেতারা সেখানে উপস্থিত ছিলেন। অতঃপর তিনি তাঁর দোভাষীর মাধ্যমে আমাদের জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের মধ্যে বংশের দিক দিয়ে এই ব্যক্তির সবচেয়ে নিকটবর্তী কে? যিনি ধারণা করেন যে, তিনি একজন নবী’। আবু সুফিয়ান বললেন, আমি। আবু সুফিয়ান বলেন, অতঃপর তিনি আমাকে ডেকে তাঁর সামনে বসালেন এবং আমার সাথীদের পিছনে বসালেন। অতঃপর তিনি আমার সাথীদের বললেন, আমি এঁকে কিছু কথা জিজ্ঞেস করব। মিথ্যা বললে, তোমরা ধরে দিবে’। আবু সুফিয়ান বলেন, যদি আমাকে মিথ্যুক বলার ভয় না থাকত, তাহলে আমি অবশ্যই মুহাম্মাদ সম্পর্কে মিথ্যা বলতাম’। (উভয়ের কথোপকথন ও হেরাক্বলের মন্তব্য সমূহ নিম্নে প্রদত্ত হল)। ‘অতঃপর তিনি তাঁর দোভাষীকে বললেন, তুমি ওঁকে প্রশ্ন কর।-

প্রশ্ন-১ : নবীর বংশ মর্যাদা (حَسَبُهُ) কেমন?
উত্তর : উচ্চ বংশীয়।
(হেরাক্বলের মন্তব্য) : হ্যাঁ। রাসূলগণ উচ্চ বংশেই প্রেরিত হয়ে থাকেন।

প্রশ্ন-২ : নবীর বাপ-দাদাদের মধ্যে কেউ কখনো বাদশাহ ছিলেন কি?
উত্তর : না’।
মন্তব্য : এটা থাকলে আমি বুঝতাম যে, নবুঅতের বাহানায় বাদশাহী হাছিল করতে চায়।

প্রশ্ন-৩ : তাঁর অনুসারীদের মধ্যে দুর্বল শ্রেণীর লোকদের সংখ্যা বেশী, না অভিজাত শ্রেণীর লোকদের সংখ্যা বেশী?
উত্তর : দুর্বল শ্রেণীর’। মন্তব্য : প্রত্যেক নবীর প্রথম অনুসারী দল দুর্বলেরাই হয়ে থাকে।

প্রশ্ন-৪ : নবুঅতের দাবী করার পূর্বে তোমরা কি কখনো তাঁর উপরে মিথ্যার অপবাদ দিয়েছ?
উত্তর : না’। মন্তব্য : ঠিক। যে ব্যক্তি মানুষকে মিথ্যা বলে না, সে ব্যক্তি আল্লাহর ব্যাপারে মিথ্যা বলতে পারে না।

প্রশ্ন-৫ : তাঁর দ্বীন কবুল করার পর কেউ তা পরিত্যাগ করে চলে যায় কি?
উত্তর : না’। মন্তব্য : ঈমানের প্রভাব এটাই যে, তা একবার হৃদয়ে বসে গেলে আর বের হয় না।

প্রশ্ন-৬ : ঈমানদারগণের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে, না কমছে?
উত্তর : বাড়ছে’। মন্তব্য : ঈমানের এটাই বৈশিষ্ট্য যে, আস্তে আস্তে বৃদ্ধি পায় ও তা ক্রমে পূর্ণতার স্তরে পৌঁছে যায়।

প্রশ্ন-৭ : তোমরা কি কখনো ঐ ব্যক্তির সাথে যুদ্ধ করেছ?
উত্তর : করেছি। কখনো তিনি জয়ী হয়েছেন (যেমন বদরে), কখনো আমরা জয়ী হয়েছি (যেমন ওহোদে)।

মন্তব্য : আল্লাহর নবীদের এই অবস্থাই হয়ে থাকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় নবীগণই লাভ করে থাকেন’।

প্রশ্ন-৮ : এই ব্যক্তি কখনো চুক্তি ভঙ্গ করেছেন কি?
উত্তর : না’। তবে এ বছর আমরা (হোদায়বিয়ার) সন্ধিচুক্তি করেছি। দেখি তিনি কি করেন’। আবু সুফিয়ান বলেন, আল্লাহর কসম! এতটুকু ছাড়া আর একটি শব্দও আমার পক্ষ থেকে যুক্ত করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু হেরাক্বল (সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে) বললেন, নবীরা কখনো চুক্তি ভঙ্গ করেন না।

প্রশ্ন-৯ : তোমাদের মধ্যে ইতিপূর্বে কেউ নবুঅতের দাবী করেছেন কি?
উত্তর : না’। মন্তব্য : হ্যাঁ। এরূপ হলে বুঝতাম যে, বাপ-দাদার অনুকরণে এ দাবী করেছেন।

প্রশ্ন-১০ : তিনি তোমাদের কি নির্দেশ দেন?
উত্তর : তিনি আমাদের নির্দেশ দেন যে, তোমরা এক আল্লাহর ইবাদত কর এবং তাঁর সাথে কোন কিছুকে শরীক করো না। আর তিনি আমাদেরকে মূর্তিপূজা করতে নিষেধ করেন। তিনি আমাদের ছালাত, যাকাত, আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা এবং পবিত্রতা অর্জনের নির্দেশ দেন।
মন্তব্য:فَإِنْ كَانَ مَا تَقُولُ حَقًّا فَسَيَمْلِكُ مَوْضِعَ قَدَمَىَّ هَاتَيْنِ ، وَقَدْ كُنْتُ أَعْلَمُ أَنَّهُ خَارِجٌ ، لَمْ أَكُنْ أَظُنُّ أَنَّهُ مِنْكُمْ ، فَلَوْ أَنِّى أَعْلَمُ أَنِّى أَخْلُصُ إِلَيْهِ لَتَجَشَّمْتُ لِقَاءَهُ ، وَلَوْ كُنْتُ عِنْدَهُ لَغَسَلْتُ عَنْ قَدَمَيْهِ ‘যদি তুমি সত্য কথা বলে থাক, তবে সত্বর তিনি আমার পায়ের তলার মাটিরও (অর্থাৎ শাম ও বায়তুল মুক্বাদ্দাসের) মালিক হবেন। আমি জনতাম যে, তিনি আগমন করবেন। কিন্তু আমি ভাবিনি যে, তিনি তোমাদের মধ্য থেকে হবেন। যদি আমি জানতাম যে, আমি তাঁর কাছে পৌঁছতে পারব, তাহলে আমি তাঁর সাথে সাক্ষাতের জন্য সাধ্যমত কষ্ট স্বীকার করতাম। আর যদি আমি তাঁর কাছে পৌঁছতে পারতাম, তাহলে আমি তাঁর দু’পা ধুয়ে দিতাম’। ছহীহ মুসলিম-এর বর্ণনায় এসেছে, إِنْ يَكُنْ مَا تَقُولُ فِيهِ حَقًّا فَإِنَّهُ نَبِىٌّ ‘তুমি যা বলছ তা যদি সত্য হয়, তাহলে তিনি অবশ্যই নবী’।

অতঃপর তিনি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) প্রেরিত পত্রটি নিয়ে পাঠ করলেন। পত্র পাঠ শেষ হলে (ভক্তির আবেশে) সভাসদগণের কণ্ঠস্বর ক্রমেই উচ্চমার্গে উঠতে লাগল এবং তাদের মধ্যে আলোচনা বৃদ্ধি পেতে থাকল। এ সময়ে আমাদেরকে চলে যেতে বলা হল।

আবু সুফিয়ান বলেন যে, রাজদরবার থেকে বেরিয়ে এসে আমি সাথীদের বললাম, لَقَدْ أَمِرَ أَمْرُ ابْنِ أَبِيْ كَبْشَةَ إِنَّهُ يَخَافُهُ مَلِكُ بَنِي الْأَصْفَرِ ‘ইবনু আবী কাবশার ব্যাপারটি মযবুত হয়ে গেল। আছফারদের সম্রাট তাকে ভয় পাচ্ছেন’।[2] আবু সুফিয়ান বলেন, এরপর থেকে আমার বিশ্বাস বদ্ধমূল হতে থাকল যে, সত্বর তিনি বিজয় লাভ করবেন। অবশেষে আল্লাহ আমার মধ্যে ইসলাম প্রবেশ করিয়ে দিলেন’।[3] অর্থাৎ ৮ম হিজরীর ১৭ই রামাযান মক্কা বিজয়ের দিন তিনি ইসলাম কবুল করেন (ইবনু হিশাম ২/৪০৩)।

