প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর জীবনী [পর্ব-২৭]






পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ট মহামানব আমাদের প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:)। যাকে আল্লাহ সমস্ত মানুষের জন্য অশেষ রহমত স্বরূপ এই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। যে নবী সারা জীবন উম্মতের জন্য সংগ্রাম করেছেন, কাল রোজ হাশরের মাঠেও যিনি উম্মতের জন্যই পেরেশান থাকবেন; সেই প্রাণপ্রিয় নবীকে আমরা কতটুকু চিনি কতটুকু জানি। প্রিয় নবী (সা:) এর জীবনের পরতে পরতে রয়েছে আমাদের জন্য শিক্ষা ও অনুপ্রেরণা। যার জীবনী পড়লে নিজের অজান্তেই চোখের পানি গড়িয়ে পড়ে। সেই নবীর জীবনী কি আমরা সত্যিই জানি? আসুন, আরেকবার দেখে নেই “প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর জীবনী”। যে জীবনী পড়ে বদলে যেতে পারে আপনার আমার জীবন। আল্লাহ আমাদের সবাইকে প্রাণপ্রিয় নবীর (সা:) উম্মত হিসাবে কবুল করুন। আমিন।।

বদর যুদ্ধের বিবরণ

বিগত অভিযানগুলির ন্যায় এ অভিযানেরও উদ্দেশ্য ছিল কুরায়েশ কাফেলাকে আটকানো। তাই অন্যান্য অভিযানের মতই এটাকে ভাবা হয়েছিল। ফলে কেউ যোগ দিয়েছিল, কেউ দেয়নি এবং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কাউকে অভিযানে যেতে বাধ্য করেননি। অবশেষে ৮ই রামাযান সোমবার অথবা ১২ই রামাযান শনিবার ৩১৩, ১৪ বা ১৭ জনের একটি কাফেলা নিয়ে সাধারণ প্রস্তুতিসহ তিনি রওয়ানা হ’লেন। যার মধ্যে ৮২, ৮৩ অথবা ৮৬ জন ছিলেন মুহাজির এবং বাকীগণ ছিলেন আনছার। আনছারগণের মধ্যে ৬১ জন ছিলেন আউস এবং ১৭০ জন ছিলেন খাযরাজ গোত্রের।[1] বিরে সুক্বইয়া নামক স্থানে এসে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) ক্বায়েস বিন আবু ছা‘ছা‘আহকে সংখ্যা গণনা করতে বললেন। পরে সংখ্যা জানতে পেরে রাসূল (ছাঃ) খুশী হয়ে আল্লাহর প্রশংসা করলেন এবং বললেন, তালূতের সৈন্য সংখ্যাও তাই ছিল’।[2] তিন শতাধিক লোকের এই বাহিনীতে মাত্র ২টি ঘোড়া ছিল যুবায়ের ইবনুল ‘আওয়াম ও মিক্বদাদ ইবনুল আসওয়াদের এবং ৭০টি উট ছিল। যাতে দু’তিন জন করে পালাক্রমে সওয়ার হয়ে চলতে হ’ত। রাসূল (ছাঃ), আলী ও আবু লুবাবাহ এবং পরবর্তীতে তার বদলে মারছাদ বিন আবু মারছাদ গানাভীর জন্য একটি উট বরাদ্দ ছিল। যাতে পায়ে হাঁটার পালা আসলে রাসূল (ছাঃ) নিজেও হাঁটতেন। এ সময় মদীনার আমীর নিযুক্ত হন অন্ধ ছাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতূম (রাঃ)।

[1]. ইবনু হিশাম ২/৬১২; ইবনু সা‘দ ২/৮; আর-রাহীক্ব ২০৪-০৫ পৃঃ।
[2]. বুখারী হা/৩৯৫৯; মুসলিম হা/১৭৬৩; বায়হাক্বী-দালায়েল, ৩/৭৩; কুরতুবী হা/৩১৮৮।

ইবনু ইসহাক বলেন, বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুসলমানদের সংখ্যা ছিল ৩১৪ জন। তন্মধ্যে মুহাজির ছিলেন ৮৩ জন। বাকী আনছারগণের মধ্যে আউস গোত্রের ৬১ জন ও খাযরাজ গোত্রের ১৭০ জন (ইবনু হিশাম ১/৭০৬)।

মাদানী বাহিনীর অবস্থান ও পরামর্শ সভা

আবু সুফিয়ানের বাণিজ্য কাফেলার নিরাপদে নিষ্ক্রমন এবং আবু জাহলের নেতৃত্বে মাক্কী বাহিনীর দ্রুত ধেয়ে আসা সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যাফরানে (ذَفرَان) অবস্থানকালেই অবহিত হন। এই অনাকাংখিত পরিস্থিতি এবং অবশ্যম্ভাবী রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের মুকাবিলা কিভাবে করা যায়, এ নিয়ে তিনি মদীনা থেকে ৬৮ কি. মি. দক্ষিণে ‘রাওহা’ (الرَّوْحَاء)-তে অবতরণ করে উচ্চ পর্যায়ের পরামর্শ বৈঠক আহবান করলেন’ (ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা আনফাল ৭ আয়াত)। কেননা তিনি যুদ্ধের জন্য প্রস্ত্ততি নিয়ে মদীনা থেকে বের হননি।

মুহাজিরগণের মধ্যে হযরত আবুবকর ও ওমর (রাঃ) তাদের মূল্যবান পরামর্শ প্রদান করলেন। অতঃপর মিক্বদাদ ইবনুল আসওয়াদ (রাঃ) দাঁড়িয়ে ওজস্বিনী ভাষায় বললেন, يَا رَسُولَ اللهِ، امْضِ لِمَا أَرَاكَ اللهُ فَنَحْنُ مَعَكَ، واللهِ لاَ نَقُولُ لَكَ كَمَا قَالَتْ بَنُو إسْرَائِيلَ لِمُوسَى: اذْهَبْ أَنْتَ وَرَبُّكَ فَقاتِلاَ، إِنَّا هَاهُنا قاعِدُونَ ‘হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহর দেখানো পথে আপনি এগিয়ে চলুন। আমরা আপনার সঙ্গে আছি। আল্লাহর কসম! আমরা আপনাকে ঐরূপ বলব না, যেরূপ বনু ইস্রাঈল তাদের নবী মূসাকে বলেছিল যে, ‘তুমি ও তোমার রব যাও গিয়ে যুদ্ধ কর! আমরা এখানে বসে রইলাম’ (মায়েদাহ ৫/২৪)। বরং আমরা বলব, اِذْهَبْ أَنْتَ وَرَبُّكَ فَقَاتِلاَ إنَّا مَعَكُمَا مُقَاتِلُونَ ‘আপনি ও আপনার রব যান ও যুদ্ধ করুন, আমরা আপনাদের সাথে যুদ্ধরত থাকব’।فَوَ الَّذِيْ بَعَثَكَ بِالْحَقِّ لَوْ سِرْتَ بِنَا إلَى بِرْكِ الْغِمَادِ لَجَالَدْنَا مَعَكَ مِنْ دُونِهِ حَتَّى تَبْلُغَهُ ‘সেই সত্তার কসম, যিনি আপনাকে সত্য সহকারে প্রেরণ করেছেন, যদি আপনি আমাদেরকে নিয়ে ‘বারকুল গিমাদ’[1] পর্যন্ত চলে যান, তবে আমরা অবশ্যই আপনার সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে সেই পর্যন্ত পৌঁছে যাব’। মিক্বদাদের এই জোরালো বক্তব্য শুনে আললাহর রাসূল (ছাঃ) খুবই প্রীত হ’লেন এবং তার জন্য কল্যাণের দো‘আ করলেন’(دَعَا لَهُ بِخَيْرٍ)।[2]

