প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর জীবনী [পর্ব- ৫২] || মহানবীর জীবনী ||




রাসুলুল্লাহ (ছাঃ) এর যুদ্ধ ও অভিযানসমূহের পর্যালোচনা

[পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ট মহামানব আমাদের প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:)। যাকে আল্লাহ সমস্ত মানুষের জন্য অশেষ রহমত স্বরূপ এই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। যে নবী সারা জীবন উম্মতের জন্য সংগ্রাম করেছেন, কাল রোজ হাশরের মাঠেও যিনি উম্মতের জন্যই পেরেশান থাকবেন ইয়া উম্মতি ইয়া উম্মতি বলে বিচলিত হবেন; সেই প্রাণপ্রিয় নবীকে আমরা কতটুকু চিনি, কতটুকু জানি? প্রিয় নবী (সা:) এর জীবনের পরতে পরতে রয়েছে আমাদের জন্য শিক্ষা ও অনুপ্রেরণা। যার জীবনী পড়লে নিজের অজান্তেই চোখের পানি গড়িয়ে পড়ে। সেই নবীর জীবনী কি আমরা সত্যিই জানি? আসুন, আরেকবার দেখে নেই “প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর জীবনী”। যে জীবনী পড়ে বদলে যেতে পারে আপনার আমার জীবন। আমরা এখানে প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর বিশাল কর্মময় জীবনকে ৬৭টি সুবিশাল পর্বে তুলে ধরেছি। আল্লাহ আমাদের সবাইকে প্রাণপ্রিয় নবীর (সা:) উম্মত হিসাবে কবুল করুন। আমিন।।]

যুদ্ধ ও অভিযান সমূহ পর্যালোচনা

(১ম হিজরীর রামাযান হ’তে ১১ হিজরীর রবীউল আউয়াল পর্যন্ত) ৯ বছর ৪ মাস
উপরের আলোচনায় মোট ২৯টি গাযওয়া ও ৬১টি সারিইয়া সাল ও তারিখ সহ ক্রমানুযায়ী আমরা বর্ণনা করলাম। মোট ৯০টি যুদ্ধের মধ্যে ইবনু হিশাম ২৭টি গাযওয়া ও ৩৮টি সারিইয়াহ সহ মোট ৬৫টি যুদ্ধের কথা বলেছেন (ইবনু হিশাম ২/৬০৮-০৯)। মানছূরপুরী ৮২টি অভিযানের তালিকা দিয়েছেন। আমরা তাঁর ও মুবারকপুরীর তালিকা মিলিয়ে মোট ৮৬টি পেয়েছি। এতদ্ব্যতীত হাদীছে ও ইতিহাসে আরও চারটি পেয়েছি। যা নিয়ে মোট ৯০টি হয়েছে। সঠিক সংখ্যা আল্লাহ ভাল জানেন। এক্ষণে উপরোক্ত যুদ্ধ ও অভিযান সমূহের উপর নিম্নোক্ত পর্যালোচনা পেশ করা হল।

উভয় পক্ষে শহীদ ও নিহতদের সংখ্যা

মাদানী জীবনে সংঘটিত যুদ্ধ সমূহে উভয় পক্ষে নিহত ও শহীদগণের সঠিক তালিকা নির্ণয় করা দুঃসাধ্য। মানছূরপুরী সারিইয়া ইবনু আবিল ‘আওজা-তে (ক্রমিক ৬৫) মুসলিম পক্ষে ৪৯ জন শহীদ বলেছেন। কিন্তু মুবারকপুরী উক্ত বিষয়ে কিছু বলেননি। অনুরূপভাবে গাযওয়া বনু কুরায়যাতে ইহূদীপক্ষে নিহতের সংখ্যা মানছূরপুরী ৪০০ বলেছেন। কিন্তু মুবারকপুরী ৬০০ থেকে ৭০০-এর মধ্যে বলেছেন। মানছূরপুরী ৪০০ ধরে হিসাব করেছেন। কিন্তু আমরা ৬০০ ধরে হিসাব করেছি। ফলে কাফের পক্ষে আমাদের হিসাব তাঁর চাইতে বেশী হয়েছে। এরপরেও ৬টি সারিইয়ায় প্রতিপক্ষের নিহতের সংখ্যা উল্লেখ না করে বলা হয়েছে ‘কিছু লোক’। এছাড়া ওহোদ যুদ্ধে ৩৭-এর অধিক এবং মুতার যুদ্ধে ‘বহু লোক’ নিহত হয়। অতএব কাফের পক্ষে নিহতের সংখ্যা আরও বাড়বে। উল্লেখ্য যে, সবচেয়ে বড় ৯টি যুদ্ধে অর্থাৎ বদর (ক্রমিক ৯), ওহোদ (২০), খন্দক (৩১), খায়বর (৫২), মুতা (৬৯), মক্কা বিজয় (৭২), হোনায়েন (৭৭), ত্বায়েফ (৮১) ও তাবূক (৮৭) যুদ্ধে মুসলিম পক্ষে যথাক্রমে ১৪, ৭০, ৬, ১৮, ১২, ২, ৬, ১২, ০০=১৪০ জন সহ ৩৩৩ জন শহীদ এবং কাফের পক্ষে ৭০, ৩৭, ১০, ৯৩, ০০, ১২, ৭১, ০০, ০০=২৯৩ জন সহ ১০০৯ জন নিহত। সর্বমোট ১৩৪২ জন। মানছূরপুরীর হিসাব মতে যা ৩২২ ও ৮৪৯ মোট ১১৭১ জন।

আধুনিক জাহেলিয়াতের যুগে তথাকথিত গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার নামে যেভাবে দেশে দেশে নির্বিচারে মানুষ হত্যা করা হয়, তার তুলনায় এ সংখ্যা তৃণসম বলা চলে।

অভিযান সমূহ কাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়েছিল এবং কেন?

অভিযানগুলির মধ্যে ১ হ’তে ৭২-এর মধ্যে মোট ২১টি অভিযান পরিচালিত হয়েছে কুরায়েশদের বিরুদ্ধে। ১১ হ’তে ৫৩-এর মধ্যে মোট ৮টি অভিযান পরিচালিত হয়েছে ইহূদীদের বিরুদ্ধে। ৪৪ হ’তে ৯০-এর মধ্যে ৬টি অভিযান খ্রিষ্টানদের বিরুদ্ধে এবং ১০ হ’তে ৮৩-এর মধ্যে মোট ৫১টি অভিযান পরিচালিত হয়েছে নাজদ ও অন্যান্য এলাকার বেদুঈন গোত্র ও সন্ত্রাসী ডাকাত দলের বিরুদ্ধে। এর মধ্যে ২৪, ২৫, ৩৬ ও ৬৫ নং সারিইয়া চারটি ছিল স্রেফ তাবলীগী কাফেলা এবং প্রতারণামূলকভাবে যাদের প্রায় সবাইকে হত্যা করা হয়। বদরসহ প্রথম দিকের ৯টি অভিযান ছিল কুরায়েশদের বাণিজ্য কাফেলা দখল করে তাদের আর্থিক মেরুদন্ড ভেঙ্গে দেওয়ার জন্য ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে তাদের যুদ্ধ প্রস্ত্ততি ভন্ডুল করার জন্য।

শুরুতে কুরায়েশদের মূল লক্ষ্য ছিল তাদের ভাষায় ছাবেঈ (صَابِئِي) বা ধর্মত্যাগী মুহাম্মাদ ও তাঁর সাথী মুষ্টিমেয় মুহাজিরদের নির্মূল করা এবং সেখানে আক্রোশটা ছিল প্রধানতঃ ধর্মবিশ্বাসগত। কিন্তু পরে তাদের প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় মদীনা হয়ে সিরিয়ায় তাদের ব্যবসায়িক পথ কণ্টকমুক্ত করা। সেই সাথে ছিল তাদের বড়ত্বের অহংকার। কেননা মুহাম্মাদ তাদের বহিষ্কৃত সন্তান হয়ে তাদের চাইতে বড় হবে ও তাদের উপরে প্রাধান্য বিস্তার করবে, এটা ছিল তাদের নিকটে একেবারেই অসহ্য। তাদের এই ক্ষুব্ধ ও বিদ্বেষী মানসিকতাকেই কাজে লাগায় ধূর্ত ইহূদী নেতারা ও অন্যান্যরা। ফলে মক্কা বিজয়ের পূর্বেকার মুসলিম অভিযানগুলির অধিকাংশ ছিল প্রতিরোধ মূলক।

