প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর জীবনী [পর্ব-০৯]




আবু লাহাবের পরিণাম ও দ্বীনের দাওয়াতে জনগণের প্রতিক্রিয়া

আবু লাহাবের স্ত্রী

তার স্ত্রী ছিলেন আবু সুফিয়ানের বোন আরওয়া (أروى) অথবা ‘আওরা’ (العوراء) ওরফে উম্মে জামীল বা ‘সুন্দরের উৎস’। তবে একচক্ষু দৃষ্টিহীন হওয়ায় ইবনুল ‘আরাবী উক্ত মহিলাকে ‘আওরা উম্মে ক্বাবীহ’(عوراء ام قبيح) ‘এক চক্ষু সকল নষ্টের মূল’ বলেন’ (কুরতুবী)। তিনিও স্বামীর অকপট সহযোগী ছিলেন এবং সর্বদা রাসূল (ছাঃ)-এর বিরুদ্ধে গীবত-তোহমত ও নিন্দাবাদে মুখর থাকতেন। চোগলখুরী ও মিথ্যাচারের মাধ্যমে সংসারে বা সমাজে অশান্তির আগুন ধরিয়ে দেওয়া ব্যক্তিকে আরবদের পরিভাষায়حَمَّالَةُ الْحَطَبِ ইন্ধন বহনকারী বা ‘খড়িবাহক’ বলা হ’ত। অর্থাৎ ঐ শুষ্ককাঠ যাতে আগুন লাগালে দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়ে। আবু লাহাবের স্ত্রী একাজটিই করতেন পিছনে থেকে। সেকারণ আল্লাহ তাকেও স্বামীর সাথে জাহান্নামে প্রেরণ করবেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর বিরুদ্ধে হেন অপপ্রচার নেই, যা আবু লাহাব ও তার স্ত্রী করতেন না।

তার স্ত্রী উম্মে জামীল রাসূল (ছাঃ)-এর বিরুদ্ধে নানাবিধ দুষ্কর্মে পটু ছিলেন। তিনি রাসূল (ছাঃ)-এর যাতায়াতের পথে বা তাঁর বাড়ীর দরজার মুখে কাঁটা বিছিয়ে বা পুঁতে রাখতেন। যাতে রাসূল (ছাঃ) কষ্ট পান। তিনি ছিলেন কবি। ফলে নানা ব্যঙ্গ কবিতা পাঠ করে তিনি লোকদের ক্ষেপিয়ে তুলতেন। সূরা লাহাব নাযিল হ’লে রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে উক্ত মহিলা হাতে প্রস্তরখন্ড নিয়ে রাসূল (ছাঃ)-কে মারার উদ্দেশ্যে কা‘বা চত্বরে গমন করেন। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছায় রাসূল (ছাঃ) সামনে থাকা সত্ত্বেও তিনি তাঁকে দেখতে পাননি’।[১] তাই পাশে দাঁড়ানো আবুবকরের কাছে তার মনের ঝাল মিটিয়ে কুৎসাপূর্ণ কবিতা বলে ফিরে আসেন। উক্ত কবিতায় তিনি ‘মুহাম্মাদ’ (প্রশংসিত) নামকে বিকৃত করে ‘মুযাম্মাম’ (নিন্দিত) বলেন। যেমন-مُذَمَّمًا عَصَيْنَا + وَأَمْرَهُ أَبَيْنَا + وَدِيْنَهُ قَلَيْنَا ‘নিন্দিতের আমরা অবাধ্যতা করি’। ‘তার নির্দেশ আমরা অমান্য করি’। ‘তার দ্বীনকে আমরা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করি’।[২]

