প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর জীবনী [পর্ব- ৩০]





পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ট মহামানব আমাদের প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:)। যাকে আল্লাহ সমস্ত মানুষের জন্য অশেষ রহমত স্বরূপ এই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। যে নবী সারা জীবন উম্মতের জন্য সংগ্রাম করেছেন, কাল রোজ হাশরের মাঠেও যিনি উম্মতের জন্যই পেরেশান থাকবেন; সেই প্রাণপ্রিয় নবীকে আমরা কতটুকু চিনি কতটুকু জানি। প্রিয় নবী (সা:) এর জীবনের পরতে পরতে রয়েছে আমাদের জন্য শিক্ষা ও অনুপ্রেরণা। যার জীবনী পড়লে নিজের অজান্তেই চোখের পানি গড়িয়ে পড়ে। সেই নবীর জীবনী কি আমরা সত্যিই জানি? আসুন, আরেকবার দেখে নেই “প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর জীবনী”। যে জীবনী পড়ে বদলে যেতে পারে আপনার আমার জীবন। আল্লাহ আমাদের সবাইকে প্রাণপ্রিয় নবীর (সা:) উম্মত হিসাবে কবুল করুন। আমিন।।

বদর যুদ্ধ পরবর্তি অভিযানসমূহ এবং মদিনা সনদ স্বাক্ষর

বদর পরবর্তী অভিযানসমূহ

সারিইয়া ওমায়ের বিন ‘আদী আল-খিত্বমী

২য় হিজরীর ২৫শে রামাযান। একাকী স্বীয় সম্পর্কিত বোন ‘আছমা (عَصْمَاء) বিনতে মারোয়ান খিত্বমিয়াকে হত্যা করেন। কেননা মহিলাটি সর্বদা তার গোত্রকে রাসূল (ছাঃ)-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য প্ররোচনা দিত। সে ইসলাম ও ইসলামের নবী (ছাঃ)-এর বিরুদ্ধে কুৎসা গেয়ে কবিতা বলত। ওমায়ের ছিলেন তার গোত্রের প্রধান এবং সর্বপ্রথম ইসলাম কবুলকারী। তার পিতা ‘আদী বিন খারশাহ ছিলেন একজন প্রসিদ্ধ কবি। ওমায়ের অন্ধ হওয়া সত্ত্বেও রাত্রির অন্ধকারে একাকী ঐ মহিলার বাড়ীতে গিয়ে তাকে ঘুমন্ত অবস্থায় এক আঘাতে শেষ করে দেন। ফিরে এসে ফজরের ছালাত শেষে তিনি রাসূল (ছাঃ)-কে উক্ত খবর দেন। তিনি তার জন্য দো‘আ করেন ও ‘আল-বাছীর’ বলে আখ্যায়িত করেন। এরপর থেকে ওমায়ের ‘আয-যারীর’-এর বদলে ‘আল-বাছীর’ নামে প্রসিদ্ধ হন। আয-যারীর (الضرير) অর্থ অন্ধ এবং আল-বাছীর (البصير) অর্থ দৃষ্টি সম্পন্ন।[1]

সারিইয়া সালেম বিন ওমায়ের আনছারী

২য় হিজরীর শাওয়াল মাস। তিনি একাকী ১২০ বছরের বৃদ্ধ ইহূদী কবি আবু ‘আফাক(أبو عَفَك)-কে হত্যা করেন। কারণ সে সর্বদা ইহূদীদেরকে রাসূল (ছাঃ)-এর বিরুদ্ধে কবিতার মাধ্যমে যুদ্ধের উস্কানী দিত। সালেম বিন ওমায়ের (রাঃ) তাকে হত্যা করার মানত করেন। তিনি বদর, ওহোদ ও খন্দকসহ রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে সকল যুদ্ধে শরীক ছিলেন। এছাড়া তাবূক যুদ্ধে যানবাহনের অভাবে যেতে না পারায় ‘ক্রন্দনকারীদের’ (وَهُوَ أحدُ الْبَكَّاءِين) অন্যতম ছিলেন। মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর খেলাফতকালে মৃত্যুবরণ করেন।[2]

গাযওয়া বনু সুলায়েম

২য় হিজরীর শাওয়াল মাস। বদর যুদ্ধ হ’তে প্রত্যাবর্তনের মাত্র সাতদিন পরে এটি সংঘটিত হয়। বনু গাত্বফান গোত্রের শাখা বনু সুলায়েম মদীনায় হামলার প্রস্ত্ততি নিচ্ছে জানতে পেরে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) স্বয়ং ২০০ উষ্ট্রারোহীকে নিয়ে মক্কা ও সিরিয়ার বাণিজ্যপথে ‘কুদ্র’ (الْكُدْرُ) নামক ঝর্ণাধারার নিকটে পৌঁছে তাদের উপরে আকস্মিক হামলা চালান। তারা হতবুদ্ধি হয়ে ৫০০ উট রেখে পালিয়ে যায়। ইয়াসার (يسار) নামে একটি গোলাম আটক হয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে মুক্ত করে দেন। অতঃপর তিনি সেখানে তিনদিন অবস্থান করে মদীনায় ফিরে আসেন। এই সময় মদীনার দায়িত্বে ছিলেন সিবা‘ বিন উরফুত্বাহ আল-গিফারী অথবা আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতূম (রাঃ)।[3]

সারিইয়া গালিব বিন আব্দুল্লাহ লায়ছী

২য় হিজরীর শাওয়াল মাসে আগ্রাসী বনু সুলায়েম বাহিনীকে তাড়িয়ে দিয়ে সেখানে তিন দিন অবস্থান শেষে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মদীনায় ফিরে আসেন। পরে শত্রুরা পুনরায় সংগঠিত হয়েছিল। তখন তাদের বিরুদ্ধে এই অভিযান প্রেরিত হয়। যাতে শত্রুপক্ষের কয়েকজন এবং মুসলিম পক্ষের তিন জন মারা যায়।[4]

গাযওয়া বনু ক্বায়নুক্বা

২য় হিজরীর ১৫ই শাওয়াল শনিবার থেকে ১৫ দিন অবরোধ করে রাখার পর এই বিশ্বাসঘাতক ও সমৃদ্ধিশালী ইহূদী গোত্রটি ১লা যিলক্বা‘দ আত্মসমর্পণ করে। এরা ছিল খাযরাজ গোত্রের মিত্র। ফলে মাত্র একমাস পূর্বে ইসলাম কবুলকারী খাযরাজ গোত্রভুক্ত মুনাফিক নেতা আব্দুল্লাহ বিন উবাইয়ের একান্ত অনুরোধে ও পীড়াপীড়িতে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) তাদের প্রাণদন্ড মওকুফ করে মদীনা থেকে বহিষ্কারের নির্দেশ দেন। এদের মধ্যে ৭০০ জন ছিল সশস্ত্র যোদ্ধা এবং মদীনার সেরা ইহূদী বীর। এরা সবকিছু ফেলে সিরিয়ার দিকে চলে যায় এবং অল্পদিনের মধ্যেই তাদের অধিকাংশ সেখানে মৃত্যুবরণ করে। মানছূরপুরী বলেন, তারা খায়বরে যেয়ে বসতি স্থাপন করে।[5]

গাযওয়া সাভীক্ব

২য় হিজরীর ৫ই যিলহাজ্জ রবিবার। বদর যুদ্ধে লজ্জাকর পরাজয়ে কুরায়েশ নেতা আবু সুফিয়ান শপথ করেছিলেন যে, মুহাম্মাদের সঙ্গে যুদ্ধ করে এর প্রতিশোধ না নেওয়া পর্যন্ত তার মস্তক নাপাকীর গোসলের পানি স্পর্শ করবে না। সেই প্রতিজ্ঞা পূরণের জন্য তিনি ২০০ উষ্ট্রারোহী নিয়ে রাতের বেলায় গোপনে মদীনায় এসে ইহূদী গোত্র বনু নাযীর নেতা ও তাদের কোষাধ্যক্ষ সাল্লাম বিন মিশকামের সঙ্গে শলা পরামর্শ শেষে রাতেই মক্কায় রওয়ানা হয়ে যান। কিন্তু যাওয়ার আগে একটি দল পাঠিয়ে দেন। যারা মদীনার উপকণ্ঠে ‘উরাইয’ (العُرَيض) নামক স্থানে একটি খেজুর বাগান জ্বালিয়ে দেয় এবং সেখানে দায়িত্বরত একজন আনছার ও তার এক মিত্রকে হত্যা করে ফিরে যায়।

এখবর জানতে পেরে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) দ্রুত গতিতে তাদের পশ্চাদ্ধাবন করেন। আবু সুফিয়ান ভয়ে এত দ্রুত পলায়ন করেন যে, বোঝা হালকা করার জন্য তাদের বহু রসদ সম্ভার এবং ছাতুর বস্তা রাস্তার পাশে ফেলে দেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ক্বারক্বারাতুল কুদর(قَرْقَرَةُ الْكُدْر) পর্যন্ত ধাওয়া করে ফিরবার পথে তাদের ফেলে যাওয়া পাথেয় ও ছাতুর বস্তাগুলো নিয়ে আসেন। ছাতুকে আরবীতে ‘সাভীক্ব’ (السَّوِيق) বলা হয়। সেজন্য এই অভিযানটি ‘গাযওয়া সাভীক্ব’ বা ছাতুর যুদ্ধ নামে পরিচিত হয়েছে। এ সময় মদীনার দায়িত্বে ছিলেন আবু লুবাবাহ বাশীর বিন মুনযির (রাঃ)।[6]

গাযওয়া যী আমর

৩য় হিজরীর ছফর মাস। উদ্দেশ্য নাজদের বনু গাত্বফান গোত্র। তাদের বনু ছা‘লাবাহ ও বনু মুহারিব গোত্রদ্বয় বিরাট এক বাহিনী নিয়ে মদীনা আক্রমন করবে মর্মে খবর পেয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সাড়ে চারশ’ সৈন্য নিয়ে মুহাররম মাসেই তাদের মুকাবিলায় বের হন। পথিমধ্যে বনু ছা‘লাবাহ গোত্রের জাববার (جَبَّار) নামক জনৈক ব্যক্তি গ্রেফতার হয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে ইসলামের দাওয়াত দিলে সে মুসলমান হয়ে যায় এবং মুসলিম বাহিনীর পথপ্রদর্শক হিসাবে কাজ করে। শত্রুপক্ষ পালিয়ে যায়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদের ঘাঁটি এলাকায় পৌঁছে যী আমর(ذي أمر) নামক ঝর্ণাধারার পাশে অবস্থান গ্রহণ করেন। তিনি সেখানে পুরা ছফর মাস বা তার কাছাকাছি সময় অতিবাহিত করেন। যাতে মুসলিম শক্তির প্রভাব ও প্রতিপত্তি শত্রুদের অন্তরে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। এ সময় মদীনার দায়িত্বে ছিলেন হযরত ওছমান বিন ‘আফফান (রাঃ)।[7]

