প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর জীবনী [পর্ব-০৭]




কুরআন নাজিল ও নবুঅত লাভ


ধ্যানমগ্ন মুহাম্মাদের কাছে জীব্রাইল এলেন

২১শে রামাযান সোমবার ক্বদরের রাত্রি।[১] ফেরেশতা জিবরীলের আগমন হ’ল। ধ্যানমগ্ন মুহাম্মাদকে বললেন, إِقْرَأْ ‘পড়’। বললেন,مَا أَنَا بِقَارِئٍ ‘আমি পড়তে জানিনা’। অতঃপর তাকে বুকে চেপে ধরলেন ও বললেন, পড়। কিন্তু একই জবাব, ‘পড়তে জানিনা’। এভাবে তৃতীয়বারের চাপ শেষে তিনি পড়তে শুরু করলেন,
إِقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِيْ خَلَقَ- خَلَقَ الْإِنْسَانَ مِنْ عَلَقٍ- إِقْرَأْ وَرَبُّكَ الْأَكْرَمُ- الَّذِي عَلَّمَ بِالْقَلَمِ- عَلَّمَ الْإِنْسَانَ مَا لَمْ يَعْلَمْ- (العلق ১-৫)-
(১) ‘পড় তোমার প্রভুর নামে যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন’ (২) ‘সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট রক্ত থেকে’ (৩) ‘পড় এবং তোমার প্রভু বড়ই দয়ালু’ (৪) ‘যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দান করেছেন’ (৫) ‘তিনি মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন যা সে জানত না’ (আলাক্ব ৯৬/১-৫)।

এটাই হ’ল পবিত্র কুরআনের মাধ্যমে মানবজাতির প্রতি আল্লাহর প্রথম প্রত্যাদেশ। হে মানুষ! তুমি পড় এবং লেখাপড়ার মাধ্যমে জ্ঞানার্জন কর। যা তোমাকে তোমার সৃষ্টিকর্তার সন্ধান দেয় এবং তাঁর প্রেরিত বিধান অনুযায়ী তোমার জীবন পরিচালনার পথ বাৎলে দেয়। কুরআনের অত্র আয়াতগুলি প্রথম নাযিল হ’লেও সংকলনের পরম্পরা অনুযায়ী তা ৯৬তম সূরার প্রথমে আনা হয়েছে। উল্লেখ্য যে, এই তারতীব আল্লাহর হুকুমে হয়েছে, যা অপরিবর্তনীয়। এর মধ্যে জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য আল্লাহর নিদর্শন রয়েছে।

মাত্র পাঁচটি আয়াত নাযিল হ’ল। তারপর ফেরেশতা অদৃশ্য হয়ে গেল। প্রথম কুরআন নাযিলের এই দিনটি ছিল ৬১০ খ্রিষ্টাব্দের ১০ই আগষ্ট সোমবার। ঐ সময় রাসূল (ছাঃ)-এর বয়স ছিল চান্দ্রবর্ষ হিসাবে ৪০ বছর ৬ মাস ১২ দিন এবং সৌরবর্ষ হিসাবে ৩৯ বছর ৩ মাস ২২ দিন।[২] উল্লেখ্য, সকল ছহীহ হাদীছে এটি প্রমাণিত যে, সর্বদা অহি নাযিল হয়েছে জাগ্রত অবস্থায়, ঘুমন্ত অবস্থায় নয়’ (সীরাহ ছহীহাহ ১/১২৯)।

ভারতের উর্দূ কবি আলতাফ হোসায়েন হালী (১৮৩৭-১৯১৪ খৃঃ) বলেন,
اوتر كر حراسے سوئے قوم آيا + اور اك نسخۂ كيميا ساتھ لايا
‘হেরা থেকে নেমে জাতির কাছে এলেন এবং একটি পরশমণির টুকরা সাথে নিয়ে এলেন’ (মুসাদ্দাসে হালী ১৩ পৃঃ)।

[১]. আর-রাহীক্ব ৬৬ পৃঃ। উক্ত অহী রাতের বেলায় নাযিল হয়েছিল (ইবনু হিশাম ১/২৩৬; সূরা ক্বদর ৯৭/১-৫)। দিনের বেলা নয়। যেমনটি ড. আকরাম যিয়া ধারণা করেন (সীরাহ ছহীহাহ ১/১২৫)।
[২]. আর-রাহীক্ব ৬৬ পৃঃ। নুযূলে কুরআনের উক্ত তারিখ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা দ্রষ্টব্য : আর-রাহীক্বব পৃঃ ৬৬-৬৭, টীকা-২।

নতুনের শিহরণ ও খাদীজার বিচক্ষণতা

নতুন অভিজ্ঞতায় শিহরিত মুহাম্মাদ (ছাঃ) দ্রুত বাড়ী ফিরলেন। স্ত্রী খাদীজাকে বললেন, زَمِّلُوْنِى زَمِّلُوْنِى ‘শিগগীর আমাকে চাদর মুড়ি দাও। চাদর মুড়ি দাও’। কিছুক্ষণ পর ভয়ার্তভাব কেটে গেলে সব কথা স্ত্রীকে খুলে বললেন। রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে খাদীজা কেবল স্ত্রী ছিলেন না, তিনি ছিলেন তাঁর নির্ভরতার প্রতীক ও সান্ত্বনার স্থল। ছিলেন বিপদের বন্ধু। তিনি অভয় দিয়ে বলে উঠলেন, এটা খারাব কিছুই হ’তে পারে না।كَلاَّ وَاللهِ لاَيُخْزِيْكَ اللهُ اَبَدًا إِنَّكَ لَتَصِلُ الرَّحِمَ وَتَحْمِلُ الْكَلَّ وَتَكْسِبُ الْمَعْدُوْمَ وَتَقْرِى الضَّيْفَ وَتُعِيْنُ عَلَى نَوَائِبِ الْحَقِّ- ‘কখনোই না। আল্লাহর কসম! তিনি কখনোই আপনাকে অপদস্থ করবেন না। আপনি আত্মীয়দের সঙ্গে সদাচরণ করেন, দুস্থদের বোঝা বহন করেন, নিঃস্বদের কর্মসংস্থান করেন, অতিথিদের আপ্যায়ন করেন এবং বিপদগ্রস্তকে সাহায্য করেন’। বস্ত্ততঃ সে যুগে কেউ কোন মর্যাদাবান ব্যক্তিকে আশ্রয় দিলে তার উদ্দেশ্যে এরূপ প্রশংসাসূচক বাক্য বলা হ’ত। যেমন বলেছিলেন সে সময় মক্কার নিম্নভূমি অঞ্চলের নেতা ইবনুদ দুগুন্না (ابْنُ الدُّغُنَّة) গোপনে হাবশায় গমনরত আবুবকর (রাঃ)-কে আশ্রয় দিয়ে ফেরাবার সময় (ইবনু হিশাম ১/৩৭৩)।