সংখ্যালঘু মুহাজিরগণের উপরোক্ত তিন নেতার বক্তব্য শোনার পর সংখ্যাগুরু আনছারদের পরামর্শ চাইলে আউস গোত্রের নেতা সা‘দ বিন মু‘আয (রাঃ) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি হয়ত আশংকা করছেন যে, আমাদের সঙ্গে আপনার চুক্তি অনুযায়ী আনছারগণ কেবল (মদীনা) শহরে অবস্থান করেই আপনাদের সাহায্য করা কর্তব্য মনে করে। জেনে রাখুন, আমি আনছারদের পক্ষ থেকেই বলছি, যেখানে চান সেখানে আপনি আমাদের নিয়ে চলুন। যার সঙ্গে চান আপনি সন্ধি করুন বা ছিন্ন করুন- সর্বাবস্থায় আমরা আপনার সাথে আছি। যদি আপনি অগ্রসর হয়ে ‘বারকুল গিমাদ’ পর্যন্ত চলে যান, তবুও আমরা আপনার সাথেই থাকব।لَوْ اسْتَعْرَضْتَ بِنَا هَذَا الْبَحْرَ فَخُضْتَهُ لَخُضْنَاهُ مَعَكَ ‘যদি আমাদেরকে নিয়ে আপনি এই সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়েন, তবে আমরাও আপনার সাথে ঝাঁপিয়ে পড়ব’। مَا تَخَلَّفَ مِنَّا رَجُلٌ وَاحِدٌ، فَسِرْ بِنَا عَلَى بَرَكَةِ اللهِ ‘আমাদের একজন লোকও পিছিয়ে থাকবে না। অতএব আপনি আমাদের নিয়ে আল্লাহর নামে এগিয়ে চলুন’। সা‘দের উক্ত কথা শুনে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) খুবই খুশী হ’লেন ও উদ্দীপিত হয়ে বললেন, سِيرُوا عَلَى بَرَكَةِ اللهِ وَأَبْشِرُوا، فَإِنَّ اللهَ تَعَالَى قَدْ وَعَدَنِي إحْدَى الطَّائِفَتَيْنِ واللهِ لَكَأَنِّي الْآنَ أَنْظُرُ إلَى مَصَارِعِ الْقَوْمِ‘আল্লাহর রহমতের উপর তোমরা বেরিয়ে পড়ো এবং সুসংবাদ গ্রহণ কর। কেননা আল্লাহ তা‘আলা আমাকে দু’টি দলের কোন একটির বিজয় সম্পর্কে ওয়াদা দান করেছেন। আল্লাহর কসম! আমি এখন ওদের বধ্যভূমিগুলো দেখতে পাচ্ছি’।[3]

একথাটি কুরআনে এসেছে এভাবে,

وَإِذْ يَعِدُكُمُ اللهُ إِحْدَى الطَّائِفَتِيْنِ أَنَّهَا لَكُمْ وَتَوَدُّوْنَ أَنَّ غَيْرَ ذَاتِ الشَّوْكَةِ تَكُوْنُ لَكُمْ وَيُرِيْدُ اللهُ أَنْ يُحِقَّ الحَقَّ بِكَلِمَاتِهِ وَيَقْطَعَ دَابِرَ الْكَافِرِيْنَ- لِيُحِقَّ الْحَقَّ وَيُبْطِلَ الْبَاطِلَ وَلَوْ كَرِهَ الْمُجْرِمُوْنَ- (الأنفال ৭-৮)

‘আর যখন আল্লাহ দু’টি দলের একটির ব্যাপারে তোমাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, সেটি তোমাদের হস্তগত হবে। আর তোমরা কামনা করছিলে যে, যাতে কোনরূপ কণ্টক নেই, সেটাই তোমাদের ভাগে আসুক (অর্থাৎ বিনা যুদ্ধে তোমরা জয়ী হও)। অথচ আল্লাহ চাইতেন সত্যকে স্বীয় কালামের মাধ্যমে (প্রদত্ত প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে) সত্যে পরিণত করতে এবং কাফিরদের মূল কর্তন করে দিতে’। ‘যাতে তিনি সত্যকে সত্য এবং মিথ্যাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে দেন, যদিও পাপাচারীরা এটাকে অপছন্দ করে’ (আনফাল ৮/৭-৮)।

পরামর্শ সভায় আবু আইয়ূব আনছারীসহ কিছু ছাহাবী বাস্তব অবস্থার বিবেচনায় এবং এই অপ্রস্ত্তত অবস্থায় যুদ্ধ না করে ফিরে যাওয়ার পক্ষে মত প্রকাশ করেন। কেননা তাঁরা এসেছিলেন বাণিজ্য কাফেলা আটকানোর জন্য, বড় ধরনের কোন যুদ্ধ করার জন্য নয়। কিন্তু আল্লাহ এতে নাখোশ হয়ে আয়াত নাযিল করেন,

كَمَا أَخْرَجَكَ رَبُّكَ مِنْ بَيْتِكَ بِالْحَقِّ وَإِنَّ فَرِيْقًا مِّنَ الْمُؤْمِنِيْنَ لَكَارِهُوْنَ- يُجَادِلُوْنَكَ فِي الْحَقِّ بَعْدَ مَا تَبَيَّنَ كَأَنَّمَا يُسَاقُوْنَ إِلَى الْمَوْتِ وَهُمْ يَنْظُرُوْنَ- (الأنفال ৫-৬)-

‘যেমনভাবে তোমাকে তোমার গৃহ থেকে তোমার পালনকর্তা বের করে এনেছেন সত্য সহকারে। অথচ মুমিনদের একটি দল তাতে অনীহ ছিল’। ‘তারা তোমার সাথে বিবাদ করছিল সত্য বিষয়টি (অর্থাৎ যুদ্ধ) প্রকাশিত হওয়ার পর। তাদেরকে যেন মৃত্যুর দিকে হাঁকিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এবং তারা যেন তা স্বচক্ষে দেখতে পাচ্ছে’।[4] অর্থাৎ অসত্যকে প্রতিহত করার জন্য ও সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য নবীকে তার পালনকর্তা যেভাবে মদীনার গৃহ থেকে বের করে এনেছেন, তেমনিভাবে তিনি কাফিরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ প্রস্ত্ততির জন্য এখন যা কিছু করছেন, সবই আল্লাহর হুকুমে করছেন। অতএব তোমাদের উচিত তাকে পূর্ণ সহযোগিতা করা। এভাবে আল্লাহ কোনরূপ পূর্ব ঘোষণা ও প্রয়োজনীয় প্রস্ত্ততি ছাড়াই উভয় বাহিনীকে মুখোমুখি করে দিলেন। যার মধ্যে ছিল তাঁর একটি অত্যন্ত দূরদর্শী পরিকল্পনা। যেমন আল্লাহ বলেন,

إِذْ أَنْتُمْ بِالْعُدْوَةِ الدُّنْيَا وَهُمْ بِالْعُدْوَةِ الْقُصْوَى وَالرَّكْبُ أَسْفَلَ مِنْكُمْ وَلَوْ تَوَاعَدْتُمْ لاَخْتَلَفْتُمْ فِي الْمِيعَادِ وَلَكِنْ لِيَقْضِيَ اللهُ أَمْرًا كَانَ مَفْعُولاً لِيَهْلِكَ مَنْ هَلَكَ عَنْ بَيِّنَةٍ وَيَحْيَى مَنْ حَيَّ عَنْ بَيِّنَةٍ وَإِنَّ اللهَ لَسَمِيعٌ عَلِيمٌ

‘স্মরণ কর, যখন তোমরা (মদীনার) নিকট প্রান্তে ছিলে এবং কাফের বাহিনী ছিল দূরপ্রান্তে। আর (আবু সুফিয়ানের ব্যবসায়ী) কাফেলা ছিল তোমাদের নিম্নভূমিতে। যদি তোমরা উভয় দল আগে থেকে যুদ্ধের ব্যাপারে ওয়াদাবদ্ধ হ’তে, তাহ’লে (সংখ্যালঘু হওয়ার কারণে) তোমরা সে ওয়াদা রক্ষায় মতবিরোধ করতে। কিন্তু আল্লাহ (উভয় দলকে যুদ্ধে সমবেত করার) এমন একটি কাজ সম্পন্ন করতে চেয়েছিলেন, যা নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল। এটা এজন্য যাতে যে ধ্বংস হয় সে যেন (ইসলামের) সত্যতা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ধ্বংস হয় এবং যে বেঁচে থাকে সে যেন সত্য প্রতিষ্ঠার পর বেঁচে থাকে। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বশ্রোতা ও মহাজ্ঞানী’ (আনফাল ৮/৪২)।

পরামর্শ সভায় সবধরনের মতামত আসতে পারে। এটা কোন দোষের ছিল না। কিন্তু ছাহাবায়ে কেরামের উচ্চ মর্যাদার সঙ্গে এই সামান্যতম ভীরুতাকেও আল্লাহ পসন্দ করেননি। তাই উপরোক্ত ধমকিপূর্ণ আয়াত নাযিল হয়। যা ছাহাবায়ে কেরামের ঈমান শতগুণে বৃদ্ধি করে। তিরমিযী, হাকেম, আহমাদ প্রভৃতি হাদীছ গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে যে, বদর যুদ্ধে কাফেররা পরাজিত হবার পর রাসূল (ছাঃ)-কে বলা হ’ল যে, আমাদের কেবল বাণিজ্য কাফেলার বিষয়ে বলা হয়েছিল। এর বেশী কিছু নয়। তখন ঐ ব্যক্তিকে উচ্চৈঃস্বরে ডেকে আববাস বলেন, (তখন তিনি বন্দী ছিলেন), আল্লাহ তাঁকে ওয়াদা করেছিলেন দু’টি দলের একটি সম্পর্কে (আনফাল ৭) এবং সেটি আল্লাহ তাঁকে দিয়েছেন। তখন রাসূল (ছাঃ) বললেন, তুমি ঠিক বলেছ’।[5]