সারিইয়া মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহ

(কা‘ব বিন আশরাফের হত্যাকান্ড); হিজরতের ২৫ মাস পরে ৩য় হিজরীর ১৪ই রবীউল আউয়াল) :

মদীনার নামকরা ইহূদী পুঁজিপতি ও কবি কা‘ব বিন আশরাফ সর্বদা মুসলমানদের বিরুদ্ধে ইহূদীদেরকে যুদ্ধে প্ররোচনা দিত। তার পিতা ছিল বনু ত্বাঈ গোত্রের এবং মা ছিল মদীনার ইহূদী বনু নাযীর গোত্রের। বদর যুদ্ধে পরাজয়ের পর সে মক্কায় গিয়ে কুরায়েশ নেতাদের পুনরায় যুদ্ধে উস্কে দেয়। তারপর মদীনায় ফিরে এসে ছাহাবায়ে কেরামের স্ত্রীদের নামে কুৎসা গেয়ে কবিতা বলতে থাকে। তাতে অতিষ্ঠ হয়ে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) তাকে হত্যার নির্দেশ দেন। সেমতে আউস গোত্রের মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহর নেতৃত্বে পাঁচজনের একটি দল ১৪ই রবীউল আউয়াল চাঁদনী রাতে তার বাড়ীতে গিয়ে তাকে হত্যা করে।[8] এই ঘটনার পর ইহূদীরা সম্পূর্ণরূপে হিম্মত হারিয়ে ফেলে এবং রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে সন্ধিচুক্তি করে (আবুদাঊদ হা/৩০০০)। এর ফলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আভ্যন্তরীণ গোলযোগের আশংকা হ’তে মুক্ত হন এবং বহিরাক্রমণ মুকাবিলার দিকে পূর্ণ মনোযোগ দেওয়ার সুযোগ পান। বিস্তারিত বিবরণ নিম্নরূপ।-

কা‘ব বিন আশরাফ ছিল একজন খ্যাতনামা ইহূদী পুঁজিপতি, কবি ও চরম মুসলিম বিদ্বেষী। তার দুর্গটি ছিল মদীনার পূর্ব-দক্ষিণে দু’মাইল দূরে বনু নাযীর গোত্রের পশ্চাদভূমিতে। বদর যুদ্ধে কুরায়েশ নেতাদের চরম পরাজয়ে সে রাগে-দুঃখে ফেটে পড়ে। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) ও মুসলমানদের ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করে ও কুরায়েশ নেতাদের প্রশংসা করে সে কবিতা বলতে থাকে। কিন্তু তাতে তার ক্ষোভের আগুন প্রশমিত না হওয়ায় সে মক্কায় চলে যায় এবং কুরায়েশ নেতাদের কবিতার মাধ্যমে উত্তেজিত করতে থাকে। সে যুগে কবিতাই ছিল সাহিত্যের বাহন এবং কারু প্রশংসা বা ব্যঙ্গ করার প্রধান হাতিয়ার। কোন বংশে কোন কবি জন্মগ্রহণ করলে সে বংশ তাকে নিয়ে গর্ব করত এবং তাকে সৌভাগ্যের প্রতীক মনে করা হ’ত। আবু সুফিয়ান এবং মক্কার নেতারা তাকে জিজ্ঞেস করলেন, أَدِينُنَا أَحَبُّ إِلَى اللهِ أَمْ دِينُ مُحَمَّدٍ وَأَصْحَابِهِ وأَيُّ الْفَرِيقَينِ أَهْدَى سَبيلاً؟ ‘আমাদের দ্বীন আল্লাহর নিকটে অধিক প্রিয় না মুহাম্মাদ ও তার সাথীদের দ্বীন? আর এ দু’টি দলের মধ্যে কোন দলটি অধিক সুপথপ্রাপ্ত? সে বলল, أَنْتُمْ أَهْدَى مِنْهُمْ سَبِيلاً ‘তোমরাই তাদের চাইতে অধিক সুপথপ্রাপ্ত’।[9]

উক্ত প্রসঙ্গে সূরা নিসা ৫১-৫২ আয়াত দু’টি নাযিল হয়। যেখানে বলা হয়,أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِينَ أُوتُوا نَصِيبًا مِنَ الْكِتَابِ يُؤْمِنُونَ بِالْجِبْتِ وَالطَّاغُوتِ وَيَقُولُونَ لِلَّذِينَ كَفَرُوا هَؤُلاَءِ أَهْدَى مِنَ الَّذِينَ آمَنُوا سَبِيلاً- أُولَئِكَ الَّذِينَ لَعَنَهُمُ اللهُ وَمَنْ يَلْعَنِ اللهُ فَلَنْ تَجِدَ لَهُ نَصِيرًا ‘তুমি কি তাদের (ইহূদীদের) দেখোনি, যাদেরকে ইলাহী কিতাবের কিছু অংশ দেওয়া হয়েছে। যারা প্রতিমা ও শয়তানের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে এবং (মক্কার) কাফিরদের বলে যে, তারাই মুমিনদের চাইতে অধিক সুপথপ্রাপ্ত’। ‘এদের প্রতি আল্লাহ অভিসম্পাৎ করেছেন। আর আল্লাহ যাকে অভিসম্পাৎ করেন, তুমি তার জন্য কোন সাহায্যকারী পাবে না’ (ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা নিসা ৫১-৫২ আয়াত)।

এরপর সে মদীনায় ফিরে এসে একই রূপ আচরণ করতে থাকে। এমনকি ছাহাবায়ে কেরামের স্ত্রীদের নামে কুৎসা রটনা করতে থাকে ও নানাবিধ ব্যঙ্গাত্মক কবিতা বলতে থাকে। এতে অতিষ্ঠ হয়ে একদিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, مَنْ لِكَعْبِ بْنِ الأَشْرَفِ فَإِنَّهُ قَدْ آذَى اللهَ وَرَسُولَهُ‘কা‘ব বিন আশরাফকে হত্যা করার জন্য কে আছ? কেননা সে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে কষ্ট দিয়েছে’। তখন আউস গোত্রের মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহ বললেন, يَا رَسُولَ اللهِ أَتُحِبُّ أَنْ أَقْتُلَهُ ‘হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কি চান আমি তাকে হত্যা করি? রাসূল (ছাঃ) বললেন, হ্যাঁ। তখন মুহাম্মাদ বললেন, আমাকে কিছু উল্টা-পাল্টা কথা বলার অনুমতি দিন’। রাসূল (ছাঃ) তাকে অনুমতি দিলেন। অতঃপর তার নেতৃত্বে ‘আববাদ বিন বিশর ও কা‘ব বিন আশরাফের দুধভাই আবু নায়েলাহ সহ পাঁচ জন প্রস্ত্তত হয়ে গেলেন। সে মোতাবেক প্রথমে মুহাম্মাদ ও পরে আবু নায়েলাহ কা‘বের কাছে গিয়ে রাসূল (ছাঃ)-এর বিরুদ্ধে অনেক কথার মধ্যে একথাও বলেন যে, এ ব্যক্তি আমাদের কাছে ছাদাক্বা চাচ্ছে। এ লোক আমাদেরকে দারুণ কষ্টের মধ্যে ফেলেছে। অতএব আমরা আমাদের পরিবার-পরিজনের কষ্ট নিবারণের জন্য আপনার নিকটে কিছু খাদ্য-শস্য কামনা করছি। কা‘ব কিছু বন্ধকের বিনিময়ে দিতে রাযী হ’ল। প্রথমে নারী বন্ধক, অতঃপর পুত্র বন্ধক, অবশেষে অস্ত্র বন্ধকের ব্যাপারে নিষ্পত্তি হ’ল। আবু নায়েলাহ বলল, আমারই মত কষ্টে আমার কয়েকজন বন্ধু আছে। আমি তাদেরকেও আপনার কাছে নিয়ে আসব। আপনি তাদেরও কিছু খাদ্য-শস্য দিয়ে অনুগ্রহ করুন। অতঃপর পূর্ব সিদ্ধান্ত মতে (৩য় হিজরীর রবীউল আউয়াল মাসের ১৪ তারিখের) চাঁদনী রাতে মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহ তার দলবল নিয়ে কা‘বের বাড়ীতে গেলেন (বুখারী হা/৪০৩৭, জাবের (রাঃ) হ’তে)। কা‘ব বিন মালেক (রাঃ)-এর বর্ণনায় এসেছে, রাসূল (ছাঃ) আউস নেতা সা‘দ বিন মু‘আযকে তার বিরুদ্ধে একদল লোক পাঠাতে বললেন, যেন তারা তাকে হত্যা করে। তখন তিনি মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহকে পাঠালেন (আবুদাউদ হা/৩০০০)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদেরকে বাকী‘ গারক্বাদ পর্যন্ত এগিয়ে দেন এবং বলেন,انْطَلِقُوا عَلَى اسْمِ اللهِ وَقَالَ: اللهُمَّ أَعِنْهُمْ ‘তোমরা আল্লাহর নামে অগ্রসর হও। হে আল্লাহ তুমি এদের সাহায্য কর’ (আহমাদ হা/২৩৯১)।

দুধভাই আবু নায়েলাহ কা‘বের দুর্গদ্বারে দাঁড়িয়ে ডাক দিল। এ সময় কা‘বের নববধূ তাকে বাধা দিয়ে বলল, أَسْمَعُ صَوْتًا كَأَنَّهُ يَقْطُرُ مِنْهُ الدَّمُ ‘আমি এমন এক ডাক শুনলাম, মনে হ’ল তা থেকে রক্তের ফোঁটা ঝরছে’। কিন্তু কা‘ব কোনরূপ সন্দেহ না করে বলল, এরা তো আমার ভাই। তাছাড়াإِنَّ الْكَرِيمَ لَوْ دُعِىَ إِلَى طَعْنَةٍ بِلَيْلٍ لأَجَابَ ‘সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি রাত্রিতে যদি তরবারির দিকেও আহুত হন, তথাপি তিনি তাতে সাড়া দিয়ে থাকেন’।

মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহ অপর দু’জনকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন এবং তাদেরকে বলেছিলেন, যখন সে আসবে তখন আমি তার মাথার চুল ধরে শুঁকতে থাকব। যখন তোমরা আমাকে দেখবে যে, খুব শক্তভাবে আমি তার মাথা অাঁকড়িয়ে ধরেছি, তখন তোমরা তরবারি দিয়ে তাকে আঘাত করবে।

অতঃপর কা‘ব চাদর গায়ে দিয়ে নীচে নেমে আসলে তার শরীর থেকে সুঘ্রাণ বের হচ্ছিল। তখন মুহাম্মাদ বললেন, আজকের মতো এত উত্তম সুগন্ধি আমি আর কখনো দেখিনি। উত্তরে কা‘ব বলল, আমার নিকট আরবের সম্ভ্রান্ত ও মর্যাদাসম্পন্ন সুগন্ধি ব্যবহারকারী মহিলা আছে। তখন মুহাম্মাদ বললেন, আমাকে আপনার মাথা শুঁকতে অনুমতি দিবেন কি? সে বলল, হ্যাঁ। এরপর তিনি তার মাথা শুঁকলেন এবং এরপর তার সাথীদেরকে শুঁকালেন। তারপর তিনি আবার বললেন, ‘আমাকে আর একবার শুঁকবার অনুমতি দিবেন কি? সে বলল, হ্যাঁ। এরপর তিনি তাকে কাবু করে ফেলে সাথীদেরকে বললেন, তোমরা একে হত্যা করো। তারা তাকে হত্যা করলেন এবং রাসূল (ছাঃ)-কে খবর দিলেন’।[10] অন্য বর্ণনায় এসেছে, এ সময় রাসূল (ছাঃ) তাদেরকে দো‘আ করে বলেন, أفلَحَتِ الوجوهُ ‘তোমাদের চেহারাগুলি সফল থাকুক’ (হাকেম হা/৫৮৪০, সনদ ছহীহ)।

কা‘ব বিন আশরাফকে গোপনে হত্যা করায় প্রমাণিত হয় যে, ইসলামের স্বার্থে এরূপ দুশমনকে গুপ্তহত্যা করা চলে। দ্বিতীয় আরেকটি বিষয় প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ছাঃ)-এর বিরুদ্ধে কুৎসা রটনাকারী ও অপপ্রচারকারীর শাস্তি মৃত্যুদন্ড (তাওবাহ ৯/৬৫-৬৬)। মুসলিম মহিলাদের ইয্যত নিয়ে কুৎসা রটনাকারীদের জন্য একই শাস্তি নির্ধারিত। এই ধরনের দুশমন নির্মূল করার জন্য প্রয়োজন বোধে যেকোন কৌশলের আশ্রয় নেয়া যাবে। তবে এর জন্য সর্বোচ্চ সরকারী নির্দেশ আবশ্যিক হবে। এককভাবে কোন ব্যক্তি বা সংগঠনের জন্য এরূপ করা সিদ্ধ নয়। কেননা এখানে রাসূল (ছাঃ) ছিলেন সর্বোচ্চ নির্দেশদাতা।

[1]. ওয়াক্বেদী, মাগাযী ১/২-৩; ইবনু সা‘দ ২/২০-২১; আল-ইছাবাহ, উমায়ের ক্রমিক ৬০৪৭; আল-ইস্তী‘আব; মানছূরপুরী এটা ধরেছেন। মুবারকপুরী ধরেননি।
[2]. ওয়াক্বেদী, মাগাযী ১/৩; ইবনু সা‘দ ২/২১; আল-ইছাবাহ, সালেম ক্রমিক ৩০৪৮; রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ২/১৮৭। মুবারকপুরী এটা ধরেননি।
ইবনু হিশাম এখানে সারিইয়া সালেম বিন ওমায়েরকে আগে এনেছেন। তিনি বলেন, হারেছ বিন সুওয়াইদ বিন ছামেতকে হত্যা করার পর আবু ‘আফাক-এর মুনাফেকী স্পষ্ট হয়ে যায় এবং সে মুসলমানদের বিরুদ্ধে কুৎসা গেয়ে কবিতা বলে। তখন রাসূল (ছাঃ) তাকে হত্যার আদেশ দেন (ইবনু হিশাম ২/৬৩৫-৩৬)। অতঃপর আবু ‘আফাক-এর হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে ‘আছমা বিনতে মারওয়ান আল-খিত্বমিয়াহ মুনাফিক হয়ে যান এবং ইসলাম ও ইসলামের নবী (ছাঃ)-এর বিরুদ্ধে কুৎসা গেয়ে কবিতা বলেন। তখন রাসূল (ছাঃ)-এর নির্দেশে ওমায়ের বিন ‘আদী তাকে হত্যা করেন (ইবনু হিশাম ২/৬৩৬-৩৭)।
[3]. ইবনু হিশাম ২/৪৩; আল-বিদায়াহ ৩/৩৪৪; যাদুল মা‘আদ ৩/১৬৯; আর-রাহীক্ব ২৩৪ পৃঃ।
[4]. রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ২/১৮৮। এটি অন্য কেউ ধরেননি।
[5]. যাদুল মা‘আদ ৩/১৭০; ইবনু হিশাম ২/৪৭-৪৯; ইবনু সা‘দ ২/২১-২২; আর-রাহীক্ব ২৩৬ পৃঃ; রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ১/১৩০, ২/১৮৭।

(১) প্রসিদ্ধ আছে যে, বনু ক্বায়নুক্বার শাস বিন ক্বায়েস (شَاسُ بْنُ قَيْسٍ) নামক জনৈক বৃদ্ধ ইহূদী মুসলমানদের প্রতি চরম বিদ্বেষ পোষণ করত। একদিন সে ছাহাবায়ে কেরামের একটি মজলিসের নিকট দিয়ে যাচ্ছিল, যেখানে আউস ও খাযরাজ উভয় গোত্রের ছাহাবী ছিলেন। দুই গোত্রের লোকদের মধ্যকার এই প্রীতিপূর্ণ বৈঠক তার নিকটে অসহ্য ছিল। কেননা উভয় গোত্রের মধ্যে যুদ্ধাবস্থা টিকিয়ে রেখে উভয় গোত্রের নিকটে অস্ত্র বিক্রি ও সূদ ভিত্তিক ঋণদান ব্যবসা চালিয়ে আসছিল তারা দীর্ঘদিন ধরে। ইসলাম আসার পর এসব বন্ধ হয়েছে এবং তারা পুনরায় ভাই ভাই হয়ে গেছে। যাতে দারুণ আর্থিক ক্ষতির মধ্যে পড়ে যায় মদীনার কুসিদজীবী ইহূদী গোত্রগুলি।

ঐ বৃদ্ধ একজন যুবক ইহূদীকে উক্ত মজলিসে পাঠাল এই নির্দেশ দিয়ে যে, সে যেন সেখানে গিয়ে উভয় গোত্রের মধ্যে পাঁচ বছর পূর্বে সংঘটিত বু‘আছ (بعاث) যুদ্ধ ও তার পূর্ববর্তী অবস্থা আলোচনা করে এবং ঐ সময়ে উভয় পক্ষ হ’তে যেসব বিদ্বেষমূলক ও আক্রমণাত্মক কবিতা সমূহ পঠিত হ’ত, তা থেকে কিছু কিছু পাঠ করে শুনিয়ে দেয়। যুবকটি যথারীতি তাই-ই করল এবং উভয় গোত্রের মুসলমানদের মধ্যে লড়াইয়ের অবস্থা তৈরী হয়ে গেল। এমনকি উভয় পক্ষ ‘হার্রাহ’ (الْحَرَّةُ) নামক স্থানের দিকে ‘অস্ত্র অস্ত্র’ (السَّلاح السَّلاح) বলতে বলতে বেরিয়ে গেল।

এ খবর পেয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কয়েকজন মুহাজির ছাহাবীকে সাথে নিয়ে দ্রুত ঘটনাস্থলে উপস্থিত হ’লেন এবং সবাইকে শান্ত করলেন। তখন সবাই বুঝলেন যে, এটা শয়তানী প্ররোচনা (نَزْغَةٌ مِنْ الشَّيْطَانِ) ব্যতীত কিছুই নয়। তারা তওবা করলেন ও পরস্পরে বুক মিলিয়ে ক্রন্দন করতে লাগলেন। এভাবে শাস বিন ক্বায়েস ইহূদী শয়তানের জ্বালানো আগুন দ্রুত নিভে গেল। উক্ত ঘটনা উপলক্ষ্যে আলে ইমরান ৯৮-১০০ আয়াতগুলি নাযিল হয়’ (ইবনু হিশাম ১/৫৫৫-৫৫৭)। ঘটনাটি ইবনু ইসহাক বিনা সনদে উল্লেখ করেছেন। ফলে এর সনদ ‘মু‘যাল’ বা যঈফ (মা শা-‘আ ১৩৫-৩৬ পৃঃ)।

(২) প্রসিদ্ধ আছে যে, বদর যুদ্ধের পর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একদিন বনু ক্বায়নুক্বার বাজারে উপস্থিত হলেন ও তাদের ডেকে নানাভাবে উপদেশ দিলেন। অবশেষে বললেন, يَا مَعْشَرَ يَهُودَ أَسْلِمُوا قَبْلَ أَنْ يُصِيبَكُمْ مِثْلُ مَا أَصَابَ قُرَيْشًا- ‘হে ইহূদী সম্প্রদায়! তোমরা অনুগত হও কুরায়েশদের ন্যায় অবস্থা প্রাপ্ত হওয়ার আগেই’। এতে তারা উত্তেজিত হয়ে বলল, হে মুহাম্মাদ! তুমি কিছু কুরায়েশকে হত্যা করে ধোঁকায় পড়ো না। ওরা আনাড়ী। ওরা যুদ্ধবিদ্যার কিছুই জানে না। যদি তুমি আমাদের সঙ্গে যুদ্ধ কর, তবে তুমি আমাদের মত কাউকে পাবে না’। উক্ত ঘটনা উপলক্ষ্যে আলে ইমরান ১২ আয়াতটি নাযিল হয়’ (ইবনু হিশাম ১/৫৫২; আবুদাঊদ হা/৩০০১ সনদ যঈফ; মা শা-‘আ ১৩৪ পৃঃ)।