[১]. মুসনাদে বাযযার হা/১৫; বাযযার বলেন, এর চাইতে উত্তম সনদে বিষয়টি বর্ণিত হয়েছে বলে আমরা জানতে পারিনি; মাজমা‘উয যাওয়ায়েদ হা/১১৫২৯।
[২]. ইবনু হিশাম ১/৩৫৬; হাকেম হা/৩৩৭৬, ২/৩৬১ সনদ ছহীহ; আলবানী, ছহীহ সীরাহ নববিইয়াহ ১৩৭ পৃঃ; তাফসীর কুরতুবী, ইবনু কাছীর; সীরাহ ছহীহাহ ১/১৪৭।

আবু লাহাবের পরিণতি

বদর যুদ্ধের এক সপ্তাহ পরে আবু লাহাবের গলায় প্লেগ মহামারীর ফোঁড়া দেখা দেয়। আজকের ভাষায় যাকে ‘গুটি বসন্ত’ (Small Pox) বলা যায়। যার প্রভাবে তার সারা দেহে পচন ধরে ও তাতেই তিনি মারা যান। সংক্রামক ব্যাধি হওয়ার কারণে তার পরিবারের লোকেরা তাকে ছেড়ে চলে যায়। তিনদিন সেখানে লাশ পড়ে থাকার পর দুর্গন্ধের হাত থেকে বাঁচার জন্য কুরায়েশ-এর এক ব্যক্তির সহায়তায় আবু লাহাবের দুই ছেলে লাশটি মক্কার উচ্চ ভূমিতে নিয়ে যায় এবং সেখানেই একটি গর্তে লাঠি দিয়ে ঠেলে ফেলে দেয়। অতঃপর দূর থেকে পাথর ছুঁড়ে গর্ত বন্ধ করে দেয়।[১] যিনি একদিন রাসূল (ছাঃ)-কে পাথর ছুঁড়ে মারতে উদ্যত হয়েছিলেন, তাকেই আজ মরণের পর তার ছেলেরাই পাথর ছুঁড়ে মেরে অনাদরে পুঁতে দিল। তার বিপুল ধন-সম্পদ ও সন্তান- সন্ততি তার কোনই কাজে আসল না। অহংকারের পরিণাম চিরদিন এরূপই হয়ে থাকে।

[১]. ইবনু হিশাম ১/৬৪৬; বায়হাক্বী দালায়েলুন নবুঅত ৩/১৪৫-১৪৬; আল-বিদায়াহ ৩/৩০৯; আর-রাহীক্ব পৃঃ ২২৫-২৬; কুরতুবী, তাফসীর সূরা লাহাব।

আবু লাহাবের স্ত্রীর পরিণতি

মুররাহ আল-হামদানী বলেন, আবু লাহাবের স্ত্রী উম্মে জামীল প্রতিদিন কাঁটাযুক্ত ঝোপের বোঝা এনে মুসলমানদের চলার পথে ছড়িয়ে দিতেন। ইবনু যায়েদ ও যাহহাক বলেন, তিনি রাতের বেলায় একাজ করতেন। একদিন তিনি গলায় বোঝা বহন করে আনতে অপারগ হয়ে একটা পাথরের উপরে বসে পড়েন। তখন ফেরেশতা এসে তাকে পিছন থেকে টেনে ধরে হালাক করে দেয়’ (কুরতুবী, তাফসীর সূরা লাহাব)।

