প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর জীবনী [পর্ব- ৬৬] || মহানবীর জীবনী ||




রাসূল (ছাঃ) এর অতি কাছের মানুষদের বর্ণনা

[পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ট মহামানব আমাদের প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:)। যাকে আল্লাহ সমস্ত মানুষের জন্য অশেষ রহমত স্বরূপ এই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। যে নবী সারা জীবন উম্মতের জন্য সংগ্রাম করেছেন, কাল রোজ হাশরের মাঠেও যিনি উম্মতের জন্যই পেরেশান থাকবেন ইয়া উম্মতি ইয়া উম্মতি বলে বিচলিত হবেন; সেই প্রাণপ্রিয় নবীকে আমরা কতটুকু চিনি, কতটুকু জানি? প্রিয় নবী (সা:) এর জীবনের পরতে পরতে রয়েছে আমাদের জন্য শিক্ষা ও অনুপ্রেরণা। যার জীবনী পড়লে নিজের অজান্তেই চোখের পানি গড়িয়ে পড়ে। সেই নবীর জীবনী কি আমরা সত্যিই জানি? আসুন, আরেকবার দেখে নেই “প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর জীবনী”। যে জীবনী পড়ে বদলে যেতে পারে আপনার আমার জীবন। আমরা এখানে প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর বিশাল কর্মময় জীবনকে ৬৭টি সুবিশাল পর্বে তুলে ধরেছি। আল্লাহ আমাদের সবাইকে প্রাণপ্রিয় নবীর (সা:) উম্মত হিসাবে কবুল করুন। আমিন।।]

রাসূল (ছাঃ) এর রেখে যাওয়া দু’টি বস্তু

বিদায় হজ্জের ভাষণসমূহের এক স্থানে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, تَرَكْتُ فِيْكُمْ أَمْرَيْنِ لَنْ تَضِلُّوْا مَا تَمَسَّكْتُمْ بِهِمَا كِتَابَ اللهِ وَسُنَّةَ نَبِيِّهِ ‘আমি তোমাদের মাঝে ছেড়ে যাচ্ছি দু’টি বস্তু। যতদিন তোমরা এ দু’টি বস্তু আঁকড়ে থাকবে, ততদিন তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না। আল্লাহর কিতাব ও তার নবীর সুন্নাহ’।[1] তিনি বলেন,الأَنْبِيَاءُ لَمْ يَرِثُوا دِينَاراً وَلاَ دِرْهَماً وَإِنَّمَا وَرَّثُوا الْعِلْمَ ‘নবীগণ কোন দীনার ও দিরহাম ছেড়ে যান না। ছেড়ে যান কেবল ইল্ম’।[2] আর শেষনবী (ছাঃ)-এর ছেড়ে যাওয়া সেই ইল্ম হ’ল কুরআন ও হাদীছ। দীনার ও দিরহামের ক্ষয় আছে, লয় আছে। কিন্তু ইল্মের কোন ক্ষয় নেই লয় নেই। ইল্ম চির জীবন্ত। যে ঘরে হাদীছের পঠন-পাঠন হয়, সে ঘরে যেন স্বয়ং শেষনবী (ছাঃ) কথা বলেন। যেমন ইমাম তিরমিযী স্বীয় হাদীছগ্রন্থ সম্পর্কে বলেন, مَنْ كَانَ فِي بَيْتِهِ هَذَا الْكِتَابُ فَكَأَنَّمَا فِي بَيْتِهِ نَبِيٌّ يَتَكَلَّمُ ‘যার ঘরে এই কিতাব থাকে, তার গৃহে যেন স্বয়ং নবী কথা বলেন’।[3] যিনি হাদীছ বর্ণনা করেন, স্বয়ং রাসূল (ছাঃ)-এর বাণী তার মুখ দিয়ে বের হয়।

যিনি হাদীছ অনুযায়ী আমল করেন, তিনি স্বয়ং নবীর আনুগত্য করেন। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি হাদীছকে অগ্রাহ্য করে, সে স্বয়ং নবীকে অগ্রাহ্য করে। আল্লাহ বলেন, فَلْيَحْذَرِ الَّذِيْنَ يُخَالِفُوْنَ عَنْ أَمْرِهِ أَنْ تُصِيْبَهُمْ فِتْنَةٌ أَوْ يُصِيْبَهُمْ عَذَابٌ أَلِيْمٌ ‘অতএব যারা রাসূল-এর আদেশ-নিষেধের বিরোধিতা করবে, তারা এ বিষয়ে সাবধান হৌক যে, ফিৎনা তাদেরকে গ্রেফতার করবে এবং যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি তাদেরকে গ্রাস করবে’ (নূর ২৪/৬৩)। শুধু তাই নয় তার সমস্ত আমল আল্লাহর নিকটে বাতিল বলে গণ্য হবে (মুহাম্মাদ ৪৭/৩৩)। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘জগদ্বাসীকে জান্নাতের প্রতি আল্লাহর পক্ষ হ’তে আহবানকারী (الدَّاعِى) হলেন মুহাম্মাদ! যে ব্যক্তি মুহাম্মাদের আনুগত্য করল, সে ব্যক্তি আল্লাহর আনুগত্য করল। আর যে ব্যক্তি মুহাম্মাদের অবাধ্যতা করল, সে ব্যক্তি আল্লাহর অবাধ্যতা করল। মুহাম্মাদ হলেন مُحَمَّدٌ فَرْقٌ بَيْنَ النَّاسِ ‘মানুষের মধ্যে পার্থক্যকারী মানদন্ড’।[4] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, أَلاَ إِنِّى أُوتِيتُ الْكِتَابَ وَمِثْلَهُ مَعَهُ ‘জেনে রেখ, আমি কুরআন প্রাপ্ত হয়েছি এবং তার ন্যায় আরেকটি বস্ত্ত (অর্থাৎ হাদীছ)।[5]

عَنْ أَبِىْ رَافِعٍ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لاَ أُلْفِيَنَّ أَحَدَكُمْ مُتَّكِئًا عَلَى أَرِيكَتِهِ يَأْتِيْهِ الأَمْرُ مِنْ أَمْرِى مِمَّا أَمَرْتُ بِهِ أَوْ نَهَيْتُ عَنْهُ فَيَقُوْلُ لاَ أَدْرِى مَا وَجَدْنَا فِى كِتَابِ اللهِ اتَّبَعْنَاهُ ، رَوَاهُ أَحْمَدُ وَأَبُوْ دَاؤُدَ وَالتِّرْمِذِىُّ-

