প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর জীবনী [পর্ব- ৫৬] || মহানবীর জীবনী ||





মক্কা বিজয়ের পর দলে দলে বিভিন্ন গোত্রের  ইসলাম গ্রহণ

(চতূর্থ অংশ)

[পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ট মহামানব আমাদের প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:)। যাকে আল্লাহ সমস্ত মানুষের জন্য অশেষ রহমত স্বরূপ এই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। যে নবী সারা জীবন উম্মতের জন্য সংগ্রাম করেছেন, কাল রোজ হাশরের মাঠেও যিনি উম্মতের জন্যই পেরেশান থাকবেন ইয়া উম্মতি ইয়া উম্মতি বলে বিচলিত হবেন; সেই প্রাণপ্রিয় নবীকে আমরা কতটুকু চিনি, কতটুকু জানি? প্রিয় নবী (সা:) এর জীবনের পরতে পরতে রয়েছে আমাদের জন্য শিক্ষা ও অনুপ্রেরণা। যার জীবনী পড়লে নিজের অজান্তেই চোখের পানি গড়িয়ে পড়ে। সেই নবীর জীবনী কি আমরা সত্যিই জানি? আসুন, আরেকবার দেখে নেই “প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর জীবনী”। যে জীবনী পড়ে বদলে যেতে পারে আপনার আমার জীবন। আমরা এখানে প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর বিশাল কর্মময় জীবনকে ৬৭টি সুবিশাল পর্বে তুলে ধরেছি। আল্লাহ আমাদের সবাইকে প্রাণপ্রিয় নবীর (সা:) উম্মত হিসাবে কবুল করুন। আমিন।।]

গাসসান খ্রিষ্টান প্রতিনিধি দল

সিরিয়া এলাকা হ’তে তিন সদস্যের এই খ্রিষ্টান প্রতিনিধি দলটি ১০ম হিজরীর রামাযান মাসে মদীনায় এসে ইসলাম কবুল করে। রাসূল (ছাঃ) তাদেরকে বহু উপঢৌকন প্রদান করেন। অতঃপর তাঁরা নিজ গোত্রে ফিরে গিয়ে ইসলামের প্রচার ও প্রসারে নিয়োজিত হন। কিন্তু কেউ তাদের দাওয়াত কবুল করেনি। তখন তারা তাদের ইসলাম গোপন রাখেন এবং সেভাবেই দু’জন মৃত্যুবরণ করেন। ওমর (রাঃ)-এর খেলাফতকালে সেনাপতি আবু ওবায়দাহ ইবনুল জাররাহর নেতৃত্বে সিরিয়া বিজয়ের সময়েও ঐ তিন জনের একজন জীবিত ছিলেন। তিনি তাঁকে উচ্চ সম্মান প্রদান করেন’ (যাদুল মা‘আদ ৩/৫৮৪)।

[শিক্ষণীয়: অমুসলিমদের কখনোই জোর করে মুসলমান করা হয়নি, এটি তার অন্যতম প্রমাণ।]

সালামান প্রতিনিধি দল

হাবীব বিন ‘আমরের নেতৃত্বে ১০ম হিজরীর শাওয়াল মাসে ৭ সদস্যের এই প্রতিনিধি দলটি রাসূল (ছাঃ)-এর খিদমতে এসে ইসলাম কবুল করে। তারা প্রশ্ন করে, হে আল্লাহর রাসূল!أَىُّ الأَعْمَالِ أَفْضَلُ ‘সর্বোত্তম আমল কোনটি? রাসূল (ছাঃ) বললেন,الصَّلاَةُ لِوَقْتِهَا ‘ওয়াক্ত মোতাবেক ছালাত আদায় করা’।[1]

তারা তাদের এলাকায় খরা ও অনাবৃষ্টির অভিযোগ করল এবং দো‘আর আবেদন করল। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) দো‘আ করে বললেন, ‘হে আল্লাহ! এদেরকে তাদের এলাকায় বৃষ্টি দ্বারা পরিতৃপ্ত কর’। দলনেতা হাবীব আরয করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনার হাত দু’খানা উঠিয়ে একটু দো‘আ করুন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মুচকি হেসে হাত উঠিয়ে দো‘আ করলেন। প্রতিনিধি দল তিনদিন অবস্থান করে। তাদেরকে বহুমূল্য উপঢৌকনাদি দেওয়া হয়। অতঃপর তারা নিজ এলাকায় ফেরৎ গিয়ে দেখল যে, ঠিক যেদিন দো‘আ করা হয়েছিল, সেদিনই তাদের এলাকায় বৃষ্টি হয়েছে’।[2]

[শিক্ষণীয় : অন্য হাদীছে এসেছে, খালেছ অন্তরে দো‘আ করলে তার জন্য আল্লাহ পাক তিনটি কল্যাণের যেকোন একটি দান করে থাকেন : (১) তার দো‘আ দ্রুত কবুল করেন অথবা (২) তার প্রতিদান আখেরাতের জন্য রেখে দেন অথবা (৩) তার থেকে অনুরূপ আরেকটি কষ্ট দূর করে দেন’।[3] অতএব নেককার মুমিনের খালেছ দো‘আ সর্বদা সকলের জন্য ফলপ্রদ।]

[1]. বুখারী হা/৭৫৩৪; মিশকাত হা/৫৬৮।
[2]. যাদুল মা‘আদ ৩/৫৮৫; আল-বিদায়াহ ৫/৮৯।
[3]. আহমাদ হা/১১১৪৯; হাকেম হা/১৮১৬; মিশকাত হা/২২৫৯, সনদ ছহীহ।

বনু ‘আব্স প্রতিনিধি দল

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর মৃত্যুর চার মাস পূর্বে ৯ সদস্যের এই প্রতিনিধি দলের আগমন ঘটে। এরা ছিল নাজরান এলাকার খ্রিষ্টান বাসিন্দা এবং তারা মুসলমান হয়েই মদীনায় আসে।

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে তারা জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের বিদ্বানগণ (قُرَّاؤُنَا) আগেই এসেছিলেন। অতঃপর তারা আমাদের খবর দিয়েছেন যে, আপনি বলেছেন,لاَ إسْلاَمَ لِمَنْ لاَ هِجْرَةَ لَهُ ‘যার হিজরত নেই, তার ইসলাম নেই’। সেকারণ আমরা চাই যে, আমাদের মাল-সম্পদ, গবাদি পশু সব বিক্রি করে দিয়ে পরিবার-পরিজন সহ মদীনায় হিজরত করে আসি এবং আপনার সাহচর্যে জীবন কাটিয়ে দিই’। রাসূল (ছাঃ) বললেন,اتَّقُوا اللهَ حَيْثُ كُنْتُمْ فَلَنْ يَلِتَكُمْ مِنْ أَعْمَالِكُمْ شَيْئًا ‘যেখানে তোমরা আছ, সেখানে থেকেই আল্লাহকে ভয় কর। তোমাদের নেক আমলের ছওয়াবে কোনই কমতি হবে না’।[1]