আবু লাহাবের তার সন্তানাদি

আবু লাহাবের উৎবা, উতাইবা ও মু‘আত্তাব নামে তিন পুত্র এবং দুর্রাহ, খালেদা ও ইযযাহ নামে তিন কন্যা ছিল। তন্মধ্যে উৎবা ও উতাইবা রাসূল (ছাঃ) দুই কন্যা রুক্বাইয়া ও উম্মে কুলছূমের স্বামী ছিল। সূরা লাহাব নাযিলের পর আবু লাহাবের নির্দেশে ছেলেরা তাদের স্ত্রীদের তালাক দেয়। পরবর্তীতে তাঁরা ওছমান (রাঃ)-এর সাথে পরপর বিবাহিতা হন। উম্মে কুলছূমের স্বামী উতাইবা রাসূল (ছাঃ)-এর বদদো‘আ প্রাপ্ত হয়ে আবু লাহাবের জীবদ্দশায় কুফরী হালতে বাঘের হামলায় নিহত হয়। বাকী দু’জন পুত্র ও তিন কন্যা মক্কা বিজয়ের পর মুসলমান হন। পুত্রদ্বয় হোনায়েন ও ত্বায়েফ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। হোনায়েন যুদ্ধে সংকটকালে তারা রাসূল (ছাঃ)-এর নিরাপত্তায় দৃঢ় ছিলেন। মু‘আত্তাব এই যুদ্ধে একটি চোখ হারান। মক্কা বিজয়ের পরে অন্যেরা মদীনায় হিজরত করলেও তারা দু’ভাই আমৃত্যু মক্কায় অবস্থান করেন।[১]

[১]. ইবনু সা‘দ, ত্বাবাক্বাতুল কুবরা ক্রমিক ৩৫৫, ৩৫৬ (৪/৪৪-৪৫ পৃঃ), ৪০৯৯-৪১০০ (৮/২৯-৩১ পৃঃ), ৪১২১-২৩ (৮/৪০ পৃঃ), হাকেম হা/৩৯৮৪; মুহিববুদ্দীন ত্বাবারী (মৃ. ৬৯৪ হি.), যাখায়েরুল ‘উক্ববা (কায়রো : ১৩৫৬ হি.) ২৪৯ পৃঃ।

সর্বস্তরের লোকদের নিকট দাওয়াত

ছাফা পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে কুরায়েশদের নিকটে দাওয়াত পৌঁছানোর পর রাসূল (ছাঃ) এবার সর্বস্তরের মানুষের নিকটে দাওয়াত পৌঁছানোর সিদ্ধান্ত নিলেন।

উল্লেখ্য যে, ঐ সময় মক্কায় বিদ্রূপকারীদের নেতা ছিল পাঁচ জন: বনু সাহম গোত্রের ‘আছ বিন ওয়ায়েল, বনু আসাদ গোত্রের আসওয়াদ বিন মুত্ত্বালিব, বনু যোহরা গোত্রের আসওয়াদ বিন ‘আব্দে ইয়াগূছ, বনু মাখযূম গোত্রের অলীদ বিন মুগীরাহ এবং বনু খুযা‘আহ গোত্রের হারিছ বিন তুলাত্বিলা। এই পাঁচ জনই আল্লাহর হুকুমে একই সময়ে মৃত্যুবরণ করে। এভাবেই আল্লাহর ওয়াদা সত্যে পরিণত হয় (ইবনু হিশাম ১/৪০৯-১০)। কেননা আল্লাহ আগেই স্বীয় নবীকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলেন,إِنَّا كَفَيْنَاكَ الْمُسْتَهْزِئِينَ ‘তোমাকে বিদ্রুপকারীদের জন্য আমরাই যথেষ্ট’ (হিজর ১৫/৯৫)।

রাসূল (ছাঃ) মক্কার হাটে-মাঠে-ঘাটে, বাজারে ও বস্তিতে সর্বত্র দাওয়াত ছড়িয়ে দিতে থাকলেন। তিনি ও তাঁর সাথীরা নিরন্তর প্রচেষ্টা চালাতে থাকেন। এ সময় তাঁরা মূর্তিপূজার অসারতা, শিরকী আক্বীদার অনিষ্টকারিতা এবং তাওহীদের উপকারিতা বুঝাতে থাকেন। সাথে সাথে মানুষকে আখেরাতে জবাবদিহিতার বিষয়ে সজাগ করতে থাকেন।

