প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর জীবনী [পর্ব- ৫০] || মহানবীর জীবনী ||




বিনা যুদ্ধে তাবূক বিজয়, রোমক সম্রাটের পলায়ন

[পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ট মহামানব আমাদের প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:)। যাকে আল্লাহ সমস্ত মানুষের জন্য অশেষ রহমত স্বরূপ এই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। যে নবী সারা জীবন উম্মতের জন্য সংগ্রাম করেছেন, কাল রোজ হাশরের মাঠেও যিনি উম্মতের জন্যই পেরেশান থাকবেন ইয়া উম্মতি ইয়া উম্মতি বলে বিচলিত হবেন; সেই প্রাণপ্রিয় নবীকে আমরা কতটুকু চিনি, কতটুকু জানি? প্রিয় নবী (সা:) এর জীবনের পরতে পরতে রয়েছে আমাদের জন্য শিক্ষা ও অনুপ্রেরণা। যার জীবনী পড়লে নিজের অজান্তেই চোখের পানি গড়িয়ে পড়ে। সেই নবীর জীবনী কি আমরা সত্যিই জানি? আসুন, আরেকবার দেখে নেই “প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর জীবনী”। যে জীবনী পড়ে বদলে যেতে পারে আপনার আমার জীবন। আমরা এখানে প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর বিশাল কর্মময় জীবনকে ৬৭টি সুবিশাল পর্বে তুলে ধরেছি। আল্লাহ আমাদের সবাইকে প্রাণপ্রিয় নবীর (সা:) উম্মত হিসাবে কবুল করুন। আমিন।।]

তাবূক যুদ্ধের পতাকাবাহীগণ

তাবূক যুদ্ধের প্রধান পতাকা ছিল আবুবকর ছিদ্দীক্ব (রাঃ)-এর হাতে। দ্বিতীয় প্রধান পতাকাটি ছিল যুবায়ের ইবনুল ‘আওয়াম (রাঃ)-এর হাতে। আউসদের পতাকা ছিল উসায়েদ বিন হুযায়ের (রাঃ)-এর হাতে। খাযরাজদের পতাকা ছিল আবু দুজানাহ (রাঃ)-এর হাতে। মতান্তরে হুবাব ইবনুল মুনযির (রাঃ)-এর হাতে। এছাড়াও আনছারদের অন্যান্য গোত্র এবং আরবদের অন্যান্য দলের পৃথক পৃথক পতাকা ছিল। যেমন যায়েদ বিন ছাবেত (রাঃ) বনু মালেক বিন নাজ্জার-এর এবং মু‘আয বিন জাবাল (রাঃ) বনু মাসলামাহ-এর পতাকা বহন করেন। তথ্যগুলি সবই এককভাবে ওয়াক্বেদী বর্ণিত। যিনি পরিত্যক্ত (مَتْرُوك)। কিন্তু তাঁর সীরাত গ্রন্থ অগণিত তথ্যাবলী সমৃদ্ধ। সেখান থেকে এই ধরনের তথ্য গ্রহণে কোন ক্ষতি নেই’ (সীরাহ ছহীহাহ ২/৫৩২)।

তাবূক যুদ্ধে যেতে না পেরে ক্রন্দনকারীগণ

অসুখ, দরিদ্রতা, বাহন সংকট প্রভৃতি কারণে যারা জিহাদে যেতে পারেননি, তারা জান্নাত লাভের এই মহা সুযোগ হারানোর বেদনায় কাঁদতে থাকেন। যারা ইতিহাসে ‘ক্রন্দনকারীগণ’ (الْبَكَّاؤون) বলে খ্যাত (যাদুল মা‘আদ ৩/৪৬২-৬৩)। তাদেরই অন্যতম ছিলেন, ‘উলবাহ বিন যায়েদ(عُلْبَةُ بن زَيْدٍ)। যিনি রাত্রি জেগে ছালাত আদায় করেন ও আল্লাহর নিকটে কেঁদে কেঁদে বলেন, ‘হে আল্লাহ! তুমি আমাদেরকে জিহাদের নির্দেশ দিয়েছ ও তাতে উৎসাহিত করেছ। কিন্তু আমার নিকটে এমন কিছু নেই, যা দিয়ে আমি তোমার রাসূলের সঙ্গে যেতে সক্ষম হই এবং আমার দেহে বা সম্পদে যে সব যুলুম হয়েছে, তার প্রতিটি যুলুমের বিনিময়ে প্রত্যেক মুসলমানের উপর আমি ছাদাক্বা করি’। অতঃপর ফজর ছালাতের পর রাসূল (ছাঃ) সবার উদ্দেশ্যে বললেন, আজ রাতে ছাদাক্বা দানকারী কোথায়? কিন্তু কেউ দাঁড়ালো না। রাসূল (ছাঃ) দ্বিতীয়বার বললে ঐ ব্যক্তি দাঁড়াল ও তাঁকে সব খবর জানাল। তখন রাসূল (ছাঃ) বললেন,أَبْشِرْ فَوَاَلَّذِي نَفْسُ مُحَمّدٍ بِيَدِهِ لَقَدْ كُتِبَتْ فِي الزَّكَاةِ الْمُتَقَبَّلَةِ ‘সুসংবাদ গ্রহণ কর! যার হাতে মুহাম্মাদের জীবন তাঁর কসম করে বলছি, তোমার ছাদাক্বা আল্লাহর কবুলকৃত যাকাতের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে’। অন্য বর্ণনায় এসেছে,قَدْ غُفِرَ لَهُ ‘তাকে ক্ষমা করা হয়েছে’।[1]