‘আবু রাফে‘ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহে ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন, ‘আমি যেন তোমাদের কাউকে এরূপ না দেখি যে, সে তার গদীতে ঠেস দিয়ে বসে থাকবে, আর তার কাছে আমার কোন আদেশ বা নিষেধাজ্ঞা পৌঁছলে সে বলবে যে, আমি এসব কিছু জানিনা। যা আল্লাহর কিতাবে পাব, তারই আমরা অনুসরণ করব’।[6]

কুরআন ও হাদীছ হ’ল রাসূল (ছাঃ)-এর রেখে যাওয়া দুই অনন্য উত্তরাধিকার, দুই জীবন্ত মু‘জেযা। যা মানবজাতির জন্য চিরন্তন মুক্তির দিশা। অতএব ইহকালে ও পরকালে সফলকাম হওয়ার জন্য সর্বাবস্থায় সেদিকেই আমাদের ফিরে যেতে হবে। আল্লাহ আমাদের সেই তাওফীক দান করুন- আমীন!

[1]. মুওয়াত্ত্বা হা/৩৩৩৮, সনদ হাসান; মিশকাত হা/১৮৬।
[2]. আহমাদ হা/২১৭৬৩; তিরমিযী হা/২৬৮২; আবুদাঊদ হা/৩৬৪১; মিশকাত হা/২১২।
[3]. শামসুদ্দীন যাহাবী (৬৭৩-৭৪৮ হি.), তাযকেরাতুল হুফফায ২/৬৩৪ পৃঃ ক্রমিক সংখ্যা ৬৫৮; সুনান তিরমিযী, তাহকীক : আহমাদ মুহাম্মাদ শাকির (বৈরূত : ১ম সংস্করণ, ১৪০৮/১৯৮৭) পৃঃ ৩।
[4]. বুখারী হা/৭২৮১; মিশকাত হা/১৪৪।
[5]. আবুদাঊদ হা/৪৬০৪; মিশকাত হা/১৬৩।
[6]. আবুদাঊদ হা/৪৬০৫; তিরমিযী হা/২৬৬৩; মিশকাত হা/১৬২।

রাসূল চরিত পর্যালোচনা

সাধারণতঃ লোকেরা নবী-রাসূলগণকে ধর্মনেতা হিসাবেই ভাবতে অভ্যস্ত। যারা দুনিয়াদারী থেকে সর্বদা দূরে থাকেন ও কেবল আল্লাহর যিকরে মশগূল থাকেন। আসলে ব্যাপারটি ঠিক তা নয়। বরং তাঁরা মানুষকে তার সার্বিক জীবনে শয়তানের দাসত্ব হ’তে মুক্ত করে আল্লাহর দাসত্বে ফিরিয়ে নিতে সর্বদা প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। বিভিন্ন যুগে নবী-রসূলগণ যে নির্যাতিত হয়েছেন, তা ছিল মূলতঃ তাদের আনীত ধর্ম বিশ্বাসের সাথে মানুষের মনগড়া ধারণা ও রীতি-নীতি সমূহের মধ্যে বিরোধ হওয়ার কারণেই। তবে হযরত মূসা (আঃ)-এর সঙ্গে ফেরাঊনের সংঘর্ষ ধর্মবিশ্বাসগত হওয়া ছাড়াও নির্যাতিত বনু ইস্রাঈলদের মুক্তির মত রাজনৈতিক বিষয়টিও জড়িত ছিল। কেননা বনু ইস্রাঈলকে ফেরাঊনের গোত্র ক্বিবতীরা দাস-দাসী হিসাবে ব্যবহার করত এবং তাদের উপরে অমানুষিক নির্যাতন চালাত। মূসা (আঃ) তাদেরকে ফেরাঊনের কবল থেকে মুক্ত করে তাদের আদি বাসস্থান শামে ফেরৎ নিতে চেয়েছিলেন। হযরত ঈসা (আঃ)-এর দাওয়াতের মধ্যে রাজনীতির নাম-গন্ধ না থাকলেও সমসাময়িক রাজা তাঁর জনপ্রিয়তায় ভীত হয়ে এবং ইহূদীদের চক্রান্তে তাঁকে হত্যা করার প্রয়াস চালান। কেননা ইহূদীরা হযরত ঈসা (আঃ)-কে নবী হিসাবে মানেনি। উপরন্তু তাওরাতের কিছু বিধান পরিবর্তন করায় তারা তাঁর ঘোর দুশমন ছিল। ফলে আল্লাহ ঈসা (আঃ)-কে আসমানে জীবিত উঠিয়ে নেন (আলে ইমরান ৩/৫৫; নিসা ৪/১৫৭)।

পক্ষান্তরে শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) দুনিয়াতে প্রেরিত হয়েছিলেন মানবজাতির জন্য উসওয়ায়ে হাসানাহ বা ‘সর্বোত্তম নমুনা’ হিসাবে (আহযাব ৩৩/২১)। সেকারণ মানবজীবনে প্রয়োজনীয় সকল কল্যাণকর বিষয়ে সর্বোত্তম আদর্শ হিসাবে আল্লাহ তাঁকে প্রেরণ করেন। ফলে তিনি একাধারে ধর্মনেতা, রাজনৈতিক নেতা, সমাজনেতা, অর্থনৈতিক বিধানদাতা, সমরনেতা, বিচারপতি এবং বিচার বিভাগীয় নীতি ও দর্শনদাতা- এক কথায় বিশ্ব পরিচালনার সামগ্রিক পথপ্রদর্শক হিসাবে আল্লাহ তাঁকে প্রেরণ করেছিলেন এবং সেটা তিনি বাস্তবে দেখিয়ে গিয়েছিলেন। সেদিক দিয়ে বিচার করলে মুহাম্মাদ (ছাঃ) বিগত সকল নবী থেকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য, গুণাবলী ও বিশেষ মর্যাদার অধিকারী ছিলেন।