পরামর্শ সভায় যুদ্ধে অগ্রগমনের সিদ্ধান্ত হওয়ার পর আবু লুবাবাহ ইবনু আব্দিল মুনযিরকে ‘আমীর’ নিযুক্ত করে মদীনায় ফেরৎ পাঠানো হয়। অতঃপর কাফেলার মূল পতাকা বহনের দায়িত্ব দেওয়া হয় মদীনায় প্রথম দাঈ মুছ‘আব বিন ওমায়ের (রাঃ)-কে। ইতিপূর্বেকার সকল পতাকার ন্যায় আজকের এ পতাকাও ছিল শ্বেত বর্ণের। ডান বাহুর সেনাপতি নিযুক্ত হন যুবায়ের ইবনুল ‘আওয়াম এবং বাম বাহুর জন্য মিক্বদাদ ইবনুল আসওয়াদ (রাঃ)। পুরা বাহিনীতে এ দু’জনেরই মাত্র দু’টি ঘোড়া ছিল। পশ্চাদ্ভাগের সেনাপতি নিযুক্ত হন ক্বায়েস বিন আবু ছা‘ছা‘আহ (রাঃ)। এতদ্ব্যতীত মুহাজিরগণের পতাকা বাহক হন আলী (রাঃ) এবং আনছারগণের সা‘দ ইবনু মু‘আয (রাঃ) অথবা হুবাব ইবনুল মুনযির। উভয় পতাকাই ছিল কালো রংয়ের। আর সার্বিক কম্যান্ডের দায়িত্বে থাকেন স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)।[6]

[1]. বারকুল গিমাদ : এটির অবস্থান নিয়ে মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেছেন, স্থানটি ইয়ামন সীমান্তে অবস্থিত। কেউ বলেছেন, হিজরের শেষ প্রান্তে। তবে সুহায়লী বলেন, আমি কোন একটি তাফসীরের কিতাবে দেখেছি যে, এটি হাবশার একটি শহর (ইবনু হিশাম ১/৬১৫, টীকা-১)। তাফসীর ইবনু কাছীর সূরা আনফাল ৮ আয়াতের টীকায় বলা হয়েছে, এটি হল মক্কার আগে পাঁচ দিনের দূরত্বে সাগরের তীরবর্তী স্থান।
[2]. আহমাদ হা/১৮৮৪৭; ছহীহাহ হা/৩৩৪০।
[3]. ইবনু হিশাম ১/৬১৫; আহমাদ হা/১৮৮৪৭; ছহীহাহ হা/৩৩৪০; তাফসীর ত্বাবারী হা/১৫৭২০ সনদ ছহীহ; ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা আনফাল ৮ আয়াত; সীরাহ ছহীহাহ ২/৩৫৯ পৃঃ।
[4]. আনফাল ৮/৫-৬; ঐ, তাফসীর ইবনে কাছীর; ফাৎহুল বারী হা/৩৭৩৬ ‘তাফসীর’ অধ্যায়; হায়ছামী বলেন, ত্বাবারাণী বলেছেন, সনদ হাসান।
[5]. তিরমিযী হা/৩০৮০; হাকেম হা/৩২৬১; আহমাদ হা/২০২২; আরনাঊত্ব বলেন, ইকরিমা থেকে সিমাক-এর বর্ণনায় ‘ইযতিরাব’ রয়েছে। এতদসত্ত্বেও হাদীছটি ইমাম তিরমিযী ‘হাসান ছহীহ’ বলেছেন। হাকেম ‘ছহীহ’ বলেছেন। যাহাবী তা সমর্থন করেছেন। ইবনু কাছীর ‘জাইয়িদ’ বলেছেন। তবে আলবানী সনদ ‘যঈফ’ বলেছেন। সনদ যঈফ হ’লেও ঘটনা ছিল বাস্তব। আর তা ছিল এই যে, কাফের পক্ষ পরাজিত হয়েছিল।
[6]. আর-রাহীক্ব ২০৪-০৫ পৃঃ; ইবনু হিশাম ১/৬১২-১৩; আল-বিদায়াহ ৩/২৬০; সীরাহ ছহীহাহ ২/৩৫৬।

কুরায়েশ বাণিজ্য কাফেলার অবস্থা

কুরায়েশ বাণিজ্য কাফেলার নেতা আবু সুফিয়ান অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে পথ চলছিলেন। যাকেই পেতেন, তাকেই মদীনা বাহিনী সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতেন। তিনি একটি সূত্রে জানতে পারলেন যে, কাফেলার উপরে হামলা করার জন্য মুহাম্মাদ নির্দেশ দিয়েছেন। এ সংবাদে ভীত হয়ে তিনি যামযাম বিন আমর আল-গিফারী(ضَمْضم بن عمرو) কে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে মক্কায় পাঠিয়ে দিলেন, যাতে দ্রুত সাহায্যকারী বাহিনী পৌঁছে যায়। এরপর বদর প্রান্তর অতিক্রম করার আগেই তিনি কাফেলা থামিয়ে দিয়ে নিজে অগ্রসর হন এবং মাজদী বিন আমর(مَجْدِى بن عمرو) এর কাছে মদীনা বাহিনীর খবর নেন। তার কাছে জানতে পারেন যে, দু’জন উষ্ট্রারোহীকে তারা দেখেছিল, যারা টিলার পাশে তাদের উট বসিয়ে মশকে পানি ভরে নিয়ে চলে গেছে। সুচতুর আবু সুফিয়ান সঙ্গে সঙ্গে টিলার পাশে গিয়ে উটের গোবর থেকে খেজুরের অাঁটি খুঁজে বের করে বুঝে নেন যে, এটি মদীনার উটের গোবর। ব্যস! তখনই ফিরে এসে কাফেলাকে নিয়ে বদরকে বামে রেখে মূল রাস্তা ছেড়ে ডাইনে পশ্চিম দিকে উপকূলের পথ ধরে দ্রুত চলে গেলেন। এভাবে তিনি স্বীয় কাফেলাকে মদীনা বাহিনীর কবল থেকে বাঁচিয়ে নিতে সক্ষম হ’লেন। অতঃপর তিনি নিরাপদে পার হয়ে আসার খবর মক্কায় পাঠিয়ে দিলেন। যাতে ইতিপূর্বে পাঠানো খবরের কারণে তারা অহেতুক যুদ্ধে বের না হয়।[1]

[1]. আর-রাহীক্ব ২০৭ পৃঃ; ইবনু হিশাম ১/৬১৮।

এখানে রাসূল (ছাঃ)-এর ফুফু আতেকাহ বিনতে আব্দুল মুত্ত্বালিব ও জুহাইম বিন ছালতের দু’টি স্বপ্ন সম্পর্কে বিভিন্ন ইতিহাস গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে। যেখানে বদর যুদ্ধে কুরায়েশ বাহিনীর সাক্ষাৎ পরাজয় ও তাদের নেতাদের নিহত হওয়া সম্পর্কে বলা হয়েছে। আবু জাহল এগুলিকে বনু মুত্ত্বালিবের মিথ্যা রটনা বলে উড়িয়ে দেন। ঘটনা দু’টি বিশুদ্ধ সূত্রে প্রমাণিত নয় (মা শা-‘আ ১০৪ পৃঃ)।

মাক্কী বাহিনীর অগ্রযাত্রা

আবু সুফিয়ানের প্রথম পত্র পেয়ে বাণিজ্য কাফেলা উদ্ধারের জন্য ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য আবু জাহলের নেতৃত্বে ১৩০০ মাক্কী ফৌজ রওয়ানা হয়ে যায়। অতঃপর রাবেগ-এর পূর্ব দিকে জুহফা নামক স্থানে পৌঁছলে পত্রবাহকের মাধ্যমে আবু সুফিয়ানের নিরাপদ প্রত্যাবর্তনের খবর পেয়ে বাহিনীর সবাই মক্কায় ফিরে যেতে চাইল। কিন্তু আবু জাহলের দম্ভের সামনে কারু মতামত গ্রাহ্য হ’ল না। তবু তার আদেশ অমান্য করে আখনাস বিন শারীক্ব আছ-ছাক্বাফী(الْأَخْنَسُ بْنُ شَرِيق الثَّقَفِيُّ)-এর নেতৃত্বে বনু যোহরা(بَنُو زُهْرَة) গোত্রের ৩০০ লোক মক্কায় ফিরে গেল। আখনাস ছিলেন ত্বায়েফের ছাক্বীফ গোত্রের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু তিনি ছিলেন বনু যোহরা গোত্রের মিত্র ও নেতা। তাঁর এই দূরদর্শিতার কারণে তিনি উক্ত গোত্রে আজীবন সম্মানিত নেতা হিসাবে বরিত ছিলেন। বনু হাশেমও ফিরে যেতে চাইল। কিন্তু মুহাম্মাদ-এর স্বগোত্র হওয়ায় তাদের উপরে আবু জাহলের কঠোরতা ছিল অন্যদের চেয়ে বেশী। ফলে তারা ক্ষান্ত হন।