আবু মূসা আশ‘আরীর নেতৃত্বে আশ‘আরীগণ এসে বাহনের দাবী করলে রাসূল (ছাঃ) তাদেরকে তিনটি উটের বেশী দিতে পারলেন না’ (বুখারী হা/৬৭১৮)। ফলে এইসব দুর্বল ও অক্ষমদের বিষয়ে নাযিল হয়,لَيْسَ عَلَى الضُّعَفَاءِ وَلاَ عَلَى الْمَرْضَى وَلاَ عَلَى الَّذِينَ لاَ يَجِدُونَ مَا يُنْفِقُونَ حَرَجٌ إِذَا نَصَحُوا لِلَّهِ وَرَسُولِهِ مَا عَلَى الْمُحْسِنِينَ مِنْ سَبِيلٍ وَاللهُ غَفُورٌ رَحِيمٌ- وَلاَ عَلَى الَّذِينَ إِذَا مَا أَتَوْكَ لِتَحْمِلَهُمْ قُلْتَ لاَ أَجِدُ مَا أَحْمِلُكُمْ عَلَيْهِ تَوَلَّوْا وَأَعْيُنُهُمْ تَفِيضُ مِنَ الدَّمْعِ حَزَنًا أَلاَّ يَجِدُوا مَا يُنْفِقُونَ- ‘কোন অভিযোগ নেই দুর্বলদের উপর, রোগীদের উপর ও ব্যয়ভার বহনে অক্ষমদের উপর, যদি তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি খালেছ ঈমান রাখে। বস্ত্ততঃ সৎকর্মশীলদের বিরুদ্ধে কোনরূপ অভিযোগ নেই। আর আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়াবান’। ‘অধিকন্তু ঐসব লোকদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নেই যারা তোমার নিকট এজন্য আসে যে, তুমি তাদের (জিহাদে যাবার) জন্য বাহনের ব্যবস্থা করবে। অথচ তুমি বলেছ যে, আমার নিকটে এমন কোন বাহন নেই যার উপর তোমাদের সওয়ার করাবো। তখন তারা এমন অবস্থায় ফিরে যায় যে, তাদের চক্ষুসমূহ হ’তে অবিরলধারে অশ্রু প্রবাহিত হতে থাকে এই দুঃখে যে, তারা এমন কিছু পাচ্ছে না যা তারা ব্যয় করবে’ (তওবা ৯/৯১-৯২)। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘নিশ্চয়ই মদীনায় একদল লোক রয়েছে। যারা তোমাদের সাথে অভিযানে অংশগ্রহণ করেনি।... حَبَسَهُمُ الْعُذْرُ ‘ওযর তাদেরকে আটকিয়ে রেখেছিল’ (বুখারী হা/৪৪২৩)।

[1]. যাদুল মা‘আদ ৩/৪৬২-৬৩, সনদ ছহীহ -আরনাঊত্ব; সীরাহ ছহীহাহ ২/৫২৯-৩০; আল-ইছাবাহ, ‘উলবাহ ক্রমিক ৫৬৬১।

তাবূক যুদ্ধে সেনাবাহিনীতে বাহন ও খাদ্য সংকট

সাধ্যমত দান-ছাদাক্বা করা সত্ত্বেও তা এই বিশাল সেনাবাহিনীর জন্য যথেষ্ট ছিল না। ফলে প্রতি ১৮ জনের জন্য একটি করে উটের ব্যবস্থা হয়। যার উপরে তারা পালাক্রমে সওয়ার হতেন। অনুরূপভাবে খাদ্য সংকট দেখা দেয়ায় তারা গাছের ছাল-পাতা খেতে থাকেন। যাতে তাদের ঠোটগুলো ফুলে যায়।

পথিমধ্যে ব্যাপকভাবে পানি সংকটে পড়ায় সবাই রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে এসে পানির অভিযোগ করেন। তখন রাসূল (ছাঃ) আল্লাহর নিকটে পানি প্রার্থনা করেন। ফলে আল্লাহ বৃষ্টির মেঘ পাঠিয়ে দেন, যা বিপুল পরিমাণ বৃষ্টি বর্ষণ করে। সেনাবাহিনী তৃপ্তি সহকারে পানি পান করে এবং পাত্রসমূহ ভরে নেয়।[1]

[1]. ইবনু হিশাম ২/৫২২; যাদুল মা‘আদ ৩/৪৬৬ সনদ জাইয়িদ- ঐ টীকা; আর-রাহীক্ব ৪৩৪।

প্রসিদ্ধ আছে যে, পানির অভাবে প্রাণ ওষ্ঠাগত হবার উপক্রম হ’লে বাহন সংকট থাকা সত্ত্বেও তারা মাঝে-মধ্যে উট নহর করতে বাধ্য হ’তেন এবং উটের পিঠের কুঁজোতে (الْكَرِشُ) সঞ্চিত পানি পান করতেন’ (আর-রাহীক্ব ৪৩৩-৩৪)। বর্ণনাটি ‘যঈফ’ (আলবানী, দিফা‘ আনিল হাদীছ ৯ পৃঃ)।

তাবূক অভিমূখে হিজর অতিক্রম

গমন পথে মুসলিম বাহিনী ‘হিজর’ এলাকা অতিক্রম করে। যা ছিল খায়বরের অদূরে ওয়াদিল ক্বোরা(وَادِى الْقُرَى) এলাকায় অবস্থিত। এখানে বিগত যুগে ছামূদ জাতি আল্লাহর গযবে ধ্বংস হয়। যারা পাথর কেটে মযবুত ঘর-বাড়ি তৈরী করত(الَّذِينَ جَابُوا الصَّخْرَ بِالْوَادِ) (ফজর ৮৯/৯)। হযরত ছালেহ (আঃ) তাদের নিকটে প্রেরিত হয়েছিলেন। কিন্তু তারা তাঁকে অমান্য করে। ফলে তারা আল্লাহর গযবে পতিত হয়।

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন,لاَ تَدْخُلُوا مَسَاكِنَ الَّذِينَ ظَلَمُوا أَنْفُسَهُمْ، أَنْ يُصِيبَكُمْ مَا أَصَابَهُمْ إِلاَّ أَنْ تَكُونُوا بَاكِينَ. ثُمَّ قَنَّعَ رَأْسَهُ وَأَسْرَعَ السَّيْرَ حَتَّى أَجَازَ الْوَادِىَ ‘তোমরা গযবপ্রাপ্ত ছামূদদের ঘর-বাড়িতে প্রবেশ করো না ক্রন্দনরাত অবস্থায় ব্যতীত। যাতে তাদের যে বিপদ হয়েছে, তোমাদের তেমনটি না হয়। অতঃপর তিনি মাথা নীচু করলেন এবং দ্রুত উক্ত এলাকা অতিক্রম করলেন’।[1] অর্থাৎ কেউ প্রবেশ করতে চাইলে কাঁদতে কাঁদতে প্রবেশ করবে। অথবা মাথা নীচু করে দ্রুত এলাকা ত্যাগ করবে। তিনি তাদের নির্দেশ দিলেন যে,فَأَمَرَهُمْ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم- أَنْ يُهَرِيقُوا مَا اسْتَقَوْا وَيَعْلِفُوا الإِبِلَ الْعَجِينَ وَأَمَرَهُمْ أَنْ يَسْتَقُوا مِنَ الْبِئْرِ الَّتِى كَانَتْ تَرِدُهَا النَّاقَةُ ‘তোমরা যে পানি সংগ্রহ করেছ তা ফেলে দাও। উক্ত পানি দিয়ে যদি আটার খামীর করে থাক, তবে তা উটকে খাইয়ে দাও’। আরও নির্দেশ দিলেন যে, ‘ছালেহ (আঃ)-এর উষ্ট্রী যে কুয়া থেকে পানি পান করত, তোমরা সেই কুয়া থেকে পানি সংগ্রহ করো’ (মুসলিম হা/২৯৮১)।