(৩) আরও প্রসিদ্ধ আছে যে, একদিন জনৈকা মুসলিম মহিলা বনু ক্বায়নুক্বার বাজারে দুধ বিক্রি করে বিশেষ কোন প্রয়োজনে এক ইহূদী স্বর্ণকারের দোকানে গিয়ে বসেন। তখন কতগুলো দুষ্টমতি ইহূদী তার মুখের অবগুণ্ঠন খুলতে চায়। কিন্তু তিনি অস্বীকার করেন। তখন ঐ স্বর্ণকার ঐ মহিলার অগোচরে তার কাপড়ের এক প্রান্ত তার পিঠের দিকে গিরা দেয়। কাজ শেষে মহিলা উঠে দাঁড়াতেই কাপড়ে টান পড়ে বিবস্ত্র হয়ে পড়েন। দুর্বৃত্তরা তখন অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। এতে মহিলাটি লজ্জায় ও ক্ষোভে চিৎকার করে ওঠেন। এমতাবস্থায় একজন মুসলমান ঐ স্বর্ণকারের উপরে লাফিয়ে পড়ে তাকে হত্যা করে ফেলেন। প্রত্যুত্তরে এক ইহূদী ঝাঁপিয়ে পড়ে মুসলমানটিকে হত্যা করে। ফলে সংঘাত বেধে যায়’ (ইবনু হিশাম ২/৪৮)। ঘটনাটির সনদ ‘যঈফ’। প্রকৃত প্রস্তাবে বনু ক্বাইনুক্বার বহিষ্কারের প্রত্যক্ষ কোন কারণ পাওয়া যায় না। বরং তাদের লাগাতার ষড়যন্ত্র থেকে নিষ্কৃতি পাওয়াই ছিল এর মূল কারণ’ (মা শা-‘আ ১৩৩-৩৪ পৃঃ)।

[6]. ইবনু সা‘দ ২/২২-২৩; ইবনু হিশাম ২/৪৪-৪৫; যাদুল মা‘আদ ৩/১৬৯-৭০; আর-রাহীক্ব ২৪০ পৃঃ।
[7]. ইবনু হিশাম ২/৪৬; আর-রাহীক্ব ২৪১ পৃঃ।
[8]. ইবনু সা‘দ ২/২৪; ইবনু হিশাম ২/৫১; বুখারী হা/৪০৩৭ ‘কা‘ব বিন আশরাফ হত্যাকান্ড’ অনুচ্ছেদ।
[9]. ইবনু কাছীর, সীরাহ নববিইয়াহ (বৈরূত : দারুল মা‘রিফাহ ১৩৯৫/১৯৭৬ খৃ.) ৩/১২।
[10]. বুখারী হা/৪০৩৭, ‘যুদ্ধ-বিগ্রহ’ অধ্যায় ১৫ অনুচ্ছেদ; আহমাদ হা/২৩৯১; আবুদাঊদ হা/২৭৬৮; ইরওয়া হা/১১৯১ সনদ ছহীহ; ইবনু হিশাম ২/৫১-৫৭; যাদুল মা‘আদ ৩/১৭১; আর-রাহীক্ব ২৪২-৪৫ পৃঃ।

প্রসিদ্ধ আছে যে, কাজ সেরে তার মাথা নিয়ে বাক্বী‘ গারক্বাদে ফিরে এসে তারা জোরে তাকবীর ধ্বনি করেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)ও তাকবীর ধ্বনি করে ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন এবং খুশী হয়ে বলেন, أفلَحَتِ الوجوهُ ‘তোমাদের চেহারাগুলি সফল থাকুক’। তারাও বললেন, وَوَجْهُكَ يا رسولَ الله ‘এবং আপনার চেহারাও হে আল্লাহর রাসূল’! এ সময় ঐ দুষ্টের কাটা মাথাটা তার সামনে রাখা হলে তিনি ‘আলহামদুলিল্লাহ’ পাঠ করেন (আর-রাহীক্ব ২৪৪-৪৫ পৃঃ)। ঘটনাটি ওয়াক্বেদী ও ইবনু সা‘দ স্ব স্ব গ্রন্থে বিনা সনদে উল্লেখ করেছেন। অতএব তা গ্রহণযোগ্য নয়।

মদীনা সনদ

মদীনার সংখ্যাগরিষ্ঠ আউস ও খাযরাজ নেতাগণ আগেই ইসলাম কবুল করায় এবং আউস ও খাযরাজ দুই প্রধান গোত্রের আমন্ত্রণ থাকায় তাদের সাথে সন্ধিচুক্তির কোন প্রশ্নই ছিল না। খাযরাজ গোত্রের আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই নেতৃত্বের অভিলাষী থাকলেও গোত্রের সংখ্যাগুরু মুসলমানদের বিরুদ্ধে গিয়ে প্রকাশ্যে কিছু করার ক্ষমতা তার ছিল না। বদর যুদ্ধের পর সে এবং তার অনুসারীরা প্রকাশ্যে ইসলাম কবুল করে। তবে সেসময় মদীনার সংখ্যালঘু ইহূদী সম্প্রদায় মুসলমানদের নবতর জীবনধারার প্রতি এবং বিশেষভাবে রাসূল (ছাঃ)-এর প্রতি ঈর্ষান্বিত থাকলেও অতি ধূর্ত হওয়ার কারণে প্রকাশ্য বিরোধিতায় লিপ্ত হয়নি। সমস্যা ছিল কেবল কুরায়েশদের নিয়ে। তারা পত্র প্রেরণ ও অন্যান্য অপতৎপরতার মাধ্যমে মুনাফিক ও ইহূদীদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে রাসূল (ছাঃ) ও তার সাথীদেরকে মদীনা থেকে বহিষ্কারের সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে থাকে। একাজে তারা যাতে সফল না হয় সেজন্য রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সর্বপ্রথম মদীনার পার্শ্ববর্তী এলাকার লোকদের সাথে সহযোগিতা চুক্তি সম্পাদনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন।

সেকারণ তিনি পার্শ্ববর্তী নিকট ও দূরের এলাকাসমূহের বিভিন্ন গোত্রের সাথে শান্তিচুক্তি সম্পাদন করেন। যেমন, (১) ২য় হিজরীর ছফর মাসে মদীনা হ’তে ২৯ মাইল দূরবর্তী ওয়াদ্দান (ودَّان) এলাকায় এক অভিযানে গেলে রাসূল (ছাঃ) সেখানকার বনু যামরাহ(بَنُو ضَمْرَة) গোত্রের সঙ্গে সন্ধিচুক্তি করেন। (২) অতঃপর ২য় হিজরীর রবীউল আউয়াল মাসে বুওয়াত্ব (بُواط) এলাকায় এক অভিযানে গিয়ে রাসূল (ছাঃ) তাদের সাথেও সন্ধিচুক্তি করেন। (৩) একই বছরের জুমাদাল আখেরাহ মাসে ইয়াম্বু‘ ও মদীনার মধ্যবর্তী যুল-‘উশায়রা(ذُو الْعُشَيْرَة) এলাকায় গিয়ে তিনি বনু মুদলিজ(بَنُو مُدْلِج) গোত্রের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন। এভাবে রাসূল (ছাঃ) চেয়েছিলেন, যেন যুদ্ধাশংকা দূর হয় এবং সর্বত্র শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু এসময় মদীনায় ইহূদী চক্রান্ত চূড়ান্ত রূপ ধারণ করে। যার নেতৃত্বে ছিল তাদের ধনশালী নেতা ও ব্যঙ্গ কবি কা‘ব বিন আশরাফ। রাসূল (ছাঃ), ছাহাবায়ে কেরাম ও তাঁদের স্ত্রীদের নিয়ে কটূক্তি করাই ছিল তার বদস্বভাব।

এ বিষয়ে ছহীহ সনদে কা‘ব বিন মালেক আনছারী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, ইহূদী নেতা কা‘ব বিন আশরাফ রাসূল (ছাঃ)-এর বিরুদ্ধে ব্যঙ্গ কবিতা বলত এবং কাফের কুরায়েশদেরকে তাঁর বিরুদ্ধে উস্কানী দিত। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) যখন মদীনায় আসেন, তখন এখানে মিশ্রিত বাসিন্দারা ছিল। তাদের মধ্যে মুসলমানেরা ছিল। মুশরিকরা ছিল, যারা মূর্তিপূজা করত। ইহূদীরা ছিল, যারা রাসূল (ছাঃ) ও তাঁর ছাহাবীদের কষ্ট দিত। এমতাবস্থায় আল্লাহ স্বীয় নবীকে ছবর ও মার্জনার আদেশ দিয়ে আয়াত নাযিল করেন,لَتُبْلَوُنَّ فِي أَمْوَالِكُمْ وَأَنْفُسِكُمْ وَلَتَسْمَعُنَّ مِنَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ مِنْ قَبْلِكُمْ وَمِنَ الَّذِينَ أَشْرَكُوا أَذًى كَثِيرًا وَإِنْ تَصْبِرُوا وَتَتَّقُوا فَإِنَّ ذَلِكَ مِنْ عَزْمِ الْأُمُورِ ‘অবশ্যই তোমরা পরীক্ষায় পতিত হবে তোমাদের ধন-সম্পদে ও তোমাদের নিজেদের জীবনে। আর তোমরা অবশ্যই শুনবে তোমাদের পূর্ববর্তী আহলে কিতাব ও মুশরিকদের কাছ থেকে অনেক কষ্টদায়ক কথা। যদি তোমরা তাতে ধৈর্য ধারণ কর এবং আল্লাহভীরুতা অবলম্বন কর, তবে সেটাই হবে দৃঢ় সংকল্পের কাজ’ (আলে ইমরান ৩/১৮৬)। অতঃপর যখন কা‘ব বিন আশরাফ রাসূল (ছাঃ)-কে কষ্টদানে বিরত থাকতে অস্বীকার করল, তখন রাসূল (ছাঃ) আউস নেতা সা‘দ বিন মু‘আযকে তার বিরুদ্ধে একদল লোক পাঠাতে বললেন, যেন তারা তাকে হত্যা করে। তখন তিনি মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহকে পাঠালেন। অতঃপর তিনি (রাবী) তার হত্যার কাহিনী বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, এ ঘটনায় ইহূদী ও মুশরিকরা ভীত হয়ে পড়ে। ফলে পরদিন তারা রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে হাযির হয়ে বলল, আমাদের নেতাকে রাতের বেলায় তার বাড়ীতে গিয়ে হত্যা করা হয়েছে। তখন রাসূল (ছাঃ) তাদেরকে তার ব্যঙ্গ কবিতার কথা বললেন। অতঃপর তিনি তাদের বললেন তাঁর ও তাদের মধ্যে একটা লিখিত চুক্তি সম্পাদন করতে। যাতে তারা যেসব গালি ও কষ্ট দেয়, তা থেকে বিরত হয়। অতঃপর নবী (ছাঃ) তাঁর ও তাদের মধ্যে এবং মুসলমানদের মধ্যে একটা চুক্তিনামা (صَحِيفَة) লিখে দিলেন’।[1]