উল্লেখ্য যে, আলী (রাঃ)-এর বড় ভাই ত্বালিব বিন আবু ত্বালিব বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করলেও জনৈক কুরায়েশ নেতার সাথে বাদানুবাদের প্রেক্ষিতে প্রত্যাবর্তনকারীদের সাথে মক্কায় ফিরে যান (ইবনু হিশাম ১/৬১৯)।

অতঃপর আবু জাহল বদর অভিমুখে রওয়ানা হন এবং দর্পভরে বলেন, আল্লাহর কসম! আমরা বদরে যাব ও সেখানে তিনদিন থাকব ও আমোদ-ফূর্তি করে পান ভোজন করব। এর ফলে সমগ্র আরব জাতির উপরে আমাদের শক্তি প্রকাশিত হবে ও সকলে ভীত হবে। এই সময় সব মিলিয়ে মাক্কী বাহিনীতে এক হাযার ফৌজ ছিল। তন্মধ্যে দু’শো অশ্বারোহী, ছয়শো লৌহবর্ম ধারী এবং গায়িকা বাঁদী দল তাদের বাদ্যযন্ত্রাদি সহ ছিল। প্রতি মনযিলে খাদ্যের জন্য তারা ৯টি বা ১০টি করে উট যবেহ করত।

উল্লেখ্য যে, আবু সুফিয়ানের বাণিজ্য কাফেলায় সকল গোত্রের লোকদের মালামাল ছিল। তাছাড়া মাক্কী বাহিনীতে বনু ‘আদী ব্যতীত কুরায়েশদের সকল গোত্রের লোক বা তাদের প্রতিনিধি যোগদান করেছিল। অথবা যোগদানে বাধ্য করা হয়েছিল। যেমন রাসূল (ছাঃ)-এর চাচা আববাস, হযরত আলীর দু’ভাই ত্বালেব ও ‘আক্বীল। রাসূল (ছাঃ)-এর জামাতা আবুল ‘আছ সহ বনু হাশেমের লোকেরা। তারা আসতে অনিচ্ছুক ছিলেন। নেতাদের মধ্যে কেবল আবু লাহাব যাননি। তিনি তার বদলে তার কাছে ঋণগ্রস্ত একজন ব্যক্তিকে পাঠিয়েছিলেন।[1]

[1]. ইবনু হিশাম ১/৬১৮-১৯; আল-বিদায়াহ ৩/২৬০।

বদরযুদ্ধে রওয়ানাকালে আবু জাহেল

আবু জাহল মক্কা থেকে রওয়ানার সময় দলবল নিয়ে কা‘বাগৃহের গেলাফ ধরে কেঁদে কেঁদে প্রার্থনা করেছিল, اللَّهُمَّ انْصُرْ أَقْرَانَا لِلضَّيْفِ وَأَوْصَلَنَا لِلرَّحِمِ وَأَفَكَّنَا لِلْعَانِيْ، إِنْ كَانَ مُحَمَّدٌ عَلَى حَقٍّ فَانْصُرْهُ وَاِنْ كُنَّا عَلَى حَقٍّ فَانْصُرْنَا، وَرُوِي اَنَّهُمْ قَالُوْا : اللهُمَّ انْصُرْ أَعْلَى الْجُنْدَيْنِ وَأَهْدَى الْفِئَتَيْنِ وَاَكْرَمَ الْحِزْبَيْنِ ‘হে আল্লাহ! তুমি সাহায্য কর আমাদের মধ্যেকার সর্বাধিক অতিথি আপ্যায়নকারী, সর্বাধিক আত্মীয়তা রক্ষাকারী ও বন্দী মুক্তি দানকারী দলকে’। ‘হে আল্লাহ! মুহাম্মাদ যদি সত্যের উপরে থাকে, তবে তুমি তাকে সাহায্য কর। আর যদি আমরা সত্যের উপর থাকি, তবে আমাদেরকে সাহায্য কর’। ‘হে আল্লাহ! তুমি সাহায্য কর আমাদের দু’দলের মধ্যকার সেরা সেনাদলকে, সেরা হেদায়াতপ্রাপ্ত ও সেরা সম্মানিত দলকে’।[1]

এর দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, আবু জাহল আল্লাহকে সর্বশক্তিমান হিসাবে বিশ্বাস করত। যাকে ‘তওহীদে রুবূবিয়াত’ বলা হয়। এর ফলে কেউ মুসলমান হ’তে পারে না। কেননা মুসলিম হওয়ার জন্য ‘তওহীদে ইবাদত’-এর উপর ঈমান আনা যরূরী। যার মাধ্যমে মানুষ সার্বিক জীবনে আল্লাহর দাসত্ব করতে স্বীকৃত হয়। সেই সাথে শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর উপর ঈমান ও তাঁর আনীত শরী‘আতের বিধানসমূহ পালন করা অপরিহার্য।

অতঃপর রওয়ানা হওয়ার সময় তাদের মনে পড়ল বনু বকর গোত্রের কথা। যাদের সঙ্গে তাদের শত্রুতা ছিল। পথিমধ্যে তারা হামলা করতে পারে। ফলে মাক্কী বাহিনী দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পড়ে গেল। কিন্তু শয়তানী প্ররোচনায় গর্বোদ্ধত হয়ে তারা বেরিয়ে পড়ল। উক্ত প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, وَلاَ تَكُونُوا كَالَّذِينَ خَرَجُوا مِنْ دِيَارِهِمْ بَطَرًا وَرِئَاءَ النَّاسِ وَيَصُدُّونَ عَنْ سَبِيلِ اللهِ وَاللهُ بِمَا يَعْمَلُونَ مُحِيطٌ ‘আর তোমরা তাদের মত হয়ো না যারা তাদের ঘর (মক্কা) থেকে বের হয়েছিল দর্পভরে ও লোক দেখিয়ে এবং যারা আল্লাহর পথ থেকে লোকদের বাধা দিত। অথচ আল্লাহ তাদের সকল কাজ পরিবেষ্টন করে আছেন’ (আনফাল ৮/৪৭)। এভাবে শয়তান মানুষের অন্তরে ধোঁকা সৃষ্টি করে। যাতে তার স্বাভাবিক বোধশক্তি লুপ্ত হয় এবং সে পথভ্রষ্ট হয়। যেমন বদরের যুদ্ধে শয়তানের ভূমিকা সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, وَإِذْ زَيَّنَ لَهُمُ الشَّيْطَانُ أَعْمَالَهُمْ وَقَالَ لاَ غَالِبَ لَكُمُ الْيَوْمَ مِنَ النَّاسِ وَإِنِّي جَارٌ لَكُمْ فَلَمَّا تَرَاءَتِ الْفِئَتَانِ نَكَصَ عَلَى عَقِبَيْهِ وَقَالَ إِنِّي بَرِيءٌ مِنْكُمْ إِنِّي أَرَى مَا لاَ تَرَوْنَ إِنِّي أَخَافُ اللهَ وَاللهُ شَدِيدُ الْعِقَابِ ‘আর যখন শয়তান (বদরের দিন) কাফেরদের নিকট তাদের কাজগুলিকে শোভনীয় করে দেখিয়েছিল এবং বলেছিল আজ লোকদের মধ্যে তোমাদের উপর বিজয়ী হবার মত কেউ নেই। আর আমি তোমাদের সাথে আছি। কিন্তু যখন দু’দল মুখোমুখী হ’ল, তখন সে পিছন ফিরে পালালো এবং বলল, আমি তোমাদের থেকে মুক্ত। আমি যা দেখেছি তোমরা তা দেখোনি। আমি আল্লাহকে ভয় করি। আর আল্লাহ কঠিন শাস্তিদাতা’ (আনফাল ৮/৪৮)।

শয়তানের দোসর মুনাফিকদের সম্পর্কেও আল্লাহ অনুরূপ বলেন,إِذْ يَقُولُ الْمُنَافِقُونَ وَالَّذِينَ فِي قُلُوبِهِمْ مَرَضٌ غَرَّ هَؤُلاَءِ دِينُهُمْ وَمَنْ يَتَوَكَّلْ عَلَى اللهِ فَإِنَّ اللهَ عَزِيزٌ حَكِيمٌ ‘যেদিন মুনাফিকরা এবং যাদের অন্তরে রোগ ছিল, তারা বলেছিল, এদের দ্বীন এদেরকে (মুসলমানদেরকে) প্রতারিত করেছে (অর্থাৎ ধর্মান্ধ করেছে)। অথচ যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ভরসা করে (আল্লাহ তার জন্য যথেষ্ট)। কেননা আল্লাহ মহা পরাক্রান্ত ও প্রজ্ঞাময়’ (আনফাল ৮/৪৯)। অতঃপর মানুষের বিরুদ্ধে শয়তানের চিরন্তন রীতি সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,