[1]. বুখারী হা/৪৪১৯; মুসলিম হা/২৯৮০; মিশকাত হা/৫১২৫।

এখানে বর্ণিত হয়েছে যে রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, তোমরা এখানকার কুয়া থেকে পানি পান করো না, ঐ পানিতে ওযূ করো না।... আজকে রাতে তোমরা কেউ বের হয়োনা সাথী ব্যতীত’। লোকেরা সেটাই করল। কিন্তু বনু সা‘এদাহ-র দু’জন লোক বের হ’ল। যাদের একজন হাজত সারার জন্য, অন্যজন তার উট খোঁজার জন্য। এক্ষণে যে ব্যক্তি হাজত সারার জন্য বের হয়েছিল, সে তার হাজতের স্থানেই গলায় ফাঁস লেগে পড়ে রইল। অন্যজনকে ঝড়ে উড়িয়ে নিয়ে ত্বাঈ পাহাড়ে নিক্ষেপ করল। রাসূল (ছাঃ)-কে এ খবর দেওয়া হ’লে তিনি বললেন, আমি কি তোমাদেরকে সাথী ব্যতীত বের হ’তে নিষেধ করিনি? অতঃপর তিনি গলায় ফাঁস লেগে পড়ে থাকা ব্যক্তির নিকটে গিয়ে দো‘আ করলেন। ফলে সে আরোগ্য লাভ করল। দ্বিতীয় জনকে মদীনায় পৌঁছার পর রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট ত্বাঈ গোত্রের লোকেরা হাদিয়া স্বরূপ প্রেরণ করল’ (যাদুল মা‘আদ ৩/৪৬৫; ইবনু হিশাম ২/৫২১-২২)। বর্ণনাটির সনদ ‘মুরসাল’ (তাহকীক ইবনু হিশাম, ক্রমিক ১৮৭২)।

তাবূক যুদ্ধে মু‘জেযা সমূহ

(১) শুষ্ক ঝর্ণায় পানির স্রোত(جريان العين اليابس بماء منهمر) :
তাবূকের নিকটবর্তী পৌঁছে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন,إنَّكُمْ سَتَأْتُوْنَ غَدًا إنْ شَاءَ اللهُ تَعَالَى عَيْنَ تَبُوْكَ ‘আগামীকাল ইনশাআল্লাহ তোমরা তাবূকের ঝর্ণার নিকটে পৌঁছবে। তবে দিন গরম হওয়ার পূর্বে তোমরা সেখানে পৌঁছতে পারবে না। যদি তোমরা কেউ আগে পৌঁছে যাও, তবে আমি না পৌঁছা পর্যন্ত যেন কেউ ঝর্ণার পানি স্পর্শ না করে’।

মু‘আয বিন জাবাল (রাঃ) বলেন, আমরা গিয়ে দেখি আমাদের দু’জন লোক আগেই পৌঁছে গেছে এবং কিছু পানিও পান করেছে। (হয়তবা তারা রাসূল (ছাঃ)-এর নিষেধাজ্ঞা জানতে পারেনি)। এ সময় খুব ধীরগতিতে পানি আসছিল। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদের কিছু ভৎর্সনা করলেন। অতঃপর ঝর্ণা থেকে অঞ্জলী ভরে একটু একটু করে পানি নিলেন ও সঞ্চয় করলেন। অতঃপর তা দিয়ে স্বীয় হাত ও মুখমন্ডল ধৌত করলেন। অতঃপর ঐ পানি পুনরায় ঝর্ণায় নিক্ষেপ করলেন। ফলে ঝর্ণায় তীব্রগতিতে পানির প্রবাহ সৃষ্টি হ’ল এবং অল্প সময়ের মধ্যে বিপুল পানি রাশি জমা হয়ে গেল। ছাহাবায়ে কেরাম তৃপ্তি সহকারে পানি পান করলেন। এসময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মু‘আযকে লক্ষ্য করে বললেন,يُوشِكُ يَا مُعَاذُ إنْ طَالَتْ بِكَ حَيَاةٌ أَنْ تُرَى مَا هَاهُنَا قَدْ مُلِئَ جِنَانًا ‘যদি আল্লাহ তোমার হায়াত দীর্ঘ করেন, তবে তুমি এই স্থানটিকে সবুজ-শ্যামল বাগিচায় পূর্ণ দেখতে পাবে’ (মুসলিম হা/৭০৬ (১০)। উক্ত ভবিষ্যদ্বাণী কার্যকর হয়েছে- আলহামদুলিল্লাহ।

তাবূক পৌঁছার পর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সবাইকে বললেন, আজ রাতে তোমাদের উপর প্রবল বালুঝড়(رِيْحٌ شَدِيْدَةٌ) বয়ে যেতে পারে। সুতরাং তোমাদের কেউ যেন দাঁড়ায় না। যাদের উট আছে, তারা যেন উটকে শক্তভাবে বেঁধে রাখে’। দেখা গেল যে, প্রবল বেগে ঝড় এলো। তখন (সম্ভবতঃ কৌতূহল বশে) একজন উঠে দাঁড়ালো। ফলে ঝড় তাকে উড়িয়ে নিয়ে ‘ত্বাঈ’ পাহাড়ের(فِي جَبَلِ طَيْءٍ) মাঝখানে নিক্ষেপ করল’।[1]

