প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর জীবনী [পর্ব-১১]




নবী মোহাম্মদের বিরুদ্ধে নানাবিধ অপবাদ ও বিভিন্ন কৌশলে বাধা প্রদান


নানাবিধ অপবাদ রটনা

হজ্জের মৌসুম শেষে নেতারা পুনরায় হিসাব-নিকাশে বসে গেলেন। দেখা গেল যে, অপবাদ রটনায় কাজ হয়েছে সবচেয়ে বেশী। এর দ্বারা যেমন প্রতিপক্ষকে মানসিকভাবে দুর্বল করা যায়। তেমনি সাধারণ মানুষ দ্রুত সেটা লুফে নেয়। কেউ যাচাই-বাছাই করতে চাইলে তো আমাদের কাছেই আসবে। কেননা আমরাই সমাজের নেতা এবং আমরাই তার নিকটতম আত্মীয় ও প্রতিবেশী। অতএব আমরাই যখন তার বিরুদ্ধে বলছি, তখন কেউ আর এ পথ মাড়াবে না। অতএব অপবাদের সংখ্যা বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নেওয়া হ’ল। ফলে রাসূল (ছাঃ)-এর বিরুদ্ধে তারা অনেকগুলি অপবাদ তৈরী করল। যেমন-

তিনি (১) পাগল (২) কবি وَيَقُولُونَ أَئِنَّا لَتَارِكُوا آلِهَتِنَا لِشَاعِرٍ مَّجْنُونٍ ‘তারা বলল, আমরা কি একজন কবি ও পাগলের জন্য আমাদের উপাস্যদের পরিত্যাগ করব? (ছাফফাত ৩৭/৩৬)। (৩) জাদুকর (৪) মহা মিথ্যাবাদী وَقَالَ الْكَافِرُونَ هَذَا سَاحِرٌ كَذَّابٌ ‘কাফেররা বলল, এ লোকটি একজন জাদুকর ও মহা মিথ্যাবাদী’ (ছোয়াদ ৩৮/৪)। (৫) পুরাকালের উপাখ্যান বর্ণনাকারী إِنْ هَـذَا إِلاَّ أَسَاطِيْرُ الأوَّلِيْنَ ‘এটা পূর্ববর্তীদের মিথ্যা উপাখ্যান ব্যতীত কিছুই নয়’ (আনফাল ৮/৩১)। (৬) অন্যের সাহায্যে মিথ্যা রচনাকারী يَقُولُونَ إِنَّمَا يُعَلِّمُهُ بَشَرٌ ‘তারা বলে যে, তাকে শিক্ষা দেয় একজন মানুষ’ (নাহল ১৬/১০৩), (৭) মিথ্যা রটনাকারী وَقَالَ الَّذِينَ كَفَرُوا إِنْ هَذَا إِلاَّ إِفْكٌ افْتَرَاهُ وَأَعَانَهُ عَلَيْهِ قَوْمٌ آخَرُونَ ‘কাফেররা বলে, এটা বানোয়াট ছাড়া কিছুই নয় যা সে উদ্ভাবন করেছে এবং অন্য সম্প্রদায়ের লোকেরা তাকে এব্যাপারে সাহায্য করেছে’ (ফুরক্বান ২৫/৪)। (৮) গণৎকার فَذَكِّرْ فَمَا أَنتَ بِنِعْمَتِ رَبِّكَ بِكَاهِنٍ وَلاَ مَجْنُونٍ ‘অতএব তুমি উপদেশ দিতে থাকো। তোমার প্রতিপালকের অনুগ্রহে তুমি গণক নও, উন্মাদও নও’ (তূর ৫২/২৯)। (৯) ইনি তো সাধারণ মানুষ, ফেরেশতা নন وَقَالُوا مَالِ هَذَا الرَّسُولِ يَأْكُلُ الطَّعَامَ وَيَمْشِي فِي الْأَسْوَاقِ لَوْلاَ أُنزِلَ إِلَيْهِ مَلَكٌ فَيَكُونَ مَعَهُ نَذِيراً ‘তারা বলে যে, এ কেমন রাসূল যে খাদ্য ভক্ষণ করে ও হাট-বাজারে চলাফেরা করে? তার প্রতি কেন ফেরেশতা নাযিল করা হলো না, যে তার সাথে থাকতো সদা সতর্ককারী রূপে? (ফুরক্বান ২৫/৭)। (১০) পথভ্রষ্ট وَإِذَا رَأَوْهُمْ قَالُوا إِنَّ هَؤُلاَء لَضَالُّونَ ‘যখন তারা ঈমানদারগণকে দেখত, তখন বলত, নিশ্চয়ই এরা পথভ্রষ্ট’ (মুত্বাফফেফীন ৮৩/৩২)। (১১) ধর্মত্যাগী قَالَ ابو لهب: لاَتُطِيْعُوْهُ فَإِنَّهُ صَابِىءٌ كَذَّابٌ ‘আবু লাহাব বলত, তোমরা এর আনুগত্য করো না। কেননা সে ধর্মত্যাগী মহা মিথ্যাবাদী’ (আহমাদ)। (১২) পিতৃধর্ম বিনষ্টকারী (১৩) জামা‘আত বিভক্তকারী (ইবনু হিশাম ১/২৯৫) (১৪) জাদুগ্রস্ত يَقُوْلُ الظَّالِمُوْنَ إِنْ تَتَّبِعُوْنَ إِلاَّ رَجُلاً مَّسْحُوْراً ‘যালেমরা বলে, তোমরা তো কেবল একজন জাদুগ্রস্ত ব্যক্তির অনুসরণ করছ’ (বনু ইস্রাঈল ১৭/৪৭)। (১৫) ‘মুযাম্মাম’। আবু লাহাবের স্ত্রী উম্মে জামীল ‘মুহাম্মাদ’ (প্রশংসিত) নামের বিপরীতে ‘মুযাম্মাম’ (নিন্দিত) নামে ব্যঙ্গ কবিতা বলত (ইবনু হিশাম ১/৩৫৬)। (১৬) রা‘এনা। মদীনায় হিজরত করার পর সেখানকার দুরাচার ইহূদীরা রাসূল (ছাঃ)-কে ‘রা‘এনা’ (رَاعِنَا) বলে ডাকত (বাক্বারাহ ২/১০৪)। তাদের মাতৃভাষা হিব্রুতে যার অর্থ ছিল شَرِيْرُنَا ‘আমাদের মন্দ লোকটি’।[১]

এইসব অপবাদের জওয়াবে আল্লাহ বলেন, اُنْظُرْ كَيْفَ ضَرَبُوْا لَكَ الأَمْثَالَ فَضَلُّوْا فَلاَ يَسْتَطِيْعْوْنَ سَبِيْلاً ‘দেখ ওরা কিভাবে তোমার নামে (বাজে) উপমাসমূহ প্রদান করছে। ওরা পথভ্রষ্ট হয়েছে। অতএব ওরা আর পথ পেতে সক্ষম হবে না’ (বনু ইস্রাঈল ১৭/৪৮; ফুরক্বান ২৫/৯)। কুৎসা রটনাকারীদের বিরুদ্ধে যুগে যুগে এটাই হ’ল সর্বোত্তম জবাব।

[১]. মুজাম্মা‘ লুগাতুল ‘আরাবিইয়াহ (মিসর : ১৪০৯/১৯৮৮) ১/৫০৬; আরবী ভাষায় رَاعِنَا অর্থ ‘আমাদের তত্ত্বাবধায়ক’। মাদ্দাহ الرعاية والحفظ এই লকবে ডেকে তারা বাহ্যতঃ মুসলমানদের খুশী করত। কিন্তু এর দ্বারা তারা নিজেদের ভাষা অনুযায়ী গালি (الرُّعُونَةُ) অর্থ নিত। সেকারণ আল্লাহ এটাকে নিষিদ্ধ করে انظُرْنَا (‘আমাদের দেখাশুনা করুন’) লকবে ডাকার নির্দেশ দিলেন (ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা বাক্বারাহ ১০৪ আয়াত)।