ইহূদীদের বিরুদ্ধে অভিযানগুলি হয় অবিরতভাবে তাদের চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের কারণে এবং তাদের চুক্তিভঙ্গের কারণে। খ্রিষ্টানদের কোন তৎপরতা মদীনায় ছিল না। সিরিয়ার নিকটবর্তী দূমাতুল জান্দালে প্রথম যে অভিযানটি (ক্রমিক ৪৪) তাদের দিকে প্রেরিত হয়, সেটি ছিল মূলতঃ তাবলীগী সফর এবং তাতে তাদের গোত্রনেতাসহ সকলে মুসলমান হয়ে যায়। অতঃপর মুতার যুদ্ধ (ক্রমিক ৬৯) এবং তাবূক অভিযান (ক্রমিক ৮৬) ছিল আগ্রাসী রোম সম্রাটের বিরুদ্ধে ও তার প্রেরিত বিশাল বাহিনীর মদীনা আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য। অবশেষে রোমকরা ভয়ে পিছু হটে গেলে কোন যুদ্ধ হয়নি।

উল্লেখ্য যে, ৩য় হিজরীতে ওহোদ যুদ্ধে (ক্রমিক ২০) কপটতার জন্য রাসূল (ছাঃ) মুনাফিকদের আর কোন যুদ্ধে যাবার অনুমতি দেননি। কিন্তু আব্দুল্লাহ বিন উবাই ও অন্যান্যদের প্রকাশ্যে তওবা ও বারবার অনুরোধে তিনি তাদেরকে ৫ম হিজরীতে বনু মুছত্বালিক যুদ্ধে (ক্রমিক ৪৩) যাবার অনুমতি দেন। কিন্তু সেখানে তারা যথারীতি মুনাফেকী করে। ফলে তাদেরকে আর কোথাও অনুমতি দেওয়া হয়নি। কিন্তু তাবূক অভিযানে (ক্রমিক ৮৬) তাদের ১২ জন এজেন্ট গোপনে ঢুকে পড়ে ও রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে হত্যার চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়।

পরিশেষে বলা চলে যে, ইসলামের দাওয়াত মক্কায় ছিল কেবল প্রচারমূলক। কিন্তু মদীনায় ছিল প্রচার ও প্রতিরোধ মূলক। যুগে যুগে ইসলামী দাওয়াতে উভয় নীতিই প্রযোজ্য হয়েছে এবং হবে। এখানে হারাম মাসে যুদ্ধ করার অনুমতিও পাওয়া গেছে কেবল বিশেষ অবস্থার প্রেক্ষিতে। যার সূত্রপাত ঘটে নাখলা যুদ্ধে (ক্রমিক ৮)। এ প্রসঙ্গে সূরা বাক্বারাহ ২১৭ আয়াতটি নাযিল হয়।

যুদ্ধ সমূহের উদ্দেশ্য ও প্রকৃতি

(১) প্রথমেই উল্লেখ করা আবশ্যক যে, রাসূল আগমনের উদ্দেশ্য হ’ল, মানুষকে সৃষ্টির দাসত্ব ছেড়ে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর দাসত্বে ফিরিয়ে আনা এবং অহীর বিধান প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সকলের সমানাধিকার নিশ্চিত করা (যারিয়াত ৫১/৫৬)। সেই সাথে এর ফলাফল হিসাবে দুনিয়াবাসীকে জান্নাতের সুসংবাদ শুনানো এবং ব্যর্থতায় জাহান্নামের ভয় প্রদর্শন করা। বহুত্ববাদ ছেড়ে মানুষকে আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাসী করা (আ‘রাফ ৭/৬৫) এবং এর মাধ্যমে মানবতার সর্বোত্তম বিকাশ ঘটানো। মক্কার ইবরাহীম সন্তানেরা উক্ত আক্বীদায় বিশ্বাসী ছিল। কিন্তু পরে তারা তা থেকে বিচ্যুত হয়। যদিও তাদের দাবী বাকী ছিল। নবুঅত লাভের পর রাসূল (ছাঃ) তাদেরকে তাওহীদের দাওয়াত দেন এবং ইবরাহীমী পথে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেন। মক্কাতে রাসূল (ছাঃ) সেই দাওয়াতই শুরু করেছিলেন। কিন্তু আত্মগর্বী কুরায়েশ নেতারা রাসূল (ছাঃ)-এর এ দাওয়াতের মধ্যে নিজেদের দুনিয়াবী ক্ষতি বুঝতে পেরে প্রচন্ড বিরোধিতা করে এবং অবশেষে তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্র করে। পরে তিনি মদীনায় হিজরত করলেন। কিন্তু সেখানেও তারা লুটতরাজ, হামলা ও নানাবিধ চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র চালাতে লাগল। ফলে তাদের হামলা প্রতিরোধের জন্য এবং অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্য রাসূল (ছাঃ)-কে যুদ্ধের অনুমতি দেওয়া হয় (হজ্জ ২২/৩৯)। ফলে এটাই প্রমাণিত সত্য যে, হামলাকারীদের প্রতিরোধ ও তাদের অনিষ্ট থেকে আত্মরক্ষার জন্যই প্রধানতঃ যুদ্ধগুলি সংঘটিত হয়েছিল।

(২) সমস্ত যুদ্ধই ছিল মূলতঃ কুরায়েশদের হিংসা ও হঠকারিতার ফল। বনু কুরায়েশ, বনু গাত্বফান, বনু সুলায়েম, বনু ছা‘লাবাহ, বনু ফাযারাহ, বনু কেলাব, বনু ‘আযল ও ক্বারাহ, বনু আসাদ, বনু যাকওয়ান, বনু লেহিয়ান, বনু সা‘দ, বনু তামীম, বনু হাওয়াযেন, বনু ছাক্বীফ প্রভৃতি যে গোত্রগুলির সাথে যুদ্ধ হয়েছিল, এরা সবাই ছিল কুরায়েশদের পিতামহ ইলিয়াস বিন মুযারের বংশধর (রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ২/২০৭-০৯)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিজেও ছিলেন কুরায়েশ বংশের বনু হাশেম গোত্রের। ফলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে এদের যত লড়াই হয়েছে, সবই ছিল মূলতঃ গোত্রীয় হিংসার কারণে। এইসব গোত্রের নেতারা রাসূল (ছাঃ)-এর নেতৃত্ব ও প্রাধান্যকে মেনে নিতে পারেনি। বদরের যুদ্ধে বনু হাশেম গোত্র চাপের মুখে অন্যান্যদের সাথে থাকলেও তারা রাসূল (ছাঃ)-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেনি। কিন্তু আবু জাহল সহ বাকীরা সবাই ছিল অন্যান্য গোত্রের।

(৩) রাসূল (ছাঃ)-এর জীবনকালে আরব উপদ্বীপের অন্য কোন গোত্রের সাথে তাঁর কোন যুদ্ধ বা সংঘাত হয়নি। তিনি সারা আরবে লড়াই ছড়িয়ে দেননি।

(৪) রাসূল (ছাঃ)-এর বিরুদ্ধে ইহূদী ও মুনাফিকদের শত্রুতার প্রধান কারণ ছিল তাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক নেতৃত্ব হারানো। বাকীগুলি ছিল অজুহাত মাত্র। এজন্য তারা ছিল কুরায়েশদের সঙ্গে একাত্ম অথবা গোপনে চুক্তিবদ্ধ।

(৫) নবুঅতের পুরা সময়কালে একজন লোকও এমন পাওয়া যাবে না, যে কেবলমাত্র ধর্মীয় কারণে মুসলমানদের হাতে নিগৃহীত হয়েছে। যতক্ষণ না সে মুসলমানদের উপরে চড়াও হয়েছে কিংবা ষড়যন্ত্র করেছে। চাই সে মূর্তিপূজারী হৌক বা ইহূদী-নাছারা হৌক বা অগ্নিপূজারী হৌক।