(২) দুর্বল উট সবল হ’ল(البعير الضعيف صار قويا) :

ফাযালাহ বিন উবায়েদ আনছারী (মৃ. ৫৩ হি.) বলেন, তাবূক থেকে ফেরার পথে আমাদের উটগুলি কষ্টে হাসফাস করতে থাকে। রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে বিষয়টি পেশ করা হ’লে তিনি দো‘আ করে বলেন,اللَّهُمَّ احْمِلْ عَلَيْهَا فِى سَبِيلِكَ إِنَّكَ تَحْمِلُ عَلَى الْقَوِىِّ وَالضَّعِيفِ وَعَلَى الرَّطْبِ وَالْيَابِسِ فِى الْبَرِّ وَالْبَحْرِ ‘হে আল্লাহ! তোমার রাস্তায় এগুলির উপরে আরোহণ করাও। নিশ্চয় তুমি আরোহণ করিয়ে থাক শক্তিশালী ও দুর্বলের উপরে। নরম ও শুষ্ক যমীনের উপরে এবং স্থলভাগ ও সমুদ্রের উপরে’। অতঃপর মদীনায় আসা পর্যন্ত তারা আর দুর্বল হয়নি’। রাবী বলেন, এটি ছিল রাসূল (ছাঃ)-এর দো‘আর বরকত। তাঁর এই দো‘আ শক্তিশালী ও দুর্বলের উপরে আমরা ফলতে দেখেছি। অতঃপর সমুদ্রের উপরে ফলতে দেখলাম তখনই, যখন আমরা ২৭ হিজরীতে ওছমান (রাঃ)-এর খেলাফতকালে মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর নেতৃত্বে রোমকদের বিরুদ্ধে নৌযুদ্ধে গমন করলাম’ (আহমাদ হা/২৪০০১, হাদীছ ছহীহ)। নিঃসন্দেহে এটি ছিল রাসূল (ছাঃ)-এর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মু‘জেযা (সীরাহ ছহীহাহ ২/৫৩৫)।

[1]. ছহীহ ইবনু হিববান হা/৬৫০১, সনদ ছহীহ।
 ছালাতে জমা ও ক্বছর (الجمع والقصر فى الصلوات)
আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, তাবূক যুদ্ধে পথ চলাকালীন সময়ে রাসূল (ছাঃ)-এর নিয়ম ছিল এই যে, তিনি সর্বদা যোহর ও আছরে এবং মাগরিব ও এশাতে জমা (ও ক্বছর) করতেন।[1] এতে জমা তাক্বদীম ও জমা তাখীর দু’টিই হ’ত। ‘তাক্বদীম’ অর্থ শেষের ছালাতটি পূর্বের ছালাতের সাথে জমা করা এবং ‘তাখীর’ অর্থ প্রথমের ছালাতটি শেষেরটির সাথে জমা করা (মির‘আত হা/১৩৫৩-এর আলোচনা)। সফরে রাসূল (ছাঃ) সুন্নাত-নফল ছাড়াই যোহর ও আছর একত্রে (২+২) পৃথক এক্বামতে জামা‘আতের সাথে অথবা একাকী ছালাত আদায় করতেন।[2]

[1]. মুসলিম হা/৭০৫ (৫১); আবুদাঊদ হা/১২০৮; তিরমিযী হা/৫৫৩; মিশকাত হা/১৩৪৪।

[2]. বুখারী হা/১০৯২, ১৬৬২, ১৬৭৩; মিশকাত হা/২৬১৭, ২৬০৭ ‘হজ্জ’ অধ্যায়।

তাবূকে উপস্থিতি এবং রাসূল (ছাঃ)-এর সারগর্ভ উপদেশবাণী

মুসলিম বাহিনী তাবূকে অবতরণ করার পর রাসূল (ছাঃ) জান্নাতপাগল সেনাদলের উদ্দেশ্যে একটি সংক্ষিপ্ত ও সারগর্ভ (جَوَامِعُ الْكَلِمِ) ভাষণ দান করেন। যা ছিল অতীব গুরুত্বপূর্ণ এবং দুনিয়া ও আখেরাতের জন্য কল্যাণকর।

ভাষণটি সম্পর্কে ইবনু কাছীর বলেন, হাদীছটি ‘গরীব’। এর মধ্যে অপ্রাসঙ্গিক কথা (نكارة) রয়েছে এবং এর সনদে দুর্বলতা রয়েছে’ (আল-বিদায়াহ ৫/১৪)। আলবানী বলেন, এর সনদ ‘যঈফ’ (সিলসিলা যঈফাহ হা/২০৫৯)। আরনাঊত্ব বলেন, এর সনদ ‘অতীব দুর্বল’ (যাদুল মা‘আদ ৩/৪৭৪- টীকা)। আকরাম যিয়া উমারী বলেন, তাবূকের এই দীর্ঘ ভাষণটি বিশুদ্ধ সূত্রে প্রমাণিত নয়। যদিও এর বক্তব্যগুলি বিভিন্ন হাদীছ থেকে গৃহীত। যার কিছু ‘ছহীহ’ কিছু ‘হাসান’। এটি স্পষ্ট যে, কোন কোন রাবী ঐগুলি থেকে নিয়ে ভাষণটি সৌন্দর্য মন্ডিত করেছেন’ (সীরাহ ছহীহাহ ২/৫৩৪)।

সনদের বিশুদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও বক্তব্যগুলি বিভিন্ন ‘ছহীহ’ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত হওয়ায় আমরা ভাষণটি উদ্ধৃত করলাম।

উক্ত ভাষণ থেকে ইবনুল ক্বাইয়িম তিনটি বাক্য (৩২-৩৪) বাদ দিয়েছেন। মানছুরপুরী ৩৫ ক্রমিক বাদ দিয়ে মোট ৫০টি ক্রমিকে ভাগ করে ভাষণটি পেশ করেছেন। ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, বায়হাক্বী দালায়েল (৫/২৪১) ও হাকেম উক্ববা বিন ‘আমের (রাঃ) হ’তে হাদীছটি বর্ণনা করেন।-

