প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর জীবনী [পর্ব-২৫]




আরবে নতুন যুগের সূচনা


আহলে ছুফফাহ বা আছহাবে ছুফফাহ

মক্কা থেকে আগত মুহাজিরগণ মদীনায় এসে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকতেন। অতঃপর মসজিদে নববী নির্মাণ শেষে তার পিছনে একটি ছাপড়া দেওয়া হয়। যেখানে নিরাশ্রয় মুহাজিরগণ এসে বসবাস করতেন। ‘ছুফফাহ’ অর্থ ছাপড়া। যা দিয়ে ছায়া করা হয়। এভাবে মুহাজিরগণই ছিলেন আহলে ছুফফার প্রথম দল। যাঁদেরকেصُفَّةُ الْمُهَاجِرِينَ বলা হ’ত (আবুদাঊদ হা/৪০০৩)। এছাড়া অন্যান্য স্থান হ’তেও অসহায় মুসলমানরা এসে এখানে সাময়িকভাবে আশ্রয় নিতেন (আহমাদ হা/১৬০৩১)। পরবর্তীতে কোন ব্যবস্থা হয়ে গেলে তারা সেখানে চলে যেতেন। এখানে সাময়িক আশ্রয় গ্রহণকারীগণ ইতিহাসে ‘আহলে ছুফফাহ’ বা ’আছহাবে ছুফফাহ’ নামে খ্যাতি লাভ করেন। বিখ্যাত হাদীছবেত্তা ছাহাবী হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) এখানকার অন্যতম সদস্য ও দায়িত্বশীল ছিলেন। যিনি ওমর (রাঃ)-এর যুগে বাহরায়েন এবং মু‘আবিয়া (রাঃ) ও মারওয়ানের সময় একাধিকবার মদীনার গবর্ণর নিযুক্ত হন। তিনি ৫৭ হিজরীতে ৭৮ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।[1]

অনেক সময় মদীনার ছাহাবীগণও ‘যুহ্দ’ ও দুনিয়াত্যাগী জীবন যাপনের জন্য তাদের মধ্যে এসে বসবাস করতেন। যেমন কা‘ব বিন মালেক আনছারী, হানযালা বিন আবু ‘আমের ‘গাসীলুল মালায়েকাহ’, হারেছাহ বিন নু‘মান আনছারী প্রমুখ। চাতালটি যথেষ্ট বড় ছিল। কেননা এখানে যয়নব বিনতে জাহশের সাথে রাসূল (ছাঃ)-এর বিবাহের ওয়ালীমা খানায় প্রায় তিনশ’র মত মানুষ(كَانُوا زُهَاءَ ثَلاثِمِائَةٍ) জমা হয়েছিলেন।[2] তাদের সংখ্যা কম-বেশী হ’ত। তবে সাধারণতঃ সর্বদা ৭০ জনের মত থাকতেন। কখনো অনেক বেড়ে যেত। খাযরাজ নেতা সা‘দ বিন ওবাদাহ (রাঃ) একবার তাদের মধ্যে থেকে একাই আশি জনকে মেহমানদারী করেছিলেন।

[1]. তাহযীবুত তাহযীব, ক্রমিক সংখ্যা ১২১৬, ১২/২৮৮ পৃঃ; মুসলিম হা/৮৭৭; মিশকাত হা/৮৩৯। যে সকল বিদ্বান আবু হুরায়রা (রাঃ)-কে ‘গায়ের ফক্বীহ’ বলেন, তারা বিষয়টি লক্ষ্য করুন। কেননা ঐরূপ কোন ব্যক্তি গবর্ণরের মত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে আসীন হ’তে পারেন না। যেমন হানাফী উছূলে ফিক্বহ বা ব্যবহারিক আইন সূত্রে বলা হয়েছে, الرَّاوِى إن عُرِفَ بالفقه والةَّقَدُّم فى الإجةهاد كالخلفاء الراشدين والعَبَادِلَة كان حديثُهُ حُجَّةً يُةْرَكُ به القياسُ... وإن عُرِفَ بالعَدَالَةِ والضَّبْطِ دُون الفقه كأنس وأبى هريرة، إِنْ وَافَقَ حديثُهُ القياسَ عُمِلَ به وإن خالفه لم يُةْرَكْ الا بالضَّرُورة- ‘রাবী যদি ফিক্বহ ও ইজতিহাদে অগ্রগামী হওয়ার ব্যাপারে প্রসিদ্ধ হন, যেমন চার খলীফা ও চার আব্দুল্লাহ, তাহ’লে তাঁর হাদীছ দলীল হিসাবে গণ্য হবে এবং সে অবস্থায় ক্বিয়াস পরিত্যক্ত হবে।... আর যদি ফিক্বহ ব্যতীত কেবল ন্যায়নিষ্ঠা ও তীক্ষ্ণ স্মৃতির ব্যাপারে প্রসিদ্ধ হন, যেমন আনাস ও আবু হুরায়রা; যদি তাঁর হাদীছ ক্বিয়াসের অনুকূলে হয়, তাহ’লে তার উপরে আমল করা যাবে। আর যদি তার বিপরীত হয়, তাহ’লে তা পরিত্যাগ করা যাবে না বিশেষ প্রয়োজন ব্যতীত’ (আহমাদ মোল্লা জিয়ূন (মৃ. ১১৩০ হি.), নূরুল আনওয়ার (দেউবন্দ মাকতাবা থানবী, ইউপি, ভারত : এপ্রিল ১৯৮৩) ‘রাবীদের প্রকারভেদ’ অধ্যায়, ‘রাবীর অবস্থা সমূহ’ অনুচ্ছেদ ১৮২-৮৩ পৃঃ)। এ কথার প্রতিবাদ করেন হেদায়ার ভাষ্যকার প্রখ্যাত হানাফী ফক্বীহ কামাল ইবনুল হুমাম (৭৯০-৮৬১ হি.)। তিনি বলেন, كَيْفَ؟ وهو لا يَعْمَلُ بِفَتْوَى غيره وكان يُفْتِى فى زمان الصحابة رضوان الله تعالى عليهم وكان يُعَارِضُ أَجِلَّةَ الصحابة كإبن عباس... ‘এটা কিভাবে হ’তে পারে? অথচ তিনি অন্যের ফাৎওয়ার উপর আমল করতেন না। তিনি ছাহাবায়ে কেরামের যামানায় ফাৎওয়া দিতেন এবং তিনি ইবনু আববাসের ন্যায় বড় বড় ছাহাবীর ফাৎওয়ার বিরোধিতা করতেন... (ঐ, পৃঃ ১৮৩ টীকা -৪)।