একজন আধ্যাত্মিক ব্যক্তি নিয়মিত তাহাজ্জুদগোযার এবং নফল ছিয়াম ও ই‘তিকাফকারী রাসূলকে পাবেন শ্রেষ্ঠতম আধ্যাত্মিক নেতা হিসাবে। আগে-পিছে সব গোনাহ মাফ হওয়া সত্ত্বেও নৈশ ইবাদতে মগ্ন থাকা ও ক্ষমা প্রার্থনার বিষয়ে এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছিলেন, أَفَلاَ أَكُوْنُ عَبْدًا شَكُوْرًا؟ ‘আমি কি একজন কৃতজ্ঞ বান্দা হব না’?[1] একজন রাজনীতিক তার পথ খুঁজে পাবেন হোদায়বিয়ার সন্ধিতে ও মক্কা বিজয়ী রাসূল (ছাঃ)-এর কুশাগ্রবুদ্ধি ও দূরদর্শী রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের মধ্যে। একজন অকুতোভয় সেনাপতি তার আদর্শ দেখতে পাবেন বদর-খন্দক-হোনায়েন বিজেতা সেনাপতি মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর সমর কুশলতার মধ্যে। একজন সমাজনেতা তার আদর্শ খুঁজে পাবেন মক্কা ও মদীনার কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজ সংশোধনে দক্ষ সমাজনেতা মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর মধ্যে। একজন বিচারপতি তার আদর্শ খুঁজে পাবেন আল্লাহর দন্ডবিধিসমূহ বাস্তবায়নে দৃঢ়চিত্ত মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর নিরপেক্ষ বিচারের মধ্যে। যিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেন, أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّمَا أَهْلَكَ الَّذِينَ قَبْلَكُمْ أَنَّهُمْ كَانُوا إِذَا سَرَقَ فِيهِمُ الشَّرِيفُ تَرَكُوهُ وَإِذَا سَرَقَ فِيهِمُ الضَّعِيفُ أَقَامُوا عَلَيْهِ الْحَدَّ وَايْمُ اللهِ لَوْ أَنَّ فَاطِمَةَ بِنْتَ مُحَمَّدٍ سَرَقَتْ لَقَطَعْتُ يَدَهَا ‘হে জনগণ! তোমাদের পূর্বেকার উম্মতেরা ধ্বংস হয়েছে এ কারণে যে, তাদের মধ্যে উঁচু শ্রেণীর কোন লোক চুরি করলে তারা তাকে ছেড়ে দিত এবং দুর্বল শ্রেণীর কেউ চুরি করলে তার উপরে দন্ডবিধি প্রয়োগ করত। আল্লাহর কসম! যদি মুহাম্মাদের কন্যা ফাতেমাও চুরি করে, আমি অবশ্যই তার হাত কেটে দেব’।[2]

এমনিভাবে মানবজীবনের সকল দিক ও বিভাগে একজন পূর্ণাঙ্গ আদর্শের মানুষ হিসাবে তাঁকে আমরা দেখতে পাই। অতএব জীবনের কোন একটি বা দু’টি বিভাগে রাসূল (ছাঃ)-কে আদর্শ মেনে অন্য বিভাগে অন্য কোন মানুষকে আদর্শ মানলে পূর্ণ মুমিন হওয়া যাবে না। পরকালে জান্নাতও আশা করা যাবে না। মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর জীবনচরিত তাই একজন কল্যাণকামী সমাজনেতার জন্য আদর্শ জীবনচরিত। যা যুগে যুগে মানবজাতিকে সত্য ও ন্যায়ের আলোকস্তম্ভ রূপে পথ দেখাবে। মযলূম মানবতাকে যালেমদের হাত থেকে মুক্তির দিশা দিবে।

মুহাম্মাদ (ছাঃ) অস্ত্র নিয়ে ময়দানে আসেননি। এসেছিলেন একটি অভ্রান্ত আদর্শ নিয়ে। যার মাধ্যমে তিনি মানুষের ভ্রান্ত আক্বীদা ও কপোল-কল্পিত ধারণা-বিশ্বাসে পরিবর্তন এনেছিলেন। আর তাতেই সৃষ্টি হয়েছিল সর্বাত্মক সমাজ বিপ্লব। দুনিয়াপূজারী মানুষকে তিনি আল্লাহ ও আখেরাতে দৃঢ় বিশ্বাসী করতে সমর্থ হয়েছিলেন। তাওহীদ, রিসালাত ও আখেরাত বিশ্বাসের ভিত্তিতে তিনি সমাজের আমূল পরিবর্তনে সক্ষম হয়েছিলেন। আজও যদি সেই দৃঢ় বিশ্বাস ফিরিয়ে আনা যায়, তাহ’লে আবারো সেই হারানো মানবতা ও হারানো ইসলামী খেলাফত ফিরে পাওয়া সম্ভব। এজন্য প্রয়োজন একদল যিন্দাদিল নিবেদিত প্রাণ মুর্দে মুমিন। আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর প্রিয় বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত করুন- আমীন!

[1]. বুখারী হা/১১৩০, মুসলিম হা/২৮১৯-২০; মিশকাত হা/১২২০ ‘ছালাত’ অধ্যায়, ‘রাত্রি জাগরণে উৎসাহ প্রদান’ অনুচ্ছেদ-৩৩।
[2]. মুসলিম হা/১৬৮৮; বুখারী হা/৬৭৮৭-৮৮; মিশকাত হা/৩৬১০ ‘দন্ড হ্রাসে সুফারিশ’ অনুচ্ছেদ।

অহি লেখকগণ

যায়েদ বিন ছাবিত (রাঃ) ছিলেন অহি লেখকগণের মধ্যে সর্বাগ্রগণ্য। সেকারণ কুরআন জমা করার সময় ওছমান (রাঃ) তাঁকেই এ গুরুদায়িত্ব প্রদান করেন (বুখারী হা/৪৬৭৯, ৪৯৭৯)। তিনি ব্যতীত আরও অনেক ছাহাবী বিভিন্ন সময়ে এ মহান দায়িত্ব আঞ্জাম দিয়েছেন।

ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ) বলেন, অহি নাযিলের শুরু থেকে মক্কায় অহি লেখকদের মধ্যে সর্বপ্রথম ছিলেন ওছমান (রাঃ)-এর দুধভাই (১) আব্দুল্লাহ বিন সা‘দ বিন আবু সারাহ। ইনি পরে ‘মুরতাদ’ হয়ে যান। অতঃপর মক্কা বিজয়ের দিন পুনরায় মুসলমান হন। অতঃপর বিভিন্ন সময়ে অহি লেখক ছিলেন (২) আবুবকর (৩) ওমর (৪) ওছমান (৫) আলী (৬) যুবায়ের ইবনুল ‘আওয়াম (৭) খালেদ বিন সাঈদ ইবনুল ‘আছ ও তাঁর ভাই (৮) আবান বিন সাঈদ ইবনুল ‘আছ (৯) হানযালা বিন রবী‘ আসাদী (১০) মু‘আইক্বীব বিন আবু ফাতেমা দাওসী (১১) আব্দুল্লাহ বিন আরক্বাম যুহরী (১২) শুরাহবীল বিন হাসানাহ কুরায়শী (১৩) আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহা আনছারী।

মদীনায় প্রথম অহি লেখক ছিলেন (১৪) উবাই বিন কা‘ব। অতঃপর (১৫) যায়েদ বিন ছাবিত। তিনি অনুপস্থিত থাকলে অন্যেরা লিখতেন’ (রাযিয়াল্লাহু ‘আনহুম)।[1] (১৬) এছাড়া বনু নাজ্জারের জনৈক ব্যক্তি, যে খ্রিষ্টান হয়ে যায়। অতঃপর মুসলমান হন।[2]

[1]. ফাৎহুল বারী হা/৪৯৯০-এর পূর্বে ‘নবী (ছাঃ)-এর লেখক’ অনুচ্ছেদ, ৯/২২ পৃঃ।
[2]. বুখারী হা/৩৬১৭; মুসলিম হা/২৭৮১।

অন্যান্য বিষয়ে লেখকগণ
(১) আবু সালামাহ মাখযূমী (২) আরক্বাম বিন আবুল আরক্বাম (৩) ‘আমের বিন ফুহায়রাহ (৪) ত্বালহা বিন ওবায়দুল্লাহ (৫) হাত্বেব বিন ‘আমর আবু বালতা‘আহ (৬) আব্দুল্লাহ বিন আবুবকর (৭) আবু আইয়ূব আনছারী (৮) বুরায়দাহ বিন হুছাইব আসলামী (৯) হুযায়ফা ইবনুল ইয়ামান (১০) মু‘আয বিন জাবাল (১১) জনৈক আনছার আবু ইয়াযীদ (১২) ছাবেত বিন ক্বায়েস বিন শাম্মাস (১৩) আব্দুল্লাহ বিন যায়েদ বিন ‘আব্দে রবিবহি (১৪) মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহ (১৫) আব্দুল্লাহ বিন আব্দুল্লাহ বিন উবাই (১৬) খালেদ বিন অলীদ (১৭) ‘আমর ইবনুল ‘আছ (১৮) মুগীরাহ বিন শো‘বা ছাক্বাফী (১৯) জুহাম বিন সা‘দ (২০) জুহাইম বিন ছালত (২১) হুছায়েন বিন নুমায়ের (২২) হুয়াইত্বিব বিন আব্দুল ‘উযযা (২৩) সাঈদ বিন সাঈদ ইবনুল ‘আছ (২৪) জা‘ফর বিন আবু ত্বালিব (২৫) হানযালা বিন রবী‘ ও তার ভাই (২৬) রাবাহ ও চাচা (২৭) আকছাম বিন ছায়ফী তামীমী (২৮) ‘আলা ইবনুল হাযরামী (২৯) ‘আলা বিন উক্ববাহ (৩০) আববাস বিন আব্দুল মুত্ত্বালিব (৩১) আবু সুফিয়ান বিন হারব (৩২) ঐ পুত্র ইয়াযীদ বিন আবু সুফিয়ান ও (৩৩) মু‘আবিয়া বিন আবু সুফিয়ান রাযিয়াল্লাহু ‘আনহুম।[1] এতদ্ব্যতীত (৩৪) আব্দুল্লাহ বিন আমর ইবনুল ‘আছ যিনি হাদীছ লিখনে প্রসিদ্ধ ছিলেন।

লেখকগণের মধ্যে মদীনায় যাঁরা বিশেষ বিশেষ কাজে প্রসিদ্ধ ছিলেন তাঁরা হলেন, (১) অহি লিখনে আলী, ওছমান, উবাই বিন কা‘ব এবং যায়েদ বিন ছাবেত। (২) বাদশাহ ও আমীরদের নিকটে পত্র লিখনে যায়েদ বিন ছাবেত। (৩) চুক্তি লিখনে আলী ইবনু আবী তালেব। (৪) মানুষের বিভিন্ন প্রয়োজন সমূহ লিখনে মুগীরাহ বিন শো‘বা। (৫) ঋণচুক্তিসমূহ লিখনে আব্দুল্লাহ বিন আরক্বাম। (৬) গণীমতসমূহ নিবন্ধনে মু‘আইকীব। কোন লেখক অনুপস্থিত থাকলে হানযালা বিন রবী‘ লেখকের দায়িত্ব পালন করতেন। সেজন্য তিনি হানযালা আল-কাতেব নামে প্রসিদ্ধ ছিলেন।[2]