হামদ ও ছানার পরে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,

(1) فَإِنَّ أَصْدَقَ الْحَدِيْثِ كِتَابُ اللهِ (2) وَأَوْثَقَ الْعُرَى كَلِمَةُ التَّقْوَى (3) وَخَيْرَ الْمِلَلِ مِلَّةُ إبْرَاهِيْمَ (4) وَخَيْرَ السُّنَنِ سُنّةُ مُحَمَّدٍ (5) وَأَشْرَفَ الْحَدِيْثِ ذِكْرُ اللهِ (6) وَأَحْسَنَ الْقَصَصِ هَذَا الْقُرْآنُ (৭) وَخَيْرَ الْأُمُوْرِ عَوَازِمُهَا (8) وَشَرَّ الْأُمُوْرِ مُحْدَثَاتُهَا (9) وَأَحْسَنَ الْهَدْيِ هَدْيُ الْأَنْبِيَاءِ (10) وَأَشْرَفَ الْمَوْتِ قَتْلُ الشُّهَدَاءِ (11) وَأَعْمَى الْعَمَى الضَّلاَلَةُ بَعْدَ الْهُدَى (12) وَخَيْرَ الْأَعْمَالِ مَا نَفَعَ (13) وَخَيْرَ الْهُدَى مَا اُتَّبَعَ (14) وَشَرَّ الْعَمَى عَمَى الْقَلْبِ (15) وَالْيَدَ الْعُلْيَا خَيْرٌ مِنَ الْيَدِ السُّفْلَى (16) وَمَا قَلَّ وَكَفَى خَيْرٌ مِمَّا كَثُرَ وَأَلْهَى (17) وَشَرُّ الْمَعْذِرَةِ حِينَ يَحْضُرُ الْمَوْتُ (18) وَشَرُّ النّدَامَةِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ (19) وَمِنَ النَّاسِ مَنْ لاَ يَأْتِي الْجُمُعَةَ إلاَّ دُبُرًا (20) وَمِنْهُمْ مَنْ لاَ يَذْكُرُ اللهَ إلاَّ هَجْرًا (21) وَمِنْ أَعْظَمِ الْخَطَايَا اللِّسَانُ الْكَذُوْبُ (22) وَخَيْرَ الْغِنَى غِنَى النَّفْسِ (23) وَخَيْرُ الزَّادِ التَّقْوَى (24) وَرَأْسُ الْحُكْمِ مَخَافَةُ اللهِ عَزَّ وَجَلَّ (25) وَخَيْرُ مَا وَقَرَ فِي الْقُلُوبِ الْيَقِيْنُ (26) وَالإِرْتِيَابُ مِنَ الْكُفْرِ (27) وَالنِّيَاحَةُ مِنْ عَمَلِ الْجَاهِلِيَّةِ (28) وَالْغُلُوْلُ مِنْ جُثَا جَهَنَّمَ (29) وَالسَّكْرُ كَيٌّ مِنَ النَّارِ (30) وَالشِّعْرُ مِنْ إبْلِيسَ (31) وَالْخَمْرُ جِمَاعُ الْإِثْمِ ... (32) وَشَرُّ الْمَأْكَلِ مَالُ الْيَتِيْمِ (33) وَالسَّعِيْدُ مَنْ وُعِظَ بِغَيْرِهِ (34) وَالشَّقِيُّ مَنْ شَقِيَ فِي بَطْنِ أُمِّهِ ... (35) وَمَلاَكُ الْعَمَلِ خَوَاتِمُهُ (36) وَشَرُّ الرَّوَايَا رَوَايَا الْكَذِبِ (37) وَكُلُّ مَا هُوَ آتٍ قَرِيْبٌ (38) وَسِبَابُ الْمُؤْمِنِ فُسُوْقٌ (39) وَقِتَالُهُ كُفْرٌ (40) وَأَكْلُ لَحْمِهِ مِنْ مَعْصِيَةِ اللهِ (41) وَحُرْمَةُ مَالِهِ كَحُرْمَةِ دَمِهِ (42) وَمَنْ يَتَأَلَّ عَلَى اللهِ يُكَذِّبْهُ (43) وَمَنْ يَغْفِرْ يُغْفَرْ لَهُ (44) وَمَنْ يَعْفُ يَعْفُ اللهُ عَنْهُ (45) وَمَنْ يَكْظِمِ الْغَيْظَ يَأْجُرْهُ اللهُ (46) وَمَنْ يَصْبِرْ عَلَى الرَّزِيَّةِ يُعَوِّضُهُ اللهُ (47) وَمَنْ يَبْتَغِ السُّمْعَةَ يُسَمَّعِ اللهُ بِهِ (48) وَمَنْ يَتَصَبَّرْ يُضْعِفُ اللهُ لَهُ (49) وَمَنْ يَعْصِ اللهَ يُعَذِّبْهُ اللهُ (50) ثُمَّ اسْتَغْفَرَ ثَلاَثًا-