স্মর্তব্য যে, মাক্কী জীবনে যে ৮৬টি সূরা নাযিল হয়েছে, তার প্রায় সবই ছিল আখেরাত ভিত্তিক। এর মাধ্যমে দুনিয়াপূজারী ভোগবাদী মানুষকে আখেরাতমুখী করার চেষ্টা করা হয়েছে। আর এটাই হ’ল যুগে যুগে ইসলামী সমাজ গঠনের প্রধান মাধ্যম। সেই সাথে আরবদের পারস্পরিক গোত্রীয় হিংসা, দলাদলি ও হানাহানির অবসানকল্পে এবং দাস-মনিব ও সাদা-কালোর উঁচু-নীচু ভেদাভেদ চূর্ণ করার লক্ষ্যে তিনি এক আল্লাহর দাসত্বের অধীনে সকল মানুষের সমানাধিকার ঘোষণা করেন।

শিক্ষণীয় বিষয়সমূহ
(১) নিকটাত্মীয়গণ হ’ল মানুষের প্রধান আশ্রয়স্থল। যেকোন সংস্কার আন্দোলনে তাই তাদের অংশগ্রহণ ও সহযোগিতা সর্বাগ্রে প্রয়োজন হয়। সেজন্যেই রাসূল (ছাঃ)-কে প্রথমে তাদের প্রতি দাওয়াত দেওয়ার নির্দেশ প্রদান করা হয়।

(২) নিজেদের ছেলে হিসাবে নিকটাত্মীয়গণ সাধারণভাবে সংস্কারকের প্রতি অনীহা প্রদর্শন করে থাকে। যা অনেক সময় দারুণ মনোকষ্ট এমনকি দৈহিক কষ্টের কারণ হয়ে দেখা দেয়। সে অবস্থায় যাতে রাসূল (ছাঃ) ভেঙ্গে না পড়েন, সেজন্য আগেভাগে বিগত যুগের সাত জন নবীর কষ্ট ভোগের কাহিনী শুনানো হয় সূরা শো‘আরা নাযিল করার মাধ্যমে। এতে বুঝা যায় যে, সংস্কারককে গভীর ধৈর্যশীল হ’তে হয়।

(৩) প্রকাশ্য দাওয়াতের ফলে নিকটাত্মীয়গণের সকলে না এলেও তাদের মধ্যে কেউ ঘোর সমর্থক হবেন, আবার কেউ ঘোর বিরোধী হবেন, এটাই স্বাভাবিক। আবু ত্বালিব ও আবু লাহাব দুই ভাইয়ের দ্বিমুখী অবস্থান তার বাস্তব প্রমাণ বহন করে।

দু’টি দাওয়াত দু’টি আনুগত্যের প্রতি

মুহাম্মাদ (ছাঃ) ও তাঁর চাচা কুরায়েশ নেতা আবু লাহাবের দু’টি দাওয়াত ছিল দু’টি আনুগত্যের প্রতি ও দু’টি সার্বভৌমত্বের প্রতি দাওয়াত। দু’টি ছিল সম্পূর্ণ পরস্পর বিরোধী দাওয়াত। একটিতে ছিল আল্লাহর সার্বভৌমত্বের অধীনে সকল মানুষের অধিকার সমান। অন্যটিতে ছিল মানুষের সার্বভৌমত্বের অধীনে মানুষ মানুষের গোলাম। নিম্নের হাদীছ দু’টি তার জাজ্বল্যমান প্রমাণ।-

عَنْ مُحَمَّدِ بْنِ الْمُنْكَدِرِ أَنَّهُ سَمِعَ رَبِيعَةَ بْنَ عِبَادٍ الدُّؤَلِيَّ يَقُولُ: رَأَيْتُ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِمِنًى فِي مَنَازِلِهِمْ قَبْلَ أَنْ يُهَاجِرَ إِلَى الْمَدِينَةِ يَقُولُ: يَا أَيُّهَا النَّاسُ، إِنَّ اللهَ يَأْمُرُكُمْ أَنْ تَعْبُدُوهُ وَلاَ تُشْرِكُوا بِهِ شَيْئًا. قَالَ: وَوَرَاءَهُ رَجُلٌ يَقُولُ: يَا أَيُّهَا النَّاسُ، إِنَّ هَذَا يَأْمُرُكُمْ أَنْ تَتْرُكُوا دَيْنَ آبَائِكُمْ، فَسَأَلْتُ مَنْ هَذَا الرَّجُلُ؟ قِيلَ: أَبُو لَهَبٍ-