(৬) মুশরিকদের হামলা ঠেকাতে গিয়ে দারিদ্র্য জর্জরিত ও ক্ষুৎ পিপাসায় কাতর অথচ ঈমানের বলে বলীয়ান মুসলিম বাহিনী ক্রমে এমন শক্তিশালী এক অপরাজেয় বাহিনীতে পরিণত হয় যে, রাসূল (ছাঃ)-এর জীবদ্দশায় তারা কোন যুদ্ধেই পরাজিত হননি। এমনকি তাঁর মৃত্যুর পরেও খেলাফতে রাশেদাহর যুগে এই বিজয়াভিযান অব্যাহত থাকে। যার সামনে তৎকালীন বিশ্বশক্তি রোমক ও পারসিক বাহিনী মুসলিম বাহিনীর হাতে নীস্ত ও নাবূদ হয়ে যায়।

(৭) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যুদ্ধকে পবিত্র জিহাদে পরিণত করেন। কেননা জিহাদ হ’ল অন্যায় ও অসত্যের বিরুদ্ধে ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। সে যুগের যুদ্ধনীতিতে সকল প্রকার স্বেচ্ছাচার ও পাপাচার সিদ্ধ ছিল। কিন্তু ইসলামী জিহাদের প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহ প্রদত্ত বিধি-বিধান কঠোরভাবে অনুসৃত হয়। যা মানবতাকে সর্বদা সমুন্নত রাখে। ফলে তা প্রতিপক্ষের মনে গভীরভাবে রেখাপাত করে। যে কারণে সারা আরবে ও আরবের বাইরে দ্রুত ইসলাম বিস্তার লাভ করে।

(৮) যুদ্ধবন্দীর উপরে বিজয়ী পক্ষের অধিকার সর্বযুগে স্বীকৃত। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর উদার নীতি এক্ষেত্রে নবযুগের সূচনা করে। প্রতিপক্ষ বনু হাওয়াযেন গোত্রের ১৪ জন নেতা ইসলাম কবুল করে এলে তাদের সম্মানে ও অনুরোধে হোনায়েন যুদ্ধের ছয় হাযার যুদ্ধবন্দীর সবাইকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বিনা শর্তে মুক্তি দেন। এমনকি বিদায়ের সময়ে তাদের প্রত্যেককে একটি করে মূল্যবান ক্বিবতী চাদর উপহার দেন।

(৯) যুদ্ধরত কাফের অথবা বিচারে মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত ব্যক্তি ব্যতীত কাউকে হত্যা করার বিধান ইসলামে নেই। সেকারণ মাদানী রাষ্ট্রের অধীনে চুক্তিবদ্ধ অসংখ্য অমুসলিম পূর্ণ নাগরিক অধিকার নিয়ে শান্তির সাথে বসবাস করত।

(১০) রাসূল (ছাঃ)-এর নির্দেশ অর্থাৎ কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অনুমতি বা আদেশ ব্যতীত কাউকে হত্যা করা নিষিদ্ধ ছিল। সেকারণ মক্কা বিজয়ের পূর্বরাতে মক্কার নেতা আবু সুফিয়ান হযরত ওমরের হাতে ধরা পড়া সত্ত্বেও তাঁর হাত থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের প্রতি ওমর (রাঃ)-এর অটুট আনুগত্য প্রদর্শনের কারণে। অতএব রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের বাইরে এককভাবে বা দলবদ্ধভাবে কেউ কাউকে হত্যা বা যখম করতে পারে না। এতে বুঝা যায় যে, জিহাদ ফরয হ’লেও সশস্ত্র জিহাদ পরিচালনার দায়িত্ব এককভাবে মুসলিম সরকারের হাতে ন্যস্ত, পৃথকভাবে কোন ব্যক্তি বা সংগঠনের হাতে নয়। রাসূল (ছাঃ)-এর পরে খেলাফতে রাশেদাহর সময়েও একই নীতি অনুসৃত হয়।

আধুনিক যুদ্ধ সমূহের সাথে তুলনামূলক চিত্র

ইতিপূর্বে আমরা দেখে এসেছি যে, মাদানী জীবনে মুসলিম ও কাফিরের মধ্যকার যুদ্ধে উভয় পক্ষে আমাদের হিসাবে ১৩৪২ জন এবং মানছূরপুরীর হিসাবে ১১৭১ জন নিহত হয়েছে। বিনিময়ে সমস্ত আরব উপদ্বীপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ইসলামী খেলাফত এবং যার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আল্লাহর সার্বভৌমত্বের অধীনে সকল মানুষের সমানাধিকার। জান-মাল ও ইযযতের গ্যারান্টি লাভে ধন্য হয়েছিল মানবতা। বিকশিত হয়েছিল সর্বত্র মানবিক মূল্যবোধের পুষ্পকলি। তাওহীদ, রিসালাত ও আখেরাত ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা নাগরিক জীবনে এনেছিল এক অনির্বচনীয় সুখ ও সমৃদ্ধির বাতাবরণ। সৃষ্টি করেছিল সর্বত্র শান্তি ও নিরাপত্তার অনাবিল পরিবেশ।

খৃষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীর উক্ত ইসলামী বিপ্লবের পর বিগত ১৪শ বছরে পৃথিবী অনেক দূর গড়িয়েছে। পুঁজিবাদ, সমাজবাদ, ফ্যাসিবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ইত্যাকার বহুতর মতবাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে আধুনিক পৃথিবীতে। কিন্তু যুলুম ও গোলামী ব্যতীত মানুষ কিছুই পায়নি এইসব মতবাদের নেতাদের কাছ থেকে। গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার দোহাই দিয়ে কেবল বিংশ শতাব্দীতেই সংঘটিত প্রধান তিনটি যুদ্ধে পৃথিবীতে কত বনু আদমকে হত্যা করা হয়েছে, তার একটা হিসাব আমরা তুলে ধরার প্রয়াস পাব। তবে সরকারী এসব হিসাবের বাইরে প্রকৃত হিসাব যে নিঃসন্দেহে অনেক বেশী হবে, অভিজ্ঞ ব্যক্তিগণ তা ভালভাবেই জানেন।

১ম মহাযুদ্ধ (১৯১৪-১৯১৮)

মোট নিহতের সংখ্যা ৭৩ লাখ ৩৮ হাযার। তন্মধ্যে (১) রাশিয়ায় ১৭ লাখ (২) জার্মানীতে ১৬ লাখ (৩) ফ্রান্সে ১৩ লাখ ৭০ হাযার (৪) ইটালীতে ৪ লাখ ৬০ হাযার (৫) অষ্ট্রিয়ায় ৮ লাখ (৬) গ্রেট বৃটেনে ৭ লাখ (৭) তুরস্কে ২ লাখ ৫০ হাযার (৮) বেলজিয়ামে ১ লাখ ২ হাযার (৯) বুলগেরিয়ায় ১ লাখ (১০) রুমানিয়ায় ১ লাখ (১১) সার্বিয়া-মন্টিনিগ্রোতে ১ লাখ (১২) আমেরিকায় ৫০ হাযার। সর্বমোট ৭৩ লাখ ৩৮ হাযার। এর মধ্যে ইংল্যান্ডের তালিকায় ভারতীয়দের এবং ফ্রান্সের তালিকায় সেখানকার নতুন বসতি স্থাপনকারীদের নিহতের সংখ্যা যুক্ত হয়েছে কি-না জানা যায়নি। তাছাড়া যুদ্ধে আহত, পঙ্গু, বন্দী, উদ্বাস্ত্ত ও নিখোঁজদের হিসাব উপরোক্ত তালিকার বাইরে রয়েছে। অন্য এক হিসাবে নিহত ৯০ লাখ, আহত ২ কোটি ২০ লাখ এবং নিখোঁজ হয়েছিল প্রায় ১ কোটি মানুষ।[1] এছাড়া খাদ্যাভাবে ধুঁকে ধুঁকে মরা মানুষদের তালিকা কখনই প্রকাশ পাবে বলে মনে হয়না।

২য় বিশ্বযুদ্ধ (১৯৪১-১৯৪৫)