(১) সর্বাধিক সত্য বাণী হ’ল আল্লাহর কিতাব এবং (২) সবচেয়ে মযবুত হাতল হ’ল তাক্বওয়ার কালেমা। (৩) সবচেয়ে উত্তম দ্বীন হ’ল ইবরাহীমের দ্বীন। (৪) শ্রেষ্ঠ তরীকা হ’ল মুহাম্মাদের তরীকা (৫) সর্বোত্তম বাণী হ’ল আল্লাহর যিকর। (৬) সেরা কাহিনী হ’ল এই কুরআন। (৭) শ্রেষ্ঠ কর্ম হ’ল দৃঢ় সংকল্পের কর্মসমূহ এবং (৮) নিকৃষ্ট কর্ম হ’ল শরী‘আতে নব্যসৃষ্ট কর্মসমূহ। (৯) সুন্দরতম হেদায়াত হ’ল নবীগণের হেদায়াত। (১০) শ্রেষ্ঠ মৃত্যু হ’ল শহীদী মৃত্যু। (১১) সবচেয়ে বড় অন্ধত্ব হ’ল সুপথ পাওয়ার পরে পথভ্রষ্ট হওয়া। (১২) শ্রেষ্ঠ আমল তাই যা কল্যাণকর। (১৩) শ্রেষ্ঠ তরীকা সেটাই যা অনুসৃত হয়। (১৪) নিকৃষ্টতম অন্ধত্ব হ’ল হৃদয়ের অন্ধত্ব। (১৫) উপরের হাত নীচের হাতের চাইতে উত্তম। (১৬) অল্প ও পরিমাণমত সম্পদ অধিক উত্তম ঐ অধিক সম্পদ হ’তে যা (আল্লাহ থেকে) গাফেল করে দেয়। (১৭) নিকৃষ্ট তওবা হ’ল মৃত্যুকালীন তওবা। (১৮) সেরা লজ্জা হ’ল ক্বিয়ামতের দিনের লজ্জা। (১৯) লোকদের মধ্যে এমন কিছু লোক আছে, যারা জুম‘আয় আসে সবার শেষে। (২০) এমন কিছু লোক রয়েছে, যারা আল্লাহকে খুব কমই স্মরণ করে। (২১) সবচেয়ে বড় পাপ হ’ল মিথ্যা কথা বলা। (২২) শ্রেষ্ঠ প্রাচুর্য হ’ল হৃদয়ের প্রাচুর্য। (২৩) সেরা পাথেয় হ’ল আল্লাহভীরুতা। (২৪) সেরা প্রজ্ঞা হ’ল আল্লাহকে ভয় করা। (২৫) হৃদয়সমূহে যা সম্মান উদ্রেক করে, তা হ’ল দৃঢ় বিশ্বাস। (২৬) (আল্লাহ সম্পর্কে) সন্দেহ সৃষ্টি কুফরীর অন্তর্ভুক্ত। (২৭) মৃতের জন্য উচৈচঃস্বরে শোক করা জাহেলী রীতির অন্তর্ভুক্ত। (২৮) (গণীমত থেকে) চুরির মাল জাহান্নামের স্ফুলিঙ্গ। (২৯) মাদকতা জাহান্নামের টুকরা। (৩০) (নষ্ট) কবিতা ইবলীসের অংশ। (৩১) মদ সকল পাপের উৎস।... (৩২) নিকৃষ্টতম খাদ্য হ’ল ইয়াতীমের মাল ভক্ষণ। (৩৩) সৌভাগ্যবান হ’ল সেই, যে অন্যের থেকে উপদেশ গ্রহণ করে। (৩৪) হতভাগা সেই যে মায়ের পেট থেকেই হতভাগা হয়।... (৩৫) শ্রেষ্ঠ আমল হ’ল শেষ আমল। (৩৬) নিকৃষ্ট গবেষণা হ’ল মিথ্যার উপর গবেষণা। (৩৭) যেটা ভবিষ্যতে হবে, সেটা সর্বদা নিকটবর্তী। (৩৮) মুমিনকে গালি দেওয়া ফাসেকী এবং (৩৯) তার সাথে যুদ্ধ করা কুফরী। (৪০) মুমিনের পিছনে গীবত করা আল্লাহর অবাধ্যতার অন্তর্ভুক্ত। (৪১) মুমিনের মাল অন্যের জন্য হারাম, যেমন তার রক্ত হারাম। (৪২) যে ব্যক্তি আল্লাহর উপরে বড়াই করে, আল্লাহ তাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেন। (৪৩) যে ব্যক্তি ক্ষমা করে, তাকে ক্ষমা করা হয়। (৪৪) যে ব্যক্তি মার্জনা করে, আল্লাহ তাকে মার্জনা করেন। (৪৫) যে ব্যক্তি ক্রোধ দমন করে, আল্লাহ তাকে পুরস্কৃত করেন। (৪৬) যে ব্যক্তি বিপদে ধৈর্য ধারণ করে, আল্লাহ তাকে উত্তম বদলা দান করেন। (৪৭) যে ব্যক্তি শ্রুতি কামনা করে, আল্লাহ তার লজ্জাকে সর্বত্র শুনিয়ে দেন। (৪৮) যে ব্যক্তি ছবরের ভান করে, আল্লাহ তাকে দুর্বল করে দেন। (৪৯) যে ব্যক্তি আল্লাহর অবাধ্যতা করে, আল্লাহ তাকে শাস্তি দিয়ে থাকেন। (৫০) অতঃপর তিনি তিনবার আল্লাহর নিকটে ক্ষমা প্রার্থনা করেন ও ভাষণ শেষ করেন।[1]

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর উক্ত আবেগময় ভাষণে ক্ষুৎ-পিপাসায় কাতর ও দীর্ঘ সফরে ক্লান্তসেনাবাহিনীর অন্তরসমূহ ঈমানের ঢেউয়ে উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। সকলে সব কষ্ট ভুলে প্রশান্তচিত্তে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে মনোনিবেশ করেন।


[1]. যাদুল মা‘আদ ৩/৪৭৩-৭৪; আল-বিদায়াহ ৫/১৩-১৪; রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ১/১৩৮-৪০; আর-রাহীক্ব ৪৩৫ পৃঃ (সংক্ষিপ্ত); সিলসিলা যঈফাহ হা/২০৫৯।

ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) ‘হাকেম’ থেকে উদ্ধৃত বলেছেন। কিন্তু আমরা হাকেম-এর কোন কিতাবে এটি পাইনি। শায়খ আলবানীও সিলসিলা যঈফাহ (হা/২০৫৯)-এর মধ্যে সূত্র হিসাবে বিভিন্ন হাদীছ গ্রন্থের নাম উল্লেখ করলেও হাকেম-এর কথা বলেননি। সম্ভবতঃ এটি ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ)-এর নিকট রক্ষিত হাকেম-এর কোন কিতাব থেকে হ’তে পারে। যা আমাদের নিকট পৌঁছেনি। অথবা মুদ্রণ প্রমাদ হ’তে পারে। আল্লাহ সর্বাধিক অবগত।

বিনা যুদ্ধে তাবূক জয়

মুসলিম বাহিনীর তাবূকে উপস্থিতির খবর শুনে রোমক ও তাদের মিত্ররা এতই ভীত হয়ে পড়ল যে, তারা মুকাবিলার হিম্মত হারিয়ে ফেলল এবং তারা তাদের সীমান্তের অভ্যন্তরে বিভিন্ন শহরে বিক্ষিপ্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়ল। তৎকালীন বিশ্বশক্তির এই বিনাযুদ্ধে পলায়ন সমস্ত আরব উপদ্বীপে মুসলিম শক্তির জন্য অযাচিতভাবে এমন সব রাজনৈতিক সুবিধাদি এনে দিল, যা যুদ্ধ করে অর্জন করা সম্ভব হ’ত না। রোমকদের মিত্র শক্তিগুলি মদীনার প্রতি বশ্যতা স্বীকার করল।