وفى رواية عنه قَالَ: رَأَيْتُ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي الْجَاهِلِيَّةِ بِسُوقِ ذِي الْمَجَازِ وَهُوَ يَقُولُ: يَا أَيُّهَا النَّاسُ، قُولُوا لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ تُفْلِحُوا قَالَ: يُرَدِّدُهَا مِرَارًا وَالنَّاسُ مُجْتَمِعُونَ عَلَيْهِ يَتَّبِعُونَهُ، وَإِذَا وَرَاءَهُ رَجُلٌ أَحْوَلُ ذُو غَدِيرَتَيْنِ وَضِيءُ الْوَجْهِ يَقُولُ: إِنَّهُ صَابِئٌ كَاذِبٌ، فَسَأَلْتُ: مَنْ هَذَا؟ فَقَالُوا: عَمُّهُ أَبُو لَهَبٍ-

‘মু‏হাম্মাদ ইবনুল মুনকাদির বলেন, তিনি রাবী‘আহ বিন এবাদ আদ-দুআলী-কে বলতে শুনেছেন তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে মদীনায় হিজরতের পূর্বে মিনাতে লোকদের তাঁবু সমূহে গিয়ে বলতে শুনেছি, হে লোকসকল! আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন যে, তোমরা তাঁর ইবাদত কর এবং তাঁর সাথে কোন কিছুকে শরীক করো না’। রাবী বলেন, এ সময় তাঁর পিছনে আর একজন ব্যক্তিকে বলতে শুনলাম, হে লোকসকল! নিশ্চয় এই ব্যক্তি তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন যাতে তোমরা তোমাদের বাপ-দাদার ধর্ম পরিত্যাগ কর’। রাবী বলেন, আমি লোকদের জিজ্ঞেস করলাম এ ব্যক্তিটি কে? তারা বলল, আবু লাহাব’ (হাকেম হা/৩৮, হাদীছ ছহীহ)।

একই রাবী কর্তৃক অন্য বর্ণনায় এসেছে, জাহেলী যুগে আমি রাসূল (ছাঃ)-কে যুল-মাজায বাজারে লোকদের উদ্দেশ্যে বার বার বলতে শুনেছি, قُولُوا لآ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ تُفْلِحُوا ‘তোমরা বল ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। তাহ’লে তোমরা সফলকাম হবে’। তাঁর পিছে পিছে আর একজন চোখ ট্যারা, দুই ঝুটি চুল ওয়ালা উজ্জ্বল গৌর বর্ণের ব্যক্তি বলছেন,إِنَّهُ صَابِئٌ كَاذِبٌ ‘লোকটি ধর্মত্যাগী ও মিথ্যাবাদী’। আমি লোকদের জিজ্ঞেস করলাম, এই ব্যক্তিটি কে? লোকেরা বলল, উনার চাচা আবু লাহাব’।[১]

ত্বারেক আল-মাহারেবী বলেন, আমি জাহেলী যুগে যুল-মাজায বাজারে লাল জুববা পরিহিত অবস্থায় রাসূল (ছাঃ)-কে দাওয়াত দিতে শুনেছি যে,يَا أَيُّهَا النَّاسُ، قُولُوا: لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ تُفْلِحُوا ‘হে জনগণ! তোমরা বল ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। তাহ’লে তোমরা সফলকাম হবে’। তাঁর পিছে পিছে একজন লোককে তাঁর পায়ে পাথর ছুঁড়ে মারতে দেখলাম। যা তাঁর দুই গোঁড়ালী ও গোঁড়ালীর উপরাংশ রক্তাক্ত করে দিচ্ছে। আর সে বলছে,يَا أَيُّهَا النَّاسُ لَا تُطِيعُوهُ فَإِنَّهُ كَذَّابٌ ‘হে জনগণ! তোমরা এর আনুগত্য করো না। কারণ সে মহা মিথ্যাবাদী’ (ছহীহ ইবনু খুযায়মাহ হা/১৫৯)।[২]