এঁদের মধ্যে (১) খালেদ বিন সাঈদ ছিলেন আবুবকর ছিদ্দীক (রাঃ)-এর পরে ইসলাম কবুলকারী ৩য়, ৪র্থ অথবা ৫ম ব্যক্তি। কারণ হিসাবে বর্ণিত হয়েছে যে, একদিন তিনি স্বপ্নে দেখেন যে, তিনি জাহান্নামের কিনারে দাঁড়িয়ে আছেন। তার পিতা তাকে সেদিকে ঠেলে দিচ্ছেন। পক্ষান্তরে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তার হাত টেনে ধরেছেন, যাতে তিনি জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত না হন। পরদিন এ স্বপ্ন আবুবকর (রাঃ)-কে বললে তিনি বলেন, এটি শুভ স্বপ্ন। ইনিই আল্লাহর রাসূল। অতএব তুমি তাঁর অনুসরণ কর। তাহ’লে জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাবে। যার ভয় তুমি করছ’। অতঃপর তিনি রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট আসেন ও ইসলাম কবুল করেন। এ খবর জানতে পেরে তার পিতা তাকে লাঠিপেটা করেন, খানা-পিনা বন্ধ করে দেন ও তাকে বাড়ী থেকে বের করে দেন। পরবর্তীতে তিনি হাবশায় হিজরত করেন। অতঃপর হাবশা থেকে জা‘ফরের সাথে খায়বরে আসেন ও রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে সাক্ষাৎ করেন। তিনি ত্বায়েফবাসীদের সাথে সন্ধির সর্বাত্মক চেষ্টা করেন। পরে সেখান থেকে আগত ছাক্বীফ প্রতিনিধি দলের সাথে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর পক্ষে চুক্তিনামা লিপিবদ্ধ করেন। আবুবকর ছিদ্দীক (রাঃ)-এর খেলাফতকালে তিনি শামের আজনাদাইন যুদ্ধে শহীদ হন।

(২) ‘আমের বিন ফুহায়রা আবুবকর (রাঃ)-এর মুক্তদাস ছিলেন। হিজরতকালে তিনি রাসূল (ছাঃ)-এর সাথী ছিলেন। পথিমধ্যে পিছু ধাওয়াকারী সুরাক্বাহ বিন মালেক মুদলেজী-কে রাসূল (ছাঃ)-এর নির্দেশে তিনি একটি ‘নিরাপত্তানামা’ (كِتَابُ أَمْنٍ) লিখে দেন। ৪র্থ হিজরীতে বি’রে মাঊনা-র মর্মান্তিক ঘটনায় তিনি শহীদ হন।

(৩) আরক্বাম বিন আবুল আরক্বাম মাখযূমী (রাঃ) প্রথম দিকের ৭ম বা ১০ম মুসলমান ছিলেন। ছাফা পাহাড়ে তাঁর গৃহে রাসূল (ছাঃ) ইসলামের প্রচার কেন্দ্র স্থাপন করেন। যা ‘দারুল আরক্বাম’ (دَارُ الْأَرْقَمِ) নামে পরিচিত হয়। তিনি ৫৩ অথবা ৫৫ হিজরীতে ৮৫ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন (আল-ইছবাহ, আরক্বাম ক্রমিক ৭৩)।

(৪) আব্দুল্লাহ বিন যায়েদ বিন ‘আব্দে রবিবহী বায়‘আতে কুবরা-য় শরীক ছিলেন। তাঁর সবচেয়ে উচ্চ মর্যাদা ছিল এই যে, তিনিই প্রথম আযানের স্বপ্ন দেখেন এবং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে ‘সত্যস্বপ্ন’ (إِنَّهَا لَرُؤْيَا حَقٌّ) বলে আখ্যায়িত করেন এবং আল্লাহর প্রশংসা জ্ঞাপন করে বলেন, ফালিল্লাহিল হাম্দ(فََلِلَّهِ الْحَمْدُ) । অতঃপর বেলালের মাধ্যমে তা চালু করে দেন (আবুদাঊদ হা/৪৯৯)। তিনি ৩২ হিজরীতে ৬৪ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। খলীফা ওছমান (রাঃ) স্বয়ং তাঁর জানাযায় ইমামতি করেন (আল-ইছাবাহ, আব্দুল্লাহ বিন যায়েদ ক্রমিক ৪৬৮৯)।

(৫) আব্দুল্লাহ সা‘দ বিন আবু সারাহ ওছমান বিন ‘আফফান (রাঃ)-এর দুধভাই ছিলেন। ওছমানের মা তাঁকে দুধ পান করিয়েছিলেন। তিনি অহি লিখতেন। কিন্তু পরে ‘মুরতাদ’ হয়ে যান। মক্কা বিজয়ের দিন রাসূল (ছাঃ) যাদের রক্ত বৃথা ঘোষণা করেন, তিনি ছিলেন তাদের অন্তর্ভুক্ত। পরে তিনি ওছমান (রাঃ)-এর নিকটে এসে আশ্রয় প্রার্থনা করেন। ফলে রাসূল (ছাঃ) তাকে আশ্রয় দেন। এরপর থেকে মৃত্যু অবধি তাঁর ইসলাম খুবই সুন্দর ছিল। ওছমান (রাঃ)-এর খেলাফতকালে ২৫ হিজরীতে তাঁকে মিসরের গবর্ণর নিযুক্ত করা হয় এবং আফ্রিকা জয়ের নির্দেশ দেওয়া হয়। অতঃপর তাঁর আমলেই আফ্রিকা বিজিত হয়। উক্ত যুদ্ধে বিখ্যাত তিন ‘আবাদেলাহ’ অর্থাৎ আব্দুল্লাহ বিন যুবায়ের, আব্দুল্লাহ বিন ওমর এবং আব্দুল্লাহ বিন ‘আমর যোগদান করেন। ৩৫ হিজরীতে ওছমান (রাঃ)-এর শাহাদাতকালে তিনি মিসরের ‘আসক্বালান’ শহরে ছিলেন। তিনি আল্লাহর নিকট দো‘আ করেন যেন ছালাতরত অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়। অতঃপর একদিন ফজরের ছালাত আদায়কালে শেষ বৈঠকে প্রথম সালাম ফিরানোর পর দ্বিতীয় সালাম ফিরানোর আগেই তাঁর মৃত্যু হয়ে যায়। এটি ছিল ৩৬ অথবা ৩৭ হিজরীর ঘটনা।[3]