[শিক্ষণীয়: মুসলমান যেখানেই থাকে, সেখানেই আল্লাহর বিধান মেনে চলে। বিশেষ কোন স্থানে বসবাস করা আবশ্যিক নয়। অবশ্য দ্বীনের স্বার্থে হিজরত ক্বিয়ামত পর্যন্ত জারী থাকবে (বুখারী হা/২৭৮৩)।]

[1]. রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ১/১৮১; শারহুল মাওয়াহেব ৫/২২৪; যাদুল মা‘আদ ৩/৫৮৫। মানছূরপুরী এখানে বনু ‘আব্স (بَنُو عَبْس)-এর বদলে বনু ‘আয়েশ (بنو عيش) লিখেছেন। সম্ভবতঃ এটি মুদ্রণ জনিত ভুল।

গামেদ প্রতিনিধি দল

ইয়ামনের ‘আযদ’ (الأزد) গোত্রের অন্তর্ভুক্ত ১০ সদস্যের এই প্রতিনিধি দল ১০ম হিজরীতে মদীনায় আসে। তারা মদীনার বাইরে তাদের সরঞ্জামাদি একটি বালকের যিম্মায় রেখে রাসূল (ছাঃ)-এর দরবারে উপস্থিত হয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদের জিজ্ঞেস করেন, মাল-সামান কার কাছে রেখে এসেছ? তারা বলল, একটি বালকের যিম্মায়’। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, তোমরা আসার পরে সে ঘুমিয়ে গিয়েছিল। একজন এসে তোমাদের কাপড়ের বাক্স চুরি করে নিয়ে গেছে। প্রতিনিধি দলের জনৈক সদস্য বলে উঠল, হে আল্লাহর রাসূল! ওটা তো আমার। রাসূল (ছাঃ) বললেন, ভয় পেয়ো না। বাচ্চাটা উঠেছে এবং চোরের পিছে পিছে ছুটেছে ও তাকে পাকড়াও করেছে। তোমাদের সব মালামাল নিরাপদ আছে’। প্রতিনিধি দলের সদস্যরা ফিরে গিয়ে ছেলেটির কাছে যা শুনলো, তা সবকিছু রাসূল (ছাঃ)-এর বক্তব্যের সাথে মিলে গেল। ফলে এতেই তারা মুসলমান হয়ে গেল। রাসূল (ছাঃ) উবাই বিন কা‘বকে তাদের জন্য নিযুক্ত করেন। যাতে তিনি তাদের কুরআন মুখস্থ করান এবং ইসলামের বিধি-বিধান সমূহ শিক্ষা দেন। ফিরে যাবার সময় তাদেরকে উপঢৌকন দেন। যেমন অন্যান্য প্রতিনিধি দলকেও তিনি দিয়েছেন’ (যাদুল মা‘আদ ৩/৫৮৬)। অতঃপর উক্ত বিধি-বিধান সমূহ একটি কাগজে লিখে দেওয়া হয়’ (শারহুল মাওয়াহেব ৫/২২৫)।

[শিক্ষণীয়: এর মধ্যে রাসূল (ছাঃ)-এর যুগে হাদীছ লিখনের দলীল পাওয়া যায়।]

আযদ প্রতিনিধি দল

রাসূল (ছাঃ)-এর প্রেরিত মুবাল্লিগগণের দ্বারা এঁরা পূর্বেই মুসলমান হন। অতঃপর তাদের গোত্রের পক্ষ হ’তে ৭ সদস্যের এই প্রতিনিধি দল রাসূল (ছাঃ)-এর সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য মদীনায় আসেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাঁদের জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কারা? তারা বললেন, আমরা মুসলমান। রাসূল (ছাঃ) বললেন, প্রত্যেক বস্ত্তরই কিছু সারবত্তা (حَقِيقَةٌ) থাকে। তোমাদের বক্তব্যের সারবস্ত্ত কি? তারা বললেন, আমাদের মধ্যে ১৫টি বিষয় রয়েছে। ৫টি আক্বীদা বিষয়ক এবং ৫টি আমল বিষয়ক, যা আপনার প্রেরিত মুবাল্লিগগণ আমাদের শিখিয়েছেন। আর তা হ’ল :

বিশ্বাস স্থাপন করা আল্লাহর উপরে, ফেরেশতাগণের উপরে, আল্লাহর কিতাবসমূহের উপরে, তাঁর প্রেরিত রাসূলগণের উপরে এবং মৃত্যুর পর পুনরুত্থানের উপরে।

অতঃপর আমল বিষয়ক পাঁচটি বস্ত্ত হ’ল : লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ কালেমা মুখে স্বীকৃতি দেওয়া, পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত আদায় করা, যাকাত দেওয়া, রামাযানের ছিয়াম পালন করা এবং বায়তুল্লাহর হজ্জ করা, যদি সামর্থ্য থাকে।

এছাড়া যে পাঁচটি বিষয় আমাদের মধ্যে আগে থেকেই ছিল, তা হ’ল: সচ্ছলতার সময় আল্লাহর শুকরগুযারী করা, বিপদের সময় ছবর করা, আল্লাহর ফায়ছালার উপর সন্তুষ্ট থাকা, পরীক্ষার সময় সত্যের উপর দৃঢ় থাকা এবং শত্রুকে গালি না দেওয়া।

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, যারা তোমাদেরকে কথাগুলি শিখিয়েছেন, নিশ্চয়ই তারা অত্যন্ত জ্ঞানী মানুষ। সম্ভবতঃ তারা নবীগণের মধ্যেকার কেউ হবেন। আচ্ছা আমি তোমাদেরকে আরও পাঁচটি বিষয়ে শিক্ষা দিচ্ছি।-

(১) ঐ বস্ত্ত জমা করো না, যা খাওয়া হয় না (২) ঐ ঘর তৈরী করো না, যাতে বাস করা হয় না (৩) এমন কথার মুকাবিলা করো না, যা কালকে পরিত্যাগ করতে হবে (৪) আল্লাহর ভয় বজায় রাখো, যার কাছে ফিরে যেতে হবে ও যার কাছে উপস্থিত হতে হবে (৫) ঐসব বস্ত্তর প্রতি আকর্ষণ রাখো, যা তোমার জন্য আখেরাতে কাজ দিবে, যেখানে তুমি চিরস্থায়ীভাবে থাকবে’।

