প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর জীবনী [পর্ব- ৩৩] || মহানবীর জীবনী ||





পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ট মহামানব আমাদের প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:)। যাকে আল্লাহ সমস্ত মানুষের জন্য অশেষ রহমত স্বরূপ এই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। যে নবী সারা জীবন উম্মতের জন্য সংগ্রাম করেছেন, কাল রোজ হাশরের মাঠেও যিনি উম্মতের জন্যই পেরেশান থাকবেন; সেই প্রাণপ্রিয় নবীকে আমরা কতটুকু চিনি কতটুকু জানি। প্রিয় নবী (সা:) এর জীবনের পরতে পরতে রয়েছে আমাদের জন্য শিক্ষা ও অনুপ্রেরণা। যার জীবনী পড়লে নিজের অজান্তেই চোখের পানি গড়িয়ে পড়ে। সেই নবীর জীবনী কি আমরা সত্যিই জানি? আসুন, আরেকবার দেখে নেই “প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর জীবনী”। যে জীবনী পড়ে বদলে যেতে পারে আপনার আমার জীবন। আল্লাহ আমাদের সবাইকে প্রাণপ্রিয় নবীর (সা:) উম্মত হিসাবে কবুল করুন। আমিন।।

ওহোদ যুদ্ধের উল্লেখযোগ্য ৩৫টি বিষয়

‘আব্দুল্লাহ’ নামের কাফেরগণ

(ক) কুরায়েশ বাহিনীর পতাকাবাহী বনু ‘আব্দিদ্দার-এর নিহত ১০জন পতাকাবাহীর প্রথম ৬ জনের সকলেই ছিল আব্দুল্লাহ বিন ওছমান ইবনু ‘আব্দিদ্দারের পুত্র অথবা পৌত্র।

(খ) কুরায়েশ তীরন্দায বাহিনীর অধিনায়ক ছিল বদর যুদ্ধে নিহত উৎবাহর ভাই আব্দুল্লাহ বিন রাবী‘আহ।

(গ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর উপরে সরাসরি আঘাতকারী তিনজন কাফের সৈন্যের দ্বিতীয় জন ছিল আব্দুল্লাহ ইবনে শিহাব যুহরী, যার আঘাতে রাসূল (ছাঃ)-এর ললাট রক্তাক্ত হয়। ইনি ছিলেন পরবর্তীকালে বিখ্যাত তাবেঈ মুহাম্মাদ ইবনে শিহাব যুহরী (৫০-১২৪ হি.)-এর দাদা (আল-ইছাবাহ, ক্রমিক ৪৭৫৫)। তৃতীয় জন ছিল আব্দুল্লাহ বিন ক্বামিআহ লায়ছী, যার আঘাতে শিরস্ত্রাণের দু’টি কড়া রাসূল (ছাঃ)-এর চোখের নীচে হাঁড়ের মধ্যে ঢুকে যায়। শেষোক্ত ব্যক্তি একই সময়ে মুহাজিরগণের পতাকাবাহী মুছ‘আব বিন ওমায়েরকে হত্যা করে এবং চেহারায় মিল থাকার কারণে তাকেই রাসূল ভেবে ‘মুহাম্মাদ নিহত হয়েছেন’ বলে সে সর্বত্র রটিয়ে দেয়। মুছ‘আব শহীদ হওয়ার পরে রাসূল (ছাঃ) যুদ্ধের পতাকা হযরত আলী (রাঃ)-এর হাতে অর্পণ করেন।

(ঘ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন তাঁর সৈন্যদের শিবিরে ফিরিয়ে নিচ্ছিলেন, তখন তাঁর উপরে হামলাকারী প্রথম কাফের সৈন্যটির নাম ছিল ওছমান বিন আব্দুল্লাহ বিন মুগীরাহ। দ্বিতীয় কাফির সৈন্যটির নাম ছিল আব্দুল্লাহ বিন জাবের। প্রথমজন হারেছ ইবনুছ ছিম্মাহর আঘাতে এবং দ্বিতীয় জন আবু দুজানার হাতে নিহত হয়। এইসব আব্দুল্লাহগণ আল্লাহ ও আখেরাতে বিশ্বাসী হওয়া সত্ত্বেও এরা আল্লাহর বিধান মানতে ও রিসালাত-এর উপরে ঈমান আনতে রাযী ছিল না। এক কথায় তারা তাওহীদে রুবূরিয়াতে বিশ্বাসী ছিল। কিন্তু তওহীদে ইবাদতে বিশ্বাসী ছিল না। মুমিন হওয়ার জন্য যা অপরিহার্য শর্ত। এ যুগেও এমন আব্দুল্লাহদের অভাব নেই।

পিতা ও পুত্র পরস্পরের বিপক্ষে

হিজরতের পূর্বে মদীনার আউস গোত্রের সর্দার ও ধর্মযাজক ছিলেন আবু ‘আমের আর-রাহেব’। হিজরতের পরে তিনি মক্কায় চলে যান এবং কুরায়েশদের পক্ষে ওহোদ যুদ্ধে যোগদান করেন। সেজন্য রাসূল (ছাঃ) তার লকব দেন আবু ‘আমের আল-ফাসেক্ব’। পক্ষান্তরে তার পুত্র ‘হানযালা’ ছিলেন মুসলিম বাহিনীর সেই তরুণ সৈন্য যিনি সবেমাত্র বিয়ে করে বাসর যাপন করছিলেন। অতঃপর যুদ্ধের ঘোষণা শুনেই নাপাক অবস্থায় ময়দানে চলে আসেন এবং ভীষণ তেজে যুদ্ধ করে শহীদ হন। ফেরেশতাগণ তাকে গোসল দেন। এজন্য তাঁকে ‘গাসীলুল মালায়েকাহ’ বলা হয়’।[1]
[1]. ইবনু হিশাম ২/৭৫; যাদুল মা‘আদ ৩/১৭২; আর-রাহীক্ব ২৮১ পৃঃ।

দুই ভাই পরস্পরের বিপক্ষে

ওহোদ যুদ্ধে রাসূল (ছাঃ)-এর উপরে হামলাকারী তিন জনের প্রথম জন ছিল উৎবাহ বিন আবু ওয়াকক্বাছ। তার নিক্ষিপ্ত পাথরের আঘাতেই রাসূল (ছাঃ)-এর ডান দিকের নীচের রুবাঈ দাঁত ভেঙ্গে যায়। এই উৎবাহর ভাই ছিলেন ‘ইসলামে প্রথম রক্ত প্রবাহিতকারী’ এবং মুসলিম বাহিনীর খ্যাতনামা বীর ও পরবর্তীকালে ইরাক বিজেতা সেনাপতি হযরত সা‘দ বিন আবু ওয়াকক্বাছ (রাঃ)।[1]

[1]. সা‘দ বিন আবু ওয়াকক্বাছ ১৯ বছর বয়সে মক্কায় ৭ম ব্যক্তি হিসাবে ইসলাম কবুল করেন। তিনি ৪র্থ নববী বর্ষে মক্কায় আল্লাহর পথে কাফেরদের বিরুদ্ধে উটের চোয়ালের শুকনা হাড্ডি নিক্ষেপ করে রক্ত প্রবাহিত করেন। এজন্য তাঁকে ‘ইসলামে প্রথম রক্ত প্রবাহিতকারী’ (أَوّلَ دَمٍ هُرِيقَ فِي الْإِسْلاَمِ) বলা হয়’ (ইবনু হিশাম ১/২৬৩; আল-ইছাবাহ ৩১৯৬)। এ সময় তিনি তার সাথীদের নিয়ে মক্কার একটি সংকীর্ণ স্থানে গোপনে ছালাত আদায় করছিলেন। তখন কাফেররা তাদের উপর হামলা করে। ফলে তিনি তাদের প্রতি উক্ত আঘাত করেন এবং তারা ফিরে যায়। ১ম হিজরীর শাওয়াল মাসে শত্রুদের বিরুদ্ধে ‘রাবেগ’ অভিযানে সর্বপ্রথম তিনিই আল্লাহর রাস্তায় তীর নিক্ষেপ করেন। এজন্য তাঁকে ‘ইসলামে প্রথম তীর নিক্ষেপকারী’ (أَوَّلُ مَنْ رَمَى بِسَهْمٍ فِي سَبِيلِ الله) বলা হয় (আল-ইছাবাহ ৩১৯৬)। তিনি জীবদ্দশায় জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত ১০ জন ছাহাবীর (আশারায়ে মুবাশশারাহ) অন্যতম ছিলেন। তিনি বদর, ওহোদ, হোদায়বিয়াহ সহ রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে সকল যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। যাদের দো‘আ কবুল হয় (مُسْتَجَابُ الدَّعْوَةِ), তিনি ছিলেন তাদের অন্যতম। রাসূল (ছাঃ) তাঁর সম্পর্কে দো‘আ করেন اللَّهمَّ سَدِّدْ سَهْمَهُ وَأَجِبْ دَعْوَتَهُ ‘হে আল্লাহ তুমি তার তীরকে লক্ষ্যভেদী কর এবং তার দো‘আ কবুল কর’। আলী (রাঃ) বলেন, ওহোদের যুদ্ধে তিনি বলেছিলেন, يَا سَعْدُ إرْمِ فِدَاكَ أَبِي وَأُمِّي ‘হে সা‘দ! তুমি তীর নিক্ষেপ কর। তোমার জন্য আমার পিতা-মাতা উৎসর্গীত হৌন’! এরূপ কথা তিনি অন্য কারু জন্য বলেছেন বলে আমি শুনিনি’ (বুখারী হা/৪০৫৯; মুসলিম হা/২৪১১; মিশকাত হা/৬১০৩)। তিনি ওমর (রাঃ) কর্তৃক নির্বাচিত ৬ সদস্য বিশিষ্ট খেলাফত বোর্ডের সদস্য ছিলেন। তিনি ওমর (রাঃ)-এর সময় কূফার গবর্ণর ছিলেন। অতঃপর ৫৫ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। -ইবনু হাজার, আল-ইছাবাহ ক্রমিক সংখ্যা ৩১৯৬; ঐ, অন্য মুদ্রণে ৩১৮৭, ৪/১৬০-৬৪ পৃঃ; ইবনু আব্দিল বার্র, আল-ইস্তী‘আব ক্রমিক সংখ্যা ৯৬৩; আল-ইছাবাহ সহ ৪/১৭০-৭১ পৃঃ।

ওহোদ যুদ্ধে কুরায়েশ মহিলাদের তৎপরতা

(ক) কুরায়েশ পক্ষে প্রধান সেনাপতি আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দ বিনতে উৎবাহ ১৫ জনের মহিলা দলের নেতৃত্ব দেন। তারা নেচে গেয়ে তাদের সৈন্যদের উত্তেজিত করেন। যুদ্ধে আবু দুজানার তরবারির হাত থেকে হিন্দা বেঁচে যান তার হায় হায় শব্দে তাকে নারী হিসাবে চিনতে পারার কারণে।[1] (খ) পলায়নপর কুরায়েশ বাহিনী যখন পুনরায় অরক্ষিত গিরিপথ দিয়ে ময়দানে আবির্ভূত হয়, তখন কুরায়েশ বাহিনীর ভূলুণ্ঠিত যুদ্ধ পতাকা ‘আমরাহ বিনতে ‘আলক্বামাহ নাম্মী এক কুরায়েশ মহিলা অসীম বীরত্বের সাথে দ্রুত উঁচু করে তুলে ধরেন। যা দেখে বিক্ষিপ্ত ও ভীত-সন্ত্রস্ত কুরায়েশ বাহিনী পুনরায় যুদ্ধক্ষেত্রে ফিরে আসে ও গণীমত কুড়ানোয় ব্যস্ত মুসলিম বাহিনীকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে’ (আর-রাহীক্ব ২৬৪ পৃঃ)।

[1]. ইবনু হিশাম ২/৬৯; আর-রাহীক্ব ২৬১ পৃঃ।

ওহোদ যুদ্ধে মুসলিম মহিলাদের ভূমিকা

(ক) যুদ্ধ শেষে কিছু মুসলিম মহিলা ময়দানে আগমন করেন। তাঁদের মধ্যে হযরত আয়েশা বিনতে আবুবকর (রাঃ), আনাস (রাঃ)-এর মা উম্মে সুলায়েম(أم سُلَيم) আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ)-এর মা উম্মে সুলাইত্ব(أم سُلَيط) মুছ‘আব বিন উমায়ের (রাঃ)-এর স্ত্রী হামনাহ বিনতে জাহশ আল-আসাদিইয়াহ প্রমুখ ছিলেন। যারা পিঠে পানির মশক বহন করে এনে আহত সৈনিকদের পানি পান করান ও চিকিৎসা সেবা দান করেন।[1]

(খ) যুদ্ধ শেষে ঘাঁটিতে স্থিতিশীল হওয়ার পর কন্যা ফাতেমা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর যখম ধুয়ে ছাফ করেন এবং জামাতা আলী তার ঢালে করে পানি এনে তাতে ঢেলে দেন। কিন্তু যখন দেখা গেল যে, তাতে রক্ত বন্ধ হচ্ছে না। তখন ফাতেমা (রাঃ) চাটাইয়ের একটা অংশ জ্বালিয়ে তার ভস্ম ক্ষতস্থানে লাগিয়ে দেন। তাতে রক্ত বন্ধ হয়ে যায়।[2] এতে প্রমাণিত হয় যে, চিকিৎসা গ্রহণ করা নবীগণের মর্যাদার বিরোধী নয় এবং এটি আল্লাহর উপরে ভরসা করারও বিরোধী নয়। তাছাড়া এটাও বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) মানুষ নবী ছিলেন, নূরের নবী নন। এটাও প্রমাণিত হয় যে, মেয়েরা চিকিৎসক হতে পারে। যদি তা তাদের পর্দা ও মর্যাদার খেলাফ না হয়।

[1]. বুখারী হা/৪০৬৪, ২৮৮১; ত্বাবারাণী, সনদ হাসান, মাজমা‘উয যাওয়ায়েদ হা/১৫৪২৪।

প্রসিদ্ধ আছে যে, উম্মে আয়মন এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং যখন তিনি দেখলেন যে, কুরায়েশ বাহিনীর শেষোক্ত হামলায় বিপর্যস্ত হয়ে মুসলিম বাহিনীর কেউ কেউ মদীনায় ঢুকে পড়ছে, তখন তিনি তাদের চেহারায় মাটি নিক্ষেপ করতে লাগলেন ও বলতে লাগলেন هَاكَ الْمِغْزَلُ فَاغْزِلْ بِهِ وَهَلُمَّ سَيْفَكَ ‘তোমরা এই সূতা কাটার চরকা নাও এবং আমাদেরকে তরবারি দাও’। এই বলে তিনি দ্রুতগতিতে যুদ্ধক্ষেত্রে পৌঁছেন এবং আহতদের পানি পান করাতে শুরু করেন। তার উপরে জনৈক শত্রুসৈন্য তীর চালিয়ে দিলে তিনি পড়ে যান ও বিবস্ত্র হয়ে যান’। এ দেখে আল্লাহর শত্রু হো হো করে হেসে ওঠে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তখন সা‘দ বিন আবু ওয়াকক্বাছকে একটি পালকবিহীন তীর দিয়ে বলেন, এটা ওর উপরে চালাও’। সা‘দ ওটা চালিয়ে দিলে ঐ শত্রুটির গলায় বিদ্ধ হয় ও চিৎ হয়ে পড়ে বিবস্ত্র হয়ে যায়। তাতে রাসূল (ছাঃ) হেসে ওঠেন’ (আর-রাহীক্ব ২৭৭ পৃঃ; ওয়াক্বেদী, মাগাযী ১/২৭৮; বায়হাক্বী, দালায়েলুন নবুঅত ৩/৩১১)।

ঘটনাটি ওয়াক্বেদী বিনা সনদে বর্ণনা করেছেন। বিদ্বানগণের নিকটে ওয়াক্বেদী পরিত্যক্ত (مَتْرُوك)। বায়হাক্বীও তাঁর থেকে বর্ণনা করেছেন। ইবনু হাজার উম্মে আয়মানের জীবনীতে এ বিষয়ে কিছুই বলেননি। তিনি ওয়াক্বেদীর বরাতে কেবল এতটুকু বলেছেন যে, حَضَرَتْ أُمُّ أَيْمَنَ أُحُدًا وَكَانَتْ تَسْقِي الْمَاءَ وَتُدَاوِي الْجَرْحَى- ‘উম্মে আয়মান ওহোদ যুদ্ধে উপস্থিত ছিলেন এবং তিনি সৈন্যদের পানি পান করাতেন ও আহতদের সেবা দিতেন’ (আল-ইছাবাহ ক্রমিক সংখ্যা ১১৮৯৮)। অতএব বিষয়টি আদৌ প্রমাণিত নয় এবং এটি তাঁর মর্যাদার উপযোগীও নয়। ছহীহ হাদীছে যুদ্ধের ময়দানে সেবা দানে যেসব মহিলার নাম পাওয়া যায়, সেখানে উম্মে আয়মানের উল্লেখ নেই।

[2]. বুখারী হা/৪০৭৫।

প্রসিদ্ধ আছে যে, উম্মে ‘উমারাহ নুসাইবাহ বিনতে কা‘ব, যিনি ১৩ নববী বর্ষে মক্কায় অনুষ্ঠিত আক্বাবায়ে কুবরায় শরীক ছিলেন, তিনি অন্যান্য মহিলাদের সঙ্গে আহতদের সেবা-শুশ্রূষায় রত ছিলেন। যখন শুনলেন যে, আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) কাফেরদের মধ্যে ঘেরাও হয়েছেন তখন ছুটে এসে বীর বিক্রমে কাফেরদের প্রতি তীর বর্ষণ শুরু করেন। ইবনু সা‘দ ওয়াক্বেদী সূত্রে বলেন, এই সময় রাসূল (ছাঃ) তাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘তুমি যা পারছ তা কে পারবে হে উম্মে ‘উমারাহ! তিনি আরও বলেন, ‘আমি ডাইনে-বামে যেদিকে তাকাই, সেদিকেই কেবল উম্মে ‘উমারাহকে দেখি, সে আমার জন্য লড়াই করছে’ (তাবাক্বাত ইবনু সা‘দ ৮/৪১৪-১৫)। রাসূল (ছাঃ)-কে আঘাতকারী ইবনু ক্বামিআহকে তিনি তরবারি দ্বারা কয়েকবার আঘাত করেন। কিন্তু লৌহ বর্মধারী হওয়ায় সে বেঁচে যায়। পাল্টা তার আঘাতে উম্মে ‘উমারাহর স্কন্ধে গভীর ক্ষত সৃষ্টি হয়’ (ইবনু হিশাম ২/৮১-৮২; আর-রাহীক্ব ২৭২ পৃঃ; সনদ মুনক্বাতি‘ (মা শা-‘আ ১৬০; সীরাহ ছহীহাহ ২/৩৯০)।

মুবারকপুরী উক্ত ১২টি যখম ওহোদের যুদ্ধে লেগেছিল বলেছেন (আর-রাহীক্ব ২৭২ পৃঃ), যা ঠিক নয়। বরং এটি ছিল আবুবকর (রাঃ)-এর খিলাফতকালে ১১-১২ হিজরীতে সংঘটিত ভন্ডনবীদের বিরুদ্ধে ইয়ামামাহর যুদ্ধের ঘটনা, যেখানে উম্মে ‘উমারাহ সশরীরে যোগদান করেছিলেন ও ১২টি যখম দ্বারা গুরুতর আহত হয়েছিলেন’ (ইবনু হিশাম ১/৪৬৭)।