(৬) উবাই বিন কা‘ব আনছারী (রাঃ) বায়‘আতে কুবরা এবং বদর-ওহোদ সহ সকল যুদ্ধে রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে অংশগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন সাত জন শ্রেষ্ঠ ক্বারীর নেতা। আনাস বিন মালেক (রাঃ) বলেন, একদিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) উবাই বিন কা‘বকে বললেন, إِنَّ اللهَ أَمَرَنِىْ أَنْ أَقْرَأَ عَلَيْكَ (لَمْ يَكُنِ الَّذِينَ كَفَرُوْا) قَالَ وَسَمَّانِىْ لَكَ؟ قَالَ: نَعَمْ، فَبَكَى ‘আল্লাহ আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন যেন আমি তোমার উপরে সূরা বাইয়েনাহ পাঠ করি। উবাই বললেন, আল্লাহ আপনার নিকটে আমার নাম বলেছেন? রাসূল (ছাঃ) বললেন, হ্যাঁ। তখন উবাই (খুশীতে) কাঁদতে লাগলেন’।[4] তিনিই প্রথম রাসূল (ছাঃ)-এর অহি লেখক ছিলেন এবং অন্যতম ফৎওয়া দানকারী ছাহাবী ছিলেন। অধিকাংশের মতে তিনি ওমর (রাঃ)-এর খিলাফতকালে ২২ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুতে ওমর (রাঃ) বলেন, আজ মুসলমানদের নেতা মৃত্যুবরণ করল (আল-ইছাবাহ, উবাই ক্রমিক ৩২)।

(৭) যায়েদ বিন ছাবেত আনছারী (রাঃ) বয়স কম থাকায় বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণে ব্যর্থ হন। এরপর থেকে সকল যুদ্ধে রাসূল (ছাঃ)-এর সাথী ছিলেন। তিনি অহি লিখতেন এবং শিক্ষিত ছাহাবীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন (مِنْ عُلَمَاءِ الصَّحَابَةِ)। আবুবকর (রাঃ)-এর সময় কুরআন সংকলনের দায়িত্ব তাঁর উপরেই প্রদান করা হয়। হিজরতের পর রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট বনু নাজ্জারের এই তরুণকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হলে তিনি তাঁকে কুরআনের ১৭টি সূরা মুখস্থ শুনিয়ে দেন। তাতে বিস্মিত হয়ে রাসূল (ছাঃ) বলেন, তুমি ইহূদীদের পত্র পাঠ করা শিখ। তখন আমি ১৫ দিনের মধ্যেই ইহূদীদের ভাষা শিখে ফেলি। অতঃপর রাসূল (ছাঃ)-এর পক্ষ থেকে তাদের নিকট আমি পত্র লিখতাম এবং তারা লিখলে আমি তাঁকে তা পড়ে শুনাতাম’ (আল-ইছাবাহ, যায়েদ বিন ছাবেত ক্রমিক ২৮৮২)।

(৮) আব্দুল্লাহ বিন ‘আমর ইবনুল ‘আছ সাহমী কুরায়শী (রাঃ) অত্যন্ত ‘আবেদ ও যাহেদ ছাহাবী ছিলেন। রাসূল (ছাঃ) এই তরুণ ছাহাবীকে একদিন অন্তর একদিন ছিয়াম রাখার ও সাতদিনে বা সর্বনিম্নে তিনদিনে কুরআন খতম করার অনুমতি দেন (বুখারী হা/৫০৫২)। তিনি রাসূল (ছাঃ)-এর হাদীছসমূহ লিপিবদ্ধ করতেন। তিনি বলেন, আমি নিয়মিত হাদীছ লিখতাম। তাতে কুরায়েশরা আমাকে নিষেধ করে এবং বলে যে, তুমি সব কথা লিখ না। কেননা রাসূল (ছাঃ) একজন মানুষ। তিনি ক্রোধের সময় ও খুশীর সময় কথা বলেন। তখন আমি লেখা বন্ধ করি এবং রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে উক্ত বিষয়টি উত্থাপন করি। জবাবে রাসূল (ছাঃ) বলেন, اكْتُبْ فَوَالَّذِى نَفْسِى بِيَدِهِ مَا خَرَجَ مِنِّى إِلاَّ حَقٌّ ‘তুমি লেখ। যার হাতে আমার জীবন তার কসম করে বলছি, আমার থেকে হক ব্যতীত কিছুই বের হয় না’ (আহমাদ হা/৬৫১০, হাদীছ ছহীহ)। আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, مَا أَجِدُ مِنْ أَصْحَابِ رَسُولِ اللهِ صلى الله عليه و سلم أَكْثَرَ حَدِيْثًا مِنِّي إِلاَّ مَا كَانَ مِنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَمْرٍو فَإِنَّهُ كَانَ يَكْتُبُ ‘রাসূল (ছাঃ)-এর ছাহাবীগণের মধ্যে আমি আমার চাইতে অধিক হাদীছ বর্ণনাকারী কাউকে পাইনি আব্দুল্লাহ বিন ‘আমর ব্যতীত। কেননা তিনি হাদীছ লিখতেন’। তিনি ৬৫ হিজরীতে ৭২ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর স্থান নিয়ে মতভেদ আছে। কেউ বলেছেন শামে বা ত্বায়েফে বা মিসরে বা মক্কায়’ (আল-ইছাবাহ, আব্দুল্লাহ বিন ‘আমর ক্রমিক ৪৮৫০)। তাঁর লিখিত হাদীছের সংখ্যা অন্যূন সাতশত।

(৯) অনুরূপভাবে বনু নাজ্জারের জনৈক ব্যক্তি খ্রিষ্টান হয়ে যায়। পরে সে মুসলমান হয়ে ‘অহি’ লেখার দায়িত্ব পায়। অতঃপর সে পালিয়ে গিয়ে পুনরায় খ্রিষ্টান হয়ে যায় এবং অপবাদ দেয় যে, মুহাম্মাদ সেটুকুই জানে, যতটুকু আমি লিখি (مَا يَدْرِى مُحَمَّدٌ إِلاَّ مَا كَتَبْتُ لَهُ)। পরে আল্লাহ তাকে মৃত্যু দান করেন। লোকেরা তাকে দাফন করে। কিন্তু সকালে দেখা গেল যে, মাটি তাকে উগরে ফেলে দিয়েছে। তখন লোকেরা বলল, এসব মুহাম্মাদ ও তাঁর সাথীদের কাজ। অতঃপর তারা খুব গভীর করে তাকে দাফন করল। কিন্তু পরদিন সকালে একইভাবে নিক্ষিপ্ত অবস্থায় তাকে পাওয়া গেল। তখন লোকেরা বলল, এটি মানুষের কাজ নয়। অতঃপর তারা তাকে ফেলে রাখল’ (বুখারী হা/৩৬১৭)। অন্য বর্ণনায় এসেছে, সে বলেছিল, আমি মুহাম্মাদের চাইতে বেশী জানি। আমি চাইলে এরূপ লিখতে পারি’(أَنَا أَعْلَمُكُمْ بِمُحَمَّدٍ إِنْ كُنْتُ لأَكْتُبُ مَا شِئْتُ)। অতঃপর সে মৃত্যুবরণ করে। তার উপরোক্ত কথা জানতে পেরে রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘মাটি তাকে কখনই কবুল করবে না’ (إِنَّ الأَرْضَ لَنْ تَقْبَلَهُ)। রাবী আনাস (রাঃ) বলেন, আবু ত্বালহা (রাঃ) আমাকে বলেছেন যে, আমি তার মৃত্যুর স্থানে গিয়ে দেখি যে, তার লাশ মাটির উপরে পড়ে আছে। তিনি লোকদের জিজ্ঞেস করলেন। তারা বলল, আমরা তাকে বারবার দাফন করেছি। কিন্তু মাটি তাকে বারবার উপরে ফেলে দিয়েছে’।[5]