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর পত্র রোম সম্রাটের উপরে কেমন প্রভাব বিস্তার করেছিল, উপরোক্ত ঘটনায় তা প্রতীয়মান হয়। পত্রবাহক দেহিয়া কালবীকে রোম সম্রাট বহুমূল্য উপঢৌকনাদি দিয়ে সম্মানিত করেন এবং রাসূল (ছাঃ)-এর জন্য মূল্যবান হাদিয়া প্রেরণ করেন। আল্লাহ পাকের এমনই কুদরত যে, রাসূল (ছাঃ)-এর কাফের দুশমন নেতার মুখ দিয়েই আরেক অমুসলিম সম্রাটের সম্মুখে তার সত্যায়ন করালেন এবং সম্রাটকে হেদায়াত দান করলেন। ফালিল্লাহিল হামদ।

[1]. পারস্য সম্রাট খসরু পারভেয স্বীয় পুত্রের হাতে নিহত হওয়ার পর ক্ষমতাসীন কিসরা রোম সম্রাটের সাথে সন্ধি করেন এবং তাদের অধিকৃত এলাকাসমূহ ফেরৎ দেন। এ সময় তাদের ধারণা মতে হযরত ঈসাকে হত্যা করার কাজে ব্যবহৃত ক্রুশটিও ফেরৎ দেওয়া হয়। এই অভাবিত সন্ধিতে খুশী হয়ে আল্লাহর শুকরিয়া আদায়ের জন্য রোম সম্রাট নিজে যেরুযালেম আসেন এবং ক্রুশটিকে স্বস্থানে রেখে দেন। ৭ম হিজরীতে (মোতাবেক ৬২৯ খৃষ্টাব্দে) এ ঘটনা ঘটে (আর-রাহীক্ব পৃঃ ৩৫৬-টীকা)।

[2]. (ক) ‘আবু কাবশার ছেলে’ বলতে স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বুঝানো হয়েছে। এই উপনামটি রাসূল (ছাঃ)-এর দুধ পিতার অথবা তার দাদা বা নানা কারু ছিল। এটি একটি অপরিচিত নাম। আরবদের নিয়ম ছিল, কাউকে হীনভাবে প্রকাশ করতে চাইলে তার পূর্বপুরুষদের কোন অপরিচিত ব্যক্তির দিকে সম্বন্ধ করে বলা হ’ত। আবু সুফিয়ান সেটাই করেছেন। (খ) ‘বানুল আছফার’ বলতে রোমকদের বুঝানো হয়েছে। ‘আছফার’ অর্থ হলুদ। আর রোমকরা ছিল হলুদ রংয়ের।

[3]. বুখারী হা/৭, ৪৫৫৩; মুসলিম হা/১৭৭৩; মিশকাত হা/৫৮৬১।

পারস্য সম্রাট কিসরার নিকটে পত্র

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) পারস্য সম্রাট খসরু পারভেযের (أَبرَوِيزُ بنُ هُرمُزَ بنِ أَنوشِروَانَ) নিকটে ইসলামের দাওয়াত দিয়ে পত্র প্রেরণ করেন, যিনি ছিলেন অর্ধেক প্রাচ্য দুনিয়ার অধিপতি এবং মজূসী বা যারদাশতী ধর্মের অনুসারী, যারা অগ্নিপূজক ছিলেন। পত্রবাহক ছিলেন আব্দুল্লাহ বিন হুযাফাহ সাহমী (عبد الله بن حُذافةَ السَّهمِيُّ)। পত্রটি ছিল নিম্নরূপ:

بِسْمِ اللهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ، مِنْ مُحَمَّدٍ رَسُوْلِ اللهِ إلَى كِسْرَى عَظِيمِ فَارِسَ سَلاَمٌ عَلَى مَنِ اتَّبَعَ الْهُدَى وَآمَنَ بِاَللهِ وَرَسُوْلِهِ وَشَهِدَ أَنْ لاَ إلَهَ إلاَّ اللهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيْكَ لَهُ وَأَنّ مُحَمّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ، أَدْعُوْكَ بِدِعَايَةِ اللهِ فَإِنِّيْ أَنَا رَسُوْلُ اللهِ إلَى النَّاسِ كَافّةً لِيُنْذِرَ مَنْ كَانَ حَيًّا وَيَحِقَّ الْقَوْلُ عَلَى الْكَافِرِيْنَ- أَسْلِمْ تَسْلَمْ فَإِنْ أَبَيْتَ فَعَلَيْكَ إثْمُ الْمَجُوْسِ-

‘শান্তি বর্ষিত হৌক ঐ ব্যক্তির উপরে যিনি হেদায়াতের অনুসরণ করেন এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূল-এর উপরে ঈমান আনেন এবং সাক্ষ্য দেন যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। তিনি এক, তাঁর কোন শরীক নেই। আমি আপনাকে আল্লাহর দিকে আহবান জানাচ্ছি। নিশ্চয়ই আমি আল্লাহর পক্ষ হ’তে সমগ্র মানব জাতির জন্য প্রেরিত রাসূল’। ‘যাতে তিনি জীবিতদের (জাহান্নামের) ভয় প্রদর্শন করেন এবং কাফিরদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়’ (ইয়াসীন ৩৬/৭০)। ইসলাম কবুল করুন, নিরাপদ থাকুন। যদি অস্বীকার করেন, তাহ’লে মজূসীদের পাপ আপনার উপরে বর্তাবে’ (আলবানী, ফিক্বহুস সীরাহ ৩৫৬ পৃঃ, সনদ হাসান)।

পত্রবাহক সাহমী (রাঃ) পত্রখানা (কিসরার গবর্ণর) বাহরায়নের শাসক মুনযির বিন সাওয়া-র (الْمُنذِر بن ساوَى) নিকটে হস্তান্তর করেন। অতঃপর যখন পত্রটি কিসরার নিকটে পাঠ করে শুনানো হয়, তখন তিনি পত্রটি ছিঁড়ে ফেলেন ও দম্ভভরে বলেন,عَبْدٌ حَقِيْرٌ مِنْ رَعِيَّتِيْ يَكْتُبُ اسْمَهُ قَبْلِيْ ‘আমার একজন নিকৃষ্ট প্রজা তার নাম লিখেছে আমার নামের পূর্বে’। এ খবর রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে পৌঁছলে তিনি বদদো‘আ করে বলেন,أَنْ يُمَزَّقُوا كُلَّ مُمَزَّقٍ ‘আল্লাহ তাদের সাম্রাজ্যকে ছিন্নভিন্ন করুন’![1] অন্য বর্ণনায় এসেছে, اللَّهُمَّ مَزِّقْ مُلْكَهُ ‘আল্লাহ তার সাম্রাজ্যকে ছিন্নভিন্ন করুন’।[2] পরবর্তীতে সেটাই হয়েছিল।

কিসরা তার অধীনস্থ ইয়ামনের গবর্ণর ‘বাযান’ (بَاذَان) এর কাছে লিখলেন, ‘হেজাযের এই ব্যক্তিটির নিকটে তুমি দু’জন শক্তিশালী লোক পাঠাও। যাতে তারা ঐ ব্যক্তিকে আমার কাছে ধরে নিয়ে আসে’। বাযান সে মোতাবেক দু’জন লোককে একটি পত্রসহ মদীনায় পাঠান, যাতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদের সাথে কিসরার দরবারে চলে যান। তারা গিয়ে রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে বেশ ধমকের সুরে কথা বলল। তিনি তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দিলেন। তখন তারা ভয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগল। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) তাদেরকে বললেন, তোমরা কাল এসো। আমি তোমাদেরকে আমার কথা বলব। তারা পরের দিন এল। তখন তিনি তাদেরকে বললেন, أَبْلِغَا صَاحِبَكُمَا أَنَّ رَبِّي قَدْ قَتَلَ رَبَّهُ كِسْرَى فِي هَذِهِ اللَّيْلَةِ ‘তোমরা তোমাদের গবর্ণরের কাছে খবর পৌছে দাও যে, আমার প্রতিপালক তার প্রতিপালক কেসরাকে আজ রাতেই হত্যা করেছেন’ (ছহীহাহ হা/১৪২৯)।

ঘটনা ছিল এই যে, সম্রাট পুত্র শীরাওয়াইহ (شِيرَوَيْه) পিতা খসরু পারভেযকে হত্যা করে রাতারাতি পারস্যের সিংহাসন দখল করে নেয়। ৭ম হিজরীর ১০ই জুমাদাল ঊলা মঙ্গলবারের (১৫ই সেপ্টেম্বর ৬২৮ খৃ. বৃহস্পতিবার) রাতে এ আকস্মিক ঘটনা ঘটে যায়। তখন লোক দু’টি বাযানের কাছে ফিরে আসে। অতঃপর বাযান এবং তার বংশধর যারা ইয়ামনে ছিল সবাই ইসলাম কবুল করল’।[3]

অন্য বর্ণনায় এসেছে, পরদিন সকালে ঐ দু’জন লোক রাসূল (ছাঃ)-এর দরবারে এসে ঘটনা শুনে অবিশ্বাস ও বিস্ময়ভরে বলে উঠল, আমরা আপনার এই বাজে কথা সম্রাটের কাছে লিখে পাঠাব’। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, হ্যাঁ। তবে তাকে একথা বলো যে,