অত্র হাদীছ দৃষ্টে প্রতীয়মান হয় যে, চুক্তি লিখনের এই বিষয়টি হিজরতের পরেই নয়, বরং ৩য় হিজরীর রবীউল আউয়াল মাসে কা‘ব বিন আশরাফের হত্যাকান্ডের পরে হয়েছিল। যা অধিকাংশ জীবনীকার ও ইতিহাসবিদগণের বক্তব্যের বিরোধী। যেমন মুবারকপুরী বলেন, ‘মদীনায় হিজরতের পরপরই নবগঠিত ইসলামী সমাজের বিধি-বিধান প্রতিষ্ঠার জন্য’ রাসূল (ছাঃ) মদীনার সনদ রচনা করেন (আর-রাহীক্ব ১৯২ পৃঃ)। অথচ বিষয়টি ছহীহ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত নয়। নিঃসন্দেহে ঐতিহাসিক বর্ণনার চাইতে ছহীহ হাদীছের গুরুত্ব সর্বাধিক।

জীবনীকারগণ উপরোক্ত ছহীহ হাদীছের জওয়াবে বলেন, এটি ‘১ম চুক্তির নবায়ন’ (تَجْدِيْدٌ لِلْمَوْثِقِ الْأَوَّلِ) হ’তে পারে।[2] চুক্তিটি বিস্তারিতভাবে এসেছে ইবনু ইসহাকের বর্ণনায় সনদবিহীনভাবে (ইবনু হিশাম ১/৫০১-০৪ পৃঃ)। শায়খ আলবানী বলেন, এভাবে ইবনু ইসহাক সনদ ছাড়াই এটি বর্ণনা করেছেন। অতএব বর্ণনাটি মু‘যাল (যঈফ)। ইবনুল ক্বাইয়িম (৬৯১-৭৫১ হি.) তাঁর বিখ্যাত জীবনীগ্রন্থ যাদুল মা‘আদে কেবল এটুকু লিখেছেন, وَوَادَعَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَنْ بِالْمَدِينَةِ مِنَ الْيَهُودِ وَكَتَبَ بَيْنَهُ وَبَيْنَهُمْ كِتَابًا ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মদীনায় অবস্থানকারী ইহূদীদের সাথে চুক্তি করেন এবং তিনি তাঁর ও তাদের মধ্যে একটি দলীল লিপিবদ্ধ করেন’ (যাদুল মা‘আদ ৩/৫৮ পৃঃ)। এতটুকু ব্যতীত আগে-পিছে কোন বক্তব্য বা মন্তব্য নেই। ইবনু কাছীর (৭০১-৭৪ হি.) কোনরূপ মন্তব্য ছাড়াই ইবনু ইসহাকের বর্ণনাটি উদ্ধৃত করেছেন (আল-বিদায়াহ ৩/২২৪-২৬)। যেটি তাঁর স্বভাব বিরোধী। এতদ্ব্যতীত ইমাম আহমাদ (হা/২৪৪৩), ইবনু আবী খায়ছামাহ, আবু ওবায়েদ ক্বাসেম বিন সাল্লাম, বায়হাক্বী, ইবনু আবী হাতেম, ইবনু হাযম প্রমুখ যারাই উক্ত চুক্তি সংক্ষেপে বা বিস্তৃতভাবে বর্ণনা করেছেন, কোনটাই বিশুদ্ধ সূত্রে প্রমাণিত নয়। সম্ভবতঃ একারণেই বিখ্যাত মুহাদ্দিছ ও ঐতিহাসিক ইমাম যাহাবী (৬৭৩-৭৪৮ হি.) তাঁর ‘তারীখুল ইসলাম’ গ্রন্থে এবং ইমাম নববী (৬৩১-৬৭৬ হি.) স্বীয় ‘তাহযীবুল আসমা ওয়াল লুগাত’ গ্রন্থে বিভিন্ন হিজরী সনে ‘প্রসিদ্ধ ঘটনাবলী’র তালিকায় এটি আনেননি। এ চুক্তিনামা সঠিক হ’লে তিনি তা ১ম হিজরী সনের ঘটনাবলীর মধ্যে অবশ্যই আনতেন। অতএব ঘটনাটি প্রসিদ্ধ হ’লেও বিশুদ্ধ নয় (মা শা-‘আ ৯১-৯৮ পৃঃ)।

ছহীহ হাদীছের বর্ণনা অনুযায়ী কেবল এটুকুই পাওয়া যায় যে, ৩য় হিজরী সনে তিনি ইহূদীদের ও অন্যান্যদের মধ্যে একটা ‘চুক্তিনামা’ লিখে দিয়েছিলেন। সেটিই ‘মদীনার সনদ’ নামে খ্যাত। তবে সেখানে তখনকার সময়ে প্রয়োজনীয় সবকিছুই লেখা ছিল বলে ধরে নেওয়া যায়। তাতে কি লেখা ছিল, তা জানা যায় না।

মদীনার সনদের বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা শেষে ড. আকরাম যিয়া উমারী (জন্ম: ১৯৪২ খৃ.) বলেন, আমার নিকট অগ্রগণ্য এই যে, চুক্তিনামা ছিল দু’টি। প্রথমটি ছিল ইহূদীদের সাথে রাসূল (ছাঃ)-এর মদীনায় আগমনের পর এবং দ্বিতীয়টি ছিল মুহাজির ও আনছারদের মাঝে বদর যুদ্ধের পর’। কিন্তু ঐতিহাসিকগণ দু’টি চুক্তি একত্রিত করেছেন’ (সীরাহ ছহীহাহ ১/২৮১)।

আকরাম যিয়া উমারী যে উক্ত চুক্তিটিকে দুই সময়ে দুইভাগে ভাগ করেছেন, তার পিছনে কোন প্রমাণ নেই। কেননা তাঁর ও সকল জীবনীকারের এ বিষয়ে বর্ণনার ভিত্তি হ’ল ইবনু ইসহাক (৮৫-১৫১ হি.)-এর সনদবিহীন বর্ণনা। যা তিনি একবারেই এবং একসাথে বর্ণনা করেছেন (ইবনু হিশাম ১/৫০১-০৪)। আকরাম যিয়া উক্ত দীর্ঘ বর্ণনার বাক্যগুলিকে ৪৭টি ধারায় পরিণত করেছেন মাত্র (সীরাহ ছহীহাহ ১/২৮২-৮৫)।

তিনি হাদীছ ও ইতিহাসের বর্ণনাগুলির সমন্বয় করতে গিয়ে বলেছেন, উভয়ের মধ্যে হাদীছের বর্ণনা ইতিহাসের বর্ণনাসমূহের চাইতে অধিক শক্তিশালী। কিন্তু সেজন্য ইতিহাসের বর্ণনাসমূহকে নাকচ করার কোন কারণ নেই। কেননা কা‘ব বিন আশরাফের হত্যার পরে আগের চুক্তিটির তাকীদ কিংবা নবায়ন হিসাবে পুনরায় চুক্তি করায় কোন বাধা নেই’ (সীরাহ ছহীহাহ ১/২৭৮)।

বস্ত্ততঃ এগুলি স্রেফ ধারণা ও কল্পনা মাত্র। অতএব আমরা ছহীহ হাদীছের আলোকে কেবল এটুকুই বলব যে, ইহূদীরা তাদের নেতা কা‘ব বিন আশরাফের হত্যাকান্ডে ভীত হয়েই চুক্তিতে রাযী হয়েছিল এবং যা ছিল ৩য় হিজরীর রবীউল আউয়াল মাসের পরের ঘটনা। নিঃসন্দেহে সে চুক্তিটি ছিল পারস্পরিক সন্ধিচুক্তি। কিন্তু চুক্তিটি কি ছিল, তার ভাষা কি ছিল, সেখানে কয়টি ধারা ছিল, কিছুই সঠিকভাবে বলার উপায় নেই।[3]

পার্শ্ববর্তী নিকট ও দূরের গোত্রসমূহের সাথে সন্ধিচুক্তিসমূহ সম্পাদনের পর ইহূদীদের সাথে অত্র চুক্তি সম্পাদনের ফলে প্রকৃত প্রস্তাবে ইসলামী খিলাফতের ভিত্তি স্থাপিত হয় এবং মদীনা তার রাজধানীতে পরিণত হয়। অতএব বলা চলে যে, মদীনার সনদ ছিল একটি আন্তঃধর্মীয় ও আন্তঃসাম্প্রদায়িক চুক্তি, যার মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ স্বার্থে ও একক লক্ষ্যে একটি উম্মাহ বা জাতি গঠিত হয়। আধুনিক পরিভাষায় যাকে ‘রাষ্ট্র’ বলা হয়। এই সনদ ছিল আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার সর্বপ্রথম ভিত্তি স্বরূপ।

[1]. আবুদাঊদ হা/৩০০০, ‘খারাজ ও ফাই’ অধ্যায়, ‘কিভাবে মদীনা থেকে ইহূদীদের বহিষ্কার করা হয়’ অনুচ্ছেদ, হাদীছ ছহীহ।
[2]. সীরাহ ছহীহাহ ১/২৭৮ পৃঃ; মা শা-‘আ ৯৯ পৃঃ।
[3]. পাঠকদের জ্ঞাতার্থে আমরা মুহাম্মাদ বিন ইসহাক-এর ধারাবিহীন ও সনদবিহীনভাবে বর্ণিত চুক্তিনামাটি ড. আকরাম যিয়াকৃত ধারা অনুযায়ী বিন্যস্ত করে অনুবাদসহ উল্লেখ করলাম। বর্ণনার মধ্যে ভুলক্রমে একটি বাক্য দু’বার আনা সত্ত্বেও তাকে ২৪ ও ৩৮ দু’টি ধারা হিসাবে গণ্য করা হয়েছে (সীরাহ ছহীহাহ ১/২৮৪)। ধারা বিন্যাসে তিনি কিছু আগ-পিছ করেছেন। আমরা ইবনু হিশামের বর্ণনার অনুসরণ করেছি এবং একই বক্তব্য বারবার থাকায় আমরা মতনে ও অনুবাদে ৪-১১ ধারাগুলি সংক্ষিপ্ত করেছি।-

قَالَ ابْنُ إسْحَاقَ: وَكَتَبَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كِتَابًا بَيْنَ الْمُهَاجِرِينَ وَالْأَنْصَارِ، وَادَعَ فِيهِ يَهُودَ وَعَاهَدَهُمْ، وَأَقَرَّهُمْ عَلَى دِينِهِمْ وَأَمْوَالِهِمْ، وَشَرَطَ لَهُمْ، وَاشْتَرَطَ عَلَيْهِمْ:

(1) بِسْمِ اللهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ، هَذَا كِتَابٌ مِنْ مُحَمَّدٍ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، بَيْنَ الْمُؤْمِنِينَ وَالْمُسْلِمِينَ مِنْ قُرَيْشٍ وَيَثْرِبَ، وَمَنْ تَبِعَهُمْ، فَلَحِقَ بِهِمْ، وَجَاهَدَ مَعَهُمْ، (2) إنَّهُمْ أُمَّةٌ وَاحِدَةٌ مِنْ دُونِ النَّاسِ، (3) الْمُهَاجِرُونَ مِنْ قُرَيْشٍ عَلَى رِبْعَتِهِمْ يَتَعَاقَلُونَ، بَيْنَهُمْ، وَهُمْ يَفْدُونَ عَانِيَهُمْ بِالْمَعْرُوفِ وَالْقِسْطِ بَيْنَ الْمُؤْمِنِينَ، (4) وَبَنُو عَوْفٍ عَلَى رِبْعَتِهِمْ ... (5) وَبَنُو سَاعِدَةَ عَلَى رِبْعَتِهِمْ ... (6) وَبَنُو الْحَارِثِ عَلَى رِبْعَتِهِمْ ... (7) وَبَنُو جُشَمٍ عَلَى ... (8) وَبَنُو النَّجَّارِ عَلَى رِبْعَتِهِمْ ... (9) وَبَنُو عَمْرِو بْنِ عَوْفٍ عَلَى رِبْعَتِهِمْ ... (10) وَبَنُو النَّبِيتِ عَلَى ... (11) وَبَنُو الْأَوْسِ عَلَى رِبْعَتِهِمْ ... (12) وَإِنَّ الْمُؤْمِنِينَ لاَ يَتْرُكُونَ مُفْرَحًا بَيْنَهُمْ أَنْ يُعْطُوهُ بِالْمَعْرُوفِ فِي فِدَاءٍ أَوْ عَقْلٍ. وَأَنْ لاَ يُحَالِفَ مُؤْمِنٌ مَوْلَى مُؤْمِنٍ دُونَهُ، (13) وَإِنَّ الْمُؤْمِنِينَ الْمُتَّقِينَ عَلَى مَنْ بَغَى مِنْهُمْ، أَوْ ابْتَغَى دَسِيعَةَ ظُلْمٍ، أَوْ إثْمٍ، أَوْ عُدْوَانٍ، أَوْ فَسَادٍ بَيْنَ الْمُؤْمِنِينَ، وَإِنَّ أَيْدِيَهُمْ عَلَيْهِ جَمِيعًا، وَلَوْ كَانَ وَلَدَ أَحَدِهِمْ، (14) وَلاَ يَقْتُلُ مُؤْمِنٌ مُؤْمِنًا فِي كَافِرٍ، وَلاَ يَنْصُرُ كَافِرًا عَلَى مُؤْمِنٍ، (15) وَإِنَّ ذِمَّةَ اللهِ وَاحِدَةٌ، يُجِيرُ عَلَيْهِمْ أَدْنَاهُمْ، وَإِنَّ الْمُؤْمِنِينَ بَعْضُهُمْ مَوَالِي بَعْضٍ دُونَ النَّاسِ، (16) وَإِنَّهُ مَنْ تَبِعَنَا مِنْ يَهُودَ فَإِنَّ لَهُ النَّصْرَ وَالْأُسْوَةَ، غَيْرَ مَظْلُومِينَ وَلاَ مُتَنَاصَرِينَ عَلَيْهِمْ، (17) وَإِنَّ سِلْمَ الْمُؤْمِنِينَ وَاحِدَةٌ، لاَ يُسَالَمُ مُؤْمِنٌ دُونَ مُؤْمِنٍ فِي قِتَالٍ فِي سَبِيلِ اللهِ، إلاَّ عَلَى سَوَاءٍ وَعَدْلٍ بَيْنَهُمْ، (18) وَإِنَّ كُلَّ غَازِيَةٍ غَزَتْ مَعَنَا يُعْقِبُ بَعْضُهَا بَعْضًا، (19) وَإِن الْمُؤمنِينَ يُبِيْءُ بَعْضُهُمْ عَلَى بَعْضٍ بِمَا نَالَ دِمَاءَهُمْ فِي سَبِيلِ اللهِ، (20) وَإِنَّ الْمُؤْمِنِينَ الْمُتَّقِينَ عَلَى أَحْسَنِ هُدًى وَأَقْوَمِهِ، وَإِنَّهُ لاَ يُجِيرُ مُشْرِكٌ مَالاً لقريش وَلاَ نفسا، وَلاَ يَحُولُ دُونَهُ عَلَى مُؤْمِنٍ، (21) وَإِنَّهُ مَنْ اعْتَبَطَ مُؤْمِنًا قَتْلًا عَنْ بَيِّنَةٍ فَإِنَّهُ قَوَدٌ بِهِ إلاَّ أَنْ يَرْضَى وَلِيُّ الْمَقْتُولِ، وَإِنَّ الْمُؤْمِنِينَ عَلَيْهِ كَافَّةٌ، وَلاَ يَحِلُّ لَهُمْ إلاَّ قِيَامٌ عَلَيْهِ، (22) وَإِنَّهُ لاَ يَحِلُّ لِمُؤْمِنٍ أَقَرَّ بِمَا فِي هَذِهِ الصَّحِيفَةِ، وَآمَنَ بالله وَالْيَوْمِ الْآخِرِ، أَنْ يَنْصُرَ مُحْدِثًا وَلاَ يُؤْوِيهِ، وَأَنَّهُ مَنْ نَصَرَهُ أَوْ آوَاهُ، فَإِنَّ عَلَيْهِ لَعْنَةَ اللهِ وَغَضَبَهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ، وَلاَ يُؤْخَذُ مِنْهُ صَرْفٌ وَلاَ عَدْلٌ، (23) وَإِنَّكُمْ مَهْمَا اخْتَلَفْتُمْ فِيهِ مِنْ شَيْءٍ، فَإِنَّ مَرَدَّهُ إلَى اللهِ عَزَّ وَجَلَّ، وَإِلَى مُحَمَّدٍ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، (24) وَإِنَّ الْيَهُودَ يُنْفِقُونَ مَعَ الْمُؤْمِنِينَ مَا دَامُوا مُحَارَبِينَ، (25) وَإِنَّ يَهُودَ بَنِي عَوْفٍ أُمَّةٌ مَعَ الْمُؤْمِنِينَ، لِلْيَهُودِ دِينُهُمْ، وَلِلْمُسْلِمَيْنِ دِينُهُمْ، مَوَالِيهِمْ وَأَنْفُسُهُمْ، إلاَّ مَنْ ظَلَمَ وَأَثِمَ، فَإِنَّهُ لاَ يُوتِغُ إلاَّ نَفْسَهُ، وَأَهْلَ بَيْتِهِ، (26) وَإِنَّ لِيَهُودِ بَنِي النَّجَّارِ مِثْلَ مَا لِيَهُودِ بَنِي عَوْفٍ، (27) وَإِنَّ لِيَهُودِ بَنِي الْحَارِثِ مِثْلَ مَا لِيَهُودِ بَنِي عَوْفٍ، (28) وَإِنَّ لِيَهُودِ بَنِي سَاعِدَةَ مِثْلَ مَا لِيَهُودِ بَنِي عَوْفٍ، (29) وَإِنَّ لِيَهُودِ بَنِي جُشَمٍ مِثْلَ مَا لِيَهُودِ بَنِي عَوْفٍ، (30) وَإِنَّ لِيَهُودِ بَنِي الْأَوْسِ مِثْلَ مَا لِيَهُودِ بَنِي عَوْفٍ، (31) وَإِنَّ لِيَهُودِ بَنِي ثَعْلَبَةَ مِثْلَ مَا لِيَهُودِ بَنِي عَوْفٍ، إلَّا مَنْ ظَلَمَ وَأَثِمَ، فَإِنَّهُ لَا يُوتِغُ إلاَّ نَفْسَهُ وَأَهْلَ بَيْتِهِ، (32) وَإِنَّ جَفْنَةَ بَطْنٌ مِنْ ثَعْلَبَةَ كَأَنْفُسِهِمْ، (33) وَإِنَّ لِبَنِي الشَّطِيبَةِ مِثْلَ مَا لِيَهُودِ بَنِي عَوْفٍ، وَإِنَّ الْبِرَّ دُونَ الْإِثْمِ، (34) وَإِنَّ مَوَالِيَ ثَعْلَبَةَ كَأَنْفُسِهِمْ، (35) وَإِنَّ بِطَانَةَ يَهُودَ كَأَنْفُسِهِمْ، (36) وَإِنَّهُ لَا يَخْرَجُ مِنْهُمْ أَحَدٌ إلاَّ بِإِذْنِ مُحَمَّدٍ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، وَإِنَّهُ لاَ يُنْحَجَزُ عَلَى ثَأْرٍ جُرْحٌ، وَإِنَّهُ مَنْ فَتَكَ فَبِنَفْسِهِ فَتَكَ، وَأَهْلِ بَيْتِهِ، إلاَّ مِنْ ظَلَمَ، وَإِنَّ اللهَ عَلَى أَبَرِّ هَذَا، (37) وَإِنَّ عَلَى الْيَهُودِ نَفَقَتَهُمْ وَعَلَى الْمُسْلِمِينَ نَفَقَتَهُمْ، وَإِنَّ بَيْنَهُمْ النَّصْرَ عَلَى مَنْ حَارَبَ أَهْلَ هَذِهِ الصَّحِيفَةِ، وَإِنَّ بَيْنَهُمْ النُّصْحَ وَالنَّصِيحَةَ، وَالْبِرَّ دُونَ الْإِثْمِ، وَإِنَّهُ لَمْ يَأْثَمْ امْرُؤٌ بِحَلِيفِهِ، وَإِنَّ النَّصْرَ لِلْمَظْلُومِ، (38-مكرر) وَإِنَّ الْيَهُودَ يُنْفِقُونَ مَعَ الْمُؤْمِنِينَ مَا دَامُوا مُحَارَبِينَ، (39) وَإِنَّ يَثْرِبَ حَرَامٌ جَوْفُهَا لِأَهْلِ هَذِهِ الصَّحِيفَةِ، (40) وَإِنَّ الْجَارَ كَالنَّفْسِ غَيْرَ مُضَارٍّ وَلاَ آثِمٌ، (41) وَإِنَّهُ لاَ تُجَارُ حُرْمَةٌ إلاَّ بِإِذْنِ أَهْلِهَا، (42) وَإِنَّهُ مَا كَانَ بَيْنَ أَهْلِ هَذِهِ الصَّحِيفَةِ مِنْ حَدَثٍ أَوْ اشْتِجَارٍ يُخَافُ فَسَادُهُ، فَإِنَّ مَرَدَّهُ إلَى اللهِ عَزَّ وَجَلَّ، وَإِلَى مُحَمَّدٍ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، وَإِنَّ اللهَ عَلَى أَتْقَى مَا فِي هَذِهِ الصَّحِيفَةِ وَأَبَرِّهِ، (43) وَإِنَّهُ لاَ تُجَارُ قُرَيْشٌ وَلَا مَنْ نَصَرَهَا، (44) وَإِنَّ بَيْنَهُمْ النَّصْرَ عَلَى مَنْ دَهَمَ يَثْرِبَ، (45) وَإِذَا دُعُوا إلَى صُلْحٍ يُصَالِحُونَهُ وَيَلْبَسُونَهُ، فَإِنَّهُمْ يُصَالِحُونَهُ وَيَلْبَسُونَهُ، وَإِنَّهُمْ إذَا دُعُوا إلَى مِثْلِ ذَلِكَ فَإِنَّهُ لَهُمْ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ، إلاَّ مَنْ حَارَبَ فِي الدِّينِ، عَلَى كُلِّ أُنَاسٍ حِصَّتُهُمْ مِنْ جَانِبِهِمْ الَّذِي قِبَلَهُمْ، (46) وَإِنَّ يَهُودَ الْأَوْسِ، مَوَالِيَهُمْ وَأَنْفُسَهُمْ، عَلَى مِثْلِ مَا لِأَهْلِ هَذِهِ الصَّحِيفَةِ. مَعَ الْبِرِّ الْمَحْضِ؟ مِنْ أَهْلِ هَذِهِ الصَّحِيفَةِ. قَالَ ابْنُ هِشَامٍ: وَيُقَالُ: مَعَ الْبِرِّ الْمُحْسِنُ مِنْ أَهْلِ هَذِهِ الصَّحِيفَةِ. قَالَ ابْنُ إسْحَاقَ: وَإِنَّ الْبِرَّ دُونَ الْإِثْمِ، لاَ يَكْسِبُ كَاسِبٌ إلاَّ عَلَى نَفْسِهِ، وَإِنَّ اللهَ عَلَى أَصْدَقِ مَا فِي هَذِهِ الصَّحِيفَةِ وَأَبَرِّهِ، (47) وَإِنَّهُ لاَ يَحُولُ هَذَا الْكِتَابُ دُونَ ظَالِمٍ وَآثِمٍ، وَإِنَّهُ مَنْ خَرَجَ آمِنٌ، وَمَنْ قَعَدَ آمِنٌ بِالْمَدِينَةِ، إلاَّ مَنْ ظَلَمَ أَوْ أَثِمَ، وَإِنَّ اللهَ جَارٌ لِمَنْ بَرَّ وَاتَّقَى، وَمُحَمَّدٌ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ- السيرة التبوية لابن هشام 1/501-504، السيرة النبوية الصحيحة لأكرم ضياء العمري 1/282-285-