প্রতিনিধিদল কথাগুলি মুখস্থ করে নিল এবং তারা এর উপরে সর্বদা আমলকারী ছিল।[1]

[শিক্ষণীয়: সৌভাগ্যবান সেই ব্যক্তি, যে অন্যের সদুপদেশ গ্রহণ করে।]
[1]. যাদুল মা‘আদ ৩/৫৮৭; আল-বিদায়াহ ৫/৯৪; বায়হাক্বী, সিলসিলা যঈফাহ হা/২৬১৪।

বনুল মুনতাফিক্ব প্রতিনিধি দল

নাজদের ‘আমের বিন ছা‘ছা‘আহ গোত্রের অন্যতম নেতা লাক্বীত্ব বিন ‘আমের তার সাথী নাহীক বিন ‘আছেম ইবনুল মুনতাফিক্ব-কে সাথে নিয়ে রাসূল (ছাঃ)-এর দরবারে আগমন করেন। তখন তিনি ফজর ছালাতের পর লোকদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিচ্ছিলেন। লাক্বীত্ব বলেন, ভাষণ শেষে আমি ও আমার সাথী দাঁড়িয়ে গেলাম। যাতে আমরা তাঁর দৃষ্টিতে পড়ি। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কি গায়েব জানেন? তিনি বললেন, অদৃশ্য পাঁচটি বিষয়ের চাবিকাঠি কেবলমাত্র আল্লাহর নিকটে। তিনি ব্যতীত কেউ তা জানেনা। (১) কোথায় তোমার মৃত্যু হবে। (২) তোমার স্ত্রীর জরায়ুতে কি সন্তান আছে। (৩) আগামীকাল তুমি কি খাবে। (৪) কোথায় বৃষ্টি বর্ষিত হবে এবং (৫) কখন ক্বিয়ামত হবে’। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমি আপনার নিকট কিসের উপর বায়‘আত করব? তখন রাসূল (ছাঃ) হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ছালাত ও যাকাতের উপর এবং আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করবে না ও মুশরিকদের সাথে শত্রুতা করবে, একথার উপর। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! পূর্ব ও পশ্চিমে সর্বত্র আমাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হৌক। তখন তিনি তাঁর হাত টেনে নিলেন। তিনি ধারণা করলেন যে, আমরা তাঁকে এমন শর্ত দিচ্ছি, যা তাঁর পক্ষে পূরণ করা সম্ভব নয়। তখন আমি বললাম, আমরা যেখানে খুশী বসবাস করতে চাই এবং একজন ব্যক্তি নিজের অপরাধেই কেবল দোষী সাব্যস্ত হবে। তখন তিনি হাত বাড়িয়ে দিলেন এবং বললেন, তোমরা এটা পাবে। অতঃপর আমরা বায়‘আত করে ফিরে এলাম।

এসময় তাঁকে বনু বকর বিন কিলাবের জনৈক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! এরা কারা? তিনি বললেন, বনুল মুনতাফিক্ব গোত্রের। কথাটি তিনি তিনবার বললেন। অতঃপর আমরা ফিরে এসে তাঁকে প্রশ্ন করলাম, হে আল্লাহর রাসূল! জাহেলী হালতে যারা মারা গেছেন, অথচ তারা ভাবতেন যে, তারা সঠিক পথের উপরে আছেন, তাদের অবস্থা কি হবে? জবাবে একজন লোক বলে উঠল, আল্লাহর কসম! তোমার পিতা মুনতাফিক্ব অবশ্যই জাহান্নামের অধিবাসী। এতে আমার সমস্ত দেহমন জ্বলে উঠল। মনে হ’ল আমি জিজ্ঞেস করি, হে আল্লাহর রাসূল! আপনার পিতার অবস্থা কি?... (যাদুল মা‘আদ ৩/৫৮৮-৯১ সনদ যঈফ)।

[শিক্ষণীয়: (১) আল্লাহ ব্যতীত গায়েবের খবর কেউ জানেনা। (২) মুশরিকদের সাথে আন্তরিক বন্ধুত্ব রাখা যাবে না এবং কোন অবস্থায় আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করা যাবে না। (৩) রাজনৈতিক ক্ষমতা বা দুনিয়াবী কোন কিছু পাওয়ার শর্তে আমীরের নিকট বায়‘আত করা যাবে না। (৪) সত্য হ’লেও কারু সামনে তার পিতা-মাতার বিষয়ে মন্দ কিছু বলা যাবে না।]

কা‘ব বিন যুহায়ের বিন আবী সুলমার আগমন

কা‘ব বিন যুহায়ের (হিঃ পূঃ ১৩-২৬ হিঃ/৬০৯-৬৪৬ খৃঃ) ‘মুখাযরামূন’ (الْمُخَضْرَمون) কবিদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। যিনি জাহেলী ও ইসলামী উভয় যুগ পেয়েছিলেন।