ফেরেশতারা যাঁকে গোসল দিলেন

যুদ্ধে যাওয়ার ঘোষণা শুনেই বাসর ঘর ছেড়ে ত্বরিৎ গতিতে যুদ্ধের ময়দানে এসে শত্রুদের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়েন সদ্য বিবাহিত যুবক হানযালা বিন আবু ‘আমের আর-রাহেব। অমিত বিক্রমে যুদ্ধ করতে করতে তিনি শত্রু বাহিনীর সারিগুলি তছনছ করে মধ্যভাগে পৌঁছে যান। অতঃপর কুরায়েশ সেনাপতি আবু সুফিয়ানের মাথার উপরে তরবারি উত্তোলন করেন তাকে খতম করে দেবার জন্য। কিন্তু সেই মুহূর্তে শত্রুপক্ষের শাদ্দাদ বিন আউসের আঘাতে তিনি ধরাশায়ী হন ও শাহাদাত বরণ করেন।

যুদ্ধশেষে হানযালার মৃত দেহ অদৃশ্য ছিল। অনেক সন্ধানের পর এক স্থানে এমন অবস্থায় পাওয়া গেল যে, যমীন হ’তে উপরে রয়েছে এবং ওটা হ’তে টপটপ করে পানি পড়ছে। এ দৃশ্য দেখে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ছাহাবায়ে কেরামকে বললেন, ‘ফেরেশতারা তাকে গোসল দিচ্ছে’। পরে তার স্ত্রীর কাছে প্রকৃত ব্যাপারটি জানা যায় যে, তিনি নাপাকীর গোসল ছাড়াই যুদ্ধের ময়দানে ছুটে এসেছিলেন। ফলে তখন থেকে হানযালা ‘গাসীলুল মালায়েকাহ’ (غَسِيلُ الْمَلاَئِكَةِ) বা ‘ফেরেশতাগণ কর্তৃক গোসলকৃত’ বলে অভিহিত হন।[1] অপর হাদীছ থেকে জানা যায় রাসূল (ছাঃ) হামযা (রাঃ) ও হানযালা (রাঃ) উভয়কেই ফেরেশতা কর্তৃক গোসল দিতে দেখেছিলেন, কেননা তারা উভয়েই নাপাক ছিলেন।[2]

[1]. হাকেম হা/৪৯১৭; ছহীহাহ হা/৩২৬ সনদ হাসান।
[2]. ত্বাবারাণী কাবীর হা/১২০৯৪; আলবানী, আহকামুল জানায়েয ১/৫৬, সনদ ছহীহ।

নিজেদের হাতে নিজেদের মৃত্যু

খালেদ বিন ওয়ালীদের অতর্কিত হামলায় দিশেহারা মুসলিম বাহিনীর মধ্যে দু’ধরনের লোকের সৃষ্টি হয়। একদল কাফিরদের বেষ্টনীর মধ্যে পড়ে জান বাঁচানোর জন্য পালিয়ে গিয়ে মদীনায় ঢুকে পড়ে এবং কেউ পাহাড়ের মাথায় উঠে পড়ে। অন্যদল শত্রুসেনাদের মধ্যে মিশে যায়। এ বিষয়ে মা আয়েশা (রাঃ) বলেন, ওহোদ যুদ্ধের দিন মুশরিকরা পরাজিত হয়। এরপর ইবলীস ডাক দিয়ে বলে, أَىْ عِبَادَ اللهِ أُخْرَاكُمْ ‘ওহে আল্লাহর বান্দারা পিছনে’ (অর্থাৎ পিছন দিক থেকে আক্রমণ কর)’। তার কথায় সামনের সারির সৈন্যরা পিছন দিকে ফিরে আসে এবং পিছনের সারির সৈন্যদের সাথে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। হুযায়ফা (রাঃ) দেখেন যে, তাঁর পিতা ইয়ামানের উপর আক্রমণ করা হচ্ছে। তিনি তখন বলে ওঠেন, أَىْ عِبَادَ اللهِ، أَبِى أَبِى ‘হে আল্লাহর বান্দারা! উনি আমার পিতা, উনি আমার পিতা’। কিন্তু আল্লাহর কসম! (মুসলিম) সৈন্যরা আক্রমণ হতে বিরত হল না। অতঃপর তারা তাঁকে হত্যা করে ফেলল। তখন হুযায়ফা বললেন, আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করুন! উরওয়া বলেন, ‘আল্লাহর কসম! হুযায়ফা-র মধ্যে সর্বদা কল্যাণ বিরাজমান ছিল। অবশেষে তিনি আল্লাহ তা‘আলার সাথে মিলিত হন’ (বুখারী হা/৪০৬৫)।

অন্য বর্ণনায় এসেছে, তখন হুযায়ফা (রাঃ) বলেন,يَغْفِرُ اللهُ لَكُمْ وَهُوَ أَرْحَمُ الرَّاحِمِينَ ‘আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করুন! তিনি শ্রেষ্ঠ দয়াশীল’। রাসূল (ছাঃ) তাকে তার পিতার রক্তমূল্য দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি তা না নিয়ে মাফ করে দেন।[1]

[1]. ইবনু হিশাম ২/৮৭-৮৮; বর্ণনাটির সনদ ছহীহ (তাহকীক ইবনু হিশাম ক্রমিক ১১৪৬); হাকেম হা/৪৯০৯, ৩/২০২ পৃঃ।

মুশরিকদের বেষ্টনীতে রাসূল (ছাঃ)

সাথী মাত্র নয়জন জান কোরবান ছাহাবী
যুদ্ধ চলা অবস্থায় আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) সাত জন আনছার ও দু’জন মুহাজির সহ মোট নয় জন সাথী নিয়ে সেনাবাহিনীর পিছনে থেকে সৈন্য পরিচালনা করছিলেন। এমন সময় হঠাৎ দেখতে পান যে, সংকীর্ণ গিরিপথ দিয়ে খালেদ বিন অলীদ সসৈন্যে তীরবেগে ঢুকে পড়ছেন। তখন তিনি সাক্ষাৎ বিপদ বুঝতে পেরে চীৎকার দিয়ে মুসলিম বাহিনীকে ডাক দিলেন ‘হে আল্লাহর বান্দারা এদিকে এসো’ (إِلَيَّ عِبَادَ اللهِ، إِلَيَّ عِبَادَ اللهِ) বলে। এতে মুশরিক বাহিনী তাঁর অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে চারদিক থেকে এসে তাঁকে ঘিরে ফেলে। এ সময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَنْ يَرُدُّهُمْ عَنَّا وَلَهُ الْجَنَّةُ أَوْ هُوَ رَفِيقِى فِى الْجَنَّة‘যে ব্যক্তি আমাদের থেকে ওদের হটিয়ে দেবে তার জন্য জান্নাত’। অথবা তিনি বলেন, সে ব্যক্তি আমার সাথে জান্নাতে থাকবে’ (মুসলিম হা/১৭৮৯)। তখন তাঁকে বাঁচানোর জন্য সাথী সাত জন আনছার ছাহাবীর সকলে জীবন দিলেন। বাকী রইলেন দু’জন মুহাজির ছাহাবী হযরত ত্বালহা বিন ওবায়দুল্লাহ এবং সা‘দ বিন আবু ওয়াকক্বাছ (রাঃ)।[1] তাদের অতুলনীয় বীরত্বের মুখে কাফের বাহিনী এগিয়ে আসতে বাধাগ্রস্ত হয়। এ বিষয়ে কুরআন বলেছে, إِذْ تُصْعِدُوْنَ وَلاَ تَلْوُوْنَ عَلَى أحَدٍ وَالرَّسُوْلُ يَدْعُوْكُمْ فِيْ أُخْرَاكُمْ ‘যখন তোমরা (ভয়ে পাহাড়ের) উপরে উঠে যাচ্ছিলে এবং পিছন দিকে কারু প্রতি ফিরে তাকাচ্ছিলে না, অথচ রাসূল তোমাদের ডাকছিলেন তোমাদের পিছন থেকে... (আলে ইমরান ৩/১৫৩)।

[1]. মুসলিম হা/২৪১৪ ‘ছাহাবীগণের মর্যাদা’ অধ্যায় ৬ অনুচ্ছেদ।

ওয়াক্বেদী আনছার ও মুহাজির থেকে ১৪ জনের কথা বর্ণনা করেছেন। সেখানে আনছারদের মধ্যকার ৭ জন হ’লেন, (১) হুবাব ইবনুল মুনযির (২) আবু দুজানাহ (৩) ‘আছেম বিন ছাবেত (৪) হারেছ ইবনুছ ছিম্মাহ (৫) সাহল বিন হুনাইফ (৬) উসায়েদ বিন হুযায়ের এবং (৭) সা‘দ বিন মু‘আয। মুহাজিরদের মধ্যকার ৭ জন হ’লেন, (১) আবুবকর (২) আব্দুর রহমান বিন ‘আওফ (৩) আলী বিন আবু ত্বালেব (৪) সা‘দ বিন আবু ওয়াকক্বাছ (৫) ত্বালহা বিন ওবায়দুল্লাহ (৬) আবু ওবায়দাহ ইবনুল জাররাহ এবং (৭) যুবায়ের ইবনুল ‘আওয়াম (ওয়াক্বেদী, মাগাযী ১/২৪০)।

তবে ছহীহ বুখারীর বর্ণনায় মুহাজিরদের মধ্যে ত্বালহা ও সা‘দ বিন আবু ওয়াকক্বাছ (রাঃ) ব্যতীত অন্য কেউ ছিলেন না বলা হয়েছে’ (বুখারী হা/৪০৬০)। কোন কোন বর্ণনায় আনছারদের মধ্যে সর্বশেষ যিয়াদ অথবা ‘উমারাহ ইবনুস সাকান (রাঃ)-এর নাম এসেছে’ (ফাৎহুলবারী হা/৪০৬০-এর আলোচনা দ্রষ্টব্য)। ওয়াক্বেদীর উক্ত তালিকা মেনে নিতে গেলে এটা স্বীকার করতে হয় যে, ঐ সাত জন আনছার ছাহাবীর সকলেই ঐ সময় শহীদ হন। কিন্তু তাঁদের জীবনীতে দেখা যায় যে, তাঁদের একজনও ঐ সময় শহীদ হননি। সম্ভবতঃ এ কারণেই কোন জীবনীকার ঐ সাত জনের তালিকা দেননি। কোন হাদীছেও তাঁদের নাম পাওয়া যায় না। অতএব ঐ সাত জন শহীদ কে কে ছিলেন, তা অজ্ঞাত রইল।

রাসূল (ছাঃ)-এর দান্দান মুবারক শহীদ হল

ত্বালহা ও সা‘দ ব্যতীত যখন রাসূল (ছাঃ)-এর পাশে কেউ নেই,[1] তখন এই সুযোগে তাঁকে হত্যা করার জন্য কাফেররা তাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করে। প্রথমে সা‘দ বিন আবু ওয়াকক্বাছের ভাই উৎবাহ বিন আবু ওয়াকক্বাছ রাসূল (ছাঃ)-এর চেহারা লক্ষ্য করে সজোরে পাথর নিক্ষেপ করে। তাতে রাসূল (ছাঃ)-এর ডান দিকের নীচের রুবাঈ দাঁতটি ভেঙ্গে যায় ও নীচের ঠোটটি আহত হয়। এরপর আব্দুল্লাহ ইবনে শিহাব যুহরী এগিয়ে এসে তাঁর ললাটে তরবারির আঘাত করে যখম করে দেয়। এরপর আব্দুল্লাহ বিন ক্বামিআহ নামক এক দুর্ধর্ষ অশ্বারোহী এসে তার কাঁধের উপরে ভীষণ জোরে তরবারির আঘাত করে। যা তাঁর লৌহবর্ম ভেদ করতে না পারলেও তার ব্যথা ও কষ্ট তিনি এক মাসের অধিক সময় অনুভব করেন। তারপর সে দ্বিতীয় বার আঘাত করে। যাতে তাঁর শিরস্ত্রাণের দু’টি কড়া তাঁর চোখের নীচের হাড়ের মধ্যে ঢুকে থেকে যায়’।[2]

[1]. বুখারী হা/৪০৬০ ‘যুদ্ধ বিগ্রহ’ অধ্যায় ১৮ অনুচ্ছেদ।
[2]. ফাৎহুল বারী হা/৪০৬৮-এর আলোচনা; আর-রাহীক্ব ২৬৮ পৃঃ; ইবনু হিশাম ২/৮০; যাদুল মা‘আদ ৩/১৭৬।

আঘাতকারী তিন জনের পরিণতি : (১) মুবারকপুরী রাসূল (ছাঃ)-এর উপরে হামলাকারীদের পরিণতি হিসাবে বর্ণনা করেন যে, প্রথম হামলাকারী উৎবাহ বিন আবু ওয়াক্ক্বাছ যার নিক্ষিপ্ত পাথরে রাসূল (ছাঃ)-এর দান্দান মুবারক শহীদ হয়। তার ভাই সা‘দ বিন আবু ওয়াকক্বাছ (রাঃ) তার প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার আগেই হাতেব বিন আবু বালতা‘আহ তার পিছে ধাওয়া করে এক আঘাতেই তার মস্তক দেহচ্যুত করে ফেলেন এবং তার ঘোড়া ও তরবারি দখল করে নেন’ (আর-রাহীক্ব ২৭১-৭২ পৃঃ)।

বর্ণনাটি সঠিক নয়। কেননা হাতেব বিন আবু বালতা‘আহ ওহোদ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি। বরং তিনি বদর যুদ্ধে যোগদান করেন এবং হোদায়বিয়ার সন্ধিকালে উপস্থিত ছিলেন’ (আল-ইছাবাহ, হাতেব বিন আবু বালতা‘আহ ক্রমিক ১৫৪০)। উৎবাকে তিনি মেরেছিলেন বলে হাকেম যে বর্ণনা করেছেন, তা আদৌ সঠিক নয় বলে ইবনু হাজার মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, সঠিক কথা এই যে, তিনি আরও এক বছর বেঁচে থেকে কুফরী হালতে মৃত্যুবরণ করেন’ (আল-ইছাবাহ, উৎবাহ বিন আবু ওয়াকক্বাছ ক্রমিক ৬৭৫৫)।

প্রসিদ্ধ আছে যে, এ সময় রাসূল (ছাঃ) উৎবাহ বিন আবু ওয়াকক্বাছ-এর বিরুদ্ধে বদদো‘আ করে বলেন, اللَّهمَّ لا يحول عَلَيْهِ الْحَوْلَ حَتَّى يَمُوتَ كَافِرًا فَمَا حَالَ عَلَيْهِ الْحَوْلُ حَتَّى مَاتَ كَافِرًا إِلَى النَّارِ ‘হে আল্লাহ! তুমি একে এক বছরও যেতে দিয়োনা, যেন সে কাফির অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে। অতঃপর এক বছরের মধ্যেই সে কাফির অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে ও জাহান্নামে চলে যায়’ কথাটি প্রমাণিত নয় (মুছান্নাফ আব্দুর রাযযাক হা/৯৬৪৯; সনদ ‘মুরসাল’ ও মুনকাত্বি‘; মা শা-‘আ ১৩৯ পৃঃ)।

(২) দ্বিতীয় আঘাতকারী আব্দুল্লাহ বিন শিহাব যুহরী, যিনি খ্যাতনামা তাবেঈ মুহাম্মাদ ইবনু শিহাব যুহরী (৫০-১২৪ হিঃ)-এর দাদা ছিলেন। তিনি পরে ইসলাম কবুল করেন এবং বালাযুরীর বর্ণনা মতে ওছমান (রাঃ)-এর খিলাফতকালে (২৩-৩৫ হিঃ) মক্কায় মৃত্যুবরণ করেন (আল-ইছাবাহ ক্রমিক ৪৭৫৫)।

(৩) তৃতীয় আঘাতকারী আব্দুল্লাহ বিন ক্বামিআহ, যার তরবারির আঘাতে রাসূল (ছাঃ)-এর শিরস্ত্রাণের দু’টি কড়া তাঁর চক্ষুর নীচের হাড়ের মধ্যে ঢুকে যায়। প্রসিদ্ধ আছে যে, ঐ সময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে তাচ্ছিল্য করে আব্দুল্লাহ বলেছিল, خُذْهَا وَأَنَا بنُ قَمِئَةَ ‘এটা নাও। আমি ক্বামিআহর (টুকরাকারিণীর) বেটা’। জবাবে রাসূল (ছাঃ) মুখের রক্ত মুছতে মুছতে তাকে বদ দো‘আ করে বলেন, أَقَمْأَكَ اللهُ ‘আল্লাহ তোকে টুকরা টুকরা করুন!’ (আর-রাহীক্ব ২৬৮ পৃঃ)। বর্ণনাটি যঈফ (আর-রাহীক্ব, তা‘লীক্ব ১৪৬ পৃঃ)। তার পরিণতি হিসাবে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ তাঁর রাসূল-এর দো‘আ কবুল করেন এবং তার উপরে তার বকরীদের বিজয়ী করে দেন। ঘটনা ছিল এই যে, যুদ্ধ থেকে মক্কায় ফিরে সে তার বকরী পালের খোঁজে পাহাড়ের দিকে যায় এবং তার বকরীগুলিকে পাহাড়ের চূড়ায় দেখতে পায়। অতঃপর সে সেখানে উঠে বকরী খেদিয়ে আনতে গেলে হঠাৎ শক্তিশালী পাঁঠা ছাগলটি শিংয়ের প্রচন্ড গুঁতা মেরে তাকে ফেলে দেয়। অতঃপর তাকে পাহাড় থেকে নীচে ফেলতে ফেলতে এবং শিংয়ের গুঁতা মারতে মারতে টুকরা টুকরা করে ফেলে’ (আর-রাহীক্ব ২৬৮ পৃঃ)। ঘটনাটির সনদ যঈফ’ (ঐ, তা‘লীক্ব ১৪৬ পৃঃ)।

রাসূল (ছাঃ)-এর পায়ের উপরে মাথা রেখে প্রাণ দিলেন যিনি

কাফেরদের বেষ্টনীতে পড়ে গেলে সেই সংকট মুহূর্তে তরুণ আনছার ছাহাবী যিয়াদ ইবনুস সাকান আল-আশহালী, কারু মতে ‘উমারাহ বিন ইয়াযীদ ইবনুস সাকান (রাঃ) তাঁর পাঁচ জন আনছার সাথীকে নিয়ে এগিয়ে আসেন। অতঃপর একে একে সবাই শহীদ হয়ে যান। সবশেষে যিয়াদ ইবনুস সাকান যুদ্ধে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে লুটিয়ে পড়েন। ইতিমধ্যে অন্যান্য ছাহাবীগণ এসে পড়েন ও কাফেরদের হটিয়ে দেন। তখন রাসূল (ছাঃ) বলেন, أَدْنُوهُ مِنِّي ‘তোমরা ওকে আমার কাছে নিয়ে এস’। তখন তাঁরা তাকে উঠিয়ে রাসূল (ছাঃ)-এর কাছে নিয়ে যান। রাসূল (ছাঃ) তার মুখমন্ডল নিজের পায়ের উপরে রাখেন। অতঃপর তার প্রাণবায়ু নির্গত হয়’।[1] এটাই যেন ছিল তার মনের বাসনা যে, ‘প্রাণ যেন নির্গত হয় আপনার পদচুম্বনে’। এই ঘটনায় উর্দু কবি গেয়েছেন,