অতঃপর খাদীজা স্বামীকে সাথে নিয়ে চাচাতো ভাই অরাক্বা বিন নওফালের কাছে গেলেন। যিনি ইনজীল কিতাবের পন্ডিত ছিলেন এবং ঐ সময় বার্ধক্যে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি সব কথা শুনে বললেন, هَذَا النَّامُوْسُ الَّذِيْ نَزَّلَهُ اللهُ عَلَى مُوْسَى، يَا لَيْتَنِىْ فِيْهَا جَذْعًا، يَا لَيْتَنِىْ أَكُوْنُ حَيًّا إِذْ يُخْرِجُكَ قَوْمُكَ ‘এ তো সেই ফেরেশতা যাকে আল্লাহ মূসার প্রতি নাযিল করেছিলেন। হায়! যদি আমি সেদিন তরুণ থাকতাম। হায়! যদি আমি সেদিন জীবিত থাকতাম, যেদিন তোমার কওম তোমাকে বহিষ্কার করবে’। একথা শুনে চমকে উঠে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, اَوَ مُخْرِجِىَّ هُمْ؟ ‘ওরা কি আমাকে বের করে দিবে’? অরাক্বা বললেন, نَعَمْ لَمْ يَأْتِ رَجُلٌ قَطُّ بِمِثْلِ مَا جِئْتَ بِهِ إِلاَّ عُوْدِىَ ‘হ্যাঁ! তুমি যা নিয়ে আগমন করেছ, তা নিয়ে ইতিপূর্বে এমন কেউ আগমন করেননি, যার সাথে শত্রুতা করা হয়নি’। অতঃপর অরাক্বা তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, إِنْ يُدْرِكْنِيْ يَوْمُكَ أَنْصُرْكَ نَصْرًا مُؤَزَّرًا ‘যদি তোমার সেই দিন আমি পাই, তবে আমি তোমাকে সাধ্যমত সাহায্য করব’।[১]

[১]. বুখারী হা/৪৯৫৩, মুসলিম হা/১৬০, মিশকাত হা/৫৮৪১ ‘ফাযায়েল ও শামায়েল’ অধ্যায়, ‘অহি-র সূচনা’ অনুচ্ছেদ।

এখানে প্রসিদ্ধ আছে যে, রাসূল (ছাঃ)-এর কাছে ফেরেশতা আসে না শয়তান আসে, তা যাচাই করার জন্য একদিন খাদীজা তাঁকে নিজের বাম উরু অতঃপর ডান উরু অতঃপর কোলের উপর বসান এবং বলেন, আপনি কি ফেরেশতাকে দেখতে পাচ্ছেন? রাসূল (ছাঃ) বললেন হ্যাঁ। অতঃপর খাদীজা মাথার কাপড় ফেলে দিয়ে বললেন, এবার কি দেখতে পাচ্ছেন? তিনি বললেন, না। তখন খাদীজা বলে উঠলেন,اُثْبُتْ وَأَبْشِرْ فَوَاللهِ إنّهُ لَمَلَكٌ وَمَا هَذَا بِشَيْطَانٍ ‘আপনি নিশ্চিত থাকুন ও সুসংবাদ গ্রহণ করুন! আল্লাহর কসম! এটি মহান ফেরেশতা। এটি কোন শয়তান নয়’ (ইবনু হিশাম ১/২৩৮-৩৯; বায়হাক্বী দালায়েল, ২/১৫১)। বর্ণনাটি যঈফ’ (আলবানী, সিলসিলা যঈফাহ হা/৬০৯৭; মা শা-‘আ ২৭-২৮ পৃঃ)।
 অহি ও ইলহাম (الوحى والإلهام)

‘অহি’ (الْوَحْىُ) অর্থ প্রত্যাদেশ এবং ‘ইলহাম’ (الْإِلْهَامُ) অর্থ প্রক্ষেপণ। ‘অহি’ আল্লাহর পক্ষ হ’তে নবীগণের নিকটে হয়ে থাকে। পক্ষান্তরে ‘ইলহাম’ আল্লাহর পক্ষ থেকে যেকোন ব্যক্তির প্রতি হ’তে পারে। আল্লাহ মানুষের অন্তরে ভাল-মন্দ দু’টিই ‘ইলহাম’ করে থাকেন (আশ-শামস ৯১/৮)। আভিধানিক অর্থে ‘অহি’ অনেক সময় ‘ইলহাম’ অর্থে আসে। যেমন মূসার মা, খিযির, ঈসার মা ও নানী প্রমুখ নির্বাচিত বান্দাদের প্রতি আল্লাহ অহি করেছেন, যা কুরআনে বর্ণিত হয়েছে।[১] কিন্তু তা নবুঅতের অহি ছিলনা। অনুরূপভাবে জিন বা মানুষরূপী শয়তান যখন পরস্পরকে চাকচিক্যপূর্ণ যুক্তি দিয়ে পথভ্রষ্ট করে, ওটাকেও কুরআনে ‘অহি’ বলা হয়েছে (আন‘আম ৬/১১২) আভিধানিক অর্থে। তবে পারিভাষিক অর্থে ‘অহি’ বলতে কেবল তাকেই বলা হয়, যা মানবজাতির হেদায়াতের জন্য আল্লাহ তাঁর মনোনীত নবীগণের নিকট ফেরেশতা জিব্রীলের মাধ্যমে প্রেরণ করে থাকেন (বাক্বারাহ ২/৯৭)।