كَمَثَلِ الشَّيْطَانِ إِذْ قَالَ لِلْإِنْسَانِ اكْفُرْ فَلَمَّا كَفَرَ قَالَ إِنِّي بَرِيءٌ مِنْكَ إِنِّي أَخَافُ اللهَ رَبَّ الْعَالَمِينَ- فَكَانَ عَاقِبَتَهُمَا أَنَّهُمَا فِي النَّارِ خَالِدَيْنِ فِيهَا وَذَلِكَ جَزَاءُ الظَّالِمِينَ

‘(মুনাফিকরা) শয়তানের মত। যে মানুষকে কাফের হ’তে বলে। অতঃপর যখন সে কাফের হয়, তখন শয়তান বলে, আমি তোমার থেকে মুক্ত। আমি বিশ্বপালক আল্লাহকে ভয় করি’। ‘অতঃপর উভয়ের পরিণতি হয় এই যে, তারা জাহান্নামে যাবে এবং সেখানে চিরকাল বসবাস করবে। আর এটাই হ’ল যালেমদের শাস্তি’ (হাশর ৫৯/১৬-১৭)।[2] বস্ত্ততঃ আবু জাহল শয়তানের ধোঁকায় পড়েই রাসূল (ছাঃ)-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধে রওয়ানা হয়েছিল। অতঃপর কুরায়েশ বাহিনী যথারীতি দ্রুতবেগে এসে বদর উপত্যকার শেষপ্রান্তে টিলার অপর পার্শ্বে শিবির সন্নিবেশ করে।

[1]. তাফসীর কাশশাফ, বাহরুল মুহীত্ব, ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা আনফাল ১৯ আয়াত; ইবনু হিশাম ১/৬৬৮; বায়হাক্বী, দালায়েল ৩/৭৪ টীকা-৪ (৩); যাদুল মা‘আদ ৩/১৬০; আল-বিদায়াহ ৩/২৮২।
[2]. প্রসিদ্ধ আছে যে, ইবলীস এ সময় বনু কিনানাহ গোত্রের নেতা সুরাক্বাহ বিন মালেক বিন জু‘শুম আল-মুদলিজীর রূপ ধারণ করে এসে বলল, ‘আমি তোমাদের বন্ধু’ (أَنَا لَكُمْ جَارٌ)। আমি তোমাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিচ্ছি। এই আশ্বাস পাওয়ার পর কুরায়েশগণ মদীনা অভিমুখে খুব দ্রুতবেগে বদর প্রান্তরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে যায় (আর-রাহীক্ব ২০৬ পৃঃ; ইবনু হিশাম ১/৬১২)। বর্ণনাটি ‘মুরসাল’ বা যঈফ (মা শা-‘আ ১০৮ পৃঃ)।

মাদানী বাহিনীর বদরে উপস্থিতি

রাওহাতে অনুষ্ঠিত পরামর্শ সভায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) ‘বদর’ অভিমুখে রওয়ানা হন। অতঃপর ‘ছাফরা’ টিলা সমূহ অতিক্রম করে বদর প্রান্তরের নিকটবর্তী স্থানে অবতরণ করেন। সেখান থেকে তিনি বাসবাস বিন আমর আল-জুহানী এবং ‘আদী বিন আবুয যাগবা আল-জুহানীকে বদরের খবরাখবর নেবার জন্য পাঠান’ (মুসলিম হা/১৯০১)।

এরপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আলী, যুবায়ের ও সা‘দ বিন আবু ওয়াকক্বাছের নেতৃত্বে একটি গোয়েন্দা দল পাঠান শত্রুপক্ষের আরও তথ্যাদি সংগ্রহের জন্য। তারা গিয়ে দেখেন যে, দু’জন লোক বদরের ঝর্ণাধারা থেকে পানির মশক ভরছে। তাঁরা তাদের পাকড়াও করে নিয়ে এলেন। অতঃপর জিজ্ঞাসাবাদে ও সামান্য পিটুনী দেওয়ার পরে জানতে পারলেন যে, এরা আবু সুফিয়ানের লোক নয়। বরং তারা কুরায়েশ বাহিনীর লোক। কুরায়েশ বাহিনী উপত্যকার শেষপ্রান্তে টিলার অপর পার্শ্বে শিবির গেড়েছে। তাদের জন্য সে উটের পিঠে করে পানি বহন করে নিয়ে যাচ্ছে’।[1] তারপর ওদের নেতৃবর্গের নাম জিজ্ঞেস করলে তিনি আবু জাহল, উৎবা, শায়বা, উমাইয়া বিন খালাফ প্রমুখ মক্কার সেরা ব্যক্তিবর্গের নামগুলি জানতে পারেন। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘এইটি অমুকের নিহত হওয়ার স্থান, এইটি অমুকের নিহত হওয়ার স্থান’। রাবী আনাস (রাঃ) বলেন, ‘তাদের নিহতদের কেউই উক্ত ইশারার স্থান থেকে দূরে যেতে পারেনি’।[2] তবে তারা সঠিক সংখ্যা বলতে পারল না। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, দৈনিক কয়টা উট যবহ করা হয়? তারা বলল, নয়টা অথবা দশটা। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, তাহ’লে ওদের সংখ্যা নয়শত অথবা হাযার-এর মধ্যে হবে। কেননা একটি উট ১০০ জনের বা তার কাছাকাছিদের জন্য।[3]

এরপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নির্দেশে মুসলিম বাহিনী দ্রুত গিয়ে এশার সময় বদরের উপরে দখল নিল, যা ছিল ঝর্ণাধারার পাশেই। অতঃপর আউস নেতা সা‘দ বিন মু‘আয (রাঃ)-এর প্রস্তাবক্রমে যুদ্ধক্ষেত্রের উত্তর-পূর্ব পার্শ্বে একটি উঁচু টিলার উপরে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর জন্য তাঁবুর (عَرِيْشٌ) ব্যবস্থা করা হ’ল। সেখানে তাঁর সাথে কেবল আবুবকর (রাঃ) রইলেন এবং পাহারায় রইলেন সা‘দ বিন মু‘আয-এর নেতৃত্বে একদল আনছার যুবক। সা‘দ সেখানে বিশেষ সওয়ারীও প্রস্ত্তত রাখলেন। তিনি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বললেন, যদি আমরা যুদ্ধে পরাজিত হই, তাহ’লে আপনি এই সওয়ারীতে করে দ্রুত মদীনায় চলে যাবেন। কেননা فَقَدْ تَخَلَّفَ عَنْكَ أَقْوَامٌ، يَا نَبِيَّ اللهِ، مَا نَحْنُ بِأَشَدَّ لَكَ حُبًّا مِنْهُمْ ... يَمْنَعُكَ اللهُ بِهِمْ، يُنَاصِحُونَكَ وَيُجَاهِدُونَ مَعَكَ ‘সেখানে রয়েছে হে আল্লাহর নবী! আপনার জন্য আমাদের চাইতে অধিক জীবন উৎসর্গকারী একদল ভাই। আপনাকে ভালোবাসায় আমরা তাদের চাইতে অধিকতর অগ্রগামী নই। যারা যুদ্ধে কখনোই আপনার থেকে পিছনে থাকবে না। আল্লাহ তাদের মাধ্যমে আপনাকে হেফাযত করবেন। তারা আপনার শুভাকাংখী এবং তারা আপনার সঙ্গে থেকে জিহাদ করবে’। সা‘দের এ বীরত্বব্যঞ্জক কথায় আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) অত্যন্ত প্রীত হ’লেন ও তার জন্য কল্যাণের দো‘আ করলেন(دَعَا لَهُ بِخَيْرٍ)।[4]

অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যুদ্ধ কৌশল অনুযায়ী সেনাদলকে বিন্যস্ত করেন এবং সুষ্ঠুভাবে শিবির সন্নিবেশ করেন।

[1]. ইবনু হিশাম ১/৬১৬; যাদুল মা‘আদ ৩/১৫৬।
[2]. মুসলিম হা/১৭৭৯; আবুদাঊদ হা/২৬৮১।
[3]. আহমাদ হা/৯৪৮, সনদ ছহীহ; ইবনু হিশাম ১/৬১৬-১৭।