(১) এটি লিখিত হচ্ছে নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর পক্ষ হ’তে মুমিন ও মুসলমানদের মধ্যে যারা কুরায়শী ও ইয়াছরেবী এবং তাদের অনুগামী, যারা তাদের সঙ্গে মিলিত হয়ে জিহাদে অংশগ্রহণ করে থাকে। (২) এরা অন্যদের থেকে স্বতন্ত্র একটি জাতি হিসাবে গণ্য হবে। (৩) কুরায়েশ মুহাজিরগণ তাদের নিজ অবস্থায় থাকবে। তারা তাদের বন্দী বিনিময়ে মুমিনদের মাঝে ন্যায়সঙ্গতভাবে ফিদইয়া দিবে। একইভাবে (৪) বনু ‘আওফ, (৫) বনু সা‘এদাহ, (৬) বনুল হারেছ, (৭) বনু জুশাম, (৮) বনু নাজ্জার, (৯) বনু ‘আমর বিন ‘আওফ, (১০) বনু নাবীত, (১১) বনু আউস সবাই স্ব স্ব পূর্বের অবস্থায় থাকবে এবং তাদের স্ব স্ব গোত্র ও শাখাসমূহ বন্দী বিনিময়ে মুমিনদের মাঝে ন্যায়সঙ্গতভাবে ফিদইয়া দিবে। (১২) মুমিনগণ তাদের মধ্যকার কোন ঋণগ্রস্ত বা অভাবগ্রস্ত পরিবারকে ছেড়ে যাবে না, ন্যায়সঙ্গতভাবে তাকে ফিদইয়া বা রক্তমূল্য না দেয়া পর্যন্ত। কোন মুমিন কোন মুমিনের গোলামের সাথে কোনরূপ চুক্তি করবে না। (১৩) মুমিন-মুত্তাক্বীগণ তাদের মধ্যে কেউ বিদ্রোহ করলে বা বড় কোন যুলুম করলে, পাপ করলে, শত্রুতা করলে কিংবা মুমিনদের মধ্যে বিশৃংখলা সৃষ্টি করলে তার বিরোধিতা করবে এবং সকলে তার বিরুদ্ধে একত্রিত হবে। যদিও ঐ ব্যক্তি তাদের কোন একজনের সন্তান হয়। (১৪) কোন মুমিন কাফিরের বিনিময়ে কোন মুমিনকে হত্যা করবে না এবং মুমিনের বিরুদ্ধে কোন কাফিরকে সাহায্য করবে না। (১৫) আল্লাহর যিম্মা এক। তারা তাদের অধীনস্তদের আশ্রয় দিবে। আর মুমিনগণ একে অপরের বন্ধু অন্যদের থেকে। (১৬) যেসব ইহূদী আমাদের অনুসারী হবে তাদের জন্য থাকবে সাহায্য ও উত্তম আচরণ। তারা অত্যাচারিত হবে না এবং তাদের উপরে কেউ প্রতিশোধ নিতে পারবে না। (১৭) মুমিনদের সন্ধিচুক্তি একই। কোন মুমিন আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধের সময় মুমিন ব্যতীত অন্যের সাথে সন্ধি করবে না, নিজেদের মধ্যে সমভাবে বা ন্যায়সঙ্গতভাবে ব্যতীত। (১৮) প্রত্যেক যুদ্ধ যা আমাদের সাথে হবে, সেখানে একে অপরের পিছে আসবে। (১৯) মুমিনগণ একে অপরকে রক্ষা করবে, যখন আল্লাহর রাস্তায় তাদের রক্ত প্রবাহিত হবে। (২০) মুমিন-মুত্তাক্বীগণ সুন্দর ও সরল পথে থাকবে। কোন মুশরিক কোন কুরায়েশ-এর জান ও মালের হেফাযত করবে না এবং মুমিনের বিরুদ্ধে বাধা হবে না। (২১) যদি কেউ কোন মুমিনকে বিনা দোষে হত্যা করে এবং তার প্রমাণ থাকে, তাহ’লে সে তার বদলা নেবে। তবে যদি নিহত ব্যক্তির উত্তরাধিকারীগণ ক্ষমা করে দেয় (রক্ত মূল্যের বিনিময়ে)। সকল মুমিন এ চুক্তির উপরে থাকবে। এর উপরে দৃঢ় থাকা ব্যতীত তাদের জন্য অন্য কিছু সিদ্ধ হবে না। (২২) আল্লাহ ও আখেরাতে বিশ্বাসী যে মুমিন এই চুক্তিতে স্বীকৃত হবে, তার জন্য সিদ্ধ হবে না কোন বিদ‘আতীকে সাহায্য করা বা আশ্রয় দেওয়া। যে ব্যক্তি তাকে সাহায্য করবে বা আশ্রয় দিবে, কিয়ামতের দিন তার উপরে আল্লাহর লা‘নত ও গযব থাকবে। তার থেকে কোনরূপ বিনিময় কবুল করা হবে না। (২৩) যখনই তোমরা এতে মতভেদ করবে, তখনই সেটা আল্লাহ ও মুহাম্মাদের দিকে ফিরে যাবে। (২৪) ইহূদীরা মুমিনদের সাথে খরচ বহন করবে, যতক্ষণ তারা একত্রে যুদ্ধ করবে। (২৫) বনু ‘আওফের ইহূদীগণ মুসলমানদের সাথে একই জাতিরূপে গণ্য হবে। ইহূদীদের জন্য তাদের দ্বীন এবং মুসলমানদের জন্য তাদের দ্বীন। এটা তাদের দাস-দাসীদের জন্য এবং তাদের নিজেদের জন্য সমভাবে গণ্য হবে। একইভাবে বনু ‘আওফ ব্যতীত অন্য ইহূদীদের ক্ষেত্রেও এটি প্রযোজ্য হবে। তবে যে যুলুম করবে ও পাপ করবে, সে নিজেকে ও তার পরিবারকে ছাড়া কাউকে ধ্বংস করবে না। (২৬) আর বনু নাজ্জার, (২৭) বনুল হারেছ, (২৮) বনু সা‘এদাহ, (২৯) বনু জুশাম, (৩০) বনুল আউস, (৩১) বনু ছা‘লাবাহর ইহূদীদের জন্য ঐরূপ চুক্তি যেরূপ থাকবে বনু ‘আওফের ইহূদীদের জন্য। তবে যে ব্যক্তি যুলুম করবে ও পাপ করবে, সে নিজেকে ও নিজের পরিবারকে ছাড়া কাউকে ধ্বংস করবে না। (৩২) ছা‘লাবাহর জাফনাহ গোত্রটি তাদের মতই গণ্য হবে। (৩৩) বনু শুত্বাঈবাহর জন্য বনু ‘আওফের ইহূদীদের মতই চুক্তি থাকবে। কেবল সদ্ব্যবহার থাকবে, অন্যায় নয়। (৩৪) ছা‘লাবাহর দাস-দাসীগণ তাদের মতই গণ্য হবে। (৩৫) ইহূদীদের মিত্রগণ ইহূদীদের মতই গণ্য হবে। (৩৬) মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর অনুমতি ব্যতীত তাদের কেউ বাইরে যেতে পারবে না। কোন যখমের বদলা নিতে বিরত থাকবে না। যে ব্যক্তি বাড়াবাড়ি করে, সে তার নিজের উপর ও নিজ পরিবারের উপর বাড়াবাড়ি করে। তবে যে ব্যক্তি অত্যাচারিত হয়, আল্লাহ তার ব্যাপারে খুশী থাকেন। (৩৭) ইহূদীদের উপর তাদের ব্যয় এবং মুসলমানদের উপর তাদের ব্যয়। যারা এই চুক্তিকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে, তাদের বিরুদ্ধে তারা পরস্পরকে সাহায্য করবে। তারা পরস্পরের প্রতি সুধারণা রাখবে, উপদেশ দিবে ও সদাচরণ করবে। অন্যায় করবে না। মিত্রের অন্যায়ের কারণে ব্যক্তি দায়ী হবে না। মযলূমকে সাহায্য করা হবে। (৩৮-পুনরুক্ত) ইহূদীরা মুমিনদের সাথে খরচ বহন করবে, যতক্ষণ তারা একত্রে যুদ্ধ করবে (এটিতে ধারা ২৪-এর পুনরুক্তি হয়েছে)। (৩৯) চুক্তিভুক্ত সকলের জন্য ইয়াছরিবের অভ্যন্তরভাগ হারাম অর্থাৎ নিরাপদ এলাকা হিসাবে গণ্য হবে। (৪০) প্রতিবেশীগণ চুক্তিবদ্ধ পক্ষের ন্যায় গণ্য হবে। যদি সে ক্ষতিকারী ও অন্যায়কারী না হয়। (৪১) কোন নারীকে আশ্রয় দেওয়া যাবে না, তার পরিবারের অনুমতি ব্যতীত। (৪২) চুক্তিবদ্ধ পক্ষগুলোর মধ্যে কোন সমস্যা ও ঝগড়ার সৃষ্টি হ’লে এবং তাতে বিপর্যয়ের আশংকা দেখা দিলে তা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর নিকটে পেশ করা হবে। এই চুক্তিনামায় যা আছে, আল্লাহ তার উপর সর্বাধিক সতর্কতা ও সন্তুষ্টিতে আছেন। (৪৩) কুরায়েশ ও তাদের সহায়তাকারীদের আশ্রয় দেওয়া হবে না। (৪৪) ইয়াছরিবের উপরে কেউ হামলা চালালে সম্মিলিতভাবে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে। (৪৫) যখন তারা কোন সন্ধির দিকে আহুত হবে, যেখানে তারা পরস্পরে মীমাংসা করবে ও নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য তা কবুল করবে, তারা সেটাতে সাড়া দিবে। মুমিনদের উপর এটা প্রযোজ্য হবে। তবে যারা ধর্মের কারণে যুদ্ধ করে, তাদের উপর নয়। প্রত্যেকের জন্য তার নিজ পক্ষের অংশ নির্ধারিত হবে। (৪৬) আউসের (মিত্র) ইহূদীদের নিজেদের ও তাদের দাস-দাসীদের উপর অনুরূপ প্রযোজ্য হবে, যেরূপ অত্র চুক্তিকারীদের উপর প্রযোজ্য হবে। (আর তা হ’ল) স্রেফ সদাচরণ এই চুক্তিকারীদের পক্ষ হ’তে। ইবনু ইসহাক বলেন, সদাচরণ সেটাই যাতে পাপ নেই। অর্জনকারী কেবল নিজের জন্যই তা অর্জন করে থাকে। এই চুক্তিনামায় যা আছে, আল্লাহ তার উপর সর্বাধিক সত্যতা ও সন্তুষ্টিতে আছেন। (৪৭) কোন অত্যাচারী ও পাপীর জন্য এ চুক্তিনামা কোনরূপ সহায়ক হবে না। যে ব্যক্তি বের হয়ে যাবে, সে নিরাপদ থাকবে এবং যে ব্যক্তি বসে থাকবে, সে ও মদীনায় নিরাপদ থাকবে। ঐ ব্যক্তি ব্যতীত যে যুলুম ও অন্যায় করে। নিশ্চয়ই আল্লাহ ঐ ব্যক্তির সাথী, যে সদাচরণ করে ও আল্লাহভীরুতা অবলম্বন করে। আর মুহাম্মাদ হলেন আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম’। (ইবনু হিশাম ১/৫০১-০৪; সীরাহ নববীইয়াহ ছহীহাহ ১/২৮২-৮৫; আল- বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ৩/২২৪ পৃঃ)।