[1]. ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ৫/৩৩৯-৩৫৫; মুছত্বফা আ‘যামী, কুত্তাবুন নবী (বৈরূত : ১৩৯৮/১৯৭৮ খৃঃ)।
[2]. মাহমূদ শাকের, আত-তারীখুল ইসলামী (বৈরূত : আল-মাকতাবুল ইসলামী, তাবি) ২/৩৫৫ পৃঃ।
[3]. ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ৫/৩৩৯-৩৫৫, ‘অহি লেখকগণ’ অনুচ্ছেদ।
[4]. বুখারী হা/৪৯৫৯, মুসলিম হা/৭৯৯; মিশকাত হা/২১৯৬।
[5]. ছহীহ ইবনু হিববান হা/৭৪৪; আহমাদ হা/১২২৩৬, সনদ ছহীহ। মিশকাত হা/৫৮৯৮ ‘মু‘জিযা সমূহ’ অনুচ্ছেদ। মিশকাতে বর্ণিত হাদীছে তার মুরতাদ হওয়ার খবর শুনে রাসূল (ছাঃ) ‘মাটি তাকে কবুল করবে না’ (إن الأرض لا تقبله) বলেন। অতঃপর শেষে ‘মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ’ লেখা হয়েছে। কিন্তু বুখারী ও মুসলিমে কোথাও উক্ত বক্তব্য পাওয়া যায়নি। বরং তার মৃত্যুর পরে তিনি বলেছিলেনإِنَّ الأَرْضَ لَنْ تَقْبَلَهُ (ছহীহ ইবনু হিববান হা/৭৪৪) অথবা إِنَّ الأَرْضَ لَمْ تَقْبَلَهُ (আহমাদ হা/১২২৩৬)।

রাসূল (ছাঃ)-এর মুক্তদাস ও দাসীগণ

ইমাম নববী বলেন, বিভিন্ন সময়ে রাসূল (ছাঃ)-এর মোট ৫০ জন গোলাম ছিল। যেমন, (১) যায়েদ বিন হারেছাহ (২) ছাওবান বিন বুজদুদ (ثوبان بن بجدد) (৩) আবু কাবশাহ সুলায়েম। ইনি বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। (৪) বাযাম (৫) রুওয়াইফে‘ (৬) ক্বাছীর (৭) মায়মূন (৮) আবু বাকরাহ (৯) হুরমুয (১০) আবু ছাফিইয়াহ উবায়েদ (১১) আবু সালমা (১২) আনাসাহ (১৩) ছালেহ (১৪) শুক্বরান (১৫) রাবাহ (১৬) আসওয়াদ আন-নূবী (১৭) ইয়াসার আর-রা‘ঈ (১৮) আবু রাফে‘ আসলাম (১৯) আবু লাহছাহ (أبو لهثة)। (২০) ফাযালাহ ইয়ামানী (২১) রাফে‘ (২২) মিদ‘আম (২৩) আসওয়াদ (২৪) কিরকিরাহ (২৫) যায়েদ, যিনি হেলাল বিন ইয়াসার-এর দাদা ছিলেন। (২৬) ওবায়দাহ (২৭) ত্বাহমান (অথবা কায়সান, মিহরান, যাকওয়ান, মারওয়ান)। (২৮) মা’বূর আল-ক্বিবত্বী (২৯) ওয়াক্বেদ (৩০) আবু ওয়াক্বেদ (৩১) হিশাম (৩২) আবু যুমাইরাহ (৩৩) হোনায়েন (৩৪) আবু ‘আসীব আহমার (৩৫) আবু ওবায়দাহ (৩৬) মিহরান ওরফে সাফীনাহ (৩৭) সালমান ফারেসী (৩৮) আয়মান বিন উম্মে আয়মান (৩৯) আফলাহ (৪০) সাবেক্ব (৪১) সালেম (৪২) যায়েদ বিন বূলা (زيد بن بولا)। (৪৩) সাঈদ (৪৪) যুমাইরাহ বিন আবু যুমাইরাহ (ضُمَيرة بن أبى ضميرة) (৪৫) ওবায়দুল্লাহ বিন আসলাম (৪৬) নাফে‘ (৪৭) নাবীল (৪৮) ওয়ারদান (৪৯) আবু উছাইলাহ (أبو أثيلة)। (৫০) আবুল হামরা রাযিয়াল্লাহু ‘আনহুম।

ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) আরও কয়েকজন মুক্তদাসের নাম বলেছেন। যেমন (১) আনজাশাহ (২) সানদার (سندر) (৩) ক্বাসাম (قسام) (৪) আবু মুওয়াইহিবাহ (যাদুল মা‘আদ ১/১১১-১৩)।

মুক্তদাসী ছিল ১২ জন। যেমন, (১) সালমা (২) উম্মে রাফে‘ (৩) উম্মে আয়মান বারাকাহ (৪) মায়মূনাহ বিনতে সাঈদ (৫) খাযেরাহ (خَضِرَةُ)। (৬) রাযওয়া (رَضْوَى)। (৭) উমাইমাহ (৮) রায়হানা (৯) উম্মে যুমাইরাহ (১০) মারিয়াহ বিনতে শাম‘ঊন আল-ক্বিবত্বিয়াহ (১১) তার বোন শীরীন (১২) উম্মে আববাস। এরা কেউ একসঙ্গে ছিলেন না। বরং বিভিন্ন সময়ে ছিলেন।[1] ইবনুল ক্বাইয়িম আর একজনের নাম বলেছেন, রাযীনাহ (رَزِينَةُ) (যাদুল মা‘আদ ১/১১৩)।