উল্লেখ্য যে, ইলহাম ও অহি এক নয়। প্রথমটি যেকোন ব্যক্তির মধ্যে হ’তে পারে। কিন্তু অহি কেবল নবী-রাসূলদের নিকট আল্লাহর পক্ষ থেকে হয়ে থাকে। নবী হওয়ার জন্য আধ্যাত্মিকতা শর্ত নয়। বরং আল্লাহর মনোনয়ন শর্ত। যদিও নবীগণ আধ্যাত্মিকতার সর্বোচ্চ নমুনা হয়ে থাকেন। অন্যদের আধ্যাত্মিকতায় শয়তানী খোশ-খেয়াল সম্পৃক্ত হ’তে পারে। যেমন বহু কাফের-মুশরিক যোগী-সন্ন্যাসীদের মধ্যে দেখা যায়।

এখানে এসে অনেক ইসলামী চিন্তাবিদের পদস্খলন ঘটে গেছে। তাঁরা ইলহাম ও অহীকে একত্রে গুলিয়ে ফেলেছেন। যেমন মাওলানা আব্দুর রহীম (১৯১৮-১৯৮৭ খৃ.) বলেন, বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার অনেকাংশেই এক ধরনের ‘ইলহাম’-এর সাহায্যে হয়ে থাকে। এ ইলহাম বা অহীরই বাস্তবতা আমরা দেখতে পাই সেইসব লোকের জীবনেও, যাঁদের আমরা বলি নবী ও রাসূল।... বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (স.)-এর প্রতি বিশ্বলোক ও বিশ্ব মানবতার সমস্যার সঠিক সমাধান অনুরূপ পদ্ধতিতে ও আকস্মিকভাবে মক্কার এক পর্বত গুহায় উদ্ঘাটিত হয়ে পড়ে। তাঁকে নির্দেশ করা হয় : ‘পড় তোমার সেই রবের নামে...। এই দু’টি ক্ষেত্রের জন্যই সেই একই মহাসত্যের নিকট থেকে ‘হঠাৎ আলোর ঝলকানি’ আসার এ ঘটনাবলী অত্যন্ত বিষ্ময়কর হ’লেও এতে পারস্পরিক বৈপরিত্য বলতে কিছুই নেই’।[২]

আমরা বলব, এ যুগের আইনস্টাইন বলে খ্যাত স্টিফেন হকিং (জন্ম : ১৯৪২)[৩] যিনি বলেন, ঈশ্বর ও পরকাল বলে কিছু নেই, তিনিও কি তাহ’লে আল্লাহর অহী পেয়ে এগুলো বলছেন, নাকি শয়তানের ধোঁকায় পড়ে এগুলি বলছেন? নিঃসন্দেহে বিজ্ঞানী ও নবী কখনোই এক নন। আধ্যাত্মিক ব্যক্তি ও চিন্তাবিদ মানুষ চিরকাল থাকবেন। কিন্তু তারা কখনোই নবী হবেন না। আর নবুঅতের সিলসিলা শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) পর্যন্ত এসে সমাপ্ত হয়ে গেছে।

[১]. ক্বাছাছ ২৮/৭; কাহফ ১৮/৮২; মারিয়াম ১৯/২৪; আলে ইমরান ৩/৩৫-৩৬।
[২]. মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম, মহাসত্যের সন্ধানে (ঢাকা : খায়রুন প্রকাশনী ৫ম প্রকাশ ১৯৯৮) লেখকের ‘ভূমিকা’ জুলাই ১৯৭৫।
[৩]. Stephen William Hawking একজন বৃটিশ তাত্ত্বিক পদার্থবিদ। যিনি কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে Centre for Theoretical Cosmology-এর প্রধান গবেষণা পরিচালক। ২১ বছর বয়সে ১৯৬৩ সাল থেকে তিনি মাথা ব্যতীত সর্বাঙ্গ প্যারালাইজড অবস্থায় শয্যাশায়ী আছেন। বর্তমানে তাঁর বয়স ৭৩ বছর।

অহি-র প্রকারভেদ

আল্লাহ কিভাবে ‘অহি’ প্রেরণ করেন, সে বিষয়ে তিনি বলেন,وَمَا كَانَ لِبَشَرٍ أَنْ يُكَلِّمَهُ اللهُ إِلاَّ وَحْيًا أَوْ مِنْ وَرَاءِ حِجَابٍ أَوْ يُرْسِلَ رَسُولاً فَيُوحِيَ بِإِذْنِهِ مَا يَشَاءُ إِنَّهُ عَلِيٌّ حَكِيْمٌ ‘মানুষের জন্য এটি অসম্ভব যে, আল্লাহ তার সাথে সরাসরি কথা বলবেন অহি-র মাধ্যম ছাড়া অথবা পর্দার অন্তরাল ব্যতিরেকে অথবা এমন দূত প্রেরণ ব্যতীত, যে তাঁর অনুমতিক্রমে তিনি যা চান তা ব্যক্ত করে। নিশ্চয়ই তিনি সর্বোচ্চ ও প্রজ্ঞাময়’ (শূরা ৪২/৫১)। হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) নবীদের নিকটে ‘অহি’ প্রেরণের সাতটি প্রকারভেদ বর্ণনা করেছেন। যেমন-

(১) সত্য স্বপ্নের মাধ্যমে। যা রাসূল (ছাঃ) ৪০ বছর বয়সে রবীউল আউয়াল মাস থেকে রামাযান মাস পর্যন্ত প্রথম ছয়মাস প্রাপ্ত হয়েছিলেন। যা প্রভাত সূর্যের ন্যায় সত্য হয়ে দেখা দিত (বুখারী হা/৩)।

(২) অদৃশ্য থেকে হৃদয়ে অহি-র প্রক্ষেপণ, যা জিব্রীল মাঝে-মধ্যে রাসূল (ছাঃ)-এর উপরে করতেন।[১]

(৩) মানুষের রূপ ধারণ করে জিব্রীলের আগমন। যেমন একবার দেহিয়াতুল কালবীর রূপ ধারণ করে ছাহাবীগণের মজলিসে এসে তিনি রাসূল (ছাঃ)-কে ইসলাম, ঈমান, ইহসান ও ক্বিয়ামতের আলামত সম্পর্কে প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে শিক্ষা দেন।[২] যাকে ‘হাদীছে জিব্রীল’ বলা হয়।