নাচ-গানের আসর করা

গল্পের আসর জমানো এবং গান-বাজনা ও নৃত্য-গীতের অনুষ্ঠান করা, যাতে মানুষ মুহাম্মাদের কথা না শোনে। এজন্য অন্যতম কুরায়েশ নেতা ও বিত্তশালী ব্যবসায়ী নযর বিন হারেছ তৎকালীন সমৃদ্ধ শহর ইরাকের ‘হীরা’ নগরীতে চলে যান এবং সেখান থেকে পারস্যের প্রাচীন রাজা-বাদশাদের কাহিনী, রুস্তম ও ইস্ফিনদিয়ারের বীরত্বের কাহিনী শিখে এসে মক্কায় বিভিন্ন স্থানে গল্পের আসর বসাতে শুরু করেন। যেখানেই রাসূল (ছাঃ) মানুষকে জাহান্নামের ভয় ও জান্নাতের সুখ-শান্তির কথা শুনিয়ে দ্বীনের দাওয়াত দিতেন, সেখানেই নযর বিন হারেছ গিয়ে উক্ত সব কল্প-কাহিনী শুনিয়ে বলতেন, এগুলো কি মুহাম্মাদের কাহিনীর চেয়ে উত্তম নয়? এতেও তিনি ক্ষান্ত না হয়ে অনেকগুলি সুন্দরী দাসী খরিদ করেন, যারা নৃত্য-গীতে পারদর্শী ছিল। তিনি তাদের নিয়ে বিভিন্ন স্থানে নাচ-গানের আসর বসাতেন এবং মানুষকে সেখানে আকৃষ্ট করতেন। এমনকি কোন লোক মুহাম্মাদের অনুসারী হয়েছে জানতে পারলে তিনি ঐসব সুন্দরীদের তার পিছনে লাগিয়ে দিতেন এবং তাকে ফিরিয়ে আনার যেকোন পন্থা অবলম্বনের নির্দেশ দিতেন’ (ইবনু হিশাম ১/৩০০)।

উপরোক্ত ঘৃণ্য ক্রিয়া-কলাপের প্রেক্ষিতেই নিম্নোক্ত আয়াত নাযিল হয়-

وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَشْتَرِي لَهْوَ الْحَدِيْثِ لِيُضِلَّ عَنْ سَبِيْلِ اللهِ بِغَيْرِ عِلْمٍ وَّيَتَّخِذَهَا هُزُواً أُولَئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ مُّهِيْنٌ- (لقمان ৬)-

‘লোকেদের মধ্যে একটা শ্রেণী আছে, যারা মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করার জন্য অজ্ঞতাবশে অলীক কল্প-কাহিনী খরীদ করে এবং আল্লাহর পথকে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে। এদের জন্য রয়েছে মর্মন্তুদ শাস্তি’ (লোকমান ৩১/৬)।

আধুনিক যুগের মিথ্যাচার ও খেল-তামাশার বাহন স্বরূপ ইসলাম বিরোধী প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া সমূহ এ আয়াতের আওতাভুক্ত। সেযুগের চেয়ে এ যুগে এসবের ক্ষতি শতগুণ বেশী। কেননা সে যুগে এসব যে স্থানে প্রদর্শিত হ’ত, সে স্থানের দর্শক ও শ্রোতারাই কেবল সংক্রমিত হ’ত। কিন্তু আধুনিক যুগে এর মন্দ প্রতিক্রিয়া হয় সাথে সাথে বিশ্বব্যাপী কোটি কোটি দর্শক ও শ্রোতার মধ্যে। সেকারণ জাহান্নামের কঠিন শাস্তি থেকে বাঁচার জন্য মিডিয়া সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের এবং পরিবারপ্রধান ও সমাজ ও প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের নেতৃবৃন্দের এ বিষয়ে অধিকতর সতর্কতা অবলম্বন করা আবশ্যক।

ব্যঙ্গ কবিতা রচনা

আবু লাহাবের স্ত্রী উম্মে জামীল রাসূল (ছাঃ)-এর বিরুদ্ধে ব্যঙ্গ কবিতা লিখতেন। যাতে রাসূল (ছাঃ) কষ্ট পান। এর মাধ্যমে তিনি লোকদের ক্ষেপিয়ে তুলতেন। সূরা লাহাব নাযিল হ’লে রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে তিনি হাতে প্রস্তরখন্ড নিয়ে রাসূল (ছাঃ)-কে মারার উদ্দেশ্যে কা‘বা চত্বরে গমন করেন এবং নিম্নোক্ত কবিতা পাঠ করেন।-

مُذَمَّمًا عَصَيْنَا + وَأَمْرَهُ أَبَيْنَا + وَدِيْنَهُ قَلَيْنَا

‘নিন্দিতের আমরা অবাধ্যতা করি’। ‘তার নির্দেশ আমরা অমান্য করি’। ‘তার দ্বীনকে আমরা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করি’।[১] উক্ত কবিতায় তিনি ‘মুহাম্মাদ’ (প্রশংসিত) নামকে বিকৃত করে ‘মুযাম্মাম’ (নিন্দিত) বলেন। কুরায়েশরাও রাসূল (ছাঃ)-কে গালি দিয়ে ‘মুযাম্মাম’ (নিন্দিত) বলত। জবাবে রাসূল (ছাঃ) কত সুন্দরই না বলতেন, أَلاَ تَعْجَبُوْنَ كَيْفَ يَصْرِفُ اللهُ عَنِّى شَتْمَ قُرَيْشٍ وَلَعْنَهُمْ يَشْتِمُوْنَ مُذَمَّمًا وَيَلْعَنُوْنَ مُذَمَّمًا وَأَنَا مُحَمَّدٌ ‘তোমরা কি বিস্মিত হও না কিভাবে আল্লাহ আমার থেকে কুরাইশদের গালি ও লা‘নতকে ফিরিয়ে দিয়েছেন? তারা আমাকে ‘মুযাম্মাম’ (مُذَمَّمٌ) ‘নিন্দিত’ বলে গালি দিয়েছে ও লা‘নত করেছে, অথচ আমি হ’লাম ‘মুহাম্মাদ’ (مُحَمَّدٌ) ‘প্রশংসিত’।[২] যুগে যুগে সংস্কারপন্থী আলেম ও সংগঠনের বিরুদ্ধে কটূক্তিকারীদের জন্য এটাই হবে সর্বোত্তম জওয়াব।

[১]. ইবনু হিশাম ১/৩৫৬; হাকেম হা/৩৩৭৬, ২/৩৬১ সনদ ছহীহ; আলবানী, ছহীহ সীরাহ নববিইয়াহ ১৩৭ পৃঃ; তাফসীর কুরতুবী, ইবনু কাছীর; সীরাহ ছহীহাহ ১/১৪৭।
[২]. ইবনু হিশাম ১/৩৫৬; বুখারী হা/৩৫৩৩; মিশকাত হা/৫৭৭৮।

অতীতে সংঘটিত বিভিন্ন কাহিনী সম্পর্কে প্রশ্ন করা

আছহাবে কাহফ ও যুল-ক্বারনায়েন

তাঁকে ভন্ডনবী প্রমাণের জন্য কুরায়েশ নেতারা ইহূদীদের পরামর্শ মতে বিভিন্ন অতীত কাহিনী সম্পর্কে প্রশ্ন করেছিল। যেমন- (১) আছহাবে কাহফের সেই যুবকদের ঘটনা, যারা প্রাচীনকালে শহর ছেড়ে চলে গিয়েছিল এবং ৩০৯ বছর ঘুমিয়ে থেকে আবার জেগে উঠেছিল। (২) যুল-ক্বারনায়েন-এর ঘটনা, যিনি পৃথিবীর পূর্ব ও পশ্চিমে সফর করেছিলেন। (৩) রূহ কি?