سر بوقت ذبح اپنا اس كے زير پائے ہے
يہ نصيب الله اكبر لوٹنے كي جائے ہے

‘যবহের সময় নিজের মাথা
রাসূলের পায়ের উপর
দুনিয়া হতে বিদায়কালে ‘আল্লাহু আকবর’
কতই না বড় সৌভাগ্য তার’! (রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ১/১১১)।

[1]. ইবনু হিশাম ২/৮১; আর-রাহীক্ব ২৬৭ পৃঃ; আল-ইছাবাহ, যিয়াদ বিন সাকান ২৮৫৬; আল-ইস্তী‘আব।

রাসূল (ছাঃ)-এর দুঃখপূর্ণ দো‘আ

আনাস (রাঃ)-এর বর্ণনায় এসেছে, দান্দান মুবারক শহীদ হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, كَيْفَ يُفْلِحُ قَوْمٌ شَجُّوا نَبِيَّهُمْ وَكَسَرُوا رَبَاعِيَتَهُ وَهُوَ يَدْعُوهُمْ إِلَى اللهِ ‘ঐ জাতি কিভাবে সফলকাম হবে, যারা তাদের নবীর মুখমন্ডল আহত করেছে এবং তাঁর দাঁত ভেঙ্গে দিয়েছে। অথচ তিনি তাদেরকে আল্লাহর দিকে আহবান করছেন’।[1] ইবনু আববাস (রাঃ)-এর বর্ণনায় এসেছে যে, এ সময় তিনি বলেন,اشْتَدَّ غَضَبُ اللهِ عَلَى قَوْمٍ دَمَّوْا وَجْهَ رَسُولِهِ ‘আল্লাহর কঠিন গযব নাযিল হৌক ঐ জাতির উপরে যারা তাঁর রাসূলের চেহারাকে রক্তাক্ত করেছে’ (আহমাদ হা/২৬০৯, সনদ হাসান )।

ইবনু মাসঊদ (রাঃ)-এর বর্ণনায় এসেছে যে, এ সময় তিনি বিগত এক নির্যাতিত নবীর বর্ণনা দিয়ে জাতির হেদায়াতের জন্য আল্লাহর নিকটে দো‘আ করে বলেন,رَبِّ اغْفِرْ لِقَوْمِى فَإِنَّهُمْ لاَ يَعْلَمُونَ ‘হে আমার পালনকর্তা! তুমি আমার কওমকে হেদায়াত কর। কেননা তারা (আমাকে) জানে না’।[2] আবু হুরায়রা (রাঃ)-এর বর্ণনায় এসেছে তিনি বলেন, إِنِّى لَمْ أُبْعَثْ لَعَّانًا وَإِنَّمَا بُعِثْتُ رَحْمَةً ‘আমি লা‘নতকারী হিসাবে প্রেরিত হইনি। বরং আমি প্রেরিত হয়েছি রহমত হিসাবে।[3]

একইরূপ কথা তিনি বলেন ঘাঁটিতে স্থিতি লাভের পর।[4] তখন নিম্নোক্ত আয়াত নাযিল হয়, لَيْسَ لَكَ مِنَ الأَمْرِ شَيْءٌ أَوْ يَتُوْبَ عَلَيْهِمْ أَوْ يُعَذَّبَهُمْ فَإِنَّهُمْ ظَالِمُوْنَ ‘আল্লাহ তাদের ক্ষমা করবেন অথবা শাস্তি দিবেন, সে বিষয়ে তোমার কিছুই করার নেই। কেননা তারা হল যালেম’ (আলে ইমরান ৩/১২৮)।[5] এতে বুঝা যায় যে, যালেমদের শাস্তি দানের বিষয়টি সম্পূর্ণরূপে আললাহর ইচ্ছাধীন। যখন চাইবেন তখন তিনি তাদের শাস্তি দিবেন। বান্দা কেবল দো‘আ করতে পারে। কবুল করার মালিক আল্লাহ।

[1]. মুসলিম হা/১৭৯১; মিশকাত হা/৫৮৪৯। প্রসিদ্ধ আছে যে, (১) আব্দুল্লাহ বিন ক্বামিআর তরবারির প্রচন্ড আঘাতে শিরস্ত্রাণের দু’টি কড়া রাসূল (ছাঃ)-এর চোখের নীচে হাঁড়ের মধ্যে ঢুকে যায়। যা বের করার জন্য হযরত আবুবকর (রাঃ) এগিয়ে গেলে আবু ওবায়দাহ ইবনুল জাররাহ (রাঃ) তাকে আল্লাহর দোহাই দেন ও নিজেই দাঁত দিয়ে কামড়ে ধীরে ধীরে টান দিয়ে একটা কড়া বের করে আনেন। এতে তাঁর উপরের সম্মুখ সারির একটি ‘ছানিয়া’ (ثَنِيَّةٌ) দাঁত ভেঙ্গে পড়ে যায়। দ্বিতীয়টির বেলায় আবুবকর (রাঃ) আবার এগিয়ে গেলেন। কিন্তু এবারেও তিনি আল্লাহর দোহাই দিয়ে তাঁকে সরিয়ে দেন ও নিজেই সেটা দাঁত দিয়ে কামড়ে ধীরে ধীরে টেনে বের করেন। এতে তার আরেকটি ‘ছানিয়া’ দাঁত ভেঙ্গে পড়ে যায়। এখান থেকে তাঁর লকব হয়ে যায় ‘দুই ছানিয়া দাঁত হারানো ব্যক্তি’ (سَاقِطُ الثَّنِيَتَيْنِ) হিসাবে’ (ইবনু হিশাম ২/৮০; যাদুল মা‘আদ ৩/১৮৩; আর-রাহীক্ব ২৭০ পৃঃ; ছহীহ ইবনু হিববান হা/৬৯৮০)। বর্ণনাটির সনদ মুনক্বাতি‘ বা যঈফ’ (মা শা-‘আ ১৪৩ পৃঃ)।

(২) আরও প্রসিদ্ধ আছে যে, সূরা মুজাদালাহ ২২ আয়াতটি আবু ওবায়দাহ ইবনুল জাররাহ (রাঃ)-এর উপলক্ষ্যে নাযিল হয় (তাফসীর কুরতুবী, বায়হাক্বী সুনান)। যখন তিনি ওহোদের যুদ্ধে কিংবা বদরের যুদ্ধে তার পিতাকে হত্যা করেন। বর্ণনাটির সনদ মুনক্বাতি‘ বা যঈফ (মা শা-‘আ ১২৪ পৃঃ)।

জানা আবশ্যক যে, দু’জন ছাহাবী রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে তাদের স্ব স্ব পিতাকে হত্যা করার অনুমতি চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি তাদেরকে অনুমতি দেননি। একজন হলেন মুনাফিক নেতা আব্দুল্লাহ ইবনু উবাই-এর পুত্র আব্দুল্লাহ এবং অন্যজন হলেন আবু ‘আমের আর-রাহেব-এর পুত্র হানযালা ‘গাসীলুল মালায়িকাহ’। উভয়কে তিনি তাদের স্ব স্ব পিতার সঙ্গে সদাচরণ করতে বলেন (ছহীহ ইবনু হিববান, সিলসিলা ছহীহাহ হা/৩২২৩; আল-ইছাবাহ, হানাযালাহ, ক্রমিক ১৮৬৫; মা শা-‘আ ১২৬)। অনুরূপভাবে রাসূল (ছাঃ) কর্তৃক তাঁর স্ত্রীদের সাথে ঈলা-র ঘটনার সময় ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) তাঁর কন্যা হাফছাহকে হত্যা করার অনুমতি চেয়েছিলেন। কিন্তু রাসূল (ছাঃ) তাকে নিষেধ করেন (মুসলিম হা/১৪৭৯, ‘তালাক’ অধ্যায়)।

[2]. বুখারী হা/৩৪৭৭; মুসলিম হা/১৭৯২; মিশকাত হা/৫৩১৩।
[3]. মুসলিম হা/২৫৯৯; মিশকাত হা/৫৮১২।
[4]. ইবনু হিশাম ২/৮৬; বুখারী হা/৪০৭৩-৭৬।
[5]. মুসলিম হা/১৭৯১।

প্রসিদ্ধ আছে যে, আবু সাঈদ খুদরীর পিতা মালেক ইবনু সিনান রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ললাট হতে রক্ত চেটে খেয়ে ফেলেন। তখন তাকে নিজের রক্ত মুছতে বলা হলে তিনি বলেন, আল্লাহর কসম! আমি রক্ত মুছবো না। বলেই তিনি ময়দানে ছুটলেন ও যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। এটা দেখে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَنْ مَسَّ دَمِي دَمَهُ لَمْ تُصِبْهُ النَّارُ ‘আমার রক্ত যার রক্তকে স্পর্শ করেছে, তাকে জাহান্নাম স্পর্শ করবে না’ (ইবনু হিশাম ২/৮০)। অন্য বর্ণনায় এসেছে, مَنْ أَرَادَ أَنْ يَنْظُرَ إلَى رَجُلٍ مِنْ أَهْلِ الْجَنّةِ فَلْيَنْظُرْ إلَى هَذَا ‘যে ব্যক্তি কোন জান্নাতী ব্যক্তিকে দেখতে চায়, সে যেন এ ব্যক্তিকে দেখে’ (যাদুল মা‘আদ ৩/১৮৮; আর-রাহীক্ব ২৭২ পৃঃ; আল-ইছাবাহ ক্রমিক সংখ্যা ৭৬৪১)। অতঃপর তিনি যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হয়ে গেলেন। বর্ণনাটির সনদ মুনক্বাতি‘ বা যঈফ (মা শা-‘আ ১৪০-৪২ পৃঃ)।

চলমান শহীদ

(ক) ত্বালহা বিন ওবায়দুল্লাহ : কাফিরদের বেষ্টনীতে পড়ার সংকটকালীন সময়ে রাসূল (ছাঃ)-কে রক্ষাকারী নয় জনের মধ্যে ৭ জন আনছার ছাহাবী শহীদ হওয়ার পর সর্বশেষ দু’জন মুহাজির ছাহাবী হযরত সা‘দ বিন আবু ওয়াকক্বাছ ও ত্বালহা বিন ওবায়দুল্লাহ অতুলনীয় বীরত্বের সাথে লড়াই করে কাফিরদের ঠেকিয়ে রাখেন। দু’জনেই ছিলেন আরবের সেরা তীরন্দায। তাদের লক্ষ্যভেদী তীরের অবিরাম বর্ষণে কাফির সৈন্যরা রাসূল (ছাঃ)-এর কাছে ভিড়তে পারেনি। এই সময় রাসূল (ছাঃ) স্বীয় তূণ হ’তে তীর বের করে সা‘দকে দেন ও বলেন ارْمِ فِدَاكَ أَبِى وَأُمِّى ‘তীর চালাও! তোমার উপরে আমার পিতা-মাতা উৎসর্গীত হউন’। তার বীরত্বের প্রতি রাসূল (ছাঃ) কতবড় আস্থাশীল ছিলেন, একথাই তার প্রমাণ। কেননা আলী (রাঃ) বলেন, সা‘দ ব্যতীত অন্য কারুর জন্য আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) স্বীয় পিতা-মাতা উৎসর্গীত হউন, এরূপ কথা বলেননি।[1]

অন্য বর্ণনায় এসেছে, তিনি তার জন্য দো‘আ করে বলেন,اللَّهُمَّ سَدِّدْ رَمْيَتَهُ، وَأَجِبْ دَعْوَتَهُ ‘হে আল্লাহ! তুমি তার নিক্ষিপ্ত তীরকে লক্ষ্যভেদী কর এবং তার দো‘আ কবুল কর’।[2]

দ্বিতীয় মুহাজির ছাহাবী হযরত ত্বালহা বিন ওবায়দুল্লাহ সম্পর্কে হযরত জাবের বিন আব্দুললাহ (রাঃ) বলেন যে, ঐদিন তিনি একাই এগারো জনের সঙ্গে লড়াই করেন। এইদিন তিনি ৩৫ বা ৩৯টি আঘাত পান। তাঁর শাহাদাত ও মধ্যমা অঙ্গুলী কেটে যায় ও পরে তা অবশ হয়ে যায়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তার সম্পর্কে বলেন,مَنْ سَرَّهُ أَنْ يَنْظُرَ إِلَى شَهِيدٍ يَمْشِى عَلَى وَجْهِ الأَرْضِ فَلْيَنْظُرْ إِلَى طَلْحَةَ بْنِ عُبَيْدِ اللهِ ‘যদি কেউ ভূপৃষ্ঠে চলমান কোন শহীদকে দেখতে চায়, তবে সে যেন ত্বালহা বিন ওবায়দুল্লাহকে দেখে’।[3] বস্ত্ততঃ তিনি শহীদ হন হযরত আলীর খেলাফতকালে ‘উটের যুদ্ধে’র দিন কুচক্রীদের হামলায়। আবুবকর (রাঃ) ওহোদ যুদ্ধের প্রসঙ্গ উঠলে বলতেন,ذَاكَ يَوْمٌ كُلُّهُ لِطَلْحَةَ ‘ঐ দিনটি ছিল পুরোপুরি ত্বালহার’ (আল-বিদায়াহ ৪/২৯)। অর্থাৎ নিঃসঙ্গ রাসূলকে বাঁচানোর জন্য সেদিন যে ত্যাগ তিনি স্বীকার করেছিলেন, তা ছিল তুলনাহীন।

[1]. ইবনু হিশাম ২/৮২; বুখারী হা/৪০৫৫; উল্লেখ্য যে, বুখারী হা/৪০৫৯ হাদীছে সা‘দ বিন মালেক বলা হয়েছে। মূলতঃ সা‘দ বিন আবু ওয়াকক্বাছ-এর মূল নাম হ’ল সা‘দ বিন মালেক। আবু ওয়াকক্বাছ হ’ল তাঁর কুনিয়াত বা উপনাম। মুসলিম হা/২৪১১; মিশকাত হা/৬১০৩।
[2]. হাকেম হা/৪৩১৪, সনদ ছহীহ।
[3]. ইবনু হিশাম ২/৮০; তিরমিযী হা/৩৭৩৯, সনদ ছহীহ; মিশকাত হা/৬১১৩। প্রসিদ্ধ আছে যে, এই সময় রাসূল (ছাঃ) বলেছিলেন, دُونَكُمْ أَخَاكُمْ فَقَدْ أَوْجَبَ ‘তোমাদের ভাইকে ধর, সে জান্নাতকে ওয়াজিব করে নিয়েছে’ (আর-রাহীক্ব ২৭০ পৃঃ)। কথাটি যঈফ। মুশরিক বাহিনী কর্তৃক ঘেরাওকালীন সংকট মুহূর্তে সর্বপ্রথম আবুবকর (রাঃ) রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে এসেছিলেন বলে আয়েশা (রাঃ) প্রমুখাৎ ছহীহ ইবনু হিববান-এর বর্ণনাটিও (আর-রাহীক্ব ২৭০ পৃঃ) ‘যঈফ’ (ঐ, তা‘লীক্ব ১৪৭ পৃঃ)। তবে أَوْجَبَ طَلْحَةُ (‘ত্বালহা জান্নাতকে ওয়াজিব করে নিয়েছে’) কথাটি ‘ছহীহ’ (আলবানী, ছহীহাহ হা/৯৪৫)।

ফেরেশতা নাযিল হল

হযরত সা‘দ বিন আবু ওয়াকক্বাছ (রাঃ) বলেন, ওহোদ যুদ্ধের দিন আমি রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে দু’জন সাদা পোশাকধারী লোককে দেখি, যারা তাঁর পক্ষ হতে প্রচন্ড বেগে লড়াই করছিলেন। যাঁদেরকে আমি এর পূর্বে বা পরে আর কখনো দেখিনি- অর্থাৎ জিব্রীল ও মীকাঈল।[1]

ফেরেশতাগণ সংকট মুহূর্তেই কেবল সহযোগিতা করেছেন, সর্বক্ষণের জন্য নয়। এই সহযোগিতা ছিল প্রেরণামূলক। যাতে রাসূল (ছাঃ) ও মুসলমানদের হিম্মত বৃদ্ধি পায়। নইলে একা জিব্রীলই যথেষ্ট ছিলেন কাফির বাহিনীকে নির্মূল করার জন্য।

[1]. বুখারী হা/৪০৫৪; মুসলিম হা/২৩০৬।

ওহোদের যুদ্ধক্ষেত্রে তন্দ্রা

কাফিরদের বেষ্টনী থেকে মুসলিম বাহিনীকে মুক্ত করে যখন আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) ধীরে ধীরে পাহাড়ের উচ্চভূমির ঘাঁটিতে ফিরে আসছিলেন, তখন হঠাৎ করে অনেকের মধ্যে তন্দ্রা নেমে আসে। বদর যুদ্ধের ন্যায় এটা ছিল তাদের জন্য আল্লাহ প্রেরিত এক ধরনের প্রশান্তি। হযরত আবু ত্বালহা (রাঃ) বলেন, ওহোদ যুদ্ধের দিন যারা তন্দ্রাভিভূত হয়ে পড়েন, আমি ছিলাম তাদের অন্যতম। এমনকি এদিন আমার হাত থেকে কয়েকবার তরবারি পড়ে যায়। অবস্থা এমন ছিল যে, ওটা পড়ে যাচ্ছিল, আর আমি ধরে নিচ্ছিলাম। আবার পড়ে যাচ্ছিল, আবার ধরে নিচ্ছিলাম’ (বুখারী হা/৪৫৬২)। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন,ثُمَّ أَنْزَلَ عَلَيْكُمْ مِنْ بَعْدِ الْغَمِّ أَمَنَةً نُعَاسًا يَغْشَى طَائِفَةً مِنْكُمْ وَطَائِفَةٌ قَدْ أَهَمَّتْهُمْ أَنْفُسُهُمْ يَظُنُّونَ بِاللهِ غَيْرَ الْحَقِّ ظَنَّ الْجَاهِلِيَّةِ يَقُولُونَ هَلْ لَنَا مِنَ الْأَمْرِ مِنْ شَيْءٍ قُلْ إِنَّ الْأَمْرَ كُلَّهُ لِلَّهِ يُخْفُونَ فِي أَنْفُسِهِمْ مَا لاَ يُبْدُونَ لَكَ يَقُولُونَ لَوْ كَانَ لَنَا مِنَ الْأَمْرِ شَيْءٌ مَا قُتِلْنَا هَاهُنَا قُلْ لَوْ كُنْتُمْ فِي بُيُوتِكُمْ لَبَرَزَ الَّذِينَ كُتِبَ عَلَيْهِمُ الْقَتْلُ إِلَى مَضَاجِعِهِمْ وَلِيَبْتَلِيَ اللهُ مَا فِي صُدُورِكُمْ وَلِيُمَحِّصَ مَا فِي قُلُوبِكُمْ وَاللهُ عَلِيمٌ بِذَاتِ الصُّدُورِ ‘অতঃপর আল্লাহ তোমাদের উপর দুঃখের পরে তন্দ্রার শান্তি নাযিল করলেন, যা তোমাদের একদলকে (দৃঢ়চেতাগণকে) আচ্ছন্ন করেছিল। আরেকদল (দুর্বলচেতাগণ) নিজেদের জান নিয়ে ভাবছিল। তারা আল্লাহ সম্পর্কে মূর্খদের মতো অন্যায় ধারণা করছিল। তারা বলছিল, এ বিষয়ে আমাদের কি কিছু করার আছে? তুমি বলে দাও যে, সকল কর্তৃত্ব আল্লাহর। ওরা বুকের মধ্যে লুকিয়ে রাখে, যা ওরা তোমার নিকট প্রকাশ করে না। ওরা বলে, যদি আমাদের কোন কর্তৃত্ব থাকত, তাহলে এখানে আমরা নিহত হতাম না। তুমি বল, যদি তোমরা তোমাদের বাড়ীতে থাকতে, তবুও যাদের উপর হত্যা নির্ধারিত হয়ে গেছে, তারা অবশ্যই তাদের বধ্যভূমিতে উপস্থিত হত। আর আল্লাহ এটা করেছেন, তোমাদের বুকের মধ্যে যা লুকানো আছে তা পরীক্ষা করার জন্য এবং অন্তরে যা আছে, তা নির্মল করার জন্য। বস্তুতঃ আল্লাহ তোমাদের বুকের মধ্যে লুকানো বিষয়ে সম্যক অবহিত’ (আলে ইমরান ৩/১৫৪)। আল্লাহর উক্ত বাণীর মধ্যে ওহোদ যুদ্ধের বিপর্যয়ে মুসলমানদের অনেকের মধ্যে যে দোদুল্যমান অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল, সেটা প্রমাণিত হয়।