৮ম হিজরীর শেষে হোনায়েন ও ত্বায়েফ যুদ্ধ থেকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মদীনায় প্রত্যাবর্তনের পর মু‘আল্লাক্বা খ্যাত কবি যুহায়ের বিন আবী সুলমার জ্যেষ্ঠ পুত্র এবং আরবের শ্রেষ্ঠ কবিদের অন্যতম এই স্বল্পায়ু কবি রাসূল (ছাঃ)-এর দরবারে আগমন করেন ও ইসলাম কবুল করেন। তার ছোট ভাই বুহায়েরও কবি ছিলেন এবং তিনি পিতার অছিয়ত মোতাবেক মুসলমান হয়েছিলেন। কিন্তু বড় ভাই কা‘ব পিতার অছিয়ত অমান্য করে রাসূল (ছাঃ)-এর কুৎসা রটনায় কবিতা লিখতে থাকেন। ফলে মক্কা বিজয়ের সময় যাদের রক্ত বৃথা ঘোষণা করা হয়, ইমাম হাকেমের মতে কা‘ব ছিলেন তাদের মধ্যকার অন্যতম। ৮ম হিজরীর শেষে হোনায়েন ও ত্বায়েফ যুদ্ধ থেকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মদীনায় প্রত্যাবর্তনের পর কা‘বের ছোট ভাই বুহায়ের (অথবা বুজায়ের) তাকে পত্র লিখলেন যে, মক্কা বিজয়ের সময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কয়েকজন কুৎসা রটনাকারীকে হত্যা করেছেন। তবে কেউ তওবা করে ক্ষমা প্রার্থনা করলে তিনি তাকে ক্ষমা করে থাকেন। অতএব বাঁচতে চাইলে তুমি সত্বর মদীনায় গিয়ে তওবা করে রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে ক্ষমা প্রার্থনা কর। দু’ভাইয়ের মধ্যে এভাবে পত্রালাপ চলতে থাকে এবং কা‘ব ক্রমেই ভীত হয়ে পড়তে থাকেন। অবশেষে তিনি একদিন মদীনায় এলেন এবং জোহায়না গোত্রের জনৈক ব্যক্তির বাড়ীতে আশ্রয় নিলেন। অতঃপর তিনি জোহানী ব্যক্তির সাথে গিয়ে মসজিদে নববীতে ফজরের ছালাত আদায় করেন। ছালাত শেষে জোহানীর ইশারায় তিনি রাসূল (ছাঃ)-এর সামনে গিয়ে বসেন এবং তাঁর হাতে হাত রেখে বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! কা‘ব বিন যুহায়ের তওবা করে মুসলমান হয়ে এসেছে আপনার নিকটে আশ্রয় প্রার্থনার জন্য। আমি যদি তাকে আপনার কাছে নিয়ে আসি, তাহ’লে আপনি কি তার প্রার্থনা কবুল করবেন? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, হ্যাঁ। তখন তিনি বলে উঠলেন, আমিই কা‘ব বিন যুহায়ের’।

উল্লেখ্য, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কা‘বকে চিনতেন না। এ সময় জনৈক আনছার লাফিয়ে উঠে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে অনুমতি দিন, ওর গর্দান উড়িয়ে দেই’। রাসূল (ছাঃ) বললেন, ছাড় ওকে। সে তওবা করে এসেছে এবং সব কালিমা থেকে মুক্ত হয়েছে’। এই সময় কা‘ব রাসূল (ছাঃ)-এর প্রশংসায় তার বিখ্যাত ক্বাছীদা (দীর্ঘ কবিতা) পাঠ করেন, যা ‘ক্বাছীদা বুরদাহ’ নামে খ্যাত। যার শুরু হ’ল নিম্নোক্ত চরণ দিয়ে-

بَانَتْ سُعَادُ فَقَلْبِي الْيَوْمَ مَتْبُوْلُ * مُتَيِّمٌ إثْرَهَا لَمْ يُفْدَ مَكْبُوْلُ

‘প্রেমিকা সু‘আদ চলে গেছে। বিরহ ব্যথায় আমার হৃদয় আজ বিদীর্ণ। তার ভালোবাসার শৃংখলে আমি আবদ্ধ। আমার মুক্তিপণ দেওয়া হয়নি। আমি বন্দী’।

সে যুগের বিখ্যাত কবিরা এভাবে বিগত প্রেমিকার প্রতি বিরহ বেদনা প্রকাশ করেই তাদের দীর্ঘ কবিতাসমূহ শুরু করতেন।

অতঃপর ৩৯ লাইনে গিয়ে রাসূল (ছাঃ)-এর প্রশংসা এবং নিজের ক্ষমা প্রার্থনা করে তিনি বলেন,

نُبِّئْتُ أَنَّ رَسُولَ اللهِ أَوْعَدَنِي * وَالْعَفْوُ عِنْدَ رَسُوْلِ اللهِ مَأْمُوْلُ

‘আমি জানতে পেরেছি যে, আল্লাহর রাসূল আমাকে হুমকি দিয়েছেন। কিন্তু আল্লাহর রাসূল-এর নিকটে সর্বদা ক্ষমাই কাম্য’।

مَهْلاً هَدَاكَ الَّذِيْ أَعْطَاكَ نَافِلَةَ الْ * قُرْآنِ فِيْهَا مَوَاعِيْظُ وَتَفْصِيْلُ

‘থামুন! আল্লাহ আপনাকে সুপথ প্রদর্শন করুন! যিনি আপনাকে বিশেষ পুরস্কার হিসাবে কুরআন দান করেছেন। যার মধ্যে রয়েছে উপদেশ সমূহ এবং সকল বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা সমূহ’।

لاَ تَأْخُذَنِّيْ بِأَقْوَالِ الْوُشَاةِ وَلَمْ * أُذْنِبْ وَلَوْ كَثُرَتْ فِيَّ الْأَقَاوِيْلُ

‘নিন্দুকদের কথায় আমাকে পাকড়াও করবেন না। আমি কোন অপরাধ করিনি। যদিও আমার সম্পর্কে অনেক কথা বলা হয়েছে।

لَقَدْ أَقُوْمُ مَقَامًا لَوْ يَقُوْمُ بِهِ * أَرَى وَأَسْمَعُ مَا لَوْ يَسْمَعُ الْفِيَلُ

‘আমি এমন এক স্থানে দাঁড়িয়েছি এবং দেখছি ও শুনছি, যদি কোন হাতি সেখানে দাঁড়াতো ও সেকথা শুনতো-

لَظَلَّ يَرْعَدُ إلاَّ أَنْ يَكُوْنَ لَهُ * مِنْ الرَّسُوْلِ بِإِذْنِ اللهِ تَنْوِيْلُ

‘তাহ’লে সে অবশ্যই কাঁপতে থাকত। তবে যদি আল্লাহর অনুমতিক্রমে রাসূলের পক্ষ হ’তে তার জন্য অনুকম্পা হয়’।

حَتَّى وَضَعْتُ يَمِيْنِيْ مَا أُنَازِعُهُ * فِي كَفِّ ذِيْ نَقِمَاتٍ قِيْلُهُ الْقِيْلُ

‘অবশেষে আমি আমার ডান হাত রেখেছি যা আমি ছাড়িয়ে নেইনি, এমন এক হাতের তালুতে, যিনি প্রতিশোধ নেওয়ার ক্ষমতাশালী এবং যাঁর কথাই চূড়ান্ত কথা’।

فَلَهُوَ أَخْوَفُ عِنْدِيْ إذْ أُكَلِّمُهُ * وَقِيْلَ إنَّكَ مَنْسُوْبٌ وَمَسْئُوْلُ

‘অতঃপর নিশ্চয়ই তিনি আমার নিকটে অধিক ভীতিকর ব্যক্তি, যখন আমি তাঁর সাথে কথা বলি, এমন অবস্থায় যে আমার সম্পর্কে বলা হয়েছে, তুমি (অমুক অমুক ব্যঙ্গ কবিতার দিকে) সম্পর্কিত এবং সেগুলি সম্পর্কে তুমি জিজ্ঞাসিত হবে’।