وَقُولاَ لَهُ: إِنَّ دِينِي وَسُلْطَانِي سَيَبْلُغُ مَا بلغ كسْرَى وينتهى إِلَى الْخُفِّ وَالْحَافِرِ، وَقُولاَ لَهُ: إِنْ أَسْلَمْتَ أَعْطَيْتُكَ مَا تَحْتَ يَدَيْكَ وَمَلَّكْتُكَ عَلَى قَوْمِكَ مِنَ الْأَبْنَاءِ-

‘আমার দ্বীন ও শাসন ঐ পর্যন্ত পৌঁছবে, যে পর্যন্ত কিসরা পৌঁছেছেন এবং সেখানে গিয়ে শেষ হবে, যার পরে আর উট ও ঘোড়ার পা চলবে না’। তাকে একথাও বলো, ‘যদি তিনি মুসলমান হয়ে যান, তবে তার অধিকারে যা কিছু রয়েছে, সব তাকে দেওয়া হবে এবং তাকে তোমাদের জাতির জন্য বাদশাহ করে দেওয়া হবে’।[4]

লক্ষ্যণীয় বিষয় যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তার পত্রে أَسْلِمْ تَسْلَمْ ‘ইসলাম কবুল করুন, নিরাপদ থাকুন’ কথাটি লিখেছিলেন, যা ছিল এক প্রকার ভবিষ্যদ্বাণী স্বরূপ। কিসরা সেটি প্রকাশ্যে অস্বীকার করেন ও পত্রটি ছিঁড়ে ফেলে চরম বেআদবী করেন। ফলে তার রাজনৈতিক নিরাপত্তা তার ছেলের মাধ্যমেই দ্রুত ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। পক্ষান্তরে একই কথা তিনি অন্য খ্রিষ্টান রাজা নাজাশীকে লিখলে তিনি ইসলাম কবুল করেন এবং তার রাজ্য নিরাপদ ও দৃঢ় হয়। অপর খ্রিষ্টান মিশরের রাজা মুক্বাউক্বিস ইসলাম কবুল না করলেও প্রত্যাখ্যান করেননি। বরং তিনি রাসূল (ছাঃ)-এর পত্র ও পত্রবাহক দূতকে সম্মানিত করেন ও মদীনায় মূল্যবান উপঢৌকনাদি প্রেরণ করেন। ফলে তার রাজ্য নিরাপদ থাকে।

বলা বাহুল্য যে, রাসূল (ছাঃ)-এর প্রদত্ত উক্ত আগাম খবরে বাযান ও ইয়ামনে বসবাসরত পারসিকরা সবাই মুসলমান হয়ে যায় ও তাদের শাসিত এলাকার অধিকাংশ লোক ইসলাম কবুল করে (ইবনু হিশাম ১/৬৯)।

[1]. বুখারী হা/৪৪২৪; যাদুল মা‘আদ ৩/৬০১।
[2]. ইবনু সা‘দ ১/১৯৯; ছহীহাহ হা/১৪২৯। জীবনীকারগণের বর্ণনায় এসেছে, مَزَّقَ اللهُ مُلْكَهُ ‘আল্লাহ তার সাম্রাজ্যকে ছিন্নভিন্ন করুন’ (আল-বিদায়াহ ৬/১৯৪; যাদুল মা‘আদ ৩/৬০১)।
[3]. তাবাক্বাত ইবনু সা‘দ (বৈরূত : দারুল কুতুবিল ইলমিয়াহ ১৪১০/১৯৯০) ১/১৯৯ পৃঃ।
[4]. আল-বিদায়াহ ৪/২৭০; ফিক্বহুস সীরাহ পৃঃ ৩৬২, সনদ ‘মুরসাল’ বা যঈফ।

মিসর রাজা মুক্বাউক্বিসের নিকটে পত্র

মিসর ও আলেকজান্দ্রিয়ার (الْإِسكَندَرِيَّة) খ্রিষ্টান সম্রাট জুরায়েজ বিন মীনা(جُرَيْج بنُ مِيْنَاء) ওরফে মুক্বাউক্বিস (الْمُقَوقِس)-এর নিকটে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একটি পত্র লেখেন। যার বাহক ছিলেন হযরত হাতেব বিন আবু বালতা‘আহ (রাঃ)। পত্রটি ছিল নিম্নরূপ:

بِسْمِ اللهِ الرّحْمَنِ الرّحِيمِ، مِنْ مُحَمّدٍ عَبْدِ اللهِ وَرَسُوْلِهِ إلَى الْمُقَوْقِسِ عَظِيمِ الْقِبْطِ سَلاَمٌ عَلَى مَنْ اتّبَعَ الْهُدَى أَمّا بَعْدُ فَإِنّي أَدْعُوْكَ بِدِعَايَةِ الْإِسْلاَمِ أَسْلِمْ تَسْلَمْ وَأَسْلِمْ يُؤْتِكَ اللهُ أَجْرَكَ مَرّتَيْنِ فَإِنْ تَوَلّيْتَ فَإِنَّ عَلَيْكَ إثْمَ الْقِبْطِ – يَا أَهْلَ الْكِتَابِ تَعَالَوْا إِلَى كَلِمَةٍ سَوَاءٍ بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمْ أَلاَّ نَعْبُدَ إِلاَّ اللهَ وَلاَ نُشْرِكَ بِهِ شَيْئًا وَلاَ يَتّخِذَ بَعْضُنَا بَعْضًا أَرْبَابًا مِنْ دُوْنِ اللهِ فَإِنْ تَوَلَّوْا فَقُولُوْا اشْهَدُوْا بِأَنَّا مُسْلِمُوْنَ-

‘করুণাময় কৃপানিধান আল্লাহর নামে’- ‘আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল মুহাম্মাদের পক্ষ হতে ক্বিবতীদের সম্রাট মুক্বাউক্বিসের প্রতি’। শান্তি বর্ষিত হৌক তাঁর প্রতি, যিনি হেদায়াতের অনুসরণ করেন। অতঃপর আপনাকে ইসলামের দাওয়াত দিচ্ছি। ইসলাম গ্রহণ করুন। নিরাপদ থাকুন। ইসলাম গ্রহণ করুন। আল্লাহ আপনাকে দ্বিগুণ পুরস্কার দান করবেন। কিন্তু যদি মুখ ফিরিয়ে নেন, তাহ’লে ক্বিবতীদের (অর্থাৎ মিসরীয়দের ইসলাম গ্রহণ না করার) পাপ আপনার উপরে বর্তাবে। (আল্লাহ বলেন,) ‘হে কেতাবধারীগণ! তোমরা এস...’ (আলে ইমরান ৩/৬৪)।

হযরত হাতেব বিন আবু বালতা‘আহ (রাঃ) পত্রখানা সম্রাটের হাতে অর্পণ করার পর বললেন, আপনার পূর্বে এই মিসরে এমন একজন শাসক গত হয়ে গেছেন, যিনি বলতেন,أَنَا رَبُّكُمُ الْأَعْلَى، فَأَخَذَهُ اللهُ نَكَالَ الْآخِرَةِ وَالْأُوْلَى ‘আমিই তোমাদের বড় পালনকর্তা’। ‘অতঃপর আল্লাহ তাকে পরকালের ও ইহকালের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দ্বারা পাকড়াও করলেন’ (নাযে‘আত ৭৯/২৪-২৫)। হাতেব (রাঃ) বলেন,فَاعْتَبِرْ بِغَيْرِكَ وَلاَ يَعْتَبِرُ غَيْرُك بِكَ ‘অতএব আপনি অন্যের থেকে শিক্ষা গ্রহণ করুন এবং অন্যেরা যেন আপনার থেকে শিক্ষা গ্রহণ না করে’। জওয়াবে মুক্বাউক্বিস বললেন,إنَّ لَنَا دِيْنًا لَنْ نَدَعَهُ إلاَّ لِمَا هُوَ خَيْرٌ مِنْهُ ‘নিশ্চয়ই আমাদের একটি দ্বীন রয়েছে। আমরা তা ছাড়তে পারি না, যতক্ষণ না তার চাইতে উত্তম কিছু পাই’। হাতেব (রাঃ) বললেন, আমরা আপনাকে ইসলামের দিকে আহবান জানাচ্ছি। যার মাধ্যমে আল্লাহ বিগত দ্বীনসমূহের অপূর্ণতাকে পূর্ণতা দান করেছেন। আমাদের নবী সকল মানুষকে আহবান জানিয়েছেন। কুরায়েশরা শক্তভাবে বিরোধিতা করে, ইহূদীরা শত্রুতা করে। কিন্তু নাছারাগণ নিকটবর্তী থাকে। আমার জীবনের কসম! ঈসার জন্য মূসার সুসংবাদ ছিল যেমন, মুহাম্মাদের জন্য ঈসার সুসংবাদও ছিল তেমন। কুরআনের প্রতি আপনাকে আমাদের আহবান ঐরূপ, যেমন ইনজীলের প্রতি তাওরাত অনুসারীদেরকে আপনার আহবান। যখন কোন নবীর আবির্ভাব ঘটে, তখন সেই যুগের সকল মানুষ তাঁর উম্মত হিসাবে গণ্য হয়। তখন তাদের কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায় তাঁর আনুগত্য করা। আপনি তাদের মধ্যেকার একজন, যিনি বর্তমান নবীর যামানা পেয়েছেন। আমরা মসীহের দ্বীন থেকে আপনাকে নিষেধ করছি না। বরং আমরা তাঁর দ্বীনের প্রতিই আপনাকে দাওয়াত দিচ্ছি’।