(৪) কখনো ঘণ্টাধ্বনির আওয়ায করে ‘অহি’ নাযিল হ’ত। এ সময় রাসূল (ছাঃ) খুব কষ্ট অনুভব করতেন। প্রচন্ড শীতের দিনেও দেহে ঘাম ঝরত (বুখারী হা/২)। উটের পিঠে থাকলে অধিক ভার বহনে অক্ষম হয়ে উট বসে পড়ত (হাকেম হা/৩৮৬৫)। রাসূল (ছাঃ)-এর উরুর চাপে একবার এ অবস্থায় যায়েদ বিন ছাবিতের উরুর হাড় ভেঙ্গে যাবার উপক্রম হয়েছিল (বুখারী হা/২৮৩২)।

(৫) জিব্রীল (আঃ) স্বরূপে এসে ‘অহি’ প্রদান করতেন। এটি দু’বার ঘটেছে। যেমন সূরা নাজমে (৫-১৪) বর্ণিত হয়েছে।[৩]

(৬) সরাসরি আল্লাহর ‘অহি’। যেমন মে‘রাজ রজনীতে সিদরাতুল মুনতাহায় অবস্থানকালে পর্দার অন্তরাল থেকে আল্লাহ সরাসরি অহি-র মাধ্যমে পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত ফরয করেন।[৪]

(৭) ফেরেশতার মাধ্যম ছাড়াই দুনিয়াতে আল্লাহ পর্দার অন্তরাল থেকে স্বীয় নবীর সঙ্গে কথা বলেন। যেমন মূসা (আঃ)-এর সঙ্গে তূর পাহাড়ে তিনি কথা বলেছিলেন (ত্বোয়াহা ২০/১১-২৩; নিসা ৪/১৬৪)। অনেকে অষ্টম আরেকটি ধারা বলেছেন যে, কোনরূপ পর্দা ছাড়াই দুনিয়াতে আল্লাহ তাঁর সাথে সরাসরি কথা বলেছেন। এটি প্রমাণিত নয়।[৫]

[১]. ছহীহাহ হা/২৮৬৬; মিশকাত হা/৫৩০০।
[২]. মুসলিম হা/৮; নাসাঈ হা/৪৯৯১; মিশকাত হা/২।
[৩]. মুসলিম হা/১৭৭; তিরমিযী হা/৩২৭৭।
[৪]. বুখারী হা/৩২০৭; মুসলিম হা/১৬২।
[৫]. যা-দুল মা‘আদ ১/৭৭-৭৯; আর-রাহীক্ব ৭০ পৃঃ।

শিক্ষণীয় বিষয়সমূহ
১. সর্বপ্রথম নাযিলকৃত সূরা ‘আলাক্বের প্রথম পাঁচটি আয়াতে পড়া ও লেখা এবং তার মাধ্যমে এমন জ্ঞান অর্জনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যা আধ্যাত্মিক ও বৈষয়িক উভয় জ্ঞানের সমন্বয় সাধন করে। আর সেটাই হ’ল প্রকৃত মানবীয় শিক্ষা।
২. আলাক্ব-এর চাহিদা পূরণে গৃহীত বস্ত্তগত শিক্ষা যেন মানুষকে তার খালেক-এর সন্ধান দেয় এবং তাঁর প্রতি দাসত্ব, আনুগত্য ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশে উদ্বুদ্ধ করে, সে বিষয়ে নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে।
৩. সসীম মানবীয় জ্ঞানের সাথে অসীম এলাহী জ্ঞানের হেদায়াত যুক্ত না হওয়া পর্যন্ত মানুষ কখনোই প্রকৃত জ্ঞানী হ’তে পারে না এবং সে কখনোই প্রকৃত সত্য খুঁজে পাবে না- সেকথা স্পষ্টভাবে বলে দেওয়া হয়েছে। যেমন মানুষের নিজস্ব দৃষ্টিশক্তির সাথে চশমা, অনুবীক্ষণ বা দূরবীক্ষণ যন্ত্র যুক্ত হ’লে তার দৃষ্টিসীমা প্রসারিত হয়। বলা বাহুল্য তাওহীদের জ্ঞান অর্জনের আহবানই ছিল মানবজাতির প্রতি কুরআনের সর্বপ্রথম আহবান।
৪. কয়েকদিনের বিরতির পর সূরা মুদ্দাছছিরে নাযিলকৃত পাঁচটি আয়াতে পূর্বোক্ত অভ্রান্ত জ্ঞানের তথা তাওহীদের প্রচার ও প্রসারের গুরু দায়িত্ব ন্যস্ত করা হয়েছে এক অপূর্ব অলংকারসমৃদ্ধ ভাষায়। উঠো! ভোগবাদী মানুষকে শয়তানের ধোঁকা থেকে বাঁচাও। সর্বত্র আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা কর। শিরকী জাহেলিয়াতের কলুষময় পোষাক ঝেড়ে ফেল এবং সকল অপবিত্রতা হ’তে মুক্ত হও। অর্থাৎ মানুষের মনোজগতে ও কর্মজগতে আমূল সংস্কার সাধনের প্রতিজ্ঞা নিয়ে হে চাদরাবৃত মুহাম্মাদ! উঠে দাঁড়াও!!
৫. যার পরপরই একই দরদভরা ভাষায় সূরা মুযযাম্মিল নাযিল করে রাসূল (ছাঃ) ও ছাহাবীগণের জন্য তাহাজ্জুদ ছালাত তথা নৈশ ইবাদতের নির্দেশ দেওয়া হয় (মুযযাম্মিল ৭৩/১-৪)। কেননা পরবর্তী সমাজ বিপ্লবের গুরুদায়িত্ব পালনের জন্য নৈতিক ও আধ্যাত্মিক শক্তি সম্পন্ন মানুষ তৈরী করাই ছিল প্রধান কাজ। আর আধ্যাত্মিক মানস গঠনে তাহাজ্জুদ ছালাতের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
৬. দুনিয়াপূজারী অধঃপতিত জাতিকে উদ্ধারের যে পথ মুহাম্মাদ (ছাঃ) তালাশ করছিলেন, তা তিনি পেয়ে গেলেন আল্লাহর অহি-র মাধ্যমে। আর তা হ’ল জীবনের লক্ষ্য পরিবর্তন। অর্থাৎ দুনিয়াপূজারী মানুষকে আল্লাহমুখী করা এবং সার্বিক জীবনে অহি-র বিধান অনুসরণের মাধ্যমে আখেরাতে মুক্তিই হবে মানুষের পার্থিব জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। অন্য কোন পথে মানবতার মুক্তি নেই।
৭. সসীম জ্ঞানের ঊর্ধ্বে অসীম জ্ঞানের উৎস আল্লাহর সন্ধান পাওয়াই ছিল প্রথম নুযূলে অহি-র অমূল্য অবদান।
ইকবাল বলেন,
الله سے كرے دور تو تعليم بهى فتنہ + أملاك بهى اولاد بهى جاگير بهى فتنہ
ناحق كے لئے اٹهے تو شمشير بهى فتنہ + شمشير ہى كيا نعرۂ تكبير بهى فتنہ
(১) আল্লাহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে, সে শিক্ষা হ’ল ফিৎনা। (২) সম্পদ, সন্তান এমনকি জাগীরও ফিৎনা। (৩) অসত্যের জন্য যদি তরবারি ওঠে, তবে সেটিও ফিৎনা। (৪) তরবারি কিসের, নারায়ে তাকবীরও ফিৎনা।