উক্ত প্রেক্ষিতে সূরা কাহফ নাযিল হয়। তবে এ বিষয়ে ইবনু ইসহাক থেকে যে বর্ণনা এসেছে, তা যঈফ। সেখানে বলা হয়েছে যে, রাসূল (ছাঃ) নেতাদেরকে পরদিন জবাব দিবেন বলে ওয়াদা করেন। কিন্তু ‘ইনশাআল্লাহ’ বলেন নি। ফলে ১৫ দিন যাবৎ অহী নাযিল বন্ধ থাকে। পরে জিব্রীল এসে তাঁকে এজন্য তিরষ্কার করেন এবং সূরা কাহফ নাযিল করেন। কথাগুলির মধ্যে যেমন অযৌক্তিকতা রয়েছে, সনদেও রয়েছে তেমনি চরম দুর্বলতা।[১]

রূহ সম্পর্কে প্রশ্ন

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, একবার কুরায়েশ নেতারা ইহূদী পন্ডিতদের বলল, তোমরা আমাদের এমন কিছু শিখিয়ে দাও, যেটা আমরা এই ব্যক্তিকে প্রশ্ন করব (এবং সে জবাব দিতে পারবে না)। তখন তারা বলল, তোমরা তাকে ‘রূহ’ সম্পর্কে জিজ্ঞেস কর। সেমতে তারা জিজ্ঞেস করল। তখন আল্লাহ তা‘আলা নাযিল করেন,وَيَسْأَلُونَكَ عَنِ الرُّوحِ قُلِ الرُّوحُ مِنْ أَمْرِ رَبِّي وَمَا أُوتِيتُمْ مِنَ الْعِلْمِ إِلاَّ قَلِيلاً ‘আর ওরা তোমাকে প্রশ্ন করছে ‘রূহ’ সম্পর্কে। তুমি বলে দাও, রূহ আমার প্রতিপালকের একটি আদেশ মাত্র। আর এ বিষয়ে তোমাদের প্রতি সামান্যই জ্ঞান দেওয়া হয়েছে (ইসরা ১৭/৮৫)।[২] ‘রূহ’ সম্পর্কিত প্রশ্নটি পুনরায় মদীনায় ইহূদীরা করলে সেখানে একই জবাব দেওয়া হয়, যা মক্কায় সূরা বনু ইস্রাঈল ৮৫ আয়াত নাযিলের মাধ্যমে দেওয়া হয়েছিল।[৩]

[১]. ইবনু জারীর, কুরতুবী, ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা কাহফ ৫ আয়াত; ত্বাবারী হা/২২৮৬১, ১৫/১২৭-২৮; বায়হাক্বী দালায়েলুন নবুঅত ২/২৭০; ইবনু হিশাম ১/৩০৮; সনদ যঈফ।
[২]. তিরমিযী হা/৩১৪০, আহমাদ হা/২৩০৯, সনদ ছহীহ।
[৩]. বুখারী, ফাৎহুল বারী হা/৪৭২১-এর আলোচনা; মুসলিম হা/২৭৯৪; তিরমিযী হা/৩১৪০।

ইহূদী পন্ডিতদের মাধ্যমে সরাসরি নবীকে পরীক্ষা করা

মদীনার কপট ইহূদী পন্ডিতরা মক্কায় এসে রাসূল (ছাঃ)-কে প্রশ্ন করল, বলুন তো শামে বসবাসকারী কোন নবীর ছেলেকে মিসরে বহিষ্কার করা হয় এবং তিনি সেই শোকে কেঁদে অন্ধ হয়ে যান? ইহূদীরা এঘটনা জানত তাওরাতের মাধ্যমে যা ছিল হিব্রু ভাষায়। মক্কার লোকেরা হিব্রু জানত না। এমনকি তারা আরবীতেও লেখাপড়া জানত না। তারা ইউসুফ নবী সম্পর্কে কিছুই জানত না। এ প্রশ্ন ছিল রাসূল (ছাঃ)-এর জন্য একটি কঠিন পরীক্ষা। ফলে ইউসুফের কাহিনী পূরাটাই একত্রে একটি সূরায় নাযিল হয়। যা অন্য নবীদের বেলায় হয়নি (তাফসীর ইবনু জারীর হা/১৮৭৮৬; কুরতুবী প্রভৃতি)।

চাঁদ দ্বিখন্ডিত করণের প্রস্তাব

সবকিছুতে ব্যর্থ হয়ে সবশেষে ইহূদী পন্ডিতেরা কুরায়েশ নেতাদের একটা বিস্ময়কর কৌশল শিখিয়ে দিল। তারা বলল, মুহাম্মাদ জাদুকর কি-না, যাচাইয়ের একটা প্রকৃষ্ট পন্থা এই যে, জাদুর প্রভাব কেবল যমীনেই সীমাবদ্ধ থাকে। আসমানে এর কোন প্রতিক্রিয়া হয় না। অতএব তোমরা মুহাম্মাদকে বল, সে চাঁদকে দ্বিখন্ডিত করুক। সম্ভবতঃ হযরত মূসা (আঃ) কর্তৃক লাঠির সাহায্যে নদী বিভক্ত হওয়ার মু‘জেযা থেকেই চন্দ্র দ্বিখন্ডিত করার চিন্তাটি ইহূদীদের মাথায় এসে থাকবে। অথচ নদী বিভক্ত করার চাইতে চন্দ্র দ্বিখন্ডিত করা কতই না কঠিন বিষয়। কেননা এটি দুনিয়ার এবং অন্যটি আকাশের। কুরায়েশ নেতারা মহা খুশীতে বাগবাগ হয়ে গেল এই ভেবে যে, এবার নির্ঘাত মুহাম্মাদ কুপোকাৎ হবে। তারা দল বেঁধে রাসূল (ছাঃ)-এর কাছে গিয়ে এক চন্দ্রোজ্জ্বল রাত্রিতে উক্ত প্রশ্ন করল। ঐ সময় সেখানে হযরত আলী, আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ, জুবায়ের ইবনু মুত্ব‘ইম প্রমুখ ছাহাবীগণ উপস্থিত ছিলেন। এতদ্ব্যতীত বহু ছাহাবী উক্ত বিষয়ে হাদীছ বর্ণনা করেছেন। যে কারণে হাফেয ইবনু কাছীর এতদসংক্রান্ত হাদীছসমূহকে ‘মুতাওয়াতির’ পর্যায়ভুক্ত বলেছেন (ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা ক্বামার)।

কুরায়েশ নেতাদের দাবী মোতাবেক আল্লাহর হুকুমে রাসূল (ছাঃ)-এর উক্ত মু‘জেযা প্রদর্শিত হ’ল। মুহূর্তের মধ্যে চাঁদ দ্বিখন্ডিত হয়ে পূর্ব ও পশ্চিমে ছিটকে পড়ল। উভয় টুকরার মাঝখানে ‘হেরা’ পর্বত আড়াল হয়ে গেল। অতঃপর পুনরায় দুই টুকরা এসে যুক্ত হ’ল। এ সময় আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) মিনা-তে ছিলেন। ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ) কর্তৃক ছহীহায়নের বর্ণনায় এসেছে যে, এরপর রাসূল (ছাঃ) উপস্থিত নেতাদের বললেন, إشْهَدُوْا ‘তোমরা সাক্ষী থাক’।[১] ইবনু মাস‘ঊদ ও ইবনু ওমর (রাঃ) কর্তৃক ছহীহ মুসলিম-এর বর্ণনায় এসেছে যে, ঐসময় আল্লাহকে সাক্ষী রেখে রাসূল (ছাঃ) বলেন,اللَّهُمَّ اشْهَدْ ‘হে আল্লাহ! তুমি সাক্ষী থাক’।[২] এতে অনুমিত হয় যে, ইবনু মাসঊদ (রাঃ)-এর সাথে ঐ সময় ইবনু ওমর (রাঃ) হাযির ছিলেন এবং উভয়ে উক্ত ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন। এ সময় তাঁর বয়স ছিল ১৩ বছরের মত। ঘটনাটি ৯ম নববী বর্ষে ঘটে।[৩] উক্ত ঘটনার প্রেক্ষিতে সূরা ক্বামার নাযিল হয়। যার শুরু হ’লاقْتَرَبَتِ السَّاعَةُ وَانْشَقَّ الْقَمَرُ ‘ক্বিয়ামত আসন্ন। চন্দ্র বিদীর্ণ হয়েছে’ (ক্বামার ৫৪/১)।