খ্রিষ্টান শাসনকর্তাদের সঙ্গে সন্ধি

(১) আয়লার (أَيْلَة) খ্রিষ্টান গবর্ণর ইউহান্নাহ বিন রু’বাহ(يُحَنَّةُ بنُ رُؤْبَةَ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর খিদমতে হাযির হয়ে সন্ধি করেন এবং তাঁকে জিযিয়া প্রদান করেন। (২) আযরুহ (أذْرُح) ও জারবা (جَرْبَاء)-এর নেতৃবৃন্দ এসে জিযিয়া প্রদান করেন। রাসূল (ছাঃ) তাদের প্রত্যেককে সন্ধির চুক্তিনামা প্রদান করেন, যা তাদের কাছে রক্ষিত থাকে। শুধুমাত্র জিযিয়ার বিনিময়ে তাদের জান-মাল-ইয্যত ও ধর্মের স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ রাখার গ্যারান্টি দেওয়া হয়। (৩) রাসূল (ছাঃ) দূমাতুল জান্দালের শাসনকর্তা উকায়দিরের (أُكَيْدِرُ) নিকটে ৪২০ জন অশ্বারোহী সৈন্যের একটি বাহিনীসহ খালেদ বিন অলীদকে প্রেরণ করেন। যাত্রাকালে তিনি বলে দেন যে,إنَّكَ سَتَجِدُهُ يَصِيْدُ الْبَقَرَ ‘তুমি তাকে জংলী নীল গাভী শিকার করা অবস্থায় দেখতে পাবে’ (বায়হাক্বী হা/১৯১১৪)। সেটাই হ’ল। চাঁদনী রাতে দুর্গটি পরিষ্কার দেখা যায়, এমন দূরত্বে পৌঁছে গেলে হঠাৎ দেখা গেল যে, একটি নীল গাভী জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এসে দুর্গদ্বারে শিং দিয়ে গুঁতা মারছে। এমন সময় উকায়দির গাভীটাকে শিকার করার জন্য লোকজন নিয়ে বের হ’লেন। এই সুযোগে খালেদ তাকে বন্দী করে ফেললেন। এভাবে রাসূল (ছাঃ)-এর ভবিষ্যদ্বাণী কার্যকর হয়’ (ইবনু হিশাম ২/৫২৬)।

উকায়দিরকে রাসূল (ছাঃ)-এর দরবারে আনা হ’ল। অতঃপর ২০০০ উট, ৮০০ গোলাম, ৪০০ লৌহবর্ম ও ৪০০ বর্শা দেবার শর্তে এবং জিযিয়া কর প্রদানে স্বীকৃত হওয়ায় তার সঙ্গে সন্ধিচুক্তি সম্পাদিত হ’ল। যেমন ইতিপূর্বে আয়লাহ, তাবূক, ও তায়মার সাথে সম্পাদিত হয়েছিল। একইভাবে রোমকদের মিত্র অন্যান্য গোত্রসমূহ তাদের পুরানো মনিবদের ছেড়ে মুসলমানদের নিকটে এসে মৈত্রীবন্ধনে আবদ্ধ হ’ল।

এভাবে একেবারেই বিনাযুদ্ধে এবং কোনরূপ জানমালের ক্ষয়-ক্ষতি ছাড়াই আল্লাহর গায়েবী মদদে মদীনার ইসলামী খেলাফতের সীমানা বিস্তৃত হয়ে রোম সাম্রাজ্যের প্রান্তসীমা পর্যন্ত পৌঁছে গেল। ফালিল্লাহিল হাম্দ।

বিনা যুদ্ধে শহীদ যুল বিজাদায়েন

তাবূকে অবস্থানকালীন সময়ে তরুণ ছাহাবী আব্দুল্লাহ যুল-বিজাদায়েন(عَبْدُ اللهِ ذُو الْبِجَادَيْنِ) এর মৃত্যু হয়। এই নিঃস্ব-বিতাড়িত শাহাদাত পিয়াসী মুহাজির তরুণের জীবন কাহিনী অতীব বেদনাময়, চমকপ্রদ ও শিক্ষাপ্রদ। শিশু অবস্থায় পিতৃহারা আব্দুল ‘উযযা মক্কায় তার চাচার কাছে প্রতিপালিত হন। তরুণ বয়সে চাচার উট-বকরী চরানোই ছিল তার কাজ। ইতিমধ্যে ইসলামের বাণী তার নিকটে পৌঁছে যায় এবং তিনি তাওহীদের প্রতি আকৃষ্ট হন। কিন্তু চাচার ভয়ে প্রকাশ করেননি। হঠাৎ মক্কা বিজয় সবকিছুকে ওলট-পালট করে দিল। যুবক আব্দুল ‘উয্যার লুক্কায়িত ঈমান ফল্গুস্রোত হয়ে বেরিয়ে এলো। চাচার সামনে গিয়ে ইসলাম কবুলের অনুমতি চাইলেন। চাচা তাকে সকল মাল-সম্পদ থেকে বঞ্চিত করার হুমকি দিলেন। এমনকি তার দেহের পরিহিত বস্ত্র পর্যন্ত ছিনিয়ে নিলেন। ফলে নগ্ন অবস্থায় ছুটে মায়ের কাছে গেলেন। গর্ভধারিণী মা তার এ অবস্থা দেখে কেঁদে ফেললেন ও তাকে একটা কম্বল দিলেন। আব্দুল ‘উযযা সেটাকে ছিঁড়ে দু’ভাগ করে একভাগ দেহের নিম্নভাগে ও একভাগ ঊর্ধ্বভাগে পরিধান করে শূন্য হাতে চললেন মদীনা অভিমুখে। পক্ষকাল পরে মদীনা পৌঁছে ফজরের সময় মসজিদে নববীতে রাসূল (ছাঃ)-এর সম্মুখে উপস্থিত হ’লেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তার সব কথা শুনে দুঃখে বিগলিত হ’লেন। তার আব্দুল ‘উযযা নাম পাল্টিয়ে রাখলেন ‘আব্দুল্লাহ’। লকব দিলেন ‘যুল বিজাদায়েন’(ذُو الْبِِجَادَيْنِ) ‘দুই টুকরা কম্বলওয়ালা’। অতঃপর মসজিদের সাথে অবস্থিত ‘আছহাবে ছুফফা’-র মধ্যে তাকে শামিল করা হ’ল। সেখানে তিনি বিপুল আগ্রহে কুরআন শিখতে থাকেন। তার কুরআনের ধ্বনি অনেক সময় মুছল্লীদের ছালাতে ব্যাঘাত ঘটাতো। একদিন ওমর ফারূক (রাঃ) এ বিষয়ে অভিযোগ করলে রাসূল (ছাঃ) বললেন, ওমর ওকে কিছু বলো না। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল-এর জন্য সে সর্বস্ব ত্যাগ করে এসেছে’।