মোট নিহতের সংখ্যা প্রায় ৩ কোটি।[2] তন্মধ্যে একা সোভিয়েট ইউনিয়ন প্রায় ৮৯ লাখ সৈন্য হারায় বলে মস্কো থেকে এএফপি পরিবেশিত এবং ২০০৭ সালে প্রকাশিত রিপোর্টে জানা যায়। এ সময় জাপানের হিরোশিমাতে নিক্ষিপ্ত এটমবোমায় তাৎক্ষণিক ভাবে নিহত হয় ১ লাখ ৩৮ হাযার ৬৬১ জন এবং ১৩ বর্গ কিলোমিটার এলাকা ধ্বংসস্তূপ ও ছাইয়ে পরিণত হয়। আমেরিকার ‘লিটল বয়’ নামক এই বোমাটি নিক্ষিপ্ত হয় ১৯৪৫ সালের ৬ই আগষ্ট সকাল সোয়া ৮-টায়। এর তিনদিন পরে ৯ই আগষ্ট বুধবার দ্বিতীয় বোমাটি নিক্ষিপ্ত হয় জাপানের নাগাসাকি শহরে। যাতে সাথে সাথে মৃত্যুবরণ করে আড়াই লাখ বনু আদম। উভয় বোমার তেজষ্ক্রিয়তার ফলে ক্যান্সার ইত্যাদির মত দুরারোগ্য ব্যাধিতে আজও সেখানকার মানুষ মরছে। বংশ পরম্পরায় জাপানীরা বহন করে চলেছে এসব মরণ ব্যাধির বীজ।[3] হিরোশিমা মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান ১৯৪৯ সালের ২০শে আগস্ট এক ঘোষণায় বলেন, ১৯৪৫ সালে ৬ই আগস্টের দিন বোমা হামলায় মৃত্যু বরণকারীর সংখ্যা ছিল ২ লক্ষ ১০ হাযার থেকে ৪০ হাযারের মধ্যে’।[4] এছাড়াও বর্তমানে সেখানে জন্মগ্রহণকারী শিশুদের অধিকাংশ হচ্ছে পঙ্গু ও প্রতিবন্ধী। মূল ধ্বংসস্থলে আজও কোন ঘাস পর্যন্ত জন্মায় না বলে পত্রিকান্তরে প্রকাশ।

ভিয়েতনাম যুদ্ধ(১৯৫৫-১৯৭৩)

আগ্রাসী মার্কিন শক্তির বিরুদ্ধে আক্রান্ত ভিয়েতনামীরা দীর্ঘ ১৮ বছর যাবৎ এই যুদ্ধ করে। এতে এককভাবে আমেরিকা ৩৬ লাখ ৭২ হাযার মানুষকে হত্যা করে ও ১৬ লাখ মানুষকে পঙ্গু করে এবং ৯ লাখ শিশু ইয়াতীম হয়।[5]

সম্প্রতি মার্কিন আদালতে ‘ভিয়েতনাম এসোসিয়েশন ফর ভিকটিম্স অফ এজেক্ট অরেঞ্জ/ডায়োক্সিন’-এর পক্ষ হ’তে নিউইয়র্কের একটি আদালতে মামলা দায়ের করা হ’লে আদালত তা খারিজ করে দেয়। বাদীগণ এই রায়ের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রীম কোর্টে আবেদন জানাবেন। বিবরণে বলা হয় যে, ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় রাসায়নিক অস্ত্র হিসাবে যুক্তরাষ্ট্র এই ‘এজেক্ট অরেঞ্জ’ (Eject orange) স্প্রে করেছিল। যাতে ক্যান্সার ও বিকলাঙ্গ শিশু জন্মসহ বিভিন্ন রোগ হয়ে থাকে। ‘এজেক্ট অরেঞ্জের’ ক্ষতিকর প্রভাবের কারণে ভিয়েতনামে প্রায় ৩০ লাখ মানুষ রোগাক্রান্ত বলে ধারণা করা হয়।[6] গত ৩০শে এপ্রিল ২০১৫ ভিয়েতনাম যুদ্ধের ৪০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, দেশটির প্রায় ৪৮ লাখ মানুষ এজেক্ট অরেঞ্জের শিকার হয়েছেন। এদের মধ্যে ৩০ লাখ মানুষ এজেক্ট অরেঞ্জের কারণে ক্যান্সারসহ নানা মারাত্মক স্বাস্থ্য সংকটে পড়েছেন। এদের মধ্যে অন্ততঃপক্ষে ৪ লাখ মানুষ মারা গেছেন বা বিকলাঙ্গ হয়েছেন। আর পরবর্তী সময়ে প্রায় ৫ লাখ শিশু মারাত্মক জন্মগত বৈকল্য নিয়ে ভূমিষ্ঠ হয়েছে।[7]

জন ডেভেনপোর্ট তার An Apology for Muhammed and the Koran বইয়ে কেবলমাত্র খ্রিষ্টান ধর্মীয় আদালতের নির্দেশে খ্রিষ্টান নাগরিকদের নিহতের সংখ্যা ১ কোটি ২০ লাখ বলেছেন। স্পেন সরকার ৩ লাখ ৪০ হাযার খ্রিষ্টানকে হত্যা করে। যার মধ্যে ৩২ হাযার খ্রিষ্টানকে তারা জীবন্ত পুড়িয়ে মারে (রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ২/২১৪-১৫)।

এতদ্ব্যতীত ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় এডলফ হিটলার কর্তৃক জার্মানীতে গ্যাস চেম্বারে ঢুকিয়ে ৬০ লাখ ইহূদীকে এবং ৫০ লাখ নন-ইহূদীকে হত্যা করার মর্মান্তিক বিভীষিকা মানবেতিহাসের কলংকতম ঘটনা।[8] এছাড়াও রয়েছে অন্যান্য নৃশংস হত্যাকান্ডের লোমহর্ষক কাহিনী সমূহ। যা অহরহ ঘটছে।

ইরাক-ইরান যুদ্ধ(১৯৮০-১৯৮৮)

আমেরিকার স্বার্থে ও তাদের উসকানিতে ইরাকী নেতা সাদ্দাম হোসেন ইরানের উপর এই হামলা চালান। যাতে আট বছরে দুই পক্ষে প্রায় দশ লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটে।[9] যুদ্ধের দীর্ঘ বিশ বছর পরে গত ২রা মার্চ ’০৮ আহমেদিনেযাদই প্রথম ইরানী প্রেসিডেন্ট, যিনি ইরাক সফর করেন। পরের দিন ইরাকের প্রধানমন্ত্রীর সাথে যৌথ সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রই মধ্যপ্রাচ্যে সন্ত্রাসের বীজ বপন করেছে’। একইভাবে সাদ্দাম ১৯৯০ সালের ২রা আগষ্টে কুয়েতে আগ্রাসন চালিয়ে ও সঊদী আরবে হামলা করে বহু মানুষকে হতাহত করেন। আল্লাহর অমোঘ বিধানে সাদ্দাম হোসেন (১৯৩৭-২০০৬) তার বিদেশী প্রভুদের চক্রান্তে স্বদেশী উপকার ভোগীদের হাতে ২০০৬ সালের ৩০শে ডিসেম্বর ঈদুল আযহার দিন সকালে নিজ রাজধানীতে ৬৯ বছর বয়সে ফাঁসিতে ঝুলে নিহত হন।

এতদ্ব্যতীত বসনিয়া-হার্জেগোভিনা, সোমালিয়া, সার্বিয়া, কসোভো, ফিলিস্তীন, সূদান, শ্রীলংকা, কাশ্মীর, নেপাল, ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়া, লিবিয়া, পাকিস্তান ও অন্যান্য দেশ সমূহে এইসব কথিত গণতন্ত্রী ও মানবাধিকারবাদী সাম্রাজ্যবাদীরা নানা অজুহাতে নিত্যদিন কত যে মানুষের রক্ত ঝরাচ্ছে, তার হিসাব কে রাখে?