ভাতিজা ও চাচার দ্বিমুখী দাওয়াত, দ্বিমুখী সার্বভৌমত্বের ও দ্বিমুখী আনুগত্যের প্রতি দাওয়াত। যা সদা সাংঘর্ষিক। ক্বিয়ামত পর্যন্ত সত্য ও মিথ্যার এই দ্বন্দ্ব চলবে। জান্নাত পিয়াসী মানুষ সর্বদা সত্যের উপাসী হবে ও পরকালে জান্নাত লাভে ধন্য হবে। আর প্রকৃত প্রস্তাবে তারাই হ’ল ইহকালে ও পরকালে সফলকাম।

বর্তমান যুগে মুসলমানদের মধ্যে কুরায়েশদের ন্যায় তাওহীদের দাবী আছে। কিন্তু বাস্তবে নেই। যাকে ‘তাওহীদে রুবূবিয়াত’ বলা হয়। অর্থাৎ রব হিসাবে আল্লাহকে স্বীকার করা। পক্ষান্তরে রাসূল (ছাঃ)-এর দাওয়াত ছিল জীবনের সর্বক্ষেত্রে আল্লাহর আনুগত্য করা। যাকে ‘তাওহীদে ইবাদাত’ বা ‘উলূহিয়াত’ বলা হয়। আল্লাহ বলেন, ‘আমি জিন ও ইনসানকে সৃষ্টি করেছি কেবলমাত্র আমার ইবাদত করার জন্য’ (যারিয়াত ৫১/৫৬)। কুরায়েশদের মধ্যে আল্লাহর স্বীকৃতি ছিল। কিন্তু আল্লাহর ইবাদত ছিল না এবং তাদের সার্বিক জীবনে আল্লাহর আনুগত্য ছিল না। এ যুগের মুসলমানদের মধ্যেও একই অবস্থা কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া। অতএব জান্নাত পিয়াসী মুমিনগণ সাবধান!

[১]. হাকেম হা/৩৯, ১/১৫ পৃঃ, হাদীছ ছহীহ, আহমাদ হা/১৬০৬৬।
[২]. হাকেম হা/৪২১৯, ২/৬১১; ছহীহ ইবনু হিববান হা/৬৫৬২; ছহীহ ইবনু খুযায়মাহ হা/১৫৯,; দারাকুৎনী হা/২৯৫৭, সনদ ছহীহ।

দ্বীনের দাওয়াতে জনগণের প্রতিক্রিয়া

প্রথমে ছাফা পর্বতচূড়ার আহবান মক্কা নগরী ও তার আশপাশ এলাকার আবাল-বৃদ্ধ-বণিতার মধ্যে এক নতুনের শিহরণ জাগিয়ে তুলেছিল। অতঃপর সর্বত্র প্রকাশ্য দাওয়াতের প্রতিক্রিয়ায় সকলের মুখে মুখে একই কথার অনুবৃত্তি হ’তে থাকে, কি শুনছি আজ আব্দুল্লাহ্র পুত্রের মুখে। এ যে নির্যাতিত মানবতার প্রাণের কথা। এ যে মযলূমের হৃদয়ের ভাষা। যে ক্রীতদাস ভাবত এটাই তার নিয়তি, সে এখন নিজেকে স্বাধীন মানুষ ভাবতে লাগল। যে নারী ভাবত, সবলের শয্যাসঙ্গিনী হওয়াই তার নিয়তি, সে এখন নিজেকে অধিকার সচেতন সাহসী নারী হিসাবে ভাবতে লাগল। যে গরীব ভাবত সূদখোর মহাজনের করাল গ্রাস হ’তে মুক্তির কোন পথ নেই, সে এখন মুক্তির দিশা পেল। সর্বত্র একটা জাগরণের ঢেউ। একটা নতুনের শিহরণ। এ যেন নিদ্রাভঙ্গের পূর্বে জাগৃতির অনুরণন।