مِنْ ضَيْغَمٍ بِضَرَّاءِ الْأَرْضِ مُخْدَرُهُ * فِيْ بَطْنِ عَثَّرَ غَيْلٌ دُوْنَهُ غَيْلُ

‘(তিনি আমার নিকট অধিক ভীতিকর) যমীনের কঠিনতম স্থানের ঐ সিংহের চাইতে, যার অবস্থানস্থল এমন উপত্যকায়, যেখানে পৌঁছার আগেই ঘাতক নিহত হয়ে যায়’।

অতঃপর ৫১ লাইনে পৌঁছে তিনি রাসূল (ছাঃ)-এর প্রশংসায় বলেন,

إنَّ الرَّسُوْلَ لَنُوْرٌ يُسْتَضَاءُ بِهِ * مُهَنَّدٌ مِنْ سُيُوْفِ اللهِ مَسْلُوْلُ

‘নিশ্চয়ই রাসূল আলোকস্তম্ভ স্বরূপ, যা থেকে আলো গ্রহণ করা হয়। তিনি আল্লাহর তরবারি সমূহের মধ্যে কোষমুক্ত হিন্দুস্থানী তরবারি সদৃশ’ (ইবনু হিশাম ২/৫১২)।

এ সময় আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) খুশী হয়ে নিজের চাদর কবির গায়ে জড়িয়ে দেন (আল-ইছাবাহ, কা‘ব ক্রমিক ৭৪১৬)। এজন্য কবির এ দীর্ঘ কবিতাটি ‘ক্বাছীদাতুল বুরদাহ’(قَصِيْدَةُ الْبُرْدَةِ) বা চাদরের ক্বাছীদা নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। যা কবির ছেলের নিকট থেকে মু‘আবিয়া (রাঃ) খরীদ করে নেন। অতঃপর তা খলীফাগণ ঈদের দিন সমূহে পরিধান করতেন (আল-ইছাবাহ)।[1] কবিতা শেষে রাসূল (ছাঃ) তাকে জিজ্ঞেস করেন, সু‘আদ কে? তিনি বললেন, আমার স্ত্রী (আল-বিদায়াহ ৪/৩৭৩)। এরপর রাসূল (ছাঃ) তাকে বলেন, যদি তুমি আনছারদের প্রশংসায় কিছু বলতে! কেননা তারাই এর উপযুক্ত। তখন তিনি রাসূল (ছাঃ)-এর জন্য আনছারদের অপূর্ব ত্যাগের প্রশংসায় ১৩ লাইন কবিতা বলেন (ইবনু হিশাম ২/৫১৪-১৫)। ক্বাছীদাহ বুরদার কবিতা সংখ্যা বায়হাক্বী ৪৮ বলেছেন (বায়হাক্বী কুবরা হা/২০৯৩১)। পক্ষান্তরে ইবনু হিশাম ৫৮ লাইন উদ্ধৃত করেছেন (ইবনু হিশাম ২/৫০৩-১৩)।

ইবনু কাছীর বলেন, উপরের কথাগুলি প্রসিদ্ধ হ’লেও আমি এমন কোন বিশুদ্ধ সূত্র পাইনি, যাতে আমি সন্তুষ্ট হ’তে পারি (আল-বিদায়াহ ৪/৩৭৩)। শাওকানী বলেন, হাফেয ইরাক্বী বলেন যে, উক্ত ক্বাছীদাটি আমরা বিভিন্ন সূত্রে বর্ণনা করেছি। যার একটিও বিশুদ্ধ নয় (নায়লুল আওত্বার ২/১৮৬)।

উল্লেখ্য যে, ‘ক্বাছীদাতুল বুরদাহ’ নামে প্রসিদ্ধ আরেকটি ক্বাছীদা হ’ল, রাসূল (ছাঃ)-এর প্রশংসায় মিসরের কবি মুহাম্মাদ বিন সাঈদ আল-বূছীরী (৬০৮-৬৯৬ হি./১২১২-১২৯৬ খৃ.) লিখিত ১৬৫ লাইনের দীর্ঘ কবিতা। যা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয়। উক্ত দীর্ঘ কবিতাটি একটি অলৌকিক কবিতা হিসাবে পরিচিত। যেখানে পক্ষাঘাতগ্রস্ত কবি স্বপ্নে রাসূল (ছাঃ)-এর দর্শন লাভ করেন এবং স্বপ্নের মধ্যেই তাঁকে তাঁর প্রশংসায় লিখিত উক্ত ক্বাছীদাটি শুনান। তাতে খুশী হয়ে রাসূল (ছাঃ) কবির গায়ে তাঁর চাদরটি জড়িয়ে দেন। অতঃপর ঘুম থেকে উঠে কবি দেখেন যে, তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ। তখন থেকে এটি রোগ নিরাময়ের বরকতময় কবিতা হিসাবে প্রসিদ্ধি অর্জন করে।

বলা হয়ে থাকে যে, উক্ত ক্বাছীদা পাঠের ৮টি পূর্বশর্ত রয়েছে। যেমন প্রথমে ওযূ করতে হবে, ক্বিবলামুখী হ’তে হবে, বিশুদ্ধ উচ্চারণসহ অর্থ বুঝে ছন্দ মিলিয়ে মিলিয়ে মুখস্থ পড়তে হবে, পাঠককে অনুমতিপ্রাপ্ত কোন ব্যক্তির নিকট থেকে অনুমতিপ্রাপ্ত হ’তে হবে এবং কবি মনোনীত বিশেষ দরূদ সহ পাঠ করতে হবে। দরূদটি হ’ল, مَولايَ صَلِّ وسلِّمْ دَائِمًا أبدًا عَلَى حَبِيبكَ خَيرِ الْخَلْقِ كُلِّهِمْ। বলা বাহুল্য এগুলির কোন শারঈ ভিত্তি নেই। তাছাড়া উক্ত ক্বাছীদার কিছু কিছু লাইনে তাওহীদ পরিপন্থী কুফরী বক্তব্য রয়েছে। ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ সহ বিশ্ববিখ্যাত বিদ্বানগণ এই ক্বাছীদার বরকত সম্পর্কিত প্রচলিত ধারণা সমূহের তীব্র প্রতিবাদ করেন।[2]