উল্লেখ্য যে, আবু হুরায়রা (রাঃ) ছিলেন সর্বাধিক হাদীছবেত্তা ছাহাবী। অতএব ফাৎওয়া দেওয়ার অধিকার তাঁরই সবচেয়ে বেশী হওয়া উচিত। তিনি ছিলেন হাদীছ মুখস্থ করা বিষয়ে রাসূল (ছাঃ)-এর বিশেষ দো‘আ প্রাপ্ত ছাহাবী (বুখারী হা/১১৯)। যাঁর মুখস্থকৃত হাদীছের সংখ্যা ছিল ৫৩৭৪। তিনি সহ ৭জন শ্রেষ্ঠ হাদীছ বর্ণনাকারী ছাহাবী হ’লেন যথাক্রমে আব্দুল্লাহ বিন ওমর ২৬৩০, আনাস বিন মালিক ২২৮৬, আয়েশা (রাঃ) ২২১০, আব্দুল্লাহ বিন আববাস ১৬৬০, জাবের বিন আব্দুল্লাহ ১৫৪০ এবং আবু সাঈদ খুদরী ১১৭০। বাকী ছাহাবীগণ এরপরের।

[2]. ইবনু আবী হাতেম হা/১৭৭৫৯, তাফসীর সূরা আহযাব ৫৩-৫৪ আয়াত; ইবনু কাছীর, তাফসীর ঐ।

আহলে ছুফফা’র সংখ্যা

আবু নু‘আইম তাঁর ‘হিলইয়াতুল আউলিয়া’ গ্রন্থে আছহাবে ছুফফাহর একশ’র অধিক নাম লিপিবদ্ধ করেছেন। যাদের মধ্যে প্রসিদ্ধ ছিলেন, হযরত আবু হুরায়রা দাওসী, আবু যার গিফারী আনছারী, যিনি স্বেচ্ছায় সেখানে অবস্থান করতেন। ওয়াছেলা বিন আসক্বা‘, কা‘ব বিন মালেক, সালমান ফারেসী, হানযালা বিন আবু ‘আমের, হুযায়ফা ইবনুল ইয়ামান, রিফা‘আহ আবু লুবাবাহ আনছারী, আব্দুল্লাহ যুল-বাজাদাইন, খাববাব ইবনুল আরাত, আব্দুল্লাহ বিন মাস‘ঊদ, ছুহায়েব বিন সিনান রূমী, রাসূল (ছাঃ)-এর মুক্তদাস শুক্বরান, সাফীনাহ ও ছাওবান। বেলাল বিন রাবাহ, ইরবায বিন সারিয়াহ, আবু সাঈদ খুদরী প্রমুখ।

আছহাবে ছুফফাহর সদস্যগণ অধিকাংশ সময় ই‘তিকাফ, ইবাদত ও তেলাওয়াতে লিপ্ত থাকতেন। একে অপরকে কুরআন শিক্ষা দিতেন ও লেখা-পড়া শিখাতেন। তাদের কেউ কেউ বিভিন্ন বিষয়ে প্রসিদ্ধি অর্জন করেন। যেমন আবু হুরায়রাহ (রাঃ) হাদীছ বর্ণনার ক্ষেত্রে এবং হুযায়ফা ইবনুল ইয়ামান ফিৎনা সম্পর্কিত হাদীছসমূহ বর্ণনার ক্ষেত্রে।

অধিকাংশ সময় সমাজ থেকে দূরে থাকলেও তাদের কেউ কেউ বিভিন্ন জিহাদে অংশগ্রহণ করেছেন। এমনকি শহীদ হয়েছেন। যেমন বদরে শহীদদের মধ্যে ছিলেন ছাফওয়ান বিন বায়যা, খুরাইম বিন ফাতেক আসাদী, খোবায়েব বিন ইয়াসাফ, সালেম বিন উমায়ের প্রমুখ। ওহোদের শহীদদের মধ্যে ছিলেন হানযালা ‘গাসীলুল মালায়েকাহ’। কেউ হোদায়বিয়ার সন্ধিকালে উপস্থিত ছিলেন। যেমন জারহাদ বিন খুওয়াইলিদ, আবু সারীহাহ গিফারী। তাদের মধ্যে কেউ খায়বরে শহীদ হয়েছিলেন। যেমন ছাক্বফ বিন আমর। কেউ তাবূকে শহীদ হয়েছিলেন। যেমন আব্দুল্লাহ যুল বিজাদায়েন। কেউ ভন্ডনবীদের বিরুদ্ধে ইয়ামামাহর যুদ্ধে শহীদ হন। যেমন আবু হুযায়ফাহর মুক্তদাস সালেম ও যায়েদ ইবনুল খাত্ত্বাব (রাযিয়াল্লাহু ‘আনহুম)। প্রকৃত প্রস্তাবে তারা ছিলেন রাতের বেলা ইবাদত গুযার ও দিনের বেলায় ঘোড় সওয়ার।