শিক্ষণীয় বিষয়সমূহ
(১) বংশীয়, গোত্রীয় এবং ধর্মীয় পরিচয় ও স্বাতন্ত্র্য অক্ষুণ্ণ রেখেও বৃহত্তর ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্রীয় খেলাফত প্রতিষ্ঠা করা যায়, রাসূল (ছাঃ)-এর মাদানী জীবনের কর্মনীতি তার বাস্তব সাক্ষী।

(২) ইসলামী বিধানের অনুসরণের মাধ্যমেই কেবল বিশ্বকে ঐক্যবদ্ধ করা সম্ভব, মদীনার সনদ তার বাস্তব দলীল।

গাযওয়া বাহরান

৩য় হিজরীর রবীউল আখের। একটি কুরায়েশ বাণিজ্য কাফেলাকে আটকানোর জন্য আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) ৩০০ সৈন্য নিয়ে হেজাযের ‘ফুরু‘ (الفُرُع) সীমান্তের ‘বাহরান’ অঞ্চলে গমন করেন। সেখানে তিনি রবীউল আখের ও জুমাদাল ঊলা দু’মাস অবস্থান করেন। কিন্তু কোন যুদ্ধ হয়নি। এ সময় মদীনার দায়িত্বে ছিলেন আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতূম (রাঃ)।[1]

[1]. যাদুল মা‘আদ ৩/১৭০; ইবনু হিশাম ২/৪৬; ইবনু সা‘দ ২/২৭; আর-রাহীক্ব ২৪৫ পৃঃ। মানছূরপুরী এটা ধরেননি।

সারিইয়া যায়েদ বিন হারেছাহ

৩য় হিজরীর জুমাদাল আখেরাহ। মদীনার পথে ব্যবসায়ের প্রতিবন্ধকতার কথা ভেবে কুরায়েশ বাণিজ্য কাফেলা মদীনার পূর্বদিক দিয়ে দীর্ঘ পথ ঘুরে সম্পূর্ণ অজানা পথে নাজদ হয়ে সিরিয়া যাবার মনস্থ করে। এ খবর মদীনায় পৌঁছে গেলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যায়েদ বিন হারেছাহর নেতৃত্বে ১০০ জনের একটি অশ্বারোহী দল প্রেরণ করেন। তারা অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সাথে অগ্রসর হয়ে ‘ক্বারদাহ’ (قَرْدة) নামক প্রস্রবণের কাছে পৌঁছে তাদের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়েন। অতর্কিতে এই হামলার মুকাবিলায় ব্যর্থ হয়ে কাফেলা নেতা ছাফওয়ান বিন উমাইয়া সবকিছু ফেলে পালিয়ে যান। মজুরীর বিনিময়ে নেওয়া কুরায়েশদের পথ প্রদর্শক ফুরাত বিন হাইয়ান(فُرَاتُ بنُ حَيَّانَ) এবং বলা হয়েছে যে, আরও অন্য দু’জন বন্দী হয়ে মদীনায় নীত হয়। অতঃপর তারা রাসূল (ছাঃ)-এর হাতে বায়‘আত করে ইসলাম কবুল করেন। এই সফরে বড় বড় ব্যবসায়ী ছিলেন। যাদের মধ্যে কুরায়েশ নেতা আবু সুফিয়ান ইবনু হারবের নিকটেই ছিল সর্বাধিক রৌপ্য ও রৌপ্য সামগ্রীসমূহ। ফলে আনুমানিক এক লক্ষ দেরহামের রৌপ্য সহ বিপুল পরিমাণ গণীমতের মাল হস্তগত হয়। এই পরাজয়ে কুরায়েশরা হতাশ হয়ে পড়ে। এখন তাদের সামনে মাত্র দু’টি পথই খোলা রইল। যিদ ও অহংকার পরিত্যাগ করে মুসলমানদের সাথে সন্ধি করা অথবা যুদ্ধের মাধ্যমে হৃত গৌরব পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করা। বলা বাহুল্য, তারা শেষটাই গ্রহণ করে এবং যা ওহোদ যুদ্ধকে অনিবার্য করে তোলে। সোজাপথে না গিয়ে পালানো পথে সিরিয়া গমনের কাপুরুষতাকে কটাক্ষ করে রাসূল (ছাঃ)-এর সভাকবি হাসসান বিন ছাবেত আনছারী (রাঃ) কুরায়েশ নেতাদের বিরুদ্ধে এ সময় কবিতা পাঠ করেন।[1]
[1]. ইবনু সা‘দ ২/২৭; ইবনু হিশাম ২/৫০।



প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর ৬৭ পর্বের জীবনীর সকল পর্ব এখান থেকে পড়ুন-

পর্ব-০১   পর্ব-০২   পর্ব-০৩   পর্ব-০৪   পর্ব-০৫   পর্ব-০৬   পর্ব-০৭   পর্ব-০৮   পর্ব-০৯   পর্ব-১০   পর্ব-১১   পর্ব-১২   পর্ব-১৩   পর্ব-১৪   পর্ব-১৫   পর্ব-১৬   পর্ব-১৭   পর্ব-১৮   পর্ব-১৯   পর্ব-২০   পর্ব-২১   পর্ব-২২   পর্ব-২৩   পর্ব-২৪   পর্ব-২৫   পর্ব-২৬   পর্ব-২৭   পর্ব-২৮   পর্ব-২৯   পর্ব-৩০    পর্ব-৩১   পর্ব-৩২   পর্ব-৩৩   পর্ব-৩৪   পর্ব-৩৫   পর্ব-৩৬   পর্ব-৩৭   পর্ব-৩৮   পর্ব-৩৯   পর্ব-৪০   পর্ব-৪১   পর্ব-৪২   পর্ব-৪৩   পর্ব-৪৪   পর্ব-৪৫   পর্ব-৪৬(১ম) পর্ব-৪৬(২য়)    পর্ব-৪৭   পর্ব-৪৮   পর্ব-৪৯   পর্ব-৫০   পর্ব-৫১   পর্ব-৫২   পর্ব-৫৩   পর্ব-৫৪   পর্ব-৫৫   পর্ব-৫৬   পর্ব-৫৭   পর্ব-৫৮   পর্ব-৫৯   পর্ব-৬০   পর্ব-৬১   পর্ব-৬২   পর্ব-৬৩   পর্ব-৬৪   পর্ব-৬৫   পর্ব-৬৬   পর্ব-৬৭  




**************************************
>>> Welcome, You are now on Mohammadia Foundation's Website. Please stay & Tune with us>>>


এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url