[1]. মানছূরপুরী, রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ২/২১৪; মাওলানা আব্দুর রহীম, আল-কুরআনে রাষ্ট্র ও সরকার (ঢাকা, ৩য় সংস্করণ ২০০০ খৃঃ) পৃঃ ২৩৪, টীকা-১।
[2]. মাওলানা আব্দুর রহীম, আল-কুরআনে : রাষ্ট্র ও সরকার ২৩৪ পৃঃ, টীকা-১।
[3]. দৈনিক আমার দেশ, ঢাকা ৬ই আগষ্ট ২০০৭, ৭ পৃঃ।
[4]. আবুল হাসান আলী নাদভী, মুসলমানদের পতনে বিশ্ব কী হারালো? (ঢাকা : ৩য় মুদ্রণ ২০০৪) ২৬৩ পৃঃ।
[5]. দৈনিক আমার দেশ, ঢাকা ১৮ই মে ২০০৭, ৬ পৃঃ।
[6]. দৈনিক ইত্তেফাক, ঢাকা ২৫শে ফেব্রুয়ারী ২০০৮, পৃঃ ৭/৩-৪ কলাম।
[7]. দৈনিক প্রথম আলো, ঢাকা ৩০শে এপ্রিল ২০১৫।
[8]. Snyder 2010, p. 45. ; Niewyk, Donald L. and Nicosia, Francis R. The Columbia Guide to the Holocaust, Columbia University Press, 2000, pp. 45-52.।
[9]. আমার দেশ, ৪ঠা মার্চ ২০০৮ পৃঃ ৫/২-৫ কলাম।

ইহূদী-খ্রিষ্টানদের যুদ্ধনীতি

ইহূদী-খৃষ্টানদের এই ব্যাপক নরহত্যার পিছনে রয়েছে তাদের কথিত ধর্মীয় নির্দেশনা সম্বলিত যুদ্ধনীতি। যেমন বাইবেলে যুদ্ধের সময় বেসামরিক মানুষদের, বিশেষ করে সকল পুরুষ শিশুকে এবং সকল বিবাহিত নারীকে নির্বিচারে হত্যার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। শুধুমাত্র কিশোরী ও কুমারী মেয়েদেরকে নিজেদের স্বার্থে জীবিত রাখার নির্দেশ রয়েছে। কোন দেশ যুদ্ধ করে দখল করতে পারলে তার সকল পুরুষ অধিবাসীকে নির্বিচারে হত্যা করতে হবে এবং নারী ও গবাদিপশুদেরকে ভোগের জন্য রাখতে হবে। আর সেই দেশ যদি ইহূদীদের দেশের নিকটবর্তী কোন দেশ হয়, তবে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে তথাকার সকল মানুষকে হত্যা করতে হবে।[1]
[1]. The Bible, Numbers 31/17-18; The Bible, Deuteronomy 20/13-16.

ইসলামের যুদ্ধনীতি

ইসলামের প্রদত্ত যুদ্ধ নীতিতে যোদ্ধা ও বিচারে দন্ডপ্রাপ্ত ব্যতীত কাউকে হত্যা করার বিধান নেই। তেমনি শরী‘আতের দেওয়া নিয়ম-নীতির বাইরে কোনরূপ স্বেচ্ছাচারিতার সুযোগ নেই। যেমন-

(১) হযরত সুলায়মান বিন বুরায়দা (রাঃ) তাঁর পিতা হ’তে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন কোন বড় কিংবা ছোট সেনাদলের উপর কাউকে ‘আমীর’ নিযুক্ত করতেন, তখন তাকে বিশেষভাবে আল্লাহকে ভয় করে চলার এবং তার সঙ্গী মুসলমানদের সাথে উত্তম ব্যবহার করার উপদেশ দিতেন। অতঃপর বলতেন,اَغْزُوا بِاسْمِ اللهِ فِى سَبِيلِ اللهِ قَاتِلُوا مَنْ كَفَرَ بِاللهِ اغْزُوا وَ لاَ تَغُلُّوا وَلاَ تَغْدِرُوا وَلاَ تَمْثُلُوا وَلاَ تَقْتُلُوا وَلِيدًا وَإِذَا لَقِيتَ عَدُوَّكَ مِنَ الْمُشْرِكِينَ فَادْعُهُمْ إِلَى ثَلاَثِ خِصَالٍ ‘আল্লাহর নামে আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধে গমন কর এবং যারা আল্লাহর সাথে কুফরী করে তাদের সাথে যুদ্ধ কর। সাবধান! জিহাদ কর, কিন্তু গণীমতের মালে খেয়ানত করো না, চুক্তি ভঙ্গ করো না, নিহতদের অঙ্গহানি করো না, কোন শিশুকে হত্যা করো না। কাফেরদের মুকাবিলায় তুমি তাদেরকে তিনটি কথার প্রতি আহবান জানাবে’। যদি তারা সেগুলি মেনে নেয়, তাহ’লে তাদের প্রতি আক্রমণ করা থেকে বিরত হবে। (১) তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দিবে। (২) যদি তারা ইসলাম কবুল করে, তাহ’লে তারা তাদের নিজ এলাকা থেকে মুসলমানদের এলাকায় হিজরত করে চলে আসবে এবং তারা মুহাজিরগণের ন্যায় (গণীমত ইত্যাদির) অধিকার প্রাপ্ত হবে। (৩) ইসলাম কবুলের পরেও যদি তারা হিজরত করে আসতে রাযী না হয়, তাহ’লে তারা বেদুঈন মুসলমানদের মত সেখানে থাকবে এবং আল্লাহর বিধানসমূহ পালন করবে।

পক্ষান্তরে যদি তারা ইসলাম গ্রহণ করতে অস্বীকার করে, তাহ’লে তাদের নিকট থেকে জিযিয়া দাবী কর এবং তাদের প্রতি আক্রমণ করা হ’তে বিরত থাক। যদি তারা জিযিয়া দিতে অস্বীকার করে, তাহ’লে আল্লাহর প্রতি ভরসা কর এবং তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর। আর যদি তুমি কোন দুর্গ অবরোধ কর, আর তারা তোমাদের সাথে চুক্তিতে আবদ্ধ হ’তে চায়, তাহ’লে তোমরা নিজ দায়িত্বে তাদের সাথে চুক্তিবদ্ধ হ’তে পার। এ সময় আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নামে চুক্তি করো না। কেননা (যদি কোন কারণে উক্ত চুক্তি ভঙ্গ করতে বাধ্য হও, তখন) আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নামে কৃত চুক্তি ভঙ্গ করা অপেক্ষা তোমাদের কৃত চুক্তি ভঙ্গ করা অধিকতর সহজ ...’।[1]

(২) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,مَنْ قَتَلَ مُعَاهَدًا لَمْ يَرِحْ رَائِحَةَ الْجَنَّةِ وَإِنَّ رِيْحَهَا تُوْجَدُ مِنْ مَسِيْرَةِ أَرْبَعِيْنَ عَامًا ‘যদি কোন ব্যক্তি কোন চুক্তিবদ্ধ ব্যক্তিকে অর্থাৎ রাষ্ট্রের অনুগত কোন অমুসলিম ব্যক্তিকে হত্যা করে, তবে সে জান্নাতের সুগন্ধিও পাবে না। অথচ তার সুগন্ধি ৪০ বছরের দূরত্ব হ’তে লাভ করা যাবে’।[2]

(৩) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করা নিষিদ্ধ করে বলেন,إِنَّ النَّارَ لاَ يُعَذِّبُ بِهَا إِلاَّ اللهُ ‘আগুন দ্বারা কেউ শাস্তি দিতে পারে না আল্লাহ ব্যতীত’। তিনি আরও বলেন,لاَ تُعَذِّبُوا بِعَذَابِ اللهِ ‘তোমরা আল্লাহর শাস্তি দ্বারা শাস্তি প্রদান করো না’ (বুখারী হা/৩০১৬)।

(৪) বিদায় হজ্জের ভাষণে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,فَإنَّ دِمَاءَكُمْ وَأمْوَالَكُمْ وَأَعْرَاضَكُمْ عَلَيْكُمْ حَرَامٌ، كَحُرْمَةِ يَوْمِكُمْ هَذَا فِيْ بَلَدِكُمْ هَذَا فِيْ شَهْرِكُمْ هَذَا ‘তোমাদের রক্ত, তোমাদের ধন-সম্পদ ও তোমাদের ইযযত পরস্পরের উপরে এমনভাবে হারাম, যেমন এই দিন, এই শহর ও এই মাস তোমাদের জন্য হারাম’।[3] (বিস্তারিত দ্রঃ ‘ইসলামের জিহাদ বিধান’ অনুচ্ছেদ পৃঃ ২৬৫)।