ত্বালহার কাঁধে রাসূল (ছাঃ)

পাহাড়ের ঘাঁটিতে প্রত্যাবর্তনের পথে একটা টিলা পড়ে যায়। রাসূল (ছাঃ) চেষ্টা করেও তার উপরে উঠতে সক্ষম হলেন না। তখন ৩৯টি আঘাতে জর্জরিত উৎসর্গীতপ্রাণ ছাহাবী ত্বালহা বিন উবায়দুল্লাহ মাটিতে বসে রাসূল (ছাঃ)-কে কাঁধে উঠিয়ে নেন। অতঃপর টিলার উপরে চলে যান। এ সময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) খুশী হয়ে বলেন, أَوْجَبَ طَلْحَةُ أَيِ الْجَنَّةَ ‘ত্বালহা জান্নাতকে ওয়াজিব করে নিল’।[1]

[1]. ইবনু হিশাম ২/৮৬; তিরমিযী হা/৩৭৩৮; আহমাদ হা/১৪১৭; মিশকাত হা/৬১১২; ছহীহাহ হা/৯৪৫।

রাসূল (ছাঃ)-এর শহীদ হবার খবর ও তার প্রতিক্রিয়া

মুসলিম বাহিনীর পতাকাবাহী মদীনায় প্রেরিত ইসলামের প্রথম দাঈ বীরকেশরী মুছ‘আব বিন ওমায়ের শহীদ হবার পর তাঁকে আঘাতকারী আব্দুল্লাহ বিন ক্বামিআহ ফিরে গিয়ে সানন্দে ঘোষণা করে যে,إِنَّ مُحَمَّدًا قَدْ قُتِلَ ‘মুহাম্মাদ নিহত হয়েছে’। কেননা রাসূল (ছাঃ)-এর চেহারার সাথে মুছ‘আবের চেহারায় অনেকটা মিল ছিল। এই খবর উভয় শিবিরে দারুণ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। মুসলমানগণ ক্ষণিকের জন্য কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন। ফলে পরস্পরকে চিনতে ব্যর্থ হয়ে মুসলমানের হাতেই কোন কোন মুসলমান শহীদ হয়ে যান। এমনই অবস্থার শিকার হ’য়ে খ্যাতনামা ছাহাবী হযরত হুযায়ফা (রাঃ)-এর বৃদ্ধ পিতা হযরত ইয়ামান (রাঃ) শহীদ হয়ে যান’।[1]

[1]. বুখারী হা/৪০৬৫ ‘যুদ্ধ বিগ্রহ’ অধ্যায়-৬৪ অনুচ্ছেদ-১৮।

(১) মুবারকপুরী লিখেছেন যে, এ সময় একদল অস্ত্র ত্যাগ করলেন। এমনকি মদীনায় পলায়ন পর্যন্ত করলেন। কেউ পাহাড়ে উঠে গেলেন। অন্যদল কাফিরদের মধ্যে মিশে গেলেন। এদের মধ্যে কেউ কেউ মুনাফিক নেতা আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের মাধ্যমে কাফের নেতা আবু সুফিয়ানের নিকটে সন্ধি প্রস্তাব পাঠানোর চিন্তাও করেন’ (আর-রাহীক্ব ২৬৫ পৃঃ)। বক্তব্যগুলি ভিত্তিহীন।

(২) প্রসিদ্ধ আছে যে, ছাবিত বিন দাহদাহ তার কওমকে ডেকে বলেন, হে আনছারগণ! إنْ كَانَ مُحَمّدٌ قَدْ قُتِلَ فَإِنّ اللهَ حَيّ لاَ يَمُوتُ، فَقَاتِلُوا عَنْ دِينِكُمْ، فَإِنّ اللهَ مُظْهِرُكُمْ وَنَاصِرُكُمْ- ‘যদি মুহাম্মাদ নিহত হন, তাহ’লে আল্লাহ চিরঞ্জীব, তিনি মরেন না। তোমরা তোমাদের দ্বীনের উপরে যুদ্ধ কর। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদেরকে বিজয় দান করবেন এবং সাহায্য করবেন’। তখন তার সাথে একদল আনছার খালেদের অশ্বারোহী বাহিনীর উপরে হামলা করল। যুদ্ধ চলা অবস্থায় খালেদের বর্শা নিক্ষেপে তিনি ও তার সাথীরা নিহত হন’ (আর-রাহীক্ব ২৬৬ পৃঃ; সীরাহ হালাবিইয়াহ ২/৫০৩)। বর্ণনাটি সনদবিহীন।

(৩) প্রসিদ্ধ আছে যে, এ সময় জনৈক মুহাজির একজন আনছার ছাহাবীর নিকট দিয়ে যাচ্ছিলেন। এমতাবস্থায় তিনি তার রক্ত ছাফ করছিলেন। তিনি তাকে বললেন, হে অমুক! তুমি কি জান, মুহাম্মাদ নিহত হয়েছেন? আনছার বললেন, যদি মুহাম্মাদ নিহত হয়ে থাকেন, তাহ’লে তিনি দ্বীন পৌঁছে দিয়ে গেছেন। অতএব তোমরা তোমাদের দ্বীনের উপরে যুদ্ধ কর’ (আর-রাহীক্ব ২৬৬ পৃঃ; যাদুল মা‘আদ ৩/১৮৬)। বর্ণনাটি ‘মুরসাল’ (আর-রাহীক্ব, তা‘লীক্ব ১৪৬ পৃঃ)।

(৪) প্রসিদ্ধ আছে যে, বিপর্যয়ের পর রাসূল (ছাঃ) নিজ সেনাদলের দিকে অগ্রসর হ’তে থাকেন। তখন ছাহাবী কা‘ব বিন মালেক আনছারী (রাঃ) তাঁকে সর্বপ্রথম চিনতে পারেন ও খুশীতে চিৎকার করে বলে ওঠেন, يَا مَعْشَرَ الْمُسْلِمِينَ أَبْشِرُوا هَذَا رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ‘হে মুসলিমগণ! সুসংবাদ গ্রহণ কর। এইতো আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)’। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে চুপ থাকতে ইঙ্গিত করেন। যাতে মুশরিকরা তাঁর অবস্থান বুঝতে না পারে। কিন্তু তার আওয়ায মুসলিম বাহিনীর কানে ঠিকই পৌঁছে গিয়েছিল এবং দ্রুত সেখানে ৩০ জনের মত ছাহাবী জমা হয়ে গেলেন। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) সবাইকে নিয়ে ঘাঁটির দিকে যেতে শুরু করেন ও সেখানে গিয়ে স্থির হন’ (আর-রাহীক্ব ২৭৩ পৃঃ; ইবনু হিশাম ২/৮৩; আল-বিদায়াহ ৪/৩৫; যাদুল মা‘আদ ৩/১৭২)। বর্ণনাটির সনদ ‘মুরসাল’ (তাহকীক ইবনু হিশাম, ক্রমিক ১১৩৩)।

নাক-কান কাটা ভাগিনা ও মামা এক কবরে

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর এর ফুফাতো ভাই আব্দুল্লাহ বিন জাহশ (রাঃ) ও তার মামা রাসূল (ছাঃ)-এর চাচা হামযাহ বিন আব্দুল মুত্ত্বালিব (রাঃ)-কে একই কবরে দাফন করা হয়’।[1] আব্দুল্লাহ বিন জাহ্শ যুদ্ধে নামার আগের দিন দো‘আ করেছিলেন,اللَّهم ارْزُقْنِي غدًا رجلاً شديدًا بأسُهُ شديدًا حَرْدُهُ، فأُقَاتِلُه فيك و يُقَاتِلُنِي ثم يَأْخُذُنِي فَيُجَدِّعُ أَنْفِي و أُذُنِي فإذا لَقِيْتُكَ غدًا قلتَ : يا عبدَ الله فِيْمَ جُدِّعَ أَنْفُكَ و أُذُنُكَ؟ فأقولُ فِيْكَ و في رسولِكَ فيقولُ : صَدَقْتَ ‘হে আল্লাহ! আগামীকাল আমাকে এমন একজন বীর ও দুর্ধর্ষ যোদ্ধার মুখোমুখি কর, যে আমাকে প্রচন্ড লড়াই শেষে হত্যা করবে এবং আমার নাক ও কান কেটে দেবে। তারপর আমি তোমার সামনে হাযির হ’লে তুমি বলবে, হে আব্দুল্লাহ! তোমার নাক-কান কাটা কেন? আমি বলব, হে আল্লাহ! তোমার জন্য ও তোমার রাসূলের জন্য(فِيكَ وَفِى رَسُولِكَ)। তখন তুমি বলবে, صَدَقْتَ ‘তুমি সত্য বলেছ’ (হাকেম হা/২৪০৯, হাদীছ ছহীহ)। এ দো‘আর সত্যায়ন করে হযরত সা‘দ বিন আবু ওয়াকক্বাছ (রাঃ) বলেন, আমার চেয়ে তার দো‘আ উত্তম ছিল এবং সেভাবেই তিনি শাহাদাত লাভে ধন্য হয়েছেন। আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) নিজে হামযা ও আব্দুল্লাহ দু’জনকে একই কবরে দাফন করেন। এ সময় তাঁর বয়স ছিল ৪০-এর কিছু বেশী। যুবায়ের (রাঃ) বলেন, আব্দুল্লাহ বিন জাহশকে ‘আল্লাহর পথে নাক-কান কাটা’(الْمُجَدَّعُ فِي اللهِ) বলে অভিহিত করা হয়। যেটা ওহোদের যুদ্ধে শহীদ হওয়ার পর করা হয়েছিল।[2]

[1]. আর-রাহীক্ব ২৮১ পৃঃ। মুবারকপুরী এখানে আব্দুল্লাহ বিন জাহশকে রাসূল (ছাঃ)-এর দুধ ভাই বলেছেন। যা প্রমাণিত নয়। কেবলমাত্র সুহায়লী ‘বলা হয়ে থাকে’ (يقال) মর্মে সনদ বিহীনভাবে কথাটি উল্লেখ করেছেন (ইবনু হিশাম ১/১৬১ টীকা-৬; আর-রওযুল উনুফ ১/২৮৩)। এটি মেনে নিলে তার আপন বোন যয়নাব বিনতে জাহশকে বিবাহ করা রাসূল (ছাঃ)-এর উপর হারাম হয়ে যেত। কারণ তখন তিনি হ’তেন রাসূল (ছাঃ)-এর দুধ বোন।

[2]. আল-ইছাবাহ, আব্দুল্লাহ বিন জাহশ ক্রমিক ৪৫৮৬; বায়হাক্বী, হাকেম হা/২৪০৯; হাকেম ছহীহ বলেছেন এবং যাহাবী তা সমর্থন করেছেন; সীরাহ ছহীহাহ ২/৩৮৮।

(১) এখানে মু‘জিযা হিসাবে প্রসিদ্ধ আছে যে, যুবায়ের (রাঃ) বলেন, এদিন আব্দুল্লাহ বিন জাহ্শ এলেন এমতাবস্থায় যে, তার তরবারি ভেঙ্গে গিয়েছিল। তখন রাসূল (ছাঃ) তাকে একটি খেজুরের শুকনা ডাল দিলেন। অতঃপর সেটি আব্দুল্লাহর হাতে তরবারিতে পরিণত হ’ল’ (আল-ইছাবাহ ক্রমিক ৪৫৮৬; আল-ইস্তী‘আব)। যাহাবী বলেন, বর্ণনাটি ‘মুরসাল’ (যাহাবী, তারীখুল ইসলাম ১৮৬ পৃঃ ; মা শা-‘আ ১৬০পৃঃ)।

(২) আরও প্রসিদ্ধ আছে যে, আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দ বিনতে উৎবাহ, নিহত হামযার কলিজা বের করে চিবিয়েছিলেন এবং তার নাক-কান কেটে কণ্ঠহার বানিয়েছিলেন (আর-রাহীক্ব ২৭৬ পৃঃ; ইবনু হিশাম ২/৯৫)। বর্ণনাটির সনদ ‘মু‘যাল’ বা যঈফ (তাহকীক ইবনু হিশাম, ক্রমিক ১১৫৫; আর-রাহীক্ব, তা‘লীক্ব ১৫২ পৃঃ)।

(৩) এছাড়াও বলা হয়েছে যে, উক্ত প্রসঙ্গে সূরা নাহ্ল ১২৬ আয়াতটি নাযিল হয়। যেখানে আল্লাহ বলেন, وَإِنْ عَاقَبْتُمْ فَعَاقِبُوا بِمِثْلِ مَا عُوقِبْتُمْ بِهِ وَلَئِنْ صَبَرْتُمْ لَهُوَ خَيْرٌ لِلصَّابِرِينَ ‘যদি তোমরা প্রতিশোধ গ্রহণ কর, তবে ঐ পরিমাণ করবে, যে পরিমাণ তোমাদের সাথে করা হয়েছে। কিন্তু যদি তোমরা ধৈর্য ধারণ কর, তাহলে ধৈর্যশীলদের জন্য নিশ্চয়ই সেটি উত্তম’ (নাহল ১৬/১২৬)। ফলে রাসূল (ছাঃ) ধৈর্য ধারণ করেন ও নিহত ব্যক্তিদের অঙ্গহানি করতে নিষেধ করেন বলে ইবনু ইসহাক কর্তৃক সনদবিহীন যে বর্ণনা (ইবনু হিশাম ২/৯৬) এসেছে, সেটি ‘যঈফ’। ইবনু কাছীর স্বীয় আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ (৯/১২০) গ্রন্থে উক্ত ঘটনা উল্লেখ করে বলেন, আয়াতটি হ’ল মাক্কী আর যুদ্ধ হ’ল মদীনায় হিজরতের তৃতীয় বছরে। কিভাবে এ ঘটনার সাথে এটি মিলানো যেতে পারে? (৪) আরও বলা হয়েছে যে, রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘যদি আল্লাহ আমাকে কুরায়েশদের উপরে একদিনের জন্যও বিজয়ী করেন, তাহ’লে আমি তাদের ৩০ জন নিহত ব্যক্তির অঙ্গহানি করব’ (ইবনু হিশাম ২/৯৫-৯৬)। অন্য বর্ণনায় ৭০ জনের কথা এসেছে। একথা শুনে জিব্রীল সূরা নাহল ১২৬ আয়াতটি নিয়ে অবতরণ করেন। তখন রাসূল (ছাঃ) উক্ত কসমের কাফফারা দেন এবং বিরত হন’ (হাকেম হা/৪৮৯৪, যাহাবী বলেন, অন্যতম রাবী ছালেহ একজন বাজে লোক (واهٍ); বায়হাক্বী শো‘আব হা/৯৭০৩)।

(৫) আরেক বর্ণনায় এসেছে যে, হামযার কলিজা চিবানো লাশ দেখে রাসূল (ছাঃ) বলেন, সে কি এখান থেকে কিছু খেয়েছে? তারা বললেন, না। তখন তিনি বললেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ হামযার দেহের কোন অংশকে জাহান্নামে প্রবেশ করাবেন না’ (আহমাদ হা/৪৪১৪)। অত্র হাদীছে হিন্দা জাহান্নামী হওয়ার ইঙ্গিত রয়েছে। অথচ তিনি পরে মুসলমান হয়েছিলেন। আর ইসলাম বিগত সকল গোনাহ ধ্বসিয়ে দেয়’ (মুসলিম হা/১২১; মিশকাত হা/২৮)। (৬) অন্য বর্ণনায় এসেছে, যদি (তার বোন) ছাফিয়া দুঃখ না পেত, তাহ’লে আমি হামযাহকে এখানেই ছেড়ে যেতাম। অতঃপর আল্লাহ তাকে জন্তু-জানোয়ার ও পক্ষীকুলের পেট থেকে পুনরুত্থান ঘটাতেন’ (হাকেম হা/৪৮৮৭)। উপরে বর্ণিত সকল বর্ণনাই ‘যঈফ’ (মা শা-‘আ ১৪৭-৪৮)।

তবে কাফেররা যে কারু কারু অঙ্গহানি করেছিল, সেটা নিশ্চিত। যেমন যুদ্ধ শেষে আবু সুফিয়ান মুসলিম নেতাদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, إِنَّكُمْ سَتَجِدُونَ فِى الْقَوْمِ مُثْلَةً لَمْ آمُرْ بِهَا وَلَمْ تَسُؤْنِى ‘তোমরা তোমাদের কিছু নিহত ব্যক্তির অঙ্গহানি পাবে। এবিষয়ে আমি কোন নির্দেশ দেইনি এবং এটা আমাকে ব্যথিতও করেনি’ (বুখারী হা/৩০৩৯)।

উল্লেখ্য যে, আবু সুফিয়ান ও তাঁর স্ত্রী হিন্দা মক্কা বিজয়ের দিন মুসলমান হন। হিন্দা যদি হামযার কলিজা চিবানোর মত নিকৃষ্ট কর্ম করতেন, তাহ’লে রাসূল (ছাঃ) নিশ্চয়ই তার রক্ত বৃথা ঘোষণা করতেন। যেমন কয়েকজন নারী-পুরুষের রক্ত বৃথা ঘোষণা করা হয়েছিল এবং তাদেরকে মক্কা বিজয়ের দিন হত্যা করা হয়েছিল (ইবনু হিশাম ২/৪১০-১১; ফাৎহুল বারী হা/৪২৮০-এর আলোচনা)। তাছাড়া বনু হাশেম কখনো আবু সুফিয়ানকে ছাড়তেন না। আর আবু সুফিয়ান ছিলেন বনু ‘আব্দে শামস গোত্রের। যদিও সকলেই ছিলেন কুরায়েশ বংশের অন্তর্ভুক্ত।