তাদের সম্পর্কে বিশেষভাবে কুরআনে কয়েকটি আয়াত নাযিল হয়। যেমন সূরা বাক্বারাহ ২৭৩ আয়াত ও সূরা তওবাহ ৯১ আয়াত। তাঁদের সম্পর্কে ওয়াক্বেদী, ইবনু সা‘দ, আবু নাঈম, তাক্বিউদ্দীন সুবকী, সামহূদী প্রমুখ বিদ্বানগণ পৃথক পৃথক গ্রন্থ সংকলন করেছেন (সীরাহ ছহীহাহ ১/২৫৭-৭১)। আয়াত দু’টি নিম্নরূপ:

لِلْفُقَرَاءِ الَّذِينَ أُحْصِرُوا فِي سَبِيلِ اللهِ لاَ يَسْتَطِيعُونَ ضَرْبًا فِي الْأَرْضِ يَحْسَبُهُمُ الْجَاهِلُ أَغْنِيَاءَ مِنَ التَّعَفُّفِ تَعْرِفُهُمْ بِسِيمَاهُمْ لاَ يَسْأَلُونَ النَّاسَ إِلْحَافًا وَمَا تُنْفِقُوا مِنْ خَيْرٍ فَإِنَّ اللهَ بِهِ عَلِيمٌ

‘তোমরা ব্যয় কর ঐসব অভাবীদের জন্য, যারা আল্লাহর পথে আবদ্ধ হয়ে গেছে, যারা ভূ-পৃষ্ঠে বিচরণে সক্ষম নয়। না চাওয়ার কারণে অজ্ঞ লোকেরা তাদের অভাবমুক্ত মনে করে। তুমি তাদের চেহারা দেখে চিনতে পারবে। তারা মানুষের কাছে নাছোড়বান্দার মত প্রার্থী হয় না। আর তোমরা উত্তম মাল হ’তে যা কিছু ব্যয় কর, নিশ্চয়ই আল্লাহ তা সম্যকভাবে অবহিত’ (বাক্বারাহ ২/২৭৩)।

দ্বিতীয় আয়াতটি হ’ল,

لَيْسَ عَلَى الضُّعَفَاءِ وَلاَ عَلَى الْمَرْضَى وَلاَ عَلَى الَّذِينَ لاَ يَجِدُونَ مَا يُنْفِقُونَ حَرَجٌ إِذَا نَصَحُوا لِلَّهِ وَرَسُولِهِ مَا عَلَى الْمُحْسِنِينَ مِنْ سَبِيلٍ وَاللهُ غَفُورٌ رَحِيمٌ ‘কোন অভিযোগ নেই দুর্বলদের উপর, রোগীদের উপর ও ব্যয়ভার বহনে অক্ষমদের উপর, যদি তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি খালেছ ঈমান রাখে। বস্ত্ততঃ সৎকর্মশীলদের বিরুদ্ধে কোনরূপ অভিযোগ নেই। আর আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়াবান’ (তওবাহ ৯/৯১)।

আনছার ও মুহাজিরগণের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব বন্ধন

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আনাস বিন মালেকের গৃহে আনছার ও মুহাজিরদের নেতৃস্থানীয় ৯০ জন ব্যক্তির এক আনুষ্ঠানিক বৈঠক আহবান করেন। যেখানে উভয় দলের অর্ধেক অর্ধেক সদস্য উপস্থিত ছিলেন’।[1] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদের পরস্পর দু’জনের মধ্যে ইসলামী ভ্রাতৃত্বের (الْمَؤَاخَاةُ الْإِسْلاَمِيَّةُ) বন্ধন স্থাপন করেন এই শর্তে যে, ‘তারা একে অপরের দুঃখ-বেদনার সাথী হবেন এবং মৃত্যুর পরে পরস্পরের সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবেন’। তবে উত্তরাধিকার লাভের শর্তটি ২য় হিজরীতে বদর যুদ্ধের পর অবতীর্ণ আয়াতের মাধ্যমে রহিত হয়ে যায়। যেখানে বলা হয়, وَأُوْلُوا الْأَرْحَامِ بَعْضُهُمْ أَوْلَى بِبَعْضٍ فِيْ كِتَابِ اللهِ إِنَّ اللهَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيْمٌ ‘রক্ত সম্পর্কিত আত্মীয়গণ আল্লাহর কিতাবে পরস্পরের অধিক হকদার। নিশ্চয়ই আল্লাহ সকল বিষয়ে অধিক জ্ঞাত’ (আনফাল ৮/৭৫)। এর ফলে উত্তরাধিকার লাভের বিষয়টি রহিত হ’লেও তাদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন ছিল অটুট এবং অনন্য। বিশ্ব ইতিহাসে যার কোন তুলনা নেই। ভ্রাতৃত্ব বন্ধনের এই ঘটনা ১ম হিজরী সনেই ঘটেছিল মসজিদে নববী নির্মাণকালে অথবা নির্মাণ শেষে। তবে ঠিক কোন তারিখে ঘটেছিল, সেটা সঠিকভাবে জানা যায় না। ইবনু আব্দিল বার্র এটিকে হিজরতের ৫ মাস পরে বলেছেন। ইবনু সা‘দ এটিকে হিজরতের পরে এবং বদর যুদ্ধের পূর্বে বলেছেন (সীরাহ ছহীহাহ ১/২৪৩)। কয়েকটি দৃষ্টান্ত নিম্নে প্রদত্ত হ’ল।-