বলা বাহুল্য ইসলামী জিহাদের উপরোক্ত নীতিসমূহ অনুসরণের ফলেই খুলাফায়ে রাশেদীন ও পরবর্তী যুগে সে সময়ে খ্রিষ্টান, পারসিক ও পৌত্তলিকদের শাসনাধীনে থাকা উত্তর আরব, সিরিয়া, ইরাক, ইরান এবং এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপ মহাদেশের বিভিন্ন এলাকা ইসলামী খেলাফতের অধীনস্ত হয়। বস্ত্ততঃ একমাত্র ইসলামী খেলাফতের অধীনেই রয়েছে মুসলিম-অমুসলিম সকল নাগরিকের জান-মাল ও ইযযতের নিশ্চয়তা। কেননা ইসলামী জিহাদ-এর মূল উদ্দেশ্য হ’ল, মানুষকে শয়তানের দাসত্ব হ’তে মুক্ত করে আল্লাহর দাসত্বে ফিরিয়ে আনা এবং সর্বত্র আল্লাহর বিধান প্রতিষ্ঠা করা। আর এর মধ্যেই রয়েছে মানবতার মুক্তি ও কল্যাণের স্থায়ী নিশ্চয়তা।

[1]. মুসলিম হা/১৭৩১; মিশকাত হা/৩৯২৯ (সংক্ষেপায়িত)।
[2]. বুখারী হা/৩১৬৬; মিশকাত হা/৩৪৫২।
[3]. বুখারী হা/১৭৩৯; মুসলিম হা/১৬৭৯; মিশকাত হা/২৬৫৯।

ইহূদী চক্রান্তসমূহ

(ক) সাধারণ ইহূদীদের চক্রান্ত : মুসলমানেরা সম্মান ও শ্রদ্ধার সাথে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে رَاعِنَا বলত, যার অর্থ أَرْعِنَا ‘আপনি আমাদের দেখাশুনা করুন’। কিন্তু ইহূদীরা তাদের হিব্রু ভাষায় এটিকে গালি হিসাবে বলত। তারা الرُّعُونَةُ (বেওকূফী) কিংবা شَرِيْرُنَا ‘আমাদের মন্দ লোকটি’ অর্থ নিত ও মুখ ঘুরিয়ে তাচ্ছিল্য ভরে উচ্চারণ করত। এমতাবস্থায় তাদেরকে রা‘এনা বলতে নিষেধ করা হয় এবং তার পরিবর্তে ‘উনযুরনা’ (انْظُرْنَا) বলার নির্দেশ দেওয়া হয়’।[1] এতদ্ব্যতীত মুসলমানদেরকে সালাম দেওয়ার সময় তারা আসসা-মু আলাইকুম(السَّامُ عَلَيْكُمْ) বলত। অর্থাৎ ‘তোমাদের মৃত্যু হৌক’।[2]

(খ) ইহূদী নেতাদের চক্রান্ত : মদীনার তিনটি ইহূদী গোত্র বনু ক্বায়নুক্বা, বনু নাযীর ও বনু কুরায়যার নেতারা সর্বদা মুসলমানদের বিরুদ্ধে চক্রান্তে লিপ্ত থাকত। অতঃপর বদর যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর বিজয়ে তারা চরমভাবে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে নানাবিধ কষ্টদায়ক ও বিদ্রূপাত্মক আচরণ শুরু করে। এদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী, সম্পদশালী ও মুসলমানদের প্রতি সর্বাধিক বিদ্বেষপরায়ণ ছিল বনু ক্বায়নুক্বা।[3] ২য় হিজরীর ১৫ই শাওয়াল রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদের দুর্গ অবরোধ করেন ও দু’সপ্তাহ অবরোধের পর তারা আত্মসমর্পণ করে। অতঃপর তাদেরকে সর্বপ্রথম মদীনা থেকে বিতাড়িত করা হয়। এরপর একই কারণে ৪র্থ হিজরীতে বনু নাযীরকে এবং ৫ম হিজরীতে বনু কুরায়যাকে বিতাড়নের মাধ্যমে মদীনাকে ইহূদীমুক্ত করা হয়।

বনু নাযীর খায়বরে নির্বাসিত হয়ে সেখান থেকে কুরায়েশদের সাথে ষড়যন্ত্র করে মদীনাকে ধ্বংস করার চেষ্টা করে। যার ফলে সম্মিলিত শত্রু বাহিনীর হামলার মাধ্যমে ৫ম হিজরীতে ‘খন্দক যুদ্ধ’ সংঘটিত হয়। খন্দকের যুদ্ধে মদীনার সর্বশেষ ইহূদী গোত্র বনু কুরায়যা সন্ধিচুক্তি ভঙ্গ করে শত্রুবাহিনীকে সাহায্য করে। ফলে উক্ত যুদ্ধ শেষে তাদেরকে মদীনা থেকে বহিষ্কার করা হয়। পরবর্তীতে তাদেরকে পুনরায় বিতাড়নের জন্য ৭ম হিজরীতে খায়বর যুদ্ধ সংঘটিত হয়। একইভাবে তাদের চক্রান্তে মদীনায় রোমক হামলার আশংকা দেখা দেয়। ফলে ৮ম হিজরীতে মুতার যু্দ্ধ ও ৯ম হিজরীতে সর্বশেষ তাবূক অভিযান সংঘটিত হয়। এমনকি ১১ হিজরীতে মৃত্যুর দু’দিন আগেও রোমক হামলা প্রতিরোধের জন্য রাসূল (ছাঃ) ওসামা বিন যায়েদকে প্রেরণ করেন।

এভাবে দেখা যায়, মদীনায় হিজরতের শুরু থেকে রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যু পর্যন্ত অধিকাংশ যুদ্ধের পিছনে ইহূদী চক্রান্ত সক্রিয় ছিল। মুসলিম বিশ্বের বিরুদ্ধে অদ্যাবধি তাদের চক্রান্ত অব্যাহত রয়েছে।

[1]. মুজাম্মা‘ লুগাতুল ‘আরাবিইয়াহ (মিসর : ১৪০৯/১৯৮৮) ১/৫০৬; আরবী ভাষায় رَاعِنَا অর্থ ‘আমাদের তত্ত্বাবধায়ক’। মাদ্দাহ الرعاية والحفظ এই লকবে ডেকে তারা বাহ্যতঃ মুসলমানদের খুশী করত। কিন্তু এর দ্বারা তারা নিজেদের ভাষা অনুযায়ী গালি (الرُّعُونَةُ) অর্থ নিত। সেকারণ আল্লাহ এটাকে নিষিদ্ধ করে انظُرْنَا (‘আমাদের দেখাশুনা করুন’) লকবে ডাকার নির্দেশ দিলেন (কুরতুবী, ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা বাক্বারাহ ১০৪ আয়াত)।
[2]. বুখারী হা/৬০৩০; মুসলিম হা/২১৬৫ (১০)।
[3]. বনু ক্বায়নুক্বার চক্রান্ত বিষয়ে দ্রষ্টব্য ‘গাযওয়া বনু ক্বায়নুক্বা’ পৃঃ ৩২৫ টীকা সমূহ।

রাসূল (ছাঃ)-কে হত্যার প্রচেষ্টাসমূহ

(১) হিজরতের পরদিন ৬২২ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ই সেপ্টেম্বর শুক্রবার ছওর পাহাড়ের গুহামুখে ১০০ উটের পুরস্কার লোভী শত্রুদের ব্যর্থ চেষ্টা।[1]

(২) ১৮ই সেপ্টেম্বর বুধবার বনু মুদলিজ গোত্রের নেতা সুরাক্বা বিন মালেক বিন জু‘শুম কর্তৃক হিজরতের সময় পথিমধ্যে হামলার ব্যর্থ চেষ্টা।[2]

(৩) ৬ষ্ঠ হিজরীর মুহাররম মাসে ইয়ামামাহর হানীফা গোত্রের নেতা ছুমামাহ বিন আছাল হানাফী(ثُمَامَةُ بنُ آثالٍ الْحَنَفِيُّ) ইয়ামামার নেতা মুসায়লামাহর নির্দেশে রাসূল (ছাঃ)-কে হত্যার জন্য ছদ্মবেশে মদীনায় আসছিল। কিন্তু পথিমধ্যে সে মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহর সেনাদলের হাতে ধরা পড়ে যায়। মদীনায় আনার পর তিনদিন মসজিদে নববীতে তাকে বেঁধে রাখা হয়। তারপর তাকে মুক্তি দিলে তিনি মুসলমান হয়ে মক্কায় ওমরাহ করতে যান এবং ইসলামের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।[3]