(৭) আরও প্রসিদ্ধ আছে যে, হামযার লাশের সামনে দাঁড়িয়ে রাসূল (ছাঃ) বলেন, তোমার মত বিপদগ্রস্ত কেউ কখনো হয়নি এবং তোমার এই দৃশ্যের চাইতে কোন দৃশ্য আমাকে এত ক্রুদ্ধ করেনি। অতঃপর তিনি বলেন,جَاءَنِي جِبْرِيلُ فَأَخْبَرَنِي أَنَّ حَمْزَةَ بْنَ عَبْدِ الْمُطَّلِبِ مَكْتُوبٌ فِي أَهْلِ السَّمَوَاتِ السَّبْعِ: حَمْزَةُ ابْن عَبْدِ الْمُطَّلِبِ، أَسَدُ اللهِ، وَأَسَدُ رَسُولِهِ ‘আমার নিকটে জিব্রীল এসেছেন ও খবর দিয়েছেন যে, হামযাহ বিন আব্দুল মুত্ত্বালিব সপ্ত আকাশের অধিবাসীদের নিকটে লিখিত আছেন এই মর্মে যে, হামযাহ বিন আব্দুল মুত্ত্বালিব ‘আসাদুল্লাহ’ ও ‘আসাদু রাসূলিহী’ অর্থাৎ ‘আল্লাহর সিংহ’ এবং তাঁর ‘রাসূলের সিংহ’ (ইবনু হিশাম ২/৯৬; হাকেম হা/৪৮৯৮)। হাদীছটি ‘মুনকার’ বা যঈফ (যঈফাহ হা/৬৩৫৫)। তবে ‘সাইয়িদুশ শুহাদা’ লকবটি ‘ছহীহ হাদীছ’ দ্বারা প্রমাণিত’ (হাকেম হা/৪৮৮৪; ছহীহাহ হা/৩৭৪; ছহীহুল জামে‘ ৫৪৬৯)।

উল্লেখ্য যে, হামযাহ, রাসূল (ছাঃ) ও আবু সালামাহ পরস্পরে দুধ ভাই ছিলেন। যারা শিশুকালে আবু লাহাবের দাসী ছুওয়াইবার দুধ পান করেছিলেন’ (আল-ইছাবাহ, ছুওয়াইবাহ ক্রমিক ১০৯৬৪; ইবনু হিশাম ২/৯৬)।

আবু সুফিয়ানের প্রতি নাখোশ তার সেনাপতি

উবাইশ গোত্রের নেতা(سَيِّدُ الْأُبَيْشِ) হুলাইস বিন যাববান(حُلَيْسُ بْنُ زَبَّان) যুদ্ধশেষে আবু সুফিয়ানের নিকট দিয়ে যাচ্ছিলেন। এ সময় আবু সুফিয়ান নিহত হামযা বিন আব্দুল মুত্ত্বালিবের চোয়ালে বর্শা দিয়ে খোঁচা মারছিলেন আর বলছিলেন,ذُقْ عُقَقْ অর্থাৎذُقْ يَا عَاقُّ ‘মজা চাখো হে অবাধ্য! এ দৃশ্য দেখে হুলাইস বলে উঠলেন, হে বনু কিনানাহ! ইনি হ’লেন কুরাইশের নেতা। দেখ তিনি তার ভাতিজার মৃত লাশের সাথে কিরূপ আচরণ করছেন? তখন আবু সুফিয়ান লজ্জিত হয়ে বলে উঠলেন,وَيْحَكَ! اُكْتُمْهَا عَنِّي، فَإِنَّهَا كَانَتْ زَلَّةً ‘তোমার ধ্বংস হৌক! চুপ থাক। এটা একটা পদস্খলন’ (ইবনু হিশাম ২/৯৩)।

রাসূল (ছাঃ)-এর জন্য ঢাল হলেন যাঁরা

আনাস (রাঃ) বলেন, ওহোদের দিন সংকট মুহূর্তে লোকেরা যখন এদিক-ওদিক ছুটছে, তখন আবু ত্বালহা স্বীয় ঢাল নিয়ে রাসূল (ছাঃ)-এর সামনে দাঁড়িয়ে যান। রাসূল (ছাঃ) এবং তিনি একই ঢালের আড়ালে থাকেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আবু ত্বালহার নিক্ষিপ্ত তীর কোথায় পড়ছে, দেখার জন্য একটু মাথা উঁচু করলেই আবু ত্বালহা বলে উঠতেন,يَا نَبِىَّ اللهِ بِأَبِى أَنْتَ وَأُمِّى، لاَ تُشْرِفْ يُصِيبُكَ سَهْمٌ مِنْ سِهَامِ الْقَوْمِ، نَحْرِى دُونَ نَحْرِكَ ‘হে আল্লাহর নবী! আমার পিতা-মাতা আপনার জন্য উৎসর্গীত হৌন- আপনি মাথা উঁচু করবেন না। তাহ’লে ওদের নিক্ষিপ্ত তীর আপনার গায়ে লেগে যাবে। আমার বুক হৌক আপনার বুক’।[1] আবু ত্বালহা ছিলেন একজন দক্ষ তীরন্দায। এইদিন তিনি দু’টি বা তিনটি ধনুক ভেঙ্গেছিলেন। শত্রুর দিক থেকে তীর এলেই তিনি রাসূল (ছাঃ)-কে বাঁচানোর জন্য নিজের বুক উঁচু করে ধরতেন। রাসূল (ছাঃ) তার তীর চালনায় খুশী হয়ে বলেন, لَصَوْتُ أَبِى طَلْحَةَ فِى الْجَيْشِ أَشَدُّ عَلَى الْمُشْرِكِينَ مِنْ فِئَةٍ ‘যুদ্ধে আবু ত্বালহার কণ্ঠস্বর মুশরিকদের উপরে একটি দলের হামলার চাইতে ভয়ংকর ছিল’ (আহমাদ হা/১৩১২৭, সনদ ছহীহ)।

[1]. বুখারী হা/৩৮১১; মুসলিম হা/১৮১১।

প্রাণ নিয়ে খেললেন যারা

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর দান্দান মুবারক শহীদ হওয়ার পর সেই কঠিন মুহূর্তে মুষ্টিমেয় যে কয়জন ছাহাবী রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে ছুটে এসে তাঁকে বাঁচানোর জন্য নিজেদের জীবন নিয়ে খেলতে থাকেন, তাঁরা ছিলেন হযরত আবু দুজানা, মুছ‘আব বিন ওমায়ের, আলী ইবনু আবী ত্বালেব, সাহ্ল বিন হুনায়েফ, মালেক ইবনু সিনান (আবু সাঈদ খুদরীর পিতা), উম্মে ‘উমারাহ নুসাইবাহ বিনতে কা‘ব আল-মাযেনিয়াহ, ক্বাতাদাহ বিন নু‘মান, ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব এবং আবু ত্বালহা (রাযিয়াল্লাহু ‘আনহুম)। এঁদের মধ্যে মুছ‘আব বিন উমায়ের এবং মালেক ইবনু সিনান শহীদ হয়ে যান’ (আর-রাহীক্ব ২৭০ পৃঃ)।

দুই বৃদ্ধের শাহাদাত লাভ

দুইজন অতি বৃদ্ধ ছাহাবী হযরত ইয়ামান ও ছাবিত বিন ওয়াক্বশ (ثابت بن وَقْش)-কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ঘাঁটিতে রেখে এসেছিলেন প্রহরা ও ছোটখাট কাজের জন্য। কিন্তু বিপর্যয়কালে তাঁরা শাহাদাত লাভের আকাংখায় ময়দানে ছুটে যান এবং প্রথমজন ভুলক্রমে মুসলমানের হাতে এবং দ্বিতীয় জন কাফিরের হাতে শহীদ হন।[1]

[1]. ইবনু হিশাম ২/৮৭; সীরাহ ছহীহাহ ২/৩৮৯; হাকেম হা/৪৯০৯। বর্ণনাটির সনদ ছহীহ (তাহকীক ইবনু হিশাম, ক্রমিক ১১৪৬)।

মু‘জেযাসমূহ, যা বিশুদ্ধভাবে প্রমাণিত নয়

(১) প্রসিদ্ধ আছে যে, ওহোদ যুদ্ধের দিন হযরত ক্বাতাদাহ বিন নু‘মানের একটি চোখ যখমী হওয়ায় তা বেরিয়ে ঝুলে পড়ে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিজ হাতে ওটাকে যথাস্থানে ঢুকিয়ে দেন। তাতে চোখ ঠিক হয়ে যায় এবং তার সৌন্দর্য বৃদ্ধি পায় ও দৃষ্টি শক্তি আগের চেয়ে তীক্ষ্ণ হয়।[1]

(২) ঘাঁটিতে পৌঁছে রাসূল (ছাঃ)-কে হামলাকারী উবাই বিন খালাফকে মারার জন্য রাসূল (ছাঃ) হারেছ ইবনুছ ছিম্মাহর কাছ থেকে নিয়ে যে বর্শাটি নিক্ষেপ করেছিলেন, তাতে তার গলায় কেবল অাঁচড় কেটে গিয়েছিল। যাতে রক্তপাত পর্যন্ত হয়নি। অথচ তাতেই সে ওহোদ থেকে ফেরার পথে কয়েকদিন পর মক্কায় পৌঁছার আগেই ‘সারিফ’ নামক স্থানে মারা পড়ল।[2]

(৩) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ঘাঁটিতে অবস্থানকালে আবু সুফিয়ান ও খালেদ বিন অলীদের নেতৃত্বে যে দলটি তাঁকে হামলা করার জন্য পাহাড়ে উঠে যায়, তারা যাতে নিকটে পৌঁছতে না পারে, সেজন্য রাসূল (ছাঃ) আল্লাহর নিকটে দো‘আ করেন, اللَّهُمَّ إنَّهُ لاَ يَنْبَغِي لَهُمْ أَنْ يَعْلُونَا ‘হে আল্লাহ! তাদের জন্য এটা উচিৎ হবে না যে, তারা আমাদের নিকট উপরে উঠে আসে’। অতঃপর ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) ও একদল মুহাজির তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করে পাহাড় থেকে নামিয়ে দিলেন’।[3] ইবনু ইসহাক এটি সনদবিহীনভাবে বর্ণনা করেছেন। তবে হাদীছে এটিاللَّهُمَّ إِنَّهُ لَيْسَ لَهُمْ أَنْ يَعْلُونَا মর্মে এসেছে।[4] কিন্তু সেখানে ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব ও মুহাজিরদের একটি দল তাদের নামিয়ে দেন, এ মর্মে কিছুই বলা হয়নি। বরং ঐ সময় রাসূল (ছাঃ)-এর নির্দেশক্রমে আবু সুফিয়ানের সঙ্গে ওমর ইবনুল খাত্ত্বাবের কথোপকথন প্রমাণিত আছে।

(৪) একই সময়ে রাসূল (ছাঃ) সা‘দ বিন আবু ওয়াকক্বাছকে বলেন,اُجْنُبْهُمْ او يَقُولُ اُرْدُدْهُمْ ‘ওদেরকে দুর্বল করে দাও। অথবা বললেন, ওদেরকে ফিরিয়ে দাও’। তখন সা‘দ বললেন,كَيْفَ أَجْنُبُهُمْ وَحْدِي ‘কিভাবে আমি একা ওদের দুর্বল করে দেব’? অতঃপর রাসূল (ছাঃ) তাকে তিনবার একই নির্দেশ দিলে তিনি নিজের তূণ থেকে একটা তীর বের করে নিক্ষেপ করেন। তাতে শত্রুপক্ষের একজন নিহত হয়। তিনি বলেন, অতঃপর আমি ঐ তীর নিয়ে নিলাম এবং দ্বিতীয় আরেক শত্রুকে মারলাম। সেও নিহত হ’ল। আমি আবার ঐ তীর নিয়ে নিলাম ও তৃতীয় আরেক শত্রুকে মারলাম। তাতে সেও মারা পড়ে। এর ফলে শত্রুরা ভয়ে নীচে নামতে লাগল। আমি ঐ তীর এনে আমার তূণের মধ্যে রেখে দিলাম। আমি বললাম,هَذَا سَهْمٌ مُبَارَكٌ ‘এটা বরকতপূর্ণ তীর’। এই তীরটি সা‘দের নিকটে আমৃত্যু ছিল এবং তাঁর পরে তাঁর সন্তানদের কাছে ছিল (যাদুল মা‘আদ ৩/১৮৪)। অতঃপর হযরত ওমর ও মুহাজিরগণের একটি দল ধাওয়া করে তাদেরকে পাহাড়ের উপর থেকে নীচে নামিয়ে দেয় (আর-রাহীক্ব ২৭৬ পৃঃ)।[5]

[1]. ইবনু হিশাম ২/৮২; আর-রাহীক্ব ২৭২ পৃঃ; হাকেম হা/৫২৮১; যাদুল মা‘আদ ৩/১৭৭। বর্ণনাটির সনদ ‘মুরসাল’। তাছাড়া ঘটনাটি ইবনু ইসহাকের বর্ণনায় এসেছে ‘বদরের দিন’ বায়হাক্বীর বর্ণনায় এসেছে ওহোদের দিন’। ইবনু আব্দিল বার্র বলেন, বলা হয়েছে যে, এটি খন্দকের দিন’ (মা শা-‘আ ১২০-২১ পৃঃ)।

আরও প্রসিদ্ধ আছে যে, ওহোদ যুদ্ধের দিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) স্বীয় ধনুক দ্বারা এত অধিক তীর চালিয়েছিলেন যে, ধনুকের প্রান্তদেশ ভেঙ্গে যায়’। পরে ঐ ধনুকটি ক্বাতাদাহ নিয়ে নেন এবং তার কাছেই রেখে দেন’ (ইবনু হিশাম ২/৮২)। বর্ণনাটির সনদ ‘মুরসাল’ বা যঈফ (তাহকীক ইবনু হিশাম, ক্রমিক ১১২৮)।

[2]. আর-রাহীক্ব ২৭৫ পৃঃ; যাদুল মা‘আদ ৩/১৭৮; ইবনু হিশাম ২/৮৪। বর্ণনাটির সনদ ‘মুরসাল’ (তাহকীক ইবনু হিশাম, ক্রমিক ১১৩৪)। আকরাম যিয়া উমারী বলেন, ঘটনাটি সীরাতের কিতাব সমূহে ব্যাপকভাবে বর্ণিত। তাছাড়া সাঈদ ইবনুল মুসাইয়েব-এর ‘মুরসাল’ বর্ণনা সমূহ শক্তিশালী (সীরাহ ছহীহাহ ২/৩৯২ টীকা-১)। উক্ত মর্মে সাঈদ ইবনুল মুসাইয়েব বর্ণিত হাদীছটি ছহীহ (হাকেম হা/৩২৬৩; হাকেম বুখারী ও মুসলিমের শর্তানুযায়ী ছহীহ বলেছেন এবং যাহাবী তা সমর্থন করেছেন)।

উল্লেখ্য যে, যে সকল বিদ্বান এই ঘটনা মেনে নিয়েছেন তাদের মধ্যে অন্যতম হ’লেন শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ)। তিনি বলেন,وَلَمْ يَقْتُلْ بِيَدِهِ إِلاَّ أُبَيَّ بْنَ خَلَفٍ، قَتَلَهُ يَوْمَ أُحُدٍ، وَلَمْ يَقْتُلْ بِيَدِهِ أَحَدًا لاَ قَبْلَهَا وَلاَ بَعْدَهَا ‘রাসূল (ছাঃ) নিজ হাতে কাউকে হত্যা করেননি ওহোদের দিন উবাই বিন খালাফকে ব্যতীত। তার পূর্বে বা পরে তিনি আর কখনোই কাউকে হত্যা করেননি’ (মিনহাজুস সুন্নাহ (রিয়াদ : জামে‘আতুল ইমাম মুহাম্মাদ বিন সাঊদ আল-ইসলামিইয়াহ, ১ম সংস্করণ১৪০৬/১৯৮৬ খৃ.) ৮/৭৮)।

[3]. ইবনু হিশাম ২/৮৬; আর-রাহীক্ব ২৭৬ পৃঃ।

[4]. আহমাদ হা/২৬০৯; হাকেম হা/৩১৬৩, সনদ হাসান।

[5]. বর্ণনাটি ‘যঈফ’। কেননা ইবনু আবিদ্দুনিয়া এটি সনদসহ বর্ণনা করেছেন। কিন্তু সেখানে অজ্ঞাত (مجهول) রাবী আছেন (ইবনু আবিদ্দুনিয়া, ‘মাকারিমুল আখলাক্ব’ হা/১৮১)।

প্রসিদ্ধ আছে যে, ওহোদ যুদ্ধ শেষে ঘাঁটিতে যোহরের ছালাতের সময় হ’লে যখমের কারণে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বসে ছালাত আদায় করেন। ছাহাবায়ে কেরামও তাঁর পিছনে বসে ছালাত আদায় করেন (ইবনু হিশাম ২/৮৭; আর-রাহীক্ব ২৭৮ পৃঃ)। বর্ণনাটির সনদ ‘যঈফ’ (তাহকীক ইবনু হিশাম, ক্রমিক ১১৪৪)।

আবু সুফিয়ান ও হযরত ওমরের কথোপকথন

যুদ্ধ শেষে মাক্কী বাহিনী প্রত্যাবর্তনের প্রস্ত্ততি গ্রহণ শেষ করে প্রধান সেনাপতি আবু সুফিয়ান ওহোদ পাহাড়ে উঠে উচ্চৈঃস্বরে বললেন,أَفِيكُمْ مُحَمَّدٌ؟ ‘তোমাদের মধ্যে মুহাম্মাদ আছে কি’?أَفِيكُمْ ابْنُ أَبِي قُحَافَةَ؟ ‘তোমাদের মধ্যে আবু কুহাফার বেটা (আবুবকর) আছে কি’?أَفِيكُمْ عُمَرُ بْنُ الْخَطّابِ؟ ‘তোমাদের মধ্যে ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব আছে কি’? রাসূল (ছাঃ) বললেন, তোমরা তার কথার জবাব দিয়ো না। তিনবার করে বলার পর জবাব না পেয়ে সে বলে উঠল, নিশ্চয়ই তারা নিহত হয়েছে। বেঁচে থাকলে তারা জবাব দিত। তখন ওমর নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলেন না। তিনি (উচ্চৈঃস্বরে) বললেন, كَذَبْتَ يَا عَدُوَّ اللهِ ، أَبْقَى اللهُ عَلَيْكَ مَا يُخْزِيكَ ‘হে আল্লাহর দুশমন! তুমি মিথ্যা বলেছ। আল্লাহ তোমাকে লাঞ্ছিত করার উৎস সবাইকে বাঁচিয়ে রেখেছেন’। জবাবে আবু সুফিয়ান বলে উঠলেন, أُعْلُ هُبَلُ ‘হোবল দেবতার জয় হৌক’। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, তোমরা ওর কথার জবাব দাও। ছাহাবীগণ বললেন, আমরা কি বলব? রাসূল (ছাঃ) বললেন, তোমরা বল,اللهُ أعْلَى وأَجَلُّ ‘আল্লাহ সর্বোচ্চ ও সবচেয়ে সম্মানিত’। আবু সুফিয়ান বললেন, لَنَا عُزَّى وَلاَ عُزَّى لَكُمْ ‘আমাদের জন্য ‘উযযা দেবী রয়েছে, তোমাদের ‘উযযা নেই’। জবাবে রাসূল (ছাঃ) বললেন, তোমরা বল, اللهُ مَوْلاَنَا وَلاَ مَوْلَى لَكُمْ ‘আল্লাহ আমাদের অভিভাবক। আর তোমাদের কোন অভিভাবক নেই’। তখন আবু সুফিয়ান বললেন,يَوْمٌ بِيَوْمِ بَدْرٍ وَإِنَّ الْحَرْبَ سِجَالٌ ‘আজকের দিনটি বদরের দিনের প্রতিশোধ। নিশ্চয়ই যুদ্ধ হ’ল বালতির ন্যায়’। অর্থাৎ যুদ্ধে কখনো একদল জয়ী হয়, কখনো অন্যদল। যেমন বালতি একবার একজনে টেনে তোলে, আরেকবার অন্যজনে (বুখারী হা/৩০৩৯, ৪০৪৩)। জবাবে ওমর (রাঃ) বললেন, لاَ سَوَاءٌ قَتْلاَنَا فِي الْجَنَّةِ وَقَتْلاَكُمْ فِي النَّار ‘না সমান নয়। আমাদের নিহতেরা জান্নাতে, আর তোমাদের নিহতেরা জাহান্নামে’। অতঃপর আবু সুফিয়ান (সম্ভবতঃ নিজের পাপবোধ থেকে কৈফিয়তের সুরে) বললেন,أَمَا إِنَّكُمْ سَوْفَ تَجِدُونَ فِى قَتْلاَكُمْ مُثْلاً وَلَمْ يَكُنْ ذَاكَ عَنْ رَأْىِ سَرَاتِنَا. قَالَ ثُمَّ أَدْرَكَتْهُ حَمِيَّةُ الْجَاهِلِيَّةِ قَالَ فَقَالَ أَمَا إِنَّهُ قَدْ كَانَ ذَاكَ وَلَمْ نَكْرَهْهُ ‘তবে তোমরা সত্বর তোমাদের নিহতদের মধ্যে অনেকের অঙ্গহানি দেখতে পাবে। যাতে আমাদের নেতাদের নির্দেশ ছিল না’। রাবী বলেন, এ কথা বলার পরে তাকে জাহেলিয়াতের উত্তেজনা গ্রাস করে। অতঃপর তিনি বলেন, হ্যাঁ এটা হয়েছে। তবে আমরা এটাকে অপছন্দ করিনি’ (আহমাদ হা/২৬০৯, সনদ হাসান)। অন্য বর্ণনায় এসেছে, وَاللهِ مَا رَضِيتُ، وَمَا سَخِطْتُ، وَمَا نَهَيْتُ، وَمَا أَمَرْتُ ‘আল্লাহর কসম! আমি এতে খুশী নই, নাখোশও নই। আমি এতে নিষেধ করিনি, নির্দেশও দেইনি’।