মুক্বাউক্বিস বললেন, আমি এ নবীর বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করেছি। আমি তাকে পেয়েছি এভাবে যে, তিনি কোন অপছন্দনীয় কাজের নির্দেশ দেন না। আমি তাঁকে ভ্রষ্ট জাদুকর বা মিথ্যুক গণৎকার হিসাবে পাইনি। আমি তাঁর সাথে নবুঅতের এই নিদর্শন পাচ্ছি যে, তিনি গায়েবী খবর প্রকাশ করছেন এবং পরামর্শের (মাধ্যমে কাজ করার) নির্দেশ দিচ্ছেন। অতএব আমি ভেবে দেখব’। অতঃপর তিনি পত্রখানা সসম্মানে হাতীর দাঁত দ্বারা নির্মিত একটি মূল্যবান বাক্সে রাখলেন এবং সীলমোহর দিয়ে যত্নসহকারে রাখার জন্য দাসীর হাতে দিলেন। অতঃপর আরবী জানা একজন কেরানীকে ডেকে নিম্নোক্ত জওয়াবী পত্র লিখলেন-

بِسْمِ اللهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيْمِ، لِمُحَمَّدِ بْنِ عَبْدِ اللهِ مِنَ الْمُقَوْقِسِ عَظِيمِ الْقِبْطِ سَلاَمٌ عَلَيْك أَمَّا بَعْدُ : فَقَدْ قَرَأْتُ كِتَابَك وَفَهِمْتُ مَا ذَكَرْتَ فِيهِ وَمَا تَدْعُو إلَيْهِ وَقَدْ عَلِمْتُ أَنَّ نَبِيًّا بَقِيَ وَكُنْتُ أَظُنُّ أَنّهُ يَخْرُجُ بِالشَّامِ وَقَدْ أَكْرَمْتُ رَسُوْلَك وَبَعَثْتُ إلَيْك بِجَارِيَتَيْنِ لَهُمَا مَكَانٌ فِي الْقِبْطِ عَظِيمٌ وَبِكِسْوَةٍ وَأَهْدَيْتُ إلَيْك بَغْلَةً لِتَرْكَبَهَا وَالسَّلاَمُ عَلَيْك-

‘করুণাময় কৃপানিধান আল্লাহর নামে’ ‘মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল্লাহর জন্য ক্বিবতী সম্রাট মুক্বাউকিবসের পক্ষ হতে- আপনার উপরে শান্তি বর্ষিত হউক! অতঃপর আমি আপনার পত্র পাঠ করেছি এবং সেখানে আপনি যা বর্ণনা করেছেন ও যেদিকে আহবান জানিয়েছেন, তা অনুধাবন করেছি। আমি জানি যে, একজন নবী আসতে বাকী রয়েছেন। আমি ধারণা করতাম যে, তিনি শাম (সিরিয়া) থেকে আবির্ভূত হবেন। আমি আপনার দূতকে সম্মান করেছি। আমি আপনার জন্য দু’জন দাসী পাঠালাম। ক্বিবতীদের মধ্যে যাদের উচ্চ মর্যাদা রয়েছে। আপনার জন্য এক জোড়া পোষাক এবং বাহন হিসাবে একটি খচ্চর উপঢৌকন স্বরূপ পাঠালাম। আপনার উপরে শান্তি বর্ষিত হৌক!’

মুক্বাউক্বিস এর বেশী কিছু লেখেননি, ইসলামও কবুল করেননি। দাসী দু’জন ছিল মারিয়াহ (مَارِيَةُ بنتِ شَمْعُونَ) ও তার বোন সীরীন (سِيْرِينُ)। মারিয়া ক্বিবতিয়ার গর্ভে রাসূল (ছাঃ)-এর শেষ সন্তান ইবরাহীমের জন্ম হয়। সীরীনকে কবি হাসসান বিন ছাবিত আনছারীকে দেওয়া হয়। ‘দুলদুল’ নামক উক্ত খচ্চরটি মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর যামানা পর্যন্ত জীবিত ছিল’।[1]

[1]. যাদুল মা‘আদ ৩/৬০৪; হায়ছামী, মাজমাউয যাওয়ায়েদ হা/৬৭৫১, সনদ ছহীহ।

ইয়ামামার খ্রিষ্টান শাসক হাওযাহ বিন আলীর নিকটে পত্র

পত্রবাহক সালীত্ব বিন ‘আমর আল-‘আমেরী (রাঃ) রাসূল (ছাঃ)-এর মোহরাংকিত পত্র নিয়ে সরাসরি প্রাপকের হাতে সমর্পণ করেন। পত্রটি ছিল নিম্নরূপ:

بِسْمِ اللهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيْمِ، مِنْ مُحَمّدٍ رَسُولِ اللهِ إلَى هَوْذَةَ بْنِ عَلِيِّ سَلاَمٌ عَلَى مَنِ اتَّبَعَ الْهُدَى وَاعْلَمْ أَنَّ دِينِي سَيَظْهَرُ إلَى مُنْتَهَى الْخُفِّ وَالْحَافِرِ فَأَسْلِمْ تَسْلَمْ وَأَجْعَلْ لَكَ مَا تَحْتَ يَدَيْكَ-

‘... আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদের পক্ষ হ’তে হাওযাহ বিন আলীর প্রতি। শান্তি বর্ষিত হৌক ঐ ব্যক্তির উপরে যিনি হেদায়াতের অনুসরণ করেন। আপনি জানুন যে, আমার দ্বীন বিজয়ী হবে যতদূর উট ও ঘোড়া যেতে পারে। অতএব আপনি ইসলাম কবুল করুন, নিরাপদ থাকুন। আপনার অধীনস্থ এলাকা আপনাকে প্রদান করব’।

ওয়াক্বেদী বর্ণনা করেন, এই সময় দামেষ্কের খ্রিষ্টান নেতা উরকূন (أُرْكُون) হাওযাহর নিকটে বসে ছিলেন। তিনি তাকে শেষনবী (ছাঃ) সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে হাওযাহ বলেন, তাঁর চিঠি আমার কাছে এসেছে। তিনি আমাকে ইসলামের দাওয়াত দিয়েছেন। কিন্তু আমি আমার ধর্মে দৃঢ় থাকতে চাই। তাছাড়া আমি আমার জাতির নেতা। যদি আমি তাঁর অনুসারী হই, তাহলে নেতৃত্ব হারাবো’। উরকূন বললেন, হ্যাঁ। তবে আল্লাহর কসম! যদি আপনি তাঁর অনুসারী হন, তাহলে অবশ্যই তিনি আপনাকে শাসন ক্ষমতায় রাখবেন। অতএব আপনার জন্য কল্যাণ রয়েছে তাঁর আনুগত্যের মধ্যে। নিশ্চয়ই তিনি সেই আরবী নবী, যার সুসংবাদ দিয়ে গেছেন ঈসা ইবনে মারিয়াম। আর আমাদের ইনজীলেও লিখিত আছে, মুহাম্মাদ রাসূলুল্লাহ’।

অতঃপর হাওযাহ পত্রবাহককে যথাযোগ্য আতিথ্য ও সম্মান প্রদর্শন করেন এবং পত্রের জওয়াবে তিনি লেখেন-

مَا أَحْسَنَ مَا تَدْعُو إلَيْهِ وَأَجْمَلَهُ وَالْعَرَبُ تَهَابُ مَكَانِي فَاجْعَلْ إلَيَّ بَعْضَ الْأَمْرِ أَتْبَعُكَ-

‘কতই না সুন্দর ও উত্তম বিষয়ের দিকে আপনি আমাকে আহবান জানিয়েছেন। আরব জাতি আমার উঁচু স্থানকে ভীতির চোখে দেখে। অতএব আপনার রাজত্বের কিছু অংশ আমাকে দান করুন, তাহলে আপনার আনুগত্য করব’। রাসূল (ছাঃ) তাতে অস্বীকার করেন। ফলে সে নিজে ধ্বংস হল এবং যেটুকু তার অধীনে ছিল তাও হারালো’ (যাদুল মা‘আদ পৃঃ ৩/৬০৭-৬০৮)। অর্থাৎ নেতৃত্ব চেয়ে নেওয়াটাই ছিল তার ধ্বংসের কারণ ।