[1]. যাদুল মা‘আদ ৩/৫৬; বুখারী হা/৭৩৪০; সীরাহ ছহীহাহ ১/২৪৪।

আনছার ও মুহাজিরগণের ভ্রাতৃত্বের নমুনা

আব্দুর রহমান বিন ‘আওফ

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মুহাজির আব্দুর রহমান বিন ‘আওফকে আনছার সা‘দ বিন রবী‘-এর সাথে ভ্রাতৃত্ব বন্ধন স্থাপন করে দেন। অতঃপর সা‘দ তার মুহাজির ভাইকে বললেন, ‘আনছারদের মধ্যে আমি সর্বাপেক্ষা ধনী। আপনি আমার সম্পদের অর্ধেক গ্রহণ করুন এবং আমার দু’জন স্ত্রীর মধ্যে যাকে আপনি পসন্দ করেন, তাকে আমি তালাক দিয়ে দিব। ইদ্দত শেষে আপনি তাকে বিবাহ করবেন’। আব্দুর রহমান বিন ‘আওফ তার আন্তরিকতায় মুগ্ধ হয়ে তাকে দো‘আ করলেন, بَارَكَ اللهُ لَكَ فِى أَهْلِكَ وَمَالِكَ ‘আল্লাহ আপনার পরিবারে ও সম্পদে বরকত দান করুন’! আপনি আমাকে আপনাদের বাজার দেখিয়ে দিন। অতঃপর তাঁকে বনু ক্বায়নুক্বা-র বাজার দেখিয়ে দেওয়া হ’ল। তিনি সেখানে গিয়ে পনীর ও ঘি-এর ব্যবসা শুরু করলেন এবং কিছুদিনের মধ্যে সচ্ছলতা লাভ করলেন। এক সময় তিনি বিয়ে-শাদীও করলেন।[1]

খেজুর বাগান ভাগ করে দেবার প্রস্তাব

হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, আনছারগণ একদিন রাসূল (ছাঃ)-এর কাছে এসে আবেদন করলেন যে, আপনি আমাদের খেজুর বাগানগুলি আমাদের ও মুহাজির ভাইগণের মধ্যে সমানভাবে বণ্টন করে দিন’। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এতে অসম্মতি জ্ঞাপন করলেন। তখন তারা বললেন, তবে এমন করুন যে, মুহাজির ভাইগণ আমাদের কাজ করে দিবেন এবং আমরা তাদের ফলের অংশ দিব’। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এতে সম্মত হ’লেন (বুখারী হা/৩৭৮২)।

জমি বণ্টনের প্রস্তাব

বাহরায়েন এলাকা বিজিত হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সেখানকার পতিত জমিগুলি আনছারদের অনুকূলে বরাদ্দ দিতে চাইলে তারা আপত্তি করে বললেন, আমাদের মুহাজির ভাইদের উক্ত পরিমাণ জমি দেওয়ার পরে আমাদের দিবেন। তার পূর্বে নয়।[2] আনছারদের এই অসাধারণ ত্যাগ ও মহত্ত্বের প্রশংসা করে আল্লাহ আয়াত নাযিল করেন (হাশর ৫৯/৯)। যা ইতিপূর্বে বর্ণিত হয়েছে।

[1]. বুখারী হা/৩৭৮০-৮১ ‘ছাহাবীগণের মর্যাদা’ অধ্যায়, ৩৩ অনুচ্ছেদ ও হা/২৬৩০ ‘হেবা’ অধ্যায়, ৩৫ অনুচ্ছেদ।
[2]. বুখারী হা/২৩৭৬ ‘জমি সেচ করা’ অধ্যায়, ১৪ অনুচ্ছেদ।

আরবে নবতর জাতীয়তা

মুহাজির ভাইদের জন্য আনছারগণের সহমর্মিতা ও ভ্রাতৃত্ব বন্ধন ছিল তাক্বওয়া বা আল্লাহভীতির উপরে প্রতিষ্ঠিত। যার মাধ্যমে বংশ, বর্ণ, অঞ্চল, ভাষা প্রভৃতি আরবের চিরাচরিত বন্ধন সমূহের উপরে তাওহীদ, রিসালাত ও আখেরাত ভিত্তিক নবতর এক জাতীয়তার বন্ধন স্থাপিত হয়। যা পরবর্তীতে ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার জন্ম দেয় এবং প্রতিষ্ঠিত হয় আল্লাহর দাসত্বের অধীনে সকল মানুষের সমানাধিকার ভিত্তিক ইসলামী খেলাফতের দৃঢ় ভিত্তি। উপ্ত হয় প্রকৃত অর্থে এক অসাম্প্রদায়িক ও উদারনৈতিক ইসলামী সমাজের বীজ।