[শিক্ষণীয়: মিথ্যা অপবাদ ও কুৎসা রটনা করা জঘন্যতম অপরাধ। এ থেকে তওবা করার পথ হ’ল পুনরায় প্রশংসা করা। এর মাধ্যমেই কেবল তাকে ক্ষমা করা যেতে পারে। গণমাধ্যম কর্মীদের উপরোক্ত ঘটনা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত।]

[1]. ইবনু হিশাম ২/৫০৩-০৮, সনদ ‘মুরসাল’ (তাহকীক ইবনু হিশাম ক্রমিক ১৮৫৪); হাকেম হা/৬৪৭৯; যাদুল মা‘আদ ৩/৪৫৫-৬০; আর-রাহীক্ব ৪৪৬ পৃঃ বর্ণনাটির সনদ ছহীহ নয় (ঐ, তা‘লীক্ব ১৭৮ পৃঃ)।
[2]. গৃহীত : ক্বাছীদাতুল বুরদাহ (কাব্যানুবাদ) ড. মুহাম্মাদ ফজলুর রহমান (প্রফেসর আরবী বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)। প্রকাশক : রিয়াদ প্রকাশনী (ঢাকা, পশ্চিম নাখালপাড়া, জানুয়ারী ২০০১) ৯-১০ পৃঃ।

ইয়ামনের শাসকদের দূতের আগমন

তাবূক অভিযান থেকে মদীনায় ফেরার পর ৯ম হিজরীর রামাযান মাসে ইয়ামনের হিমইয়ার শাসকদের পত্র নিয়ে তাদের দূত মালেক বিন মুররাহ আর-রাহাভী(مَالِكُ بنُ مُرَّةَ الرَّهَاوِيُّ) রাসূল (ছাঃ)-এর খিদমতে আগমন করেন। পত্রে তাদের শাসকদের ইসলাম কবুলের এবং শিরক ও শিরককারীদের সাথে সম্পর্কচ্যুতির খবর ছিল। ঐ শাসকগণের নাম ছিল হারেছ বিন ‘আব্দে কুলাল(الْحَارِثُ بنُ عَبْدِ كُلاَل) তার ভাই নু‘আইম বিন ‘আব্দে কুলাল ও নু‘মান। যারা ছিলেন যু-রু‘আইন, মা‘আফির ও হামদান এলাকার শাসক।

জওয়াবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একটি পত্র সহ মু‘আয বিন জাবালের নেতৃত্বে একদল ছাহাবীকে সেখানে শিক্ষা দানের জন্য প্রেরণ করেন। পত্রে তিনি মুমিনদের করণীয় বিষয়সমূহ এবং জিযিয়া প্রদানের বিষয়াদি উল্লেখ করেন’।[1]

[শিক্ষণীয়: শিরক ও তাওহীদ কখনো একত্রে চলতে পারে না। শাসকদের ক্ষেত্রেও সেকথা প্রযোজ্য। মুসলমান নামধারী ধর্মনিরপেক্ষ এবং তথাকথিত মডারেট বা শৈথিল্যবাদী লোকদের জন্য উপরের ঘটনায় শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে।]

[1]. ইবনু সা‘দ ১/২৬৭; ইবনু হিশাম ২/৫৮৮, বর্ণনাটির সনদ ‘মুরসাল’ তাহকীক ইবনু হিশাম, ক্রমিক ১৯৭৫; আর-রাহীক্ব ৪৪৯ পৃঃ। মুবারকপুরী এখানে নু‘মান বিন ক্বীল যী-রাঈন লিখেছেন, যা ভুল।

নাখ‘ঈ প্রতিনিধি দল

এটাই ছিল সর্বশেষ আগত প্রতিনিধি দল। যারা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর মৃত্যুর দু’মাস পূর্বে ১১ হিজরীর মুহাররম মাসের মাঝামাঝি সময়ে মদীনায় আগমন করে। এদের পরে আর কোন প্রতিনিধি দল আসেনি। ইয়ামন থেকে আগত ২০০ জনের এই বিরাট প্রতিনিধি দলটি আগেই মু‘আয বিন জাবাল (রাঃ)-এর হাতে মুসলমান হয়েছিল। তাদেরকে কেন্দ্রীয় মেহমানখানায়(دَارُ الضِّيَافَةِ) রাখা হয়। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন যুরারাহ বিন ‘আমর(زُرَارَةُ بْنُ عَمْرٍو)। তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আসার সময় রাস্তায় আমি কয়েকটি আজব স্বপ্ন দেখেছি। এর ব্যাখ্যা কি হবে? রাসূল (ছাঃ) বললেন, শুনাও দেখি’।-

১ম স্বপ্ন : যুরারাহ বললেন, আমি দেখলাম যে, বকরী বাচ্চা দিয়েছে, যা সাদা ও কালো রংয়ের ডোরাকাটা (أَبْلَق)।
ব্যাখ্যা : রাসূল (ছাঃ) বললেন, তোমার স্ত্রীর ছেলে হয়েছে এবং সেটা তোমারই ছেলে।

যুরারাহ বললেন, কিন্তু সাদা-কালো ডোরাকাটা কেন হ’ল? রাসূল (ছাঃ) তাকে কাছে ডেকে গোপনে আস্তে আস্তে বললেন, তোমার দেহে শ্বেতকুষ্ট ব্যাধি রয়েছে, যা তুমি লোকদের থেকে লুকিয়ে রাখো। তোমার সন্তানের মধ্যে সেটারই প্রভাব পড়েছে। যুরারাহ বলে উঠলেন, কসম আল্লাহর, যিনি আপনাকে সত্য রাসূল হিসাবে প্রেরণ করেছেন, আমার এই গোপন রোগের খবর এ যাবত কারুরই জানা ছিল না।

২য় স্বপ্ন : যুরারাহ বললেন, আমি আরবের বাদশাহ নু‘মান বিন মুনযিরকে হাতে বাযুবন্দ, কোমরে কংকন ইত্যাদি অলংকারাদি পরিহিত অবস্থায় দেখলাম (সীরাহ হালাবিইয়াহ ৩/২৭৯)।
ব্যাখ্যা : রাসূল (ছাঃ) বললেন, এর দ্বারা আরব দেশকে বুঝানো হয়েছে। যা এখন শান্তি ও সচ্ছলতা লাভ করেছে।

৩য় স্বপ্ন : আমি একটা বুড়ীকে দেখলাম মাটি থেকে বেরিয়ে আসছে এবং যার চুলের কিছু অংশ সাদা ও কিছু অংশ কালো।
ব্যাখ্যা : রাসূল (ছাঃ) বললেন, এর দ্বারা ‘দুনিয়া’ বুঝানো হয়েছে। যার (ধ্বংসের) বাকী সময়টুকু এখনো অবশিষ্ট রয়েছে।