এরপর আবু সুফিয়ান ওমর (রাঃ)-কে কাছে ডাকলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে অনুমতি দিলেন। কাছে গেলে আবু সুফিয়ান বললেন,أَنْشُدُكَ اللهَ يَا عُمَرُ، أَقَتَلْنَا مُحَمَّدًا؟ ‘আমি তোমাকে আল্লাহর দোহাই দিয়ে বলছি হে ওমর! আমরা কি মুহাম্মাদকে হত্যা করেছি’? ওমর বললেন, اللَّهُمَّ لاَ ‘আল্লাহর কসম! না।وَإِنَّهُ لَيَسْمَعُ كَلَامَكَ الْآنَ ‘তিনি এখন তোমার কথা শুনছেন’। জবাবে আবু সুফিয়ান বললেন, أَنْتَ عِنْدِي أَصْدَقُ مِنَ ابْنِ قَمِئَةَ وَأَبَرُّ ‘তুমি আমার নিকটে ইবনু ক্বামিআহর চাইতে অধিক সত্যবাদী ও অধিক সৎ’।[1] কেননা তিনি ধারণা করতেন যে, আব্দুল্লাহ ইবনু ক্বামিআহ লায়ছী রাসূল (ছাঃ)-কে হত্যা করেছে।

[1]. ইবনু হিশাম ২/৯৪, আলবানী, ফিক্বহুস সীরাহ পৃঃ ২৬০, সনদ ছহীহ। এখানে ওমর বলার অর্থ তিনি রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট থেকে শুনে বলেছেন। যেমন পরবর্তীতে হোদায়বিয়া সন্ধিকালে তিনি রাসূল (ছাঃ)-কে একইভাবে জিজ্ঞেস করেছিলেন, أَلَيْسَ قَتْلاَنَا فِي الْجَنَّةِ وَقَتْلاَهُمْ فِي النَّارِ؟ ‘আমাদের নিহতেরা কি জান্নাতে নয়? এবং তাদের নিহতেরা জাহান্নামে? রাসূল (ছাঃ) বললেন, হ্যাঁ (বুখারী হা/৩১৮২; মুসলিম হা/১৭৮৫ (৯৪)।

এখানে প্রসিদ্ধ আছে যে, আবু সুফিয়ান ও তার সাথীরা যখন ফিরে যান, তখন তিনি উচ্চৈঃস্বরে বলেন, إنَّ مَوْعِدَكُمْ بَدْرٌ لِلْعَامِ الْقَابِلِ ‘তোমাদের সঙ্গে আগামী বছর বদরে ওয়াদা রইল’। তখন রাসূল (ছাঃ) তাঁর সাথীদের একজনকে বললেন, قُلْ: نَعَمْ، هُوَ بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمْ مَوْعِدٌ ‘বল! হ্যাঁ। আমাদের ও তোমাদের মধ্যে ওটাই ওয়াদা রইল’ (ইবনু হিশাম ২/৯৪)। বর্ণনাটি সনদবিহীন (মা শা-‘আ ১৬১ পৃঃ)।

জান্নাতের সুগন্ধি লাভ

(ক) আনাস বিন নাযার : ইনি আনাস বিন মালেক (রাঃ)-এর চাচা ছিলেন। তিনি বদর যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করতে না পারায় দুঃখিত ছিলেন এবং ওহোদ যুদ্ধে যোগদান করেন। অতঃপর যুদ্ধের দ্বিতীয় ভাগে মুসলিম বাহিনীর বিপর্যয়কালে তিনি বলেন, اللَّهُمَّ إنِّي أَعْتَذِرُ إلَيْكَ مِمّا صَنَعَ هَؤُلَاءِ يَعْنِي الْمُسْلِمِينَ وَأَبْرَأُ إلَيْكَ مِمّا صَنَعَ هَؤُلاَءِ يَعْنِي الْمُشْرِكِينَ ‘হে আল্লাহ এই লোকগুলি অর্থাৎ (তীরন্দায) মুসলমানেরা যা করেছে সেজন্য আমি তোমার নিকটে ক্ষমা প্রার্থনা করছি এবং ওরা অর্থাৎ মুশরিকেরা যা করছে, তা হ’তে আমি নিজেকে দায়মুক্ত ঘোষণা করছি’। একথা বলে তিনি সম্মুখে অগ্রসর হ’লে আউস নেতা সা‘দ বিন মু‘আয (রাঃ)-এর সাথে সাক্ষাৎ হয়। তিনি তাকে বললেন, أَيْنَ يَا سَعْدُ إِنِّى أَجِدُ رِيحَ الْجَنَّةِ دُونَ أُحُدٍ ‘কোথায় যাচ্ছ হে সা‘দ! আমি ওহোদের পিছন থেকে জান্নাতের সুগন্ধি পাচ্ছি’।

অতঃপর তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে গেলেন ও প্রাণপণ যুদ্ধ করে শহীদ হ’লেন। ঐদিন বর্শা, তীর ও তরবারির ৮০টির অধিক যখম লেগে তার দেহ ঝাঝরা হয়ে গিয়েছিল। কেবল আঙ্গুলের মাথাগুলি দেখে তার ভগ্নী রবী‘ বিনতে নযর তাকে চিনতে পারেন। কাফেররা তার বিভিন্ন অঙ্গ কর্তন করেছিল। রাবী আনাস বিন মালেক (রাঃ) বলেন, আমরা ধারণা করতাম যে, সূরা আহযাব ২৩ আয়াতটি তাঁর বা তাঁর মতো অন্যদের কারণেই নাযিল হয়েছে।[1] যেখানে বলা হয়েছে, مِنَ الْمُؤْمِنِينَ رِجَالٌ صَدَقُوا مَا عَاهَدُوا اللهَ عَلَيْهِ فَمِنْهُمْ مَنْ قَضَى نَحْبَهُ وَمِنْهُمْ مَنْ يَنْتَظِرُ وَمَا بَدَّلُوا تَبْدِيلاً ‘মুমিনদের মধ্যে কিছু ব্যক্তি আছে যারা আল্লাহর সাথে কৃত ওয়াদা পূর্ণ করেছে। তাদের মধ্যে কেউ মৃত্যুবরণ করেছে এবং কেউ প্রতীক্ষা করছে। তারা তাদের সংকল্প মোটেই পরিবর্তন করেনি’ (আহযাব ৩৩/২৩)। বিশেষ কোন প্রেক্ষিতে নাযিল হ’লেও অত্র আয়াত সকল যুগের সকল মুজাহিদের জন্য প্রযোজ্য।

(খ) সা‘দ বিন রবী‘: যুদ্ধ শেষে আহত ও নিহতদের সন্ধানকালে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যায়েদ বিন ছাবিতকে পাঠান সা‘দ বিন রবী‘-এর সন্ধানে। বলে দিলেন যদি তাকে জীবিত পাও, তবে আমার সালাম বলো এবং আমার কথা বলবে যে, আল্লাহর রাসূল তোমাকে বলেছেন,كَيْفَ تَجِدُك؟ ‘তুমি নিজেকে কেমন পাচ্ছ? যায়েদ বলেন, আমি তাকে যখন পেলাম, তখন তাঁর মৃত্যুক্ষণ এসে গিয়েছে। তিনি ৭০-এর অধিক যখম প্রাপ্ত হয়েছিলেন। আমি তাকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সালাম জানিয়ে তাঁর কথাটি জানিয়ে দিলাম। তখন তিনি রাসূল (ছাঃ)-কে সালাম দিতে বললেন এবং বললেন, তুমি তাঁকে বলো,يَا رَسُولَ اللهِ أَجِدُ رِيحَ الْجَنَّةِ ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমি জান্নাতের সুগন্ধি পাচ্ছি’। অতঃপর আমার কওম আনছারদের বলো, তাদের একজনও বেঁচে থাকতে যদি শত্রুরা রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট পর্যন্ত পৌঁছে যায়, তবে আল্লাহর নিকটে তাদের কোন কৈফিয়ত চলবে না’। পরক্ষণেই তাঁর প্রাণবায়ু নির্গত হ’ল।[2] ইনি ছিলেন ১৩ নববী বর্ষে মক্কায় অনুষ্ঠিত বায়‘আতে কুবরার দিন রাসূল (ছাঃ)-এর নিযুক্ত ১২ জন নক্বীবের অন্যতম এবং খাযরাজ গোত্রের অন্যতম নেতা।

[1]. বুখারী হা/২৮০৫, ৪৭৮৩।

এখানে প্রসিদ্ধ আছে যে, এ সময় বসে থাকা কিংকর্তব্যবিমূঢ় ওমর, ত্বালহা সহ মুহাজির ও আনছারদের একদল ছাহাবীকে দেখে তিনি বলেন, مَا يُجْلِسُكُمْ؟ ‘কিসের জন্য বসে আছেন? তারা বললেন, قُتِلَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিহত হয়েছেন’। আনাস বললেন,مَا تَصْنَعُونَ بِالْحَيَاةِ بَعْدَهُ؟ فَقُومُوا فَمُوتُوا عَلَى مَا مَاتَ عَلَيْهِ رَسُولُ الله صَلَّى الله عَلَيْهِ وَسَلَّمَ- ‘তাঁর পরে বেঁচে থেকে আপনারা কি করবেন? উঠুন, যার উপরে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) জীবন দিয়েছেন, তার উপরে আপনারাও জীবন দিন’। অতঃপর তিনি এগিয়ে যান ও যুদ্ধ করে নিহত হন’ (ইবনু হিশাম ২/৮৩; যাদুল মা‘আদ ৩/১৭৭; আর-রাহীক্ব ২৬৫-৬৬ পৃঃ; আল-বিদায়াহ ৪/৩৪)। বর্ণনাটি ‘মুরসাল’ বা যঈফ (মা শা-‘আ ১৪৫ পৃঃ)। সঠিক সেটাই যা উপরে ছহীহ হাদীছসমূহে বর্ণিত হয়েছে।

তাছাড়া এটা কিভাবে সঠিক হ’তে পারে যে, ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব ও ত্বালহা বিন ওবায়দুল্লাহ (রাঃ)-এর মত জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত ছাহাবীগণ রাসূল (ছাঃ)-এর নিহত হওয়ার খবর শুনে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে থাকবেন? বরং ছহীহ বর্ণনার সাথে এগুলি যোগ করা হয়েছে মাত্র। এমনকি মুবারকপুরী বাড়তি লিখেছেন যে, রাসূল (ছাঃ)-এর নিহত হওয়ার খবর শুনে ছাহাবীদের অনেকের আত্মা দোদুল্যমান হয়ে যায়। কেউ যুদ্ধ থেকে বিরত হয়। কেউ অস্ত্র ফেলে দিয়ে বসে যায়। আবার অনেকে মুনাফেক নেতা আব্দুল্লাহ বিন উবাই-এর সাথে সাক্ষাৎ করে তার মাধ্যমে আবু সুফিয়ানের নিকট থেকে তাদের জন্য শান্তি ও নিরাপত্তা প্রার্থনার চিন্তা করতে থাকে (আর-রাহীক্ব ২৬৫ পৃঃ; আল-বিদায়াহ ৪/২৩)। অথচ এ কথাগুলি সনদবিহীনভাবে বলা হয়েছে। ছাহাবীগণ সম্পর্কে ঐ সংকটকালে এরূপ চিন্তা করাও কষ্টকর বৈ-কি!

[2]. হাকেম হা/৪৯০৬, হাদীছ ছহীহ; যাদুল মা‘আদ ২/৯৬; আর-রাহীক্ব ২৮০ পৃঃ।

প্রসিদ্ধ রয়েছে যে, একদিন হযরত আবুবকর (রাঃ) সা‘দের ছোট্ট মেয়েকে কোলে নিয়ে আদর করতে করতে বলেন, এটি সা‘দের মেয়ে। যিনি আমার চেয়ে উত্তম ছিলেন। তিনি ক্বিয়ামতের দিন নুক্বাবায়ে মুহাম্মাদীর মধ্যে শামিল হবেন (হায়ছামী, মাজমাউয যাওয়ায়েদ হা/১৫৭০৪, সনদ যঈফ)।

এক ওয়াক্ত ছালাত আদায় না করেও জান্নাতী হলেন যারা

(১) আউস গোত্রের বনু ‘আব্দিল আশহাল শাখার ‘আমর বিন ছাবিত আল-উছায়রিম(عَمْرو بن ثابت الْأُصَيْرِمِ) কে আহতদের মধ্যে দেখতে পেয়ে হতাহতদের সন্ধানকারী মুসলিম বাহিনী হতবাক হয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলেন,مَا الَّذِي جَاءَ بِك؟ أَحَدَبٌ عَلَى قَوْمِك أَمْ رَغْبَةٌ فِي الْإِسْلاَمِ؟ ‘কোন বস্ত্ত তোমাকে এখানে এনেছে? নিজ সম্প্রদায়কে সাহায্য করার উত্তেজনা, না-কি ইসলামের আকর্ষণ? উত্তরে তিনি বললেন, بَلْ رَغْبَةٌ فِي الْإِسْلاَمِ آمَنْتُ بِاَللهِ وَرَسُولِهِ ثُمَّ قَاتَلْتُ مَعَ رَسُولِ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ حَتَّى أَصَابَنِي مَا تَرَوْنَ ‘বরং ইসলামের আকর্ষণ। আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উপরে ঈমান এনেছি। অতঃপর আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে যুদ্ধ করেছি। অতঃপর যে অবস্থায় উপনীত হয়েছি, তাতো তোমরা দেখছই’। এরপরেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তার বিষয়টি রাসূল (ছাঃ)-কে বলা হ’লে তিনি বলেন, إِنَّهُ لَمِنْ أَهْلِ الْجَنَّةِ ‘নিশ্চয়ই সে জান্নাতবাসী’।[1] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আরও বলেন,عَمِلَ قَلِيلاً وَأُجِرَ كَثِيرًا ‘কম আমল করল এবং পুরস্কার বেশী পেল’।[2] আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন,وَلَمْ يُصَلِّ لِلَّهِ صَلاَةً قَطٌّ ‘অথচ তিনি আল্লাহর জন্য এক রাক‘আত ছালাতও কখনো আদায় করেননি’।[3]

উল্লেখ্য যে, দ্বাদশ নববী বর্ষে মক্কায় অনুষ্ঠিত ২য় বায়‘আতের পর ১২ জন মুসলমানের সাথে ইসলামের প্রথম দাঈ হযরত মুছ‘আব বিন ওমায়েরকে মদীনায় পাঠানো হ’লে তাঁর দাওয়াতে আউস নেতা সা‘দ বিন মু‘আয ইসলাম কবুল করেন এবং স্বীয় গোত্রের সকলকে আল্লাহর দোহাই দিয়ে সন্ধ্যার মধ্যেই ইসলাম কবুলের আহবান জানান। নইলে তাদের সঙ্গে তিনি কথা বলা হারাম ঘোষণা করেন। এমতাবস্থায় সন্ধ্যার মধ্যে সবাই ইসলাম কবুল করে। কেবলমাত্র উছায়রিম বাকী থাকে। উক্ত ঘটনার চার বছর পরে ওহোদ যুদ্ধের দিন তিনি স্বেচ্ছায় ইসলামের কালেমা পাঠ করে যুদ্ধক্ষেত্রে ছুটে যান এবং শহীদ হয়ে যান।[4]

(২) আমর ইবনু উক্বাইশ(عَمْرو بن أُقَيْشٍ) : জাহেলী যুগে তার সূদের টাকা পাওনা ছিল। সেগুলি আদায়ের আগ পর্যন্ত তিনি ইসলাম কবুলে অনাগ্রহী ছিলেন। পরে তিনি ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হন। অতঃপর তিনি ওহোদের দিন চলে আসেন এবং গোত্র নেতা সা‘দ বিন মু‘আয ও তার গোত্রীয় ভাইদের খোঁজ করেন। তিনি জানতে পারেন যে, তারা সবাই ওহোদের যুদ্ধে চলে গেছেন। তখন তিনি পোশাক পরে যুদ্ধের ময়দানে চলে যান। তাকে এ অবস্থায় দেখে মুসলমানরা নিষেধ করল। কিন্তু তিনি বললেন, ‘আমি ঈমান এনেছি’। অতঃপর তিনি যুদ্ধে লিপ্ত হন এবং আহত অবস্থায় মদীনায় নীত হন। তখন সা‘দ বিন মু‘আয (রাঃ) তার কাছে গিয়ে তার বোনকে বলেন, তুমি ওকে জিজ্ঞেস কর তুমি কি তোমার গোত্রীয় উত্তেজনায় গিয়েছিলে, নাকি আল্লাহর প্রতি ভালোবাসার টানে গিয়েছিলে? জবাবে তিনি বললেন,بَلْ غَضَبًا لِلَّهِ وَلِرَسُولِهِ فَمَاتَ. فَدَخَلَ الْجَنَّةَ وَمَا صَلَّى لِلَّهِ صَلاَةً ‘বরং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের মহববতের টানে’। অতঃপর তিনি মৃত্যুবরণ করেন ও জান্নাতে প্রবেশ করেন। অথচ তিনি আল্লাহর জন্য এক ওয়াক্ত ছালাতও আদায় করেননি’।[5]