এত বড় ঘটনা চাক্ষুষ দেখা সত্ত্বেও কুরায়েশ নেতারা ঈমান আনলেন না। পরে বিভিন্ন এলাকা হ’তে আগত লোকদের কাছেও তারা একই ঘটনা শোনেন। ইবনু মাসঊদ বলেন, তারা বললেন, এটা আবু কাবশার পুত্রের (মুহাম্মাদের) জাদু। সে তোমাদের জাদু করেছে। অতএব তোমরা বহিরাগত লোকদের জিজ্ঞেস কর। কেননা মুহাম্মাদ একসঙ্গে সবাইকে জাদু করতে পারবে না। অতএব বহিরাগতরা বললে সেটাই ঠিক। নইলে এটা স্রেফ জাদু মাত্র। অতঃপর চারদিক থেকে আসা মুসাফিরদের জিজ্ঞেস করলেন। তারা সবাই এ দৃশ্য দেখেছেন বলে সাক্ষ্য দেন’।[৪] কিন্তু যিদ ও অহংকার তাদেরকে ঈমান আনা হ’তে বিরত রাখলো। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন,وَإِن يَّرَوْا آيَةً يُعْرِضُوا وَيَقُولُوا سِحْرٌ مُّسْتَمِرٌّ، وَكَذَّبُوا وَاتَّبَعُوا أَهْوَاءَهُمْ وَكُلُّ أَمْرٍ مُّسْتَقِرٌّ ‘তারা যদি কোন নিদর্শন (যেমন চন্দ্র দ্বিখন্ডিত করণ) দেখে, তবে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং বলে যে, এটা তো চলমান জাদু’। ‘তারা মিথ্যারোপ করে এবং নিজেদের খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করে। অথচ প্রত্যেক কাজের ফলাফল (ক্বিয়ামতের দিন) স্থিরীকৃত হবে (ক্বামার ৫৪/২-৩)।

তারীখে ফিরিশতায় বর্ণিত হয়েছে যে, চন্দ্র দ্বিখন্ডিত হওয়ার এই দৃশ্য ভারতের মালাবারের জনৈক মহারাজা স্বচক্ষে দেখেন এবং তা নিজের রোজনামচায় লিপিবদ্ধ করেন। পরে আরব বণিকদের মুখে ঘটনা শুনে তখনকার রাজা ‘সামেরী’ উক্ত রোজনামচা বের করেন। অতঃপর তাতে ঘটনার সত্যতা দেখে তিনি মুসলমান হয়ে যান। যদিও সামরিক নেতা ও সমাজনেতাদের ভয়ে তিনি ইসলাম গোপন রাখেন’।[৫] ১৯৬৯ সালের ২০শে জুলাই চন্দ্রে প্রথম পদাপর্ণকারী দলের নেতা নেইল আর্মষ্ট্রং স্বচক্ষে চন্দ্রপৃষ্ঠের বিভক্তি রেখা দেখে বিস্ময়াভিভূত হন এবং ইসলাম কবুল করেন। কিন্তু মার্কিন প্রশাসনের ভয়ে তিনি একথা কয়েক বছর পরে প্রকাশ করেন।[6]

চন্দ্র দ্বিখন্ডিত করা ছাড়াও রাসূল (ছাঃ)-এর জীবনে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মু‘জেযা প্রদর্শিত হয়েছে। কিন্তু এগুলি ছিল কেবল হঠকারীদের অহংকার চূর্ণ করার জন্য। এর দ্বারা তারা কখনোই হেদায়াত লাভ করেনি। যদিও এর ফলে দ্বীনদারগণের ঈমান বৃদ্ধি পেয়েছে।

[১]. বুখারী হা/৩৮৬৮; মুসলিম হা/২৮০০ (৪৩-৪৪); মিশকাত হা/৫৮৫৪-৫৫।
[২]. মুসলিম হা/২৮০০ (৪৫) ‘মুনাফিকদের বৈশিষ্ট্যাবলী’ অধ্যায়, ‘চন্দ্র দ্বিখন্ডিত করণ’ অনুচ্ছেদ।
[৩]. মানছূরপুরী, রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ৩/১৫৫ পৃঃ।
[৪]. তাফসীর ইবনু জারীর হা/৩২৬৯৯ প্রভৃতি; সনদ ছহীহ; কুরতুবী হা/৫৭৩৭।
[৫]. মুহাম্মাদ ক্বাসেম হিন্দুশাহ ফিরিশতা, তারীখে ফিরিশতা (ফার্সী হ’তে উর্দূ অনুবাদ : লাক্ষ্ণৌ ছাপা, ১৩২৩/১৯০৫) ১১শ অধ্যায় ‘মালাবারের শাসকদের ইতিহাস’ ২/৪৮৮-৮৯ পৃঃ।
[৬]. লেখক নিজে উক্ত চন্দ্র বিজয়ী দলের ঢাকা সফরকালে নিকট থেকে তাদের স্বচক্ষে দেখেছেন এবং অনেক পরে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় উক্ত খবরটি পড়েছেন। -লেখক।

আপোষমুখী প্রস্তাব সমূহ পেশ

বুদ্ধিবৃত্তিক ও অলৌকিক সকল পন্থায় পরাজিত হয়ে কুরায়েশ নেতারা এবার আপোষমুখী পদ্ধতি গ্রহণ করল। ‘কিছু গ্রহণ ও কিছু বর্জন’-এর নীতিতে তারা রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে আপোষ করতে চাইল। কুরআনের ভাষায়وَدُّوْا لَوْ تُدْهِنُ فَيُدْهِنُوْنَ ‘তারা চায় যদি তুমি কিছুটা শিথিল হও, তাহ’লে তারাও নমনীয়তা দেখাবে’ (ক্বলম ৬৮/৯)। এ বিষয়ে তাদের প্রস্তাবগুলি ছিল নিম্নরূপ :

(ক) একদিন রাসূল (ছাঃ) কা‘বায় তাওয়াফ করছিলেন। এমতাবস্থায় আসওয়াদ বিন আবদুল মুত্ত্বালিব, অলীদ বিন মুগীরাহ, উমাইয়া বিন খালাফ, ‘আছ বিন ওয়ায়েল প্রমুখ মক্কার বিশিষ্ট নেতৃবর্গ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকটে এসে আপোষ প্রস্তাব দিয়ে বলেন,

يَا مُحَمَّدُ، هَلُمَّ فَلْنَعْبُدْ مَا تَعْبُدُ، وَتَعْبُدُ مَا نَعْبُدُ، فَنَشْتَرِكُ نَحْنُ وَأَنْتَ فِي الْأَمْرِ، فَإِنْ كَانَ الَّذِي تَعْبُدُ خَيْرًا مِمَّا نَعْبُدُ، كُنَّا قَدْ أَخَذْنَا بِحَظِّنَا مِنْهُ، وَإِنْ كَانَ مَا نَعْبُدُ خَيْرًا مِمَّا تَعْبُدُ، كُنْتَ قَدْ أَخَذْتَ بِحَظِّكَ مِنْهُ