‘আল্লাহর দাসত্বের অধীনে সকল মানুষের অধিকার সমান’- এই মহান সাম্যের বাণী ও তার বাস্তব প্রতিফলন দেখে আজীবন মানুষের দাসত্বের নিগড়ে আবদ্ধ মযলূম জনতা এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে নিগৃহীত ও শোষিত মানবতা যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো। জান্নাত লাভের প্রতিযোগিতায় সর্বোত্তমরূপে বিকশিত মানবতা মদীনার আদি বাসিন্দাদের চমকিত করল। যা তাদের স্বার্থান্ধ জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল। নোংরা দুনিয়াপূজা হ’তে মুখ ফিরিয়ে আখেরাতমুখী মানুষের বিজয় মিছিল এগিয়ে চলল। কাফির-মুশরিক, ইহূদী-নাছারা ও মুনাফিকদের যাবতীয় অপচেষ্টাকে নস্যাৎ করে দিয়ে প্রতিষ্ঠা লাভ করল বিশ্বজয়ী ইসলামী খেলাফত। যা কয়েক বছরের মধ্যেই তৎকালীন বিশ্বের সকল পরাশক্তিকে দমিত করে অপরাজেয় বিশ্বশক্তিরূপে আবির্ভূত হ’ল। ফালিল্লা-হিল হাম্দ।

বস্তুতঃ আনছার ও মুহাজিরগণের মধ্যে যদি এইরূপ নিখাদ ভালবাসা ও ঐক্যের বন্ধন সৃষ্টি না হ’ত এবং স্থানীয় ও বহিরাগত দ্বন্দ্বের ফাটল দেখা দিত, তাহ’লে মদীনায় মুসলমানদের উঠতি শক্তি অংকুরেই বিনাশ হয়ে যেত। পরিণামে তাদেরকে চিরকাল ইহূদীদের শোষণের যাঁতাকলে নিষ্পিষ্ট হ’তে হ’ত। যেভাবে ইতিপূর্বে মক্কায় কুরায়েশ নেতাদের হাতে তারা পর্যুদস্ত হয়েছিল।

শিক্ষণীয় বিষয়সমূহ
(১) সুনির্দিষ্ট অঙ্গীকার ও আল্লাহকে সাক্ষী রেখে বায়‘আত গ্রহণের মাধ্যমে প্রাথমিকভাবে কর্মীদল সৃষ্টি হ’লেও তাদের কর্মকান্ড পর্যবেক্ষণ করা এবং অন্যান্য বিশ্বস্ত কর্মীদের পাঠিয়ে বাস্তবতা যাচাই শেষে পদক্ষেপ নেওয়াই দূরদর্শী নেতার কর্তব্য। ১ম বায়‘আতের পর মুছ‘আবকে পাঠিয়ে হিজরতের জন্য দীর্ঘ তিন বছর অপেক্ষা করার মধ্যে রাসূল (ছাঃ)-এর সেই কর্মনীতি আমরা দেখতে পাই।

(২) নেতৃবৃন্দের অকপট আশ্বাস ও সাধারণ জনমত পক্ষে থাকলেও নেতৃস্থানীয়দের মধ্যে সর্বদা কিছু শত্রু ও দ্বিমুখী চরিত্রের লোক অবশ্যই থাকবে, সংস্কারবাদী নেতাকে সর্বদা সে চিন্তা মাথায় রাখতে হবে এবং সে হিসাবেই পদক্ষেপ নিতে হবে। মাদানী জীবনের প্রথম থেকেই কিছু ইহূদী নেতার বিরুদ্ধাচরণ এবং আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের দ্বি-মুখী আচরণ তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ।

(৩) সমাজদরদী নেতা সাধ্যমত শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সমাজ গঠনে সচেষ্ট থাকবেন। সাথে সাথে শত্রুপক্ষের চক্রান্ত সম্পর্কেও হুঁশিয়ার থাকবেন ও যথাযোগ্য ব্যবস্থা নিবেন।


ইসলামে জিহাদের অনুমতি

কুরায়েশদের সন্ত্রাসমূলক অপতৎপরতা ও প্রকাশ্য হামলাসমূহ মুকাবিলার জন্য মুসলমানদেরকে সশস্ত্র যুদ্ধের অনুমতি দিয়ে ইতিপূর্বে হিজরতকালে সূরা হজ্জ ৩৯ ও ৪০ আয়াত নাযিল হয়[1], যা ইতিপূর্বে বর্ণিত হয়েছে।

ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, এটাই প্রথম আয়াত, যা কাফিরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের অনুমতি দিয়ে হিজরতকালে নাযিল হয়।[2] আর জিহাদের উদ্দেশ্য হ’ল সমাজ থেকে যুলুম ও অন্যায়ের প্রতিরোধ করা। যা উক্ত আয়াতে বর্ণিত হয়েছে।

অন্যত্র আল্লাহ তালূত কর্তৃক অত্যাচারী বাদশাহ জালূতের ধ্বংস প্রসঙ্গে বলেন, وَلَوْلاَ دَفْعُ اللهِ النَّاسَ بَعْضَهُمْ بِبَعْضٍ لَّفَسَدَتِ الأَرْضُ وَلَـكِنَّ اللهَ ذُوْ فَضْلٍ عَلَى الْعَالَمِيْنَ ‘যদি আল্লাহ একজনকে আরেকজনের দ্বারা প্রতিহত না করতেন, তাহ’লে দুনিয়া ধ্বংস হয়ে যেত। কিন্তু বিশ্ববাসীর প্রতি আল্লাহ একান্তই করুণাময়’ (বাক্বারাহ ২/২৫১)।