শেষনবী মুহাম্মাদ (সা:)

(ক) মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে শেষনবী হিসাবে মনোনীত:
আল্লাহ মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে শেষনবী হিসাবে মনোনীত করেন। তিনি বলেন, مَا كَانَ مُحَمَّدٌ أَبَا أَحَدٍ مِنْ رِجَالِكُمْ وَلَكِنْ رَسُولَ اللهِ وَخَاتَمَ النَّبِيِّينَ ‘মুহাম্মাদ তোমাদের কোন ব্যক্তির পিতা নন। বরং তিনি আল্লাহর রাসূল ও শেষনবী’ (আহযাব ৩৩/৪০)।[১] তিনি বলেন, اللهُ أَعْلَمُ حَيْثُ يَجْعَلُ رِسَالَتَهُ ‘আল্লাহ সর্বাধিক অবগত কার নিকটে তিনি রিসালাত সমর্পণ করবেন’ (আন‘আম ৬/১২৪)। কেননা وَاللهُ يَخْتَصُّ بِرَحْمَتِهِ مَن يَّشَاءُ ‘আল্লাহ স্বীয় অনুগ্রহের জন্য যাকে চান তাকে খাছ করে নেন’ (বাক্বারাহ ২/১০৫)।

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, إِنَّ مَثَلِى وَمَثَلَ الأَنْبِيَاءِ مِنْ قَبْلِى كَمَثَلِ رَجُلٍ بَنَى بَيْتًا فَأَحْسَنَهُ وَأَجْمَلَهُ إِلاَّ مَوْضِعَ لَبِنَةٍ مِنْ زَاوِيَةٍ فَجَعَلَ النَّاسُ يَطُوفُونَ بِهِ وَيَعْجَبُونَ لَهُ وَيَقُولُونَ هَلاَّ وُضِعَتْ هَذِهِ اللَّبِنَةُ قَالَ فَأَنَا اللَّبِنَةُ وَأَنَا خَاتِمُ النَّبِيِّينَ ‘আমি ও আমার পূর্বেকার নবীগণের তুলনা ঐ ব্যক্তির ন্যায় যিনি একটি গৃহ নির্মাণ করেছেন। অতঃপর সেটিকে খুবই সুন্দর ও আকর্ষণীয় করেছেন। কিন্তু কোণায় একটি জায়গা খালি রেখেছেন। তখন লোকেরা ঐ স্থানটি ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকে এবং বিস্ময় প্রকাশ করতে থাকে ও বলতে থাকে, কেন এখানে একটি ইট দেওয়া হয়নি? রাসূল (ছাঃ) বলেন, আমিই সেই ইট এবং আমিই শেষনবী’।[২] لاَ نَبِىَّ بَعْدِى ‘আমার পরে আর কোন নবী নেই’।[৩] তিনি বলেন, بُعِثْتُ إِلَى الأَحْمَرِ وَالأَسْوَدِ، وَكَانَ النَّبِىُّ يُبْعَثُ إِلَى قَوْمِهِ خَاصَّةً وَبُعِثْتُ إِلَى النَّاسِ عَامَّةً- ‘আমি লাল ও কালো সকলের প্রতি প্রেরিত হয়েছি। অন্য নবীগণ নির্দিষ্টভাবে স্ব স্ব গোত্রের জন্য প্রেরিত হয়েছেন। কিন্তু আমি মানবজাতির সকলের জন্য প্রেরিত হয়েছি’।[৪] আল্লাহ বলেন, وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلاَّ كَافَّةً لِلنَّاسِ ‘আমরা তোমাকে পুরা মানবজাতির প্রতি প্রেরণ করেছি’ (সাবা ৩৪/২৮)­। অত্র আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, فَأَرْسَلَهُ إِلَى الْجِنِّ وَالإِنْسِ ‘অতঃপর আল্লাহ তাঁকে জিন ও ইনসানের প্রতি প্রেরণ করেন’।[৫] আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণিত অন্য হাদীছে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, وَأُرْسِلْتُ إِلَى الْخَلْقِ كَافَّةً وَخُتِمَ بِىَ النَّبِيُّونَ ‘আমাকে পুরা সৃষ্টি জগতের প্রতি প্রেরণ করা হয়েছে এবং আমাকে দিয়েই নবীদের সিলসিলা সমাপ্ত করা হয়েছে’।[৬]