বালক্বা (দামেশ্ক্ব)-এর খ্রিষ্টান শাসক হারেছ বিন আবু শিম্র আল-গাসসানীর নিকটে পত্র

সিরিয়ার বনু আসাদ বিন খোযায়মা গোত্রভুক্ত ছাহাবী শুজা‘ বিন ওয়াহাব আল-আসাদী (রাঃ)-কে পত্রবাহক হিসাবে প্রেরণ করা হয়। পত্রটি ছিল নিম্নরূপ:

بِسْمِ اللهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيْمِ مِنْ مُحَمّدٍ رَسُولِ اللهِ إلَى الْحَارِثِ بْنِ أَبِيْ شِمْرٍ سَلاَمٌ عَلَى مَنِ اتَّبَعَ الْهُدَى وَآمَنَ بِاللهِ وَصَدَّقَ وَإِنِّي أَدْعُوْكَ إلَى أَنْ تُؤْمِنَ بِاللهِ وَحْدَهُ لاَ شَرِيكَ لَهُ يَبْقَى لَكَ مُلْكُكَ-

‘... আমি আপনাকে আহবান জানাচ্ছি যে, আপনি আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করুন। যিনি এক, যার কোন শরীক নেই। আপনার রাজত্ব বাকী থাকবে’।

পত্র পাঠে হারেছ সদম্ভে বলে উঠলেন, مَنْ يَّنْزِعُ مُلُكِيْ مِنِّيْ؟ أَنَا سَائِرٌ إِلَيْهِ ‘কে আমার রাজ্য ছিনিয়ে নিবে? আমি তার দিকে সৈন্য পরিচালনা করব’। তিনি ইসলাম কবুল করলেন না (যাদুল মা‘আদ পৃঃ ৩/৬০৮-৬০৯)।

বাহরায়নের শাসক মুনযির বিন সাওয়া-র নিকটে পত্র

পারস্য সম্রাটের গবর্ণর বাহরায়নের শাসক মুনযির বিন সাওয়া-র নিকটে ইসলামের দাওয়াত দিয়ে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) ‘আলা ইবনুল হাযরামী (রাঃ)-কে পত্রবাহক হিসাবে প্রেরণ করেন। পত্র পেয়ে তিনি ইসলাম কবুল করেন এবং বাহরায়নের অধিকাংশ লোক মুসলমান হয়ে যায়। অতঃপর তিনি জওয়াবী পত্রে রাসূল (ছাঃ)-কে লেখেন, হে আল্লাহর রাসূল! বাহরায়েন বাসীদের অনেকে ইসলাম পছন্দ করেছে ও কবুল করেছে, অনেকে অপছন্দ করেছে। আমার এ মাটিতে অনেক মজূসী (অগ্নিউপাসক) ও ইহূদী রয়েছে। অতএব এদের বিষয়ে আপনার নির্দেশ কি আমাকে জানাতে মর্যী হয়’। তখন রাসূল (ছাঃ) তার জওয়াবে লিখলেন,

بِسْمِ اللهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ، مِنْ مُحَمَّدٍ رَسُولِ اللهِ إلَى الْمُنْذِرِ بْنِ سَاوَى سَلاَمٌ عَلَيْكَ فَإِنِّي أَحْمَدُ إلَيْك اللهَ الَّذِيْ لاَ إلَهَ إلاَّ هُوَ وَأَشْهَدُ أَنْ لاَ إلَهَ إلاَّ اللهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُوْلُهُ، أَمَّا بَعْدُ : فَإِنِّيْ أُذَكِّرُكَ اللهَ عَزَّ وَجَلَّ فَإِنَّهُ مَنْ يَنْصَحْ فَإِنَّمَا يَنْصَحُ لِنَفْسِهِ وَإِنَّهُ مَنْ يُطِعْ رُسُلِيْ وَيَتَّبِعْ أَمْرَهُمْ فَقَدْ أَطَاعَنِيْ وَمَنْ نَصَحَ لَهُمْ فَقَدْ نَصَحَ لِيْ وَإِنَّ رُسُلِيْ قَدْ أَثْنَوْا عَلَيْكَ خَيْرًا وَإِنِّي قَدْ شَفَعْتُكَ فِيْ قَوْمِك فَاتْرُكْ لِلْمُسْلِمِيْنَ مَا أَسْلَمُوْا عَلَيْهِ وَعَفَوْتُ عَنْ أَهْلِ الذُّنُوبِ فَاقْبَلْ مِنْهُمْ وَإِنَّكَ مَهْمَا تُصْلِحْ فَلَنْ نَعْزِلَكَ عَنْ عَمَلِكَ وَمَنْ أَقَامَ عَلَى يَهُوْدِيَّةٍ أَوْ مَجُوْسِيَّةٍ فَعَلَيْهِ الْجِزْيَةُ-

‘করুণাময় কৃপানিধান আল্লাহর নামে। আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদের পক্ষ হতে মুনযির বিন সাওয়ার প্রতি। আপনার উপরে শান্তি বর্ষিত হৌক! অতঃপর আমি আপনার নিকটে আল্লাহর প্রশংসা করছি, যিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই এবং আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ তাঁর বান্দা ও তাঁর রাসূল। অতঃপর আমি আপনাকে মহান আল্লাহর কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি। কেননা যে ব্যক্তি উপদেশ গ্রহণ করে, সে তার নিজের জন্যই তা করে। যে ব্যক্তি আমার প্রেরিত দূতদের আনুগত্য করে ও তাদের নির্দেশের অনুসরণ করে, সে ব্যক্তি আমার আনুগত্য করে। যে ব্যক্তি তাদের প্রতি সদাচরণ করে, সে আমার প্রতি সদাচরণ করে। আমার দূতগণ আপনার সম্পর্কে উত্তম প্রশংসা করেছে। আপনার জাতি সম্পর্কে আমি আপনার সুফারিশ কবুল করলাম। অতএব মুসলমানদেরকে তাদের অবস্থার উপরে ছেড়ে দিন। অপরাধীদের আমি ক্ষমা করলাম। আপনিও ক্ষমা করুন। অতঃপর যতদিন আপনি সংশোধনের পথে থাকবেন, ততদিন আমরা আপনাকে দায়িত্ব হতে অপসারণ করব না। আর যে ব্যক্তি ইহূদী বা মজূসী ধর্মের উপরে থাকবে, তার উপরে জিযিয়া কর আরোপিত হবে’।[1] ইবনুল ক্বাইয়িম এটি হোনায়েন যুদ্ধের পর ৮ম হিজরীর যুলক্বা‘দাহ মাসে জি‘ইর্রানাহ থেকে ফেরার পূর্বের এবং ইবনু হিশাম এটি ৮ম হিজরীর রামাযান মাসে মক্কা বিজয়ের পূর্বের ঘটনা বলেছেন।[2]

[1]. যাদুল মা‘আদ ৩/৬০৫, ইবনু হিশাম ২/৫৭৬।
[2]. যাদুল মা‘আদ ১/১১৯; ইবনু হিশাম ২/৫৭৬।

ওমানের সম্রাটের নিকটে পত্র

৮ম হিজরীর যুলক্বা‘দাহ মাসে ওমানের খ্রিষ্টান সম্রাট জায়ফার ও তার ভাই আব্দ-এর নামে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) পত্র লেখেন। পত্রবাহক ছিলেন হযরত আমর ইবনুল ‘আছ (রাঃ)। পত্রটি ছিল নিম্নরূপ:

بِسْمِ اللهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ مِنْ مُحَمّدِ بْنِ عَبْدِ اللهِ إلَى جَيْفَرَ وَعَبْدٍ ابْنَيِ الْجُلَنْدَى سَلاَمٌ عَلَى مَنِ اتَّبَعَ الْهُدَى، أَمَّا بَعْدُ : فَإِنِّي أَدْعُوكُمَا بِدِعَايَةِ الْإِسْلاَمِ أَسْلِمَا تَسْلَمَا فَإِنِّي رَسُولُ اللهِ إلَى النَّاسِ كَافَّةً لِأُنْذِرَ مَنْ كَانَ حَيًّا وَيَحِقَّ الْقَوْلُ عَلَى الْكَافِرِينَ، فَإِنَّكُمَا إنْ أَقْرَرْتُمَا بِالْإِسْلاَمِ وَلَّيْتُكُمَا وَإِنْ أَبَيْتُمَا أَنْ تُقِرَّا بِالْإِسْلاَمِ فَإِنَّ مُلْكَكُمَا زَائِلٌ عَنْكُمَا وَخَيْلِيْ تَحُلُّ بِسَاحَتِكُمَا وَتَظْهَرُ نُبُوَّتِيْ عَلَى مُلْكِكُمَا-