(১) প্রসিদ্ধ আছে যে, এ সময়ে রাসূল (ছাঃ) বলে ওঠে هَذِهِ مَكَّةُ قَدْ أَلْقَتْ إلَيْكُمْ أَفْلاَذَ كَبِدِهَا-‘এই যে মক্কা তার কলিজার টুকরাগুলোকে তোমাদের কাছে নিক্ষেপ করেছে’ বর্ণনাটির সনদ ‘মুরসাল’ (আলবানী, ফিক্বহুস সীরাহ ২২২ পৃঃ; মা শা-‘আ ১০৬ পৃঃ)।
(২) আরও প্রসিদ্ধ আছে যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বদরে পৌঁছে শত্রুবাহিনীর তথ্য জানার জন্য পায়ে হেঁটে নিজেই রওয়ানা হন আবুবকর (রাঃ)-কে সাথে নিয়ে। সেখানে এক বৃদ্ধের সঙ্গে সাক্ষাৎ হ’লে তিনি তার কাছে উভয় বাহিনী সম্পর্কে জানতে চান। বৃদ্ধ তাদেরকে তারা কোন বাহিনীর লোক সেকথা জানানোর শর্তে তথ্য দিল যে, আমি রওয়ানা হবার যে সংবাদ পেয়েছি, তাতে মুহাম্মাদের বাহিনী আজকে অমুক স্থানে রয়েছে এবং কুরায়েশ বাহিনী অমুক স্থানে রয়েছে। বৃদ্ধের অনুমান সঠিক ছিল। এবার শর্তানুযায়ী রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) জবাব দিলেন, نَحْنُ مِنْ مَاءٍ ‘আমরা একই পানি হ’তে’ (অর্থাৎ একই বংশের)। রাসূল (ছাঃ)-এর এই ইঙ্গিতপূর্ণ জবাবে বৃদ্ধ কিছুই বুঝতে না পেরে বিড় বিড় করতে করতে চলে গেল (ইবনু হিশাম ১/৬১৬; আর-রাহীক্ব ২১০ পৃঃ)। বর্ণনাটির সনদ মুনক্বাতি‘ (যঈফ), মা শা-‘আ ১০৫ পৃঃ।
[4]. ইবনু হিশাম ১/৬২০-২১; আর-রাহীক্ব ২১১-১২ পৃঃ; সীরাহ ছহীহাহ ২/৩৬২।

প্রসিদ্ধ আছে যে, এ সময় সামরিক বিষয়ে দক্ষ ছাহাবী হুবাব ইবনুল মুনযির ইবনুল জামূহ (حُباب بن المنذر ابن الجموح) বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! এখানে কি আল্লাহর নির্দেশক্রমে অবতরণ করলেন, না-কি যুদ্ধকৌশল হিসাবে? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, যুদ্ধকৌশল মনে করে’। তখন তিনি বললেন, ‘এটি উপযুক্ত স্থান নয়। কেননা এখান থেকে আগে বা পিছে যাবার কোন সুযোগ নেই’। অতএব আরো এগিয়ে কুরায়েশ শিবিরের নিকটবর্তী প্রস্রবণটি আমাদের দখলে নিতে হবে এবং সবগুলি ঝর্ণাস্রোত ঘুরিয়ে এক জায়গায় এনে পানি এক স্থানে সঞ্চয় করতে হবে। কুরায়েশরা টিলার মাথায় উচ্চভূমিতে অবস্থান করছে। যুদ্ধ শুরু হ’লে পানির প্রয়োজনে ওরা নীচে এসে আর পানি পাবে না। তখন পানির সঞ্চয়টি থাকবে আমাদের দখলে’। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তার পরামর্শ গ্রহণ করলেন এবং এগিয়ে গিয়ে কুরায়েশ বাহিনীর নিকটবর্তী পানির প্রস্রবণটি দখলে নিলেন। তারপর অন্যান্য সব ব্যবস্থা শেষ করলেন (ইবনু হিশাম ১/৬২০; আর-রাহীক্ব ২১১ পৃঃ; সীরাহ ছহীহাহ ২/৩৬০)। হুবাবের পরামর্শদানের পর জিব্রীল অবতরণ করেন ও রাসূল (ছাঃ)-কে বলেন, আল্লাহ আপনাকে সালাম দিয়েছেন এবং বলেছেন যে, হুবাবের উক্ত রায় সঠিক’ (ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা আনফাল ৭ আয়াত)। উক্ত মর্মের বর্ণনাগুলির সনদ ‘মুনকার’ ও যঈফ (আলবানী, ফিক্বহুস সীরাহ ২২৪ পৃঃ; মা শা-‘আ ১১০ পৃঃ)। বরং ছহীহ হাদীছসমূহ দ্বারা এটাই প্রমাণিত যে, রাসূল (ছাঃ) তাঁর ছাহাবীগণের সাথে পরামর্শক্রমেই যুদ্ধকৌশল নির্ধারণ করেছিলেন। ‘অহি’ বহির্ভূত সকল বিষয়ে তিনি এভাবেই সিদ্ধান্ত নিতেন।

বর্ষাস্নাত রাত্রি ও গভীর নিদ্রা

বদর যুদ্ধের পূর্বরাত। সৈন্যদের শ্রেণীবিন্যাস শেষ হয়েছে। সবাই ক্লান্ত-শ্রান্ত। হঠাৎ সামান্য বৃষ্টি এলো। মুসলিম বাহিনী কেউ গাছের নীচে কেউ ঢালের নীচে ঘুমে এলিয়ে পড়ল। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন বাহিনীর সকল ক্লান্তি দূর হয়ে গেল এবং যুদ্ধের জন্য দেহমন প্রস্ত্তত হয়ে গেল। বালু-কংকর সব জমে দৃঢ় হয়ে গেল। ফলে চলাফেরায় স্বাচ্ছন্দ্য এল। সেই সাথে অধিকহারে বৃষ্টির পানি সঞ্চয়ের ব্যবস্থা হয়ে গেল।

এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, إِذْ يُغَشِّيْكُمُ النُّعَاسَ أَمَنَةً مِّنْهُ وَيُنَزِّلُ عَلَيْكُم مِّنَ السَّمَاءِ مَاءً لِّيُطَهِّرَكُمْ بِهِ وَيُذْهِبَ عَنْكُمْ رِجْزَ الشَّيْطَانِ وَلِيَرْبِطَ عَلَى قُلُوبِكُمْ وَيُثَبِّتَ بِهِ الأَقْدَامَ ‘স্মরণ কর সে সময়ের কথা, যখন তিনি তাঁর পক্ষ থেকে প্রশান্তির জন্য তোমাদেরকে তন্দ্রায় আচ্ছন্ন করেন এবং তোমাদের উপরে আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করেন। এর মাধ্যমে তোমাদেরকে পবিত্র করার জন্য, তোমাদের থেকে শয়তানের কুমন্ত্রণা দূরীভূত করার জন্য, তোমাদের হৃদয়গুলি পরস্পরে আবদ্ধ করার জন্য এবং তোমাদের পাগুলিকে দৃঢ় রাখার জন্য’ (আনফাল ৮/১১)।

শয়তানের কুমন্ত্রণা এই যে, সে যেন দুর্বলচিত্ত মুসলমানদের মধ্যে এই প্রশ্ন ঢুকিয়ে দেবার সুযোগ না পায় যে, আমরা যদি ন্যায় ও সত্যের পথে থাকব এবং আমরা যদি আল্লাহর বন্ধু হই, তাহ’লে আমরা এই নিম্নভূমিতে ধূলি-কাদার মধ্যে কেন থাকব? এটি নিঃসন্দেহে আমাদের পরাজয়ের লক্ষণ। অথচ কুরায়েশরা কাফের হওয়া সত্ত্বেও উচ্চ ভূমিতে আছে। তারা উট যবেহ করে খাচ্ছে আর ফূর্তি করছে। এটা নিশ্চয়ই তাদের জন্য বিজয়ের লক্ষণ। সকালেই যেখানে যুদ্ধের সম্মুখীন হ’তে হবে, সেখানে রাতেই যদি সংখ্যালঘু মুসলিম বাহিনীর মধ্যে এ ধরনের বিভ্রান্তি ঢুকে যায়, তাহ’লে সেটা সমূহ ক্ষতির কারণ হবে। সেকারণ আল্লাহ বৃষ্টি বর্ষণের মাধ্যমে তাদেরকে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন করে দিলেন। ফলে ঘুম থেকে উঠে প্রফুল্লচিত্তে সবাই যুদ্ধে জয়ের জন্য একাট্টা হয়ে দ্রুত প্রস্ত্তত হয়ে গেল।

আলী (রাঃ) বলেন যে, বদর যুদ্ধের রাতে এমন কেউ বাকী ছিল না যে, যিনি ঘুমাননি। কেবল রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ব্যতীত। তিনি সারা রাত জেগে ছালাতে রত থাকেন। তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) বারবার স্বীয় প্রভুর নিকট দো‘আ করতে থাকেন, اللَّهُمَّ إِنَّكَ إِنْ تُهْلِكْ هَذِهِ الْعِصَابَةَ لاَ تُعْبَدْ فِى الأَرْضِ أَبَداً ‘হে আল্লাহ! যদি তুমি এই দলকে ধ্বংস করে দাও, তাহ’লে জনপদে তোমার ইবাদত করার আর কেউ থাকবে না’। অতঃপর সকাল হলে তিনি সবাইকে ডাকেন, الصَّلاَةَ عِبَادَ اللهِ ‘আল্লাহর বান্দারা! ছালাত’। অতঃপর সবাই জমা হ’লে তিনি ফজরের জামা‘আত শেষে সবাইকে যুদ্ধের জন্য উৎসাহিত করেন’।[1]