বর্তমান পৃথিবীর সকল জিন ও ইনসান শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর উম্মত। যারা তাঁর দ্বীন কবুল করেছে, তারা হ’ল ‘উম্মাতুল ইজাবাহ’ (أُمَّةُ الْإِجَابَةِ) অর্থাৎ মুসলিম। আর যারা তাঁর দ্বীন কবুল করেনি, তারা হ’ল ‘উম্মাতুদ দা‘ওয়াহ’ (أُمَّةُ الدَّعْوَةِ) অর্থাৎ কাফির-মুশরিকগণ, যাদেরকে ইসলামের দিকে দাওয়াত দিতে হবে। যেহেতু আর কোন শরী‘আত নিয়ে আর কোন নবী আসবেন না, সেকারণ ক্বিয়ামত পর্যন্ত সকল জিন-ইনসান শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর উম্মত। মুসলমানের কর্তব্য হ’ল শেষনবী (ছাঃ)-এর আনীত ইসলামী শরী‘আত নিজেরা মেনে চলা এবং দুনিয়াবাসীকে তা মেনে চলার আহবান জানানো। কেননা হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেছেন,وَالَّذِى نَفْسُ مُحَمَّدٍ بِيَدِهِ لاَ يَسْمَعُ بِى أَحَدٌ مِنْ هَذِهِ الأُمَّةِ يَهُودِىٌّ وَلاَ نَصْرَانِىٌّ ثُمَّ يَمُوْتُ وَلَمْ يُؤْمِنْ بِالَّذِى أُرْسِلْتُ بِهِ إِلاَّ كَانَ مِنْ أَصْحَابِ النَّارِ ‘যাঁর হাতে মুহাম্মাদের জীবন তাঁর কসম করে বলছি, ইহূদী হৌক বা নাছারা হৌক এই উম্মতের যে কেউ আমার আগমনের খবর শুনেছে, অতঃপর মৃত্যুবরণ করেছে, অথচ আমি যা নিয়ে প্রেরিত হয়েছি, তার উপরে ঈমান আনেনি, সে ব্যক্তি অবশ্যই জাহান্নামী হবে’।[৭]

মূলতঃ খতমে নবুঅতের আক্বীদার মধ্যেই বিশ্ব মুসলিম ও বিশ্ব মানবতার ঐক্য ও অগ্রগতি নির্ভর করে। এই ঐক্য বিনষ্ট করার জন্য শয়তান শুরু থেকেই চেষ্টা চালিয়েছে এবং এখনও চালিয়ে যাচ্ছে। এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) উম্মতকে সাবধান করে বলেন, ‘অতদিন ক্বিয়ামত হবে না, যতদিন না আমার উম্মতের কিছু গোত্র মুশরিকদের সঙ্গে মিশে যাবে এবং মূর্তিপূজা করবে। আর সত্ত্বর আমার উম্মতের মধ্যে ত্রিশ জন মিথ্যাবাদীর জন্ম হবে। যাদের প্রত্যেকে ধারণা করবে যে, সে নবী (كَذَّابُونَ ثَلاَثُونَ كُلُّهُمْ يَزْعُمُ أَنَّهُ نَبِىٌّ)। অথচ আমি শেষনবী। আমার পরে কোন নবী নেই। আর আমার উম্মতের মধ্যে চিরদিন একটি দল হক-এর উপরে বিজয়ী থাকবে, বিরোধীরা তাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না। এভাবেই আল্লাহর নির্দেশ (ক্বিয়ামত) এসে যাবে’ (আবুদাঊদ হা/৪২৫২)। রাসূল (ছাঃ)-এর জীবদ্দশায় ছান‘আর আসওয়াদ ‘আনাসী ও ইয়ামামার মুসায়লামা কাযযাব (মুসলিম হা/২২৭৪) এবং তাঁর মৃত্যুর পরে আরও কয়েকজন সহ এ যুগে মির্যা গোলাম আহমাদ কাদিয়ানী (১৮৩৯-১৯০৮ খৃ.) তাদের অন্যতম।

(খ) নবীগণের অঙ্গীকার:
আখেরী নবীর প্রতি ঈমান আনা ও তাঁকে সর্বতোভাবে সাহায্য করার জন্য পূর্বেই আল্লাহ নবীগণের নিকট থেকে অঙ্গীকার নিয়েছিলেন। যেমন তিনি বলেন,وَإِذْ أَخَذَ اللهُ مِيْثَاقَ النَّبِيِّينَ لَمَا آتَيْتُكُمْ مِنْ كِتَابٍ وَحِكْمَةٍ ثُمَّ جَاءَكُمْ رَسُولٌ مُصَدِّقٌ لِمَا مَعَكُمْ لَتُؤْمِنُنَّ بِهِ وَلَتَنْصُرُنَّهُ قَالَ أَأَقْرَرْتُمْ وَأَخَذْتُمْ عَلَى ذَلِكُمْ إِصْرِي قَالُوا أَقْرَرْنَا قَالَ فَاشْهَدُوا وَأَنَا مَعَكُمْ مِنَ الشَّاهِدِيْنَ- ‘আর যখন আল্লাহ নবীগণের নিকট থেকে অঙ্গীকার নিলেন এই মর্মে যে, আমি তোমাদের কিতাব ও হিকমত যা দান করেছি, এরপরে যদি কোন রাসূল আসেন, যিনি তোমাদেরকে প্রদত্ত কিতাবের সত্যায়ন করবেন, তাহ’লে অবশ্যই তোমরা তার প্রতি ঈমান আনবে এবং অবশ্যই তাকে সাহায্য করবে। তিনি বললেন, তোমরা কি এতে স্বীকৃতি দিচ্ছ এবং তোমাদের স্বীকৃতির উপর আমার অঙ্গীকার নিচ্ছ? তারা বলল, আমরা স্বীকৃতি দিলাম। তিনি বললেন, তাহ’লে তোমরা সাক্ষী থাক এবং আমিও তোমাদের সাথে অন্যতম সাক্ষী রইলাম’ (আলে ইমরান ৩/৮১)।[৮]

(গ) আহলে কিতাব পন্ডিতদের অঙ্গীকার:
আহলে কিতাব পন্ডিতগণের নিকট থেকে অঙ্গীকার নেওয়া হয় এই মর্মে যে, তারা যেন সত্য গোপন না করে এবং শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর আগমন ও তাঁর প্রতি ঈমান আনার বিষয়টি লোকদের নিকট প্রকাশ করে। যেমন আল্লাহ বলেন,وَإِذْ أَخَذَ اللهُ مِيثَاقَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ لَتُبَيِّنُنَّهُ لِلنَّاسِ وَلاَ تَكْتُمُونَهُ فَنَبَذُوهُ وَرَاءَ ظُهُورِهِمْ وَاشْتَرَوْا بِهِ ثَمَنًا قَلِيلاً فَبِئْسَ مَا يَشْتَرُونَ ‘আর আল্লাহ যখন আহলে কিতাবদের নিকট থেকে অঙ্গীকার নিলেন যে, তোমরা অবশ্যই (শেষনবী মুহাম্মাদের আগমন ও তার উপর ঈমান আনার বিষয়টি) লোকদের নিকট বর্ণনা করবে এবং তা গোপন করবে না। অতঃপর তারা তা পশ্চাতে নিক্ষেপ করল এবং গোপন করার বিনিময়ে তা স্বল্পমূল্যে বিক্রয় করল। কতই না নিকৃষ্ট তাদের ক্রয়-বিক্রয়’ (আলে-ইমরান ৩/১৮৭)।