দ্বীনের দাওয়াতে সমাজনেতাদের প্রতিক্রিয়া

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর আহবানের সত্যতা ও যথার্থতার বিষয়ে সমাজনেতাদের মধ্যে কোনরূপ দ্বিমত ছিল না। কিন্তু ধুরন্ধর নেতারা তাওহীদের এ অমর আহবানের মধ্যে তাদের দুনিয়াবী স্বার্থের নিশ্চিত অপমৃত্যু দেখতে পেয়েছিল। এক আল্লাহকে মেনে নিলে শিরক বিলুপ্ত হবে। দেব-দেবীর পূজা বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে সারা আরবের উপর তাদের ধর্মীয় নেতৃত্ব ও পৌরহিত্যের মর্যাদা শেষ হয়ে যাবে। এছাড়া লোকেরা যে পূজার অর্ঘ্য সেখানে নিবেদন করে, তা ভোগ করা থেকে তারা বঞ্চিত হবে। আল্লাহর বিধানকে মানতে গেলে তাদের মনগড়া সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিধানসমূহ বাতিল হয়ে যাবে। ঘরে বসে দাদন ব্যবসার মাধ্যমে চক্রবৃদ্ধি হারে সূদ নিয়ে তারা যেভাবে জোঁকের মত গরীবের রক্ত শোষণ করছিল, তা বন্ধ হয়ে যাবে। যে নারীকে তারা কেবল ভোগের সামগ্রী হিসাবে মনে করে, তাকে পূর্ণ সম্মানে অধিষ্ঠিত করতে হবে। এমনকি তাকে নিজ কষ্টার্জিত সম্পত্তির উত্তরাধিকার দিতে হবে। কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাসদের ‘ভাই’ হিসাবে সমান ভাবতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা যুগ যুগ ধরে যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক নেতৃত্ব তারা দিয়ে আসছিল, তা নিমেষে হারিয়ে যাবে এবং মুহাম্মাদকে নবী মেনে নিলে কেবল তারই আনুগত্য করতে হবে। অতএব মুহাম্মাদ দিন-রাত কা‘বাগৃহে বসে ইবাদত-বন্দেগীতে লিপ্ত থাকুক, আমরাও তার সাথী হ’তে রাযী আছি। কিন্তু তাওহীদের সাম্য ও মৈত্রীর আহবান আমরা কোনমতেই মানতে রাযী নই। এইভাবে প্রধানতঃ সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থের বিপরীত ধারণা করেই তারা রাসূল (ছাঃ)-এর বিরোধিতা করার সিদ্ধান্ত নেয়। আল্লাহ বলেন,قَدْ نَعْلَمُ إِنَّهُ لَيَحْزُنُكَ الَّذِي يَقُولُوْنَ فَإِنَّهُمْ لاَ يُكَذِّبُونَكَ وَلَكِنَّ الظَّالِمِيْنَ بِآيَاتِ اللهِ يَجْحَدُوْنَ ‘তারা যেসব কথা বলে তা যে তোমাকে খুবই কষ্ট দেয়, তা আমরা জানি। তবে ওরা তোমাকে মিথ্যাবাদী বলে না। বরং যালেমরা আল্লাহর আয়াত সমূহকে অস্বীকার করে’ (আন‘আম ৬/৩৩)। যুগে যুগে সকল নবী-রাসূল ও তাঁদের সনিষ্ঠ অনুসারীদের একই অবস্থার সম্মুখীন হ’তে হয়েছে এবং হবে।