[1]. তিরমিযী হা/৩১৭১; আহমাদ হা/১৮৬৫।
[2]. তিরমিযী হা/৩১৭১; নাসাঈ হা/৩০৮৫ ‘জিহাদ’ অধ্যায়।

ইসলামে জিহাদ বিধান

‘জিহাদ’ অর্থ সর্বাত্মক প্রচেষ্টা। শারঈ পরিভাষায় ‘জিহাদ’ হ’ল সমাজে ইসলামী বিধান প্রতিষ্ঠার জন্য আল্লাহর রাস্তায় সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো। কুফরী শক্তির বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ করা যার চূড়ান্ত রূপ। জিহাদের উদ্দেশ্য হ’ল মানুষকে মানুষের দাসত্ব থেকে মুক্ত করে আল্লাহর দাসত্বে ফিরিয়ে আনা এবং মানুষে মানুষে সাম্য ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা।

(ক) মাক্কী জীবনে কাফেরদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধের অনুমতি ছিল না। বলা হয়েছিল, كُفُّوا أَيْدِيَكُمْ وَأَقِيمُوا الصَّلاَةَ وَآتُوا الزَّكَاةَ ‘তোমরা হস্ত সংযত রাখ এবং ছালাত আদায় কর ও যাকাত প্রদান কর’... (নিসা ৪/৭৭)। এই নীতি সর্বদা প্রযোজ্য। যখন কুফরী শক্তি প্রবল হবে এবং ইসলামী শক্তি তার তুলনায় দুর্বল থাকবে।

(খ) অতঃপর দেশ থেকে বা গৃহ থেকে বিতাড়িত হওয়ার মত চূড়ান্ত যুলুমের অবস্থায় সশস্ত্র যুদ্ধের অনুমতি দেওয়া হয় দ্বীন ও জীবন রক্ষার্থে। বলা হয়, أُذِنَ لِلَّذِينَ يُقَاتَلُونَ بِأَنَّهُمْ ظُلِمُوا وَإِنَّ اللهَ عَلَى نَصْرِهِمْ لَقَدِيرٌ- ‘যুদ্ধের অনুমতি দেওয়া হ’ল তাদেরকে, যারা আক্রান্ত হয়েছে। কারণ তাদের প্রতি অত্যাচার করা হয়েছে। আর আল্লাহ নিশ্চয়ই তাদেরকে (যুদ্ধ ছাড়াই) সাহায্য করতে সক্ষম’ (হাজ্জ ২২/৩৯)।

(গ) এ সময় কেবল যুদ্ধকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়, وَقَاتِلُوا فِي سَبِيلِ اللهِ الَّذِينَ يُقَاتِلُونَكُمْ وَلاَ تَعْتَدُوا إِنَّ اللهَ لاَ يُحِبُّ الْمُعْتَدِينَ ‘আর তোমরা লড়াই কর আল্লাহর পথে তাদের বিরুদ্ধে, যারা লড়াই করে তোমাদের বিরুদ্ধে এবং এতে বাড়াবাড়ি করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সীমালংঘনকারীদের ভালবাসেন না’ (বাক্বারাহ ২/১৯০)। অর্থাৎ স্রেফ পরকালীন স্বার্থেই জিহাদ হবে, দুনিয়াবী কোন স্বার্থে নয় এবং যারা যুদ্ধ করে কেবল তাদের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ করবে।

(ঘ) যুদ্ধকালে নির্দেশ দেওয়া হয়, اغْزُوا بِاسْمِ اللهِ فِى سَبِيلِ اللهِ قَاتِلُوا مَنْ كَفَرَ بِاللهِ اغْزُوا وَلاَ تَغُلُّوا وَلاَ تَغْدِرُوا وَلاَ تُمَثِّلُوا وَلاَ تَقْتُلُوا الْوِلْدَانَ وَلاَ أَصْحَابَ الصَّوَامِعِ ‘তোমরা আল্লাহর নামে আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ কর তাদের বিরুদ্ধে যারা আল্লাহর সাথে কুফরী করে। যুদ্ধ কর, কিন্তু গণীমতের মালে খেয়ানত করো না। চুক্তি ভঙ্গ করো না। শত্রুর অঙ্গহানি করো না। শিশুদের ও উপাসনাকারীদের হত্যা করো না’।[1]

(ঙ) অতঃপর কুফরী শক্তির সর্বব্যাপী হামলা থেকে দ্বীন ও জীবন রক্ষার্থে মৌলিক নির্দেশনা জারী করা হয়, وَقَاتِلُوهُمْ حَتَّى لاَ تَكُونَ فِتْنَةٌ وَيَكُونَ الدِّينُ لِلَّهِ فَإِنِ انْتَهَوْا فَلاَ عُدْوَانَ إِلاَّ عَلَى الظَّالِمِينَ ‘আর তোমরা তাদের সাথে লড়াই কর যে পর্যন্ত না ফেৎনার (কুফরীর) অবসান হয় এবং আনুগত্য স্রেফ আল্লাহর জন্য হয়। অতঃপর যদি তারা নিবৃত্ত হয়, তবে যালেমদের ব্যতীত অন্যদের প্রতি কোন প্রতিশোধ নেই’ (বাক্বারাহ ২/১৯৩; আনফাল ৮/৩৯)।