‘হে মুহাম্মাদ! এসো আমরা ইবাদত করি তুমি যার ইবাদত কর এবং তুমি পূজা কর আমরা যার পূজা করি। আমরা এবং তুমি আমাদের কাজে পরস্পরে শরীক হই। অতঃপর তুমি যার ইবাদত কর, তিনি যদি উত্তম হন আমরা যাদের পূজা করি তাদের চাইতে, তাহলে আমরা তার ইবাদতে পুরাপুরি অংশ নিব। আর আমরা যাদের পূজা করি, তারা যদি উত্তম হয় তুমি যার ইবাদত কর তাঁর চাইতে, তাহলে তুমি তাদের পূজায় পুরাপুরি অংশ নিবে’ (ইবনু হিশাম১/৩৬২)।[১] ইবনু জারীর-এর বর্ণনায় এসেছে,ونُشركُكَ في أَمرِنا كُلِّهِ، فإن كان الذي جِئتَ به خيرًا مما بأيدينا، كنا قد شَرِكناكَ فيه ‘আমরা তোমাকে আমাদের সকল কাজে শরীক করব। অতঃপর তুমি যে দ্বীন নিয়ে এসেছ, তা যদি আমাদের দ্বীনের চাইতে উত্তম হয়, তাহলে আমরা সবাই তোমার সাথে তাতে শরীক হব। আর যদি আমাদেরটা উত্তম হয়, তাহলে তুমি আমাদের কাজে শরীক হবে এবং তাতে পুরোপুরি অংশগ্রহণ করবে’। তখন অত্র সূরা নাযিল হয়।

(খ) যদি তুমি আমাদের কোন একটি মূর্তিকে চুমু দাও, তাহলে আমরা তোমাকে সত্য বলে মেনে নিব। (গ) তারা একথাও বলেছিল যে, তুমি চাইলে আমরা তোমাকে এত মাল দেব যে, তুমি সেরা ধনী হবে। তুমি যাকে চাও, তার সাথে তোমাকে বিয়ে দেব। আর আমরা সবাই তোমার অনুসারী হব। কেবল তুমি আমাদের দেব-দেবীদের গালি দেওয়া বন্ধ কর। যদি তাতেও তুমি রাযী না হও, তাহ’লে একটি প্রস্তাবে তুমি রাযী হও, যাতে আমাদের ও তোমার মঙ্গল রয়েছে। আর তা হ’ল, (ঘ) তুমি আমাদের উপাস্য লাত-উযযার এক বছর পূজা কর এবং আমরা তোমার উপাস্যের এক বছর পূজা করব। এইভাবে এক বছর এক বছর করে সর্বদা চলবে’। তখন সূরা কাফেরূন নাযিল হয় (কুরতুবী) এবং তাদের সাথে চূড়ান্ত বিচ্ছেদ ঘোষণা করা হয়।[২]

সূরা কাফেরূন নাযিলের কারণ হিসাবে বর্ণিত উপরোক্ত বিষয়গুলির সূত্র যথার্থভাবে ছহীহ নয়। তবে এগুলির প্রসিদ্ধি অতি ব্যাপক। যা ইবনু জারীর, কুরতুবী, ইবনু কাছীরসহ প্রায় সকল প্রসিদ্ধ তাফসীর গ্রন্থে এসেছে। অতএব সূত্র দুর্বল হ’লেই ঘটনা সঠিক নয়, তা বলা যাবে না। কেননা সূরা কাফেরূনের বক্তব্যেই ঘটনার যথার্থতা প্রতীয়মান হয়।

[১]. ইবনু জারীর, কুরতুবী; ইবনু হিশাম ১/৩৬২ ‘সূরা কাফেরূন নাযিলের কারণ’ অনুচ্ছেদ; আলবানী, ছহীহুস সীরাহ ২০১-২০২ পৃঃ ।
[২]. আর-রাহীক্ব পৃঃ ৮৪-৮৫; তাফসীর ইবনু জারীর, কুরতুবী, ইবনু কাছীর প্রভৃতি; ইবনু হিশাম ১/৩৬২। বর্ণনাটির সনদ ‘মুরসাল’ (তাহকীক ইবনু হিশাম ক্রমিক ৩৫৪); মা শা-‘আ ৫১ পৃঃ।

লোভনীয় প্রস্তাবসমূহ পেশ

অতঃপর তারা সাধারণ মুসলমানদের ফিরিয়ে আনার জন্য লোভনীয় প্রস্তাব সমূহ পেশ করল। সেরা ধনী অলীদ বিন মুগীরাহ্র নেতৃত্বে তারা নির্যাতিত-নিপীড়িত নওমুসলিমদের বলতে লাগলো যে, তোমরা পিতৃধর্মে ফিরে এলে তোমাদের জীবনে সচ্ছলতা ও সুখ-সাচ্ছন্দ্য ফিরিয়ে দেওয়া হবে। এমনকি পরকালে তোমাদের পাপের বোঝা আমরাই বহন করব। যেমন আল্লাহ বলেন,

وَقَالَ الَّذِيْنَ كَفَرُوا لِلَّذِيْنَ آمَنُوا اتَّبِعُوْا سَبِيْلَنَا وَلْنَحْمِلْ خَطَايَاكُمْ وَمَا هُمْ بِحَامِلِيْنَ مِنْ خَطَايَاهُمْ مِنْ شَيْءٍ إِنَّهُمْ لَكَاذِبُوْنَ- وَلَيَحْمِلُنَّ أَثْقَالَهُمْ وَأَثْقَالاً مَعَ أَثْقَالِهِمْ وَلَيُسْأَلُنَّ يَوْمَ الْقِيَامَةِ عَمَّا كَانُوا يَفْتَرُونَ- (العنكبوت ১২-১৩)-

‘কাফিররা মুমিনদের বলে, তোমরা আমাদের পথ অনুসরণ কর, আমরা তোমাদের পাপভার বহন করব। অথচ তারা তাদের পাপভার কিছুই বহন করবে না। নিশ্চয়ই তারা মিথ্যাবাদী’। ‘তারা নিজেদের পাপের বোঝা বহন করবে এবং তাদের বোঝার সাথে অন্যদের বোঝা সমূহ। আর তারা যেসব মিথ্যা উদ্ভাবন করে, সেবিষয়ে তাদেরকে ক্বিয়ামতের দিন অবশ্যই প্রশ্ন করা হবে’ (আনকাবূত ২৯/১২-১৩; তাফসীর ইবনু কাছীর)। বস্ত্ততঃ কুফর ও নিফাকের অনুসারী বাতিলপন্থীরা সর্বযুগে উক্ত কপট নীতি অনুসরণ করে থাকে।