(৪) ৭ম হিজরীর মুহাররম মাসে খায়বর বিজয়ের পর রাসূল (ছাঃ) যখন একটু নিশ্চিন্ত হ’লেন, তখন বিতাড়িত বনু নাযীর গোত্রের অন্যতম নেতা ও কোষাধ্যক্ষ সাল্লাম বিন মিশকামের স্ত্রী যয়নব বিনতুল হারেছ তাকে বকরীর বিষমাখানো ভুনা রান হাদিয়া পাঠায়। রাসূল (ছাঃ) তার কিছু অংশ চিবিয়ে ফেলে দেন, গিলেননি।[4] এভাবে আল্লাহর রহমতে তিনি বেঁচে যান।

(৫) ৭ম হিজরীর রবীউল আউয়াল মাসে যাতুর রিক্বা‘ যুদ্ধ থেকে ফেরার পথে রাসূল (ছাঃ) একটি গাছের নীচে ঘুমিয়ে যান এবং তরবারিটি গাছে ঝুলিয়ে রাখেন। এ সময় গাওরাছ ইবনুল হারেছ নামক জনৈক বেদুঈন তরবারিটি হাতে নিয়ে রাসূল (ছাঃ)-কে হুমকি দিয়ে বলে, এবার তোমাকে রক্ষা করবে কে? জবাবে রাসূল (ছাঃ) দৃঢ়কণ্ঠে বলেন, ‘আল্লাহ’। তখন তরবারিটি তার হাত থেকে পড়ে যায়।[5]

(৬) ৮ম হিজরীর শাওয়াল মাসে হোনায়েন যুদ্ধের সংকটকালে মক্কার নওমুসলিম শায়বা বিন ওছমান সুযোগ পেয়ে রাসূল (ছাঃ)-কে হত্যার জন্য তরবারি উঠায়। কিন্তু হঠাৎ এক আগুনের ফুলকি এসে তার চেহারাকে ঝলসে দিয়ে যায়। ফলে তার হত্যা চেষ্টা ব্যর্থ হয়। রাসূল (ছাঃ) তাকে কাছে ডেকে দো‘আ করেন। ফলে সে তওবা করে।[6]

(৭) ৯ম হিজরীর রামাযান মাসে তাবূক অভিযান থেকে ফেরার পথে এক সংকীর্ণ গিরিসংকটে ১২ জন মুখোশধারী মুনাফিকের একটি দল রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে নিরিবিলি পেয়ে তাঁকে হত্যার প্রচেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়’।[7]

[1]. ইবনু হিশাম ১/৪৮৯, বুখারী হা/৩৯০৬।
[2]. বুখারী হা/৩৬১৫; মুসলিম হা/২০০৯; মিশকাত হা/৫৮৬৯।
[3]. বুখারী হা/৪৩৭২; মুসলিম হা/১৭৬৪; মিশকাত হা/৩৯৬৪।
[4]. বুখারী হা/৩১৬৯; ইবনু হিশাম ২/৩৩৭; ফিক্বহুস সীরাহ ৩৪৭ পৃঃ, সনদ ছহীহ।
[5]. বুখারী হা/৪১৩৬; মুসলিম হা/৮৪৩; মিশকাত হা/১৪২২ ‘ভীতির ছালাত’ অনুচ্ছেদ।
[6]. আল-ইছাবাহ ক্রমিক ৩৯৪৯; যাদুল মা‘আদ ৩/৪১২; ইবনু হিশাম ২/৪৪৪; সনদ ছহীহ (তাহকীক ইবনু হিশাম ক্রমিক ১৭৪৮)।
[7]. মুসলিম হা/২৭৭৯; মিশকাত হা/৫৯১৭।

এতদ্ব্যতীত যঈফ সূত্রে বর্ণিত আরও ৭টি হত্যা প্রচেষ্টা নিম্নরূপ :
(১) এক্ষেত্রে বহুল প্রসিদ্ধ ঘটনাটি হ’ল এই যে, রাসূল (ছাঃ)-কে হত্যার জন্য মক্কার চৌদ্দ নেতা রাত্রিতে তাঁর বাড়ি ঘেরাও করেছিলেন। অবশেষে তিনি তাদের চোখে ধূলি নিক্ষেপ করে গভীর রাতে বেরিয়ে যান (আর-রাহীক্ব ১৫৮-৬০ পৃঃ)। ঘটনাটি ভিত্তিহীন (আর-রাহীক্ব, তা‘লীক্ব ৯৬ পৃঃ)।

(২) হিজরতকালে পথিমধ্যে বুরাইদা আসলামীর কাফেলার সাথে সাক্ষাৎ হয়। বুরাইদা ছিলেন একজন বীরপুরুষ ও নিজ সম্প্রদায়ের নেতা। তিনি মক্কাবাসীদের ঘোষিত পুরস্কারের লোভে মুহাম্মাদের মাথা নেওয়ার জন্য অনুসন্ধানে ছিলেন। কিন্তু শিকার হাতে পেয়ে তিনিই ফের শিকারে পরিণত হ’লেন’ (রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ১/৯০ পৃঃ; আর-রাহীক্ব ১৭০ পৃঃ)। ঘটনাটির কোন সূত্র খুঁজে পাওয়া যায়নি। মানছূরপুরী রাসূল (ছাঃ)-এর মু‘জিযা অধ্যায়ে বর্ণিত ২১টি ঘটনার মধ্যেও এটি আনেননি (রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ৩/১৩৮-৬২ পৃঃ)। বিস্তারিত দ্রঃ ‘হিজরতকালের কিছু ঘটনাবলী’ অধ্যায়।

(৩) ২য় হিজরীর ১৭ই রামাযানে সংঘটিত বদর যুদ্ধের কয়েক দিন পরে মক্কার নেতা ছাফওয়ান বিন উমাইয়ার কুপরামর্শে দুষ্টমতি ওমায়ের বিন ওয়াহাব আল-জুমাহী (عُمَيْرُ بن وَهْبٍ الْجُمَحِي) তীব্র বিষ মিশ্রিত তরবারি নিয়ে মদীনায় আগমন করে। তখন রাসূল (ছাঃ) তার নিকট মক্কায় বসে ছাফওয়ান ও তার মধ্যকার গোপন পরামর্শ এবং তার হত্যা পরিকল্পনার কথা ফাঁস করে দেন। এতে সে ভীত হয়ে আত্মসমর্পণ করে ও মুসলমান হয়ে যায়। পরে মক্কায় ফিরে গিয়ে তার দাওয়াতে বহু লোক ইসলাম কবুল করে’ (ইবনু হিশাম ১/৬৬১; আল-বিদায়াহ ৩/৩১৩; আর-রাহীক্ব ২৩৫-৩৬ পৃঃ)। ঘটনাটির সনদ ‘মুরসাল’ বা যঈফ (তাহকীক ইবনু হিশাম ক্রমিক ৮২৬)। বিস্তারিত দ্রঃ বদরের ‘যুদ্ধবন্দীদের বিষয়ে ফায়ছালা’ অনুচ্ছেদ।

(৪) ৪র্থ হিজরীর রবীউল আউয়াল মোতাবেক ৬২৫ খ্রিষ্টাব্দের আগস্ট মাসে মদীনা থেকে বনু নাযীরের বহিষ্কার সম্পর্কে এটি প্রসিদ্ধ রয়েছে যে, রাসূল (ছাঃ) তাদের কাছে বনু কেলাবের নিহত দুই ব্যক্তির রক্তমূল্য সংগ্রহের জন্য এলে তারা তাঁকে ও তাঁর সাথীদেরকে শঠতার মাধ্যমে বসিয়ে রাখে। অতঃপর দেওয়ালের উপর থেকে পাথরের চাক্কি ফেলে তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্র করে। ঘটনাটি বিশুদ্ধ সনদে প্রমাণিত নয় বরং ‘মুরসাল’ বা যঈফ (যঈফাহ হা/৪৮৬৬; ইবনু হিশাম ২/১৯০; আর-রাহীক্ব ২৯৫ পৃঃ)।