(চ) সর্বক্ষেত্রে ও সর্বাবস্থায় ‘তাওহীদের ঝান্ডা উঁচু থাকবে ও শিরকের ঝান্ডা অবনমিত হবে’ মর্মে জিহাদের চিরন্তন নীতিমালা ঘোষণা করা হয়। যেমন আল্লাহ বলেন, وَجَعَلَ كَلِمَةَ الَّذِينَ كَفَرُوا السُّفْلَى وَكَلِمَةُ اللهِ هِيَ الْعُلْيَا وَاللهُ عَزِيزٌ حَكِيمٌ ‘এবং তিনি কাফেরদের (শিরকের) ঝান্ডা অবনত করে দিলেন ও আল্লাহর (তাওহীদের) ঝান্ডা সমুন্নত রাখলেন। বস্ত্ততঃ আল্লাহ মহা পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময়’ (তওবা ৯/৪০)।

(ছ) যারা আল্লাহর সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে মানুষের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চায় এবং আল্লাহর দ্বীনকে ফুৎকারে নিভিয়ে দিতে চায়, সেইসব কাফের অপশক্তির বিরুদ্ধে ইসলামকে বিজয়ী করাই ছিল যুগে যুগে নবী ও রাসূল প্রেরণের উদ্দেশ্য। শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে প্রেরণের উদ্দেশ্যও ছিল তাই। যেমন আল্লাহ বলেন, يُرِيدُونَ لِيُطْفِئُوا نُورَ اللهِ بِأَفْوَاهِهِمْ وَاللهُ مُتِمُّ نُورِهِ وَلَوْ كَرِهَ الْكَافِرُونَ- هُوَ الَّذِي أَرْسَلَ رَسُولَهُ بِالْهُدَى وَدِينِ الْحَقِّ لِيُظْهِرَهُ عَلَى الدِّينِ كُلِّهِ وَلَوْ كَرِهَ الْمُشْرِكُونَ‘তারা চায় তাদের মুখের ফুৎকারে আল্লাহর জ্যোতিকে নিভিয়ে দিতে। অথচ আল্লাহ স্বীয় জ্যোতিকে (ইসলামকে) পূর্ণতা দান করবেন। যদিও অবিশ্বাসীরা তা পসন্দ করে না’। ‘তিনিই তাঁর রাসূলকে প্রেরণ করেছেন হেদায়াত ও সত্য দ্বীন সহকারে। যাতে তিনি উক্ত দ্বীনকে সকল দ্বীনের উপরে বিজয়ী করতে পারেন। যদিও মুশরিকরা তা পসন্দ করে না’ (ছফ ৬১/৮-৯; তওবাহ ৯/৩২)।

(জ) কোন মুসলিম যদি কুফরী শক্তির দোসর হিসাবে কাজ করে, তাহ’লে তার বিরুদ্ধে ‘কঠোর’ হবার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ বলেন, يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ جَاهِدِ الْكُفَّارَ وَالْمُنَافِقِينَ وَاغْلُظْ عَلَيْهِمْ وَمَأْوَاهُمْ جَهَنَّمُ وَبِئْسَ الْمَصِيرُ ‘হে নবী! তুমি জিহাদ কর কাফির ও মুনাফিকদের বিরুদ্ধে এবং তাদের উপরে কঠোর হও। ওদের ঠিকানা হ’ল জাহান্নাম। আর কতইনা মন্দ ঠিকানা সেটি’ (তওবা ৯/৭৩; তাহরীম ৬৬/৯)। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, কাফিরদের বিরুদ্ধে জিহাদ হবে অস্ত্রের দ্বারা এবং মুনাফিকদের বিরুদ্ধে জিহাদ হবে যবান দ্বারা এবং অন্যান্য পন্থায় কঠোরতা অবলম্বনের দ্বারা’।[2] মুনাফিক সর্দার আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইকে সকল নষ্টের মূল জেনেও রাসূল (ছাঃ) তাকে হত্যার নির্দেশ দেননি তার বাহ্যিক ইসলামের কারণে।

(ঝ) মুসলমানদের পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা নিষিদ্ধ।[3] কোন কারণে যুদ্ধ লাগলে অন্যদের দায়িত্ব হবে উভয় পক্ষকে থামানো এবং তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দেওয়া’ (হুজুরাত ৪৯/৯)। নইলে বিরত থাকা। এ বিষয়ে আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ) বলেন,يَمْنَعُنِى أَنَّ اللهَ حَرَّمَ دَمَ أَخِى ‘আমাকে যুদ্ধ থেকে বিরত রেখেছে এ বিষয়টি যে, আল্লাহ আমার উপর আমার ভাইয়ের রক্ত হারাম করেছেন’। লোকেরা বলল, আল্লাহ কি বলেননি, وَقَاتِلُوْهُمْ حَتَّى لاَ تَكُوْنَ فِتْنَةٌ وَيَكُوْنَ الدِّيْنُ ِللهِ ‘তোমরা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর, যতক্ষণ না ফিৎনা অবশিষ্ট থাকে এবং দ্বীন সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর জন্য হয়ে যায়’ (বাক্বারাহ ২/১৯৩)। জবাবে তিনি বলেন,قَاتَلْنَا حَتَّى لَمْ تَكُنْ فِتْنَةٌ، وَكَانَ الدِّينُ ِللهِ، وَأَنْتُمْ تُرِيدُونَ أَنْ تُقَاتِلُوا حَتَّى تَكُونَ فِتْنَةٌ، وَيَكُونَ الدِّينُ لِغَيْرِ اللهِ ‘আমরা যুদ্ধ করেছি যাতে ফিৎনা (শিরক ও কুফর) না থাকে এবং দ্বীন সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর জন্য হয়ে যায়। আর তোমরা যুদ্ধ করছ যাতে ফিৎনা (বিপর্যয়) সৃষ্টি হয় এবং দ্বীন আল্লাহ ব্যতীত অন্যের (শত্রুর) জন্য হয়ে যায়’ (বুখারী হা/৪৫১৩)। তিনি ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, هَلْ تَدْرِى مَا الْفِتْنَةُ؟ كَانَ مُحَمَّدٌ صلى الله عليه وسلم يُقَاتِلُ الْمُشْرِكِينَ، وَكَانَ الدُّخُولُ عَلَيْهِمْ فِتْنَةً، وَلَيْسَ كَقِتَالِكُمْ عَلَى الْمُلْكِ ‘তুমি কি জানো ফিৎনা কি? মুহাম্মাদ (ছাঃ) যুদ্ধ করতেন মুশরিকদের বিরুদ্ধে। আর তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধটাই ছিল ফিৎনা। তোমাদের মত শাসন ক্ষমতা লাভের জন্য যুদ্ধ নয়’ (বুখারী হা/৪৬৫১, ৭০৯৫)।