উদ্ভট দাবী সমূহ পেশ

যেমন (ক) উৎবা, শায়বাহ, আবু সুফিয়ান, নযর বিন হারেছ, আবুল বাখতারী, আসওয়াদ বিন মুত্ত্বালিব, অলীদ বিন মুগীরাহ, আবু জাহল, উমাইয়া বিন খালাফ, আব্দুল্লাহ ইবনু আবী উমাইয়া সহ ১৪জন কুরায়েশ নেতা রাসূল (ছাঃ)-কে মাগরিবের পর কা‘বা চত্বরে ডাকিয়ে এনে বললেন, হে মুহাম্মাদ! তুমি তোমার বংশের উপরে যে বিপদ ডেকে এনেছ, সমগ্র আরবে কেউ তা আনেনি।لَقَدْ شَتَمْتَ الْآبَاءَ، وَعِبْتَ الدِّينَ، وَشَتَمْتَ الْآلِهَةَ، وَسَفَّهْتَ الْأَحْلاَمَ، وَفَرَّقْتَ الْجَمَاعَةَ ‘তুমি তোমার বাপ-দাদাকে গালি দিয়েছ, তাদের দ্বীনকে দোষারোপ করেছ, উপাস্যদের গালি দিয়েছ, জ্ঞানীদের বোকা ধারণা করেছ এবং আমাদের জামা‘আতকে বিভক্ত করেছ’। এক্ষণে যদি তুমি এগুলো পরিত্যাগের বিনিময়ে মাল চাও, মর্যাদা চাও, নেতৃত্ব চাও, শাসন ক্ষমতা চাও, তোমার জিন ছাড়ানোর চিকিৎসক চাও, সবই তোমাকে দিব। জবাবে রাসূল (ছাঃ) বললেন, আল্লাহ আমাকে আপনাদের নিকট রাসূল হিসাবে পাঠিয়েছেন। আমি আপনাদের নিকট রিসালাত পৌঁছে দিয়েছি। যদি আপনারা সেটা কবুল করেন, তাহ’লে দুনিয়া ও আখেরাতে আপনাদের কল্যাণ হবে। আর যদি অস্বীকার করেন, তাহ’লে আমি আল্লাহর আদেশের অপেক্ষায় ধৈর্য ধারণ করব। যতক্ষণ না তিনি আমার ও আপনাদের মধ্যে ফায়ছালা করে দেন’। তখন নেতারা বললেন, তুমি যদি আমাদের কোন কথাই না শোন, তাহ’লে তোমার প্রভুকে বল যেন (১) তিনি মক্কার পাহাড়গুলি সরিয়ে এস্থানটিকে সমতল ভূমিতে পরিণত করে দেন। কেননা তুমি জান মক্কার চাইতে সংকীর্ণ শহর আর নেই। (২) তোমার প্রভু যেন এখানে নদীসমূহ প্রবাহিত করে দেন, যেমন শাম ও ইরাকে রয়েছে। (৩) আমাদের সাবেক নেতা কুছাই বিন কিলাবকে জীবিত করে এনে দাও। যার কাছে শুনব তোমাকে যে আল্লাহ রাসূল করে পাঠিয়েছেন, তা সত্য কি-না। (৪) তোমার প্রভু যেন তোমার সঙ্গে একজন ফেরেশতা পাঠান, যিনি তোমার ব্যাপারে সত্যায়ন করবেন। (৫) তুমি তাঁর নিকটে প্রার্থনা কর, যেন তোমার জন্য বাগ-বাগিচা এবং স্বর্ণ ও রৌপ্য মন্ডিত প্রাসাদ বানিয়ে দেন। (৬) আমরা তোমার উপরে ঈমান আনিনি বিধায় তোমার প্রভু যেন আমাদের উপর আকাশকে টুকরা-টুকরা করে গযব হিসাবে নামিয়ে দেন, যেমনটি তুমি ধারণা করে থাক। (৭) তাদের একজন বলল, আমরা কখনই তোমার উপরে ঈমান আনবো না, যতক্ষণ না আল্লাহ ও ফেরেশতাদেরকে আমাদের সামনে না নিয়ে আসবে। (৮) আরেকজন নেতা রাসূল (ছাঃ)-এর ফুফাতো ভাই আব্দুল্লাহ ইবনু আবী উমাইয়া বললেন, আল্লাহর কসম! আমরা কখনই তোমার উপরে ঈমান আনবো না, যতক্ষণ না তুমি আসমান থেকে সিঁড়ি নামিয়ে দিবে। অতঃপর তুমি তাতে আরোহন করবে ও আল্লাহর কাছে চলে যাবে। অতঃপর সেখান থেকে চারজন ফেরেশতাকে সাথে নিয়ে আসবে, যে তোমার বিষয়ে সাক্ষ্য দিবে যে, তুমি যা বল, তা সত্য।[১]

দাবীগুলির বর্ণনা এবং তার সনদ যঈফ হ’লেও এগুলির বর্ণনা ও এসবের জবাব কুরআনে এসেছে। এতেই বুঝা যায় যে, ঘটনা সঠিক ছিল। যেমন আল্লাহ বলেন,

وَقَالُوْا لَنْ نُؤْمِنَ لَكَ حَتَّى تَفْجُرَ لَنَا مِنَ الْأَرْضِ يَنْبُوعًا- أَوْ تَكُونَ لَكَ جَنَّةٌ مِنْ نَخِيلٍ وَعِنَبٍ فَتُفَجِّرَ الْأَنْهَارَ خِلاَلَهَا تَفْجِيرًا- أَوْ تُسْقِطَ السَّمَاءَ كَمَا زَعَمْتَ عَلَيْنَا كِسَفًا أَوْ تَأْتِيَ بِاللهِ وَالْمَلاَئِكَةِ قَبِيلاَ- أَوْ يَكُونَ لَكَ بَيْتٌ مِنْ زُخْرُفٍ أَوْ تَرْقَى فِي السَّمَاءِ وَلَنْ نُؤْمِنَ لِرُقِيِّكَ حَتَّى تُنَزِّلَ عَلَيْنَا كِتَابًا نَقْرَؤُهُ قُلْ سُبْحَانَ رَبِّي هَلْ كُنْتُ إِلاَّ بَشَرًا رَسُولاً-

‘তারা বলল, আমরা কখনোই তোমার উপর বিশ্বাস স্থাপন করব না যতক্ষণ না তুমি আমাদের জন্য ভূমি থেকে ঝর্ণাধারা প্রবাহিত করে দিবে’ (৯০)। ‘অথবা তোমার জন্য খেজুর ও আঙ্গুরের বাগিচা হবে। যার মধ্যে তুমি ব্যাপকভাবে (শাম ও ইরাকের ন্যায়) নদী-নালা প্রবাহিত করাবে’ (৯১)। ‘অথবা আকাশকে টুকরা টুকরা করে আমাদের উপরে নিক্ষেপ করবে যেমনটা তুমি ধারণা ব্যক্ত করে থাক। অথবা আল্লাহ ও ফেরেশতাদেরকে আমাদের সামনে নিয়ে আসবে’ (৯২)। ‘অথবা তোমার একটি স্বর্ণমন্ডিত প্রাসাদ হবে। অথবা তুমি আকাশে আরোহণ করবে। অবশ্য আমরা তোমার আকাশে আরোহণে বিশ্বাস করব না যতক্ষণ না তুমি সেখান থেকে (তোমার সত্যতার পক্ষে) আমাদের উপর কোন কিতাব নাযিল করাবে, যা আমরা পড়ে দেখব। তুমি বল, আমার প্রভু (এইসব থেকে) পবিত্র। আমি একজন মানুষ রাসূল ব্যতীত কিছুই নই’ (ইসরা ১৭/৯০-৯৩)। কাফেররা মানুষ রাসূল চায়নি, ফেরেশতা রাসূল চেয়েছিল। যার প্রতিবাদে এক আয়াত পরেই আল্লাহ বলেন,قُلْ لَوْ كَانَ فِي الْأَرْضِ مَلَائِكَةٌ يَمْشُونَ مُطْمَئِنِّينَ لَنَزَّلْنَا عَلَيْهِمْ مِنَ السَّمَاءِ مَلَكًا رَسُولاً ‘যদি ফেরেশতারা যমীনে স্বচ্ছন্দে পদচারণা করতে পারত, তাহ’লে আমরা তাদের জন্য ফেরেশতা রাসূল পাঠাতাম’ (ইসরা ১৭/৯৫)।

মুসলমানদের মধ্যে যারা রাসূল (ছাঃ)-কে ‘নূরের নবী’ বলেন, তারা কি কাফেরদের ‘ফেরেশতা রাসূল’ দাবীর সাথে সুর মিলাচ্ছেন না? অতএব আল্লাহ নিরাকার। তিনি সর্বত্র বিরাজমান। প্রত্যেক সৃষ্টিই আল্লাহর অংশ। রাসূল (ছাঃ) মানুষ নবী নন, তিনি নূরের নবী ইত্যাদি নষ্ট আক্বীদা থেকে প্রথমেই তওবা করা আবশ্যক।

ইবনু কাছীর বলেন, কুরায়েশ নেতারা রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে এগুলি দাবী করেছিল। যদি আল্লাহ এর মধ্যে তাদের কোন কল্যাণ আছে বলে জানতেন, তাহলে অবশ্যই তা কবুল করতেন। কিন্তু তিনি ভালভাবেই অবহিত ছিলেন যে, তারা এসব প্রশ্ন করছে স্রেফ কুফরী ও হঠকারিতা বশে। সেকারণ তিনি তা কবুল করেননি (ইবনু কাছীর, তাফসীর উক্ত আয়াত)।

ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, কুরায়েশরা রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে দাবী করল যে, আপনি আপনার প্রতিপালকের নিকটে দো‘আ করুন। যেন তিনি ছাফা পাহাড়কে আমাদের জন্য স্বর্ণ বানিয়ে দেন। তাহ’লে আমরা ঈমান আনব। রাসূল (ছাঃ) তাদের দাবী মোতাবেক দো‘আ করলেন। অতঃপর জিব্রীল (আঃ) রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে এসে তাঁর প্রতি আল্লাহ তা‘আলার সালাম পৌঁছে দিয়ে বললেন, আল্লাহ বলেছেন, ‘আপনি চাইলে আমি তাদের জন্য ছাফা পাহাড়কে স্বর্ণে রূপান্তরিত করব। কিন্তু এরপর যারা কুফরী করবে, তাদেরকে আমি এমন শাস্তির সম্মুখীন করব, যা আমি পৃথিবীর অন্য কাউকে দেইনি। আর যদি তুমি চাও তবে আমি তওবা ও রহমতের দুয়ার খুলে দিব। তখন রাসূল (ছাঃ) তওবা ও রহমতই কামনা করলেন। অতঃপর আল্লাহ নাযিল করলেন,وَمَا مَنَعَنَا أَنْ نُرْسِلَ بِالْآيَاتِ إِلاَّ أَنْ كَذَّبَ بِهَا الْأَوَّلُونَ وَآتَيْنَا ثَمُودَ النَّاقَةَ مُبْصِرَةً فَظَلَمُوا بِهَا وَمَا نُرْسِلُ بِالْآيَاتِ إِلاَّ تَخْوِيفًا ‘পূর্ববর্তী উম্মতসমূহ কর্তৃক নিদর্শন সমূহকে অস্বীকার করাই আমাদেরকে (তোমাদের প্রতি) নিদর্শন প্রেরণ করা হ’তে বিরত রেখেছে। আমরা ছামূদ কওমের নিকট স্পষ্ট নিদর্শন স্বরূপ উষ্ট্রী পাঠিয়েছিলাম। অতঃপর তারা তার প্রতি অত্যাচার করেছিল (অর্থাৎ হত্যা করেছিল)। আর আমরা কেবল ভয় প্রদর্শনের জন্যেই নিদর্শন সমূহ প্রেরণ করে থাকি’ (ইসরা ১৭/৫৯)।[২]

[১]. ইবনু জারীর, ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা বাক্বারাহ ১০৮; কুরতুবী হা/৪০৭৯, সনদ যঈফ; ইবনু হিশাম ১/২৯৫-২৯৮।
[২]. আহমাদ হা/২১৬৬; হাকেম হা/৩৩৭৯; সিলসিলা ছহীহাহ হা/৩৩৮৮।

দুনিয়াবী স্বার্থ লাভের দাবী পেশ

এক সময় তারা তিনটি দাবী নিয়ে উপস্থিত হয়।
(ক) যদি তুমি সত্যই নবী হয়ে থাক, তাহ’লে সারা পৃথিবীর ধন-ভান্ডার আমাদের কাছে এনে দাও।
(খ) আমাদের ভবিষ্যৎ ভাল-মন্দের বিষয়গুলি বলে দাও। যাতে আমরা আগে ভাগে সাবধান হতে পারি।
(গ) তুমি একজন ফেরেশতাকে নবী হিসাবে এনে দাও, আমরা তাকে নেতা রূপে মেনে নেব। কেননা তুমি তো আমাদেরই মত একজন মানুষ মাত্র। জবাবে আল্লাহ নিম্নোক্ত আয়াত নাযিল করেন,

قُل لآ أَقُولُ لَكُمْ عِنْدِيْ خَزَآئِنُ اللهِ وَلا أَعْلَمُ الْغَيْبَ وَلا أَقُولُ لَكُمْ إِنِّي مَلَكٌ إِنْ أَتَّبِعُ إِلاَّ مَا يُوحَى إِلَيَّ قُلْ هَلْ يَسْتَوِي الأَعْمَى وَالْبَصِيرُ أَفَلاَ تَتَفَكَّرُونَ- (الأنعام 50)

‘তুমি বলে দাও, আমি তোমাদের একথা বলিনা যে, আমার কাছে আল্লাহর ধন-ভান্ডার সমূহ রয়েছে। আর আমি অদৃশ্য বিষয় অবগত নই। আমি একথাও বলি না যে, আমি ফেরেশতা। আমি তো কেবল তারই অনুসরণ করি, যা আমার নিকটে ‘অহি’ করা হয়। তুমি বল, অন্ধ ও চক্ষুষ্মান কি কখনো সমান হয়? তোমরা কি চিন্তা করবে না? (আন‘আম ৬/৫০)।

বিভিন্ন অপযুক্তি প্রদর্শন

যেমন- (ক) আল্লাহ প্রেরিত রাসূল হ’লে উনি কখনো মানুষের মত খাওয়া-দাওয়া ও বাজার-ঘাট করতেন না। আল্লাহ বলেন,وَقَالُوا مَالِ هَذَا الرَّسُوْلِ يَأْكُلُ الطَّعَامَ وَيَمْشِي فِي الْأَسْوَاقِ لَوْلاَ أُنزِلَ إِلَيْهِ مَلَكٌ فَيَكُونَ مَعَهُ نَذِيراً ‘তারা বলে, এ কেমন রাসূল যে খাদ্য ভক্ষণ করে ও হাট-বাজারে চলাফেরা করে? কেন তার নিকটে ফেরেশতা নাযিল হ’ল না যে তার সাথে সর্বদা সতর্ককারী হিসাবে থাকত’ (ফুরক্বান ২৫/৭)।[১] জবাবে আল্লাহ বলেন,وَلَوْ جَعَلْنَاهُ مَلَكاً لَّجَعَلْنَاهُ رَجُلاً وَلَلَبَسْنَا عَلَيْهِم مَّا يَلْبِسُونَ ‘যদি আমরা কোন ফেরেশতাকে রাসূল করে পাঠাতাম, তবে সে মানুষের আকারেই হ’ত এবং তাকে ঐ ধরনের পোষাক পরাতাম, যা তারা পরিধান করে’ (আন‘আম ৬/৯)। তিনি বলেন,اُنْظُرْ كَيْفَ ضَرَبُوْا لَكَ الْأَمْثَالَ فَضَلُّوْا فَلاَ يَسْتَطِيْعُوْنَ سَبِيْلاً ‘দেখ ওরা কিভাবে তোমার নামে (বাজে) উপমা সমূহ প্রদান করছে। ওরা পথভ্রষ্ট হয়েছে। অতএব ওরা আর পথ পেতে সক্ষম হবে না’ (ইসরা/বনু ইস্রাঈল ১৭/৪৮; ফুরক্বান ২৫/৯)।

(খ) তারা বলল, যদি নিতান্তই কোন মানুষকে নবী করার ইচ্ছা ছিল, তাহ’লে মক্কা ও ত্বায়েফের বিত্তবান প্রভাবশালী কোন নেতাকে কেন নবী করা হ’ল না? যেমন আল্লাহ বলেন,وَقَالُوْا لَوْلاَ نُزِّلَ هَذَا الْقُرْآنُ عَلَى رَجُلٍ مِّنَ الْقَرْيَتَيْنِ عَظِيْمٍ ‘তারা বলে, কুরআন কেন দুই জনপদের কোন প্রধান ব্যক্তির উপরে অবতীর্ণ হ’ল না? (যুখরুফ ৪৩/৩১)। জবাবে আল্লাহ বলেন,أَهُمْ يَقْسِمُوْنَ رَحْمَةَ رَبِّكَ ‘তারা কি তোমার প্রতিপালকের অনুগ্রহ বণ্টন করবে? (যুখরুফ ৪৩/৩২)। অর্থাৎ আল্লাহ কাকে অনুগ্রহ করে নবুঅত দান করবেন এটা কেবল তাঁরই এখতিয়ার। এতে অন্যদের কিছুই করার নেই।