ইবনু কাছীর বলেন, অত্র আয়াতে ইহূদী-নাছারা পন্ডিতদের ধমক দেওয়া হয়েছে ও ধিক্কার জানানো হয়েছে এ কারণে যে, তারা নিকৃষ্ট দুনিয়াবী স্বার্থে পূর্বেকার সেই অঙ্গীকার ভুলে গেছে এবং লোকদের নিকট উক্ত অঙ্গীকারের কথা চেপে গেছে। এই অঙ্গীকারের কথা তাদের নবীগণের মাধ্যমে তাদের ধর্মনেতাদের জানিয়ে দেওয়া হয়। কতই না নিকৃষ্ট ছিল তাদের হাতের উপর হাত রাখা এবং কতই না নিকৃষ্ট ছিল তাদের বায়‘আত গ্রহণ করা। তিনি বলেন, এর মধ্যে মুসলিম আলেমদের জন্য সতর্কবাণী রয়েছে, যেন তারা আহলে কিতাবদের মত না হন এবং তারা যেন সৎকর্মের কোন ইলম গোপন না করেন (ঐ, তাফসীর)।

(ঘ) ঈসা (আঃ)-এর ভবিষ্যদ্বাণী:
পূর্বের নবীগণের ন্যায় আহলে কিতাবগণের শেষনবী ঈসা (আঃ) স্বীয় কওমকে উদ্দেশ্য করে সর্বশেষ নবী ও রাসূল মুহাম্মাদের আগমনের সুসংবাদ দিয়েছিলেন। যেমন আল্লাহ বলেন, وَإِذْ قَالَ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ يَا بَنِي إِسْرَائِيلَ إِنِّي رَسُولُ اللهِ إِلَيْكُم مُّصَدِّقاً لِّمَا بَيْنَ يَدَيَّ مِنَ التَّوْرَاةِ وَمُبَشِّراً بِرَسُولٍ يَأْتِي مِن بَعْدِي اسْمُهُ أَحْمَدُ فَلَمَّا جَاءهُم بِالْبَيِّنَاتِ قَالُوا هَذَا سِحْرٌ مُّبِينٌ ‘স্মরণ কর, যখন মরিয়ম-তনয় ঈসা বলেছিল, হে বনু ইস্রাঈলগণ! আমি তোমাদের প্রতি আল্লাহর প্রেরিত রাসূল, আমার পূর্ববর্তী তওরাতের আমি সত্যায়নকারী এবং আমি এমন একজন রাসূল-এর সুসংবাদ দানকারী, যিনি আমার পরে আগমন করবেন, তার নাম হবে ‘আহমাদ’। অতঃপর যখন তিনি তাদের নিকট স্পষ্ট নিদর্শনাবলীসহ আগমন করলেন, তখন তারা বলল, এটাতো প্রকাশ্য জাদু মাত্র’ (ছফ ৬১/৬)।

(ঙ) তাওরাত ও ইনজীলে ভবিষ্যদ্বাণী:
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর আগমন সংবাদ তাওরাত-ইনজীলেও লিপিবদ্ধ ছিল। যেমন আল্লাহ বলেন, الَّذِيْنَ يَتَّبِعُوْنَ الرَّسُوْلَ النَّبِيَّ الْأُمِّيَّ الَّذِي يَجِدُوْنَهُ مَكْتُوبًا عِنْدَهُمْ فِي التَّوْرَاةِ وَالْإِنْجِيْلِ ‘(এই কল্যাণ কেবল তাদেরই প্রাপ্য) যারা এই রাসূলের আনুগত্য করে যিনি নিরক্ষর নবী, যার বিষয়ে তারা তাদের কিতাব তাওরাত ও ইনজীলে লিপিবদ্ধ পেয়েছে’ (আ‘রাফ ৭/১৫৭)। সেকারণ তাঁর আগমন বিষয়ে ইহূদী-নাছারা পন্ডিতগণ আগেভাগেই জানতেন (বাক্বারাহ ২/৮৯)। তারা তাঁকে চিনতেন যেমন নিজের সন্তানদের তারা চিনতেন’।[৯]

(চ) আহলে কিতাবগণের প্রতীক্ষিত নবী:
মক্কায় অরাক্বা বিন নওফাল, শামে বাহীরা প্রমুখ পন্ডিতগণ তাঁকে দেখেই চিনতে পেরেছিলেন। সেকারণ হাবশার সম্রাট নাজাশী, রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াস ও মিসররাজ মুক্বাউক্বিস সকলেই তাঁকে সসম্মানে গ্রহণ করেছিলেন। যারা সবাই খ্রিষ্টান ছিলেন। শেষনবীর সন্ধানেই সুদূর পারস্যের ইছফাহান হ’তে অগ্নিপূজক সালমান ফারেসী খ্রিষ্টান পাদ্রীদের কাছে শুনে দীর্ঘদিন সন্ধান শেষে মদীনায় এসে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট ১ম হিজরীতে ইসলাম কবুল করেন।[১০] ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন, আহলে কিতাবদের নিকটে মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর পরিচিতি অবিরত ধারায় বর্ণিত ছিল।[১১] আহলে কিতাবদের নিকট থেকে ইয়াছরিবের অধিবাসীরা আগে থেকেই শেষনবীর আগমন ও তাঁর নাম-চেহারা ও পরিচিতি সম্পর্কে জানত (ইবনু হিশাম ১/২৩২)। এমনকি তারা শেষনবীর আগমনের পর তাকে সাথে নিয়ে অবাধ্য ইয়াছরেবীদের উপর জয়লাভ করবে ও তাদের হত্যা করবে বলে হুমকি দিত।[১২] আর সেকারণেই তারা মক্কায় এসে আগেই ইসলাম কবুল করে এবং তাদের আহবানে সাড়া দিয়ে রাসূল (ছাঃ) মদীনায় হিজরত করেন।