আলী (রাঃ) বলেন, لَقَدْ رَأَيْتُنَا يَوْمَ بَدْرٍ وَنَحْنُ نَلُوذُ بِرَسُولِ اللهِ صلى الله عليه وسلم- وَهُوَ أَقْرَبُنَا إِلَى الْعَدُوِّ وَكَانَ مِنْ أَشَدِّ النَّاسِ يَوْمَئِذٍ بَأْساً ‘বদরের যুদ্ধের দিন আমরা সকলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকটে আশ্রয় নিয়েছিলাম। তিনি আমাদের মধ্যে শত্রুর সর্বাধিক নিকটবর্তী ছিলেন এবং আমাদের সকলের চাইতে সর্বাধিক বড় যোদ্ধা ছিলেন’ (আহমাদ হা/৬৫৪, সনদ ছহীহ)।

[1]. আহমাদ হা/২০৮, ৯৪৮; সীরাহ ছহীহাহ ২/৩৬০ পৃঃ।

মাক্কী বাহিনীর দিশাহারা অবস্থা

প্রত্যুষে কুরায়েশ বাহিনী পাহাড় থেকে নীচে অবতরণ করে হতবাক হয়ে গেল। পানির উৎসের উপরে রাতারাতি মুসলিম বাহিনীর দখল কায়েম হয়ে গেছে। হাকীম বিন হেযাম সহ অতি উৎসাহী কয়েকজন কুরায়েশ সেনা সরাসরি রাসূল (ছাঃ)-এর টিলার সম্মুখস্থ পানির হাউযের দিকে অগ্রসর হ’ল। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদের ছেড়ে দেবার নির্দেশ দিলেন। ফলে যারা সেখান থেকে পানি পান করল, তারা সবাই পরে যুদ্ধে নিহত হ’ল। একমাত্র হাকীম পান করেননি। তিনি বেঁচে যান। পরে তিনি পাক্কা মুসলিম হয়ে যান। এ ঘটনাকে স্মরণ করে হাকীম বিন হেযাম শপথ করার সময় সর্বদা বলতেন لاَ وَالَّذِي نَجَّانِي يَوْمَ بَدْرٍ ‘ঐ সত্তার কসম! যিনি আমাকে বদরের দিন রক্ষা করেছেন’। ঘটনাটি বহু পূর্বেকার তালূত বাহিনীর ঘটনার সাথে তুলনীয়। সেদিন যারা নদীর পানি পান করেছিল, তাদের কেউই তালূতের সাথে জালূতের বিরুদ্ধে জিহাদে শরীক হ’তে পারেনি’।[1]

কুরায়েশ নেতারা অবস্থার ভয়াবহতা বুঝতে পারল এবং নিজেদের বোকামিতে দুঃখে-ক্ষোভে হাত-পা ছুঁড়তে লাগল। তারা মুসলিম বাহিনীর অবস্থা ও সংখ্যা নিরূপণের জন্য ওমায়ের বিন ওয়াহাব আল-জুমাহী নামক একজন অশ্বারোহীকে প্রেরণ করল। সে গিয়ে মুসলিম বাহিনীর চারদিক প্রদক্ষিণ করে এসে বলল, তিন শো বা তার কিছু কমবেশী হবে’। তবে আরেকটু সময় দাও, আমি দেখে আসি, ওদের পিছনে কোন সাহায্যকারী সেনাদল আছে কি-না। সে আবার ছুটলো এবং বহু দূর ঘুরে এসে বলল, ওদের পিছনে কাউকে দেখলাম না। তবে সে বলল,يَا مَعْشَرَ قُرَيْشٍ: الْبَلاَيَا تَحْمِلُ الْمَنَايَا ... لَيْسَ مَعَهُمْ مَنَعَةٌ وَلاَ مَلْجَأٌ إلاَّ سُيُوفُهُمْ ‘হে কুরায়েশগণ, বিপদ এসেছে মৃত্যুকে সাথে নিয়ে। ... তাদের সাথে কোন শক্তি নেই বা কোন আশ্রয় নেই কেবল তাদের তরবারি ছাড়া’। অতএব واللهِ مَا أَرَى أَنْ يُقْتَلَ رَجُلٌ مِنْهُمْ حَتّى يَقْتُلَ رَجُلاً مِنْكُمْ ... فَرُوا رَأْيَكُمْ ‘আল্লাহর কসম, তোমাদের একজন নিহত না হওয়া পর্যন্ত তাদের একজন নিহত হবে না’। ... অতএব তোমরা চিন্তা-ভাবনা কর’।[2] তার এ রিপোর্ট শুনে হাকীম বিন হেযাম বয়োজ্যেষ্ঠ কুরায়েশ নেতা উৎবা বিন রাবী‘আহর কাছে এসে যুদ্ধ না করে ফিরে যাবার ব্যাপারে বুঝাতে লাগলেন। তিনি রাযী হ’লেন। এমনকি ইতিপূর্বে নাখলা যুদ্ধে মুসলমানদের হাতে রজবের শেষ দিনে হারাম মাসে নিহত আমর ইবনুল হাযরামীর রক্তমূল্য তিনি নিজ থেকে দিতে চাইলেন। উৎবা বললেন, সমস্যা হ’ল ইবনুল হানযালিয়াহকে নিয়ে (আবু জাহলের মায়ের নাম ছিল হানযালিয়াহ)। তুমি তার কাছে যাও।

অতঃপর উৎবা দাঁড়িয়ে সকলের উদ্দেশ্যে বললেন, হে কুরায়েশগণ! মুহাম্মাদ ও তার সাথীদের সঙ্গে যুদ্ধ করায় তোমাদের কোন গৌরব নেই। কেননা তাতে তোমরা তোমাদের চাচাতো ভাই বা খালাতো ভাই বা মামাতো ভাইয়ের বা নিজ গোত্রের লোকদের রক্তাক্ত চেহারা দেখবে, যা তোমাদের কাছে মোটেই পসন্দনীয় হবে না।فَارْجِعُوا وَخَلُّوا بَيْنَ مُحَمَّدٍ وَبَيْنَ سَائِرِ الْعَرَبِ ‘অতএব তোমরা ফিরে চল এবং মুহাম্মাদ ও গোটা আরব দুনিয়াকে ছেড়ে দাও। যদি তারা তাকে মেরে ফেলে, তবে সেটা তাই-ই হবে, যা তোমরা চেয়েছিলে। আর যদি তা না হয়, তাহ’লে সে তোমাদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবে এজন্য যে, তোমরা তার সাথে সেরূপ ব্যবহার করোনি, যেরূপ তোমরা চেয়েছিলে’।

এদিকে হাকীম বিন হেযাম আবু জাহলের কাছে গিয়ে নিজের ও উৎবার মতামত ব্যক্ত করে মক্কায় ফিরে যাবার জন্য তাকে অনুরোধ করলেন। এতে আবু জাহল ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে বলে উঠলেন, انتفخَ واللهِ سَحْرُهُ ‘আল্লাহর কসম! উৎবার উপরে মুহাম্মাদের জাদু কার্যকর হয়েছে’।كَلاَّ واللهِ لاَ نَرْجِعُ حَتَّى يَحْكُمَ اللهُ بَيْنَنَا وَبَيْنَ مُحَمَّدٍ ‘কখনোই না। আল্লাহর কসম! আমরা ফিরে যাব না, যতক্ষণ না আল্লাহ আমাদের ও মুহাম্মাদের মাঝে একটা ফায়ছালা করে দেন’। তিনি বললেন, ‘এতক্ষণে বুঝলাম যে, উৎবার পুত্র আবু হুযায়ফা যে মুসলমান হয়ে হিজরত করে আগে থেকেই মুহাম্মাদের দলে রয়েছে এবং যুদ্ধ বাধলে সে নিহত হবে, সেই ভয়ে উৎবা যুদ্ধ না করেই ফিরে যেতে চাচ্ছে’।

হাকীমের কাছ থেকে আবু জাহলের এইসব কথা শুনে উৎবার বিচারবুদ্ধি লোপ পেল। তার সুপ্ত পৌরুষ জেগে উঠলো। ক্ষুব্ধ চিৎকারে তিনি যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে ছুটে চললেন। ওদিকে আবু জাহল ‘আমের ইবনুল হাযরামীকে গিয়ে বললেন, দেখছ কি! তোমার ভাই আমরের রক্তের প্রতিশোধ আর নেওয়া হ’ল না। ঐ দেখ কাপুরুষ উৎবা পালাচ্ছে। শীঘ্র উঠে আর্তনাদ শুরু কর’। একথা শোনা মাত্র ‘আমের তার সারা দেহে ধুলো-বালি মাখতে মাখতে এবং গায়ের কাপড় ছিঁড়তে ছিঁড়তে নাখলা যুদ্ধে নিহত ভাই ‘আমর ইবনুল হাযরামীর নামে واعَمْراه واعَمْراه (হায় আমর! হায় আমর!) বলে আর্তনাদ করে বেড়াতে লাগল। আর যায় কোথায়। মুহূর্তের মধ্যে মুশরিক শিবিরে যুদ্ধের আগুন জ্বলে উঠল। রণোন্মত্ত কুরায়েশ বাহিনী যুদ্ধের ময়দানে ছুটে চলল।[3] হাকীম বিন হেযামের সকল প্রচেষ্টা ভন্ডুল হয়ে গেল কেবলমাত্র আবু জাহলের হঠকারিতা ও ধূর্তামির কারণে।[4]