‘... আব্দুল্লাহর পুত্র মুহাম্মাদের পক্ষ হ’তে জুলান্দা আযদীর দুই পুত্র জায়ফার ও আব্দের প্রতি। শান্তি বর্ষিত হৌক ঐ ব্যক্তির উপরে যিনি হেদায়াতের অনুসরণ করেন। অতঃপর আমি আপনাদের দু’জনকে ইসলামের দিকে আহবান জানাচ্ছি। আপনারা ইসলাম কবুল করুন, নিরাপদ থাকুন। আমি সমগ্র মানবজাতির প্রতি আল্লাহর রাসূল হিসাবে প্রেরিত হয়েছি, যাতে আমি জীবিতদের সতর্ক করি এবং কাফিরদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। অতঃপর যদি আপনারা ইসলাম কবুল করেন, তবে আপনাদেরকেই আমি গবর্ণর নিযুক্ত করে দেব। আর যদি ইসলাম কবুলে অস্বীকার করেন, তাহ’লে আপনাদের রাজত্ব শেষ হয়ে যাবে। আমার ঘোড়া আপনাদের এলাকায় প্রবেশ করবে ও আমার নবুঅত আপনাদের রাজ্যে বিজয়ী হবে’।

আমর ইবনুল ‘আছ (রাঃ) বলেন, পত্রটি নিয়ে আমি ওমান গেলাম এবং ছোট ভাই আব্দের নিকটে আগে পৌঁছলাম। কেননা ইনি ছিলেন অধিক দূরদর্শী ও নম্র স্বভাবের মানুষ। আমি তাকে বললাম যে, ‘আমি আপনার ও আপনার ভাইয়ের নিকটে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-এর দূত হিসাবে এসেছি’। তিনি বললেন, বয়সে ও রাজত্বে ভাই আমার চেয়ে বড়। আমি আপনাকে তাঁর নিকটে পৌঁছে দিচ্ছি, যাতে তিনি আপনার পত্র পাঠ করেন। অতঃপর তিনি বললেন, وَمَا تَدْعُو إلَيْهِ ؟ ‘কোন দিকে আপনি আমাদের দাওয়াত দিচ্ছেন’? আমি বললাম, আমি আল্লাহর দিকে আহবান জানাচ্ছি। যিনি এক, যার কোন শরীক নেই। তিনি ব্যতীত অন্য সকল উপাস্য হতে আপনি পৃথক হয়ে যাবেন এবং সাক্ষ্য দিবেন যে, মুহাম্মাদ তাঁর বান্দা ও তাঁর রাসূল। তিনি বললেন, হে আমর! আপনি আপনার গোত্রের নেতার পুত্র। বলুন, আপনার পিতা কেমন আচরণ করেছেন? কেননা তাঁর মধ্যে আমাদের জন্য শিক্ষণীয় রয়েছে। আমি বললাম, তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন এমতাবস্থায় যে, মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর উপরে বিশ্বাস স্থাপন করেননি। কতই না ভাল হত যদি তিনি ইসলাম কবুল করতেন ও রাসূলকে সত্য বলে জানতেন। আমিও তাঁর মতই ছিলাম। কিন্তু আল্লাহ আমাকে ইসলামের পথ প্রদর্শন করেছেন। তিনি বললেন, কবে আপনি তাঁর অনুসারী হয়েছেন? আমি বললাম, অল্প কিছুদিন পূর্বে’।[1]

তিনি বললেন, কোথায় আপনি ইসলাম কবুল করলেন? বললাম, নাজাশীর দরবারে এবং আমি তাকে এটাও বললাম যে, নাজাশীও মুসলমান হয়ে গেছেন। তিনি বললেন, তাঁর রাজত্বের ব্যাপারে তাঁর সম্প্রদায় কি আচরণ করল? আমি বললাম, তারা তাঁকে স্বপদে রেখেছে ও তাঁর অনুসারী (মুসলমান) হয়েছে’। তিনি আশ্চর্য হয়ে বললেন, বিশপ ও পাদ্রীগণও তাঁর অনুসারী হয়েছে? আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি বললেন, হে আমর! আপনি কি বলছেন ভেবে-চিন্তে দেখুন। কেননা মিথ্যা বলার চাইতে নিকৃষ্ট স্বভাব মানুষের জন্য আর কিছুই নেই। আমি বললাম, আমি মিথ্যা বলিনি এবং আমাদের ধর্মেও এটা সিদ্ধ নয়। অতঃপর তিনি বললেন, আমার ধারণা হেরাক্বল নাজাশীর ইসলাম কবুলের খবর জানেন না। আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি জানেন। তিনি বললেন, কিভাবে এটা আপনি বুঝলেন? আমি বললাম, নাজাশী ইতিপূর্বে তাঁকে খাজনা দিতেন। কিন্তু ইসলাম গ্রহণের পরে তিনি বললেন,وَاللهِ لَوْ سَأَلَنِي دِرْهَمًا وَاحِدًا مَا أَعْطَيْتُهُ ‘আল্লাহর কসম! এখন যদি তিনি আমার নিকটে একটি দিরহামও চান, আমি তাকে দেব না’। হেরাক্বলের নিকটে এখবর পৌঁছে গেলে তার ভাই ‘নিয়াক্ব’ (نِيَاق) তাকে বলেন, আপনি কি ঐ গোলামটাকে ছেড়ে দিবেন, যে আপনাকে খাজনা দেবে না? আবার আপনার ধর্ম ত্যাগ করে একটা নতুন ধর্ম গ্রহণ করবে? জবাবে হেরাক্বল বললেন, একজন লোক একটি ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে এবং তা নিজের জন্য পছন্দ করেছে। এক্ষণে আমি তার কি করব? وَاللهِ لَوْلاَ الضَّنَّ بِمُلْكِيْ لَصَنَعْتُ كَمَا صَنَعَ ‘আল্লাহর কসম! যদি আমার মধ্যে সাম্রাজ্যের বিষয়টি না থাকত, তবে আমিও তাই করতাম, যা সে করেছে’। আব্দ বললেন, ভেবে দেখুন আমর আপনি কি বলছেন? আমি বললাম, وَاللهِ صَدَّقْتُكَ আল্লাহর কসম! আমি আপনাকে সত্য বলছি’। আব্দ বললেন, এখন আপনি বলুন, তিনি কোন কোন বিষয়ে নির্দেশ দেন ও কোন কোন বিষয়ে নিষেধ করেন? আমি বললাম, তিনি আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের নির্দেশ দেন এবং তাঁর অবাধ্য হতে নিষেধ করেন। তিনি সৎকাজের ও আত্মীয়তা রক্ষার আদেশ দেন এবং যুলুম, সীমা লংঘন, ব্যভিচার, মদ্যপান, পাথর, মূর্তি ও ক্রুশ পূজা হতে নিষেধ করেন।

আব্দ বললেন, مَا أَحْسَنَ هَذَا الَّذِيْ يَدْعُو إلَيْهِ ‘ইনি কতই না সুন্দর বিষয়ের দিকে আহবান করেন! যদি আমার ভাই আমার অনুগামী হতেন, তাহলে আমরা দু’জনে মুহাম্মাদ-এর দরবারে গিয়ে ঈমান আনতাম ও তাঁকে সত্য বলে ঘোষণা করতাম’। কিন্তু আমার ভাই এ দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করলে স্বীয় রাজত্বের জন্য অধিক ক্ষতিকর প্রমাণিত হবেন এবং আপাদমস্তক গোনাহগার হবেন’। আমি বললাম, যদি তিনি ইসলাম কবুল করেন, তবে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) তাঁকে বাদশাহ হিসাবে বহাল রাখবেন। তিনি কেবল ধনীদের নিকট থেকে ছাদাক্বা গ্রহণ করবেন ও গরীবদের মধ্যে তা বণ্টন করবেন। তিনি বললেন, এটা খুবই সুন্দর আচরণ। তবে ছাদাক্বা কি জিনিষ? তখন আমি তাকে বিভিন্ন মাল-সম্পদের এমনকি উটের যাকাত সম্পর্কে বর্ণনা করলাম, যা আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) ফরয করেছেন। তিনি বললেন, হে আমর! আমাদের চতুষ্পদ জন্তু সমূহ থেকেও ছাদাক্বা নেওয়া হবে, যারা স্বাধীনভাবে ঘাস-পাতা খেয়ে চরে বেড়ায়? আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি বললেন, আল্লাহর কসম! আমার মনে হয় না যে, আমার কওম তাদের রাজ্যের বিশালতা ও লোকসংখ্যার আধিক্য সত্ত্বেও এটা মেনে নিবে’।