তাদের উক্ত আকাংখার বিষয়টি প্রকাশ করে আল্লাহ বলেন, وَلَمَّا جَاءَهُمْ كِتَابٌ مِنْ عِنْدِ اللهِ مُصَدِّقٌ لِمَا مَعَهُمْ وَكَانُوا مِنْ قَبْلُ يَسْتَفْتِحُونَ عَلَى الَّذِينَ كَفَرُوا فَلَمَّا جَاءَهُمْ مَا عَرَفُوا كَفَرُوا بِهِ فَلَعْنَةُ اللهِ عَلَى الْكَافِرِينَ ‘আর যখন তাদের কাছে আল্লাহর পক্ষ হ’তে কিতাব (কুরআন) এসে গেল, যা সত্যায়নকারী ছিল (তওরাত-ইনজীলের), যা তাদের কাছে রয়েছে। অথচ ইতিপূর্বে তারা (শেষনবীর মাধ্যমে) কাফেরদের উপর বিজয় কামনা করত। অবশেষে যখন তাদের নিকট পরিচিত সেই কিতাব (কুরআন) এসে গেল তারা তাকে অস্বীকার করল। অতএব কাফেরদের উপরে আল্লাহর অভিসম্পাৎ’ (বাক্বারাহ ২/৮৯)।

এক্ষণে আমরা রাসূল (ছাঃ)-এর দীর্ঘ তেইশ বছরের নবুঅতী জীবন বিবৃত করব। যার মধ্যে মাক্কী জীবনের তের বছর ছিল নিরবচ্ছিন্নভাবে দাওয়াতী জীবন এবং শেষ দশ বছরের মাদানী জীবন ছিল তাওহীদ ভিত্তিক সমাজ গঠনের জন্য দাওয়াত ও জিহাদের সমন্বিত কষ্টকর জীবন।

[১]. পালিত পুত্র যায়েদ বিন হারেছাহ্র তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রী যয়নাব বিনতে জাহশকে আল্লাহর হুকুমে বিয়ে করার পর কাফির ও মুনাফিকদের অপপ্রচারের প্রতিবাদে অত্র আয়াত নাযিল হয়। এর মাধ্যমে যায়েদ বিন হারেছাহকে ‘যায়েদ বিন মুহাম্মাদ’ বলতে নিষেধ করা হয় (ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা আহযাব ৪০ আয়াত)। দুর্ভাগ্য এটি এখন বিদ‘আতীদের নিকট মীলাদের আয়াতে পরিণত হয়েছে।
[২]. বুখারী হা/৩৫৩৫; মুসলিম হা/২২৮৬; মিশকাত হা/৫৭৪৫, আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে।
[৩]. বুখারী হা/৩৪৫৫; মুসলিম হা/১৮৪২; আবুদাঊদ হা/৪২৫২ মিশকাত/৩৬৭৫, ৫৪০৬, ছাওবান (রাঃ) হ’তে।
[৪]. আহমাদ হা/১৪৩০৩; বুখারী হা/৩৩৫; মুসলিম হা/ ৫২১; মিশকাত হা/৫৭৪৭।
[৫]. দারেমী, ‘ভূমিকা’ হা/৪৬, সনদ ছহীহ; মিশকাত হা/৫৭৭৩।
[৬]. মুসলিম হা/৫২৩; মিশকাত হা/৫৭৪৮।
[৭]. মুসলিম হা/১৫৩; মিশকাত হা/১০।
[৮]. ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা আলে ইমরান ৮১ আয়াত; ইবনু হিশাম ১/২৩২-৩৪।
[৯]. বাক্বারাহ ২/১৪৬; ইবনু হিশাম ১/২০৪।
[১০]. ইবনু হিশাম ১/২১৪-২২২; আহমাদ হা/২৩৭৮৮, সনদ হাসান।
[১১]. ইবনু তায়মিয়াহ, আল-জাওয়াবুছ ছহীহ লেমান বাদ্দালা দীনাল মাসীহ ১/৩৪০।
[১২]. ইবনু হিশাম ১/২১১, সনদ হাসান; সীরাহ ছহীহাহ ১/১২২; ইবনু কাছীর, তাফসীর বাক্বারাহ ৮৯ আয়াত।



প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর ৬৭ পর্বের জীবনীর সকল পর্ব এখান থেকে পড়ুন-

পর্ব-০১   পর্ব-০২   পর্ব-০৩   পর্ব-০৪   পর্ব-০৫   পর্ব-০৬   পর্ব-০৭   পর্ব-০৮   পর্ব-০৯   পর্ব-১০   পর্ব-১১   পর্ব-১২   পর্ব-১৩   পর্ব-১৪   পর্ব-১৫   পর্ব-১৬   পর্ব-১৭   পর্ব-১৮   পর্ব-১৯   পর্ব-২০   পর্ব-২১   পর্ব-২২   পর্ব-২৩   পর্ব-২৪   পর্ব-২৫   পর্ব-২৬   পর্ব-২৭   পর্ব-২৮   পর্ব-২৯   পর্ব-৩০    পর্ব-৩১   পর্ব-৩২   পর্ব-৩৩   পর্ব-৩৪   পর্ব-৩৫   পর্ব-৩৬   পর্ব-৩৭   পর্ব-৩৮   পর্ব-৩৯   পর্ব-৪০   পর্ব-৪১   পর্ব-৪২   পর্ব-৪৩   পর্ব-৪৪   পর্ব-৪৫   পর্ব-৪৬(১ম) পর্ব-৪৬(২য়)    পর্ব-৪৭   পর্ব-৪৮   পর্ব-৪৯   পর্ব-৫০   পর্ব-৫১   পর্ব-৫২   পর্ব-৫৩   পর্ব-৫৪   পর্ব-৫৫   পর্ব-৫৬   পর্ব-৫৭   পর্ব-৫৮   পর্ব-৫৯   পর্ব-৬০   পর্ব-৬১   পর্ব-৬২   পর্ব-৬৩   পর্ব-৬৪   পর্ব-৬৫   পর্ব-৬৬   পর্ব-৬৭  



******************************************
>>> Welcome, You are now on Mohammadia Foundation's Website. Please stay & Tune with us>>>

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url