এ সময় রাসূল (ছাঃ) লাল উটের উপরে সওয়ার উৎবা বিন রাবী‘আহর দিকে উদ্দেশ্য করে বললেন, إنْ يُطِيْعُوهُ يَرْشُدُوْا ‘যদি তার দল তার আনুগত্য করত, তাহ’লে তারা সঠিক পথে থাকতো’ (ইবনু হিশাম ১/৬২১)। অর্থাৎ যদি তারা উৎবাহর কথামত মক্কায় ফিরে যেত, তাহ’লে তাদের মঙ্গল হ’ত। এর মধ্যে রাসূল (ছাঃ)-এর শান্তিবাদী নীতি ফুটে ওঠে।

[1]. ইবনু হিশাম ১/৬২২; আল-বিদায়াহ ৩/২৬৮; সূরা বাক্বারাহ ২/২৪৯ আয়াত।
[2]. ইবনু হিশাম ১/৬২২; সনদ জাইয়িদ; সীরাহ ছহীহাহ ২/৩৫৯ পৃঃ।
[3]. ইবনু হিশাম ১/৬২৩; আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ৩/২৬৯।
[4]. তারীখু ত্বাবারী ২/৪৪৩, ৪২৪-২৫; সনদ হাসান; সীরাহ ছহীহাহ ২/৩৫৯ পৃঃ।

আবু জাহেলের দো‘আ

মাক্কী বাহিনী যখন মাদানী বাহিনীর নিকটবর্তী হ’ল, তখন আবু জাহল আল্লাহর নিকটে প্রার্থনা করে বললেন,اللَّهُمَّ أَقْطَعُنَا لِلرَّحِمِ وَآتَانَا بِمَا لاَ نَعْرِفُ فَأَحِنْهُ الْغَدَاةَ اي فأهلكه ‘হে আল্লাহ! আমাদের উভয়দলের মধ্যে যে দল অধিক আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী এবং আমাদের নিকট এমন বস্ত্ত (কুরআন) আনয়নকারী যা আমরা জানি না, তুমি তাকে ধ্বংস করে দাও’![1] অন্য বর্ণনায় এসেছে, যুদ্ধের শুরুতে তিনি বলেছিলেন, اللهُمَّ أَيَّنَا كَانَ أَحَبُّ إلَيْكَ وَأَرْضَى عِنْدَكَ فَانْصُرْهُ الْيَوْمَ اللَّهُمَّ اَوْلاَنَا بِالْحَقِّ فَانْصُرْهُ الْيَوْمَ ‘হে আল্লাহ! আমাদের মধ্যে যে তোমার নিকটে সর্বাধিক প্রিয় ও তুমি যার প্রতি সর্বাধিক সন্তুষ্ট, আজ তুমি তাকে সাহায্য কর। হে আল্লাহ! আমাদের মধ্যে যে দল সর্বাধিক হক-এর উপরে আছে, তুমি আজ তাকে সাহায্য কর’।[2]

এদিকে ইঙ্গিত করে আল্লাহ বলেন, إِنْ تَسْتَفْتِحُوا فَقَدْ جَاءَكُمُ الْفَتْحُ وَإِنْ تَنْتَهُوا فَهُوَ خَيْرٌ لَكُمْ وَإِنْ تَعُودُوا نَعُدْ وَلَنْ تُغْنِيَ عَنْكُمْ فِئَتُكُمْ شَيْئًا وَلَوْ كَثُرَتْ وَأَنَّ اللهَ مَعَ الْمُؤْمِنِينَ ‘যদি তোমরা ফায়ছালা চাও, তবে সেটাতো তোমাদের সামনে এসেই গেছে। আর যদি ক্ষান্ত হও, তবে সেটাই তোমাদের জন্য উত্তম। কিন্তু যদি তোমরা ফের আগে বাড়ো, তাহ’লে আমরাও ফিরে আসব। (মনে রেখ) তোমাদের দল যত বড়ই হৌক, তা তোমাদের কোন কাজে আসবেনা। বস্ত্ততঃ আল্লাহ মুমিনদের সাথেই থাকেন’ (আনফাল ৮/১৯)।

[1]. হাকেম হা/৩২৬৪, ২/৩২৮; সনদ ছহীহ; ইবনু হিশাম ১/৬২৮; মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বা হা/৩৭৮২৯; তাফসীর কাশশাফ প্রভৃতি।
[2]. যাদুল মা‘আদ ৩/১৬৫; সীরাহ হালাবিইয়াহ ২/৪১৮; আর-রাহীক্ব পৃঃ ২১৬।

মুসলিম বাহিনী

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিজের বাহিনীকে দ্রুত প্রস্ত্তত ও সারিবদ্ধ করে ফেললেন। এরি মধ্যে জনৈক সাউয়াদ ইবনু গাযিইয়াহ(سَوَّادُ بنُ غَزِيَّةَ) সারি থেকে কিছুটা আগে বেড়ে এল। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তার পেটে তীর দিয়ে টোকা মেরে পিছিয়ে যাবার ইঙ্গিত দিয়ে বললেন,اسْتَوِ يَا سَوَّادُ ‘সমান হয়ে যাও হে সাউয়াদ!’ সাথে সাথে সে বলে উঠলো, হে আল্লাহর রাসূল, আপনি আমাকে কষ্ট দিয়েছেন। বদলা দিন! রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তখন নিজের পেট আলগা করে দেন ও বদলা নিতে বলেন। তখন সে ছুটে এসে তাঁকে জড়িয়ে ধরে পেটে চুমু খেতে লাগলো’। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে বললেন, কিজন্য তুমি এরূপ করলে? সে বলল, আমাদের সামনে যে অবস্থা আসছে তাতো আপনি দেখছেন। সেজন্য আমি চেয়েছিলাম যে, আপনার সাথে আমার শেষ আদান-প্রদান যেন এটাই হয় যে, আমার দেহচর্ম আপনার দেহচর্মকে স্পর্শ করুক’। তার এ মর্মস্পর্শী কথা শুনে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তার জন্য কল্যাণের দো‘আ করলেন(دَعَا لَهُ بِخَيْرٍ)।[1] রাসূল (ছাঃ)-এর এ কাজের মধ্যে মানবিক সাম্যের এক উত্তম নমুনা রয়েছে, যা নিঃসন্দেহে এক ঈর্ষণীয় বিষয়।

অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদেরকে বললেন, চূড়ান্ত নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত কেউ যুদ্ধ শুরু করবে না। ব্যাপকহারে তীরবৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত কেউ তীর ছুঁড়বে না এবং তোমাদের উপরে তরবারি ছেয়ে না যাওয়া পর্যন্ত তরবারি চালাবে না’। তিনি আরও বলেন, বনু হাশেমকে জোর করে যুদ্ধে আনা হয়েছে। তাদের সাথে আমাদের কোন যুদ্ধ নয়। অতএব তাদের কোন ব্যক্তি সামনে পড়ে গেলে তাকে যেন কেউ আঘাত না করে। আববাসকে যেন হত্যা না করা হয়। অনুরূপভাবে আবুল বাখতারী বিন হেশামকেও হত্যা করো না। কেননা এরা মক্কায় আমাদের কোনরূপ কষ্ট দিত না। বরং সাহায্যকারী ছিল।

উল্লেখ্য যে, বনু হাশিমের বিরুদ্ধে কুরায়েশদের বয়কটনামা যারা ছিঁড়ে ফেলেছিল, তাদের একজন ছিলেন আবুল বাখতারী। কিন্তু যুদ্ধে আবুল বাখতারী নিহত হয়েছিলেন তার নিজস্ব হঠকারিতার জন্য। তিনি তার সঙ্গী কাফের বন্ধুকে ছাড়তে চাননি। ফলে যুদ্ধে তারা উভয়ে নিহত হয়।[2] অতঃপর রাসূল (ছাঃ) ও আবুবকর (রাঃ) টিলার উপরে সামিয়ানার নীচে নিজ স্থানে চলে যান।

[1]. ইবনু হিশাম ১/৬২৬; সিলসিলা ছহীহাহ হা/২৮৩৫; আল-বিদায়াহ ৩/২৭০-৭১।
[2]. ইবনু হিশাম ১/৬২৮-৩০; সীরাহ ছহীহাহ ২/৩৬৭ পৃঃ।



**************************************
>>> Welcome, You are now on Mohammadia Foundation's Website. Please stay & Tune with us>>>


এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url