আমর ইবনুল ‘আছ (রাঃ) বলেন, আমি সেখানে কয়েকদিন অবস্থান করলাম। তিনি তাঁর ভাইয়ের কাছে গেলেন ও আমার ব্যাপারে তাকে সবকিছু অবহিত করলেন। অতঃপর একদিন তিনি (অর্থাৎ সম্রাট) আমাকে ডেকে পাঠালেন। আমি ভিতরে প্রবেশ করলে তার প্রহরীরা আমাকে দু’বাহু ধরে নিয়ে গেল। তিনি বললেন, ওকে ছেড়ে দাও’। আমাকে ছেড়ে দেওয়া হল। আমি বসতে গেলাম। কিন্তু তারা আমাকে বসতে দিল না। আমি তখন সম্রাটের দিকে তাকালাম। তিনি বললেন, আপনার প্রয়োজন সম্পর্কে বলুন। তখন আমি মোহরাংকিত পত্রটি তাঁর নিকটে দিলাম। তিনি সীলমোহরটি ছিঁড়লেন এবং পত্রটি পড়ে শেষ করলেন। অতঃপর সেটা তার ভাইয়ের হাতে দিলেন। তিনিও সেটা পাঠ করলেন। আমি দেখলাম যে, তার ভাই তার চাইতে অধিকতর কোমল হৃদয়ের।

অতঃপর সম্রাট আমাকে কুরায়েশদের অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। আমি বললাম, تَبِعُوْهُ، إمَّا رَاغِبٌ فِي الدِّيْنِ وَإِمَّا مَقْهُوْرٌ بِالسَّيْفِ ‘তারা তাঁর অনুগত হয়েছে। কেউ দ্বীনের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে, কেউ তরবারির দ্বারা পরাভূত হয়ে’। তিনি বললেন, তাঁর সাথে কারা আছেন? আমি বললাম, যারা ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন এবং অন্য সবকিছুর উপরে একে স্থান দিয়েছেন। অতঃপর আল্লাহ প্রদত্ত হেদায়াতের সাথে সাথে নিজেদের জ্ঞান দ্বারা উপলব্ধি করেছেন যে, তারা ইতিপূর্বে ভ্রষ্টতার মধ্যে ছিলেন’। এতদঞ্চলে আপনি ব্যতীত আর কেউ (অর্থাৎ আর কোন সম্রাট তার দ্বীনে প্রবেশ করতে) বাকী আছেন বলে আমার জানা নেই। আজ যদি আপনি ইসলাম কবুল না করেন এবং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর অনুগামী না হন, তাহ’লে অশ্বারোহী বাহিনী আপনাকে পদদলিত করবে এবং আপনার শস্যক্ষেত সমূহ ধ্বংস করবে। অতএব আপনি ইসলাম কবুল করুন। নিরাপদ থাকুন। আপনাকে আপনার জাতির উপরে তিনি শাসক নিযুক্ত করবেন এবং আপনার এলাকায় অশ্বারোহী বা পদাতিক বাহিনী প্রবেশ করবে না। সম্রাট বললেন,دَعْنِيْ يَوْمِيْ هَذَا وَارْجِعْ إلَيَّ غَدًا ‘আজকের দিনটা আমাকে সময় দিন। কাল আপনি পুনরায় আসুন’।

সম্রাটের দরবার থেকে বেরিয়ে আমি পুনরায় তাঁর ভাইয়ের কাছে ফিরে গেলাম। তিনি বললেন, يَا عَمْرُو إنِّيْ لَأَرْجُو أَنْ يُسْلِمَ إنْ لَمْ يَضِنَّ بِمُلْكِهِ ‘হে আমর! আমি মনে করি সম্রাট মুসলমান হবেন, যদি তাঁকে রাজত্ব থেকে বিচ্যুত না করা হয়’।

কথা মত দ্বিতীয় দিন সকালে আমি দরবারে গেলাম। কিন্তু তিনি অনুমতি দিতে অস্বীকার করলেন। আমি তার ভাইয়ের কাছে ফিরে গিয়ে বিষয়টি বললাম। তখন তিনি আমাকে সেখানে পৌঁছে দিলেন। অতঃপর সম্রাট আমাকে বললেন, আমি আপনার আবেদনের বিষয়টি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করেছি। দেখুন, যদি আমি এমন এক ব্যক্তির নিকটে আমার রাজত্ব সমর্পণ করি, যার অশ্বারোহী দল এখনো এখানে পৌঁছেনি, তাহলে আমি ‘আরবদের দুর্বলতম ব্যক্তি’ (أَضْعَفُ الْعَرَبِ) হিসাবে পরিগণিত হব। আর যদি তার অশ্বারোহী দল এখানে পৌঁছে যায়, তাহলে এমন লড়াইয়ের সম্মুখীন তারা হবে, যা ইতিপূর্বে তারা কখনো হয়নি।’ একথা শুনে আমি বললাম, বেশ, আগামীকাল তাহলে আমি চলে যাচ্ছি(فَأَنَا خَارِجٌ غَدًا)।

অতঃপর যখন তিনি আমার চলে যাওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত হলেন, তখন তার ভাইকে নিয়ে একান্তে বৈঠক করলেন। ভাই তাকে বললেন, مَا نَحْنُ فِيْمَا قَدْ ظَهَرَ عَلَيْهِ وَكُلُّ مَنْ أَرْسَلَ إلَيْهِ قَدْ أَجَابَهُ ‘আমরা তাদের তুলনায় কিছুই নই, যাদের উপরে তিনি বিজয়ী হয়েছেন। আর যার নিকটেই তিনি দূত পাঠিয়েছেন, তিনি তা কবুল করে নিয়েছেন’।

পরদিন সকালে সম্রাট আমাকে ডেকে পাঠালেন। সম্রাট ও তাঁর ভাই উভয়ে ইসলাম কবুল করলেন এবং রাসূল (ছাঃ)-কে সত্য বলে ঘোষণা করলেন। অতঃপর তারা আমাকে ছাদাক্বা গ্রহণ ও এ বিষয়ে লোকদের মধ্যে মীমাংসা করার জন্য ঢালাও অনুমতি দিলেন এবং আমার বিরুদ্ধাচারীদের বিরুদ্ধে সাহায্যকারী হলেন। অতঃপর প্রজাদের অধিকাংশ মুসলমান হয়ে যায়’।[2]

[1]. অর্থাৎ ৭ম হিজরীর প্রথম দিকে’ (আর-রাহীক্ব ৩৪৭-৪৮ পৃঃ টীকা সহ)।
[2]. যাদুল মা‘আদ ৩/৬০৫-৬০৭, তাবাক্বাত ইবনু সা‘দ ১/২৬৩, যায়লাঈ, নাছবুর রা’য়াহ ৪/৪২৩-২৪।

হাবশার সম্রাট নাজাশীর নিকটে পত্র

৯ম হিজরীর রজব মাসে হাবশার সম্রাট প্রথম নাজাশীর মৃত্যুর পরে নতুন নাজাশীর নিকটে এই পত্র পাঠানো হয়। ‘আমর বিন উমাইয়া যামরী (রাঃ)-এর মাধ্যমে প্রেরিত উক্ত পত্রের ভাষ্য ছিল নিম্নরূপ:

هَذَا كِتَابُ مُحَمَّدٍ رَسُوْلِ اللهِ إِلَى النَّجَاشِيِّ الْأَصْحَمِ عَظِيْمِ الْحَبَشِ سَلاَمٌ عَلَى مَنِ اتَّبَعَ الْهُدَى، وَآمَنَ بِاللهِ وَرَسُوْلِهِ، وَشَهِدَ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيْكَ لَهُ، لَمْ يَتَّخِذْ صَاحِبَةً وَلاَ وَلَدًا، وَأَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُوْلُهُ، أَدْعُوْكَ بِدُعَاءِ اللهِ، فَإِنِّي أَنَا رَسُوْلُ اللهِ، فَأَسْلِمْ تَسْلَمْ، (يَا أَهْلَ الْكِتَابِ تَعَالَوْا إِلَى كَلَمَةٍ سَوَاء بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمْ أَلاَّ نَعْبُدَ إِلاَّ اللهَ وَلاَ نُشْرِكَ بِهِ شَيْئًا وَلاَ يَتَّخِذَ بَعْضُنَا بَعْضاً أَرْبَابًا مِّنْ دُوْنِ اللهِ فَإِنْ تَوَلَّوْا فَقُولُوا اشْهَدُوْا بِأَنَّا مُسْلِمُونَ) فَإِنْ أَبَيْتَ فَعَلَيْكَ إِثْمُ النَّصَارَى مِنْ قَوْمِكَ-

‘এটি আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ-এর পক্ষ হ’তে প্রেরিত পত্র হাবশার সম্রাট আছহামা নাজাশীর নিকটে। শান্তি বর্ষিত হৌক ঐ ব্যক্তির উপরে যিনি হেদায়াতের অনুসরণ করেন এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূল-এর উপরে ঈমান আনেন এবং সাক্ষ্য দেন যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। তিনি এক, তাঁর কোন শরীক নেই। তিনি কোন স্ত্রী বা সন্তান গ্রহণ করেন না। আর মুহাম্মাদ তাঁর বান্দা ও রাসূল।