৪র্থ স্বপ্ন : আমি দেখলাম যে, একটা দাবানল মাটি থেকে উত্থিত হল। যা আমার ও আমার ছেলের মধ্যবর্তী স্থানে এসে গেল। আগুনটি বলছে, পোড়াও পোড়াও চক্ষুষ্মান হৌক বা অন্ধ হৌক। হে লোকেরা! তোমাদের খাদ্য, তোমাদের বংশ, তোমাদের মাল-সম্পদ সব আমাকে খাবার জন্য দাও’।
ব্যাখ্যা : রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, এটা হল ফাসাদ, যা আখেরী যামানায় বের হবে। যুরারাহ বললেন, সেটা কেমন ফিৎনা হবে? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, লোকেরা তাদের খলীফাকে (إمام) হত্যা করবে। তারা আপোষে এমন লড়াইয়ে মত্ত হবে, যেমন দু’হাতের পাঞ্জার আঙ্গুলগুলি পরস্পরে জড়িয়ে যায়। বদকার লোকেরা ঐ সময় নিজেদের নেককার মনে করবে। ঈমানদারগণের রক্ত পানির মত সস্তা মনে করা হবে। যদি তোমার ছেলে মারা যায়, তবে তুমি দেখবে। আর তুমি মারা গেলে তোমার ছেলে এই ফেৎনা দেখবে’।

যুরারাহ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! দো‘আ করুন যেন আমি এই ফেৎনা না দেখি। রাসূল (ছাঃ) তার জন্য দো‘আ করলেন, ‘হে আল্লাহ! সে যেন এই ফেৎনার যামানা না পায়’। পরে দেখা গেল যে, যুরারাহ মারা গেলেন। তার ছেলে বেঁচে থাকল। যে হযরত ওছমান (রাঃ)-এর বায়‘আত ছিন্ন করেছিল’ (যাদুল মা‘আদ ৩/৫৯৯-৬০০)।

[শিক্ষণীয়: দুনিয়াবী স্বার্থ মানুষকে অন্ধ করে দেয়। মুসলমানেরা তা থেকে নিরাপদ থাকবে না। আখেরাত পিয়াসীগণ হবেন উক্ত হামলার প্রধান টার্গেট। অতএব ঈমানদারগণ সাবধান!]

প্রতিনিধি দল সমূহের আগমন পর্যালোচনা

মক্কা বিজয়ের পর থেকে সমস্ত আরব উপদ্বীপের লোকদের মধ্যে ইসলামের বিজয়ী ভূমিকা সম্পর্কে নিশ্চিত ধারণা জন্মে এবং ৯ম ও ১০ম হিজরী সনেই চারদিক থেকে দলে দলে বিভিন্ন গোত্রের প্রতিনিধিদের আগমন ঘটে। এমন কথাও জানা যায় যে, ইয়ামন থেকে ৭০০ মুসলমান কেউ আযান দিতে দিতে, কেউ কুরআন তেলাওয়াত করতে করতে এবং কেউ লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ পড়তে পড়তে মদীনায় উপস্থিত হয়। তাদের উৎসাহ দেখে রাসূল (ছাঃ) খুশী হয়ে বলেছিলেন, ‘তোমাদের কাছে ইয়ামানীরা এসেছে। অন্তরের দিক দিয়ে তারা সবচেয়ে দুর্বল ও নরম। দ্বীনের বুঝ হ’ল ইয়ামানীদের এবং প্রজ্ঞা হ’ল ইয়ামানীদের।[1] অনুরূপ উৎসাহ-উদ্দীপনা ছিল আরবের প্রায় সর্বত্র। প্রকৃত অর্থে ‘মদীনা’ তখন আরব উপদ্বীপের রাজধানীর মর্যাদা লাভ করেছিল। ইচ্ছায় হৌক, অনিচ্ছায় হৌক মদীনার আনুগত্য স্বীকার করা ব্যতীত কারু কোন উপায় ছিল না।

একথা অনস্বীকার্য যে, দলীয় হুজুগের মধ্যে ভাল-মন্দ সবধরনের লোক যুক্ত হয়ে যায়। এখানেও তার ব্যতিক্রম ছিল না। ফলে এইসব লোকদের মধ্যে এমন লোকও ছিল, যাদের হৃদয়ে ইসলাম শিকড় গাড়তে পারেনি। পূর্বেকার জাহেলী মনোভাব ও অভ্যাস তাদের মধ্যে তখনও জাগরুক ছিল। এদিকে ইঙ্গিত করেই আল্লাহ বলেন,

الْأَعْرَابُ أَشَدُّ كُفْرًا وَّنِفَاقًا وَّأَجْدَرُ أَلاَّ يَعْلَمُوا حُدُوْدَ مَا أَنْزَلَ اللهُ عَلَى رَسُوْلِهِ وَاللهُ عَلِيْمٌ حَكِيْمٌ- وَمِنَ الْأَعْرَابِ مَنْ يَّتَّخِذُ مَا يُنْفِقُ مَغْرَمًا وَّيَتَرَبَّصُ بِكُمُ الدَّوَائِرَ عَلَيْهِمْ دَائِرَةُ السَّوْءِ وَاللهُ سَمِيْعٌ عَلِيْمٌ- ( التوبة 97-98)-

‘বেদুঈন লোকেরা কুফরী ও মুনাফেকীতে অতি কঠোর এবং তারাই এ ব্যাপারে অধিক যোগ্য। কেননা তারা জানেনা ঐসব বিধানসমূহ, যা আল্লাহ তাঁর রাসূলের উপর নাযিল করেছেন। আল্লাহ সর্বজ্ঞ ও মহাজ্ঞানী’। ‘বেদুঈনদের মধ্যে এমন লোকও আছে, যারা (আল্লাহর রাস্তায়) ব্যয় করাকে জরিমানা মনে করে এবং তোমাদের উপরে কালের আবর্তন সমূহ (অর্থাৎ বিপদসমূহ) আপতিত হওয়ার অপেক্ষায় থাকে। অথচ তাদের উপরেই হয়ে থাকে কালের অশুভ আবর্তন। আল্লাহ সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ’ (তওবাহ ৯/৯৭-৯৮)।