[1]. যাদুল মা‘আদ ৩/১৮০; ইবনু হিশাম ২/৯০; আহমাদ হা/২৩৬৮৪, সনদ হাসান।
[2]. যাদুল মা‘আদ ৩/৪২; বুখারী ফৎহসহ হা/২৮০৮, ৬/২৫ পৃঃ।
[3]. আহমাদ হা/২৩৬৮৪, সনদ হাসান; যাদুল মা‘আদ ৩/১৮০. আর-রাহীক্ব পৃঃ ২৮০, ১৪৬।
[4]. ইবনু হিশাম ১/৪৩৭, ২/৯০; যাদুল মা‘আদ ৩/১৮০; আর-রাহীক্ব পৃঃ ১৪৬, ২৮০।
[5]. আবুদাঊদ হা/২৫৩৭; হাকেম হা/২৫৩৩, সনদ ছহীহ। ইবনু হাজার উছায়রিম ও ‘আমরকে একই ব্যক্তি বলেছেন। ইনি প্রখ্যাত ছাহাবী হুযায়ফা ইবনুল ইয়ামানের বোনের পুত্র ছিলেন। উছায়রিম ছিল ‘আমর বিন উক্বাইশের লক্বব (আল-ইছাবাহ, ‘আমর বিন ছাবেত বিন উক্বাইশ ক্রমিক ৫৭৮৯)।

ইসলামের পক্ষে লড়াই করেও জাহান্নামী হল যারা

(১) মদীনার বনু যাফর(بنو ظَفر) গোত্রের ‘কুযমান’ (قُزمان) ওহোদ যুদ্ধে রাসূল (ছাঃ)-এর পক্ষে বীর বিক্রমে যুদ্ধ করেছিল। সে একাই কুরায়েশ বাহিনীর ৪ জন পতাকাবাহীসহ ৭/৮ জন শত্রুসৈন্য খতম করেছিল। যুদ্ধের ময়দানে তাকে আহত অবস্থায় পাওয়া গেলে মুসলিম সেনারা তাকে উঠিয়ে মদীনায় তার মহল্লায় নিয়ে যান এবং জান্নাতের সুসংবাদ শুনান। তখন সে বলল, وَاللهِ إنْ قَاتَلْتُ إلاَّ عَنْ أَحْسَابِ قَوْمِي، وَلَوْلاَ ذَلِكَ مَا قَاتَلْتُ ‘আল্লাহর কসম! আমি যুদ্ধ করেছি আমার বংশের গৌরব রক্ষার জন্য। যদি এটা না থাকত, তাহলে আমি যুদ্ধই করতাম না’। অতঃপর যখন তার যখমের যন্ত্রণা অত্যধিক বৃদ্ধি পেল, তখন সহ্য করতে না পেরে সে নিজের তীর দিয়ে নিজেকে হত্যা করে ফেলল। তার বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলে রাসূল (ছাঃ) বলেন,إنَّهُ لَمِنْ أَهْلِ النَّارِ ‘নিশ্চয়ই সে জাহান্নামী’। প্রকৃত অর্থে সে ছিল একজন মুনাফিক।[1] বংশ গৌরবের উত্তেজনাই তাকে যুদ্ধে টেনে এনেছিল। এ প্রসঙ্গে রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, إنَّ السَّيْفَ لاَ يَمْحُو النِّفَاقَ ‘তরবারি নিফাককে দূরীভূত করে না’।[2] অর্থাৎ জিহাদে নিহত হ’লেও মুনাফেকীর পাপের কারণে সে জাহান্নামী হয়।

(২) হারেছ বিন সুওয়াইদ বিন ছামেত আনছারী : এ ব্যক্তি বাহ্যিকভাবে মুসলমান ছিল। কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে সে মুনাফিক ছিল। মুসলমানদের পক্ষে সে ওহোদ যুদ্ধে যোগদান করে। কিন্তু যুদ্ধের মধ্যে সে তার স্বপক্ষীয় মুজাযযার বিন যিয়াদ আল-বালাওয়া (مُجَذَّر بن زياد البَلَوى) আনছারীকে হত্যা করে মক্কায় পালিয়ে যায়। সে তাকে মেরে কুফরী অবস্থায় আউস ও খাযরাজের মধ্যকার কোন এক যুদ্ধে তার পিতা সুওয়াইদকে হত্যার প্রতিশোধ নিয়েছিল। আর এজন্য সে যুদ্ধের ময়দানকে সুযোগ হিসাবে বেছে নিয়েছিল।[3]

এতে স্পষ্ট হয় যে, কেবলমাত্র আল্লাহর কালেমাকে বুলন্দ করার উদ্দেশ্য ব্যতীত অন্য কোন উদ্দেশ্যে যুদ্ধকারীর পরিণতি জাহান্নাম ছাড়া কিছুই নয়। রাসূল (ছাঃ)-এর পতাকাতলে জিহাদে শরীক হয়েও উক্ত ব্যক্তিদ্বয় জান্নাত থেকে মাহরূম হয়ে গেল নিয়তে ত্রুটি থাকার কারণে। অথচ উছায়রিম ও ‘আমর বিন উক্বাইশ (রাঃ) এক ওয়াক্ত ছালাত আদায় না করেও কেবল আল্লাহর কালেমাকে সমুন্নত করার খালেছ নিয়তের কারণে জান্নাতী হ’লেন। এজন্যেই হাদীছে বলা হয়েছে,إِنَّمَا الأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ ‘সকল কাজ নিয়তের উপর নির্ভরশীল’।[4]

[1]. ইবনু হিশাম ২/৮৮; সনদ ‘মুরসাল’ (তাহকীক ইবনু হিশাম ক্রমিক ১১৪৮)।
[2]. দারেমী হা/২৪১১; মিশকাত হা/৩৮৫৯ ‘জিহাদ’ অধ্যায়, সনদ ছহীহ।
[3]. ইবনু সা‘দ ৩/৪১৭; ইবনু হিশাম ২/৮৯, সনদ ‘মুরসাল’ (তাহকীক ইবনু হিশাম ক্রমিক ১১৪৯)।
[4]. বুখারী হা/১; মুসলিম হা/১৯০৭; মিশকাত হা/১।

উত্তম ইহূদী

ওহোদ যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর নিহতদের মধ্যে মুখাইরীক্ব (مُخَيْرِيقٌ) নামের এক ইহূদী আলেমকে পাওয়া গেল। যিনি বনু নাযীর ইহূদী গোত্রের বনু ছা‘লাবাহ শাখার অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তিনি খেজুর বাগিচাসহ বহু মাল-সম্পদের অধিকারী ছিলেন। তিনি রাসূল (ছাঃ)-এর গুণাবলী সম্পর্কে অবগত ছিলেন এবং তাঁর দ্বীনের প্রতি সর্বদা অনুরক্ত ছিলেন। ইতিমধ্যে ওহোদের যুদ্ধ উপস্থিত হয়। ঐ দিন ছিল শনিবার। যুদ্ধ চলাকালে তিনি স্বীয় গোত্রকে বলেন,يَا مَعْشَرَ يَهُودَ وَاللهِ لَقَدْ عَلِمْتُمْ أَنَّ نَصْرَ مُحَمَّدٍ عَلَيْكُمْ لَحَقٌّ ‘হে ইহূদীগণ! তোমরা জান যে, মুহাম্মাদকে সাহায্য করা তোমাদের উপর অবশ্য কর্তব্য’। তারা বলল, الْيَوْمَ يَوْمُ السَّبْتِ ‘আজকে যে শনিবার’। তিনি বললেন,لاَ سَبْتَ لَكُمْ ‘তোমাদের জন্য কোন শনিবার নেই’। এই বলে তিনি তরবারি ও অন্যান্য যুদ্ধ সরঞ্জামাদি উঠিয়ে নিয়ে বলেন,إِنْ أُصِبْتُ فَمَالِي لِمُحَمَّدٍ يَصْنَعُ فِيهِ مَا شَآءَ ‘যদি আমি আজকে নিহত হই, তাহ’লে আমার মালামাল সব মুহাম্মাদের হবে। তিনি তা নিয়ে যা খুশী করবেন, যা আল্লাহ তাঁকে নির্দেশ দিবেন’। এরপর তিনি যুদ্ধে গিয়ে নিহত হন। তাঁর সম্পর্কে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বলেন,مُخَيْرِيقُ خَيْرُ يَهُودَ ‘মুখাইরীক্ব একজন উত্তম ইহূদী’।[1] অর্থাৎ ইহূদী থেকে মুসলমান হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ঐ দিন যারা যুদ্ধে উপস্থিত ছিলেন, তাদের মধ্যে তিনি উত্তম ছিলেন। নইলে ইতিপূর্বে ইসলাম কবুলকারী বিখ্যাত ইহূদী আলেম আব্দুল্লাহ বিন সালাম (রাঃ) ছিলেন সর্বোত্তম ও স্বীয় জীবদ্দশায় জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত ছাহাবী’ (বুখারী হা/৩৮১২-১৩)। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বনু নাযীর গোত্রে তার পরিত্যক্ত সাতটি খেজুর বাগান আল্লাহর রাস্তায় ওয়াফক করে দেন এবং এটাই ছিল মদীনার প্রথম ওয়াকফ ভূমি।[2]

[1]. ইবনু হিশাম ১/৫১৮; ২/৮৮-৮৯; আর-রাহীক্ব ২৮০ পৃঃ। ইবনু ইসহাক এটি বিনা সনদে বর্ণনা করেছেন। ভাষ্যকার সুহায়লী বলেন, মুখাইরীক্ব মুসলিম ছিলেন। এজন্য তাঁকে خَيْرُ يَهُودَ ‘উত্তম ইহূদী’ বলা হয়েছে, خَيْرُ الْيَهُودِ ‘ইহূদীদের মধ্যে উত্তম’ বলা হয়নি (ইবনু হিশাম ১/৫১৮-টীকা; আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ৪/৩৭; মা শা-‘আ ১৫৯ পৃঃ)। ইবনু হাজার তাঁকে ছাহাবীদের অন্তর্ভুক্ত গণ্য করেছেন (আল-ইছাবাহ, মুখাইরীক্ব ক্রমিক ৭৮৫৫; সীরাহ ছহীহাহ ২/৩৮৯)।
[2]. মুসলিম, শরহ নববী হা/১৭৫৯ (৫৪); ইবনু হিশাম ১/৫১৮; সনদ ‘মুরসাল’ (তাহকীক ইবনু হিশাম ক্রমিক ১১৪৯)।

শহীদের রক্ত মিশকের ন্যায় সুগন্ধিময়

ওহোদ যুদ্ধে নিহত শহীদগণের লাশ পরিদর্শনকালে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,أَنَا شَهِيدٌ عَلَى هَؤُلاَءِ ‘আমি এদের উপরে সাক্ষী থাকব’। অতঃপর তিনি বলেন, لاَ يُكْلَمُ أَحَدٌ فِى سَبِيلِ اللهِ- وَاللهُ أَعْلَمُ بِمَنْ يُكْلَمُ فِى سَبِيلِهِ- إِلاَّ جَاءَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَجُرْحُهُ يَثْعَبُ، اللَّوْنُ لَوْنُ دَمٍ وَالرِّيحُ رِيحُ مِسْكٍ ‘কেউ আল্লাহর রাস্তায় আহত হ’লে, আর আল্লাহ ভালো জানেন কে তার রাস্তায় আহত হয়েছে, ক্বিয়ামতের দিন সে এমন অবস্থায় উপস্থিত হবে যে, তার ক্ষতস্থান হ’তে রক্ত ঝরতে থাকবে। যার রং হবে রক্তের ন্যায়, কিন্তু সুগন্ধি হবে মিশকের ন্যায়’।[1]

[1]. বুখারী হা/২৮০৩; মুসলিম হা/১৮৭৬; মিশকাত হা/৩৮০২ ‘জিহাদ’ অধ্যায়।

ল্যাংড়া শহীদ

‘আমর ইবনুল জামূহ ল্যাংড়া ছিলেন বিধায় তার ব্যাঘ্রসম চার পুত্র জিহাদে যান ও পিতাকে যেতে নিষেধ করেন। কিন্তু তিনি রাসূল (ছাঃ)-কে এসে বললেন, আমি যদি এই ল্যাংড়া পায়ে যুদ্ধ করে নিহত হই, তাহলে কি জান্নাত পাব? জবাবে রাসূল (ছাঃ) বললেন, হ্যাঁ পাবে। কিন্তু তোমার জন্য যুদ্ধ মাফ। তখন তিনি বলে উঠলেন, فَوَاللهِ إنِّي لَأَرْجُو أَنْ أَطَأَ بِعَرْجَتِي هَذِهِ فِي الْجَنَّةِ ‘আল্লাহর কসম! এই ল্যাংড়া পা নিয়েই আজ আমি জান্নাত মাড়াব। তখন রাসূল (ছাঃ) তার ছেলেদের উদ্দেশ্যে বললেন, مَا عَلَيْكُمْ أَنْ لاَ تَمْنَعُوهُ، لَعَلَّ اللهَ أَنْ يَرْزُقَهُ الشَّهَادَةَ ‘তোমরা তাকে নিষেধ করো না। আল্লাহ হয়ত এর মাধ্যমে তাঁকে শাহাদাত দান করবেন’। অতঃপর তিনি যুদ্ধে নামেন ও শহীদ হয়ে যান।[1] অন্য বর্ণনায় এসেছে যে, তার লাশেল পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় রাসূল (ছাঃ) বলেছিলেন,كَأَنِّى أَنْظُرُ إِلَيْكَ تَمْشِى بِرِجْلِكَ هَذِهِ صَحِيحَةً فِى الْجَنَّةِ ‘আমি যেন তোমাকে দেখতে পাচ্ছি যে, তুমি সুস্থ পা নিয়ে জান্নাতে বিচরণ করছ’ (আহমাদ হা/২২৬০৬, সনদ ‘হাসান’)।

[1]. ইবনু হিশাম ২/৯০; আলবানী, ফিক্বহুস সীরাহ ২৬০ পৃঃ সনদ হাসান; যাদুল মা‘আদ ৩/১৮৭।

ওহোদ যুদ্ধের শুহাদা কবরস্থান
অনেকে শহীদদের লাশ মদীনায় স্ব স্ব বাড়ীতে নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সব লাশ ফেরত আনার নির্দেশ দেন। অতঃপর বিনা গোসলে তাদের পরিহিত যুদ্ধ পোষাকে (বর্তমান শুহাদা কবরস্থানে) এক একটি কবরে দু’তিনজনকে দাফন করা হয়। একটি কাপড়ে দু’জনকে কাফন পরানো হয়। অতঃপর ‘লাহদ’ বা পাশখুলি কবর খোড়া হয়। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) জিজ্ঞেস করেন,أَيُّهُمْ أَكْثَرُ أَخْذًا لِلْقُرْآنِ؟ এদের মধ্যে সর্বাধিক কুরআন জানতেন কে’? লোকেরা ইঙ্গিত দিলে তিনি তাকেই আগে কবরে নামাতেন। জাবের (রাঃ)-এর পিতা আব্দুল্লাহ বিন ‘আমর বিন হারাম এবং ‘আমর ইবনুল জামূহকে তিনি এক কবরে রাখেন। কেননা তাঁদের মধ্যে বন্ধুত্ব ছিল’ (ইবনু হিশাম ২/৯৮)।

অনুরূপ হযরত হামযা (রাঃ) ও আব্দুল্লাহ বিন জাহ্শকে একই কবরে রাখা হয়। কেননা তিনি ছিলেন মামা-ভাগিনা।[1] তাঁদের উভয়েরই অঙ্গহানি করা হয়েছিল। তবে তাদের কলিজা বের করা হয়নি (ইবনু হিশাম ২/৯৭)। তাদের জন্য কাফনের কাপড় যথেষ্ট না হওয়ায় মাথা ঢেকে দিয়ে পায়ের উপরে ‘ইযখির’ (الإذخر) ঘাস দেওয়া হয়।[2] মুছ‘আব বিন ওমায়ের-এর সাথে কেবল একটি চাদর ছিল। তাতে কাফনের কাপড়ে কমতি হ’লে তাঁরও ইযখির ঘাস দিয়ে পা ঢাকা হয় (বুখারী হা/১২৭৬)। ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন, হামযার জন্য দো‘আ করার সময় আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) এত কেঁদেছিলেন যে, তাঁর স্বর উঁচু হয়ে যায় এবং আমরা তাঁকে এত কাঁদতে কখনো দেখিনি’ (সীরাহ হালাবিইয়াহ ২/৫৩৪)। এখানেও শহীদদের উদ্দেশ্যে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বলেন, أَنَا شَهِيدٌ عَلَى هَؤُلاَءِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ ‘ক্বিয়ামতের দিন আমি এদের সকলের উপরে সাক্ষী হব’। তাদের গোসল দেওয়া হয়নি এবং কারু জানাযা হয়নি’।[3]

[1]. আর-রাহীক্ব ২৮১ পৃঃ। মুবারকপুরী এখানে আব্দুল্লাহ বিন জাহশকে রাসূল (ছাঃ)-এর দুধ ভাই বলেছেন। যা প্রমাণিত নয় (আল-ইছাবাহ, ছুওয়াইবাহ ক্রমিক ১০৯৬৪; ইবনু হিশাম ২/৯৬)।

[2]. আহমাদ হা/২৭২৬২; মিশকাত হা/১৬১৫।
[3]. বুখারী হা/১৩৪৩, ৪০৭৯; মিশকাত হা/১৬৬৫; আহমাদ হা/২৩৭০৭; হাকেম ৩/২৩।

ভাইয়ের লাশ দেখতে মানা

হযরত হামযার বোন ছাফিয়া বিনতে আব্দুল মুত্ত্বালিব ছুটে এসেছেন ভাইয়ের লাশ শেষবারের মত দেখার জন্য। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) পুত্র যুবায়েরকে বললেন, তিনি যেন তার মাকে ফিরিয়ে নিয়ে যান। কিন্তু তিনি বাধা না মেনে বলেন, কেন বাধা দিচ্ছ। আমি শুনেছি, আমার ভাইয়ের নাক-কান কাটা হয়েছে। وَذَلِكَ فِي اللهِ ‘আর তা হয়েছে আল্লাহর পথে’। তাতে আমি সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট রয়েছি। لَأَحْتَسِبَن وَلَأَصْبِرَن إنْ شَآءَ اللهُ ‘আল্লাহ চাহেন তো আমি এতে ছওয়াব কামনা করব এবং অবশ্যই ধৈর্য ধারণ করব’। একথা শোনার পর রাসূল (ছাঃ) তাকে অনুমতি দেন। অতঃপর তিনি ভাইয়ের লাশের কাছে পৌঁছেন এবং তার জন্য দো‘আ ও ক্ষমা প্রার্থনা করেন।[1]

[1]. ইবনু হিশাম ২/৯৭; সনদ যঈফ (তাহকীক ইবনু হিশাম ১১৭১); আল-বিদায়াহ ৪/৪২।
 ওহোদ যুদ্ধের উল্লেখযোগ্য বিষয়সমূহ- ৩২. শহীদগণের জন্য বিদায়ী দো‘আ(الدعاء الوداعى للشهداء)
দাফন শেষে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ছাহাবায়ে কেরামকে পিছনে সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড় করিয়ে দীর্ঘক্ষণ ধরে আল্লাহর প্রশংসা করেন ও তাঁর নিকটে প্রার্থনা করেন।[1] উল্লেখ্য যে, শোহাদা কবরস্থানটি চারদিকে পাঁচিল দিয়ে বর্তমানে ঘেরা রয়েছে। নির্দিষ্টভাবে কোন কবরের চিহ্ন সেখানে নেই।