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, سَتَكُونُ فِتَنٌ، الْقَاعِدُ فِيهَا خَيْرٌ مِنَ الْقَائِمِ، وَالْقَائِمُ فِيهَا خَيْرٌ مِنَ الْمَاشِى ... وَمَنْ وَجَدَ مَلْجَأً أَوْ مَعَاذًا فَلْيَعُذْ بِهِ ‘সত্বর তোমাদের মধ্যে ফিৎনাসমূহ সৃষ্টি হবে। তখন তোমাদের মধ্যেকার বসা ব্যক্তি দাঁড়ানো ব্যক্তির চাইতে উত্তম হবে এবং বসা ব্যক্তি হাঁটা ব্যক্তির চাইতে উত্তম হবে। আর হাঁটা ব্যক্তি দৌড়ানো ব্যক্তির চাইতে উত্তম হবে। যদি কেউ আশ্রয়স্থল বা বাঁচার কোন স্থান পায়, তবে সে যেন সেখানে গিয়ে আশ্রয় নেয়’।[4] ফিৎনার সময় করণীয় প্রসঙ্গে হযরত সা‘দ ইবনু আবী ওয়াকক্বাছ (রাঃ) রাসূল (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করেন, হে আল্লাহর রাসূল! যখন আমাকে হত্যার জন্য আমার ঘরে ঢুকে কেউ আমার দিকে হাত বাড়াবে, তখন আমি কি করব? জবাবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, كُنْ كَابْنِ آدَمَ ‘তুমি আদমের পুত্রের মত হও’ (অর্থাৎ হাবীলের মত মৃত্যুকে বরণ কর)। অতঃপর আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) মায়েদাহ ২৮ আয়াতটি পাঠ করে শুনালেন’। যেখানে হত্যাকারী ক্বাবীলের বিরুদ্ধে হাবীলের উক্তি উদ্ধৃত করে আল্লাহ বলেন, لَئِنْ بَسَطْتَ إِلَيَّ يَدَكَ لِتَقْتُلَنِي مَا أَنَا بِبَاسِطٍ يَدِيَ إِلَيْكَ لِأَقْتُلَكَ إِنِّي أَخَافُ اللهَ رَبَّ الْعَالَمِينَ ‘যদি তুমি আমাকে হত্যার উদ্দেশ্যে তোমার হাত বাড়াও, তবুও আমি তোমাকে হত্যার জন্য আমার হাত বাড়াবো না। আমি বিশ্বপ্রভু আল্লাহকে ভয় করি’ (মায়েদাহ ৫/২৮)।[5] আবু মূসা আশ‘আরী (রাঃ)-এর বর্ণনায় এসেছে, যখন তোমাদের কারু গৃহে ফেৎনা প্রবেশ করবে, তখন সে যেন আদমের দুই পুত্রের উত্তমটির মত হয়(فَلْيَكُنْ كَخَيْرِ ابْنَىْ آدَمَ)।[6]

[1]. মুসলিম হা/১৭৩১; আহমাদ হা/২৭২৮; মিশকাত হা/৩৯২৯।
[2]. ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা তওবা ৭৩ আয়াত।
[3]. মুসলিম হা/২৫৬৪; বুখারী হা/৪৮; মুসলিম হা/৬৪ (১১৬); মিশকাত হা/৪৮১৪।
[4]. বুখারী হা/৩৬০১; মুসলিম হা/২৮৮৬ (১০); মিশকাত হা/৫৩৮৪।
[5]. আহমাদ হা/১৬০৯; আবুদাঊদ হা/৪২৫৭ ‘ফিতান’ অধ্যায়, সনদ ছহীহ।
[6]. আবুদাঊদ হা/৪২৫৯; ইবনু মাজাহ হা/৩৯৬১ সনদ ছহীহ।



**********************************
সাইটটি ভিজিট করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আর্টিকেলটি ভাল লাগলে সত্য ও ন্যয়ের পথে অন্য ভাইনদেরকে দাওয়াতের নিয়তে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন। মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে এবং দীন ও মানবতার সেবায় অংশ নিতে OUR ACTION PLAN বাটনে ক্লিক করুন।


এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url