আবার এদের মধ্যে ছিলেন বহু প্রকৃত ঈমানদার মুসলমান। যাদের মধ্য হ’তেই মুসলিম সমাজ লাভ করে ইয়ামন থেকে আগত আশ‘আরী গোত্রের খ্যাতনামা ছাহাবী হযরত আবু মূসা আশ‘আরী, দাউস গোত্রের অপ্রতিদ্বন্দ্বী হাদীছজ্ঞ ছাহাবী হযরত আবু হুরায়রা, ত্বাঈ গোত্রের হযরত ‘আদী বিন হাতেম প্রমুখ অগণিত বিশ্বখ্যাত মনীষী ছাহাবীবৃন্দ। এদিকে ইঙ্গিত করে আল্লাহ বলেন,

وَمِنَ الْأَعْرَابِ مَنْ يُّؤْمِنُ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَيَتَّخِذُ مَا يُنْفِقُ قُرُبَاتٍ عِنْدَ اللهِ وَصَلَوَاتِ الرَّسُوْلِ أَلاَ إِنَّهَا قُرْبَةٌ لَهُمْ سَيُدْخِلُهُمُ اللهُ فِيْ رَحْمَتِهِ إِنَّ اللهَ غَفُوْرٌ رَحِيْمٌ-(التوبة ৯৯)-

‘বেদুঈনদের মধ্যে এমন লোকও রয়েছে, যারা আল্লাহ ও আখেরাতের উপরে দৃঢ় বিশ্বাস রাখে এবং তারা যা ব্যয় করে তাকে আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের ও রাসূল-এর দো‘আ লাভের উপকরণ হিসাবে গ্রহণ করে। মনে রেখ, নিশ্চয়ই তাদের এই ব্যয় (আল্লাহর) নৈকট্য স্বরূপ। আল্লাহ তাদেরকে সত্বর স্বীয় অনুগ্রহের মধ্যে প্রবেশ করাবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়াবান’ (তওবাহ ৯/৯৯)।

১০ম হিজরীতে বিদায় হজ্জের ভাষণে রাসূল (ছাঃ) শিরকী জাহেলিয়াতের চির অবসানের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেছিলেন,أَلاَ كُلُّ شَيْءٍ مِّنْ أَمْرِ الْجَاهِلِيَّةِ تَحْتَ قَدَمَيَّ مَوْضُوْعٌ ‘শুনে রাখো, জাহেলী যুগের সকল রীতিনীতি আমার পায়ের তলে পিষ্ট হ’ল’। অতঃপর তিনি বলেন, أَلاَ وَإِنَّ الشَّيْطَانَ قَدْ أَيِسَ مِنْ أَنْ يُعْبَدَ فِى بِلاَدِكُمْ هَذِهِ أَبَدًا وَلَكِنْ سَتَكُونُ لَهُ طَاعَةٌ فِيمَا تَحْتَقِرُونَ مِنْ أَعْمَالِكُمْ فَسَيَرْضَى بِهِ ‘মনে রেখ, নিশ্চয়ই শয়তান তোমাদের এই দেশে পূজা পেতে চিরদিনের মত নিরাশ হয়ে গেছে। তবে তার অনুসরণ হবে ঐসব কাজে যেগুলিকে তোমরা তুচ্ছ মনে করবে। আর তাতেই সে সন্তুষ্ট হবে’।[2]

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর উপরোক্ত ভাষণ সমূহের মধ্যে যে ভবিষ্যদ্বাণী ফুটে উঠেছিল, তাতে আরব উপদ্বীপে ইসলাম ব্যতীত অন্য কোন দ্বীন ও তাদের অনুসারীদের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হওয়ার ইঙ্গিত ছিল এবং সেটাই বাস্তবায়িত হ’তে দেখা গেছে রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আরব উপদ্বীপের বিভিন্ন প্রান্ত হ’তে বিভিন্ন গোত্রীয় প্রতিনিধি দল সমূহের দলে দলে মদীনা আগমনের মধ্য দিয়ে। এভাবেই সূরা নছরের ভবিষ্যদ্বাণী রাসূল (ছাঃ)-এর জীবদ্দশাতেই বাস্তবায়িত হয় এবং সমস্ত আরবে ইসলাম সর্বতোভাবে বিজয় লাভ করে। পূর্ণতা লাভের পর আর কিছুই বাকী থাকে না। তাই উক্ত সূরা নাযিলের মধ্যে রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যুসংবাদ খুঁজে পেয়েছিলেন দূরদর্শী তরুণ ছাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ)’ (বুখারী হা/৪৯৭০)।

[1]. কুরতুবী, তাফসীর সূরা নাছর; বুখারী হা/৪৩৮৮; মুসলিম হা/৫২। দ্রঃ প্রতিনিধি দল ক্রমিক ২৩।
[2]. তিরমিযী হা/২১৫৯; মিশকাত হা/২৬৭০।




প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর ৬৭ পর্বের জীবনীর সকল পর্ব এখান থেকে পড়ুন-

পর্ব-০১   পর্ব-০২   পর্ব-০৩   পর্ব-০৪   পর্ব-০৫   পর্ব-০৬   পর্ব-০৭   পর্ব-০৮   পর্ব-০৯   পর্ব-১০   পর্ব-১১   পর্ব-১২   পর্ব-১৩   পর্ব-১৪   পর্ব-১৫   পর্ব-১৬   পর্ব-১৭   পর্ব-১৮   পর্ব-১৯   পর্ব-২০   পর্ব-২১   পর্ব-২২   পর্ব-২৩   পর্ব-২৪   পর্ব-২৫   পর্ব-২৬   পর্ব-২৭   পর্ব-২৮   পর্ব-২৯   পর্ব-৩০    পর্ব-৩১   পর্ব-৩২   পর্ব-৩৩   পর্ব-৩৪   পর্ব-৩৫   পর্ব-৩৬   পর্ব-৩৭   পর্ব-৩৮   পর্ব-৩৯   পর্ব-৪০   পর্ব-৪১   পর্ব-৪২   পর্ব-৪৩   পর্ব-৪৪   পর্ব-৪৫   পর্ব-৪৬(১ম) পর্ব-৪৬(২য়)    পর্ব-৪৭   পর্ব-৪৮   পর্ব-৪৯   পর্ব-৫০   পর্ব-৫১   পর্ব-৫২   পর্ব-৫৩   পর্ব-৫৪   পর্ব-৫৫   পর্ব-৫৬   পর্ব-৫৭   পর্ব-৫৮   পর্ব-৫৯   পর্ব-৬০   পর্ব-৬১   পর্ব-৬২   পর্ব-৬৩   পর্ব-৬৪   পর্ব-৬৫   পর্ব-৬৬   পর্ব-৬৭  




******************************************
>>> Welcome, You are now on Mohammadia Foundation's Website. Please stay & Tune with us>>>


এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url