এমন সময় তাবূক যুদ্ধের ঘোষণা চলে আসে। আব্দুল্লাহ ছুটে রাসূল (ছাঃ)-এর দরবারে এসে যুদ্ধে যাবার অনুমতি চান। দয়ার নবী তাকে গাছের একটা ছাল নিয়ে আসতে বলেন। ছালটি নিয়ে রাসূল (ছাঃ) তার হাতে বেঁধে দিয়ে আল্লাহর নিকটে প্রার্থনা করেন, ‘হে আল্লাহ! আমি কাফেরদের জন্য এর রক্ত হারাম করছি’। আব্দুল্লাহ বললেন, ‘হে রাসূল! আমি তো এটা চাইনি (অর্থাৎ আমি যে শাহাদাতের কাঙাল)’। রাসূল (ছাঃ) বললেন, যদি তুমি প্রচন্ড জ্বরে মারা যাও অথবা বাহন থেকে পড়ে তার আঘাতে মারা যাও, তথাপি তুমি শহীদ হিসাবে গণ্য হবে’। এতে বুঝা যায় যে, শাহাদাতের একান্ত কামনা নিয়ে বিছানায় মৃত্যুবরণ করলেও তিনি শহীদ হিসাবে গণ্য হবেন। তার ভাগ্যে সেটাই দেখা গেল। তাবূক পৌঁছে হঠাৎ গাত্রোত্তাপ বেড়ে গেলে সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয় (ওয়াক্বেদী ৩/১০১৪)।

বেলাল বিন হারেছ আল-মুযানী বলেন, রাত্রিতে তার দাফনকার্য সম্পন্ন হয়। রাসূল (ছাঃ)-এর মুওয়াযযিন বেলালের হাতে চেরাগ ছিল। আবুবকর ও ওমর তার লাশ বহন করে আনেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিজে কবরে নামেন এবং বলেন,أَدْنِيَا إِلَىَّ أَخَاكُمْ ‘তোমরা দু’জন তোমাদের ভাইকে আমার নিকটে এনে দাও’। অতঃপর তাকে কবরে কাত করে শোয়ানোর সময় তিনি বলেন,اللَّهُمَّ إِنِّيْ أَمْسَيْتُ رَاضِيًا عَنْهُ فَارْضِ عَنْهُ ‘হে আল্লাহ! আজ সন্ধ্যা পর্যন্ত আমি এ যুবকের উপরে খুশী ছিলাম। তুমিও এর উপরে খুশী হও’। তার দাফনকার্যের এই দৃশ্য দেখে আবুবকর (রাঃ) বলে ওঠেন, يَا لَيْتَنِيْ كُنْتُ صَاحِبَ الْحُفْرَةِ ‘হায়! এই কবরে যদি আমি হ’তাম’![1]

[1]. আল-ইছাবাহ ক্রমিক ৪৮০৭; ত্বাবারাণী আওসাত্ব হা/৯১১১; মুসনাদে বাযযার হা/১৭০৬; মাজমাঊয যাওয়ায়েদ হা/৪২৩৭; ইবনু হিশাম ২/৫২৮; যাদুল মা‘আদ ৩/৪৭৩। সনদ মুনক্বাতি‘। তবে হাদীছ ‘হাসান’ (তাহকীক ইবনু হিশাম ক্রমিক ১৮৮৭)। ইবনু হিশাম ও অন্যান্য সীরাত গ্রন্থে আবুবকর (রাঃ)-এর স্থলে ইবনু মাসঊদ (রাঃ)-এর নাম এসেছে।



প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর ৬৭ পর্বের জীবনীর সকল পর্ব এখান থেকে পড়ুন-

পর্ব-০১   পর্ব-০২   পর্ব-০৩   পর্ব-০৪   পর্ব-০৫   পর্ব-০৬   পর্ব-০৭   পর্ব-০৮   পর্ব-০৯   পর্ব-১০   পর্ব-১১   পর্ব-১২   পর্ব-১৩   পর্ব-১৪   পর্ব-১৫   পর্ব-১৬   পর্ব-১৭   পর্ব-১৮   পর্ব-১৯   পর্ব-২০   পর্ব-২১   পর্ব-২২   পর্ব-২৩   পর্ব-২৪   পর্ব-২৫   পর্ব-২৬   পর্ব-২৭   পর্ব-২৮   পর্ব-২৯   পর্ব-৩০    পর্ব-৩১   পর্ব-৩২   পর্ব-৩৩   পর্ব-৩৪   পর্ব-৩৫   পর্ব-৩৬   পর্ব-৩৭   পর্ব-৩৮   পর্ব-৩৯   পর্ব-৪০   পর্ব-৪১   পর্ব-৪২   পর্ব-৪৩   পর্ব-৪৪   পর্ব-৪৫   পর্ব-৪৬(১ম) পর্ব-৪৬(২য়)    পর্ব-৪৭   পর্ব-৪৮   পর্ব-৪৯   পর্ব-৫০   পর্ব-৫১   পর্ব-৫২   পর্ব-৫৩   পর্ব-৫৪   পর্ব-৫৫   পর্ব-৫৬   পর্ব-৫৭   পর্ব-৫৮   পর্ব-৫৯   পর্ব-৬০   পর্ব-৬১   পর্ব-৬২   পর্ব-৬৩   পর্ব-৬৪   পর্ব-৬৫   পর্ব-৬৬   পর্ব-৬৭  




******************************************
>>> Welcome, You are now on Mohammadia Foundation's Website. Please stay & Tune with us>>>

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

মোহাম্মদীয়া ফাউন্ডেশনের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url