[1]. বুখারী, আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৫৪১, সনদ হাসান; আহমাদ হা/১৫৫৩১, ২২০০১; সনদ ছহীহ।

মদীনা ফেরার পথে মহিলাদের আকুতিপূর্ণ ঘটনাবলী

(ক) হামনাহ বিনতে জাহশ : মদীনায় ফেরার সময় পথিমধ্যে হামনাহ বিনতে জাহ্শের সাথে সাক্ষাৎ হলে তাকে প্রথমে তাঁর ভাই আব্দুল্লাহ বিন জাহ্শ, অতঃপর মামু হামযাহ বিন আব্দুল মুত্ত্বালিবের শাহাদাতের খবর দেওয়া হয়। উভয় খবরে তিনি ইন্নালিল্লাহ পাঠ করেন ও তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন। এরপর তাঁকে তাঁর স্বামী মুছ‘আব বিন ওমায়ের-এর শাহাদাতের খবর শুনানো হ’লে তিনি চীৎকার দিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন(فَصَاحَتْ وَوَلْوَلَتْ)।[1] উল্লেখ্য যে, মুছ‘আবকে রাসূল ভেবে হত্যা করেছিল আব্দুল্লাহ বিন ক্বামিআহ লায়ছী (ইবনু হিশাম ২/৭৩)।

(খ) বনু দীনার গোত্রের এক মহিলাকে তার স্বামী, ভাই ও পিতার শাহাদাতের খবর শুনানো হলে তিনি ইন্নালিল্লাহ পাঠ করেন ও তাদের জন্য ইস্তিগফার করেন। অতঃপর তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ)-এর খবর কি? বলা হ’ল, তিনি ভাল আছেন যেমন তুমি চাচ্ছ হে অমুকের মা’। তখন তিনি অস্থির চিত্তে বলে উঠলেন, أَرُونِيهِ حَتّى أَنْظُرَ إلَيْهِ ‘আমাকে দেখিয়ে দাও। যাতে আমি তাঁকে স্বচক্ষে দেখতে পারি’। তারপর তাকে দেখিয়ে দিতেই তিনি খুশী হয়ে রাসূল (ছাঃ)-কে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন, كُلُّ مُصِيبَةٍ بَعْدَكَ جَلَلٌ ‘আপনাকে পাওয়ার পর সব বিপদই তুচ্ছ’। হিন্দ নাম্মী এই মহিলা ছিলেন ল্যাংড়া শহীদ ‘আমর ইবনুল জামূহ আনছারী (রাঃ)-এর স্ত্রী।[2]

[1]. প্রসিদ্ধ আছে যে, তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, إنّ زَوْجَ الْمَرْأَةِ مِنْهَا لَبِمَكَانِ ‘নিশ্চয়ই স্বামীর জন্য স্ত্রীর নিকটে রয়েছে এক বিশেষ স্থান’ (ইবনু হিশাম ২/৯৮; আর-রাহীক্ব ২৮৩ পৃঃ; সীরাহ ছহীহাহ ২/৩৯৫)। বর্ণনাটি ‘যঈফ’ (আর-রাহীক্ব, তা‘লীক্ব ১৫৫ পৃঃ)।
[2]. ইবনু হিশাম ২/৯৯, সনদ ‘মুরসাল’ ঐ, তাহকীক ক্রমিক ১১৮০; যুরক্বানী ৬/২৯০; সীরাহ ছহীহাহ ২/৩৯৫।

প্রসিদ্ধ আছে যে, এ সময় আউস গোত্রের নেতা সা‘দ-এর মা দৌড়ে আসেন। তখন তার পুত্র সা‘দ বিন মু‘আয রাসূল (ছাঃ)-এর ঘোড়ার লাগাম ধরে চলছিলেন। কাছে এলে সা‘দ বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল, ইনি আমার মা। রাসূল (ছাঃ) তাকে অভ্যর্থনা জানিয়ে বললেন, ‘মারহাবা’। অতঃপর তিনি থেমে যান এবং তাঁকে তার পুত্র ‘আমর বিন মু‘আযের শাহাদাতের জন্য সমবেদনা জানান ও ধৈর্য ধারণের উপদেশ দেন। তখন উম্মে সা‘দ বলেন, إذْ رَأَيْتُك سَالِمًا، فَقَدْ أَشْوَتِ الْمُصِيبَةُ أمّا ‘যখন আমি আপনাকে নিরাপদ দেখেছি, তখন সকল মুছীবত নগণ্য হয়ে গেছে’। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ওহোদ যুদ্ধের সকল শহীদের জন্য দো‘আ করেন এবং উম্মে সা‘দকে উদ্দেশ্য করে বলেন, يَا أُمَّ سَعْدٍ، أَبْشِرِي وَبَشِّرِي أَهْلِيهِمْ أَنَّ قَتَلاَهُمْ قَدْ تَرَافَقُوا فِي الْجَنَّةِ جَمِيعًا وَشَفَعُوا فِي أَهْلِيهِمْ جَمِيْعًا- ‘হে উম্মে সা‘দ! সুসংবাদ গ্রহণ কর এবং শহীদ পরিবারগুলিকে সুসংবাদ শুনিয়ে দাও যে, তাদের শহীদগণ সকলে জান্নাতে একত্রে রয়েছে এবং তাদের পরিবারবর্গের ব্যাপারে তাদের সবারই শাফা‘আত কবুল করা হবে’। উম্মে সা‘দ বললেন, رَضِينَا يَا رَسُولَ اللهِ، وَمَنْ يَبْكِي عَلَيْهِمْ بَعْدَ هَذَا؟ ‘আমরা সন্তুষ্ট হয়েছি হে আল্লাহর রাসূল! এরপরে আর কে তাদের জন্য কান্নাকাটি করবে? অতঃপর তিনি বললেন, اُدْعُ يَا رَسُولَ اللهِ لِمَنْ خُلّفُوا ‘হে আল্লাহর রাসূল! তাদের উত্তরাধিকারীদের জন্য দো‘আ করুন’। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) দো‘আ করলেন, اللَّهُمَّ أَذْهِبْ حُزْنَ قُلُوبِهِمْ وَاجْبُرْ مُصِيبَتَهُمْ، وَأَحْسِنْ الْخَلَفَ عَلَى مَنْ خُلِّفُوا- ‘হে আল্লাহ! তুমি তাদের অন্তরের দুঃখ দূর করে দাও। তাদের বিপদ উত্তরণ করে দাও এবং তাদের উত্তরাধিকারীদের উত্তমরূপে তদারকী কর’ (আর-রাহীক্ব পৃঃ ২৮৩; ওয়াক্বেদী, মাগাযী ১/৩১৫; সীরাহ হালাবিইয়াহ ২/৪৭)। বর্ণনাটি সনদবিহীন।

কান্নার রোল নিষিদ্ধ

(১) জাবের বিন আব্দুল্লাহ বিন ‘আমর বলেন, আমার আববাকে অঙ্গহানি করা অবস্থায় কাপড়ে ঢেকে নিয়ে আসা হয়। তখন আমি বারবার কাপড় উঠিয়ে তাকে দেখছিলাম আর কাঁদছিলাম। লোকেরা এতে আমাকে নিষেধ করে। কিন্তু রাসূল (ছাঃ) আমাকে নিষেধ করেননি। এসময় তিনি চিৎকার দানকারিণী কোন মহিলার কণ্ঠ শোনেন। তাঁকে বলা হ’ল, ইনি আমরের মেয়ে অথবা বোন (অর্থাৎ নিহত আব্দুল্লাহর বোন অথবা ফুফু)। তখন তিনি বলেন, ابْكُوهُ أَوْ لاَ تَبْكُوهُ مَا زَالَتِ الْمَلاَئِكَةُ تُظِلُّهُ بِأَجْنِحَتِهَا حَتَّى دَفَنْتُمُوهُ ‘তোমরা কাঁদ বা না কাঁদ, ফেরেশতারা তাকে তাদের ডানা দিয়ে ছায়া করবে, যতক্ষণ না তোমরা তাকে দাফন করবে’।[1]

(২) ওহোদ থেকে ফেরার পথে রাসূল (ছাঃ) আনছারদের বনু আব্দিল আশহাল ও বনু যাফর গোত্রের মহিলাদের স্ব স্ব নিহতদের জন্য কান্নার রোল শুনতে পেলেন। তাতে তাঁর দু’চোখ অশ্রুসিক্ত হ’ল এবং তিনি কাঁদতে লাগলেন। এক পর্যায়ে তিনি বললেন, সবাই কাঁদছে। কিন্তু আজ হামযার জন্য কাঁদবার কেউ নেই(وَلَكِنَّ حَمْزَةَ لاَ بَوَاكِىَ لَهُ)। অতঃপর যখন গোত্রনেতা সা‘দ বিন মু‘আয ও উসায়েদ বিন হুযায়ের সেখানে এলেন, তারা মহিলাদের বললেন, রাসূলের চাচার শোকে কান্নার জন্য। সেমতে তারা সবাই কাঁদতে কাঁদতে রাসূল (ছাঃ)-এর বাসগৃহের সামনে এসে পৌঁছে গেল। তখন রাসূল (ছাঃ) বেরিয়ে এসে তাদের ধন্যবাদ জানিয়ে বললেন, اِرْجِعْنَ يَرْحَمُكُنَّ الله ‘তোমরা ফিরে যাও। আল্লাহ তোমাদের উপর রহম করুন! এদিন থেকে কান্নার রোল (النَّوْحُ) নিষিদ্ধ করা হয়’।[2]

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,لَيْسَ مِنَّا مَنْ ضَرَبَ الْخُدُودَ ، وَشَقَّ الْجُيُوبَ ، وَدَعَا بِدَعْوَى الْجَاهِلِيَّةِ ‘সে ব্যক্তি আমাদের দলভুক্ত নয়, যে (মৃতের শোকে) নিজের মুখ চাপড়ায়, জামা ছিঁড়ে এবং জাহেলী যুগের ন্যায় চিৎকার দিয়ে কাঁদে’। মুসলিমের বর্ণনায় এসেছে, রাসূল (ছাঃ) বলেন, أَنَا بَرِىءٌ مِمَّنْ حَلَقَ وَسَلَقَ وَخَرَقَ আমি দায়মুক্ত ঐ ব্যক্তি থেকে, যে শোকে মাথা মুন্ডন করে, চিৎকার দিয়ে কাঁদে এবং কাপড় ছিঁড়ে’।[3] উল্লেখ্য যে, জাহেলী যুগের এটা রীতি ছিল যে, যার মৃত্যুতে যত বেশী মহিলা কান্নাকাটি করবে, তিনি তত বেশী মর্যাদাবান বলে খ্যাত হবেন। তবে চিৎকার বিহীন সাধারণ কান্না নিষিদ্ধ নয়। যেমন ওছমান বিন মাযঊন (রাঃ)-এর মৃত্যুর পর রাসূল (ছাঃ) তাকে চুমু খান। এ সময় তাঁর দু’চোখ দিয়ে অবিরল ধারে অশ্রু প্রবাহিত হচ্ছিল।[4]

[1]. মুসনাদে ত্বায়ালেসী হা/১৭১১, ১৮১৭; বুখারী হা/২৮১৬; মুসলিম হা/২৪৭১।
[2]. ইবনু হিশাম ২/৯৯; ইবনু মাজাহ হা/১৫৯১, সনদ হাসান।
[3]. বুখারী হা/১২৯৪; মুসলিম হা/১০৪; মিশকাত হা/১৭২৫-২৬ ‘মৃতের জন্য ক্রন্দন’ অনুচ্ছেদ।
[4]. তিরমিযী হা/৯৮৯; মিশকাত হা/১৬২৩ ‘জানাযা’ অধ্যায়।

ওহোদের শহীদগণের জন্য আল্লাহর সুসংবাদ

আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, لَمَّا أُصِيبَ إِخْوَانُكُمْ بِأُحُدٍ جَعَلَ اللهُ أَرْوَاحَهُمْ فِى جَوْفِ طَيْرٍ خُضْرٍ تَرِدُ أَنْهَارَ الْجَنَّةِ تَأْكُلُ مِنْ ثِمَارِهَا وَتَأْوِى إِلَى قَنَادِيلَ مِنْ ذَهَبٍ مُعَلَّقَةٍ فِى ظِلِّ الْعَرْشِ فَلَمَّا وَجَدُوا طِيبَ مَأْكَلِهِمْ وَمَشْرَبِهِمْ وَمَقِيلِهِمْ قَالُوا : مَنْ يُبَلِّغُ إِخْوَانَنَا عَنَّا أَنَّا أَحْيَاءٌ فِى الْجَنَّةِ نُرْزَقُ لِئَلاَّ يَزْهَدُوا فِى الْجِهَادِ وَلاَ يَنْكُلُوا عِنْدَ الْحَرْبِ فَقَالَ اللهُ سُبْحَانَهُ : أَنَا أُبَلِّغُهُمْ عَنْكُمْ. قَالَ : فَأَنْزَلَ اللهُ (وَلاَ تَحْسَبَنَّ الَّذِينَ قُتِلُوا فِى سَبِيلِ اللهِ أَمْوَاتً ‘যখন তোমাদের ভাইয়েরা ওহোদ যুদ্ধে বিপদগ্রস্ত হয়, তখন আল্লাহ তাদের আত্মাগুলিকে সবুজ পাখির পেটে ভরে দেন। যারা জান্নাতের নদীসমূহের কিনারে অবতরণ করে। তারা সেখানে জান্নাতের ফলসমূহ ভক্ষণ করে এবং আরশের ছায়ার নীচে ঝুলন্ত স্বর্ণ নির্মিত লণ্ঠনসমূহে অবস্থান নেয়। এভাবে যখন তারা সেখানে সুন্দর খানা-পিনা ও বিশ্রামস্থল পেয়ে যায়, তখন তারা বলে, কে আমাদের ভাইদেরকে আমাদের পক্ষ থেকে এ খবর পৌঁছে দিবে যে, আমরা জান্নাতে জীবিত আছি। আমরা রূযী প্রাপ্ত হচ্ছি। যেন তারা জিহাদ থেকে দূরে না থাকে এবং যুদ্ধ থেকে বিরত না হয়। তখন মহান আল্লাহ বললেন, আমিই তোমাদের পক্ষ থেকে পৌঁছে দিচ্ছি। রাসূল (ছাঃ) বলেন, অতঃপর তিনি নাযিল করেন, وَلاَ تَحْسَبَنَّ الَّذِينَ قُتِلُوا فِي سَبِيلِ اللهِ أَمْوَاتًا بَلْ أَحْيَاءٌ عِنْدَ رَبِّهِمْ يُرْزَقُونَ ‘যারা আল্লাহর রাস্তায় নিহত হয়, তাদেরকে মৃত ভেবো না। বরং তারা জীবিত। তারা তাদের প্রতিপালকের নিকট হতে জীবিকাপ্রাপ্ত হয়’।[1]

আল্লাহ বলেন,وَلَقَدْ صَدَقَكُمُ اللهُ وَعْدَهُ إِذْ تَحُسُّونَهُمْ بِإِذْنِهِ حَتَّى إِذَا فَشِلْتُمْ وَتَنَازَعْتُمْ فِي الْأَمْرِ وَعَصَيْتُمْ مِنْ بَعْدِ مَا أَرَاكُمْ مَا تُحِبُّونَ مِنْكُمْ مَنْ يُرِيدُ الدُّنْيَا وَمِنْكُمْ مَنْ يُرِيدُ الْآخِرَةَ ثُمَّ صَرَفَكُمْ عَنْهُمْ لِيَبْتَلِيَكُمْ وَلَقَدْ عَفَا عَنْكُمْ وَاللهُ ذُو فَضْلٍ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ ‘আল্লাহ তোমাদের নিকট (ওহোদ যুদ্ধে) দেওয়া (বিজয়ের) ওয়াদা সত্যে পরিণত করেছেন, যখন তোমরা (দিনের প্রথম ভাগে) ওদের কচুকাটা করছিলে তাঁর হুকুমে। অবশেষে (দিনের শেষভাগে) যখন তোমরা হতোদ্যম হয়ে পড়লে ও কর্তব্য নির্ধারণে ঝগড়ায় লিপ্ত হলে (যেটা তীরন্দাযরা করেছিল) আমি তোমাদেরকে (বিজয়) দেখানোর পর যা তোমরা কামনা করেছিলে, এ সময় তোমাদের মধ্যে কেউ দুনিয়া (গণীমত) কামনা করছিলে এবং কেউ আখেরাত কামনা করছিলে (অর্থাৎ দৃঢ় ছিলে)। অতঃপর তিনি তোমাদেরকে তাদের (উপর বিজয়ী হওয়া) থেকে ফিরিয়ে দিলেন যাতে তিনি তোমাদের পরীক্ষা নিতে পারেন। অবশ্য আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করেছেন। বস্ত্ততঃ আল্লাহ মুমিনদের প্রতি অনুগ্রহশীল’ (আলে ইমরান ৩/১৫২)।

[1]. আবুদাঊদ হা/২৫২০; হাকেম হা/২৪৪৪; আহমাদ হা/২৩৮৮, সনদ হাসান।



প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর ৬৭ পর্বের জীবনীর সকল পর্ব এখান থেকে পড়ুন-

পর্ব-০১   পর্ব-০২   পর্ব-০৩   পর্ব-০৪   পর্ব-০৫   পর্ব-০৬   পর্ব-০৭   পর্ব-০৮   পর্ব-০৯   পর্ব-১০   পর্ব-১১   পর্ব-১২   পর্ব-১৩   পর্ব-১৪   পর্ব-১৫   পর্ব-১৬   পর্ব-১৭   পর্ব-১৮   পর্ব-১৯   পর্ব-২০   পর্ব-২১   পর্ব-২২   পর্ব-২৩   পর্ব-২৪   পর্ব-২৫   পর্ব-২৬   পর্ব-২৭   পর্ব-২৮   পর্ব-২৯   পর্ব-৩০    পর্ব-৩১   পর্ব-৩২   পর্ব-৩৩   পর্ব-৩৪   পর্ব-৩৫   পর্ব-৩৬   পর্ব-৩৭   পর্ব-৩৮   পর্ব-৩৯   পর্ব-৪০   পর্ব-৪১   পর্ব-৪২   পর্ব-৪৩   পর্ব-৪৪   পর্ব-৪৫   পর্ব-৪৬(১ম) পর্ব-৪৬(২য়)    পর্ব-৪৭   পর্ব-৪৮   পর্ব-৪৯   পর্ব-৫০   পর্ব-৫১   পর্ব-৫২   পর্ব-৫৩   পর্ব-৫৪   পর্ব-৫৫   পর্ব-৫৬   পর্ব-৫৭   পর্ব-৫৮   পর্ব-৫৯   পর্ব-৬০   পর্ব-৬১   পর্ব-৬২   পর্ব-৬৩   পর্ব-৬৪   পর্ব-৬৫   পর্ব-৬৬   পর্ব-৬৭  



**************************************
>>> Welcome, You are now on Mohammadia Foundation's Website. Please stay & Tune with us>>>

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url