আমি আপনাকে আল্লাহর দিকে আহবান জানাচ্ছি। নিশ্চয়ই আমি আল্লাহর রাসূল। অতঃপর আপনি ইসলাম কবুল করুন। নিরাপদ থাকুন। (আল্লাহ বলেন, হে নবী!) ‘তুমি বল, হে কিতাবধারীগণ! এসো এমন একটি কথার দিকে, যা আমাদের ও তোমাদের মাঝে সমান। আর তা এই যে, আমরা আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারু ইবাদত করব না এবং আমরা তার সাথে কোন কিছুকে শরীক করব না। আর আল্লাহ ব্যতীত আমরা কাউকে ‘রব’ হিসাবে গ্রহণ করব না। এরপর যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে তাদের বলে দাও, তোমরা সাক্ষী থাকো যে, আমরা মুসলমান’ (আলে ইমরান ৩/৬৪)। অতঃপর যদি আপনি দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করেন, তাহলে আপনার উপরে আপনার খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের পাপ বর্তাবে’।[1]

ইবনু কাছীর (রহঃ) বলেন, বর্ণনাটি বায়হাক্বী হাবশায় হিজরত প্রসঙ্গে এনেছেন এবং নাজাশীর নাম ‘আছহামা’ বলেছেন, যা ভুল। কেননা এই পত্রে সূরা আলে ইমরানের ৬৪ আয়াতটি উল্লেখ রয়েছে। যা মদীনায় নাযিল হয়। যুহরী বলেন, আহলে কিতাব রাজা-বাদশাহদের নিকট প্রেরিত সকল পত্রে উক্ত আয়াতটি উল্লেখিত ছিল। অতএব এই পত্রটি প্রেরিত হয়েছিল প্রথম নাজাশীর মৃত্যুর পরে নতুন নাজাশীর নিকটে। রাবীর ভুলে ‘আছহামা’ নামটি যোগ হয়েছে মাত্র (আল-বিদায়াহ ৩/৮৩)। একই কথা বলেছেন, ইবনু হাযম ও ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ)। ইবনু হাযম বলেন, শেষের নাজাশী ইসলাম কবুল করেননি’ (যাদুল মা‘আদ ১/১১৭, ৩/৬০৩)। প্রথম নাজাশী মুসলমান ছিলেন। যিনি ৯ম হিজরীর রজব মাসে ইন্তেকাল করেন (আল-ইছাবাহ, আছহামা ক্রমিক ৪৭৩)। আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাদেরকে সাথে নিয়ে বাক্বী‘ গারক্বাদের মুছাল্লায় গিয়ে তার গায়েবানা জানাযা পড়েন। আমরা তাঁর পিছনে কাতারবন্দী হই এবং তিনি চার তাকবীরে ছালাত আদায় করেন।[2] আবু হুরায়রা (রাঃ) ৭ম হিজরীর মুহাররম মাসে খায়বর যুদ্ধ শেষে সেখানে গিয়ে ইসলাম কবুল করেন (আল-ইছাবাহ, আবু হুরায়রা ক্রমিক ১০৬৭৪)। জানাযায় তাঁর উপস্থিতি প্রমাণ করে যে, নাজাশী ৭ম হিজরীর পরে মারা গেছেন। অতএব সুহায়লী, ইবনু কাছীর, ইবনু হাজার প্রমুখ বিদ্বানগণের বক্তব্য অনুযায়ী উপরোক্ত চিঠি ৯ম হিজরীর রজব মাসে নাজাশীর মৃত্যুর পর নতুন নাজাশীর নিকট তাবূক যুদ্ধে যাওয়ার পূর্বে বা যুদ্ধ থেকে ফেরার পর রামাযান মাসে প্রেরিত হয় বলে নিশ্চিতভাবে প্রতীয়মান হয়। যদিও ওয়াক্বেদী, ত্বাবারী প্রমুখ জীবনীকারগণ এটিকে ৬ষ্ঠ হিজরীর যিলহজ্জ মাসে প্রেরিত বলেছেন (সীরাহ ছহীহাহ ২/৪৫৪)। ইবনুল ক্বাইয়িম ও মুবারকপুরী উভয়ে চিঠিটি এক নম্বরে এনেছেন এবং ৬টি চিঠিকে ৬জন পত্র বাহকের মাধ্যমে ৭ম হিজরীর মুহাররম মাসে একই দিনে প্রেরিত বলেছেন।[3] যা বাস্তবতার সাথে অমিল। সেকারণ পূর্বাপর বিবেচনায় আমরা পত্রটিকে শেষে আনলাম। আল্লাহ সর্বাধিক অবগত।

উল্লেখ্য যে, পত্রবাহক ‘আমর বিন উমাইয়া যামরী মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর খেলাফতকালে (৪০-৬০ হিঃ) মদীনায় মৃত্যুবরণ করেন। আবু নু‘আইম বলেন, তিনি ৬০ হিজরীর পূর্বে মারা যান (আল-ইছাবাহ, ‘আমর বিন উমাইয়া, ক্রমিক ৫৭৬৯)।

[1]. আল-বিদায়াহ ৩/৮৩; হাকেম হা/৪২৪৪।
[2]. ইবনু মাজাহ হা/১৫৩৪; বুখারী হা/১২৪৫; মুসলিম হা/৯৫১।
[3]. যাদুল মা‘আদ ১/১১৬, ৩/৬০১; আর-রাহীক্ব ৩৫০-৫১ পৃঃ।

 ইয়ামনের শাসকের নিকট প্রেরিত পত্র (الكتاب إلى ملك اليمن)
৯ম হিজরীর রামাযান মাসে তাবূক যুদ্ধ থেকে ফেরার পথে অথবা ১০ম হিজরীর রবীউল আউয়াল মাসে আবু মূসা আশ‘আরী ও মু‘আয বিন জাবাল (রাঃ)-কে পাঠানো হয়। তাদের দাওয়াতে সেখানকার অধিকাংশ অধিবাসী স্বেচ্ছায় ইসলাম কবুল করে। তাঁদের পরে আলী (রাঃ)-কে সেখানে পাঠানো হয়। অতঃপর তিনি সেখান থেকে সরাসরি বিদায় হজ্জে গিয়ে রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে মিলিত হন।

হিমইয়ারী শাসকদের নিকটে প্রেরিত পত্র

জারীর বিন আব্দুল্লাহ বাজালীকে যুল-কালা‘(ذُو الْكَلاَع) হিমইয়ারী ও যু-‘আমরের নিকটে পাঠানো হয়। তারা উভয়ে ইসলাম কবুল করেন। অতঃপর জারীর বিন আব্দুল্লাহ সেখানে থাকা অবস্থায় রাসূল (ছাঃ) মৃত্যুবরণ করেন (যাদুল মা‘আদ ১/১১৯)।

এভাবে তৎকালীন বিশ্বের ক্ষমতাধর অধিকাংশ রাজা-বাদশাহর নিকটে পত্রের মাধ্যমে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে দেন। দু’একজন বাদে প্রায় সকলেই তাঁর দাওয়াত কবুল করেছিলেন। যারা অস্বীকার করেছিল, তাদের কাছেও শেষনবী (ছাঃ) ও ইসলাম পরিচিতি লাভ করে। এভাবে ইসলাম সার্বজনীন ও বিশ্বধর্মে পরিণত হয়।



প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর ৬৭ পর্বের জীবনীর সকল পর্ব এখান থেকে পড়ুন-

পর্ব-০১   পর্ব-০২   পর্ব-০৩   পর্ব-০৪   পর্ব-০৫   পর্ব-০৬   পর্ব-০৭   পর্ব-০৮   পর্ব-০৯   পর্ব-১০   পর্ব-১১   পর্ব-১২   পর্ব-১৩   পর্ব-১৪   পর্ব-১৫   পর্ব-১৬   পর্ব-১৭   পর্ব-১৮   পর্ব-১৯   পর্ব-২০   পর্ব-২১   পর্ব-২২   পর্ব-২৩   পর্ব-২৪   পর্ব-২৫   পর্ব-২৬   পর্ব-২৭   পর্ব-২৮   পর্ব-২৯   পর্ব-৩০    পর্ব-৩১   পর্ব-৩২   পর্ব-৩৩   পর্ব-৩৪   পর্ব-৩৫   পর্ব-৩৬   পর্ব-৩৭   পর্ব-৩৮   পর্ব-৩৯   পর্ব-৪০   পর্ব-৪১   পর্ব-৪২   পর্ব-৪৩   পর্ব-৪৪   পর্ব-৪৫   পর্ব-৪৬(১ম) পর্ব-৪৬(২য়)    পর্ব-৪৭   পর্ব-৪৮   পর্ব-৪৯   পর্ব-৫০   পর্ব-৫১   পর্ব-৫২   পর্ব-৫৩   পর্ব-৫৪   পর্ব-৫৫   পর্ব-৫৬   পর্ব-৫৭   পর্ব-৫৮   পর্ব-৫৯   পর্ব-৬০   পর্ব-৬১   পর্ব-৬২   পর্ব-৬৩   পর্ব-৬৪   পর্ব-৬৫   পর্ব-৬৬   পর্ব-৬৭  




******************************************
>>> Welcome, You are now on Mohammadia Foundation's Website. Please stay & Tune with us>>>

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url