মারিয়াহ ও শীরীন দুই বোনকে মিসর রাজ মুক্বাউক্বিস রাসূল (ছাঃ)-এর জন্য উপঢৌকন হিসাবে প্রেরণ করেন। পরে রাসূল (ছাঃ) মারিয়াকে রাখেন ও শীরীনকে হাসসান বিন ছাবিত আনছারী-কে হাদিয়া দেন। মারিয়ার গর্ভে রাসূল (ছাঃ)-এর শেষ সন্তান ইবরাহীমের জন্ম হয় ও শীরীন-এর গর্ভে আব্দুর রহমান বিন হাসসান-এর জন্ম হয় (আল-বিদায়াহ ৫/৩০৭-০৮)।

[1]. ইমাম নববী (৬৩১-৬৭৬ হি.), তাহযীবুল আসমা ওয়াল লুগাত, তাহকীক : মুছত্বফা আব্দুল ক্বাদের ‘আত্বা ১/৩৮-৩৯ পৃঃ; যাদুল মা‘আদ ১/১১১-১৩।

রাসূল (ছাঃ)-এর খাদেমগণ

(১) আনাস বিন মালেক (২) হিন্দ ও তার ভাই (৩) আসমা বিন হারেছাহ আসলামী (৪) রাবী‘আহ বিন কা‘ব আসলামী (৫) আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ। ইনি রাসূল (ছাঃ)-এর জুতা ও মিসওয়াক বহন করতেন। যখনই তিনি উঠতেন জুতা পরিয়ে দিতেন এবং যখনই তিনি বসতেন জুতা জোড়া খুলে নিজ হাতে নিয়ে নিতেন। (৬) ওক্ববাহ বিন ‘আমের আল-জুহানী। সফরকালে তাঁর খচ্চর চালনা করতেন। (৭) বেলাল বিন রাবাহ, মুওয়াযযিন (৮) সা‘দ। দু’জনেই ছিলেন আবুবকর ছিদ্দীক-এর মুক্তদাস। (৯) বাদশাহ নাজাশীর ভাতিজা যূ-মিখমার। যাকে রাসূল (ছাঃ)-এর খিদমতের জন্য ৭ম হিজরীতে বাদশাহ পাঠিয়েছিলেন। (১০) বুকায়ের বিন সারাহ লায়ছী (১১) আবু যার গিফারী (১২) আসলা‘ বিন শারীক আ‘রাজী। সওয়ারী পালন করতেন। (১৩) মুহাজির। উম্মে সালামাহ (রাঃ)-এর মুক্তদাস। (১৪) আবুস সাজা‘ (أبو السجع) রাযিয়াল্লাহু ‘আনহুম (টীকা-পূর্বোক্ত)।

(১৫) এছাড়া একটি ইহূদী বালক তাঁর খাদেম ছিল। যে তাঁর ওযূর পানি ও জুতা এগিয়ে দিত। হঠাৎ সে অসুস্থ হয়ে পড়লে রাসূল (ছাঃ) তাকে দেখতে যান। তার আসন্ন মৃত্যু বুঝতে পেরে তিনি তাকে ইসলাম কবুলের দাওয়াত দেন। সে তার পিতার দিকে তাকালে পিতা তাকে বললেন, أَطِعْ أَبَا الْقَاسِمِ ‘তুমি আবুল ক্বাসেমের আনুগত্য কর’। তখন ছেলেটি কালেমা শাহাদাত পড়ে ইসলাম কবুল করল। অতঃপর মারা গেল। তখন রাসূল (ছাঃ) বেরিয়ে আসার সময় বললেন, الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِى أَنْقَذَهُ بِى مِنَ النَّارِ ‘সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য যিনি আমার মাধ্যমে ছেলেটিকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিলেন’।[1]

[1]. আহমাদ হা/১২৮১৫,১৩৩৯৯; আবুদাঊদ হা/৩০৯৫; বুখারী হা/১৩৫৬; মিশকাত হা/১৫৭৪।




প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর ৬৭ পর্বের জীবনীর সকল পর্ব এখান থেকে পড়ুন-

পর্ব-০১   পর্ব-০২   পর্ব-০৩   পর্ব-০৪   পর্ব-০৫   পর্ব-০৬   পর্ব-০৭   পর্ব-০৮   পর্ব-০৯   পর্ব-১০   পর্ব-১১   পর্ব-১২   পর্ব-১৩   পর্ব-১৪   পর্ব-১৫   পর্ব-১৬   পর্ব-১৭   পর্ব-১৮   পর্ব-১৯   পর্ব-২০   পর্ব-২১   পর্ব-২২   পর্ব-২৩   পর্ব-২৪   পর্ব-২৫   পর্ব-২৬   পর্ব-২৭   পর্ব-২৮   পর্ব-২৯   পর্ব-৩০    পর্ব-৩১   পর্ব-৩২   পর্ব-৩৩   পর্ব-৩৪   পর্ব-৩৫   পর্ব-৩৬   পর্ব-৩৭   পর্ব-৩৮   পর্ব-৩৯   পর্ব-৪০   পর্ব-৪১   পর্ব-৪২   পর্ব-৪৩   পর্ব-৪৪   পর্ব-৪৫   পর্ব-৪৬(১ম) পর্ব-৪৬(২য়)    পর্ব-৪৭   পর্ব-৪৮   পর্ব-৪৯   পর্ব-৫০   পর্ব-৫১   পর্ব-৫২   পর্ব-৫৩   পর্ব-৫৪   পর্ব-৫৫   পর্ব-৫৬   পর্ব-৫৭   পর্ব-৫৮   পর্ব-৫৯   পর্ব-৬০   পর্ব-৬১   পর্ব-৬২   পর্ব-৬৩   পর্ব-৬৪   পর্ব-৬৫   পর্ব-৬৬   পর্ব-৬৭  



******************************************
>>> Welcome, You are now on Mohammadia Foundation's Website. Please stay & Tune with us>>>


এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url