সম্প্রদায়ের নেতাদের মন্দ প্রতিক্রিয়ার অন্যতম কারণ ছিল গোত্রীয় হিংসা এবং ভালোর প্রতি হিংসা। যেমন অন্যতম নেতা আখনাস বিন শারীক্ব-এর প্রশ্নের উত্তরে আবু জাহ্ল বলেছিলেন,تَنَازَعْنَا نَحْنُ وَبَنُو عَبْدِ مَنَافٍ الشَّرَفَ... قَالُوا: مِنَّا نَبِيٌّ يَأْتِيهِ الْوَحْيُ مِنَ السَّمَاءِ، فَمَتَى نُدْرِكُ مِثْلَ هَذِهِ؟ وَاللهِ لاَ نُؤْمِنُ بِهِ أَبَدًا وَلاَ نُصَدِّقُهُ ‘বনু ‘আব্দে মানাফের সাথে আমাদের বংশ মর্যাদাগত ঝগড়া আছে’।... তারা বলবে, আমাদের বংশে একজন নবী আছেন, যার নিকটে আসমান থেকে ‘অহি’ আসে। আমরা কিভাবে ঐ মর্যাদায় পৌঁছব? অতএব আল্লাহর কসম! আমরা কখনোই তার উপর ঈমান আনব না বা তাকে সত্য বলে বিশ্বাস করব না’।[১]

উল্লেখ্য যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ছিলেন ‘আব্দে মানাফের পুত্র হাশেম-এর বংশধর। পক্ষান্তরে আবু জাহল ছিলেন বনু মাখযূম গোত্রের। বনু হাশেম গোত্রে নবীর আবির্ভাব হওয়ায় বনু মাখযূম গোত্র তাদের প্রতি হিংসা পরায়ণ ছিল। যদিও সকলে ছিলেন কুরায়েশ বংশীয়।

উর্দূ কবি হালী এই সময়কার অবস্থা বর্ণনা করেন নিম্নোক্ত ভাষায়-

وه بجلى كا كڑكا تها يا صوت ہادى + عرب كى زمين جس نے سارى ہلا دى
نئى اك لگن دل ميں سب كے لگا دى + اك آواز ميں سوتى بستى جگا دى
پڑا ہر طرف غل يہ پيغام حق سے + كہ گوبخ اوٹھے دشت وجبل نام حق سے

(১) এটি বজ্রের ধবনি ছিল, না পথ প্রদর্শকের কণ্ঠ ছিল, আরবের সমগ্র যমীন যা কাঁপিয়ে দিল। (২) নতুন এক বন্ধন সকলের অন্তরে লাগিয়ে দিল, এক আওয়াযেই ঘুমন্ত জাতিকে জাগিয়ে দিল। (৩) সত্যের এ আহবানে সর্বত্র হৈ চৈ পড়ে গেল, সত্যের নামে ময়দান ও পাহাড় সর্বত্র গুঞ্জরিত হ’ল’ (মুসাদ্দাসে হালী -উর্দূ ষষ্ঠপদী, ১৪ পৃঃ)।

[১]. ইবনু হিশাম ১/৩১৫-১৬; সনদ মুনক্বাতি‘ বা যঈফ (তাহকীক ইবনু হিশাম ক্রমিক ৩০৪)। বায়হাক্বী, দালায়েলুন নবুঅত ২/২০৬; আল-বিদায়াহ ৩/৬৪।



**************************
সাইটটি ভিজিট করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আর্টিকেলটি ভাল লাগলে সত্য ও ন্যয়ের পথে অন্য ভাইনদেরকে দাওয়াতের নিয়তে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন। মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে এবং দীন ও মানবতার সেবায় অংশ নিতে OUR ACTION PLAN বাটনে ক্লিক করুন।


এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url