(গ) কোন যুক্তিতে কাজ না হওয়ায় অবশেষে তারা অজুহাত দিল, যদি আল্লাহ চাইতেন, তাহ’লে আমরা শিরক করতাম না। যেমন আল্লাহ বলেন,

سَيَقُوْلُ الَّذِيْنَ أَشْرَكُواْ لَوْ شَآء اللهُ مَا أَشْرَكْنَا وَلاَ آبَاؤُنَا وَلاَ حَرَّمْنَا مِن شَيْءٍ كَذَلِكَ كَذَّبَ الَّذِينَ مِن قَبْلِهِم حَتَّى ذَاقُوا بَأْسَنَا قُلْ هَلْ عِندَكُم مِّنْ عِلْمٍ فَتُخْرِجُوهُ لَنَا إِن تَتَّبِعُونَ إِلاَّ الظَّنَّ وَإِنْ أَنتُمْ إَلاَّ تَخْرُصُوْنَ- (الأنعام ১৪৮)-

‘সত্বর মুশরিকরা বলবে, যদি আল্লাহ ইচ্ছা করতেন তাহ’লে না আমরা শিরক করতাম, না আমাদের বাপ-দাদারা। আর না আমরা কোন বস্ত্তকে হারাম করতাম। বস্ত্ততঃ এভাবেই তাদের পূর্ব যুগের কাফিররা (রাসূলদের) মিথ্যা সাব্যস্ত করেছিল। অবশেষে তারা আমাদের শাস্তির স্বাদ আস্বাদন করেছিল। তুমি বল, তোমাদের কাছে কি কোন প্রমাণ আছে, যা আমাদের দেখাতে পার? তোমরা কেবল ধারণার অনুসরণ কর এবং কেবল অনুমান ভিত্তিক কথা বলে থাক’ (আন‘আম ৬/১৪৮)। বস্ত্ততঃ এ আয়াতটিই হ’ল অদৃষ্টবাদী ভ্রান্ত ফের্কা জাবরিয়াদের প্রধান দলীল। অথচ বান্দা শিরক ও কুফরীতে লিপ্ত হউক, এটা কখনোই আল্লাহ চান না। যেমন তিনি বলেন,وَلاَ يَرْضَى لِعَبِادِهِ الْكُفْرَ ‘তিনি তার বান্দাদের কুফরীতে সন্তুষ্ট হন না’ (যুমার ৩৯/৭)।

[১]. কাফের নেতাদের ধন্যবাদ দিতে হয় যে, তাদের মাথায় রাসূল (ছাঃ)-কে ‘নূর’ বলার যুক্তিটির উদয় হয়নি। কেননা ‘নূর’ হ’লে তার খাওয়া-পরা ও বাজার-ঘাট কিছুই লাগে না। যেমন একদল পীর ও মুফতী তাঁকে ‘নূর’ বানিয়েছেন এবং ‘তিনি মরেননি’ বলে প্রচার করেন। সেই সাথে ‘আওলিয়ারা মরেন না’ বলে চুটিয়ে কবরপূজার ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। এভাবে স্বাধীন মানুষকে তারা মৃত মানুষের গোলামে পরিণত করেছেন। আর ভক্তদের পকেট ছাফ করছেন।

শিক্ষণীয় বিষয়সমূহ
(১) স্বার্থান্ধ ব্যক্তি ও সমাজনেতারা সত্যকে চিনতে পেরেও তাকে মেনে নিতে পারে না।
(২) সত্যকে গলা টিপে হত্যা করার জন্য হেন অপকৌশল নেই, যা তারা অবলম্বন করে না।

 রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর উপর নানামুখী অত্যাচার - ১. ঠাট্টা-বিদ্রুপ করা (الاسةهزاء والسخرية)
সমস্ত যুক্তি, কৌশল ও আপোষ প্রস্তাব ব্যর্থ হওয়ার পর কুরায়েশ নেতারা এবার রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর উপরে সরাসরি অত্যাচারের সিদ্ধান্ত নিল। যেমন-

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর দিক থেকে লোকদের ফিরিয়ে আনার জন্য কুরায়েশ নেতারা বিদ্রুপ করে বলে, আমরাও এরূপ বলতে পারি। এ বিষয়ে আল্লাহ বলেন,وَإِذَا تُتْلَى عَلَيْهِمْ آيَاتُنَا قَالُوْا قَدْ سَمِعْنَا لَوْ نَشَاءُ لَقُلْنَا مِثْلَ هَـذَا إِنْ هَـذَا إِلاَّ أَسَاطِيْرُ الْأَوَّلِيْنَ ‘যখন তাদের নিকটে আমাদের আয়াত সমূহ পাঠ করা হয়, তখন তারা বলে, আমরা শুনেছি। ইচ্ছা করলে আমরাও এরূপ বলতে পারি। এসব তো পূর্ববর্তীদের উপকথা ভিন্ন কিছুই নয়’ (আনফাল ৮/৩১)।

উক্ত আয়াতে কাফেররা ‘কুরআনকে পুরাকালের কাহিনী এবং ইচ্ছা করলে আমরাও এরূপ বলতে পারি’ বলে দম্ভ প্রকাশ করেছে। অথচ অনুরূপ একটি কুরআন বা তার মত দু’একটি সূরা বা আয়াত জিন-ইনসান সকলকে একত্রিত হয়ে রচনা করে আনার জন্য মক্কায় পাঁচবার এবং মদীনায় একবার (বাক্বারাহ ২/২৩-২৪) সহ মোট ছয়বার কাফেরদের চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। কিন্তু সে যুগে ও এ যুগে কেউ সে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেনি। বরং দেখা গেছে যে, সে যুগে ঐসব নেতারাই গোপনে রাতের অন্ধকারে বাইরে দাঁড়িয়ে তাহাজ্জুদের ছালাতে রাসূল (ছাঃ)-এর কুরআন তেলাওয়াত শুনত। আবু সুফিয়ান, নযর বিন হারেছ, আখনাস বিন শারীক্ব, আবু জাহল প্রমুখ নেতারা একে অপরকে না জানিয়ে গোপনে একাজ করত’ (ইবনু হিশাম ১/৩১৫-১৬)। কিন্তু যখন তারা তাদের জনগণের সামনে যেত, তখন তাদের মন্তব্য পাল্টে যেত। কারণ তখন দুনিয়াবী স্বার্থ তাদেরকে সত্যভাষণ থেকে ফিরিয়ে রাখত। একই অবস্থা আজকালকের মুসলিম-অমুসলিম নেতাদের। যাদের অধিকাংশ রাসূল (ছাঃ) ও কুরআনের সত্যতাকে স্বীকার করে। কিন্তু বাস্তবে তা মানতে রাযী হয় না স্রেফ দুনিয়াবী স্বার্থের কারণে।

এভাবে কাফেররা তাঁকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগ পর্যন্ত নানারূপ মানসিক কষ্ট দেয়। এ সময় আল্লাহ তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন,وَاصْبِرْ عَلَى مَا يَقُوْلُوْنَ وَاهْجُرْهُمْ هَجْرًا جَمِيْلاً ‘তারা যেসব কথা বলে, তাতে তুমি ছবর কর এবং তাদেরকে সুন্দরভাবে পরিহার করে চল’ (মুযযাম্মিল ৭৩/১০)। তিনি আরও বলেন,إِنَّا كَفَيْنَاكَ الْمُسْتَهْزِئِيْنَ ‘বিদ্রূপকারীদের বিরুদ্ধে আমরাই তোমার জন্য যথেষ্ট’ (হিজর ১৫/৯৫)।



*****************************
সাইটটি ভিজিট করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আর্টিকেলটি ভাল লাগলে সত্য ও ন্যয়ের পথে অন্য ভাইনদেরকে দাওয়াতের নিয়তে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন। মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে এবং দীন ও মানবতার সেবায় অংশ নিতে OUR ACTION PLAN বাটনে ক্লিক করুন।


এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url