(৫) ৬ষ্ঠ হিজরীর রামাযান মাসে বনু ফাযারাহ (بَنُو فَزَارَةَ) গোত্রের একটি শাখার নেত্রী উম্মু ক্বিরফা (أُمُّ قِرْفَةَ) রাসূল (ছাঃ)-কে অপহরণ ও গোপন হত্যার ষড়যন্ত্র করে এবং এজন্য ৩০ জন সশস্ত্র ব্যক্তিকে নিয়োগ করে। কিন্তু তারা আবুবকর (রাঃ) অথবা যায়েদ বিন হারেছাহর সেনাদলের হাতে গ্রেফতার হয়ে নিহত হয়’ (আর-রাহীক্ব ৩৩৪-৩৫ পৃঃ)। মুবারকপুরী কোনরূপ সূত্র ছাড়াই এই গোপন হত্যার (اغتيال) ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন। ইবনু হিশাম সহ অন্য কোন জীবনীকার এটি বর্ণনা করেননি।

(৬) ৮ম হিজরীর ১৭ই রামাযান মক্কা বিজয়ের পর কা‘বাগৃহ ত্বাওয়াফকালে ফাযালাহ বিন ওমায়ের রাসূল (ছাঃ)-কে হত্যার জন্য তাঁর নিকটবর্তী হয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে তার কুমতলবের কথা ফাঁস করে দিলে সে মুসলমান হয়ে যায় (ইবনু হিশাম ২/৪১৭; যাদুল মা‘আদ ৩/৩৬৩; আর-রাহীক্ব ৪০৭ পৃঃ) বর্ণনাটির সনদ মু‘যাল বা যঈফ (আর-রাহীক্ব, তা‘লীক্ব ১৭৪ পৃঃ)।

(৭) ১০ম হিজরী সনে বনু ‘আমের বিন ছা‘ছা‘আহর প্রতিনিধি দলের নেতা ‘আমের বিন তোফায়েল ও আরবাদ বিন ক্বায়েস রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে মদীনায় মসজিদে নববীতে হত্যার প্রচেষ্টা চালায়। কিন্তু বারবার চেষ্টা করেও তরবারি কোষ থেকে বের না হওয়ায় তারা ব্যর্থ হয়। রাসূল (ছাঃ)-এর বদদো‘আয় মদীনা থেকে ফেরার পথে তাদের প্রথমজন হঠাৎ ঘাড়ে ফোঁড়া উঠায় এবং দ্বিতীয় জন বজ্রাঘাতে নিহত হয় (আর-রাহীক্ব ৪৫৩ পৃঃ; মাজমা‘উয যাওয়ায়েদ হা/১১০৯১, সনদ যঈফ)।

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর উপরে জাদু

হত্যা প্রচেষ্টা ছাড়াও তাঁকে জাদু করে পাগল বানিয়ে দেওয়ার চেষ্টাও করে ষড়যন্ত্রকারীরা। ইহূদীদের মিত্র বনু যুরায়েক্ব গোত্রের লাবীদ বিন আ‘ছাম(لَبِيدُ بن أَعْصَم) নামক জনৈক মুনাফিক তার মেয়েদের মাধ্যমে এই জাদু করে। প্রথমে সে রাসূল (ছাঃ)-এর বাসার কাজের ছেলের মাধ্যমে কয়েকটি চুলসহ রাসূল (ছাঃ)-এর ব্যবহৃত চিরুনীটি সংগ্রহ করে। অতঃপর তার কন্যাদের দ্বারা উক্ত চুলে ১১টি জাদুর ফুঁক দিয়ে ১১টি গিরা দেয় ও তার মধ্যে ১১টি সুঁচ ঢুকিয়ে দেয়। অতঃপর চুল ও সুঁচ সমেত চিরুনীটি একটি খেজুরের শুকনা কাঁদির আবরণীর মধ্যে প্রবেশ করিয়ে ‘যারওয়ান’(بِئْرُ ذَرْوَانَ) কূয়ার তলায় একটি বড় পাথরের নীচে চাপা দিয়ে রাখে। মা আয়েশা (রাঃ) বলেন, উক্ত জাদুর প্রভাবে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) মাঝে মধ্যে দিশেহারা হয়ে পড়তেন। যে কাজ করেননি, তা করেছেন বলে মনে করতেন। একরাতে স্বপ্নে দু’জন ফেরেশতা এসে নিজেদের মধ্যে প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে তাঁকে জাদুর বিষয়ে অবহিত করেন এবং সেটি কোথায় আছে বলে দেন। ফলে পরদিন আলী, যুবায়ের ও ‘আম্মার বিন ইয়াসিরসহ একদল ছাহাবী গিয়ে উক্ত কূয়া সেঁচে পাথরের নীচ থেকে খেজুরের কাঁদির খোসাসহ চিরুনীটি বের করে আনেন। ঐ সময় সূরা ফালাক্ব ও নাস নাযিল হয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ঐ দুই সূরার ১১টি আয়াতের প্রতিটি পাঠ শেষে এক একটি গিরা খুলতে থাকেন। অবশেষে সব গিরা খুলে গেলে তিনি স্বস্তি লাভ করেন।

লোকেরা ঐ ব্যক্তিকে হত্যা করতে চাইলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিষেধ করে বলেন,أَمَّا أَنَا فَقَدْ شَفَانِى اللهُ وَخَشِيتُ أَنْ يُثِيرَ ذَلِكَ عَلَى النَّاسِ شَرًّا ‘আল্লাহ আমাকে রোগমুক্ত করেছেন (এটাই যথেষ্ট)। লোকদের মধ্যে মন্দ ছড়িয়ে পড়ুক, এটা আমি চাই না’।[1]

[1]. বুখারী হা/৬৩৯১; আহমাদ হা/২৪৬৯৪; বায়হাক্বী দালায়েল হা/২৫১০; ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা নাস অবলম্বনে।

শিক্ষণীয় বিষয়
খালেছ তাওহীদের অনুসারী, সমাজ সংস্কারক ব্যক্তি ও নেতাই হ’লেন শয়তানের সবচেয়ে বড় শত্রু। তাই তাদেরকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য ইবলীস তার বন্ধুদের মাধ্যমে সর্বদা চেষ্টা করে থাকে। এতে মুমিন কখনো পরীক্ষিত হয়, কখনো রক্ষা পায়। কিন্তু সর্বাবস্থায় সেটি তার জন্য কল্যাণকর হয় ও দ্বীন বিজয়ী থাকে।



প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর ৬৭ পর্বের জীবনীর সকল পর্ব এখান থেকে পড়ুন-

পর্ব-০১   পর্ব-০২   পর্ব-০৩   পর্ব-০৪   পর্ব-০৫   পর্ব-০৬   পর্ব-০৭   পর্ব-০৮   পর্ব-০৯   পর্ব-১০   পর্ব-১১   পর্ব-১২   পর্ব-১৩   পর্ব-১৪   পর্ব-১৫   পর্ব-১৬   পর্ব-১৭   পর্ব-১৮   পর্ব-১৯   পর্ব-২০   পর্ব-২১   পর্ব-২২   পর্ব-২৩   পর্ব-২৪   পর্ব-২৫   পর্ব-২৬   পর্ব-২৭   পর্ব-২৮   পর্ব-২৯   পর্ব-৩০    পর্ব-৩১   পর্ব-৩২   পর্ব-৩৩   পর্ব-৩৪   পর্ব-৩৫   পর্ব-৩৬   পর্ব-৩৭   পর্ব-৩৮   পর্ব-৩৯   পর্ব-৪০   পর্ব-৪১   পর্ব-৪২   পর্ব-৪৩   পর্ব-৪৪   পর্ব-৪৫   পর্ব-৪৬(১ম) পর্ব-৪৬(২য়)    পর্ব-৪৭   পর্ব-৪৮   পর্ব-৪৯   পর্ব-৫০   পর্ব-৫১   পর্ব-৫২   পর্ব-৫৩   পর্ব-৫৪   পর্ব-৫৫   পর্ব-৫৬   পর্ব-৫৭   পর্ব-৫৮   পর্ব-৫৯   পর্ব-৬০   পর্ব-৬১   পর্ব-৬২   পর্ব-৬৩   পর্ব-৬৪   পর্ব-৬৫   পর্ব-৬৬   পর্ব-৬৭  




******************************************
>>> Welcome, You are now on Mohammadia Foundation's Website. Please stay & Tune with us>>>


এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url